সূচনা

প্রবন্ধ-সংগ্রহ – মোহিতলাল মজুমদার

প্রথম প্রকাশ, মাঘ ১৪০০

প্রচ্ছদপট অঙ্কন – পূর্ণেন্দু রায়

প্রকাশকের নিবেদন

বাংলা সাহিত্যে সমালোচনার ইতিহাসে স্বর্গত মোহিতলাল মজুমদার নামটি আজও এক শিরোনাম বিশেষ এবং সে নাম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতোই ভাস্বর। তিনি সমালোচক হিসেবে বড় না কবি হিসেবে বড়, এ নিয়ে তর্কের মীমাংসা এখনও দুরূহ পাঠকের কাছে। মোহিতলাল মজুমদার মহাশয়ের জীবৎকালে তাঁর সাহিত্য-আলোচনায় প্রাঞ্জলতা এবং বক্তব্যের ঋজুতার জন্য বিরুদ্ধ মতাবলম্বী পাঠকও তাঁর প্রবন্ধ না পড়ে থাকতে পারতেন না। যাঁরা তাঁকে দেখেছেন তাঁদের তো কথাই নেই, যাঁরা দেখেন নি তাঁরাও তাঁর প্রবন্ধ ও সাহিত্য-আলোচনা পাঠের মধ্যে আজও তাঁর সেই ঋজু ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি ও অনুভব করতে পারেন। এই প্রবন্ধ-সংগ্রহ প্রকাশের কাজে আমরা বাংলাসাহিত্যের রসজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীভবতোষ দত্তের কাছে ঋণী। তিনি যত্নসহকারে তাঁর মূল্যবান সময় ব্যয় করে প্রবন্ধগুলি নির্বাচন করে দিয়েছেন। সুপণ্ডিত সাহিত্য-অধ্যাপক শ্রীঅসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় অনুগ্রহ করে গ্রন্থটির ভূমিকা লিখে দেওয়ায় আমরা তাঁর প্রতি সবিশেষ কৃতজ্ঞ। মোহিতলাল মজুমদার মহাশয়ের দুই পুত্র শ্রীমণিলাল মজুমদার ও শ্রীমনসিজ মজুমদারের সানুগ্রহ সহযোগিতা ব্যতীত এই গ্রন্থ প্রকাশ সম্ভব হত না। এঁদের সকলের কাছেই আমরা ঋণপাশে আবদ্ধ।

.

ভূমিকা

মোহিতলাল মজুমদার মহাশয়ের* প্রবন্ধ-সংগ্রহের ভূমিকা লিখতে গিয়ে কয়েকটি কথা মনে পড়ছে। তাঁর সান্নিধ্যে এলে মনে হত, যেন এক বিশ্বচেতনার পাদপীঠে বসে আছে। তখন শুধু আমাদের শ্রোতার ভূমিকা, মোহিতলাল একাই বক্তা। কখনও ওঠে ব্যঙ্গবিদ্রূপের বক্রতা, কখনো অর্ধবিকশিত নয়নে স্বপ্নের অঞ্জন। কখনও স্নিগ্ধ সজল কণ্ঠে মেঘনাদবধ কাব্যের শেষ সর্গের শেষাংশের আবৃত্তি, কখনো-বা রবীন্দ্রনাথের ‘ঝুলন’ কবিতার তরঙ্গায়িত দোদুল্যমানতা। সেই মোহিতলালকে আমরা কি ভুলে গেছি?

