৮-৯. বিচ্ছেদের পরোয়ানা

০৮.

দু পক্ষের অনুমোদনের ফলে যা ঘটবার সহজেই ঘটে গেছে।

বিচ্ছেদের পরোয়ানা বেরিয়েছে।

বাপের বাড়ির আবহাওয়া রীতিমত গরম সেদিন। বাড়িতে যেন সাড়া পড়ে গেছে একটা। বিজনের উত্তেজনা, বরুণার উত্তেজনা, মায়ের উত্তেজনা। বিজন পারলে তক্ষুনি আর একটা বিয়ে দিয়ে দেয় অর্চনার। হাতের কাছে তেমন পাত্র মজুত নেই নাকি?

আছে সকলেই জানে। এমন একটা দিনে ননিমাধবও এসেছে। তার ফস। মুখখানি একটু বেশি লাল হয়েছে, পকেট থেকে ঘন ঘন রুমাল বেরিয়েছে। ওদিকে শুভার্থী আত্মীয়-পরিজনও কেউ কেউ এসেছেন। আজকালকার দিনে এটা যে এমন কিছু ব্যাপার নয়, বার বার সে-কথাই ঘোষণা করে গেছেন তারা।

অর্চনা তার নিজের ঘরে। বিয়ের আগে যে-ঘরে থাকত। নিচের জটলায় তারও নিঃসঙ্কোচ উপস্থিতি সকলের কাম্য ছিল। বিশেষ করে মায়ের আর দাদার। যার জন্য এত বড় গুরুভার লাঘব করার চেষ্টা, সে একপাশে সরে থাকলে নিস্পত্তিটা খুব সহজ মনে হয় না।

আর অনুপস্থিত বাড়ির কর্তা ডক্টর বাসু। অবশ্য এ-সভায় তিনি অবাঞ্ছিতও বটেন। তাঁর অনুমোদন ছিল না সেটা সকলেই জানত। কিন্তু আজ আর তাকে আমল দিচ্ছে কে, হুট করে এমন একটা বিয়ে দিয়ে বসেছিলেন বলেই তো এ রকমটা ঘটল। নিজের ঘরে বসে স্তব্ধ বিষণ্ণতায় চুরুট টানছেন। ইদানীং ঘন ঘন চুরুট ফুরোচ্ছে। দাণ্ডকে পাঠিয়েছেন বাক্স ভরে চুরুট কিনে নিয়ে আসতে।

তিনি না এলেও মিসেস বাসু অব্যাহতি দেন নি। তাঁর কাছে এলে থেকে থেকে জ্বলে উঠেছেন, সেই অমানুষ লোকটার বিরুদ্ধে যে একটা দিন শান্তিতে থাকতে দেয় নি তার মেয়েকে-এবারে হাড় জুড়োবে। সমর্থন না পেয়ে স্বামীর ওপরেই আগুন।–যত কিছুর মূলে তুমি, তুমি তো চুপ করে থাকবেই এখন!

ডক্টর বাসু তার পরেও চুপ করে থাকেন নি। গল্পীর আদেশের স্বরে বলেছেন, তুমি দয়া করে যাবে এখান থেকে?

মিসেস বাসু হকচকিয়ে গেছেন। এ-ধরনের কণ্ঠস্বর বড় শোনেন নি। মুখে যতই বলুন, মেয়ের জন্য দুর্ভাবনায় ভিতরে ভিতরে মায়ের মন শুকিয়েছিল বটেই। অসহায় ক্ষোভে সেটুকুই প্রকাশ হয়ে গেছে।-ও… আমাকে বুঝি এখন তোমার সহ্য হচ্ছে না! কোথা থেকে একটা অপদার্থ অমানুষ ধরে এনে সংসারটাকে একেবারে তছনছ করে দিলে, অপমানে অপমানে মেয়েটার হাড় কালি-তার দিকে একবারও চেয়ে দেখেছ তুমি?

নারীর বল চোখের জল। কান্নার বেগ সামলাবার জন্যে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন।

বাড়ির মধ্যে সেদিন বিমর্ষ দেখা গেছে আর একজনকে। দাঁত। বাক্স ভরা চুরুটের গোটাকতক অন্তত তার পকেটেই থাকার কথা। কিন্তু খেয়াল ছিল না। দিদিমণির ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে গতি তার আপনি মন্থর হয়েছে।…জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে, বাইরে থেকে সে-মুখের আভাস দেখা যায় শুধু। চুরুটের বাক্সটার দিকে চেয়ে আর-একদিনের স্মৃতি তার মনে পড়েছে। বড় মিষ্টি স্মৃতি। সেদিনের পাওয়ার আনন্দে দিদিমণি নিজের হাতে ওর পকেটে একটা চুরুট গুঁজে দিয়েছিল।

নিচের ঘরে বরুণার উত্তেজনা এবং আক্রোশ দুই-ই স্বতঃস্ফুর্ত। বার বার বলেছে– ঠিক হয়েছে, খুব ভাল হয়েছে, যেমন লোক তেমন শিক্ষা হয়েছে। তার দিদিকে হেনস্থা করেছে যে লোকটা তার কত বড় শিক্ষা হল সেটা ভেবে ডগমগিয়ে উঠছে থেকে থেকে। বিজনকে জিজ্ঞাসা করেছে-আচ্ছা, খবরটা কাগজে বেরুবে?

অদূরে বসে তার স্বামী বেচারা যে ওর আনন্দ-মিশ্রিত উত্তেজনাটুকু করুণ নেত্রে লক্ষ্য করছে সেদিকে খেয়াল নেই।

স্বামীর কাছে অবর্ষণ করতে হলেও ছেলের কাছে সত্যিকারের সান্ত্বনা পেয়েছেন মিসেস বাসু। বিজন বলেছে–অত মুষড়ে পড়লে চলে, এ-রকম তো আজকাল হামেশাই হচ্ছে। এই তো কোর্টে দেখে এলে তিন হাজার খুলছে এই কেস, তারা কি সব চোখে অন্ধকার দেখছে?

