প্রথম পরিচ্ছেদ
অতি পূর্ব্বকালে, ভারতবর্ষে দুষ্মন্ত নামে সম্রাট্ ছিলেন। তিনি, একদা, বহু সৈন্য সামন্ত সমভিব্যাহারে, মৃগয়ায় গিয়াছিলেন। এক দিন, মৃগের অনুসন্ধানে বনমধ্যে ভ্রমণ করিতে করিতে, এক হরিণশিশুকে লক্ষ্য করিয়া, রাজা শরাসনে শরসন্ধান করিলেন। হরিণশিশু, তদীয় অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া, প্রাণভয়ে দ্রুত বেগে পলাইতে আরম্ভ করিল। রাজা, রথারোহণে ছিলেন, সারথিকে আজ্ঞা দিলেন, মৃগের পশ্চাৎ রথচালন কর। সারথি কশাঘাত করিবামাত্র, অশ্বগণ বায়ুবেগে ধাবমান হইল।
কিয়ৎ ক্ষণে রথ মৃগের সন্নিহিত হইলে, রাজা শরনিক্ষেপের উপক্রম করিতেছেন, এমন সময়ে দূর হইতে দুই তপস্বী উচ্চৈঃ স্বরে কহিতে লাগিলেন, মহারাজ! এ আশ্রমমৃগ বধ করিবেন না, বধ করিবেন না। সারথি শুনিয়া অবলোকন করিয়া কহিল, মহারাজ! দুই তপস্বী এই মৃগের প্রাণবধ করিতে নিষেধ করিতেছেন। রাজা, তপস্বীর নামশ্রবণমাত্র অতিমাত্র ব্যস্ত হইয়া, সারথিকে কহিলেন, ত্বরায় রশ্মি সংযত করিয়া রথের বেগ সংবরণ কর। সারথি, যে আজ্ঞা মহারাজ বলিয়া, রশ্মি সংযত করিল।
এই অবকাশে, তপস্বীরা রথের সন্নিহিত হইয়া কহিতে লাগিলেন, মহারাজ! এ আশ্রমমৃগ, বধ করিবেন না। আপনকার বাণ অতি তীক্ষ্ণ ও বজ্রসম, ক্ষীণজীবী অল্পপ্রাণ মৃগশাবকের উপর নিক্ষেপ করিবার যোগ্য নহে। শরাসনে যে শর সন্ধান করিয়াছেন, আশু তাহার প্রতিসংহার করুন। আপনকার শস্ত্র আর্ত্তের পরিত্রাণের নিমিত্ত, নিরপরাধীকে প্রহার করিবার নিমিত্ত নহে।
রাজা লজ্জিত হইয়া, তৎক্ষণাৎ শরপ্রতিসংহারপূর্ব্বক, প্রণাম করিলেন। তপস্বীর দীর্ঘায়ুরস্ত বলিয়া ইন্ত তুলিয়া আশীর্বাদ করিলেন, এবং কহিলেন, মহারাজ! আপনি যে বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, আপনাকার এই বিনয় ও সৌজন্য তদুপযুক্তই বটে। প্রার্থনা করি আপনকার পুত্রলাভ হউক, এবং সেই পুত্র এই সসাগরা সদ্বীপা পৃথিবীর অদ্বিতীয় অধিপতি হউন। রাজা প্রণাম করিয়া কহিলেন, ব্রাহ্মণের আশীর্বাদ শিরোধার্য্য করিলাম।
অনন্তর, তাপসেরা কহিলেন, মহারাজ! ঐ মালিনীনদীর তীরে, আমাদের গুরু মহর্ষি কণ্বের আশ্রম দেখা যাইতেছে; যদি কার্য্যক্ষতি না হয়, তথায় গিয়া অতিথিসৎকার গ্রহণ করুন। আর, তপস্বীরা কেমন নির্বিঘ্নে ধর্ম্মকার্য্যের অনুষ্ঠান করিতেছেন দেখিয়া, বুঝিতে পারিবেন, আপনকার ভুজবলে ভূমণ্ডল কিরূপ শাসিত হইতেছে। রাজা জিজ্ঞাসিলেন, মহর্ষি আশ্রমে আছেন? তপস্বীরা কহিলেন, না মহারাজ! তিনি আশ্রমে নাই; এইমাত্র, স্বীয় দুহিতা শকুন্তলার প্রতি অতিথিসৎকারের ভার প্রদান করিয়া, তদীয় দুর্দৈবশান্তির নিমিত্ত, সোমতীর্থ প্রস্থান করিলেন। রাজা কহিলেন, মহর্ষি আশ্রমে নাই তাহাতে কোনও ক্ষতি নাই; আমি, অবিলম্বে, তদীয় তপোবন দর্শন করিয়া, আত্মাকে পবিত্র করিতেছি। তখন তাপসেরা, এক্ষণে আমরা চলিলাম, এই বলিয়া প্রস্থান করিলেন।
