ছত্রপতির ছোরা

ছত্রপতির ছোরা

এক – সুন্দরবাবুর শাস্তিভোগ

‘আজ সাত দিন আপনার দেখা নেই৷ আজ সাত দিন চায়ের আসরে আপনার আসন খালি পড়ে আছে৷ সুন্দরবাবু এজন্যে আপনাকে শাস্তি নিতে হবে৷’

-‘কী শাস্তি দিতে চাও জয়ন্ত?’

-‘সুকঠোর শাস্তি! আজ একাসনে বসে গলাঃধকরণ করতে হবে সাত পেয়ালা চা, সাতখানা টোস্ট আর সাতটা এগপোচ৷’

-‘ওঃ ! তাহলে তো সুন্দরবাবু আনন্দের সপ্তমস্বর্গে আরোহণ করবেন! ভারি শাস্তি দিতে চাও তো জয়ন্ত!’ মানিক বললে হাসতে হাসতে৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘মানিকের ছেঁড়া কথায় কান পেতো না জয়ন্ত! তোমার শাস্তি যে অত্যন্ত কঠোর শাস্তি, সে বিষয়ে সন্দেহ নাস্তি৷ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখো, দস্তুরমতো ম্লানমুখে আর দুঃখিত ভাবেই ওই শাস্তি আমি গ্রহণ করব৷ আনন্দিত হব কী, মুখ টিপে একটুখানি হাসব না পর্যন্ত৷’

জয়ন্ত বললে, ‘বেশ, তাহলে চেয়ারে বসে পড়ুন৷ শাস্তির জন্যে প্রস্তুত হন৷’

-‘হুম! আমি প্রস্তুত৷’

-‘এতদিন আসেননি কেন?’

-‘পরে বলব৷ আগে শাস্তি দাও৷ সাত পেয়ালা চা, সাতখানা টোস্ট, সাতটা এগপোচ৷ ঃউ, কল্পনাতীত শাস্তি!’

মিনিট সাতেকের মধ্যে সাত-সাতখানা করে টোস্ট আর এগপোচ, বদন-বিবরের মধ্যে নস্যাৎ করে দিয়ে সুন্দরবাবু বললেন, ‘এইবারে তোমাদের সঙ্গে কথা কইতে কইতে সপ্তপেয়ালা চায়ের সদব্যবহার করব৷ কী জানতে চাও জয়ন্ত?’

-‘এতদিন কী করছিলেন?’

-‘তদন্ত৷’

-‘নতুন মামলা বুঝি?’

-‘হুঁ৷ এমন মামলা যে সামলানো দায়৷’

-‘কীরকম?’

-‘খুনের মামলা কিন্তু একেবারে সূত্রহীন-অর্থাৎ খুনি কুত্রাপি সূত্র-টুত্র কিছুই রেখে যায়নি৷ অগাধ জলে সাঁতার কাটতে কাটতে হাঁপিয়ে উঠেছি ভায়া!’

-‘মামলাটার বিবরণ শুনতে পাই না?’

– ‘শুনবে বই কী, শোনাবার জন্যেই তো আমার শুভাগমন৷ আচ্ছা, একটু সবুর করো৷ আর মোটে দু-পেয়ালা চা বাকি আছে৷ রোসো, এক-এক চুমুকে সেটুকু সাবাড় করে দিই৷ হুম, এখন তোমার মত কী মানিক? আমি কি রীতিমতো হর্ষহীন বিমর্ষ মুখে জয়ন্তের দেওয়া কঠোর শাস্তি ভোগ করলুম না? আমি কি একবারও হেসেছি-একবারও আনন্দ প্রকাশ করেছি? অতএব সাবধান, ভবিষ্যতে আর কখনো আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়ো না৷’

মানিক বললে, ‘আজ একটা ব্যাপার আপনি প্রমাণ করলেন বটে৷’

-‘কী’?

-‘পুলিশ কেবল জবরদস্তি করতেই জানে না, খাসা অভিনয় করতেও জানে৷’

-‘অভিনয়?’

-‘হ্যাঁ, প্রথম শ্রেণির অভিনয়৷ আপনি ইচ্ছা করলে শিশির ভাদুড়ির অন্নও মারতে পারেন৷’

-‘জয়ন্ত, তোমার স্যাঙাতটি হচ্ছে অতিশয় হাড়-ঢ্যাঁটা৷ ও আমাকে আবার নতুন দিক দিয়ে আক্রমণ করতে চায়৷ এবার কিন্তু আমি ক্রুদ্ধ হবার চেষ্টা করব৷’

মানিক কৃত্রিম অনুনয়ের স্বরে বললেন, ‘দোহাই সুন্দরবাবু, আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক-আপনি দয়া করে একটিবার ক্রুদ্ধ হন!’

সুন্দরবাবু থতোমতো খেয়ে বললেন, ‘মানে?’

-‘মানে হচ্ছে এই৷ আপনি ক্রুদ্ধ হলেই আপনাকে নিয়ে বেশি মজা করা যায়৷’

-‘আমাকে নিয়ে মজা?’

-‘হ্যাঁ দাদা!’

-‘আমাকে নিয়ে মজা করতে চাও?’

-‘তা ছাড়া আর কী?’

-‘তাহলে আমি কিছুতেই ক্রুদ্ধ হব না৷’

-‘তবে হাস্য করুন৷’

-‘না৷ আমি আর ক্ষুব্ধ কি ক্রুদ্ধও হব না, হাস্যও করব না৷’

-‘তবে মুখটি বুজে চুপটি করে বসে থাকুন৷’

-‘না, আমি মুখটি বুজে চুপটি করে বসেও থাকব না৷ আমি এখন জয়ন্তের কাছে আমার মামলার কথা বলব৷’

মানিক নাচার ভাবে বললে, ‘তথাস্তু৷’

দুই – হত্যানাট্যের পাত্র-পাত্রী

সুন্দরবাবু বললেন, ‘জয়ন্ত তুমি বসন্তপুরের স্বর্গীয় জমিদার রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ রায়ের নাম শুনেছ?’

-‘শুনেছি৷ তিনি দানশীল ব্যক্তি ছিলেন৷’

-‘হ্যাঁ তাঁর দুই পুত্র-হীরেন্দ্রনারায়ণ, দীনেন্দ্রনারায়ণ৷ এক কন্যা, সৌদামিনী দেবী৷ জ্যেষ্ঠ পুত্র হীরেন্দ্র চিরকুমার৷ কনিষ্ঠ দীনেন্দ্র পিতার জীবদ্দশাতেই বিপত্নীক হয়ে এক পুত্র রেখে মারা পড়েন, ছেলেটির নাম দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ৷ রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ নানাদিক দিয়ে গুণী হয়েও, অত্যন্ত একরোখা ও কোপনস্বভাব ছিলেন, ছেলেদের সঙ্গে তাঁর বনিবনাও হত না৷ ব্যাপার ক্রমে এমন চরমে ওঠে যে, হীরেন্দ্র আর দীনেন্দ্র পিতৃগৃহ ত্যাগ করে চলে যান৷ রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ উইল করে সমস্ত সম্পত্তি দান করেন কন্যা সৌদামিনী দেবীকে৷ সৌদামিনীর বিবাহ হয়৷ রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ সন্ন্যাস রোগে মারা পড়েন৷ তারপর জননী হবার আগেই বৎসর ঘুরতে-না-ঘুরতেই সৌদামিনী হন বিধবা৷’

জয়ন্ত বললে, ‘এ যে দেখছি দুর্ভাগ্যের ইতিহাস৷’

-‘হ্যাঁ, এর সমাপ্তিও বিয়োগান্ত৷ কলকাতার উপকন্ঠে রাজা নরেন্দ্রনারায়ণের একখানা অট্টালিকা আছে৷ বিধবা হবার পর থেকে সৌদামিনী সেইখানেই বাস করে আসছেন৷ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হীরেন্দ্র তাঁর কাছ থেকে মাসিক হাজার টাকা করে সাহায্য পেতেন৷ তিনি মাঝে মাঝে ভগ্নীর সঙ্গে দেখা করেও যেতেন৷ কনিষ্ঠ দীনেন্দ্রের পুত্র দ্বিজেন্দ্র পিতার মৃত্যুর পর পিতামহের বাড়িতেই বাস করেন, বলা বাহুল্য যে সৌদামিনীর ইচ্ছানুসারেই৷ সৌদামিনীর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে এই ভ্রাতুস্পুত্রই৷ এখন আমার সঙ্গে ব্যাপারটার সম্পর্ক কী শোনো৷ আজ আট দিন হল, সৌদামিনী দেবী হঠাৎ মারা পড়েছেন৷ স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, অপঘাত মৃত্যু৷’

-‘হত্যাকাণ্ড?’

-‘হ্যাঁ! একদিন সকালে দাসী ঘরে ঢুকে দেখে, বিছানার উপরে পড়ে রয়েছে সৌদামিনীর মৃতদেহ-বক্ষে তাঁর অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন৷ হত্যাকারী যে কে, ধরবার কোনো উপায়ই নেই৷ ঘটনাস্থলে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমি একটিমাত্র সূত্র আবিষ্কার করতে পারিনি৷ কেবল এইটুকু আন্দাজ করতে পেরেছি, হত্যাকারী বাড়ির বাইরে থেকে আসেনি৷’

-‘এমন আন্দাজের কারণ?’

‘সৌদামিনীর শয়নগৃহের প্রত্যেক জানালা ছিল ভিতর থেকে বন্ধ৷ ঘরের দরজা রাত্রে অর্গলবদ্ধ থাকত না বটে, কিন্তু সেই দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতে হলে আরও দু-টি এমন ঘরের ভিতর দিয়ে আসতে হয়, যার প্রত্যেকটিতেই থাকে অন্য অন্য লোক৷’

-‘আপনি কি সন্দেহ করেন, বাড়ির কোনো লোকই হত্যাকাণ্ডের জন্যে দায়ী?’

-‘বাড়ির সব লোককেই প্রশ্ন করে বুঝেছি, তারা প্রত্যেকেই সন্দেহের অতীত৷’

-‘বাড়ির লোকদের কথা বলুন৷’

-‘প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েও সৌদামিনী একান্ত সাধারণভাবেই জীবনযাপন করতেন৷ প্রকাণ্ড অট্টালিকার মধ্যে বাসিন্দা আছে মাত্র গুটিকয়৷ তিন-মহলা বাড়ি৷ প্রথম দুটো মহল একরকম তালাবন্ধ থাকে বললেই চলে৷ একটিমাত্র মহলই ব্যবহার করতেন সৌদামিনী৷ যে ঘরের ভিতর দিয়ে সৌদামিনীর ঘরে ঢোকা যায়, সেখানে থাকে তাঁর নিজস্ব পুরাতন দাসী৷ বয়স পঞ্চান্ন, নাম উমাতারা৷ সে সাধারণ দাসী নয়, গরিব কায়স্থের মেয়ে, বিধবা৷ ঘটনার দিন সে পাড়ার এক বিয়েবাড়িতে থিয়েটার দেখতে গিয়েছিল৷ রাত একটার সময়ে ফিরে আসে৷ সৌদামিনী দেবী তখন জীবিত ছিলেন কি না সে বলতে পারে না, কারণ নিজের ঘরে ফিরে এসেই সে শুয়ে আর ঘুমিয়ে পড়ে৷ সেই-ই সকালে উঠে প্রথমে সৌদামিনীকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়৷

‘তার ঘরের দরজা দিয়েই আসা যায়, পবিত্রবাবুর ঘরে৷ তার বয়স পঞ্চাশ বৎসর-এই পরিবারে কাজ করছেন দীর্ঘ পঁচিশ বৎসর৷ এখন নায়েবের পদে মোতায়েন৷ একরকম ঘরেরই লোক আর অত্যন্ত বিশ্বাসী৷ নিঃসন্তান৷ সহধর্ম্মিণী সুরবালার সঙ্গে এই বাড়িতেই বাস করেন৷ কথায়-বার্তায় হাবভাব ব্যবহারে অতিশয় অমায়িক৷ তিনিও পাড়ার ওই বাড়িতে গিয়ে খানিকক্ষণ থিয়েটার দেখে রাত এগারোটার সময় বাড়িতে ফিরে আসেন৷ সুরবালার বয়স বিয়াল্লিশ৷ তিনি হাঁপানি রোগে প্রায় শয্যাশায়িনী৷ ঘটনার দিন বাড়িতেই ছিলেন না, পিত্রালয়ে গিয়েছিলেন৷

‘এই ঘরের পাশেই একখানা ছোট্ট ঘর৷ সেখানে থাকে এক প্রৌঢ়া ব্রাহ্মণী৷ বিধবা৷ রান্নাবান্নার ভার তার উপরেই৷ নাম বিন্দুবালা৷ সঙ্গে থাকে তার অবিবাহিতা কন্যা সিন্ধুবালা৷ বয়স পনেরো৷ রান্নাঘরের কাজে মাকে সাহায্য করে৷

‘মহলের একদিকে তিনখানা ঘর নিয়ে বাস করে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ৷ বয়স পঁচিশ৷ সুশিক্ষিত৷ কলেজের পড়া সাঙ্গ করেছে৷ কাব্যব্যাধিগ্রস্ত, মাসিকপত্রে কবিতা লেখে৷ খবর নিয়ে জেনেছি সচ্চরিত্র৷ স্বভাব কিঞ্চিৎ রোমান্টিক৷ মাসে দু-শো টাকা হাত খরচা পায়৷ পান সিগারেট পর্যন্ত খায় না৷

‘বাকি রইল আর একজনের কথা৷ নাম তার মানসী৷ বয়স বিশ বৎসর৷ পরমা সুন্দরী৷ সুমধুর প্রকৃতি৷ সুশিক্ষিতা৷ সৌদামিনীর স্বামীর দূর-সম্পর্কের আত্মীয়া৷ পিতা-মাতার মৃত্যুর পর সে একান্ত অসহায় হয়ে পড়াতে সৌদামিনী তাকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন৷ আজ দুই বৎসর সে এখানে বাস করছে৷ উঠতে-বসতে তাকে ছাড়া সৌদামিনীর একদণ্ডও চলে না৷ আগে নায়েব পবিত্রবাবুই ছিলেন সৌদামিনীর ডান হাতের মতো, মানসী আসবার পর থেকেই তাঁর প্রভুত্ব ধীরে ধীরে কমে এসেছে৷ পবিত্র বাবুর কথাবার্তা শুনে ধারণা হল, এজন্যে তিনি মনে মনে মানসীর উপরে বিশেষ খুশি নন৷ তা এটা স্বাভাবিক৷

‘বাড়ির ভিতরে বাস করে এই কয়জন লোক৷ আর আছে দু-জন দ্বারবান, তিন জন বেয়ারা, দু-জন মালী, সকলেই পরীক্ষিত, পুরাতন লোক৷ তারা রাত্রে বাড়ির ভিতরেও থাকে না৷ তাদের জন্যে বাড়ির বাইরে, বাগানের ভিতর আলাদা ঘর আছে৷ আর তারা কীসের লোভে নরহত্যা করবে? সৌদামিনীর ঘর থেকে মূল্যবান কোনো জিনিসই চুরি যায়নি৷ একজন ঠিকে ঝি আছে, বাসন-কোসন মেজে দিয়ে চলে যায়৷

‘যেসব বাড়ির লোকের কথা বললুম, সৌদামিনীর জীবনের সঙ্গে তাদের প্রত্যেকেরই স্বার্থ জড়িত৷ সৌদামিনী বেঁচে থাকলেই লাভ৷ সৌদামিনীর মৃত্যুর পর তাদের চাকরি যাবার সম্ভাবনা৷ সম্পত্তি পেয়ে দ্বিজেন কী করবে না করবে, কে বলতে পারে? মানসী চাকরি করে না বটে, কিন্তু সৌদামিনীর মৃত্যুর পর আবার তার অবস্থা হয়েছে অসহায়৷ সে দ্বিজেনের কেউ নয়৷ দ্বিজেন তার ভার গ্রহণ করবে কি না সন্দেহ!’

মানিক বললে, ‘কিন্তু সৌদামিনীর মৃত্যুতে দ্বিজেন কি লাভবান হবে না?’

-‘মানিক, অপরাধীদের নিয়ে মাথার চুল পাকিয়ে ফেললুম, দুষ্ট লোক কি আমার চোখে ধুলো দিতে পারে? অপরাধীদের টাইপই আলাদা৷ দ্বিজেনের সম্বন্ধে নানা জনের কাছ থেকে খবরাখবর নিয়ে আমি তার কোনো দোষই আবিষ্কার করতে পারিনি৷ বিশেষ দ্বিজেনের মুখের উপরেই আছে তার মনের উজ্জ্বল পরিচয়৷ এমন শিশুর মতো সরল পবিত্র মুখ সচরাচর চোখে পড়ে না৷’

জয়ন্ত শুধোলে, ‘সৌদামিনীর দাদা হীরেন্দ্রনারায়ণ কীরকম লোক?’

-‘খোঁজ নিয়েছি৷ সুবিধের লোক নয়, মাতাল, জুয়াড়ি৷ একা থাকে, অথচ হাজার টাকা মাসোহারা পেয়েও নিজের খরচ কুলোতে পারে না৷ সৌদামিনীর মৃত্যুর হপ্তা খানেক আগেও সে বোনের কাছে আরও টাকা চাইতে এসেছিল, কিন্তু টাকা পায়নি৷ তাই নিয়ে ভাই-বোনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়৷ হীরেন রাগ করে চলে যায়৷ কিন্তু তবু তাকে সন্দেহ করবার উপায় নেই৷’

-‘কেন?’

