সোনার চাকতির নকশা

সোনার চাকতির নকশা

জয়ন্ত বুদ্ধমূর্তির দিকে স্থিরদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল৷ কিন্তু তার ভিতর থেকে কোনোরকম বিশেষত্বই আবিষ্কার করতে পারলে না৷ এ ধরনের লক্ষ লক্ষ বুদ্ধমূর্তি এশিয়ায় সর্বত্রই পাওয়া যায়৷

মূর্তির ভাঙা মাথাটি দেহের উপরে আলতো ভাবে লাগিয়ে জয়ন্ত বুদ্ধদেবকে আবার টেবিলের উপর বসিয়ে দিলে৷ তারপরে যেন আপন মনেই মৃদুকন্ঠে বললে, ‘হত্যাকারী এই মূর্তিই চুরি করতে এসেছিল? কিন্তু হিংসার সঙ্গে এই মূর্তিমান অহিংসার সম্পর্ক কী?’

মানিক বললে, ‘হয়তো বিশেষ কোনো কারণে ওই মূর্তিকে কেউ এমন পবিত্র মনে করে যে, ওকে হস্তগত করবার জন্যে সে নরহত্যা করতেও সংকুচিত নয়!’

জয়ন্ত বললে, ‘এর উত্তরে দু-টি কথা বলা যায়৷ প্রথমত বুদ্ধের প্রতি এতটা অতি-ভক্তি থাকা সম্ভব কেবল গোঁড়া বৌদ্ধের৷ কিন্তু কলকাতায় এমন ভীষণ প্রকৃতির বৌদ্ধ আছে বলে মনে হয় না৷ দ্বিতীয়ত কাশীধামে কাক মরলে কামরূপে কেউ হাহাকার করে না৷ কাম্বোডিয়ার অজানা জঙ্গলে কুড়িয়ে পাওয়া সাধারণ বুদ্ধমূর্তি, তার জন্যে কলকাতার কোনো বৌদ্ধের এতটা নাড়ির টান হবে কেন? এর চেয়ে ঢের মূল্যবান আর অসাধারণ পুরোনো বুদ্ধমূর্তি কত লোকের ঘরে ঘরে রয়েছে, তাদের জন্যে তো কোনো বৌদ্ধের মাথাব্যথা হয় না! না মানিক৷ এ ব্যাপারের মধ্যে অন্য রহস্য আছে৷’

মানিক বললে, ‘দেশে লক্ষ লক্ষ কালীর প্রতিমা আছে, তাদের জন্যে ভক্তরা তেমন পাগল হয় না৷ কিন্তু শুনতে পাই, কোনো কোনো কালীর মূর্তি নাকি জাগ্রত, তাই তাদের জন্যে অনেক ভক্ত প্রাণ নিতে বা দিতে প্রস্তুত৷ কে বলতে পারে, এই বুদ্ধমূর্তিরও তেমন কোনো খ্যাতি আছে কি না?’

জয়ন্ত বললে, ‘থাকতে পারে৷ কিন্তু সে খ্যাতির কথা কাম্বোডিয়ার দুর্ভেদ্য জঙ্গলের ভিতর থেকে কলকাতায় আসবে কেমন করে ?’

এতক্ষণ অমলবাবু চুপ করে খুব মন দিয়ে জয়ন্ত ও মানিকের কথাবার্তা শুনছিলেন৷ এখন তিনি বললেন, ‘জয়ন্তবাবু, আমার মনে হচ্ছে, মূর্তিটি কেমন করে আমরা পেয়েছিলুম, সে গল্পটাও আপনাদের কাছে বলা উচিত৷ হয়তো তাহলেই আপনাদের কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সহজ হবে৷’

জয়ন্ত একখানা চেয়ার টেনে বসে পড়ে বললে, ‘বলুন৷ আমরা গল্প শুনতে ভালোবাসি৷’

অমলবাবু আর কোনোরকম ভূমিকা না করেই বলতে লাগলেন:

‘বহুদিন থেকেই আমি কাম্বোডিয়ার ওঙ্কারধামের (ইংরেজিতে Angkor Thom) কথা শুনে আসছি৷ তাই মাস কয়েক আগে আমি যখন সুরেনবাবুর কাছে প্রাচীন হিন্দুদের এই বিরাট কীর্তিমন্দির দেখতে যাবার প্রস্তাব করলুম, তখন তিনিও খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন৷

‘কিন্তু আমরা তো সাধারণ ভ্রমণকারী নই, আমরা হচ্ছি প্রত্নতাত্ত্বিক৷ আমাদের অন্য উচ্চাকাঙ্খাও ছিল৷ শুনেছি, ওঙ্কারধামের চারিদিককার গভীর অরণ্যের মধ্যে এমন আরও অনেক হিন্দুকীর্তি আছে, যা এখনও আবিস্কৃত হয়নি৷ আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, তাদের সন্ধান নেওয়া৷

‘যথাসময়ে যাত্রা করলুম৷ তারপর সাগর, নগর ও অরণ্য পার হয়ে কী করে ওঙ্কারধামের আকাশছোঁয়া ও দৃষ্টিসীমা-ছাড়ানো ধ্বংসস্তূপের পরিত্যক্ত বিজন বিরাটতার ছায়ায় এসে দাঁড়ালুম, সে সব কথা এখানে বলবার দরকার নেই৷

‘গৌরবময় অতীতের এই মূর্তিমান মৃত্যুনিসাড় দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে একদিন আমি আর সুরেনবাবু সবিস্ময়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময়ে শুনতে পেলাম পাশের ভাঙা মন্দিরের ভিতরে কে কাতর আর্তনাদ করছে!