রাজা সারথিকে কহিলেন, সূত! রথচালন কর, তপোবন দর্শন করিয়া আত্মাকে পবিত্র করিব। সারথি, ভূপতির আদেশ পাইয়া, পুনর্বার রথচালন করিল। রাজা কিয়ৎ দূর গমন ও ইতস্ততঃ দৃষ্টিসঞ্চারণ করিয়া কহিলেন, সূত! কেহ কহিয়া দিতেছে না, তথাপি তপোবন বলিয়া বোধ হইতেছে। দেখ! কোটরস্থিত শুকের মুখভ্রষ্ট নীবার সকল তরুতলে পতিত রহিআছে; তপস্বীরা যাহাতে ইঙ্গুলীফল ভাঙ্গিয়াছেন, সেই সকল উপলখণ্ড তৈলাক্ত পতিত আছে; ঐ দেখ, কুশভূমিতে হরিণশিশু সকল নিঃশঙ্ক চিত্তে চরিয়া বেড়াইতেছে; এবং যজ্ঞীয়ধূমসমাগমে নব পল্লব সকল মলিন হইয়া গিয়াছে। সারথি কহিল, মহারাজ! যথার্থ অজ্ঞা করিতেছেন।
রাজা কিঞ্চিৎ গমন করিয়া সারথিকে কহিলেন, সূত! আশ্রমের উৎপীড়ন হওয়া উচিত নহে। এই স্থানেই রথ স্থাপন কর, আমি অবতীর্ণ হইতেছি। সারথি রশ্মি সংযত করিল। রাজা রথ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। অনন্তর, তিনি স্বীয় শরীরে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, সূত! তপোবনে বিনীত বেশে প্রবেশ করাই কর্ত্তব্য; অতএব, শরাসন ও সমুদয় আভরণ রাখ। এই বলিয়া, রাজা সেই সমস্ত সূতহস্তে সমর্পণ করিলেন, এবং কহিলেন, তাশ্বগণের আজি অতিশয় পরিশ্রম হইয়াছে। অতএব, আশ্রমবাসীদিগকে দর্শন করিয়া প্রত্যাগমন করিবার উহাদিগকে ভাল করিয়া বিশ্রাম করাও। সারথিকে এই আদেশ দিয়া, রাজা তপোবনে প্রবেশ করিলেন।
তপোবনে প্রবেশ করিবামাত্র, তদীয় দক্ষিণ বাহু স্পন্দিত হইতে লাগিল। রাজা, তপোবনে পরিণয়সূচক লক্ষণ দেখিয়া, বিস্ময়পন্ন হইয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, এই আশ্রম পদ শান্তরসাস্পদ, অথচ আমার দক্ষিণ বাহুর স্পন্দন হইতেছে; ঈদৃশ স্থানে মাদৃশ জনের এতদনুযায়ী ফললাভের সম্ভাবনা কোথায়। অথবা, ভবিতব্যের দ্বার সর্ব্বত্রই হইতে পারে। মনে মনে এই আন্দোলন করিতেছেন, এমন সময়ে, প্রিয়সখি! এ দিকে এ দিকে; এই শব্দ রাজার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল। রাজা শ্রবণ করিয়া কহিতে লাগিলেন, বৃক্ষবাটিকার দক্ষিণাংশে যেন স্ত্রীলোকের আলাপ শুনা যাইতেছে; কি বৃত্তান্ত অনুসন্ধান করিতে হইল।
এই বলিয়া, কিঞ্চিৎ গমন করিয়া, রাজা দেখিতে পাইলেন, তিনটি অল্পবয়স্কা তপস্বিকন্যা, অনতিবৃহৎ সেচনকলস কক্ষে লইয়া, আলবালে জলসেচন করিতে আসিতেছে। রাজা, তাহাদের রূপের মাধুরীদর্শনে চমৎকৃত হইয়া, কহিতে লাগিলেন, ইহারা আশ্রমবাসিনী; ইহার যেরূপ, এরূপ রূপবতী রমণী আমার অন্তঃপুরে নাই। বুঝিলাম, আজি উদ্যানলতা সৌন্দর্য্যগুণে বনলতার নিকট পরাজিত হইল। এই বলিয়া, তরুচ্ছায়ায় দণ্ডায়মান হইয়া, রাজা অনিমিষ নয়নে তাঁহাদিগকে অবলোকন করিতে লাগিলেন।
শকুন্তলা, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা নাম্নী দুই সহচরীর সহিত, বৃক্ষবাটিকাতে উপস্থিত হইয়া, আলবালে জলসেচন করিতে আরম্ভ করিলেন। অনসূয়া পরিহাস করিয়া শকুন্তলাকে কহিলেন, সখি শকুন্তলে! বোধ করি, তাত কণ্ব তোমা অপেক্ষাও আশ্রমপাদপদিগকে ভাল বাসেন। দেখ, তুমি নবমালিকাকুসুমকোমলা, তথাপি তোমায় আলবালজলসেচনে নিযুক্ত করিয়াছেন। শকুন্তলা ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, সখি অননুয়ে! কেবল পিতা আদেশ করিয়াছেন, বলিয়াই, জলসেচন করিতে অসিয়াছি এমন নয়, আমারও ইহাদের উপর সহোদরস্নেহ আছে। প্রিয়ংবদা কহিলেন, সখি শকুন্তলে! গ্রীষ্মকালে যে সকল বৃক্ষের কুসুম হয়, তাহাদের সেচন সমাপ্ত হইল; এক্ষণে, যাহাদের কুসুমের সময় অতীত হইয়াছে, এস, তাহাদিগকেও সেচন করি। এই বলিয়া, সকলে মিলিয়া সেই সমস্ত বৃক্ষে জলসেচন করিতে লাগিলেন।
