৪. সকাল দশটার ফ্লাইটে

সকাল দশটার ফ্লাইটে রওনা হয়ে বেলা বারোটায় কলকাতায় পৌঁছেছি। রওনা হবার ঘণ্টাখানেক আগে ঘোষ সাহেব হোটেল থেকে মেয়েকে ফোন করেছিলেন। মেয়ে আবার তার দাদাকে ফোনে জানিয়ে থাকবে। অফিল কামাই করে ছেলে আর জামাই এয়ারপোর্টে উপস্থিত।

শমীর বাড়িতে দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা। দেবু বলল, আমায়। ওখানেই ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলাম, শমীটা কিছুতেই রাজি হল না, মাঝখান থেকে আমাদের সুদ্ধ ওর ওখানে নেমন্তন।

দেবুর দিকে চেয়ে আমি ওর সেই এগারো বছরের মুখখানা কল্পনা করতে চেষ্টা করছিলাম, একশ সাড়ে পাঁচ ছয় অবে, ভাজাভাজা, বেহু, সেখানে ডাকাতের হাত থেকে প্রাণ আর ইজ্জত রক্ষা পাওয়া একটা উনিশ বছরের মেয়ে পাকেচক্রে এসে গিয়ে ওর বাবার পাশে গড়িয়ে দেখছে আর তারপর বিধান দিচ্ছে।

কল্পনা করতে পারব কেন, মাঝে তেইশ বছরের ফারাক। কিন্তু রাধার সেই উনিশ বছরের মুখ দিবি চোখের সামনে আসছে।

বাপের সঙ্গে আমাকেও পেয়ে শমী খুশিতে আটখানা। ছেলের বউ ঊর্মিলা তো কডার করিয়ে নিল, সকলে মিলে একদিন তার কোয়াটার্স এও জমায়েত হতে হবে। তারপর তাদের সাগ্রহ প্রশ্ন, প্রোডিউসারের সঙ্গে আমার হিন্দী ছবির কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল কিনা।

ঘোষ সাহেব মাঝখানে ফোড়ন কাটলেন, পকেট কি-রকম বোঝাই করে ফিরলেন সেটা বরং জিগ্যেস কর।

ওরা সানন্দে বিশ্বাস করল, কারণ ওদের ধারণা বকের ফিল জগতে টাকার গাছের ছড়াছড়ি, ধরে একবার নাড়া দিতে পারলেই ঝরঝর করে পড়ে। শমী আনন্দ করে বলে উঠল, তাই নাকি! তাহলে তো আমাদের আর একটা বড় খাওয়া পাওনা হয়ে থাকল।

রসিকতা করতে গিয়ে ঘোষ সাহেব একটা বড় রকমের সত্যি কথাই বলে ফেলেছেন। অনেক বার কাজের তাগিদেই বোম্বাই গেছি এসেছি, থোকে টাকাও কম পাইনি, কিন্তু এবারের মতো এখন পকেট বোঝাই করে আর কখনো ফিরিনি। খুশি মুখে সায় দিয়েছি, নিশ্চয়, যেদিন বলবে সে-দিনই হবে, তোমরাই ঠিক করো–

মেয়েটার মধ্যে সত্যি কৃত্রিমতা কম, সেটা অন্যভাবে প্রকাশ করল।–আগে বলুন কত টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে ফিরলেন, আমরা সেই বুঝে প্রোগ্রাম করব, শুধু খেলেই তো হবে না কি বলো বউদি?

আড় চোখে একবার ঘোষ সাহেবের মুখখানা দেখে নিয়ে জবান দিলাম, আমার এবারকার পোডিউসার সবটাই অ্যাডভান্স করে দিয়েছেন–তোমরা খুশিমতো ইলাস্টিক প্রোগ্রাম করতে পারে।

জামাই তার গাড়িতে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল, তার প্রস্তাব নাকচ করে ঘোষ সাহেব বিকেল চারটে নাগাদ ট্যাক্সি ডাকিয়ে আমাকে নিয়ে রওনা হয়েছেন। তারপরেই বলেছেন, আপনিও তো মশাই ঝানু কম নন, পুলিশের ওপর একেবারে টেক্কা দিয়ে বসলেন! আমি গেলাম সাদা মনে একটু রসিকতা করতে–

আমি যতটুকু সম্ভব গম্ভীর। যতই খুশির চাল চালি এই লোকের গলা নিয়ে মনের তলায় একটা বড়-রকমের অস্থিরতা থিতিয়েই আছে। কথার মাঝে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, বসিকতা করতে গিয়ে আপনি একটু মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন, আর আমার দিক থেকে আমি নিজল। সত্যি কথাই বলেছি।

–কি রকম? আপনি পকেট বোঝাই করে ফিরেছেন আর প্রোডিউসার আপনাকে সবটাই অ্যাডভান্স করে দিয়েছে?

এবারে হাসলাম। আমার পকেট কতটা বোঝাই এখন আপনি জানবেন কি করে? আর, প্রোডিউসার সবই অ্যাডভান্স করেছে–কিছু বাকি আছে সেটা আপনার থেকে ভালো আর কে জানে?

পরদিন সন্ধ্যার আগেই আমরা কাগজ-পত্র নিয়ে কলকাতার স্পেশালিস্ট ডাক্তারের কাছে হাজির। গ্রাফিক চার্টে একশ পঞ্চায় ইউনিট দেখে বেশ গম্ভীর। জিগ্যেস করলেন, তাদের কি অ্যাডভাইস …এক্ষুনি অপারেশনের দিকে যেতে চান না তো?

মাথা নাড়লাম। কী অ্যাডভাইস বললাম।

সায় দিয়ে বললেন, আমারও তাই মত। …এক দেড় বছর একই ভাবে চলছে, বারো বছর কত যদি চলে তো চলুক না। তবে মাঝে মাঝে গিয়ে চেক করতে হবে, আর অসুবিধে বোধ করলে তো তড়ি ঘড়ি করাতে হবে। তার আগে পর্যন্ত এক চিকিৎসা, পরে অন্য

যা শুনতে চাইছি সে কথাটাই বলছেন না বলে ভিতরে ভিতরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি। জিগ্যেস করলাম, আপনার চিকিৎসায় পরের বারের রিডিং তো কিছু নেমে আসতে পারে?

ভদ্রলোক হেসেই ফেললেন একটু।– পারেই না এটা জোর দিয়ে বলছি না, তা নামলে চিন্তার তো অর্ধেক হয়ে গেল, তাহলে টিপিক্যাল ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ নয় বলে আশা করা যেতে পারে, একশ পঞ্চান্ন থেকে আর না বাড়ে সব ডাক্তারের কাছেই এটা এখন এখন চিন্তা।

ঘোষ সাহেব আস্তে আস্তে বললেন, আমার একটি ছেলে আর একটি মেয়ে…ম্যারেড অ্যাণ্ড কোয়াইট অ্যাডালট, তাদের কি কিছু জানানো উচিত মনে করেন?

ডাক্তার বিস্মিত একটু। …এতদিনের ব্যাপার, বম্বে গিয়ে টেস্ট করিয়ে এলেন…অথচ তাঁরা এখনো কিছুই জানে না বা সন্দেহ করেননি?

-না, আমার এই বন্ধুটি সহজেই ম্যানেজ করেছেন, আর বাড়া বাড়ি না হলে ভবিষ্যতেও ম্যানেজ করা যাবে–জানলে খুবই আপসেট হবে…তবু আপনার কি অ্যাডভাইস?

–তাহলে জানাবার জন্য তাড়াহুড়ো করার কি আছে, বাড়লে তো আপনিই জানাজানি হবে, কিন্তু একইভাবে চললে তাদের আর উতলা করে লাভ কি?

ভদ্রলোক বেশ ভেবে-চিন্তে প্রেসকৃপশন লিখলেন। ওষুধ খুব বেশি নয়। সময় ধরে ধরে এক-একটা ব্লড টেস্টের অ্যাডভাইই বেশি।

পরদিন।

বিকেল তখন চারটে হবে। ঘোষ সাহেবের গাড়ি তার দোর গোড়ায় দাঁড়ানো। হীরু দাস চালাচ্ছিল। যাকে আশা করছিলাম সে-ই কিনা দেখার জন্য রেলিঙে ঝুঁকলাম। হা, গাড়ি থেকে রাধা নামল। তারপরের যেটুকু সেটুকুই অপ্রত্যাশিত। রাধার দুচোখ প্রথমে ওবাড়ির দোতলার দিকে উঠল। বারান্দায় কেউ নেই। তারপর এ-বারান্দার দিকে ঘুরল। আমাকে দেখেই দু’হাত জোড় করে নিচতলার দরজার দিকটা দেখিয়ে দিল। অর্থাৎ সানুনয়ে আমাকে চলে আসতে অনুরোধ করল।

রাধা এলে ঘোষ সাহেব একসময় আমাকে ডেকে পাঠাতে পারেন এমন একটা আশা আমার মনের তলায় ছিল। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে বারান্দায় আমাকে দেখেই এই একজন সানুনয়ে আমাকে আসতে বলবে এ ভাবব কি করে। যা-ই হোক পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে চললাম।

দোতলায় উঠে দরজার সামনে এসে দাঁড়াতে ঘোষ সাহেবের খুনি গলা কানে এলো, এত তাড়াতাড়ি এসে যাবি ভাবিনি–রাস্তা ফাঁকা ছিল বুঝি? মোড়াটা টেনে বোস।

পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখছি দেয়ালে টাঙানো কালীর পটের সামনে গড়িয়ে প্রণাম সেরে রাধা ফিরল। এবারে ঘোষ সাহেবের পায়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল।

–এত প্রণামের কি আছে, বোস বোস।

মোড়াটা কাছে টেনে বসল মনে হল। কেমন আছ?

–খাসা, এই তিন চার দিনেই তরতাজা হয়ে ফিরেছি। সাড়া দিলাম, আসব?

কয়েক নিমেষ থমকালেন কিনা বোঝা গেল না।–আরে মুখুজ্জে মশাই নাকি, আসুন, আসুন–

ভিতরে এসে দাঁড়াতেই সহাস্য প্রশ্ন, ওকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই এসে গেলেন নাকি?

জবাব রাধা দিল, উনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছেলেন, দেখে আমিই আসতে বলেছি। চট করে উঠে আর একটা মোড়া এনে সামনে রাখল। –বোসো বাবু।

ও ডেকেছে শুনে ঘোষ সাহেব একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে আমার দিকে তাকালেন। এভাবে ডাকাটা আমার কাছেও দুর্বোধ্য। আমি বসতে রাধা নিজের মোড়াটা আধ-হাত সরিয়ে নিয়ে বসল। ঠাণ্ডা দু’চোখ আমার দিকে।–ভালো বেড়ানো হল?

হাসি মুখে ফিরে বললাম, তোমার বড়বাবু কী বলেন?

জবাব দিল না, ঘোষ সাহেবের দিকে তাকালো না। ঠাণ্ডা চাউনি আমার মুখের ওপরই পড়ে থাকল খানিক। তারপর রয়ে সয়ে যা বলল শুনে আমরা দুজনাই বিমূঢ়। বড়বাবু সম্ভব হলে একশর মধ্যে একশ কথাই মিথ্যে বলে আমাকে, আর তোমার তো শুনি মিথ্যে বলাই পেশা, মাথা থেকে বানিয়ে গপপ লেখো শুনি, তবু তোমাকেই জিগ্যেস করব বলেই ডেকেছি–যা বলব সত্যি জবাব দেবে না ভাওতা দেবে?

