নায়ক ছেড়ে এই কাহিনীর লেখকও আমি নই। আমি অনেকটা মুনশীর কাজ করছি। অর্থাৎ, কারো কাছ থেকে শুনে লিখছি। কিন্তু শোনাটা সেকেন্ডহ্যান্ড নয়, ডাইরেক্ট। এর নায়ক বা নিয়ামক আমাদের কুঞ্জলাল।
আমাদের কুঞ্জলাল বলতে যাঁরা আমাদের সতীর্থ বা সমসাময়িক তারাই চিনবেন। কারণ, কুঞ্জলালকে সেদিন য়ুনিভার্সিটির তো বটেই, আশপাশের কলেজের বহু ছেলেমেয়েও চিনত। প্রণয়ের ব্যাপারে কন্দর্পদেবটি তার বক্ষ-বরাবর একখানি শর উঁচিয়েই ছিলেন। কুঞ্জলালের অবিমিশ্র বাঙালী-প্রীতি আমাদের চক্ষু এবং জঠরগত লাভের কারণ ছিল। তার পয়সায় রেস্টুরেন্টে কত চপ-কাটলেট খেয়েছি, কত ছবি আর খেলা দেখেছি ঠিক নেই।
ইউ. পি-র শেঠেরা টাকা চেনে শুনেছিলাম। ব্যবসা ছাড়া এমনিতেই টাকা খাঁটিয়ে টাকা বাড়ায়। তা যদি সত্যি হয়, তাহলে কুঞ্জলাল শেঠ-কুলের কলঙ্ক! সে টাকা। গোছাতে জানে না, টাকা ছড়াতে জানে।
তার বাবা মানিকলাল শেঠ লক্ষ্ণৌয়ের নাম-করা চিকন কাপড়ের কারবারী। ভদ্রলোকের অনেকগুলো ছেলেপুলে হয়েছিল, কিন্তু একটাও টেকেনি। কুঞ্জলালের দু-বছর বয়সের সময় তার মাসি তাকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল। ছেলে নেই ভাবলে যদি ছেলে থাকে, সেই চেষ্টা করতে তার আপত্তি নেই। এই উপায়টা ছেলের মাসি আর আত্মীয়-পরিজনেরা তাঁর মাথায় ঢুকিয়েছিল। বলা বাহুল্য, যে যোগাযোগেই হোক এই ছেলেটা বেঁচেছে, অন্যথায় এ কাহিনীর সূত্রপাত হত না।
কুঞ্জলাল কলকাতায় ম্যাট্রিক পাস করার পর তার বাবা তাকে কারবারে নিয়ে লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভয়ে ভয়ে, কারণ তখনো ফাঁড়ার ভয় একেবারে কাটেনি। আই-এ পাস করার পর ছেলেকে নিয়ে যাবার আগ্রহ আর একটু বেড়েছিল, কিন্তু মাসি দেননি। বি-এ পাস করার পর তো রীতিমত বকাবকি করেছিলেন, ছেলের এত বিদ্যে তাঁর অস্বস্তির কারণ হয়েছিল। কিন্তু ছেলে নিজেই তখন বেঁকে বসেছে–এম এ সে পড়বেই। তারপর এই দুই বছরের মধ্যে তাকে নিয়ে যাওয়া দূরে থাক, সুত্রাসে লক্ষ্ণৌ থেকে তাকেই বার কয়েক কলকাতায় ছুটে আসতে হয়েছে।
একবার যখন রত্না বোসকে সপ্তাহে সাতদিন,মাসে তিরিশ দিন কুঞ্জলাল মাসির গাড়িতে চড়াতে শুরু করেছিল। মাসির ছোট গাড়িটা সর্বক্ষণ তারই হেপাজতে থাকত।
