০৬. চলিতে চলিতে মালতীর কথা ভাবিয়া

চলিতে চলিতে মালতীর কথা ভাবিয়া রাজকুমার শ্রান্তি বোধ করে। কি মধুর ছিল মালতী সম্পর্কে তার গুরুতর কর্তব্যের কল্পনা কয়েক মুহূর্ত আগে! মালতীকে ভালোভাবে বুঝাইয়া দিতে হইবে মালতী কি চায়। জীবনের স্রোতে ভাসিয়া চলিতে চলিতে একটি বিচ্ছিন্ন ফুল অস্থায়ী বাধায় আটকাইয়া গিয়াছে, ভাবিতেছে এইখানে বুঝি তার ভাসিয়া চলার শেষ, আবার তাকে ভাসিয়া যাওয়ার সুযোগ দিতে হইবে তার নিজস্ব পরিণতি, স্থায়ী সার্থকতার দিকে। এই কাজটুকু করিবে ভাবিয়াই নিজেকে রাজকুমারের দেবতা মনে হইতেছিল। ভীরু দুর্বল মানুষের মতো এখন তার মনে হইতে থাকে, মালতীর মুখোমুখি হওয়া একটা বিপদ, মালতীকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা বিপজ্জনক সম্ভাবনায় ভরা।

অবিশ্বাস্য, তবু সত্য। মালতী যে ঘরে তার প্রতীক্ষা করিতেছিল তার রুদ্ধ দরজায় টোকা। দেওয়ার সময় রাজকুমার পূর্ণমাত্রায় সচেতন হইয়া উঠিল যে, দরজার ওপাশে মালতীর স্পর্শ ছাড়া আর সমস্তই অর্থহীন। কথা অবশ্য সে বলিতে পারে যত খুশি, কিন্তু কথার কোনো মানে থাকিবে না। স্যার কে. এল-এর স্যাম্পেনের বোতল খোলার আওয়াজের মতো কথা হইবে শুধু তৃষ্ণার সঙ্কেত, পানীয়ের আহ্বান।

আজ হঠাৎ নয়, চিরদিন এমনি ছিল, মনের অনেক দরজার ওপাশে অনেক মালতীর স্পৰ্শ। এইমাত্র শুধু সেটা জানা গেল। আকাশের মেঘে সে বাসা বাঁধিয়াছিল, সেখান হইতে নামাইয়া আনিয়া রিণি তাকে মাটিতে আছড়াইয়া ফেলিয়াছে, তাই জানা গেল। সন্দেহ করার ভরসাও তার নাই। অভিজ্ঞতার মতো এভাবে যা জানা যায় তাতে কি আর ভুলের সুযোগ থাকেঃ একটি রহস্য শুধু এখন বিস্ময়ের মতো জাগিয়া আছে যে, মালতী কেন? যার জন্য নিজের স্নেহকে একদিন ভালবাসা মনে হইয়াছিল, সে কেন? রিণি আর সরসী থাকিতে মালতী কেন এ অভাবনীয় রূপকে পরিণত হইয়া গেল?

চুলোয় যাক। মালতীকে দুয়ার খুলিবার সঙ্কেত জানাইবার পর মালতী দুয়ার খুলিয়া দেওয়া পর্যন্ত কয়েক মুহূর্ত রাজকুমার ভাবিয়াছিল–চুলোয় যাক। কি আসিয়া যায় মালতী যদি শ্যামলকে। ভালবাসে আর সেই ভালবাসাই তাকে ঠেলিয়া দেয় তার পরম শ্রদ্ধাস্পদ রাজকুমারের দিকে, রাজকুমারকে সে শুধু ভালবাসিতে চায় বলিয়া, রাজকুমারকেই তার ভালবাসা উচিত এই ধারণা পোষণ করে বলিয়া? এ তো সর্বদাই ঘটিতেছে। ভালবাসিবার দুরন্ত ইচ্ছা যে ভালবাসা নয় এ জ্ঞান অনেকের যেভাবে আসিয়াছে মালতীরও সেভাবে আসুক–আজ রাত্রি শেষে, অথবা আগামীকাল। সে নিজে অবশ্য সব জানে। কিন্তু জানা কথা না জানার ভান করা নিজের কাছে এমন কি কঠিন? তার ফরমুলা তো বাধাই আছে–আজিকার রাত্রি স্মরণীয় হোক, কাল চুলোয় যাক।

