গোরা ১৮

১৮

বিনয় আনন্দময়ীর কথা কয়টি ভাবিতে ভাবিতে বাসায় গেল। আনন্দময়ীর মুখের একটি কথাও এপর্যন্ত বিনয়ের কাছে কোনোদিন উপেক্ষিত হয় নাই। সে রাত্রে তাহার মনের মধ্যে একটা ভার চাপিয়া রহিল।

পরদিন সকালে উঠিয়া সে যেন একটা মুক্তির ভাব অনুভব করিল। তাহার মনে হইল গোরার বন্ধুত্বকে সে একটা খুব বড়ো দাম দিয়া চুকাইয়া দিয়াছে। এক দিকে শশিমুখীকে বিবাহ করিতে রাজি হইয়া সে জীবনব্যাপী যে-একটা বন্ধন স্বীকার করিয়াছে ইহার পরিবর্তে আর-এক দিকে তাহার বন্ধন আলগা দিবার অধিকার হইয়াছে। বিনয় সমাজ ছাড়িয়া ব্রাহ্মপরিবারে বিবাহ করিবার জন্য লুব্ধ হইয়াছে, গোরা তাহার প্রতি এই-যে অত্যন্ত অন্যায় সন্দেহ করিয়াছিল– এই মিথ্যা সন্দেহের কাছে সে শশিমুখীর বিবাহকে চিরন্তন জামিন-স্বরূপে রাখিয়া নিজেকে খালাস করিয়া লইল। ইহার পরে বিনয় পরেশের বাড়িতে নিঃসংকোচে এবং ঘন ঘন যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিল।

যাহাদিগকে ভালো লাগে তাহাদের ঘরের লোকের মতো হইয়া উঠা বিনয়ের পক্ষে কিছুমাত্র শক্ত নহে। সে যেই গোরার দিকের সংকোচ তাহার মন হইতে দূর করিয়া দিল অমনি দেখিতে দেখিতে অল্প কালের মধ্যেই পরেশবাবুর ঘরের সকলের কাছেই যেন বহুদিনের আত্মীয়ের মতো হইয়া উঠিল।

কেবল ললিতার মনে যে-কয়দিন সন্দেহ ছিল যে সুচরিতার মন হয়তো বা বিনয়ের দিকে কিছু ঝুঁকিয়াছে সেই কয়দিন বিনয়ের বিরুদ্ধে তাহার মন যেন অস্ত্রধারণ করিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু যখন সে স্পষ্ট বুঝিল যে সুচরিতা বিনয়ের প্রতি বিশেষভাবে পক্ষপাতী নহে তখন তাহার মনের বিদ্রোহ দূর হইয়া সে ভারি আরাম বোধ করিল এবং বিনয়বাবুকে অসামান্য ভালো লোক বলিয়া মনে করিতে তাহার কোনো বাধা রহিল না।

হারানবাবুও বিনয়ের প্রতি বিমুখ হইলেন না– তিনি একটু যেন বেশি করিয়া স্বীকার করিলেন যে বিনয়ের ভদ্রতাজ্ঞান আছে। গোরার যে সেটা নাই ইহাই এই স্বীকারোক্তির ইঙ্গিত।

বিনয় কখনো হারানবাবুর সম্মুখে কোনো তর্কের বিষয় তুলিত না এবং সুচরিতারও চেষ্টা ছিল যাহাতে না তোলা হয়– এইজন্য বিনয়ের দ্বারা ইতিমধ্যে চায়ের টেবিলের শান্তিভঙ্গ হইতে পায় নাই।

