০৬. এক হাজার টাকা

০৬.

এক হাজার টাকা মাসি ঘরের বাক্স থেকেই বার করতে পেরেছিল। বলেছে, কুড়িয়ে বাড়িয়ে হয়ে গেল দেখছি, আবার ব্যাঙ্কে যাবি, চেক ভাঙাবি–তোর সুবিধেই হল।

সকালে বাড়ি থেকে বেরোবার আগে মেসো বার পাঁচেক তাকে সাবধান করেছে আবার যেন টাকাটা খোয়া না যায়। কোথায় কোন্ পকেটে রাখল, অন্য কাগজপত্রের সঙ্গে মিশে গেল কিনা দেখে নিয়ে আর এগিয়ে দিতে এসে শেষ বারের মতো আরো বার দুই সতর্ক করে তবে ভদ্রলোক ছেড়েছে তাকে।

আবারও মনটা খিঁচড়ে গেছে শঙ্কর সারাভাইয়ের। টাকাটা মেসোর পকেটে গুঁজে দিয়ে পালাতে ইচ্ছে করেছে। না পেরে নিজের ওপরেই দ্বিগুণ আক্রোশে জ্বলছে। চোয়াল দুটো শক্ত হয়েছে তার। ফ্যাক্টরী বাঁচানো নিজে বাঁচার সামিল। ওটার সঙ্গে তার সত্তার যোগ। সে শেষ দেখবে। শেষ দেখার আগে এই যোগ ছি ভূতে দেবে না।

কি-কি চাই তার লম্বা লিস্ট একটা করাই ছিল। নগদ টাকা ফেললে মাল তুলতে কতক্ষণ আর। মস্ত একটা সুতোর মোট আর অন্যান্য বহু টুকিটাকি উপকরণের তেমনি বড়সড় একটা বোঁচকা নিয়ে প্রায় গলদঘর্ম হয়ে স্টেশনের বাসে উঠল শঙ্কর সারাভাই।

ওঠার মুখেই ছোটখাট অপ্রিয় ব্যাপার ঘটে গেল একটা। সেদিনের অর্থাৎ কুড়ি বছর আগের পাবলিক বাসের অবস্থা আজকের মতো ছিল না। লোক গুণে ভোলা হত না। ঠাসাঠাসি ভিড় হত, যার শরীরের তাগত বেশি সে-ই উঠে পড়ত। আর স্টেশনের বাসে ভিড় তত লেগেই আছে।

পর পর দুখানা বাস ছাড়তে হয়েছে। সঙ্গের মোট দেখে ড্রাইভার বাধা দিয়েছে। তাছাড়া ভিড়ও খুবই বেশি ছিল। মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে ছিল শঙ্কর সারাভাইয়ের। মাসির হাত থেকে টাকা হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে ভিতরটা সেই যে তেতে আছে এখনো ঠাণ্ডা হয়নি। ফাঁক পেলেই ভিতর থেকে কে যেন চোখ রাঙাচ্ছে এরকম মিথ্যা আর ভাওতাবাজির ওপর ক’দিন চলবে? পরক্ষণে নিজের ওপরে দ্বিগুণ বিরক্ত, মাসির কাছে তো একেবারে মিথ্যে বলতে হয়নি, আধা-সত্যি যা তাই জেনেছে মাসি। টাকা ব্যবসার জন্যেই নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাত দিনের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়া যে সম্ভব হবে না সেটা শঙ্করের থেকে বেশি আর কে জানে? তাছাড়া শিগগীর আর এই শহরে আসা হবে না। এলেও মেসোর কাছ থেকে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। মাসিকে অবশ্য মেসো কখনোই বলতে পারবে না কোন্ মতলবে সে-ও দরাজ মুখে টাকা বার করে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। ফলে বাড়িতে অন্তত মেসো প্রকাশ্যে রাগারাগিও করতে পারবে না। কিন্তু মনে মনে তাকে ভস্ম করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। টাকা হাতে এলে বা দিন ফিরলে মেসোর টাকা সে কড়ায়-ক্রান্তিতে শোধ করে দেবে কেবল একটু সময় চাই। আবার এও মনে হল, তেমন দিন কোনোদিন আসবে এমন ভরসা শঙ্কর সারাভাই করে কি করে?

এর ওপর দু’দুটো বাস ছাড়তে হওয়ায় মেজাজ আরো গনগনে হয়ে আছে। ওপরওয়ালার কিছু চক্রান্ত ছিল বলেই শঙ্কর সারাভাই তৃতীয় বাসখানায় উঠতে পারল।

বাস-কণ্ডাক্টর বাধা দেবার অবকাশ পেল না। পেল না বলেই তার রাগ। ভিড়ের মধ্যে মাল নিয়ে ওঠার জন্য গজগজ করতে লাগল। তার কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে শঙ্কর সারাভাই যতটা সম্ভব ভিতরে সেঁধিয়ে যেতে চেষ্টা করল। তাতে লোকের অসুবিধে হল বটে কিন্তু নিজে সুফল পেল। ঠিক সামনের সীটটির থেকেই একজন উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে একে-ওকে ঠেলে শঙ্কর সারাভাই সে জায়গাটি দখল করল।

ঘেমে নেয়ে গেছে। ঘাম মুছে ঠাণ্ডা হতে না হতে কণ্ডাক্টর টিকিটের জন্য হাত বাড়াল। তারপরেই তুমুল বচসা।

কণ্ডাক্টর মালের জন্য দু’খানা বাড়তি টিকিট নেবে, শঙ্কর সারাভাই একটার বেশি বাড়তি টিকিট করবে না।

কণ্ডাক্টর না-ছোড়, মালের জন্য দুটো টিকিট কাটতে হবে। শঙ্কর সারাভাই তিরিক্ষি মেজাজে প্রতিবাদ করল, কেন, দুটো টিকিট কাটব কেন?

তাহলে নেমে যান।

কি? আবদার নাকি? একটা মাল তো বেঞ্চির তলায় ঢুকিয়েছি–একটা টিকিট নিচ্ছি এই বেশি।

ঝগড়া বেধে গেল। কণ্ডাক্টরও ছাড়বে না, সে-ও দেবে না। যাত্রীরা অনেকে বিরক্ত, অনেকে দুই দলে ভাগ হয়ে গেল। বচসাটা একজনের মুখ থেকে আর একজন লুফে লুফে নিতে আরম্ভ করল। এদিকে পাশের লেডীস সীটে বসে কোনো সুদর্শনা রমণী যে দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে দুনিয়ার তাজ্জব কাণ্ড দেখছে কিছু– শঙ্কর অন্তত তা আদৌ লক্ষ্য করেনি। দশ পয়সার একটা টিকিটের জন্য যে জগতে এরকম কাণ্ড হয় বা হওয়া সম্ভব, মেয়েটির ধারণা নেই।

ওপরওয়ালার চক্রান্ত জটিল বলেই বাসের এই মেয়ে যশোমতী পাঠক। জীবনে এই প্রথম সে বাসে উঠেছে। ওঠার পর থেকে। তার দম বন্ধ হবার উপক্রম। ঠাসাঠাসি ভিড়। ওপরের রড থেকে হাত ফসকালে একসঙ্গে পাঁচ সাতটা লোক তার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়া বিচিত্র নয়। উঠেই ভেবেছিল নেমে গিয়ে ট্যাক্সি করলে হয়। এভাবে মানুষ যায় সেটা আগে সে চোখে হয়তো দেখেছে, কষ্টটা অনুভব করেনি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন চোখ রাঙালো তাকে। সে মাটির ওপর দিয়ে চলবে বলেই বেরিয়েছে। মাটির ওপর দিয়ে হাঁটবে বলেই বাবার আভিজাত্যের শো-কেস থেকে বেরিয়ে এসেছে। না, আরামের প্রশ্রয় দেবে না, এত লোক যাচ্ছে কি করে?

কিন্তু দশ পয়সার বাড়তি টিকিটের এই নাটকটা ভয়ানক বিস্ময় কর মনে হল তার। স্থান-কাল ভুলে সামনে উপবিষ্ট লোকটাকেই হাঁ করে দেখছে সে। দশটা পয়সার জন্য একজন এ-রকম করছে বলে সঙ্কোচ যেন তারই। দেখল লোকটারই জিত হল, বাড়তি দশটা পয়সা শেষ পর্যন্ত দিলই না। কণ্ডাক্টর হাল ছাড়ল বটে, কিন্তু তার মুখ রাগে কালো।

কণ্ডাক্টরকে ছেড়ে যশোমতী সামনের বিজেতা মূর্তিটি নিরীক্ষণ করতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতর প্রচণ্ড ধাক্কা। আচমকা একটা সঙ্কট বুঝি গ্রাস করতে আসছে তাকে। লোকটার মুখের সামনে খবরের কাগজ বাস চলার বাতাসে কাগজের একটা কোণ উড়তে ভিতরের পাতাটা দেখা যাচ্ছে। বার বার দেখা যাচ্ছে। সেই পাতায় কি দেখল যশোমতী পাঠক?….একবার….দু-বার….তিন বার দেখা গেল ভিতরের ছবিটা। নিজের ছবি নিজের কাছে এমন বিপদের কারণ হতে পারে সে-কি কল্পনা করাও সম্ভব? কাগজের তলার কোণটা বাতাসে ওপরের দিকে উঠলেই ছবিটা দেখা যাচ্ছে– তারই ফোটো।

যশোমতী কি যে করবে ভেবে পেল না। মুখ লাল, কান গরম, দম বন্ধ করে ছটফট করতে লাগল সে। ধরা বুঝি পড়েই গেল। এই মুহূর্তে দুনিয়ায় ওই কাগজটা ভিন্ন আর বুঝি কোনো সমস্যা নেই তার সামনে। ইচ্ছে করল লোকটার হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নিয়ে জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

টিকিট?

যশোমতী চমকে উঠে আত্মস্থ হল। তারই টিকিট চাইছে কণ্ডাক্টর। এতক্ষণ ভিড় ঠেলে আসতে পারেনি বলে টিকিট হয়নি। তাড়াতাড়ি পাশের বড় শৌখিন ব্যাগটার উদ্দেশে হাত বাড়ালো যশোমতী। কিন্তু হাতে কিছু না ঠেকতে সবিস্ময়ে পাশের দিকে। মুখ ফেরালো।

ব্যাগ নেই।

যশোমতী প্রথমে বিমূঢ়, তারপর রাজ্যের বিস্ময়। সে ঠিক দেখছে কিনা বা ম্যাজিক দেখছে কিনা, বুঝছে না। পাশে ব্যাগ রেখে সে নিশ্চিন্ত মনে এই অভিনব গণ-যাত্রার কষ্ট আর রোমাঞ্চ অনুভব করছিল। তারপর সামনের লোকটার এই দশ পয়সার ঝগড়া দেখতে দেখতে কিছুই আর খেয়াল ছিল না। আর তারপর ওই ছবির ধাক্কা। পাতা ওল্টালে যে ছবি চোখে পড়বেই, আর তারপর….ধরণী দ্বিধা হও….

