০৫. রাজকুমার

জীবনে রাজকুমারের অনেকবার অনেক রকম বেঁক আসিয়াছে। এটা অবশ্য রাজকুমারের একচেটিয়া নয়, নেহাৎ গোবেচারি শ্লথ মানুষেরও ঝোঁক আসে। কোনো কোনো মানুষ কেঁকের মাথায় কখনো কোনো কাজ করে না, ভালো কাজও নয়। দুঃখ আর অশান্তি দূর করিয়া পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে সুখী করার কেঁকও যদি এ সমস্ত মানুষের চাপে, যতক্ষণ ঝোঁক থাকিবে কিছুই তারা করিবে না। ঝিমাইয়া পড়া পর্যন্ত মনে মনে শুধু বিবেচনা করিয়া চলিবে কাজটা উচিত কিনা আর লাভ-লোকসানের খতিয়ানটা কি এবং নিজের সংযমের বাহুল্যে গভীর আত্মপ্রসাদ অনুভব করিবে। সংযম যেন নিছক ধীরতা ও শৈথিল্য।

হঠাৎ-জাগা সমস্ত ইচ্ছাকে রাজকুমার অবশ্য আমল দেয় না, পাগল ছাড়া সেটা কারো পক্ষে সম্ভবও নয়। তবে কেঁকের মাথায় কাজ করার স্বভাব তার আছে। অনেক পুরস্কার ও শাস্তি, আনন্দ ও বিষণ্ণতা এমনিভাবে সে অৰ্জন করিয়াছে।

এবার যে সৃষ্টিছাড়া খেয়ালটি তাকে আশ্ৰয় করিল, আবির্ভাবটা তার আকস্মিক নয়। তবু এ খেয়ালটি ঝোঁকের মতোই প্রবল হইয়া উঠিল। প্রথমে মনের কোণে কথাটা একবার শুধু উঁকি দিয়া গেল, ভাঙা মেঘের মতো মনের আকাশের এক টুকরা অসঙ্গত আলগা চিন্তা। নিজের কাছেই যেন রাজকুমার লজ্জা বোধ করিল। এসব চিন্তা কোথা হইতে ভাসিয়া আসে, আবার কোথায় চলিয়া যায়। এ চিন্তাটিরও ধীরে ধীরে মনের দিগন্তে মিলাইয়া যাওয়া উচিত ছিল, তার বদলে দিন দিন যেন স্পষ্টতর ও অবাধ্য হইয়া উঠিতে লাগিল।

শীতের আমেজে দেহের সঙ্কোচন প্রক্রিয়া অনুভব করা যায়, কালীর হাতে সেলাই করা পাড়ের কথা গায়ে টানিয়া শেষ রাত্রে বড়ই আরাম বোধ হয়। আধ ঘুম আধ জাগরণের সেই। যুক্তিহীন নীতিহীন নিস্পাপ জগতের অবাস্তব অবলম্বনে একটি অপরূপ নিরাবরণ দেহ আলগোছে ভাসিতে থাকে। বেশি দূরে নয়, হাত বাড়ালেই বোধহয় স্পর্শ করা যায়, তবু অস্পষ্ট। কোন জীবনের উপযোগী এ দেহ, ভিতরের প্রকৃতির কোন পরিচয় আঁকা আছে এই দেহের বাহিরে, কিছুই টের পাওয়া যায় না। ঘুম ভাঙিবার পর ছায়া মিলাইয়া যায়, ওই রকম কয়েকটি দেহ পরীক্ষা করিবার ঔৎসুক্য শুধু জাগিয়া থাকে রাজকুমারের।

মোটা মোটা ডাক্তারি বই আর নোটবুকগুলির পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে এই কথাটা সে মনে মনে নাড়াচাড়া করে। পরীক্ষার জন্য দেহ ভাড়া করা যায়, কিন্তু সে সব নরনারীর দেহ পরীক্ষা করিয়া তার বিশেষ কোনো লাভ হইবে না। যাদের সে জানে, যাদের সুখ-দুঃখ-আশা-আকাঙ্ক্ষার সংবাদের সঙ্গে জীবনযাপনের রীতিনীতির পরিচয় সে রাখে, নিরাবরণ তাদের কয়েক জনকে সে যদি দেখিতে পাইত!

কিন্তু এদের কারো কাছে ইচ্ছাটা জানানো পর্যন্ত চলে না।

শোনামাত্র যুগ-যুগান্তরের সংস্কারে ঘা লাগিবে, তাকে মনে করিবে পাগল, অসভ্য, বর্বর। বুঝাইয়া বলিলে যে কেউ বুঝিবে সে ভরসাও রাজকুমারের নাই।

সে যে শুধু একটা সত্যের, একটা নিয়মের সন্ধান চায়, কেউ তা বিশ্বাস করিবে না। যতই ভীরু আর লাজুক মনে হহাক, উদ্ধত অত্যাচারী সৈনিক বা যন্ত্রীর জীবন ছাড়া শ্যামলের সুখী হওয়ার উপায় কেন নাই; কঞ্চির মতো যতই অবাধ্য ও স্বাধীন মনে হোক রিণিকে, শাসন-পিপাসু শক্তিমান পুরুষের উপর কলা-বৌয়ের মতো নির্ভর করিতে না পারিলে রিণির জীবনে সাৰ্থকতা কেন নাই; দেশে দেশে নগরে নগরে যাযাবর জীবন কেন স্যার কে. এল-এর প্রয়োজন ছিল; ইতিমধ্যেই চার-পাঁচটি সন্তানের মা হইতে না পারায় সরসী কেন সভা-সমিতি করিয়া বেড়ায়; এসব প্রশ্নের জবাব জানিবার প্রয়োজন কেউ বোধ করে না, কৌতূহলও কারো নাই। এগুলি প্রশ্ন বলিয়াই তারা স্বীকার করিতে চায় কিনা সন্দেহ। মানুষের দেহে এই সব রহস্যের নির্দেশ সন্ধান করা ওদের কাছে অর্থহীন উদ্ভট ব্যাপার, ডি ছি করার ব্যাপার।

কিন্তু যেটুকু সে জানিয়াছে কেবল সেইটুকু জানিয়া থামিয়া থাকার কথা ভাবিলেও এদিকে জীবনটাই যেন অসঙ্গত মনে হয়। কেঁকের এই অভিশাপ চিরকালের যখন যেদিকে গতি, সেদিক ছাড়া অন্য কোনোদিকে জগতের সাৰ্থক অস্তিত্ব আছে ভাবা যায় না।

 

একদিন আলোচনা ও পরামর্শের জন্য রাজকুমার বিকালবেলা হাজির হয় বন্ধু পরেশের কাছে।

পরেশ বলে, এ্যানাটমি শিখতে চাও? সেটা তো এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। আমি সব ব্যবস্থা করে দিতে পারি। ওর আর কি, পয়সা দিয়ে মড়া কিনবে, ছুরি দিয়ে কাটবে

মড়া! জীবনের সঙ্গে সে খুঁজিতেছে জীবন্ত মানুষের সংযোগ ও সামঞ্জস্যের রীতি, মড়া কাটিয়া তার হইবে কি?

উৎসাহের সঙ্গে রাজকুমার পরেশকে ব্যাপারটা বুঝাইয়া বলিতে আরম্ভ করে।

পরেশ ডাক্তার মানুষ, রাজকুমারের কথা শুনিতে শুনিতে সে হাসিতে আরম্ভ করিয়া দেয়।

হাত দেখার ব্যাপারটা জানি, শরীর দেখাটা নতুন ঠেকছে।

তুমি হাত দেখায় বিশ্বাস কর না?

না। ওসব বুজরুকি।

তুমি যা জান না তাই যদি বুজরুকি হয়–

আমি জানি না বলে নয়। একটা কিছু সম্ভবপর কিনা সাধারণ বুদ্ধিতেই মোটামুটি বোঝা যায়। ভবিষ্যৎ কখনো মানুষের হাতে লেখা থাকতে পারে! হাত দেখে কখনো বলা যেতে পারে একদিন মানুষের জীবনে কি ঘটবে না ঘটবে?

নগেনবাবু যে এক বছরের মধ্যে অন্ধ হয়ে যাবেন, তুমি কি করে জানলে?

সেটা ভিন্ন কথা। নগেনবাবুর চোখে অসুখ হয়েছে, চোখের এই অসুখে বছরখানেকের মধ্যে মানুষ অন্ধ হয়ে গেছে।

কয়েকটা চেনা লক্ষণ দেখে তুমি জানতে পেরেছ, নগেনবাবুর চোখে অসুখ হয়েছে, কেমন? আগে আরো অনেকের চোখে এই রকম অসুখ হয়েছে, অল্পদিনের মধ্যে তারা অন্ধ হয়ে গেছে, তুমি তাই বলতে পারছ নগেনবাবুও অন্ধ হয়ে যাবেন। মানুষের হাতেও তো চেনা লক্ষণ থাকতে পারে, যা দেখে এরকম ভবিষ্যদ্বাণী করা চলে? যেমন ধর পরেশের হাত টানিয়া আঙুলগুলির ঠিক নিচে হাতের তালুতে চারটি চিহ্ন দেখাইয়া দেয়, এগুলো দেখে আমি বুঝতে পারছি ডাক্তারিতে তোমার কোনোদিন পসার হবে না।

হাত দেখার বুজরুকির পরেশের হঠাৎ গভীর কৌতূহল দেখা যায়। আগ্রহের সঙ্গে সে জিজ্ঞাসা করে, কি করে জানলে?

আরো অনেকের হাতে এরকম চিহ্ন ছিল, দেখা গেছে তারা খুব ঢিলে অলস প্রকৃতির মানুষ। কোনো বিষয়ে চেষ্টাও থাকে না, পরিশ্রমও করতে পারে না। বছর পাঁচেকের মধ্যে তোমার উন্নতি হওয়া অসম্ভব।

পাঁচ বছর পরে সম্ভব?

তা বলা যায় না। তবে উন্নতি না হওয়ার লিমিট যে পাঁচ বছর সেটা জোর করে বলতে পারি। বাপের পয়সাতেই এ কটা বছর তোমায় চালাতে হবে। অবস্থার ফেরে যদি স্বভাব বদলায়, হাতের এই চিহ্নগুলিও বদলে যাবে, তখন হয়তো তোমার কিছু হতে পারে। বছর পাঁচেক সময় তাতে লাগবেই।

পরেশ মনে মনে চটিয়াছিল, ব্যঙ্গ করিয়া বলিল, তুমি এত বড় গণৎকার হয়ে উঠেছ তা তো জানতাম না। ডাক্তারি করার আগে তোমার সঙ্গে পরামর্শ না করে তো ভুল করেছি!

শুধু ডাক্তারি তো নয়, তা বলি নি আমি। ডাক্তারিতে পসার হবে না, এ কথা তোমার হাতে লেখা নেই। থাকলেও সে লেখা পড়বার ক্ষমতা আমার নেই। তোমার হাতে লক্ষণ আছে উন্নতি করবার অক্ষমতার। নিজে উপাৰ্জন করে বড়লোক হওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই, তাই বলে তোমার যে টাকা হবে না তাও বলা চলে না। অন্য কেউ তোমার টাকা খাঁটিয়ে তোমাকে আরো বড়লোক করে দিতে পারে, কোনো আত্মীয় মারা গিয়ে সম্পত্তি দিয়ে যেতে পারে, লটারির টিকিট কিনে টাকা পেতে পার। তোমার হাত দেখে যদি বলি টাকা তোমার হবে না, শান্তি স্বস্ত্যয়ন কর, সেটা হবে বুজরুকি। কিন্তু যদি বলি নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে টাকা তোমার হবে না, সেটা হবে বিজ্ঞান। হাত দেখারও খানিকটা বিজ্ঞান, বাকিটা বুজরুকি। আর এই বুজরুকির জন্যই খুঁটি জিনিসটুকুর ওপর লোকের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেছে। বেশি ফকির সুযোগ থাকলে বিজ্ঞান ভেস্তে যায়। ফুটপাতের তিলক আঁটা উড়ে গণৎকারের মতো ডাক্তার গজাতে পায় না বলে তোমাদের লোকে বিশ্বাস করে, নিমুনিয়া হলে তোমরা অনেকে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা কর, তবু।

তাই নাকি?

তাই। বিজ্ঞানের এত উন্নতি কেন সম্ভব হয়েছে জান? জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকের কথাও কেউ বিশ্বাস করতে পারে না, এই নিয়ম মেনে চলা হয়েছে বলে। সামান্য একটি আবিষ্কার পর্যন্ত তাকে প্রমাণ করতে হবে আগে শ খানেক আবিষ্কারের মানুষকে চমকে দিয়েছে বলেই যে তার এক শ এক নম্বর আবিষ্কারটি মেনে নেওয়া হবে, তা চলবে না। অনুমান করার অধিকার আছে কিন্তু সেটা অনুমান বলেই ঘোষণা করতে হবে। আমি বলছি বলে কোনো কথা বিজ্ঞানে নেই।

সত্যি, ভারি আশ্চর্য তো!

রাজকুমার মনে মনে হাসে। ঠিক এই প্রতিক্রিয়াই পরেশের কাছে প্রত্যাশা করা চলে। অকৰ্মণ্য অলস মানুষের স্থিতিশীল অকৰ্মণ্যতার এও একটা প্রমাণ। যা ভাবে না, যা জানে না, অন্যের কাছে তার ব্যাখ্যা শুনিতে এরা জ্বালা বোধ করে। মনে করে তারই যেন সমালোচনা করিতেছে, উপদেশ দিয়া প্ৰমাণ করিতেছে, তারই মূখতা।

আশ্চর্য বৈকি, গাম্ভীর্যের ভান বজায় রাখিয়াই রাজকুমার বলিয়া যায়, আমি যে দেহ দেখে মানুষকে জানার কথা বলছিলাম তাও কতকটা হাত দেখার মতো। মানুষকে দেখে অনেক সময় তার স্বভাব-চরিত্র টের পাওয়া যায় মান তো?

কে জানে, জানি না।

যেমন ধর সুরেশ। দেখলেই টের পাওয়া যায় ছেলেটা বিগড়ে গেছে। অনায়াসে বলা যায় ছেলেটা লেখাপড়াও শিখবে না, মানুষও হবে না। যেখানে ওকে তুমি রাখ, যে কাজেই লাগিয়ে দাও, ও কখনো ভালোভাবে চলতে পারবে না।

সুরেশ পরেশের ছোট ভাই কদিন আগে অতি কুৎসিত একটা অপরাধে ছমাসের জন্য জেলে গিয়াছে। সুরেশের পাংশু শীর্ণ মুখে সদা চঞ্চল কুটিল দুটি চোখ দেখিলে অপরিচিত মানুষও সত্যসত্যই টের পাইয়া যাইত তার ভিতরটা কি রকম বিকারে ভরা।

পরেশ মুখ অন্ধকার করিয়া উঠিয়া দাঁড়ায়।

একটা রোগী দেখতে যাব। বলিয়া সে চলিয়া যায় বাড়ির ভিতর।

তখন সন্ধ্যা পার হইয়া গিয়াছে। পথে চলিতে চলিতে রাজকুমারের মনে হয় পরেশকে না। চটাইলেই হইত। এরকম সস্তা অভিমান দেখিলেই কেন যে তার আঘাত দিতে ইচ্ছা হয়! ছেলেবেলা ফাপানো খেলনা বেলুন দেখিলেই যেমন ফুটা না করিয়া থাকিতে পারি না, এখন ফ্ৰকা মানুষের সংস্পর্শে আসিলেই ফাঁকিতে খোঁচা দেওয়ার সাধটা তেমনি সে দমন করিতে পারে না। মানুষের সঙ্গে এই জন্য তার বনে না। আবেগ আর অভিমানে সায় দেওয়ার তোষামোদ জানে না বলিয়া আত্মীয় বন্ধু অনেকের কাছেই সে পছন্দসই লোক নয়। দশজনের সঙ্গে খাপ খাইয়া চলার প্রধান মন্ত্রটিই সে বাতিল করিয়া রাখে।

ভাবিতে ভাবিতে গভীর একাকিত্বের অনুভূতি তাকে বিশ্ন করিয়া দেয়। মানুষের সঙ্গ লাভের এমন একটা জোরালো কামনা সে অনুভব করে যেন বহুদিন অরণ্যে বা প্রান্তরে বাস করিতেছে। ক্লাবের কথা মনে পড়ায় তাড়াতাড়ি সে সেখানে গিয়া হাজির হয়। টেনিস খেলার শখ জাগায় একদিন সে ক্লাবে যোগ দিয়াছিল, তারপর নিয়মিত চাঁদা দিয়া আসিতেছে কিন্তু ক্লাবে যাতায়াত করে কদাচিৎ। এই ব্যাপারটা আজ যেন তার খেয়াল হইল প্রথম। ক্লাবের সে মেম্বার, ক্লাবে সুযোগ আছে খেলাধুলা ও দশজনের সঙ্গে মেলামেশা করার, কিন্তু ক্লাবের জন্য কোনো আকর্ষণ সে অনুভব করে না। মানুষের সঙ্গ সে কি ভালবাসে না? মানুষটা সে কি কুনো? অথবা দশজনের সঙ্গে মানাইয়া চলিতে পারে না বলিয়া দশজনকে এড়াইয়া চলে?

স্যার কে. এল প্রায়ই ক্লাবে বিলিয়ার্ড খেলিতে আসেন। তিনজন অর্ধ-পরিচিতের সঙ্গে ব্রিজ খেলিতে বসিয়া রাত নটার সময় বিরক্তিতে রাজকুমারের চোখে যখন প্রায় জল আসিয়া পড়ার উপক্ৰম করিয়াছে, স্যার কে. এল-ই তাকে উদ্ধার করিলেন।

গাড়িতে উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হঠাৎ তুমি আজ এদিকে?

