সংস্কৃতি ও সাহিত্য

সংস্কৃতি ও সাহিত্য (১৩৬৩/১৯৫৬)

কালচার শব্দের প্রতিশব্দ কেউ লেখেন কৃষ্টি কেউ লেখেন সংস্কৃতি। কালচার আর কৃষ্টি দুই শব্দেরই ব্যুৎপত্তিতে কৃষি বা কর্ষণের ভাব আছে। রবীন্দ্রনাথ কৃষ্টি শব্দ পছন্দ করতেন না, তিনিই সংস্কৃতি চালিয়েছেন।

কোনও ইংরেজী শব্দের যখন বাংলা প্রতিশব্দ করা হয় তখন ইংরেজী শব্দের পারিভাষিক অর্থ পুরোপুরি মেনে নেওয়া হয়। Oxford Pocket Dictionaryco cultureqi fafatig wet

Trained and refined state of the understanding and man ners and tastes; phase of this prevalent at a time or place.

এই পারিভাষিক অর্থে বুদ্ধি আচরণ ও রুচির যে শিক্ষিত ও মার্জিত অবস্থা বোঝায় তা সংস্কৃতি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থে নিহিত আছে।

আচার্য যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির একটি গ্রন্থ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে–বেদের দেবতা ও কৃষ্টিকাল। এই গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন–

আমি সভ্যতা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি এই শব্দত্রয় ত্রিবিধ অর্থে প্রয়োগ করিয়া থাকি। (১) দেহের সুখ বিধান যে কৃতির লক্ষ্য তাহা সভ্যতা। (২) যদদ্বারা মনের সুখ সাধন হয় তাহা সংস্কৃতি। (৩) যদ্বারা বুদ্ধি ও জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় তাহা কৃষ্টি। মহেনজো-দেড়োর আবিষ্কৃত পুরাকৃতি প্রাচীন সিন্ধুবাসীর সভ্যতার, ভরতনাট্যম্ প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতির, এবং নয়টি অঙ্ক দ্বারা যাবতীয় সংখ্যা প্রকাশ বৈদিক আর্যগণের কৃষ্টির পরিচয়।

ইংরেজী অভিধানে কালচার শব্দের যে বিশিষ্ট অর্থ দেওয়া আছে। যোগেশচন্দ্র তাই বিশ্লিষ্ট করে সভ্যতা সংস্কৃতি আর কৃষ্টি এই তিন শব্দে ভাগ করে দিয়েছেন। আমার মনে হয় এই বিশ্লেষণের ফলে কালচার বিষয়ক আলোচনা সহজ হবে। পার্থক্য সকল ক্ষেত্রে স্পষ্ট না হলেও মোটামুটি বলা যেতে পারে–

(১) ভারত-রাষ্ট্রের সংবিধান, দেওয়ানী ফৌজদারী আইন, জলসেক। ব্যবস্থা, বাঁধ, সেতু, লোহা প্রভৃতির কারখানা, বিবিধ প্রাসাদ, রেলগাড়ি মোটর-কার টেলিফোন রেডিও, বিদ্যুৎশক্তির বিস্তার, স্কুল কলেজ হাসপাতাল, দেশীয় ও পাশ্চাত্ত্য চিকিৎসা পদ্ধতি প্রভৃতি বর্তমান ভারতীয় সভ্যতার পরিচায়ক, যদিও বহু ক্ষেত্রে কৃতি বা উদ্ভাবনের গৌরব বিদেশীর। চা সিগারেট কেক বিস্কুট, ইওরোপীয় প্যান্ট শার্ট কোট, পঞ্জাবী জামা, গান্ধী টুপি, বিলাতী গড়নের জুতা, মাদ্রাজী চপ্পল–এ সবও আমাদের বর্তমান সভ্যতার অঙ্গ।