-‘প্রথমত, খুনি বাইরে থেকে এসেছে এমন কোনো প্রমাণ নেই৷ দ্বিতীয়ত, ভগ্নীহত্যা করে হীরেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারতে যাবে কেন? সৌদামিনীর মৃত্যুর সঙ্গেসঙ্গেই তার হাজার টাকা মাসোহারা বন্ধ হবার সম্ভাবনা৷’

-‘এখন সৌদামিনী সম্বন্ধে আরও কিছু বলতে পারেন?’

-‘পারি৷ মৃত্যুকালে সৌদামিনীর বয়স হয়েছিল পঁয়ষট্টি৷ একহারা, শুকনো চেহারা, কিন্তু খুব শক্ত৷ আরও পনেরো-বিশ বছর অনায়াসে যমকে কলা দেখাতে পারতেন৷ বাপের মতন তিনিও ছিলেন বিষম একরোখা, কোপন-প্রকৃতি৷ ভালো-মন্দ যা-কিছু স্থির করতেন, তার আর নড়চড় হবার জো ছিল না৷ বাড়ির লোকের কারু তুচ্ছ ত্রুটি-বিচ্যুতিও সহ্য করতে পারতেন না, একেবারে আগুন হয়ে উঠতেন৷ তার উপরে ছিলেন বেজায় রাশভারী মানুষ, মানসী আর পবিত্রবাবু ছাড়া আর কেউ সহজে তাঁর কাছে ঘেঁষতে সাহস করত না৷ বাড়ির প্রত্যেকেই তাঁকে ভয় করত, কেউ ভালোবাসত বলে মনে হয় না৷’

-‘এতদিনে নিশ্চয়ই শবব্যবচ্ছেদ হয়েছে?’

-‘তা হয়েছে বই কী!’

-‘হত্যাকারী কীরকম অস্ত্র ব্যবহার করেছে?’

-‘ডাক্তারের মতে ছোরা৷ কিন্তু ঘটনাস্থলে ছোরা-টোরা কিছুই পাওয়া যায়নি৷’

-‘পদচিহ্ন, আঙুলের ছাপ?’

-‘কিছু না, কিছু না৷’

-‘ডাক্তারের মতে সৌদামিনী মারা পড়েছেন কখন?’

-‘আন্দাজ রাত এগারোটা কি বারোটা৷’

জয়ন্ত কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল৷ তারপর বললে, ‘সুন্দরবাবু, মামলাটা বেশ অসাধারণ৷ বুড়ি মেরে অকারণে কেউ খুনের দায়ে পড়তে চায় কেন?’

-‘হুম, আমারও তো ওই প্রশ্ন!’

-‘কিন্তু বুড়িকে নিশ্চয়ই কেউ অকারণে খুন করেনি৷ তলে তলে মস্ত একটা রহস্য আছে৷ আমি এইরকম রহস্যময় মামলাই পছন্দ করি৷’

সুন্দরবাবু জোরে মস্তকান্দোলন করে বললেন, ‘আমি কিন্তু মোটেই পছন্দ করি না৷ সূত্রহীন মামলা ঘাড়ে পড়লে পুলিশকে কেবল নাকানি-চোবানি খেয়ে মরতে হয়৷’

-‘সূত্রহীন মামলা প্রমাণিত করে অপরাধীর চাতুর্য৷ কিন্তু কে বললে এ মামলাটা সূত্রহীন?’

-‘সূত্র আছে কুত্র, দেখিয়ে দাও দেখি?’

-‘সূত্র আছে রাজা নরেন্দ্রনারায়ণের বাড়ির ভিতরে৷’

-‘কী ছাই বল! আজ ক-দিন ধরে বাড়ির ভিতরটা কি আমি খুঁজতে বাকি রেখেছি? সেখানে সূত্রের নামগন্ধও নেই৷’

-‘তাহলে হত্যাকারী বাইরের লোক৷’

-‘অসম্ভব৷’

-‘দেখা যাক৷ আপনি এক কাজ করতে পারেন?’

-‘বলো৷’

-‘বললেন, নরেন্দ্রনারায়ণের বাড়ির দুটো মহলে কেউ বাস করে না৷ আমি আর মানিক ওই দুটো মহলের কোনো একটায় হপ্তা খানেক থাকতে পারি, এমন ব্যবস্থা কি হয় না?’

-‘খুব সহজেই হয়৷ ধরতে গেলে দ্বিজেনই এখন বাড়ির মালিক৷ আমি প্রস্তাব করলে নিশ্চয়ই সে নারাজ হবে না৷’

-‘তবে তাই করুন৷’

-‘ওখানে গিয়ে থাকলেই কি সূত্র বেরিয়ে পড়বে মাটি ফুঁড়ে?’

-‘মাটি ফুঁড়ে না বেরোক, মানুষের মন ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়তে পারে তো? অপরাধী যদি বাড়ির ভিতরে থাকে তাহলে আমি তাকে নিশ্চয়ই আবিষ্কার করতে পারব৷’

তিন – দ্বিজেন্দ্রনারায়ণের প্রবেশ

কলকাতার উপকন্ঠ বটে, কিন্তু জায়গাটার মধ্যে আছে পল্লিগ্রামের ছাপ৷

মাঠের পর মাঠ সবুজ, মাঝে মাঝে তাল-নারিকেলকুঞ্জ, বড়ো বড়ো বনস্পতির ভিড়৷ একদিকে কালীঘাট থেকে এগিয়ে এসেছে আদিগঙ্গার একটি শীর্ণ ধারা, তার ঝিরঝিরে জলে ঝিকমিক করছে সূর্যকরচূর্ণ৷ অনেক দূরে দূরে দেখা যায় এক-একখানা বাড়ি৷ তারা মনের ভিতরে মনুষ্য-বসতির স্মৃতি জাগায় বটে, কিন্তু নষ্ট করে দিতে পারে না নিরালা শ্যামল পল্লিশ্রী৷

জয়ন্ত বললে, ‘দেখো মানিক, দিনের বেলায় এমন জায়গায় ওই ছাড়া ছাড়া বাড়িগুলিকে দেখতে খুব শান্ত, খুব সুন্দর৷ কবি আর শিল্পীরা নাকি ওইরকম সব বাড়িতেই বাস করতে ভালোবাসেন৷ কিন্তু এমনি নিরালা, নির্জন অন্ধকার গভীর রাত্রে ওই বাড়িগুলো শহরের যেকোনো বাড়ির চেয়ে ভয়াবহ আর বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে৷’

-‘এ কথা কেন বলছ?’

-‘এইরকম সব বাড়িতেই বিয়োগান্ত নাট্যাভিনয়ের সুযোগ আর সুবিধা থাকে বেশি৷ এসব জায়গায় অপরাধীরা যথেষ্ট অসংকোচে কাজ করতে পারে৷ তাই এমন সব বাড়ি দেখলে আমার মনে কবিত্ব জাগে না, জাগে আতঙ্ক৷’

মানিক হেসে বললে, ‘অপরাধ-তত্ব ঘেঁটে তোমার মনের গড়ন বদলে যাচ্ছে৷’

-‘হয়তো তাই মানিক, হয়তো তাই৷’

একখানা প্রকাণ্ড দ্বিতল অট্টালিকা, তার চারিধারে বাগান৷ ফটক দিয়ে জয়ন্তদের মোটর বাগানের ভিতরে প্রবেশ করলে৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘এই হচ্ছে নরেন্দ্রনারায়ণের শহরতলির প্রাসাদ৷

মানিক বললে, ‘একসময়ে হয়তো এটা প্রাসাদই ছিল, কিন্তু এখন ওর মধ্যে প্রাসাদত্ব কিছুই নজরে পড়ে না৷ কত বৎসর সংস্কার হয়নি কে জানে! বাগানেও নেই বাগানত্ব৷’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুঁ, সৌদামিনী দেবী ওসব বিষয়ে অত্যন্ত উদাসীন৷ কেবল যে মহলে নিজে বাস করতেন, একটু-আধটু নজর দিতেন তার দিকেই৷ ওই যে আমাদের মোটরের শব্দ পেয়ে দ্বিজেন নিজেই নেমে এসেছে৷’

গাড়ি এসে থামল গাড়িবারান্দার তলায়৷ একটি তরুণ যুবক এসে নমস্কার করে বললে, ‘সুন্দরবাবু, এঁরাই কি দয়া করে আমাদের এখানে অতিথি হবেন?’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, এঁদেরই নাম জয়ন্তবাবু আর মানিকবাবু, জয়ন্ত, ইনি হচ্ছেন শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ রায়৷’

দ্বিজেন বললে, ‘দুনিয়ায় ভালো-মন্দ কিছুই ব্যর্থ হয় না৷ আমার দুর্ভাগ্যের জন্যেই এঁদের মতো বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ হবার সৌভাগ্য অর্জন করলাম৷’

জয়ন্ত বললে, ‘কিন্তু আমি হয়তো আবার এখানকার কারুর না কারুর দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়াব!’

দ্বিজেনের মুখের উপর ঘনিয়ে উঠল একটা ছায়া৷ তাড়াতাড়ি সে হাসবার চেষ্টা করলে, কিন্তু হাসিটা ভালো করে জমল না৷

সুন্দরবাবু শুধোলেন, ‘দ্বিজেনবাবু, আমার বন্ধুরা ঠাঁই পাবেন কোন মহলে?’

দ্বিজেন বললে, ‘সদর মহলে৷ ঠাকুরদাদার আমলে এখানে অনেক অতিথি-অভ্যাগতদের আগমন হত৷ অনেকেই পাঁচ-দশ দিন থেকে যেতেন, তাঁদের জন্যে যে ঘরগুলো নির্দিষ্ট ছিল, তারই দু-খানা ঘর ওঁদের জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছি৷ একেবারে সেইখানেই চলুন৷’

গোড়া থেকেই জয়ন্ত লক্ষ করছিল দ্বিজেনের চেহারা, ভাবভঙ্গি ও সাজসজ্জা৷ সুন্দর সুমিষ্ট মুখশ্রী, ছিপছিপে সুগঠিত দেহ, পরিচ্ছন্ন সাজসজ্জায় শৌখিনতা নেই, আছে সুরুচির পরিচয়৷ মৌখিকভাবে শিশুসুলভ সরলতা থাকলেও চিন্তাশীলতার অভাব নেই৷ কন্ঠস্বর মার্জিত৷ অপরাধীদের মধ্যে এ শ্রেণির লোক দেখা যায় না৷

কিন্তু সেইসঙ্গে আর একটা বিশেষত্ব আকৃষ্ট করলে জয়ন্তের দৃষ্টিকে৷ দ্বিজেনের ভাবভঙ্গি কেমন সংকুচিত এবং তার চক্ষে কেমন একটা সন্দেহের ছাপ৷ জয়ন্তের মনে বারংবার প্রশ্ন জাগতে লাগল-কেন, কেন, কেন?

দ্বিজেনের সঙ্গে তারা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলে৷ কার্পেট পাতা প্রশস্ত সোপান শ্রেণি-তার পাশের দেওয়াল বড়ো বড়ো তৈলচিত্রে অলংকৃত৷ বড়ো বড়ো হলঘর, দামি দামি ছবি, মস্ত মস্ত আয়না, পাথরের বা পিতলের বা ব্রোঞ্জের মূর্তি, সোফা, কৌচ, গদিমোড়া চেয়ার, নানা আকারের টেবিল ও বিজলিবাতির ঝাড় প্রভৃতির দ্বারা সুসজ্জিত৷ ঐশ্বর্যের কোনো মালমশলার অভাব নেই, কিন্তু অনাদরে ও মার্জনার অভাবে সমস্তই যেন একান্ত শ্রীহীন বলে মনে হয়৷ যেখানে রয়েছে এমন সব মূল্যবান আসবাব, তাদেরই উপরে এবং আশেপাশে চোখে পড়ে কালি-ঝুলি-ধূলি, মাকড়সার জাল এবং আরও যত কিছু মালিন্য ও কলঙ্ক৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘সৌদামিনী দেবী পিতার সম্পত্তির মালিক হয়েও তার সদব্যবহার করেননি কেন?’

দ্বিজেন বললে, ‘বিধবা হবার পর থেকেই আমার পিসিমা সংসারের উপরে সমস্ত আস্থাই যেন হারিয়ে ফেলেছিলেন৷’

-‘কিন্তু আপনি আছেন তো?’

-‘পিসিমা বলতেন, আমি বেঁচে থাকতে কেউ যেন আমার বাবার শখের জিনিসে হাত না দেয়! তাঁর হুকুমের বিরুদ্ধে যাবার সাহস ছিল না৷’

-‘অথচ আপনিই তাঁর উত্তরাধিকারী!’

দ্বিজেন শুষ্ক মৃদু স্বরে ধীরে ধীরে বললে, ‘না, আমি তাঁর উত্তরাধিকারী নই৷’

সচমকে ফিরে দাঁড়িয়ে সুন্দরবাবু সবিস্ময়ে বললেন, ‘সেকী!’

-‘আমি আগে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ছিলুম বটে, কিন্তু এখন আর নই৷’

-‘আপনার কথার অর্থ আমি বুঝতে পারছি না৷’

দ্বিজেন ম্লান হাসি হেসে বললে, ‘মৃত্যুর তিন দিন আগে পিসিমা এক নতুন উইল করে সমস্ত সম্পত্তি জ্যাঠামশাইকে দিয়ে গিয়েছেন৷’

-‘হীরেন্দ্রনারায়ণ রায়কে?

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘এ কথা এতদিন আমাকে বলেননি কেন?’

-‘আমি নিজেই সঠিক খবর জানতুম না৷ দিন-তিনেকের জন্যে আমি কলকাতার বাইরে গিয়েছিলুম-নতুন উইল হয় সেই সময়ে আমার অজ্ঞাতসারেই৷ তারপর কাল আমাদের অ্যাটর্নিবাবু হরিদাস চৌধুরীর মুখে এই খবরটা জানতে পেরেছি৷’

-‘তাহলে সৌদামিনী দেবী যখন মারা পড়েন, তখনও আপনি এ খবর জানতেন না?’

-‘না৷’

সুন্দরবাবু নিজের মনে মনেই কী যেন ভেবে মাথা নাড়লেন৷ তারপর বললেন, ‘আপনার জ্যাঠামশাই নতুন উইলের কথা নিশ্চয়ই জানতে পেরেছেন?’

-‘না৷’

-‘কেন?’

-‘শুনেছেন তো পিসিমার সঙ্গে জ্যাঠামশাইয়ের টাকা নিয়ে মনান্তর হয়েছিল? তার দুই-একদিন পরেই জ্যাঠামশাই কারুকে কিছু না জানিয়েই কলকাতার বাইরে কোথায় গিয়েছেন; কবে ফিরবেন তা কেউ বলতে পারছে না৷ কাজেই নতুন উইল বা পিসিমার মৃত্যুর খবর তাঁর কানে গিয়ে পৌঁছোয়নি৷’

-‘আপনাদের অ্যাটর্নির ঠিকানা কী?’

দ্বিজেন ঠিকানা দিলে৷

ঠিকানাটা টুকে নিয়ে সুন্দরবাবু বললেন, ‘আজ আসি জয়ন্ত! একটা জরুরি তদন্ত আছে! কাল আবার আসব৷’

চার – কায়ার ছায়া

দু-খানি পাশাপাশি মাঝারি আকারের ঘর জয়ন্ত ও মানিকের জন্যে নির্বাচিত হয়েছিল৷ প্রত্যেক ঘরের দু-দিকেই বারান্দা-একটি ভিতরকার আঙিনার দিকে, আর একটি বাইরেকার বাগানের দিকে৷

দ্বিজেন বললে, ‘এ ঘর দু-খানার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দেখে আপনারা অবাক হবেন না৷ এ দু-খানা আপনাদের বাসোপযোগী করে তোলবার ভার নিয়েছিলেন নায়েবমশাই নিজেই৷ আপনারা আসছেন শুনে তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছেন৷’

জয়ন্ত শুধোলে, ‘কেন?’

-‘নায়েব মশাইয়ের মতে সরকারি পুলিশ কোনোই কর্মের নয়৷ আপনারা একটু চেষ্টা করলেই নাকি খুনির ধরা পড়তে বিলম্ব হবে না৷’

-‘আপনিও কি এ কথা বিশ্বাস করেন?’

-‘করি৷’

-‘আপনার বিশ্বাস হয়তো ভ্রান্ত৷’

-‘না জয়ন্তবাবু, আপনার অদ্ভুত শক্তির কথা কে না জানে? অসাধারণ আপনার প্রতিভা! কিন্তু সে কথা এখন থাক৷ আপনাদের ঘর পছন্দ হয়েছে তো?’

-‘হয়েছে৷’

ঠিক এই সময়েই ঘরের ভিতর আর এক ব্যক্তির আবির্ভাব৷ হৃষ্টপুষ্ট দোহারা চেহারা৷ শ্যামবর্ণ৷ মিষ্ট স্মিত মুখ৷ সমুজ্জ্বল দৃষ্টি৷ নিরহংকার ভাবভঙ্গি৷ বয়স প্রৌঢ়ত্ব ও বৃদ্ধত্বের সীমারেখায় এসে উপস্থিত হয়েছে বটে কিন্তু মাথার চুলে ও দাড়ি-গোঁফে দেখা দেয়নি এখনও শুভ্রতার চিহ্ন৷

তিনি ঘরে ঢুকেই উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘স্বাগত জয়ন্তবাবু! স্বাগত মানিকবাবু! আমাদের কী সৌভাগ্য! নমস্কার, নমস্কার!’

জয়ন্ত প্রতি নমস্কার করে বললে, ‘আসুন পবিত্রবাবু!’

