৬. বড় ক্ষতও আপনি শুকোয়

০৬.

অনুকুল অবকাশে অনেক বড় ক্ষতও আপনি শুকোয়। এই ছোট ব্যাপারটা দুদিনেই মিটে যাবার কথা। যেতও হয়তো। সুখেন্দুব রাগ আর জেদ বেশি, দুদিনের জায়গায় না-হয় দশদিন লাগত। কিন্তু কাঁচা ক্ষতর ওপর বার বার ঘষা পড়লে ছোট ব্যাপারও দুষিয়ে বিষিয়ে বিষম হয়ে ওঠে। মেয়ের সংসারটিকে যুগের আলো-বাতাসে টেনে ভোলার শুভ তাড়নায় মিসেস বাসু প্রায় নির্মম। মেয়ে একটা ভুল করে ফেলেছে বলেই তার সংসারযাত্রা সুনির্বিঘ্ন করে দেওয়ার দায়িত্ব যেন আরো বেশি। এই দায়িত্ব পালনের চেষ্টাটা আর একদিকে কেমন লাগছে সেটা তিনি বুঝলেন না বা বুঝতে চেষ্টাও করলেন না।

মেয়ের বাড়িতে একটা টেলিফোন আনার তোড়জোড় অনেকদিন ধরেই করছিলেন তিনি। টেলিফোনের অভাবে অর্চনার কতটা অসুবিধে হচ্ছে সেটা ভাবেননি। নিজের অসুবিধে দিয়েই মেয়ের অসুবিধেটা বড় করে দেখেছেন। অযাচিত ভাবে হুটহুট করে মেয়ের বাড়িতে কত আর আসা যায়, একটা টেলিফোন থাকলে অনেক ঝামেলা বাঁচে।

কিন্তু টেলিফোন চাই বললেই টেলিফোন মেলে না আজকাল। এর জন্যে তদবির তদারক যা করা দরকার তিনিই করেছেন। খরচাপও সব তারই। টেলিফোনের স্যাংশান পাওয়া গেল সেই রাত্রে বোনকে জামাই দেখানোর কয়েকদিনের মধ্যেই। সেইদিন জামাই কি মন বা কি মেজাজ নিয়ে গেছে সেটা তাঁর পক্ষে অনুমান করাও সম্ভব না। আপাতত টেলিফোন এনে ফেলতে পারার কৃতিত্বে বিভোর তিনি।

সুখেন্দু খবরটা জানল, টেলিফোন অফিসের লোক এসে যখন বাড়ি দেখেশুনে গেল তখন।

জনাকতক লোক বাড়ির সামনেটা অনেকটা খুঁড়ে ফেলেছে। গর্তের ভিতর দিয়ে টেলিফোনের তার বাড়ির দিকে গেছে। অর্চনা পাশের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে তাই দেখছিল। টেলিফোন একটা এলে মন্দ অবশ্য হয় না, কিন্তু সুখের নিস্পৃহতায় খুব স্বস্তিবোধ করছে না। এই কটা দিনের মধ্যে আগের মত হাসিমুখে কথাও বলেনি তার সঙ্গে। তারপর মায়ের এই টেলিফোন আনার ব্যবস্থাপত্র দেখে একেবারে চুপ।

পিসিমাও রাস্তা খোঁড়ার ব্যাপারটা আজই নতুন দেখলেন। গঙ্গাস্নান পুজো-আর্চা নিয়ে থাকলেও তার চোখে বড় এড়ায় না কিছু। ক’দিন ধরেই ছেলের ভাবগতিক অন্যরকম লক্ষ্য করছেন। সেদিনও সকালে গন্যমান সেরে ওপরে উঠে দেখেন, গম্ভীর মনোযোগে বসে কাগজ পড়ছে সে। কি ভেবে ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ রে সুখেন, বাড়ির সামনেটা ওরকম খুঁড়ে ফেলেছে কেন?

সুখেন্দু মুখের সামনে থেকে কাগজ সাল।–টেলিফোন আসছে।

টেলিফোন! আমাদের এখানে?

সে রকমই তো শুনছি। মুখের ওপর খবরের কাগজ তুলল আবার।

টেলিফোন আসছে সুখবরই, তা বলে ছেলের মুখ ও-রকম কেন পিসিমা বুঝে উঠলেন না। চুপচাপ একটু নিরীক্ষণ করে ফিরে এলেন তিনি। পাশের ঘরের জানালার কাছে অর্চনাকে দেখেছিলেন, বারান্দার এ-মাথায় এসে কি ভেবে ডাকলেন তাকে।…মাথায় কাপড় তুলে দিয়ে অর্চনা কাছে এসে দাঁড়াল।

বাড়িতে নাকি টেলিফোন আসছে? খুশী মূখেই জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।

হ্যাঁ পিসিমা, উঠে পড়ে লাগতে হয়ে গেল, এত সহজে হয় না।

পিসিমা হেসে বললেন, খুব ভাল হল, দুই বেয়ানে সারাক্ষণ দুদিক থেকে টেলিফোন কানে দিয়েই বসে থাকব।

অর্চনাও হাসল তাঁর সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু হাসিটা তেমন সহজে আসছে না। বলল, মা হয়তো এসে পড়বেন এক্ষুনি।

তাই নাকি! তোমার মা পারেন, আমাদের মত জবুথবু নন। একটু থেমে হঠাৎ নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ বউমা, আজ কদিন ধরেই সুখেনকে যেন কেমন কেমন দেখছি–কি হয়েছে? শরীরটরির ভাল তো?

অর্চনা বিব্রতমুখে জবাব দিল, ভালই…।

যাক, আমার ভাবনা হয়েছিল। যে রাগ-চাপা ছেলে। ভাল কথা, বেয়ানকে না খাইয়ে ছেড়ো না কিন্তু, আমি দেখি ওদিকে ওরা কি করছে

তিনি চলে গেলেন। অর্চনা পায়ে পায়ে নিজের ঘরে এসে দেখে খবরের কাগজের দু-পাট খুলে সেই একভাবেই মুখ আড়াল করে বসে আছে মানুষটা। খানিক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। এই ভাবগতিক আর বেশি বরদাস্ত করতেও ভাল লাগল না তার। এগিয়ে এসে আলমারির মাথা থেকে আর একটা পুরনো খবরের কাগজ টেনে নিল। তারপর অন্য হাতে কোণ থেকে মোড়াটা তুলে পা টিপে সুখেন্দুর ঠিক সামনে রেখে মুখোমুখি বসল।

সুখেন্দুর হাতের কাগজ নড়ল এবার। কাগজ সরিয়ে দেখে, ঠিক তারই অনুকরণে অর্চনা দু-হাতে মুখের সামনে কাগজ মেলে সর্বাঙ্গ ঢেকে বসে আছে।

ভুরু কুঁচকে দেখল একটু, তারপর আবারও কাগজ পড়ায় মন দিল–

মুখের সামনে থেকে এবারে অর্চনা আস্তে আস্তে কাগজ সরিয়ে তাই দেখে নিজের হাতের কাগজটা একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর খপ করে সুখেন্দুর কাগজ ধরে এক টান। কাগজটা ছিঁড়ে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে অর্চনা জিব কাটল। তার পরেই জোর দিয়ে বলে উঠল, বেশ হয়েছে পিসিমা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করছিলেন তোমার কি হয়েছে! মা সেই কবে কি না কি একটা কথা বলেছে, তুমি এখনো তাই ধরে বসে আছ!

সুখেন্দু নিস্পৃহ জবাব দিল, আমি কিছুই ধরে বসে নেই।

তবে? ও, টেলিফোন!

জবাব না দিয়ে সুখেন্দু খবরের কাগজে চোখ রাখল।

তোমার আপত্তি সে কথা তুমি মাকে বলে দাওনি কেন? ক’মাস ধরেই তো শুনছ টেলিফোনের কথা–

সুখেন্দু বলল, তোমার মা টেলিফোন আনছেন তোমার সুবিধের জন্য, আমি আপত্তি করতে যাব কেন?

বিরক্তিতে অর্চনা মোড় ঠেলে উঠে দাঁড়াল একেবারে।– দেখ, এই জন্যেই তোমার উপর আমার রাগ হয়–আমার সুবিধে কি অসুবিধে সেটা তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেই তো পারতে–আমি কি বাইরের কেউ?

বোঝাপড়াটা ঠিকমত করে ওঠার অবকাশ পাওয়া গেল না। নিচে গাড়ি থামার শব্দে মায়ের আবির্ভাব ঘোষণা। অচন। অনুনয় করল, এভাবে বসে থেকো না, লক্ষ্মীটি, ওঠো–

বাইরের মাটি খোঁড়ার কাজ দেখতে দেখতে হৃষ্টচিত্তে মিসেস বাসু ভিতরে ঢুকলেন। পিসিমা নিচে ছিলেন, টের পেয়ে চাবির গোছা বাঁধতে বাঁধতে হাসিমুখে অভ্যর্থনায় এগিয়ে এলেন।-নমস্কার বেয়ান, আসুন–আপনি আসছেন বউমা বলেছে।

ওভাবে চাবির গোছা আঁচলে বাঁধাটাও মিসেস বাসুর চোখে বিরক্তিকর। আর কার চাবি কে আঁচলে বাধে ভিতরে ভিতরে হয়তো সেই খেদও একটু। আপ্যায়নের জবাবে মাথা নাড়ালেন কি নাড়ালেন না।–অর্চনা কোথায়?

দেখা গেল সিঁড়ি দিয়ে অর্চনা নেমে আসছে আর ওপরের রেলিং-এর মাথায় সুখেন্দু দাঁড়িয়ে। পিসিমা হাসিমুখে বললেন, এই তো–আমি একটু আগে বউমাকে বলছিলাম টেলিফোন এলে দু-বেয়ানে দু-দিক থেকে টেলিফোন কানে দিয়ে বসে থাকব।

মিসেস বাসু একবার শুধু তাকালেন তার দিকে, পরে মেয়ের দিকে ফিরলেন। নীরব তাচ্ছিল্যটুকু এমনই স্পষ্ট যে পিসিমা বিব্রত মুখে ওপরের দিকে চোখ তুলে দেখেন সুখেন্দুও তাঁর দিকেই চেয়ে আছে।

মিসেস বাসু মেয়েকে বললেন, কোথা দিয়ে কি হবে না হবে দেখতে এলাম–

অর্চনা বাধা দিল, আচ্ছা সে-সব হবে’খন, তুমি ওপরে চলো।

তুই হড়বড় করিস না, দেখতে শুনতে বুঝতে দে–

দেখতে শুনতে বুঝতে বুঝতে অর্চনার পাশ কাটিয়ে আগে আগেই ওপরে চললেন তিনি। সুখেন্দু সরে গেছে। অর্চনা এবং তার পিছনে পিসিমাও পায়ে পায়ে উপরে উঠতে লাগলেন। একটু আগের উপেক্ষা সত্ত্বেও গৃহকত্রী হিসাবে পিসিমা নিচের থেকেই সরে যেতে পারলেন না।

ওপরে উঠেই সামনের দেয়ালের বারান্দায় টাঙানো চিত্ৰিকরা কুলো, উবুড় করা ডাল। আর পেরেকে ঝোলানো জপের মালার দিকে চোখ পড়তে মিসেস বাসু থমকে দাঁড়ালেন। টেলিফোন প্রসঙ্গ ভুলে গেলেন, চোখে যেন হুল ফুটছে তার। এ-সব সামগ্রী কার জেনেও রাজ্যের বিরক্তিতে মেয়ের উদ্দেশেই বলে উঠলেন, ও কি রে! এখনো সেই ডালা কুলো মালা? সেই কবে না এগুলো এখান থেকে সরাতে বলেছিলাম তোকে–কি যে রুচি তোদের বুঝি না, বাইরের লোক দেখে ভাবে কি?

ত্রস্তে ঘাড় ফেরাল অর্চনা। পিসিমা তার পিছনেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে। লজ্জায় সঙ্কোচে অস্ফুটকণ্ঠে বলে উঠল, আঃ মা–চলো, ঘরে চলো—

তাঁকে একরকম ঠেলে নিয়েই ঘরে ঢুকে গেল সে। হতভম্ব মূর্তির মত পিসিমা দাঁড়িয়ে রইলেন আরো কিছুক্ষণ। তার পর আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে দেয়ালের পেরেক থেকে মালাটা তুলে নিলেন। শ্লথ পায়ে বারান্দার মাথায় নিজের ঘরের দিকে এগোলেন তিনি। অতিথি আপ্যায়নে তাঁর কোন প্রয়োজন নেই বুঝে নিয়েছেন। এক কোণে হরিয়া বসে পূজোর বাসন মুছে রাখছিল। তাকে বললেন দেয়াল থেকে ওই ভাল কুলো নামিয়ে তার ঘরে রেখে আসতে।

ওগুলো ওখানেই থাকবে।

চকিতে ফিরে তাকালেন পিসিমা। তারই ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সুখেন্দু। এ নিয়ে কথা কাটাকাটি করাও লজ্জার, পিসিমা তাড়াতাড়ি অন্যদিকে সরে গেলেন।

অর্চনাও মায়ের ওপর যথার্থ ই বিরক্ত হয়েছে। এসেই এ-রকম একটা কাণ্ড করে বসবে ভাবেনি। তাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে ক্ষুব্ধ অস্বস্তিতে বলে উঠল, ছি ছি ছি, পিসিমা কি ভাবলেন বলো তো?

পিসিম। যাই ভাবুন, মায়ের চোখে মেয়ের এই সঙ্কোচটাই বেশি দুর্ভাবনার কারণ।–তুই চুপ কর, পিসিমার মুখ চেয়ে আমাকে কথা বলতে হবে?