ইতিহাসের পটোত্তোলন করলে মনে হবে, বিস্মরণীর স্রোতোধারা বাঙালী চেতনার অন্তস্তল দিয়ে বয়ে চলেছে। আজ যাঁকে স্মরণের মণিকোঠায় ভক্তি-অর্ঘ্যে অর্চনা করি, কিছুকাল অতিক্রান্ত হলে তাঁকে অবহেলা ও অনাদরে ধূলিধূসর কুলুঙ্গিতে তুলে রাখি। গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনার তীরে তীরে গড়ে উঠেছে সভ্যতা, রচিত হয়েছে দেবদেউল, লেখা হয়েছে কত না কাব্যকাহিনী। ভরা ভাদ্রের প্রবল স্রোত তটভূমিকে গ্রাস করে, ভাঙনের আঘাতে গ্রাম কোন্ অতলে তলিয়ে যায়, তার ঠিকঠিকানা থাকে না। তাই কবি সত্যেন্দ্রনাথের মতো বলতে ইচ্ছা করে, গম্-ধাতুই বাঙালীর প্রাণের ধাতু, কেবল চলাই তার জীবনধর্ম। কিছুই সে জমিয়ে রাখে না, দু’হাতে যতটা সঞ্চয় করে, তার সবটাই বিলিয়ে দেয়। তাই বোধহয় একালে মোহিতলালের স্মৃতি ক্রমেই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রায় চল্লিশ বছর আগেও তাঁকে দেখেছি। তখন স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছিল, হাত-পা ফুলতে আরম্ভ করেছিল, মৃত্যুর পরোয়ানা তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু তখনও কণ্ঠে কত তীব্রতা, শুষ্ক নয়নে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। সাহিত্যে যাঁরা মিথ্যাচারী, নাস্তিক, ফিলিস্টাইন—তাদের প্রতি দুর্বাসার অভিশাপের মতো তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল তীব্র ব্যঙ্গ। আবার অন্যদিকে দ্বিতীয় বিধাতার মতো তিনি রসস্রষ্টা, কামনার পঞ্চপ্রদীপে যাঁর আরতি করেছেন সেই কল্পনাসুন্দরী তাঁকে বারবার হাতছানি দিয়ে নিয়ে গিয়েছেন রূপ-রস-গন্ধমাতাল বিশ্বভুবনের শ্যামলে-হরিতে-নীলিমায়, পৌঁছিয়ে দিয়েছেন রসতীর্থের ঘাটে ঘাটে।

মোহিতলাল কবি ও সমালোচক, রসস্রষ্টা ও রসপ্রমাতা। এই দুই বিপ্রতীপ মনোধর্ম তাঁর যাবতীয় সৃষ্টিকর্মকে নিয়ন্ত্রিত করেছিল। অনেক কবিই যুগপৎ শিল্পী ও শিল্পবিচারক। বোধহয় কবিরা নিজেদের মনের মধ্যে দুটি সত্তা লালন করেন। একটি সত্তা রসানন্দ সৃষ্টি করে, আর একটি সত্তা সৃষ্টিকর্মকে দূর থেকে নিরীক্ষণ করে। একদিকে তিনি কবি, আর একদিকে তিনি পাঠক। পাঠক তাঁর কবিসত্তার গুণাগুণ বিচার করে। তখন তিনি মননধর্মী, বিশ্লেষণ তাঁর হাতিয়ার। যাঁর মধ্যে এই দুই সত্তার মিলন হয়, তাঁর মধ্যে কবি ও সমালোচক অবিরোধে বাস করতে পারে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরীজ, হাইনে, শেলী, আরনল্ড, এলিয়ট, পাউণ্ড—তাঁরা একই সঙ্গে কবি ও সমালোচক। আমাদের দেশেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এবং একালের কোনো কোনো কবি (সুধীন্দ্র দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে) কল্পনার তুরঙ্গে সওয়ার হয়ে বিশ্বভুবন পরিক্রমণ করেন, আবার অতন্দ্র বুদ্ধির পাহারায় কল্পনাকে সংযত করে রাখেন। হয়তো কেউ কেউ প্রধানতঃ কবি, গৌণতঃ সমালোচক। কেউ-বা তার বিপরীত। মোহিতলাল কিন্তু একই সঙ্গে কবি ও সমালোচক, তাঁর দুই মানসিকতাই সমভারসহ। কিন্তু তাঁর কবিস্বরূপ সম্বন্ধে যতটা আলোচনা হয়েছে, সমালোচক-সত্তা সম্বন্ধে ততটা বুদ্ধিগ্রাহ্য বিশ্লেষণ—যাকে এ্যাকাডেমিক আলোচনা বলে, চোখে পড়ে না। এই প্রসঙ্গে বাংলা সমালোচনার বিবর্তন সম্বন্ধে দু’ এক কথা আলোচনা করা যেতে পারে।