ভরসার অঙ্কটার ওপরেই জোর দিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন রাণু দেবী। তিন হাজার।

কম করে। তোমরা তো তবু চট করেই রেহাই পেয়ে গেলে-যা হবার হয়ে গেল, ভালই হল। তারপর আভাসে ইঙ্গিতে বিজন আশ্বস্ত করেছে মাকে। বলেছে, আইনের কড়াকড়ির সময়টা পেরুলেই এমন বিয়ে দেবে অর্চনার যাতে গায়ে আর আঁচটি না লাগে সারা জীবনে।

এত বড় আশ্বাসের গাত্রটি কে তাও সকলেই জানে।

দিন কাটতে লাগল।

এর মধ্যে দুটি পরিবর্তন হয়েছে। এক, বাসা-বদল। অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে বিপরীত এলাকায় বিজন বড় বাড়ি ভাড়া করেছে। নিজেদের বাড়ি না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থানের বাসনা। তাছাড়া পূর্বস্মৃতির কাছাকাছির মধ্যে না থাকাই বাঞ্ছনীয়, নতুন পরিবেশে অর্চনারও কিছুটা পরিবর্তন সম্ভব।

দ্বিতীয়, অর্চনা আবার এম. এ. পড়া শুরু করেছে।

দিন যায়। অর্চনার মনে হত, কি করছে সেই মানুষটা, মনে মনে কেমন জ্বলছে, জানতে পেলে হত। জানার উপায় নেই বলেই নিজে জ্বলত। জীবন থেকে যাকে ধুয়ে মুছে ফেলেছে, মন থেকে তাকে বিদায় দেওয়াটা সম্পূর্ণ হচ্ছে না বলেই আরো জ্বালা। পার্টি ভাল লাগে না, ক্লাব না, থিয়েটার না। বই পড়ে। দিনরাত্রির বেশির ভাগই বই নিয়ে কাটে। য়ুনিভার্সিটি লাইব্রেরি থেকে আসতেও বেশ রাত হয় এক-একদিন। কিন্তু বইও ভাল লাগে না সক সময়।

সকলেরই একটা চোখ আছে তার দিকে। কিন্তু বাড়ির মধ্যে যে একজনের সস্নেহ দৃষ্টি আর আহ্বানের আশায় ভিতরটা প্রতীক্ষাতুর সর্বদা, তিনি যেন চেনেনও না ওকে। তিনি বাবা। সামনাসামনি হলেও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যান। বিরক্তও হন! অর্চনা পারলে তার সামনে আসে না। বাবা ঘরে না থাকলে সংগোপনে তার ঘর গুছিয়ে রেখে আসে। তার পর একটা দুর্বহ বেদনা বুকে চেপে নিজের ঘরে এসে চুপচাপ বসে থাকে।

বাবার উপেক্ষা মা অবশ্য দ্বিগুণ পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। নতুন বৈচিত্র্যের সন্ধানে মাঝে মাঝে কিছু একটা প্রোগ্রাম করে মেয়ের মত নিতে আসেন প্রায়ই। অর্চনা কখনো নিস্পৃহভাবে চুপ করে থাকে, আবার অকারণে ঝাঁঝিয়েও ওঠে এক-একদিন। ননিমাধবের সিনেমার টিকিট কেনা নিয়ে সেদিনও মায়ের সঙ্গে একপ্রস্থ হয়ে গেছে। অৰ্চনা সবে যুনিভার্সিটি থেকে ফিরেছিল। ননিমাধবের গাড়িটা প্রায়ই যেমন দাঁড়ানো দেখে, সেদিনও তেমনি দেখেছিল। নিজের ঘরে এসেই একটা বই নিয়ে শুয়ে পড়েছিল সে।

মা ভিতরে ঢুকে প্রসন্ন মুখে সংবাদ দিয়েছেন, ননিমাধব সকলের জন্য সিনেমার টিকিট কেটে বসে আছে, তার জন্যেই সকলের প্রতীক্ষা এখন।

সকলের অর্থাৎ দাদা বউদি। অর্চনা মায়ের মুখের ওপর একটা শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বই হাতে আবার পাশ ফিরে শুয়েছে।

মা মনে মনে শঙ্কিত।–শুয়ে পড়লি যে, শরীর খারাপ হয় নি তো?

না।

ওঠ তাহলে, চট করে মুখ হাত ধুয়ে নে–আর সময় নেই।

ওঁদের যেতে বলে।

ওদের যেতে বলব…ননিমাধব যে চারখানা টিকিট কেটে এনেছে।

বই রেখে অর্চনা আস্তে আস্তে উঠে বসেছে। মাকে নিরীক্ষণ করেছে একটু।–আমার টিকিটে তুমিই যাও তাহলে।

মিসেস বাসুর মেয়ের এই বুদ্ধি-বিবেচনার অভাবের সঙ্গেই যুঝতে হচ্ছে ক্রমাগত। বলেছেন, কি যে করি ভাল লাগে না, ওঠ

ভাল আমারও লাগে না মা।–অর্চনা চেষ্টা করেও খুব শান্ত থাকতে পারে নি, কতদিন তোমাকে নিষেধ করেছি তবু তুমি কেন এভাবে আমাকে বিরক্ত করে বলো তো?

আমি তোকে বিরক্ত করি!–মা আকাশ থেকে পড়েছেন প্রথম। তার পর সখেদে প্রস্থান–আমারও হয়েছে যেমন জালা তাই সবেতে আসি, তোর যা খুশি কর, আর কখনো যদি কিছু বলতে আসি–

কিন্তু আবারও বলতে না এসে পারেন নি তিনি। সরাসরি না বললেও চুপ করে থাকতে পারেন নি। ননিমাধবের কর দিনে দিনে বাড়ছে। এলেই চা করে দেন, ভালমন্দ খবর নেন, কারণে-অকারণে অর্চনাকে ঘরে ডাকেন। বরুণা

শুরবাড়িতে থাকে, আসে প্রায়ই, মায়ের সঙ্গে তার গোপন পরামর্শের আভাসও অর্চনা পায় একটু আধটু। . যে বরুণা ননিমাধবকে দেখলেই মুখ চোত আর দিদিকে ঠাট্টা করত, সে-ও আজকাল ঠাট্টা দূরে থাক, কিছু একটা প্রত্যাশা নিয়েই ভদ্ৰলোককে লক্ষ্য করে। পারলে একটু যেন তোয়াজ করে চলে। আর, দাদা-বউদির কথাই নেই। ননিমাধবের মত এমন লোক তায় একজনের বেশি দুজন দেখেছে বলে মনে হয় না।।

দাদা বা মায়ের বিশেষ এক ধরনের ডাক শুনলেই অর্চনা বুঝতে পারে, ঘরে কেউ আর আছে, আর সে ননিমাধব ছাড়া আর কেউ নয়। ওর ভিতরের বিরক্তি বাইরে তেমন প্রকাশ পায় না। ডাকলে সাড়া দেয়, থরে আসে, কথা বলে। আর রুমালে মুখ ঘষতে ঘষতে একখানা কর্ণা মুখ লাল হয়ে উঠেছে তাও লক্ষ্য করে।

অর্চনা আর বিয়ে করবে না এমন কথা কখনো বলে নি, এমন মনোভাবও কখনো প্রকাশ করে নি। সেই বিচ্ছেদের দিন থেকেই বলতে গেলে তার আবার বিয়ের কথা উঠেছিল। কিন্তু আইনগত বাধার আর সামাজিক চক্ষুলজ্জার খাতিরেই সম্ভবত প্রথম বছরটা কেউ সরাসরি এ-প্রস্তাব তোলে নি। তার পর তার ভাবগতিক দেখে কথাটা সামনা-সামনি তুলতে তেমন ভরসাও পেয়ে ওঠে নি কেউ। যেটুকু বলে, আভাসে ইঙ্গিতে। অর্চনা তার জবাবও দেয় না। সকলেই মনে মনে তখন তার এম এ পরীক্ষাটা শেষ হওয়ার প্রতীক্ষা করছে।