(২) প্রাচীন ও আধুনিক দেবমন্দির স্থূপাদি, ভারতীয় সংগীত চিত্র ও মূর্তি নির্মাণ কলা, রামায়ণ মহাভারত পুরাণ ও সংস্কৃত কাব্যাদি ভারতের সংস্কৃতির পরিচায়ক। বাঙালীর বিশিষ্ট সংস্কৃতির উদাহরণ-কীর্তন ও বাউলের গান, রবীন্দ্রসংগীত, প্রাচীন পট ও আধুনিক চিত্র-পদ্ধতি এবং বাংলা-সাহিত্য।

(৩) ভারতীয় কৃষ্টির পরিচায়ক–সংস্কৃত বর্ণমালা (alphabet), ব্যাকরণ ছন্দ ও অলংকার শাস্ত্র, বিবিধ দর্শন শাস্ত্র, এবং নবায়ত্ত বিজ্ঞান। বাঙালীর বিশিষ্ট কৃষ্টির উদাহরণ–নব্যন্যায়, দায়ভাগ, শুভংকরের গণনা-পদ্ধতি এবং বিধবা ও অসবর্ণের বিবাহের প্রবর্তন চেষ্টা। অনাবশ্যক বোধে টিকি বর্জন–এও বাঙালী হিন্দুর কৃষ্টির লক্ষণ।

সভ্যতা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি কালে কালে পরিবর্তিত হয়। দেড় শ বৎসর আগে পর্যন্ত বাংলা দেশে এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে হয়েছিল, তার পর ব্রিটিশ রাজত্বকালে অতি দ্রুত লয়ে ঘটেছে। স্বাধীনতা লাভের পর পরিবর্তনের গতি আরও ত্বরিত হয়েছে।

কালচারের সর্বার্থক প্রতিশব্দরূপে সংস্কৃতি শব্দই আজকাল বেশী চলছে, কিন্তু সাহিত্যিক আলোচনায় সংস্কৃতি যে অর্থে চলে তা যোগেশচন্দ্রের সংজ্ঞার্থেরই অনুরূপ। বাঙালীর সংস্কৃতি বললে যা বোঝায় তার প্রধান অঙ্গ বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। এখন তার কথাই বলছি।

প্রায় পাঁচ শ বৎসর এ দেশে মুসলমান রাজত্ব ছিল, তার ফলে হিন্দু সংস্কৃতিতে মুসলমান (বা পারসীক) প্রভাব কিছু কিছু এসে পড়েছে। বিস্তর ফারসী আরবী আর তুর্কী শব্দ বাংলা ভাষার অন্তর্গত হয়ে গেছে। ব্রিটিশ আধিপত্যের কাল দুশ বৎসরেরও কম, কিন্তু সংস্কৃতিতে তার প্রভাব আরও ব্যাপক। এর কারণ ব্রিটিশ শাসনের উপর যতই বিদ্বেষ থাকুক, ব্রিটিশ সংস্কৃতি আর সাহিত্যের প্রতি বাঙালীর অশেষ শ্রদ্ধা ছিল। তার ফলে আধুনিক বাংলা ভাষা ইংরেজীর অন্তর্বর্তী হয়ে পড়েছে, শিক্ষিত বাঙালী সমাজও ক্রমে ক্রমে ইওরোপীয় আদর্শ অনুসরণ করছে।

.

হিন্দী রাষ্ট্রভাষা হলে তার প্রভাব বাংলা ভাষার উপর অবশ্যই কিছু পড়বে, কিন্তু ইংরেজীর তুল্য নয়, কারণ হিন্দীর সে প্রতিপত্তি নেই। ইংরেজীর স্থান হিন্দী কখনও নিতে পারবে না। অন্ধ হিন্দীপ্রেমী ছাড়া সকলেই বুঝেছেন। যে ইংরেজীর চর্চা লোপ পেলে আমাদের জ্ঞানের দ্বার রুদ্ধ হবে। ভারত সংবিধানে অষ্টম তফসিলে যে চৌদ্দটি ভারতীয় ভাষার উল্লেখ আছে তার মধ্যে সংস্কৃত আছে অথচ ইংরেজীর নাম নেই। ইংরেজী অ্যাংলোইন্ডিয়ানদের ভাষা অতএব অন্যতম ভারতীয় ভাষা–এই কারণে তাদের মুখপাত্র শ্রীযুক্ত ফ্রাঙ্ক অ্যান্টনি ইংরেজীকে তফসিলভুক্ত করবার চেষ্টা করছেন। আমাদের উচিত সর্বতোভাবে এই চেষ্টার সমর্থন করা।