‘মন্দিরের মধ্যে ঢুকে দেখলুম, একদিকে একজন বর্মি ফুঙ্গি বা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী শুয়ে প্রায় অচেতন অবস্থায় ছটফট ও আর্তনাদ করছেন৷ তাঁর গায়ে হাত দিয়ে দেখলুম, জ্বরে গা যেন পুড়ে যাচ্ছে৷

‘সুরেনবাবু চিকিৎসাশাস্ত্র জানতেন, তাঁর সঙ্গে ঔষধের বাক্স ছিল৷ চিকিৎসার গুণে দু-দিন পরে সন্ন্যাসীর অসুখ কিছু কমল৷ তাঁর মুখে শুনলুম, তিনি ওঙ্কারধামে বেড়াতে এসে এই বিপদে পড়েছেন৷ কেবল ওঙ্কারধাম নয়, ইতিমধ্যে এখানকার গহন বনের ভিতরে অদৃশ্য, অনেক অজানা বিস্ময় তিনি দেখে এসেছেন৷

‘সন্ন্যাসীর কাছ থেকে নতুন তথ্য জানতে পারা যাবে বুঝে আমরা প্রাণপণে তাঁর চিকিৎসা ও সেবা করতে লাগলুম৷ কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না, হপ্তা খানেক পরে তাঁর অবস্থা একেবারে খারাপ হয়ে পড়ল৷

‘সুরেনবাবু হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, আর কোনো আশা নেই৷ আজকের রাত বোধ হয় কাটবে না৷

‘গভীর রাত্রে সন্ন্যাসী আচ্ছন্নের মতো বললেন, সুরেনবাবু, আমার কাছে সরে এসো৷

‘সুরেনবাবু তাঁর মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললেন আদেশ করুন৷

‘সন্ন্যাসী খুব ক্ষীণস্বরে বললেন, সুরেনবাবু, তুমি আর তোমার বন্ধু আমার জন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করেছ৷ কিন্তু আমি আর বাঁচব না৷ মরবার আগে আমি তোমাদের পুরস্কার দিয়ে যেতে চাই৷

‘সুরেনবাবু বললেন, পুরস্কারের লোভে আমরা আপনার সেবা করিনি৷

‘-সে কথা আমি জানি৷ সেই জন্যেই তোমাদের পুরস্কার দিতে চাই, তোমাদের সেবার ঋণ নিয়ে মরব কেন? কিন্তু যে পুরস্কার তোমাদের দেব তা বড়ো সাধারণ পুরস্কার নয়, এর জন্যে পৃথিবীর যেকোনো সম্রাটও লালায়িত হতে পারে৷ তবে এ পুরস্কার লাভ করবার আগে তোমাদের এক কাজ করতে হবে৷

‘সুরেনবাবু বললেন, কী কাজ?

‘-তোমাদের সঙ্গে দেখছি ইন আর চ্যান রয়েছে৷ ওদের কালকেই বিদায় করে দিয়ো৷

‘সুরেনবাবু সবিস্ময়ে বললেন, কেন?

‘-ওরা ভালো লোক নয়৷ ওরা সঙ্গে থাকলে তোমরা বিপদে পড়বে৷

‘আমাদের দলে জন-বারো কুলি ছিল৷ চ্যান হচ্ছে তাদের সর্দার৷ ইন হচ্ছে আমাদের পথপ্রদর্শক৷ এরা যে অকারণে কেন আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করতে চাইবে, তার কোনো হদিস খুঁজে পেলুম না৷

‘সন্ন্যাসীর কথা কইতে কষ্ট হচ্ছিল৷ তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, সুরেনবাবু, আমি বুঝতে পারছি আমার শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে৷ এখন আমি যা বলব, খুব মন দিয়ে শোনো৷ এখানে উত্তর-পশ্চিম দিকে একটা ভাঙা হাতির মূর্তি আছে৷ তার ওপাশে একটা সরু পথ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গিয়েছে৷ সেই পথ ধরে তোমরা অগ্রসর হবে৷ যেখানে পথ নেই, সেইখানে জঙ্গলের ভিতরে পথ করে নেবে-কিন্তু সাবধান, উত্তর-পশ্চিম দিক ছাড়া আর কোনো দিকে যেয়ো না৷ দু-দিন পরে প্রকাণ্ড এক প্রান্তরে গিয়ে পড়বে৷ তারপর-এই পর্যন্ত বলবার পরেই সন্ন্যাসীর গলা থেকে ক্রমাগত হেঁচকি উঠতে লাগল৷

‘খানিকক্ষণ পরে সেই অবস্থাতেই থেমে সন্ন্যাসী বললেন, তারপর সেই প্রান্তরের ভিতরে দেখবে চারিদিকে পাথরে বাঁধানো একটি পুষ্করিণী৷ তার এক কোণ থেকে পশ্চিমমুখো একটি রাস্তা আছে৷ সেই রাস্তার শেষে আছে একটি প্রকাণ্ড মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ৷ প্রধান মন্দিরের চারিকোণে আরও চারটি ছোটো ছোটো ভাঙা মন্দিরও আছে!

