বুদ্ধিমান শিষ্য ২

টোলের যিনি গুরু, তাঁর অনেক শিষ্য। সবাই লেখে, সবাই পড়ে, কেবল একজনের আর কিছুতেই কিছু হয় না। বছরের পর বছর গেল, তার বিদ্যাও হয় না, বুদ্ধিও খুলল না। সকলেই বলে—”ওটা মূর্খ, ওটা নির্বোধ, ওটার আর হবে কি? ওটা যেমন বোকা, তেমনিই থাকবে।” শেষটায় গুরু পর্যন্ত আশা ছেড়ে দিলেন। বেচারার কিন্তু একটি গুণ সকলেই স্বীকার করে,—সে প্রাণপণে গুরুর সেবা করতে ত্রুটি করে না।
একদিন গুরু শুয়ে আছেন, মূর্খ শিষ্য বসে বসে তাঁর পা টিপে দিচ্ছে। গুরু বললেন, “তুমি ঘমতে যাবার আগে খাটিয়াটা ঠিক করে দিও। পায়াগুলো অসমান আছে।” শিষ্য উঠবার সময় দেখল, একদিকের পায়াটা একেবারে ভাঙা। এখন উপায়? বেচারা খাটের সেই দিকটা নিজের হাঁটুর উপর রেখে সারারাত জেগে কাটাল। সকালে গুরু ঘুম থেকে উঠে ব্যাপার দেখে অবাক!
গুরুর মনে ভারি দুঃখ হল। তিনি ভাবলেন, আহা বেচারা এমন করে আমার সেবা করে, এর কি কোনরকম বিদ্যা বুদ্ধি হবার উপায় নাই? পুঁথি পড়ে বিদ্যালাভ সকলের হয় না, কিন্তু দেখে শুনেও ত কত লোকে কত কি শেখে? দেখা যাক, সেই ভাবে একে কিছু শেখান যায় কিনা। তিনি শিষ্যকে ডেকে বললেন, “বৎস, এখন থেকে তুমি যেখানেই যাও, ভাল ক’রে সব দেখবে—আর কি দেখলে, কি শুনলে, কি করলে, সব আমাকে এসে বলবে।” শিষ্য বলল, “আজ্ঞে, তা বলব।”
তারপর কিছুদিন যায়, শিষ্য একদিন জঙ্গলে একটা কাঠ আনতে গিয়ে একটা সাপ দেখতে পেল। সে টোলে ফিরে এসে গুরুকে বলল, “আজ একটা সাপ দেখেছি।” গুরু উৎসাহ ক’রে বললেন, “বেশ বেশ। বল ত সাপতা কি রকম?” শিষ্য বললে, “আজ্ঞে, ঠিক যেন লাঙ্গলের ঈষ্‌।” শুনে গুরু বেজায় খুশী হয়ে বললেন, “হাঁ, হাঁ, ঠিক বলেছ। অনেকটা লাঙ্গলের ডাণ্ডার মতই ত। সরু, লম্বা, বাঁকা আর কালো মতন। তুমি এমনি ক’রে সব জিনিস মন দিয়ে দেখতে শেখ, আর ভাল ক’রে বর্ণনা করতে শেখ, তা হলেই তোমার বুদ্ধি খুলবে।
শিষ্য ত আহ্লাদে আটখানা। সে ভাবলে, “তবে যে লোকে বলে আমার বুদ্ধি নেই।” আর একদিন সে বনের মধ্যে গিয়ে ফিরে এসে গুরুকে বলল, “আজ একটা হাতী দেখলাম।” গুরু বললেন, “হাতীটা কি রকম?” শিষ্য বললে, “ঠিক যেন লাঙ্গলের ঈষ্‌।” গুরু ভাবলেন, “হাতীটাকে লাঙ্গল দণ্ডের মত বলছে কেন? ও বোধহয় শুঁড়টাকেই ভাল করে দেখেছে। তা ত হবেই—শুঁড়টাই হল হাতীর আসল বিশেষত্ব কিনা। ও শুধু হাতী দেখেছে তা নয়, হাতীর মধ্যে সব চাইতে যেটা দেখবার জিনিস, সেইটাই আরও বিশেষ করে দেখেছে।’ সুতরাং তিনি শিষ্যকে খুব উৎসাহ দিয়ে বললেন, “ঠিক, ঠিক, হাতীর শুঁড়টা দেখতে অনেকটা লাঙ্গলের ঈষের মতই ত।” শিষ্য ভাবলে, ‘গুরুর তাক্‌ লেগে গেছে—না জানি আমি কি পণ্ডিত হলাম রে!’
তারপর শিষ্যরা একদিন গেছে নিমন্ত্রণ খেতে। মূর্খও সঙ্গে গিয়েছে। খেয়েদেয়ে ফিরে আসতেই গুরু বললেন, “কি ক’রে এলে?” শিষ্য বললে, “দুধ দিয়ে, দৈ দিয়ে, গুড় মেখে খেলাম।” গুরু বললেন, “বেশ করেছ। বল ত, দৈ দুধ কি রকম?” শিষ্য একগাল হেসে বলল, “আজ্ঞে, ঠিক যেন লাঙ্গলের ঈষ্‌।”
গুরুর ত চক্ষুস্থির! তিনি বললেন, “ও মূর্খ! এই বুঝি তোর বিদ্যে! আমি ভাবছি যে তুই বুঝি বুদ্ধি খাটিয়ে সব জবাব দিচ্ছিস। তুই লাঙ্গলও দেখেছিস, দুধ দৈও খেয়েছিস, তবে কোন্‌ আক্কেলে বললি যে লাঙ্গলের ঈষের মত? দূর্‌ দূর্‌ দূর্‌! কোনদিন তোর কিচ্ছু হবে না।”
শিষ্য বেচারা হঠাৎ এমন তাড়া খেয়ে একেবারেই দমে গেল। সে মনে মনে বলতে লাগল, “এদের কিছুই বোঝা গেল না। ঐ কথাটাই ত ক’দিন ধ’রে ব’লে আসছি, শুনে গুরু রোজই ত খুশী হয়। তাহলে আজকে কেন বলছে ‘দূর দূর’! দুত্তারি! এদের কথার কিছু ঠিক নেই।”


© 2024 পুরনো বই