ভদ্রলোক বিস্মিত কন্ঠে বললেন, ‘আপনি আমাকে চিনলেন, আর আমার নাম জানলেন কেমন করে?’

-‘মন্ত্রবলে নয়৷ কিন্তু বুঝতে পারছি আপনি আমাদের উপস্থিতির খবর পেয়েছেন এইমাত্র৷’

-‘কী আশ্চর্য! সত্যিই তাই!’

-‘আরও বুঝতে পারছি, খবর পেয়েই দুধের বাটি রেখে তাড়াতাড়ি এখানে ছুটে এসেছেন৷’

দুই চক্ষু সভয়ে বিস্ফারিত করে পবিত্রবাবু বললেন, ‘অপরং বা কিং ভবিষ্যতি! মশাই, আপনি জাদুকর!’

জয়ন্ত সবিনয়ে বললে, ‘না মশাই, আমি একান্ত সাধারণ ব্যক্তি৷’

-‘না, না, আপনি অসাধারণ মানুষ, তৃতীয় নেত্রের অধিকারী!’

-‘চোখ আমার দু-টির বেশি নয়, তবে দুটো চোখকেই সর্বদা আমি সজাগ রাখি বটে৷ শুনুন তবে৷ আমি জানি এ বাড়িতে দু-জন মাত্র ভদ্রলোক থাকেন-দ্বিজেনবাবু আর আপনি৷ কাজেই আপনিই যে পবিত্রবাবু, সেটা বোঝা একটুও কঠিন নয়৷’

-‘ঠিক, ঠিক! কিন্তু-‘

-‘আগে শুনুন৷ আমাদের দেখবার জন্যে আপনি আগ্রহান্বিত ছিলেন-নয়?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ, অত্যন্ত৷ ধরতে গেলে আমি আপনার পথ চেয়েই বসে ছিলুম৷’

-‘কে আপনাকে খবর দিলে যে আমরা এসেছি?’

-‘বেয়ারা৷’

-‘তখন আপনি দুগ্ধপান করছিলেন?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ সকালে আমি চায়ের বদলে একটু গরম দুধ খাই৷ কিন্তু কী আশ্চর্য, আপনি-‘

-‘কিছুই আশ্চর্য নয়, আপনার গোঁফের ডগায় এখনও দুধের দাগ লেগে রয়েছে৷ এখানে আসবার আগ্রহ আপনার এত বেশি যে, আপনি মুখ ধোবার বা দাগ মোছবার সময় পর্যন্ত পাননি৷ খুব তাড়াতাড়ি-প্রায় ছুটেই-আপনি এসেছেন, কারণ ঘরে ঢোকবার সময়ে আপনার শ্বাস-প্রশ্বাস ছিল দ্রুত৷ তাড়াতাড়ি-প্রায় দুটো মহল পার হতে হয়েছে, এই বয়সে একটু হাঁপাবেন বই কী!’

চমৎকৃতভাবে পবিত্রবাবু বললেন, ‘রহস্যটা আপনি খুব সোজা করে আনলেন বটে, কিন্তু তবু বলব, অদ্ভুত! এক মুহূর্তে এত বেশি দেখা আর ভাবা সাধারণ মানুষের পক্ষে অসম্ভব৷ দেখছ তো দ্বিজেন, কত সহজে ইনি কত অজানা কথা জানতে পারেন? আপনার আগমনে আমরা ধন্য হলুম, ধন্য হলুম!’

-‘ক্ষান্ত হোন পবিত্রবাবু, এত বেশি প্রশংসাবাণে বিদ্ধ করলে আমরা অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়ব৷’

-‘আপনাদের জন্যে চা আর জলখাবার আনতে বলে দিই?’

-‘না, ধন্যবাদ৷ ছোটো হাজারি বাড়িতেই সেরে এসেছি৷’

-‘দুপুরে কীরকম খাবার খাবেন?’

-‘আপনাদের যা খুশি৷ আমাদের সেটা খাই না, ওটা খাই না বলার অভ্যাস নেই৷ যা পাই তাই খাই৷’

-‘বেশ, তাহলে আগে আপনাদের ভোজনের ব্যবস্থাটাই করে আসি৷ তারপর আপনার সঙ্গে প্রাণ খুলে ভালো করে আলাপ করব৷’ পবিত্রবাবু যেমন দ্রুতপদে এসেছিলেন, চলে গেলেন তেমনি দ্রুতপদেই৷

জয়ন্ত একটা গোল টেবিলের সামনে বসে পড়ে সামনের আসনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে গম্ভীর স্বরে বললে, ‘বসুন দ্বিজেনবাবু, আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে৷’

জয়ন্তের কন্ঠস্বর শুনে দ্বিজেন একটু বিস্মিতভাবে তাকালে তার মুখের পানে৷ তারপর টেবিলের ওধারের নির্দেশিত চেয়ারে গিয়ে উপবেশন করলে বিনা বাক্যব্যয়ে৷

দ্বিজেনের মুখের উপরে স্থির দৃষ্টি রেখে জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবুর কাছে আপনি বললেন, সৌদামিনী দেবী যে নতুন উইল করেছেন, তিনি মারা যাবার পরেও তার সঠিক খবর আপনার জানা ছিল না৷’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘সঠিক খবর মানে নিশ্চিত খবর তো?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘কিন্তু অনিশ্চিত-অর্থাৎ ভাসা ভাসা কোনো খবর কি আপনি পেয়েছিলেন?’

দ্বিজেন প্রথমটা ইতস্তত করে তারপর বললে, ‘নিশ্চিত বা অনিশ্চিত কোনো খবরই পাইনি৷ তবে নতুন উইল যে হতে পারে এটুকু আন্দাজ করেছিলুম৷’

-‘কেন? স্পষ্টাস্পষ্টি বলুন, কেন?’

অতিশয় অসহায়ের মতো দ্বিজেন নতমুখে স্তব্ধ হয়ে রইল৷

জয়ন্ত বললে, ‘দ্বিজেনবাবু, কিছু লুকোবার চেষ্টা করলে আপনি নিজেই বিপদে পড়বেন, এটা বলে রাখা উচিত মনে করছি৷ একটু চেষ্টা করলেই অন্য উপায়ে আপনার গুপ্তকথা নিশ্চয়ই আমি জানতে পারব৷’

আবার কিছুক্ষণের স্তব্ধতা৷ তারপর নিতান্ত নাচারের মতো দ্বিজেন বললে, ‘ব্যাপারটা একেবারেই ঘরোয়া৷ এর সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের কোনো সম্পর্কই আপনি আবিষ্কার করতে পারবেন না৷’

-‘তবু আমি শুনতে চাই৷’

দ্বিজেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, ‘বেশ, শুনুন৷ সুন্দরবাবুর মুখে মানসীর পরিচয় আপনি নিশ্চয়ই পেয়েছেন?’

-‘হ্যাঁ৷ শুনেছি তিনি সুরূপা আর সুশিক্ষিতা৷’

-‘কিন্তু ও তো তার বাইরের পরিচয়৷ মানসীর মনের পরিচয় পেলে আপনি তাকে দেবী বলে শ্রদ্ধা না করে পারবেন না৷’

-‘বেশ, মানলুম৷’

-‘মানসী আজ দুই বৎসর আমাদের এখানে বাস করছে৷ পিসিমাকে দেখাশোনা করবার সমস্ত ভারই থাকত তার উপরে৷ কিন্তু সত্যকথা বলতে কী, বাড়ির সবাই জানে পিসিমার প্রকৃতি ছিল রুক্ষ, মুখ ছিল অতিশয় তিক্ত৷ অনাথা মানসীকে কেবল আশ্রয় দিয়েই তিনি তাঁর উচ্চমনের পরিচয় দেননি, মানসীর ভবিষ্যতের সম্বলের জন্যে পুরাতন উইলে পঞ্চাশ হাজার টাকাও ব্যবস্থা করেছিলেন৷ কিন্তু তবু তাঁর কটু কথায় রূঢ় ব্যবহারে মানসীকে বড়োই মানসিক অশান্তি ভোগ করতে হত-এমনকী প্রায়ই সে গোপনে না কেঁদেও থাকতে পারত না৷ এ বাড়িতে তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করবার লোকও আর কেউ ছিল না৷ দু-দিনের মধ্যেই সে পিসিমার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, এজন্যে সবাই তাকে হিংসা করত৷ নায়েবমশাইয়ের মতো অমায়িক লোকও নিজের প্রভুত্ব ক্ষুণ্ণ হওয়াতে তার প্রতি বিশেষ সদয় ছিলেন না৷ সে সহানুভূতি পেত কেবল আমার কাছ থেকেই৷ সে নিজের মন খোলবার আর সান্ত্বনার কথা শোনবার সুযোগলাভ করত৷

‘আমারও অবস্থা কল্পনা করতে পারছেন তো? ছেলেবেলাতেই হারিয়েছি পিতা-মাতাকে৷ সংসারে আত্মীয় বলে জেনেছি কেবল পিসিমাকেই৷ কিন্তু তিনি আমাকে ভালোবাসতেন তাঁর নিজের প্রকৃতি অনুসারেই-যা নয় মোহনীয়, নয় সহনীয়৷ কখনো শুনিনি তাঁর মুখ থেকে আদরের কথা৷ আমিও সন্তর্পণে তাঁর কাছ থেকে থাকতাম দূরে দূরে৷ এ সংসারে আমার মনের মানুষ বলতে কেউ ছিল না-আমি সাবালক হয়ে উঠেছি দাসদাসী-কর্ম্মচারীদের প্রতিবেশ প্রভাবের মধ্যেই৷ আমার অভাব-অভিযোগ শুনতেন কেবল নায়েবমশাই৷ তাঁর স্ত্রী সুরবালা দেবীও আমাকে ভালোবাসেন, যত্ন করেন৷ ছেলেবেলায় তাঁর কোলে চড়েছি বলেও স্মরণ হয়৷ কিন্তু তাঁরাও কেউ আমার আত্মীয় নন৷

‘অনাথা মানসী আর অনাদৃত আমি-আমরা দু-জনেই যে পরস্পরের দিকে আকৃষ্ট হব, এটা খুবই স্বাভাবিক৷ আমাদের দু-জনের মন বুঝতুম কেবল আমরা দু-জনেই৷ নিজেদের সুখ-দুঃখ, ভবিষ্যতের আশা-আকাঙ্খা নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করতুম সুবিধা পেলেই৷ ক্রমে আমাদের সম্পর্ক এতটা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল যে আমরা স্থির করলুম, পরস্পরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হব৷ জয়ন্তবাবু, এইখান থেকেই আমাদের দুর্ভাগ্যের সূত্রপাত৷

‘পিসিমার কাছে যেদিন আমাদের মনের ইচ্ছা প্রকাশ করলুম, তিনি বিষম রাগে একেবারে আগুন হয়ে উঠলেন৷ চিৎকার করে বললেন, এ বিবাহ হতে পারে না, হতে পারে না, হতে পারে না!

‘আমি যত বোঝাই, তিনি তত বেঁকে দাঁড়ান৷ এইটেই ছিল তাঁর চিরকেলে স্বভাব-তাঁর সংকল্প থেকে কেউ তাঁকে টলাতে পারত না৷ কেবল তাঁর কেন, আমাদের বংশের প্রত্যেকেই নাকি প্রকাশ করেছেন ওইরকম স্বভাব৷ হয়তো ওটা আমাদেরই রক্তের গুণ বা দোষ৷ কাজেই আমিও বংশ ছাড়া নই৷ পিসিমা যত বেঁকে দাঁড়ান, আমার সংকল্প তত দৃঢ় হয়ে ওঠে৷

‘পিসিমার আপত্তির প্রধান কারণ মানসী অনাথা, গরিব, বংশগৌরব থেকে বঞ্চিত-রাজা নরেন্দ্রনারায়ণের পৌত্রের সঙ্গে তার বিবাহ অসম্ভব৷ সেই সেকেলে যুক্তি-খাপ খায় না যা নব্যযুগের সাম্যবাদের সঙ্গে৷ আমি বললুম, ও যুক্তি আমি মানি না, মানসী ছাড়া আর কারুকে বিবাহ করব না!

‘পিসিমা বললেন, তাহলে তোমাকে আমি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করব৷ আমি বললুম, তাই সই৷ তার কয়েকদিন পরেই পিসিমার মৃত্যু৷

‘জয়ন্তবাবু, আপনি জানতে চেয়েছেন, আমাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে যে নতুন উইল হবার সম্ভাবনা আছে, এটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছিলুম কি না? তা পেরেছিলুম বই কী! পিসিমা ছিলেন ভীষণ একগুঁয়ে মানুষ; যা ধরতেন, তা আর ছাড়তেন না৷ আপনি আর কিছু জানতে চান?’

জয়ন্ত ভাবতে ভাবতে বললে, ‘আপাতত আর কিছু জানতে চাই না৷ হ্যাঁ, একটা কথা৷ মানসী দেবী কি পর্দানশিন মহিলা?’

-‘মানে?’

-‘তিনি কি আমার সঙ্গে দেখা আর বাক্যালাপ করতে পারবেন?’

-‘অনায়াসে৷ কিন্তু মানসীর সঙ্গে আপনার কী দরকার?’

-‘এ প্রশ্নের উত্তর আপনার কাছে না দিলেও চলবে৷’

-‘সে বেচারির সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের কোনোই সম্পর্ক নেই৷’

জয়ন্ত বিরক্ত স্বরে বললে, ‘সে বিচার করব আমি৷ জানেন দ্বিজেনবাবু, গোয়েন্দার প্রথম কর্তব্য হচ্ছে, সকলকেই সন্দেহ করা৷ আপনাদের দাস-দাসী দ্বারবানরা পর্যন্ত সন্দেহ থেকে মুক্ত নয়৷’

দ্বিজেন চেয়ার ত্যাগ করে বললে, ‘বেশ, আপনার যা ইচ্ছা৷ মানসীকে কি এখনি পাঠিয়ে দেব এখানে?’

-‘না৷ আজ আপনার মুখে যা শুনলুম আগে তাই পরিপাক করি৷ মানসী দেবীর সঙ্গে আলাপ করব কাল সকালে৷’

দ্বিজেন নমস্কার করে চলে গেল৷ তার মুখে দুশ্চিন্তার চিহ্ন৷

মানিক বললে, ‘ভাই জয়ন্ত, এতদিনেও সুন্দরবাবু যা করতে পারেননি, তুমি একবেলাতেই তা পেরেছ৷’

-‘কীরকম?’

-‘অন্ধকার ভেদ করে বেশ খানিকটা এগিয়ে যেতে পেরেছ৷’

-‘পেরেছি কি? আমার তো তা মনে হয় না৷ এই তো সবে গৌরচন্দ্রিকা, আসল উপন্যাস এখনও শুরুই হয়নি৷’

‘কিন্তু তুমি একটা মস্ত আবিষ্কার করেছ৷’

-‘কী আবিষ্কার?’

-‘এতদিন হত্যাকাণ্ডটা ছিল উদ্দেশ্যহীন৷ এইবারে উদ্দেশ্যের কিছু কিছু আভাস পাওয়া যাচ্ছে৷’

-‘যথা?’

-‘ঠিক স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারব না৷ তবে সন্দেহ হচ্ছে যেন, ওই নতুন উইলের সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের একটা যোগাযোগ আছে৷’

-‘হয়তো আছে৷ হয়তো নেই৷ আমার পরিকল্পনা এখনও কোনো নির্দিষ্ট আকার পায়নি৷’

-‘মানুষ হিসাবে দ্বিজেন সম্বন্ধে কোনো ধারণা করতে পারলে?’

-‘এক আঁচড়েই মানুষ চেনা যায় না ভাই! মোটামুটি দ্বিজেনকে আমার ভালোই লাগল৷ সরল, উদার, ভদ্র৷ যে স্বীকারোক্তি করলে তার মধ্যে কোনো মারপ্যাঁচ নেই৷ কিন্তু আমি এখন ভাবছি আর একটা কথা৷ ওই জানলাটার পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে গোপনে কে এতক্ষণ আমাদের কথোপকথন শ্রবণ করছিল?’

মানিক সবিস্ময়ে বলে উঠল, ‘তাই নাকি? পুরুষ, না স্ত্রীলোক?’

-‘তা বোঝা গেল না৷ পর্দাটা পুরু আর গাঢ় রঙের৷ কিন্তু বাইরের আলো আর জানলার পর্দার মাঝখানে আমি কোনো মানুষের স্পষ্ট ছায়া দেখেছি৷ দ্বিজেনের প্রস্থানের সঙ্গেসঙ্গেই ছায়াটাও সরে গেল৷ কার কায়া থেকে এই ছায়ার জন্ম? আমি জানতে চাই, আমি জানতে চাই!’

পাঁচ – ছত্রপতির ছোরা

পরদিন৷ প্রভাতী চায়ের আসর৷ জয়ন্ত আছে, মানিক আছে, আর আছেন সুন্দরবাবু আর পবিত্রবাবু৷ দ্বিজেনও হয়তো সেখানে হাজির থাকত, কিন্তু বাড়ির বাইরে গিয়েছে কোনো জরুরি কাজে৷

কথায় কথায় পবিত্রবাবু বললেন, ‘জয়ন্তবাবু, আপনি রাজা নরেন্দ্রনারায়ণের লাইব্রেরি দেখেছেন?’

-‘না৷’

-‘আপনি বই পড়তে ভালোবাসেন?’