টিকিট? বিরক্ত কণ্ডাক্টর দ্বিতীয়বার তাড়া দিল।

মাথায় যেন আকাশ ভেঙেছে যশোমতীর। এ-দিক ও-দিক আর বেঞ্চির নিচেটা দেখল একবার। নেই। নেই কেন তখনো মাথায় আসছে না। তখনো বুঝতে পারছে না পাশ থেকে ব্যাগটা কোথায় উড়ে যেতে পারে। যশোমতী জেগে আছে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেবল বিপদের স্বপ্ন দেখছে!

সুদর্শনা রমণীর মুখের এই বিমুঢ় সঙ্কট-কারু অনেকেই লক্ষ্য করল। চোখ পড়লে চোখ ফেরানো শক্ত। যেন চাপ রক্ত এসে জমছে মুখে। কিছু একটা হয়েছে সেটা অন্তত বোঝা গেল। একজন যাত্রী জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? ।

আমার ব্যাগটা….!

কোথায় ছিল? কোথায় ছিল? কি ব্যাগ? কেমন ব্যাগ? অনেকে মুখর, অনেকে উৎসুক।

যশোমতী পাশের চার আঙল শূন্য জায়গাটার দিকে অসহায় চোখে তাকালে শুধু।

কতবড় ব্যাগ? এই ভিড়ে ব্যাগ কেউ পাশে রাখে! এক মুখেই কৌতূহল আর উপদেশ।

আর একজন মন্তব্য করল, নিয়ে সরে পড়েছে কেউ, উপকার করেছে–

অন্য একজনের মন্তব্যে প্রচ্ছন্ন সংশয়, ব্যাগ সত্যি সত্যি ছিল তো, না উনি আনতে ভুলে গেছেন?….হাতের ওপর থেকে ব্যাগ টেনে নিলে টের না পাবার কথা নয়। এক কথায়, ব্যাগ হারানোটা অজু হাত কিনা এও বিবেচনার বিষয়।

যশোমতী জবাব দেবে কি, সে অকূলে পড়েছে। সমস্ত মুখ ঘেমে লাল। অসহায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখাচোখি হল যার সঙ্গে, সে শঙ্কর সারাভাই। মুখের সামনে থেকে কাগজ সরিয়ে সে ঘটনাটা বুঝতে চেষ্টা করছে।

এই মুহূর্তে ভিতরের পাতার ছবি চোখে পড়ার সঙ্কট থেকে যশোমতী বাঁচল বটে, কিন্তু তপ্ত কড়া থেকে জ্বলন্ত আগুনে পড়ার মতো অবস্থা তার।

কণ্ডাক্টরের মেজাজ এখনো প্রসন্ন হয়নি, তাছাড়া পথে-ঘাটে এ-রকম অনেক আধুনিকার চাল-চলন তার জানা আছে। পয়সা ফাঁকি দেওয়ার ব্যাপারে অতি আধুনিকারা ছেলেদের থেকে কোনো অংশে কম যায় না বলেই তার ধারণা।

সুন্দর মুখ দেখে সে ভুলল না, গম্ভীর মুখে বলল, তাহলে নেক্সট স্টপে নেমে যান।

অমনি শঙ্কর সারাভাইয়ের পুরুষকার চাড়িয়ে উঠল। কণ্ডাক্টরের অকরুণ উক্তি বরদাস্ত করা সম্ভব হল না। প্রতিবাদ করল, ব্যাগ চুরি গেছে মহিলার, এ-ভাবে বলার অর্থ কি?

কণ্ডাক্টর তার দিকে ফিরল, গম্ভীর মুখে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল, ব্যাগ চুরি গেছে আপনি দেখেছেন?

–আমি দেখব মানে! দেখলে চুরি যাবে কেন?

তাহলে চুপ করে থাকুন।

–কেন চুপ করে থাকব, শঙ্কর সারাভাই গর্জন করে উঠল, একজন মহিলার ব্যাগ চুরি গেছে শুনেও তুমি এভাবে কথা বলবে কেন? ভদ্রতাজ্ঞান নেই?

ব্যস, দ্বিতীয় প্রস্থ শুরু হল। যশোমতী পাঠক নির্বাক দর্শক। ভিড়ের ওধার থেকে একজন টিপ্পনী কাটল, একটু আগে তো নিজের স্বার্থে দিবি এক-প্রস্থ লড়েছেন। এখন কণ্ডাক্টর তার ডিউটি করছে তার মধ্যেও আপনার অত শিভালরি দেখাবার কি হল মশাই?

মুখ আড়াল করে ওধার থেকে আর একজন প্রায় অভব্য টীকা ছুঁড়ল, আ-হা, আপনারই বা কি কাণ্ডজ্ঞান মশাই, শিভালরি দেখাবার মতো সীচুয়েশন যে!

রাগে শঙ্কর সারাভাই ভিড়ের মধ্য থেকে বক্তা দুটিকে তক্ষুনি আহ্বান জানালো, কারা বলছেন এদিকে এগিয়ে আসুন মশাই সাহস করে, আড়াল থেকে কেন–

বামের কোন কোন ভদ্রলোক রমণীর প্রতি অনুকম্প বশত ছি-ছিও করে উঠল। যশোমতীর সমস্ত মুখ টকটকে লাল। খানিক আগের বচসার পর এই লোকটাই অর্থাৎ শঙ্কর সারাভাই আবার বিনা টিকিটের যাত্রিণীর পক্ষ নিয়েছে বলেই হয়তো কণ্ডাক্টরের গো চাপল। বলে উঠল, আমার ডিউটি পয়সা আদায় করা, টিকিট চেয়েছি তার মধ্যে অত কথার দরকার কি? ব্যাগ হারিয়েছে বলে আপনার অত দরদ হয়ে থাকে তো আপনিই দিয়ে দিন না ভাড়াটা-টার্মিনাস পর্যন্ত দশটা পয়সা তো ভাড়া এখান থেকে।

আমি দিয়ে দেব! পয়সা দেবার নামেই শঙ্কর সারাভাইয়ের গলা শমে নেমে এল।–বা রে, ভদ্রমহিলা হঠাৎ বিপদে পড়েছেন তাই বলছিলাম, আমি–আমি দিতে যাব কেন?

কণ্ডাক্টর বলল, তাহলে আর বেশি সহানুভূতি না দেখিয়ে চুপ করে বসে থাকুন।

ওদিক থেকে রসালো উক্তি, দিয়েই ফেলুন দাদা–দশ পয়সায় হীরো হবার মওকা ছাড়বেন না।

আবার হাসির রোল, আবারও ভদ্রলোকদের কারো কারো ছি ছি। বাসটা থামলে যশোমতী নেমে পড়ে বাঁচত। কিন্তু তার মুখের দিকে চেয়ে সামনের লোকটার কি হল কে জানে। শঙ্কর সারাভাই মুহূর্ত থমকালো মুখের দিকে চেয়ে। ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছেয় হোক, একটা হাত আপনা থেকেই নিজের পকেটে গিয়ে ঢুকল, তারপর পকেট থেকে ব্যাগ বার করে দশটা পয়সা কণ্ডাক্টরকে দিয়ে বলল, একটু ভদ্রতা শিখতে চেষ্টা করো? বুঝলে কণ্ডাক্টরের কাজ আর কশাইয়ের কাজ এক জিনিস নয়–এই নাও তোমার টিকিটের দাম।

স্বাস্থ্যের দিকে চেয়েই হোক বা যে কারণেই হোক, কণ্ডাক্টর বিনাবাক্যে টিকিট কেটে সেটা শঙ্করেরই হাতে দিল।

–এই নিন। টিকিটটা যশোমতীর দিকে বাড়িয়ে চাপা রুক্ষ মেজাজে শঙ্কর বলল, বাসে উঠলে ব্যাগ খোয়া যায়, পথে-ঘাটে একা বেরোন কেন আপনারা!

আর মনে মনে বলল, দশ-দশটা পয়সা গচ্চা, কি কুক্ষণে মুখ খুলতে গেছলাম–

যশোমতীর মনে হল, তার বাবার মতোই কেউ যেন আবার একপ্রস্থ বিদ্রূপ করল। রাগ হচ্ছে, আবার অসহায় বোধ করছে। টিকিটটা লোকটার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে নেমে গেলে হয়। কিন্তু নেমে যাবে কোথায়? হঠাৎ বুঝি দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে। পরক্ষণে বিরক্তমুখ লোকটা আবার কাগজে মন দিতে যাচ্ছে দেখে ত্রাসে চমকে উঠল। কোন্ দিক সামলাবে যশোমতী?

নষ্ট করার মতো সময় নেই, ফোটো চোখে পড়লেই হয়েছে। কি মনে পড়তে তাড়াতাড়ি টিকিটটা আবার তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করল, এতে আপনার ঠিকানাটা লিখে দিন দয়া করে।

কেন?

কেন বুঝতে পারছেন না? দু’চোখ একটু বেশি স্পষ্ট করেই তার মুখের উপর তুলে ধরল।

পয়সা ফেরত দেবেন? বাসের মধ্যে আমি কলম নিয়ে বসে আছি?