রাজকুমার বলিল, আড্ডা দিতে এসেছিলাম। কিন্তু আজ্ঞা আমার একেবারে সয় না।

আমারও সয় না। তবু আড্ডা দিই।

পথে স্যার কে. এল-এর এক বন্ধুর বাড়ি হইতে রিণিকে তুলিয়া নেওয়ার কথা ছিল। রিণি এখানে প্রায়ই রাত্রে টেনিস খেলিতে আসে। বিকালে সে খেলে না। খেলার পর যে শ্রান্তি বোধ হয় তাতে নাকি বিকালটা তার মাটি হইয়া যায়। রিণির দেখাদেখি আরো কয়েকটি ছেলেমেয়ে নাকি বিকালের বদলে রাত্রে টেনিস খেলার সুবিধা বুঝিতে পারিয়াছে।

তখনো খেলা চলিতেছে। সর্ট আর শার্ট পরা রিণিকে যে সে দেখিতে পাইবে রাজকুমার তা কল্পনাও করে নাই। জোরালো কৃত্রিম আলোয় রিণির দ্রুত সঞ্চরণশীল হালকা শরীরটি তার চোখে যেন নতুন একটা বিস্ময়ের মতো ঠেকিতে লাগিল। প্রতিপক্ষ দলের মেয়েটি শাড়ি পরিয়াই খেলিতে নামিয়াছে, মাঝে মাঝে রিণির দিকে চাহিয়া তার ঠোঁটে ফুটিয়া উঠিতেছে। মৃদু হাসি।

খেলা দেখার জন্য দাঁড়াইয়া রাজকুমার শেষ পর্যন্ত দেখিয়া গেল শুধু রিণিকে।

খেলার শেষে রিণি বলিল, আরেকটু শীত না পড়লে খেলে আরাম নেই। যত শীত পড়ে তত তাড়াতাড়ি ঘাম শুকিয়ে যায়।

রাজকুমার বলিল, খেললে ঘাম হয় না।

ফ্যাট হয় না। আর রাত্রে ভালো ঘুম হয়। বাড়ি গিয়ে স্নান করলেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসবে।

শরীর সম্বন্ধে রিণির যে এতখানি যত্ন আছে রাজকুমারের জানা ছিল না। স্যার কে. এল-এর জন্য আজ গাড়িতে রিণির পাশে বসিতে না পারায় তার কেমন যেন ক্ষতি বোধ হইতে থাকে। রিণির গলা পর্যন্ত এখন ঢাকা, মুখ ফিরাইয়া কথা বলিতে গিয়া সে আবরণ সে যেন দেখিতে পায়। না, টেনিস কোর্টের রিণিই যেন এত কাছে পিছনের সিটে বসিয়াছে মনে হয়। এই দেহাশ্রয়ী জীবটি আহলাদী মেয়ের মতো আদরের তাপে গলিতে চায়, শান্ত সুরক্ষিত সংস্কারময় অন্তঃপুরে স্বামী নামে প্রভুর তত্ত্বাবধানে বাস করিবার শুধু সে উপযোগী এই সিদ্ধান্ত কি সে করিয়াছে এই রিণির সম্বন্ধে?

রাজকুমারের যেন ধাঁধা লাগিয়া যায়।

রিণির সাহস আছে, একগুঁয়েমি আছে, তেজ আছে। এইগুলি সে অৰ্জন করিয়াছে তার আত্মবিরোধী জীবন যাপনের প্রক্রিয়ায়। রিণিকে সে যদি তার নূতন চিন্তাধারার সন্ধান দেয়? রিণির কাছে সে যদি তার অসঙ্গত দাবি জানায়?

স্যার কে. এল-এর একটা কথাও রাজকুমারের কানে যায় না, নিজে সে কি বলিতেছে আর রিণি কি জবাব দিতেছে তাও ভালো খেয়াল থাকে না।

কথা বন্ধ করিয়া হঠাৎ সে গম্ভীর হইয়া যায়।

শান্ত মনে কথাটা বিবেচনা করা দরকার। রিণিকে কিছু বলা না বলার উপর অনেক কিছু নির্ভর করিতেছে, কেঁকের মাথায় কিছু করিয়া বসিলে চলিবে না। রিণি রাগ করিতে পারে, চিরদিনের জন্য তার সঙ্গে সব সম্পর্ক তুলিয়া দিতে পারে, মনে মনে তাকে ঘৃণা করিতে পারে, দুঃখ পাইতে পারে, হাসিয়া উড়াইয়া দিতে পারে। অনেক রকম সম্ভাবনাই আছে। ভালো করিয়া ভাবিয়া দেখা দরকার।

কিন্তু অনুরোধটা জানাইলে রিণির কাছে কি রকম প্রতিক্রিয়া আশা করা উচিত সে বিষয়ে তাকে ভাবিতে হইতেছে কেন? ঠিক কি রকম প্রতিক্রিয়া হইবে এতদিন রিণিকে জানিয়া এটুকুও সে কি অনুমান করিতে পারে না?

রিণি বাড়ির মধ্যে চলিয়া যাইতেছিল, রাজকুমার তাড়াতাড়ি গিয়া বলিল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে রিণি। খুব দরকারি কথা।

রিণি আশ্চর্য হয় না। কোথাও কিছু নাই, হঠাৎ খাপছাড়া উত্তেজনার সঙ্গে খুব দরকারি একটা কথা বলিতে চাওয়া, রিণি তার মানে জানে। ঠিক এমনিভাবে ওরা চিরদিন কথাটা জানায়। বলার সুযোগ যখন থাকে তখন কিছু বলে না, আজকালের মধ্যে আবার সুযোগ আসিবে জানিয়াও অপেক্ষা করিতে পারে না, অসময়ে ব্যস্ত হইয়া ওঠে।

কি কথা?

ঘরে চল, বলছি।

দু-চার মিনিটে বলা হবে না বোধহয়?

না। একটু সময় লাগবে। অনেক কথা বুঝিয়ে বলতে হবে তোমাকে।

আমারও বুঝতে সময় লাগবে নিশ্চয়। মালতীর মতো বুদ্ধি তো নেই।

রিণির এই ঈর্ষার খোঁচাটা রাজকুমারকে তিরস্কারের মতো আঘাত করিল। মালতীর কথা তার মনেই ছিল না। নূতন চিন্তাটাই কিছুদিন হইতে তার মন জুড়িয়া আছে। মালতী নামে যে একটি মেয়ে আছে জগতে, গত বর্ষার এক সন্ধ্যায় ওই মেয়েটিকে যে জগতের অন্য সব মেয়ের চেয়ে সে কাছে আসিতে দিয়াছে, এসব সে যেন ভুলিয়াই গিয়াছিল।

মালতীকে সে আর পড়ায় না। এবার মালতীর পরীক্ষা, ভালোভাবে পাস করার আগ্রহ তার চিরদিন খুব প্রবল। রাজকুমারের কাছে পড়িলে তার আর পাস করার ভরসা নাই। রাজকুমার তাই নিজেই পড়ানো বন্ধ করিয়া দিয়াছে। মালতীও আপত্তি করে নাই। তার আসা-যাওয়া যে একেবারে কমিয়া গিয়াছে, বাদ পড়িয়াছে অতি প্রয়োজনীয় অনাবশ্যক কথা বলা, সেজন্যও মালতীর কাছ। হইতে কোনো নালিশ আসে নাই। হয়তো মালতী ভাবিয়াছে পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটানোর ভয়ে সে যায় না, পরীক্ষার আগে আবেগ ও উত্তেজনায় তাকে একটি দিনের জন্যও অশান্ত করিতে চায় না। ভাবিয়া মালতী হয়তো কৃতজ্ঞতাই বোধ করিতেছে।

তার ব্যবহারে মালতী দুঃখ পায় নাই–এই যুক্তি কিন্তু রাজকুমারের নিজের মানসিক শান্তি বজায় রাখতে কাজে লাগে না। শ্যামলের কথাটা তার মনে পড়িয়া যায়। শ্যামল বলিয়াছিল, মালতীকে ভালবাসিবার উপযুক্ত সে নয়। অসঙ্গত বলিয়া জানিলেও কথাটা এখন তাকে পীড়ন করিতে থাকে। রিণির কাছে যে প্রস্তাব করিতে সে চাহিতেছে, জানিতে পারিলে মালতী ব্যথা পাইবে। সে ব্যথার স্বাদ কতকটু, কত তীব্র তার জ্বালা, রাজকুমার অনুমান করিতে পারে। মালতী তার উদ্দেশ্য বুঝিবে না। রিণির রূপ যে সে দেখিতে চায় না, রিণিকে অনুরোধটা জানানোর আগে তার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হওয়া আর গলা শুকাইয়া যাওয়ার কারণ যে মনের কোনো দুর্বলতা নয়, মালতী তা ধারণাও করিতে পারিবে না, বিশ্বাসও করিবে না! মালতীর কাছে সে উদারতা প্রত্যাশাও করা চলে না। আহত-বিস্ময়ে কত কি যে মালতী ভাবিবে! ক্ষোভ, দুঃখ, ঈর্ষা ও ক্রোধে আরো কত আঘাত যে নিজের জন্য নিজেই সে চয়ন করিবে।

তবে, হয়তো মালতী জানিবে না। না জানার সম্ভাবনাই বেশি। রিণি যদি রাগ করে, চিরদিনের জন্য যদি তার সঙ্গে সম্পর্ক চুকাইয়া দেয়, কারো কাছে সে কোনোদিন বলতে পারিবে না, ছদ্মবেশী এক বুনো জানোয়ারের কোন দাবি একদিন তাকে প্রত্যাখ্যান করিতে হইয়াছিল।

মালতী জানিবে না। তবু রাজকুমার অস্বস্তি বোধ করিতে থাকে। স্তরে স্তরে সঞ্চিত সংস্কারের অবাধ্য প্রতিবাদ একটানা চাপের মতো মনে অশান্তি জাগাইয়া রাখে। মালতীর না জানা তো বড় কথা নয়! মালতীর জানার ফলাফলটা সে যতখানি কল্পনা করিতে পারে তারই গুরুত্ব যেন সকলের আগে বিবেচ্য। জানুক বা না জানুক, আঘাত পাক বা না পাক, যে কাজ করিলে একটি মেয়ের সুখ-শান্তি ধ্বংস হইয়া যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সে কাজ করা তার উচিত নয়। মনে তার পাপ নাই?—না থাক। পুণ্যের জন্যও অনেক কাজ সংসারে করা যায় না।

রিণির সঙ্গে গুরুতর বোঝাপড়ার লড়াই শুরু করিবার ঠিক আগে এসব চিন্তা রাজকুমারকে একটু কাবু করিয়াছিল বৈকি। কালও যা করা চলিবে আজ তা না করিয়া পালানোর কথাটাও একবার তবু মনে আসিল। ভাবিয়া চিন্তিয়া দেখিবার জন্য আরেকটু সময় নিলে কি আসিয়া যায়? হঠাৎ যেন একটু ভয় করিতে লাগিল রাজকুমারের। ভাবনা তার ছিল অনেক, এতক্ষণ ভয়। এতটুকু ছিল না।

সময় যদি লাগে, তাহলে তুমি বোসো। নেয়ে এসে তোমার দরকারি কথা শুনব।

না, আগেই শুনে যাও।

বেশিক্ষণ লাগবে না নাইতে। মিনিট কুড়ি। কথাটা ততক্ষণ মনে মনে গুছিয়ে নাও বরং, বলতে সুবিধে হবে।

রিণি একটু হাসিল। এমন মধুর হাসি রাজকুমার কোনোদিন তার মুখে দ্যাখে নাই। রিণি যেন। হঠাৎ আজ কেমন হইয়া গিয়াছে।

তবে আজ থাক, রিণি।

থাকবে কেন? তোমার আজ কি হয়েছে বল তো? খেলে এসে না নাওয়া পর্যন্ত আমার কি বিশ্রী লাগে তুমি বুঝবে না। বলতে চাও বলো, শুনতে কিন্তু আমার ভালো লাগবে না বলে রাখছি।

কথাটা শোন আগে, বুঝতে পারবে নাইতে যাওয়ার আগে কেন বলতে চাই। আমি বাথরুমে থাকব, রিণি।

বাথরুমে থাকবে?

তোমার নাওয়া দেখব। তুমি নাইবে, আমি এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকব চুপ করে।

রিণি কথা বলতে পারে না। জোরে তার দাতে সঁত আটকাইয়া গিয়াছে, মুখ দেখিলেই বোঝা যায়। রাজকুমার সোজা তার চোখের দিকে তাকায় দ্বিধা সঙ্কোচ ভয় সব তার এতক্ষণে কাটিয়া গিয়াছে।

কথাটা তোমার খুব অন্যায় মনে হচ্ছে? এখানে বোলোঁ, আমি তোমায় সব বুঝিয়ে বলছি।

বুঝিয়ে বলতে হবে না। আমি বুঝেছি। কোথায় গিয়েছিলে বাবার সঙ্গে? কটা পেগ গিলেছ?

পেগ? ওসব আমার নেই তুমি জান না?

এতদিন তাই তো জানতাম।

আজ আমার কথা শুনে ধারণাটা বদলে গেছে, না? আমার সব কথা কিন্তু শোন নি রিণি।

হাত ধরিয়া রিণিকে একরকম সে জোর করিয়া একটা সোফায় বসাইয়া দিল। বড় রাগ হইতেছিল রাজকুমারের। এত কথা ভাবিবার থাকিতে রিণি কিনা ভাবিয়া বসিল মদ গিলিয়া সে তার সঙ্গে ফাজলামি করিতে আসিয়াছে!

আগ্রহের সঙ্গে সে রিণিকে সব বুঝাইয়া দিতে থাকে। বিশেষ করিয়া জোর দেয় তার নিস্পাপ। নির্বিকার মনোভাবের উপর, তার উদ্দেশ্যের আসল মানের উপর। কি আবেগের সঙ্গেই সে যে বার বার ঘোষণা করে, বাথরুমে রিণিকে দেখিতে যাওয়ার মতো অভদ্র ছোটলোক সে নয়, ওরকম ইচ্ছা জাগার মতো হীন নয় তার মন।

ব্যাখ্যা করিতে রাজকুমার চিরদিনই ওস্তাদ। বুঝিতে রিণির আর কিছুই বাকি থাকে না। মুখের ভাবে তার পরিবর্তন কিন্তু হয় আশ্চর্য রকম, রাজকুমারের সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। মনে হয়, রাজকুমারের প্রস্তাব শুনিয়া তার যেন শুধু চমক লাগিয়াছিল, রাজকুমার মদ খাইয়া আসিয়াছে ভাবিয়া তার যেন দুঃখ হইয়াছিল। এতক্ষণে তার রাগ হইয়াছে, ব্যাখ্যা শুনিবার পর, সব বুঝিবার পর।

বুঝতে পেরেছ রিণি?

