সূচনা

কীর্তিহাটের কড়চা – উপন্যাস – ১৯৬৭ – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

উপন্যাসখানির কালসীমা কমবেশি দেড়শো বছর, ছেদহীন দেড়শো বছর। ‘পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট’ উপন্যাসখানির মেরুদণ্ড। উপন্যাসের মূল আখ্যানের আরম্ভ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আরম্ভের সঙ্গে, সমাপ্তি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সমাপ্তি ঘোষণা দিয়ে। তবে স্বাভাবিক আরম্ভেরও আরম্ভ আছে, সমাপ্তির পরও যে শেষ থাকে সেই সুশেষ আছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বে ও পরে সেই অংশটুকুও সেই কারণেই আছে স্বাভাবিকভাবেই।

সনৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

.

নিবেদন

‘কীর্তিহাটের কড়চা’ লেখকের বৃহত্তম রচনা শুধু নয়—সম্ভবত তাঁর মহত্তম রচনাও। এপিক উপন্যাস বলতে যা বোঝায়—তার সমস্ত শর্তই এতে পালিত হয়েছে। প্রায় দুশো বছর সময়ের পৃষ্ঠপটে, জমিদারী প্রথার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত এর কাহিনীতে একটি বংশের সাতপুরুষের ইতিহাস বিধৃত। তারাশঙ্কর নিজে জমিদার বংশের সন্তান, তিনি যেখানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন- সে অঞ্চলে ছোট বড় বহু জমিদারের বাস, ‘সাড়ে সাত গণ্ডার জমিদার’ থেকে বিত্তশালী বড় বড় জমিদার অনেককেই উনি দেখেছেন। বিত্তহীন জমিদারদের ঐতিহ্যসর্বস্ব জীবনের পুরাতন মহিমাকে আঁকড়ে ধরে থাকার যে সকরুণ প্রয়াস—প্রথম জীবনে বোধ করি এই মানসিকতাই ওঁকে বিচলিত করেছিল বেশী। জমিদারী প্রথার কুফল প্রসঙ্গে অনেক কথা বলা হয়েছে কিন্তু এঁদের সম্বন্ধে ভাল কথাও কিছু বলবার আছে। ভেতর দিক থেকে—আত্মীয়তাসূত্রে বহু জমিদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলেই—এই শ্রেণীটিকে সর্বাঙ্গীণভাবে দেখার সুযোগ ওঁর ঘটেছিল। লেখকের একাধিক বিখ্যাত রচনায় তার পরিচয় আছে। কিন্তু সবই প্রায় খণ্ড পরিচয়। বোধ করি সর্বশেষ প্রয়াস হিসেবে এই বিপুলাকার গ্রন্থটিকে তিনি একটি বংশের উত্থান-পতনের সামগ্রিক ইতিহাসে তার একটা সর্বাঙ্গীণ চিত্র দেবারই চেষ্টা করেছেন-এবং তা সার্থকও হয়েছে। তারাশঙ্কর তাঁর প্রায় তাবৎ উৎকৃষ্ট রচনাই দু-বার করে লিখেছেন। এই সব উপন্যাস সাময়িকপত্রে প্রকাশের সময়ে—নিয়মিত রচনা যোগান দেবার তাগিদে, অনবসর প্রযুক্ত অনেক সময়েই মনের মতো করে  লেখা হত না, কাহিনীর অংশটাই সেখানে প্রবল ও প্রধান হয়ে থাকত—রচনাশৈলীর দিকে নজর রাখা সম্ভব হত না বলেই দুবার করে লিখছেন, এমন কি কোন কোন বই বেশ কয়েকবারই পুনর্লিখিত হয়েছে। কীর্তিহাটের কড়চাও পুনর্লিখন ও পরিমার্জনের অভিপ্রায়ে সরিয়ে রেখেছিলেন, বিরাট গ্রন্থের মহৎ রূপটিকে নিখুঁতভাবে প্রকাশ করবেন—সম্ভবত এই রকমই তাঁর ইচ্ছা ছিল। তার জন্য বৃহত্তর অবসর প্রয়োজন। আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে সে অবসর আর তিনি পাননি। মিত্র ও ঘোষ থেকে এর আগে ‘কীর্তিহাটের কড়চা’র চারটি খণ্ড দুটি আলাদা আলাদা গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছিল। পাঠকদের অনুরোধে সেই চারটি খণ্ড একত্রিত করে এই অখণ্ড সংস্করণটি প্রকাশিত হল। এ উপন্যাস লেখকের অসংখ্য সার্থকতায় গাঁথা গৌরবমাল্যের মধ্যমণি হয়ে থাকবে।

প্রকাশক

.

