সমুদ্রপাড়ি

বন্দর পার হইয়া জাহাজে গিয়া উঠিলাম। আরও অনেকবার জাহাজে চড়িয়াছি প্রত্যেকবারেই প্রথমটা কেমন মনের মধ্যে একটা সংকোচ উপস্থিত হয়। সে সংকোচ অপরিচিত স্থানে অপরিচিত মানুষের মধ্যে প্রবেশ করিবার সংকোচ নহে। জাহাজটার সঙ্গে নিজের জীবনের বিচ্ছেদ অত্যন্ত বেশি করিয়া অনুভব করি। এ জাহাজ যাহারা গড়িয়াছে, যাহারা চালাইতেছে, তাহারাই এ জাহাজের প্রভু– আমি টাকা দিয়া টিকিট কিনিয়া এখানে স্থান পাইয়াছি। এই সমুদ্রের চিহ্নহীন পথের উপর দিয়া কত বংশ ধরিয়া ইহাদের কত নাবিক আপনার জীবনের অদৃশ্য রেখা রাখিয়া গিয়াছে; বারম্বার কত শত মৃত্যুর দ্বারা তবে এই পথ ক্রমে সরল হইয়া উঠিতেছে। আমি যে আজ এই জাহাজে দিনে নির্ভয়ে আহার বিহার করিতেছি ও রাত্রে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইতেছি, এই নির্ভয়তা কি শুধু টাকা দিয়া কিনিবার জিনিস। ইহার পশ্চাতে স্তরে স্তরে কত চিন্তা কত সাহসের সঞ্চয় সমুচ্চ হইয়া রহিয়াছে; সেখানে আমাদের কোনো অর্ঘ্য জমা হয় নাই।

যখন এই ইংরেজ স্ত্রী-পুরুষদের দেখি, তাহারা ডেকের উপর খেলিতেছে, ঘুমাইতেছে, হাস্যালাপ করিতেছে, তখন আমি দেখিতে পাই–ইহারা তো কেবলমাত্র জাহাজের উপরে নাই, ইহারা স্বজাতির শক্তির উপর নির্ভর করিয়া আছে। ইহারা নিশ্চয় জানে যাহা করিবার তাহা করা হইয়াছে এবং যাহা করিবার তাহা করা হইবে, সেজন্য ইহাদের সমস্ত জাতি জামিন রহিয়াছে। যদি প্রাণসংশয়-সংকট উপস্থিত হয় তবে কেবল যে কাপ্তেন আছে তাহা নহে, ইহাদের সমস্ত জাতির প্রকৃতিগত উদ্যম ও নিরলস সতর্কতা শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে। ইহারা সেই দৃঢ় ক্ষেত্রের উপর এমন প্রফুল্লমুখে প্রসন্নচিত্তে সঞ্চরণ করিতেছে, চারি দিকের তরঙ্গের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করিতেছে না। এই জায়গায় ইহারা নিজেরা যাহা দিয়াছে তাহাই পাইতেছে–আর আমরা যাহা দিই নাই তাহাই লইতেছি; সুতরাং সমুদ্র পার হইতে হইতে দেনা রাখিয়া রাখিয়া যাইতেছি। তাই জাহাজে ডেকের উপরে ইংরেজ যাত্রীদের সঙ্গে একত্র মিলিয়া বসিতে আমার মন হইতে কিছুতে সংকোচ ঘুচিতে চায় না।

ডাঙায় বসিয়া অনেক বিলাতি জিনিস ব্যবহার করিয়া থাকি, সেজন্য মনের মধ্যে এমনতরো দৈন্য বোধ হয় না; জাহাজে আমরা আরও যেন কিছু বেশি লইতেছি। এ তো শুধু কলকারখানা নয়, সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আছে। জাহাজ যাহারা চালাইতেছে তাহারা নিজের সাহস দিয়া, শক্তি দিয়া পার করিতেছে; তাহাদের যে মনুষ্যত্বের উপর ভর দিয়া আছি নিজেদের মধ্যে তাহারই যদি কোনো পরিচয় থাকিত তবে যে টাকাটা দিয়া টিকিট কিনিয়াছি তাহার ঝম্‌ঝমানির সঙ্গে অন্য মূল্যের আওয়াজটাও মিশিয়া থাকিত। আজ মনের মধ্যে এই বড়ো একটা বেদনা বাজে যে, উহারা প্রাণ দিয়া চালাইতেছে আর আমরা টাকা দিয়া চলিতেছি,ইহার মাঝখানে যে একটা প্রকাণ্ড সমুদ্র পড়িয়া রহিল তাহা আমরা কবে কোন্‌ কালে পার হইতে পারিব! এখনো আরম্ভও করা হয় নাই, এখনো অকাতরে কত প্রাণ দেওয়া বাকি রহিয়াছে–এখনো কত বন্ধন ছিঁড়িতে হইবে, কত সংস্কার দলিতে হইবে, সে কথা যখন ভাবি তখন বুঝিতে পারি, আজ গোটাকয়েক খবরের কাগজের নৌকা বানাইয়া তাহারই খেলার পালের উপর আমরা যে বক্তৃতার ফুঁ লাগাইতেছি তাহাতে আমাদের কিছুই হইবে না।