মুখ চেয়ে কথা বললে ক্ষতিটা কোথায় সেটা মাকে বোঝানোর চেষ্টা বিড়ম্বনা। অর্চনার বিরক্তি বাড়লো আরো।–কি দরকার মা তোমার এ-সব নিয়ে মাথা ঘামানোর, এমন এক একটা কাণ্ড করে বসো তুমি লজ্জায় মাথা কাটা যায়। হুট করে একটা টেলিফোন এনে বসলে–এই সেদিন মাসিমার কাছে প্রিন্সিপাল হওয়া-টওয়া নিয়ে কিসব বলেছ–

আগের সঞ্চিত ক্ষোভটাও মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

অবোধ মেয়ের কথা শুনে মিসেস বাসু অবাক প্রথমে। মাসিমা অর্থাৎ বোনের কাছে কি বলেছিলেন তাও মনে পড়েছে।-ও… এই নিয়েও তোকে কিছু বলেছে বুঝি? মেয়ের দিকে চেয়ে জামাইয়ের সাহসের পরিমাণটা আঁচ করতে চেষ্টা করলেন তিনি। তার পর চাপা রাগে কিরে ধমকেই উঠলেন প্রায়, মাসিমার কাছে যা বলেছি তাই যাতে হয় সেই চেষ্টা কর–এই চারশ টাকাতেই দিন চলবে ভাবিস?

সুখেন্দু ঘরে ঢুকল। মায়ের কথা কানে গেছে সেটা তার দিকে একবার চেয়েই অর্চনার অনুমান করতে ভুল হল না। আর জামাইকে হাতের কাছে পেয়ে তাকেই একটু সমঝে দেওয়া প্রয়োজন মনে করলেন মিসেস বাসু। স্পষ্ট অথচ মোলায়েম করে বললেন, এই যে সুখেন্দু, সেদিন তোমার মাসি-শাশুড়ীর কাছে কি বলেছি না বলেছি তাই শুনে নাকি রাগ করেছ শুনলাম।

আঃ, মা-রাগের কথা তোমাকে কে বলল?

বাধা পেয়ে মা বিরক্ত চোখে মেয়ের দিকে শুধু তাকালেন একবার, তার পর জামাইয়ের দিকে ফিরলেন।-যা বলি তোমাদের ভালর জন্যেই বলি। তোমাকেও উন্নতির চেষ্টা করতে হবে, আর ওকেও ওর সংসার বুঝে নিতে হবে–তোমাদের সংসার চিরকাল তো কেউ আগলে বসে থাকবে না।

এ-ধরনের আভাস জামাইকে আগেও দিয়েছেন তিনি। অর্চনার নিরুপায় অবস্থা। মিসেস বানু উঠে জানালার কাছে পানের কুঁচি ফেলতে গিয়ে নিচের দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা সমস্যার সমাধান চোখে পড়ল যেন।–এই তো রে অর্চনা, এখান দিয়েই তো টেলিফোনের লাইনটা সবাসবি তোদের ঘরে আসতে পারে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সুখেন্দু আলনা থেকে জামা টেনে নিয়ে গায়ে পরছে। আর অস্বস্তি নিয়ে তাই দেখছে অর্চনাও। উনি ফিরে চেয়ারে এসে বসলেন আবার। কর্তব্যবোধে যেটুকু বলা হয়েছে তার জন্য একটুও চিন্তিত নন। বললেন, ভাল কথা, সামনের শুক্রবার তো ছুটি তোমাদের? সেদিন দুপুরে আমাদের ওখানেই খাবে, অর্চনাকে নিয়ে একটু সকাল সকালই যেও, বরুণা বলে দিয়েছে। বিজুই খাওয়াচ্ছে অবশ্য, কন্টাক্ট সাপ্লাই করল একটা

দুই এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সুখেন্দু খুব শান্ত মুখে বলল, আমাদের যেতে হলে পিসিমাকে বলে যান।

মিসেস বাসু কথাটা শুনে যে-ভাবে তাকালেন, যেন মুখের ওপর ঠাস করে অপমান করা হল তাকে। প্রথমে অবাক, পরে ক্রুদ্ধ। সুখেন্দু ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বারান্দার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেছে। চকিত বিমুঢ় নেত্রে অর্চনা একবার সেদিকে আর একবার মায়ের রক্তিম মুখের দিকে চেয়েই উঠে তাড়াতাড়ি সিঁড়ির কাছে এগিয়ে এলো। সুখেন্দু অর্ধেক সিঁড়ি নেমে গেছে।

তুমি বেরুচ্ছ নাকি?

সুখেন্দু ঘুরে দাঁড়াল, তার দিকে শুধু তাকাল একবার, তার পর নিচে নেমে গেল।

অর্চনা সিঁড়ির মুখেই দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ।

.

এইটুকু সংসারে খুশীর বাতাস ক্রমশ যেন কমে আসছে। দিনে দিনে অনভিপ্রেত ছায়া পড়ছে একটা।

অর্চনা চেষ্টা করে আগের সেই আনন্দ-ছোঁয়া দিনগুলির মধ্যে ফিরে যেতে। কিন্তু সেটা আর সহজ হয়ে উঠছে না খুব। শাশুড়ীর নির্দেশমত না হোক, সুখেন্দু রোজগার বাড়ানোর ব্যাপারে সচেতন হয়েছে ঠিকই। সকালে সপ্তাহে তিনদিন এম. এ-র ছাত্রী পড়াত, বিকেলেও তিনদিন তিনদিন করে আরো দুটি কলেজের ছাত্রের ভার নিয়েছে। প্রাইভেট কলেজের মাস্টার, সেদিক থেকে কোন বাধা নেই।

ট্যুইশন সেরে ফিরতে তার রাত হয় প্রায়ই। চুপচাপ খাওয়া-দাওয়া সেরে তার পরেও বই নিয়ে পাশের ঘরে পড়তে বসে যায়। ইদানীং পড়ার ঝোঁক বেড়েছে। বেশ রাত করেই শুতে আসে। অচর্ন জেগে কি ঘুমিয়ে ভাল করে লক্ষ্যও করে না। শুয়েই ঘুম। অর্চনার এক-একদিন ইচ্ছে করে ঠেলে তুলে দিতে–এই মেজাজ নিয়ে বিছানায় গা ঠেকাতে না ঠেকাতে এমন ঘুম আসে কি করে ভেবে পায় না। ইজিচেয়ারে বই পড়তে পড়তেও ঘুমিয়ে পড়ে এক-একদিন। অর্চনা ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে নিয়ে আসে। আর বলেও, সুবিধে যদি হয় তোমার বিছানাটা কাল থেকে এ-ঘরেই করে দেব না হয়।

পিসিমা লক্ষ্য করেন সবই। কোথাও একটা গোযোগ শুরু হয়েছে সেটা তিনি ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পারেন। ছেলে বেশির ভাগই চুপচাপ, বউয়ের মুখেও আগের সেই হাসি লেগে নেই। তার মায়ের সেদিনের সেই বিসদৃশ ব্যবহার মন থেকে ঝেড়েই ফেলেছিলেন তিনি। কিছুটা সুখেন্দুর হাব ভাব দেখে, কিছুটা বা বউয়ের প্রতি মমতায়। এই ব্যাপারের কয়েকদিন পরেই গুরুদেবের সঙ্গ ধরে দিনকয়েকের জন্য কাশী যাবার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। অর্চনা একটু চুপ করে থেকে শেষে বলেছে, তার থেকে আমাকেই বিদেয় করে দিন পিসিমা!

বালাই-ষাট! পিসিমা হকচকিয়ে দু-হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে শেষে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন। শেষে রাগ করে বলেছেন, আর কখনো যেন তোমার মুখে এ-কথা না শুনি বউমা। তুমি যে কি, জানলে আর এমন কথা মুখেও আনতে না। তোমার শাশুড়ীর ওই ছবিটার দিকে চেয়ে দেখো!

তিনিই শুধু মনে কোন ক্ষোভ রাখেননি। এমন কি অর্চনার মায়ের ওপরেও না। ভেবেছেন আধুনিক শিক্ষিত মহিলা, এসব সেকেলে ব্যাপার…চোখেও হয়তো সত্যিই লাগে-তাই বলে ফেলেছেন। না বলে মনে মনে পুষে রাখলে কি আরো ভাল হত–তাকে উদ্দেশ করে হয়তো কিছুই বলেননি।

মায়ের কাছে জামাইয়ের তিন-তিনটে টুইশনের খবর অর্চনা বলেনি। তবু জানতে বাকি নেই তার। অন্তর্দাহ তাঁরও দিনে দিনে আরো পুষ্ট হচ্ছে বই কমছে না।

কারণও আছে।

এই দেড় বছরে বিজন আর ননিমাধবের ব্যবসা বলতে গেলে তিনগুণ স্ফীতি লাভ করেছে। অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যটা মহিলার প্রত্যক্ষভাবে যেমনই আনন্দের কারণ, পরোক্ষভাবে তেমনই অনুশোচনার উৎস-ব্যবসায়ের অর্ধেক মালিক ননিমাধব ছেলেটা একেবারে হাতের মুঠোয় ছিল। কেন জোর করেই বিয়েতে বাধা দেননি, সেই পরিতাপটা তিলে তিলে বাড়ছে এখন। এমন কি, বিজনও তার মনের কথা বুঝেই যেন আপসোস করেছে, বাবার আর দুটো দিন সবুর সইল না, দেখলে তো…

ননিমাধব যত বড় আঘাতই পাক, এ বাড়ির সংস্রব ত্যাগ করেনি। এখনো অর্চনাকে দেখলে মুখে তার রুমাল ওঠে, সন্তর্পণে বড় নিশ্বাস ফেলে। মিসেস বার চোখ এড়ায় না, সখেদে নিশ্বাস ফেলেন তিনিও। মনে মনে ভাবেন, যেমন কপাল– সম্ভব হলে বরুণার সঙ্গেই বিয়ে দিতেন। কিন্তু তা হয় না, বরুণা বি. এ. পড়লেও অর্চনার থেকে চার বছরের ছোট। বয়েসের অনেক তফাত হয়ে যায়। সেটা বিজনই মাকে বলেছে। মন বোকর জন্য বরুণার বিয়ের ভাবনাটা প্রকারান্তরে ননিমাধবকে একদিন শুনিয়েছিল সে। ননিমাধব বলেছে, বরুণা ছেলেমানুষ, অল্পবয়সী একটি ভাল ছেলে খোঁজ করা দরকার। খোঁজটা সেও করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে।

ব্যবসায় এমন আচমকা শ্রীবৃদ্ধির ফলেই নিজের জামাইকে আরো বেশি অকর্মণ্য মনে হয়েছে মিসেস বাসুর। তার ওপর এই টুইশনের খবর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটের মত। তার মতে এ-ও নিশ্চেষ্টতার নজির ছাড়া আর কিছু নয়। জ্বালাটা গোপন করা সম্ভব হয় নি তার পক্ষে। কখনো টেলিফোনে কখনো বা সামনাসামনি মেয়েকে বলেন, এভাবে বাড়ি বাড়ি ছেলে পড়িয়েই কাটবে তাহলে, কেমন?

রাগের মাথায় অর্চনা ফিরে মাকেই পাঁচ কথা শুনিয়ে দেয়, আবার যার জন্যে বলা ঘরে এসে এক-একদিন তার সঙ্গেও বোবাপড়া করতে ছাড়ে না। এরই মধ্যে একদিন বাবাও তাকে ডেকে বলেছেন, সুখেন্দুর অত খাটুনির দরকার কি, খরচপত্র খুব বেশি নাকি রে? দরকার হলে আমার কাছ থেকে কিছু কিছু নে না–বিজু তো টাকা-পয়সা দিচ্ছেই এখন, কোন অসুবিধে হবে না।

নিরুপায় ক্ষোভে অর্চনা জ্বলতে জ্বলতে বাড়ি এসেছিল সেদিনও। রাগ বাবার ওপরে নয়, তিনি সাদা মনেই বলেছেন জানে। রাগ মায়ের ওপর, তার গঞ্জনাতেই বাবা ভুল বুঝে বলেছেন। দাদার সামনে বউদির সামনে বরুণার সামনে অর্চনা অনেক কষ্টে সামলেছে নিজেকে, আর বাড়ি এসেই ফেটে পড়েছে একেবারে তুমি এসব ছেলে-পড়ানো মেয়ে-পড়ানো ছাড়বে কি না?

জবাবে সুখেন্দু উঠে গিয়ে পাঁচখানা দশটাকার নোট তার সামনে ফেলে দিয়ে বলেছে, তোমার মাকে দিয়ে দিও।

অর্চনা চুপ একেবারে। আগের দিনই মা কি এক চ্যারিটি শো-এর টিকিট পাঠিয়েছেন দুটো।

নতুন কিছু নয়। উঁচু-মহলের পরিচিত জনের রিলিফ-ফাণ্ড চ্যারিটি শো, অথবা অন্য কোন নিয়মিত উৎসবের টিকিট বিক্রি করতে এলে আত্মসম্মানের তাগিদে মা নিজের জন্য তো বটেই, তাদের অনুরোধে মেয়ে-জামাইয়ের জন্যেও টিকিট না কিনে পারেন না। অবশ্য মেয়ে-জামাইয়ের কাছ থেকে টাকা না নেবার কথা ভেবেই টিকিট কেনেন তিনি। কিন্তু প্রতিবারেই মেয়ের কাছ থেকে হাত পেতে তাকে টাকা নিতে হয়। প্রথম যেবার নিতে চাননি, মেয়ে সেবার টাকা ক’টা একরকম ছুঁড়ে ফেলে দিয়েই চলে গিয়েছিল। কারণটা অবশ্য তিনি জানতেন না। কারণ ছিল। টাকা দেবার দরকার নেই বলায় সুখেন্দু অর্চনার সামনে ঠিক ওভাবেই টাকা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল।

শুধু এই ব্যাপারে নয়, মা একখানা ভাল শাড়ি কিনে পাঠালে পর্যন্ত সুখেন্দু প্রায় আদেশের সুরেই বলে, দাম জেনে দাম দিয়ে দিও। মাসকাবারে টেলিফোনের খরচটাও সে-ই যুগিয়ে আসছে, মা দেবে অর্চনা এ-কথাটা বলতেও ভরসা পায়নি। এমন কি বাড়ির গাড়ি অর্চনাকে নিতে এলেও অসন্তুষ্ট হয়, বলে, গাড়ি পাঠাতে বারণ করে দিও, ট্যাক্সিতে যাবে।

অর্চনা হাসিমুখেই বলেছে একদিন, তুমি তো সঙ্গে যাচ্ছ না–ট্যাক্সিঅলা এই ভরসন্ধ্যেয় আমাকে নিয়ে যদি নিজের খুশিমত একদিকে গাড়ি ছোটায়, তখন?