কিন্তু হারানের অনুপস্থিতিতে সুচরিতা নিজে চেষ্টা করিয়া বিনয়কে তাহার সামাজিক মতের আলোচনায় প্রবৃত্ত করিত। গোরা এবং বিনয়ের মতো শিক্ষিত লোক কেমন করিয়া যে দেশের প্রাচীন কুসংস্কারগুলি সমর্থন করিতে পারে ইহা জানিবার কৌতূহল কিছুতেই তাহার নিবৃত্তি হইত না। গোরা ও বিনয়কে সে যদি না জানিত তবে এ-সকল মত কেহ স্বীকার করে জানিলে সুচরিতা দ্বিতীয় কোনো কথা না শুনিয়া তাহাকে অবজ্ঞার যোগ্য বলিয়া স্থির করিত। কিন্তু গোরাকে দেখিয়া অবধি গোরাকে সে কোনোমতে মন হইতে অশ্রদ্ধা করিয়া দূর করিতে পারিতেছে না। তাই সুযোগ পাইলেই ঘুরিয়া ফিরিয়া বিনয়ের সঙ্গে সে গোরার মত ও জীবনের আলোচনা উত্থাপন করে এবং প্রতিবাদের দ্বারা সকল কথা শেষ পর্যন্ত টানিয়া বাহির করিতে থাকে। পরেশ সুচরিতাকে সকল সম্প্রদায়ের মত শুনিতে দেওয়াই তাহার সুশিক্ষার উপায় বলিয়া জানিতেন, এইজন্য তিনি এ-সকল তর্কে কোনোদিন শঙ্কা অনুভব বা বাধা প্রদান করেন নাই।

একদিন সুচরিতা জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, গৌরমোহনবাবু কি সত্যই জাতিভেদ মানেন, না ওটা দেশানুরাগের একটা বাড়াবাড়ি?”

বিনয় কহিল, “আপনি কি সিঁড়ির ধাপগুলোকে মানেন? ওগুলোও তো সব বিভাগ– কোনোটা উপরে কোনোটা নীচে।”

সুচরিতা। নীচে থেকে উপরে উঠতে হয় বলেই মানি– নইলে মানবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। সমান জায়গায় সিঁড়িকে না মানলেও চলে।

বিনয়। ঠিক বলেছেন– আমাদের সমাজ একটা সিঁড়ি– এর মধ্যে একটা উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হচ্ছে নীচে থেকে উপরে উঠিয়ে দেওয়া, মানবজীবনের একটা পরিণামে নিয়ে যাওয়া। যদি সমাজকে সংসারকেই পরিণাম বলে জানতুম তা হলে কোনো বিভাগব্যবস্থার প্রয়োজনই ছিল না– তা হলে য়ুরোপীয় সমাজের মতো প্রত্যেকে অন্যের চেয়ে বেশি দখল করবার জন্যে কাড়াকাড়ি মারামারি করে চলতুম; সংসারে যে কৃতকার্য হ’ত সেই মাথা তুলত, যার চেষ্টা নিষ্ফল হত সে একেবারেই তলিয়ে যেত। আমরা সংসারের ভিতর দিয়ে সংসারকে পার হতে চাই বলেই সংসারের কর্তব্যকে প্রবৃত্তি ও প্রতিযোগিতার উপরে প্রতিষ্ঠিত করি নি– সংসার-কর্মকে ধর্ম বলে স্থির করেছি, কেননা কর্মের দ্বারা অন্য কোনো সফলতা নয়, মুক্তি লাভ করতে হবে, সেইজন্য এক দিকে সংসারের কাজ, অন্য দিকে সংসার-কাজের পরিণাম, উভয় দিকে তাকিয়ে আমাদের সমাজ বর্ণভেদ অর্থাৎ বৃত্তিভেদ স্থাপন করেছেন।

সুচরিতা। আমি যে আপনার কথা খুব স্পষ্ট বুঝতে পারছি তা নয়। আমার প্রশ্ন এই যে, যে উদ্দেশ্যে সমাজের বর্ণভেদ প্রচলিত হয়েছে আপনি বলছেন সে উদ্দেশ্য কি সফল হয়েছে দেখতে পাচ্ছেন?