‘সন্ন্যাসীর হাঁপ ও হেঁচকি আরও বেড়ে উঠল৷ কিন্তু আমাদের আগ্রহ তখন জেগে উঠেছে, বারংবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলুম, তারপর-তারপর?

‘কিছুক্ষণ পরে অতি কষ্টে তিনি বললেন, বড়ো মন্দিরের মাঝখানে একটি বেদি আছে৷ তার উপরে আছে ছোটো একটি বুদ্ধমূর্তি৷ তোমরা সেই মূর্তিকে তুলে নিয়ে-সন্ন্যাসী আবার থেমে গেলেন, তাঁর দুই চোখ মুদে এল৷

‘সুরেনবাবু তাঁর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘তারপর আমরা কী করব?

‘কিন্তু সে কথা সন্ন্যাসী শুনতে পেলেন বলে মনে হল না৷ যেন নিজের মনেই অস্ফুট স্বরে তিনি বললেন, পদ্মরাগ বুদ্ধ, পদ্মরাগ বুদ্ধ-তারপরেই তাঁর মৃত্যু হল৷

‘এর পরের কথা আমি খুব সংক্ষেপেই সারব৷ আমরা সন্ন্যাসীর কথার আসল অর্থ বুঝতে পারলুম না বটে, কিন্তু তাঁর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলুম৷ চ্যান আর ইনের প্রাপ্য চুকিয়ে দিয়ে বললুম-আমরা ওঙ্কারধাম ছেড়ে আর কোথাও যাব না, এখানেই হপ্তা দুয়েক থেকে আবার দেশে ফিরব৷ আমাদের সঙ্গে কেবল চার জন কুলি রেখে বাকি লোক নিয়ে তারা চলে যেতে পারে৷

‘আমাদের হঠাৎ মতপরিবর্তনে তারা বিস্মিত হল বটে, কিন্তু কোনোরকম সন্দেহ করতে পেরেছে বলে মনে হল না৷ সেইদিনই তারা বিদায় গ্রহণ করলে৷

‘সেই অজ্ঞাত মন্দিরে গিয়ে কী দেখব আর কী লাভ হবে, তা আন্দাজ করতে পারলুম না, কিন্তু কী একটা রহস্যের নেশায় আমাদের কৌতূহল এমন ভাবে জেগে উঠল যে পরদিনই উত্তর-পশ্চিম দিকে যাত্রা করলুম৷

‘সেই প্রান্তরে, পুষ্করিণী আর চারটি ছোটো মন্দিরের মাঝখানে প্রধান একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ,-সমস্তই পাওয়া গেল৷ বড়ো মন্দিরের ভিতরে পাথরের বেদির উপরে একটি বুদ্ধমূর্তি বেদির সঙ্গে গাঁথা ছিল৷ আমরা গাঁথুনি থেকে মূর্তিটিকে খুলে নিলুম৷ কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও সেখানে উল্লেখযোগ্য আর কিছুই আবিষ্কার করতে পারলুম না৷ সম্রাটেরও পক্ষে লোভনীয় কোনো পুরস্কারই সেখানে ছিল না-যদিও আমাদের মতো প্রত্নতাত্ত্বিকের পক্ষে লোভনীয় অনেক পুরাতন জিনিসই সেখানে দেখতে পেলুম৷ বিশেষ, হাজার বছর পুরানো যে শিলালিপি সেখানে পেয়েছি, তাইতেই আমাদের সমস্ত পরিশ্রম সার্থক হয়েছে৷

‘সেখান থেকে ফিরে আসবার সময় সুরেনবাবু খুশি হয়ে বললেন, সন্ন্যাসী বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন, কীসের লোভে আমরা এদেশে এসেছি! যে শিলালিপি আমরা পেয়েছি, তার চেয়ে অমূল্য সম্পদ আর কী থাকতে পারে?

‘জয়ন্তবাবু, চোর আজ যে বুদ্ধমূর্তিটি চুরি করবার চেষ্টা করেছিল, ওইটিকেই আমরা সেই বড়ো মন্দিরের ভিতরে পেয়েছিলুম৷ কিন্তু ও মূর্তি নিয়ে চোরের কী লাভ হত, এ কথাটা কিছুতেই আমি বুঝতে পারছি না৷’

জয়ন্ত অনেকক্ষণ চুপ করে রইল৷ তারপর ধীরে ধীরে বললে, ‘অমলবাবু, আপনি বলছেন যে সন্ন্যাসীর শেষ কথা হচ্ছে পদ্মরাগ বুদ্ধ? কিন্তু পদ্মরাগ বুদ্ধ নামে কোনো বুদ্ধমূর্তির কথা তো আমি কখনো শুনিনি?’

অমলবাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমিও শুনিনি৷’

মানিক বললে, ‘কিন্তু পদ্মরাগ মণি বলে মহামূল্যবান মণি আছে!’