ঘরের ভিতরে গিয়া এ ভাবটা অবশ্য তার কাটিয়া গেল। কিন্তু ঝড়ের গতিবেগের মতোই আবেগের গতি, বেগ থামিবার পরেও গতি হঠাৎ থামে না। আপনা হইতেই খানিকটা আগাইয়া। চলে।

খাটে বসিয়া রাজকুমার বলে, দেরি হয়ে গেছে, না?

মালতী অট স্বরে বলে, হ্যাঁ।

একলা কষ্ট হচ্ছিল?

আমার ভয়ানক কষ্ট হচ্ছে।

রাজকুমার এতক্ষণে মালতীর দিকে তাকায়। দেয়ালে নিচু ব্র্যাকেটে আলো জ্বলিতেছে, মেঝে আর ওপাশের দেয়ালে মালতীর ছায়া পড়িয়াছে, ছায়ায় তার শাড়ির বিন্যাস ও অবিন্যাস স্পষ্টতর। পিছনের দেয়ালের পটভূমিকায় মালতীকে দেখাইতেছে মনের ক্যামেরায় তোলা পুরোনো ফটোর মতো অস্পষ্টতার রহস্যে রহস্যময়ী–আধ-ভোলা স্মৃতি যেন ঘিরিয়া আছে তাকে। তাড়াতাড়ি কয়েকবার চোখের পলক ফেলিয়া রাজকুমার নিজের চোখের জলীয় ভ্রান্তিকেই যেন মুছিয়া দিতে চায়, তারপর হারানো গোধূলির নিম্প্ৰভ দিগন্তে সোনার থালার মতো নতুন চাদকে উঠিতে দেখিয়া শিশু যেভাবে চাহিয়া থাকে তেমনি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখিতে থাকে মালতীকে। সরসীকে তার মনে পড়িতেছে, হৃদয়-সাগর মন্থনে উথি তা উর্বশী সরসীকে। সে যেন কতদিনের কথা, রাজকুমার যেন ভুলিয়া গিয়াছিল। তেমনি অনবদ্য নগ্নতার প্রতিমূর্তির মতো মালতীকে ওইখানে, যেখানে সে দাঁড়াইয়া আছে কৃত্রিম আলোয় সাজানো পুতুলের মতো, দাঁড় করাইয়া দুচোখ ভরিয়া তাকে দেখিবার জন্য রাজকুমারের হৃদয় উতলা হইয়া ওঠে। দেহে মনে আবার সে যেন সেদিনের মতো নবজীবনের, মহৎ আনন্দের সঞ্চার অনুভব করে। তার আশা হয়, সরসীর মতো মালতীও আজ তাকে সমস্ত শ্রান্তি ও ক্ষোভ ভুলাইয়া দিতে পারিবে, আবার নিরুদ্বেগ মুক্তি জুটিবে তার, আবার সে উঠিতে পারিবে তার আকাশের আবাসে, যে কুলায় ছাড়িয়া নিজের ইচ্ছায় সে নামিয়া আসে নাই।

নিজের অজ্ঞাতসারে রাজকুমার উচ্চারণ করিতে থাকে, মালতী মালতী! পথহারা শ্ৰান্ত মুমূর্ষ শিশু যেভাবে তার মাকে ডাকিয়া কাতরায়।

কিন্তু মালতী শুধু মাথা নাড়ে। রাজকুমার বুঝিতে পারে না, আবার আবেদন জানায়। মালতী মাথা নাড়ে আর আঁচলের প্রান্ত দিয়া নিজেকে আরেকটু ঢাকিতে চেষ্টা করে। কথা যখন সে বলে। তার কণ্ঠস্বর শোনায় কর্কশ।

মালতী বলে, শোন। আমার কেমন যেন লাগছে।

কেমন লাগছে মালতী?