হকচকিয়ে গিয়ে ঘোষ সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনিও আমারই মত বিমূঢ়।

-অত চোখ তাকা-তাকি করার দরকার নেই, তোমরা বুদ্ধিমান বলে অন্য সকলেই ষোল আনা বোকা নয়। বোম্বাইয়ের ডাক্তার বড়বাবুর কী পরীক্ষা করল কী বলল, সব আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলো–কিছু ফাঁকি দেবে না।

আমি হাঁ হয়ে ঘোষ সাহেবের দিকে তাকালাম। তিনি আমার থেকেও ডবল হাঁ।

–তুই জানলি কি করে– বুঝলি কি করে?

বিরক্ত ভাব।–এটুকু জানা বোঝা কি খুব বাহাদুরির কাজ। আমার কথায় একে সঙ্গে করে তুমি অন্য ডাক্তার দেখালে চিকিচ্ছে করলে, তারপর এর হুট করে বোম্বাইতে কাজ পড়ে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে তুমিও সেখানে বেড়াতে যাবার জন্য নেচে উঠলে-অথচ ছেলে মেয়ে সাধ্য-সাধনা করলেও ঘর ছেড়ে নড়তে চাও না–বুঝেছি বলেই তক্ষুনি তোমার যাবার কথায় সায় দিয়েছিলাম–ছেলেমেয়ে দুটোকে বুঝতে দাওনি ভালো করেছ, আমাকে গোপন করার কি আছে? এখন কথা না বাড়িয়ে আগে সব বলো শুনি

ঘোষ সাহেব বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে হাসতে লাগলেন। আমাকেই বললেন, আর রাখা-ঢাকার চেষ্টা করে লাভ নেই।

এরপর সাগ্রহেই আমি আদ্যোপান্ত বললাম, যতটা সম্ভব সহজ করে পরিস্থিতি বোঝাতে চেষ্টা করলাম।

অপলক চোখে তাকিযে এক মনে শুনল। তারপর হঠাৎ বেখাপ্পা প্রশ্ন।–ধরো আর পাঁচ বেড়ে বেপদের ঘরেই এলো, তখন আর কোনো চিকিচ্ছেই নেই?

ঘোষ সাহেব জবাব দিলেন, থাকবে না কেন, তবে সেটা হল সব থেকে কঠিন অবস্থার চিকিৎসা

তাঁর দিকে একটা আঙুল তুলে রাধা বলল, তুমি চুপ করে থাকো, যা বলার ইনি বলুন। আবার আমার দিকে তাকালো যত কঠিন অবস্থাই হোক, চিকিচ্ছে যখন আছে, কেউ ভালো হয় কিনা, একজনও ভালো হয় কিনা?

তাড়াতাড়ি জবাব দিলাম, নিশ্চয় হয়।

চেয়ে আছে। যেন আমার মুখখানাই নিরক্ষণের বস্তু। –ডাক্তার যখন বলেছে পাঁচ সাত বছরও এ অবস্থায় থাকতে পারে…তা লে চের জেবন থাকতে পারে না কেন?

পারে না এমন কথা কেউ বলেনি।…তবে ওই কঠিন রোগ হলে তা থাকে না।

অসহিষ্ণু।–কঠিন রোগ যে হয়েইছে এ-কথা এখনো তো কেউ হলপ করে বলতে পারেনি?

জবাব না দেওয়াই নিরাপদ ভাবলাম, কিন্তু ঘোষ সাহেব আলতো করে বলে বসলেন, জেনে-বুঝেও তুই নিজেই কী বলেছিস– কেবল ডাক্তার বদলানোর তাগিদ দিয়েছিস।

আস্তে আস্তে তার দিকে ফিরল। চেয়ে আছে তো আছেই।– তোমার ভাবনা-টাবনা আর সব বালাই তুমি আমাকে দেছ কি দাওনি?

এবারে ঘোষ সাহেবের চেয়ে থাকার পালা একটু।– তোর কি মনে হয়, দিয়েছি না দিইনি।

-তাহলে এখন থেকে তুমি আমার কিছু কথা মেনে চলবে চিকিচ্ছে যেমন চলছে চলবে, তোমার এই বন্ধুটি নরম মনের ভালো মানুষ, খুব বুদ্ধি ধরেন, তোমার চিকিচ্ছের ব্যবস্থার ভার যখন লয়েছেন ও-ব্যাপারে কখন কী করতে হবে সে-চিন্তা তার–তুমি কেবল ধরে নেবে তুমি ভালো আছ, তোমার কিছু হয়নি–কেবল ধরে নেবে না, বিশ্বাস করবে। দেহ যখন ধরেছ উপসর্গ থাকবেই। তারপরেও যদি দরকার হয় রাধা তোমার কথা ভাববে–দায় যখন দিয়ে দেছ তোমার কি ভাবনা? আমার কথা তোমার মনে লাগছে?

ঘটা করে ঘোষ সাহেব আবার একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়লেন। জবাব দিলেন, খুব সোজা করে বড় কঠিন হুকুম করলি, এমন বিশ্বাস মনে লেগে থাকবে কি না এ-ও তুই জানিস।

কালো সুন্দর মুখখানা ভারি কোমল হয়ে এলো।–থাকবে গো থাকবে, তোমার চেষ্টার জোর এখন কত তার তুমি কী জানো তোমার কেবল আনন্দে থাকা কাজ আর নিশ্চিন্ত থাকার চেষ্টা।

আমার দিকে ফিরল, তারপর আঙুল তুলে সোজা দেওয়ালে টাঙানো কালীর ফোটোটা দেখালো-ওই মেয়ে লড়াই বড় ভালবাসে বুঝলে বাবু, নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গেও লড়াইয়ে নেমে যায়, কিন্তু লড়াইয়ে জিতলে কত দুঃখ পায় আর হারলে কত খুশি হয় এখপরটি আমার নিজের জেবন দিয়ে বুঝে নিয়েছি–বুঝলে বাবু? মোড়া ছেড়ে সোজা উঠে দাঁড়ালো, পটের দিকে দু’পা এগিয়ে গেলো। অদ্ভুত ধীর অথচ টনটনে গলায় বলল, আমিও দেখব তোর মুরোদ কত, হেরে হাসিস না জিতে কাঁদিস!

অভিভূত বিস্ময়ে চেয়ে আছি। মনে হল রাধার সরল শান্ত টান দুই চোখে এই প্রথম আমি আগুন দেখলাম।…

দেখছি। দু’চোখ বুজে স্থির দাঁড়িয়ে রইলো খানিক। তারপর সুডোল দেহে একটু ঝাঁকুনি তুলে নিজেকে নিজের মধ্যে ফেরালো যেন। আগের সেই শান্ত কোমল মুখ। ঘোষ সাহেবের দিকে ফিরল। -হীরুকে ডাকো, আমি এক্ষুনি ফিরব।

ঘোষ সাহেবেরও সম্বিত ফিরল যেন।-সে কি! এত পথ যাবি একটু জলও তো মুখে দিলি না।

-আজ জল মুখে দেবার মন নিয়ে আসিনি বড়বাবু, আমার তাড়া আছে

দরজার দিকে এগলো। নিজের অগোচরে আমিও মোড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ব্যস্ত হয়ে ঘোষ সাহেব হীর উদ্দেশে হাঁক-ডাক করে উঠলেন। হীরু প্রস্তুতই ছিল।

ঘোষ সাহেব সামনের বারান্দার রেলিংএ এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে আমিও। হীরু গাড়ির দরজা খুলে দিতে রাধা সোজা উঠে গেল। একটু পরেই গাড়ি চোখের আড়ালে।

ঘরে ফিরে আবার বসলাম আমরা। মনে হল ঘোষ সাহেবের ভেতরটাও এই মুহূর্তে দূরে সরে আছে। একটু হেসে জিগ্যেস করলেন, কীরকম বুঝলেন মশাই?

একটু থেমে ফিরে জিগ্যেস করলাম, আমার থেকে আপনি এঁকে ঢের ভালো জানেন… আপনি কী-রকম বুঝলেন?

বিমনা ভাব একটু। তারপরেই হালকা হবার চেষ্টা।–ও যা বলে গেল ভাবলে বোঝা সকলের পক্ষেই সোজা। …ডাক্তারদের বা আমাদের যা আশংকা ও তার উল্টো কিছু ভাবছে না বা বলছে না।

পরের প্রশ্নটা করে আমি নিজেই অপ্রস্তুত একটু।

এরকম লড়াইয়ে আপনার বিশ্বাস আছে?

স্বস্তি, একটুও চিন্তিত বা বিব্রত দেখলাম না। হেসেই জবাব দিলেন, এ-সব লড়াইয়ের মর্ম বুঝি না খবর রাখি যে আমি বিশ্বাস করব? আমার আগের সেই উদ্বেগ আর নেই এটুকু শুধু বলতে পারি …আর আজ দেখে রাধার বিশ্বাসও কিছুটা আঁচ করতে পারি।

উৎসুক।– কী রকম?

–যত কঠিনই হোক জিতবে এই স্থির বিশ্বাস নিয়েই ও লড়াইয়ে নামছে

ফিরে আসার পর অনেক সময় অনেকগুলো ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। আমি খুব আত্মস্থ বোধ করিনি। রাতে ভালো ঘুম হবে না মনে হলে আগে থাকতে কোনো-একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে নিই। আজ শষ্যা নেবার দু’ঘণ্টার মধ্যেও চোখে পাতায় এক হল না, তবু ওষুধের দিকে হাত বাড়াইনি কারণ জেগে থাকতেই ভালো লাগছে।

নিঃশব্দে উঠলাম। আবছা অন্ধকার সামনের বারান্দায় একে উড়ালাম। রাত কত দেখিনি। শহর ঘুমুচ্ছে।

বিস্ময় নয়, আমায় স্নায়ুতে স্নায়ুতে মগজের কোষে কোষে কথা চলে কেবল বিশ্বাস নামে একটা শব্দ নিয়ে। দুর্গেয় বিশ্বাসের মিছিল আমি কম দেখিনি। নিজে তার সঙ্গে ভিড়তে পারিনি, কিন্তু অজ্ঞতা বা দুর্বলতা বলে উড়িয়ে দিতে পারিনি।

…আজ কয়েক পলকের জন্য রাখার চোখে যে আগুন দেখলাম সে-ও বোধ করি বিশ্বাসেরই আগুন। এ-বিশ্বাস জয়ী হবে কি হবে না তা অনাগত ভবিষ্যত জানে। পাঠককে আমি তার হদিস দিতে পারব না। কিন্তু এর আগেও আর একবার রাধার চোখে এ আগুন যিনি দেখেছেন, বিশ্বাসের এমনি আগুন দেখেছেন, আর জয়ী হতেও দেখেছেন–পাঠকের কাছে এখন আমি কেবল সেই বৃত্তান্তটুকুই পেশ করতে পারি।

.