পেরেছি বৈকি।

গলার আওয়াজেই রাজকুমার সচেতন হইয়া উঠিল। তীক্ষ্ণ সুরকে চাপিয়া এভাবে দাঁতে কাটিয়া রিণিকে সে আর একদিন কথা বলিতে শুনিয়াছিল। গানের আবেশে বিহ্বলা রিণির বাড়ানো মুখের আমন্ত্রণ যেদিন সে গ্রহণ করে নাই। সেদিনও রিণির নাক এমন ফুলিয়া উঠিয়াছিল। মুখ দেখিয়া মনে হইয়াছিল রাগের মাথায় হঠাৎ বুঝি কামড়াইয়া দিবে দুরন্ত ছোট মেয়েরা যেমন দেয়।

ম্লান মুখে রাজকুমার একটু হাসিল।

জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, তুমি রাজি নও বুঝতে পারছি।

বুঝবে বৈকি। তুমি তো বোকা নও।

কিছু মনে কোরো না রিণি।

না। মনে আবার কি করব।

আমি তবে যাই।

যাও। আর এস না।

আচ্ছা।

রাজকুমার উঠিয়া দাঁড়াইল।

কথাটা তুমি আর একটু উদারভাবে নেবে ভেবেছিলাম, রিণি।

রিণিও উঠিয়া দাঁড়াইল।

তোমায় বোকা ভাবতে পারলে তাই নিতাম। তুমি তো বোকা নও।

রাজকুমার চলিয়া যায়, রিণি পিছন হইতে তাকে ডাকিল।

একটা উপদেশ নিয়ে যাও। আরেকটি মেয়েকে যখন কথাটা বলবে, মালতীকেই বলবে বোধহয়, কিছু বুঝিয়ে বলতে যেও না। শুধু বোলো যে তোমার এ সাধটা না মেটালে তুমি পাগল হয়ে যাবে, সায়ানাইড খাবে। হয়তো রাজি হতে পারে।

রিণি কিছুই অস্পষ্ট রাখে নাই। কয়েকটি কথাতেই সব পরিষ্কার বুঝাইয়া দিয়াছে। যতই অসঙ্গত হোক, শুধু তার ইচ্ছার কথা হইলে নিজের নিরাবরণ দেহটি তাকে দেখাইতে রিণি রাজি হইলেও হইতে পারিত। সত্য সত্যই রাজি সে হয়তো হইত না, কিন্তু একটু দোমনা তো অন্তত হইত। একবারের জন্যও মনে তো হইত কি আসিয়া যায় মানুষটার ব্যাকুল প্রার্থনা মিটাইলে? বিমুখ করিয়া একটু আফসোসও হয়তো জাগিত। নিজের জন্য আবেদন জানানো ছাড়া রিণির মন একটু নরম করারও আর কোনো উপায় নাই। কেবল রিণির নয়, সব মেয়ের সম্বন্ধেই এই এক কথা। রিণি তাই বলিয়াছে।

রাজকুমার কি কথাটা জানে না? যুক্তির দাম মেয়েদের কাছে নাই, একটুখানি আবেগের বন্যায় বিশ্বের সমস্ত যুক্তি তর্ক উচিত অনুচিত ভালো মন্দ ভাসিয়া যাইতে পারে, এটুকু জ্ঞান কি সে সঞ্চয় করিতে পারে নাই এত দিনে? রাজকুমার লজ্জা বোধ করে। রিণি তাকে বোকা মনে করিতে অস্বীকার করিয়াছে, বোকামি কিন্তু সে করিয়াছে সত্যই। সায়ানাইড খাওয়ার কথা বলিলে রিণি গর্ব বোধ করিবে আর নিছক একটা থিয়োরি যাচাই করিতে তার সাহায্য চাহিলে সে বোধ করিবে অপমান, এটুকু তার খেয়াল রাখা উচিত ছিল।

তাছাড়া, রিণি প্রত্যাশা করিয়াছিল অন্য কথা। রাজকুমার বিশ্বাস করে না রিণি তাকে ভালবাসে। তাতে কিছু আসিয়া যায় না। ভালো না বাসিলেও ভালবাসার ঘোষণা শুনিতে কে না। ভালবাসে? এদিকটাও তার খেয়াল করা উচিত ছিল।

নিজের চারকোনা ঘরে চারকোনা খাটে রাজকুমার চিৎ হইয়া পড়িয়া থাকে আর উত্তেজিত চিন্তায় ছোটাছুটি করে তার মন। সিলিঙের হাত তিনেক নিচে একটা মাড়সা শূন্যে ঝুলিয়া আছে, সূক্ষ্ম অবলম্বনটি চোখে পড়ে না। কিছুক্ষণ নিশ্চেষ্ট থাকিয়া উপরে উঠিতে আরম্ভ করিয়া মাকড়সাটি আরো হাতখানেক নিচে পড়িয়া যায়। রাজকুমারের ঠোঁটে হাসি ফুটিয়া ওঠে। না, দ্বিতীয় বার চেষ্টা করার চেয়ে তার ব্যর্থতাই ভালো।

জীবনে আর কোনো মেয়ের কাছে এ দাবি সে করিবে না।

এক কাপ চা আনিয়া কালী বলে, এখন চা খেলে ভাত খাবেন কখন? খিদে নষ্ট হয়ে যাবে।

খিদে থাকলে তো নষ্ট হবে।

খিদে নেই কেন?

ধর খেয়ে এসেছি?

ধর খেয়ে এসেছি মানে? খেয়ে এলে খেয়ে এসেছেন, নয়তো খেয়ে আসেন নি। কোথায় খেলেন? কি খেলেন?

রাজকুমার মুখ গম্ভীর করিয়া বলে, একটা মেয়ে খাইয়ে দিয়েছে কালী। এত খাইয়েছে কি বলব। পেট ভরে বুক ভরে মাথা পর্যন্ত ভরে গেছে।

মাথা ধরেছে?-শঙ্কিতভাবে কালী প্রশ্ন করে।

ধরে নি, ভরেছে।

রাজকুমারের হাসির জবাবে কালী কিন্তু হাসে না। মুখ ভার করিয়া বলে, আপনার শুধু মেয়ে বন্ধু, গণ্ডা গণ্ডা মেয়ে বন্ধু। বেটাছেলের মেয়ে বন্ধু থাকতে নেই।

তাহলে তো তোমার সঙ্গে আড়ি করতে হয়।

আমি তো বন্ধু নই। আমি অনেক ছোট।

ওরাও বন্ধু নয় কালী। ওরা আমার চেয়ে অনেক ছোট–ছেলেমানুষ।

ছেলেমানুষ! কালী অদ্ভুত অবজ্ঞার হাসি হাসে, ধেড়ে ছেড়ে সব মেয়ে, বিয়ে হলে এ্যাদ্দিন–

সাত ছেলের মা হত, না?

কালী সায় দিয়া বলে, বিয়ে হয় নি কেন ওদের? পাত্র জোটে নি?

নাঃ, কই আর জুটল? আমি একবার বলেছিলাম ওদের, এস তোমাদের সবাইকে আমি বিয়ে করছি। ওরা রাজি হয়ে গেল। কিন্তু ধেড়ে ধেড়ে মেয়ে তো সব, ভারি চালাক। প্রত্যেকে বলতে লাগল, আমায় আগে বিয়ে কর, তারপর আর সবাইকে বিয়ে করবে। তার মানে বুঝতে পারছ?

খুব পারছি। একবার বিয়েটা হয়ে গেলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে দেবে না, একা বৌ হয়ে থাকবে। আমি তো মেয়ে, মেয়েদের ব্যাপার আমি সব জানি।

রাজকুমারও ক্ৰমে ক্ৰমে সেটা জানিতে পারিয়া আশ্চর্য হইয়া যাইতেছিল। আজকাল কালীর মুখ ফুটিয়াছে। রাজকুমারের সঙ্গে হালকা অথবা ভারি চালে সে অনর্গল আলাপ করিয়া যায়। অভিজ্ঞতার অভাব আছে কিন্তু সাংসারিক বিষয়ে জ্ঞানের তার অভাব আছে বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু তবু তার যে সরলতা মুগ্ধ করে, সেটা ভান নয়, মুগ্ধ করার ক্ষমতাই তার সব চেয়ে বড় প্রমাণ। রিণি মালতী সরসীর চেয়ে কালী বোকা নয়! কালীও সব বিষয়ে ওদের মতো। ওদের সঙ্গে কালীর তফাত দুপুরের রোদের সঙ্গে সকালের রোদের তফাতের মতো।

সহজভাবে নিশ্চিন্ত মনে কালীর সঙ্গে কথা বলা যায়। এভাবে কারো সঙ্গে কথা বলিবার। সুখটা রাজকুমারের এতদিন জানা ছিল না। কথা বলার আগে কিছু ভাবিতে হয় না, ভাবিবার সময় কথা বলিয়া যাইতে হয় না। যতক্ষণ খুশি কথা বল, এক মিনিট অথবা এক ঘণ্টা। কথা বলতে চাও বল, কথা শুনতে চাও শোন, নয়তো খুশিমতো চুপ করিয়া থাক, বধির হইয়া যাও। সবই স্বাভাবিক, কেউ রাগ করিবে না। বলার কথাও খুঁজিতে হয় না। রিণি-মালতী-সরসীর সঙ্গে কথা বলার সময় কতবার বলার কথা না থাকায় অস্বস্তি বোধ করিতে হইয়াছে, টানিয়া আনিতে হইয়াছে সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতি অথবা চেনা মানুষের সমালোচনা। ছেলেমানুষি আবোল তাবোল কথা শুধু কালীর সঙ্গে বলা যায়।

মনোরমা হেঁসেল আগলাইয়া বসিয়া থাকে, ঘরে দুজনের গল্প চলে। দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া পায়ে ব্যথা ধরিয়া গেলে কালী কোণের টুলটা কাছে আনিয়া বসে। কালীর প্রসাধনের গন্ধটি তেজী ও স্পষ্ট। রিণি-মালতী-সরসীর মতো কেবল সুবাসের মৃদু ইঙ্গিত নয়।

হঠাৎ এক সময় মনোরমার এদিকে ভয় হয়। এত দেরি? রাজকুমারের সম্বন্ধে ভাবনার কিছু নাই বটে, তবু এত দেরি? বিবাহের আগে শুধু একদিন একজনের সঙ্গে মনোরমা আধ ঘণ্টা নির্জনে গল্প করিয়াছিল। কেউ বাধা দিয়া গল্পের সমাপ্তি ঘটায় নাই, বাধা সে দিয়াছিল নিজেই, নিজেকে বাঁচানোর জন্য। ভাবিছিল, তাই উচিত। দুদিন পরে যার সঙ্গে বিবাহ হইবে, এখন তার কাছে ধরা না দেওয়াটাই নিয়ম। আজ অসময়। কিন্তু আর তো আসিল না সে মানুষটি। মনোরমা জানে, সেদিন ধরা দিলে সে আসিত। দুদিনের জন্য নয় চিরদিনের জন্য। সে তো বুঝিতে পারে নাই। মনোরমার মনের কথা, হাত ধরামাত্র তার রক্তেও কি আগুন লাগিয়াছিল–আজো তার তাপে মনোরমার মন জ্বলিয়া যায়। সে ভাবিয়াছিল, মনোরমা বুঝি ঠাণ্ডা, মন তার বরফের দেশ। কল্পনার শীতল মনোরমা তার ভালবাসাকে জুড়াইয়া দিয়াছিল। তাছাড়া আর কি কারণ থাকতে পারে তার না আসার, মনোরমাকে বিবাহ না করার?

সাড়ে নটার সময় কালী চা দিতে গিয়াছে, সাড়ে দশটা বাজিয়া গেল। মনোরমার বুক ঢিপঢ়িপ করে। এত দেরি। খাইতে আসার তাগিদ দিতে রাজকুমারকে ডাকিতে গিয়া কালীকে বাঁচানোর জন্য মনটা ছটফট করে মনোরমার। কিন্তু সে উঠিতে পারে না। শুধু আজের জন্য বচাইতে গিয়া সে যদি কালীর চিরদিনের মরার ব্যবস্থা করিয়া বসে?

তারপর কালীর তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ কানে আসে। মনোরমা জোরে নিশ্বাস ফেলে। সর্বাঙ্গে তার কয়েকবার শিহরণ বহিয়া যায়। পিঁড়িটা ঠেলিয়া দেয়ালের কাছে গিয়া ঠেস্ দিয়া বসিয়া সে চোখ বোজে! হাসি! আর ভয় নাই। যেখানে হাসি আছে সেখানে কোনো ভয় নাই।

রাজকুমার একদিন সন্ধ্যার পর মালতীর খোঁজ করিতে গেল। এতটুকু পথ যাইতেই চোখে পড়িল আলো আর দেবদারু পাতায় সাজানো তিনটি বাড়ি। ছাতে সামিয়ানা, সানাই বাজিতেছে। অগ্রহায়ণ মাস, চারিদিকে বিয়ের ছড়াছড়ি। রাজকুমারের মনে পড়ে, একটি বন্ধুর বিবাহে তার নিমন্ত্রণ ছিল। দুটি বছর খুঁজিয়া বাছিয়া একটি মেয়ে পাওয়া গিয়াছে পছন্দমতো। এ পছন্দের মানে রাজকুমার জানে। মেয়েটি সুন্দরী নয়, রং খুব ফর্সা। তার আরেকটি বন্ধু এরকম বাছাই করা এক মেয়েকে বিবাহ করিয়াছে। অমন রূপ নাকি খুব কম দেখা যায়। বৌ দেখিয়া তাকে নিজের বৌ হিসাবে কল্পনা করিতে গিয়া রাজকুমার শিহরিয়া উঠিয়াছিল, এমন কুৎসিত ছিল সেই অত্যন্ত ফর্সা রঙের মেয়েটি।

মালতীর বাড়ি গিয়া দেখা গেল, সরসী আর রুক্মিণী আসিয়াছে। দুজনেই বিশেষভাবে সাজিয়াছে, মালতীও দামি কাপড় পরিয়া নামিয়া আসিল। তিনজনে বিবাহের নিমন্ত্রণ রাখিতে যাইবে শ্যামলের সঙ্গে।

নিমন্ত্রণে যাওয়ার আগ্রহ তিনজনেরই প্রবল, শ্যামলের দেরির জন্য কারো কিন্তু বিরক্তি দেখা গেল না।

বোন আর বৌদিকে নিয়ে আসবে।–মালতী বলিল।

দেরি করার অপরাধ তাই শ্যামলের নয়। দুটি মেয়েকে সঙ্গে আনিতে হওয়ায় দেরি যে তার হইবে, এটা সকলে ধরিয়াই রাখিয়াছে।

রাজকুমার বলিল, আমি তবে বিদায় হলাম।

সরসী বলিল, তুমিও চল না আমাদের সঙ্গে?

অনাহূত?

অনাহূত মানে? ধীরেনবাবু তোমায় বলেন নি?

তোমরা ধীরেনের বিয়েতে যাচ্ছ নাকি? এ তো ভারি আশ্চর্য যোগাযোগ হল!

আশ্চর্য যোগাযোগ আবার হল কোখানটায়? তুমি ধীরেনবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে, আমি চেষ্টা করে একটা চেনা মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি। আমরা যাচ্ছি কন্যা পক্ষে, তুমি যাবে বরযাত্রী হয়ে। এ তো সোজা কথা।

আগে জানিলে কথাটা সোজাই মনে হইত। একটা বিবাহ ঘটানোর গর্বে এখন বিশ্বের, সমস্ত ঘটনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরসীর আয়ত্তে আসিয়াছে, আশ্চর্য কিছু ঘটিবার উপায় নাই। রাজকুমার যে ঠিক আজ সন্ধ্যাতেই অনেকদিন পরে মালতীর ঘেঁজ করিতে আসিয়াছে, তাও সরসীরই বাহাদুরি। ধীরেনের দু বছর খোঁজার পর পছন্দমতো মেয়ে পাওয়ার ব্যাপারটা রাজকুমার এবার বুঝিতে পারে। সরসীই তার মনে পড়াইয়া দেয় তার বাড়িতে মেয়েটিকে রাজকুমার একদিন দেখিয়াছিল। না, দু বছর খুঁজিয়া পছন্দ করার মতো মেয়ে সে নয়। তবে মাঝখানে সরসী ছিল। সেই পছন্দ করাইয়া দিয়াছে সন্দেহ নাই। সরসী সব পারে।

সকলকে আড়াল করিয়া সরসী একাই তার সঙ্গে কথা বলে। চিরদিন তার এই রীতি। দেখা হওয়ামাত্র রাজকুমারকে সে দখল করে। মনে হয়, রাজকুমারের জন্যই সে যেন ওত পাতিয়া ছিল। তার সভা-সমিতি করিয়া বেড়ানোর মানে আর কিছুই নয়, রাজকুমারের অদর্শনের কটা দিন বাজে কাজে কোনো রকমে সে সময় কাটায়।

মালতী বলে, তোমায় কেমন আনমনা ঠেকছে আজ?

সরসী সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারের হইয়া জবাব দেয়, কবিত্ব করিস নে মালতী, থাম। একটা মানুষ ভালো করে চুল না আঁচড়ালেই তোর কাছে আনমনা ঠেকে। চিরুনিটা দেখি তোর।

সরসী নিজেই মালতীর চিরুনি দিয়া রাজকুমারের চুল ঠিক করিয়া দেয়। তার পিছনে দাঁড়াইয়া মালতী একটু হাসে।

রুক্মিণী বলে, চুল আঁচড়ালে কি হবে, রাজকুমারবাবুর চেহারাটাই কবির মতো।

সরসী মুখে এ কথার প্রতিবাদ করে না, শুধু ভৎসনার দৃষ্টিতে রুক্মিণীর মুখের দিকে তাকায়। রুক্মিণী একেবারে বিব্রত হইয়া পড়ে। কারো চোহারা কবির মতো, এ কথা বলা কি অসঙ্গত? প্রশংসার বদলে তাতে কি নিন্দা বুঝায়? কে জানে! অথচ সদ্য পরিচিত একজনকে ঠিক এই কথা বলায় পরদিন সকালে সে বাড়ি আসিয়া রুক্মিণীর সঙ্গে আলাপ করিয়া গিয়াছিল।

তাড়াতাড়ি সে আবার বলিতে যায়, কবির মতো চেহারা মানে—

সরসী বলে, মানে, ওকে তোমার খুব পছন্দ হয়ে গেছে!

এবার রুক্মিণী নিৰ্ভয়ে সহজভাবে জবাব দেয়, তা হয়েছে। তবে এক পক্ষের পছন্দে আর লাভ কি!

রাজকুমার মনে মনে তার নিজস্ব অপদেবতার কাছে কাতর প্রার্থনা জানায়। কিন্তু উপায় তো নাই, কথার পিঠে কথা চাপাইতেই হইবে। কোনো রকমে একটু হাসিয়া সে বলে, এ অনুমানটা আপনার ভুল।

ভুল নয় রাজকুমারবাবু, প্রমাণ আছে। পছন্দ দূরে থাক, আমায় আপনি অপছন্দ করেন।

আগে আপনার প্রমাণ দাখিল করুন, আসামি জবাবদিহি করবে।

রুক্মিণী মৃদু মৃদু হাসে। এ ধরনের আলাপের সময় সকলেই হাসে, তবে ঠিক এ ভাবে নয়! কেমন যেন বাকা বাঁকা রুক্মিণীর হাসি। বোঝা যায়, সরসী অতি কষ্টে ধৈর্য ধরিয়া আছে।

রুক্মিণী বলে, যেমন ধরুন, যাকে পছন্দ করে তার বাড়ি লোকে না ডাকতেই যায়। যাকে পছন্দ করে না যাওয়ার কথা থাকলে তার বাড়িতেও ভদ্রতার খাতিরে যায়। যাকে অপছন্দ করে তার বাড়িতে যাওয়ার সব ঠিক থাকলেও যায় না।

তাই বটে। রুক্মিণী একদিন তাকে বাড়িতে যাওয়ার নিমন্ত্ৰণ করিয়াছিল, সেও যাইবে বলিয়াছিল। কবে কটার সময় যাইবে তাও ঠিক ছিল। তারপর রুক্মিণীর অস্তিত্বই সে ভুলিয়া গিয়াছিল। না যাওয়ার অজুহাত দিয়া ক্ষমা চাহিয়া একখানা চিঠি পর্যন্ত লেখে নাই। রুক্মিণী আহত হইয়াছে, রাগ করিয়াছে। রাগ করার কথাই।

রাজকুমারের বিপদের টের পাইয়া সরসী মুখ খোলে।

কেন রাজকুমারের চিঠি পাও নি তুমি?