গা গুলিয়ে বমি আসছে।

ক্ৰোধ, বিরক্তি আর বিষাদে রাজকুমারের অনুভূতির আধারে ফেনিল আবর্তের সৃষ্টি হয়। তীব্র সঙ্কীর্ণ বেদনার পুনরাবৃত্তিময় সংক্ষিপ্ত আবেদন ক্ষণিকের নির্বিকার শান্তিতে লয় পায় আর আর্তনাদ করিয়া ওঠে। সে অনুভব করে, স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতরভাবে অনুভব করে, ভয় ও শ্রদ্ধার বশ্যতা, কাব্য ও স্বপ্নের মোহ, আবেগ ও উত্তেজনার তাগিদ, কিছুই মালতীকে ভুল করিতে দিবে না। তার দিকে মালতীর গতি বন্ধ করিয়া কোনদিকে তাকে চলিতে হইবে দেখাইয়া দিবার কথা সে যা ভাবিছিল, তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। মালতী আর আগাইবে না। সে ডাকিলেও নয়, হাত ধরিয়া টানিলেও নয়। শুধু আজ নয়, চিরদিন এই পর্যন্তই ছিল মালতীর ভুলের সীমা। ভুল কি ভুল নয় তাও হয়তো মালতী জানে না, এখনো হয়তো সে ধরিয়া রাখিয়াছে আজ রাত্রেই তার প্রিয় মিলনের রাত্রি, কিন্তু রাজকুমার দুবাহু বাড়াইয়া দিলে সে আসিয়া ধরা দিবে না।

মালতীর সম্বন্ধে এ যে তার কল্পনা নয় সে বিষয়ে রাজকুমারের এতটুকু সন্দেহ থাকে না, অশোকতরুমূলে ক্লেশপাণ্ডুরবর্ণা অধোমুখী সীতার দিকে চাহিয়া দেবতা ব্রহ্মা আর রাক্ষসী নিকষার পুত্র রাবণ যে যন্ত্রণায় অমরত্বের প্রতিকার চাহিত, রাজকুমারও তেমনি যন্ত্রণা ভোগ করে। রাবণের তবু মন্দোদরী ছিল, জীবনে রাবণ তবু ভালবাসিয়াছিল সেই একটিমাত্র নারীকে, একটু যে ভালবাসিবে রাজকুমার এমন তার কেউ নাই। তাছাড়া, তার সীতাকে সে ফিরাইয়া দিতে। চাহিয়াছিল। প্ৰায় গায়ের জোরের মতোই ব্যক্তিত্বের প্রভাবকে ছল বল কৌশল করিয়া রাখিয়া এতদিন সে মালতীকে হরণ করিয়া রাখিয়াছিল, আজ ভাবিয়ছিল তার মনটি পর্যন্ত মুক্ত করিয়া শ্যামলকে ফিরাইয়া দিবে। এই উদারতার কল্পনাটুকু পর্যন্ত তার মিথ্যা, অকারণ অহঙ্কার বলিয়া প্রমাণিত হইয়া গেল!

নিছক অহঙ্কার, অতি সস্তা আত্মতৃপ্তি, নিজেকে কেন্দ্ৰ করিয়া শিশুর মতো রূপকথা রচনা করা। মালতী কবে তার বশে ছিল যে আজ তাকে মুক্তি দেওয়ার কথা সে ভাবিতেছিল? কোনোদিন কিছু দাবি করে নাই বলিয়াই তার সম্বন্ধে মালতীর মোহ এতদিন টিকিয়া ছিল, দাবি জানানো মাত্র মালতী ছিটকাইয়া দূরে সরিয়া যাইত, হয়তো ঘৃণা পর্যন্ত করিতে আরম্ভ করিত তাকে।

বাড়ি যাবে মালতী?