অপর একটি প্রস্তাব বহুবার আলোচিত হয়ে চাপা পড়ে গেছে ভারতের সমস্ত ভাষার জন্য রোমানলিপি বা scriptএর প্রবর্তন, অবশ্য বর্ণমালা বা alphabet যে ভাষার যেমন আছে তাই থাকবে। ভারতীয় লিপি চিরকাল সমান ছিল না। অনেকের ভুল ধারণা আছে যে নাগরী হচ্ছে সংস্কৃত ভাষার লিপি সেজন্য দেবনাগরী নাম। সংস্কৃতের কোন সনাতনী লিপি নেই, দিল্লীর লৌহস্তম্ভের লিপি আর সম্রাট হর্ষবর্ধনের স্বহস্তাক্ষরের কোনও মিল নেই অথচ ভাষা উভয়েরই সংস্কৃত। প্রচলিত বিভিন্ন লিপির মায়া ত্যাগ করে সর্ব ভারতের মিলনের যোগসূত্ররূপে রোমান লিপি প্রবর্তনের জন্য প্রবল চেষ্টা আবশ্যক। তুরস্ক তা করে লাভবান হয়েছে, চীন দেশেও আয়োজন হচ্ছে।

ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলা ভাষা বাধা পায় নি, প্রশ্রয়ও পায় নি। ষাট বৎসর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার স্থান ছিল না তথাপি বাংলা সাহিত্যের প্রচুর উন্নতি হয়েছিল। তার কারণ, ইংরেজী শিক্ষার ফলে বাঙালী সুধীজন নবদৃষ্টি লাভ করেছিলেন, বাংলাসাহিত্যও ইংরেজীর তুল্য সমৃদ্ধ হতে পারে এই বিশ্বাসে তারা সাহিত্য সাধনায় নিবিষ্ট হয়েছিলেন। ইংরেজী সাহিত্যের প্রতি শিক্ষিত জনের প্রবল অনুরাগ ছিল, বিদেশী ভাষা থেকে রাশি রাশি ভাব আহরণ করে তারা বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত করেছিলেন। জনকতক মাতৃ ভাষাকে অবজ্ঞা করলেও বহু শিক্ষিত জন অপ্রমত্ত হয়ে বাংলা সাহিত্যের সেবা করেছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পর বাঙালীর মাতৃভাষাপ্রীতি বেড়ে গেছে।

ইংরেজী ভাষা আর সাহিত্যের যে গৌরব হিন্দীর তা নেই, সুতরাং ভবিষ্যতে হিন্দী কর্তৃক বাংলা অভিভূত হবে এই ভয় অমূলক। হিন্দী যদি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রভাষা হয়, বঙ্গ-বিহার যদি কোনও কালে যুক্ত হয়ে যায়, তবে অন্য লাভ ক্ষতি যাই হক বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের হানি হবার সম্ভাবনা নেই। বঙ্গবিহার বা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তারা যদি উকট হিন্দীপ্রেমের বশে বাংলা ভাষার উপর উপদ্রব শুরু করেন তবে বাঙালী কি এতই দুর্বল যে তা রোধ করতে পারবে না?