রুক্মিণী বলে, চিঠি? কিসের চিঠি?

রাজকুমার ভাবে, চিঠি? কিসের চিঠি?

সরসী বলে, আমার সামনে ও যে তোমায় চিঠি লিখল? হঠাৎ শিলং যেতে হল ওকে, নিজেই বলতে যাচ্ছিল তোমাকে, আমি বললাম চিঠি লিখে দিলে চলবে। চিঠি পোস্ট করেছিলে তো রাজকুমার?

রাজকুমার বলে, নিশ্চয়।

সরসী বলে, চিঠির কোনো গোলমাল হয়েছিল বোধহয়। পোস্টাপিসের ব্যাপার তো।

পোস্টাপিসের ঘাড়ে সব দোষ চাপাইয়া সরসী ব্যাপারটা শেষ করিয়া দেয়। রুক্মিণী নরম হইলেও এত সহজে রাজকুমারকে রেহাই দিতে পারে না।

শিলং থেকে ফিরে একদিন আসতে পারতেন তো?

এবার আত্মরক্ষার দায়িত্ব রাজকুমারের, সে দুঃখের ভান করিয়া বলে, এমন ব্যস্ত ছিলাম, কি। বলব আপনাকে। তা ছাড়া হঠাৎ গিয়ে আপনাকে বিরক্ত করতেও ভরসা পাইনে।

আচ্ছা, এবার হঠাৎ গিয়ে আমায় বিরক্ত করার নেমন্তন্ন করে রাখলাম। ভুলবেন না যেন। বলিয়া রুক্মিণী এতক্ষণ পরে ক্ষমার সহজ হাসি হাসিল। অর্থহীন দীর্ঘ ভূমিকার পর।

রাজকুমার ভাবিতে লাগিল, সভ্যতার নামে এরা কি অসভ্যতাই শিখিয়াছে। প্রথমে দেখা হওয়ামাত্র এই হাসি হাসিলে কত সহজ হইয়া যাইত মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় করার ইচ্ছা জাগানো।

খানিক পরেই শ্যামল আসিল। ব্যস্তসমস্ত উদ্বিগ্ন শ্যামল। এক ঘণ্টার বেশি দেরি করিয়া ফেলার অপরাধে সে যেন নিজের মরণ কামনা করিতেছে। সঙ্গে তার বোন সুধা ও বৌদিদি ইন্দিরা। দুজনের সাজসজ্জা একেবারে চমকপ্রদ। শ্যামলের যে মোটে ঘন্টাখানেক দেরি হইয়াছে তাই আশ্চর্য।

রাজকুমারকে দেখিয়া শ্যামলের মুখ অন্ধকার হইয়া গেল। রাজকুমার মালতীকে পড়ানো ছাড়িয়া দিয়াছে জানিয়া সে স্বস্তি পাইয়াছিল।

রাজকুমার মাঝে মাঝে আসে তা সে জানিত কিন্তু সেদিন বর্ষা-সন্ধ্যার ব্যাপারটির পর রাজকুমারকে সে এ বাড়িতে দ্যাখে নাই।

রাজকুমার বলিল, কেমন আছ শ্যামল?

শ্যামল জবাব দিল না।

প্রশ্নের জবাব না দিবার সাধারণ কারণ থাকা সম্ভব মানুষের। হয়তো শ্যামল শুনিতে পায় নাই। মেয়েদের বিয়েবাড়িতে পৌঁছিয়া দিবার হাঙ্গামায় যে রকম ব্যতিব্যস্তই সে হইয়া পড়িয়াছে! কিন্তু সেদিন মিটিঙের কথাটা সকলের মনে ছিল। সকলেরই তাই মনে হইল, সেদিনের অপমানের জন্যই বুঝি শ্যামল রাগ করিয়া রাজকুমারের সঙ্গে কথা বন্ধ করিয়া দিয়াছে। মালতীই যেন বিব্রত হইয়া পড়িল সকলের চেয়ে বেশি। শ্যামলকে সে একপাশে ডাকিয়া নিয়া গেল।

রাজুদার সঙ্গে কথা বল না?

না।

কেন?

ইচ্ছে হয় না।

ছি ছি, কবে সেই মিটিঙে কি হয়েছিল, আজো তা মনে করে রেখেছ? দোষ তো ছিল তোমার। তুমি কেন গায়ে পড়ে–

সেজন্য নয়। ও একটা রাস্কেল মালতী।

উত্তেজিত অবস্থায় না থাকিলে কথাটা শ্যামল বলিয়া ফেলিত না। অত বোকা সে নয়। মালতীর মুখের সঙ্গে নিজের মুখখানাও তার বিবর্ণ হইয়া গেল।

তোমার বড্ড মাথা গরম। কাকে কি বল ঠিক নেই। রাজুদা তোমাকে দশ বছর পড়াতে পারে, তা জান?

পেটে বিদ্যে থাকলেই লোকের মনুষ্যত্ব থাকে না।

রাজুদার মনুষ্যত্ব নেই, মনুষ্যত্ব আছে তোমার! লোকের মুখের দিকে চেয়ে একটা কথা বলতে পার না তুমি! ওর তুলনায় তুমি তো কেঁচো।

মালতী ছিটকাইয়া রাজকুমারের কাছে সরিয়া গেল।

চল! চল, আমরা যাই।

শ্যামল কোথা হইতে কার একটি গাড়ি সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছে। একটা গাড়িতে এতগুলি মানুষের যাওয়া সম্ভব ছিল না। অন্তত দুজনের ট্রামে বা বাসে যাইতেই হইত। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো কথা ওঠার আগেই মালতী চুপিচুপি রাজকুমারকে বলিল, শ্যামলের গাড়িতে আমি যাব না। চল, আমরা ট্রামে যাই।

গাড়িতে যে জায়গা কম পড়িবে, এতক্ষণে সকলের সেটা খেয়াল হইয়াছিল। সরসী বলিল, গাড়িতে তো কুলোবে না সকলের। আমি বরং রাজকুমারের সঙ্গে

মালতী তখন পথ ধরিয়া কয়েক পা আগাইয়া গিয়াছে। মুখ ফিরাইয়া সে বলিল, তোমরা গাড়িতে যাও। আমরা দুজন ট্রামে যাচ্ছি। এস।

সরসীর চোখের সামনে রাজকুমারকে সঙ্গে করিয়া মালতী বড় রাস্তার দিকে চলিয়া গেল।

একটা ট্রাম সমুখ দিয়া চলিয়া গেল। মালতী বলিল, না। পরের ট্রামে।–এখনো থাকিয়া থাকিয়া মালতী কাঁপিয়া উঠিতেছিল।

কি হয়েছে মালতী?

শ্যামলের সঙ্গে কোনোদিন আমি যদি কথা বলি—

এতক্ষণে গলা ধরিয়া মালতীর চোখে জল আসিয়া পড়িল।

কি করেছে শ্যামল?

আমায় অপমান করেছে!

অপমান করেছে? কি অপমান?

তোমায় রাস্কেল বলেছে।

আমায় রাস্কেল বলেছে তাতে তোমার অপমান হল কেন?

চুপ কর। তামাশা ভালো লাগে না। যা হচ্ছে আমার! শ্যামল কিনা বলে তোমার মনুষ্যত্ব নেই। নিজে থেকে ভিখিরির মতো আসে, দয়া করে হেসে কথা কই, তাইতে ভেবেছে, কি না জানি মহাপুরুষ হয়ে গেছি আমি। এবার বাড়িতে এলে দূর করে তাড়িয়ে দেব।

অত রাগ কোরো না, মালতী। বেচারি তোমায় ভালবাসে, সেদিন জানালা দিয়ে আমাদের দেখে ওর মাথা বিগড়ে গেছে। আমাকে গাল তো দেবেই।

মালতী সন্দিগ্ধভাবে বলিল, ভালবাসে না ছাই। অত ছোট মন নিয়ে কেউ ভালবাসতে পারে?

রাজকুমার হাসিয়া বলিল, ভালবাসে বলেই তো মন ছোট হয়েছে। তাছাড়া, আমার ওপর ওর রাগের আরেকটা কারণ আছে।

জানি, কাদের বাড়ির মেয়ের হাত ধরেছিলে তো?

রাজকুমার আশ্চর্য হইল না।

শ্যামল বলেছে?

মালতী মাথা নাড়িয়া বলিল, না, এমনি শুনেছি। সবাই জানে। ওসব লোকের বাড়িতে যাওয়ার কি দরকার ছিল তোমার?

দরকারের কথা পরে বলছি। জেনেও তুমি চুপ করে ছিলে যে?

তুমিও তো চুপ করে ছিলে?

রাজকুমার কিছুক্ষণ কথা বলিল না। আরেকটি ট্রাম সামনে দিয়া চলিয়া গেল।

ব্যাপারটা প্রথমে আমার কাছে এত তুচ্ছ ছিল মালতী বলার কোনো দরকার বোধ করি নি। পরে যখন দেখলাম আমার কাছে তুচ্ছ হলেও অন্যের কাছে তুচ্ছ নয়, তখন বলব ভেবেছিলাম। সময়মতো নিজেই বলতাম।

আমিও জানতাম তুমি সময়মতো নিজেই বলবে। তাই চুপ করে ছিলাম। কিন্তু শ্যামলের কি স্পর্ধা! তোমার সমালোচনা করতে যায়।

আরেকটি ট্রাম আসিতে দেখিয়া মালতী বলিল, যাবে? আমার কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না।

রাজকুমার বলিল, না, চল। সকলের সামনে বিয়েবাড়ি যাব বলে বেরিয়েছি, না গেলে ওরা কি ভাববে?

মালতী হাসিল, লোকে কি ভাববে, তুমি আবার তা ভাব নাকি? পরের বাড়ির মেয়ের হাত ধরতে যাও কেন তবে?

এই জন্যে।–বলিয়া রাজকুমার মালতীর হাত মুঠায় চাপিয়া ধরিয়া ছাড়িয়া দিল।

বিয়ে বাড়িতে সময়টা কাটিল ভালেই। বন্ধু ও পরিচিত অনেকে উপস্থিত ছিল। রাত দশটার মধ্যে লগ্ন, বসিয়া বসিয়া অনেকক্ষণ রাজকুমার বিবাহ দেখিল। কনেকে সত্যই আশ্চর্য রকম সুন্দরী দেখাইতেছে। রং তার অত্যন্ত ফর্সা, সাধারণ অবস্থায় দিনের বেলা লাবণ্যের অভাবে চোখে ভালো লাগে না, এখন ক্রিম, পাউডার, স্নাে, চন্দন আর ঘামে স্নিগ্ধ ও কোমল হইয়াছে মুখখানা। খুঁতগুলি চাপা পড়িয়া গিয়াছে সাজানোর কায়দায় এবং খুঁতও মেয়েটির কম নয়। রাজকুমার অনাবশ্যক সহানুভূতি বোধ করে। সাধারণ দৈনন্দিন জীবনে এভাবে সাজিয়া থাকিবার সুযোগ মেয়েটি পাইবে না। দুপাশে চাপা কপাল, নিভাজ চোখের কোণ, নাকের নিচে ভিতর দিকে মুখের অসমতল খাদ, চোয়ালের অসামঞ্জস্য, এ সব লোকের চোখে পড়িতে থাকিবে। তবে, ধীরেনের চোখে হয়তো পড়িবে না। ফর্সা রঙে তার চোখে যে ধাঁধা লাগিয়াছে, সেটা আর কাটিবার নয়। বাড়ির বৌয়ের রঙের গর্বে বাড়ির অন্য মানুষেরাও হয়তো তার রূপের অন্য সব কটির কথা তেমনভাবে মনে রাখিবে না।

মেয়েটি একটু বোকা এবং অহঙ্কারী। মুখ দেখিয়া এটুকু বোঝা যায়। কাপড়ে পুঁটলি করা দেহটি দেখিয়া অনুমান করা যায় ভোতা, অনাড়ম্বর, নিষ্ক্রিয় প্রেমের সে উপযোগী। নীরবে অনেকটা নির্জীব পুতুলের মতো নিজেকে দান করার জন্য সে চব্বিশ ঘণ্টা প্রস্তুত হইয়া থাকিবে; ধীরেনের যখন খুশি গ্রহণ করিবে যখন খুশি করিবে না, তার দিক হইতে কখনো কোনো দাবি আসিবে না, কোনো সাড়া পাওয়া যাইবে না। স্বামীর সঙ্গে অন্তরালের জীবনটিও প্রথম হইতেই তার কাছে হইয়া থাকিবে প্রকাশ্য উঠা-বসা-চলা-ফেরার জীবনের মতোই বাঁচিয়া থাকার নিছক একটা অঙ্গ মাত্র, আবেগ ও রোমাঞ্চের বাড়াবাড়ি যাতে বিকারের শামিল। দাবি সে করিবে সুখ, সুবিধা ও অধিকার, কর্তৃত্ব সে করিবে অনেক বিষয়ে, সংসারে নিজের স্থানটি দখল করিতে কারো সাহায্যের তার দরকার হইবে না, তার হুকুমেই ধীরেন উঠিবে বসিবে। নিস্তেজ প্ৰাণহীন শুধু হইয়া থাকিবে। স্বামীর সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক।

মেয়েটির সম্বন্ধে আরো অনেক কিছু হয়তো স্পষ্টভাবে জানা যাইত, যদি–

মনের চোখে সেইভাবেই দেখিয়াছে। একটু বাড়াবাড়ি হইয়া যাইতেছে না, বিবাহের আসরে বন্ধুর কনেকে পর্যন্ত এরকম অভদ্ৰভাবে কল্পনা করা? এ দিকটা রাজকুমারের একবার খেয়ালও হয়। নাই। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক আবেষ্টনীতে মেয়েটির জীবনে কি বৈশিষ্ট্য থাকিবে সেই অনুমানেই মশগুল হইয়া গিয়াছিল। কাপড়-ঢাকা দেহ দেখিয়া কতটুকুই বা বুঝিতে পারা যায়? দশ মিনিটের জন্য যদি ভগবান যেমন সৃষ্টি করিয়াছেন ঠিক তেমনি অবস্থায় মেয়েটিকে সে দেখিতে পাইত! বন্ধুর দাম্পত্য জীবনের সমস্ত ভবিষ্যৎ ইতিহাস তার জানা হইয়া যাইত।

এগারটার সময় সরসী কোথা হইতে আসিয়া বলিল, আমায় বাড়ি পৌঁছে দেবে চল।

ওরা?

ওরা পরে যাবে-শ্যামলের সঙ্গে।

ওরা দেরি করছে কেন?

আড্ডা দিচ্ছে, এখনো খেতেও বসে নি।

তুমি খেয়েছ?

সন্দেশ মিষ্টি খেয়েছি, আমি নেমন্তন্ন খাই না।

এ বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমার মিল আছে। আমি অবশ্য ঘরোয়া নেমন্তন্ন খাই, তুমি বললে তোমার বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসব। ভোজ কখনো খাই না।

কিছু খেয়েছ তো?

কই আর খেলাম? দুবার ডাকতে এল, আমি বললাম, সকলের সঙ্গে বসব না। ব্যস, কেউ আর টু শব্দটি করল না।

তুমি বড় ছেলেমানুষ রাজু। বিয়ে বাড়ি, পাঁচ-সাত শ লোক খাবে, প্রত্যেকের বিষয়ে অমন করে খোঁজখবর রাখতে পারে? বললে না কেন তোমায় কিছু এনে দিতে? আমি বসব না মশায়, আমায় একটা প্লেটে সামান্য কিছু এনে দিন, এ কথাটা আর মুখ ফুটে বলতে পারলে না!

কথাটা ওদের বলাই উচিত ছিল না?

তোমরাই আবার মেয়েদের সেন্টিমেন্টাল বল। সরসী হাসিয়া ফেলিল, আমি বলে দিচ্ছি, কিছু খেয়ে নাও। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়?

নিশ্চয়?

রাজকুমারকে খাবার দেওয়ার কথা বলিতে সরসী কিন্তু যায় না, খোপা ঠিক করার অবসরে কত কি যেন ভাবিয়া নেয়।

তার চেয়ে আমার বাড়ি গিয়ে খাবে চল।

বাঁচালে সরসী। লক্ষ্মী মেয়ে। হাটে বসে খাবার গিলতে সত্যি আমার কষ্ট হয়, সেন্টিমেন্টাল বল আর যাই বল।

আমি কিন্তু এ সব হাটে বসে দশজনের সঙ্গেই খেতে ভালবাসি, রাজু। তোমায় মিছে। বলেছিলাম, আমি খুব নেমন্তন্ন খাই। তোমায় বাড়ি নিয়ে যাব বলে না খেয়ে ওদের আগে চলে এসেছি।

বল কি সরসী? আমায় তো সাবধান হতে হবে।

তুমি আবার অসাবধান কবে? বাস তো কর দুর্গে, সাবধান আবার হবে কি?

কিসের দুর্গ সরসী? কার দুর্গ?