একটু শুয়ে থাকি। বড় অস্থির অস্থির করছে।

রাজকুমার বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইতে মালতী গিয়া শুইয়া পড়িল।

দরজা বন্ধ করে এতক্ষণ ঘরে বসে ছিলাম বলে বোধহয়।

তা হবে।

মিছিমিছি রুমটা নেওয়া হল।

তাতে কি।

সাতটা টাকাই নষ্ট। কি চার্জ! এক রাত্রির জন্য একটা রুম, তার ভাড়া সাত টাকা! কে জানত হঠাৎ এমন বিশ্রী লাগবে শরীরটা?

ও রকম হয় মালতী!

এক হিসাবে ভালোই হয়েছে। তুমি বেঁচে গেলে।

মালতীর ঠোঁটে এলোমেলো নড়াচড়া চলে, চোখের পাতা যেন ঘন ঘন ওঠে নামে চুলগুলি বিশৃঙ্খল হইয়া আছে। তার শোয়ার ভঙ্গিতে গভীর অবসন্নতা। মহাকাব্যের শৃঙ্গারাস্তা রমণীর বর্ণনা রাজকুমারের মনে পড়িয়া যায়।

রাজুদা একটা কথা বলি শোন। তুমি কি ভাববে জানি না। আমি একটা বিশ্রী উদ্দেশ্য নিয়ে আজ এসেছিলাম। মানে, আমার উদ্দেশ্য ভারি খারাপ ছিল।

বল কি, ভারি আশ্চর্য কথা তো!

মালতীর বিবর্ণ মুখে রঙের প্লাবন আসিয়া আটকাইয়া রহিয়া গেল।

তা নয়। ঠিক তা নয়। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে তা হলে তুমি বাধ্য হয়ে বিয়ে করবে।

কেন? নাও তো করতে পারতাম।

তামাশা করছ? এই কি তোমার তামাশার সময় হল? আমার এদিকে মাথা ঘুরছে, কি ভাবছি কি বলছি বুঝতে পারছি না–রাগ করেছ নাকি? তুমি নিশ্চয় রাগ করেছ। তাই এমনিভাবে ছাড়া ছাড়া কথা বলছ–রাগ হয়েছে তোমার।

উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে রাজকুমারের মুখের দিকে চাহিয়া তার রাগের চিহ্ন খুঁজিতে খুঁজিতে মালতী একেবারে উঠিয়া বসে।

রাগ করেছ কেন? তুমি তো জান তুমি যা চাইবে তাই হবে, আমি কথাটি বলব না। সত্যি বলছি, বিয়ের কথা আর মনেও আনব না। এতক্ষণ তাই ভাবছিলাম একটি ঘরে বসে। তুমি যখন ওসব অনুষ্ঠান পছন্দ কর না, আমার কাজ নেই বাবা বিয়ে ফিয়েতে। কিন্তু, মালতীর গলায় করুণ মিনতির সুর ফুটিয়া উঠিল, আমার একটা কথা তোমার রাখতে হবে। বল রাখবে?

কি কথা মালতী?

এক রাত্রির জন্য রুম নিয়ে নয়, চল আমরা কোথাও চলে যাই দুজনে, মাস তিনেকের জন্যে। অন্তত দুমাস। কিছুদিন এক সঙ্গে এক বাড়িতেই যদি না রইলাম–

আজ রাত্রিকে বাতিল করার সমর্থনে এই জোরালো যুক্তি মালতী আবিষ্কার করিয়াছে। আরম্ভ হওয়ার আগেই কাব্য প্রেম স্বপ্ন আর কল্পনা শুধু মনের উদ্বেগ আর দেহের অস্থিরতায় যে পরিণতি হইয়া গেল তার তো একটা কারণ থাকা চাই? সে কারণটি এই। একটি বিচ্ছিন্ন রাত্রির অসম্পূর্ণ ভাঙা প্ৰেম তার ভালো লাগবে না। কাল সকালে ছেদ পড়িবে ভাবিয়া মিলনকে সে গ্রহণ করিতে পারিতেছে না, শুধু এই কারণে দেহমন তার বিরোধী হইয়া উঠিয়াছে। রাজকুমারকে সে ভালবাসে বৈকি?