-‘অত্যন্ত৷’

-‘রাজার লাইব্রেরিতে অনেক দামি দামি কেতাব আছে৷ মস্ত লাইব্রেরি৷ দেখবেন তো চলুন৷’

-‘চলুন৷’

সুন্দরবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ধেৎ, লাইব্রেরি দেখে লাভ? এখন কেউ যদি খুনিকে দেখাতে পারে তবেই আমি খুশি হই৷’

পবিত্রবাবু হেসে বললেন, ‘খুনিকে দেখাবার ভার তো আপনাদেরই উপরে!’

লাইব্রেরিঘরটা প্রকাণ্ড৷ তার চারিদিকেরই দেওয়ালের অনেকখানি পর্যন্ত ঢেকে দাঁড় করানো আছে সারি সারি আলমারি এবং আলমারির থাকগুলো রোগা আর মোটা কেতাবে কেতাবে ঠাসা৷

জয়ন্ত বইগুলো পরীক্ষা করতে করতে বললে, ‘দেখছি এখানে কোনো হালের বই নেই৷’

পবিত্রবাবু বললেন, ‘রাজার মৃত্যুর সঙ্গেসঙ্গেই লাইব্রেরির জন্যে বই কেনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ সে তো আজকের কথা নয়, আমিই তখন এ বাড়িতে আসিনি৷’

ঘরের মাঝখানে রয়েছে লম্বা একটা কাচের ডালাওয়ালা কাষ্ঠাধার৷ সেইদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে জয়ন্ত শুধোলে, ‘ওটা কী?’

-‘শোকেস৷’

-‘কী আছে ওর মধ্যে?’

-‘সেকেলে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করার শখ ছিল রাজার৷ ওর মধ্যে সেইগুলোই সাজানো আছে৷’

-‘বড়ো চিত্তাকর্ষক সংগ্রহ তো!’ জয়ন্ত কৌতূহলী হয়ে কাষ্ঠাধারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল৷ তারপর হেঁট হয়ে পরীক্ষা করতে লাগল৷

প্রাচীন ও মধ্যযুগের হরেকরকম অস্ত্র, ধনুক, তির, তরবারি, ছোরা-ছুরি, খড়্গ, কুঠার ও বর্ষা প্রভৃতি আরও কত কী! প্রত্যেক অস্ত্রের গায়ে বেরঙা গোলাপি ফিতার সঙ্গে সংলগ্ন এক-একখানা কার্ড-তার উপরে দুই-এক লাইনে লেখা অস্ত্রের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস৷

জয়ন্ত লক্ষ করলে, একজায়গায় ফিতায় সংলগ্ন কার্ডের উপরে লেখা রয়েছে-‘ছত্রপতির ছোরা’, কিন্তু তার সঙ্গে কোনো অস্ত্র নেই৷ সে পবিত্রবাবুর দৃষ্টি সেইদিকে আকৃষ্ট করলে৷

যেন আকাশ থেকে পড়লেন পবিত্রবাবু৷ বিস্ফারিত চক্ষে সবিস্ময়ে বললেন, ‘একী ব্যাপার! বাড়িতে হত্যাকাণ্ডের আগের দিনেও যে ছোরাখানাকে দেখেছি যথাস্থানে! কোথায় গেল সেখানা? কে চুরি করলে?’

জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে, ‘ছত্রপতির ছোরা ব্যাপারটা কী?’

-‘ছত্রপতি শিবাজী নাকি ছোরাখানা ব্যবহার করতেন৷ তাই ওই নাম৷’

এতক্ষণে সুন্দরবাবু জাগ্রত হয়ে উঠলেন৷ বললেন, ‘হুম, হুম! বড়োই সন্দেহজনক, বড়োই সন্দেহজনক! আপনি ঠিক বলছেন, হত্যাকাণ্ডের আগের দিনেও ছোরাখানা, এইখানেই ছিল?’

পবিত্রবাবু বললেন, ‘তাতে আর কোনো সন্দেহই নেই৷ আমার বেশ মনে আছে৷ সৌদামিনী দেবীর হুকুম ছিল, তাঁর পিতার বহু যত্নে সংগ্রহ করা বইগুলি যেন কীটপতঙ্গের অত্যাচারে নষ্ট না হয়ে যায়, বেয়ারাদের সাহায্যে আমি যেন হপ্তায় একবার করে লাইব্রেরিঘর পরিষ্কার করি৷ দেখছেন না, এ-মহলের অন্যান্য ঘরের মতো এ ঘরখানাও দুর্দশাগ্রস্ত নয়?’

-‘হুম! তোমার মত কী জয়ন্ত?’

-‘আমারও ওই মত৷ ছোরা চুরি যাওয়া সন্দেহজনক৷’

-‘সৌদামিনী দেবী মারাও পড়েছেন ছোরার আঘাতেই!’

-‘হ্যাঁ, সুন্দরবাবু৷ বাইরের কোনো চোর এ ছোরা চুরি করেনি৷’

পবিত্রবাবু সভয়ে বলে উঠলেন, ‘আপনারা কী বলছেন, আমি বুঝতে পারছি না৷ এ বাড়িতে সৌদামিনী দেবীকে হত্যা করতে পারে কে? আর কেনই-বা করবে? আমরা যে সকলেই তাঁরই আশ্রিত! যে ডালে বসে সে ডাল কেউ কাটে? না জয়ন্তবাবু, আমাকে ক্ষমা করবেন-আমার মাথা ঘুরছে, আমার পা অবশ হয়ে আসছে, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না, আমি চললুম-আমি চললুম!’ মাতালের মতো টলতে টলতে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন৷

জয়ন্ত করুণভাবে দুই বার মাথা নাড়লে৷ সুন্দরবাবুর মুখও অত্যন্ত গভীর৷

মানিক বললে, ‘এতদিন পরে পাওয়া গেল একটা নিরেট প্রমাণ৷ অপরাধী তাহলে এই বাড়ির ভিতরেই আছে৷ চলো জয়ন্ত, আমাদের ঘরে গিয়ে বসি৷’

ঘরে ফিরে এসে তিন জনেই খানিকক্ষণ বসে রইল বোবার মতো৷

সর্বপ্রথমে কথা কইলেন সুন্দরবাবু৷ বললেন, ‘আমার কী বিশ্বাস জানো জয়ন্ত?’

-‘বলুন৷’

-‘আসল হত্যাকারী বাড়ির লোক না হতেও পারে৷’

-‘এমন কথা কেন বলছেন?’

-‘আসল হত্যাকারী হয়তো বাইরে থেকেই এসেছে, কিন্তু তাকে সাহায্য করেছে বাড়ির কোনো লোক৷’

-‘বুঝেছি৷ আপনি বোধ হয় আসল হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছেন হীরেন্দ্রনারায়ণকেই?’

-‘তা ছাড়া আর কে? সে লোক ভালো নয়৷ হত্যাকাণ্ডের সাত দিন আগে টাকার জন্যে সে সৌদামিনী দেবীর সঙ্গে ঝগড়া করেছিল৷ সে নিরুদ্দেশ হয়ে আছে৷ আমার তো তার উপরেই সন্দেহ হয়৷ বাড়ির কোনো লোক যে কারণেই হোক তাকে সাহায্য করেছে৷ রাত্রে গোপনে দরজা খুলে দিয়েছে৷ অস্ত্র পাওয়া যাবে কোন ঘরে হীরেন তা জানত৷ ছত্রপতির ছোরার দ্বারা কাজ হাসিল করে এখন সে গা-ঢাকা দিয়ে আছে৷’

মানিক বললে, ‘সুন্দরবাবুর অনুমান সঠিক হলে বলতে হবে যে, হীরেন নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মেরেছে৷ সে তখনও আন্দাজ করতে পারেনি যে, সৌদামিনী দেবী তাকেই দান করেছেন সমস্ত সম্পত্তি৷’

জয়ন্ত বললে, ‘সুন্দরবাবুর অনুমান নিতান্ত অসংগত নয়৷’

সুন্দরবাবু উৎসাহিত হয়ে গাত্রোত্থান করে বললেন, ‘তাহলে এখন আমি উঠলুম ভাই৷ দেখা যাক, এই নতুন সূত্রটা ধরে কতদূর অগ্রসর হতে পারি৷’

জয়ন্ত বললে, ‘আর আমরাও দেখি বাড়ির ভিতরে হীরেনের কোনো সহকারীকে আবিষ্কার করিতে পারি কি না৷’

সুন্দরবাবুর প্রস্থান৷ জনৈক ভৃত্যের প্রবেশ৷ সে বললে, ‘বাবুজি, দিদিমণি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান!’

-‘কে দিদিমণি? মানসী দেবী?’

-‘আজ্ঞে৷’

-‘তাঁকে আসতে বলো৷’

ভৃত্যের প্রস্থান৷ অনতিবিলম্বে মানসীর প্রবেশ৷

রূপসী বটে৷ চোখ-ভুরু-নাক যেন সুপটু শিল্পীর লিখন৷ রং যেন গোলাপি স্বপ্ন৷ দেহের গঠন শ্রেষ্ঠ ভাস্করের আদর্শ৷ কে বলবে একে দরিদ্র, অনাথা, বংশগৌরবহীনা? ভাবভঙ্গির ভিতর থেকে ফুটে উঠছে পরম আভিজাত্য! মহিমময়ী!

জয়ন্ত অতটা আশা করেনি৷ তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে বললে, ‘দয়া করে আসন গ্রহণ করুন৷’

মানসী বললে, ‘আমাকে এখানে আসতে বলেছেন?’

জয়ন্ত বাধো বাধো গলায় বললে, ‘ঠিক আপনাকে এখানে আসতে বলিনি৷ আমরাই আপনার কাছে যেতে পারতুম৷ জানেন তো অপ্রীতিকর কর্তব্যপালন করবার জন্যে আমরা এখানে এসেছি? আপনার কাছ থেকে কেবল দু-চারটে কথা জানতে চাই৷’

মানসী ম্লান হেসে বললে, ‘আপনি না ডাকলেও আমাকে কিন্তু আজ আপনার কাছে আসতেই হত৷’

জয়ন্ত বিস্মিত কন্ঠে বললে, ‘কেন?’

-‘সেকথা পরে বলব৷ আমি আগে আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই৷’

ছয় – রুমাল, সায়া, রক্ত

জয়ন্ত বললে, ‘মানসী দেবী, হত্যার রাত্রের কথা আপনি যা জানেন, বলুন৷’

মানসী বললে, ‘আমি যেটুকু জানি সুন্দরবাবুকে সব খুলে বলেছি৷ আপনি কি তা শোনেননি?’

-‘শুনেছি৷ কিন্তু পরের মুখে শোনা আর নিজের কানে শোনা এক কথা নয়৷’

-‘বেশ, শুনুন৷ সৌদামিনী দেবী অন্যান্য দিনের মতন সেদিনও রাত নয়টার সময়ে ঘুমোতে যান৷ তাঁর পাশের ঘরে থাকে উমাতারা, আর তারপরের ঘরখানিতে থাকেন পবিত্রবাবু, আর তাঁর স্ত্রী সুরবালা দেবী৷ কিন্তু সেদিন প্রথম রাত্রে দু-খানা ঘরই খালি ছিল৷ এ পাড়ার কোনো বিয়েবাড়িতে থিয়েটার ছিল, পবিত্রবাবু আর উমাতারা তাই দেখতে গিয়েছিলেন আর সুরবালা দেবী গিয়েছিলেন বাপের বাড়িতে৷

‘মাঝে মাঝে আমাকে অনিদ্রা রোগে ধরে৷ সে রাত্রেও কিছুতেই আমার ঘুম আসছিল না৷ রাত প্রায় এগারোটা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে ছটফট করবার পর উঠে পড়লুম৷ ভাবলুম, ও-মহলের লাইব্রেরিতে গিয়ে খানিকক্ষণ পড়াশোনা করে আসি৷ ঘুম না হলে আমি প্রায়ই তাই করতুম-এটা ছিল আমার অনিদ্রা রোগের চিকিৎসার মতো৷ ঘর থেকে বেরিয়ে ও-মহলের দিকে অগ্রসর হতে হতে দেখি, সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছেন পবিত্রবাবু৷

‘জিজ্ঞাসা করলাম, থিয়েটার ভেঙে গেল? তিনি বললেন, রাত একটার আগে ভাঙবে বলে তো মনে হয় না৷ আমার ভালো লাগল না তাই চলে এলুম, উমাতারা শেষ পর্যন্ত না দেখে ছাড়বে না৷ তুমি যে এখনও ঘুমোওনি? আমি বললুম, অনিদ্রাকে তাড়াবার জন্যে লাইব্রেরিতে যাচ্ছি৷ তিনি আমার অভ্যাস জানতেন৷ একটু হেসে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন৷

‘লাইব্রেরিতে ছিলাম ঘণ্টা খানেক৷ চিকিৎসা ব্যর্থ হল না, ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল৷ ফিরলুম নিজের ঘরের দিকে৷ আসতে আসতে দূর থেকেই মনে হল, এ-মহলের বারান্দা দিয়ে ছায়ামূর্তির মতো কী যেন একটা স্যাঁৎ করে চলে গেল৷ কিন্তু কাছে এসে কারুকেই দেখতে পেলুম না৷ ভাবলুম আমারই চোখের ভ্রম৷

‘দ্বিজেনবাবুর ঘরের কাছ পর্যন্ত আসতেই ঘরের ভিতর থেকে তিনি বললেন, কে যায়? আমি সাড়া দিলাম৷ তিনি বললেন, এত রাতে তুমি বাইরে! বললাম, অনিদ্রা ব্যাধির ওষুধ খোঁজবার জন্যে লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম৷ তিনি হেসে উঠে বললেন, ওষুধ পেলে? আমি বললাম, পেয়েছি৷ আমার ঘুম এসেছে৷ তিনি বললেন, তাহলে তাড়াতাড়ি ঘরে যাও৷ আর পারো তো ঘুমকে বলে দিয়ো সে যেন আমার কাছেও আসে৷ কারণ আমারও তোমার দশা৷ তারপর আমি ঘরে এসেই ঘুমিয়ে পড়লুম৷ সে রাত্রের আর কোনো কথাই আমি জানি না৷’

জয়ন্ত খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, ‘সৌদামিনী দেবীর সঙ্গে আপনার কীরকম সম্পর্ক?’

-‘সম্পর্ক একটা ছিল, তবে নামমাত্র৷ কিন্তু তাঁর পক্ষে যতটা সম্ভবপর, তিনি আমাকে ভালোবাসতেন৷ অবশ্য তার কারণও ছিল৷ আমার মতন একটি লোক না হলে তাঁর চলত না৷ আমার আগেও আরও কয়েকজনকে তিনি সঙ্গিনীরূপে থাকবার জন্যে নিযুক্ত করেছিলেন বটে, কিন্তু তারা কেউ তাঁকে দু-তিন মাসের বেশি সহ্য করতে পারেনি৷ আমি যে তা পেরেছি তার প্রধান কারণ হচ্ছে, সহ্য করা ছাড়া আমার আর অন্য উপায় ছিল না, আমি অনাথা৷ তবু তিনি যে একসময়ে আমার জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যবস্থা করেছিলেন, তা থেকেই প্রমাণিত হয় মনে মনে তিনি অসাড় ছিলেন না৷ কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যক্রমে পরে তাঁর দান থেকে আমি হয়েছি বঞ্চিত৷ তার কারণও আপনি দ্বিজেনবাবুর মুখেই শুনেছেন৷’

-‘দেখুন মানসী দেবী, আমরা এমন প্রমাণ পেয়েছি যার উপরে নির্ভর করে বলা চলে যে, হত্যাকারী বা তার সহকারী আছে এই বাড়ির ভিতরেই৷ এ সম্বন্ধে আপনার কোনো মতামত আছে?’

মানসীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল৷ থেমে থেমে বললে, ‘আমার মতামত? আমার কী মতামত থাকতে পারে? এসব আমার ধারণাতেও আসে না৷ এ বাড়িতে এমন ভয়ানক মানুষ কেউ আছে বলে আমি বিশ্বাসই করি না৷’

জয়ন্ত বললে, ‘দ্বিজেনবাবু কীরকম লোক?’

মানসীর দুই ভুরু সংকুচিত হল-কেঁপে উঠল তার ওষ্ঠাধর৷ অভিভূত কন্ঠে সে বললে, ‘আপনারা কি তাকেই সন্দেহ করেন?’

-‘যদি বলি করি?’

-‘তাহলে মস্ত ভ্রম করবেন৷’

-‘কেন?’

-‘দ্বিজেনবাবু হচ্ছেন দেবতা৷’

-‘হ্যাঁ, আপনার কাছে৷’

-‘না, যাকে জিজ্ঞাসা করবেন সেই-ই ওই কথা বলবে৷ প্রাণীহত্যার বিরোধী বলে তিনি আমিষ পর্যন্ত খেতে পারেন না৷ তিনি করবেন নরহত্যা৷ এমন কথা শুনলেও পাপ হয়৷ আপনার আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?’

-‘না৷ কিন্তু বললেন যে, আমি না ডাকলেও আপনাকে আজ আমার কাছে আসতে হত৷ কেন?’

-‘আজ এমন একটা ব্যাপার হয়েছে যার কোনো অর্থই আমি খুঁজে পাচ্ছি না৷’

-‘ব্যাপারটা কী?’

-‘আমার ঘরে একটা দেওয়াল আলমারি আছে৷ তার ভিতরে আটপৌরে কাপড়চোপড় রাখি৷ আজ সকালে খানকয় কাপড়ের ভিতর থেকে এই রুমালখানা পেয়েছি৷’ মানসী একখানা রুমাল বার করে এগিয়ে ধরলে৷

জয়ন্ত রুমালখানা নিয়ে তার উপরে চোখ বুলিয়েই সোজা হয়ে উঠে বসল৷ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে বললে, ‘মানিক, অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক রুমাল!’