বিরক্ত মুখেই অন্য দিকে ফিরল শঙ্কর সারাভাই। এদিকে বাসের মধ্যে আবার একটা লঘু রসের সূচনা হতে যাচ্ছে দেখে যশোমতী চুপ করে গেল। কিন্তু যেটুকু হল, তাতেই লোকটার কাগজের প্রতি মনোযোগ কমেছে মনে হল। উসখুস দৃষ্টিটা দুই-একবার ফিরল এদিকে। সদ্য-সঙ্কটে এর থেকে বেশি আর কিছু কাম্য নয়, তাই দুই একবার পাল্টা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে পুরুষের রূঢ়তায় অপমানিত বোধ করার মততই মুখ করে বসে রইল যশোমতী।

স্টেশন।

মোটের বোঝা নিয়ে লোকটা নামল। পিছনে যশোমতী। স্টেশনে যাবে বলেই বাসে উঠেছিল সে-ও। তারপর কোথায় যাবে ঠিক করেনি। সবার আগে এই জায়গাটাই ছাড়তে চেয়েছিল সে। সবার আগে বাবার কাছ থেকে দূরে সরতে চেয়েছিল। ভেবেছিল, ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে দূরপাল্লার যে-কোনো একটা ট্রেনে উঠে পড়বে, তারপর বেশি রাতে যে-কোনো একটা স্টেশনে নামবে। তারপর যা হয় হবে।

কিন্তু মাথায় আকাশ ভেঙেছে এখন। ব্যাগ চুরি যাবার দরুন নিজের ওপরেই ভয়ানক রাগ হচ্ছে তার। সকলের ওপর রাগ হচ্ছে। এমন কি ওপরওয়ালার ওপরেও। তাকে জব্দ করার জন্যই এ যেন চক্রান্ত একটা। জব্দ কি সোজা জব্দ! পঙ্গু অবস্থা। যশোমতী কি করবে এখন? ওই রকম চিঠি লিখে কাল বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, আর আজ নিজেই ফিরে যাবে? বাবা কিছু বলবে না, কিন্তু মনে মনে হাসবে। প্রাণ খুলে হাসবে। সে-হাসি যশোমতী যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। মেয়েরা কত অসহায় আর কত অপদার্থ, সেই নজিরই পাকা-পোক্ত হয়ে থাকবে বাবার মনে। দুনিয়া দেখতে বেরিয়ে একদিনেই এ-রকম নাজেহাল হয়ে ফিরে যাবে? আভিজাত্যের শো-কেসই যে তাদের উপযুক্ত জায়গা, ফিরে গিয়ে এটাই ঘটা করে প্রমাণ করবে?

তার থেকে মরে যাওয়া ভাল। রাগে দুঃখে ক্ষোভে মরে যেতেই ইচ্ছে করছে যশোমতীর। কিছুটা নিজের গোচরে কিছুটা বা অগোচরে স্টেশনেই এসে দাঁড়াল সে। আর সেই মুহূর্তেই স্থির করল নিজে থেকে সে কিছুতে বাড়ি ফিরবে না, এর থেকে বাবার তল্লাসীর জালে ধরা পড়ে বাড়ি ফেরা ভাল। কাগজে ছবি তো ছাপিয়েইছে। আরো কতভাবে খোঁজাখুজি চলেছে কে জানে। ধরা পড়েই যদি তাতে সম্মানটা অন্তত বাঁচবে। কেউ বলবে না অযোগ্য বলে ফিরে এলো। বাবা রাগ করতে পারে, হাসবে না।

আর ধরা যদি না পড়ে, যা কপালে থাকে হবে। গায়ে যা গয়না আছে তারও দাম নেহাত কম হবে না। অবশ্য বেশি ভারী গয়না সে পরে না। তবু হাতের হীরে-বসানো বালা দুটোর দামই তো যা খোয়া গেছে তার থেকে ঢের বেশি। তার ওপর হার আছে, দুল আছে–আঙুলে মুক্তোর আংটি আর কব্জিতে দামী ঘড়িও আছে। দেখা যাক–

সামনেই সেই লোকটা। অর্থাৎ সারাভাই। মোটগুলো রেখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কুলি আসতে মুখ ঘুরিয়ে নিল, অর্থাৎ দরকার নেই। তখনই তাকে যশোমতী দেখল। দেখল শঙ্কর সারাভাইও। একটু লক্ষ্য করেই দেখল যেন।

আপনি কি এই মৌল প্যাসেঞ্জারে যাবেন?

জায়গার নাম অথবা গাড়ির নাম জীবনে এই প্রথম শুনল যশোমতী। কিন্তু ভাবার সময় নেই, মাথা নাড়ল। অর্থাৎ তাই যাবে।

এই মালগুলো দু’মিনিট দেখবেন দয়া করে, আমি টিকিটটা কেটে নিয়ে আসি, যাব আর আসব।

বাসের টিকিট কেটে দিয়েছে যখন, এটুকু উপকার দাবি করতে তার দ্বিধা নেই। যশোমতী মাথা নাড়ল। দেখবে।

শঙ্কর সারাভাই হনহন করে চলে গেল। কিন্তু কাউন্টারে ভিড়, ফিরতে দেরিই হল একটু। ঘেমে সারা। ব্যস্তসমস্ত হয়ে মোটগুলো তুলতে তুলতে বলল, ভিড়ের ঠেলায় প্রাণান্ত, তার ওপর নড়তে চড়তে দিন কাবার। গাড়ি ছাড়তে আর খুব বেশি দেরি নেই

বড় মালটা এক হাতে নিল, অন্য সব কটা মাল অপর হাতের আয়ত্তে আনতে একটু অসুবিধেই হচ্ছিল। যশোমতী তাড়াতাড়ি মাঝারি সাইজের ঝোলাটা তুলে নিয়ে বলল, সব একলা পারবেন কেন, এটা আমি নিচ্ছি–চলুন!

এই সৌজন্যটুকু প্রত্যাশিত নয়। শঙ্কর সারাভাই থমকে মুখের দিকে তাকালো একটু, তারপর এগিয়ে চলল। এও বাসের টিকিট কাটার প্রতিদান ধরে নিল সে।

খানিকটা এগিয়ে আসার পর কি মনে পড়তে ফিরে তাকালো আবার। জিজ্ঞাসা করল, আপনি কোন্ ক্লাসে যাবেন?

যশোমতীর ভাবতে সময় লাগল না একটুও, এত মোট নিয়ে একটা কুলি পর্যন্ত করল না যে, সে কোন্ ক্লাসে যাবে জানা কথাই। মোটের জন্য বাসের একটা বাড়তি টিকিট কাটা নিয়ে কণ্ডাক্টরের সঙ্গে ঝগড়াও এরই মধ্যে তোলবার নয়।

থার্ড ক্লাস–

লোকটা নিশ্চিন্ত হল যেন একটু। মনে মনে হাসিই পাচ্ছে যশোমতীর। জীবনে দুর্ভাবনা করার অবকাশ এ পর্যন্ত হয়নি বললেই চলে। তাই এ-রকম দুর্বিপাকে পড়া সত্ত্বেও ভিতরে ভিতরে কৌতুক বোধ করতে পারছে। অসুবিধে বোধ করা মাত্র সেটা দূর হতে সময় লাগে না এ-রকম দেখেই অভ্যস্ত সে। এই প্রথম এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে সে যেখানে সুবিধে অসুবিধের কোনো প্রশ্নই নেই।

ঢোকার মুখে গেটে চেকার দাঁড়িয়ে। কিন্তু ভিড়ের জন্যই হোক বা যে জন্যই হোক নির্বিঘ্নে ঢোকা গেল। লোকাল গাড়ির ভিড়ে অত কড়াকড়ি নেই হয়তো। তবু একটু ভয়-ভয়ই করছিল যশোমতীর।

লোকটা তার সামান্য আগে আগে চলেছে। তার বগলের খবরের কাগজটা হাতের মালের বোঝা সামলাতে গিয়ে দুই-একবার পড়-পড় হয়েছে। ওই কাগজটা চক্ষুশূল যশোমতীর। তার সমস্ত ত্রাস আপাতত ওই এক জায়গায় পুঞ্জীভূত।

আবার ফ্যাসাদে পড়ার ভয়ে প্রথম সুযোগে পিছন থেকে কাগজটা টেনে নিল সে। শঙ্কর সারাভাই ফিরে তাকাতে মিষ্টি করে হেসে বলল, আপনার অসুবিধে হচ্ছিল, আমার কাছে থাক।…. আপনি যাবেন কোথায়?

এই সুতৎপর জিজ্ঞাসার হেতু আছে যশোমতীর। একটু বাদেই হয়তো লোকটা তাকে এই প্রশ্ন করবে, তার গন্তব্য স্থান জানতে চাইবে। প্ল্যাটফর্মে ঢোকার পর কাতারে কাতারে এত অচেনা মুখ দেখে একটু যে অসহায় বোধ করছে যশোমতী তাতে সন্দেহ নেই। ভরসা যদি একটুও কারো ওপর করতে হয়, যার সঙ্গে এই যোগাযোগ, তার ওপরে করাই ভাল।

শঙ্কর সারাভাই জবাব দিল, একেবারে শেষপর্যন্ত–মৌলা। আপনি?

যশোমতী মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, এক জায়গাতেই যাচ্ছে। পাছে। আর কিছু জিজ্ঞাসা করে সেই ভয়ে ভিড়ের দরুনই যেন একটু তফাতে পড়ে গেল সে।

ঠাসাঠাসি ভিড়। এগোতে এগোতে আর জায়গার খোঁজে কম্পার্টমেন্ট দেখতে দেখতে বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে শঙ্কর বলল, এই ঘণ্টার গাড়িতে ভিড় লেগেই আছে–

যাই হোক, গায়ের জোরেই ঠেলাঠেলি করে একটা কামরায় আগে উঠল সে। মালের ঠেলায় অনেকে এদিক-ওদিক সরে যেতে বাধ্য হল। বলতে গেলে বেশির ভাগই আধাভদ্র আর নিম্নশ্রেণীর যাত্রীর ভিড়। অবশ্য ভদ্রলোকও দু’পাঁচজন নেই এমন নয়। নিজে উঠে হাত বাড়িয়ে যশোমতীর হাতের ঝোলাটা নিল শঙ্কর সারাভাই। তারপর দু’হাতে ভিড় ঠেলে সরিয়ে তাকে ওঠাবার চেষ্টা করতে করতে বার কয়েক হাক দিল, এই ভাই সরো না, মহিলা উঠতে পারছেন না দেখছ না!