জয়ন্ত অস্ফুট কন্ঠে বললে, ‘সন্ন্যাসী এমন পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন, যার জন্যে পৃথিবীর যেকোনো সম্রাট লালায়িত হতে পারেন৷ এঁরা ওখান থেকে এনেছেন চুনাপাথরের গড়া এক বুদ্ধমূর্তি, আর একখানা শিলালিপি, -রাজা মহারাজার কাছে যা তুচ্ছ! অথচ এই সামান্য বুদ্ধমূর্তিও চোরে চুরি করতে চায়, এর জন্যে মানুষ খুন করতেও ভয় পায় না! আশ্চর্য রহস্য!’ সে বুদ্ধমূর্তির ভাঙা মাথাটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে দেহটা আবার তুলে নিলে৷ তারপর তাকে উলটে ধরে খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে বললে, ‘দেখো মানিক, এর তলার দিকটা!’

মানিক দেখলে, মূর্তির তলায় খানিকটা জায়গায় গুঁড়ো পাথরের প্রলেপ মাখানো হয়েছে! সে বললে, ‘এখানে একটা ছ্যাঁদা ছিল৷ এখন ভরাট করে দেওয়া হয়েছে!’

জয়ন্ত হঠাৎ মূর্তিটা উচুঁতে তুলে ধরে মাটির উপরে সজোরে নিক্ষেপ করলে, সেটা সশব্দে চূর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল৷

অমলবাবু হাঁ হাঁ করে বলে উঠলেন, ‘কী করলেন, কী করলেন! ওর পিছনে যে ব্রাহ্মী লিপি ছিল৷’

জয়ন্ত সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে হেঁট হয়ে ভাঙা টুকরোর ভিতর থেকে একটা জিনিস নিয়ে সকলের চোখের সামনে তুলে ধরলে৷

জিনিসটা তামার একটা কৌটোর মতো-অনেকটা বিলাতি সেভিংস্টিকের কৌটোর মতন দেখতে, তেমনি গোল, কিন্তু তার চেয়ে লম্বা, প্রায় এক বিঘত হবে!

জয়ন্ত বললে, ‘মূর্তির ভিতরে খুদে এই কৌটোটা পুরে, তলার ছ্যাঁদা আবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল৷’

অমলবাবু খানিকক্ষণ হতভম্বের মতো চুপ করে থেকে বললেন, ‘ও কৌটোর ভিতর কী আছে?’

-‘সেইটেই এখন দেখতে হবে৷ কারণ, এর ভিতর যা আছে, তার লোভেই আজ এখানে চোরের আবির্ভাব হয়েছিল!’ সে কৌটোর ঢাকুনি খুলে তার ভিতর থেকে বার করলে একটি চাবি ও একটি সোনার চাকতি!

অমলবাবু বললেন, ‘ও আবার কী?’

জয়ন্ত জবাব না দিয়ে চাকতিটা খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে বললে, ‘এতে কী একটা নকশা খোদা রয়েছে৷’

-‘নকশা?’

‘হ্যাঁ,’ বলেই সে টেবিলের ধারে আলোর কাছে গিয়ে বসল৷ তারপর পকেট থেকে কাগজ, পেনসিল ও ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস বার করলে৷ বাঁ-হাতে চাকতির উপরে ম্যাগ্নিফাইং গ্লাস ও ডান হাতে কাগজের উপরে পেনসিল ধরে সে তখনি তাড়াতাড়ি আর একখানা বড়ো নকশা তৈরি করে ফেললে৷ তারপর উঠে দাঁড়িয়ে কাগজে আঁকা নকশাখানা অমলবাবুর হাতে সমর্পণ করলে৷

অমলবাবু কাগজখানার দিকে তাকিয়ে সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘এ যে প্রান্তরের সেই মন্দিরের নকশা! এই মন্দিরেই আমরা ওই বুদ্ধমূর্তি পেয়েছি৷’

জয়ন্ত খুব খুশিমুখে পকেট থেকে রুপোর নস্যদানি বার করে দু-বার নস্য নিয়ে বললে, ‘তাহলে আসুন অমলবাবু! এই টেবিলের ধারে বসুন! ভালো করে আপনি একবার নকশাখানা দেখুন৷ আমার মনে হচ্ছে, সন্ন্যাসী যা বলে যেতে পারেননি, আমরা এইবারে সেই গুপ্তকথাটা জানতে পারব! পদ্মরাগ বুদ্ধ! পদ্মরাগ বুদ্ধ! রহস্যময় নাম৷’

অমলবাবু নকশার কাগজখানার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে অনেকক্ষণ বসে রইলেন৷ তারপর বললেন, ‘দেখুন জয়ন্তবাবু, এখানা যে সেই মন্দিরের নকশা, তাতে আর একটুও সন্দেহ নেই৷ সেই চার-ঘাটওয়ালা পুকুর, তার কোনাকুনি রাস্তা, চারিদিকে চারটি ছোটো আর মাঝখানে প্রধান মন্দির, এমনকী কালো পাথরের লম্বাটে বেদিটি পর্যন্ত মিলে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় অমিল রয়েছে৷’

জয়ন্ত নকশার উপরে ঝুঁকে পড়ে বললে, ‘কী কী মিলছে না, আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন৷’

-‘মন্দিরের ভিতরে, বেদির সামনে সিঁড়ির মতন ওটা কী আঁকা রয়েছে? আমার বেশ মনে আছে, মন্দিরের ভিতরে ওরকম কিছুই আমাদের চোখে পড়েনি৷’

-‘তারপর?’