সে গাড়িতে আমরাও হামেশা চড়তাম, কিন্তু সেটা তেমন কারো চোখে পড়ত না। রত্না বোস চড়লে পড়ত। বেগতিক দেখে মাসি বাপকে খবর দিয়েছিলেন। বাপ রাশভারি লোক, বিচক্ষণ, গম্ভীর প্রকৃতির। অন্যান্য সকলের দেখাদেখি ছেলেও তাকে কম সমীহ করে না। কিন্তু সেই নতুন বয়সের রোমান্সের জট ছাড়াতে ভদ্রলোকটিকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। শেষে মেয়ের বাপের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল তাকে। মেয়ের বাপেরও অবস্থা ভালো, কিন্তু কুঞ্জলাল যে এমন নিরেট অবাঙালী, সেটা তার বাবাকে না দেখা পর্যন্ত ভদ্রলোক অনুমান করতে পারেন নি। একমাসের মধ্যেই তিনি মেয়ের বিয়ে দিয়ে মেয়ে-জামাই দুজনকেই বিলেতের জাহাজে তুলে দিয়েছেন। মেয়ের বাবার অবস্থা যদিও ভালো, তবু এই খরচের ভারটা কুঞ্জলালের বাবা বহন করেছেন কিনা, সেই সংশয়ে অনেককে কানাকানি করতে দেখা গেছে। কুঞ্জলাল আমাদের মতই ফুর্তি করে। বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়েছে, আর বিষণ্ণ মুখে বিলেতগামী জাহাজ সী-অফ করেছে।
এম. এ পড়তে পড়তেই কুঞ্জলাল দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থবার প্রেমে পড়েছে। এরাও বাঙালী মেয়েই। প্রৌঢ় মানিকলালকে আরও বার কয়েক কলকাতায় ছুটোছুটি করতে হয়েছে। তবে এগুলো প্রথমবারের মত অত জোরাল প্রেম নয়। মানিকলালকে এগুলোর ধকল সামলে উঠতে খুব বেগ পেতে হয়নি। ত্যাজ্যপুত্র করার ভ্রূকুটিতেই ছেলে ঠাণ্ডা হয়েছে।
এই কুঞ্জলাল একযুগ ধরে আমার সহপাঠী। স্কুল-কলেজ বা য়ুনিভার্সিটিতে তার মার্কা-মারা সাজ-সজ্জার বদল হয়নি, জামাকাপড়ের মাপ বদলেছে শুধু। চিকনের কারুকার্য-করা পাঞ্জাবির ওপর কুর্তা চাপিয়ে আসত। আমাদের অনেকবার চিকনের। জামা-টামা উপহার দিতে চেয়েছে। কিন্তু মনে মনে লোভ থাকলেও আমরা ভরসা করে সেগুলো নিতে পারিনি। বরাবর চিকন পরত বলে ওকে সকলে বলত চিকন বাবু। আমাদের কি বলবে ঠিক কি!
তাছাড়া আমাদের বেশভূষা চাল-চলনের প্রতি তির্যক দৃষ্টি হানবার মত অভিভাবক ছিলেন বাড়িতে। লুকিয়ে-চুরিয়ে রেস্টুরেন্টে খাওয়া, সিনেমা দেখা, খেলা দেখা চলতে পারে। লুকিয়ে সাজ-সজ্জা চলবে কেমন করে?
এম-এ পাস করার পর তার বাবার কবলে পড়ল কুঞ্জলাল। ওদের সতের পুরুষের মধ্যে কেউ এম-এ পাস করেনি। তাই কুঞ্জলাল তার বাপের কারবারে টিকে থাকবে এ আমরা একবারও ভাবিনি কুঞ্জলালও ভাবেনি বোধহয়। লক্ষ্ণৌতে সে একটা বড় চাকরিই বাগিয়ে বসেছিল, শুনেছিলাম। সাতদিন না যেতে চাকরি ছেড়েছিল, তাও কানে এসেছে। কুঞ্জলাল লিখেছিল, বাংলা দেশে এতকাল থাকলাম, সেখানেই মানুষ। হলাম, কিন্তু চাকরি কি করে বরদাস্ত করতে হয় তাই শিখলাম না।
চিঠি-পত্রের যোগাযোগ ক্রমশ: স্বাভাবিকভাবেই কমে এসেছে। তারপর স্মৃতিও মুছে গেছে। এমন কি বিশ বছরের দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর লক্ষৌ এসেও কুঞ্জলালের কথা একটি বার মনে পড়েনি।