বাংলা গদ যেদিন থেকে সাবালকত্ব অর্জন করল, তখন থেকে সাহিত্যবিচার পদ্ধতিও ক্ষীণভাবে আবির্ভূত হল। মধ্যযুগে গদ্যের ব্যবহার ছিল না, তাই কাকে সাহিত্যবিচার বলে, কোন্ মানদণ্ডে কাব্যাদি বিশ্লেষণ করতে হবে, সে বিষয়ে সেকালে কারো মনে কোনো প্রশ্ন জাগেনি। মধ্যযুগের শেষকবি ভারতচন্দ্রের অলঙ্কারশাস্ত্র ঘাঁটা মন কিছুটা রসের স্বরূপ বুঝতে পেরেছিল—”যে হৌক সে হৌক ভাষা, কাব্য রস লয়ে।” ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্র ও রসতত্ত্বের মতে রসই কাব্যের প্রাণ। ‘রস’, অর্থাৎ শিল্পসৃষ্টি থেকে বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক আনন্দ জন্মায়। উনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্রের কিছু পূর্বে সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে অল্পস্বল্প সমালোচনা শুরু হলেও রাজেন্দ্রলাল মিত্রের পূর্বে এবিষয়ে কোনো বড়ো মাপের সমালোচনা চোখে পড়ে না। রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বাঙ্গালা কবিবিষয়ক প্রবন্ধ’ (১৮৫২) এবং ‘পদ্মিনী উপন্যাসে’র ভূমিকায় কাব্যের গুণাগুণ বিচারের চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইংরেজি কাব্য-নাট্যতত্ত্ব সম্বন্ধে সম্যক অবহিত ছিলেন। সে কথা বোঝা যাবে তাঁর চিঠিপত্র থেকে। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা সমালোচনার পথ নির্মাণ করেন। অবশ্যই পাশ্চাত্য সাহিত্যবিচার পদ্ধতির নানা প্রকরণ তাঁর চিন্তাশক্তিকে সচেতন করেছিল। ম্যাথু আর্নডের মতো তিনিও মধ্যভিক্টোরীয় নীতিবাদ ও শুচিতাবোধের মুঠিপেষণ এড়াতে পারেননি এবং সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রের প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না, বরং রস সম্বন্ধে আলঙ্কারিকদের অভিমত তাঁকে যথেষ্ট বিরস করে তুলেছিল। সে যাই হোক, তাঁর সাহিত্যবিচারপদ্ধতি পুরোপুরি ইংরেজির অনুগামী। আমাদের মনে হয়, পাশ্চাত্য সমালোচনা পদ্ধতি ও প্রাচীন ভারতীয় রসবাদের মধ্যে অহিনকুল সম্বন্ধ নেই, এ সত্যটি তাঁর কাছে উদ্ঘাটিত হলে বাংলা সমালোচনার প্রথম বুনিয়াদ অধিকতর দৃঢ় হতে পারত। সাহিত্যবিচারে বঙ্কিমচন্দ্র প্রধানত যুক্তিমার্গ অবলম্বন করেছিলেন। অপর দিকে কবি রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যবিচারেও একান্তভাবে ব্যক্তিগত, গীতিকবিদের যে স্বভাব তাঁর প্রায় সমস্ত গদ্য রচনাতেই তা লক্ষ্য করা যাবে। কল্পনা, আবেগ, সৌন্দর্যবোধ ও ঔপনিষদিক আনন্দতত্ত্বকে সমালোচনার কায়া ও কান্তিগঠনে প্রয়োগ-সাহিত্যবিচারে তাঁর প্রধান অবলম্বন। সংস্কৃত সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য প্রভৃতি আলোচনায় তিনি ব্যক্তিগত উপলব্ধির মাপকাঠি ব্যবহার করেছেন। তাই সমালোচনা তাঁর কাছে জ্ঞানানন্দ নয়, রসানন্দ। একালের মূল্য যাচাই করা সমালোচনা তাঁর রুচিকর নয়—”আমাদের আজকালকার সমালোচনা বাজার দর যাচাই করা; কারণ সাহিত্য এখন হাটের জিনিস।” তাই তাঁর স্থির সিদ্ধান্ত, “যথার্থ সমালোচনা পূজা, সমালোচক পূজারি পুরোহিত।” এক সময়ে যাকে creative criticism বলা হত, অর্থাৎ সৃজনশীল রসসাহিত্যের মতো সমালোচনাকেও নিছক বুদ্ধিগ্রাহ্য না করে হৃদয়সংবাদী ও মনোহারী করার দিকে তাঁর ছিল স্বাভাবিক প্রবণতা। প্রথম যৌবনে তিনি শুরু করেছিলেন সৌন্দর্যতত্ত্ব দিয়ে, অর্থাৎ সৌন্দর্যসৃষ্টি সাহিত্যের মূল কথা। পরে তাঁর প্রথম যৌবনের সৌন্দর্যতত্ত্ব উত্তর-যৌবনে আনন্দতত্ত্বে পরিণতি লাভ করল, যে আনন্দতত্ত্ব তিনি উপনিষদের রসতত্ত্ব থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর উত্তর-জীবনে আবির্ভূত নব্য কবির দল, সেই সব avant-garde, যাঁরা প্রগতি, কল্লোল, কালিকলম, সংহতিতে আসর জাঁকিয়ে বসেছিলেন, তাঁরা পুরোপুরি ইংরেজি-ফরাসি-জার্মান সমালোচনা পদ্ধতি গ্রহণ করলেন। মার্কস্, ফ্রয়েড, এ্যাডলার, য়ুং তাঁদের যাত্রাপথে আলো ধরলেন, ‘শিকাগো ক্রিটিকস্’ থেকে কডওয়েল পর্যন্ত সমালোচনার বিচিত্র পথে তাঁরা সাহিত্যসমালোচনাকে নামিয়ে আনলেন। ক্রমে আলোচনায় মননের স্থানে জেঁকে বসল যান্ত্রিকতা। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে বোঝা গেল, যন্ত্র যন্ত্রই, তা চেতনাকে নিয়ন্ত্রিত করে না। মানুষই যন্ত্র বানায়, দরকার হলে সে যন্ত্র ভেঙেও ফেলে। যান্ত্রিক বিচারপদ্ধতি মানুষকে গ্রাস করলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সমষ্টির যূপকাষ্ঠে বলি প্রদত্ত হবে। তার প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া সারা বিশ্বেই প্রকটভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে।