রাজকুমার নীরবে একটু হাসিল। ভাবিল, মালতী তার অর্থহীন হাসির যা খুশি মানে করুক, কিছু আসিয়া যায় না। মালতীর সঙ্গে বোঝাপড়ারও কোনো প্রয়োজন নাই। মালতী একদিন নিজেই বুঝিতে পারিবে। মালতীর পক্ষে সেভাবে সব বুঝিতে পারাই ভালো।

পরদিন ছুটি ছিল, সকালে কয়েকটি বন্ধুবান্ধব দেখা করিতে আসিল। রাজকুমার বেকার, তার ছুটিও নাই। একটু সে ঈর্ষা বোধ করিল, বন্ধুদের জীবনে কাজের দিনগুলির মধ্যে ছুটির দিন সত্য সত্যই অনেকখানি পৃথক হইয়া আসে বলিয়া। অনেক বেলায় সরসীও আসিয়া হাজির। যত বড় বড় ঘটনাই ঘটুক সরসীর জীবনে, কোনোদিন তার মনে কিছু ঘটে না, কোনোদিন সে বদলায় না, চিরদিন সে একরকম থাকিয়া গেল। আজো তার প্রকাণ্ড একটা মিটিং আছে। রাজকুমার যেন নিশ্চয় যায়। একটু প্রস্তুত হইয়াই যেন যায়, কিছু বলিতে হইবে।

সেদিনের মতো কেলেঙ্কারি কোরো না।

কেলেঙ্কারি করেছিলাম নাকি সেদিন?

প্রায়। শেষটা সামলে গেলে তাই রক্ষা। ঘরোয়া মিটিং ছিল বলে সামলে নেবার সুযোগ পেলে, পাবলিক মিটিং হলে আগেই লোকে হাসতে আরম্ভ করত।

তা হইবে। সেদিন মস্ত একটা বাহাদুরি করিয়াছে এ ধারণাটা এতদিন বজায় রাখিতে না দিয়া আগে সরসী এ খবরটা দিলে ভালো হইত।

রিণির কি হয়েছে জান?–সরসী হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল।

কি হয়েছে?

আমি তো তাই জিজ্ঞেস করছি। বাড়ি থেকে নাকি বার হয় না, কারো সঙ্গে দেখা করে না। পরশু গিয়েছিলাম, দরজা বন্ধ করে ঘরে কি যেন করছিল, দরজা খুলল না, ভেতর থেকেই আমায় বসতে বলল। বসে আছি তো বসেই আছি, দরজা আর খুলল না। দুবার ডাকলাম, সাড়াও দিলে না। শেষে আমি যখন ডেকে বললাম, আমার কাজ আছে আমি চললাম, একটা যাচ্ছেতাই জবাব দিলে।

কি বললে?

সে আমি উচ্চারণ করতে পারব না।

আমার সম্বন্ধে কোনো কথা?

না। তোমার সম্বন্ধে কি কথা বলবে? একটা বিশ্রী ফাজলামি করলে, একেবারে ইতরামি যাকে বলে।

আরো কিছুক্ষণ বসিয়া, কালীর সঙ্গে একটু ভাব জমানোর চেষ্টা করিয়া সরসী চলিয়া গেল। সরসীকে কালী পছন্দ করে না, রাজকুমারের সঙ্গে তাকে কথা বলিতে দেখিলেই তার মুখ কালো হইয়া যায়। এক মিনিটের বেশি কাছে থাকিতে পারে না কিন্তু ঘুরিয়া ঘুরিয়া বার বার কাছে আসে। সরসী আর রাজকুমারের মুখের দিকে তাকায়, ঠোঁট কাড়মায়, হঠাৎ একটা খাপছাড়া কথা বলে, দুপদাপ পা ফেলিয়া চলিয়া যায়।

সেদিন মনোরমার তিরস্কারের পর কালী কেমন বদলাইয়া গিয়াছে। মনোরমা যতটুকু সাজাইয়া দেয় তার উপর সে নিজে নিজে আরেকটু বেশি করিয়া সাজ করে। গায়ে একটু বেশি সাবান ঘষে, মুখে একটু বেশি ক্রিম মাখে, একটু বেশি দামের কাপড় পরে।

সরসী চলিয়া যাওয়ামাত্র সে বলিল, এই মেয়েটা এলে আপনি পৃথিবী ভুলে যান।

এই মেয়েটা আবার কে কালী?