সুখেন্দু গম্ভীর মুখে টিপ্পনী কেটেছে, ট্যাক্সিতে উঠেই তোমার মায়ের পরিচয়টা দিয়ে দিও আগে, তাহলে আর সাহস করবে না।

অতএব মাইনের টাকায় যে কুলোয় না সেটা ঠিকই। কিন্তু রাগের মাথায় অর্চনার সব সময় সেটা মনে থাকে না। আর থাকে না যখন সুখে এমনি শান্ত অথচ রূঢ়ভাবেই খরচের দিকটা স্মরণ করিয়ে দেয় তাকে। অর্চনা ভাবে মাকে নিষেধ করে দেবে এভাবে যেন খরচ না বাড়ান তিনি। কিন্তু পারে না, তাতে করে বাড়ির সকলেই আরো একটু করুণার চোখে দেখবে। তাছাড়া এ-সংসারের কল্পিত অনটনের ক্ষোভটাই মা ফুলিয়ে ফাপিয়ে বড় করে তুলবেন আরো।

এই টানাপোড়েনের মধ্যেই মর্মান্তিক ব্যাপার ঘটে গেল আবারও। বিজনের জন্মদিন উপলক্ষ সেটা। একান্ত ঘরোয়া অনুষ্ঠান হলেও এবারে এই দিনটার সার্থকতা একটু অন্যরকম। বিজনের কাছে তো বটেই, তার মায়ের কাছেও। ইতিমধ্যে বিজনেরও একখানা গাড়ি হয়েছে, সেই গাড়ি চড়ে ননিমাধবকে নিয়ে আগের দিন সে নিজেই এসে অর্চনাকে বলে গেছে। সুখেন্দু বাড়ি ছিল না, সকালের ট্যুইশন সারতে বেরিয়েছিল।

অর্চনা খুশী হয়েছিল। তাদের বাড়িতে ননিমাধবের সেই প্রথম পদার্পণ। তাকে হাসিমুখে আদর-আপ্যায়ন করেছে। দাদাকে বলেছে, তুমি হোমরাচোমরা মানুষ এখন, নিজে নেমন্তন্ন করতে এসেছ, যাব না বলে কি?

চেষ্টা-চরিত্র করে ননিমাধব বলেছে, আজকাল তো তেমন আসোটাসো না

অর্চনা তক্ষুণি জবাব দিয়েছে, আমাদের তো আর আপনাদের মতো দুজনের দুটো গাড়ি নেই, ইচ্ছে থাকলেও যখন-তখন যাই কি করে! আর বলেছে, আপনি আসতে খুব খুশী হয়েছি, একদিনও তো আসেননি!

এর পর তার পকেটের রুমাল আর পকেটে থাকেনি। অর্চনা তার দিকে চেয়ে সকৌতকে মন্তব্য করেছে, টাকাই করুন আর গাড়িই করুন, সাইকেল-রিকশর ব্যবসায় কিন্তু আপনাকে মানায় না।

পার্টনারের মুখের অবস্থা দেখে বিজনের পর্যন্ত হাসি পেয়ে গিয়েছিল। যাবার আগে আবারও বলেছে, যাস কিন্তু তোরা তাহলে, সুখেন্দুর সঙ্গে দেখা হল না–

দেখা হল না বলেই অর্চনা ভিতরে ভিতরে স্বস্তিবোধ করছে। এসেই চান করে কোনরকমে দুটি মুখে দিয়ে কলেজে যাবার তাড়া। সেই ব্যস্ততার মধ্যে বসে দু মিনিট কথা বলার ফুরসৎও পাবে না। অতিথিরা সেটা না বুঝে ক্ষু হতে পারে।

–আমি বল’খন। চকিতে অর্চনা কি ভেবেছে একটু।–তুমি না হয় পিসিমাকেও বলে রেখে যাও।

বিজন তাই করেছে। পিসিমা খুশী হয়ে অনেক আশীর্বাদ করেছেন।

সকালে অর্চনা সুখেন্দুকে নিজে কিছু বলার অবকাশ পায়নি। তবে তাব খাবার সময় পিসিমা বলেছেন শুনেছে। অর্চনা বিকেলে বলেছে। অন্যত্র যে কোন জায়গায় যাবার কথা উঠলে সুখেন্দুর আগ্রহ অন্যরকম হত। কোথাও যাবার নাম করে অর্চনা দু-পাঁচদিন ছুটি নেবার কথা বললেও হয়তো খুশী হয়েই রাজী হয়। মাঝে-মধ্যে আশাও করেছে তার এত খাটুনি দেখে অর্চনা বলবে। প্রথম দিনের সেই একান্ত দুজনের দিনগুলির লোভ সুখেন্দুর এই একটানা নিস্পৃহতার তলায় তলায় ছড়িয়ে আছে এখনো। যাকে পেয়েছে সেটা কম পাওয়া নয় উপলব্ধি করে বলেই মনে মনে প্রত্যাশা বেশি। তাই অভিমানও বেশি। আর তাই উদাসীনতার রূঢ়তাও বেশি।

আমি যাব কি করে, কাল তো ছুটির দিন নয়!

রাত্রিতে তো—

রাত্রিতে বাড়ি বসে থাকি?

অর্চনা জোর দিয়ে বলেছে, একটা দিনের ব্যবস্থা করে নাও-ও-কাজ তো রোজই আছে। দাদা নিজে এসে বলে গেছে, না গেলে ভয়ানক বিচ্ছিরি হবে।

সুখেন্দু গুম হয়ে বসে রইল। এ সামাজিকতার তাৎপর্য বোঝার মত সুস্থ মেজাজ নয় এখন। উন্টে ভাবল, তার কাজটা অবহেলার চোখে দেখে অর্চনাও, আর বড়লোক দাদা নিজে এসে বলে গেছে সেটাই বড় ওর কাছে।

পরদিনও কলেজে যাবার আগে রাতের নেমন্তম্নের কথা অর্চনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সুখেন্দু চুপচাপ শুনেছে, চুপচাপ কলেজে চলে গেছে। অর্চনা নিশ্চিন্ত ছিল।

কিন্তু অভিমানের সঙ্গে বিবেচনার আপস নেই তেমন। সুখেন্দু বাড়ি ফিরল একেবারে রাতের ছেলে-পড়ানো শেষ করে। আর তার পরে ট্রামে-বাসে না উঠে দেড় মাইল পথ হেঁটে এলো।

হাতমুখ ধুয়ে একটা বই নিয়েই শুয়ে ছিল, আর মনে মনে একটুখানি উষ্ণ আনন্দ উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছিল। এতখানি রূঢ়তার দরুন একটু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ একেবারে কাটিয়ে উঠতে পারছিল না বলেই বোধ হয়।

পিসিমা ঘরে এলেন।–তুই গেলি না যে?

না।

না তো দেখতেই পাচ্ছি, না কেন?

মুখে বলল, আমার কাজটা ওদের কাছে কিছু না হলেও আমার কাছে কম নয়। তারা টাকা দেয়।

পিসিমা বিরক্ত হলেন।–টাকা দেয় বলে কি লোক-লৌকিকতা কিছু নেই, না হয় তাড়াতাড়িই আসতিস একটু।

আমার জন্যে তো আটকায় নি কিছু, যার যাওয়া দরকার সে গেছে–

যাবে না তো করবে কি, কতবার করে টেলিফোনে ডাকাডাকি-তাও তো কতক্ষণ দেরি করেছে। সন্ধ্যে থেকে ঘর-বার করেছে মেয়েটা, শেষে চোখের জল আর সামলাতে পারে না–তোর সবেতে বাড়াবাড়ি!

সঙ্গে সঙ্গে খচ করে লাগল কোথায়। এই শাস্তিই দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা ঠিকমত লেগেছে জেনে ভিতরে ভিতরে এখন অনুতপ্ত একটু। বউ নেই, এই অবকাশে পিসিমা কিছু বলবেন ঠিক করেই এসেছেন। বলেও গেলেন। তোদের হল কি আজকাল আমি তো কিছু বুঝি না, তোর শ্বশুরবাড়ি ভাল লাগে না বলে কি মেয়েটা বাপ-মা ভাই-বোন সব ছেঁটে ফেলে দেবে? সে তো ওই সংসারেই অত বড়টি হয়েছে, না কি, তা সত্ত্বেও এমন ভাল মেয়ে বলেই এ-ভাবে থাকে। ভাইপোকে নীরব দেখে পিসিমা আর একটু চড়লেন এবং আরো একটা খেদ না প্রকাশ করে পারলেন না।-এ-ভাবে চলিস তো নিজেদের সংসার নিয়ে নিজেরাই থাক তোর, দু’বছর হতে চলল একটা ছেলেপুলে হবার নাম পর্যন্ত নেই, মা’টা তো কাঁদতে কাঁদতে চোখ বুজেছে, আমার অত পোষাবে না। সেই বউ এলো, দেখে চোখ জুড়লো, ভাবলাম এবার সব হবে, হতভাগী ওপর থেকে দেখবে–তোদের ব্যাপারখানা কি?

ঠিক সময়টিতে বেশ ভালমতই একটা নাড়া দিয়ে গেলেন পিসিমা। সুখেন্দু উসখুস করতে লাগল। টেবিলের ওপর টাইমপীস ঘড়িটার দিকে চোখ গেল।… ছাত্রের বাড়ি থেকে হেঁটে না এলেও যাওয়া যেত। এখন গেলে হয়তো দেখবে অর্চনা রওনা হয়ে গেছে। অন্যমনস্কতার ফাঁকে মায়ের ছবিটাই নজরে পড়ল। মা ওর দিকেই চেয়ে আছেন।…তার চোখেও পিসিমার অনুযোগ।

কিন্তু আর একদিকের মেঘ তখন ঈশান-কোণে। ওতে শুধু ঝড়ের উপকরণ। অত্যন্ত কাছের মানুষ অপ্রত্যাশিত রূঢ়তায় দূরে ঠেলে দিলে যে অপমান, সেই অপমানের যাতনা নিয়ে অর্চনা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। ফিরেছে তারও চারগুণ বিতৃষ্ণা নিয়ে।

বাপের বাড়িতে পা দিয়েই একটা আলগা খুশীর আবরণে নিজেকে আড়াল করতে চেষ্টা করেছে সে। বাইরের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে, দাদার জন্মদিন উপলক্ষে ঘরের আগের চেহারা বদলে গেছে, দামী সোফা-সেটি এসেছে। মাঝখানের টেবিলে বড় একটা কাচের চৌবাচ্চার ওপর ঝুঁকে রঙিন মাছের খেলা দেখছে দাদা বউদি বরুণা আর ননিমাধব। চৌবাচ্চার জলের ভিতর ইলেকট্রিক বা ফিট, করা, সেই আলোয় চৌবাচ্চাটা ঝকঝক করছে। ওপর থেকে বউদি খাবারের গুড়ো ছড়িয়ে দিচ্ছে বোধ হয়।

সকলের অগোচরে অর্চনা পা-টিপেই বারান্দা ধরে সিঁড়ির দিকে এগোলে। এক্ষুনি আর-একজনের না আসার জেরার মুখে পড়তে চায় না। সিঁড়ির কাছাকাছি আসতে খাবার-দ্বয়ের দিক থেকে মায়ের তপ্তক কানে এলো। বকাবকিটা দাঁতর উদ্দেশে সন্দেহ নেই। এক মুহূর্ত থেমে অচলা চুপচাপ ওপরে উঠে গেল। উদ্দেশ্য, সকলকে একটু অবাক করে দেবার জন্য একেবারে বাবাকে নিয়ে নামবে। আসলে বাবার একটুখানি ছায়া কাম্য নিজের কাছেও সেটা স্বীকার করতে চায় না। বাবার কাছে থাকলে এক মা ছাড়া আর সকলের অন্তত মুখ বন্ধ। আর দরকার হলে মাকে মুখ বন্ধ করতেও শুধু তিনিই পারেন।

ওপরে এসে দেখে বাবার ঘর ফাঁকা। অর্চনা অবাক, নিচেও তো দেখল না। এদিক-ওদিক ঘুরে দেখল একটু। ওপরে নেই। বাবার বিছানাতেই এসে বসল আবার। তাকে না পেয়ে তার কাছে আসার দুর্বলতাটা নিজের চোখেই ধরা পড়ে গেছে হয়তো। ঘরের সর্বত্র অযত্নের ছাপ, অর্চনা সেই কারণেই যেন উষ্ণ হতে চেষ্টা করল। বরুণার ওপরেই চটে গেল, অতবড় মেয়ে করে কি। শেষবার ঘর গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছিল মাস দুই আগে, তার পর আর বোধ হয় হাত পড়েনি। তাকের উল্টো-পাল্টা বইগুলি ঠিক করে রাখল, টেবিলটাও হাতে হাতে গোছাল একটু। কিন্তু এভাবে ওপরে এসে বসে থাকাটা বিসদৃশ। মুখে একটা হালকা ভাব টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

সিঁড়ির কাছাকাছি আসতে ওপরেই দাশুর সঙ্গে দেখা। কিছু একটা হুকুম তামিল করতে এসেছিল বোধ হয়। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে অর্চনা জিজ্ঞাসা করল, বাবা কোথায়?