-‘পুকুরের পশ্চিম কোণে তিনকোনা ওই কালো অংশটাই বা কী? মন্দিরের বেদির মাঝখানে একটি সাদা জায়গা আছে-ওইখানেই আমরা বুদ্ধমূর্তি দেখেছিলুম৷ কিন্তু পুকুরের কোণেও কালোর মাঝখানে সাদা চিহ্ন আছে, বুঝতে পারছি না৷ পুকুরের ওখানে আমরা জল ছাড়া আর কিছুই দেখিনি৷’

-‘আর কোনো অমিল দেখতে পাচ্ছেন?’

-‘না৷ তবে মন্দির থেকে পুকুরে আসবার পথের উপরে তিনটে তির চিহ্ন রয়েছে কেন?’

জয়ন্ত নকশার দিকে চেয়ে খানিকক্ষণ ভেবে বললে, ‘আমার মাথায় কতকগুলো সন্দেহের উদয় হচ্ছে! কিন্তু সেগুলো এখন প্রকাশ করে লাভ নেই, কারণ সেসব সন্দেহ অমূলক হতেও পারে৷ তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি যে অমিলের কথা বলছেন, তারই মধ্যে পদ্মরাগ বুদ্ধের সমস্ত রহস্য লুকিয়ে আছে৷’

অমলবাবু বললেন, ‘জয়ন্তবাবু, আমার আর একটা কথা মনে পড়ছে৷ ওঙ্কারধামে যাবার আগে আমরা শ্যামদেশেও বেড়াতে গিয়েছিলুম৷ সেখানে একটা জনপ্রবাদ শুনেছি৷ ও অঞ্চলে কোথায় নাকি এক মূল্যবান বুদ্ধমূর্তি আছে, তা নাকি দুর্লভ মণিমাণিক্য কেটে একসঙ্গে জুড়ে জুড়ে গড়া! কিন্তু সে মূর্তির ঠিকানা কেউ জানে না! অবশ্য এটা আমরা জনপ্রবাদ বলেই উড়িয়ে দিয়েছি, কারণ জনপ্রবাদ অসম্ভবকেই সম্ভব করতে চায়!’

মানিক বললে, ‘ভেবে দেখো জয়ন্ত, পদ্মরাগও হচ্ছে মহা মূল্যবান মণি! এই মণি দিয়ে যদি বুদ্ধমূর্তি গড়া হয়, তবে তার পদ্মরাগ বুদ্ধ নাম হওয়া খুবই স্বাভাবিক!’

জয়ন্ত বললে, ‘সন্ন্যাসীও এমন পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন, যার জন্যে পৃথিবীর যেকোনো সম্রাট লালায়িত হতে পারেন!’

-‘পদ্মরাগ বুদ্ধ! আমাদের অনুমান যদি সত্য হয়, তবে সে মূর্তি সম্রাটের পক্ষেও লোভনীয় বটে!’

-‘পদ্মরাগ বুদ্ধ! সে মূর্তি কত বড়ো? কতগুলো পদ্মরাগ মণি দিয়ে সে মূর্তি গড়া হয়েছে? মানিক, এই অসম্ভব সম্পদের কথা ভাবতেও আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে!’

অমলবাবু মাথা নেড়ে হেসে বললেন, ‘কিন্তু সেই মণিময় বুদ্ধ কোথায় লুকিয়ে আছেন, কেউ তা জানে না!’

জয়ন্ত বললে, ‘অমলবাবু লোভের মহিমা দেখুন! মণিময় বুদ্ধের নাম শুনেই আমি পরম ভক্ত বৌদ্ধ হয়ে পড়েছি!’

-‘কিন্তু জয়ন্তবাবু, এটাও ভুলে যাবেন না যে, সারা মন্দির তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমরা চুনাপাথরে গড়া বুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই পাইনি!’

জয়ন্ত উত্তেজিত কন্ঠে বললে, ‘আপনিও ভুলে যাবেন না যে, এই চুনাপাথরে গড়া মূর্তির মধ্যে আমরা পেয়েছি একটি চাবি আর নকশা আঁকা চাকতি! বুদ্ধমূর্তির মধ্যে এমন দুটো জিনিস লুকিয়ে রাখবার কথা কে কবে শুনেছে? এত লুকোচুরির কারণ কি অত্যন্ত অসামান্য নয়? সেই কারণটাই কি বুঝিয়ে দিচ্ছে না যে আমরা কল্পনাতীত কোনো সুদুর্লভ বস্তু লাভ করতে পারি? এই জন্যেই এমন একটি সাধারণ মূর্তির লোভে কেউ নরহত্যা করেছে, হয়তো আজ আপনাকেও খুন করত! কীসের এই চাবি? চাবিটা যেরকম বড়ো, তাতে মনে হচ্ছে, এর দ্বারা খুব বড়ো কুলুপই খোলা যায়! সে কুলুপ কোথায় লাগানো আছে? আপনার মতে, এই চাকতির উপরে সেই ভাঙা মন্দিরের নকশা আছে৷ কিন্তু নকশার ওই সিঁড়ির রহস্যটাই বা কি? ওরকম কোনো সিঁড়ি আপনি দেখতে পাননি বটে, কিন্তু নিশ্চয়ই ও সিঁড়ি কাল্পনিক নয়-নকশার সবটাই যখন মিলছে তখন ও সিঁড়ি কাল্পনিক হতে পারে না, ওর অস্তিত্ব আছেই৷’

অমলবাবু দৃঢ় স্বরে বললেন, ‘না ওর অস্তিত্ব নেই!’