ভূমিকা

সর্বাগ্রে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন করি যে, যে-কাজ আমি করতে বসেছি তাতে আমার অধিকার নেই। কোন লেখকের রচনার গুণাগুণ বিচার করে পাঠকের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেবার দুর্লভ অধিকার আর যারই থাকুক লেখকের পুত্রের হাতে না থাকলেই ভালো হয়। বিশেষ করে যে পুত্র যদি সে কর্মের যোগ্য না হয়। আমার সে যোগ্যতা নেই, তা সত্ত্বেও এ দায়িত্ব আমাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়েছে।

এর কারণ আছে। সেই কারণটিই এখানে সর্বাগ্রে নিবেদন করি। তারাশঙ্কর বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেগুলি প্রথমেই স্বাভাবিক রীতি অনুযায়ী সাময়িকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে সেগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান মুহূর্তে তারাশঙ্করের গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা যথেষ্ট থাকলেও উপন্যাস দু-একখানি ছাড়া অপ্রকাশিত নেই।

সেই অপ্রকাশিত উপন্যাসের একখানি ‘কীর্তিহাটের কড়চা’। যদিও এ রচনাটি সাময়িকপত্রে প্রায় পনেরো বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল, এটি তারাশঙ্কর গ্রন্থাকারে প্রকাশ করতে দেননি। প্রকাশ করতে না দেবার কারণ ছিল উপন্যাসখানি পুনর্লেখনের অভিপ্রায়। অথচ এই বিষয়টি তাঁর ধ্যানে অন্তত দশ বারো বছর ছিল এবং বিষয়টি নিয়ে ‘কীর্তিহাটের কড়চা’  লেখার আগে আরও দুবার লিখেছিলেন। সে রচনাগুলিও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি।

‘কীর্তিহাটের কড়চা’ প্রায় আড়াই বছর ধরে কিস্তিতে কিস্তিতে প্রতি সপ্তাহে সাপ্তাহিক ‘অমৃত’তে প্রকাশিত হয়েছিল। সেও অনেক কাল আগের কথা। বহু পূর্বে লেখা এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি বলেই বিদগ্ধ রসিকজনেরাও স্বভাবতই এর সঙ্গে পরিচিত নন।

সেই কারণেই ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ রচনাবলীতে প্রথম প্রকাশের সময় মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স-এর কর্তৃপক্ষ আমাকে এর পরিচয়-পর্বটুকু সম্পন্ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমার কাজ রচনাটিকে পাঠকের সঙ্গে শুধুমাত্র পরিচিত করে দেওয়া। এর সাহিত্য-বিচার আমার বিষয় নয়। তবে সেই প্রসঙ্গে রচনার

পৃষ্ঠপট-সংক্রান্ত কিছু কথা পাঠকের কৌতূহল পরিতৃপ্ত করতে পারবে।

‘কীর্তিহাটের কড়চা’ তারাশঙ্করের পরিণত জীবনের শেষাংশের শ্রেষ্ঠতম রচনা বলেই আমার বিশ্বাস। শুধু তাই নয়, এ উপন্যাস কলেবরে তারাশঙ্করের সুদীর্ঘ সাহিত্য জীবনের বৃহত্তম রচনা।