রাজা দেখিয়া শুনিয়া, প্রীত ও চমৎকৃত হইয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, এই সেই কণ্বতনয়া শকুন্তলা! মহর্ষি অতি অবিবেচক, এমন শরীরে কেমন করিয়া বল্কল পরাইয়াছেন। অথবা, যেমন প্রফুল্ল কমল শৈবালযোগেও বিলক্ষণ শোভা পায়, যেমন পূর্ণ শশধর কলঙ্কসম্পর্কেও সাতিশয় শোভমান হয়; সেইরূপ এই সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী, বল্কল পরিধান করিয়াও, যার পর নাই মনোহারিণী হইয়াছেন। যাহাদের আকার স্বভাবসুন্দর, তাহাদের কি না অলঙ্কারের কার্য্য করে।
শকুন্তলা জলসেচন করিতে করিতে, সম্মুখে দৃষ্টিপাতপূর্ব্বক, সখীদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, সখি! দেখ দেখ, সমীরণ ভরে সহকারতরুর নব পল্লব পরিচালিত হইতেছে; বোধ হইতেছে যেন সহকার অঙ্গুলিসঙ্কেত দ্বারা আমাকে আহ্বান করিতেছে। অতএব, আমি উহার নিকটে চলিলাম। এই বলিয়া, তিনি সহকারিতরুতলে গিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। তখন, প্রিয়ংবদা পরিহাস করিয়া কহিলেন, সখি! ঐ খানে খানিক থাক। শকুন্তল জিজ্ঞাসিলেন, কেন সখি? প্রিয়ংবদা কহিলেন, তুমি সমীপবর্ত্তিনী হওয়াতে, যেন সহকারতরু অতিমুক্তলতার সহিত সমাগত হইল। শকুন্তলা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, সখি! এই নিমিত্তই তোমাকে প্রিয়ংবদা বলে।
রাজা, প্রিয়ংবদার পরিহাসশ্রবণে সাতিশয় পরিতোষ লাভ করিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, প্রিয়ংবদা যথার্থ কহিয়াছে; কেন না, শকুন্তলার অধরে নবপল্লবশোভার আবির্ভাব; বাহুযুগল কোমলবিটপশোভা ধারণ করিয়াছে, আর নব যৌবন, বিকসিতকুসুমরাশির ন্যায়, সর্ব্বাঙ্গ ব্যাপিয়া রহিয়াছে।
অনসূয়া কহিলেন, শকুন্তলে! দেখ দেখ, তুমি যে নবমালিকার বনতোষিণী নাম রাখিয়াছ, সে স্বয়ংবরা হইয়া সহকারতরুকে আশ্রয় করিয়াছে। শকুন্তলা, শুনিয়া বনতোষিণীর নিকটে গিয়া, সহর্ষ মনে কহিতে লাগিলেন, সখি অনুসূয়ে! দেখ, ইহাদের উভয়েরই কেমন রমণীয় সময় উপস্থিত; নবমালিকা, বিকসিত নব কুসুমে সুশোভিত হইয়াছে, আর সহকারও ফলভরে অবনত হইয়া রহিয়াছে। উভয়ের এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, ইত্যবসরে প্রিয়ংবদা হাস্যমুখে অনসূয়াকে কহিলেন, অনসূয়ে! কি নিমিত্ত শকুন্তলা সর্ব্বদাই বনতোষিণীকে উৎসুক নয়নে নিরীক্ষণ করে, জান? অনসূয়া কহিলেন, না সখি! জানি না, কি বল দেখি। প্রিয়ংবদা কহিলেন, এই মনে করিয়া, যে, যেমন বনতাষিণী সহকারের সহিত সমাগত হইয়াছে, আমিও যেন তেমনই আপন অনুরূপ বর পাই। শকুন্তলা কহিলেন, এটি তোমার আপনার মনের কথা।