ভিড় ঠেলে ওঠার অভ্যেস থাকলে যশোমতী উঠতে পারত। নেই বলেই পেরে উঠছে না। এক হাতের মুঠোয় কাগজ, অন্য হাতে হ্যাণ্ডেল ধরেছে কোনো রকমে। কিন্তু তারপর লোক ঠেলে ওঠা আর সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এরই মধ্যে তার চাকতে মনে হল কি। এক বিপদের ফাঁকে আর এক বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার আশা। মুহূর্তে শঙ্কর সারাভাইয়ের দিকে একবার চোখ চালিয়ে সকলের অলক্ষ্যে অন্য হাতের খবরের কাগজটা টুপ করে ফেলে দিল সে।

ওদিকে সৰিক্ৰমে দু’হাতে ভিড় সরিয়ে শেষে একহাতে প্রায় তাকে টেনেই তুলল শঙ্কর সারাভাই। তবু দু’দিকের চাপাচাপিতে যশোমতীর মুখ লাল। ঘেমেই উঠেছে। শঙ্কর সারাভাই এবারে একে মিষ্টি কথা বলে, ওকে রূঢ় কথা বলে নিজের মাল রাখার জায়গা করল আগে।

ওদিকে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।

যশোমতী বসার জায়গা পায় নি তখনো। গা বাঁচিয়ে একটু সরে দাঁড়াবে কোথাও, এমন ফাঁকও নেই। বিশ বছর বয়েস পর্যন্ত সে এই জগতেই বিচরণ করে এসেছে কিনা ঠাওর করতে পারছে না। যাদের দেখছে, তাদের যেন আর কখনো সে দেখে নি।

মাল সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হবার পর এবারে বসার চিন্তা শঙ্কর সারাভাইয়ের। একজন মেয়েছেলে ভিড়ের মধ্যে এ-ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখতেও বিসদৃশ। শঙ্কর এদিক-ওদিক উঁকি দিয়ে দেখল, ভিতরের দিকে এগিয়ে যেতে পারলে বসার ব্যবস্থা হতেও পারে। ও-দিকটায় হাত-পা ছড়িয়েও বসে আছে কেউ কেউ। অতএব আবার চেষ্টা।

ইশারায় যশোমতীকে আসতে বলে ভিড় ঠেলে সে এগোতে লাগল–ও-দিকের লোকগুলো একটু সঙ্কুচিত হলে একজনের মতো বসার জায়গা অনায়াসে হতে পারে। কিন্তু দরজার দিক থেকে ভিতরে ঢোকাই মুশকিল।

মেয়েছেলে ওদিকে যাবে, একটু জায়গা দাও না ভাই। এই একটু একটু করতে করতে যশোমতীকে নিয়ে সত্যি একপ্রান্তের দুই বেঞ্চির মাঝে এসে দাঁড়াল।

বুড়ো মতো এক ভদ্রলোকের উদ্দেশে সবিনয়ে আবার বলল, একটু সরে সরে বসুন না সার দয়া করে, মেয়েছেলে বসবে–

বার বার মেয়েছেলে মেয়েছেলে শুনে যশোমতীর লজ্জাই করছে। বিতিকিচ্ছিরি ভিড়ের দরুন তার গা-ও ঘুলোচ্ছে। এর ওপর আবার অস্বস্তিতে ফেললে ওই বুড়ো মতো ভদ্রলোক। সরি বলা সত্ত্বেও তার মেজাজ প্রসন্ন থাকল না। ঠাস করে বলে বসল, এ-রকম ভিড় দেখেও মেয়েছেলে নিয়ে ওঠেন কেন মশাই। একটা গাড়ি ছেড়ে উঠলেই তো হয়–

সঙ্গে সঙ্গে জবাব শুনেও দুই চক্ষু বিস্ফারিত যশোমতীর। শঙ্কর সারাভাই হাসিমুখে সাদা-সাপটা জবাব দিল, ভুল হয়ে গেছে, আপনার সঙ্গে আগে দেখা হলে পরামর্শ করেই উঠতাম। উঠে যখন পড়েছি, মেয়েছেলে সঙ্গে থাকলে তাকে ফেলেই বা উঠি কি করে। দোষ-ত্রুটি না ধরে আপনি এখন দয়া করে একটু চেষ্টা করে দেখুন, ব্যবস্থা হয় কি না।

বুড়োর রুক্ষু মুখ বিকৃত হল। বচন শুনে এপাশ-ওপাশের কেউ কেউ হাসছে। লোকটার কথায় না থোক, যশোমতীর দিকে চেয়ে অনেকেরই একটু জায়গা করে দেওয়ার আগ্রহ হল। ফলে জায়গাও হল। যশোমতী বসে বাঁচল। তার দু’হাত দূরে শঙ্কর সারাভাই দাঁড়িয়ে। নিজের জায়গার জন্য আর ঝগড়া-ঝাঁটি করার ইচ্ছে নেই বোঝা গেল। পকেট থেকে তোয়ালের মতো একটা রুমাল বার করে ঘাম মুছছে।

ছোট লাইনের লোকাল ট্রেন। কাছাকাছি স্টেশন। দুটো। স্টেশন পার হয়ে গেল। কিছুলোক নেমে গেল। দাঁড়িয়ে যারা ছিল তারা কেউ কেউ বসতে পেয়ে গেল। যশোমতীর উল্টোদিকের বেঞ্চিতে শঙ্করও বসার মতো জায়গা পেল একটু। মনটা তার ভালো নেই খুব। গাড়িতে উঠে নিশ্চিন্ত হবার পর মনে পড়েছে কিছু। নিরুপায় হয়ে মেসোর কাছ থেকে যেভাবে টাকা আনতে হল সেটাই ভিতরে খচখচ করেছে। বসতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিবেকের খচখচানি বাতিল করে দিয়ে পকেট থেকে ছোট হিসেবের বই বার করল। মন দিয়ে কেনা-কাটার হিসেবটা সেরে ফেলতে লাগল সে।

যশোমতী এক-একবার আড়চোখে দেখছে তাকে, আবার বাইরের দিকে মুখ করে বসে থাকছে। এদিকে ফিরবে কি, আবার কার হাতে খবরের কাগজ চোখে পড়বে–মনে মনে এখন সেই অস্বস্তি। আজই কাগজে ছবি বেরিয়ে গেছে যখন, তার চিঠিখানা প্রত্যাশিত সময়ের আগেই বাবা-মায়ের হাতে পড়েছে। লিখে আসা সত্ত্বেও এ-ভাবে ঢাক পিটিয়ে খবরের কাগজে ছবি ছাপিয়ে তাকে বিব্রত করার দরুনও বাবার ওপর রাগ হতে লাগল। তাকে ধরার জন্য আরো কি করেছে আর করছে, কে জানে। সত্যি সত্যি শো-কেসের পুতুল ভাবে বলেই এত ভাবনা, তার কাছে মেয়েদের একটুও মর্যাদা থাকলে দু’দিন অন্তত সবুর করে দেখত।

–এঁর টিকিট? একটু ঘুরে ইঙ্গিতে যশোমতীকে দেখিয়ে তার টিকিট চাইল চেকার।

-আমি কি জানি! বলতে না বলতে হঠাৎ কোন্ অস্পষ্ট চেতনার ঘায়ে শঙ্কর সারাভাই বিমূঢ় যেন। যশোমতীর দিকেই তাকালে সে। চোখাচোখি হওয়ামাত্র বিপদ স্বতঃসিদ্ধ মনে হল। তবু জিজ্ঞাসা করল, আপনার টিকিট কোথায়?

যশোমতী নিরুত্তর। ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ার সুযোগ থাকলে সে লাফিয়েই পড়ত।

শঙ্কর আরো রুক্ষ মেজাজে বলে উঠল, কি আশ্চর্য, টিকিট আছে না নেই?

নিরুপায় যশোমতী সামান্য মাথা নাড়ল শুধু।

সঙ্গে সঙ্গে তার পাশের সেই বুড়ো ভদ্রলোক বক্র মন্তব্য ছুড়ল, মেয়েছেলের টিকিট তার হাতে দেওয়া কেন, নিজের সঙ্গে রাখলেই হত।

তিক্ত-বিরক্ত হয়ে শঙ্কর সারাভাই তাকেই ঝাঁঝিয়ে উঠল প্রথম, আপনি থামুন তো মশাই!

যশোমতীর দিকে ফিরল আবার। গলার স্বর সংযত রাখা দায়। –টিকিট নেই তো গাড়িতে ওঠার সময় সেটা মনে পড়ল না–বিনা টিকিটে দিবি গাড়িতে উঠে বসলেন? আমার কাছে কি টিকিট গজাবে এখন! আরো কি বলতে যাচ্ছিল, যশোমতীর নিষ্প্রভ পাংশু মুখের দিকে চেয়ে থেমে গেল। চেকারকে সবিনয়ে বলল, দেখুন, স্টেশনে আসার সময় বাসে ওঁর ব্যাগটা চুরি হয়ে গেছে, সে জন্যেই আর কি

বাস-কণ্ডাক্টরের সঙ্গে টিকিট চেকারের খুব একটা তফাত নেই। শুনে ঠাণ্ডা মুখে বলল, আপনি টিকিট করে নিন এখন, গার্ডকে বলে ওঠেন নি, কিছু ফাইনও লাগবে। মৌল তো?…. টিকিট একটাকা দশ আনা আর ফাইন দেড় টাকা–তিনটাকা দু আনা দিন—

যাঃ কলা! শঙ্কর সারাভাই প্রথমে বিমুঢ়, পরে তিক্ত-বিরক্ত। –আমি দিতে যাব কেন?

একটা মজার সূচনা দেখে অনেকেরই দৃষ্টি এদিকে এবারে। চেকারও ঈষৎ বিস্মিত তাহলে কে দেবে? উনি আপনার সঙ্গে নন?

–আমার-মানে–আমার সঙ্গে আবার কি।

সঙ্গের মহিলা বিব্রত বোধ করছে দেখেও শঙ্কর সারাভাইয়ের এরকম ব্যবহার মনঃপুত হল না অনেকেরই। ভিড়ের মধ্যে মালপত্র লটবহর সমেত মেয়েটিকে সুদ্ধ টেনে গাড়িতে তুলে কি ভাবে জায়গা করে নিয়েছে–এরই মধ্যে সেটা কারো ভোলার কথা নয়। সেই বুড়োলোকটিই চুপ করে থাকতে না পেরে তিক্ত মুখে ফোঁড়ন কাটল আবার।–টিকিট নেই যখন চুপচাপ টাকাটা গুণে দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে দিন না, টাকাটা বাঁচানো গেল না যখন কি আর করবেন উনি আপনার সঙ্গের কেউ কিনা সেটা আমরা সকলেই জানি।

অর্থাৎ, সঙ্গিনীর টিকিট না কেটে টাকা বাঁচাতে চেষ্টা করা হয়েছিল–ধরা পড়ার পরে সুড়সুড় করে টাকা বার করে দেওয়াই এখন বুদ্ধিমানের কাজ।

সীট ছেড়ে শঙ্কর সোজা উঠে দাঁড়াল একেবারে। ফলে জোড়া চোখ তার মুখের দিকে ধাওয়া করল। সশঙ্ক ব্যাকুল চোখে তাকালো যশোমতীও।

ধীর গম্ভীর মুখে বুড়ো লোকটাকে ভাল করে দেখেই যেন নিজেকে সংযত করতে চেষ্টা করল শঙ্কর সারাভাই। কিন্তু পেরে উঠল না। আগে সহ্য করেছে বারকয়েক, কিন্তু এই উক্তি বরদাস্ত করার মতো নয়। বলল, ফের অপিনি মুখ খুলবেন তো ওই জানলা দিয়ে আপনাকে আমি ছুঁড়ে ফেলে দেব, বুঝলেন?