তোমার নিজের দুর্গ। কিসের তা জানি না।

কথার কথা? কে জানে! বুঝিতে না পারিয়া রাজকুমার একটু বিরক্তি বোধ করিতে লাগিল। জিজ্ঞাসা করিয়া কথাটা স্পষ্ট করিতেও বাঁধ বাঁধ ঠেকিতে লাগিল। সরসীর ইঙ্গিত তার জিজ্ঞাসা করিয়াই বোঝা উচিত।

সরসীদের বাড়ির সকলেই বিয়েবাড়িতে গিয়াছিল, কেবল কেদার সকাল সকাল ফিরিয়া শুইয়া পড়িয়াছেন। রাত তিনটায় কাশিতে কাশিতে তার ঘুম ভাঙিবে, তার আগে ভদ্রলোকের আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়ার সম্ভাবনা নাই।

চাকর দরজা খুলিয়া দিয়া হুকুমের জন্য দাঁড়াইয়া রহিল। সরসী বলিল, তুই শো গে যা লছমন।

একটু পুরোনো ধাচের বড় চারকোনা বাড়ি, ঘরগুলি প্রকাণ্ড। নিচের হলটিতে রীতিমধ্যে সভা বসানো চলে। এই হলে রাজকুমারকে বসাইয়া সরসী খুঁজিয়া পাতিয়া নানারকম খাবার আনিয়া হাজির করিল।

পেট ভরেই খাও। এখন একবার খেয়ে বাড়ি গিয়ে আর খাবার দরকার নেই।

পেট ভরে না খেলেও বাড়ি গিয়ে আর খেতাম না সরসী।

এখনো তোমার হজমের গোলমাল হয়?

সাবধান থাকলে হয় না।

খুব গুণের কথা হল, না? এই বয়সে বুড়োদের মতো খাওয়ার বিষয়ে সাবধান হয়ে চলতে হবে? তুমি একেবারে একসারসাইজ কর না। সারা দিন শুয়ে বসে ঘরের কোণে কাটালে মানুষের স্বাস্থ্য ঠিক থাকে?

সেজন্য খুব বেশি আসত যেত না সরসী। আসল কারণ হল, এক কালে খুব একসারসাইজ করতাম, হঠাৎ ছেড়ে দিয়েছি। চিরকালের আলসে লোকের শুয়ে বসে থাকাটা দিব্যি সয়ে যায়, হঠাৎ একদিন আলসে হলেই বিপদ।

ছাড়লে কেন? আবার তো ধরতে পার?

ধরব। শিগগির ধরব। দু-চার দিনের মধ্যে।

অতিরিক্ত আগ্রহের সঙ্গে রাজকুমারের কথা বলার ধরনে সরসী একটু আশ্চর্য হইয়া যায়। সে যেন সরসীর কাছে প্রতিজ্ঞা করিতেছে, দেহকে আর অবহেলা করিবে না, অবিলম্বে ব্যায়াম আরম্ভ করিবে। অপরাধের বিলম্বিত প্ৰায়শ্চিত্ত করার মতো। রাজকুমারের খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত সরসী আর কথা বলে না, নীরবে তাকে দেখিয়া যায়। সেটা বিস্ময়কর ঠেকে রাজকুমারের কাছে।

এবার বিদায় নেওয়া যাক।

বোসো।

সেটা কি উচিত হবে? রাত কম হয় নি।

তুমি আমাকে উচিত অনুচিত শেখাতে এস না।

নিজেও সরসী বসে। বসার পর একসঙ্গে বেশিক্ষণ রাজকুমারের মুখখানা দেখিতে না পারায় এদিক ওদিক চাহিতে চাহিতে বার বার তার মুখের দিকে তাকায়। রাজকুমার নীরবে প্রত্যাশা করিয়া থাকে। সরসীর কিছু বলিবার আছে অনেক আগেই সে তা অনুমান করিয়াছিল। তার কাছে কিছু আশা করিয়া সরসী সুযোগ পাইয়া এত রাত্রে তাকে খালি বাড়িতে ডাকিয়া আনে নাই, সরসীর কাছে এসব হঠাৎ পাওয়া সুযোগ সুবিধার কোনো মানে নাই। সেরকম ইচ্ছা থাকলে কবে সকলে বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রণ রাখিতে গেলে বাড়ি কঁকা হইবে সে ভরসায় বসিয়া না থাকিয়া রাজকুমারকে দিয়াই হয়তো সে খালি একটা বাড়ি ভাড়া করার ব্যবস্থা করিত। কোনো কারণে তাকে আজ সরসীর দরকার হইয়াছে। খুব সম্ভব তাকে কিছু বলিবে সরসী এবং যতক্ষণ মুখ ফুটিয়া না বলিবে, কি যে সে বলিতে চায় কেউ কল্পনাও করিতে পারিবে না।

সরসীর প্রকৃতি আসলে খুব সহজ ও সরল। দরকারি নির্দোষ মিথ্যা সে অনর্গল বলিতে পারে, আজ সন্ধ্যায়ও অনায়াসে লাগসই কৈফিয়ত রচনা করিয়া নিজেকে সাক্ষী দাঁড় করাইয়া রুক্মিণীর কাছে তার লজ্জা বচাইয়াছিল। বুদ্ধি তার ধারালো, মানুষের কাছে কাজ আদায় করার কোনো কৌশল বোধহয় তার অজানা নাই, সস্তা আবেগ তার কাছে এতটুকু প্রশ্রয় পায় না।

কাল থেকে তোমার কথাই ভাবছি রাজুদা।

কেন?

তুমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছ দিনকে দিন।

কেমন হয়ে যাচ্ছি?

কি রকম অস্থির দিশেহারা হয়ে পড়ছ। বেঁচে থাকতেই তোমার যেন ভালো লাগছে না, সব সময় একটা কষ্ট ভোগ করছ। অনেকদিন থেকেই তোমার এ ভাবটা লক্ষ করছি। কি হয়েছে তোমার?

রাজকুমার নীরবে মাথা নাড়িল।

সরসী ভ্রূ কুঁচকাইয়া একটু ভাবিল।–কি হয়েছে বুঝতে পারা আশ্চর্য নয়। কিন্তু কিছু যে তোমার হয়েছে তাও কি বুঝতে পার না? অসুখ হলে তো সব সময় জানা যায় না কি অসুখ হয়েছে, শরীরটা শুধু খারাপ লাগে। নিজের ভেতরে সেই রকম কিছু বোধ কর না? অসুখের কথা বলছি না? মনে তোমার কোনো রকম অস্বস্তি আছে, টের পাও না?

এসব কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন সরসী?

বললাম না তোমার জন্য আমার ভাবনা হচ্ছে? রিণির কাছে সব শুনে—

তাই বল।

তুমি যা ভাবছ, তা নয়। রিণির কাছে সব শুনে আমার ভাবনা হয় নি, তার অনেক আগে থেকেই তোমার সাধারণ চালচলন কথাবার্তার ধরন দেখেই ভাবনা হয়েছে। তবে রিণির ব্যাপারটা না জানলে আমি হয়তো চুপ করে থাকতাম। মানুষের কত কি হয়, বিশেষ করে তোমার মত যারা নিজের মনের মধ্যেই বেশি করে বাঁচে। তোমার ভেতর কোনো একটা গুরুতর পরিবর্তন ঘটেছে, আস্তে আস্তে আবার সামঞ্জস্য হয়ে যাবে মনে করেছিলাম। একবার ভেবেছিলাম, লভে পড়েছ বুঝি, ছেলেখেলা নয়, আসল লভ। তারপর দেখলাম সে সব কিছু নয়।

কি করে জানলে সে সব কিছু নয়।

সে রোগের সিমটম আলাদা, আমরা চিনতে পারি। একটা মেয়েকে ভালবাসার মানে জান? সকলকে ভালবাসা, জীবনকে ভালবাসা, বেঁচে থাকতেই মজা লাগা। তুমি কাউকে ভালবাস না, নিজেকে পর্যন্ত নয়। সব সময় তুমি ছটফট করছ, কি করলে একটু স্বস্তি পাবে। সর্বস্ব হারিয়ে গেলে মানুষ যেমন পাগলের মতো খুঁজে খুঁজে বেড়ায়, তুমিও ঠিক তেমনিভাবে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছ। থিয়োরি? তুমি পাগল রাজুদা। দেহের গড়নের সঙ্গে মানুষের প্রকৃতির সম্পর্ক কি তাই টেস্ট করার জন্য কেউ এভাবে ব্যাকুল হয়? তোমার আরো সিরিয়াস কিছু হয়েছে, এ শুধু তার একটা লক্ষণ। আমার কান্না পাচ্ছে বুঝতে পারছ?

সেটা সহজেই বোঝা যাইতেছিল। গলা ভারি হইয়া চোখ জলে ভরিয়া আসিয়াছে। রাজকুমার তাড়াতাড়ি বলিল, কেঁদ না সরসী। কান্না আমি সইতে পারি না।

কান্না পেলেই আমি কাঁদি নাকি?

তাই তো তোমায় ভালবাসি।

ভালবাস না, ছাই। পছন্দ কর। ভালবাসলে তো বেঁচে যেতে।

রাজকুমার করুণভাবে একটু হাসিল। সরসীকে সে পছন্দ করে, স্নেহ করে, একটু ভয়ও। করে। নিজের সম্বন্ধে এই স্পষ্ট ও সহজ কথাগুলি সরসী ছাড়া কারো কাছে সে শুনিতে পাই না। অনেক দিন হইতেই সরসী জানে তার ভিতরে কিছু একটা গোলমাল চলিতেছে। নিজের সম্বন্ধে নিজে সে কখনো এভাবে চিন্তা করে নাই। যখন এ বিষয়ে কিছু ভাবিয়াছে, স্থূল বাস্তব জগতের আপেক্ষিকতার মাপকাঠিতে বিচার করিয়া বুঝিতে চাহিয়াছে, ব্যাপারখানা কি। নিজের সম্বন্ধে যত কেন জাগিয়াছে, তার সবগুলির জবাব খুজিয়াছে যে অভিধানে শুধু সাধারণ চলতি মানে পাওয়া যায়। মুদির হিসাবে যেন সুখ-দুঃখের হিসাব করিয়াছে। ভূমিকম্পের কারণ খুঁজিয়াছে মাটির উপরে। আরো যে অনেক উষ্ণ গহন স্তর আছে মাটির নিচে এ যেন সে ভুলিয়াই গিয়াছিল। আজ সরসী মনে পড়াইয়া দিয়াছে। গভীর কৃতজ্ঞতায় অনেকদিন পরে রাজকুমারের হৃদয়গ্ৰন্থিতে স্রাব হয় চোখের জলের মতো নোনতা সুস্বাদু রসের, শুকনো মন একটু ভিজিয়া ওঠে।

সরসী বলিল, এত বড় হলে বসতে ভালো লাগছে না? উপরে যাবে? চল।

উপরে দুটি পাশাপাশি ঘর সরসীর, একটিতে সে বসে, অপরটিতে শোয়। মাঝখানে একটি দরজা আছে, ঘর দুটির ব্যবধান বজায় রাখতে দরজাটি সে অধিকাংশ সময় বন্ধ করিয়া রাখে, সামনের বারান্দা ঘুরিয়া যাতায়াত করে এঘর হইতে ওঘরে।

বসিবার ঘরে রাজকুমারকে বসাইয়া সে বাহিরে চলিয়া গেল। একপাশে একটি চারকোনা টেবিলে সরসী লেখাপড়া করে, তার সভা-সমিতির কাগজপত্রেই টেবিলের অর্ধেকটা ভরিয়া আছে। ছোট একটি শেলফে বাছা বাছা বই, প্রত্যেকটি বই রাজকুমারের পড়া। নির্বিচারে ভালোমন্দ সব বই পড়ার সময় সরসীর হয় না। রাজকুমারের সঙ্গে তাই তার বন্দোবস্ত আছে, রাজকুমার নিজে পড়িয়া যে সব বই তাকে পড়িতে বলে শুধু সেই বইগুলিই সে পড়ে তার জ্ঞানবুদ্ধির আয়ত্তের বাহিরের বইগুলি ছাড়া। এ ঘরে প্রায়ই অনেক মেয়ে জড়ো হয়, সোফা চেয়ারে ঘরটি একটু ঠাসিয়া ফেলিতে হইয়াছে। জানালার কাছে গেরুয়া আস্তরণ ঢাকা একটি ইজিচেয়ার, সরসী ওখানে বিশ্রাম করে। আস্তরণে মাথার চুলের দাগ পড়িয়াছে টের পাওয়া যায়। সারাদিন ছোটাছুটির পর ওখানে চিৎ হইয়া শ্ৰান্ত সরসী না জানি কি ভাবে! দশজনের সঙ্গে সরসীর কারবার, সর্বদা সে মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে, দু-চারজন সঙ্গিনী সারাদিন তার আছেই। সরসীকে এই ঘরে একা কল্পনা করিতে গিয়া রাজকুমারের মনে হয় সে যেন নিজেরই এক রহস্যময় ভাবপ্রবণতাকে প্রশ্রয় দিতেছে।

সরসীর ফিরতে দেরি হইতেছিল। এত রাত্রে তাকে একা বসাইয়া কি করিতেছে সরসী? আত্মসংবরণ করিতেছে? রাজকুমার নিজের কাছেই মাথা নাড়ে। যতই বিচলিত হোক সামলাইয়া উঠিতে সরসীর সময় লাগে না, নির্জনতার প্রয়োজন হয় না। নিচে তার যখন কান্না আসিয়াছিল তখনো এক মিনিটের জন্য উঠিয়া গিয়া কাঁদিয়া অথবা কান্না থামাইয়া আসিতে হয় নাই।

রাজকুমার মৃদুস্বরে ডাকে, সরসী?

পাশের ঘর হইতে সরসী সাড়া দেয়, আসছি।

কেমন যেন অস্বাভাবিক মনে হয় সরসীর গলা। নিচে অত সহজে যে কান্না সে আটকাইয়াছিল, ও ঘরে গিয়া সত্য সত্যই তবে কি সেই কান্নাই সে কাদিতেছে? রাজকুমার কাঠ হইয়া বসিয়া থাকে। রিণির কাছে তার খাপছাড়া প্রস্তাবের বিবরণ শুনিয়া এমন আঘাত লাগিয়াছে সরসীর মনে? রিণিকে কথাটা বলার আগে সে শুধু ভাবিয়াছিল, এসব কানে গেলে মালতী কত কষ্ট পাইবে। সরসীর কথা তার মনেও আসে নাই। শেষ পর্যন্ত আঘাতটা তবে পাইল সরসী?

রাজকুমার ভাবিয়াছিল, সরসী বাহির হইতে ঘরে আসিবে। শোবার ঘরের দরজা খোলার শব্দে সেদিকে চাহিয়া তার চোখের পলক পড়া বন্ধ হইয়া গেল।

সরসী আগাইয়া আসিল আরো কয়েক পা।

রিণির মতো রং নেই, আমি কালো। তবু ভাবলাম, তুমি তো রং দেখতে চাও না—

তুমি কাঁপছ সরসী।

মনের জোরে কুলোচ্ছে না। কি মনে হচ্ছে জান? ছুটে গিয়ে খাটে তোশক গদির নিচে ঢুকে। পড়ি। কিছু ভাবা আর করার মধ্যে কত তফাত! তখন থেকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি, তুমি না ডাকলে দরজা খুলতেই পারতাম না।

তুমি বড় সুন্দর সরসী।

চুপ। ওসব বল না। দম আটকে মরে যাব।

মরবে না, শোন। তোমার শরীর এমন সুন্দর বলে তোমার মনটাও সুন্দর। তোমায় এখন আমি প্রণাম করতে পারি, জান?

অনির্বচনীয় আনন্দে রাজকুমারের চিত্ত ভরিয়া যায়, নিরবসন্ন সক্রিয় শান্তির মতো এক অপূর্ব অনুভূতি জাগে। শক্তি ও সহিষ্ণুতার যেন সীমা নাই। শ্রদ্ধা, মমতা, কৃতজ্ঞতা আর সহানুভূতি মেশানো যে মনোভাব সরসীর প্রতি জাগে প্রেমের চেয়ে তা বোধহয় কম জোরালো নয়। সরসী তাকে বোঝে, বিশ্বাস করে। ব্যাখ্যা করিয়া সরসীকে তার কিছু বুঝাইতে হয় নাই, রিণির কাছে তার বক্তব্যের ভাঙাচোরা বিকৃত বিবরণ শুনিয়া সে যতটুকু বুঝিতে পারিয়াছে তাই মনে করিয়াছে যথেষ্ট। আর জেরা করে নাই, তর্ক তোলে নাই, নিজের হইয়া ওকালতি করার যন্ত্রণা তাকে দেয়। নাই, বিনা ভূমিকায় নিজের দেহটি তাকে দেখিতে দিয়াছে। সরসী ছাড়া আর কেউ তা পারিত না।

সরসীর মুখ বিবৰ্ণ হইয়াই ছিল, ধীরে ধীরে কখন আপনা হইতে তার চোখ বুজিয়া যায়, আর খোলে না।

এবার যাও সরসী।

তোমার কাজ হয়েছে? এসেছি যখন, মাঝখানে পালিয়ে গিয়ে লাভ হবে না। আর দু-তিন মিনিট কোনো রকমে সইতে পারব।

আর দরকার নেই।

সরসী শোয়র ঘরে গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দেয়। কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না কিন্তু বোঝা যায় দরজার কাছেই সে দাঁড়াইয়া আছে। বোধহয় দম নিতেছে।

এবার তুমি যাও রাজুদা। আজ আর তোমায় মুখ দেখাতে পারব না।

আচ্ছা।

লছমনকে ডেকে দিয়ে যেও।

আচ্ছা। সরসী?