নবাবের দেশ, ইতিহাসের দেশ, বিপর্যয়ের দেশে এসে আমি শুধু লেখার রসদ খুঁজে বেড়িয়েছি। আমি যাঁর আশ্রিত তিনি এখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা। ভদ্রলোক ডাক্তার। সুরসিক। সাইকেল রিক্স আর টাঙ্গায় আপদমস্তক কালো বোরখা-ঢাকা মহিলাদের প্রতি আমার একটু বিশেষ লক্ষ্য দেখে তিনি অনেকরকম ঠাট্টা-ইশারা করেছেন। এমন কি কলকাতায় আমার গৃহিণীকে সাবধান করবেন বলেও শাসিয়েছেন।
কিন্তু সত্যিই আমার রহস্যের মত লাগত। বোরখা-ঢাকা প্রায় মুখগুলোই দেখতে ইচ্ছে করত। বোরখা জিনিসটার উৎপত্তি-ব্যুৎপত্তির খবর জানি না। এককালে ওটা হয়ত নিষেধেরই নিদর্শন ছিল। কখনো-সখনো পুরুষ-সন্নিধানে আসতে হলে চোখের আঁচ ঠেকাবার উপকরণ ছিল হয়ত ওটা। কিন্তু এখন অন্তঃপুরিকাদের পুরুষের সমান তালে পথে বেরনো নৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই ওটা আর এখন নিষেধের বস্তু মনে হয় না, অঙ্গসজ্জা বলেই মনে হয়। সহজ সান্নিধ্যেও নিজেকে আড়ালে রেখে পুরুষ-চেতনা সচেতুন রাখার মত লোভনীয় অঙ্গ-সজ্জা। যা দেখলে কৌতূহল জাগে, কল্পনার জাল বুনতে ইচ্ছে করে।
সামনে দিয়ে সেদিন ঝকঝকে একটা প্রাইভেট টাঙ্গায় দুজন বোরখা-ঢাকা মহিলা যাচ্ছিলেন। এক নজর তাকালেই অভিজাত মনে হয়। আমি কত নজর তাকিয়েছিলাম বলতে পারব না। টাঙ্গা দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের এই বোরখা-পরা মেয়েরা প্রায় সবাই কি অপরূপ সুন্দরী?
সঙ্গী জবাব দিলেন, সুন্দরী অনেক আছে, কিন্তু প্রায় সবাই কেন হবে? কেন বলুন তো?
–আমার তো প্রায় সকলকেই ভারি সুন্দরী বলে মনে হয়। হাতের আর পায়ের যতটুকু দেখা যায় ফুটফুট করছে
সঙ্গী ঠাট্টা করলেন, সকলকেই যেন চাদে ধোয়া, কেমন?
–তাই তো। দেখতে ইচ্ছে করে…।
–আচ্ছা, আপনাকে চেষ্টা করব দু-চারটে দেখাতে। তারপর আর দেখতে ইচ্ছে। করবে না–এতদিন ধরে এখানে ডাক্তারী করছি, দু-চারটে ছেড়ে দু-চারশ দেখেছি বোধহয়। প্রথম প্রথম ওই হাত দেখে আর পা দেখে আপনার মতই খুব দেখতে ইচ্ছে করত। মাথা ধরার ওষুধ নিতে এলেও, চোখ দেখা আর জিভ দেখার নাম করে কম দেখতাম না। এখন আর একটুও দেখতে ইচ্ছে করে না।
আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে হল না, বিস্ময় লক্ষ্য করেই ভদ্রলোক হা-হা করে হেসে উঠলেন।–আরে মশাই, এটা রঙের যুগ, ভুলে যান কেন? মনে রঙ এলে বাজারের রঙ ঘরে আসতে কতক্ষণ! কত সুবিধে বলুন তো, শুধু হাত দুখানা আর পা দুখানা রঙ-পালিশ করে নিলেই হল। আর নিখুঁতভাবে করতেও পারে এরা, হাত দেখলে মনে হবে চাপার কলি, পা দেখে ভাববেন চরণকৌমুদী।