মৃত বুড়ীর দেহ পোস্টমর্টেমে যাবে, সেখানকার রিপোর্ট আসতে ঢের দেরি। কিন্তু তাকে যে গলা টিপে মারা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আবার জিপ পাঠিয়ে ডাক্তার বিজন চৌধুরীকে নিয়ে শব পরীক্ষা করানো হয়েছে। তিনিও নির্দিধায় একই মত দিয়ে গেছেন। বুড়ীকে সনাক্ত করেছে রাধা। অতএব পুলিশকে এখন বিধিমতেই অনুসন্ধান শুরু করতে হবে। অংশুমান রাধাকে আবার ওপরে নিয়ে গিয়ে ধমক-ধামক করেও আর খাওয়াতে পারেননি। তার আগে তার স্ত্রীর অনুনয় ব্যর্থ হয়েছে।

রাধার ঠাণ্ডা জবাব, চোখ দেখিও না বাবু, তোমাদের যা করার করো– আমার মুখে এখন কিছু উঠবে না।

সুচারু দেবী ব্যাকুল মুখে স্বামীকে আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেছেন, ওকে এখন আর খাওয়ানো যাবে না, দোহাই তোমার ওকে আর একটি কটু কথা বোলো না।

অংশুমান তাকে আশ্বাস দিয়েছেন, ওকে কিছু খাওয়ার চেষ্টাতেই ওরকম করে বলেছেন, ওকে নিয়ে যেটুকু কাজ তা শেষ হলেই জিপে করে ঘরে পৌঁছে দেবেন।

সুচারু দেবী আবার এসে রাধার হাত ধরে অনুনয় করেছেন, তোমাকে নিয়ে উনি এখন একটু তদন্ত করতে বেরুবেন, কিন্তু তুমি কথা দাও ওঁর সঙ্গেই আবার এখানে ফিরে এসে খাবে?

রাধা বলেছে, খাওয়াবার মন হলে তার অনেক সময় পাবে দিদি.. আগে বুঝতে দাও আমাকে বাঁচাতে মা-কালী ওই বুড়ীকে কেন নিল, কে ওই রাক্ষুসীর কাছে এমন দয়া চেয়েছেল?

অন্য তিন-চার কর্মচারীসহ রাধাকে নিয়ে সংশুমান কুলপির দিকেই সেই চাষের জমির পাশের ‘কুজিঘরে এসেছেন। তিনটে ঘরের মধ্যে রাখা শেষের ঘরটাকে দেখালো। ওই ঘরটায় ডাকাতেরা তাকে এনে তুলেছিল, পিদিম হাতে বুড়ী শিকল খুলে হাতমুখ বাঁধা অবস্থায় তাকে দেখে বলে উঠেছিল, ডাকাতরা তোকে জোর করে তুলে এনেছে–টাকার লোভে নিজে আসিসনি?

রাধা তখন নিশ্চিত জানে না-কালী বুড়ী সেজে ওকে বাঁচাতে এসেছে, কারণ আকুল হয়ে ও তখন মা-কালীকেই ডাকছিল। কথা শুনে রাগই হয়ে গেছল, জোরে জোরে মাথা নেড়েছে।

কাছে নয় দূরে-দূরে কিছু জনবসতি আছে। জিপে করে সে দিকে গিয়ে অংশুমান কয়েকজন বয়স্ক লোকের কাছে বুড়ীর সম্পর্কে খবর নিয়েছেন। তারা কেউ ভালো বলল না। চাষের সময় ভিন্ন জমির মালিকেরা কোনো লোককে তারা ওই কুজিঘরে থাকতে দেখেনা। ঘর তিনটে তখন ওই বুড়ীকেই আগলাতে দেখা যায়। সে জমির মালিকের লোক কিনা কেউ জানে না। …ওই ঘরগুলো তখন মাতাল বদমায়েসের আড্ডা হয়ে ওঠে। সকলেরই ধারণা বুড়ীটা এদের কাছ থেকে টাকা-কড়ি পায়।

জমির মালিকের নাম শ্রীনাথ পোদ্দার, অনেক জায়গায় অনেক জমি-জমার মালিক, অর্থাৎ নামকরা জোতদার। লক্ষ্মীকান্তপুরে নিবাস।

এই একটি নাম অংশুমান ঘোষের শোনা আছে। যে কয়েকটি শাঁসালো লোকের নাম আগের বন্ধু ও সি তাকে দিয়ে গেছলেন, এই নাম তাদের ওপরের সারিতে। তার পিছনে জোরালো রাজ নৈতিক পার্টির মদত আছে। হাতে গুণ্ডা আর মাস্তানের দল। চালের সাদা-কালো কারবারে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। কলকাতায় মদের দোকান আছে, অন্য লোক চালায় কিন্তু আসল মালিক সে-ই। সুদে টাকা খাটায়, কিন্তু যেসব খাতকের ঘরে সুন্দরী মেয়ে বউ আছে–তারা। তার বদান্যতার প্রশংসা করে। মোট কথা লোকটার সব গুণই পুলিশের অনুকূলে। পুলিশ তার দিকে চোখ তুলে তাকানোর আগেই সবিনয়ে সে পর্যাপ্ত সম্মানদক্ষিণা দিয়ে থাকে। তার কোন পুকুরে বায়ো চৌদ্দ কিলো রুই কাতলার চাষ হয় কেউ জানে না, কিন্তু পূজা-পার্বনে নিজস্ব পুকুরের ও-রকম মাছের আস্বাদ থানার পদস্থ জনেরা পেয়ে থাকে। তার কাছে সর্ব-ধর্ম সমান, ঈদ বা বড়দিনকেও তুচ্ছ করে না, পর্যাপ্ত মাছ মাংসসহ বিদেশী বোতলও আসে। তাছাড়া সমাজের শান্তি-রক্ষকদের আমের দিনে আম-মিষ্টি, ইলিশের মৌসুমে গঙ্গার ইলিশ খাওয়ানোটাও তার কর্তব্য-কর্মের মধ্যে পড়ে। এই ফিরিস্তি দেবার পর গলা খাটো করে প্রাক্তন ও সি বন্ধুটি বলেছিলেন, শ্রীনাথ পোদ্দারের এসব দাক্ষিণ্যের মর্যাদা করাটা কিন্তু থানার ও সি’র চাকরির পক্ষে খুব নিরাপদ নয়।

ঘটনাস্থল থেকে জিপে লক্ষ্মীপুরে আধ-ঘণ্টার পথ নয়। পুলিশের গাড়ি তারও আগে শ্রীনাথ পোদ্দারের মন্ত দালানের সামনে দাঁড়ালো।

অংশুমান পরিচয় দেওয়া মাত্র বন্ধুর বিবৃতির জ্যান্ত পট দেখলেন। দু’হাত জোড় করে কোমর পর্যন্ত মাথা নোয়ালো। পরনের দামী তাঁতের ধূতি খাটো করে পর, গায়ে পাক্ষির থ্রি-কোয়াটার-হাত ফতুয়া, গলায় সোনার হার। বছর চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে বয়েস। ছিপছিপে দোহারা চেহারা গায়ের রং ফস, নাকের নিচে কালো ভোরার মতো এক ইঞ্চি প্রমাণ পুষ্ট গোঁফ। মাননীয় অতিথিকে নিয়ে কী করবে, কোথায় বসাবে ভেবে না পেয়ে অস্থির যেন। দীন কুটিরের বিলাসবহুল বৈঠকখানায় এনে বসিয়ে বার বার খেদ প্রকাশ করল, বিশেষ কাজে তিন সপ্তাহের ওপর দিল্লিতে থাকতে হয়েছিল, ফিরে আসতে কলকাতার কর্তাদের তলব, মাত্র তিন চারদিন হল ঘরে ফিরে হাঁপ ফেলতে পেরেছে–আজ কালের মধ্যেই সে নিজে গিয়ে বড়বাবুর দর্শন-প্রার্থী হত–এই ত্রুটিটুকু মাপ করতেই হবে, আগের সদাশয় ও সি তাকে খুব স্নেহ করতেন, তার খুব আশা এই ত্রুটির জন্য নতুন বড়বাবুর কাছ থেকেও এই স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে না, ইত্যাদি।

এই ধরনের মানুষকে চিনতে বা বুঝতে অংমানের সময় লাগার কথা নয়। মনে মনে হাসলেন, মুখে জানালেন, আগের ও সি মিস্টার চক্রবর্তীর কাছে তিনিও তার অনেক প্রশংসা শুনেছেন। বিশেষ ব্যস্ততার মধ্যে আছেন বলে আজ আর তিনি বসতে বা সময় দিতে পারছেন না। এরপর তার আসার কারণ অর্থাৎ ঘটনা শুনে অতি বিনয়ী জোতদার শ্রীনাথ পোদ্দার হতবাক। বুড়ীর কথা বলামাত্র চিনল।

বুড়ীটার নাম জিগ্যেস করতে শ্রীনাথ তক্ষুনি মনে করতে পারল না। অন্য একজন স্মরণ করিয়ে দিল নাম কামিনী। শ্রীনাথ সখেদে জানান দিল, এই বুড়ীর সম্পর্কে পাঁচরকম কথা তার কানে আসছিল, ওকে ঘুষ দিয়ে অবাঞ্ছিত লোকেরা এসে নাকি রাত কাটিয়ে যায়, সে নিজেও ভাবছিল বুড়ীটাকে আর ওখানে রাখবে না, কিন্তু আশ্চর্য, একটা মেয়ের মান ইজ্জত রক্ষা করতে গিয়ে নিজে প্রাণটা দিল।

অংশুমান কান খাড়া করে কথা ক’টা শুনলেন। তারপর ফেরার জন্য পা বাড়ালেন। নামী অতিথির সেবা করা গেল না বলে নাথ পোদ্দারের আর একপ্রস্থ খেদ। সঙ্গে সঙ্গে জিপ পর্যন্ত এলো। আসবে জানা কথাই।

বড়সড় জিপ। পিছনে নয়, নিজে ড্রাইভারের পাশে বসে রাধাকেও সামনেই বসতে দিয়েছিলেন। ডাকলেন, রাধা নেমে আয় তো একটু।

রাধা জিপ থেকে নামল। শ্রীনাথ পাোরের দিকে চেয়ে অংশুমান কেবল একটু চোখের ইশারা করলেন। তাইতেই সে আরো দুই এক পা কাছে এগিয়ে এলো।…পরনে অংশুমানের স্ত্রীর দেওয়া সাদার ওপর বেগুনে ডুরের দামী শাড়ি, গায়ে তেমনি চকচকে নতুন হালকা বেগনি রঙের ব্লাউস, স্নানের পর মহিলা নিজের হাতে চুল বেঁধে দিয়েছিলেন। থমথমে মুখ সত্ত্বেও নিটোল যৌবনা মেয়েটাকে দেখাচ্ছিল বড় সুন্দর। দেখার নামে শ্ৰীনাথ পোদ্দারের দু’চোখ তার সর্বাঙ্গ লেহন করল একপ্রস্থ। কিন্তু চতুর মানুষের আত্মস্থ হতে সময় লাগল না বড়বাবুর দিকে ফিরে জিগ্যেস করল, একেই ডাকাতে ধরে নিয়ে গিয়ে আমার জমির কুজিঘরে নিয়ে তুলেছিল?

অংশুমান মাথা নাড়লেন। দু’চোখ রাধার মুখের ওপর। রাধা অপলক চোখে শ্রীনাথ পোদ্দারকেই দেখছে।

-এ কোন্ গাঁয়ের মেয়ে? ডাকাতের খপ্পরে পড়ল কী করে?