বিনয়। পৃথিবীতে সফলতার চেহারা দেখতে পাওয়া বড়ো শক্ত। গ্রীসের সফলতা আজ গ্রীসের মধ্যে নেই, সেজন্যে বলতে পারি নে গ্রীসের সমস্ত আইডিয়াই ভ্রান্ত এবং ব্যর্থ। গ্রীসের আইডিয়া এখনো মানবসমাজের মধ্যে নানা আকারে সফলতা লাভ করছে। ভারতবর্ষ যে জাতিভেদ বলে সামাজিক সমস্যার একটা বড়ো উত্তর দিয়েছিলেন, সে উত্তরটা এখনো মরে নি– সেটা এখনো পৃথিবীর সামনে রয়েছে। য়ুরোপও সামাজিক সমস্যার অন্য কোনো সদুত্তর এখনো দিতে পারে নি, সেখানে কেবলই ঠেলাঠেলি হাতাহাতি চলছে– ভারতবর্ষের এই উত্তরটা মানবসমাজে এখনো সফলতার জন্যে প্রতীক্ষা করে আছে– আমরা একে ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের অন্ধতাবশত উড়িয়ে দিলেই যে এ উড়ে যাবে তা মনেও করবেন না। আমরা ছোটো ছোটো সম্প্রদায়েরা জলবিম্বের মতো সমুদ্রে মিশিয়ে যাব, কিন্তু ভারতবর্ষের সহজ প্রতিভা হতে এই-যে একটা প্রকাণ্ড মীমাংসা উদ্ভূত হয়েছে পৃথিবীর মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত এর কাজ না হবে ততক্ষণ এ স্থির দাঁড়িয়ে থাকবে।

সুচরিতা সংকুচিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি রাগ করবেন না, কিন্তু সত্যি করে বলুন, এ-সমস্ত কথা কি আপনি গৌরমোহনবাবুর প্রতিধ্বনির মতো বলছেন, না এ আপনি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছেন?”

বিনয় হাসিয়া কহিল, “আপনাকে সত্য করেই বলছি, গোরার মতো আমার বিশ্বাসের জোর নেই। জাতিভেদের আবর্জনা ও সমাজের বিকারগুলো যখন দেখতে পাই তখন আমি অনেক সময়েই সন্দেহ প্রকাশ করে থাকি– কিন্তু গোরা বলে, বড়ো জিনিসকে ছোটো করে দেখলেই সন্দেহ জন্মে– গাছের ভাঙা ডাল ও শুকনো পাতাকেই গাছের চরম প্রকৃতি বলে দেখা বুদ্ধির অসহিষ্ণুতা– ভাঙা ডালকে প্রশংসা করতে বলি নে, কিন্তু বনস্পতিকে সমগ্র করে দেখো এবং তার তাৎপর্য বুঝতে চেষ্টা করো।”

সুচরিতা। গাছের শুকনো পাতাটা নাহয় নাই ধরা গেল, কিন্তু গাছের ফলটা তো দেখতে হবে। জাতিভেদের ফলটা আমাদের দেশের পক্ষে কী রকম?

বিনয়। যাকে জাতিভেদের ফল বলছেন সেটা অবস্থার ফল, শুধু জাতিভেদের নয়। নড়া দাঁত দিয়ে চিবোতে গেলে ব্যথা লাগে, সেটা দাঁতের অপরাধ নয়, নড়া দাঁতেরই অপরাধ। নানা কারণে আমাদের মধ্যে বিকার ও দুর্বলতা ঘটেছে বলেই ভারতবর্ষের আইডিয়াকে আমরা সফল না করে বিকৃত করছি– সে বিকার আইডিয়ার মূলগত নয়। আমাদের ভিতর প্রাণ ও স্বাস্থ্যের প্রাচুর্য ঘটলেই সমস্ত ঠিক হয়ে যাবে। গোরা সেইজন্যে বার বার বলে যে, মাথা ধরে বলে মাথাটাকে উড়িয়ে দিলে চলবে না– সুস্থ হও, সবল হও।

সুচরিতা। আচ্ছা, তা হলে আপনি ব্রাহ্মণ জাতকে নরদেবতা বলে মানতে বলেন? আপনি সত্যি বিশ্বাস করেন ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলোয় মানুষ পবিত্র হয়?