কূলকিনারার বন্ধন ছাড়াইয়া একেবারে নীল সমুদ্রের মাঝখানে আসিয়া পড়িয়াছি। ভয় ছিল, ডাঙার জীব সমুদ্রের দোলা সহিতে পারিব না– কিন্তু, আরব-সমুদ্রে এখনো মৈসুমের মাতামাতি আরম্ভ হয় নাই। কিছু চঞ্চলতা নাই তাহা নহে, কারণ, পশ্চিমের উজান হাওয়া বহিয়াছে, জাহাজের মুখের উপর ঢেউয়ের আঘাত লাগিতেছে, কিন্তু এখনো তাহাতে আমার শরীরের অন্তবিভাগে কোনো আন্দোলন উপস্থিত করিতে পারে নাই। তাই সমুদ্রের সঙ্গে আমার প্রথম সম্ভাষণটা প্রণয়সম্ভাষণ দিয়াই শুরু হইয়াছে। মহাসাগর কবির কবিত্বটুকুকে ঝাঁকানি দিয়া নিঃশেষ করিয়া দেন নাই, তিনি যে ছন্দে মৃদঙ্গ বাজাইতেছেন আমার রক্তের নাচ তাহার সঙ্গে দিব্যি তাল রাখিয়া চলিতে পlতেছে। যদি হঠাৎ খেয়াল যায় এবং একবার তাঁহার সহস্র উদ্যত হস্তে তাণ্ডবনৃত্যের রুদ্রবোল বাজাইতে থাকেন, তাহা হইলে আর মাথা তুলিতে পারিব না। কিন্তু, ভাবখানা দেখিয়া মনে হইতেছে, ভীরু ভক্তের উপর এ যাত্রায় তাঁহার সেই অট্টহাস্যের তুমুল পরিহাস প্রয়োগ করিবেন না।

তাই জাহাজের রেলিং ধরিয়া জলের দিকে তাকাইয়া আমার দিন কাটিতেছে। শুক্লপক্ষের শেষ দিকে আমাদের যাত্রা আরম্ভ হইয়াছে। যেমন সমুদ্র তেমনি সমুদ্রের উপরকার রাত্রি; স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া দুই অন্তহীনের সুন্দর মিলনটি দেখিতে থাকি; স্তব্ধের সঙ্গে চঞ্চলের, নীরবের সঙ্গে মুখরের, দিগন্তব্যাপী আলাপ চুপ করিয়া শুনিয়া লই। জাহাজের দুই ধারে জ্বলন্ত ফেনরাশি কাটিয়া কাটিয়া পড়ে, তাহার ভঙ্গীটি আমার দেখিতে বড়ো সুন্দর লাগে। ঠিক মনে হয় যেন জাহাজটাকে ফুলের বীজকোষের মতো করিয়া তাহার দুই পাশে সাদা পাপড়ি মুহূর্তে বিকশিত হইয়া ছড়াইয়া পড়িতেছে।