রাইটার্স বিল্ডিংয়ে লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনকক্ষ থেকে মেদিনীপুর জেলার ‘কংসাবতী বারি বিধৌততট বনছায়াশীতল’ গ্রাম কীর্তিহাট পর্যন্ত এর কাহিনী প্রসারিত। কুড়ারাম ভট্টাচার্য ওরফে কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্য থেকে অধস্তন সপ্তম পুরুষ সুরেশ্বর রায় পর্যন্ত এর কাহিনী। সাত পুরুষের কাহিনী যার আরম্ভ কীর্তিহাটে তার শেষ মধ্য কলকাতার জানবাজারে। সাতপুরুষে রায়বংশে মানুষ কম নয়। পুরুষ স্ত্রীলোক ধরে প্রায় পঞ্চাশজন। রায়বংশের সাতপুরুষের এই প্রায় পঞ্চাশজন মানুষকে ঘিরে এর কাহিনির আবর্তন বিবর্তন। এঁরাই কাহিনীর কেন্দ্রস্থলে। এঁদের মাঝখানে রেখে আরও অন্তত শতাধিক চরিত্র উপন্যাসের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করছে। এরই সঙ্গে আরও অন্তত পঞ্চাশজন পুরুষ, যাঁরা ঐতিহাসিক মানুষ, সত্য মানুষ, যাঁদের আমরা জানি চিনি, তাঁরা একই সঙ্গে এই রচনার পৃষ্ঠাকে উজ্জ্বল করেছেন।

এই দুশোর উপর সত্য ও কাল্পনিক, অলীক ও ঐতিহাসিক মানুষের সম্মেলনে ও সমবায়ে এ উপন্যাসের সৃষ্টি। সত্যের সঙ্গে কল্পনার, ইতিহাসের সঙ্গে অলীকের মিলনে যা সৃষ্টি হয়েছে তার ক্রিয়া বিচিত্র। এই মিলনের ক্রিয়ায় কল্পনাকে ও অলীককে আরও সত্য বলে মনে হয়। মনে হয়, যাদের কথা এখানে বলা হয়েছে তারা আমার আপনার মতোই নিজের নিজের সত্য মূর্তিতেই বেঁচে ছিল। মনে হয়, এ উপন্যাস নয়, আমার অজানা কিছু মানুষের জীবন-কথা ও ইতিহাস। আমি নিজে আরও স্পষ্ট স্মরণ করতে পারি, যখন এ রচনাটি সাপ্তাহিক অমৃতে সপ্তাহে সপ্তাহে প্রকাশিত হচ্ছিল, তখন বাংলাদেশের একজন মহামান্য পুরুষ, যিনি একাধারে পণ্ডিত ও রসিক বলে খ্যাত এবং আজও জীবিত আছেন, তিনি তারাশঙ্করকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এ রচনা প্রসঙ্গে —আপনি কোন্ জমিদার বাড়ির কথা লিখছেন?

উপন্যাসের চরিত্রের সংখ্যাধিক্য, রচনার পৃথু কলেবর বা দীর্ঘকালের ব্যাপ্তি কোন উপন্যাসের পক্ষে একমাত্র প্রশংসার বিষয় নয়। উপন্যাসের প্রথম ও শেষ বিচার রসের বিচারে। যখন প্রকাশিত হয় তখন, এবং তারপরের এই দীর্ঘ কালে আমি উপন্যাসখানি একাধিকবার পাঠ করেছি। প্রতিবারেই মনে হয়েছে, সবিনয়ে নিবেদন করছি, আমার অধিকার-বহির্ভূত বক্তব্য জেনেও নিবেদন করছি যে এ রচনায় তারাশঙ্করের বহু-অভিজ্ঞ ও পরিণত শিল্পীমন পাকা রসের ভিয়েনে নিজেকে উত্তীর্ণ করেছেন, করতে পেরেছেন। তবে আমার রসবিচার করার প্রয়োজনই বা কি? ব্যঞ্জনের পরিচয় তো তার আস্বাদেই। পাঠক নিজেই সে বিচার করতে পারবেন।