ছন্দপতন। ডাক্তার হলেই কি এমন বেরসিক হতে হয়। আমার সৌন্দর্য কল্পনার। জালটা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। এই জাল নিয়ে এরপর কোনো সত্যিকারের সুন্দরীকেও ঘেঁকে তোলা শক্ত।
এবারে কুঞ্জর কথা বলি। অর্থাৎ কুঞ্জলালের কথা। গৃহিণীর জন্য একখানা চিকন শাড়ি নিয়ে যাব বলে এক মস্ত দোকানে ঢুকে পড়েছি। মাঝে বিশটা বছরের ব্যবধান–লক্ষ্ণৌয়ে এসেছি, চিকন শাড়ি কিনব বলে এসেছি–তখনো কুঞ্জলালের কথা একটি বার মনেও পড়েনি। সামনের গদির বৃদ্ধটি পরম সৌজন্যে আহবান জানালেন, আইয়ে–
ভিতরের মস্ত ফরাসে বড় কাঠের ক্যাশ-বার সামনে বসে যে লোকটি, সেও সবিনয় আপ্যায়ন জানাতে গিয়ে মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ থমকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও। দুজনের এই থমকানি থেকেই সংশয় দূর হয়ে গেল। কুঞ্জলাল ক্যাশ-বাক্স টপকে দুহাতে আমাকে জাপটে ধরে দু-চার ঝকানির পরেই এমন একটা কাণ্ড করে বসল, যা দেখে দোকানের কর্মচারীরা আর অন্যান্য ক্রেতারা হাঁ। আমার শরীরের ভারও নেহাত কম নয়, ফলে আমাকে নিয়ে ফরাসের উপরেই একপ্রস্থ গড়াগড়ি। পরে দম নিতে নিতে বলল, তুই একটা ইডিয়ট, তুই একটা রাবিশ, কতকাল পরে দেখলাম রে তোকে! তুই একটা জেম! পাকাঁপোক্ত লেখক বনে গেছিস একেবারে-অ্য? ..চোখ পাকাল, তোর বইয়ের বিজ্ঞাপন দেখলেই আমি কিনে ফেলি সে-খবর রাখিস? থাকিস কোন চুলোয়? প্রথম বই পড়ে দশ বছর আগে একটা চিঠি লিখেছিলাম –নো রিপ্লাই। উঃ, তোকে এখন খুন করতে ইচ্ছে করছে আমার
সকলের অগোচরে তার হাতের কাছ থেকে একটু সরে বসে হাসতে লাগলাম। কর্মচারীরা বা ক্রেতারা বাংলা না বুঝলেও উচ্ছ্বাস বুঝল। সামনের বৃদ্ধটি ঘাড় ফিরিয়ে দেখছেন আর হাসছেন মিটিমিটি। কুঞ্জলালের বাবা মানিকলাল নন, তাকে আমি কলকাতায় দেখেছি।
আজকের মত কুঞ্জলালের দোকানে বসা হয়ে গেল–আমার চিকন শাড়ি কেনাও। আমাকে নিয়ে উঠে পড়ল। বৃদ্ধটিকে বলল, কাকাজী, আমার পুরনো বন্ধু এসেছে। –একসঙ্গে দশ বছর পড়েছি আমরা–আমি এখন দোকানে থাকছি না।
তারপর কয়েকটা দিন কুঞ্জলালের সঙ্গেই বেশির ভাগ সময় কেটেছে। কুঞ্জলাল বিয়ে-থা করেছে, ছেলেপুলে আছে। না, বাঙালী মেয়ে নয়, স্বজাতিকেই বিয়ে করেছে। তার বাবা বছর তিন-চার হল মারা গেছেন। এতবড় কারবারের সে-ই মালিক এখন।