সম্মুখে আমার নিস্তব্ধ রাত্রে এই মহাসমুদ্রের সুগম্ভীর কললীলা, আর পশ্চাতে আমার এই জাহাজের যাত্রীদের অবিশ্রাম হাস্যালাপ আমোদ আহ্লাদ। যতবার আমি জাহাজে আসিয়াছি প্রত্যেক বারেই আমার এই কথাটি মনে হইয়াছে যে, আমাদের ক্ষুদ্র জীবনটুকুর চারি দিকেই যে-একটি অক্ষুব্ধ অনন্ত রহিয়াছেন,তাঁহার দিকে এই যাত্রীদের এক মুহূর্তও তাকাইবার অবকাশ নাই। জীবনের প্রতি ইহাদের আসক্তি এত অত্যন্ত বেশি যে, জীবনের গভীর সত্যকে উপলব্ধি করিতে হইলে তাহার নিকট হইতে কতটুকু দূরে যাওয়া আবশ্যক ইহারা এক মুহূর্তের জন্যও ততটুক দূরে যাইতে পারে না। এইজন্য ইহাদের ধর্মোপাসনা যেন একটা বিশেষ আয়োজনের ব্যাপার, নিজেকে যেন এক জায়গা হইতে বিশেষভাবে বিচ্ছিন্ন করিয়া ক্ষণকালের জন্য আর-এক জায়গায় লইয়া যাইতে হয়। এ জাহাজ যদি ভারতবাসী যাত্রীদের জাহাজ হইত তাহা হইলে দিনের সমস্ত কাজকর্ম-আমোদ-আহ্লাদের অত্যন্ত মাঝখানেই দেখিতে পাইতাম মানুষ অসংকোচে অনন্তকে হাতজোড় করিয়া প্রণাম করিতেছে; সমস্ত হাসিগল্পের মাঝে মাঝেই নিতান্ত সহজেই ধর্মসংগীত ধ্বনিত হইয়া উঠিত। সসীমের সঙ্গে অসীম, জীবের সঙ্গে শিব যে একেবারে মিলিয়া আছেন। দুইয়ের সহযোগেই যে সত্য সর্বত্র পরিপূর্ণ, এই চিন্তাটা আমাদের চিত্তের মধ্যে এত সহজ হইয়া আছে যে, এ সম্বন্ধে আমাদের মনে কোনো সংকোচ মাত্র নাই। কিন্তু, এই ইংরেজ যাত্রীরা তাহাদের হাস্যালাপের কোনো-একটা ছেদে ধর্মসংগীত গাহিতেছে,এ কথা মনে করিতেই পারি না এবং ইহারা যদি ডেকের উপর জুয়া খেলিতে হঠাৎ কোনো-এক সময়ে চোখ তুলিয়া দেখিতে পায় যে ইহাদের স্বজাতীয় কেহ চৌকিতে বসিয়া উপাসনা করিতেছে, তবে নিশ্চয়ই তাহাকে পাগল বলিয়া মনে করিবে এবং সকলেই মনে মনে বিরক্ত হইয়া উঠিবে। এইজন্যই ইহাদের জীবনের মধ্যে আধ্যাত্মিক সচেতনতার একটি সহজ সুনম্র শ্রী দেখিতে পাই না–ইহাদের কাজকর্ম-হাস্যালাপের মধ্যে কেবলই এক-দিক-ঘেঁষা একটা তীব্রতা প্রকাশ পায়।

এই জাহাজটার মধ্যে কী আশ্চর্য আয়োজন। এই-যে জাহাজ দেশকালের সঙ্গে অহরহ লড়াই করিতে করিতে চলিয়াছে, তাহার সমস্ত রহস্যটা আমাদের গোচর নহে। তাহার লৌহকাঠিন হৃৎপিণ্ড উঠিতেছে পড়িতেছে, দিনরাত সেই ধুক্‌ধুক্‌ স্পন্দন অনুভব করিতেছি। যেখানে তাহার জঠরানল জ্বলিয়াছে এবং তাহার নাড়ির মধ্যে উত্তপ্ত বাষ্পের বেগ আলোড়িত হইয়া উঠিতেছে, সেখানকার প্রচণ্ড শক্তির সমস্ত উদ্যোগ আমাদের চোখের আড়ালে রহিয়াছে। আমাদের উপরিতলে এই প্রচুর অবকাশ ও আলস্যের মাঝে মাঝে ঘণ্টাধ্বনি স্নানাহারের সময় জ্ঞাপন করিতেছে। এই-যে দেড়শো-দুইশো যাত্রীর আহারবিহারের আয়োজন– এ কোথায় হইতেছে সেই কথা ভাবি। সেও চোখের আড়ালে। তাহারও শব্দমাত্র শুনি না, গন্ধমাত্র পাই না। আহরের টেবিলে গিয়া যখন বসি, সমস্ত সুসজ্জিত প্রস্তুত। ভোজ্যসামগ্রীর পরিবেষনের ধারা যেন নদীর প্রবাহের মতো অনায়াসে চলিতে থাকে।