তারাশঙ্কর সম্পর্কে একটি-দুটি তত্ত্ব প্রবাদের মতো প্রচলিত হয়ে আসছে। প্রথম তিনি উপন্যাসকার হিসাবে আঞ্চলিক, দ্বিতীয় তিনি সামন্ততন্ত্র বা জমিদারীপ্রথা সম্পর্কে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। এ দুটি প্রচলিত থিয়োরি সম্পর্কে দু-একটি কথা এখানে এই ‘কীর্তিহাটের কড়চা’কে অবলম্বন করে বলা প্রয়োজন। এই থিয়োরি দুটিকে স্বীকার বা অস্বীকার না করেই সে সম্পর্কে যা বলবার বলছি।

তারাশঙ্করের জন্ম বাংলাদেশের উত্তর রাঢ়ে এবং তাঁর শিল্পী-জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা ও উপকরণ সেই রাঢ়ভূমি থেকেই সংগৃহীত হয়েছে। এবং তিনি মূলত সেখানকার মানুষের কথাই লিখেছেন। এ উক্তি বর্ণে বর্ণে সত্য। কিন্তু তা থেকে যদি এই সিদ্ধান্ত টানা যায় যে রাঢ়ের কথাই লিখেছেন তা হলে বোধহয় সে সিদ্ধান্ত ঠিক হবে না। কারণ সে ক্ষেত্রে আসল কথা যে মানুষ, সেই মানুষই বাদ পড়ে যাবে। তবে এ সিদ্ধান্ত যদি এই হয় যে তারাশঙ্কর মানুষের কথাই লিখেছেন এবং সে মানুষ রাঢ়ভূমির, তা হলেই বোধহয় সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়।

কারণ কোন্ সার্থক ঔপন্যাসিক আঞ্চলিক নন? যে পটভূমিতে কোন উপন্যাসের পাত্র-পাত্রী নিজেদের মানবলীলা প্রকটিত করে সে তো একটি বিশেষ ভূমিখণ্ড, বিশেষ অঞ্চল। যে শিল্পী নিজের উপন্যাসের পটভূমিতে যত স্পষ্ট, যত গাঢ়ভাবে জানবেন তাঁর রচনায় তো সেই বিশেষ পটভূমি ততখানি গাঢ় বর্ণে বর্ণিত হয়ে স্পষ্ট মূর্তিতে দেখা দেবেই। মানুষ তো স্থান-কালহীন প্রাণী নয়। স্থান ও কালে সংস্থিত মানুষকে নিয়েই তো শিল্প। না হলে সে তো নিরালম্ব বায়ুভুক মূর্তিতে দেখা দেবে! তারাশঙ্কর নিজের ভূমিকে ও নিজের কালকে ভালো করেই জানতেন। তা তাঁর কাছে প্রায় করতলামলকবৎ ছিল। এই কারণেই তাঁর রচনায় রাঢ়ভূমি সর্বদাই অতি স্পষ্ট রেখা ও বর্ণে চিত্রিত চালচিত্রের মতো বড় স্পষ্ট মূর্তিতে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই চালচিত্রকে পিছনে রেখে তিনি আপনার পাত্র-পাত্রীর প্রতিমাকে স্থাপন করেছেন।

কিন্তু ‘কীর্তিহাটের কড়চা’য় তিনি তাঁর রচনাকে তাঁর চির পরিচিত ও অভ্যস্ত উত্তর রাঢ় ভূমিতে অজয়, ময়ূরাক্ষী কি কোপাইয়ের তীরে স্থাপন করেননি। তিনি রচনাকে এবার স্থাপন করেছেন কংসাবতী বারিবিধৌত কীর্তিহাটে, যাকে বর্ণনা করেছেন মেদিনীপুর বলে। আমি সঠিক জানি না আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট এই অভিযোগ থেকে সহজে অব্যাহতি লাভের জন্যই তিনি এ কাজ করেছিলেন কি না! বরং পাঠক একটু যত্ন করে দেখলেই অনুভব করবেন, এ মানুষগুলি কি মূলত উত্তর রাঢ়ের, বীরভূমের? তারাশঙ্কর কি ছলনা করে তাদের মেদিনীপুরে বসিয়ে দিয়েছেন? না তারা আসলে মানুষই, বীরভূম মেদিনীপুর যেখানেই জন্মাক সেইখানেই তারা সত্য ও সঠিকভাবেই চেহারা পেয়েছে?