এই সাক্ষাতের ফলে আমার কলকাতায় ফেরাই দিন কতক পিছিয়ে গেল। সকালের দিকে তার আড়তে বসে কথাবার্তা গল্প-গুজব হয়। মস্ত আড়ত। চিকনের কারিগররা সব এখানেই আসে। পারিশ্রমিক নেয়, অর্ডার-পত্র নেয়। মেয়ে-পুরুষ দুই রকমের কারিগরই আছে। এর মধ্যে বর্ষীয়সী কয়েকটি রমণীর বোরখার সামনের দিকটা। ঘোমটার মত করে তোলা। অল্পবয়স্কা আপাদ-মস্তক বোরখা-ঢাকা কয়েকটি মেয়েকেও দেখলাম। কারো হাত-পা তেমনি ফুটফুটে ফর্সা। কিন্তু ডাক্তার বন্ধু আমার রূপাভিসার কল্পনার ঝোঁকটা বিধ্বস্ত করে দিয়েছেন। এদের হাত-পায়ের দিকে চেয়ে আমি এখন উল্টে আসল রঙ আবিষ্কার করতে চেষ্টা করি।
কারিগরদের কাছে কুঞ্জলাল মনিব কড়া দেখলাম। কাজ মনের মত না হলে রূঢ় কথা মুখে আটকায় না–তা সে মেয়ে হোক, বা পুরুষ হোক। তবে কাজের হাত যাদের ভালো, তাদের সে অবজ্ঞা করে বলে মনে হল না। কিন্তু অন্যেরা তটস্থ তার সামনে।
সেদিনও তার আড়তে এসে দেখি, বোরখা-পরা একটি মেয়ে বসে। আগেও দেখেছি, কিন্তু দেখার মত নয়। অর্থাৎ, হাত আর পা শ্যামবর্ণ। তবে বেশ স্বাস্থ্যবতী মনে হয়। মেয়েটি স্থির বসে আছে, আর কুঞ্জলাল তার সামনে ঝুঁকে বসে সাগ্রহে কতকগুলো অর্ডার বুঝিয়ে দিচ্ছে। রাজা-মহারাজার ঘরের অর্ডার, এর দায়দায়িত্ব এবং মুনাফা, সবই বেশি।
মেয়েটি মাঝে মাঝে সায় দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলছে, জী–।
অর্থাৎ, যা তাকে বোঝানো হচ্ছে, সে বুঝতে পারছে। কিন্তু ওইটুকু থেকেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর ভারি মিষ্টি মনে হল আমার। অর্ডারগুলো গুছিয়ে নিয়ে আমাদের দুজনের উদ্দেশ্যেই বিনীত অভিবাদন জানিয়ে মেয়েটি শান্ত পায়ে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
কোনো কারিগরের প্রতি কুঞ্জলালের এতটা সম্ভ্রমপূর্ণ মিষ্টি ব্যবহার আর দেখিনি। মেয়েটি চলে যাবার পরেও কুঞ্জলালকে বেশ অন্যমনস্ক দেখাল যেন। একটু বাদে আমাকে বলল, এই মেয়েটি আমার কারবারের সব থেকে সেরা কারিগর, মাস গেলে কম করে পাঁচ-ছশ টাকা রোজগার করে। সী ইজ এ স্কীল আর্টিস্ট।
এত ভালোর কদর হতেই পারে। কিন্তু কুঞ্জলালের হাব-ভাব আমার কেমন যেন। লাগল–এর সবটুকুই ব্যবসায়সুলভ মনে হচ্ছে না। প্রশংসাটুকু একটু যেন আবেগ মেশান। অথচ মেয়েটি তো চোখে পড়া বা মনে ধরার মত কিছু নয়। তার ওই হাত আর পায়ের আভাসের ওপর সাদাটে গোলাপী রঙ চড়ালে বরং চোখে অন্য রকম লাগতে পারত।
কি মনে হতে কুঞ্জলাল নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। সাগ্রহে বলল, তুই তো লেখক বনে গেছিস–একটা গল্প শুনবি? এ লাইফ?
আমি শঙ্কা বোধ করলাম। কুঞ্জলাল বিয়ে করেছে, ছেলেপুলের বাপ, বয়েস চল্লিশ পেরিয়ে গেছে–কিন্তু য়ুনিভার্সিটির সেই রোগ এখনও আছে নাকি!