ইহার মধ্যে যেটা বিশেষ করিয়া ভাবিবার কথা সেটা এই যে, ইহারা লেশমাত্র অসুবিধাকেও মানিয়া লইতে চায় না; এতবড়ো একটা সমুদ্রে পাড়ি–নাহয় আহারবিহারে কিছু টানাটানিই হইল, নাহয় মোটামুটি রকমেই কাজ সারিয়া লওয়া গেল। কিন্তু তা নয়; ইহারা কোনো ওজরকেই ওজর বলিয়া গণ্য করিবে না; ইহারা সকল অবস্থাতেই আপনার সকল রকমের দাবিকে সর্বোচ্চ সীমায় টানিয়া রাখিতে চায়। তাহার ফল হয় যে, অবশেষে সেই অসম্ভব দাবিও মেটে। দাবি করিবার সাহস যাহাদের নাই তাহারাই কোনোমতে অভাবের সঙ্গে আপোষ করিয়া দিন কাটায়–তাহারাই বলে, অর্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ। তাহাতে হয় এই যে, সেই অর্ধের মধ্য হইতেও কেবলই অর্ধ বাদ পড়িয়া যায় এবং পণ্ডিত আপনার পণ্ডিত্যের মধ্যেই ক্রমাগত পণ্ড হইতে থাকেন।

কিন্তু, সমস্ত সুবিধাই লইব, এ দাবি করিয়া বসিয়া কী প্রকাণ্ড ভার বহন করিতে হয়! প্রত্যেক সামান্য আরামের ব্যবস্থা কত মস্ত জায়গা জুড়িয়া বসে! এই ভার বহন করিবার শক্তি ইহাদের আছে, সেখানে ইহারা কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নহে। এই উপলক্ষে আমার মনে পড়ে আমাদের বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা। সেখানেও দুশো লোকের জন্য চার বেলাকার খাওয়া জোগাড় করিতে হয়। কিন্তু প্রয়াসের সীমা নাই ভোর চারটে হইতে রাত্রি একটা পর্যন্ত হাঁকডাকের অবধি দেখি না। অথচ, ইহার মধ্যে নিতান্ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু নাই বলিলেও হয়। আয়োজনের ভার যথাসাধ্য কম করা গিয়াছে কিন্তু আবর্জনার ভার কিছুমাত্র কমে না। গোলমাল বাড়িয়া চলে, ময়লা জমিতে থাকে– ভাতের ফেন, তরকারির খোসা এবং উচ্ছিষ্টাবশেষ লইয়া কী করা যায় তাহা ভাবিয়া পাওয়া যায় না। ক্রমে সে সম্বন্ধে ভাবনা পরিহার করিয়া জড় প্রকৃতির উপর বরাত দিয়া কোনোক্রমে দিন কাটানো যায়। এ কথা কিছুতেই আমরা জোর করিয়া বলিতে পারি না যে, ইহা কিছুতেই চলিবে না। কারণ, তাহা বলিতে গেলেই ভার বহন করিতে হয়। শেষকালে গোড়ায় গিয়া দেখি, সেই ভার বহন করিবার ভরসা এবং শক্তি আমাদের নাই, এইজন্য আমরা কেবলই দুঃখ এবং অসুবিধা বহন করি কিন্তু দায়িত্ব বহন করিতে চাই না।

একজন উচ্চপদস্থ রেলোয়ে ইঞ্জিনিয়ার আমাদের সহযাত্রী আছেন; তিনি আমাকে বলিতেছিলেন, “চাবি তালা প্রভৃতি নানা ছোটোখাটো প্রয়োজনের জিনিস আমি রেলোয়েবিভাগের জন্য এই দেশ হইতেই সংগ্রহ করিতে অনেক চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু, বরাবর দেখিতে পাই, তাহার মূল্য বেশি অথচ জিনিস তেমন ভালো নয়।’ এ দিকে পণ্যদ্রব্যের দাম এবং বেতনের পরিমাণ বাড়িয়াই চলিয়াছে অথচ এখানে যে-সমস্ত দ্রব্য উৎপন্ন হইতেছে পৃথিবীর বাজারদরের সঙ্গে তাহা তাল রাখিয়া চলিতে পারিতেছে না। তিনি বলিলেন, য়ুরোপীয় কর্তৃত্বে এ দেশে যে-সমস্ত কারখানা চলিতেছে এ দেশের লোকের উপর তাহার প্রভাব অতি সামান্য। আর, দেশীয় কর্তৃত্বে যেখানে কাজ চলে সেখানে দেখিতে পাই, পুরা কাজ আদায় হয় না– মানুষের যতখানি শক্তি আছে তাহার অধিকাংশকেই খাটাইয়া লইবার যেন তেজ নাই। এইজন্যই মজুরির পরিমাণ অল্প হওয়া সত্ত্বেও মূল্য কমিতে চায় না। কেননা, মানুষ যতগুলি খাটিতেছে শক্তি ততটা খাটিতেছে না।