যার সঙ্গে এতক্ষণ গল্প করলেন–আপনার সরসী?

ওকে তুমি সরসীদি বলবে।

আমার বয়ে গেছে ওকে দিদি বলতে।

মুখ উঁচু করিয়া ঠোঁট ফুলাইয়া সিধা হইয়া কালী মূর্তিমতী বিদ্রোহের মতো দাঁড়াইয়া থাকে, তার চোখ দুটি কেবল জলে বোঝাই হইয়া যায়। রাজকুমার অন্যমনে রিণির কথা ভাবিতেছিল, অবাক হইয়া সে কালীর দিকে চাহিয়া থাকে। এতটুকু মেয়ের মধ্যে ভাবাবেগের এই তীব্রতা সে হঠাৎ ঠিকমতো ধারণা করিয়া উঠিতে পারে না।

কি উদ্দেশ্যে এবং কেন কিছু না ভাবিয়াই, সম্ভবত আহত সকাতর শিশুকে আদর করার স্বাভাবিক প্রেরণার বশে, কালীর দিকে সে হাত বাড়াইয়া দেয়। কালীর নাগাল কিন্তু সে পায় না, দুহাতে তাকে সজোরে ঠেলিয়া দিয়া কালী ছুটিয়া পলাইয়া যায়।

সমস্ত দুপুর রাজকুমার বিষণ্ণ হইয়া থাকে। বাহিরে কড়া রোদ, ঘরে উজ্জ্বল আলো, রাজকুমারের মনে যেন সন্ধ্যার ছায়া, অমাবস্যা রাত্রির ছদ্মবেশী আগামী অন্ধকার। একটা কষ্টবোধও যেন সমস্ত শরীরে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, রাত্রি জাগরণের পর যেমন হয়। রাত্রে সে তো কাল ঘুমাইয়াছিল, সমস্ত রাত ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিয়াছে?

বিকালে রাজকুমার রিণিদের বাড়ি গেল।

দারোয়ানের কাছে খবর পাওয়া গেল স্যার কে. এল বাড়িতেই আছেন, সারাদিন একবারও তিনি বাহিরে যান নাই। রিণির অসুখ, দুবার ডাক্তার আসিয়াছিল।

অসুখ? নিচের হলে গিয়া দাঁড়াইতে রিণির ভাঙা ভাঙা গানের সুর রাজকুমারের কানে ভাসিয়া আসে। তারপর হঠাৎ এত জোরে সে বাড়ির দাসীকে ডাক দেয় যে তার সেই শেষ পর্দায় তোলা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর যে ঘরের দেয়ালে, ঘরের বাতাসে, রাজকুমারের গায়ে আঁচড় কাটিয়া যায়। ডাক্তারকে দুবার আসিতে হইয়াছিল রিণির এমন অসুখ! আগাগোড়া সবটাই কি রিণির তামাশা? কেবল তার সঙ্গে নয়, বাড়ির লোকের সঙ্গেও সে কি খেলা করিতেছে–তার বিকারগ্রস্ত মনের কোনো এক আকস্মিক ও দুর্বোধ্য প্রেরণার বশে?

ধীরে ধীরে উপরে উঠিয়া রিণিকে দেখিবামাত্র এ সন্দেহ তার মিটিয়া গেল। রিণির সত্যই অসুখ করিয়াছে। তার চুল এলোমেলো, আঁচল লুটাইতেছে মেঝেতে, মুখে ও চোখে এক শ পাঁচ ডিগ্রি জ্বরের লক্ষণ। অথচ শুইয়া থাকার বদলে সে অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক করিয়া বেড়াইতেছে। এক পাশে চেয়ারে মরার মতো হেলান দিয়া বসিয়া স্যার কে. এল হতাশভাবে তার দিকে চাহিয়া আছেন।