রবীন্দ্রনাথ যেমন রসানন্দকে সাহিত্যবিচারের মাপকাঠি ধরেছেন তেমনি এ্যাকাডেমিক ও প্রতিষ্ঠানিক সমালোচকেরা বাংলা সমালোচনা রীতির আর একটি দিগন্ত খুলে দিয়েছেন। কেউ কেউ প্রাচীন ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রের ধ্বনি, রস, বক্রোক্তি, ঔচিত্য প্রভৃতি তত্ত্বের আধারে বাংলা সমালোচনাকে ঢেলে সাজাবার চেষ্টা করলেন এবং ভরত আনন্দবর্ধন অভিনবগুপ্ত মন্মট ভট্ট থেকে জগন্নাথ পর্যন্ত সংস্কৃত কাব্যবিচারপ্রণালীকে বাংলা সাহিত্যবিষয়ে প্রয়োগের সিদ্ধান্ত করলেন; অতুলচন্দ্র গুপ্ত, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, সুধীরকুমার দাশগুপ্ত প্রভৃতি নব্য অভিনবগুপ্তেরা পুরাতন ধ্বনিবাদ রসবাদের মাপকাঠি মেপে মেপে বাংলা সাহিত্যবিচারে প্রবৃত্ত হলেন। অপরদিকে, যাঁরা পাশ্চাত্যপন্থী, তাঁরা এ্যারিস্টটল থেকে টলস্টয় ক্রোচে রিচার্ডস এলিয়ট এজরা পাউন্ড প্রচারিত সাহিত্যবিচার প্রণালীকে একমাত্র শিষ্ট রীতি বলে গ্রহণ করলেন। তাঁরা প্রায় সকলেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের কৃতবিদ্য অধ্যাপক। এঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর ছাত্র ও শিষ্যেরা। তাঁদের পূর্বে প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ও শশাঙ্কমোহন সেন বাংলা সাহিত্য বিশ্লেষণে ও—দেশের পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের প্রতি এঁদের মমতা ছিল, কিন্তু অধিকতর শ্রদ্ধা ছিল ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি। তাঁরা চেষ্টা করলে বাংলা সাহিত্যের উপযোগী theory of literature গড়ে তুলতে পারতেন, যে-কাজ তাঁদের অনেক পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন। কলকাতায় Anglophil ও Orientalist দের যে দ্বন্দ্ব উনিশ শতকের চতুর্থ দশকে আরম্ভ হয়েছিল ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সাহিত্য-সমালোচনাতেও তার প্রতিধ্বনি শোনা যাবে। এখন সংস্কৃত রসবিচার ও অলঙ্কার শাস্ত্র সংস্কৃত পড়ুয়ারা ছাড়া আর কেউ তা নিয়ে আলোচনা করেন না। সাহিত্যসমালোচনা, ভাষাবিজ্ঞান, শৈলীবিজ্ঞান নিয়ে যে সমস্ত গবেষণা হচ্ছে, তার বারো আনা অংশ পাশ্চাত্য রীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