বুড়োর মেজাজও তেমনি। রুখে গর্জে উঠল তৎক্ষণাৎ, কি? কি করবে তুমি! মগের মুলুক এটা, কেমন? একগাদা লোক ঠেলে বিনা টিকিটে মেয়েছেলে নিয়ে উঠে আবার–

শঙ্কর কি করবে? সাদা চুল দেখল, দাঁত নেই দেখল। না, কিছু করার নেই। বুড়োটা অতি বুড়ো, সেটাই তার জোর। রুদ্ধ নোষে এক ঝটকায় যশোমতীর দিকে ফিরল। কিন্তু তার মুখের দিকে চেয়েও থমকে গেল। যা বলতে যাচ্ছিল বলা হল না। চেয়েই রইল একটু। তারপর চেকারের দিকে ফিরল।

–কত দিতে হবে বললেন?

–তিন টাকা দু আনা।

–ফাইনও দিতে হবে?

হবে।

–আচ্ছা রিসিট লিখুন।

মানিব্যাগ টেনে নিয়ে টাকা বার করল। একগোছ নোটই আছে বটে এখনো, তবে সবই হিসেবের টাকা।

টাকা গুণে দিয়ে রিসিট নিল। নিয়েই রাগের মাথায় সেটা যশোমতীর দিকে বাড়িয়ে দিল। যশোমতী ভয়ে ভয়ে তাকালে তার দিকে। কি ভেবে শঙ্কর সারাভাই পরক্ষণে আবার হাত টেনে নিয়ে রিসিটটা নিজের ব্যাগেই রাখল।

চেকার চলে গেল। শঙ্কর নিজের আসনে গুম হয়ে বসল। যশোমতী ওদিকে ফিরে জানলার বাইরে মুখ আড়াল করেছে আবার। অপমানের চূড়ান্তই হয়ে গেছে যেন। তিন টাকা দু আনার জন্য এরকম পরিস্থিতিতে কেউ পড়ে এ যশোমতীর স্বপ্নেরও অগোচর। এরপর সে কি করবে, পরের স্টেশনে নেমে গিয়ে বাড়িতে টেলিগ্রাম করার ব্যবস্থা করবে একটা? তারপর বাড়ি গিয়ে বাবাকে বলবে, দুনিয়া দেখতে বেশিদিন লাগল না–একদিনেই দেখা হয়ে গেছে? বলবে তুমি ঠিকই বলেছ, নিজের জোরে বাঁচার শক্তি নেই আমাদের–আমরা শো-কেসে থাকারই উপযুক্ত?

তার থেকে গলায় দড়ি দেবার মতো দড়ি জুটবে না একটু? কিংবা ডুবে মরার মতো একটু জল? আর রেললাইন আর রেল গাড়িও তো আছেই। বাবারই মেয়ে বটে সে, সে রকমই গো। যত অপদস্থ হল, ততো বেশি গো চাপল তার। বাড়ি ফেরার চিন্তা সমূলে হেঁটে দিল, আর আত্মহত্যার পর নিজের চেহারাটা কল্পনা করতে একটুও ভাল লাগল না। সেটা ভয়ানক বীভৎস ব্যাপার। মনে মনে ভাবল, যত নষ্টের মূলে ওই চোর হতভাগা–বাস থেকে যে তার ব্যাগ নিয়েছে। তাকে হাতে পেলে আর ক্ষমতা থাকলে এই মুহূর্তে তাকে ফাঁসি দিত বোধহয়।

স্টেশন আসছে, যাচ্ছে। কামরার লোক কমছে।

একটা প্রশ্ন কানে ঢুকতেই আবার সচকিত কণ্টকিত হয়ে উঠল যশোমতী। এদিকে ফিরল না। লোকটা জিজ্ঞাসা করছে, আমার কাগজটা–কাগজটা কি করলেন?

প্রাণপণে বাইরের দিকে ঝুঁকে মাটি দেখছে যশোমতী। কিন্তু রেহাই পেল না।

–ইয়ে, শুনছেন? আমার কাগজটা আপনার হাতে ছিল, কোথায় রাখলেন?

অগত্যা নিরুপায় যশোমতী মুখ ফেরালো। আবারও বিপদের সম্মুখীন। তবে লোকজন নেমে যাওয়ার ফলে ওদিকের আসন অনেক ফাঁকা, এদিকে কারো চোখ নেই, আর সেই বুড়ো লোকটাও কখন নেমে গেছে।

–আমার কাগজটা? তিনবার একই কথা জিজ্ঞাসা করতে হল বলে শঙ্কর সারাভাইয়ের বিরক্তি।

যশোমতী কি আর জবাব দেবে, অসহায় চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। কাগজ বলে একটা বস্তুর অস্তিত্ব এই যেন প্রথম শুনল।

সঙ্গে সঙ্গে মেজাজ চড়তে লাগল শঙ্কর সারাভাইয়ের। যশোমতীর এপাশ ওপাশ আর বেঞ্চির তলায় চোখ চালিয়ে সে-ই খুঁজে নিল একটু। তারপর রুক্ষস্বরে বলে উঠল, এটাও হারিয়েছেন? বলি এভাবে একা স্টাইল করে আপনারা বেনোন কেন? আপনার কি ত্রিভুবনে কেউ নেই? সেই–সেই বাসে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে আমার কত লাভ হয়েছে বুঝতে পারছেন? দেখছেন কি? আমার অসুবিধা হচ্ছে বলে কাগজখানা আপনি টেনে নিয়েছিলেন– সেটা কি করলেন?

কি যে হল যশোমতীর কে জানে। একটু দূরে দূরে যারা ছিল তারাও এবারে সবিস্ময়ে ঘুরে বসেছে। ঠিক বুঝতে পারছে না হয়তো কি নিয়ে লোকটার মেজাজ চড়েছে–কিন্তু কথাবার্তার সুর তাদের কানে বেসুরো লাগছে নিশ্চয়ই।

সমস্ত মুখ লাল যশোমতীর। অনুচ্চ কঠিন প্রায় রূঢ় জবাব দিয়ে বসল, ফেলে দিয়েছি।

ফেলে দিয়েছেন। জবাবটা অথবা জবাবের এই সুরটাই হয়তো ঠিক বোধগম্য হয়নি শঙ্করের।মানে আমার কাগজটা আপনি ফেলে দিয়েছেন?….কেন? কেন?

–আমার খুশি।

শঙ্কর অবাক। এতক্ষণ যে মেয়ে দুই ঠোঁট সেলাই করে বসে ছিল, তার এই জবাব শুনে এতগুলো ক্ষতির হিসেব পর্যন্ত ভুল হবার দাখিল। নইলে এতখানি লোকসানের পর এরকম উক্তি বরদাস্ত করার লোক নয় সে।

হঠাৎ ভিতরে একটা অজ্ঞাত অস্বস্তি গুড়গুড় করে উঠতে লাগল শঙ্করের। মাথায় গণ্ডগোল নেই তো কিছু! যে ভাবে এখন মুখের দিকে চেয়ে আছে, মনে হল আর কিছু বললে সে-ও ঠাস করে মুখের ওপর জবাব দেবে।

অতএব আর কিছু না বলে শঙ্কর অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালো, কিন্তু আড়ে আড়ে বার-কতক লক্ষ্য করল মেয়েটাকে। পরনের বেশ-বাস এমন কি পায়ের জুতোজোড়া পর্যন্ত দামী মনে হয়। হাতের হীরে বসানো মোটা বালা-দুটো আর আংটি ঝকমক করছে। কানের ঝোলানো দুল দু’টাও। গলার হারও কম দামী নয়, হাতে দামী লেডীস রিস্ট-ওয়াচ। মেসোর থেকে ও-ভাবে টাকা আনার দরুন, আর সেই বাস থেকে একের পর এক ব্যবসায়ের পয়সা অকারণে খোয় যাবার দরুন মেজাজ বিগড়ে ছিল বলেই হয়তো খুব ভাল করে লক্ষ্য করা হয়নি এতক্ষণ। পয়সার ব্যাপারে শঙ্করের কড়াক্রান্তি হিসেব তার ওপর এ তো বলতে গেলে প্রাণের দায়ে চুরি করা বহু কষ্টের পয়সা।….কিন্তু এই প্রথম মনে হল শঙ্কর সারাভাইয়ের, দেখলে দেখার মতোই বটে মেয়েটি। মুখখানা যে ভারী ভারী মিষ্টি তাতে কোন সন্দেহ নেই।

….অথচ একলা বেরিয়েছে। কিন্তু একলা বেরিয়ে যে অভ্যস্ত সে রকম একটুও মনে হয় না।

ওদিকে একের পর এক নাজেহাল হয়ে যশোমতী সত্যিই রেগে গিয়েছিল। রাগে ক্ষোভে তার চোখে জল আসার উপক্রম হয়েছিল। আর কিছু বললে সেও চুপ করে থাকত না ঠিকই। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যা মুখে আসে তাই বলে বসত হয়তো। কিন্তু লোকটার হাব-ভাব হঠাৎ এ-ভাবে বদলে যেতে আত্মস্থ হল। ফলে শুধু লজ্জা নয়, সঙ্কোচ বোধ করতে লাগল। বনেত্রে সেও বার-কতক লক্ষ্য করল তাকে।