–মাতন গাঁয়ের।…আমারও এখন অনেক কিছু জানতে বাকি, বুড়ীকে চেনে এমন কাউকে এখুনি আপনি আমার থানায় পাঠিয়ে দিন, পোস্টমর্টেমে নিয়ে যাবার আগে সনাক্ত করবে, চলি–

শ্রীনাথ পোদ্দার যুক্ত করে আবার আনত হল।

জিপ চলতে অংশুমান গলা খাটো করে জিগ্যেস করলেন, এই লোকটাকে বা তার সঙ্গে যারা ছিল কাউকে কখনো দেখেছিস?

রাখা মাথা নাড়ল। দেখেনি।

…এই লোকটাকে তুই ওভাবে দেখছিলি কেন?

–ওর কুজিঘর বলল, তাই।…লোকটা ভালো না।

–ও তো মস্ত লোক, ভালো না তোকে কে বলল?

–কেউ না। আমার মনে এলো।

–ওই তিন ডাকাতের কাউকে যদি দেখিস চিনতে পারবি?

-জঙ্গলের আন্ধার থেকে টেনে নে আন্ধার পথে গেছল, হাত মুখ বেন্ধে আন্ধার ঘরে ফেলে রেখেছিল, মুখগুলো খুব আছা চোখে লেগে আছে…ঠিক চেনতে পারবনি

ওখান থেকে অংশুমান বিবিমায়ের থানে এলেন একাই নেমে খোঁজ নিতে গেলেন বিবিমায়ের পুজো করে শফিদার মা শফিদা জানালো, রাধা দিদির বাড়িতে কী গণ্ডগোলের কথা শুনে তার মা সেখানে গেছে

রাধা কাল কখন এখানে এসেছিল আর কখন চলে গেছল?

জবাব, দুকুরে এয়েছিল, রেতে গেছে, আলে অনেকক্ষণ থাকে।

–রাতে জংলা পথে একলা ফেরে?

মেয়েটা ঘাড় কাত করল। মুখেও বলল, রাধা দিদির কুনো ভয়-ডর লাইগো বাবু।

বেলা সাড়ে দশটা। রাধার চালা-ঘরের সামনে তখন ভিড় জমে গেছে। গতকাল বেলাবেলি মেয়ে বেরিয়েছে, সমস্ত রাতের মধ্যে আর দেখা নেই সেটাই উত্তেজনার ব্যাপার। রাতে রাধার ঘরের সামনের দাওয়ায় যে বয়স্কা মেয়েলোকটি ঘুমোয় আর দিনমানেও বেশির ভাগ সময় এখানে পড়ে থাকে তার নাম বিলাসী। আগে শ্মশানে রাত কাটাতে, কপালী বাবাকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করে, রাধার বাপ মরে যাওয়ার পর থেকে কপালী বাবার হুকুমে সে রাধার কাছে থাকে। ভাইটা তো বাপ মারা যাবার পরে-পরেই নিরুদ্দেশ। রাধা খুশি মনেই তার খাওয়া দাওয়ার ভার নিয়েছে। রাত পর্যন্ত আসছে না। দেখেও বিলাসী উতলা হয়নি। কারণ এটা কোনরকম অনিয়মের মধ্যে পড়ে না। কোথাও গাইতে গেলে ফিরতে রাত হয়, কপালী বাবার সঙ্গে শ্মশানে বা তাঁর ডেরার জংলি কালীর কাছে গিয়ে বসলেও ফিরতে কত সময় বেশি রাত হয়ে যায়।

দাওয়ায় পড়ে এক ঘুম দিয়ে ওঠার পরেও বিলাসী ঘরে চুপি দিয়ে দেখে রাধা নেই। কত রাত জানে না, কিন্তু গহিন রাত এটুকু আন্দাজ করতে পেরেছে। তখন দুর্ভাবনা শুরু হয়েছে।

…শনি মঙ্গলের রাত কপালী বাবা শ্মশানে কাটান। অন্য পাঁচ দিন ঘরেই নিজের জংলি কালীর পুজো নিয়ে থাকেন। রাধার ঘর থেকে পিছনের পুকুর পার দিয়ে জংলা পথ ধবে গেলে দশ মিনিটের মধ্যে তার ডেরায় যাওয়া যায়। আর সামনের ঘুর পথ ধরলে মিনিট পনেরো লাগে। কপালী বাবার আজ ঘরেই থাকার কথা। কিন্তু এত রাতে বিলাসীর পিছনের জংলা পথ ধরে যেতে সাহস হয়নি। ঘরের শিকল তুলে দিয়ে লণ্ঠন নিয়ে সামনের রাস্তা ধরেই গেছে। গিয়ে দেখে জংলি কালীর সামনে মাটির মেঝেতে শুয়ে বাবা গভীর ঘুমে। ভয়ে ভয়ে তাকে ঠেলে তুলল।

রাধা এত রাতেও ঘরে ফেরেনি শুনে তিনি হকচকিয়ে গেলেন। মায়ের মূর্তির দিকে খানিক চেয়ে থেকে বিলাসীকে বললেন, এত রাতে আর কোথায় খোঁজ করব, তুই ঘরে যা, আমি সকাল হলেই যাচ্ছি।

এসেছেন। গত দিনে কখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ছিল আর কোথায় গেছল জিগ্যেস করেছেন। তারপর দাড়িতে খানিক হাত বুলিয়ে বলেছেন, এক কাজ কর, মনোহর পাইকের ঘর চিনিস তো?…পা চালিয়ে চলে যা, বলবি আমি এক্ষুনি ডাকছি।

মনোহর পাইকের ডেরা এখান থেকে মাইলটাক দূরে।

মনোহর পাইক বাবার সাম্প্রতিক কাজের ভক্ত। বছর পাঁচেক আগেও রাধাকে জ্বালাত বলে বাবাটি ওকে ত্রিশূল নিয়ে তাড়া করেছিলেন। মনোহর এখন তা বলে বাবার সাধন-ভজনের ভক্ত নয়, তেল-তত্ত্ব এবং তোয়াজ তোষামোদ কলায় সিদ্ধহস্ত। তার বাপ সাইকেল রিকশা চালাতো, সেই বাপ দু’বছর হল গত হয়েছে, মনোহর পাইক তার বাবু ছেলে। ঘরে বিধবা মা ছাড়া আর কেউ নেই। বছর পঁচিশ ছাব্বিশ বয়েস এখন, রাধার থেকে বছর দু’সাত বড়। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই তার রাধার দিকে চোখ। উপযুক্ত ছেলের বিয়ে দেবার জন্য তার মা নাকি মাথা খুড়ছে, কিন্তু ছেলের বিয়েতে মতি নেই। বাপ। রিকশ চালাতে, ছেলে ঝকঝকে একটা শৌখিন সাইকেলে চেপে গ্রাম শহরে টহল দিয়ে বেড়ায়। পরনে সর্বদা চকচকে চোঙা প্যান্ট, গায়ে নানা রঙ বেরঙের দামী জামা, হাতে ঘড়ি, পায়ে পালিশ করা জুতো, মুখের সিগারেট কপালী বাবা কখনো দেখেন নি কিন্তু শ্রদ্ধাবনত হয়ে সামনে এলে গন্ধ পান। বার প্রতি তার বিগলিত ভক্তির একটাই কারণ। রাধার গার্জেন বলতে এখন কপালী বাবা। মনোহরের বড় আশা এই বাবাটি যদি একবার মুখ খোলন বা হুকুম করেন, রাধা সুভড় করে তার ঘরে চলে আসবে। সাহস করে কপালী বাবার একটা দুর্বল জায়গায় হাত ফেলতে পেরেছে মনোহর। রক্তাম্বর ধুতি চাদর দিয়ে প্রণিপাত শুরু করেছিল, সেটা এখন ‘কারণে’ দাঁড়িয়েছে। দিশির মধ্যে সেরা অর্থাৎ যাকে বলে ‘বেলায়তি’, সে-রকম এক-একটা বোতল এনে তার চরণের সামনে রাখে। এই কারণ-সুধার স্বাদ তিনি কমই পান। ভক্তদের মধ্যে যারা যা এনে দেয় তা নির্জলা দিশি, আর… সঙ্গে যা পান করেন তা একেবারেই চোলাই। আগে শববাহকরা যা একটু ভালো-মন্দ বাবাকে খাওয়াত ওই নোহরের ভক্তির ঠেলায় তার থেকেও ভালো জিনিস জুটছে।

তার উদ্দেশ্য কপালী বাবা গোড়া থেকেই জানেন। তাই প্রথম দিন পায়ের কাছে বোতল রাখতেই চোখ লাল করে তার দিকে তাকিয়েছিলেন। তোর তাহলে এসব চলে?

জিভ কেটে নাক-কান মলে মনোহর মাথা নেড়েছে। খায় না। এই ‘কারণ প্রণামীর গুণেই মনোহরের কিছুটা অন্তরঙ্গ হওয়া সহজ হয়েছে। বাবা খোলাখুলি জিগ্যেস করেছেন, তোর বাপ তত রিকশ চালাতো, তুই এত বাবুয়ানি করার টাকা পাস কোথায়?

মনোহর তক্ষুনি কালীর দিব্বি কেটে বলেছে, তার সবই উপার্জনের টাকা, হকের টাকা, দিন-কাল বুঝে সে কাজের লাইন বদলেছে, তাইতেই ভালো রোজগার হচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন, কী কাজ করিস তুই?

মনোহর দালাল শব্দটা মুখে উচ্চারণ করেনি। বাবাকে বুঝিয়েছে, সব লেন-দেনের কাজের মধ্যেই আজকাল মাঝখানে একজন লোক থাকে, যে দুই পার্টির যোগাযোগ করিয়ে দেয়। যেমন একজন টাকার দরকারে জমি বেচবে আর একজন কিনে বাড়তি টাকা খরচ করবে দু’জনের যোগাযোগ করিয়ে দিলে দু’তরফ থেকেই তার কিছু পাওনা হয়। তেমনি কারো চালের আড়ত আছে, সে তিন টাকা কিলো দরে একশ বস্তা চাল ছাড়বে, আবার কলকাতার কোনো চালের ব্যবসায়ী চাল দেখে সাড়ে তিন টাকা দরে সেই চাল কিনতে রাজী, তার তখন কিলো প্রতি আট আনা লাভ–মাল পৌঁছে দেওয়ার খরচ-খরচা বাদ দিয়েও কিলো প্রতি চার পাঁচ আনা নেট লাভ তো থাকবেই।

কপালী বাবার দু’চোখ কপালে বলিস কি রে?

তার আসল রোজগার যে চোলাইয়ের দালালি থেকে এটা মুখ ফুটে বলার মতো বোকা সে নয়। চোলাই তৈরি করে এমন তিন তিনটি ঘাটির মাল মেয়ে মজুবনির মারফত নানা জায়গায় চালান করেই কাঁচা টাকার মুখ দেখছে সে।

কপালী বাবার বিবেচনায় ছেলেটা চৌকসই বটে। অতএব রাধার মন বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। শুনেই রাধা ঝাঁঝিয়ে উঠেছে, ওটা হাড়-বজ্জাত, খবার তুমি ওকে আস্কারা দেবে না বাবা।

কারণের লোভে এ-মেয়েকে তার অনিচ্ছায় কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার লোক নন তিনি। তাকে সোজা বলেছেন, যা চাইবার সোজা মায়ের কাছে চাইবি, নামঞ্জুর করলে সব পাওয়া যায়, নইলে লবডঙ্কা।

আরজি নিয়ে মা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে এ বিশ্বাস মনোহরের নিজেরও নেই। অতএব এ ব্যাপারেও সে কপালী বাবাকে মিডলম্যান হিসাবেই তোয়াজ করে চলেছে।

বিলাসীর মুখে খবর শুনে মনোহর তার সাইকেল উড়িয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে এলো। কপালী বাবা তীক্ষ্ণ চোখে প্রথমে তাকে নিরীক্ষণ করেছেন। কাল দুপুরে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি.. তার কী হতে পারে?