উনিশ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ দশকে রামমোহন, হিন্দু কলেজের ছাত্রসমাজ, বিদ্যাসাগর—বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা ও চিন্তায় বুদ্ধির যে জয়ধ্বনি শোনা গিয়েছিল, তার মূলে ছিল সমাজ, সাহিত্য, শিক্ষা, রাজনীতি ও ধর্মতত্ত্বের নতুনভাবে পর্যালোচনার প্রয়াস। রামমোহন থেকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র সেন পর্যন্ত ধর্মীয় অনুভাবনা নাগরিক কলকাতাকে বিচঞ্চল করে তুলেছিল। হিন্দু কলেজের ডিরোজিও-পন্থী ইয়ং বেঙ্গল’ যুবজন এ-সব ধর্মকর্মকে কুসংস্কার বলে পরিত্যাগ করেছিলেন, এই কালাপাহাড়ি যুবকদের হিন্দুধর্ম বিরোধিতায় কলকাতার উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজ অতিশয় উৎকণ্ঠিত হয়েছিলেন। অবশ্য ইয়ং বেঙ্গলদের “সংশপ্তক” হুংকার ক্রমেই উগ্রতা হারাল। কেউ পুরাতন বিশ্বাসে ফিরে গেলেন, ঘটা করে হিন্দুয়ানির চূড়ান্ত করে ছাড়লেন (যেমন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়)। এর কারণ, তাঁরা জাতির মূল আশ্রয় পরিত্যাগ করে বায়ুজীবী অর্কিডে পরিণত হয়েছিলেন। অপরদিকে ত্রিধাবিভক্ত ব্রাহ্মসমাজ (আদি ব্রাহ্মসমাজ, ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ও ভারতবর্ষীয় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ) ক্রমেই হীনবল হয়ে পড়ল এবং বঙ্কিমচন্দ্রের জন্য পৌরাণিক মতবাদ সেই শূন্যস্থান পূরণে অগ্রসর হল, যার শেষ ফলশ্রুতি শ্রীরামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের সমন্বয়মূলক হিন্দুধর্ম ও দর্শন। অবশ্য কেউ কেউ বলে থাকেন (কাজী আবদুল ওহুদ, সুশোভন সরকার), রামমোহন-প্রবর্তিত ব্রাহ্মসমাজ-প্রভাবিত মুক্ত বুদ্ধি ক্রমেই হিন্দু রক্ষণশীলতার কুক্ষিগত হল এবং নব্য পৌরাণিক হিন্দুসমাজ প্রবল হয়ে উঠল, তার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা বাঙালীর উজ্জাগর নব্য মানসিকতাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তাই এঁরা উনিশ শতকের শেষার্ধের বাঙালীর নবজাগরণকে রক্ষণশীল হিন্দুমানসিকতার পুনর্জাগরণ বলে মনে করেন। এ-ধরনের অভিমতের গুহ্য কারণ—এই নবজাগরণে, যে-কোনো কারণেই হোক, মুসলমান সমাজ যোগদান করেননি। ফলে বাঙালির রাষ্ট্রসাধনা, শিক্ষা ও সমাজপ্রগতি, ধর্মান্দোলন, সাহিত্যসৃষ্টিতে হিন্দু-মানসিকতার সঞ্চার হয়েছে। তার জন্য বিধাতা ছাড়া আর কাকেই বা দোষ দেব? এ-সমস্ত সমাজ ও ইতিহাস-সংক্রান্ত তত্ত্বকথা ছেড়ে দিলে দেখা যাবে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে এই শতাব্দীর তিন-চার দশক পর্যন্ত বাঙালির মনন অসাধারণ দীপ্তি লাভ করেছে। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রমথ চৌধুরী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এবং আমাদের কালে মোহিতলাল মজুমদার মননের বিচিত্র ঐশ্বর্য সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু এখনও মোহিতলালের মনোধর্মের সম্যক আলোচনা হয়নি। যাও-বা হয়েছে, তাতে বাম হস্তের দাক্ষিণ্যের দান লক্ষ্য করে বিষণ্ণ হতে হয়। তাঁর সাহিত্যবিচার-বিশ্লেষণ শুধু সাহিত্যঘটিত রসবিচার নয়, তাতে আধুনিক বাঙালীর সামগ্রিক চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালী সংস্কৃতির মূল তাৎপর্য আবিষ্কারের জন্য একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মোহিতলাল সেই ঐতিহ্যের শিকড় সন্ধান করেছেন। বাঙালীর বৈষ্ণব ও তান্ত্রিক সংস্কার, মধ্যযুগীয় কুলাচার, শৈব নাথ সম্প্রদায়, বৌদ্ধ তান্ত্রিকতা, সুফী, বাউল, দরবেশ ও লোকযানের মধ্যে সংযুক্ত বাঙালীর অব্রাহ্মণ্য প্রত্ন-ইতিহাস; পরিশেষে পাশ্চাত্য সভ্যতা, শিক্ষা ও সাহিত্যের প্লাবনে এ-জাতির নতুন জীবনায়ন। মোহিতলাল সাহিত্য সংক্রান্ত, সমাজ-সংস্কৃতিগত আলোচনা এবং ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে বাঙালীর সেই মূল চরিত্রের সন্ধান করেছেন। তাঁর ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্য’, ‘সাহিত্যকথা’, ‘সাহিত্যবিতান, ‘বিবিধকথা’, ‘বিচিত্রকথা’, মধুসূদন—বঙ্কিমচন্দ্র-বিহারীলাল-রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র বিষয়ে সূচীমুখ আলোচনা, বাংলার মধ্যযুগের সাহিত্যাদর্শ ও চিন্তায় সাহিত্য ও শিল্পের মৌলিক প্রশ্ন ও তার উত্তরের আলোচনা নিশ্চয় আছে। তার সঙ্গে আছে বাঙালী চেতনার জীয়নকাঠি আবিষ্কারের ঐকান্তিক চেষ্টা। তাই তাঁর এই সমস্ত গ্রন্থগুলিকে নিছক সাহিত্য-সমালোচনা বলে সহজ করা যায় না, তার মধ্যে এদেশের সমগ্র চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। একালের দুর্মেধা পাঠককুল এবং ডিলিট্যান্ট সমালোচকবর্গ তাঁকে স্বল্পপ্রশংসায় আড়াল করে রেখেছেন। কিন্তু কে না জানে, অল্প প্রশংসা নিন্দারই ছদ্মবেশ! সে যাই হোক, একালের তরুণ পাঠক—পাঠিকা, যাঁরা এখনও কেতাবি বিদ্যার ছাপমারা হননি, তাঁদের জন্য প্রকাশক এই সংগ্রহটি প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে আছে সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যবিশ্লেষণ, পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ যার শুরু করেছিলেন। সেই তত্ত্বের আলোকে মোহিতলাল ঊনিশ শতকের বাঙালী কবি-সাহিত্যিকদের রচনা বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর অসাধারণ মৌলিকতা, প্রকাশের ঋজুতা এবং গভীর চিন্তা রবীন্দ্রনাথ ও রামেন্দ্রসুন্দরের পর আর কার মধ্যেই বা এত অজস্র পরিমাণে ধরা পড়েছে?