বিনয়। পৃথিবীতে অনেক সম্মানই তো আমাদের নিজের সৃষ্টি। রাজাকে যতদিন যে কারণেই হোক দরকার থাকে ততদিন মানুষ তাকে অসামান্য বলে প্রচার করে। কিন্তু রাজা তো সত্যি অসামান্য নয়। অথচ নিজের সামান্যতার বাধা ভেদ করে তাকে অসামান্য হয়ে উঠতে হবে, নইলে সে রাজত্ব করতে পারবেই না। আমরা রাজার কাছে থেকে উপযুক্তরূপ রাজত্ব পাবার জন্যে তাকে অসামান্য করে গড়ে তুলি– আমাদের সেই সম্মানের দাবি রাজাকে রক্ষা করতে হয়, তাকে অসামান্য হতে হয়। মানুষের সকল সম্বন্ধের মধ্যেই এই কৃত্রিমতা আছে। এমন-কি, বাপ-মার যে আদর্শ আমরা সকলে মিলে খাড়া করে রেখেছি তাতে করেই সমাজে বাপ-মাকে বিশেষভাবে বাপ-মা করে রেখেছে, কেবলমাত্র স্বাভাবিক স্নেহে নয়। একান্নবর্তী পরিবারে বড়ো ভাই ছোটো ভাইয়ের জন্য অনেক সহ্য ও অনেক ত্যাগ করে– কেন করে? আমাদের সমাজে দাদাকে বিশেষভাবে দাদা করে তুলেছে, অন্য সমাজে তা করে নি। ব্রাহ্মণকেও যদি যথার্থভাবে ব্রাহ্মণ করে গড়ে তুলতে পারি তা হলে সে কি সমাজের পক্ষে সামান্য লাভ! আমরা নরদেবতা চাই– আমরা নরদেবতাকে যদি যথার্থই সমস্ত অন্তরের সঙ্গে বুদ্ধিপূর্বক চাই তা হলে নরদেবতাকে পাব। আর যদি মূঢ়ের মতো চাই তা হলে যে-সমস্ত অপদেবতা সকল রকম দুষ্কর্ম করে থাকে এবং আমাদের মাথার উপরে পায়ের ধুলো দেওয়া যাদের জীবিকার উপায় তাদের দল বাড়িয়ে ধরণীর ভার বৃদ্ধি করা হবে।

সুচরিতা। আপনার সেই নরদেবতা কি কোথাও আছে?

বিনয়। বীজের মধ্যে যেমন গাছ আছে তেমনি আছে, ভারতবর্ষের আন্তরিক অভিপ্রায় এবং প্রয়োজনের মধ্যে আছে। অন্য দেশ ওয়েলিংটনের মতো সেনাপতি, নিউটনের মতো বৈজ্ঞানিক, রথ্‌চাইল্ডের মতো লক্ষপতি চায়, আমাদের দেশ ব্রাহ্মণকে চায়। ব্রাহ্মণ,যার ভয় নেই, লোভকে যে ঘৃণা করে, দুঃখকে যে জয় করে, অভাবকে যে লক্ষ করে না, যে “পরমে ব্রহ্মণি যোজিতচিত্তঃ’। যে অটল, যে শান্ত, যে মুক্ত সেই ব্রাহ্মণকে ভারতবর্ষ চায়– সেই ব্রাহ্মণকে যথার্থভাবে পেলে তবেই ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে। আমাদের সমাজের প্রত্যেক বিভাগকে প্রত্যেক কর্মকে সর্বদাই একটি মুক্তির সুর জোগাবার জন্যই ব্রাহ্মণকে চাই– রাঁধবার জন্যে এবং ঘণ্টা নাড়বার জন্যে নয়। সমাজের সার্থকতাকে সমাজের চোখের সামনে সর্বদা প্রত্যক্ষ করে রাখবার জন্যে ব্রাহ্মণকে চাই। এই ব্রাহ্মণের আদর্শকে আমরা যত বড়ো করে অনুভব করব ব্রাহ্মণের সম্মানকে তত বড়ো করে তুলতে হবে। সে সম্মান রাজার সম্মানের চেয়ে অনেক বেশি– সে সম্মান দেবতারই সম্মান। এ দেশে ব্রাহ্মণ যখন সেই সম্মানের যথার্থ অধিকারী হবে তখন এ দেশকে কেউ অপমানিত করতে পারবে না। আমরা কি রাজার কাছে মাথা হেঁট করি, অত্যাচারীর বন্ধন গলায় পরি? নিজের ভয়ের কাছে আমাদের মাথা নত, নিজের লোভের জালে আমরা জড়িয়ে আছি, নিজের মূঢ়তার কাছে আমরা দাসানুদাস। ব্রাহ্মণ তপস্যা করুন; সেই ভয় থেকে, লোভ থেকে, মূঢ়তা থেকে আমাদের মুক্ত করুন। আমরা তাঁদের কাছ থেকে যুদ্ধ চাই নে, বাণিজ্য চাই নে, আর কোনো প্রয়োজন চাই নে– তাঁরা আমাদের সমাজের মাঝখানে মুক্তির সাধনাকে সত্য করে তুলুন।