দুই একবার চোখোচোখি হয়ে গেল। যশোমতীর মনে হল, গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ির জন্যেই বেশি রুক্ষ লাগছে লোকটাকে….শেভ করলে বেশ ভব্য-সভ্যই দেখাবার কথা। স্বাস্থ্য রীতিমতো ভাল, গায়ের জোরের দেমাকেই লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে বেড়ায় বোধহয়। কিন্তু অন্য লোকের সঙ্গে ঝগড়ার বেশির ভাগ তার জন্যেই করেছে–এ সত্যটাও মনে মনে অস্বীকার করতে পারল না যশোমতী। ইচ্ছে করে লোকটার কাগজ ফেলে দেবার পরেও সেই কিনা উন্টে চোখ রাঙিয়ে বসল। আর তার ফলে ভদ্রলোক….ভদ্রলোকই তো মনে হচ্ছে….এ ভাবে চুপ করে যাবে আশা করে নি। করে নি বলেই যশোমতীর চিন্তা কিছুটা সঙ্গত পথে চলল। মানুষটার রুক্ষ হাব-ভাব আচরণের তলায় একটা যেন দরদী মনই আবিষ্কার করে ফেলল সে। ব্যাগ চুরি যাবার ফলে এখন তো বিপদের পাহাড় যশোমতীর মাথার ওপর। কেউ সামান্য সহায় হলেও সেটা সামান্য ভাবার কথা নয়। ভাবল না। এতবড় বিপদে এত লোকের মধ্যে এই নিতান্ত অপরিচিত একজন ছাড়া কে আর তার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। আর তো কেউ ফিরেও তাকায় নি। টিকিট-চেকারের হাতে ধরা পড়ার ফলেই তো এতক্ষণে সব ফাস হয়ে যাবার কথা। তাকে টেনে নামিয়ে জেরা শুরু করলেই ট্রাঙ্ক-টেলিফোনে বাবার কাছে খবর না পাঠিয়ে করত কি? আর তারপর….তারপর কেলেঙ্কারি হাসাহাসি, ঢি-ঢি।

এ-পর্যন্ত এই অপরিচিত মানুষটাই সর্বভাবে তার মান মর্যাদা রক্ষা করেছে। নইলে কি-যে হত কে জানে।

বক্র কটাক্ষে তাকালে আবার। আবারও চোখোঁচাখি হয়েগেল। ধমক খাবার পর এই মুখ দেখে প্রায় হাসিই পাচ্ছে যশোমতীর। এত চিন্তা-ভাবনার ফাঁকে ফাঁকেও মনের তলায় কোথায় যেন একটু ভাল লাগার অনুভূতি উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। শুধু সামান্য পয়সা –যে পয়সাকে কোনদিন পয়সা বলে ভাবার দরকার হয়নি যশোমতীর তাই নিয়ে লোকটার ও-ভাবে মাথা গরম করাটা ভাল লাগে নি।….হতে পারে গরীব, তাই বলে এমন তুচ্ছ লোকসান নিয়ে এ-রকম হিসেব-নিকেশ করার মন কেন? তার একটু প্রীতির আশায় কত জনে কত টাকা বাতাসে উড়িয়ে কৃতার্থ হবার জন্য প্রস্তুত ঠিক নেই।

মেয়েটাকে এক-একবার দেখেছে আর ভাবছে শঙ্কর সারাভাইও। সেই গোড়া থেকে অর্থাৎ বাসের যোগাযোগের শুরু থেকে তলিয়ে ভাবছে। ….না, যত দেখছে আর যত ভাবছে, মাথায় ছিট আছে বলে মনে হচ্ছে না তার। আচরণে অসঙ্গতি কোথাও দেখে নি। বাসে, বাসের থেকেও অনেক গুণ বেশি এই ট্রেনে–টিকিট না থাকার দরুন যে অসহায় মূতি লক্ষ্য করেছে, তাতে কোনরকম বিকৃতির লক্ষণ ছিল না। বিকৃতি নয় মনে হতেই ভিতরে ভিতরে আবার রাগ হতে লাগল শঙ্করের। স্টাইল করে একা বেরিয়েছে, তার ওপর কাগজ হারিয়ে উলেট আবার চোখ রাঙিয়েছে তাকে। ….দেখতে সুন্দর, ভেবেছে সকলে শুধু মুখ দেখেই ভুলে যাবে। সুন্দর মুখ দেখেই সে একের পর এক এতগুলো লোকসান বরদাস্ত করেছে কিনা মনে হতে নিজের ওপরেই উষ্ণ হয়ে উঠল। কেন অত করতে গেল? বাসের টিকিট দিতে গেল কেন,কেনই বা বিনা টিকিটে ট্রেনে ওঠার খেসারত দিতে গেল?….আশ্চর্য।

ট্রেন থামল। দিনের আলোয় টান ধরেছে। সন্ধ্যার ছায়া নেমেছে। মৌলা। লোকাল ট্রেনের যাত্রা শেষ।

কামরায় যে সাত-আটজন লোক ছিল তারা আগে নেমে গেল। শঙ্করের তাড়া নেই। ধীরে-সুস্থে মালপত্র গুছিয়ে সে নামার উদ্যোগ করল। এবারে আবার চোখ টান করে তাকে দেখছে যশোমতী। স্টেশনের দিকে এক নজর তাকিয়েই তার ভিতরটা দুমড়ে গেছে। দু’দণ্ড নিশ্চিন্ত হবার মতো কিছুই কি বরাতে জুটবে না আজ? খোলা স্টেশন, মাথার ওপর ছাদ নেই। ওদিকে খুপরির মতো ছনের ছোট ছোট অফিস-ঘর গোটা দুই-তিন, ওয়েটিংরুম আশা করা দুরাশা বোধহয়। স্টেশনের এদিক-ওদিক যতদূর চোখ যায় ধু-ধু মাঠ।

আগে মালগুলো সব নামিয়ে আর একবার উঠে বেঞ্চির তলায় উঁকি দিয়ে দেখে নিল শঙ্কর, টুকিটাকি জিনিস কিছু থলে থেকে গাড়িতে পড়েছে কিনা। তারপর নেমে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

যশোমতী বসে আছে। শুধু বসে আছে নয়, তার দিকেই চেয়ে আছে। মেয়েটার এই দৃষ্টি আবার যেন কেমন অসহায় মনে হল শঙ্করের।

তবু আর বোধহয় মাথা গলাতে না সে, সেই থেকে অনেক শিক্ষা হয়েছে–কিন্তু মেয়েটির টিকিটের রসিদও যে তারই কাছে। তাছাড়া, এভাবে বসে থাকতে দেখে অবাকও কম হয়নি। হাব-ভাব গোলমেলেই লাগছে।

দাঁড়িয়ে দেখল একটু। গম্ভীর মুখে জানান দিল, এটা মৌলা স্টেশন।

জবাব নেই।

–আপনি নামবেন কি এখানে? খানিক বাদে গাড়ি আবার ফিরে যাবে।

অগত্যা যশোমতী উঠল। তার পিছনে পিছনে নামল। স্টেশন না এলে, এই পথ এত শিগগীর না ফুরোলেই বাঁচত বুঝি। আবার এক সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্যে প্রস্তুত হতে চেষ্টা করেছে প্রাণপণে।

শঙ্কর সারাভাই মালপত্রগুলো দু-হাতের দখলে আনতে চেষ্টা করল। আসার সময়ের মতো স্বাভাবিক সৌজন্যবশতই হোক বা একটু সাহায্য করার তাগিদেই হোক, সেই ঝোলাটা নেবার জন্য হাত বাড়ালো যশোমতী।

তার আগে শঙ্কর তাড়াতাড়ি ওটা দখলই করল যেন। বলল, থাক এটা খোয়া গেলে আবার আমাকে এই গাড়িতেই ফিরতে হবে।

টিকিট দিয়ে বাইরে এলো। যশোমতী কি করবে এখন জানে না। দিনের আলোয় যে সাহসে বুক বেঁধেছিল, আসন্ন রাতের ছায়া নামতে তা যেন উবে গেছে। এর থেকে গাড়িতে বসে থাকলে ভাল হত বোধহয়। গাড়ি আবার ফিরে যেত অবশ্য। গেলেও বড় স্টেশনে রাত কাটানো যেত। দিনের আলোয় আবার ভাবা যেত কি করা যায়।

বাইরে আসার পর লোকটা যেন আর চেনেই না তাকে। ও-ধারের আঙিনা ছাড়িয়ে রাস্তায় নেমেই রিকশায় মালপত্র তুলতে লাগল। যশোমতী কি করবে? কেমন লোক–ভাল কি মন্দ কিছুই জানে না। কিন্তু এ-রকম দিশাহারা অবস্থায় পড়ে তার মনে হল, এতক্ষণের এই চেনা লোক যেন নির্লিপ্ত নিষ্ঠুরের মতো তাকে বিপদের মধ্যে ফেলে চলে যাচ্ছে।

যশোমতী সিঁড়ির ওপরেই দাঁড়িয়েছিল। রাস্তায় নামে নি। লোকটা তার দিকে আর ফিরে তাকাবে কিনা জানে না, আর একবারও তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে কিনা জানে না। তবু সঁাড়িয়ে আছে যশোমতী, তবু প্রতীক্ষা করছে। সাধারণ স্থলে এ-রকম বেখাপ্পা পরিস্থিতিতে এই বয়সের কোনো মেয়ের আলাপ-পরিচয় ঘটলে পুরুষের দিক থেকে অন্তত একটু ঘনিষ্ট হবার কথা। আর কিছু না হোক, তার একটু কৌতূহল হবার কথা। কিন্তু এ-রকম নীরস গদ্যকারের পৃথিবী যশোমতী আর দেখে নি। চলে যেতে দেখে লোকটার ওপর এখন রীতিমতো রাগ হচ্ছে তার–পাঁচ টাকাও খরচ হয়নি ওর জন্যে, কিন্তু সেই লোকসানের শোকেই অস্থির।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত গেল না, ফিরে তাকালো। আর, তক্ষুনি প্রাণের দায়ে যশোমতী কিছু বলবে এ-রকম কিছু আভাসই প্রকাশ করল। হয়তো। বিস্ময়ের আঁচড় পড়তে লাগল লোকটার মুখে। সে যে এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তাও এতক্ষণ খেয়াল করে নি বোধহয়।

যশোমতীর রাগ হবারই কথা।

যাক, ফিরে আসছে।

যশোমতী জিজ্ঞাসা করল, এখানে রাতে থাকার মতো কোনো হোটেল-টোটেল বা সেরকম কিছু নেই?

জবাব না দিয়ে শঙ্কর সারাভাই অবাক চোখে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। মেয়েটিকে আবার নতুন করে দেখল একপ্রস্থ। শুধু দেখা নয়, বুঝতেও চেষ্টা করল।আপনি যাবেন কোথায়?

যশোমতী নিরুত্তর।

-এখানে আপনার চেনা-জানা কেউ নেই?

সুবোধ মেয়ের মতো তক্ষুনি মাথা নাড়ল। নেই। শঙ্কর সারাভাই দেখছে। রাগ নয়, একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি। মনের তলায় দুর্বোধ্য জটিলতার ছায়া পড়ছে।

–আপনি এখানে এসেছেন কেন?

এই প্রশ্নের একটাই জবাব হতে পারে। যশোমতী তাই বলল। চাকরির খোঁজে….

চাকরিকি চাকরি?