তাঁর ভাষা-ভঙ্গিমা সম্বন্ধে দু-এক কথা বলি। কারণ একালে কেউ কেউ বলেন, তাঁর গদ্যরীতি একটু গুরুভার, বাক্যগঠন দীর্ঘায়ত। ফলে সূক্ষ্ম তত্ত্বকথা যথাস্থানে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়ে যায়। শশাঙ্কমোহন সেন এবং শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় চিন্তার ক্ষেত্রে অনন্য, সিদ্ধান্তে নৈয়ায়িক। উভয়েই ইংরেজী সাহিত্য মন্থন করে বাংলা ভাষায় তার অমৃতভাণ্ড উপহার দিয়েছেন। কিন্তু ইংরেজী-গন্ধী কৃত্রিম ভাষারীতির জন্য তাঁরা পাঠকের হৃদয়-দুয়ার পুরোপুরি খুলতে পারেন নি। মোহিতলালের বাণী গ্রন্থনা তাঁর চিন্তার মতো ঋজু কঠিন, কোনো দিকে হেলে না, বাঁকে না। এই ক্লাসিক গদ্যরীতি একালের দুর্বল-মস্তিষ্ক বাঙালীর কাছে বিভীষিকা বলে মনে হতে পারে। টপ্‌পা-ঠুংরীর চালে অভ্যস্ত সৌখিন পাঠক ধ্রুপদ-ধামারের বোলে স্বতই বিমূঢ় হয়ে পড়বেন। যে-ভাষারীতি বিদ্যাসাগর থেকে বঙ্কিমচন্দ্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথে পূর্ণতা লাভ করেছে সে রীতি বোধহয় একালে আর অনুশীলিত হবে না। একালে লেখার গদ্য সম্বন্ধে কিছু না বলাই ভালো। যেখানে বানান নিয়ে ‘ধুন্ধুমার’ চলেছে, এখনও পর্যন্ত বাংলা বানান দূরস্ত হল না, ব্যাকরণ ক্রমে বিভীষিকায় পরিণত হয়েছে, সেখানে এ ভাষা পরম্পরাগত রীতি অনুসরণ করছে কিনা কে তার বিচার করবে?