সেই বহু প্রতীক্ষার এম এ পরীক্ষাও হয়ে গেল।

ফল দেখে আনন্দে আটখানা সকলে। ননিমাধব সকালেই মস্ত এক ফুলের তোড়া এনে হাজির। মিসেস বাসু আনলে সেদিন তাকে সোজা অর্চনা ঘরে পাঠিয়ে দিলেন।–তুমি তো ঘরের ছেলে, নিজের হাতেই দাও গে যাও।

সিঁড়িতে রাণু বউদি আর একদফা চাঙ্গা করেছে তাকে। উৎফুল্ল ইশারায় ঘর দেখিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ ঘরেই আছে, সরাসরি গিয়ে ঢুকে পড়ুন

কিন্তু ঢুকে পড়ে অস্বস্তি অনুভব করেছে ননিমাধব। নিরাসক্ত মূখে পরীক্ষা পাসের কোন আনন্দ চোখে পড়ে নি। দোরগোড়া থেকে একটু নিরীক্ষণ করে ঢোঁক গিলে বলেছে, আসব?

অর্চনা অন্যদিকে ফিরে ছিল। ফুলের তোড়া হাতে তাকে দেখে একটু থেমে বলেছে, আসুন–

ননিমাধব আরক্ত মুখে তোড়া এগিয়ে দিয়েছে।

ফুল হাতে নিয়ে অর্চনা খুশীর ভাব দেখাতেও চেষ্টা করেছে একটু।…কি ব্যাপার–

সকালে উঠেই এম এ রেজাল্ট দেখলাম—

ও…। অর্চনা মুখ হাসির মতই। সহজভাবে বলল, এ পাবার মত একমন কিছু রেজাল্ট হয়নি।

ননিমাধবের সলজ্জ বিস্ময়ে, সে কি! ফার্স্ট ক্লাস–

অর্চনা বলতে যাচ্ছিল, ফার্স্ট ক্লাস ফি-বছরই দুই-একজন পায়। কিন্তু রুমালের খোঁজে পকেটে হাত ঢুকতে দেখে বলা হল না। ওদিকে উৎফুল্ল আনন্দে দিদিকে ডাকতে ডাকতে বলাও হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। ফুল এবং ননিমাধবকে দেখে যেমন খুশী তেমনি অপ্রস্তুত।

আপনি। আমি এসেছিলাম দিদিকে কংগ্রাচুলেট করতে—

ননিমাধব বলল, আমিও।

অর্চনা তাকের থেকে ফুলদানি এনে টেবিলে ফুলের তোড়া রাখছিল। বরুণা খুশী মুখে ননিমাধবকে আপ্যায়ন করল। টেবিলসংলগ্ন চেয়ার আর বিছানা ছাড়া বসার আর জায়গা না দেখে ননিমাধব ইতস্তত করছিল।

বাইরে থেকে বিজনের ডাকাডাকিতে ছন্দপতন। সাড়া দিয়ে বিরসবদনে প্রস্থান করতে হল তাকে।

বরুণা হেসে ওঠার মুখেও সামলে নিল, দিদির গম্ভীর মুখের দিকে তাকালে হাসি আসে না। অর্চনা বিছানায় বসে তাকে ডাকল, বোস, তোর কি খবর?

তার গা ঘেঁষে বসল বরুণা।–খবর তো আজ তোর, বা-ব্বা কি পড়াই পড়লি দুবছর ধরে।…তার আরো কাছে এসে উৎসুক মুখে জিজ্ঞাসা করল, দিদি, বাবা খুব খুশী হয়েছেন রেজাল্ট শুনে?

কি জানি…

বরুণা থমকে তাকাল।

একটা উদগত অনুভূতি সামলে নিয়ে অর্চনা হাসল একটু, তারপর আস্তে আস্তে বলল, যারা এই দু বছরের মধ্যে একটা দিনও আমার সঙ্গে ডেকে কথা কন্ নি রে।

বরুণা জানত। আর বাবার ওপর রাগই হল তার। উঠে দাঁড়াতে গেল, তাই বুঝি, বাবাকে দেখাচ্ছি মজা–

অর্চনা হাত ধরে বসিয়েই রাখল তাকে উঠতে ছিল না। চুপচাপ দুজনেই। দুজনেরই চোখ ছলছল।

এর পর যত দিন যায়, অর্চনার বিয়ের চিন্তায় মনে মনে উদগ্ৰীব সকলে। এ. এ. পাশ করার পর ননিমাধবের হাজিরাও নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মায়ের গরজ বালাই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিবাহ-প্রসঙ্গটা তিনি এখন উত্থাপন করলেন মেয়ের কাছে। করে, ধমক খেলেন। তার পর মায়ের তাড়নায় ভয়ে ভয়ে হাল ধরতে এলো বরুণ। এসে সে-ও ধমক খেল। সব শেষে বউদি। রঙ্গরস করে তিনি অগ্রসর হলেন, বলি ব্যাপারখানা কি?

বসে কি একটা পড়ছিল অর্চনা। মুখ তুলে তাকাল।

রোজ রোজ ভদ্রলোক এসে বসে থাকেন, দেখে মায়াও হয় না একটু?

অর্চনা তেমনি চেয়ে আছে। একটু বাদে ফিরে জিজ্ঞাসা করল, কি করতে বলো?

অস্বস্তি চেপে বউদি একটু জোর দিয়েই বলল, বিয়েটা করে ফেললেই তো চুকে যায়।

ভিতরে ভিতরে তেতে উঠলেও সেটুকু প্রকাশ পেল না। বিয়ে করব কোনদিন তোমাদের বলেছি?