–কোনো স্কুল-টুলে–

–স্কুলে চাকরি! মেয়েদের স্কুল বলতে তো এখানে একটা পাঠশালা আছে শুধু।

যশোমতী সাগ্রহে বলল, সেখানেই একটা কা-কাজ পাওয়া যেতে পারে শুনেছিলাম

শঙ্কর সারাভাই হাঁ করে তবু মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। আবার একটা গণ্ডগোলে পড়ে যাচ্ছে ভেবেই চিরাচবিত অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পেল কিনা কে জানে। বলে উঠল, চাকরি পাওয়া যেতে পারে শুনেছিলেন তো সকালের গাড়িতে এসে দেখাশোনা করে যান নি কেন? এখানে কি হোটেল-রেস্তরার ছড়াছড়ি যে মনে হল আর একা মেয়েছেলে ভর-সন্ধ্যায় হুট করে চলে এলেন? দৃষ্টি ঘোরালো হল পরক্ষণেই।–সঙ্গে তো টাকাকড়ি কিছু নেই, হোটেল থাকলেই বা আপনার কি সুবিধে হত?

যশোমতী কি জবাব দেবে? তবু মরিয়া হয়েই বলল, ভদ্রলোকের হোটেল হলে কোনো মহিলা বিপদে পড়েছে শুনলে সাহায্য করতেন বোধহয়। আমি ফিরে গিয়েই আবার টাকা পাঠিয়ে দিতুম। গয়না বেচে দেনা শোধ করে যেত সেটা আর বলতে পারল না।

শঙ্কর সারাভাইয়ের নিজেরই যেন বুদ্ধিসুদ্ধি সব ঘুলিয়ে যাচ্ছে কেমন। হাঁ করে আবার ও মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। অস্বস্তি বাড়ছেই। কেন যেন আর মাথা গলানো ঠিক নয় মনে হল তার। তিরিক্ষি মেজাজে পকেট থেকে ব্যাগ টেনে একটা টাকা বার করে তার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, একটা রিকশা নিয়ে যেখানে যাবার কথা চলে যান, রাত করে আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য তো পাঠশালা খুলে বসে আছে সব। মোটকথা, যা ভাল বোঝেন করুন। ভাল দিন পড়েছে আজ আমার

যশোমতী চেয়ে রইল শুধু। হাত বাড়াল, বা টাকা নিল না। বিপুল ঐশ্বর্যের উত্তরাধিকারিণীর এই দুরবস্থা সে যেন নিজেই এখনো কল্পনা করতে পারছে না।

–কই, নিন! এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে?

–থাক, আপনি যান।

কি করে বলল, সত্যিই চলে গেলে কি হবে যশোমতী জানে না। তবু মুখ দিয়ে এই কথাই বেরুল তার।

ব্যাগের টাকা আবার ব্যাগে পুরে হনহন করে এগিয়ে গিয়ে রিকশায় উঠে বসল শঙ্কর সারাভাই। রিকশাওয়ালা এতক্ষণ হাঁ করে দেখছিল তাদের। এবারে রিকশা তুলে নিল। দু’চার গজ এগিয়েই শঙ্কর পিছন ফিরে তাকালো।

যশোমতী দাঁড়িয়ে আছে। স্থির, নির্বাক। এদিকেই চেয়ে আছে।

আরো পাঁচ-সাত গজ গেল। আবারও ফিরে তাকালো শঙ্কর সারাভাই।

যশোমতী তেমনি দাঁড়িয়ে।

অস্বস্তির একশেষ। শঙ্করের কেবলই মনে হল, মেয়েটি বিপদে পড়েছে। এই চেহারার….এই গয়না আর সাজ-পোশাকের মেয়ে পাঠশালার চাকরির খোঁজে এসেছে শুনে সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিয়েছে বটে, কিন্তু এই মুহূর্তে আসন্ন সন্ধ্যার টান-ধরা আলোয় এই মুখের দিকে চেয়ে কেন যেন বিপদে পড়া ছাড়া আর কিছু ভাবা গেল না। যেমন অসহায়, তেমনি করুণ…আবার তেমনি সুন্দর।

রিকশা ফেরাতে বলল।

সিঁড়ির পাশে রিকশা থামতে লাফিয়ে নেমে পড়ল।

যশোমতী নিশ্চল দাঁড়িয়ে। কিন্তু তার বুকের ভেতরটা গুড়গুড় করছে আবার।

–চলুন।

যশোমতী চেয়ে আছে।

যশোমতী চেয়েই আছে।

বিরক্তি চাপতে গিয়েও সেটা প্রকাশ হয়েই পড়ল—আপনাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছুই নেই। বাসে ব্যাগ হারাবার পরেও ফিরে যাওয়ার কথাটা মনে হল না আপনার….দেখছেন কি, উঠুন রিকশায়।

পায়ে পায়ে নেমে এসে যশোমতী রিকশায় উঠল। আশ্রয় পাওয়ার পর দ্বিধা, ভাল করল কি মন্দ করল জানে না। যে সঙ্কটে পড়েছে, ভাল থোক মন্দ হোক কিছু একটা করতেই হবে। গাঁয়ের এই স্টেশনে রাত কাটাবার কথা ভাবতেও তার দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল।

সে বসার পর পাশে যেটুকু জায়গা থাকল, সেখানে কোনো অচেনা পরপুরুষের বসার প্রশ্ন ওঠে না। তবু সভয়ে তাকালে যশোমতী।

চল–। রিকশা চালাতে হুকুম করে শঙ্কর সারাভাই হনহন করে আগেই হেঁটে চলল। তারপর পিছন ফিরে বলল, মালগুলোর দিকে দয়া করে লক্ষ্য রাখবেন পড়ে-টড়ে না যায়, আর খেয়াল খুশিমতো কোনটা ফেলে দেবেন না আবার।

রিকশাওয়ালা আবার রিকশা তুলে নিল। হঠাৎ খুব হালকা আর খুব নিশ্চিন্ত লাগছে যশোমতীর। বিপদের থেকে আরো বিপদের মধ্যে পা বাড়ায় নি, এ আশ্বাস যেন নিজের ভিতর থেকেই পাচ্ছে সে। লোকটার নাম পর্যন্ত জানে না এখনো, কিন্তু আবছা সন্ধ্যায় এরকম একটা সুযোগ পেয়েও যে রিকশায় উঠে বসল না, বা বসার কথা একবার ভাবলও না–তাতেই লোকটা যে ভদ্র তাতে আর সন্দেহ থাকল না। ভেবে ভাবনার কূল-কিনারা পাবে না যশোমতী জানে, তাই হঠাৎ সমস্ত ভাবনা-চিন্তা রসাতলে পাঠাতে ইচ্ছে করল। ….ভদ্রই যদি হয় তাহলে জলে পড়বে না। ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হবার দাখিল, আর ভাবতে পারে না। দেখা যাক।

রিকশাওয়ালা তার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল। যশোমতী তাকালে একবার। আবছা অন্ধকার সত্ত্বেও পাশ কাটাবার মুখে স্পষ্টই দেখতে পেল। রাজ্যের বিরক্তি মুখে এটে মাথা গোজ করে চলেছে লোকটা। রিকশা এগিয়ে যেতে হঠাৎ হেসেই ফেলল সে। বাসের টিকিট নিয়ে বিভ্রাটের পর থেকে একজন সঙ্গী পেয়েছে বটে!

দু’ধারে মাঠ, মাঝে রাস্তা। নির্জন। যশোমতী আর একবার তাকালো পিছন ফিরে। তারপর কি ভেবে রিকশাওয়ালাকে বলল, আস্তে চলতে, পিছনের লোকের সঙ্গে আসতে।….হাসি পেয়েছিল বটে, কিন্তু হাসিটা যে ছেলেমানুষি, তার থেকে বেশি কে আর জানে। কোথায় কার বাড়ি যাচ্ছে, কি দেখবে সেখানে গিয়ে কে জানে। সেখানে যারা আছে তাদের মুখ দেখাবে কি করে? তাদের জেরার কি জবাব দেবে? কি ভাববে তারা? কিন্তু উদ্বেগের তাড়নায় কিনা বলা যায় না, একটু আগের স্বতঃস্ফূর্ত আশ্বাসটুকুই আঁকড়ে ধরে থাকতে চেষ্টা করল যশোমতী।….সেই বাস থেকে যেমন দেখে আসছে এই অচেনা অজা সহযাত্রীটিকে, তার মেজাজ যেমনই হোক, বা হিসেবের মুঠোটা যত শক্তই হোক, তার ভিতরের একটা চেহারা যেন সে দেখেছে। সেটা মানুষেরই চেহারা, মেয়েছেলের বিপদ দেখে হীন সুযোগ নেবার মতো নয়। আপাতত এই নির্ভরতাটুকুই সম্বল।

রিকশার গতি শিথিল হবার ফলে পিছনের মানুষ পাশে আসতে যশোমতী উৎসুক মুখে তাকালো। শঙ্করও ঘাড় ফেরাল। আর তক্ষুনি বোঝা গেল মেজাজ তখনো ঠাণ্ডা হয়নি। হয়নি বলেই যেন বেশি নিশ্চিন্ত বোধ করছে। এবারে বিব্রত মুখে যশোমতী চিরাচরিত সৌজন্যের কুণ্ঠাই প্রকাশ করল।

–আপনার হেঁটে যেতে কষ্ট হচ্ছে….

দৃষ্টিটা তার মুখের ওপর আটকে নিয়ে শঙ্কর বলল, কষ্ট হলে কি আর করা যাবে, ওখানে উঠব?

ওখানে অর্থাৎ রিকশায়। কি রকম মেয়ে বোঝার জন্যেই ফিরে বক্র প্রশ্ন ছুঁড়েছে শঙ্কর।

থতমত খেয়ে যশোমতী তাড়াতাড়ি জবাব দিল, না না, বলছিলাম আর একটা রিকশা করলে হত….

–তার ভাড়াটা কে দিত, আপনি না আমি?

এই জবাবই বোধহয় সব থেকে ভাল লাগল যশোমতীর। এরই থেকে মন বুঝতে সুবিধে হয়, অন্তত মনের গতি সোজা পথে চলছে কিনা সেটা বোঝা যায়। ভাল মুখ করে বলল, এখন আপনিই দিতেন, পরে না হয় আমি দিয়ে দিতাম।

যে-রকম হিসেবী, আরো কিছু বললে মাথা একটু ঠাণ্ডা হবে মনে হল। রিকশার গতি আর একটু না কমলে কথা বলার সুবিধে হচ্ছে না। আগে রিকশাওয়ালাকে নির্দেশ দিল, এই, আরো আস্তে চলল। তারপর পাশের লোকের দিকে ফিরে সবিনয়ে বলল, আমার জন্যে আপনার অনেক খরচা হয়ে গেল, কিন্তু আপনার কিছু লোকসান হবে না, আমি সব মিটিয়ে দেব।

জবাবে শঙ্কর সারাভাই একটা তপ্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল শুধু। পরমুহূর্তে আচমকা প্রশ্ন করল, আপনার নাম কি?