মানিক হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করলে রুমালখানা৷ বললে, ‘এর উপরে যে রক্তের দাগ আছে!’

-‘হুঁ, কয়েকটা রক্তের ছোপ আর একটা আঙুলের ছাপ৷’

মানসী চিন্তিতভাবে বললে, ‘এখন বলুন জয়ন্তবাবু, আমার জামাকাপড়ের আলমারিতে ওই রক্তমাখা রুমালখানা কোত্থেকে এল? ও রুমাল তো আমার নয়!’

-‘রুমালের কোনে ওই ধোপার চিহ্ন?’

-‘ও চিহ্ন আমাদেরই ধোপার৷’

-‘তাহলে এখানা বাড়ির কোনো লোকেরই সম্পত্তি৷ কিন্তু এর মালিক যে কে, সেটা বিশেষ করে বোঝবার উপায়ই নেই৷ এরকম সাধারণ রুমাল রাম-শ্যাম সবাই ব্যবহার করে৷’

মানিক বললে, ‘কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাম-শ্যামের রুমাল নিজে মানসী দেবীর আলমারির ভিতরে বেড়াতে আসেনি, কে ওখানা রাখতে পারে ওখানে?’

জয়ন্ত বললে, ‘তারপরের প্রশ্ন, কেনই বা ওখানে রাখবে?’

মানিক বললে, ‘আরও একটা প্রশ্ন, রুমালখানা রক্তাক্ত কেন?’

জয়ন্ত বললে, ‘আচ্ছা, পরে এসব প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করলেও চলবে৷ আপাতত এই অদ্ভুত আবিষ্কারের জন্যে মানসী দেবীকে ধন্যবাদ দিচ্ছি৷ কে বলতে পারে ভবিষ্যতে এই রুমালখানাই আমাদের মামলার একটা প্রধান সূত্র হয়ে উঠবে না?’

মানসী সভয়ে বলে উঠল, ‘আপনি কী বলছেন! আপনি কি বলতে চান সৌদামিনী দেবীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই রুমালের কোনো সম্পর্ক আছে?’

-‘থাকা অসম্ভব নয়৷’

-‘কেউ কি আমাকে বিপদে ফেলবার জন্যে ওখানা আমার আলমারির ভিতরে রেখে গিয়েছে?’

-‘তাও অসম্ভব নয়৷’

-‘তবে আমি কী করব?’

-‘আপনি কিছুই করবেন না, একেবারে চুপ মেরে যান৷ রুমালখানা কখনো যে চোখেও দেখেছেন সে কথা পর্যন্ত ভুলে যান৷’

-‘আর কারুকে ওর কথা বলব না?’

-‘কারুকে না, কারুকে না৷ এমনকী দ্বিজেনবাবুকেও না৷’

-‘তাঁর কোনো বিপদ হবে না তো?’

-‘মনে তো হয় না৷ আমি লক্ষ করে দেখেছি তিনি ব্যবহার করেন রঙিন রুমাল৷’

-‘হ্যাঁ জয়ন্তবাবু; তিনি বরাবরই রঙিন রুমাল ব্যবহার করে থাকেন৷’

-‘তাহলে এইখানেই সাঙ্গ হোক রুমাল পর্ব৷ এইবারে মানসী দেবী, ভালো করে মনে করে দেখুন দেখি হত্যাকাণ্ডের পর আপনার ঘরে কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে কি না?’

-‘না৷’

-‘মনে করে দেখুন, মনে করে দেখুন৷ ঘটনা যতই তুচ্ছ হোক আমার কাজে লাগতে পারে৷’

অল্পক্ষণ নীরবে ভাবতে ভাবতে মানসীর দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ সে বললে, ‘আপনার কথায় আর একটা ছোটো ব্যাপার মনে পড়ছে৷ হত্যাকাণ্ডের পরের দিন সকাল বেলায় ওই জামাকাপড়ের আলমারির ঠিক তলাতেই মেঝের উপরে দেখেছিলুম তিন ফোঁটা রক্ত!’

-‘তিন ফোঁটা রক্ত?’

-‘হ্যাঁ, ঠিক তিন ফোঁটা৷’

-‘তারপর?’

-‘কিন্তু সেজন্যে আমি বিস্মিত হইনি৷ আমার বিশ্বাস, কোনো আহত ইঁদুর কি বিড়ালের গা থেকেই সেই রক্তবিন্দুর সৃষ্টি হয়েছিল৷ তাই আমি জল ঢেলে দাগগুলো তুলে ফেলেছিলুম৷ ওই তিন ফোঁটা রক্তের কথা নিশ্চয়ই আপনার কাজে লাগবে না জয়ন্তবাবু!’

-‘নিশ্চয়ই লাগবে! তিন ফোঁটা কেন, মাত্র এক ফোঁটা রক্তই আমার কাছে মহামূল্যবান! আলমারির ভিতরে রক্তাক্ত রুমাল, আলমারির বাইরে তিন ফোঁটা রক্ত! এই দুই রক্তচিহ্নের মধ্যে কি যোগাযোগ নেই? থাকা উচিত, থাকা উচিত!’

মানসী অস্বস্তি ভরা কন্ঠে বললে, ‘আপনার সব কথাই হেঁয়ালি বলে মনে হচ্ছে!’

-‘হোক৷ তা নিয়ে আপনি একটুও মাথা ঘামাবেন না মানসী দেবী৷ আপনি কেবল মাথা ঘামিয়ে দেখুন, আর কোনো তুচ্ছ ঘটনার কথা আমাকে বলতে পারেন কি না!’

-‘উঁহু, আর কিছুই ঘটেনি৷’

-‘ভাবুন, ভাবুন, ভাবুন!’

-‘না জয়ন্তবাবু৷ . . . হ্যাঁ, একটা ব্যাপার . . . না, না, সেটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপার৷’

-‘তবু আমি শুনতে চাই৷’

-‘আমার একটা সায়া খুঁজে পাচ্ছি না৷’

-‘সায়াটা কোথায় রেখেছিলেন?’

-‘ঘরের আলনায়৷’

-‘কবে রেখেছিলেন?’

-‘হত্যাকাণ্ডের দিনে৷ বৈকালে৷’

-‘কবে খুঁজেছিলেন?’

-‘হত্যাকাণ্ডের পরের দিনেই৷’

-‘সকালে না বিকালে?’

-‘সকালে৷’

-‘তাহলে হত্যাকাণ্ডের দিন বৈকাল থেকে রাত্রের মধ্যেই সায়াটা আপনার ঘর থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে?’

-‘আপনি দেখিয়ে দিলেন বলেই তাইতো এখন মনে হচ্ছে! বাড়িতে যে ভীষণ ঘটনা ঘটেছে, সায়াটার কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলুম৷’

-‘আর কোনো তুচ্ছ ঘটনার কথা আপনার মনে পড়ছে?’

মিনিট তিন ভেবে-চিন্তে মানসী নিশ্চিন্তভাবে বললে, ‘না, আর কিছুই ঘটেনি৷’

-‘বেশ, আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই৷ নমস্কার৷’

মানসী চলে গেলে পর জয়ন্ত চুপ করে বসে বসে কী ভাবলে৷ তারপর বললে, ‘মানসী দেবীর ঘরে যেসব ছোটো ছোটো তুচ্ছ ঘটনা ঘটেছে, স্থানকালপাত্র হিসাবে সেগুলো কতখানি বিস্ময়কর, ভালো করে ভেবে দেখো মানিক৷ ঠিক হত্যাকাণ্ডের সময়ে বা তার কিছু আগে কি কিছু পরে মানসীর ঘর থেকে হারিয়েছে একটা সায়া, ঘরের আলমারির তলায় পাওয়া গিয়েছে রক্তের দাগ আর হয়তো সেই সময়েই আলমারির ভিতরেও ঢুকেছে একখানা রক্তাক্ত রুমাল৷ আপাতত এগুলো অর্থহীন বলে বোধ হচ্ছে বটে৷ কিন্তু কিছু কিছু অর্থের সন্ধানও যেন এখনি পাওয়া যায়৷ মানসীর অজ্ঞাতসারেই খুব সম্ভব হত্যাকাণ্ডের রাত্রেই তার ঘরের ভিতরে একজন বাইরের লোকের আবির্ভাব হয়েছিল৷ প্রশ্ন-কে সে? শত্রু না মিত্র না হত্যাকারী? যেই-ই হোক, সে চুরি করেছে অসামান্য কিছু নয়-সামান্য একটা সায়া মাত্র৷ প্রশ্ন-কেন? স্ত্রীলোকের একটা সায়া তার কোন কাজে লাগতে পারে? অথবা সায়াটা বিশেষ করে মানসীর বলেই তার কাছে কি মূল্যবান? সায়াটা গেল কোথায়? অদূর ভবিষ্যতে বিশেষ কোনো কার্যসাধনের জন্যে সায়াটা কি আবার আমাদের দৃষ্টিগোচর হবে? মানসীর ঘরের ওই রক্তের দাগ৷ প্রশ্ন-কার সে রক্ত? সৌদামিনী দেবীর, না যে ঘরের মধ্যে অনধিকারপ্রবেশ করেছে তার নিজের? যারই হোক, এটা বোঝা যাচ্ছে যে, আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে সে একটা কিছু করছিল৷ প্রশ্ন-কী করছিল? রক্তাক্ত রুমালখানা স্থাপন করছিল আলমারির ভিতরে? কেন, কেন, কেন? নিজের রক্তাক্ত রুমাল মানসীর আলমারির ভিতরে রাখলে তার কী উপকার বা মানসীর কী অপকার হবার সম্ভাবনা? পাগলাগারদের বাসিন্দার মন বোঝবার চেষ্টার মতো এই শেষ প্রশ্নটার অর্থ অনুধাবন করবার চেষ্টাও হবে সমান দুশ্চেষ্টা!’ বলতে বলতে হঠাৎ থেমে পড়ে হঠাৎ আবার চিৎকার করে জয়ন্ত উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠল-‘হয়েছে, হয়েছে!’

মানিক সবিস্ময়ে বললে, ‘খেপে গেলে নাকি? কী হয়েছে হে?’

-‘আলমারির ভিতরে সে হস্তচালনা করেছিল মানসীর কোনো অনিষ্টসাধনের জন্যেই!’

-‘রক্তাক্ত রুমালখানা ওখানে রাখার কারণ কি তাই?’

-‘নিশ্চয়ই নয়! তার রক্তাক্ত রুমাল তো মানসীর বিরুদ্ধে না লেগে তার নিজের বিরুদ্ধেই কাজে লাগবে৷ রুমালখানা আলমারির ভিতরে পড়ে গিয়েছিল তার অজ্ঞাতসারেই৷ এ ছাড়া ও রুমালের কোনো মানেই হয় না!’

-‘কিন্তু জয়ন্ত, আলমারির মধ্যে মানসীর পক্ষে অনিষ্টকারক কিছু পাওয়া গিয়েছে কি?’

-‘কেন যে পাওয়া যায়নি সেইটেই তো বুঝতে পারছি না৷ কিন্তু বুঝব, বুঝব, শীঘ্র তাও বুঝব! মানিক হে৷ জল বেশ ফুটে উঠেছে, ভাত সিদ্ধ হতে আর বিলম্ব হবে না!’

সাত – দ্বিজেনের সৌভাগ্য

আসন্ন সন্ধ্যা৷ বাগানে আলো-আঁধারির খেলা৷ বড়ো বড়ো গাছের বুকের ভিতর থেকে ভেসে আসছে পাখিদের বেলাশেষের কলরব৷ আজকে চাঁদের ছুটির দিন৷ একটু পরেই অমামসী পাতবে অন্ধকারের আসর৷

গোল টেবিলের ধারে বসে পবিত্রবাবুর সঙ্গে জয়ন্ত খেলছে দাবা বোড়ে৷ মানিক হচ্ছে নির্বাক দর্শক৷ উপর-চাল বলে দেবার উপায় নেই, কারণ তাহলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে জয়ন্ত৷

এক বার, দুই বার, তিন বার জয়ন্ত করলে কিস্তিমাত৷ বললে, ‘আমি একাসনে বসে চব্বিশ ঘণ্টা দাবা খেলতে পারি৷ কিন্তু আপনার কি আর খেলবার শখ আছে?’

-‘আপত্তি নেই৷’ বললেন পবিত্রবাবু৷

আবার ঘুঁটি সাজানো হল৷ পবিত্রবাবু প্রথম চাল চালতে যাচ্ছেন, এমন সময়ে দ্বিজেনের প্রবেশ৷

জয়ন্ত স্মিত মুখে বললে, ‘আসুন দ্বিজেনবাবু৷ বসুন৷ দাবার ছকের উপরে আমাদের দু-জনের যুদ্ধ দর্শন করুন৷ . . . কিন্তু না, আপনার মুখের ভাব তো ক্রীড়াকৌতুক দেখবার মতো নয়! হয়েছে কী?’

দ্বিজেন বললে, ‘আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে৷’

-‘গোপনে?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘পবিত্রবাবু তাহলে আজ আর যুদ্ধ নয়, আপাতত সন্ধি! আপনি নাহয় মানিকের সঙ্গে বাগানে গিয়ে বেড়াতে বেড়াতে খানিকটা গল্প করে আসুন৷’

মানিক ও পবিত্রবাবুর প্রস্থান৷

-‘তারপর দ্বিজেনবাবু? এইবারে আপনি নির্ভয়ে কথার ঝুলি ঝাড়তে পারেন৷’

-‘আজ দু-টি খবর শুনবেন জয়ন্তবাবু৷ একটি শুভ আর একটি অশুভ৷’

বাগানের দিকের বারান্দার উপরে ছিল তিনটে জানলা, একটা দরজা৷ একটিমাত্র জানলা খোলা ছিল৷ সেই জানলাটার দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত উঠে দাঁড়াল৷ টেবিলের উপর থেকে একটা পাউডারের কৌটো তুলে নিয়ে বললে, ‘একটু সবুর করুন দ্বিজেনবাবু, আমি এক মিনিটের মধ্যেই আসছি৷’ সে দরজা দিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে গেল৷

মিনিট দেড়েক পরে ঘরে এসে আসন গ্রহণ করে জয়ন্ত বললে, ‘আগে শুভ খবরটা কী শুনি৷’

-‘আমিই আবার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছি৷’

জয়ন্ত চমৎকৃত হয়ে বললে, ‘কেমন করে?’

-‘জ্যাঠামশাই মারা গিয়েছেন৷’

-‘হীরেন্দ্রনারায়ণ রায়?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘হঠাৎ?’

-‘হ্যাঁ, হার্টফেল করে৷’

-‘কোথায়?’

-‘এলাহাবাদে৷’

-‘কিন্তু আইনত সম্পত্তির অধিকারী তিনি৷ কোনো উইল করে আপনাকে সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছেন?’

-‘না, তিনি সম্পত্তির অধিকারীই হননি৷’

-‘কীরকম?’

-‘পিসিমার নুতন উইল হবার আগেই তিনি মারা পড়েছেন৷ কলকাতা থেকে কোনো কাজে তিনি পশ্চিমে যাচ্ছিলেন৷ ট্রেন যখন এলাহাবাদ স্টেশনে পৌঁছোয়, সেই সময়ে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা পড়েন৷

-‘এ খবর আপনি কবে পেয়েছেন?’

-‘সবে আজকেই৷’

-‘তাঁর দেহ সনাক্ত করতে দেরি হয়৷ পুলিশ অনেক সন্ধান নেবার পর জানতে পারে, তিনি আমাদের আত্মীয়৷’

-‘বুঝলুম৷ সুসংবাদ বটে কিন্তু তবু আপনার মুখে আনন্দের লক্ষণ নেই কেন? জ্যাঠামশাইকে আপনি কি খুব ভালোবাসতেন?’

-‘ভালোবাসার পথ তিনি রাখেননি৷ আমার কাছে তিনি ছিলেন প্রায় অপরিচিতের মতো৷ আমি পিসিমার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বলে আমাকে তিনি দারুণ ঘৃণা করতেন৷ আমার সঙ্গে বাক্যালাপ পর্যন্ত করতেন না৷ কেবল আমি নই, এ বাড়ির সকলেই ছিল তাঁর চক্ষুশূল৷ তিনি সম্পত্তির মালিক হলে এখানকার সকলকেই বিদায় নিতে হত৷ তাঁর মৃত্যুতে আমি আঘাত পাইনি৷ অবশ্য মৃত্যু মাত্রই দুঃখজনক, কিন্তু আত্মীয়বিয়োগে লোকে যেমন ব্যথা পায়, তাঁর মৃত্যুতে তেমন কোনো ব্যথা আমি অনুভব করিনি৷’

-‘তবে আপনার মুখ অমন বিরস কেন?’

দ্বিজেন ঘাড় হেঁট করে নীরবে বসে রইল কিছুক্ষণ৷ তারপর মুখ তুলে করুণ স্বরে বললে, ‘কিন্তু জয়ন্তবাবু, আমি বোধ হয় সম্পত্তি ভোগ করবার কোনো সুযোগই পাব না৷’

জয়ন্ত চমকে উঠে বললে, ‘সেকী!’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ আমি হতভাগ্য৷’

-‘এ আত্মলাঞ্ছনার অর্থ কী?’

-‘বলছি৷ কিন্তু তার আগে জিজ্ঞাসা করি, হত্যাকারীর কোনো সন্ধান আপনি পেয়েছেন কি?’