রাজকুমারকে দেখিয়াও রিণি যেন দেখিতে পাইল না। কেবল স্যার কে. এল হঠাৎ জীবন্ত হইয়া উঠিলেন। চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া আসিয়া রাজকুমারের সামনে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়াইলেন, রাজকুমারকে কিছু যেন বলিবেন। তারপর একটি কথাও না বলিয়া নিঃশব্দে পাশ কাটাইয়া চলিয়া গেলেন।

ছোট বুকসেফটির কাছে গিয়া একটি একটি করিয়া বই বাছিয়া মেঝেতে ছুড়িয়া ফেলিতে ফেলিতে রিণি গুনগুনানো সুর ভজিতে লাগিল।

রিণি!

কে? অ! রিণি একটু হাসিল, বোসোনা? বইগুলো একটু বেছে রাখছি–যত বাজে বই গাদা হয়েছে।

তোমার কি হয়েছে? জ্বর?

কিছু হয় নি তো।

রাজকুমার বসিল। বই থাক রিণি। এখানে এসে বোস।

রিণি চোখের পলকে ঘুরিয়া দাঁড়াইল।–দ্যাখ, হুকুম কোরো না বলছি। এক শ বার বলি নি তোমায়, আমার সঙ্গে নরম সুরে কথা কইবে? তোমরা সব্বাই আমায় নিয়ে মজা কর জানি, তা কর গিয়ে যা খুশি, আমার আপত্তি নেই, কিন্তু ভদ্ৰভাবে করবে–রেসপেক্টফুলি।–উঃ তাই বটে, ভুলে গিয়েছিলাম। কি যেন বললে তুমি?

রাজকুমার অত্যন্ত নরম সুরে বলিল, বোসো। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

রিণি আসিয়া পাশে বসিবার পরেও রাজকুমার তার দিকে চাহিয়া থাকে, কোন্ অনুভূতি হৃদয়ে আলোড়ন তুলিয়াছে বুঝিতে পারে না। কাছে আসিবার পর এখন রিণির চোখ দেখিয়া সে যেন বুঝিতে পারে তার কি হইয়াছে। রিণির চাহনি স্পষ্টভাবেই তার কাছে সব ঘোষণা করিয়া দেয়, কিন্তু মনে মনে রাজকুমার প্রাণপণে সে সংবাদকে অস্বীকার করে। তার মনে হয়, রিণির সম্বন্ধে এই ভয়ঙ্কর সত্যকে স্বীকার করিলে তার নিজের মাথাও যেন খারাপ হইয়া যাইবে।

রিণি ব্লাউজের বোতাম লাগায় নাই, লুটানো কাপড় তুলিয়া রাজকুমার তার গায়ে জড়াইয়া দিল। রিণির সঙ্গে এখন কথা বলা না বলা সমান, কোনো বিষয়েই তার সঙ্গে আলোচনা করার আর অর্থ হয় না। তবু তাকে বলিতে হইবে। রিণি সুস্থ আর স্বাভাবিক অবস্থাতে আছে ধরিয়া লইয়াই। তার সঙ্গে তাকে আলাপ করিতে হইবে। নতুবা নিজে সে অসুস্থ হইয়া পড়িবে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে।

তোমার বাবাকে ওসব বলতে গেলে কেন রিণি?

রিণির মুখে বিস্ময় ফুটিয়া উঠিল।–বাবাকে? কি বলেছি বাবাকে?

আমার সম্বন্ধে?

তোমার সম্বন্ধে? কই না, কিছুই তো বলি নি বাবাকে তোমার সম্বন্ধে? বাবার সঙ্গে আমি কথাই বলি না যে!