মনোহর আর্তনাদ করে উঠল, অন্তর্যামী হয়ে বাবা আপনি আমাকে শুধাচ্ছেন?

ভেবে চিন্তে কপালী বাবা তাকে বিবিমায়ের থানে, তারপর বড় পীরের মাজারে আর একবার শ্মশানে খবর নিয়ে আসতে বললেন।

মনোহর পাইক আবার সাইকেলে উড়ে গেছে। মিনিট চল্লিশের মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরেছে। তার খবর, বিবিমায়ের থান থেকে রাধা একটু রাতেই রওনা হয়েছিল, মাজারে বা শ্মশানে তার কোনো খবর নেই।

কপালী বাবা বলেছেন, চট, করে একবার বিষ্ণুপুরে ওর বোনাই হারাণ মণ্ডলের কাছ থেকে ঘুরে আয়, সেখানে যদি গিয়ে থাকে–

হারাণ মণ্ডল লোকটাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না মনোহর। তার ধারণা, বয়সে চৌদ্দ পনেরো বছরের বড় হলেও ওই লোকটারই শালীর ওপর সব থেকে বেশি চোখ। এমন খবরও বিলাসীর মারফত কানে এসেছে বিয়ের প্রস্তাব দিতে রাধা নাকি তাকে ঘর থেকে বার করে দিয়েছিল। বাবার পেয়ারের চেলাকে বিলাসী বলবেই বা না কেন? বিলাসী তাকে সুনজরেই দেখে।

মনোহর গলায় প্রতিবাদের সুর তুলেছে, রাধা সেখেনে যেতে যাবে কেন?

-একবার গিয়েই দ্যাখ, না, হাজার হোক বোনাই তো…মান ভাঙাবার জন্যও তো গিয়ে থাকতে পারে।

অর্থাৎ বিলাসী তাকে গোপনে যে খবরটা দিয়েছে, বাবাকেও তা বলতে বাকি রাখেনি। ঐ সম্ভাবনার কথা শোনামাত্র মনোহরের বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠেছে। তক্ষুনি সাইকেলে উঠে ছুটেছে। তিন কোয়াটারের মধ্যে হারাণ মণ্ডলকে সাইকেলের ক্যারিয়ারে তুলে নিয়ে ফিরেছে। এ সংবাদ শুনে সে-ই বা ঘরে বসে থাকে কী করে?

এই করে বেলা বেড়েছে আর লোক বেড়েছে। বিবিায়ের থান থেকে শফিদার মা এসেছে, বড় পীরের মাজার থেকে তাজউদ্দীন পীর সাহেব এসেছে, প্রথমে কাছের, পরে দূরের প্রতিবেশীরাও এসেছে। কপালী বাবা, শফিদার মা আর পীর সাহেব একত্র হলে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ছুটে আসবেই, আধ-মাইল দূর থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসেছে নিতাই স্যাকরা। রাধার কোনো প্রেমিক নেই, তা বলে রাধাকেও কেউ প্রেমিকার চোখে দেখবে না। এ তো আর নয়। মনোহর পাইক আর হারাণ মণ্ডলের পরে তৃতীয় দাবিদার নিতাই স্যাকরা। সাত আর পাঁচ বছরে দুটো ছেলে মেয়ের বাপ, ছেলে হবাব ছ’মাসের মধ্যে তার বউ সৃতিকায় মরেছে। হারাণ মণ্ডলের কাছাকাছি বয়েস, দু’জনে বন্ধুও ছিল, আর দু’জনেরই উনিশ-বিশ একই রকমের কপাল। তফাতের মধ্যে হারাণের শিশু সন্তান দুটোও মরেছে, সে ঝাড়া হাত পা, আর নিতাই স্যাকরার ছেলে মেয়ে দুইই বেঁচে, তাদের স্বাস্থ্যও ভালো। নিতাইয়ের সঙ্গে হারাণ মণ্ডলের মনোমালিন্যও বাবাকে নিয়েই। রাধার মুরুব্বি হিসেবে হারাণের ইচ্ছেটা নিতাই তার কাছেই প্রকাশ করেছিল। ফলে এখন মুখ দেখাদেখি বন্ধ।

…তা সবার সেরা অর্থাৎ সব থেকে উত্তেজনার খবরটি সে-ই এনেছে। এখবরের যোগানদার যে-সে লোক নয়, সকলের সব থেকে পরিচিত এবং শ্রদ্ধার মানুষ ডাক্তার বিজন চৌধুরী। খানিক আগে তিনি বৃদ্ধ কালী ভক্ত দোতারবাবুকে দেখতে এসেছিলেন। দোতারা বাবু রাধাকে খুব স্নেহ করেন, মাঝে মাঝে ডেকে এনে গান শোনেন। বছরে দু’তিনবার রাধাকে তিনি টাকা-কাপড় দ্যান। তাকে দেখতে এসে বিজন ডাক্তার রাধার দুর্বিপাকের কথা বলেছেন। রাধাকে তিন ডাকাত জঙ্গল থেকে মুখ বেঁধে নিয়ে কুলপির কাছে এক চাষের জমির কুজিঘরে এনে তুলেছিল। ওকে বেঁধে ফেলে রেখে ডাকাতরা ফুর্তি করার জন্য মদ কিনতে গেছল। সেই ফাঁকে এক বুড়ী এসে তাকে উদ্ধার করে। খুব সম্ভব রাগের চোটে ওই ডাকাতরাই বুড়ীকে গলা টিপে মেরে ফেলে। বিজন ডাক্তার সেই বুড়ীকে দেখে তবে দোতারা বাবুর কাছে এসেছেন। রাধা এখনো থানার ও সি ঘোষ সাহেবের হেপাজতে কাল রাত থেকে আছে।

দোতারা বাবুর বাজার সরকার নিতাইয়ের বন্ধু। তার দোকানে বসে তেষ্টা মেটায়। রাধার ব্যাপারে বন্ধুর মনও জানে। খবরটা শুনে সবার আগে সে বন্ধুকে জানানো কর্তব্য ভেবেছে। নিতাই স্যাকরা সবে তখন দোকানের ঝাঁপ খুলতে যাচ্ছিল। দোকানের চিন্তা মাথায় তুলে সে ছুটতে ছুটতে রাধার ডেরায় এসেছে এবং সকলকে হালের খবর দিয়েছে। এর পর লোক আসা বাড়তেই থেকেছে।

.

জিপ থেকে আগে রাধা নামল। তার বেশবাস দেখে অন্য সকলে ছেড়ে কপালী বাবা পর্যন্ত অবাক। মুখখানা বেজায় গম্ভীর অবশ্য, কিন্তু নতুন দামী জামা-কাপড়ে দেখাচ্ছে কি সুন্দর। তারপরেই থানার ও সি সাহেবকে নামতে দেখে কার মুখে আর কথা সরবে?

কপালী বাবা দাওয়ায় দাঁড়িয়ে। তার পাশে পীর সাহেব আর শফিদার মা। উঠোন ধরে এগিয়ে গিয়ে রাখা আগে কপালী বাবার পায়ে মাথা রেখে প্রণাম করল। তারপর অন্য দু’জনকে। রক্তাম্বর বেশে কপালী বাবাকে অংশুমান সেই প্রথম দেখলেন। অন্য দু’জনকেও, কিন্তু এই একজনকেই মেয়েটার গুরু মনে হল। থানায় ফে ছাড়া তার আর করণীয় কিছু নেই এখন। তবু দাওয়ায় উঠে একবার সামনের ঘরটার ভিতরে উঁকি দিলেন। মাটির ঘরের তকতকে মেঝের কোণে অনেকগুলো ছোটবড় দেব-দেবীর ফোটো দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো।

বিৰি মায়ের স্থান থেকে ফেরার সময় অংশুমানেরও কেন যেন ইচ্ছে হয়েছিল মেয়েটাকে আবার থানায় ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীর হাতে তুলে দেন। মুখ ফুটে সে-প্রস্তাবও করেছিলেন। রাধা মাথা নেড়েছে, এখন না।

-কেন, তুই তো বুঝতে চেয়েছিলি, তোকে বাঁচানোর জন্য তোর মা-কালী ওই বুড়ীকে কেন নিল।…তা আমি যা খবর পেলাম বুড়ীটা ভালো লোক ছিল না, ওকে টাকা খাইয়ে অনেক বদ লোক ওখানে আশ্রয় নিত, মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তিও করত, তোর বেলায় তার সুমতি হয়েছিল, তার ফল পেল, আর বোঝার কী আছে?

রাধা তার দিকে তাকায়নি, সামনে চোখ রেখে বলেছিল, মা-কালী। ওর ওপর ভর না করলে তার এমন সুমতি হতে যাবে কেন…।

-তাই না-হয় হল, কিন্তু তোর বোঝা তত হয়ে গেলো, এখন যেতে আপত্তি কি?

-না।…তোমার কাজ হয়ে গিয়ে থাকে তো আমাকে এখানেই ছাড়ি দিতে পারো।

আর জোর না করে অংশুমান তাকে তার ডেরায় নিয়ে এসেছেন। ঘরটা একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিয়ে আর অনুরোধ না করে চলে গেলেন।

রাধা তার ঘরের মধ্যে।

মাতনের চার ভাগের তিন ভাগ বাসিন্দা মুসলমান, বাকিরা নানা বর্ণের হিন্দু। ভিড় করে আছে যারা তারা প্রায় সকলেই সাধারণ মানুষ, রাধাকে বেশির ভাগই ভালবাসে। মেয়েটার কী হল, চূড়ান্ত সর্বনাশ কিছু হয়ে গেল কিনা এটা জানা বোঝার জন্য তারা ব্যাকুল। যদিও অনেকেরই বিশ্বাস ( তাকে দেখার পর আরো বেশি) এ-মেয়ের বড় ক্ষতি করার সাধ্য কারো নেই। আবার এই রাধা-অঙ্গের প্রতি ভিতরে ভিতরে লুব্ধ জোয়ান মরদও বেশ কিছু আছে, আর তার চলন বাঁকা দেখে এমন মেয়ে-পুরুষও নেই এমন নয়। তাই কপালী বাবার আদেশ আর ফকির সাহেব তাজউদ্দীন আর বিবিমায়ের পূজারিণী শফিদার মায়ের অনুরোধে ভক্ত হিন্দু মুসলমানদের বেশির ভাগই চলে গেল বটে, আবার অনেকে ভালো করে জানা যোঝর জন্য দাঁড়িয়ে রইলো। এবারে কপালী বাবা তেড়ে এলেন, তাঁকে সাহায্য করল মনোহর পাইক আর নিতাই স্যাকরা। শেষ পর্যন্ত ভগ্নিপতি হারাণ মল, মনোহর পাইক আর নিতাই স্যাকরা ছাড়া একে একে সকলেই চলে গেল।

রাধা তার মাটির ঘরে দরজার হাত দুই দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। তিন জন ছাড়া বাকি লোকদের চলে যেতে দেখল। অবশ্য তাজউদ্দীন, শফিদার মা আর কপালী বাবা ছাড়া। এবারে মাটির উঠোনের মনোহর আর নিতাইয়ের সঙ্গে রাধার চোখাচোখি। আঙুল তুলে রাগত মুখে তাদের দেখিয়ে কপালী বাবাকে ইশারা করল, ওদেরও চলে যেতে বলো।

কপালী বাবা মনোহরের ওপর সদয় একটু, তাকে বললেন, সকাল থেকে তুই অনেক করেছিস বাবা, এখন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করগে যা। তারপর নিতাইয়ের দিকে ফিরলেন, তুই দাঁড়িয়ে কেন বাপু, এক্ষুনি কোনো গয়না-পত্র বানানোর অর্ডার পাবার আশায় নাকি?