ঠিক এই মুহূর্তে এ-প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। হকচকিয়ে জবাব দিল, লি-লীলা।

লীলা কী?

প্রশ্নের সুরটা খট করে কানে লাগল কেমন যশোমতীর। চোখ কান বুজে যে পদবী মনে এল তাই বলে দিল।

-লীলা নায়েক। কেন….?

জবাব পেল না। আবছা আলোয় আর একবার যেন তাকে ভাল করে দেখে নিল লোকটা।

কি ভেবে হঠাৎ রিকশাওয়ালাকে রিকশা থামাতে বলল যশোমতী। শঙ্কর দাঁড়িয়ে গেল। যশোমতী নামল। বলল, রিকশাওয়ালা চলুক, আমিও হেঁটেই যাই।

শঙ্কর সারাভাই আপত্তি করল না। তার মনে নানা সংশয় আনাগোনা করছে। বাস থেকে এ-পর্যন্ত অনেক কিছুই অস্বাভাবিক লাগছে তার। রিকশাওয়ালাকে চলতে ইঙ্গিত করে এগিয়ে চুপচাপ চলল। শুধু বলল, বাড়ি এখনো আধ মাইল পথ।

সঙ্গে সঙ্গে যশোমতী জিজ্ঞাসা করল, আপনার বাড়িতে কে আছেন?

বিরক্ত মুখে কিছু বলতে গিয়েও শঙ্করের খেয়াল হল, এই বয়সের মেয়ে অপরিচিত লোকের বাড়ি যাচ্ছে, খোঁজ নেওয়াই স্বাভাবিক।

–দিদি আছে, আর বাচ্চা ভাগ্নে আছে।

দিদি আছে শুনে খানিকটা নিশ্চিন্ত যশোমতী।–আর কেউ নেই?

আর বিহারী আছে–পুরনো চাকর।….আপনি স্কুলে কাজ পাবেন জেনে এসেছেন, না কাজের চেষ্টায় এসেছেন?

ঢোঁক গিলে যশোমতী জবাব দিল, চেষ্টায়….

স্কুলের যারা চাকরি দেবার মালিক তারা আপনাকে এসে দেখা করতে লিখেছিল?

-না….মানে, আমার এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম এসে চেষ্টাচরিত্র করলে কাজ হতে পারে….এসে গেলাম। আপনার তাদের সঙ্গে চেনা-জানা আছে?

জবাব পেল না। আবছা অন্ধকার সত্ত্বেও যশোমতীর মনে হল লোকটার চোখে কিছু সংশয় ঘন হয়ে উঠেছে।

দুই-এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শঙ্কর হঠাৎ আবার জিজ্ঞাসা করল, কোথায় থাকবেন ঠিক না করেই অজানা অচেনা জায়গায় দেখা-সাক্ষাৎ করতে বেরিয়ে পড়েছেন? এখানে আসতেই সন্ধ্যে হয়ে যাবে আপনি জানতেন না?

রিকশা থেকে না নামলেই ঠিক হত বোধহয়। মিথ্যে বলা অভ্যেস নেই যশোমতীর। দরকারও হয়নি কখনো। মিথ্যে কেউ বললে সে তাকে ঘৃণাই করত। কিন্তু ইচ্ছে না থাকলেও মিথ্যে না বলে পারা যায় না এ কে জানত। প্রাণের দায়ে অম্লানবদনে মিছে কথা বলার জন্যেই প্রস্তুত হল সে।

প্রথমে মাথা নাড়ল, সন্ধ্যা হবে জানতাম না। তারপর অস্ফুট বিশ্বাসযোগ্য সুরেই বলল, এ-রকম অবস্থায় পড়ে যাব ঠিক ভাবিনি।

–স্কুলে দেখা করে কাল ফিরে যাবেন?

–চাকরি না হলে তো ফিরতেই হবে, তবে ঠিক ফেরার ইচ্ছে ছিল না….এখানে না হলে আবার অন্য কোথাও চেষ্টা করতে চলে যাব ভেবেছিলাম। অত ভিড়ের মধ্যে বাসে ব্যাগটা চুরি হয়ে গিয়েই সব গণ্ডগোল হয়ে গেল।

ঘাড় ফিরিয়ে শঙ্কর সারাভাই খপ করে আবার জিজ্ঞাসা করে বসল, ব্যাগে আপনার কত টাকা ছিল?

পা-পাঁচ-পাঁচশো। পাঁচ হাজার বলতে গিয়েও কোন রকমে সামলে নিয়ে পাঁচশো বলল। এমনিতেই অবিশ্বাস উঁকিঝুঁকি দিয়েছে বুঝতে পারছে, পাঠশালার চাকরি পাবার আশায় পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল শুনলে সঙ্গে সঙ্গে আবার হয়তো স্টেশনের রাস্তাই ধরতে বলবে তাকে। পাঁচশো টাকা বলার ফলেই প্রায় সেই গোছের মুখ।

পাঁচশো টাকা সঙ্গে নিয়ে এখান থেকে এখানে আপনি চাকরির চেষ্টায় এসেছিলেন?

–ব-বললাম তো আর ফেরার ইচ্ছে ছিল না–যা ছিল সব নিয়ে বেরিয়েছিলাম। চুপচাপ কয়েক মুহূর্ত। পরের প্রশ্ন শুনে প্রায় আঁতকেই উঠল যশোমতী।

বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন?

-পা-পালাব মানে! যশোমতী রেগেই গেল।–পালাতে যাব কেন, বনিবনা হচ্ছিল না, চলে এসেছি। বলে এসেছি, নিজের রাস্তা নিজে দেখে নেব, আর ফিরব না।

ইচ্ছে করেই এতটা বলল যশোমতী। এই বলার ফলে আখেরে সুবিধে হতে পারে।

আবার গভীর প্রশ্ন।– বাড়িতে কে আছে? কার সঙ্গে বনিবনা হয়নি।

ভিতরে ভিতরে নাজেহাল যশোমতী। তবু জিজ্ঞাসাবাদের ফয়সালা এখানেই যে হয়ে যাচ্ছে, সেটা এক পক্ষে ভাল। অজানা অচেনা বাড়িতে গিয়ে ওঠার পর সকলের জেরার সামনে পড়তে হলে আরো বিতকিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।

–দা-দাদার আর দাদার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আর বউদির সঙ্গে।

অন্ধকার ঘন হয়েছে। অদূরের রিকশাটাকেও আবছা দেখাচ্ছে। তবু পার্শ্ববর্তিনীকে আর একবার ভাল করে দেখতে চেষ্টা করল শঙ্কর সারাভাই।–আপনার দাদা অবস্থাপন্ন?

জেরার ফলেই মাথা খুলছে যশোমতীর। এক মুহূর্তেই মনে হল, তার যা বেশবাস, অবস্থাপন্ন না বললে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, খুব। বড় অবস্থা বলেই তো মান বাঁচাতে সরে দাঁড়াতে হল।

যাক। এবারে জেরা শেষ হয়েছে মনে হল। আর মাথা খাঁটিয়ে যেভাবে জবানবন্দী দিল সে, খানিকটা বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে বলেও মনে হল তার।

–আপনার দাদা কি করেন?

ব্যবসা। এর পর আর কিছু জিজ্ঞাসা করলে রাগই হবে যশোমতীর।

-কিসের ব্যবসা?

ফের জেরার আগেই তড়বড় করে অনেক কথা বলে ফেলল যশোমতী। পাঁচ রকমের ব্যবসা, আমি অত খবর রাখিনে। মোট কথা তাদের ব্যবহারে সেখানে থাকতে আমার অপমান লাগছিল, তাই যা হোক একটা চাকরিবাকরি নিয়ে থাকব ঠিক করে চলে এসেছি। সেট। কি অন্যায় কিছু করা হয়েছে?

জবাব পেল না। ক্রমাগত মিথ্যে বলে যেতে হচ্ছে বলে রাগ হলেও ফলাফল তার অনুকূলেই যাচ্ছে মনে হল। এভাবে একা বাড়ি ছেড়ে আসার পিছনে একটা মোটামুটি স্বাভাবিক কারণ। উপস্থিত করা গেছে সন্দেহ নেই।

অনেকখানি নিশ্চিন্ত হবার পর যশোমতীর খারাপ লাগছে না। ভিতরে ভিতরে এখন বেশ মজাই লাগছে। বাড়ির দিদিটি কেমন কে জানে, বাড়িটা পছন্দ হলে আর নিরাপদ মনে হলে দু’-পাঁচ দিন থেকে গিয়ে সত্যিই হয়তো পাঠশালায় চাকরির চেষ্টাও করা যেতে পারে। যে ছাদে বাড়ি ছাড়ার গল্প ফাঁদা হয়েছে, ঠকবে না। আর চাকরি একটা পেয়ে গেলে কড়া-ক্রান্তিতে এই লোকের দেনা শোধ তো নিশ্চয় করবে।

….দেনা। দেনার অঙ্ক মনে হতে যশোমতীর হাসিই পেয়ে গেল। রিকশার ভাড়া ধরলেও এ-পর্যন্ত পাঁচ টাকা হবে না হয়তো। পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বেরিয়েছিল, এখন দেখছে পাঁচ টাকার দামও কম নয়। দুনিয়া দেখতে না বেরুলে এ-রকম অভিজ্ঞতা তার হত না ঠিকই।

–আপনার নাম কি? এবারের প্রশ্ন যশোমতীর।

–শঙ্কর–শঙ্কর সারাভাই।

–আপনি এখানে চাকরি করেন বুঝি?

না, ব্যবসা।

যশোমতীর মনে পড়ল, তার মালপত্রর সঙ্গে একরাশ সুতোও দেখেছে। তাই কিসের ব্যবসা জানার কৌতূহলও হল। কিন্তু ভরসা করে জিজ্ঞাসা করতে পারল না, কারণ যেটুকু জবাব দিয়েছে তাতেই বিরক্তি লক্ষ্য করেছে। অথচ ওর বেলায় যেন পুলিসের জেরা শুরু করে দিয়েছিল।


© 2024 পুরনো বই