বাঙালী লেখকরা বহু কাল ধরে ইংরেজী ভাবরাশি আত্মসাৎ করেছেন, তার ফলে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ ও পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু তার জাতিনাশ হয় নি। সম্প্রতি বাংলা সাহিত্যে একটি অদ্ভুত সন্ধিক্ষণ দেখা দিয়েছে। নবীন বাঙালীর ইংরেজীজ্ঞান পূর্বের তুলনায় কমে যাচ্ছে। শুনতে পাই অনেক গ্র্যাজুয়েটও ইংরেজী গল্পের বই বুঝতে পারেন না, সেজন্য আজকাল অনুবাদ গ্রন্থের এত প্রচলন হয়েছে। শুধু ইংরেজী গ্রন্থ নয়, চিরায়ত বা ক্লাসিক বাংলা রচনাও ক্রমশ অবোধ্য হয়ে পড়ছে। যুবক ও মধ্যবয়স্ক অনেক শিক্ষিত লোককে বলতে শুনেছি–কপালকুণ্ডলা বুঝতে পারি না আর কালীসিংহের মহাভারত? ওরে বাপ রে! হয়তো কিছুকাল পরে রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্রও অবোধ্য হয়ে পড়বেন।

কিন্তু ইংরেজী ভাষার দখল যতই কমুক, ইংরেজী এখনও বাংলা ভাষার গুরুস্থানীয়, বরং গুরুভক্তি আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে এবং তার সঙ্গে মোহ এসেছে। বহুপ্রচলিত বাংলা বাক্যরীতি স্থানে ইংরেজী রীতি ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। উপযুক্ত বাংলা শব্দ থাকলেও ইংরেজী মাছিমারা নকলে নূতন শব্দ চালানো হচ্ছে। বাংলা ভাষার উপর সংস্কৃত ব্যাকরণের যেটুকু শাসন ছিল তা লোপ পাচ্ছে, তার ফলে ভাষা উদ্ধৃঙ্খল হচ্ছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা যেমন নবীন শিক্ষিত জনের অবোধ্য, অনেক আধুনিক লেখকের ভাষাও তেমনি প্রবীণ পাঠকদের অবোধ্য হয়ে পড়েছে। আধুনিক বাঙালী লেখকদের এই প্রবৃত্তি অনেকের মতে অবাঞ্ছনীয় হলেও রোধ করা অসম্ভব; ভাল মন্দ নানা পথ দিয়ে ভাষা অগ্রসর হবে এবং যে রীতি অধিকাংশ সুধীজনের সম্মত তাই কালক্রমে প্রতিষ্ঠা পাবে।

গত ৫ নভেম্বর Nature পত্রিকায় Dr John R Baker একটি প্রবন্ধে লিখেছেন–

Many scientific papers published in Great Britain are written in a style quite different from that adopted by good English authors… Three kinds of errors are–those of gram mar, grandiloquence, and German construction.

ইংরেজী লেখকদের বিরুদ্ধে ইনি যে অভিযোগ এনেছেন আধুনিক অনেক বাংলা লেখকদের সম্বন্ধেও তা খাটে…ব্যাকরণের ভুল, আড়ম্বর এবং (জার্মনের বদলে) ইংরেজী বাক্যরীতি।

হিন্দীর কিছু প্রভাব বাংলা ভাষার উপর অবশ্যই আসবে। হিন্দীর মহত্ত্বের জন্য নয়, ভারতের সর্বাধিক প্রচলিত এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রভাষা বলেই আসবে। তার লক্ষণ এখনই দেখা যায়। অনেক বাঙালী লেখক নূতন স্থানে নয়া সমুদ্র স্থানে দরিয়া, স্বাধীনতা স্থানে আজাদী লিখতে ভালবাসেন। অনেকে প্রদেশ, বিপ্লব, শিল্প স্থানে প্রান্ত, ক্রান্তি, উদ্যোগ লিখছেন। কালক্রমে হয়তো অনুগ্রহ পূর্বক স্থানে হিন্দী কৃপয়া, ডাকবাক্স স্থানে চিঠি ঘুসেড়, জরুরী স্থানে ধড়াধড় চলবে। অনেক বাংলা বই-এর নাম মলাটের উপর নাগরী ছাঁদে লেখা হয়। বাঙালী যদি রাশি রাশি ইংরেজী ভেজাল হজম করতে পারে তবে একটু ভারতীয় ভেজাল সইবে না কেন?


© 2024 পুরনো বই