জয়ন্তও দৃঢ় স্বরে বললে, ‘কিন্তু আমি যদি ওর অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারি?’

-‘কেমন করে ?’

-‘ওঙ্কারধামে গিয়ে৷’

-‘ওঙ্কারধামে গিয়ে? সে যে হবে মরীচিকার পিছনে ছোটার মতো৷ ওই অদৃশ্য সিঁড়ি, আর পুকুরের কোণে আর এক অদৃশ্য রহস্য, এরা কোন জাদুমন্ত্রে আবার দৃশ্যমান হবে?’

-‘বুদ্ধির জাদুমন্ত্রে অমলবাবু, বুদ্ধির জাদুমন্ত্রে!’

অমলবাবু আহত কন্ঠে বললেন, ‘অদৃশ্য সিঁড়ি দেখতে পাইনি বলে আপনি কি আমাকে এক নম্বরের গাধা বলে মনে করেন?’

জয়ন্ত ব্যস্ত ভাবে বললে, ‘না, না অমলবাবু, আপনাকে বোকা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়! আমার বক্তব্য হচ্ছে, পৃথিবীর বুদ্ধিমান লোকরাও সকল ক্ষেত্রে সমান ভাবে বুদ্ধিকে ব্যবহার করতে পারে না৷ ধরুন প্রত্নতত্ত্বের কথা৷ ও বিভাগে আপনার তুলনায় আমার বুদ্ধি একেবারেই অকেজো৷ আবার, আমার বিভাগে আপনার মাথাও বেশি সুবিধা করে উঠতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না৷ এই চাবি আর সোনার চাকতির ব্যাপারটাই ভেবে দেখুন না! বুদ্ধদেবের মূর্তি আপনাদের কাছে এতদিন ধরে রয়েছে, তবু এমন দুটো অদ্ভুত জিনিস আপনারা আবিষ্কার করতে পারেননি! আর একটা প্রমাণ হাতে হাতেই দিতে পারি৷ এখানে এসেই আমি যখন বারান্দায় গিয়েছিলুম, তখন কতকগুলো কাদামাখা পায়ের দাগ চোখে পড়েছিল! এতক্ষণ সেগুলো পরীক্ষা করবার সময় পাইনি, এইবারে তাদের কাছে যাওয়া যাক৷ আসুন অমলবাবু, এসো মানিক!’

সকলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন৷ লম্বা বারান্দায় সারি সারি পায়ের দাগ রয়েছে, তার অনেকগুলোই বেশ স্পষ্ট৷

জয়ন্ত বললে, ‘এগুলো নিশ্চয়ই চোরের পায়ের দাগ! আচ্ছা অমলবাবু, এই দাগগুলো দেখে আপনার কী মনে হয়?’

অমলবাবু সেগুলোর উপরে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন৷ ‘কী আবার মনে হবে? ওগুলো হচ্ছে চোরের পায়ের দাগ!’

জয়ন্ত হেঁট হয়ে পড়ে দাগগুলো তীক্ষ্ণ নেত্রে পরীক্ষা করতে করতে বললে, ‘আর কিছু মনে হয় না?’

অমলবাবু বললেন, ‘আমার মনে হয় দাগগুলো অতিরিক্ত বড়ো! . . . কিন্তু জয়ন্তবাবু, পায়ের দাগ নিয়ে অত বেশি মাথা ঘামাবার কী আছে? আসামি যখন পলাতক, তখন ওই দাগগুলোর ভিতর থেকে তাকে তো আর গ্রেপ্তার করা যাবে না!’

কিন্তু সেকথা বোধ হয় জয়ন্তের কানে ঢ়ুকল না৷ পকেট থেকে নস্যদানি বার করে সে ঘন ঘন নস্য নিতে লাগল, নীরবে!

তারপর সে বললে, ‘পৃথিবীতে যেদিন থেকে অপরাধ সৃষ্টি হয়েছে, সেই দিন থেকেই যেসব প্রমাণের জোরে অপরাধী ধরা পড়েছে তাদের মধ্যে পায়ের দাগই হচ্ছে প্রধান!’ একটু থেমে, হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে সে আবার বললে, ‘অমলবাবু, আমি একটি লোকের চেহারার কথা বলব, তাকে আপনি চেনেন কি? মাথায় সে খুব ঢ্যাঙা, মাপলে সাত ফুটও হতে পারে৷ তার দেহ রীতিমতো হৃষ্টপুষ্ট৷ তার গায়ে অসুরের মতন জোর৷ সে ডান পাশে একটু বেশি হেলে পড়ে হাঁটে৷ আর-আর তার ডান পায়ের কড়ে আঙুল নেই!’

প্রথমে অমলবাবু হতভম্বের মতন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন৷ তারপর তাঁর মুখে-চোখে গভীর বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল৷ তিনি তাড়াতাড়ি বললেন, ‘জয়ন্তবাবু, আপনি চ্যানকে চিনলেন কেমন করে?’

জয়ন্ত দুই ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসার স্বরে বললে, ‘চ্যান?’

-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ চ্যান৷ ওঙ্কারধামে সে আমাদের কুলির সর্দার ছিল৷ সন্ন্যাসীর কথায় তাকে আর তার বন্ধু ইনকে আমরা বিদায় করে দিয়েছিলুম৷ আপনার মুখে এখনি অবিকল চ্যানেরই বর্ণনা শুনলাম, আর তাকে আপনি চেনেন না!’