তাকে দেখে দাশু সানন্দে এক কথার জবাবে অনেক কথা জানিয়ে দিল। যথা দিদিমণিরা এলো না ভেবে মা বহুক্ষণ ধরেই ফাটছিলেন, সেই অবস্থায় বাবু ওকে চুরুট কিনে নিয়ে আসার কথা বলতে মা বাবুকেই দাবড়ে দিলেন, আর ওকে হুকুম করলেন কাজে যেতে। দাশুর অবশ্য হাতে তেমন কাজ নেই, কিন্তু সেটা আর তাকে বলে কেমন করে? বাবু নিজেই চুরুট আনতে গেছেন।

অর্চনা দাশুর ওপরেই রেগে গেল হঠাৎ।–চুরুট ফুরিয়েছে দেখে আগে থাকতে এনে রাখতে পার না? বাক্স থেকে সরাতে তো খুব পারো।

এ-সব অনুযোগ গায়ে মাখার লোক নয় দাশু। গলা খাটো করে প্রায় উপদেশই দিল, তুমি নিচে যাও তো, ওদিকে তোমার কথাই হচ্ছে।

কিন্তু নিচে বসার ঘরে কথা যা হচ্ছে তার একটুখানি কানে আসতে অর্চনা দরজার এধারেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। অপমানের আঘাতে নিস্পন্দ। কারো কোন কথার জবাবে মায়ের নিদারুণ বিরক্তি।–কি জানি আসবে কি আসবে না, মাসের শেষ, হয়তো হাতে কিছুই নেই–আসতে হলেও তো একটা কিছু অন্তত

মা ওটুকু বলেই থেমেছেন। দাদার গলা শোনা গেছে, কি যে কাণ্ড, তা বলে আসবে না কেন?

অর্চনার মাথায় দপ করে যেন আগুন জ্বলল একপ্রস্থ। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে অতিকষ্টে নিজেকে সামলাল সে। বিতৃষ্ণায় মা আজকাল অনেক সময় অনেকের সামনেই তাদের অপদস্থ করে বসে সে-আভাস অর্চনা আগেও পেয়েছে। কিন্তু সেটা যে এ-পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে ভাবতে পারেনি।

ঘরে এসে দাঁড়াতে বিজনই সর্বাগ্রে বলে উঠল, এই তো এসেছে! এত দেরি? সুখেন্দু কই?

সকলের দৃষ্টি দরজার কাছ থেকে ফিরে এলো।

প্রথমেই অর্চনার চোখ গেল ননিমাধবের দিকে। দাদার দিকে ফিরে জবাব দিল, আসতে পারলেন না, কাজে গেছেন এখনো ফেরেননি।

তার বলার ধরনে বিজন মনে মনে অবাক একটু। বিস্ময় প্রকাশ করল, সে কি রে!

ওদিক থেকে বউদি বলে উঠল, ভারি অন্যায়, কোথায় গেছেন বলে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি—

অর্চনা বলল, আমরা ট্রামে-বাসেই চলাফেরা করি বউদি তাঁর আসা সম্ভব নয়।

বউদি থমকে গেল। মা ভুরু কুঁচকে তাকালেন, তার মানে সে আসবে না?

অর্চনা মায়ের চোখে চোখ রাখল! নিজেকে সংযত করতেই চেয়েছিল, কিন্তু সবটা সম্ভব হল না।–সে তো কারো হুকুমের লোক নয় মা, আসতেই হবে ভাবছ কেন?

রাগ ভুলে মা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। মেয়ের কথাবার্তা হাব-ভাব দুর্বোধ্য। শুধু মা-ই নয়, অন্য সকলেও হকচকিয়ে গেছে। একটু। বরুণাই সর্বপ্রথম ঘরর এই থমকানি ভাবটা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করল। অবাঞ্ছিত প্রসঙ্গটাই বাতিল করে দিয়ে তাড়াতাড়ি কাছে এসে দিদির হাত ধরে টানল, ননিদা কি এনেছেন দেখে যা–।

লঘু আগ্রহে কাচের চৌবাচ্চার কাছে নিয়ে এলো তাকে। জলের গাছগাছড়ার মধ্য দিয়ে লাল নীল হলদে সবুজ মাছগুলি খেলে বেড়াচ্ছে।

চমৎকার, না?

খুব সুন্দর। দুই এক মিনিট দেখে অর্চনা এগিয়ে এসে দাদাকে প্রণাম করল। তারপর হাত-ব্যাগ খুলে কেস থেকে ঝকঝকে একটা ফাউন্টেন পেন বার করে তার বুকপকেটে লাগিয়ে দিল।

পেনটা আবার তুলে দেখে বিজন ভারি খুশী।–বাঃ।

বরুণ সাগ্রহে এগিয়ে এলো, দেখি দাদা দেখি- পেন হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে বরুণার আনন্দে যেন লোভ ঝরে পড়ল, ও মা কি সুন্দর। এর যে অনেক দাম রে দিদি, সেই যে তোতে আমাতে একবার দোকানে দেখেছিলাম–

বিয়ের অনেক আগে একবার কলম কিনতে গিয়ে এই জিনিসই একটা দুই বোনের খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু দাম শুনেই তখন সে কলম রেখে দিয়ে অন্য কলম কিনতে হয়েছে। অর্চনার মনে আছে। মনে আছে বলেই দেখার সঙ্গে সঙ্গে এটাই কিনেছে।

বিজন জ্যেষ্ঠোচিত অনুযোগ করল একটু, কি দরকার ছিল তোর এত দামী জিনিস আনার!

কিছু মনে করবার কথা নয়, বরং তুষ্ট হওয়ারই কথা। কিন্তু বাইরের এক জনের সামনেই একটু আগে যে আলোচনা এখানে হয়ে গেছে, সেই ক্ষোভের মাথায় দাদার এই স্বাভাবিক অনুযোগের তাৎপর্য বিপরীত। অর্চনা হাসল একটু। মায়ের দিকে তাকাল এক পলক, পরে দাদার দিকে। তার পর নিরুত্তাপ জবাব দিল, জিনিস দামী না হলে যে দেয় তার দামও একটু কমে যায় দাদা, কিন্তু এমন কিছু দাম নয় ওটার, তবু যদি খুশী হয়ে থাকে। সেই ঢের–

বিজন বিব্রত, একটু আগে মায়ের সঙ্গে আলোচনাটা কানে গেছে কিনা চকিতে সেই সংশয় মনে জেগেছে। মাও ক্রুদ্ধনেত্রে তাকালেন মেয়ের দিকে, খোঁচাটা বোধগম্য না হবার মত অস্পষ্ট নয়। বউদি গম্ভীর। ননিমাধব রুমালে মুখ ঘষছে। বরুণা চোখ বড় বড় করে দিদিকে দেখছে।

আরো একটু বাকি ছিল।

দরজার বাইরে থেকে ডক্টর বানুর গলা শোনা গেল, অর্চনা এলো? ঘরে এসে মেয়েকে দেখে নিশ্চিন্ত।–এই তো, সুখেন্দু কই?

তিনি আসতে পারলেন না বাবা।

কেন? অবাক একটু।

জবাবটা দিলেন মিসেস বাসু। গম্ভীর শ্লেষে বললেন, সে কাজের মানুষ আসবে কি করে, তাছাড়া সে কি হুকুমের লোক আমাদের যে হুকুম করলেই আসবে।

বিরক্তি আর বিতৃষ্ণায় অর্চনা আরক্ত। কিছু না বুঝে ভদ্রলোক ফ্যালফ্যাল করে স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইলেন খানিক। শেষে মেয়ের দিকে ফিরে সহজ অর্থটাই গ্রহণ করলেন।–ও, কাজে আটকেছে বুঝি?

দিদিকে খুশী করার জন্যেই হোক, পরিবেশটা একটু সহজ করার তাগিদেই হোক, বরুণা কলমটা তাড়াতাড়ি বাবার দিকে বাড়িয়ে দিল, দেখ বাবা কি সুন্দর কলম, দিদি এনেছে।

বাবা কলম দেখলেন। তাঁর চোখেও সুন্দরই লাগল আর দামীই মনে হল। কলমের সুখ্যাতি করে সেই সঙ্গে আর যে কথাগুলো বললেন তিনি, তার জন্য দায়ী অন্তত তিনি নন। বললেন, তুই আবার এত খরচ করতে গেলি কেন, ক’টা টাকাই বা মাইনে পায় সুখেন! বুঝেসুজে না চললে ও বেচারী সামলাবে কি করে?

এই দুর্ভাবনা বাবার মাথায় কে ঢুকিয়েছে অর্চনা জানে। হয়তো আজও এই নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে তাকে, নইলে কলম দেখেই আগে খরচের কথাটা মনে হত না। ভিতরে ভিতরে অর্চনা বুঝি ক্ষেপেই গেল এবার। দাতে করে নিজেই ঠোঁট কামড়ে আড়চোখে ননিমাধবের দিকে তাকাল।

মিসেস বাসু স্বামীর দিকে একটা তীব্র দৃষ্টিনিক্ষেপ করে উঠে সোজা দরজার কাছে চলে এলেন। তার পর ঘুরে দাঁড়িয়ে নীরসকণ্ঠে আদেশ দিলেন, বউমা, আর রাত না করে খাবার দেবার ব্যবস্থা করো।

বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে গটগট করে ওপরে উঠে গেলেন তিনি।

অর্চনা সকলের সঙ্গেই খেতে বসেছে। কি খেল তাও বোধ হয় সকলেই লক্ষ্য করেছে। খাওয়া শেষ হতেই ফেরার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। বাবা গাড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন, তাতেও আপত্তি করেনি। বাড়ি ফিরে ধীর শান্ত পায়েই ওপরে উঠেছে।

পিসিমার ঘর অন্ধকার। শুধু ওর ঘরেই আলো জ্বলছে।

বিছানায় শুয়ে সুখেন্দু অন্যমনকের মত দেয়ালে ছবিটার দিকে চেয়ে, বুকের ওপর একটা খোল বই উপুড় করা। বিছানার গা ঠেকানোর সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের অপবাদটা আজ অন্তত প্রয়োজ্য নয়। এক পলক দেখে নিয়ে অর্চনা সোজা তার ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।

সাড়া পেয়ে সুখেন্দু ফিরে তাকাল। দেখল একটু। অনুতাপ প্রকাশের ৰীতি জানা নেই তেমন, চেষ্টা করে নিছক গদ্যাকারের প্রশ্নই করল একটা, হয়ে গেল?

ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে অর্চনা দুল খুলছে কানের। জবাব না দিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল শুধু একবার, তার পর অন্য দুলটা খুলল।

তার দিকে চোখ রেখেই সুখেন্দু আধাআধি উঠে বসল। ওদিকে ফিরে থাকলেও আয়নায় সামনা-সামনি আর পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণের আপসোচিত প্রতীক্ষার পর হঠাৎই খুব ভাল লাগছে সুখেন্দুর। লোভনীয় লাগছে। মেজাজের ঝেকে অনেকদিনের উপোসী চিত্তটা যেন অভীষ্টপ্রাপ্তির তটে বসেও মুখ ঘুরিয়ে ছিল। বুকের তলায় অনেক অতনু-মুহূর্ত হারানোর খেদ।

আয়নার ভিতর দিয়ে কঠিন নিস্পৃহতায় অর্চনাও লক্ষ্য করেছে তাকে। এই মুগ্ধ দৃষ্টির ভাষা জানে। একসঙ্গে বাপের বাড়ি যাবে বলে সচেতন সাজসজ্জায় নিজেকে ঘিরে প্রলোভনের প্রচ্ছন্ন মায়া একটু রচনা করেছিল বটে। কিন্তু যার জন্যে করা, তারই এই বিহ্বল দৃষ্টি-লেহন সব থেকে বেশি অসহ্য এখন। অর্চনা ভাবল, পরিপূর্ণভাবে অপমান করতে পারার অন্তষ্টির ফলেই এই ব্যতিক্রম, সেই তুষ্টির ফলেই আর এক আনুষঙ্গিক তৃপ্তির তাগিদ। দুল টেবিলে রেখে আস্তে আস্তে ঘুরে বসল তার দিকে।

সুখেন্দু চেয়েই ছিল, অপ্রতিভ মুখে হাসল একটু।–শোন—

বলো, শুনছি।

এখানে এসো না—

অর্চনা উঠে সামনে এসে দাঁড়াল। প্রত্যাখ্যানের বর্ম আঁটা।

সুখেন্দু তার হাত ধরে কাছে টেনে বসিয়ে দিল। নিজের একটা আচ্ছন্নতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সেই আনন্দটাই বড়।–রাগ করেছ?