এবার দ্বিতীয় তত্ত্বটি সম্পর্কে আসা যাক।

তারাশঙ্কর সামন্ততন্ত্র সম্পর্কে সহানুভূতিশীল এ কথাও প্রবাদবাক্যের চলে আসছে। আমার নিজের ধারণা, এর হেতু তাঁর প্রথম জীবনের রচনা দুটি গল্প, ‘রায়বাড়ি’ ও ‘জলসাঘর’। তারাশঙ্কর অন্তত ষাটের উপর উপন্যাস ও দৃশোর কাছাকাছি ছোটগল্প রচনা করেছেন। তার মধ্যে ক’টিই বা জমিদারদের নিয়ে  লেখা? ‘ধাত্রীদেবতা’, ‘কালিন্দী’, ‘পদচিহ্ন’ ও শেষ এই ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। গল্পের মধ্যে ‘রায়বাড়ি’ ও ‘জলসাঘর’ ছাড়া পাঠককে এ প্রসঙ্গে ‘রাখাল বাঁড়ুজ্জে ও ‘সাড়ে সাত গণ্ডার জমিদার’ পড়ে দেখতে অনুরোধ করব এবং সবিনয়ে বিচার করে দেখতে বলব ওজনে জমিদারির গুণাগুণ দেখানোর পাল্লাটা সমান হয়েছে কিনা।

এ সম্পর্কে বিচার করতে হলে, আমার ধারণা, আমাদের আর একটু এগিয়ে যেতে হবে। তারাশঙ্করের সাহিত্যসৃষ্টিতে জমিদারতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতির কথাটা ধরে নিলেও বিচারে অসুবিধা হবে না। তবে তাঁর এ সহানুভূতিকে খণ্ডিত করে দেখলে হয়তো বিচারে ত্রুটি ঘটবে। আমরা যদি তারাশঙ্করের সহানুভূতির ক্ষেত্রটি বিচার করি তা হলে দেখতে পাব তাঁর সহানুভূতির ক্ষেত্র অতি সাধারণ ব্রাত্য মানুষের জীবন থেকে উদ্ভূত হয়ে তা ক্রমপ্রসারিত হতে হতে সমাজের উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তের মানুষে গিয়ে শেষ হয়েছে। তিনি যে সংখ্যায় ও যে মমতায় উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তের জমিদারকে এঁকেছেন তার থেকে বহুতর সংখ্যায় ও বহু পরিমাণ মমতা দিয়ে সমাজের অন্তেবাসীদের জীবনকে চিত্রিত করেছেন। তবে এ কথাও ঠিক যে, সমাজের উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তের মানুষও তাঁর সহানুভূতি, এবং ক্ষেত্রবিশেষে শ্রদ্ধায় বঞ্চিত হয়নি। তা যদি হত তা হলে তা কি শিল্পী তারাশঙ্করের পক্ষে অধিকতর গৌরবের বিষয় হত? শিল্পের একাংশ চোখের জলে ও বুকের মমতার রসে ভিজিয়ে, অপর এক অংশকে মমতা-বঞ্চিত করে আঁকলে তাতে, আর যাই হোক, শিল্পসৃষ্টিও হত না, শ্রদ্ধাবান শিল্পীর পক্ষে তাতে সমদর্শিতাও বজায় থাকত না।

কিন্তু এহ বাহ্য। শিল্পী তারাশঙ্করের যা ধাতুপ্রকৃতি তাতে মমতাহীন হয়ে আঁকা তাঁর পক্ষে সম্ভবই ছিল না। এ তাঁর শিল্পের প্রকৃতিবিরুদ্ধ। আমরা যদি এই মমতার উৎস সন্ধান করি তা হলে একটি বিচিত্র সত্যের সন্ধান পাব। আমার ধারণা, এই মমতার মূল উৎস হল মাটি, দেশের মাটি। দেশের মাটিকে অবলম্বন করে যারা তাঁর চোখের সামনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কাঠামোর মধ্যে বেঁচে ছিল তাদের সকলকেই তিনি ভালোবেসেছেন। সে জমির রায়তই হোক, আর জমিদারই হোক। যার গায়ে পুরু কি পাতলা মাটির প্রলেপ ও গন্ধ আছে তাকেই তিনি অপরিসীম মমতায় ভালোবেসেছেন। সেই ভালোবাসার সময় রায়ত কি জমিদার তিনি বিচারের অবকাশ পাননি।