পলকহীন দৃষ্টিতে রিণি রাজকুমারের চোখের দিকে সোজা তাকাইয়া থাকে, তার মুখের ভাবের সামান্য একটু পরিবর্তনও ঘটে না। তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হইয়া ওঠে ক্রোধের অভিব্যক্তি।

দাঁড়াও ডাকছি বাবাকে।

রাজকুমার ব্যস্ত হইয়া বলে, থাক, রিণি, থাক্। বারণ কানে না তুলিয়া সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত আগাইয়া গিয়া তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চিৎকার করিয়া রিণি স্যার কে. এলকে ডাকিতে থাকে, বাবা বাবা? ড্যাডি? ড্যাডি?

স্যার কে. এল উপরে আসিতেই হাত ধরিয়া তাকে সে টানিয়া আনে রাজকুমারের সামনে, কাদ কাদ হইয়া বলে, রাজুদার নামে তোমায় আমি কি বলেছি বাবা?

স্যার কে. এল শান্ত কণ্ঠে বলেন, কই না, কিছুই তো বল নি তুমি?

বলেছি। রাজুদা আমার বেস্টফ্রেন্ড, তাই বলেছি। নিন্দে করে কিছু বলি নি। বলেছি বাবা?

না। বল নি।

নিশ্চিন্ত হইয়া রাজকুমারের পাশে বসিয়া রিণি গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া, বিড়বিড় করিয়া আরো কত কি যে বলিতে লাগিল বোঝা গেল না। একটু অপেক্ষা করিয়া স্যার কে. এল চলিয়া গেলেন।

রাজকুমার বলিল, একটু শুয়ে থাকবে রিণি?

রিণি উদাসভাবে বলিল, তুমি বললে শুতে পারি।

তোমার শরীর ভালো নেই, শুয়েই থাক। আমি এখুনি ঘুরে আসছি।

তুমি আর আসবে না।

আসব, নিশ্চয় আসব।

বিনা দ্বিধায় রাজকুমার তাকে শিশুর মতো দুহাতে বুকে তুলিয়া বিছানায় লইয়া গিয়া। শোয়াইয়া দিল। তার অনেক দিনের লিপস্টিক ঘষা ঠোঁট আজ শুকনো রক্ত মাখা হইয়া আছে। সন্তৰ্পণে সেখানে চুম্বন করিয়া সে নীরবে বাহির হইয়া গেল।

নিজের ঘরে স্যার কে. এল টেবিলে মাথা রাখিয়া বসিয়া ছিলেন, টেবিলে তার মাথার একদিকে একটি আধখালি মদের বোতল অন্যদিকে শূন্য একটি গেলাস। রাজকুমারের সাড়া পাইয়া মুখ তুলিলেন।

নার্ভাস ব্রেক ডাউন? রাজকুমার জিজ্ঞাসা করিল।

স্যার কে. এল মাথা নাড়িলেন।–ইনস্যানিটি।

ডাক্তার কি বললেন?

এখন আর ওর বেশি কি বলবেন? সারতেও পারে, নাও সারতে পারে। ভালো রকম এগজামিনের পরে হয়তো জানা যাবে।

পরস্পরের মাথার পাশ দিয়া পিছনের দেয়ালে চোখ পাতিয়া দুজনে অনেকক্ষণ নীরবে মুখোমুখি বসিয়া রহিল।

তারপর স্যার কে. এল ধীরে ধীরে বলিলেন, আমার আলমারি খুলে বোতল নিয়ে কদিন নাকি খুব ড্রিঙ্ক করছিল। কিছু টের পাই নি। ডাক্তার সন্দেহ করছেন খুব ধীরে ধীরে ইনস্যানিটি আসছিল, অতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করার ফলে দু-চার দিনের মধ্যে এটা হয়েছে। রিণি ড্রিঙ্ক করত নাকি জান?

কদাচিৎ কখনো একটু চুমুক দিয়ে থাকতে পারে, সে কিছু নয়।

স্যার কে. এল-এর মাথা নিচে নামিতে নামিতে প্রায় গেলাসে ঠেকিয়া গিয়াছিল তেমনিভাবেই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার নামে রিণি যা বলেছিল রাজু?

সব কল্পনা।

তোমায় নিয়ে কেন?

তা জানি না।

আবার দুজনে নীরবে মুখখামুখি বসিয়া রহিল।


© 2024 পুরনো বই