পরেশবাবু এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন, তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, “ভারতবর্ষকে যে আমি জানি তা বলতে পারি নে এবং ভারতবর্ষ যে কী চেয়েছিলেন এবং কোনোদিন তা পেয়েছিলেন কি না তা আমি নিশ্চয় জানি নে, কিন্তু যে দিন চলে গেছে সেই দিনে কি কখনো ফিরে পাওয়া যায়? বর্তমানে যা সম্ভব তাই আমাদের সাধনার বিষয়–অতীতের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে সময় নষ্ট করলে কি কোনো কাজ হবে?”

বিনয় কহিল, “আপনি যেমন বলেছেন আমিও ঐরকম করে ভেবেছি এবং অনেক বার বলেওছি–গোরা বলে যে, অতীতকে বলে বরখাস্ত করে বসে আছি বলেই কি সে অতীত? বর্তমানের হাঁকডাকের আড়ালে পড়ে সে আমাদের দৃষ্টির অতীত হয়েছে বলেই অতীত নয়–সে ভারতবর্ষের মজ্জার মধ্যে রয়েছে। কোনো সত্য কোনোদিনই অতীত হতে পারে না। সেইজন্যই ভারতবর্ষের এই সত্য আমাদের আঘাত করতে আরম্ভ করেছে। একদিন একে যদি আমাদের একজনও সত্য বলে চিনতে ও গ্রহণ করতে পারে তা হলেই আমাদের শক্তির খনির দ্বারে প্রবেশের পথ খুলে যাবে–অতীতের ভাণ্ডার বর্তমানের সামগ্রী হয়ে উঠবে। আপনি কি মনে করছেন ভারতবর্ষের কোথাও সেরকম সার্থকজন্মা লোকের আবির্ভাব হয় নি?”

সুচরিতা কহিল, “আপনি যেরকম করে এ-সব কথা বলছেন ঠিক সাধারণ লোকে এরকম করে বলে না–সেইজন্যে আপনাদের মতকে সমস্ত দেশের জিনিস বলে ধরে নিতে মনে সংশয় হয়।”

বিনয় কহিল, “দেখুন, সূর্যের উদয় ব্যাপারটাকে বৈজ্ঞানিকেরা একরকম করে ব্যাখ্যা করে, আবার সাধারণ লোকে আর-এক রকম করে ব্যাখ্যা করে। তাতে সূর্যের উদয়ের বিশেষ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি করে না। তবে কিনা সত্যকে ঠিকমতো করে জানার দরুন আমাদের একটা লাভ আছে। দেশের যে-সকল সত্যকে আমরা খণ্ডিত করে বিক্ষিপ্ত করে দেখি গোরা তার সমস্তকে এক করে সংশ্লিষ্ট করে দেখতে পায়, গোরার সেই আশ্চর্য ক্ষমতা আছে–কিন্তু সেইজন্যই কি গোরার সেই দেখাকে দৃষ্টিবিভ্রম বলে মনে করবেন? আর যারা ভেঙে চুরে দেখে তাদের দেখাটাই সত্য?”