এই দিক দিয়ে বিচার করলে ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ তাঁর অনন্য সৃষ্টি। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কাঠামোর মধ্যে ভূমিকে অবলম্বন করে যে যেখানে আছে দেশের মধ্যে সে-ই তাঁর ভালোবাসার অংশভাগী হয়েছে। তবে ভালোবাসতে গিয়েও, মমতা প্রকাশ করতে গিয়েও যে শাসন ও শোষণ করেছে তার সাধুবাদ করেননি, আবার যে অত্যাচার পেয়েছে তাকে সহানুভূতি জানাতেও ভোলেননি।

তারাশঙ্কর তাঁর সাহিত্যজীবনের কাহিনী লিখতে গিয়ে ‘জলসাঘর’ প্রসঙ্গে একটি উক্তি করেছিলেন। সেটি এখানে স্মরণ করি। তিনি ‘জলসাঘর’ গল্পটি লেখেন ১৩৪১ সনের বৈশাখ মাসে। সেই সময় থেকেই ‘জলসাঘর’-এর সূত্র ধরে তাঁর তিনটি গল্প  লেখার পরিকল্পনা মাথায় আসে। একটি জমিদার বাড়ির উত্থান ও পতনের কাহিনী লিখবেন তিনটি ছোট গল্পে। প্রথম উত্থান, দ্বিতীয় রাজত্ব, তৃতীয় পতন। তৃতীয় গল্পটিই লেখেন সর্বপ্রথম। তারপর এর আড়াই কি পৌনে তিন বছর পর দ্বিতীয় গল্পটি লেখা হয়। নাম ‘রায়বাড়ি’। এরপর ‘জলসাঘর’ বই হিসাবে প্রকাশিত হবার সময় প্রকাশক হিসাবে সজনীকান্ত দাস ‘জলসাঘর’ গল্প সংগ্রহের প্রথম গল্প হিসাবে ‘জলসাঘর’ নামে চিহ্নিত করে তার অধীনে ওই দুটি গল্প সংকলিত করেন। তারাশঙ্করও এ পর্যায়ের প্রথম কাহিনীটি লেখা হবার জন্য আর অপেক্ষা করেননি। আমার নিজের ধারণা ১৩৪১ সালে ‘জলসাঘর’ গল্পটি লিখবার সময় যে পরিকল্পনা তাঁর মাথায় এসেছিল তাই এর ত্রিশ বৎসর পরে মূর্তিলাভ করে ‘কীর্তিহাটের কড়চা’য়।

কিন্তু মাঝখানের ত্রিশ বৎসর তিনি এই পরিকল্পনাটি নিয়ে কাজ করবার চেষ্টায় একাধিকবার কলম ধরেছেন। নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকেননি। সময়টা, যতদূর মনে পড়ে, বাংলা বাহান্ন তিপ্পান্ন সাল। সে সময় সে কালের একটি নামকরা সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল ‘সচিত্র ভারত’। ‘সচিত্র ভারত’-এর কর্তৃপক্ষ তাঁকে তাঁদের কাগজে লিখবার জন্য অনুরোধ করেন। যদিও তারাশঙ্কর বহু সংখ্যক উপন্যাস লিখেছেন তবু বহুপ্রসবের জন্য নিজেকে বার বার তিরস্কার করতেন। কিন্তু না লিখেও উপায় থাকত না। কাগজের চাহিদায় ও তাগিদে তাকে লিখতে হত। তাই মধ্যপথ বেছে নিয়ে তিনি উপন্যাস না লিখে অন্য ধরনের  লেখা লিখতেন। ‘সচিত্র ভারত’-এর তাগাদায় তিনি লিখতে আরম্ভ করলেন একটি নাটক। তার বিষয়বস্তু দু’পুরুষ জমিদারের সংঘাত। মাঝখানে এবং তান্ত্রিক ঘটনাচক্রে নাটকের কাহিনীতে জড়িয়ে গিয়েছেন। সে নাটক প্রকাশিত হয়নি। আজও উঠে যাওয়া ‘সচিত্র ভারত’-এর পৃষ্ঠায় সে রচনা মহানিদ্রায় নিদ্রিত।