বলছ না বলেই তো ভাবনা–

তোমরা এই ভাবনা-টাবনাগুলো বাদ দিয়ে চললে আমার এখানে থাকাটা একটু সহজ হয় বউদি।

গম্ভীর মুখে আবার বই টেনে নিল সে। বউদি পালিয়ে বাঁচল।

বই রেখে অর্চনা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। পড়াশুনো নিয়ে ছিল ভাল। এই ঢালা অবকাশ দুর্বহ। স্মৃতিপথে যারা ভিড় করে আসে দু-হাতে তাদের ঠেলে সরিয়ে রাখার চেষ্টায় ভিতরে ভিতরে ক্লান্ত সে। প্রতিটি দণ্ড পল মুহূর্ত ভারি বোঝার মত।

রাস্তায় দুটো মেয়ে পুরুষ গান গেয়ে ভিক্ষা করছে। পুরুষের গলায় সস্তা একটা হারমোনিয়াম বোলানো, মেয়েটির কাঁধের দুদিকে দু-পা ঝুলিয়ে বসে একটা কচি বাচ্চা। হালকা গান। এই দুনিয়ায় নারী-পুরুষের অনাবিল বিনিময় গানের বিষয়বস্তু। অনেকে শুনছে, কেউ কেউ পয়সা দিচ্ছে। অর্চনা নির্নিমেষে দেখছে। জীবন-ধারণের একটা যৌথ প্রচেষ্টা দেখছে। মেয়েটার কাঁধের শিশুটিকে দেখছে।

অর্চনার সর্বাঙ্গে কিসের শিহরণ। চেষ্টা করেও পারছে না অন্যমনস্ক হতে। ঝাপসা চোখের সামনে একটা অয়েল-পেন্টিং ছবি এসে পড়ছে বার বার। সেই ছবিতে নারীর আকুতি। অব্যক্ত নীরবতায় সেই নারী যেন ওই প্রতীক্ষা করে ছিল, ওর কাছেই কিছু চেয়েছিল। সেই চাওয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বসে ছিল আর একটি বৃদ্ধা বিধবা।…আর তারা চাইবে না। তাদের চাওয়া শেষ।

অর্চনা জানালা থেকে সরে এলো। ভিতরটা ধড়ফড় করছে কেমন।

অব্যক্ত যাতনায় মন থেকে সবকিছু আবার বেড়ে ফেলতে চেষ্টা করল সে। আবার পড়বে। হোক একটা বিষয় নিয়ে আবারও পড়ায়ে শুরু করবে।

সঙ্কল্পটা টের পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির লোকের ভি ভাবনা। বিশেষ করে মায়ের আর বিজনের। এখনই একটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। পড়াশুনায় এগিয়ে গেলে আবারও দু বছরের ধাক্কা। এম. এ পাস করেছে তার সাত-আট মাস হয়ে গেল।

অর্চনা জানে, ননিমাধবের সঙ্গে তার বিয়েটা সম্পন্ন করার পিছনে দাদারই আগ্রহ আপাতত সব থেকে বেশি। শুধু বন্ধু নয়, এতবড় এক উঠতি ব্যবসায়ের অর্ধেক অংশীদার। তাকে আত্মীয়তার মধ্যে এনে ফেলতে পারলে ষোল-আনা নিশ্চিন্ত।

রাত্রিতে সেদিন দাদার ঘরে ডাক পড়তে অর্চনা এসে দেখে, ঘরে শুধু মা আর দাদা বসে। সঙ্গে সঙ্গে কেন ডাকা হয়েছে অনুমান করতে দেরি হল না।

বিজন মোলায়েম করে বলল, বোস, কি করছিলি?

কিছু না।…বিছানার একধারে মা বসে, অন্য ধারে সে-ও বসল।

বিজন জিজ্ঞাসা করল, তুই আবার কি নিয়ে পড়াশুনো আরম্ভ করছিস শুনলাম?

অর্চনা জবাব দিল না। দোরগোড়ায় ডক্টর বাসু এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর দিকেই চোখ গেল সকলের। একবার দেখে নিয়ে তিনি দরজার কাছ থেকে সরে গেলেন। বিজন ভণিতা বাদ দিয়ে সোজা আসল বক্তব্য উত্থাপন করল। এম. এ. পাস তো হয়েই গেছে, আবার পড়াশুনো কিসের–তাছাড়া, তুই এভাবে থাকবি কেন, আমি তো কিছু বুঝি না।

অর্চনা দাদার চোখে চোখ রাখল।–তোমার কি ইচ্ছে?

মিসেস বাসু নীরবে ছেলের দিকে তাকালেন। বিজন আমতা-আমতা করে বলল, আমার ইচ্ছে, আমার কেন–আমার, মার, তোর বউদির, সকলেরই ইচ্ছে, হাতের কাছে এমন একটি ছেলে

কিভাবে বলে উঠবে কথাটা ঠিক করতে না পেরে ধমকাল একটু। মিসেস বাসু সঙ্গে সঙ্গে পরিপূরক সুলভ মন্তব্য করলেন, হীরের টুকরো ছেলে …

অর্চনা অপলক চোখে বিজনের দিকেই চেয়ে ছিল।–এই জন্যে ডেকেছ?

ভাবগতিক দেখে বিজন মনে মনে ঘাবড়েছে। আরো মিষ্টি করে বলল, হ্যাঁ, কথাটা তো ভেবে দেখা দরকার–

দরকার দেখতেই পাচ্ছি! তোমার স্বার্থটা কোথায় আমি জানি দাদা, কিন্তু—

স্থির কঠিন চোখে মায়ের দিকে ফিরল সে।

মিসেস বাসু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, এ আবার কি কথা। আমরা তো তোর ভালর জয়েই বলছি–

সঙ্গে সঙ্গে অর্চনা জলে উঠল যেন। এতদিনের ধৈর্যের প্রয়াস এক মুহূর্তে তছনছ হয়ে গেল।–ভালর জন্যে বলছ, আমার ভালর জঙ্গে–না মা?…মুখে চোখে নির্মম বিপ। আমার শুধু ঘরে ঘরে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে হয় তোমার মত ক’জন মা ক’টি মেয়ের এত ভাল করছে।…আরো তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল সে, কিন্তু কেন? কেন এত ভাল করতে চাও তোমরা? কেন ভাল করার এত মোহ তোমাদের? তোমাদের ভাল করার এই নিষ্ঠুর লোভে জ্বলে পুড়ে সব শেষ হয়ে গেল মা।

কণ্ঠস্বর রুদ্ধ। অন্য দুজন চিত্রার্পিত। প্রাণপণ চেষ্টায় অর্চনা সামলে নিল একটু। আস্তে আস্তে দাঁড়াল।-কিছু মনে করো না মা, আমার ভাল তোমরা অনেক করেছ…দোহাই তোমাদের, আর ভাল করতে চেয়ো না।

মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। অদূরের রেলিঙের কাছে স্তব্ধ মূর্তির মত আরো কেউ দাঁড়িয়ে, চোখে পড়ল না। নিজের ঘরে এসে শষ্যায় মুখ ঢাকল সে।

পায়ে পায়ে রেলিং ছেড়ে ওর দোয়গোড়ায় এসে দাঁড়ালেন ডক্টর বাসু। দেখলেন। ভিতরে এসে বিছানার এক পাশে বসলেন। তার পর আস্তে আস্তে একখানা হাত রাখলেন মেয়ের পিঠের ওপর।

অর্চনা মুখ তুলল। গাল বেয়ে অঝোরে ধারা নেমেছে। নিঃশব্দ দৃষ্টি বিনিময়। দুই হাতে তাকে আঁকড়ে ধরে অর্চনা ছোট মেয়ের মত বাবার কোলের মধ্যে মুখ গুঁজল এবার।

ডক্টর বাসু গভীর মমতায় মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

দু-চোখ তাঁরও চিক চিক করছে।

.