শকুন্তলা, এই বলিয়া অনতিদূরবর্ত্তিনী বাধবীলতার সমীপবর্ত্তিনী হইয়া, হৃষ্ট মনে প্রিয়ংবদাকে কহিলেন, সখি! তোমাকে এক প্রিয় সংবাদ দি, মাধবীলতার মূল অবধি অগ্র পর্য্যন্ত মুকুল নির্গত হইয়াছে। প্রিয়ংবদা কহিলেন, সখি! আমিও তোমাকে এক প্রিয়সংবাদ দি, তোমার বিবাহ নিকট হইয়াছে। শকুন্তলা, শুনিয়া কিঞ্চিৎ কৃত্রিম কোপ প্রদর্শন করিয়া, কহিলেন, এ তোমার মনগড়া কথা, আমি শুনিতে চাহি না। প্রিয়ংবদা কহিলেন, না সখি! আমি পরিহাস করিতেছি না। পিতার মুখে শুনিয়াছি, তাই কহিতেছি, মাধবীলতার এই যে মুকুলনির্গম এ তোমারই শুভসূচক। উভয়ের এইরূপ কথোপকথন শ্রবণ করিয়া, অনমুয়া হাসিতে হাসিতে কহিলেন, প্রিয়ংবদে! এই নিমিত্তই শকুন্তলা মাধবীলতাকে সাদর মনে সেচন ও সস্নেহে নয়নে নিরীক্ষণ করে। শকুন্তলা কহিলেন, সে জন্যে ত নয়; মাধবীলতা আমার ভগিনী হয়, এই নিমিত্ত ইহাকে সাদর মন সেচন ও সস্নেহ নয়নে নিরীক্ষণ করি।
এই বলিয়া, শকুন্তলা মাধবীলতায় জলসেচন আরম্ভ করিলেন। এক মধুকর মাধবীলতার অভিনব মুকুলে মধুপান করিতেছিল; জলসেক করিবামাত্র, মাধবীলতা পরিত্যাগ করিয়া, বিকসিতকুসুমভ্রমে, শকুন্তলার প্রফুল্ল মুখকমলে উপবিষ্ট হইবার উপক্রম করিল। শকুন্তলা করপল্লবসঞ্চালন দ্বারা নিবারণ করিতে লাগিলেন। দুর্বৃত্ত মধুকর তথাপি নিবৃত্ত হইল না, গুন্ গুন্ করিয়া অধরসমীপে পরিভ্রমণ করিতে লাগিল। তখন, শকুন্তলা একান্ত অধীরা হইয়া কহিতে লাগিলেন, সখি! পরিত্রাণ কর, দুর্বৃত্ত মধুকর আমায় নিতান্ত ব্যাকুল করিয়াছে; তখন, উভয়ে হাসিতে হাসিতে কহিলেন, সখি! আমাদের পরিত্রাণ করিবার ক্ষমতা কি; দুষ্মন্তুকে স্মরণ কর; রাজারাই তপোবনের রক্ষণাবেক্ষণ করিয়া থাকেন। ইতিমধ্যে ভ্রমর অত্যন্ত উৎপীড়ন আরম্ভ করাতে, শকুস্তুলা কহিলেন, দেখ, এই দুর্বৃত্ত কোনও মতে নিবৃত্ত হইতেছে না; আমি এখান হইতে যাই। এই বলিয়া, দুই চারি পা গমন করিয়া কহিলেন, কি আপদ্! এখানেও আবার আমার সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছে। সখি! পরিত্রাণ কর। তখন তাঁহারা পুনর্বার কহিলেন, প্রিয়সখি! আমাদের পরিত্রাণের ক্ষমতা কি, দুষ্মন্তকে স্মরণ কর, তিনি তোমায় পরিত্রাণ করিবেন।
রাজা শুনিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, ইহাদের সম্মুখে উপস্থিত হইবার এই বিলক্ষণ সুযোগ ঘটিয়াছে। কিন্তু, রাজা বলিয়া পরিচয় দিতে ইচ্ছা হইতেছে না। কি করি। অথবা, অতিথিভাবে উপস্থিত হইয়া অভয় প্রদান করি। এই স্থির করিয়া, রাজা, সত্বর গমনে তাঁহাদের সম্মুখবর্ত্তী হইয়া, কহিতে লাগিলেন, পুরুবংশোদ্ভব দুষ্মন্ত দুর্বৃত্তদিগের শাসনকর্ত্তা বিদ্যমান থাকিতে কার সাধ্য, মুগ্ধস্বভাবা তপস্বিকন্যাদিগের সহিত অশিষ্ট ব্যবহার করে।
তপস্বিকন্যারা, এক অপরিচিত ব্যক্তিকে সহসা সম্মুখে উপস্থিত দেখিয়া, প্রথমতঃ অতিশয় সঙ্কুচিত হইলেন। কিঞ্চিৎ পরে, অনসূয়া কহিলেন, না মহাশয়! এমন কিছু অনিষ্টঘটনা হয় নাই। তবে কি জানেন, এক দুষ্ট মধুকর আমাদের প্রিয়সখী শকুন্তলাকে অতিশয় আকুল করিয়াছিল; তাহাতেই ইনি কিছু কাতর হইয়াছিলেন। রাজা, ঈষৎ হাস্য করিয়া শকুন্তলাকে জিজ্ঞাসিলেন, কেমন, তপস্যার বৃদ্ধি হইতেছে? শকুন্তলা লজ্জায় জড়ীভূতা ও নম্রমুখী হইয়া রহিলেন, কিছুই উত্তর করিতে পারিলেন না। অনসূয়া শকুন্তলাকে উত্তরদানে পরাঙ্মুখী দেখিয়া, রাজাকে কহিলেন, হাঁ মহাশয়! তপস্যার বৃদ্ধি হইতেছে; এক্ষণে অতিথিবিশেষের সমাগমলাভ দ্বারা সবিশেষ বৃদ্ধি হইল। প্রিয়ংবদা শকুন্তলাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, সখি! যাও যাও, শীঘ্র কুটীর হইতে অর্ঘ্যপত্র লইয়া আইস; জল আনিবার প্রয়োজন নাই; এই ঘটে যে জল আছে, তাহাতেই প্রক্ষালনক্রিয়া সম্পন্ন হইবেক। রাজা কহিলেন, না না, এত ব্যস্ত হইতে হইবেক না; মধুর সম্ভাষণ দ্বারাই আতিথ্য করা হইয়াছে। তখন অনসূয়া কহিলেন, মহাশয়! তবে এই শীতল সপ্তপর্ণ বেদীতে উপবেশন করিয়া শ্রান্তি দুর করুন। রাজা কহিলেন, তোমরাও জলসেচন দ্বারা অতিশয় ক্লান্ত হইয়াছ, কিঞ্চিৎ কাল বিশ্রাম কর। প্রিয়ংবদা কহিলেন, সখি শকুন্তলে! অতিথির অনুরোধ রক্ষা করা উচিত; এস আমরাও বসি। অনন্তর সকলে উপবেশন করিলেন।
এই রূপে সকলে উপবিষ্ট হইলে, শকুন্তলা মনে মনে কহিতে লাগিলেন, কেন এই অপরিচিত ব্যক্তিকে নয়নগোচর করিয়া, আমার মনে তপোবনবিরুদ্ধ ভাবের উদয় হইতেছে? এই বলিয়া তিনি, তাঁহার নাম ধাম জাতি ব্যবসায়াদির বিষয় সবিশেষ অবগত হইবার নিমিত্ত, নিতান্ত উৎসুকা হইলেন। রাজা তাপসকন্যাদিগের প্রতিদৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, তোমাদের সমান রূপ, সমান বয়স, সমান ব্যবসায়; সেই নিমিত্ত তোমাদের সৌহৃদ্য অতি রমণীয় হইয়াছে। প্রিয়ংবদা রাজার অগোচরে অনসূয়াকে কহিলেন, সখি! এ ব্যক্তি কে? দেখেছ, কেমন সৌম্যমূর্ত্তি, কেমন গম্ভীরাকৃতি, কেমন প্রভাবশালী। একান্ত অপরিচিত হইয়াও, মধুর আলাপ দ্বারা চিরপরিচিত সুহৃদের ন্যায় প্রতীতি জন্মইতেছেন। অনসূয়া কহিলেন, সখি! আমারও এ বিষয়ে কৌতূহল জন্মিয়াছে; ভাল, জিজ্ঞাসা করিতেছি। এই বলিয়া, তিনি রাজাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহাশয়! আপনকার মধুর আলাপ শ্রবণে সাহসী হইয়া জিজ্ঞাসিতেছি, আপনি কোন রাজর্ষিবংশ অলঙ্কৃত করিয়াছেন? কোন দেশকেই বা সম্প্রতি আপনকার বিরহে কাতর করিতেছেন? কি নিমিত্তই বা, এরূপ সুকুমার হইয়াও, তপোবন দর্শনপরিশ্রম স্বীকার করিয়াছেন? শকুন্তলা শুনিয়া মনকে প্রবোধ দিয়া কহিলেন, হৃদয়! এত উতলা হও কেন? তুমি যে জন্যে ব্যাকুল হইতেছ, অনসূয়া তাহাই জিজ্ঞাসা করিতেছে।
রাজা শুনিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, এখন কি রূপে আত্মপরিচয় দি; যথার্থ পরিচয় দিলে সকল প্রকাশ হইয়া পড়ে। এই বলিয়া, তিনি কিঞ্চিৎ ভাবিয়া কহিলেন, ঋষিতনয়ে! আমি এই রাজ্যের ধর্ম্মাধিকারে নিযুক্ত; পুণ্যাশ্রমদর্শনপ্রসঙ্গে এই তপোবনে উপস্থিত হইয়াছি। অনসূয়া কহিলেন, অদ্য তপস্বীদিগের বড় সৌভাগ্য; মহাশয়ের সমাগমে, তাঁহারা পরম পরিতোষ লাভ করিবেন। এইরূপ কথোপকথন চলিতে লাগিল। কিন্তু, পরস্পর সন্দর্শনে রাজা ও শকুন্তলা উভয়েরই মন চঞ্চল হইল; এবং উভয়েরই আকারে ও ইঙ্গিতে চিত্তচাঞ্চল্য স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতে লাগিল। অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা, উভয়ের ভাব বুঝিতে পারিয়া, রাজার অগোচরে শকুন্তলাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, প্রিয়সখি! যদি আজি পিতা আশ্রমে থাকিতেন, জীবনসর্ব্বস্ব দিয়াও এই অতিথিকে তুষ্ট করিতেন। শকুন্তলা শুনিয়া কৃত্রিম কোপ প্রদর্শন করিয়া কহিলেন, তোমরা কিছু মনে করিয়া এই কথা বলিতেছ; আমি তোমাদের কথা শুনিব না।