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জয়ন্ত বললে, ‘ঃউ, বড্ড গুমোট মনে হচ্ছে! দাঁড়ান, জানলার পর্দাটা খুলে দিয়ে আসি, ঘরের ভিতরে বাইরের বাতাস চলাফেরা করুক৷’

পর্দাটা টেনে সরিয়ে দিয়ে সে ফিরে এসে বললে, ‘হ্যাঁ, কী বলছেন দ্বিজেনবাবু? খুনির সন্ধান আমরা পেয়েছি কি না? হ্যাঁ, আমরা জানি যে খুনি সে এই বাড়িরই লোক৷’

-‘অসম্ভব, খুনিকে আপনারা জানেন না!’

-‘হঠাৎ অতটা নিশ্চিত হচ্ছেন কেন দ্বিজেনবাবু? খুনির আরও কোনো কীর্তির পরিচয় আমরা পেয়েছি৷’

-‘কীরকম কীর্তি?’

-‘আমরা জানি যে এখানকার হত্যাকাণ্ডের পরের দিন সকালে মানসী দেবীর ঘরের মেঝেতে রক্তের দাগ পাওয়া যায়৷’

দ্বিজেন বিকৃত স্বরে বললে, ‘হতেই পারে না, হতেই পারে না!’

-‘মানসী দেবী নিজেই এ কথা আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন৷’

-‘মানসী মিথ্যেকথা বলেছে৷’

-‘কেন তিনি মিথ্যেকথা বলবেন?’

-‘তা আমি জানি না৷ কিন্তু সে মিথ্যেকথা বলেছে৷ বেশ, আপনারা কী জানেন, বা জানেন বলে মনে করেন?’

-‘খুনি কোন অস্ত্র ব্যবহার করেছে তাও আমাদের অজানা নেই৷’

দ্বিজেন হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কোন অস্ত্র?’

-‘ছত্রপতির ছোরা৷’

-‘এই নিন ছত্রপতির ছোরা!’ দ্বিজেন একখানা কোষবদ্ধ ছোরা টেবিলের উপরে স্থাপন করলে৷

আট – হত্যাকারীর স্বীকারোক্তি

জয়ন্ত টেবিলের উপর থেকে ছোরাখানা তুলে নিলে এবং ভাবহীন মৌনমুখে পরীক্ষা করতে লাগল৷

খাপ রৌপ্যখচিত চামড়ায় তৈরি৷ ছোরার হাতল হাতির দাঁতের, তার উপরে মূল্যবান পাথর-বসানো সোনার কাজ৷ ফলা নীল ইস্পাতের, সাত ইঞ্চি লম্বা৷ ফলার উপরে শুকনো রক্তের দাগ৷

ছোরাখানা আবার কোষবদ্ধ করে টেবিলের উপরে রেখে দিয়ে জয়ন্ত বেশ সহজ স্বরেই জিজ্ঞাসা করলে, ‘ছোরাখানা কোথায় পেলেন?’

-‘ঠাকুরদাদার লাইব্রেরি থেকে৷’

-‘এতদিন এখানা কোথায় ছিল?’

-‘আমার কাছে৷’

-‘তারপর?’

-‘তারপর আর বিশেষ কিছু বলবার নেই৷ ওই ছোরা দিয়ে আমি পিসিমাকে খুন করেছি৷’

পূর্ণ এক মিনিটকাল ধরে জয়ন্ত নীরবে দ্বিজেনের মুখের পানে তাকিয়ে রইল মর্মভেদী দৃষ্টিতে-যেন সে তার মনের সমস্ত গুপ্তকাহিনি বাইরে আকর্ষণ করে আনতে চায়৷ তারপর নীরস হাস্য করে বললে, ‘কেন এ পাপ করলেন?’

দ্বিজেন উত্তেজিত কন্ঠে বললে, ‘করব না? কেন করব না? পিসিমা কি আমার মুখ তাকিয়েছিলেন? তিনি আমাকে পথের ভিখারি করতে চেয়েছিলেন বিনা অপরাধে! কেবল আমাকে নয়, মানসীকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দান করে আবার তা কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন৷ কেন আমি হাত-পা গুটিয়ে এসব অত্যাচার সহ্য করব? কোনো মানুষই তা পারে না৷ পিসিমা বৃদ্ধা, বিধবা, সন্তানহীনা৷ পৃথিবীর পক্ষে একেবারে ব্যর্থজীব৷ তাঁকে ইহলোক থেকে সরিয়ে দিলে পৃথিবীর কোনো অপকারই হবে না৷ আমাদের তরুণ জীবনকে সার্থক করে তোলবার জন্যে তাঁকে হত্যা করা ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না৷ অবশ্য যদি তখন জানতুম যে তার আগেই নতুন উইল হয়ে গেছে, তাহলে বোধ হয় অকারণে হত্যা করে আমার হাত করতুম না কলঙ্কিত৷ কিন্তু তখন আমি তা জানতুম না-আমি তা জানতুম না!’

জয়ন্ত অবিচলিতভাবে বললে, ‘দ্বিজেনবাবু, আপনার কথাগুলি বেশ যুক্তিপূর্ণ৷’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ আমি হত্যা করেছি বটে, কিন্তু যুক্তিহীন হত্যা করিনি৷’

-‘এখন কী করবেন?’

-‘আপনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করব৷’

-‘তার কী ফল হবে জানেন?’

-‘জানি৷ ফাঁসি৷’

-‘ওই কি আপনার কামনা?’

-‘দোষ স্বীকারের পর কোন খুনি জীবনের আশা করে?’

-‘আপনার মৃত্যুর পর মানসী দেবীর কী অবস্থা হবে সেটাও ভেবে দেখেছেন বোধ হয়?’

অন্তরের মধ্যে যেন চরম আঘাত পেয়ে দ্বিজেন শিউরে উঠল৷ ভগ্নস্বরে বললে, ‘সে কথা ভাবলেও আমি পাগল হয়ে যাব৷’

-‘মানসী দেবী এ কথা শুনলে কী বলবেন?’

-‘আত্মহত্যা করবে৷’

-‘তবে?’

-‘দোহাই জয়ন্তবাবু, এখন আর মানসীর কথা আমাকে মনে করিয়ে দেবেন না৷ আমি তাকে একেবারে ভুলে যেতে চাই!’

-‘ভোলা কি এতই সহজ?’

-‘না, সহজ নয়৷ কিন্তু তা ছাড়া উপায় কী?’

-‘কোনো উপায়ই কি নেই?’

-‘কোনো উপায় নেই, কোনো উপায় নেই! . . . না, না, এক উপায় আছে বটে! কিন্তু, কিন্তু তা অসম্ভব৷’

-‘কী অসম্ভব দ্বিজেনবাবু?’

-‘আপনি কি আমাকে মুক্তি দিতে রাজি আছেন?’

-‘অপরাধ স্বীকারের পরেও আপনি আমার কাছ থেকে মুক্তি প্রার্থনা করছেন!’

-‘নিজের জন্যে করছি না, মানসীর জন্যে করছি, আমার মরা-বাঁচার উপরেই তার মরা-বাঁচা নির্ভর করছে জয়ন্তবাবু!’

-‘সব বুঝি৷ কিন্তু কী করে আমি আপনাকে মুক্তি দিতে পারি?’

-‘আপনি সরকারি গোয়েন্দা নন৷ আমি অনুভব করতে পারছি, আমার উপরে আপনার সহানুভূতি আছে৷’

-‘কিন্তু কী করে আপনাকে মুক্তি দেব তাই বলুন৷’

-‘আপনি ছাড়া আর কেউ জানে না, আমি খুনি৷’

-‘তা জানে না বটে৷ কিন্তু পুলিশকে ওই কথা জানানোই হচ্ছে আমার কর্তব্য৷’

-‘পুলিশের শক্তিতে আমার আস্থা নেই৷ আপনি যদি মামলার ভার ত্যাগ করেন, তাহলে আমি নিশ্চয়ই রক্ষা পাব৷’

-‘কিন্তু অক্ষম বলে আমার দুর্নাম হবে৷’

-‘যেটুকু দুর্নাম হবে, তার বিনিময়ে আপনি কিছু লাভ করতেও পারেন৷’

-‘কী লাভ?’

-‘অর্থ৷’

-‘তার মানে?’

-‘জয়ন্তবাবু, ভেবে দেখুন৷ দু-দিন পরেই আমি বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হব৷ আপনি যদি এই মামলাটা ছেড়ে দেন তাহলে কোনদিক দিয়ে লাভবান হবেন, বুঝতে পারছেন?’

-‘আপনি আমাকে ঘুষ দিতে চান!’

-‘ঘুষ নয় জয়ন্তবাবু, আমার কৃতজ্ঞতার দান৷’

-‘উত্তম৷ কত টাকা আপনি দিতে পারেন?’

-‘আপনিই বলুন৷’

-‘পাঁচ হাজার টাকা?’

-‘আরও বাড়িয়ে বলুন৷’

-‘দশ হাজার টাকা?’

-‘তাও উল্লেখযোগ্য হল না৷’

-‘পনেরো হাজার টাকা?’

-‘না৷’

-‘আমি আপনাকে পঁচিশ হাজার টাকা দিতে পারি-যদিও আমার জীবনের দাম আরও ঢের বেশি হওয়া উচিত৷’

-‘টাকাটা কবে দেবেন?’

-‘তারিখ না দিয়ে আজকেই আমি চেক লিখে দিচ্ছি৷ সম্পত্তি হাতে এলেই আপনার টাকা পাবেন৷’

-‘তাই সই৷ লিখুন চেক৷’

দ্বিজেন হেঁট হয়ে চেক লিখতে বসল৷ জয়ন্ত হাসলে মুখ টেপা হাসি৷

-‘আপনি আমাকে বাঁচালেন জয়ন্তবাবু৷ চেকখানা গ্রহণ করুন৷ এতক্ষণ চোখে অন্ধকার দেখছিলুম৷’

-‘এইবারে চোখে আলো দেখতে পেয়েছেন শুনে সুখী হলুম৷ অঃতপর প্রথমেই আপনাকে একটি কাজ করতে হবে৷’

-‘আজ্ঞা করুন৷’

-‘ছত্রপতির ছোরাখানা আবার যথাস্থানে রেখে আসুন৷’

-‘এখনি রেখে আসছি৷ নমস্কার৷’

-‘নমস্কার৷’

নয় – ঘুষখোর জয়ন্ত

দ্বিজেনের প্রস্থানের পর জয়ন্ত মিনিট পাঁচেক চুপ করে বসে রইল৷ তারপর উচ্চকন্ঠে ডাক দিলে, ‘মানিক!’

পাশের ঘর থেকে সাড়া এল, ‘আসছি৷’

অনতিবিলম্বে মানিকের সঙ্গে সুন্দরবাবুর প্রবেশ৷

জয়ন্ত বললে, ‘এই যে সুন্দরবাবু৷ কতক্ষণ?’

‘বেশ খানিকক্ষণ৷ মানিকের মুখে শুনলুম দ্বিজেনের সঙ্গে তোমার নাকি গোপন পরামর্শ চলছিল?’

-‘ঠিক পরামর্শ নয় সুন্দরবাবু, খুনি নিজের মুখে দোষ স্বীকার করে গেল৷’

সুন্দরবাবু চমকে উঠে বললেন, ‘খুনি! কে খুনি?’

-‘দ্বিজেন৷’

-‘দ্বিজেন খুনি!’

-‘তাই তো সে বলে গেল৷’

-‘আর তাকে তুমি ছেড়ে দিলে?’

-‘তা দিলুম বই কী!’

-‘দিলুম বললেই হল? রোসো, দেখছি তাকে!’

সুন্দরবাবু প্রস্থানোদ্যত৷

-‘আরে মশাই, শ্রবণ করুন, শনৈঃ পন্থাঃ শনৈঃ কন্থাঃ শনৈঃ পর্ব্বতলঙ্ঘনম! ধীরে দাদা, ধীরে!’

-‘না, না, ধীরে-টিরে নয়, আমার এখন বেগে ধাবমান হওয়া উচিত দ্বিজেনের দিকে৷’

-‘আমি কারুকেই দ্বিজেনকে গ্রেপ্তার করতে দেব না৷’

-‘দেবে না কীরকম?’

-‘সে আমাকে কী দিয়েছে দেখুন৷’

-‘চেক?’

-‘হ্যাঁ, পঁচিশ হাজার টাকার চেক৷’

-‘হুম, ঘুষ!’

-‘ঠিক তাই৷’

-‘হুম, হুম, হুম! মানিক, তোমার বন্ধুর কী অঃধপতন হয়েছে দেখো৷’

মানিকের মুখের উপরে ফুটে উঠল দারুণ অভিযোগের ভাব৷

জয়ন্ত হাসতে হাসতে বললে, ‘যা মন্দার বাজার পড়েছে, লোভ সামলাতে পারলুম না ভাই!’

মানিক প্রায় অবরুদ্ধ কন্ঠে বললে, ‘জয়ন্ত তোমার মৃত্যুই শ্রেয়৷’

সুন্দরবাবু ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ‘পোড়ার মুখে হাসতে লজ্জা করছে না তোমার?’

-‘আগে আমার সব কথা শুনুন৷ তারপর বিচার করুন আমার হাসা উচিত কি না!’

-‘যা বলবার বলো৷ কিন্তু জেনে রেখো, তোমার সব কথা শোনবার পরও দ্বিজেনকে আমি গ্রেপ্তার না করে ছাড়ব না৷’

মানিক বললে, ‘আমারও ওই মত৷’

জয়ন্ত বললে, ‘ছিঃ বন্ধু, তুমিও শত্রু-শিবিরে?’

-‘আমি ঘুষখোরের বন্ধু নই৷’

জয়ন্ত সশব্দে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললে, ‘বেশ, তাহলে আমার কথাই শোনো৷’ সে দ্বিজেনের সঙ্গে তার যে কথোপকথন হয়েছিল, গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত বর্ণনা করে গেল৷ কখনো সবিস্ময়ে, কখনো ক্রুদ্ধ ভাবে, কখনো ঘৃণাভরে সুন্দরবাবু শ্রবণ করলেন তার কথা৷

জয়ন্ত বললে, ‘এই তো ব্যাপার৷ এখন আমার কী করা উচিত?’

মানিক বললে, ‘গলায় দড়ি দাও৷’

-‘সুন্দরবাবুর মত কী?’

-‘তোমার কী করা উচিত, আমি কী জানি? তবে আমার যা উচিত তাই করতে চললুম৷’

-‘কোথায় চললেন মশাই?’

-‘দ্বিজেনকে গ্রেপ্তার করতে৷’

-‘যাবেন না, যাবেন না৷’

-‘আলবত যাব, আলবত যাব!’

-‘দ্বিজেনকে গ্রেপ্তার করতে পারবেন না, পারবেন না, পারবেন না৷’

-‘কেন তুমি ঘুষ খেয়েছ বলে?’

-‘না, অন্য কারণে৷’

-‘কারণটা কী শুনি৷’

-‘দ্বিজেন হত্যাকারী নয়!’

জয়ন্তের মুখের পানে চেয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন সুন্দরবাবু৷ মানিকেরও সেই ভাব৷

জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতরে পায়চারি করতে করতে গম্ভীর স্বরে বললে, ‘হ্যাঁ, দ্বিজেন হচ্ছে নিরপরাধ৷ কেউ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না৷’

সুন্দরবাবু আমতা আমতা করে বললেন, ‘তবে কি এতক্ষণ তুমি মশকরা করছিলে? দ্বিজেন অপরাধ স্বীকার করেনি?’

-‘দ্বিজেন অপরাধ স্বীকার করেছে৷’

-‘পাগলের মতো তুমি কী বলছ জয়ন্ত৷’

-‘মানসী দেবীর আলমারির ভিতরে যে রক্তমাখা রুমালখানা পাওয়া গেছে সেখানা তো এখন আপনার কাছেই আছে?’

-‘আছে৷’

-‘সেখানা সাধারণ সাদা রুমাল৷ দ্বিজেন ওরকম রুমাল ব্যবহার করে না৷ আমার দৃঢ়বিশ্বাস সে রুমালখানা খুনিরই সম্পত্তি৷ দ্বিজেন খুনি হলে মানসীকে বিপদে ফেলবার জন্যে রুমালখানা কখনোই তার আলমারির ভিতরে রেখে আসত না, কারণ মানসীকে সে ভালোবাসে, তাকে বিবাহ করবার জন্যে সে সমস্ত সম্পত্তি থেকে স্বেচ্ছায় বঞ্চিত হতে বসেছিল৷ মানসীকে সে বিপদে ফেলতে পারেই না৷ আর ওই রুমালখানা তার নিজের হলেও ওখানা সে আলমারির ভিতরে রেখে আসত না, কারণ তাহলে তার নিজেরই বিপদের সম্ভাবনা৷ যেচে বিপদে পড়বে বলে কেন সে নিজের রুমাল মানসীর আলমারির ভিতরে স্থাপন করবে?’

মানিক বললে, ‘তোমার তো বিশ্বাস, রুমালখানা তার মালিকের অজ্ঞাতসারেই আলমারির ভিতরে পড়ে গিয়েছে৷’

-‘হ্যাঁ৷ কিন্তু রুমালের মালিক হত্যাকাণ্ডের পরে মানসীর আলমারির ভিতরে হাত চালাতে গিয়েছিল কেন, অনুমান করতে পারেন সুন্দরবাবু?’