এ কথাটা শুনিতে অপ্রিয় লাগে, কিন্তু দেশের দিকে তাকাইয়া দেখিলে সর্বত্রই এইটেই চোখে পড়ে। আমাদের দেশে সকল কাজই দুঃসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে, তাহার একটিমাত্র কারণ, ষোলো- আনা মানুষকে আমরা পাই না। এইজন্য আমাদিগকে বেশি লোক লইয়া কারবার করিতে হয়, অথচ বেশি লোককে ঠিক ব্যবস্থামতে চালনা করা এবং তাহাদের পেট ভরাইয়া দেওয়া আমাদের শক্তির অতীত। এইজন্য কাজের চেয়ে কাজের উৎপাত অনেকগুণ বেশি হইয়া উঠে, আয়োজনের চেয়ে আবর্জনাই বাড়ে এবং তরণীতে ছিদ্র ক্রমে এত দেখা দেয় যে দাঁড়-টানার চেয়ে জল-ছেঁচাতেই বেশি শক্তি ব্যয় করিতে হয়–আমাদের দেশে যে কোনো কাজে হাত দিয়াছে তাহাকে এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে।

আমি সেই ইঞ্জিনিয়ারটিকে বলিলাম, “তোমাদের দেশে যৌথ কারবার ও কলকারখানার গুণেই কি জিনিসের মূল্য কম হইতেছে না।’ তিনি বলিলেন, তাহা হইতে পারে, কিন্তু কোনো দেশে যৌথ কারবার আগে এবং উন্নতি তাহার পরে, এমন কথা বলা যায় না। মানুষ যখন যৌথ কারবারে মিলিবার উপযুক্ত হয় তখনি যৌথ কারবার আপনিই ঘটিয়া উঠে। তিনি কহিলেন, “আমি মাদ্রাজের দিকে দক্ষিণ ভারতে অনেক দেশীয় যৌথ কারবারের উৎপত্তি ও বিলুপ্তি দেখিয়াছি। দেখিতে পাই, অনুষ্ঠানটার প্রতি যে লয়াল্‌টি অর্থাৎ, যে নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধার প্রয়োজন তাহা কাহারও নাই, প্রত্যেকে স্বতন্ত্রভাবে নিজের দিকে তাকায়। ইহাতে কখনোই কোনো জিনিস বাঁধিতে পারে না। এই দৃঢ়নিষ্ঠ প্রাণপণ লয়াল্‌টি যদি জাতীয় চরিত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হয় তবে সমস্ত সম্মিলিত শুভানুষ্ঠান সম্ভবপর হয়।’

কথাটা আমার মনে লাগিল। অনুষ্ঠানের দ্বারা মঙ্গলসাধন করা যায়, এ কথাটা সত্য নহে– গোড়তেই মানুষ আছে। আমাদের দেশে একজন মানুষকে আশ্রয় করিয়া এক-একটা কাজ জাগিয়া উঠে; তাহার পরে সেই কাজকে যাহারা গ্রহণ করে তাহারা তাহাকে যতটা আশ্রয় করে ততটা আশ্রয় দেয় না। কারণ, তাহারা কাজের দিকে তেমন করিয়া তাকায় না, যেমন করিয়া নিজের দিকে তাকায়। কথায় কথায় তাহাদের মুষ্টি শিথিল হইয়া পড়ে, বাধাকে তাহারা অতিক্রমের চেষ্টা না করিয়া বাধাকে ত্যাগ করিয়া পালাইতে চায়, এবং কেবলই মনে করিতে থাকে, ইহার চেয়ে আর কোনোরূপ অবস্থা হইলে ইহার চেয়ে আরও ভালো ফল পাওয়া যাইত। এমনি করিয়া তাহারা বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়–একটা হইতে পাঁচটা টুক্‌রা দাঁড়ায় এবং পাঁচটাই ব্যর্থ হয়। ভালোমন্দ বাধাবিপত্তি সমস্তটাকে বীরের মতো স্বীকার করিয়া আরব্ধ কর্মকে একান্ত লয়াল্‌টির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত বহন করিবার অধ্যবসায় যতদিন আমাদের সাধারণের চিত্তে না জাগিবে ততদিন সম্মিলিত হিতানুষ্ঠান ও যৌথ বাণিজ্য আমাদের দেশে একেবারে অসম্ভব হইবে।