দিন যায়। বছর ঘুরে আসে আরো একটা।

মা বলতে গেলে একরকম তফাতেই সরে আছেন। আর কারো কোন ভাল-মন্দে নেই যেন তিনি। দাদাও চুপচাপ, নির্লিপ্ত। শুধু বাবার ঘরেই আগের মত ডাক পড়ে অৰ্চনার। আগের মত নয়, আগের থেকেও বেশি। আলোচনার ঝোঁকে এক-একদিন সব দুর্ভাবনা সত্যিই ভোলেন তিনি।

কিন্তু অর্চনা ভিতরে ভিতরে হাঁপিয়েই উঠছে। বিষয়ারে প্রাইভেটে এম. এ. পরীক্ষা দেবে আবার, ঠিক করেও পড়াশুনা বলতে গেলে এগোর নি। এক একসময়ে ভাবে, চাকরি-বাকরি নিয়ে কোথাও চলে যাবে। এম. এ-তে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার দরুন চাকরি সহজেই জুটতে পারে। কিন্তু তাতেও উৎসাহ নেই খুব। তার ওপর কোথাও দরখাস্ত করেছে দেখলে বাবাই প্রকারান্তরে বাধা দেন বলেন, করবি’খন চাকরি, এত তাড়া কিসের, চাকরি না করলেও তোর কোন ভাবনা নেই।

নেই বলেই এমন ক্লান্তিকর শূন্যতা। কোন কিছুর জন্যেই আর ভাবনা নেই তার। সব ভাবনা চুকিয়ে বসে আছে। এমন ভাবনাশুন্যতার মধ্যে নিজের অস্তিত্বটাই দুর্বহ বোঝার মত মনে হয়। বাড়িতেও আর অশান্তির কারণ নেই। কিছু, গৃহকর্তার নিষেধ আছে কেউ যেন ওকে উত্ত্যক্ত না করে। কাদার সামনে মায়ের মুখের ওপর সেই মর্মান্তিক আলা প্রকাশ করে ফেলে অর্চনা নিজেই অনেকটা শান্ত হয়ে গেছে। মনে মনে অনুতপ্ত হয়েছে।…নিজেরই ভাগ্য, দোষ কাকে দেবে।

একটানা অবকাশে আর একজনের কথাও মাঝে মাঝে ভাবে। জীবনের সঙ্গী হিসেবে যাকে কখনো কল্পনাও করতে পারে নি, সেই একজনের কথা। ননিমাধব–। এখনো আসে। দাদা আর মায়ের মুখ চেয়েই বুঝতে পারে বোধহয় একটু কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। তবু আসে…তার এই নীরব প্রতীক্ষা যাতনার মত বেঁধে। ইচ্ছে করলেই ভাল বিয়ে করতে পারে, সুখী হতে পারে। কিন্তু সেটা তাকে বুঝিয়ে বলে কে। অর্চনা ভাবে, সম্ভব হলে ও নিজেই একদিন বলবে। ননিমাধব এলে ওকে আর ভাকাডাকি করে ঘরে আনতে হয় না। নিজে থেকেই এসে বসে এক-একদিন। দু-পাঁচটা সাধারণ কথাও বলতে চেষ্টা করে, চা করে দেয়।

কিন্তু ওইটুকুই যে-ভাবে নাড়া দেয় ভদ্রলোককে দেখে সব সময় আবার সামনে যেতেও ইচ্ছে করে না। তার চোখে-মুখে প্রত্যাশার আলো দেখে থমকে যায়। অর্চনা দিকতকের মত নিজেকে গুটিয়ে ফেলে আবার।

কি-ই বা করতে পারে এছাড়া। ওর জীবন-বাস্তবে, যৌবন-বাস্তবে ঘর মতই আবির্ভাব যার তার আনন্দ বিষাদ হিংসা ক্রোধ সবই পুরুষের। সেই পুরুষ ছিনিয়ে নিতে জানে। নিয়েছেও। ওখানেই নিঃশেষে সর্বসমর্পণ ওর বিধিলিপি। …আজও সেটুকু গোপন স্মৃতির মতই। ও-যে কিছুই আর হাতে রেখে বসে নেই। এই রিক্ততা নিয়ে নতুন করে আবার একজনের সঙ্গে আপস হবে কেমন করে।

এক বছরে মানুষ অতি বড় বিপর্যয়ও তোলে, মায়ের আর দাদার রাগ বা অভিমান ভোলাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাছাড়া অর্চনার শান্ত পরিবর্তনটুকুও হয়তো কিছুটা আশার কারণ তাদের। বউদি আয় মায়েতে মিলে গোপনে গোপনে আবার বেন কি পরামর্শ শুরু হয়েছে একটা।

অর্চনা হঠাৎ শুনল, কিছুদিনের জন্যে বাইরে বেড়াতে বেরুনো হবে। দাদা জানাল, অর্চনার জন্যেই বিশেষ করে চেঞ্জে ঘুরে আসা দরকার, দিনকে দিন তার শরীর খারাপ হয়ে পড়ছে। তাছাড়া একঘেয়ে ব্যবসায়ের ঝামেলায় ক্লান্ত নাকি নিজেরাও। নিজেরা বলতে আর কে অর্চনা বুঝে নিল। দাদার মুখের ওপর আপত্তি করতে পারল না। এমনিতেও বাদ-প্রতিবাদ আর কারো সঙ্গেই করে না বড়। তাছাড়া ভিতরে ভিতরে সত্যিই এমন ক্লান্ত যে কোথাও বেরুনোর প্রস্তাবটা নিজেরই খারাপ লাগল না। তার ওপর বাবাও ওকে ডেকে বললেন, তোর শরীর সত্যিই ভাল দেখছি না, ওদের সঙ্গে–দিনকতক ঘুরে-টুরে এলে ভালই লাগবে।

সত্যিই বেরিয়ে পড়া হল একদিন। অর্চনার ইচ্ছে ছিল বরুণাও সঙ্গে থাক। কিন্তু তার নাকি শ্বশুরবাড়ি থেকে ছুটি মিলল না। আসলে বরুণ নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে এবং দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে সরে রইল। চারজনে বেরিয়েছে। সদা বউদি ননিমাধব আর অর্চনা। দিল্লীতে দিনকতক থেকে যাওয়া হবে আগ্রায়। আগ্রায় আবার দিনকতক থাকা, তারপর প্রত্যাবর্তন।