রাজা শকুন্তলার বৃত্তান্ত সবিশেষ অবগত হইবার নিমিত্ত একান্ত কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া, অনসূয়া ও প্রিয়ংবদাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, আমি তোমাদের সখীর বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করিতে বাঞ্ছা করি। তাঁহারা কহিলেন, মহাশয়! আপনকার এ অভ্যর্থনা অনুগ্রহবিশেষ; যাহা ইচ্ছা হয়, সচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করুন। রাজা কহিলেন, মহর্ষি কণ্ব কৌমারব্রহ্মচারী, ধর্ম্মচিন্তায় ও ব্রহ্মোপাসনায় একান্ত রত; জন্মাবচ্ছিন্নে দারপরিগ্রহ করেন নাই; অথচ তোমাদের সখী তাঁহার তনয়া, ইহা কি রূপে সম্ভবে, বুঝিতে পারিতেছি না।
রাজার এই জিজ্ঞাসা শুনিয়া অনসূয়া কহিলেন, মহাশয়! আমরা প্রিয়সখীর জন্মবৃত্তান্ত যেরূপ শুনিয়াছি, কহিতেছি শ্রবণ করুন। শুনিয়া থাকিবেন, বিশ্বামিত্র নামে এক অতি প্রভাবশালী রাজর্ষি আছেন। তিনি একদা গোমতীতীরে অতি কঠোর তপস্যা আরম্ভ করেন। দেবতারা, সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া, রাজর্ষির সমাধিভঙ্গ করিবার নিমিত্ত, মেনকানাম্নী অপ্সরাকে পাঠাইয়া দেন। মেনকা তদীয় আশ্রমে উপস্থিত হইয়া মায়াজাল বিস্তার করিলে, মহর্ষির সমাধি ভঙ্গ হইল। বিশ্বামিত্র ও মেনকা আমাদের সখীর জনক জননী। নির্দয়া মেনকা, সদ্যঃপ্রসূতা তনয়াকে অরণ্যে পরিত্যাগ করিয়া, স্বস্থানে। প্রস্থান করিল। আমাদের সখী সেই বিজন বনে অনাথা পড়িয়া রহিলেন। এক পক্ষী, কোন অনির্বচনীয় কারণে স্নেহবশ হইয়া, পক্ষপুট দ্বারা আচ্ছাদন করিয়া রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল। দৈবযোগে, তাত কণ্ব পর্য্যটনক্রমে সেই সময়ে সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। সদ্যঃপ্রসূতা কন্যাকে তদবস্থ পতিতা দেখিয়া, তাঁহার অন্তঃকরণে কারুণ্যরসের আবির্ভাব হইল। তিনি, তৎক্ষণাৎ আশ্রমে অনয়ন করিয়া, স্বীয় তনয়ার ন্যায় লালন পালান করিতে আরম্ভ করিলেন, এবং প্রথমে শকুন্ত অর্থাৎ পক্ষী লালন করিয়াছিল, এই নিমিত্ত নাম শকুন্তলা রাখিলেন।
রাজা শকুন্তলার জন্মবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কহিলেন, হাঁ সম্ভব বটে; নতুবা মানবীতে কি এরূপ অলৌকিক রূপ লাবণ্য সম্ভবিতে পারে? ভূতল হইতে কখনও জ্যোতির্ময় বিদ্যুতের উৎপত্তি হয় না। শকুন্তলা লজ্জায় নম্রমুখী হইয়া রহিলেন। প্রিয়ংবদা হাস্যমুখে, শকুন্তলার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া, রাজাকে সম্বোধিয়া কহিলেন, মহাশয়ের আকার ইঙ্গিত দর্শনে বোধ হইতেছে, যেন আর কিছু জিজ্ঞাসা করিবেন। শকুন্তলা, রাজার অগোচরে, প্রিয়ংবদাকে ভ্রূভঙ্গী ও অঙ্গুলিসঙ্কেত দ্বারা তর্জ্জন করিতে লাগিলেন। রাজা কহিলেন, বিলক্ষণ অনুভব করিয়াছ; তোমাদের সখীর বিষয়ে আমার আরও কিছু জিজ্ঞাস্য আছে। প্রিয়ংবদা কহিলেন, আপনি সঙ্কুচিত হইতেছেন কেন? যাহা ইচ্ছা হয়, সচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করুন। রাজা