মনোহর ক্ষুদ্ধ হয়ে তার সাইকেল নিয়ে চলে গেছে, আর কপালী বাবার মুখের কথা শেষ হবার আগেই নিতাই স্যাকরা প্রস্থান করেছে। রাধার দু’চোখ এবার ভগ্নিপতির মুখের উপর।

চৌদ্দ বছরের বড় হারাণ মণ্ডল কুকড়ে গিয়ে একবার কপালী বাবা আর একবার শালীর দিকে তাকালো। অর্থাৎ আদেশ বা ইংগীত পেলেই সে-ও উঠোন ছেড়ে প্রস্থান করবে। কিন্তু রাধা কেবল একটু চেয়েই রইলো, কিছু বলল না বা ইশারা করল না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে উঠোনের বাইরে এসে দাঁড়ালো। কপালী বাবা তাকে ডাকিয়ে এনেছে, আদেশ না পেলে যায় কি করে।

ফকির সাহেব, শফিদার মা আর কপালী বাবা এবারে ঘরে ঢুকলেন। তারা জানা বা শোনার জন্য কম উৎসুক নয়। মেঝেতে বসে অল্প কথায় রাধা তবু অঘটনের ব্যাপারটা বলল একসঙ্গে ডালে-চালে কয়েকটা আলু-বেগুন ফেলে বিলাসীও দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতেছে। সব শুনে তাজউদ্দীন বললেন, বড় পীরের দোয়া, বেটীকে বড় ভালবাসেন। শফিদার মা বললেন, বিবিমায়ের কাছে আমি পুজো দেব। আর কপালী বাবা বেশ রাগ করেই বললেন, কত দিন তোকে সাবধান করেছি রাত দুপুরে জঙ্গলের পথে ফিরবি না?

বিমনার মতো রাধা বলল, তাই তো দেখছি গো বাবা, অমন রাত করে তো কত ফিরি, কিন্তু সেদিন বিবিমায়ের থান থেকে জাঙল পথে পা ফেলতেই আমার মনে ডাক দেছিল…কিন্তু তুমি তো জানো। ডাক দিলেই মা-কে পরখ করার ঝোঁক বাড়ে আমার…

*

বাধার এই মনে ডাক দেওয়া আর তার মেজাজের বা রীতির ষোল আনা বুঝতে হলে এবারে বছর পাঁচ ছয় একটু পিছনে তাকানো দরকার।

তখন কত বা বয়েস, তেরো ছাড়িয়ে চৌদ্দও নয়। এর ঢের আগে থেকেই চার বছরের ছোট ভাই বাবুয়াকে নিয়ে বাবা পথে পথে গান গাইতে বেরিয়ে যায়। দূরে গেলে সন্ধ্যার আগে আর ফেরে না। পাঁচ গায়ে, শহরে, এমন কি কলকাতায়ও বাবার উদাও গলার সেই ভক্তিমূলক গানের খুব কদর ছিল। মেয়ে হলেও রাধা বাবার গলার টনটনে স্বর পেয়েছে, সুর জ্ঞান পেয়েছে। বাবা হাতে গোনা কয়েকটা গান গেয়ে সর্বত্র ভালো পয়সা পেত। বিশেষ করে দুটো গান।

‘গিরি এবার উমা এলে,
আর উমায় পাঠাব না,
বলে বলবে লোকে মন্দ,
কারো কথা শুনব না।
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয়,
উমা নেবার কথা কয়,
এবারে মায়ে ঝিয়ে করব ঝগড়া,
জামাই বলে মানব না।

সকলের মতো আর একটা গানও রাখার দারুণ ভালো লাগত।

সেটা শিব-স্তোত্র। বাবার মুখে শুনে শুনে ওই গানও মুখস্ত। একই সুরে রাধা সেটাও গাইতো। কিন্তু বাবার গম্ভীর গমগমে গলার সে গান যেমন আয়ুতে ঝংকার তুলত, ওর গলায় সে-রকম হত না। আর ভাইয়ের চি-চি গলায় সে গান শুনলে বাধা হেসে লুটোপুটি খেত।

…বাবা প্রথমে যেন পেটের নিচ থেকে ‘ওম’ বলে একটা শব্দ বার কবে মিনিট খানেক ধরে রাখত। তারপর গাইত :

‘জয় শিবশংকর, হয় ত্রিপুরারি,
সাধক জনগণ মানসবিহারী।
ত্রিলোকপালক, ত্রিলোকনাশক,
পরাৎপর প্রভু, মোক্ষবিধায়ক।
করুণনয়নে হের ভকতজনে,
লয়েছি শরণ চরণে তোমারি।

এই গান রাধার যতই ভালো লাগুক, শিব-শংকরের মূর্তি যতই চোখে ভেসে উঁকি, ও এ গান গাইলে যেন বাবার গানই মাটি। কিন্তু আগের গানটা বাবা বাবুয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে সে কত জায়গায় গেয়েছে ঠিক নেই। গিরি এবার উমা এলে আর উমায় পাঠাবে না’ বলে সুর চড়ালেই অদ্ভুত একটা শিহরণ জাগত। মনে হত ও নয়, এ গান যেন ওর মা গাইছে, আর রাধাই যেন উমা, তাকে স্বামীর ঘরে পাঠানো না পাঠানো নিয়ে মায়ের সঙ্গে বাবার বোঝাপড়া হচ্ছে।

মেয়ে যে জন্মগত ভাবে গানের গলা পেয়েছে সুর-ভাব পেয়েছে এটা বাবারও মনে হত। মায়ের গান দু’চারটে তো প্রথম বাবার কাছেই শিখেছে। কিন্তু রাখার মনে বড় দুঃখ বাবা ভাইকে নিয়ে গাইতে বেয়োয়, ওকে নিয়ে নয়। ওর ধারণা, ওকে নিয়ে বেরুলে বাবার এর থেকে ঢের বেশি রোজগার হবে। কিন্তু বাবা মোটে কানই পাতে না। বায়না ধরলে ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়। বলে, হুঃ, তোকে এসবের মধ্যে টেনে শেষে আমি বিপদে পডি আর কি, বড় হচ্ছিস খেয়াল আছে…

বাবার সঙ্গে বেরুবে, গান করবে, মায়ের নাম করবে তাতে বিপদ কি হতে পারে রাখা ভেবেই পায় না। বাবার কথাগুলো সর্বক্ষণ মাথার মধ্যে নড়াচড়া করেছে। রাতে স্বপ্ন দেখল, কপালী বাবার জংলি কালী ওর দিকে চেয়ে মিটি মিটি হাসছে আর বলছে, কাজ নেই বাপু আমার নাম করার জন্য পথে বেরিয়ে, কখন কি বিপদ হয় ঠিক আছে। ঘরের মেয়ে ঘরে থাক।

এ-স্বপ্ন রাধা কোনদিন ভুলবে না। কপালী বাবার ডেরায় তার জংলি কালীর সঙ্গে রাধার বলতে গেলে প্রায় রোজই দেখা হয়। হবে না কেন, সকালের খাওয়া খেয়ে বাবুয়াকে নিয়ে বাবা সমস্ত দিনের মতো বেরিয়ে পড়তে রাধার আর বাধা কোথায়?

বেপাড়ায় টহল, জঙ্গলে গিয়ে ঢোকে। কপালী বাবার ডেরায় যায়, সপ্তাহের শনি মঙ্গল বারে তিনি বিপুরের শ্মশানে থাকেন, কম দূর নয় কিন্তু রাধা দিব্বি হেঁটে চলে যায়, আরো দূরে বিবিমায়ের মন্দিরে যায়–বুড়ো ফকির সাহেব ওকে বড় ভালবাসেন, বড় পীরের সমাধি দেখিয়েতিনি কতজাগ্রতওর কাছে তাই নিয়ে কত গল্প করেন। আবার পর-পর তিন-চার দিন ওকে না দেখলে শফিদার মা বলেন, ক’দিন দেখা নেই বিবিমায়ের ওপর টান চলে গেল নাকি তোর।

কম দূরে থাক এসব জায়গায় আসার টান রাধার বেড়েই চলেছে। …বড় পীরের মাজারে কত দূর-দূর থেকে লোক আসে, মোম আর ধূপ কাঠি জ্বেলে সারি দিয়ে মৌন প্রার্থনায় বসে যায়, ফল দিয়ে যায়, মানত থাকলে মুরগী দিয়ে যায়। বিবিমায়ের গান আরো বেশ মজার জায়গা। মাথায় ঘোমটা টেনে বিবি বসে আছে, কোলে একটা বড়সড় মেয়ে দাঁড়িয়ে, দু’জনেরই পরনে লাল পাড় শাড়ি, গায়ে জামা, বিবিমায়ের বুক পর্যন্ত সাদা জালি কাপড়ে ঢাকা। এখানেও দূর দূর থেকে বেশির ভাগ সব-জাতের মেয়েরাই পুজো দিতে আসে, কার ছেলে হয় না, কার শ্বশুর বাড়িতে যা, কার বিয়ে হচ্ছে না, কার স্বামীর চাষ-আবাদ ভালো হচ্ছে না, কার স্বামী বিচারের আসামী। ইত্যাদি। সব আসে, মানত করে পুজো দিয়ে যায়। পুজোর নিয়মও বেশ মজার ভাবে রাধা। গ্রাম-শহর ঢুঁড়ে বাড়ি বাড়ি চাল ভিক্ষে করে এনে সেই চাল বাজারে বিক্রি করে যা পাওয়া যাবে সেই টাকা দিয়ে আবার চাল ডাল কাঁচা দুধ ডাব ইত্যাদি কিনে পুজো দিতে হবে।

পুজোর আগে বা পরে শফিদার মা এক এক-হাত একদিকের কানের ওপর রেখে গান করে।

শফিদার মায়ের এখন আর গলায় তেমন সুরটুর নেই, বয়েসও হচ্ছে, তবু শুনতে বেশ লাগে রাধার। শুনতে শুনতে এখানকার গানও তার রপ্ত হয়ে গেছে, সামনে থাকলে শফিদার মায়ের সঙ্গে গলা দেয়, গান করে, আর তখন খুব জমে ওঠে।