না-না-না। বল না রাজুদা। রাস্তায় নেবে গেলেই দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।

এতক্ষণ পরে তোমার ভয় হল সরসী? সামনে থেকে সরে গিয়ে? আমি অন্য কথা বলছিলাম।

কি কথা?

আমি কাউকে ভালবাসি না।

সে তো আমিই তোমাকে বলেছি একটু আগে।

তুমি বললে কি হবে, আমি তো জানতাম না। আজ জানতে পেরেছি। তোমায় একটা সার্টিফিকেট দিয়ে যাই। তোমার শরীর আর মন শুধু সুন্দর নয়, তুমি ভালো, তোমার বেঁচে থাকা সাৰ্থক। তুমি আমাকে উঁচুতে তুলে দিয়েছ। তোমার সাহায্য না পেলে কোনোদিন হয়তো সেখানে উঠতে পারতাম না সরসী। তুমি আমার আরেকটা উপকার করেছ সরসী। গিরির ব্যাপারটা জান?

জানি।

ব্যাপারটা তুচ্ছ করে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেছি কিন্তু শকটা কোনোমতে কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। একটা জ্বালা বরাবর থেকে গিয়েছিল। তুমি আজ জ্বালাটা দূর করে দিলে। মনে মনে কতখানি কষ্ট পাচ্ছিলাম এতদিন ভালো বুঝতে পারি নি, এখন মন শান্ত হয়েছে, এখন বুঝতে পারছি। কোনো মেয়ের সংস্পর্শে এলেই আপনা থেকে মনে হত, এও গিরির জাতের জীবন, এর মধ্যেও নিশ্চয় খানিকটা গিরির উপাদান আছে। তোমার সম্বন্ধে পর্যন্ত তাই মনে হত। যুক্তি দিয়ে। বুঝতাম অন্য রকম, কিন্তু কিছুতে চিন্তাটা ঠেকাতে পারতাম না। তুমি আজ আমার বিকারটা কাটিয়ে দিয়েছ সরসী।

একটু দাঁড়াও রাজুদা, যেও না।

কয়েক মিনিট পরে সাধারণ একটি শাড়ি পরিয়া ক্যাম্বিশের জুতা পায়ে দিয়া সরসী এ ঘরে আসিল।

জোরে জোরে মাইল খানেক হেঁটে আসি চল? আজ রাতে নইলে ঘুম আসবে না।

রাজকুমার ভাবে, কারো কাছে সে কি কোনোদিন কোনো অপরাধ করে নাই, পৃথিবী অথবা স্বৰ্গ অথবা নরকবাসী কারো কাছে? যে অপরাধের অনুভূতি তাকে যন্ত্রণা দিতে পারে, যার প্রতিক্রিয়ায় জীবজগতে স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে কারো উপরে একটু বিদ্বেষের জ্বালা অনুভব করিতে পারে?

রাগ নাই, অভিমান নাই। একটি মানুষের উপরেও নয়। জড়বস্তুকেও মানুষ কখনো হিংসা করে, হোঁচট লাগিলে অন্ধ ক্রোধে ইটের উপর পদাঘাত করে, পুতুল হইলে একটি পুতুলের মুখ তার পছন্দমতো নয় বলিয়া যতটুকু বিরক্তি বোধ করা চলিত, তাও সে বোধ করে না। মানুষের মনের অন্ধকার ও দেহের শ্ৰীহীনতার অপরাধ সে ক্ষমা করিয়াছে। মানুষ যে কৃপণ তাতে তার কিছুই আসিয়া যায় না, কারণ, মানুষের কাছে সে কিছু চায় না।

এই নির্বিকার ঔদার্য যেন জীবনের সেরা সম্পদ, কুড়াইয়া পাইয়াছে। দূর হইতে দিনের পর দিন শুধু চাহিয়া দেখিতে দেখিতে হঠাৎ একদিন ধনীর দুলালের খেলনটি বস্তিবাসী শিশুর হাতে আসিলে সে যেমন আনন্দে পাগল হইয়া ভাবে, জীবনে তার পাওয়ার আর কিছুই বাকি নাই, আর্য শান্তি আহরণের সৌভাগ্যে বিপরীত আনন্দের উন্মাদনায় রাজকুমারেরও তেমনি মনে হইতে থাকে, এবারে সে তৃপ্তি পাইয়াছে, সম্মুখে তার পরিতৃপ্ত জীবন।

সকলে জিজ্ঞাসা করে–কি হয়েছে রাজু? ডার্বি জিতেছ?

একে জিতেছি।–রাজকুমার দেখাইয়া দেয় নিজেকে, কখনো বুকের ডাইনে কখনো বয়ে আঙুল ঠেকাইয়া।

যে কাছে আসে সেই পরিবর্তন লক্ষ করে, নদীতে জোয়ার আসার মতো এত স্পষ্টভাবে সে জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে। মনোরমা বিস্মিত হয়, আশা করিবে কি হতাশ হইবে ভাবিয়া পায় না। আশাভঙ্গের ভয়টাই হয় বেশি। কালীর জন্য যদি বদলাইয়া গিয়া থাকে রাজকুমার, তাকে কিছু না। বলিয়াই কি বদলাইত? এখন শুধু এইটুকু আশা করা চলে যে তাকে কিছু না বলিলেও কালীর সঙ্গে হয়তো তার কোনো কথা হইয়াছে, হয়তো অন্য কিছু ঘটিয়াছে। অন্য কিছু কি আর ঘটিবে, হয়তো কালীকে একটু আদর করিয়াছে রাজকুমার এবং কি করিবে না করিবে সিদ্ধান্ত করিয়া ফেলিয়া সুখী। হইয়াছে। এবার সময়মতো একদিন তার কাছে কথাটা পাড়িবে।

মনে মনে মনোরমা কিন্তু মাথা নাড়ে। রাজকুমারের খুশি হওয়া যেন সে রকম নয়। সে শান্তই ছিল চিরদিন, আরো শান্ত হইয়াছে, শুধু চোখে-মুখে ফুটিয়াছে জ্যোতি, কথা ও ব্যবহার হইয়াছে নিৰ্ভয় নিশ্চিন্ত সুখী মানুষের আনন্দময় সহজ আত্মপ্রকাশ। একটু তে উত্তেজনা থাকা উচিত ছিল আনন্দে, কালীকে চায় কি চায় না এ সমস্যার মীমাংসা যদি তার হইয়া গিয়া থাকে, শুরু যদি হইয়া থাকে কালীকে পাওয়ার দিন গোনা? কালীকে সে জিজ্ঞাসা করে, ারে কালী, কি হয়েছে রে?

জিজ্ঞাসা করে অনেক বুদ্ধি খাটানো খানিকটা ভূমিকার পর। সে আর কালী ছাড়া রান্নাঘরে কেউ নাই, তবু হাত ধুইতে ধুইতে কালীকে সে শোয়র ঘরে যাইতে বলে একটা কথা আছে। একটু দেরি করিয়া নিজে ঘরে যায়, দরজা সযত্নে ভেজাইয়া দেয়। তারপর সামনে দাঁড়াইয়া হাসিমুখে সুখবর প্রত্যাশা করার মতো ব্যথভাবে প্রশ্নটা করে। যদি কিছু ঘটিয়া থাকে কালীর মতো বোকা মেয়েরও বুঝিতে বাকি থাকিবে না কোন্ বিষয়ে তার জানিবার আগ্রহ। মুখে কিছু না বলুক, কালীর মুখ দেখিয়াই সে সব বুঝিতে পারিবে।

কিন্তু হায়, কালীর মুখে বিস্ময় ছাড়া আর কোনো ভাব ফোটে না।

কিসের দিদি

হতাশ ক্রোধে মনোরমা বলে, কচি খুঁকি তুমি, কিছু জান না? রাজু তোকে কিছু বলে নি? কিছু করে নি?

না তো?

না তো? বড় গর্বের কথা তোর না? যা চেহারা, যা স্বভাব, কে তোকে পছন্দ করবে!

রাজকুমার আজকাল সকলের আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া গিয়াছে। চেষ্টা না করিয়া কেউ আজকাল রাজকুমারকে কাছে পায় না। কাছে মানে পাশে বা সামনে নয়। সেভাবে কারো কাছ। হইতে রাজকুমার নিজেকে দূরে সরাইয়া নেয় নাই। দেখা সাক্ষাৎ সকলের সঙ্গে যেমন চলিতেছিল প্রায় সেই রকমই বজায় আছে। যাদের সঙ্গে শুধু বাহিরের পরিচয় তারা বরং এমন কথাও ভাবে যে আরেকবারের আলাপে মানুষটার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই বুঝি খানিকটা বাড়িয়া গেল। কিন্তু যাদের সঙ্গে তার পরিচয় ভূমিকা পার হইয়া জীবনের আনুষঙ্গিক দৃশ্যপট জানাজানিতে অন্তত পৌঁছিয়াছে, যারা উচ্চারণ করার আগেই তার দু-চারটি মনের কথা এতকাল টের পাইয়া আসিয়াছে, চেষ্টা না করিলে তারাও আর মনের তার নাগাল পায় না, ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি তুচ্ছ একটি কথারও পুনরাবৃত্তি যেন হয়। না কারো সঙ্গে তার দু-চার ঘণ্টার আলাপে।

তিন দিন তার সঙ্গে মালতীর দেখা হইয়াছে, দশ জনের মধ্যে এবং নির্জনে। তিন দিন নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়া মশগুল মানুষটাকে মালতী দেখিয়াছে, কিন্তু তার উপস্থিতি অনুভব করিতে পারে নাই।

প্রথমেই এই চিন্তা তার মনে আসিয়াছিল, একি শ্যামলের জন্য? শ্যামল আর তার সম্বন্ধে কিছু ভাবিয়া কি রাজকুমার হঠাৎ এভাবে বদলাইয়া গিয়াছে? রাজকুমারের পরিবর্তনের কত সম্ভবপর কারণের কথাই সে ভাবিতে পারিত, কত রাগ আর অভিমান জাগিতে পারিত উপেক্ষার মতো রাজকুমারের নির্বিকার খাপছাড়া ব্যবহারে, তার বদলে শ্যামলকে কারণ হিসাবে টানিয়া আনিয়া বুকটা তার ধড়াস করিয়া উঠিল। সত্যই যেন শ্যামলের সঙ্গে তার কিছু হইয়াছে, শ্যামল যেন নিছক তার বন্ধু নয়। শ্যামলের দিক হইতে ধরিলে হয়তো সে তা নয়। হয়তো কেন, মালতী ভালোভাবেই জানে শ্যামলের মনকে বন্ধুর মন বলিয়া গণ্য করা শুধু ভুল নয়, নিষ্ঠুর অন্যায়। মাঝে মাঝে শ্যামলের জন্য আজকাল জ্বালা করিয়া চোখে তার জল আসে। আজ অপমান করিলেও কাল সে বই ফেরত নেওয়ার ছলে গম্ভীর মুখে বাড়িতে আসে, বই হাতে পাওয়া মাত্র চোখ, তার কুদ্ধ করুণ ছলছল আশ্চর্য চোখ, আড়াল করিতে অভিমানী শিশুর মতো মুখ ফিরাইয়া মাথা উঁচু করিয়া গটগট করিয়া চলিয়া যাওয়ার উপক্রম করে, কিন্তু ডাকিবামাত্র ফিরিয়া আসিয়া বলে, কি বলছ শিগগির বল, আমার কাজ আছে। তবে এটা শুধু শ্যামলের দিক। সে তো কোনোদিন তাকে প্রশ্রয় দেয় নাই–কাছে আসিতে আর কথা বলিতে দেওয়া যদি প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। রাজকুমারের ভাবান্তর তার আর শ্যামলের সম্পর্কেরই কোনো জটিল দুর্বোধ্য প্রতিক্রিয়া, প্রথমেই এ কল্পনা কেন। তাকে চমকাইয়া দেয়? তারপর সারাদিন উতলা করিয়া রাখে, নিদ্রাহীন রাত্রি যাপন করায়? কদিন মালতী যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছে দারুণ কিন্তু সে যেন কেমন এক ধরনের যন্ত্রণা, উদভ্ৰান্ত উত্তেজনা আর আত্মহারা অবসাদের বেদনাহীন পীড়ন, গা পোড়ানো জ্বরে হাড় কাঁপানো শীতের মতো।

আজ শ্যামল আসিবে। কাল মালতী নিজে তাকে আসিতে বলিয়াছে। শ্যামলের সঙ্গে তার সিনেমায় যাওয়ার কথা আছে। বাহিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়ার কথা সে ভাবিতেছে, হঠাৎ তার মনে হইল, এভাবে চলিতে পারে না, এভাবে রাজকুমারকে দূরে সরিয়া যাইতে দেওয়া অন্যায়, তারও অন্যায়, রাজকুমারেরও অন্যায়। চুপ করিয়া ঘরে বসিয়া শুধু উতলা হইলে তার চলিবে না। আজ রাজকুমারকে তার কাছে পাওয়া চাই। শ্যামল যখন আসিল, রাজকুমারের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়া মালতী সবে রিসিভারটা নামাইয়া রাখিয়াছে।

উৎসাহে শ্যামল অস্থির হইয়া পড়িয়াছিল।

শিগগির তৈরি হয়ে নাও মালতী, দেরি হয়ে গেছে।

আমি যাব না!

কেন? লক্ষ্মী চল। প্লিজ।

কি আশ্চর্য, বলছি তোমার সঙ্গে যাব না, রাজুদার সঙ্গে আমার দরকার আছে, জোর করে। নিয়ে যাবে তুমি আমায়?

জোর করে–?

যাব না–তোমার সঙ্গে কোথাও যাব না কোনোদিন। কেন তুমি আমায় জ্বালাতন কর?

আমি তো কিছুই করি নি মালতী?

কর নি? দিন রাত পেছনে লেগে আছ তুমি আমার, কিছু কর নি? এই যে তাকিয়ে আছ অমন করে, এটা কিছু করা নয়, এই যে তর্ক করছ, এটাও কিছু করা নয়–তুমি কিছুই কর না, বড় ভালো ছেলে তুমি। যেতে বলছি, চলে যাও না? তোমার কি মান অপমান জ্ঞান নেই? এত অপমান। করি, কিছুতেই তোমার অপমান হয় না?

তুমি আমায় কখনো অপমান কর নি!

করি নি? হাজারবার করেছি। অন্য কেউ হলে–?

রাগের মাথায় কখনো দু-চারটে কথা বললে, তাকে অপমান বলে না। আসতে বারণ করে নিজেই আবার আসতে বলেছ।

আমি আসতে বলেছি? ছুতো করে তুমি নিজে এসেছ।

ছুতোগুলি তুমি মেনে নাও নি কেন? বই নিতে এসেছি, বই নিয়ে চলে যেতে দিলেই চুকে যেতঃ দু-চার দিনের বেশি তো আর ছুতো করে আসতে পারতাম না, আপনা থেকে আমার আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে যেত। মালতীর সঙ্গে কলহ বাধিলে চিরদিন শ্যামলের কথা জড়াইয়া গিয়াছে, আজ তাকে চাপা গলায় ধীরে ধীরে অপরিচিত ভঙ্গিতে কথা বলিতে শুনিয়া মালতীর হঠাৎ কেমন ভয় করিতে লাগিল। শ্যামল ভয়ানক চটিয়া গিয়াছে। রাগে সে থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। তবু সে এত আস্তে এত স্পষ্টভাবে কথা বলিতেছে কি করিয়া?

থাকগে। ওসব কথা থাক শ্যামল।

না, থাকবে না।

মালতী ভীরু চোখ তুলিয়া শ্যামলের মুখের দিকে তাকায়। শ্যামলের চোখে কি হইয়াছে অমন করিয়া তার দিকে সে তাকায় কেন?