সেটা তো তোমারই একচেটে সম্পত্তি।

সত্যি, এমন হয়–। সুখেন্দু অস্বীকার করল না।–যাইনি বলে নিজেরই

থাক। কঠিন শ্লেষে অর্চনা থামিয়ে দিল।– তাকে কি বলবে বলো।

তার রাগের মাত্রা অনুমান করে সুখেন্দু হাসল একটু। তার পর বলল, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

সুসময়ে তার চোখে এই ক’টি কথার আভাস দেখতে পেলেও অর্চনার খুশী ধরত না। এখন বিদ্রুপের মত লাগল। দারুণ বিরক্তিতে শয্যা ছেড়ে উঠতে গেল।

পারল না। দুই হাতের বেষ্টনে সুখেন্দু তাকে বসিয়েই রাখল। বাপের বাড়ি থেকে অর্চনা কি মন নিয়ে ফিরেছে তার ধারণা নেই। শুধু জানে, ও যায় নি বলেই রাগ। মনোরঞ্জনের কলাকৌশল জানা থাকলে রমণী-মনের দিকটাই আগে বুঝে নিতে চেষ্টা করত, নিজের না যেতে পারার পিছনে নরম কৈফিয়ত কিছু খাড়া করত, আর সন্তপ্ত অনুরাগে তার ব্যথাটাই আগে নিজের বুকে টেনে নিত। কিন্তু সুখেন্দু তার ধারকাছ দিয়েও গেল না, অর্চনার অপমানটা কোথায় গিয়ে বিঁধেছে খোঁজ নিতেও চেষ্টা করল না। মেজাজের বেগটা তার যেমন আকস্মিক, আবেগের মুহূর্তও প্রায় তেমনিই অশান্ত। সঙ্গতির পথে আনাগোনা নয় কোনটারই। তাই নিঃসঙ্গতার আবরণ থেকে নিজের এই সদ্য-মুক্তিটাই বিনম্র আপসের বড় উপকরণ মনে হয়েছে। যেন সেইটুকুই অর্চনার জানবার বিষয়, আর সেইটুকুই তারও জানাবার তাগিদ।

দুই হাতের নিবিড়তার মধ্যে সুখেন্দু তাকে আরও একটু কাছে টেনে নিতে চেষ্টা করল।–সত্যি, শুয়ে শুয়ে আমি এতক্ষণ তোমার কথাই ভাবছিলাম… পিসিমা খানিক আগে খুব বকে গেল আমাকে। হাসতে লাগল মৃদু মৃদু, কি বলল শুনবে?

অর্চনা কঠিন, শান্ত। শোনার কোনো আগ্রহ নেই।

আরো একটু অনুকূল মুহূর্তের আশায় পিসিমার সেই নিগুঢ় বচনটি সুখেন্দু আর একভাবে প্রকাশের চেষ্টা করল।–পিসিমা মায়ের কথা বলেও অনেক দুঃখ করে গেল…মা যে তোমাকে কত চেয়েছিল জান না।

অন্য সময়ে হলে অর্চনা টিপ্পনী কাটত, মা তাকে চায়নি, মা যে কোন একটি ছেলের বউ চেয়েছিল। এখন নির্বাক চোখে শুধু তাকাল তার দিকে। স্পর্শটুকুও যন্ত্রণার মত লাগছে।

সুখেন্দু আরো একটু কাছে ঘেঁষে এলো। মুচকি হেসে চোখে চোখ রাখল। প্রায় গোপন কিছু ফাস করে দেবার মত করেই বলল, মা আরো কিছু চেয়েছিল…!

মা আরো কি চেয়েছিল অর্চনা সেটা খুব ভালই জানে। আভাসে ইঙ্গিতে কখনো বা সরাসরি পিসিমা সেটা অনেকবারই ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আজকের দুঃসহ অপমানের পর এই একজনের মুখেই সেই কথাটা শোনামাত্র দপ করে জ্বলে উঠল একেবারে। এতক্ষণের নির্বাক সহিষ্ণুতার বাঁধ ভেঙে গুঁড়িয়ে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। আচমকা তার হাত ছাড়িয়ে অর্চনা ছিটকে উঠে দাঁড়াল। তীব্র জ্বালায় অনুচ্চ-তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ-কণ্ঠে বলে উঠল, থাক। চাকরি করে ও ছেলে না পড়ালে যাদের দিন চলে না, একটা কলম কিনে নিয়ে গেলেও খরচ নিয়ে পাঁচজনের উপদেশ শুনতে হয়–তাদের আর কিছু চেয়ে কাজ নেই!

এক ঝটকায় পরদা ঠেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সুখেন্দু বিমূঢ়, হতভম্ব। এতবড় সমর্পণের মুখে এমন এক বিপরীত আঘাত আনুভব করতেও সময় লাগে। তড়িতাহত বিস্ময়ে দরজার দিকে চেয়ে রইল সে।

.

পরদাটা নড়ছে।

বিয়ের পর ছদ্ম-অভিমানে প্রথম প্রথম এক-আধদিন সুখেন্দু ঘর-বদল আগেও করেছে।

তাতে ব্যবধান রচনার অভিপ্রায় ছিল না একটুও, বরং গাঢ়তর অনুরাগের প্রত্যাশা ছিল। অর্চনা কোনদিন উঠে এসে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেছে, কোনদিন আপস করেছে, কোনদিন বা নিরীহ মুখে নিজে হাতে তার বালিশ টালিস এনে দিয়ে গেছে–অসুবিধে যাতে না হয়। পাশের ঘরটা সুখেন্দুর শুধু পড়ার ঘর নয়, রাগ হলে গোসা-ঘরও।

তাকে গুম হয়ে থাকতে দেখলে হাসি চেপে কখনো-সখনো অর্চনা নিজেও জিজ্ঞাসা করত, কোথায় শোবে–এই ঘরে, না গোসা ধরে?

এবারে ঘর-বদলের সুরটাই একেবারে ভিন্ন-রাগের।

কোন মান-অভিমানের তাপ নেই, সাধাসাধির প্রত্যাশাও নেই। পাশের ঘরের চৌকিতে বায়ো-মাস একটা গালচে পাতাই থাকে। সুখেন্দু নিজের হাতেই দুটো বালিশ তুলে নিয়ে যায়, আবার সকাল হলে সে-দুটো এ-ঘরে, খাটে ফেলে দিয়ে তার পর বারান্দার দিকের দরজা খোলে। অর্চনা চুপচাপ দেখে একটি কথাও বলে না। রাগ চড়তে থাকে তারও, নির্মম মনে হয় মানুষটাকে সহ করাও সহজ নয়, সাধতে যাওয়া আরো বিরক্তিকর। কাণ্ড একটা সে-ও বাধাত, পিসিমার ভয়ে চুপ করে আছে। নিস্পৃহতার আবরণে গুটিয়ে রেখেছে। নিজেকে।–ক’দিন চলে চলুক। পুরুষের দুর্বার তাড়নার দিকটা তার জানা আছে।

কটা দিন বাদেই অর্চনা শুনল, কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে পাঁচ-সাত দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছে সে। সুখেন্দু নিজে বলেনি, পিসিমা তাগিদ দিয়েছেন, ওর সঙ্গে কি যাবে না যাবে সব ঠিকঠাক করে দাও–।

পিসিমা সেই চিন্তায় মগ্ন ছিলেন বলে অর্চনার অবাক হওয়াটা চোখে পড়ে নি। অর্চনাও মুহূর্তেই সামলে নিয়েছে। পরে সুখেন্দুর সামনে এসে জিজ্ঞাসা করেছে, কোথায় যাচ্ছ শুনলাম?

সুখেন্দু বই পড়ছিল। মাথা নেড়েছে।

কোথায়?

বলেছে।

এডুকেশন টুরে?

সুখেন্দু বইয়ের পাতা উল্টেছে।

আমাকে জানানো দরকার মনে করনি?

সুখেন্দু বই সরিয়েছে।–তোমার মায়ের পারমিশান নেওয়া দরকার ছিল?

মায়ের নয়, আমার জানা দরকার ছিল।

যা-যা লাগতে পারে অর্চনা গোছগাছ করে দিয়েছে। সে যাবার আগে মনটাও নরম হয়েছিল একটু, কিন্তু সুখেন্দু একটা কথাও বলে নি।

ফেরার কথা পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে। ফিরল প্রায় দিন বানো পরে। পিসিমার তাগিদে অর্চনা কলেজে টেলিফোন করে জেনেছে, কলেজের ছেলেরা যথাসময়েই ফিরে এসেছে, শুধু সে-ই ফেরে নি।

ওর যেমন রাগ পড়ে এসেছে, অন্য দিক থেকেও অর্চনা সেই রকমই আশা করেছিল। স্বাভাবিক স্থলে এই কটা দিনের বিচ্ছেদ ব্যবধান ঘোচানোর অনুকুল। কিন্তু সুখেন্দুর একটুও পরিবর্তন নেই, বরং আরো সঙ্কল্পবদ্ধ কাঠিন্য নিয়েই ফিরেছে যেন। আগের মতই নিজের হাতে বালিশ তুলে নিয়ে গিয়ে পাশের ঘরে পৃথক শয্যা রচনা করেছে। আঘাত দেবার বাসনা পোষণ করতে থাকলে চরমে না ওঠা পর্যন্ত বাড়াতেই থাকে সেটা। কদিন বাদে, পিসিমা জানালেন সে-চক্ষুলজ্জাও কাটল। পাশের ঘরের চৌকিতে একটা স্থায়ী শয্যার ব্যবস্থা করে নিল সে। টেবিলসুদ্ধ তার বই আর ঈজিচেয়ারটাও পাশের ঘরে চলে এলো। পিসিমা জানালেন, অনেক রাত পর্যন্ত আজকাল আলো জেলে পড়া না করতে হয় বলেই এই ব্যবস্থা।

তার পর থেকে পিসিমা ভাইপোকে চুপচাপ লক্ষ্য করছেন শুধু। অর্চনাকেও। মুখে কিছু বলেন নি।

কিন্তু অর্চনা বলেছে। সেদিনের সেই একান্ত প্রত্যাশার মুহূর্তে ও-ভাবে আঘাত দিয়ে ফেলে নিরিবিলি অবকাশে অনুতাপ একটু নিজেরও হয়েছে। বাপের বাড়িতে ওর সেইদিনের অপমানে অনুতাপ আর-একজনের হবার কথা। হল না যে সেইখানেই অর্চনার ক্ষোভ। তার ওপর এই রূঢ়তা আরো অপমানকর। তবুও, আগের মত না হোক, মানুষটার স্বভাব জেনে যতটা সম্ভব হালকা গাম্ভীর্যে এই গুমোট কাটিয়ে তুলতেই চেষ্টা করেছে। জিজ্ঞাসা করেছে, তোমার এই এক-একটা রাগের ঝোঁক ক’দিন পর্যন্ত থাকে বলে দাও, ক্যালেণ্ডারে দাগ দিয়ে রাখি।

ফল হয় নি। সুখেন্দুর মুখের রেখাও একটা বদলায় নি।

সেদিন নিজের কাজ সেরে এসে অর্চনা দেখে, পাশের ঘরের দেয়ালের কাছে চেয়ার নিয়ে হরিয়া চাকর নিবিষ্ট মনে দেয়ালে কতকগুলো পেরেক ঠুকছে। অর্চনা জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, কি হবে। তার আগেই টেবিলটার ওপর চোখ পড়তে অবাক! টেবিলে শাশুড়ীর সেই ছবিখানা। হরিয়া ওটা খুলে এনে এ-ঘরে টাঙাবার তোড়জোড় করছে। ওদিকে পিসিমাও এসে দাঁড়িয়েছেন কখন। অবাক তিনিও। হরিয়া জানাল, কলেজ যাবার সময় দাদাবাবু তাকে ছবি ও-ঘর থেকে নামিয়ে এনে এ-ঘরে টাঙিয়ে রাখতে বলে গেছে।

পিসিমার চোখে চোখ পড়তেই অর্চনা তাড়াতাড়ি ঘরে চলে এলো। এই সামান্য একটা ব্যাপারের প্রতিক্রিয়া কম নয়। প্রথমেই মনে হল হরিয়াকে আবার আদেশ দেয়, ছবি যেখানে ছিল সেখানেই রেখে যেতে। পারল না। যেখানে লাগার লেগেছে, ছবি ফিরিয়ে এনে সেই যাতনার লাঘব হবে না। বরং হুকুম যে দিয়ে গেল হাতের কাছে তাকে পেলে সামনা-সামনি বোঝাপড়া হতে পারত। অর্চনা গুম হয়ে বসে রইল খানিক। ও-ঘরে পেরেক পোতার কি-ঠাক শব্দগুলোও কানে লাগছে। অর্চনা নিজের ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকাল। যেখান থেকে ছবিটা নামিয়ে নেওয়া হয়েছে সেখানে চৌকো দাগ পড়ে আছে একটা। সেই দিকে চেয়ে চেয়ে হঠাৎ মনে হল দাগটা যেন অশুভ সূচনা কিছুর।

অশুভ সূচনাই।

জীবনের পাশায় মায়ের দানগুলো বড় নিখুঁত ভাবে পড়ে।

টেলিফোন বাজল। অর্চনা উঠে এসে টেলিফোন ধরল। মায়ের টেলিফোন।

এক জায়গায় বরুণার বিয়ের কথাবার্তা চলছিল কিছুদিন ধরে। অর্চনা শুনেছিল, ছেলের বাড়ির মস্ত অবস্থা নিজেদের বাড়ি-গাড়ি, ছেলেও বড় চাকরি করে। কোন একটা পার্টিতে ছেলের এবং ছেলের বাড়ির সকলের সঙ্গে মায়ের পরিচয়। অর্চনার বিয়ের পর থেকেই মায়ের সঙ্গিনী বরুণা। বড় মেয়ের বেলায় যা তিনি পারেন নি, ছোট মেয়ের বেলায় সেটা পেরেছেন। মনোমত যোগাযোগ একটা ঘটেছে শেষ পর্যন্ত। মায়ের ছেলে পছন্দ হয়েছে, অপর পক্ষের মেয়ে পছন্দ হয়েছে। অবশ্য বরুণা অপছন্দের মেয়ে নয়। আর ছেলের তরফের পছন্দটা আরো জোরালো করে তুলতে হলে মেয়ে ছাড়াও আনুষঙ্গিক আর যা দরকার বিজন দরাজ অন্তঃকরণে তার সবটা ভার নিয়েছে। খরচপত্র যা লাগে লাগুক, ভাল বিয়ে হোক একটা–।