-‘উহুঁ! না, না, আলমারির ভিতর থেকে হয় সে কিছু নিতে, নয় ওখানে কিছু রাখতে গিয়েছিল৷’

-‘মানসীর আলমারিতে হত্যাকারীর পক্ষে দরকারি কী থাকতে পারে? মানসীর একটা সায়া সেইখানেই হারিয়েছিল বটে, কিন্তু সেটা ছিল আলমারির বাইরে আলনার উপরে৷ আমার মনে হয় হত্যাকারী কিছু রাখতেই গিয়েছিল৷’

-‘সেটা কী হতে পারে?’

-‘হয়তো ছত্রপতির ছোরা৷’

-‘আরে, ছোরাখানা তো আছে দ্বিজেনের কাছে৷’

-‘তা থাকতে পারে৷’

-‘আর সে নিজের মুখেই তো তোমার কাছে অপরাধ স্বীকার করেও গিয়েছে!’

-‘তা করতে পারে৷’

-‘তবু বলবে সে অপরাধী নয়?’

-‘তবু বলব সে অপরাধী নয়৷ তার মুখ-চোখ, ভাবভঙ্গি, কথার ধরনধারণ-সব প্রকাশ করে দিচ্ছিল, সে অপরাধী নয়৷ এত অভিজ্ঞতার পরও কি আমার মানুষ চেনবার শক্তি হয়নি? দ্বিজেন মিছেকথা বলছিল৷’

-‘এমন বিপদজনক মিছে কথা কেউ কখনো বলে জয়ন্ত? এ তো আত্মহত্যার শামিল!’

-‘দ্বিজেন কেন যে এমন আশ্চর্য মিছে কথা বলে গেল, তার কারণও আমি আন্দাজ করতে পারছি৷’

-‘কারণটা কী বলো না!’

-‘এখনও বলবার সময় হয়নি৷’

-‘দ্বিজেন যদি নিরপরাধ হয়, তাহলে এই খুনের জন্যে দায়ী কে হতে পারে? হীরেন্দ্রনারায়ণ? কিন্তু সে তো এখন আমাদের নাগালের বাইরে!’

-‘খুনি সম্বন্ধেও কিছু কিছু ধারণা করতে পারছি৷ কিন্তু ধারণা এখনও প্রকাশ করবার মতো স্পষ্ট হয়নি৷’

-‘তুমি কি মনে কর, দ্বিজেন তার পিতৃব্যের গৌরবরক্ষার জন্যেই এমন নির্বোধের মতো মিছে কথা বলেছে?’

-‘ওসব কথা এখন থাক৷ আপাতত এক কাজ করতে হবে আপনাকে৷ এই বাড়ির প্রত্যেক লোকের ডান হাতের আঙ্গুলের ছাপ তুলে নিতে হবে-এমনকী ঝি চাকর দ্বারবান সকলেরই৷’

-‘আজই?’

-‘আজই৷ তারপর সেগুলো নিয়ে কী করতে হবে, আপনাকে বলা বাহুল্য৷ কিছু বক্তব্য থাকলে ফোনে জানাবেন৷ কাল সন্ধ্যার আগে আবার এখানে আপনার দেখা পেতে চাই৷ খুব সম্ভব সেই সময়েই হত্যাকারীকে আপনার গ্রাসে সমর্পণ করতে পারব৷’

-‘বল কী হে, তুমি এতটা নিশ্চিত?’

-‘হ্যাঁ সুন্দরবাবু৷ এইবারে আমার সঙ্গে বারান্দায় গিয়ে কিঞ্চিত বিশুদ্ধ বায়ু ভক্ষণ করবেন?’

-‘আচমকা এ আবার কী খেয়াল?’

-‘চলুন না৷ ঘুঘু দেখাতে পারব না বটে, কিন্তু ফাঁদ দেখাতে পারব৷’

-‘তোমার সবই হেঁয়ালি৷ চলো৷’

বাইরে গিয়ে সুন্দরবাবু এদিকে-ওদিকে দৃষ্টি চালনা করে বললেন, ‘বাবা, বাইরে তো দেখছি খালি অমাবস্যার অন্ধকার!’

-‘এই যে, আমি অন্ধকারে আলোকপাত করবার জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছি৷’ একটা জানলার কাছে এগিয়ে জয়ন্ত টর্চ টিপে নীচে ফেললে আলো৷

-‘দেখুন সুন্দরবাবু৷’

-‘জানলার তলায় সাদা মতন কী ছড়ানো রয়েছে হে?’

-‘পাউডারের গুঁড়ো৷ গুঁড়োর মাঝখানে কী দেখছেন?’

-‘আরে, পায়ের দাগ না?’

-‘হ্যাঁ, হত্যাকারী কিংবা তার সহকারীর পদচিহ্ন৷’

‘হুম!’ বলে সুন্দরবাবু হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে বিস্ফারিত চক্ষে পদচিহ্ন পরীক্ষা করতে লাগলেন৷

মানিক বললে, ‘ছোটো খালি পায়ের দাগ৷ দেখে মনে হয় স্ত্রীলোকের পা৷’

জয়ন্ত বললে, ‘সে বিচার করব ছাঁচ তোলবার পর৷’

সুন্দরবাবু শুধোলেন, ‘ঠিক এইখানেই যে কারুর আবির্ভাব হবে, তুমি কেমন করে জানলে জয়ন্ত?’

-‘কোনো মূর্তি আগেও এখানে আড়ি পাততে এসেছেন৷ আন্দাজে ধরেছিলুম, আজও তিনি দয়া করে আসবেন৷ অন্য জানলা দুটো বন্ধ করে এইটাই খালি খোলা রেখেছিলাম, যাতে ওইখানেই তাঁর উদয় হয়৷ তবে বেশিক্ষণ তাঁকে দাঁড়াতে দিইনি, পর্দা সরাতেই তিনি চম্পট দিয়েছেন৷ কিন্তু তাঁর কাল পূর্ণ হয়ে এসেছে, আর তিনি আমাদের ফাঁকি দিতে পারবেন না৷’

দশ – অভিনয়ের আয়োজন

পরের দিন সকাল বেলায় জয়ন্ত চা পানের পর বাড়ির ভিতর দিকের বারান্দায় পায়চারি করছে, এমন সময়ে দুই জন বেয়ারার সঙ্গে পবিত্রবাবুর আবির্ভাব৷

জয়ন্ত শুধোলেন, ‘কী পবিত্রবাবু, বেয়ারা নিয়ে কোথায় চলেছেন?’

-‘আর কোথায়, লাইব্রেরিতে! আজ যে লাইব্রেরি সাফ করবার দিন৷’

-‘আপনি তো খুবই কর্তব্যপরায়ণ দেখছি৷ সৌদামিনী দেবী স্বর্গে, পৃথিবীতে বসে এখনও আপনি তাঁর আদেশ পালন করছেন!’

-‘হপ্তায় একদিন করে লাইব্রেরি সাফ করাতে হবে, এই ছিল তাঁর আদেশ৷ এখনও তাঁরই অন্ন খাচ্ছি, তাঁর আদেশ পালন করব না! কিন্তু এ বাড়িতে আমার অন্ন এইবারে বোধ হয় উঠল৷ সৌদামিনী দেবীকে খুন করে কোন পাষণ্ড আমারও সর্বনাশ করলে!’

-‘কেন পবিত্রবাবু?’

-‘নতুন মনিব আমার মতো বুড়ো ঘোড়াকে আর কি কাজে বহাল রাখতে চাইবেন? সৌদামিনী দেবীর মৃত্যু, আমাদেরও সর্বনাশ! সবই নিয়তির খেলা! আসি মশাই!’ অত্যন্ত দুঃখিতভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে পবিত্রবাবু অগ্রসর হলেন লাইব্রেরির দিকে৷

পবিত্রবাবুর গমনপথের দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, নুতন মনিব বলতে উনি কাকে বুঝেছেন? হীরেন্দ্রনারায়ণ না দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ?

লাইব্রেরিঘরের ভিতর থেকে পবিত্রবাবুর উত্তেজিত কন্ঠের সাড়া পাওয়া গেল-‘জয়ন্তবাবু, জয়ন্তবাবু!’

জয়ন্ত চেঁচিয়ে বললে, ‘কী পবিত্রবাবু?’

-‘শিগগির একবার এদিকে আসুন!’

শীঘ্র যাবার কোনো চেষ্টাই করলে না জয়ন্ত৷ ব্যাপারটা আন্দাজ করে মনে মনে হেসে সে ধীরে ধীরে লাইব্রেরির ভিতরে গিয়ে হাজির হল৷ যা ভেবেছে তাই! শোকেসের পাশে পবিত্রবাবু থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর মুখ-চোখ উদভ্রান্তের মতো৷

জয়ন্ত বললে, ‘কী হল মশাই? আপনি সৌদামিনী দেবীর প্রেতাত্মা দেখেছেন নাকি?’

-‘তা দেখলেও আমি অতটা অভিভূত হতুম না৷ কিন্তু যা তাঁকে প্রেতাত্মায় পরিণত করেছে, চোখের সামনে আমি তাই-ই দেখছি৷’

-‘মানে?’

-‘ছত্রপতির ছোরা, হত্যার দিন যা অদৃশ্য হয়েছিল, হত্যার পরে আবার তা যথাস্থানে ফিরে এসেছে!’

-‘কী করে জানলেন যে ওই ছোরা দিয়েই সৌদামিনী দেবীকে খুন করা হয়েছে?’

-‘সেদিন তো আপনারাই এই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন!’

-‘তা বটে৷ কিন্তু সে কেবল সন্দেহ! নিশ্চিতভাবে কিছুই বলিনি৷’

-‘কিন্তু ঠিক ঘটনার দিনে ছোরাখানা চুরিই বা গেল কেন, আর চোরে আবার তা ফিরিয়েই বা দিলে কেন?’

-‘এটা ভাববার কথা বটে৷’

-‘তবে কি হত্যাকারী এখনও এই বাড়ির ভিতরেই বাস করছে?’

-‘থাকতেও পারে৷’

-‘বাপরে, বলেন কী মশাই?’

-‘ছোরাখানা শোকেসের ভিতর থেকে বার করুন দেখি!’

পবিত্রবাবু শিউরে উঠে বললেন, ‘আমি মরে গেলেও পারব না৷’

-‘কেন?’

-‘যদি ওর উপরে এখনও সৌদামিনী দেবীর রক্ত লেগে থাকে? ও ছোরা স্পর্শ করলেও মহাপাপ!’

-‘তাহলে ও ছোরা ছুঁয়ে কাজ নেই৷ আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকুন৷ আমি বাগানে একটু বেড়িয়ে আসি৷’

পবিত্রবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন৷ জয়ন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷

দুপুর বেলায় খাওয়া-দাওয়ার পর জামাকাপড় পরে জয়ন্ত বললে, ‘মানিক, আমি একবার অ্যাটর্নি হরিদাস চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে আসি৷’

যথাসময়ে হরিদাসবাবুর কাছে গিয়ে জয়ন্ত আত্মপরিচয় দিলে৷

সাদর সম্ভাষণ করে হরিদাসবাবু শুধোলেন, ‘আমি আপনার কী করতে পারি?’

-‘সৌদামিনী দেবীর নতুন উইলখানা একবার দেখতে চাই৷’

-‘অনায়াসে দেখতে পারেন৷ কিন্তু জানেন তো সেখানা ব্যর্থ উইল? হীরেন্দ্রনারায়ণ রায় মারা পড়েছেন?’

-‘জানি৷’

উইল এল৷ তার উপরে চোখ বুলোতে বুলোতে জয়ন্ত বললে, ‘একজন সাক্ষী তো দেখছি আমাদের পবিত্রবাবু৷ দ্বিতীয় সাক্ষীটি কে?’

হরিদাসবাবু বললেন, ‘আমার কেরানি৷’

-‘সৌদামিনী দেবীর প্রথম উইলখানা এখনও আছে তো?’

-‘আছে বটে, কিন্তু এতদিন ওর অস্তিত্ব থাকবার কথা নয়৷’

-‘কেন?’

‘উইলখানা তাঁকে আর একবার দেখিয়ে আমাকে নষ্ট করে ফেলতে বলা হয়েছিল৷ কিন্তু দেখাবার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়৷ তাই সেখানা এখনও বর্তমান আছে৷’

-‘সে উইলখানাও একবার দেখতে পাই কি?’

-‘সেখানা আপনার কোনো কাজে লাগবে বলে মনে হয় না৷’

-‘তবু একবার দেখতে দোষ কী?’

-‘তবে দেখুন৷’

পুরাতন উইলখানা আনানো হল৷ জয়ন্ত সেখানা পাঠ করে ফিরিয়ে দিলে৷

হরিদাসবাবু হেসে বললেন, ‘দেখছেন তো, ওখানা আপনার পক্ষে একেবারে অকেজো কাগজ?’

জয়ন্ত পকেট থেকে রুপোর শামুকদানী বার করে দুই টিপ নস্য নিয়ে বললে, ‘না হরিদাসবাবু, উইলখানা দেখবার সুযোগ পেয়ে বড়োই উপকৃত হলাম!’

-‘উপকৃত হলেন?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ, অত্যন্ত!’

-‘কোন দিক দিয়ে যে উপকৃত হলেন, কিছুই বুঝতে পারছি না৷’

-‘সেটা এখনও বলবার সময় হয়নি, ক্ষমা করবেন৷ কিন্তু এইটুকু জেনে রাখুন, প্রথম উইলখানা দেখতে পেলুম বলেই আমার এখানে আসা সার্থক হল৷ আপনি আমাকে অন্ধকারে আলো দেখালেন৷ ধন্যবাদ, আপনাকে ধন্যবাদ! নমস্কার!’

বাসায় ফিরে এসে জয়ন্ত দেখলে মানিকের সঙ্গে দাবা খেলবার জন্যে ছকের উপরে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন পবিত্রবাবু৷

জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করলে, ‘পবিত্রবাবু, নতুন উইলের সময়ে আপনি যে সাক্ষী ছিলেন, এ কথা তো জানতুম না!’

পবিত্রবাবু বললেন, ‘ও কথা তো এ বাড়ির সবাই জানে! এ বাড়িতে আমি ছাড়া উইলের সাক্ষী হবে কে? আমি হচ্ছি সৌদামিনী দেবীর বিশ্বস্ত পুরাতন কর্মচারী৷’

-‘বুঝলুম৷ কিন্তু দ্বিজেনবাবুকে আপনি একরকম কোলে-পিঠে করেই মানুষ করেছেন৷ তাঁকে কি আপনি ভালোবাসেন না?’

-‘বলেন কী, ভালোবাসি না আবার? নিজের মতো ভালোবাসি!’

-‘তাহলে সৌদামিনী দেবী যখন দ্বিজেনবাবুকে সমস্ত সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে উদ্যত হন, তখন আপনি তাঁকে বাধা দেননি কেন?’

-‘যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম মশাই, যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম৷ আপনি সৌদামিনী দেবীকে তো জানেন না! তিনি ছিলেন তৈলপক্ক বাঁশের মতো-এতটুকু নোয়ানো অসম্ভব৷ আমাকে দ্বিজেনের পক্ষ গ্রহণ করতে দেখেই তিনি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে যেসব কথা বললেন, আর তারপর যা করলেন, সেসব কথা আর প্রকাশ না করাই ভালো!’

জয়ন্ত বললে, ‘আপনি কর্তব্যপালন করেছেন শুনে সুখী হলুম৷ যাক৷ এখন আপনি একটি কার্যভার গ্রহণ করবেন?’

-‘কেন পারব না? আপনার অনুরোধ তো আদেশ!’

-‘আজ সন্ধ্যার আগে কোনো একটা বড়ো ঘরে বাড়ির সবাইকে এনে জড়ো করতে পারবেন?’

-‘পারব৷ কিন্তু কেন বলুন দেখি?’

-‘একটা অভিনয় হবে৷’

-‘কারা অভিনয় করবে?’

-‘আমরা সকলেই৷’

এগারো – অপূর্ব অভিনয়

একখানা হলঘর৷ একদিকে পাশাপাশি উপবিষ্ট জয়ন্ত, মানিক, সুন্দরবাবু ও কয়েকজন পুলিশ-কর্মচারী৷ আর একদিকে দেখা যাচ্ছে দ্বিজেন, পবিত্রবাবু, মানসী, সুরবালা, উমাতারা, সিন্ধুবালা, বিন্দুবালা এবং বাড়ির কয়েকজন ভৃত্য ও দারোয়ান৷

সুন্দরবাবু বললেন, ‘তাহলে জয়ন্ত, তুমিই পালা শুরু করো৷’

জয়ন্ত গাত্রোত্থান করে বললে, ‘দ্বিজেনবাবু অনুগ্রহ করে এগিয়ে আসবেন কি?’

দ্বিজেন অগ্রসর হয়ে জয়ন্তের কাছে এসে দাঁড়াল৷ তার দৃষ্টি সন্দেহপূর্ণ, ভাবভঙ্গি সংকুচিত৷

জয়ন্ত বললে, ‘দ্বিজেনবাবু, সৌদামিনী দেবীকে হত্যা করেছে কে?’

দ্বিজেন হতভম্ব হয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল৷

-‘সৌদামিনী দেবীকে হত্যা করেছে কে? আপনি?’

দ্বিজেনের মুখ নীরব, মাথা নত৷

জয়ন্ত কঠোর কন্ঠে বললে, ‘এখন কি ও কথা আপনি অস্বীকার করতে চান? কিন্তু মনে রাখবেন, আপনি নিজেই আমার কাছে অপরাধ স্বীকার করেছেন!’