একেবারে কাছাকাছি থাকার দরুন এবারে কিছুটা সহজ হল ননিমাধব। তার রুমালে করে মুখ মোছা কমতে লাগল। দলের দুজন যে তার দিকে সে তো জানেই, এই বেড়ানোর তাৎপর্যও জানে। সুযোগ-সুবিধে মত অর্চনার সঙ্গে কথাবার্তা বলার অবকাশ অন্য দুজনেই করে দেয়।

অর্চনাও সদয় ব্যবহারই করছে তার সঙ্গে। হেসে কথা বলে কথা শোনে। সে ইতিহাসের ছাত্রী। ইতিহাস স্মৃতি বা ইতিহাস-নিদর্শনের প্রতি ননিমাধবের সদ্ধ জিজ্ঞাসাবাদের উত্তরে হেসেই জবাব দেয় যেটুকু জানে। অন্য দুজনের শোনার থেকেও দেখার দিকেই ঝোঁক বেশি। কাজেই দেখার সমারোহের মধ্যে দেখতে দেখতে এদিকে-সেদিকে ছড়িয়ে পড়বে তার, সে আর বিচিত্র কি।

দিল্লী-পর্ব সেরে আগ্ৰায় আসার মধ্যেই ননিমাধব মনে মনে অনেকটা ভরসা পেয়েছে। তার থেকেও বেশি ভরসা পেয়েছে–বউদি। আগ্রায় এসে ইতিহাসের আয় ছাড়াও অন্য দু-চারটে কথা বলতে শুরু করেছে ননিমাধব। যেমন, বেড়াতে কেমন লাগছে, আজকাল কথা এত কম বলে কেন অর্চনা, ইত্যাদি।

তাতেও বিরূপ বা বিরক্ত হতে দেখা যায় নি অর্চনাকে। চতুর্থবার তাজমহল দেখতে দেখতে ননিমাধবের কথা শুনে তো বেশ জোরেই হেসে ফেলেছিল। ননিমাধব একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, তাজমহল যে প্রেমের স্মৃতি-সমাধি, এখানে আসার আগে এমন করে কখনো মনে হয় নি–শাজাহানের দীর্ঘনিঃশ্বাস গুলোই যেন জমে পাথর হয়ে আছে।

অর্চনাকে হঠাৎ অমন হেসে উঠতে দেখে ননিমাধব অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিল। লজ্জায় ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। দাদা বউদি উৎফুল্ল মুখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসেছে। অর্চনা হেসেই বলেছে, কেন তোমরা রোজ রোজ এই তাজমহলে আস বল তো…ভদ্রলোকের মন খারাপ হয়ে যায়।

এতদিনে বিজন মনে মনে সত্যিই পার্টনারের তারিফ করল। খুশীর কানাকানি চলতে লাগল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। একটা গুরু বোঝা হালকা হল।

পরদিনের প্রোগ্রাম ফতেপুর সিক্রি।

মাইল পঁচিশ দূর আগ্রা থেকে। মোটরে চলেছে সকলে। দূর থেকে ইতিহাসের স্মৃতি-সমারোহের দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। অর্চনার দিকে চেয়ে ননিমাধব নীরব কৌতূহলের আভাস পেল।

মোটর থেকে নামতেই তিন-চারজন গাইড ছেকে ধরল তাদের। এই ব্যাপারটা দিল্লীতেও দেখেছে, আগ্রাতেও দেখেছে। অদূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল একজন অতিবৃদ্ধ গাইড। শনের মত সাদা চুল, সাদা দাড়ি। পরনে সাদা মলিন ঢোলা আলখাল্লা। জোয়ানদের সঙ্গে ঠিকমত পাল্লা দিতে পারে না বলেই হয়তো সবিনয়ে অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল। যদি কেউ নিজে থেকেই ডেকে নেয়।

ডেকে নিল। কে জানে কেন তাকেই পছন্দ হল ননিমাধবের। বুড়ো মানুষ, দেখাবে-শোনাবে ভাল।

সামনেই আকাশ-ছোঁয়া সিঁড়ির সমারোহ। বিশাল, বিস্তৃত সিঁড়ি। প্রতিটি সোপান মর্ত্যের মানুষের কালোত্তীর্ণ আকাক্ষার স্বাক্ষর। সকলে উঠতে লাগল। অনেক দূর থেকে কোন মুসলমান পীরের যান্ত্রিক সুরের স্তোত্ৰ-গান ভেসে আসছে। অদ্ভুত যুক্ত পরিবেশ। কাল যেন এক অপরিমেয় স্মৃতিভার বুকে করে এইখানটিতে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে।

সিঁড়ির শেষে বিশাল চত্বর। গাইড ঘুরতে লাগল তাদের নিয়ে। গল্প করতে লাগল। ইতিহাসের গল্প। এটা কেন, ওটা কি ইত্যাদি। চোস্তু উদ্ৰ অনেক কথাই বোঝা গেল না। কেউ চেষ্টাও করল না বুঝতে। গাইড আপন মনে তার কাজ করে যাচ্ছে, অর্থাৎ বকে যাচ্ছে–এরা নিজেদের মনে কথাবার্তা কইতে কইতে দেখেছে। শুধু অর্চনারই দু-চোখ ইতিহাস-স্মৃতি-প্রাচুর্যের মধ্যে একেবারে হারিয়ে গেছে।

ঘুরতে ঘুরতে এক সময়ে শ্রান্ত হয়ে পড়েছে সকলে। শেষ নেই যেন। রাণুদেবী এক জায়গায় বসে পড়ল, তোমরা ঘোরর বাবা, আমি আর পারিনে

জলের ফ্লাস্কের জন্য হাত বাড়াল সে। ফ্লাস্ক বিজনের কাঁধে। অতএব বিজনও বিশ্রামের সুযোগ পেল একটু। ওদিকে গাইডের পাশে অর্চনা, কাজেই তার পাশে ননিমাধব। তারা এগিয়ে চলল আবার। ওই দুজনের বসে-পড়াটা মিষ্টি কিছু ইঙ্গিত মনে করে শ্রান্তি সত্ত্বেও ননিমাধব তুষ্ট এবং উৎফুল্ল। কিছু একটা বলার জন্যেই এক সময় মন্তব্য করল, কি উদ্ভট শখ ছিল আকবর লোকটার, এ-রকম একটা ছন্নছাড়া জায়গায় এসে এই কাণ্ড করেছে বসে বসে!