সেই বিয়ের কথাবার্তা পাকা এতদিনে।

টেলিফোনে মিসেস বাসু বড় মেয়েকে সেই সংবাদ দিলেন।

অর্চনা যথার্থ খুশী। এমন কি ক্ষণকাল আগের গুরুভারও অনেকটা হালকা হয়ে গেল। সানন্দে বলল, খুব ভাল মা, খুব ভাল হল।

ভাল যে হল সেটা মা খুব ভাল করেই জানেন। কিন্তু বড় মেয়ের ব্যাপারে সেই ভাল না হওয়ার খেদ তাঁর দিনে দিনে বেড়েছে বই একটুও কমে নি। ফলে এই মেয়ের জন্যেই তাঁর দুশ্চিন্তা আর দরদ বেশি। অথচ কিছুকাল ধরে তিনিও অনুভব করেছেন, মেয়ের নিরঙ্কুশ ভবিষ্যৎ-রচনা সব চেষ্টাই তাঁর ব্যর্থ। শুধু তাই নয়, মেয়েও যেন মনে মনে বিরাগ তাঁর ওপর। বিজ্ঞানের জন্মদিনে সেটুকু স্পষ্টই উপলব্ধি করেছেন তিনি। মেয়ে অবুঝ, মেয়ের এই মনোভাব তিনি গায়ে মাখেন না অবশ্য। কিন্তু সেটাও দুর্ভাবনার কারণ তো বটেই। ওকে সুদ্ধু বিগড়ে দিলে আশার আর থাকল কি? সেই কারণে জামাইয়ের ওপর সম্প্রতি আরো বেশি বিরূপ তিনি। শুধু জামাইয়ের ওপর নয়, এ-বাড়ির আর এক নির্বিরোধী মহিলার ওপরেও। অযাচিত অবাঞ্ছিত ভাবে যিনি মেয়ের সংসারটিকে আগলে আছেন বলে তার বিশ্বাস, আগলে থেকে মেয়ের সামান্য ভবিষ্যৎটুকুও ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছেন।

সম্প্রতি মেয়ের অশান্তির একটু-আধটু আভাস তিনিও পাচ্ছেন। আগের মত আর তেমন হৈ-চৈ করে না, তেমন খোলা-মেল হাসে না। আসেও না বড়। দুশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় মিসেস বাসু মনে মনে অস্থির। তাই বরুণার বিয়ে উপলক্ষ করে শক্ত হাতে আর একবার হাল ধরবেন মনস্থ করেছেন। মেয়েকে কিছুকাল এখানে আটকে রেখে জামাইয়ের সঙ্গে পষ্টাপষ্টি ফয়সালা করে নেবেন একটা। তাঁর কাছে থাকলে মেয়ের আলগা ভয়-ভাবনা সঙ্কোচও কাটবে কিছুটা।

তাঁর টেলিফোন শুধু বরুণার বিয়ের খবর জানার উদ্দেশ্যেই নয়।

কিন্তু সংকল্পটা আপাতত ঘুরিয়ে ব্যক্ত করলেন তিনি। প্রথমেই জেনে নিলেন সুখেন্দু ঘরে আছে কি না। তার পর প্রস্তাব করলেন, আসছে রবিবার বিজন আর বউমা ছেলের বাড়ি যাচ্ছে আলাপ-পরিচয় করতে, অর্চনাকেও যেতে হবে। অতএব কালই যেন সে চলে আসে, শুধু তাই নয়, এবারে এসে মাস দুই তাকে থাকতে হবে-নইলে বাড়িটা একেবারে খা খা করবে।

অর্চনা রবিবারে ছেলের বাড়ি যেতে রাজী, কিন্তু দ্বিতীয় প্রস্তাবে তার আপত্তি। বলল, অতদিন থাকব কি করে মা…

টেলিফোনের ওপার থেকে মায়ের বিরক্তি।–কেন, অসুবিধেটা কিসের, বিয়ের এই দু-বছরের মধ্যে একসঙ্গে দশটা দিনও এসে থেকেছিস? বিয়ে হয়েছে বলে কি মাথা কিনেছে নাকি তারা?

তাঁর দিক থেকে বড় সুসময়ে বলেছেন কথা ক’টা। এখানকার এই আবহাওয়া অর্চনাও বরদাস্ত করে উঠতে পারছিল না। আজকের গ্লানি আরো দুর্বহ।…দিনকতকের জন্য সরে গেলে মন্দ হয় না। ফোটো আপনিই আবার এ-ঘরে এনে টাঙাতে বাধ্য হয় কি না দেখা যেতে পারে। বিয়ে হয়েছে বলে সত্যিই তো মাখা বিকোয় নি। মেজাজের মাত্ৰাজ্ঞান নেই যখন মেজাজ নিয়েই থাকুক কিছুদিন।

অন্যমনঙ্কের মত বলল, আচ্ছা, পিসিমাকে বলে দেখি–।

পিসিমাকে আবার বলবি কি। মায়ের কণ্ঠস্বর চড়ে গেল, সুখেন্দুকে বলে সোজা চলে আসবি, বলবি আমি বলেছি।

আ-হা, তুমি বুঝছ না–

সঙ্গে সঙ্গে পাশের ঘরে উঁচু থেকে কিছু একটা পড়া এবং ঝন ঝন ভাঙার শব্দ। অর্চনা চমকে তাকাল। রিসিভার কান থেকে সরে গেছে, মায়ের কথা কানে গেল না। ওধার থেকে পিসিমার উগ্রীব কণ্ঠ-বউমা, ও বউমা, কি ভাঙল?

কি ভেঙেছে অর্চনা না দেখেই অনুমান করতে পারে। টেলিফোনে মুখ নামিয়ে বলল, এখন থাক মা, পিসিমা ডাকছেন–

মেয়ের কথায় ওদিক থেকে মায়ের গা জ্বলে গেল…টেলিফোনে কথা কইছিস– পিসিমা ডাকছেন কি?

পিসিমা পূজোয় বসেছিলেন, জবাব না পেয়ে আরো উৎকণ্ঠিত।–কি ভাঙল? ও বউমা–

অর্চনা এবারে সাড়া দিল, যাই পিসিমা–। এদিকে টেলিফোন ছেড়ে দিলে মা চটবেন ভেবে তাকে বলল, আচ্ছা তুমি একট ধরে মা, আমি এক্ষুনি আসছি।

রিসিভার টেবিলে নামিয়ে রেখে ভিতরের দরজা দিয়ে পাশের ঘরে এসেই অর্চনা স্তব্ধ। শাশুড়ীর ছবি মেঝেতে উল্টে পড়ে আছে, কাঁচ ভেঙে ছত্রধান। হতভম্ব হরিয়া হাতে করেই কাচের টুকরো কুড়োচ্ছ।

পূজোর আসন ছেড়ে পিসিমাও উঠে এসেছেন। ঘরের অবস্থা দেখে তিনি আর্তনাদই করে উঠলেন। হরিয়ার উদ্দেশে বলে উঠলেন, ওরে ও হতভাগা, ছবিটা ফেললি কি করে?…বউমা, দেখ ছবিটা গেল কি না…

এগিয়ে এসে অর্চনা ছবিটা তুলল। কাচ নয় শুধু, ফ্রেমও ভেঙেছে। জায়গায় জায়গার কাচ বিঁধে আছে। মূর্তিটি অক্ষত আছে এই যা। বলল, না ছবি ঠিক আছে।

সুখেন কলেজ থেকে ফেরবার আগে ওটা বাঁধিয়ে আনার ব্যবস্থা করো। …সখেদে হরিয়াকে তাড়া দিলেন তিনি, এই জংলি, ওগুলো রেখে ছবি নিয়ে আগে দোকানে যা শিগগির

ঘাবড়ে গিয়ে হরিয়া কাচ কুড়ানো ছেড়ে তাড়াতাড়ি ফোটো নেবার জন্য হাত বাড়াতে অর্চনা দেখে তার হাত কেটে রক্তাক্ত।–আবার হাতও কেচ্ছে, দেখি–ইস!

বেশিই কেটেছে মনে হল। সমস্ত হাত রক্তে মাখা। ছবিটা অর্চনা দেয়ালের এক ধারে সরিয়ে রেখে হরিয়াকে নিয়ে বাইরে এলো। তার হাতে জল ঢেলে দিতে দিতে ঘরে আয়োডিন-তুলো আছে কিনা ভাবতে গিয়ে কি মনে পড়ল।…মা টেলিফোন ধরে আছেন। মুখ তুলে দেখে পিসিমা তখনো দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে। বলল, পিসিমা, মা টেলিফোনে রয়েছেন, আপনি একটু বলে দিন না আমি পরে টেলিফোন করব’খন।

অর্চনা হরিয়ার হাত দেখায় মন দিল আবার, ক’জায়গায় কেটেছে ঠিক নেই।

টেলিফোন কানে লাগিয়ে পলে পলে জ্বলছিলেন মিসেস বাসু। যে মেয়ের জন্য এত ভাবনা তার, সে-ই যদি এমন হয় তিনি পাবেন কি করে। ভাক শুনেই অন্তে এ-ভাবে টেলিফোন ফেলে চলে যাওয়াটা অসহ তার কাছে। আর গেছে তো গেছেই। এমন নিরীহ বশ্যতার দরুন মেয়ের ওপরেই মর্মান্তিক ক্রুদ্ধ। ওদিক থেকে টেলিফোন তোলা বা ভাল করে সাড়া পাওয়ার আগেই সপ্তকণ্ঠে ছিটকে উঠলেন তিনি।–দ্যাখ, এখনো নিজের ভাল বুঝতে শেখ,–উঠতে পিসিমা বসতে পিসিমা–টেলিফোনে কথা কইছিল, তাও পিসিমা–তোর হল কি?

এদিকের মহিলাটি হঠাৎ যেন হকচকিয়ে গেলেন একেবারে। নিজের অগোচরে সাড়া দিতে গেলেন, আমি–

আমি-আমি অনেক শুনেছি।…রাগের মাথায় মিসেস বাসু ভাবতেও পারেন না কি অঘটন ঘটাতে বসেছেন! রূঢ় কণ্ঠেই ঝাঁকিয়ে উঠলেন তিনি-অনাথা, বিধবা মানুষ বাড়িতে আছে থাক, তা বলে তার এত কর্তৃত্ব কিসের? আর তোদেই বা তাকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন? তুই এখানে এসে থাকবি দু-মাস তাকে বলেছিস?

সাড়া নেই। আচমকা আঘাতে পিসিমা একেবারে বিমূঢ়।

মেয়ে ঘাবড়ে গেছে ভেবে মিসেস বানুর অসহিষ্ণু নির্দেশ, তোর ভয়টা কিসের? পষ্ট জানিয়ে দিবি আমি বলেছি তুই এখানে এসে থাকবি দু’মাস। না পারিস আমিই সুখেনকে বলব–

আরো দুই-এক মুহূর্ত পাথরের মত দাঁড়িয়ে থেকে পিসিমা এবারে সাড়া দিলেন। শান্ত গম্ভীর স্বরে বললেন, আমি পুখেন্দুর পিসিমা…বউমা আপনাকে পরে টেলিফোন করবেন জানিয়েছেন।

রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। পাংশু, বিবর্ণ সমস্ত মুখ। খেয়াল হতে দেখেন সাবি অবাক চোখে তাকেই দেখছে। সে ওপরে আসতে বউদিমণি তাকে ঘর থেকে আয়োডিন-তুলে এনে দিতে বলেছিল। তাঁর টেলিফোনের কথাগুলো নয়, মূখের এই ভাবান্তরটুকুই সাবির বিস্ময়ের কারণ।

কি চাস?

আয়োডিন-তুলো–

নিয়ে যা।…তার পাশ কাটিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। অদূরে ও-দিক ফিরে অর্চনা হরিয়ার হাত উল্টে-পাল্টে দেখছে। কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে এসে অনুভূতিশূন্য মূর্তির মত বসে রইলেন তিনি।

হরিয়ার হাতের ব্যবস্থা করে অর্চনা ফিরে এসে ঘর পরিষ্কার করল। তার পর কি ভেবে শাশুড়ীর ছবিটা নিজেই বেরিয়ে ছবি-বাঁধাইয়ের দোকানে দিয়ে এলো। সন্ধ্যার আগে আবার গিয়ে নিয়েও এলো। এ-বেলা হরিয়া আসেই নি। সদ্য-বাধানো ছবি অর্চনা পাশের ঘরে সুখেন্দুর টেবিলের ওপরেই রেখে দিল।

পিসিমার সামনা-সামনি বার-কতক এসেছে। নিজের ভিতরটা সুস্থির থাকলে তার স্তব্ধতা অস্বাভাবিক লাগত। যেটুকু চোখে পড়েছে, ভেবেছে, ছবিটা ওভাবে ভেঙেছে বলে মন খারাপ, আর ওদের ব্যাপারটা অনুমান করেই কিছুটা গম্ভীর এবং অপ্রসন্ন।

বাড়ি ফিরে মায়ের ছবি টেবিলের ওপর দেখে সুখেন্দু প্রথমেই হরিয়ার উদ্দেশে হাঁক দিল। তার পর সদ্য পালিশ করা নতুন ফ্রেম নজরে পড়তে সেটা হাতে তুলে নিল। হরিয়ার বদলে জলখাবার হাতে অর্চনা ঘরে ঢুকেছে।–হরিয়া এ-বেলা আসে নি, জ্বর হয়ে থাকতে পারে, হাত অনেকটা কেটেছে। ছবি টাঙাতে গিয়ে ফেলে ভেঙেছিল, কাল আসে তো আবার চেষ্টা করা যাবে।

এই ফ্রেম আগে যা ছিল তার থেকে সুন্দর তো বটেই, দামীও। পছন্দটা হরিয়ার নয় বুঝেছে। ছবিটা টেবিলে রেখে সুখেন্দু, চুপচাপ হাতমুখ ধুয়ে এলো। অর্চনা নিঃশকে অপেক্ষা করছিল, তার খাওয়া শেষ হতে বলল–কাল আমি মায়ের ওখানে যাচ্ছি, কিছুদিন সেইখানেই থাকব ঠিক করেছি।

বলার সঙ্গে সঙ্গে ওদিকের প্রচ্ছন্ন অসহিষ্ণুতা উপলব্ধি করা গেল। সুখেন্দু উঠে টেবিলের একটা দরকারী বই-ই যেন উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগল।–পিসিমাকে বলে যাও।

তোমাকে বলার দরকার নেই?