জয়ন্ত আর এক টিপ নস্য নিয়ে খুশিমুখে বললে, ‘না চ্যানকে আমি চিনি না! তাহলে চ্যানের দেহ হচ্ছে বেজায় ঢ্যাঙা, জোয়ান আর মোটাসোটা?’

-‘হ্যাঁ! আর তার ডান পায়ের কড়ে আঙুল নেই!’

-‘উত্তম! মানিক, কাল ভোরে উঠেই আগে আমাদের বন্ধু ইনস্পেক্টার সুন্দরবাবুকে ফোন করে সব কথা জানিয়ো৷ চ্যানের নামে কালকেই যেন ওয়ারেন্ট বার করা হয়৷ কারণ খুব সম্ভবত সুরেনবাবুকে সেইই খুন করেছে৷ আর আজকে চ্যানই যে অমলবাবুকে খুন করতে উদ্যত হয়েছিল, তার প্রমাণ ওই পদচিহ্ন!’

অমলবাবু অভিভূত স্বরে বললেন, ‘জয়ন্তবাবু, কী বলছেন! চ্যান কি কলকাতায় আছে?’

-‘পদচিহ্ন তো সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে!’

-‘পদচিহ্ন! অসম্ভব, পায়ের দাগে কি চেহারার বর্ণনা লেখা থাকে?’

‘থাকে৷ এ বর্ণনা পড়তে পারে কেবল বিশেষ বুদ্ধি৷ পায়ের দাগগুলো আর একবার ভালো করে দেখুন, বর্ণনা পড়তে বেশি সময় লাগবে না৷ আপনিও তো দেখেছেন, পায়ের ছাপগুলো অতিরিক্ত বড়ো! সাধারণত ছোটো চেহারার পায়ের দাগ এত বড়ো হয় না৷ তারপর প্রত্যেক পদচিহ্নের মাঝখানকার ব্যবধান লক্ষ করে দেখুন৷ এই ব্যবধানের মাপ দেখেও আকৃতির আন্দাজ করা যায়৷ বেঁটে লোকের চেয়ে ঢ্যাঙা লোকেরা বেশি তফাতে পা ফেলে হাঁটে৷ দাগগুলো কীরকম স্পষ্ট দেখেছেন? হালকা দেহ বহন করে যেসব পা, তাদের ছাপ আরও কম স্পষ্ট হত৷ ডান পায়ের প্রত্যেক ছাপের ডান পাশটা বেশি চেপে মাটির উপর পড়েছে; কারণ এগুলো যার পায়ের দাগ, সে ডান পাশে বেশি হেলে হাঁটে৷ তার ডান পায়ের কড়ে আঙুল যে নেই, এ সত্য তো ছাপ দেখে বালকরাও ধরতে পারবে! আর তার গায়ের জোর তো আমরা সকলেই দেখেছি! সে আজ চোখের পলকে আপনার অতবড়ো পালোয়ান দরোয়ানকে কুপোকাত করে সরে পড়েছে! দেখছেন তো অমলবাবু, আমাকে বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয়নি, আমি কেবল বুদ্ধির যথা ব্যবহার করেছি৷ সাধারণ লোকে যা করতে পারে না৷’

অমলবাবু অস্ফুটস্বরে বললেন, ‘কিন্তু চ্যান এসেছিল আমাকে খুন করতে! কোথায় কাম্বোডিয়া, আর কোথায় কলকাতা! কী আশ্চর্য৷’

-‘এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই! ওঙ্কারধামের সন্ন্যাসী তো চ্যান আর ইন সম্বন্ধে আপনাদের আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন! নিশ্চয়ই তিনি জানতেন যে চ্যান আর ইন পদ্মরাগ বুদ্ধের সন্ধানে আছে! পদ্মরাগ বুদ্ধকে লাভ করতে হলে যে চুনাপাথরে গড়া বুদ্ধ মূর্তিটিকে দরকার, চ্যান কোনোগতিকে সেটাও টের পেয়েছে৷ ওই মূর্তি এখন আপনার দখলে তাই শত্রুর দৃষ্টি আপনার উপরেই পড়েছে! এতক্ষণে সব রহস্য তো বেশ পরিষ্কার হয়ে গেল!’

অমলবাবু সভয়ে বললেন, ‘আমি তো পদ্মরাগ বুদ্ধ চাই না, তবে আমার প্রাণ নিয়ে এত টানাটানি কেন?’

জয়ন্ত গম্ভীর কন্ঠে বললে, ‘কে বলে আপনি পদ্মরাগ বুদ্ধ চান না? এক হপ্তার ভিতরেই আপনার সঙ্গে আমরাও যে পদ্মরাগ বুদ্ধকে আনবার জন্যে ওঙ্কারধামে যাত্রা করব!’