এরপর আরও কয়েক বছর কাটল। ১৩৬৩।৬৪ সালে পূজা সংখ্যা ‘উল্টোরথ’-এ তিনি একখানি উপন্যাস লিখেছিলেন। নাম ‘জবানবন্দী’। কাহিনী এক জমিদার পরিবারের কয়েক পুরুষের কাহিনী। এই রচনায় সেই নাটকের কাহিনীটি নূতন চেহারা নিয়ে ফিরে এসেছে। সে কাহিনী রচনা আমি নিজের চোখের সামনেই দেখেছি। যা দেখেছি তাতে শিল্পী তারাশঙ্করের এই উপন্যাস লিখবার সময় যে শক্তিমত্তার প্রকাশ দেখেছিলাম তা বিস্ময়কর। তবে সে কাহিনী পৃথক এক কাহিনী। সে লেখার ক্ষেত্র কোনোদিন উপস্থিত হলে তখন বলার কথা বিবেচিত হবে।

‘উল্টোরথ’-এ প্রকাশিত ‘জবানবন্দী ও তারাশঙ্কর গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেননি। তা আজও অপ্রকাশিত। সে কাহিনী একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ অপরূপ শিল্পসৃষ্টি। তাতে কয়েক পুরুষ জমিদার বংশপরম্পরায় আবির্ভূত হয়েছেন। তার সঙ্গে এসেছে গোয়ানদের রঙদার চরিত্র। সেই সঙ্গে নাটকের সেই তান্ত্রিক সন্ন্যাসী উজ্জ্বলতর মূর্তিতে আবার এসে দাঁড়িয়েছেন আপনার পাগল-পাগল ভাবের মাতাল, দুর্দান্ত চেহারা নিয়ে। সে উপন্যাস আজকের বয়স্ক পাঠকদের অনেকেই সেদিনের পুজোসংখ্যা ‘উল্টোরথ’-এ পাঠ করেছেন। তার স্মৃতিও হয়তো তাঁদের অনেকের মনে থেকে এখনও নিশ্চিহ্ন হয়নি।

তারপর আরও চার পাঁচ বছর কেটে গেল। ‘জবানবন্দী’ পড়ে রইল অপ্রকাশিত হয়ে। তিনি তখন ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। সাপ্তাহিক অমৃতের অনুরোধে তিনি ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ লিখতে আরম্ভ করলেন। লিখবার আগে অমৃতের কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন নূতন উপন্যাস লেখা তাঁর পক্ষে সহজ হবে না। তাঁর পুরনো অপ্রকাশিত লেখা নূতন করে লিখে প্রকাশ করতে আপত্তি না হলে তিনি লিখতে পারেন। অমৃত কর্তৃপক্ষ সানন্দে সম্মতি জানালেন।

এরপর সাপ্তাহিক অমৃতে ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ প্রকাশিত হতে আরম্ভ হল। ‘জবানবন্দী’ লেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি উপন্যাসের মূল বক্তব্য বিষয় ও কাঠামো দুই-ই পেয়ে গিয়েছিলেন। মাঝখানের এই কয়েক বৎসরে সেই কাহিনী কল্পনার রসে ভিজেছে এবং সেই জারিত কল্পনার ভ্রূণ থেকে তখন স্বাভাবিকভাবেই হাজারটা জীবন্ত সূত্র তাঁর মনোলোক থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ‘জবানবন্দী’র সেই পূর্ববর্তী ধীরগতি সহজ কাহিনী তখন অসংখ্য চরিত্রের চঞ্চল মিশ্রণে ও আস্ফালনে বৃহৎ ও জটিল হয়ে উঠেছে। মূল কাহিনী ও ‘থিম’-এর গা থেকে আরও বহুতর ডালপালা গজিয়েছে। কাল্পনিক মানুষদের আশেপাশে তখন ইতিহাসের পাতা থেকে উজ্জ্বল ঐতিহাসিক পুরুষরা তাঁর কল্পনায় মূর্তি ধরে চলাফেরা করতে আরম্ভ করেছেন