এই লয়াল্‌টি, ইহা বুদ্ধিগত নহে, ইহা হৃদয়গত, জীবনগত। সমস্ত অপূর্ণতার ভিতর দিয়া মানুষ নিজেকে কিসের জোরে বহন করে। একটা জীবনের গভীর আকর্ষণে। লাভ-লোকসানের সমস্ত হিসাবে সেই জীবনের টানের কাজে লঘু। এমনটা যদি না হইত তবে কথায় কথায় সামান্য কারণে, সামান্য ক্ষতিতে, সামান্য অসন্তোষে, মানুষ আত্মহত্যা করিয়া নিষ্কৃতি লইত। সেইরূপ যে কর্মে আমরা জীবনকে নিয়োগ করিয়াছি তাহার প্রতি যদি আমাদের জীবনগত নিষ্ঠা না থাকে, তাহার প্রতি যদি আমাদের একটা বেহিসাবি আকর্ষণ না থাকে, তাহার প্রতি অপরাহত শ্রদ্ধা লইয়া আমরা যদি পরাভাবের দলেও দাঁড়াইতে না পারি, যদি মৃত্যুর মুখেও তাহার জয় পতাকাকে সর্বোচ্চ তুলিয়া ধরিবার বল না পাই, যদি অভিমন্যুর মতো ব্যূহের মধ্য হইতে বাহির হইবার বিদ্যাটাকে আমরা একেবারে অগ্রহ্য না করি, তাহা হইলে আমরা কিছুই সৃষ্টি করিতে পারিব না, রক্ষা করিতেও পারিব না। “ইহা আমাদের অতএব ইহা আমারই’ এই কথাটাকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত লাভক্ষতি, সমস্ত হারজিতের মধ্যে প্রাণপণে বলিবার শক্তি সর্বাগ্রে আমাদের চাই; তাহার পরে যেকোনো অনুষ্ঠানকেই আশ্রয় করি-না কেন, একদিন না একদিন বিঘ্নসমুদ্র পার হইতে পারিব।

নিরতিশয় কর্মের প্রয়াসের দ্বারা য়ুরোপের জীবন জীর্ণ হইতেছে, এই কথাটা আজকাল পশ্চিমদেশেও শোনা যায় এবং এই কথাটা একেবারে মিথ্যাও নহে। আমি পূর্বেই বলিয়াছি, য়ুরোপ কোনো অভাব কোনো অসুবিধাকেই কিছুমাত্র মানিবে না, এই তাহার পণ। নিজের শক্তির উপরে তাহা অক্ষুণ্ন বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থাকাতেই তাহার শক্তি পূর্ণ গৌরবে কাজ করিতেছে এবং অসাধ্য সাধন করিয়া তুলিতেছে। কিন্তু তবুও শক্তির সীমা আছে। বাতিও খুব বড়ো করিয়া জ্বালাইব অথচ সলিতাও ক্ষয় করিব না, এ তো কোনোমতেই হয় না।