তবে তার সব থেকে বেশি টান কপালী বাবা আর তার জংলি কালীর ওপর। এমন স্বপ্নটা দেখে ওঠার পর মনে হল মা-কালী যেন ওর সঙ্গে রঙ্গ করল, বিপদের ভয়ে ওকে ঘরে সেধিযে থাকতে বলল। নিজে মা বিপদ নিয়ে খেলা করে আর ওকে কিনা এই ঠাট্টা! ব্যস রোখ চেপে গেল।

এরপর কপালী বাবার কাছে গিয়ে বাবার কথা বা স্বপ্নের কথা কিছুই বলল না। তাঁকে গিয়ে ধরল ওকে অনেক কালীর গান শেখাতে হবে। কপালী বাবাব গানের গলা অবশ্যই বাবার মতো নয়, আর একটু ফাঁসফেঁসেও। কিন্তু অনেক গান জানেন, আর ভাবে বিভোর হয়ে গান যখন রাধার একটুও খারাপ লাগে না। এমন একটি ছাত্রী পেয়ে বাবা খুব খুশি। রাধার গলা কত সুন্দর তাতে তিনি জানেন।

মনে ডাক দেওয়ার ব্যাপারে সেই ছেলেবেলাতেই অনেক রকমের ব্যাপার ঘটে গেছে।…যেমন ঘরে ফিরে বাবার একবার মনে হয়েছিল পয়সা আরো অনেক বেশি পড়েছিল, কিন্তু বাড়ি এসে গুনে দেখা গেল অত নয়। গান গাইতে গাইতে যেখানে দাঁড়িয়ে যায়, বাড়ির এক-তলা দোতলা বা কলকাতায় গেলে তিন-চার তলা থেকেও সিকি আধুলি এমন কি টাকাও পড়ে, পাঁচ দশ পয়সার তো কথাই নেই। সে-সব বাবুয়া তুলে কাঁধে ঝোলানো থলেতে ফেলে। রাস্তার লোক যার দিয়ে যায় তারা সোজা থলেতেই ফেলে। বাবুয়া সে-সব দিদির হাতে তুলে দেয়, রাধা বাবাকে জানায় এত হল, তারপর তুলে রাখে। সেবারে কত হল শুনে বাবা একটু অবাক হয়েই বলল, সে কি রে, আজ তো মনে হয়েছিল অনেক বেশি পেলাম।

বাবা সরে যেতে রাধা বার কয়েক ভাইয়ের দিকে তাকালো। তারপর কথা নেই বার্তা নেই তার গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল।–পাজি তোর মুণ্ডুটা আমি ছিঁড়ে নেব, কোথায় পয়সা লুকিয়েছিস বার কর!

বাবুয়া বিষম ভেচাকা খেয়ে গেল, তবু জোর প্রতিবাদ তুলল, বা রে, আমি পয়সা সরিয়েছি তোকে কে বলল–

রাধার আবার হাত উঠল।–আমাকে মা-কালী বলে দেছে, কোথায় রেখেছিস বার কর আগে–

বাবুয়া সুড়সুড় করে তার লুকনো জায়গা থেকে আরো চার টাকা বারো আনা বার করে আনল। অল্প-স্বল্প বোজই সরায়, সেদিন অনেক পেতে লোভে পড়ে অনেক বেশিই সরিয়েছিল। বাবুয়া এরপর দিদির হাতে পায়ে ধরেছে, আর কখনো করবে না, নাক-কান মলেছে।

আশ্চর্য, এমন চিন্তা কোনোদিন রাধার মনের ধারে কাছেও ছিল না। বাবার ওই কথা শোনার পর ভাইয়ের দিকে তাকাতেই কেউ যেন ওর ভিতর থেকে বলে দিল, ওকে ধরে ঝাঁকালেই পয়সা বেরুবে।

…আর একবার। ওদের কুটীর গঙ্গার অর্ধেকেরও ও-ধারে শ্যাওলা-ছাওয়া জলে হঠাৎ চমৎকার একটা গোলাপী আভার মস্ত পদ্ম ফুটেছে দেখল। কুটীর গঙ্গা বলতে বাড়ির পিছনের নোঙরা পুকুরে। এখানে সব বাড়ির সব পুকুরই গঙ্গা। বাড়ির নাম বা পদবীর নামের সঙ্গে জুড়ে পুকুরকে গঙ্গা বলা হয়। সেই কোন্ কাল থেকে লোকের বিশ্বাস এখান দিয়ে গঙ্গা বয়ে গেছল, এখনো কিছু মাটি খুড়লেই জল বেরোয়–তাই ছোট-বড় সব পুকুরই গঙ্গা। বেলা তখন এগারোটা সাড়ে এগারোটা হবে। পুকুরের ওদিকটায় শ্যাওলা শুধু নয় আগাছায় ভর্তি। সাত আট বছর বয়েস থেকে এই পুকুরেই রাধা হুটোপুটি করে চান করেছে, সাঁতার কেটেছে। কিন্তু পুকুরের যা অবস্থা এখন, এ-জলে প্রায় চান করাই বন্ধ করে দিয়েছে। বিশ পঞ্চাশ গজ দূরের প্রতিবেশীদের মানে বাড়ইদের গঙ্গায় চান করে। পদ্মটা দেখে রাধার ভারি লোভ হল। ওটা তুলে নিয়ে বাবার জংলি কালীর পাযে দিতে পারলে বেশ হয়। কালীর পদ্মপ্রীতির কথা জানা নেই, কিন্তু অমন সুন্দর ফুল কার না ভালো লাগবে?

শাড়িটা গাছ-কোমর করে নামতে যাবে ওমনি ভিতর থেকে কেউ যেন সাবধান করল, যাসনি, বিপদ হবে। রাধা মুহূর্তের জন্য থমকালো। তারপরেই মনে হল মা-কালীকে দেবে ভেবেছে, তাই তাঁরই কৌতুক-মাখা নিষেধ এটা। রাধা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। শ্যাওলা আর আগাছা ঠেলে অনেক কষ্টে পৌঁছুল, ফুলটাও তুলল। তারপরেই চিওির কাণ্ড। কাপড়ে টান, আগাছা বা কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। যত ছাড়াতে চেষ্টা করে শাড়িটা খুলে পায়ে আরো বেশি জড়িয়ে যাচ্ছে। ওই নোঙর। জল খেতে খেতে রাধা চোখে অন্ধকার দেখল। সামনে মৃত্যু, আর বুঝি উদ্ধার নেই। জল যে খুব বেশি তা নয়, কিন্তু ডুব-জলের অনেক বেশি। শেষে অনেক কষ্টে যদি বা ছাড়া পেল বাকি জলটুকু আর সঁতরে আসতে পারে না, দু’পায়ে শাড়ি এমনি জড়িয়ে গেছে। প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়েই চেষ্টা করছে, আর মা-কালীকে ডেকে চলেছে। হঠাৎ পায়ের নিচে মাটি। কোনরকমে রাধা পাড়ে উঠল, ফুলটা কিন্তু তখনো হাতে ধরা। চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ল, আপনা থেকেই অনেকটা বমি হয়ে গেল। প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে সেই ফুল নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে ঘরে ফিরল। বিকেলে সেই পদ্ম মায়ের পায়ে পৌঁছুল, কিন্তু কালীকে ধমকও কম খেতে হল না, রাক্ষসী ফুলের লোভ দেখিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে একেবারে খেয়ে ফেললেই তো পারতিস, ছাড়লি কেন?

…আর একবার কি দুঃসাহসের কাণ্ডই না করে বসেছিল রাখা। অথচ মনে যা ডাক দিয়েছিল তা শুনলেই সে-বিপত্তি ঘটত না। তখন পনেরোয় পা দিয়েছে, বাড়ন্ত গড়নের ছাদ-ছিরি দ্রুত বদলাচ্ছে। কত বদলাচ্ছে সেটা ওই নোহর পাজির চোখ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করলে আরো বেশি অনুভব করতে পারে। কিন্তু সে তুলনায় রাধার মনের বয়েস ছাই যদি একটুও বাড়ত। নইলে ওই হাড় বজ্জাতের কথায় বিশ্বাস করে এমন লোভে পড়ে! ও পনেরোয় পা দিয়েছে মানে মনোহরও একুশে পৌঁছেছে। ওর মায়ের মুখেই শুনেছে ঠিক ছ’ বছরের বড় রাধার থেকে। ছিপছিপে লম্বা আর গায়ে শক্তিও কত রাখে সে-তো হাড়ে হাড়েই বুঝেছে।

.. নুন আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে টসটসে পাকা আধ-মিষ্টি কামরাঙা বোধহয় সব থেকে লোভনীয় খাদ্য রাধার কাছে। ও-ছেলে সেটা বেশ জানে। মাঝে মাঝে বাড়িতে এনে রেখে বলে, মা তোর জন্য কামরাঙা এনে রেখেছে–যাস। ওর মা সত্যি ভালো মানুষ, রাধার মুখে মায়ের গান শুনে মুগ্ধ হয়, তাই ডাকলে যায়। কিন্তু কামরাঙা খেয়ে আর নিয়ে ফেরার সময়, এমন কি ছল-ছুতোয় মা-কে সরিয়ে কম বজ্জাতি করে না। কামরাঙা লেগে আছে বলে গাল খিমচে ধরে, ভালো কামরাঙা কেড়ে খাওয়ার অছিলায় কাঁধ-পিঠ খাবলে ধরে, হাত ধরে টানাটানি করে। মোটকথা আরো প্রায় দু’বছর আগে থেকেই ওই বজ্জাত ছেলে ওর দেহটার ওপর হামলা করে মজা পায়। তবু যদি রাধার শিক্ষা হত আর মগজে কিছু থাকত। কপালী বাবা, ফকির সাহেব আর শফিদার মা মিথ্যেই ওকে বুদ্ধিমতী মেয়ে ভাবে।

ওর জ্বালাতনে রাখা প্রায় দুপুরেই ঘরে থাকে না। দিদির কবেই বিয়ে হয়ে গেছে, বাবুয়াকে নিয়ে বাবা গাইতে বেরুনোর পরেই তো রাধা একেবারে একলা। মনোহর সকালে নিজের ধান্ধায় ব্যস্ত থাকে, তার ফুরসৎ দুপুরে। একবার না একবার আসবেই। ওকে কলা দেখাবার জন্যই রাধা অনেক সময় ঘর ছেড়ে কোথাও না কোথাও চলে যায়। ওর যাবার জায়গার তো আর অভাব নেই। এভাবে জব্দ হয়ে একদিন দিব্বি কেটে বলেছে আর ওকে জ্বালাতন করবে না, মা-কালী নাকি ঘুমের মধ্যে তাকে চোখ রাঙিয়ে নিষেধ করেছে। শোনামাত্র রাধা বিশ্বাস করেছে। দারুণ খুশি। এ তো হতেই পারে, মা-কালী ওকে কত যে ভালবাসে তাতে কোনো সন্দেহ আছে।

এরপর বেশ কয়েকদিন মনোহর ভারি ভদ্র আর ভালো ছেলে। অনুনয় করে সাধাসাধি করে দু’দিন ওর মুখে কালীর গানও শুনেছে। রাধা বুঝে নিয়েছে পাজি ছেলেব মতি ফিরেছে। মা ইচ্ছে করলে কি না হয়।

সেই দুপুরে এসে মনোহর জানালো, ওমুক জায়গায় জলের এক গাছে মস্ত বড়বড় কামরাঙা পেকে টসটসে হয়ে ঝুলছে, মনোহরের দেখেই নাকি জিভে জল গড়িয়েছে তক্ষুনি ভেবেছে রাধাকে নিয়ে আসবে, চোখে দেখলে ও আহ্লাদে আটখানা হবে। বলল, একটা ঝোলা নিয়ে চল কত আনতে পারিস দেখব

শোনামাত্র রাধার দারুণ লোভ হল। কিন্তু তার পরেই কি রকম খটকা লাগল।-বাজে ভাওতা দিচ্ছ না তো?