মোহিতলালের চিন্তাপ্রণালী এবং সাহিত্যবিচারের প্রকৃতি ও প্রবণতা একালের পাঠকের রুচিকর হবে কি? কিন্তু কেউ যদি একটু মনোযোগ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে এই সংগ্রহের চৌদ্দটি প্রবন্ধ পড়েন, তা হলে তা থেকেই মোহিতলালের মন ও মেজাজের পরিচয় পাবেন। বাংলা সাহিত্যই বাঙালীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ। তার রাজনীতি, সামাজিক আদর্শ, চিন্তাপ্রণালী, ধর্ম-উপধর্মসম্প্রদায়ের ইতিবৃত্ত সহস্র বার পরিবর্তন হবে, কিন্তু দীর্ঘকাল বাংলা সাহিত্য বাঙালীকে বর্মের মতো রক্ষা করবে, সেই বর্মটির স্বরূপ বিশ্লেষণ এই সংগ্রহের প্রতিটি প্রবন্ধেই লক্ষ্য করা যাবে। তাঁর কাছে জীবন ও সাহিত্য এক হয়ে গিয়েছিল। সেই সাহিত্য নিয়ে কেউ ছেলেখেলা করলে বা দল ও মতের দাসত্ব করলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে পড়তেন। তখন রসনা হত ক্ষুরধার, রচনা হত শাণিত কৃপাণ। ফলে অচিরে বন্ধুরা বক্র হতেন, কেউ শত্রু হয়ে পড়তেন, শিষ্যেরা একটু দূরে দূরে অবস্থান করতেন। বাঙালী ঐতিহ্যের ক্রমিক অধঃপতন দেখে তিনি দুঃখ পেতেন, দুঃখ থেকে ক্রোধের উৎপত্তি হত—যাকে হিব্রু শাস্ত্রে বলা হয়েছে ‘holy rage’, যে-ক্রোধ তামসিক নয়, পরম সাত্ত্বিক। তাঁর সেই বিচিত্র মানসিকতার পরিচয় এই প্রবন্ধগুলিতে লক্ষ্য করা যাবে।

অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়


© 2024 পুরনো বই