কহিলেন, আমার জিজ্ঞাস্য এই, তোমাদের সখী, যাবৎ বিবাহ না হইতেছে তাবৎ পর্যন্ত মাত্র, তাপসব্রত সেবা করিবেন, অথবা যাবজ্জীবন হরিণীগণ সহবাসে কালহরণ করিবেন। প্রিয়ংবদা কহিলেন, তাত কণ্ব সঙ্কল্প করিয়া রাখিয়াছেন, অনুরূপ পাত্র না পাইলে শকুন্তলার বিবাহ দিবেন না। রাজা শুনিয়া, সাতিশয় হর্ষিত হইয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, তবে আমার শকুন্তলালাভ নিতান্ত অসম্ভাবনীয় নহে। হৃদয়! আশ্বাসিত হও, এক্ষণে সন্দেহভঞ্জন হইয়াছে; যাহাকে অগ্নিশঙ্কা করিতেছিলে, তাহা স্পর্শসুখ শীতল রত্ন হইল।
শকুন্তলা কৃত্রিম কোপ প্রদর্শন করিয়া কহিলেন, তানসূয়ে! আমি চলিলাম, আর আমি এখানে থাকিব না। অনসূয়া কহিলেন, সখি! কি নিমিত্তে? শকুন্তলা বলিলেন, দেখ, প্রিয়ংবদা মুখে যা আসিতেছে তাই বলিতেছে; আমি যাইয়া আর্য্যা গোতমীকে কহিয়া দিব। অনসূয়া কহিলেন, সখি! অভ্যাগত মহাশয়ের এ পর্যন্ত পরিচর্য্যা করা হয় নাই। বিশেষতঃ, আজি তোমার উপর অতিথিপরিচর্য্যার ভার আছে। অতএব, ইঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া তোমার চলিয়া যাওয়া উচিত নহে। শকুন্তলা কিছু না বলিয়া চলিয়া যাইতে লাগিলেন। তখন প্রিয়ংবদা শকুন্তলাকে আটকাইয়া কহিলেন, সখি! তুমি যাইতে পাইবে না। আমার এক কলসী জল ধার; আগে শোধ দাও, তবে যাইতে দিব। এই বলিয়া শকুন্তলাকে বলপূর্ব্বক নিবারণ করিলেন। শকুন্তলা, কিঞ্চিৎ কুপিত হইয়া ঋণপরিশোধের নিমিত্ত, কলস লইয়া জল আনিতে উদ্যত হইলেন। তখন রাজা প্রিয়ংবদাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিলেন, তপসকন্যে! তোমার সখী বৃক্ষসেচন দ্বারা অতিশয় ক্লান্ত হইয়াছেন, আর উঁহাকে পল্বল হইতে জল আনাইয়া অধিক ক্লান্ত করা উচিত হয় না। আমি তোমার সখীকে ঋণমুক্ত করিতেছি। এই বলিয়া, রাজা অঙ্গুলি হইতে অঙ্গুরীয় উন্মোচন করিয়া, জল কলসের মূল্যস্বরূপ, প্রিয়ংবদার হস্তে অর্পণ করিলেন।
অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা অঙ্গুরীয়মুদ্রিত নামাক্ষর পাঠে বিস্ময়পন্ন হইয়া, পরস্পর মুখ নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। অঙ্গুরীয়ে যে দুষ্মন্তনাম মুদ্রিত ছিল, প্রদানকালে রাজার তাহা স্মরণ ছিল না। এক্ষণে, তিনি আত্মপ্রকাশসম্ভাবনাদর্শনে সাবধান হইয়া কহিলেন, মুদ্রিত নাম দেখিয়া তোমরা অন্যথা ভাবিও। আমি রাজপুরুষ, রাজা আমারে প্রসাদচিহ্নস্বরূপ, এই স্বনামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় প্রদান করিয়াছেন। প্রিয়ংবদা রাজার ছল বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, মহাশয়! তবে এই অঙ্গুরীয় অঙ্গুলীবিযুক্ত করা কর্তব্য নহে, আপনকার কথাতেই ইনি ঋণে মুক্ত হইলেন; পরে, ঈষৎ হাসিয়া শকুন্তলার দিকে চাহিয়া কহিলেন, সখি শকুন্তলে! এই মহাশয়, অথবা মহারাজ, তোমায় ঋণে মুক্ত করিলেন। এক্ষণে ইচ্ছা হয় যাও। শকুন্তলা মনে মনে কহিতে লাগিলেন, এ ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করিয়া যাওয়া আর আমার সাধ্য নহে; অনন্তর, প্রিয়ংবদাকে কহিলেন, আমি যাই না যাই তোমার কি?