মনোহর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ংকর আহত যেন। বলল, এখনো আমাকে অবিশ্বাস তোর! যাক্ যেতে হবে না…মা-ই শুনে বলে দিল, যাচ্ছি যখন রাধাকে নিয়ে যা…দেখেও খুশি হবে। আমার মায়ের কথা না-হয় ছেড়ে দে, আমি কার দিব্বি কেটেছি মনে আছে-গাছে কামরাঙা এমন ঝেপে আছে তুই চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবি না–

সংশয় ঝেড়ে ফেলে রাধা জিজ্ঞেস করল, কাঁচা লঙ্কা আর নুন নিয়ে যাব?

নিয়ে নে, এত মিষ্টি যে নুনের খুব দরকার হবে না।

খোশ মেজাজে জঙ্গলে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ালো। কেউ যেন ভিতর থেকে স্পষ্ট নিষেধ করল, যাসনি, মুশকিলে পড়ে যাবি।

-কি হল?

জবাব না দিয়ে রাধা কয়েক পলক তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারছে না। তারপরেই হনহন করে আগে আগে চলল। ভিতর থেকে যে বলল কথাগুলো মনে মনে তাকেই ধমকে উঠল, বেরুবার মুখে বলেনি কেন–মজা পেয়ে গেছ, কেমন? মুশকিলে পড়লে মুশকিল আসানও তুমি করো কিনা আমি দেখে ছাড়ব।

মনোহর সঙ্গ নিয়ে ঘন জঙ্গলের দিকে চলছে। এরই মধ্যে ও প্রথমে একটা হাতের ওপর দখল নিয়েছে, তারপর সেই হাত ওর পিঠে বেষ্টন করে কাঁধে উঠেছে। হেসে বলেছে, জঙ্গলের মধ্যে হোঁচট মাচট খাবি, আমার সঙ্গে পা ফেলে সাবধানে চল। এটুকু বলার ফাঁকে কাঁধের ওপর চাপ বেড়েছে, মুখটা গালে ঠেকেছে। রাধা ঘাড় ফিরিয়ে যেটুকু দেখে নেবার দেখেছে, বুঝে নেবার বুঝেছে। চোখে মুখে লোভ আর মতলব ঠিকরে পড়ছে।…এ ছেলের সঙ্গে গায়ের জোরে পারবে না, উল্টে মাথায় খুন চাপবে হয়তো। ভুল হচ্ছে না, তবু একটু যাচাই করে নেওয়া দরকার, মা-কালীর নামে দিবি করেছিল। ঠোঁটে চেষ্টা করে একটু হাসি টেনে আনল, একবার দু’বার টেরিয়ে তাকালো, বেশ হালকা গলায় বলল, আর যদি যেতে না চাই, ঘরে ফিরে যেতে চাই?

দাঁড়িয়ে গেল। কাঁধটা আরো জোরে চেপে ধরল, দাতে দাঁত চেপে বলল, তাহলে তোর দু’গালে প্রথমে ঠাস ঠাস করে এমন চড় মারব যে চোখে আন্ধার দেখবি, তারপর তোকে এমনি করে বুকের সঙ্গে পিষে মারব! তুই আমাকে অনেক ভুগিয়েছিস

বলেই নিজের বুকের সঙ্গে সজোরে চেপে ধরল, চোখ দুটো কুর লোলুপ।

রাধা এবারে একটু বেশিই হাসছে, সেটুকুই এই ছেলের অবাক হবার মতো যথেষ্ট। কথা শুনে আরো যেন হতবাক।

ছাড়ো, আর বীরত্ব ফলাতে হবে না, তোমার মতলব আমি কামরাঙা খেতে নিয়ে যাবার কথা শুনেই বুঝেছি…আরো ভিতরের দিকে চলল, কে কোথায় এসে পড়বে

এযে এখন সৌভাগ্যের দিন মনোহর কি কল্পনাও করতে পেরেছিল। আজ একটা হেনেস্ত করার জন্য তৈরি হয়েই বেরিয়েছিল, এমন হামলাই করবে যে ওকে বিয়ে করতে এ মেয়েকে রাজি হতেই হবে। কিন্তু বাধাও যে তলায় তলায় ওকে মন দিয়ে বসে আছে জানবে কি করে? ছেড়ে দিয়ে আনন্দে আটখানা হয়ে আবার তার কাঁধ জড়িয়ে ধরল, আর হাসি-হাসি মুখে রাধাও এক হাতে ওর পিঠ বেষ্টন করে এগিয়ে চলল। পায়ের দিকে চোখ। এদিকের জঙ্গলের সবকিছু ওর চোখের দর্পণে। হাসি-ছোঁয়া চোখ তুলে এক-একবার তাকাচ্ছে, আবার মাথা নামিয়ে চারদিকে দ্রুত চোখ চালাচ্ছে।

-এখানেই বসি আয়, কেউ দেখবে না।

–আঃ এসো না!

জোর করেই টেনে নিয়ে চলল। মনোহর হাওয়ায় ভেসে জড়াজড়ি করে চলেছে। রাধা আচমকা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল, মনোহরকে ঠেলে খানিকটা সরিয়ে নিজের দিকে ফেরালো। হাসছে অল্প-অল্প, দু’হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলেই পড়ল প্রায়, বোসো, বসে পড়ো–আর না।

গলায় আর বুকে ওজনের ভারেই মনোহর ধপাস করে বসে পড়ল, রাধা বলতে গেলে প্রায় তার কোলের ওপর, সোহাগ করেই যেন তাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে শুইয়ে দিল, তারপর তেমনি হাসি-হাসি মুখে কয়েক পলক চেপে ধরে থাকল, রাধার সমস্ত দেহই প্রায় ওর উরু আর বুকের ওপর। তারপরেই ছিটকে নেমে এলো।

সঙ্গে সঙ্গে গেছি–গেছি–মরে গেলাম মরে গেলাম! বলে বিকট আর্তনাদ! কিন্তু রাধার কানেই এলো শুধু, দেখার জন্য সে আর দাঁড়িয়ে নেই। জঙ্গলের পথ ধরে হরিণীর মতো ছটছে। …শয়তান এখন কোন যন্তন্নায় দাপাদাপি করছে, সব্ব অঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে খুব ভালো করেই জানে। …গলায় ঝুলে পড়ে মস্ত একটা লাল পিঁপড়ের ঢিপির ওপর ওকে ঝপাং করে বসিয়েছে তারপর বুকের আর শরীরের ওপর চেপে বসে আদর করে শুইয়ে দিয়ে এসেছে। বড় বড় লাল পিঁপড়ে, একটা কামড়ালে অঙ্গ জ্বলে যায়, কম করে কয়েক শ’ কামড়াচ্ছে। জ্বলুক, জ্বলুক, সব অঙ্গ জ্বলে যাক, পাজী ইতর কোথাকার!

এরপর রাধা কেন, পনেরো বিশ দিনের মধ্যেও বাইরের কেউ মনোহরের মুখ দেখেনি। ওদের এক পড়শিনীর মুখ থেকে রাধা জেনেছে, মনোহরের মা নাকি ছেলের দুর্দশা দেখে কপাল চাপড়ে কেঁদেছে, কোন্ গাছ থেকে সে একটা লাল পিঁপড়ের ঢিপির ওপর পড়ে গেছল, শ’য়ে শ’য়ে পিঁপড়ের কামড়ে সব-অঙ্গ ফুলে ঢোল, বিজন ডাক্তারকে বাড়িতে ডেকে এনে চিকিৎসা করাতে হয়েছে, সুঁই নিতে হয়েছে। মরেই যায়নি রক্ষা।

এতটা শুনে অবশ্য রাধার একটু খারাপ লেগেছিল। কিন্তু ওর কি দোষ, দশ বিশটা পিঁপড়ে কামড়ালে ওই রাক্ষসের কাছ থেকে সেদিন ছাড়া পেত!

সুস্থ হবার পরে এক দুপুরে মনোহর এসেছে। তাকে আসতে দেখেই রাধা দরজা বন্ধ করে বসেছিল। মনোহর গলা উঁচিয়ে ফের মা-কালীর দিবি কেটে শাসিয়ে গেছে, এর প্রতিশোধ সে নেবে–এমন প্রতিশোধ যা জীবনে ভুলতে পারবে না।

জবাবে ঘরে বসে বাধা জিভ ভেঙিয়েছে।

কিন্তু এরপর কিছু দিন সত্যিই ও ছায়ার মতো পিছনে ঘুরেছে। আর সুযোগ খুঁজেছে। বাবা ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে রাধা একলা আর টহল দিতে বেরুতে পারে না। মাজারে যাওয়া বন্ধ, বিবিমায়ের থানে যাওয়া বন্ধ। পিছনের পুকুর ধারের জংলা পথে কেবল কপালী বাবার কাছে যেতে পারে। নিরুপায় হয়ে রাধা তার কাছেই সমস্যার কথাটা বলল। ঘটনা শুনে বাবার সে কি হাসি। পিঠ চাপড়ে বলেছেন, ঠিক করেছিস, আমি দেখছি।

তারপর একদিন শ্মশানের রাস্তায় ওকে দেখে কপালী বাবা ত্রিশূল হাতে এমন তেড়ে গেছলেন যে মনোহরের হৃৎকম্প। কোন রকমে পালিয়ে বেঁচেছে। তারপরেও ওর এক বন্ধুর মারফৎ কপালী বাবা শাসিয়ে দিয়েছেন, রাধার গায়ে একটা আঁচড় পড়লে উনি তাকে চিবিয়ে খাবেন।

ছেলে এরপর সমঝেছে। বাড়িতে এসে রাধার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। বলেছে, আমি খুব অন্যায় করেছিলাম, কিন্তু তার জন্য তুই তো আমাকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলি। রাগের মাথায় অমন দিব্বি কেটেছি, দিব্বি তুলে নিচ্ছি, তুই আমাকে ক্ষমা করে দে।

এই আপোস রাধারও কাম্য ছিল। খুশি হয়েই মাথা নেড়েছে।

…এমনি করেই রাধার মনে ডাক দেয়। রাধা থমকায় বটে। কিন্তু তার পরেই রোখ চাপে। পরীক্ষা ভাবে। যে ডাক দেওয়ায়, ওকে রক্ষা করার দায়ও তারই ভাবে! রক্ষা যে করেই থাকে তাতে কি কোনো ভুল আছে? …সেদিন বিবিষয়ের স্থান থেকে জঙ্গলের পথে পা দিতেই ভিতরের কেউ নিষেধ করেছিল। যাসনি, বিপদ হবে। রাধার সেই একই রোখ চেপেছিল। …কিন্তু তিন-তিনটে ডাকাতের হাত থেকে উদ্ধার তো আশ্চর্যভাবে পেল! যে রক্ষা করার সে রক্ষা না করে পারল?


© 2024 পুরনো বই