কুঞ্জলাল আমার মুখের দিকে চেয়েই মনের কথাটা বুঝল বোধহয়। বলল, তুমি যা ভাবছ বন্ধু, তা নয়–মেয়েটিকে আমি আজ পর্যন্ত চোখেও দেখিনি।
কুঞ্জলাল গল্প শুনিয়েছে। গল্পটা ভোলা সম্ভব নয়। শোনার পর মনে হয়েছে, না শুনলে লক্ষ্ণৌ আসা আমার ব্যর্থ হত।
বাপ বেঁচে থাকতেই কুঞ্জলাল কারবারের সমস্ত ভার নিজে নিয়েছিল। বাপ মানিকলাল প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। কুঞ্জলাল আর ওই কাকাজীকে কারবার দেখতে হত। কুঞ্জলালের আমলে কারবারের অনেক উন্নতিও হয়েছে। সেই সময় ওই মেয়েটি কিছুদিন হয় কাজে লেগেছে। নাম রুমাবাঈ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হাতের কাজ, কথামত কাজ দিয়ে যায়–একটা দিনের জন্যেও কথার খেলাপ করে না। কুঞ্জলালের তখন কারবার ফাঁপানোর নেশা, যে ভালো কাজ করবে, যার কাজ দেখে ক্রেতা মুগ্ধ হবে, তাকে দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিতে, বা দ্বিগুণ কাজ দিতে তার আপত্তি নেই। দেখতে দেখতে রুমাবাঈয়ের রোজগার সকলকে ছাড়িয়ে গেল। সব থেকে সেরা অর্ডার নেবার জন্য তারই ডাক পড়ে।
অন্যান্য কারিগররা ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল ক্রমশ। তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে লাগল একটু একটু করে। একটু আধটু রটনা শোনা যেতে লাগল। ব্যাপারটা কাকাজীর চোখেও ঘোরালো ঠেকল কেমন। মেয়েটি রূপসী মনে হলে আগেই সন্দেহ হত তাঁর, আগেই উতলা হতেন। কিন্তু রটনা কানে আসতে আর স্থির থাকতে পারলেন না তিনি। ভাইপোর কলকাতার কাণ্ডকারখানা ভালোই জানেন। রূপ থাক আর না থাক, কে কোথায় মজে ঠিক কি! মেয়েটির হাতের কাজ ভালো তিনিও স্বীকার করেন, কিন্তু বিপদের সম্ভাবনাটাই আরো বড় করে দেখলেন তিনি। শুধু কাজ ভালো হলেই এত কদর হয় না–ভালো কাজ করে এমন বয়স্ক অভিজ্ঞ কারিগরও তো আছে!
ব্যাপারটা অগ্রজ, অর্থাৎ মানিকলালকে জানানো কর্তব্য বোধ করলেন তিনি। জানালেন। শুনেই মানিকলাল ত্রাসে অস্থির। ছেলের বিয়ে-থা দিয়ে তার নতুন বয়সের রোগটার সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি। সেইদিনই রুমাবাঈকে আড়তে ডেকে পাঠালেন। শুধু কাকাজী আছেন তার সঙ্গে, আর কেউ না।
রুমাবাঈ এল। হিসেব-পত্র করাই ছিল। মানিকলাল তার পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দিলেন। বললেন, তোমাকে আর প্রয়োজন নেই, আর এস না।
রুমাবাঈ স্থির পাথরের মত বসে রইল কিছুক্ষণ। মুখ না দেখা গেলেও মুখের অবস্থা অনুমান করা কঠিন নয়। তারপর আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করল, মালিক কি আমার কাজে কোনো গাফিলতি পেয়েছেন?
মানিকলাল বললেন, না, আমার আর দরকার নেই।
নরম অথচ স্পষ্ট করে রুমাবাঈ বলল, কিন্তু আমার যে বড় দরকার মালিক। হঠাৎ এভাবে কাজ বন্ধ করে দিলে বড় অসুবিধেয় পড়ব-মালিক দয়া করে আর কটা দিন সময় দিলে
মানিকলালের মেজাজ চড়েছে। সাফ জবাব দিলেন, আর একদিনও না, অন্য জায়গায় কাজ দেখে নাও গে যাও।
কিন্তু রুমাবাঈ উঠল না। তেমনি সবিনয়ে বলল, মালিক যে কারণে আমাকে তাড়াতে চাইছেন সেটা একেবারে মিথ্যে। ছোট মালিক কাজ বোঝেন, কাজের সমঝদার তিনি, কাজ দেখে খুশী হয়েছিলেন বলে আমার নসীব ফিরেছিল। তিনি শুধু কাজই দেখেছেন, আমাকে কখনও দেখেন নি।
শোনামাত্র মাথায় রক্ত চড়েছিল মানিকলের। তিনি চেঁচিয়ে উঠেছেন, কি সত্য আর কি মিথ্যে, কে তোমার কাছে শুনতে চেয়েছে? ছোট মালিক কি দেখেছে না দেখেছে কে তোমার কাছে জানতে চেয়েছে? ছোট মালিকের নাম কে তোমাকে তুলতে বলেছে এখানে? তোমাকে আমার দরকার নেই, তুমি চলে যাও, ব্যস।
কিন্তু রুমাবাঈ তবু গেল না। নিশ্চল মূর্তির মত আরো খানিকক্ষণ বসেই রইল। তারপর তেমনি নম্র অথচ দ্বিধাশূন্য স্পষ্ট গলায় বলল, মালিক কেন আমাকে তাড়াচ্ছেন, আমি তা জানি। ওদের হিংসা আমিও দেখছি। রটনা যে একটুও সত্যি নয়, আমি যদি তার প্রমাণ দিতে পারি, তাহলেও কি মালিক আমাকে রাখতে আপত্তি করবেন?