এই মানসিক পরিবেশে তারাশঙ্করের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম ‘কীর্তিহাটের কড়চা’ রচনা আরম্ভ হল।

এ উপন্যাসে বহু নায়ক-নায়িকা। তবু মূল নায়ক রায়বংশের সপ্তম পুরুষের অন্যতম প্রধান পুরুষ সুরেশ্বর রায়। বাংলা দেশের সমস্ত বড় জমিদারদের যে হাল হয়েছিল, কীর্তিহাটের রায়বাড়ি তার থেকে কিছু আলাদা ছিল না। রায়বংশের তৃতীয় পুরুষ বীরেশ্বর রায়ের সময় থেকে রায় বাবুরা কলকাতামুখী হলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা পাকাপাকি বাস করতে লাগলেন জানবাজারে প্রাসাদোপম বাড়ি করে। সপ্তম পুরুষে সুরেশ্বর রায়ের জন্ম জানবাজারের অভিজাত ও ইংরেজি-ভাবাপন্ন মা বাপের কোলে। বাপ ইংলিশম্যান কাগজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, ঝকঝকে ইংরেজি লিখতেন পাকা কলমে। সুরেশ্বর রায়ের ক্লাসিক্যাল গানে জন্মগত অধিকার। সে লেখাপড়া শিখলে আপন খেয়ালে। শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়াল চিত্রশিল্পী, আর্টিস্ট। সে তখন তখনকারের উঠতি বোহেমিয়ানদের একজন।

এই অবস্থায় তার উপর সমন জারি হল কীর্তিহাটে যাবার, সেটেলমেন্ট অফিসে হাজিরা দেবার। যেতে হল সুরেশ্বরকে। কলকাতায় জন্ম, আজন্মলালিত মহানগরীতে। সেই নাগরিক মন নিয়েই সে গেল কীর্তিহাট। তার পরের কাহিনীই কীর্তিহাটের কড়চার কাহিনী। শিল্পী সুরেশ্বর আস্তে আস্তে ভালোবাসল কীর্তিহাটকে, তার বংশকে, সেখানকার মানুষকে, সেই সঙ্গে মাটিকে। এই বহু-জাল সমন্বিত কাহিনীর অন্তরালে আধুনিক ও উন্নাসিক নাগরিক সুরেশ্বর রায়ের এই ভালোবাসার কাহিনীটিই এর গভীরতম বক্তব্য। তাই এই বৃহৎ উপন্যাসের সমাপ্তি অতি সহজ নম্রসুরে। কোন নাটকীয়তা নেই, কোন ঝকমকানি নেই, সুরেশ্বর রায়ের শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ পত্রের মাধ্যমে এ কাহিনীর পরিসমাপ্তি। একজন লোক ছিল, সে তার দেশের মানুষ ও মাটিকে ভালোবেসেছিল, তারপর সে আর নেই। এসেছিল, ভালোবেসেছিল, তারপর চলে গিয়েছে। এর মধ্যে কোন বিস্ময় নেই, চমক নেই, কিন্তু মানবসভ্যতার শেষ বেদনাটি হয়তো নিহিত আছে। সুরেশ্বর রায়ের সারা জীবনের নিঃশব্দ ও একক অন্বেষণ তাকে নম্র সহজ করে মাটির একান্ত কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছে। দেশের মাটিতে সুরেশ্বরের মন ও দেহ যেন গড়াগড়ি দিয়ে কৃতকৃতার্থ হয়েছে।

‘কীর্তিহাটের কড়চা’র এই বোধ হয় শেষ ফলশ্রুতি।

সনৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়


© 2024 পুরনো বই