ঠিক করে ফেলার পর আর না বললেও চলে।

অর্চনা চুপচাপ দেখল দেখল একটু।–-ঠিক আজই করেছি…ঘর থেকে তোমার মায়ের ছবি সরানোর পর। তখন তুমি ছিলে না।

সুখেন্দু চকিতে তাকাল একবার। আঘাতের বিনিময়ে ক্ষোভ অথবা সমর্পণটাই হয়তো স্বাভাবিক প্রত্যাশা। অন্যথায় ফল বিপরীত। সশ্লেষে জিজ্ঞাসা করল, আপাতত তাহলে বেশ কিছুদিনই সেখানে থাকবে?

তার দিকে চোখ রেখেই অর্চনা হাসল একটু, তার পর খুব সহজ ভাবেই জবাব দিল, কি করে বলি…আমার এখানে থাকাটা তেমন অসহ হবে না বুঝলে আগেই না-হয় গিয়ে নিয়ে এসো।

চলে এলো। বই ফেলে সুখেন্দু গুম হয়ে চেয়ারে এসে বসল আবার। একবার ইচ্ছে হল তক্ষুনি ডেকে বলে দেয়, কোথাও যাওয়া হবে না। কিন্তু সেটা বলার মতও কোথাও যেন জোরের অভাব। অর্চনা হয়তো মুখের দিকে চেয়ে থেকেই হাসবে আবার আর বলবে, আচ্ছা যাব না।

বাধা দেবার মত জোরালো অথচ নিস্পৃহতর একটা উপলক্ষ মনে পড়ে গেল।…পিসিমা কি মনে করবে? পিসিমা দুঃখ পেতে পারে তেমন কারো ছেলেমানুষিই সে বরদাস্ত করবে না। তক্ষুনি উঠে পাশের ঘরে এসে দেখে অর্চনা নেই। বারান্দায় নেই। বোধহয় নিচে। ঝোঁকের মাথায় সামনে পেলে বলে ফেলত। না পেয়ে ভাবল পরে বলবে।

বারান্দায় পায়চারি করল দুই-একবার। পিসিমার পূজোর ঘরের দিকে চোখ পড়তে অবাক একটু। এ-সময়টা ও-ঘর অন্ধকার থাকে না বড়। পায়ে পায়ে সেই দিকে এগুলো। এমনিই। পাশে পিসিমার শোবার ঘরেরও আলো নেবানো। ফিরে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। মনে হল, কোণের দিকে মেঝেতে কেউ বসে। ঘরে ঢুকে আলো জ্বলল।

পিসিমাই। দেয়ালে ঠেস দিয়ে নিঃশব্দে বসে ছিলেন। দুই চোখে জলের ধারা। বিষম চমকে উঠে তাড়াতাড়ি আঁচলে করে চোখ মুছতে লাগলেন তিনি।

সুখেন্দু নির্বাক খনিকক্ষণ।– কি হয়েছে?

কিছু না, এমনি বসে ছিলাম।…এই অবস্থায় তাকে দেখে ফেলাটা সামলে নিয়ে সহজ হতে চেষ্টা করলেন।–তুই কখন এলি, খেতে-টেতে দিয়েছে?

সুখেন্দু কাছে এগিয়ে এলো। আবারও নিরীক্ষণ করে দেখল।–কি হয়েছে?

কিছু না রে বাবা, ব্যস্তভাবে উঠে দাঁড়ালেন–কত সময় কত কি মনে পড়ে– যাই রাত হয়ে গেল।

তাড়াতাড়ি ঠাকুরঘরের দিকে পা বাড়ালেন। চুপচাপ আরো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সুখেন্দু নিজের ঘরে চলে এলো। একটু বাদে বইখাতা নিয়ে ছেলে পড়াতে চলে গেল। পিসিমাকে ওভাবে দেখে হঠাৎ ধাক্কাই খেয়েছে একটা। কিছু ভাবতে পারছে না।

সেই রাতেই অর্চনা পিসিমার কাছে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাপের বাড়ি গিয়ে কিছুদিন থাকার প্রস্তাবটা উত্থাপন করল। আগে বোনের বিয়ের খবর জানাল, তারপর বলল, মা কিছুদিন গিয়ে থাকার জন্যে বার বার করে বলেছেন–

পিসিমার শুকনো উত্তর, আমাকে বলার কি আছে, সুখেনকে বলো–

এভাবে কথা বলতে অর্চনা শোনে নি কখনো। বোনের বিয়ে শুনেও একটা কথা জিজ্ঞাসা করলেন না সেটা আরো অপ্রত্যাশিত। তবু নিজে থেকেই অর্চনা বোনের বিয়ের প্রসঙ্গে এটা-সেটা জানাল। কিন্তু কোন সাড়া পেল না বা আগ্রহ দেখল না। উল্টে কেমন একটা রুক্ষ নীরবতাই লক্ষ্য করল। এই প্রথম অর্চনা মনে মনে বেশ ক্ষুণ্ণ হল তার ওপরেও।…বাড়ির ছেলেটি তুষ্ট না থাকলে ও কেউ নয়, এই আচরণে পিসিমা সেটাই স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন বোধহয়।

রাত্রিতে খাবার টেবিলে বসে সুখেন্দু নিজে থেকে কথা বড় বলেই না। আজকাল। খেয়ে চুপচাপ উঠে চলে যায়। এক একদিন অর্চনা সঙ্গে না বসেও দেখেছে, তাও কিছু জিজ্ঞাসা করে নি। কিন্তু সেই রাত্রিতে খেতে বসে ভাতে হাত দেবার আগেই ওর দিকে তাকাল! কিছু যেন নিরীক্ষণ করছে। অর্চনা ফিরে তাকাতে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করল, পিসিমার কি হয়েছে?

অর্চনা মনে মনে অবাক; এরকম প্রশ্ন কখনো শোনে নি।–-কি হবে?

জানো কি না জিজ্ঞাসা করছিলাম।

জিজ্ঞাসাটা জেরার মত লেগেছে অর্চনার। নিরুত্তাপ জবাব দিল, তোমাদের এখানে কার কখন কি হয় এই দু-বছরেও ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি।

খেতে খেতে সুখেন্দু তেমন ঠাণ্ডা গলায় বলল, পারলে ভাল হত।

অর্চনা চেষ্টা করল হাসতে, তার এবারের উক্তিটা বিদ্রুপের মতই শোনাল। কি আর করবে বলো, তোমাদের বরাত মন্দ …কি ভাবে বুঝতে হবে বলে দিলে চেষ্টা করে দেখতে পারি–

পরদিন যাবার আগে পিসিমাকে প্রণাম করার সময়ও একটি কথা বললেন না তিনি। ক’দিন থাকবে বা কবে ফিরবে, কিছু না। পিঠে হাত রেখে শুধু নির্বাক আশীর্বাদ করলেন একটু। সুখেন্দু বাড়ি নেই, সকালের টুইশনে বেরিয়েছে। তার ফেরার সময় হয়ে গেছে। ফেরে নি।

অর্চনা নীরব অভিমানে বাপের বাড়ি চলে গেল।

.

পাঁচ-ছ দিনের একটানা গাম্ভীর্যের পর পিসিমাকে প্রায় আগেই মতই সহজ হতে দেখা গেল সেদিন। সকালে সাবি রাধুনী অগোছালো কাজের দরুন বকুনি খেয়ে নিশ্চিন্ত, হরিয়া চাকরও হুকুম তামিল করে হালকা একটু। এই ক’দিনের মধ্যে সেদিন রাতেই বউয়ের ঘরটা অন্ধকার দেখে নিজেই ভিতরে এসে আলো জেলে দিলেন। শূন্য ঘরটার চারদিকে চেয়ে কেমন শূন্যতাও বোধ করলেন তিনি। দেয়ালের গায়ে ঠিক আগের জায়গায় সুখেনের মায়ের ছবিটা টাঙানো দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন! অর্চনা চলে যাবার পর সুখেন্দু নিজের হাতে এটা আবার এখানেই টাঙিয়ে রেখেছিল।

ভিতরের দরজা দিয়ে পিসিমা পাশের ঘরে এসে দাঁড়ালেন। সুখেন্দু ঈজিচেয়ারে বসেছিল। এ ঘরে আলো জ্বলতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে এদিকেই তাকিয়েছিল সে। পিসিমা বললেন–এ ঘরটা অন্ধকার করে রাখিস কেন,মেয়েটা না থাকলে এমনিতেই বর খাঁ খাঁ করে।

ব্যতিক্রম দেখে সুখেন্দুও বোধ হয় হালকা নিবাস ফেলল। পিসিমা সামনে এসে দাঁড়ালেন। হ্যাঁ রে, বউমা ফিরছে কবে?

সুখেন্দু অবাক একটু।–কিছুদিন তো সেখানে থাকবে শুনেছিলাম…তোমাকে বলে যায় নি?

পিসিমা জবাব দিলেন, বলেছে হয়তো…আমারই খেয়াল নেই। যাক তুই কালই গিয়ে নিয়ে আয় তাকে, আর যে-দুটো বাড়িতে আছে তাদের তো খাস জ্ঞান গম্যি–সময়মত হয়তো একটু ধূপধুনোও পড়বে না।

সুখেন্দু নিরুত্তরে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। আরো কিছু বক্তব্য আছে অনুমান কবেই শেষে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

জবাবে খুব সাদাসিধে ভাবেই যে সঙ্কল্পটি ব্যক্ত করলেন, শুনে নির্বাক কিছুক্ষণ। আগামী পরশু তিনি হরিদ্বার যাচ্ছেন জায়ের কাছে। জা কতকাল ধরে লেখালেখি করছেন যাবার জন্যে, কিন্তু হয়ে আর ওঠে না। এবারে মনস্থ করেছেন যাবেন। হরিদ্বারে চিঠি লিখে জানানোও হয়ে গেছে। যাবার সঙ্গীও জুটে গেছে, তার গুরুদেব-বাড়ির আরো কারা যাচ্ছে সেদিন। তাই বউমাকে কালই গিয়ে ওর নিয়ে আসা দরকার।

যত সহজ ভাবেই ইচ্ছাটা ব্যক্ত করুন তিনি, শোনা মাত্র সুখেন্দুর মনে গভীর একটা আঁচড় পড়ল। স্থির দৃষ্টি তার মুখের ওপর সংবদ্ধ।…সেজন্যে তোমার যাওয়া আটকাবে না।…কবে ফিরবে?

জবাব দিতে গিয়ে বিব্রত বোধ করছেন, দৃষ্টি এড়াল না। বললেন, আমি আপাতত ওখানেই থাকব ঠিক করেছি রে।আরো সহজ ভাবে প্রসঙ্গ নিষ্পত্তির চেষ্টা করলেন তিনি-ক’বছর আগেই তো যাব ঠিক ছিল, তোর মায়ের জন্য পণ্ড এবারে আর আটকাস না বাবা।

সুখেন্দু চেয়েই আছে। দেখছে। চেয়ার ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। জানালার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে তাকাল একবার। টেবিলের কাছে এসে অন্যমনস্কের মত একটা বই নাড়াচাড়া করল। তারপর ক্ষুদ্র জবাব দিল, আচ্ছা।

পিসিমা যেতে গিয়েও ফিরে দাঁড়ালেন। দেখলেন একটু।–হ্যাঁ রে, রাগ করলি?

সুখেন্দু মাথা নাড়ল, রাগ করে নি। তারপর শান্ত মুখে বলল, তুমি এখানে। থাকতে পারবে না আমি আগেই জানতুম পিসিমা, কিন্তু সে-যে এত শিগগির, ভাবি নি।

হাতের বইটা ফেলে পিসিমার খুব কাছে এসে দাঁড়াল সে। কণ্ঠস্বর বদলে গেল।–পিসিমা, কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?

স্পষ্ট বিড়ম্বনা–এই দ্যাখো… আমাকে আবার কে কি বলবে।

পিসিমার বাহুতে একখানা হাত রাখল, সুখেন্দু। আবার জিজ্ঞাসা করল, কেউ বলেছে কিছু?

অর্থাৎ এবারে সে গা ছুঁয়ে জিজ্ঞাসা করছে, সত্যি না বললে ওরই অকল্যাণ। পিসিমার এই দুর্বলতা সুখেন্দুর জানা আছে। জবাব শোনারও আর দরকার ছিল না, তাঁর বিব্রত মুখভাবেই জবাব লেখা।

পিসিমা জোর দিয়েই বললেন, না রে না, যা ভাবছিস তা নয়, বউমা আমাকে কোনদিন এতটুকু অশ্রদ্ধা করে নি।

সুখেন্দু তাঁর বাহু থেকে হাত নামাল না তবু। স্থির নিস্পলক চেয়ে আছে।–বউমা ছাড়াও অশ্রদ্ধা করার লোক আছে, তার মা বা আর কেউ কিছু বলেছে?