এইজন্য পাশ্চাত্যদেশে জীবনযাত্রার দাবি এক দিকে যত বাড়িতেছে আর-এক দিকে ততই সে দাহন করিতেছে। আরামকে সুবিধাকে কোথাও খর্ব করিব না, পণ করিয়া বসাতে তাহার বোঝা কেবলই প্রকাণ্ড বড়ো হইয়া উঠিতেছে। এই বোঝা তো কোনো-একটা জায়গায় চাপ দিতেছে। যেখানে সেই চাপ পড়িতেছে সেখানে যে পরিমাণে দুঃখ জন্মিতেছে সে পরিমাণে ক্ষতিপূরণ হইতেছে না। এইজন্য ভারসামঞ্জস্যের প্রয়াস আগ্নেয় ভূমিকম্পের আকারে সমস্ত পীড়িত সমাজের ভিতর হইতে ক্ষণে ক্ষণে মাথা তুলিবার উপক্রম করিতেছে। মানুষের সুবিধাকে সৃষ্টি করিবার জন্য কল কেবলই বাড়িয়া চলিতেছে এবং মানুষের জায়গা কল জুড়িয়া বসিতেছে। কোথায় ইহার অন্ত? মানুষ আপনাকে আপনার অভাবপূরণের যন্ত্র করিয়া তুলিতেছে–কিন্তু সেই আপনাকে সে পাইবে কোন্‌ অবসরে? যেমন করিয়াই হউক, এক জায়গায় তাহাকে দাঁড়ি টানিয়া দিয়া বলিতেই হইবে, “এই রহিল আমার উপকরণ, এখন আমাকেই আমার উদ্ধার করা চাই। যাহাতে আমার আবশ্যক তাহা আমাকে অবশ্যই জোগাইতে হইবে, কিন্ত,এ-সমস্তে আমার আবশ্যক নাই।’

অর্থাৎ, মানুষের উদ্যম যখন কেবলই একটানা চলিতে থাকে তখন সে একটা জায়গায় আসিয়া আপনাকে আপনি ব্যর্থ করিয়া বসে। পূর্ণতার পথ সোজা পথে নহে। সেইজন্য আজ য়ুরোপের যাহা বেদনা আমাদের বেদনা কখনোই তাহা নহে। য়ুরোপ তাহার দেহকে সম্পূর্ণ করিয়া তাহার মধ্যে আত্মাকে প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিতেছে। আমাদের আত্মা দেহ হারাইয়া প্রেতের মতো পৃথিবীতে নিষ্ফল হইয়া ফিরিতেছে। সেই আত্মার বাহ্য প্রতিষ্ঠা কোথায়? তাহার মধ্যে যে ঈশ্বরের সাধর্ম্য আছে, সে আপনার ঐশ্বর্য বিস্তার না করিয়া বাঁচে না। সে যে আপনাকে নানা দিকে প্রকাশ করিতে চায়–রাজ্যে, বাণিজ্যে, সমাজে, শিল্পে, সাহিত্যে, ধর্মে–এখানে সেই প্রকাশের উপকরণ কই? সেই উপকরণের প্রতি তাহার কর্তৃত্ব কোথায়? দেখিতেছি, তাহার কলেবর এক জায়গায় যদি বাঁধে তো আর-এক জায়গায় আলগা হইয়া পড়ে–ক্ষণকালের জন্য যদি তাহা নিবিড় হইয়া দাঁড়ায় তবে পরক্ষণেই বাষ্প হইয়া উড়িয়া যায়। তাই আজ যেমন করিয়াই হউক, আমাদিগকে এই দেহতত্ত্ব সাধন করিতে হইবে; যেমন করিয়া হউক, আমাদিগকে এই কথাটা বুঝিতে হইবে, যে, কলেবরহীন আত্মা কখনোই সত্য নহে–কেননা, কলেবর আত্মারই একটা দিক। তাহা গতির দিক, শক্তির দিক, মৃত্যুর দিক–কিন্তু তাহারই সহযোগে আত্মার স্থিতি, আনন্দ, অমৃত। এই কলেবরসৃষ্টির অসম্পূর্ণতাতেই আমাদের দেশের শ্রীহীন আত্মা শতাব্দীর পর শতাব্দী হাহাকার করিয়া ফিরিতেছে। বাহিরের সত্যকে দূরে ফেলিয়া আমাদের অন্তরাত্মা কেবলই অবাধে স্বপ্নসৃষ্টি করিতেছে। সে আপনার ওজন হারাইয়া ফেলিতেছে, এইজন্য তাহার অন্ধ বিশ্বাসের কোনো প্রমাণ নাই, কোনো পরিমাণ নাই; এইজন্য কোথাও বা সত্যকে লইয়া সে মায়ার মতো খেলা করিতেছে, কোথাও বা মায়াকে লইয়া সে সত্যের মতো ব্যবহার করিতেছে।

আরব-সমুদ্র ১৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৯


© 2024 পুরনো বই