রাজা, শকুন্তলার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, আমি ইহার প্রতি যেরূপ, এ আমার প্রতি সেরূপ কি না, বুঝিতে পারিতেছি না। অথবা, আর সন্দেহের বিষয় কি? কারণ, আমার সহিত কথা কহিতেছে না, অথচ আমি কথা কহিতে আরম্ভ করিলে অনন্ত চিত্ত হইয়া স্থির কর্ণে শ্রবণ করে; নয়নে নয়নে সঙ্গত হইলে, তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরাইয়া লয়, অথচ অন্যদিকেও অধিক ক্ষণ চাহিয়া থাকে না। অন্তঃকরণে অনুরাগসঞ্চার না হইলে এরূপ ভাব হয় না।
রাজা ও তাপসকন্যাদিগের এইরূপ আলাপ হইতেছে, এমন সময়ে সহসা অনতিদূরে অতি মহান্ কোলাহল উত্থিত হইল, এবং কেহ কহিতে লাগিল, হে তপস্বিগণ! মৃগয়াবিহারী রাজা দুষ্মন্ত, সৈন্য সামন্ত সমভিব্যাহারে, তপোবন সমীপে উপস্থিত হইয়াছেন; তোমারা আশ্রমস্থিত প্রাণিসমূহের রক্ষণার্থে সত্বর ও যত্নবান্ হও; বিশেষতঃ, এক আরণ্য হস্তী, রাজার রথদর্শনে সাতিশয় ভীত হইয়া, তপস্যার মূর্ত্তিমান্ বিঘ্ন স্বরূপ, ধর্ম্মারণ্যে প্রবেশ করিতেছে।
তাপসকন্যারা শুনিয়া সাতিশয় ব্যাকুল হইলেন। রাজা বিরক্ত হইয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, কি আপদ! অনুযায়ী লোকেরা, আমার অন্বেষণে আসিয়া, তপোবনের পীড়া জন্মাইতেছে। যাহা হউক, এক্ষণে ত্বরায় গিয়া নিবারণ করিতে হইল। অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা কহিলেন, মহারাজ! আরণ্য গজের উল্লেখ শুনিয়া, আমরা অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়াছি; অনুমতি করুন, কুটীরে যাই। রাজা ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, তোমরা কুটীরে যাও; আমিও তপোবনপীড়াপরীহারের নিমিত্ত চলিলাম। অনসূয়া ও প্রিয়ংবদা প্রস্থানকালে কহিলেন, মহারাজ! যেন পুনরায় আমরা আপনকার দর্শন পাই। আপনকার সমুচিত অতিথিসৎকার করা হয় নাই, এজন্য আমরা অত্যন্ত লজ্জিত হইতেছি। রাজা কহিলেন, না, না, তোমাদের দর্শনেই আমার যথেষ্ট সৎকার লাভ হইয়াছে।
অনন্তর সকলে প্রস্থান করিলেন। শকুন্তলা, দুই চারি পা গমন করিয়া, ছলক্রমে কহিলেন, অনসূয়ে! কুশাগ্র দ্বারা আমার পদতল ক্ষত হইয়াছে, আমি শীঘ্র চলিতে পারি না; আর, আমার বল্কল কুরবকশাখায় লাগিয়া গিয়াছে, কিঞ্চিৎ অপেক্ষা কর, ছাড়াইয়া লই। এই বলিয়া, বল্কলমোচনচ্ছলে বলম্ব করিয়া, শকুন্তলা সতৃষ্ণ নয়নে রাজাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। রাজাও মনে মনে কহিতে লাগিলেন শকুন্তলাকে দেখিয়া আর আমার নগরগমনে তাদৃশ অনুরাগ নাই। অতএব, তপোবনের অনতিদূরে শিবির সন্নিবেশিত করি। কি আশ্চর্য্য! আমি কোনও মতেই আমার চঞ্চল চিত্তকে শকুন্তলা হইতে নিবৃত্ত করিতে পারিতেছি না।