ধরা পড়ে পিসিমা ফাঁপরে পড়ে গেলেন একেবারে। নিরুপায় মুখে রাগ দেখালেন, পাগলামো করিস নে, আর কারো কথায় আমার কি আসে যায় বউমাকে কালই গিয়ে নিয়ে আয়, বলবি আমি ডেকেছি।

সুখেন্দু হাত নামিয়ে নিল। যেটুকু বোঝার বুঝে নিয়েছে। আঘাতটা কোথা থেকে এসেছে অনুমান করতে পেরেছে। চুপচাপ চেয়ারে এসে বসল আবার।

তার মুখের দিকে চেয়েই পিসিম নির্বাক খানিকক্ষণ। যা গোপন করে নিঃশব্দে চলে যেতে চেয়েছিলেন সেটা যেন উল্টে আরো বেশিই স্পষ্ট হয়ে গেল। গেল বলেই সমস্ত মুখে ব্যথার ছাপ দু’চোখ ভরে জল আসার উপক্রম। সামলে নিয়ে আর একটু কাছে এলেন। স্পষ্ট কোমল সুরে বললেন–দ্যাখ, তোকে একটা কথা বলব–

কঠিন গাম্ভীর্যে সুখেন্দু চোখ তুলে তাকাল শুধু।

বউমা খু-ব লক্ষ্মী মেয়ে, আমার চোখ অত ভুল করে না। তাকে তুই কক্ষনো দুঃখ দিস নে–

চোখের জল সংবরণ করে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

পরদিন সকাল দুপুর পেরিয়ে বিকেল গড়াতে চলল। বউমাকে কোন খবর দেওয়া হয় নি বা হবে না সেটা তিনি আগেই অনুমান করেছেন। একবার ঠিক করলেন, নিজেই টেলিফোনে ডাকরেন তাকে। আবার ভাবলেন, হরিয়াকে পাঠিয়ে খবর দেবেন। সে বাড়ি চেনে। শেষে কি ভেবে কিছুই করলেন না। তার পরদিনও গোছগাছ করতে করতে সকাল কেটে গেল। সেই দিনই বিকেলে গাড়ি। সুখেন্দু কলেজে যাবার আগে বলে গেছে, সে-ই এসে সময় মত স্টেশনে পৌঁছে দেবে। গোছগাছের ফাঁকে ফাঁকে পিসিমা হরিয়া আর সাবিকে বাবতীয় খুঁটিনাটি নির্দেশ দিলেন! আর হরিয়াকে বলে রাখলেন, সে যেন চলে না যায়, কাজ আছে।

দ্বিপ্রহরের মধ্যে সব সেরে রেখে চাবির গোছা আঁচলে বেঁধে হরিয়াকে ডাকলেন, আয় আমার সঙ্গে।

.

এই কটা দিন খানিকটা হৈ-চৈএর ওপরেই কাটিয়েছে অনা। ভিতরের তাপ একটুও বুঝতে দেয় নি। বরুণাকে আলটেছে, বউদির নভেল পড়া নিয়ে খুনসুটি করেছে, বাবার তত্ত্ব-বিশ্লেষণ শুনেছে আগের মতই, সেজেগুজে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে কেনা-কাটাও করেছে। আর এই করে মনের দিক থেকে হালকাও হয়েছে অনেকটা। নিরিবিলিতে বাড়ির কথা বেশি মনে হয় বলেই নিরিবিলি চায় না। তা সত্ত্বেও টেলিফোনে পিসিমার সঙ্গে কথা বলতে লোভ হয় মাঝে মাঝে। কিন্তু অভিমানটা এবারে তার ওপরেই বেশি–একদিন টেলিফোন তুলেও আবার রেখে দিয়েছে।

সেদিন দুপুরের শো-এ দাদা-বউদির সঙ্গে কি একটা ছবি দেখতে গিয়েছিল। বলা বাহুল্য, ননিমাধবও ছিল এবং তার আগ্রহেই যাওয়া।

ফিরেও ছিল খুশী মনেই।

ওপরে নিজেদের ঘরে ঢুকে বরুণাকে দেখবে আশা করেছিল। ওকে কলেজে পাঠিয়ে নিজেরা কত ভাল ছবি দেখে এলো একটা, সেই সমাচার শুনিয়ে ওকে রাগাবার ইচ্ছে ছিল।

বরুণার বদলে মা বসে তাদের ঘরে।

কিছু একটা ভাবছিলেন, অর্চনার সাড়া পেয়েই চকিতে হাসি টেনে আনলেন মুখে।কেমন দেখলি?

ভাল। তুমি একলাটি বসে যে, বরুণা কই?

আছে ওদিকে কিছু একটা বলবেন বলেই যেন মেয়ের দিকে চেয়ে হাসতে লাগলেন তিনি। কিন্তু হাসিটা খুব প্রাঞ্জল মনে হল না অর্চনার।

কি মা?

ও-বাড়ি থেকে তোর পিসি-শাশুড়ী এসেছিলেন, তোরা বেরোবার একটু পরেই।

অর্চনা অবাক।–পিসিমা!!

হ্যাঁ। –আবারও মুখে হাসি টেনেই ডুয়ার খুলে একগোছ চাবি বার করে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটা তোকে দেবার জন্যে দিয়ে গেলেন–

নিজের অগোচরে চাবি হাতে নিল অর্চনা। বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত যেন। বাড়ির চাবি! বিমূঢ় মুখে বলল, চাবি …চাবি কেন?

উনি যে আজ বিকেলের গাড়িতেই হরিদ্বার যাচ্ছেন…

অর্চনা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু।

বিব্রত ভাবটুকু তল করে মিসেস বাসু বললেন, আদরযত্ন করতে গেলাম, এক গেলাস জলও মুখে তুললেন না, আমরা তো সব ম্লেচ্ছ কিনা–

অর্চনা অস্ফুট বাধা দিল–জল তিনি কোথাও খান না–কি বললেন?

বলবেন আবার কি, হুকুম করেই গেলেন, চাবিটা তোকে দিতে হবে আর আজই তোকে ও-বাড়ি চলে যেতে হবে–আজ কি করে যাওয়া হয় তোর?

অর্চনা অধীর মুখে বলে উঠল, কিন্তু উনি যাচ্ছেন কেন?

মেয়ের এত উতলা ভাবটা মনঃপূত নয় মিসেস বাসুর।–বুড়ো মানুষ, তীর্থ ধর্ম করে কাটাবেন, ভালই তো~-শুনলাম ওখানেই থেকে যাবেন।

অর্চনা চমকে তাকাল মায়ের দিকে। সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে। পরক্ষণে ছুটে বেরিয়ে সোজা এসে ঢুকল বাবার ঘরে। বাবা ঘরে নেই দেখে স্বস্তি বোধ করল একটু। তাড়াতাড়ি টেলিফোন তুলে ডায়েল করল।

টেলিফোন বেজেই চলল। সাড়া নেই।

টেলিফোন রেখে ত্রস্তে বেরিয়ে আসতেই মায়ের মুখোমুখি আবার।–মা গাড়িটা আছে তো?

আছে, কিন্তু তুই যাবি কোথায়?

জবাব না দিয়ে অর্চনা তার পাশ কাটিয়ে তরতরিয়ে নিচে নেমে এসে ড্রাইভারকে বলল গাড়ি বার করতে।

হাওড়া স্টেশন।

অর্চনা খবর নিয়ে জানল, হরিদ্বারের গাড়ি প্রায় চল্লিশ মিনিট আগে ছেড়ে গেছে।

শ্রান্ত অবসন্ন চরণে স্টেশন থেকে বেরিয়ে মোটরে উঠল। পরিত্যক্ত অনুভূতি একটা। জীবন থেকে এক নিশ্চিন্তনির্ভর বিচ্যুতির শূন্যতা।

কিন্তু– কেন? কেন? কেন? কেন?

অৰ্চনার কোনদিকে হুঁশ নেই। এই কেনটা আতিপাতি করে খুঁজে বার করতে চেষ্টা করছে। পিসিমা গেলেন কেন? আগে ওকে একটা খবর পর্যন্ত দিল না কেউ। কেন দিল না? অর্চনা ভাবছে। আসার আগের দিন আর আসার দিন পিসিমাকে একেবারে অন্যরকম দেখেছিল বটে। ওর দিক থেকেই যেন মুখ ফিরিয়ে ছিলেন তিনি। আসার দিন কিছু হয় নি, যা হয়েছে আগের দিনই। সেই দিনই রাত্রিতে খেতে বসে আর-একজনও জিজ্ঞাসা করেছিল, পিসিমার কি হয়েছে… কেন জিজ্ঞাসা করেছিল? কি দেখে?

ওই দিনটাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চোখের সামনে দেখতে চেষ্টা করল।…শাশুড়ীর ছবি সরানো হয়েছিল, ছবিটা পড়ে ভেঙেছিল, পিসিমার ডাকাডাকি–ভাঙা ছবি দেখে তক্ষুনি বাঁধিয়ে আনার ব্যাকুলতা… চাকরটা হাত কেটে রক্তাক্ত…টেবিলে মায়ের টেলিফোন…

সহসা গাড়ির মধ্যে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতই চমকে উঠল অর্চনা। অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ সহের অতিরিক্ত এক ঝলক আলো সরাসরি চোখে এসে পড়লে যেমন হয় তেমনি। মা পিসিমাকে কিছু বলেছিল টেলিফোনে… মা? অর্চনার সমস্ত মুখ সাদা পাংশু। প্রথম সাক্ষাতে ঘুরেফিরে মায়ের সেই জেরা…ও টেলিফোন ছেড়ে গিয়েছিল কেন…পিসিশাশুড়ী কেন ডেকেছিল কিছু বলেছে কিন…দুর্ব্যবহার করেছে কিনা… অর্চনা ভেবেছিল, নির্দেশমত ও সত্যিই চলে এলো দেখে মায়ের কৌতূহল। ওর নিজেরই ভিতরটা ভারাক্রান্ত তখন, মায়ের জেরায় তাই বিরক্তি বেড়েছিল।

এক সময় খেয়াল হতে দেখে গাড়ি বাপের বাড়ির রাস্তা ধরেছে। ড্রাইভারকে অস্ফুট নির্দেশ দিল অন্য ঠিকানায় যেতে।

গাড়ি থেকে নেমে অর্চনা দোতলার দিকে তাকাল। ঘরে আলো জ্বলছে। ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলে দিল।

দরজা খুলে সাবি ওকে দেখেই নিশ্চিন্ত।–তুমি এসেই গেছ বউদিমণি, বাঁচা গেল–

তার দিকে চেয়ে অর্চনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল একটু।–পিসিমা চলে গেলেন কেন সাবি?

ওমা, পিসিমা তো দুপুরে তোমার ওখান থেকেই এলেন, দেখা হয় নি?

অর্চনা মাথা নাড়ল।

সাবির কথায় কিছু বোঝা গেল না।–ক’দিনই থমথমে গম্ভীর দেখা গেছে তাঁকে, তারপর আজ চলে গেলেন।

অর্চনা পায়ে পায়ে ওপরে উঠে এলো।

টেবিলের ওপর ঝুঁকে সুখেন্দু লিখছে কিছু। অর্চনা কাছে এসে দাঁড়াল। সুখেন্দু মুখ তুলে একবার তাকে দেখে নিয়ে আবার লেখায় মন দিল। বিস্মিত হয় নি, বরং জানত যেন আসবে। ও-াড়ি গেছলেন, পিসিমা জানিয়েছেন। আর, বউমার সঙ্গে দেখা হল না সেই খেদও প্রকাশ করেছেন। লিখতে লিখতে ঠাণ্ডা প্রশ্ন করল, তুমি হঠাৎ…

পিসিমা চলে গেলেন কেন?

একটু থেমে মুখ না তুলেই জবাব দিল, আর থাকা সম্ভব হল না বলে।

কেন?

মুখ তুলে সুখেন্দু স্থির চোখে তাকাল। ওর ভিতরটাই দেখে নিতে চেষ্টা করল যেন। তারপর জবাব দিল, কেন সেটা আর তিনি মুখ ফুটে বলে যান নি।

আমাকে একটা খবর দিলে না কেন?

রুদ্ধ ক্ষোভ সংবরণ করে সুখেন্দ ফিরে জিজ্ঞাসা করল, খবর দিলে কি হত?

তিনি যেতে পারতেন না। কেন খবর দিলে না, এতটাই জব্দ করার জন্যে?

জব্দ কিসের, খুশীই তো হওয়ার কথা। প্রচ্ছন্ন উষ্মায় বিদ্রুপের আভাস।

তার মানে? অর্চনা নিস্পলক চেয়ে আছে।

মানে তোমরাই জানো।

আমরা কারা?

ঘাড় ফিরিয়ে সুখে আবারও তাকাল তার দিকে।–তোমরা, তুমি আর তোমার মা।…অসহিষ্ণু হাতে কলমটা তুলে নিয়ে লেখার দিকে ঝুকল সে।

অর্চনা বেদনাহত, নিস্পন্দ। অব্যক্ত ব্যথায় খানিক চেয়ে রইল তার দিকে। তার পর মাঝের দরজা দিয়ে আস্তে আস্তে পাশের ঘরে চলে এলো। শয্যায় বসল। এ আঘাতের যেন সীমা-পরিসীমা নেই।

দেয়ালের সেই পুরানো জায়গায় শাশুড়ীর ছবি। যাবার সময় মনে মনে আশা ছিল ফিরে এসে এই ছবি এখানেই দেখবে আবার। তাই দেখল। কিন্তু এরও আর যেন কোন সান্ত্বনা নেই। ছবি অনেক-অনেক দূরে সরে গেছে। সবই অনেক দূরে সরে গেছে।

বসে আছে মূর্তির মত। ছবির দিকেই চেয়ে আছে।

দুই চোখ-ভরা জল।


© 2024 পুরনো বই