ওই কথা কটি, কণ্ঠস্বর, আর আচরণের মধ্যেও কিছু বোধহয় ছিল। কাকাজী বোবার মত দাঁড়িয়ে। আর মানিকলালও কৌতূহলে থমকালেন ঈষৎ।
–কি প্রমাণ দেবে?
প্রমাণ রুমাবাঈ মুখে কিছু দিল না। আস্তে আস্তে ঘন কালো বোরখাটা খুলে। ফেলল শুধু। খুলে সেটা সরিয়ে রাখল। তারপর মানিকলের দিকে দুচোখ মেলে তাকাল শুধু।
এতবড় বিস্ময় কাকাজী আর মানিকলের জীবনে এই প্রথম।
কাকে দেখছেন তারা কিছুই বুঝছেন না। রূপসাধক কোনো শিল্পীর আঁকা যেন–নাক-মুখ-চোখ–সমস্ত নারী-অঙ্গ। জ্যোৎস্নাঘোয়া ধপধপে গায়ের রঙ। শুধু হাতের খানিকটা আর পায়ের খানিকটা কালো রঙ করা–বোরখা পরা থাকলে যতটুকুর আভাস পাওয়া সম্ভব ততটুকু।
মানিকলাল আর কাকাজীর চোখে পলক পড়ে না, মুখে কথা সরে না।
রুমাবাঈ তেমনি শান্ত মুখে বলে গেল, যে সন্দেহ করে মালিক আমাকে তাড়াতে চাইছেন, তা সত্যি হলে টাকার জন্যে এ-পথে আসার দরকার হত না বোধহয়–মেহনতী কাজ করতে হত না। তা চাই না বলে হাতে-পায়ে কালো রঙ মেখে সকলের চোখ থেকে নিজেকে আড়ালে রেখে সম্মানের উপার্জনে লেগেছি।
দু-চার কথায় এরপর পিতৃসদৃশ মানিকলাল আর কাকাজীর কাছে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলেছে সে। এই রূপই তার জীবনের সবথেকে বড় অভিশাপ, দুষ্ট লোকে তার নামে কলঙ্ক দিয়ে তার স্বামী কেড়ে নিয়েছে–একটি ছেলে নিয়ে তাকে পথে দাঁড়াতে হয়েছে। সেই ছেলেটিই এখন প্রাণ তার। তাকে সে মানুষ করছে, ভালো জায়গায় রেখে পড়াচ্ছে। তাকে কোনো কলঙ্ক স্পর্শ করলে সেই ছেলে বড় হবে কি করে, মানুষ হবে কি করে? মালিক যেন দয়া করে কাজ থেকে না ছাড়ান তাকে, ছোট মালিক কোনোদিন তার মুখ দেখেন নি, কোনোদিন দেখবেনও না।
কাকাজীর কাছে কুঞ্জলাল এ-সব শুনেছে বাবার মৃত্যুরও অনেক পরে। শুনেছিল, কারণ কুঞ্জলালই একবার তাকে কাজ থেকে জবাব দেবে স্থির করেছিল। যে মেয়ের কাজে কখনো কোনো ত্রুটি দেখেনি, তারই কাজে পর পর অনেকদিন গাফিলতি দেখেছে। সময়ে কাজ নেয়নি, সময়ে কাজ দেয়নি, যাও দিয়েছে তাও মনোমত হয় নি। কুঞ্জলাল ভেবেছিল, রোজগারের দেমাকে এই অধঃপতন। তার ওপর একটা বড় কাজের জন্য দু তিনবার তার কাছে কর্মচারী পাঠাতে সে বলে পাঠিয়েছিল, এখন অসুবিধের মধ্যে আছে ভারি কাজ নেওয়া এ সময়ে তার পক্ষে সম্ভব নয়।
কুঞ্জলাল তেতে ছিল, এইবার আগুন হয়ে উঠল। তাছাড়া মেয়েটার চরিত্রের ওপর কটাক্ষ করার লোকও সর্বদাই আছে। কর্মচারীদের অনেকেই ঠাট্টা করেছে, নাগর। জুটেছে বোধহয়, এখন ভারি কাজ নিয়ে সময় নষ্ট করবে কেমন করে!