রাজকুমারের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর শ্যামলের সম্পর্কে মালতীর মনটা বিগড়াইয়া গিয়াছিল। নিজে সে যাচিয়া রাজকুমারকে জানাইয়া দিয়াছিল, শ্যামলের সঙ্গে তার সিনেমায় যাওয়ার কথা আছে, শ্যামল এখনই তাকে নিতে আসিবে, কিন্তু রাজকুমারের সঙ্গে সে আজ সন্ধ্যাটা কাটাইতে চায়। ভাবিয়াছিল, শ্যামলকে বাতিল করিয়া তার সঙ্গ চায় শুনিয়া রাজকুমার নিশ্চয় খুশি হইবে। খুশি সে হইয়াছিল কিনা ভগবান জানেন, শ্যামলের সঙ্গেই সিনেমায় যাওয়ার জন্য তাকে রাজি করাইতে কত চেষ্টাই যে রাজকুমার করিয়াছিল! শ্যামলের মনে নাকি কষ্ট দেওয়া উচিত নয়, শ্যামল তাকে ভালবাসে। শেষে রাজকুমার বলিয়াছিল, ওকে অন্তত মিষ্টি কথা বলে ফিরিয়ে দাও মালতী, মনে যেন দুঃখ না পায়। আমার কাছে আসছ ওকে জানিয়ে দরকার নেই। ওর সম্বন্ধে আমার ভয় আছে মালতী, মাথাপাগলা ছেলে তো, কখন কি করে বসে। তার সঙ্গে সন্ধ্যা যাপনের জন্য রাজকুমারকে রাজি করাইতে রীতিমতো চেষ্টা করিতে হওয়ায় মালতীর গা জ্বালা করিতেছিল, এসব কথা শুনিতে শুনিতে তার মনে হইয়াছিল শ্যামলের চেয়ে বড় শত্ৰু বুঝি তার নাই। হয়তো ঈর্ষাতে নয়, শ্যামলের মনে কষ্ট দেওয়ার ভয়েই রাজকুমার তাকে এড়াইয়া চলিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাকে উপেক্ষা করিতেছে। শ্যামল রাজকুমারের পরিবর্তনের কারণ। তাকে ভালবাসিয়া শ্যামল তার সর্বনাশ করিয়া ছাড়িবে।

মিষ্টি কথার বদলে অতি কড়া ভাষাতেই শ্যামলের সঙ্গে সিনেমায় যাওয়া সে তাই বাতিল করিয়া দিয়াছে। রাজকুমারের সঙ্গে তার দরকার আছে এ কথাটা জানাইয়া দিতেও কসুর করে নাই। এখন শ্যামলের রকম দেখিয়া তার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করিতে লাগিল। এতক্ষণ বিশ্বাস করে নাই, এবার মনে হইতে লাগিল রাজকুমার হয়তো ঠিক বলিয়াছে, শ্যামল ভয়ানক কিছু করিয়া বসিতে পারে।

শ্যামল বলিতে থাকে–তুমি হয়তো সত্যি আমায় অপমান করেছ, বাদর নাচিয়েছ, আজ তাড়িয়ে দিয়ে কাল আবার ডেকে পাঠিয়ে পোষা কুকুরের মতো খেলা করেছ আমার সঙ্গে। করে থাকলে বেশ করেছ। আমি বোকা, বোকাই থাকতে চাই, আমার যা ইচ্ছা তাই আমি বিশ্বাস করব। তবে তোমাকে আর জ্বালাতন করব না মালতী, প্রতিজ্ঞা করছি। তুমি আর টেরও পাবে না শ্যামল বলে কেউ এ জগতে আছে। সত্যি বলছি মালতী, কাল থেকে তুমি ধরে নিতে পারবে, আমি বেঁচে নেই।

তার মানে? এসব কি বলছ? কি করবে তুমি? শক্ত করিয়া শ্যামলের কজি চাপিয়া ধরিয়া বিস্ফারিত চোখে তার পাংশু মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে মালতী শিহরিয়া উঠিল, এই সব উদ্ভট মতলব জাগছে তোমার মাথায়। আমি আগেই জানতাম তুমি একটা ভীষণ কাণ্ড না করে থামবে না। তোমার মতো যারা ছেলেমানুষ হয়, চিরকাল তারাই লেকে ড়ুবে, সায়ানাইড খেয়ে জগতের ওপর শোধ নেয়–তোমার মতো যারা ভীরু আর কাপুরুষ!

আরো জোরে মালতী শ্যামলের হাত চাপিয়া ধরিয়া রাখিয়াছিল, ছাড়িয়া দিলেই সে যেন সঙ্গে সঙ্গে লেকে গিয়া ড়ুব দিবে অথবা কলেজের ল্যাবরেটরিতে গিয়া সায়ানাইড গিলিবে তোমায় একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোন। এই যে মতলব তুমি করেছ—আগে শুনে নাও আমার কথা—এর মানে তো এই যে আমি অন্যের হয়ে যাব, তুমি তা সহ্য করে বেঁচে থাকতে পারবে না? আমার। জন্যই মরবে তো তুমি? কিন্তু তুমি কি ভেবে দেখছ, আমাকেও তুমি কি ভাবে মেরে রেখে যাবে, এক মুহুর্তের জন্য আমি শান্তি পাব না? আমি কি করে বাঁচব বল তো? আমায় ভালবাস বলে তোমায় মরতে হবে আমাকে শাস্তি দিয়ে। একে ভালবাসা বলে নাকি? আমায় পেলে না বলে মরতে পারবে, আমার সুখের জন্য বেঁচে থাকার কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে না!

শ্যামল মৃদুস্বরে বলিয়াছিল, তা বলি নি মালতী। সায়ানাইড খাওয়ার কথা বলিনি। আমি বলছিলাম, আর তোমায় জ্বালাতন করব না, দূরে সরে যাব।

শুধু দূরে সরে যাবে?

হ্যাঁ, তোমায় আর বিরক্ত করব না।

ও!

মালতী নিশ্চিন্ত হইয়াছিল সন্দেহ নাই। মুখ দেখিয়া কিন্তু মনে হইয়াছিল সে যেন আহত হইয়াছে, অপমানও বোধ করিয়াছে। যাকে ছেলেমানুষ মনে করিয়া রাখা যায় তার কাছে ছেলেমানুষি করিয়া ফেলার লজ্জায় রাগও কি কম হয় মানুষের!

আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না মালতী!

মালতী চুপ করিয়া ছিল। শ্যামল তাকে বুঝিতে পারে না, রাজকুমার তাকে বুঝিতে পারে না, সে নারী, সে রহস্যময়ী। শ্যামল তাকে পূজা করে, রাজকুমার তাকে অবজ্ঞা করে, কারণ সে নারী, সে রহস্যময়ী, তাকে কেউ বুঝিতে পারে না।

আমার একটা কথা রাখবে মালতী?

অত ভূমিকা কোরো না। কি কথা?

একমাস বাইরে কোথাও ঘুরে আসবে?

তোমার সঙ্গে?

না। তুমি একা। কোনো আত্মীয়স্বজনের কাছে চলে যাও। পুণায় তোমার মাসিমার কাছে। অনায়াসে যেতে পার। যাবে?

তখন মালতীর মনে হইয়াছিল, শ্যামল যেন আর ছেলেমানুষ নাই, ছোট ছোট আবেগে নিজেকে সে খরচ করিয়া ফেলে না, কখন সে যেন পরিণত পুরুষ হইয়া গিয়াছে, ধীর সংযত আত্মপ্রতিষ্ঠ তেজী পুরুষ, বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ পুরুষ, হাসি কান্না আনন্দ বিষাদের রসজ্ঞ পাকা অভিনেতা। ঠিক কি অনুভূতি তখন তার জাগিয়াছিল আর আনুষঙ্গিক আরো কি সব কথা মনে হইয়াছিল পরে মালতী কোনোদিন স্মরণ করিতে পারে নাই। ওই কয়েক মুহূর্তের অভিজ্ঞতা শুধু তার মনে ছিল, নূতন চিন্তা আর অনুভূতির যেটা ফলাফল, পরবর্তী প্রক্রিয়া। সে অভিজ্ঞতা বড় অদ্ভুত। শ্যামল নিষ্ঠুর, রাজকুমারের চেয়ে নিষ্ঠুর। রাজকুমার কি নিষ্ঠুর? যাকে আপন করতে চাই সে ব্যথা দিবেই, প্রিয় নিষ্ঠুর হইবেই–কারণ জগতে কেউ আপন হয় না, কেউ প্রিয় থাকে না। চব্বিশ ঘণ্টা। একদিন রাজকুমার যখন শুধু তার চোখে চোখে চাহিয়াছিল, পলক না ফেলিয়া যতক্ষণ চাহিয়া থাকিবার ক্ষমতা মানুষের আছে ঠিক ততক্ষণ, মালতীর আর্তনাদ করিয়া ছুটিয়া পলাইয়া যাওয়ার ইচ্ছা হইয়াছিল। এ সহজ সুবোধ্য কথা। কোলের শিশুকেও তো মার মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর মনে হয়। কিন্তু গুরুজনের মতো তাকে শহর ছাড়িয়া দূরে কোথাও গিয়া থাকিতে উপদেশ দেওয়ার সময় শ্যামলকে দেখিবার কয়েকটি মুহূর্তে এ কি অভিজ্ঞতা তার জন্মিয়া গেল যে রাজকুমারের চেয়ে শ্যামলের নিষ্ঠুরতা গভীর ও মর্মান্তিক? তার আঙুলে গোলাপের কাটা ফুটিলে যে শ্যামলের মনে হয়তো লক্ষ কাঁটা ফোটার যন্ত্রণা হয়।

আমার ভালোর জন্য বলছ, তোমার কোনো স্বাৰ্থ নেই কেমন?

এবার শ্যামল চুপ করিয়া ছিল।

তুমি যাও শ্যামল। আমি বেরুব।

আমার সঙ্গেই চল?

তোমার সঙ্গে যাব না।

কখন ফিরবে?

তুমি আমায় পাগল করে দেবে। যেতে বলছি, যাও না?

যাচ্ছি মালতী!

যাচ্ছি বলিয়াও শ্যামল মিনিট দুই দাঁড়াইয়া ছিল।

আর আসব না তো?

তার মানে?

তুমি যদি সত্যি বারণ কর, তা হলে আর আসব না।

মালতী হতাশভাবে এতক্ষণ পরে বসিয়া পড়িয়ছিল।

তোমার সঙ্গে সত্যি পারলাম না শ্যামল। কি যে করি তোমাকে নিয়ে আমি! আমি জানি তুমি একটা ছুতো খুঁজছ, নাটক করার মতো খুব উচ্ছ্বসিতভাবে আমি সত্যি সত্যি তোমাকে আসতে বারণ করব, তুমিও আমার হৃদয়হীনতায় আহত হয়ে চলে যাবে, আর আসবে না। প্রথমদিন। ভাববে আমি রক্তমাংসের মানুষ নই, পরদিন ভাববে আমি মাটি, পরদিন পাথর, পরদিন লোহা, পরদিন ইস্পাত বেশ মজা হবে, না? সব ব্যাপারকে একেবারে চরমে না তুললে কি তোমার চলে না? তুমি জান ওভাবে তোমাকে আমি যেতে বলতে পারি না। তুমি বোধহয় ভাব যে মেয়েরা যার সঙ্গে লভে পড়ে তাকে ছাড়া সকলের মনে কষ্ট দিয়ে সুখ পায়?

আর কিছু বলতে হবে না মালতী। আমি যাচ্ছি।

শোন। তোমাকে কয়েকটা কথা বুঝিয়ে বলা দরকার। আজ আমার সময় নেই, ক্ষমতাও নেই। কাল সন্ধ্যার পর একবার এস।

আমাকে আর কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে না, মালতী!

হবে। সব কথায় কথা বাড়াও কেন? কাল এস।

না এলে তুমি দুঃখিত হবে?

শ্যামল! ফের যদি তুমি আমার সঙ্গে এমনি কর কোনোদিন তোমার সঙ্গে কথা কইব না।

তারপর শ্যামল চলিয়া গেলে এমন শ্ৰান্ত, উদ্ভ্রান্ত আর অসহায় মনে হইয়াছিল নিজেকে, আধ ঘণ্টা মালতী চোখ বুজিয়া বিছানায় পড়িয়া ছিল। এখন আবার রাজকুমারের সঙ্গে বোঝাপড়া বাকি আছে। শেষ বোঝাপড়ার কি আছে, কিছুই সে জানে না। কিন্তু আর তার সহ্য হয় না। এই অনির্দিষ্ট অসহ-হওয়ার প্রতিকার চাই। এ ভাবে আর চলে না, চলিতে পারে না। হয় রাজকুমার তাকে লইয়া যাক সমুদ্রতীরের কোনো বন্দরে, পাহাড়ের মাথায় কোনো শহরে, মাঠের ধারের কোনো গ্রামে, সেখানে সন্ধ্যা হইতে তাকে বুকে তুলিয়া এত জোরে পিষিতে থাক যেন শেষ রাত্রে তার দম আটকাইয়া যায়, নয়তো তাকেই অনুরোধ করুক জোরে তার গলা জড়াইয়া ধরিতে যাতে আর রাজকুমার নিশ্বাস নিতে না পারে। তার দুর্বোধ্য অর্থহীন যন্ত্রণার মতো এইরকম খাপছাড়া ভয়ানক কিছু ঘটুক।

রাজকুমার প্রতীক্ষা করিয়া আছে, সে যাচিয়া দেখা করিতে চাহিয়াছে বলিয়া রাজকুমার তার জন্য রাস্তার ধারে একটা বিলিতি দোকানের লাল বাড়ির সামনে গাড়িবারান্দার নিচে ফুটপাতে দাঁড়াইয়া তার প্রতীক্ষা করিতেছে, ক্ৰমাগত এই কথাটা মনে পড়িতে পড়িতে মালতীর মস্তিষ্কে। উদ্ভ্রান্ত চিন্তার পাক-খাওয়া কমিয়া আসিল। জীবনে মালতী একবার নাগরদোলায় চড়িয়াছিল, দশ-এগার বছর বয়সে। তার দুর্দশা পৌঁছিয়াছিল সেই সীমায় যার পরেই মূৰ্হা গিয়া পড়িয়া যাইতে হয়। উঠিয়া জামাকাপড় বদলানোর সময় আজ তার মনে হইতে লাগিল, এইমাত্র সে যেন নাগরদোলা হইতে নামিয়া আসিয়াছে। সে জানিত না, সম্প্রতি রাজকুমারেরও একদিন এই রকম মনে হইয়াছিল।

রাজকুমার বলিল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছিলাম মালতী, দেখতে দেখতে একটা অন্যায় করে ফেলেছি।

সে কি?

এদিক থেকে একজন মহিলা আসছিলেন, সামনে দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাবেন। যখন কাছাকাছি এলেন, আমি বুঝতে পারলাম তিনি আশা করছেন আমি একটু পিছু হটে তাকে পাশ কাটাবার আরেকটু জায়গা দেব। ভদ্রতা করে এক পা পিছু হটতে গিয়ে আরেকজনের পা মাড়িয়ে দিলাম, ছোটখাটো একটু ধাক্কাও লাগল। যার পা মাড়িয়ে দিলাম তিনি ঠিক মহিলা নন, কমবয়সী একটি বিদেশী মেয়ে।

তারপর?

ঘুরে দাঁড়িয়ে বুঝলাম অন্তত গালে একটা চড় সে মারবেই। আমি অ্যাপলজি পর্যন্ত চাইলাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কুড়ি কি বাইশ সেকেন্ড। তারপর হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে সে চলতে আরম্ভ করল। কি বলে গেল জান?—সরি।

তারপর?

তারপর আবার কি?

তোমার চোখের দিকে কুড়ি-বাইশ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেই মেয়েটার রাগ জল হয়ে গেল কেন বুঝিয়ে বলবে না? ওটাই তো আসল কথা–গল্পের মরাল। আচ্ছা আমিই বলছি শোন। ভুল হলে করেক্ট করবে। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পেরেছিল, মানুষ ভালো, মানুষ কখনো অন্যায় করে না, সমস্ত অন্যায় আপনি ঘটে যায় ওগুলি জীবনের অ্যাসিডেন্ট। ঠিক হয় নি?

মালতী আজ রাজকুমারকে খোঁচা দিয়াছে, ব্যঙ্গ করিয়াছে। মালতীর পক্ষে এটা একেবারে অসম্ভব বলিয়া জানিত কিনা রাজকুমার, তাই অনেকদিন পরে আজ ভালো করিয়া তার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল-—মুখের ভাব না দেখিয়া কোনো কথার মানে বোঝা যায় না অনেক সময়। শহরের শৌখিন প্ৰান্তর ডিঙাইয়া শেষ বেলার রোদ তাদের গায়ে আসিয়া পড়িয়াছে, তাপের চেয়ে সে রোদের রং বেশি। মালতীর বিবৰ্ণ মুখে সত্যই তার কথার ব্যাখ্যা ছিল।

রাজকুমার জিজ্ঞাসা করিল, তোমার কি অসুখ করেছে?

না। অসুখ করে নি।

বাড়িতে না ডেকে এখানে আমাকে অপেক্ষা করতে বললে কেন মালতী?

বাড়ির বাইরে তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হল তাই। হয় নিজের বাড়িতে নয় অন্য কারো বাড়িতে তোমার সঙ্গে এতদিন কথা বলেছি। আমায় একদিন সিনেমায় পর্যন্ত তুমি নিয়ে যাও নি আজ পর্যন্ত।

রাজকুমার একটু ভাবিল।

সাড়ে ছটার সময় স্যার কে. এল-এর সঙ্গে দেখা করতে হবে। পিওন দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এমন করে লিখেছেন দেখা করার জন্য, একটা কিছু গোলমাল হয়েছে মনে হচ্ছে। স্যার কে. এল-কে ফোন করে দিই, সাড়ে নটার সময় বাড়ি গিয়ে দেখা করব। তারপর সিনেমায় যাবে তো চল।

না। আগে দেখা করে হাঙ্গামা চুকিয়ে এস।

তুমি এতক্ষণ কি করবে?

আমিঃ এক কাজ করা যাক, হোটেলে একটা রুম নাও। তুমি স্যার কে. এল-এর সঙ্গে দেখা করতে যাবে, আমি বিশ্রাম করব—শুয়ে থাকব একটু।

তুমি লক্ষ্মী মেয়ে, মালতী!

ছেলেমানুষ নই?

আগে ছিলে, এখন কি আর তোমায় ছেলেমানুষ বলা যায়? তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ মালতী! আজ থেকে তুমি সুখী হবে।

শুনিয়া মালতীর ভয় করিতে থাকে। সুখ-দুঃখের কথা সে কখনো ভাবে নাই। সুখে অথবা দুঃখে কোনোদিন তার সচেতন হইতে খেয়াল থাকে নাই আমি সুখী অথবা আমি দুঃখী। নিজের সম্বন্ধে নিজের বিচারে এই হিসাবটা তার চিরদিন বাদ পড়িয়াছে। একটা অজানা মধ্যবিত্ত ফিরিঙ্গি হোটেলের একটি ঘরে তাকে রাখিয়া রাজকুমার স্যার কে. এল-এর সঙ্গে দেখা করিতে চলিয়া গেলে নিজেকে মালতীর বড় অসহায় মনে হইতে থাকে। অপরিচিত আবেষ্টনীতে নিজেকে একা মনে করিয়া নয়, বাঁচিয়া থাকার মতো সহজ স্বাভাবিক ব্যাপারটা হঠাৎ অতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে বলিয়া। তার নিজের একটা জীবন আছে, জীবন যাপনের কঠিন আর জটিল কৰ্তব্য তাকে পালন করিতে হইবে, কিন্তু সে কিছুই জানে না, কিছুই বোঝে না। তার বুদ্ধি নাই, সাহস নাই, অভিজ্ঞতা নাই। রাজকুমার যাই বলুক, সে সত্যই ছেলেমানুষ, এতকাল শুধু ছেলেখেলা করিয়াছে, ছেলেখেলা করা ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা তার নাই। জীবন তো ছেলেখেলার ব্যাপার নয়!