দ্বিজেন মৃদু স্বরে বললে, ‘আমার কিছুই বক্তব্য নেই৷’

ওপাশ থেকে পবিত্রবাবু বলে উঠলেন, ‘অসম্ভব! দ্বিজেন কিছুতেই হত্যাকারী হতে পারে না৷’

জয়ন্ত গম্ভীর স্বরে বললে, ‘স্তব্ধ হোন পবিত্রবাবু! আপনারা কেউ আমাকে বাধা দেবেন না৷ দ্বিজেনবাবু যে হত্যাকারী নন আমি তা জানি৷’

দ্বিজেন ভয়ে ভয়ে মুখ তুলে তাকালে৷ জয়ন্তের আসল উদ্দেশ্য যে কী, আন্দাজ করতে পারছে না সে!

জয়ন্ত বললে, ‘আমি জানি দ্বিজেনবাবু হত্যাকারী নন৷ আমি জানি হত্যাকারী কে৷ দ্বিজেনবাবু মিথ্যা বলেছেন৷ তিনি কে দ্বিজেনবাবু?’

দ্বিজেনের সর্বশরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল৷

-‘তিনি কে দ্বিজেনবাবু?’

দ্বিজেন প্রাণপণে কোনোরকমে বলে উঠল, ‘দয়া করুন জয়ন্তবাবু, দয়া করুন!’

অট্টহাস্য করে জয়ন্ত বললে, ‘দয়া! বাঘ মারতে গিয়ে শিকারি করবে দয়া! অপরাধী ধরতে এসে গোয়েন্দা করবে দয়া! . . . যাকে বাঁচাবার জন্যে আপনি ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে চেয়েছিলেন, তিনি কে? এখনও আপনি বলবেন না? তাহলে আমিই বলে দিচ্ছি৷ দ্বিজেনবাবু বেশ জানেন, সৌদামিনী দেবীকে হত্যা করেছেন শ্রীমতী মানসী দেবী৷’

দ্বিজেন মর্মান্তিক আর্তনাদ করে উঠল৷ সকলের বিস্মিত দৃষ্টি মানসীর উপরে গিয়ে পড়ল বিদ্যুতের মতো৷ কিন্তু মানসীর মুখে নেই কোনো ভাবের রেখা৷ মূর্তির মতো স্থির তার দেহ৷

জয়ন্ত বললে, ‘দ্বিজেনবাবুকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করা বৃথা৷ আপাতত ওঁর কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যাবে না৷ কিন্তু প্রত্যেক কার্যের সঙ্গে থাকে কারণের সম্পর্ক আর দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে হয় চার৷ দ্বিজেনবাবুরই কাছ থেকে তাঁর মন ধার নিয়ে আর মামলার অন্যান্য সূত্রগুলো যথাস্থানে সাজিয়ে আমি যা পরিকল্পনা করেছি, সকলে এখন তাই-ই শ্রবণ করুন৷ বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার কিছু কিছু গরমিল থাকতে পারে, কিন্তু মোটামুটি ব্যাপারটা দাঁড়ায় এইরকম৷

‘দ্বিজেনবাবু মাঝরাত্রে ঘরে শুয়ে আছেন, চোখে ঘুম আসছে না৷ এমন সময়ে বাইরে শব্দ পেয়ে সাড়া নিয়ে জানলেন, মানসী দেবীও তখন পর্যন্ত জেগে আছেন৷’

‘সেই রাত্রেই নিহত হলেন সৌদামিনী দেবী৷ সকলেরই দৃঢ় ধারণা, হত্যাকারী বাড়ির বাইরের লোক নয়৷ সে সময়ে সকলেই সহজে অন্য লোককে সন্দেহ করে৷ গতকল্যকার রাত্রের কথা ভেবে দ্বিজেনবাবুর মনটা ছ্যাঁত করে উঠল৷ অত রাত্রেও কেন জেগে ছিলেন মানসী দেবী!

‘সন্দেহের আরও একটা বিশেষ কারণও আছে৷ প্রথমত সৌদামিনী দেবী প্রথম উইলে মানসী দেবীর জন্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা বরাদ্দ করেছিলেন৷ নতুন উইলে মানসী দেবীকে সে টাকা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল৷ দ্বিতীয়ত, মানসী দেবীর সঙ্গে তিনি দ্বিজেনবাবুর বিবাহ দিতে সম্পূর্ণ নারাজ আর তাঁর কথার অবাধ্য হওয়ার দরুণ দ্বিজেনবাবুকে পথের ভিখারি করেছেন৷ সুতরাং সৌদামিনী দেবীর উপরে মানসী দেবীর বিজাতীয় ক্রোধ আর দারুণ আক্রোশ হওয়াই স্বাভাবিক৷

‘মানসী দেবী যখন অন্যান্য সকলের সঙ্গে সৌদামিনী দেবীর মৃতদেহ নিয়ে অভিভূত হয়ে আছেন, নিজের সন্দেহ ভঞ্জন করবার জন্যে দ্বিজেনবাবু তখন চুপিচুপি মানসী দেবীর ঘরে গিয়ে ঢুকলেন আর জামাকাপড়ের ভিতর থেকে আবিষ্কার করলেন রক্তমাখা ছত্রপতির ছোরা! আমার ধারণা, সেইসঙ্গে তিনি আরও কিছু আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু তা নিয়ে পরে আলোচনা করলেও চলবে৷

‘এই অভাবিত আবিষ্কার করে দ্বিজেনবাবু যে হৃদয়ে অত্যন্ত আঘাত পেলেন, সে কথা বলাই বাহুল্য৷ কিন্তু তবু মানসী দেবীর প্রতি তাঁর ভালোবাসা একটুও কমল না, বরং পুলিশের কবল থেকে তাঁকে উদ্ধার করবার জন্যে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে উদ্যত হলেন৷ কেমন দ্বিজেনবাবু, আমার অনুমান বোধ হয় নিতান্ত ভ্রান্ত নয়?’

দ্বিজেন নিরুত্তর, তার অবস্থা জীবন্মৃতের মতো৷

জয়ন্ত বললে, ‘সঞ্জীবিত হোন দ্বিজেনবাবু, আশ্বস্ত হোন! আমি জানি, আপনি মিথ্যা ভয় পেয়ে মিথ্যা কথা বলেছেন৷ আমি আপনাকে অভয় দিয়ে বলতে পারি, মানসী দেবী হত্যা করেননি সৌদামিনী দেবীকে!’

ঘরের ভিতর শোনা গেল বহু কন্ঠের বিস্ময়গুঞ্জন৷ মানসীর মূর্তি তেমনি নির্বাক, তেমনি নিস্পন্দ-সমান অটল আনন্দে-নিরানন্দে! দ্বিজেন ফেললে আশ্বস্তির নিশ্বাস৷

জয়ন্ত বললে, ‘এইবারে পবিত্রবাবু কি একবার এদিকে আসতে পারবেন?’

পবিত্রবাবু উঠে এলেন৷ দুই ভুরু তাঁর সংকুচিত৷

‘পবিত্রবাবু, আজ অ্যাটর্নি বাড়িতে গিয়ে জানলুম যে, প্রথম উইলে সৌদামিনী দেবী আপনার জন্যে বরাদ্দ রেখেছিলেন বিশ হাজার টাকা?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘নতুন উইলে আপনার ভাগে ছিল না একটিমাত্র পয়সাও? আপনি উইলের একজন সাক্ষী, এটা নিশ্চয়ই আপনি দেখেছিলেন?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘নতুন উইলে আপনার টাকা মারা গেল কেন, এটা প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি৷ তাই আজ সকালে অ্যাটর্নি বাড়ি থেকে ফিরে এসেই কৌশলে আপনার কাছ থেকে গুপ্তকথাটা আদায় করে নিই৷ -আপনাকে বঞ্চিত করার কারণ বোধ হয় আপনি করেছিলেন দ্বিজেনবাবুর পক্ষসমর্থন?’

-‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’

-‘আপনার পক্ষে দ্বিজেনবাবুর পক্ষসমর্থন বলতে বোঝায় আত্মপক্ষসমর্থনও?’

-‘অর্থ বুঝলুম না’৷

-‘নতুন উইলে সম্পত্তির মালিক হতেন হীরেন্দ্রনারায়ণ৷ তিনি আপনাকে ঘৃণা করতেন৷ তাঁকে সম্পত্তির মালিক করার অর্থই হচ্ছে আপনাকে চাকরি থেকে তাড়ানো৷’

-‘ব্যাপারটা প্রায় সেইরকমই দাঁড়ায় বটে৷’

-‘তাহলে একসঙ্গে বিশ হাজার টাকা হারিয়ে আর চাকরি খুইয়ে সৌদামিনী দেবীকে নিশ্চয়ই আপনি ধন্যবাদ দেননি?’

-‘বলা বাহুল্য৷’

-‘তাই ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে করেছিলেন সৌদামিনী দেবীর বক্ষে ছুরিকাঘাত?’

-‘আপনি কী আজগুবি কথা বলছেন!’

-‘আপনি এক ঢিলে মারতে চেয়েছিলেন দুই পাখি৷ সৌদামিনী দেবীকে হত্যা করে নিজে নিরাপদে থাকবার জন্যে সমস্ত সন্দেহ চালনা করতে চেয়েছিলেন এমন এক নিষ্পাপ নির্দোষ মহিলার দিকে, যার উপরে আপনি তুষ্ট ছিলেন না৷’

-‘কার উপরে আমি তুষ্ট ছিলুম না?’

-‘মানসী দেবীর উপরে৷ এ কথা আমি দ্বিজেনবাবুর মুখেই শুনেছি৷’

-‘একেবারে বাজে কথা৷’

-‘প্রথমত আপনি ছত্রপতির ছোরাখানা মানসী দেবীর আলমারিতে রাখেন৷ কিন্তু তারপরই বোধ করি আপনার মনে হয়, প্রমাণটা আরও দৃঢ় করা উচিত৷ মানসী দেবীর আলনা থেকে আপনি তাঁর সায়াটা নামিয়ে নেন-সেটাও রক্তলিপ্ত করতে চান৷ সৌদামিনী দেবীর ঘরে গিয়ে মৃতদেহের ক্ষত থেকে রক্ত সংগ্রহ করা চলত, কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে লাইব্রেরি থেকে মানসী দেবী এসে পড়তে পারতেন৷ আর একটু দেরি করলেই সত্যসত্যই আপনি সেইদিনই হাতেনাতে ধরা পড়ে যেতেন, কারণ মানসী দেবী তখন নিজের ঘরের দিকেই আসছিলেন, আর আসতে আসতে দূর থেকে আপনার পলায়মান মূর্তি দেখেও চিনতে পারেননি৷ খুব চটপট কাজ সারবার জন্যে আপনি ছত্রপতির ছোরা দিয়েই নিজের বাঁ-হাতের এক জায়গা অল্প একটু কেটে রক্তপাত করে সায়াটাকেও করেন রক্তাক্ত৷ তারপর ছোরা আর সায়া আলমারির ভিতরে গুঁজে রেখে পালিয়ে আসেন৷’

পবিত্রবাবু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, ‘আপনি দিব্যি বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে পারেন৷ কিন্তু প্রমাণ কোথায়?’

জয়ন্ত বললে, ‘দ্বিজেনবাবু, আলমারির ভিতরে আপনি ছোরার সঙ্গে নিশ্চয়ই একটা রক্তমাখা সায়া পেয়েছিলেন?’

দ্বিজেন শ্রান্ত স্বরে বললে, ‘পেয়েছিলুম৷’

-‘সেটা কোথায় গেল?’

-‘পুড়িয়ে ফেলেছি৷’

-‘আরও শুনুন পবিত্রবাবু৷ আপনি যে রোজ ডাক্তার ডি. এন. বসুর ডিসপেন্সারিতে আপনার বাঁ-হাতের ক্ষত ব্যান্ডেজ করতে যান, পুলিশ এ খবরও পেয়েছে৷ ছোরাখানা প্রাচীন৷ তাতে যে মরচে ধরেছে তাও আমি দেখেছি৷ তাই আপনার সামান্য ক্ষত বিষিয়ে অসামান্য হয়ে উঠেছে৷ আপনি জামার বাঁ-আস্তিন গুটোন দেখি, তাহলে সকলেই ব্যান্ডেজ দেখতে পারে৷’

পবিত্রবাবু ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘আমার হাতের ব্যান্ডেজ কি আমাকে হত্যাকারী বলে প্রমাণিত করবে?’

-‘আপনি আমার ঘরের জানলায় আড়ি পেতে আমাদের কথা শোনবার চেষ্টা করতেন৷ কৌশলে আমি আপনার পদচিহ্ন সংগ্রহ করেছি৷ তার ছাঁচও উঠেছে৷ একটু মেলালেই আপনি ধরা পড়ে যাবেন৷’

পবিত্রবাবু এইবারে অধীর স্বরে চিৎকার করে বললেন, ‘আড়ি পেতে শোনা মানেই কি নরহত্যা করা? প্রমাণ দেখান, প্রমাণ দেখান৷ যত রাবিশ কথা!’

-‘পবিত্রবাবু, তাহলে এইবারে আমাকে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করতে হল৷ ছোরা দিয়ে বাঁ-হাত কাটবার পর রক্ত বন্ধ করবার জন্যে আপনি নিজের রুমালখানা ক্ষতের উপরে জড়িয়ে নিয়েছিলেন৷ তবু তিন ফোঁটা রক্ত পড়েছিল ঘরের মেঝের উপরে৷ সেই রক্তাক্ত রুমালের উপরে ছিল আপনার ডান হাতের একটা আঙুলের ছাপ৷ কিন্তু আলমারির ভিতরে ছোরা আর সায়াটা রাখবার সময়ে রুমালখানাও যে ক্ষতস্থান থেকে খসে পড়ে গিয়েছিল, মনের উত্তেজনায় আর তাড়াতাড়িতে আপনি তা একেবারেই টের পাননি৷ কাল পুলিশ এসে আপনাদের সকলকার ডান হাতের আঙুলের ছাপ নিয়ে গিয়েছে৷ পরীক্ষায় নিশ্চিতভাবে জানা গিয়েছে যে, রুমালের উপরে আপনারই আঙুলের ছাপ৷ আপনার কিছু বক্তব্য আছে?’

পবিত্রবাবু মুখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল এবং ফুলে উঠল তাঁর কপালের দুই দিকের দুটো শির৷ তারপরই বিকট একটা চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি দুই বাহু ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করে দুই হাত দিয়ে শূন্য আঁচড়াতে আঁচড়াতে দড়াম করে পড়ে গেলেন কক্ষতলে! মহা হইচই করে সকলে কাছে ছুটে এল৷ পবিত্রবাবুর দেহ দুই-তিন বার নড়েচড়ে একেবারেই স্থির হয়ে গেল৷ তিনি সংবরণ করলেন ইহলীলা৷

জয়ন্ত বললে, ‘আর এখানে নয় মানিক, সরে পড়ি চলো৷ আমাদের কর্তব্য সমাপ্ত৷’

জয়ন্ত ও মানিক নিজেদের জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিচ্ছে, এমন সময়ে সুন্দরবাবু এসে বললেন, ‘জয়ন্ত, একেবারে ডবল ট্র্যাজেডি! পবিত্রবাবুর কীর্তি শুনে আর মৃত্যু দেখে তাঁর স্ত্রী সুরবালারও হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে!’

জয়ন্ত দুঃখিতভাবে বললে, ‘গোয়েন্দার কর্তব্য কী নিষ্ঠুর! আমাদের জন্যেই এই কাণ্ড! মারা গিয়েছিলেন কেবল সৌদামিনী দেবী৷ আমরা এসে মরাকে তো বাঁচাতে পারলুমই না, উলটে মারলুম আরও দু-জন লোককে!’

মানসীকে সঙ্গে করে ঘরের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে দ্বিজেন হাস্যমুখে বললে, ‘না জয়ন্তবাবু, গোয়েন্দার কর্তব্যে মাধুর্যও আছে৷ আমরা তো মরতেই বসেছিলুম, আপনার জন্যেই আমরা আবার লাভ করলুম নবজীবন৷ আপনি আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন৷’ মানসীর সঙ্গে দ্বিজেন যুক্ত করে জানু পেতে জয়ন্তের সামনে উপবেশন করলে৷

দু-জনকে হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দিয়ে জয়ন্ত প্রসন্ন মুখে বললে, ‘প্রার্থনা করি, ভগবান যেন আপনাদের যুক্তজীবনকে আনন্দময় করে তোলেন৷’ তারপর পকেট থেকে দ্বিজেনের দেওয়া চেকখানি বার করে সে আবার বললে, ‘এই নিন আপনার চেক৷’

দুই হাত জোড় করে দ্বিজেন বললে, ‘ক্ষমা করবেন৷ ও চেক আপনারই৷’

জয়ন্ত সকৌতুকে হেসে বললে, ‘তাই নাকি? সুন্দরবাবু, ওষ্ঠাধরে একটা নতুন চুরোট ধারণ করুন তো! আচ্ছা, এইবারে আপনার দেশলাইটা আমাকে দিন৷ দ্বিজেনবাবু আগেকার শখের বাবুরা নাকি দশ টাকার নোট পুড়িয়ে সিগারেট ধরাতেন৷ আমরাও বড়ো ছোট্ট মনুষ্য নই৷ এই দেখুন, আপনার চেকে অগ্নিসংযোগ করলুম, আর এই দেখুন, সুন্দরবাবুর শ্রীমুখ ধূম্র-উদ্গিরণ করছে!’

মানিক বললে, ‘অতুলনীয় দৃশ্যকাব্য! পঁচিশ হাজার টাকার অগ্নিসংস্কার! এ দৃশ্য দেবতাদেরও লোভনীয়!’

সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম!’

-সমাপ্ত-


© 2024 পুরনো বই