গাইড তার কথাগুলি সঠিক না বুঝুক, বক্তব্য বুঝল। গল্পের খোরাক পেল আবার।–শখ নয় বাবুজি, শাহান-শা বাদশা এখানে ফকির চিশতির দোয়া মেঙে সব পেয়েছিলেন বলেই এখানে এই সব হয়েছিল।

গাইড বলতে লাগল, এই তামাম জায়গা তো জঙ্গল ছিল, কেউ আসত না, শের আর বুনো হাতী চরত। শাহান-শা আকবর যুদ্ধফেরত এখানে এক রাতের জন্য আটকে পড়েছিলেন। এই ভীষণ জঙ্গলের গুহায় সাধন-ভজন করতেন এক পয়গম্বর পুরুষ–ফকির সেলিম চিশতি।…

কথা শুনতে শুনতে এগোচ্ছিল ওরা। খুব যে আকৃষ্ট হয়েছিল এমনও নয়। ননিমাধব তো নয়ই। অর্চনার মন্দ লাগছিল না অবশ্য। গাইড গল্প বলে চলেছে, এতবড় বাদশা সেই ফকিরকে দেখামাত্র কেমন যেন হয়ে গেলেন!

…তাঁর দোয়া মাঙলের বাদশা।

শাহান শার মনে ছিল বেজায় দুঃখু। খাস বেগমের দু-দুটো ছেলে হয়ে মরে গেছে, আর ছেলে হয় নি। তখৎ-এ-তাউসে বসবে কে? কাকে দিয়ে যাবেন মসনদ।

ফকির চিশতি বললেন, আল্লার দোয়ায় বাদশার আবার ছেলে হবে। বেগমকে এইখানেই নিয়ে আসতে বললেন সেলিম চিশতি। আকবর বাদশা তাই করলেন। ন-মাস ছিলেন এখানে বাস বেগমকে নিয়ে। তার পর ছেলে হল। ছেলের মত ছেলে। বাদশা জাহাঙ্গীর। শাহান-শা গুরুর নামে ছেলের নাম রাখলেন সেলিম। আর ফকিরগুরুর আশ্রমে বাস করবেন বলে সব জাল সাফ করে এখানে এত বড় রাজদরবার গড়ে তুললেন তিনি। ফকির বই বাদশা আকবর আর কিছু জানতেন না।

কখন যে নিবিড় আগ্রহে শুনতে শুরু করেছে অর্চনা নিজেই খেয়াল নেই। হঠাৎ কেন এমন করে স্পর্শ করল এই কাহিনী তাও জানে না। শুনতে শুনতে একটি সমাধির কাছে এসে দাঁড়াল তারা। মার্বেল পাথরের অভ্র সমাধি লাল কাপড়ে জড়ানো চারিদিকে নক্সাকাটা পাথরের জালি দেয়াল।

গাইড জানাল, এই ফকির চিশতির সমাধি।

অর্চনা কেমন যেন অভিভূত। দেখছে চুপচাপ। আর কি-একটা অজ্ঞাত আলোড়ন হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, সেই জালির দেয়ালে অসংখ্য সুতো আর কাপড়ের টুকরো বাঁধা। সুতোয় আর কাপড়ের টুকরোয় সমস্ত দেয়ালটাই বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে।

গাইডকে জিজ্ঞাসা করল, এগুলো কি?

গাইড জানাল, যাদের ছেলে হয় না তারা ছেলের জন্য ফকিরের দোয়া চেঙে এই সুতো বা কাপড় বেঁধে রেখে যায়। কত দুর দূর দেশ থেকে নিঃসন্তান মেয়েরা সুতা বাঁধার জন্য এখানে আসে। কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি খ্রীস্টান, সবাই আসে। ছেলে কামনা করে এখানে এসে ভক্তিভরে সুতো বেঁধে দিলে ছেলে হবেই। ফকিরের আশীর্বাদ কখনো মিথ্যে হয় না–তিনশ বছর হয়ে গেল কিন্তু লোকের বিশ্বাস আজও যায় নি।

অর্চনার কানে আর এক বর্ণও ঢুকছে না। কি একটা সুপ্ত ব্যথা খচখচিয়ে উঠছে ভিতরে ভিতরে। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে সমস্ত মুখ। ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। ফকিরের সব কথা ননিমাধব শোনে নি। কিন্তু অর্চনার দিকে চেয়ে থমকে গেল সে।–কি হল?

জবাব না দিয়ে অর্চনা সুতো-বাঁধা সেই জালির দেয়ালের চারদিকে ঘুরতে লাগল। মুখে অব্যক্ত যাতনার চিহ্ন, চোখে নিষ্পলক, বিভ্রান্ত আকুতি। অজস্র সুতো বাঁধা-সুতোর পর সুতো। এই প্রত্যেকটা সুতো যেন এক একটা রক্ত-মাংসের কি হয়ে দেখা দিতে লাগল চোখের সামনে।

অজস্র, অগণিত তাজা শিশু!

কি এক অজ্ঞাত উত্তেজনায় অর্চনা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। আবারও কাছে এগিয়ে এল ননিমাধব। কি হল? খারাপ লাগছে কিছু?।

তার কথায় হঠাৎ যেন সচেতন হল অর্চনা। তাকাল। এপলকে ভেবে নিল কি। সমস্ত মুখ আরক্ত তখনো। বলল, না, গরম লাগছে, একটু জল পান কি না দেখুন তো…

হন্তদন্ত হয়ে জলের সন্ধানে ছুটল ননিমাধব। জলের তৃষ্ণা দু-চোখে এমন করে ফুটে উঠতে জীবনে আর দেখে নি কখনো।

ননিমাধব পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে অর্চনা একটা কাণ্ড করে বসল। ফ্যাশ করে দামী শাড়ির আঁচলটা ছিঁড়ে ফেলল। বৃদ্ধ গাইডের বিমুঢ় চোখের সামনেই সেই শাড়ির টুকরো জালির দেওয়ালে বেঁধে দিয়ে স্কুত সরে এল সেখান থেকে। সর্বাঙ্গে থরথর কাপুনি। দেহের সমস্ত রক্তই বুঝি মুখে উঠে এসেছে।

গাইড কয়েক নিমেষ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে কি বুঝল সে-ই জানে। টেনে টেনে বলল ফকিরের দোয়া কখনো মিথ্যে হয় না মাইজী, শুচিমত থেকে। আর বিশ্বাস করে।

জল নিয়ে এসে ননিমাধব হতভম্ব। কারণ অর্চনা অন্যমনঙ্কের মত বলল, জলের দরকার নেই। দাদাবউদিও এসেছিল, ওর মুখের দিকে চেয়ে অবাক তারাও। বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগল কি হয়েছে।

অর্চনা কথা বলতে পারছে না। নিজেকে আড়াল করতে পারছে না বলেই বিব্রত হয়ে পড়ছে আরো বেশি। ছেঁড়া শাড়ির আঁচল ঢেকে ফেলেছে, তবু অস্ফুটস্বরে শুধু বলল, শরীর ভাল লাগছে না, এক্ষুনি ফেরা দরকার।

দ্রুত সিঁড়ির দিকে এগোল সে। ব্যাকুল, উদগ্রীব। একটা মুহূর্তও হাতে নেই যেন আর। তরতরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে লাগল।

সিঁড়ি সিঁড়ি সিঁড়ি সিঁড়ি। মাগো! এ-সিঁড়ির কি শেষ নেই?