হোটেলটি বড় রাস্তা হইতে খানিকটা তফাতে, পথের শব্দ কানে আসে না। হোটলটিও ছোট এবং প্রায় নিঃশব্দ। হোটেলের লোক খাটে দুজনের বিছানায় ফর্সা চাদর পাতিয়া পাশাপাশি দুটি করিয়া বালিশ রাখিয়া গিয়াছে। ছোট গোল চায়ের টেবিলের দুদিকে দুখানা চেয়ার! চারটি বড় বড় জানালায় এমন কৌশলে পর্দা দেওয়া যে ঘরের মধ্যে আলো আসে কিন্তু মানুষের দৃষ্টি আসে না। দেয়াল যেন সবুজ রঙে গম্ভীর হইয়া আছে। ড্রেসিং টেবিলে প্রসাধনের আয়োজনের অভাব মালতীর অসম্পূর্ণতার অনুভূতিকে জোরালো করিয়া তোলে। আয়নায় যে মালতীকে দেখা যায় তাকে মালতীর মনে হয় অন্য একটি মেয়ে।

শেষ মুহূর্তে রাজকুমার মালতীকে একা রাখিয়া স্যার কে. এল-এর সঙ্গে দেখা করিতে যাওয়ার ব্যবস্থাটা বাতিল করিয়া দিতে চাহিয়াছিল, মালতী রাজি হয় নাই।

না, সব হাঙ্গামা চুকিয়ে দিয়ে এস। আমার সঙ্গে কথা বলবে, আর মনে মনে ভাববে রিণির বাবা কি জন্যে ডেকে পাঠিয়েছেন, আমার তা সইবে না।

তা ভাবব না মালতী! ওটুকু মনের জোর আমার আছে।

মনের জোরের কথা নয়।

রাজকুমার চলিয়া যাওয়ার পর, আধ ঘণ্টার মধ্যে মালতী অস্থির হইয়া উঠিল। সময় যে এত শ্লথ, শুইয়া বসিয়া ঘরের মধ্যে পাক দিয়া আর ক্রমাগত কজিতে বাধা ঘড়িটির দিকে চাহিয়া সময়কে যে কিছুতেই তাড়াতাড়ি পিছনে ঠেলিয়া দেওয়া যায় না, আজ যেন সে তা জানতে পারিল প্রথম। অথচ মনে মনে সে কামনা করিতে লাগিল, রাজকুমারের ফিরিতে যেন দেরি হয়। অনেক দেরি হয়।

ফিরিয়া আসিতে রাজকুমারের সত্যই দেরি হইয়া গেল।

স্যার কে. এল-এর অফিস বেশি দূরে নয়, ট্যাক্সিতে পৌঁছিতে রাজকুমারের পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি সময় লাগিল না। আপিসের লোকজন অধিকাংশই চলিয়া গিয়াছে, কেবল তিনজন কেরানি তখনন ঘাড় গুজিয়া কাজ করিতেছে। নিজের ঘরে স্যার কে. এল পাইপ কামড়াইয়া খোলা জানালার কাছে দাঁড়াইয়াছিলেন আর ঘরের কোণে টাইপরাইটারের সামনে চুপচাপ বসিয়াছিল কুদ্ধ ও বিরক্ত একটি ফিরিঙ্গি মেয়ে। বয়স তার রিণির চেয়ে হয়তো বেশি নয়, কিন্তু মুখে অনেক বেশি বয়সের ছাপ।

বস রাজু।

স্যার কে. এল নিজেই বসিলেন।

তুমি এখনো যাও নি যে মিস রেড্‌ল?

স্যার কে. এল নিজেই তাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়াছিলেন, মনে ছিল না। মিস রেড়ল চলিয়া গেলে রাজকুমারের দিকে চাহিয়া ক্ষীণভাবে একটু হাসিবার চেষ্টা করিলেন, একটা চিঠি টাইপ করাব বলে ওয়েট করতে বলেছি, এক ঘণ্টার বেশি চুপচাপ ওয়েট করছে! একবার যে মনে করিয়ে দেবে সেটুকু সাহস নেই। খাঁটি ইংরেজ মেয়ে হলে, ইংরেজ কেন, বাঙালি মেয়ে হলে, কখন খেয়াল করিয়ে দিত, চিঠিও টাইপ করানো হত আমার। যাকগে।

মুখে যাকগে বলিলেও বাজে চিন্তাগুলিকে যাইতে দিয়া সহজে কাজের কথা কিন্তু তিনি আরম্ভ করিতে পারেন না। এক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া আবার বলিতে আরম্ভ করেন তার এক দুঃসাহসী টাইপিস্টের কথা, মাসের শেষে যে ওভারটাইম চার্জ করিয়া তার কাছে বিল পাঠাইয়াছিল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে অবশ্য বিদায় দেওয়া হইয়াছিল কিন্তু সেটা তার দুঃসাহসের জন্য নয়।

নিজের পাওনা বুঝে নেবার সাহস সকলের থাকবে, আমি তাই পছন্দ করি রাজু। তুমি তো জান আমাকে জান না? আমার প্রিন্সিপাল হল, কারো ওপর অন্যায় না করা। তাই বলে অভদ্রতাকে তো প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। আমি তাকে আপিস টাইমের পর থাকতে হুকুম দিই নি, অনুরোধ করেছিলাম। একেবারে বিল না পাঠিয়ে সেও যদি আমাকে যাকগে।

রাজকুমার বুঝিতে পারে যে ব্যাপার সহজ নয়। এতক্ষণ স্যার কে. এল শুধু অন্যমনস্ক হইয়াছিলেন, দরকারি চিঠি টাইপ করানোর জন্য টাইপিস্ট বসাইয়া রাখিয়া তার উপস্থিতি পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন, তাকে দেখিয়া এখন ভয়ানক বিচলিত হইয়া পড়িয়াছেন এবং প্রাণপণে সেটা দমন করার চেষ্টা করিতেছেন। নিজেকে একটু আয়ত্তে না আনিয়া আলোচনা আরম্ভ করিবার সাহস তাঁর হইতেছে না। তাকে এমন কি বলার থাকিতে পারে রিণির বাবার যা বলা তার পক্ষে এত কঠিন? রিণির মধ্যস্থতায় তার সঙ্গে স্যার কে. এল-এর পরিচয়, ইদানীং কেবল সে পরিচয় একটু ঘনিষ্ঠ হইয়াছে, বয়স হইতে শুরু করিয়া অর্থ সম্মান শিক্ষাদান চালচলনের পার্থক্য সত্ত্বেও পরস্পরের মধ্যে বিশ্বাস ও সহানুভূতির একটা যোগাযোগ গড়িয়া উঠিয়াছে, এই মাত্র। স্যার কে. এল-এর জীবনে কোনো অঘটন ঘটার সঙ্গে তার সম্পর্ক কি?

হঠাৎ রাজকুমারের মনে হয়, যা ঘটিয়াছে সেটা স্যার কে. এল-এর ব্যক্তিগত কিছু নয়, কেন্দ্র নিশ্চয় রিণি। নিজের জীবনে স্যার কে. এল-এর এমন কিছু ঘটতে পারে না তাকে যা না বলিলে তাঁর চলে না এবং বলিতে গিয়া এমন নার্ভাস হইয়া পড়িতে হয়। কিন্তু রিণিঃ কি হইয়াছে রিণির?

রিণি কেমন আছে? অনেকদিন দেখা হয় নি রিণির সঙ্গে।

রিণিও তাই বলছিল। তুমি আর যাও না?

রাজকুমার একটু অস্বস্তির সঙ্গে স্যার কে. এল-এর মুখের দিকে তাকায়। রিণির কথা তোলামাত্র তাঁর মুখ গম্ভীর হইয়া গিয়াছে, অতি ধীরে ধীরে তিনি কাগজকাটা ছুরির ডগা দিয়া রেখা আঁকিয়া চলিয়াছেন ব্লটিং প্যাডের একপ্রান্ত হইতে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত। তাঁর কথা, ভঙ্গি ও মুখের ভাবের কোনো মানেই রাজকুমার বুঝিতে পারে না। রিণি কি স্যার কে. এল-এর কাছে তার সেই অভদ্র অনুরোধের কথা বলিয়া দিয়াছে? স্যার কে. এল কি সেইজন্য তাকে ডাকিয়া পঠাইয়াছেন? কিন্তু সে যখন আর রিণিকে বিরক্ত করিতে যায় না, গায়ে পড়িয়া তাকে আপিসে ডাকিয়া পঠাইয়া সে কথা তুলিবার তো কোনো অর্থ হয় না।

পরশু রিণি আমাকে সব বলেছে রাজু।

রাজকুমার চুপ করিয়া বসিয়া থাকে। রিণি সব বলিয়াছে। ভালো কথা। স্যার কে, এল তাকে কি বুলিবেন? উপদেশ দিবেন? গালাগালি? লজ্জা, ভয়, আফসোস কিছুই রাজকুমার বোধ করে না, রিণির উপর রাগও হয় না। রিণির মন তার অজানা নয়। সে মনে কত খেয়াল, কত ঝোঁক, কত জিদ, আর কত আত্মপীড়নের পিপাসা আছে সে তার পরিচয় রাখে। এরকম মন যাদের হয়, জীবনকে জটিল করাই তাদের ধর্ম। কোনোদিন যদি অসাধারণ কিছু ঘটে জীবনে, সেই ঘটনার জের টানিয়া চলিতে চায় সারা জীবন, প্রেমে অথবা বিদ্বেষে সমাপ্তিতে অস্বীকার করিতে চায়, কারণ, আগেই অতিরিক্ত মূল্য দিয়া ফেলায় শেষ হইতে দিলেই এখন তাদের লোকসান।

বন্ধু একদিন তার অনাবৃত দেহ দেখিতে চাহিয়াছিল, একি রিণি ভুলিতে পারে অথবা বন্ধুর সঙ্গে শুধু সম্পর্ক চুকাইয়া দিয়াই এমন একটা ব্যাপারকে শেষ হইতে দিতে পারে! স্যার কে. এল রাজকুমারকে পছন্দ করেন? রাজকুমার যে কি ভয়ানক মানুষ তার প্রমাণ দিয়া বাপের ধারণার নাটকীয় পরিবর্তন না ঘটাইয়া রিণি থাকিতে পারিবে কেন? রাজকুমারের প্রতি স্যার কে. এল-এর ক্রোধ ও বিদ্বেষ জাগিবে, অতীতে বিলীন হইয়া যাওয়ার বদলে জের টানা চলিতে থাকিবে রাজকুমারের অসভ্যতার, রিণির হৃদয় মনে নূতন করিয়া ছোঁয়াচ লাগিবে উত্তেজনার। আগে হয়তো রাজকুমারের জ্বালা বোধ হইত, গিরির হাতটানার ব্যাপারে যেমন হইয়াছিল। এখন সে রিণির জন্য মমতাই বোধ করে। নিজের জন্য অকারণে যন্ত্রণা সৃষ্টি করার এই নেশা চিরদিন মেয়েটার জীবনে অভিশাপ হইয়া থাকিবে।

তোমার সম্বন্ধে আমার অন্য ধারণা ছিল, রাজু। আমার একটা অহঙ্কার আছে, আমি মানুষ চিনতে পারি। এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, তোমার সম্বন্ধে ভুল করেছিলাম, তুমি এত বড় রাস্কেল। সোজাসুজি কয়েকটা কথা আলোচনা করার জন্য তোমাকে তাই ডেকে পাঠিয়েছি।

আলোচনা করে লাভ কি হবে?

রিণি আমার মেয়ে রাজু। আমার আর ছেলেমেয়ে নেই!

এ কথাটা কেন বললেন বুঝতে পারছি না।

স্যার কে. এল পাইপটা মুখে তুলিয়া কামড়াইয়া ধরিলেন, তারপর আবার নামাইয়া রাখিলেন।

তুমি সব অস্বীকার করতে চাও?

না, অস্বীকার করতে চাই না। রিণির সঙ্গে অভদ্রতা করেছি, কিন্তু আমার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না। আমার কি উদ্দেশ্য ছিল বলে লাভ নেই। আপনি বুঝতে পারবেন না, বিশ্বাসও করবেন না।

অভদ্রতা! কি বলছ তুমি?

রাজকুমার কিছুই বলিল না। রিণির সঙ্গে তার ব্যবহারের সংজ্ঞা লইয়া কি স্যার কে. এল তর্ক করিতে চান? বলিতে চান ওটা অভদ্রতার চেয়ে আরো খারাপ কিছু?

ফাঁসির ভয় না থাকলে তোমায় আমি খুন করতাম রাজু। তুমি রিণির যা ক্ষতি করেছ সে জন্য নয়, তোমার এই মনোভাবের জন্য। রিণির কাছে সব শুনেও তোমায় আমি একা দোষী করি নি। রিণি ছেলেমানুষ নয়, তারও উচিত ছিল নিজেকে বাঁচিয়ে চলা। দুদিন ধরে আমি ক্রমাগত নিজেকে কি বুঝিয়েছি জান? কেবল তুমি আর রিণি নও, আরো অনেক ছেলেমেয়ে এ রকম ভুল করেছে, রিণি আমার মেয়ে বলেই আমার মাথা খারাপ করলে চলবে না, ভুল করলে চলবে না। রিণিকে তুমি বিয়ে করবে কিনা, না করলে কেন করবে না, খোলাখুলিভাবেই এই কথা জিজ্ঞেস করব বলে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু এক বছর একটি মেয়ের সঙ্গে খেলা করা যখন তোমার কাছে শুধু অভদ্রতা, তোমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই না। তোমাকে বলা বৃথা, তবু বলছি, যদি পার সুইসাইড কোরো। তোমার মতো মন নিয়ে কারো বেঁচে থাকা উচিত নয়। আচ্ছা, এবার তুমি যাও রাজু।

কথা বলিতে রাজকুমারের সাহস হইতেছিল না। রিণি সব বলিয়াছে যা ঘটে নাই, যা ঘটিতে পারিত না। কিছুই বলিতে বাকি রাখে নাই! কেন বলিয়াছে? কি চায় রিণি? তার উদ্দেশ্য কি? যতই বিকার থাক মনে, রিণি তো পাগল নয়। তাকে জড়াইয়া বাপের কাছে এই অদ্ভুত অকথ্য কাহিনী সে বলিতে গেল কেন? তাকে সে পাইতে চায়, বিবাহের মধ্যে, চিরদিনের জন্য? কিন্তু তাকে পাওয়ার জন্য এই উদ্ভট উপায় অবলম্বন করিবে কেন? রিণি তো কোনোদিন জানিতেও দেয় নাই, তাকে তার চাই।

যদি ধরা যায় তখন রিণিও নিজেকে জানি না, সেদিনকার রাগারাগির পর এতদিনের অদর্শনে তার খেয়াল হইয়াছে, নিজেই তাকে ক্ষমা করিয়া তাকে তো সে কাছে ডাকিতে পারি, চেষ্টা করিতে পারিত তাকে জয় করার। এই চেষ্টা ব্যর্থ হইলে, তাকে পাওয়ার আর কোনো উপায় খুঁজিয়া না পাইলে রিণি যদি এই পাগলামি করিত, তার একটা মানে বোঝা যাইত।

তোমায় যেতে বলেছি রাজু।

কাল আমি একবার রিশি সঙ্গে দেখা করতে চাই।

স্যার কে. এল সন্দিগ্ধভাবে বলিলেন, কেন?

রাজকুমার উঠিয়া দাঁড়াইল। আপনার সঙ্গে কথা বলার আগে রিণির সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার। এমন তো হতে পারে, আপনি সব কথা জানেন না, রিণি আপনাকে সব বলতে পারে নি? আপনি ধরে নিন, রিণি আর আমার মধ্যে কয়েকটা ভুল বোঝা আছে, ধরে নিয়ে কাল তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিন।

ব্লটিং প্যাডের দিকে চাহিয়া স্যার কে. এল চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন।

একটু অপেক্ষা করিয়া রাজকুমারও নীরবে বাহির হইয়া গেল।

পথে নামিয়া মালতীর কাছে তাড়াতাড়ি ফিরিয়া যাওয়ার জন্য রাজকুমার ট্যাক্সি ডাকিল না, ধীরে ধীরে হটিয়া চলিতে লাগিল। দেহে মনে সুন্দর সরসীকে আশ্ৰয় করিয়া সে যে আনন্দের জগতে উঠিয়া গিয়াছিল, সেখান হইতে আবার মাটিতে নামিয়া আসিতে হইয়াছে। চলিতে চলিতে রাজকুমারের মনে হয় সে কি সত্যই কিছু পাইয়াছিল, আনন্দ অথবা শান্তি? এখন তো তার মনে হইতেছে, কয়েকটা দিন সে শুধু অন্যমনস্ক হইয়া থাকিবার সুযোগ পাইছিল।


© 2024 পুরনো বই