-‘বলেন কী মশাই? একটা জনপ্রবাদের পিছনে দৌড়ে অপঘাতে মারা পড়ব? পদ্মরাগ বুদ্ধের মূল্য যদি লক্ষ কোটি টাকাও হয়, তাহলেও ওর মধ্যে আমি নেই৷ আপাতত কেবল চ্যানের সাংঘাতিক অনুগ্রহ থেকে আমাকে রক্ষা করুন, প্রতিদানে ওই চাবি আর চাকতি আপনাদের হাতে আমি সমর্পণ করলুম৷ পদ্মরাগ বুদ্ধ পেলে সে মূর্তি নিয়ে আপনারা যা-খুশি তাই করতে পারেন, তার উপরে আমার আর একটুও লোভ নেই৷’

মানিক বললে, ‘আচ্ছা, ওসব কথা পরে হবে তখন৷ কিন্তু আপাতত এইটেই আমি বুঝতে পারছি না যে, বিদেশি লোক হয়েও চ্যান কী করে অমলবাবুর বাড়ির অন্ধিসন্ধির সব খবর রেখেছে? সে কেমন করে জানলে, অমলবাবুর ঘরের কোথায় বুদ্ধমূর্তি আছে, আর গৃহকর্তা নিদ্রিত? বুঝে দেখো জয়, চ্যান অন্ধকারেই ঘরে ঢুকে মূর্তিটিকে অনায়াসে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল!’

জয়ন্ত তাড়াতাড়ি মানিকের পিঠ চাপড়ে খুশি কন্ঠে বললে, ‘শাবাশ মানিক, শাবাশ! তুমি খুব বড়ো প্রশ্ন তুলেছ, একথা তো আমার মাথাতেও ঢোকেনি! চ্যান এত হাঁড়ির খবর রাখলে কী করে?’

অমলবাবু বললেন, ‘আপনাদের কথা শুনে আর একটা কথা এখন আমার মনে পড়ছে৷ আজ কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, এই পাড়ায় চার-পাঁচজন বর্মি লোক প্রায় আনাগোনা করে৷ দেখলে মনে হয় যেন তারা এই পাড়ারই বাসিন্দা!’

জয়ন্ত বললে, ‘তাই নাকি? তাহলে তারা নিশ্চয়ই এই বাড়ির উপরে পাহারা দেয়! কিন্তু তারা ঘরের ভিতরকার খোঁজ রাখলে কেমন করে? আচ্ছা অমলবাবু, পথের ওপাশে ওই মস্ত বাড়িখানায় কে থাকে বলতে পারেন?’

-‘ওটা মেসবাড়ির মতো৷ ওখানে দেশ-বিদেশের লোক থাকে কিন্তু তারা কেউ বাঙালি নয়৷’

-‘তাহলে ও বাড়ির তিনতলার ঘর থেকে আপনার এই ঘরের ভিতরে নজর রাখা খুবই সহজ দেখছি! কে বলতে পারে এই মুহূর্তেই ওখানে বসে কেউ আমাদের গতিবিধি লক্ষ করছে কি না?’

অমলবাবু চমকে উঠলেন, ম্লান মুখে বললেন, ‘বলেন কী? আমি কি তবে শিয়রে শমন নিয়ে বাস করছি?’

জয়ন্ত বললে, ‘আচ্ছা, একটা পরীক্ষা করা যাক৷ আমরা দু-জনে আপনাকে নমস্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই৷ আপনিও প্রতিনমস্কার করে ঘরের আলো নিবিয়ে দিন৷ যদি কোথাও শত্রু জেগে থাকে, সে মনে করবে আমরা বিদায় হয়েছি, আর আপনি আবার শুয়ে পড়েছেন৷ এই পরীক্ষার ফল কী হয়, দেখা যাক৷’

কথামতো কাজ হল৷ জয়ন্ত ও মানিক ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল, ঘরের আলো নিবে গেল এবং তার পরেই রাস্তার দিক থেকে ভেসে এল একটা তীক্ষ্ণ বাঁশির আওয়াজ৷

জয়ন্ত বললে, ‘যা ভেবেছি তাই! আমাদের উপরে কড়া পাহারা বসেছে! কেউ বোধ করি বাঁশির সংকেতে তাদের জানিয়ে দিলে যে, সবাই হুঁশিয়ার হও, শত্রুরা এখনি রাস্তায় বেরুবে! ওরা কি আমাদেরও পথে আক্রমণ করতে চায়? ওরা কি ও বাড়ি থেকে দেখেছে যে, চাবি আর চাকতি আমার পকেটে ঢুকেছে? আচ্ছা, এসো! আর একবার অন্ধকারে অমলবাবুর ঘরে ঢোকা যাক!’

জয়ন্ত আস্তে আস্তে বারান্দার দরজার কাছে দাঁড়াল৷ তখন বৃষ্টির প্রবল ঝোঁকটা কেটে গেছে বটে, কিন্তু জল তখনও ঝিমঝিম করে ঝরছিল, রাস্তা দিয়ে তখনও হাঁটু-ভোর জলের ধারা কলকল করে ছুটছিল এবং শেষ রাতের আকাশের বুকে পুরু মেঘের কালো পর্দা ছিঁড়ে তখনও থেকে থেকে বিদ্যুতের অগ্নি-অক্ষরগুলো ঝকমক করে জ্বলে উঠছিল৷ সেই মুহূর্তেই আবার বিদ্যুৎ ফুটল এবং জয়ন্ত স্পষ্ট দেখলে, ওপাশের বাড়ির তিনতলার বারান্দা থেকে একটা মূর্তি রেলিংয়ের উপরে সাগ্রহে ঝুঁকে পড়ে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে!

ক্ষণিক আলোতে তাকে ভালো করে দেখা গেল না-কিন্তু কে সে? চ্যান, না আর কেউ?


© 2024 পুরনো বই