তাড়াহুড়ো করে সকলে হোটলে ফিরল আবার। কিন্তু কি ব্যাপার ঘটে গেল হঠাৎ ভেবে না পেয়ে সকলেই বিভ্রান্ত একেবারে। দাদা-বউদি ননিমাধবকেই এটা-সেটা জিজ্ঞাসা করতে লাগল। কিন্তু সে-ও বিমূঢ় কম নয়।

অর্চনা ঘোষণা করল সেই রাতের ট্রেনেই কলকাতা ফিরবে। আবারও আকাশ থেকে পড়ল সকলে। কিন্তু তার দিকে চেয়ে মুখে আর কথা সরে না কারো। স্থানীয় ডাক্তার ডেকে ব্লাড প্রেসার দেখিয়ে নেওয়ার কথাও মনে হয়েছে সকলেরই। কিন্তু শোনামাত্র অর্চনা রেগে উঠল এমন যে সকলে নির্বাক।

ট্রেনে সারা পথ এক অধীর প্রতীক্ষায় নিঃশব্দে ছটফট করতে দেখা গেল তাকে। বেশি রাতে অন্য দুজন যখন তন্দ্রাচ্ছন, ননিমাধব কাছে এল। সত্যিকারের আকৃতি নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে বলবে না?

অর্চনা সচকিত হয়ে তাকাল। কিছু একটা ভাবনায় ছেদ পড়ল। ও-টুকু মেহের স্পর্শেই দু-চোখ ছলছল করে এল। অস্ফুট জবাব দিল, কি বলব।

এভাবে চলে এলে কেন?

তেমনি মৃদুকণ্ঠে অর্চনা বলল, আসা দরকার যে … আবারও তাকাল। হঠাৎ এই মানুষটির জন্যেও বুকের ভিতরটা ব্যথায় টনটনিয়ে উঠল। একটা উদগত অনুভূতি ভিতরে ঠেলে দিয়েই অস্ফুট স্বরে বলল, একটা কথা রাখবেন?

উদ্গ্রীব প্রতীক্ষায় ননিমাধব আরো একটু কাছে এগিয়ে এলো শুধু।

আমাকে ভুলে যান। নইলে এত অপরাধের বোক আমি বইব কেমন করে!

জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে মুখ ফেরাল সে। বিস্ময়ে বেদনায় ননিমাধব বোবা একেবারে।

কলকাতা।

হঠাৎ এভাবে ফিরতে দেখে মিসেস বাসু পাঁচ কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। বিজন বিরক্ত হয়ে জবাব দিল, জিজ্ঞেস করে দেখ তোমার মেয়েকে, আমরা কিছু জানি না।

মেয়েকে দুই এক কথা জিজ্ঞাসা করে ডক্টর বাসুও কিছু হদিস পেলেন না। ধীরে-সুস্থে জানা যাবে ভেবে আর উত্ত্যক্ত করতে চাইলেন না।

দুপুরের দিকে বিজন বেরিয়েছে। বউদি রাতের ক্লান্তি দূর করছে।

অর্চনা চুপচাপ বেরিয়ে পড়ল।

ট্রাম থেকে নেমে একটুখানি হাঁটা-পথ, তার পর বাড়ি। অৰ্চনা সমস্ত বাড়িটাকে একবার দেখে নিল।

দরজা বন্ধ। বন্ধই থাকে।

কড়া নাড়ল। একবার, দুবার—

সাড়া নেই।

আরো জোরে কড়া নাড়ল। মনে মনে হিসেব করছে, যতদূর মনে পড়ে এ দিনটা অফ-ডে। নাকি রুটিন বদলেছে কলেজের। কিন্তু তাহলে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ কেন, বাইরে তালা ঝোলার কথা। অবশ্য, সাবি থাকতে পারে

ও-দিক থেকে দরজা খোলার শব্দ।

শরীরের সমস্ত রক্ত আবার মুখে এসে জমেছে অর্চনার।

দরজা খুলল। অর্চনা স্তব্ধ।

দুপুরের ঘুম-ভাঙা চোখে দরজা খুলেছে একটি মেয়ে। বিবাহিত। সুশ্রী স্রস্ত বেশবাস। কোলে একটি ফুটফুটে শিশু।

দরজা খুলে মেয়েটিও অবাক একটু।

। আচমকা ধাক্কাটা অর্চনা যেন যন্ত্র-চালিতের মতই সামলে নিল। জিজ্ঞাসা করল, এবাড়িতে কে থাকেন?

জিজ্ঞাসা করার দরকার ছিল না। দরজার নেমপ্লেটে সুখেন্দু মিত্রের নাম লেখা। আর শিশুটির মুখের আদলেও তার জবাব লেখা।

মেয়েটি ইশারায় নেমপ্লেটটাই দেখিয়ে দিল।

ও… অর্চনা বিব্রত মুখে হাসল একটু, আমি ঠিকানা ভুল করেছি। হাত বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি শিশুটির গাল টিপে দিল।–বেশ ছেলেটি তো…আপনাদের ছেলে?

মেয়েটির মুখে তুষ্টির আভাস একটু। মাথা নাড়ল। তার পর জিজ্ঞাসা করল, আপনি যাবেন কোথায়?

অর্চনা ব্যস্তভাবে জবাব দিল, এই এ-দিকেই যাব, আপনাকে বিরক্ত করলাম… নমস্কার।

আর জিজ্ঞাসাবাদের ফুরসৎ না দিয়ে ছেলেটির গালে আর একবার আঙুল স্পর্শ করে অতি-আধুনিকার মতই টক-টক করে রাস্তায় নেমে এলো অর্চনা বসু …

.

০৯.

পাখি-ডাকা আবছা অন্ধকারে ভোরের আভাস।

খরখরে দু-চোখের ওপর দিয়ে আর একটা রাতের অবসান। অর্চনা বসু উঠবে। ঈজিচেয়ারটা ঠেলে ভিতরে নিয়ে যাবে। তার পর, হাত-মুখ ধুয়ে এসে চেয়ারে বসে ঝিমুবে খানিক। দাশু চা নিয়ে আসবে। পর পর দু-তিন পেয়ালা চা খেয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবে সে, চান করে আসবে। ইস্কুলের খাতা দেখে বা বই পড়ে কাটবে কিছুক্ষণ। তারপর শুচি শুভ্র বেশবাসে নিজেকে ঢেকে ইস্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুত হবে।

সেই ধপধপে সাদা পোশাক। আর সাদাটে ব্যবধান।

গাইডের শুচি-মত থাকার নির্দেশ ভোলে নি।

আর, তার কথা-মত বিশ্বাসটাও দূর করে উঠতে পারে নি।


© 2024 পুরনো বই