কুঞ্জলাল মেয়েটিকে জবাব দেবে স্থির করেছে শুনে কাকাজী তাকে নিরস্ত করতে চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, তার ছেলের খুব অসুখ–আমাকে সে জানিয়েছে।
কুঞ্জলাল সে-কথা কানে তোলেনি। আবার ছেলেও আছে শুনে মনে মনে উল্টে সে অশ্লীল কটুক্তি করেছে। ছেলে থাকলেও সুস্থ সামাজিক সন্তান ভাবেনি। আর ছেলের অসুখ, তাও বিশ্বাস করেনি। সে ব্যবসায়ী, ব্যবসা সব কিছুইর আগে অসুখের বিন্যাস শোনার আগ্রহ তার নেই।
এরপর রুমাবাঈ আবার একদিন কাজের জন্য আসতে সে জবাব পাঠাতে যাচ্ছিল, কাজ নেই। কিন্তু কাকাজী আবার বাধা দিয়েছেন। তাকে আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে সেই একদিনের ঘটনা বলেছেন। শুনে কুঞ্জলাল কতক্ষণ স্থাণুর মত বসেছিল, ঠিক নেই। ইতিমধ্যে কাকাজী রুমাবাঈকে পরদিন আড়তে এসে মালিকের সঙ্গে দেখা করে কাজ নিয়ে যেতে বলে দিয়েছেন।
রুমাবাঈ এসেছিল। কুঞ্জলাল প্রথমেই ছেলে কেমন আছে জিজ্ঞাসা করেছে। জবাব দেবার আগে রুমাবাঈ চুপ করে বসেছিল খানিক। ছেলের অসুখের খবরটা সে একমাত্র কাকাজীকেই গোপনে দিয়েছিল। অস্ফুট শান্ত জবাব দিয়েছে, মালিকের আশীর্বাদে ভালো আছে।
কুঞ্জলাল আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারেনি। চুপচাপ চেয়ে চেয়ে সেই কালো। বোরখা আর কালো হাত-পা দেখেছিল। তারপর নিঃশব্দে কাজ এগিয়ে দিয়েছে।
রুমাবাঈয়ের এই কালো বোরখা যেন স্পষ্ট নিষেধ। কিন্তু নিষেধ মানতে চায়নি কুঞ্জলাল। একদিন ওই বোরখা সরাবার জন্য অনুনয় করেছিল। কাকাজীর কাছে সব শুনেছে জানিয়ে একটিবার মাত্র তাকে দেখতে চেয়েছিল।
কিন্তু ঘন-কালো বোরখার আড়ালে নিষ্প্রাণ মূর্তির মতই বুঝি বসেছিল রুমাবাঈ। তারপর খুব নরম করে আস্তে আস্তে বলেছে, কথা দিয়ে সে কখনো কথার খেলাপ করেনি–বড় মালিককে সে কথা দিয়েছিল। ছোট মালিককে সে শ্রদ্ধা করে, তিনি যদি চান সে বোরখা সরাবে…কিন্তু তাহলে আর তার কোনোদিন এখানে কাজ নিতে আসা হবে না।
কুঞ্জলাল তা চায় নি।