সুচরিতা চুপ করিয়া রহিল। বিনয় কহিল, “আমাদের দেশে সাধারণত যে-সকল লোক নিজেকে পরম হিন্দু বলে অভিমান করে আমার বন্ধু গোরাকে আপনি সে দলের লোক বলে মনে করবেন না। আপনি যদি ওর বাপ কৃষ্ণদয়ালবাবুকে দেখতেন তা হলে বাপ ও ছেলের তফাত বুঝতে পারতেন। কৃষ্ণদয়ালবাবু সর্বদাই কাপড় ছেড়ে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে, পাঁজিপুঁথি মিলিয়ে নিজেকে সুপবিত্র করে রাখবার জন্যে অহরহ ব্যস্ত হয়ে আছেন–রান্না সম্বন্ধে খুব ভালো বামুনকেও তিনি বিশ্বাস করেন না, পাছে তার ব্রাহ্মণত্বে কোথাও কোনো ত্রুটি থাকে–গোরাকে তাঁর ঘরের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেন না–কখনো যদি কাজের খাতিরে তাঁর স্ত্রীর মহলে আসতে হয়, তা হলে ফিরে গিয়ে নিজেকে শোধন করে নেন; পৃথিবীতে দিনরাত অত্যন্ত আলগোছে আছেন পাছে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে কোনো দিক থেকে নিয়মভঙ্গের কণামাত্র ধুলো তাঁকে স্পর্শ করে–ঘোর বাবু যেমন রোদ কাটিয়ে, ধুলো বাঁচিয়ে, নিজের রঙের জেল্লা, চুলের বাহার, কাপড়ের পারিপাট্য রক্ষা করতে সর্বদা ব্যস্ত হয়ে থাকে সেইরকম। গোরা এরকমই নয়। সে হিঁদুয়ানির নিয়মকে অশ্রদ্ধা করে না, কিন্তু সে অমন খুঁটে খুঁটে চলতে পারে না–সে হিন্দুধর্মকে ভিতরের দিক থেকে এবং খুব বড়ো রকম করে দেখে, সে কোনোদিন মনেও করে না যে হিন্দুধর্মের প্রাণ নিতান্ত শৌখিন প্রাণ–অল্প একটু ছোঁয়াছুঁয়িতেই শুকিয়ে যায়, ঠোকাঠেকিতেই মারা পড়ে।”

সুচরিতা। কিন্তু তিনি তো খুব সাবধানে ছোঁয়াছুঁয়ি মেনে চলেন বলেই মনে হয়।

বিনয়। তার ঐ সতর্কতাটা একটা অদ্ভুত জিনিস। তাকে যদি প্রশ্ন করা যায় সে তখনই বলে হাঁ, আমি এ-সমস্তই মানি–ছুঁলে জাত যায়, খেলে পাপ হয়, এ-সমস্তই অভ্রান্ত সত্য। কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি, এ কেবল ওর গায়ের জোরের কথা–এ-সব কথা যতই অসংগত হয় ততই ও যেন সকলকে শুনিয়ে উচ্চস্বরে বলে। পাছে বর্তমান হিন্দুয়ানির সামান্য কথাটাকেও অস্বীকার করলে অন্য মূঢ় লোকের কাছে হিন্দুয়ানির বড়ো জিনিসেরও অসম্মান ঘটে এবং যারা হিন্দুয়ানিকে অশ্রদ্ধা করে তারা সেটাকে নিজের জিত বলে গণ্য করে, এইজন্যে গোরা নির্বিচারে সমস্তই মেনে চলতে চায়–আমার কাছেও এ সম্বন্ধে কোনো শৈথিল্য প্রকাশ করতে চায় না।

পরেশবাবু কহিলেন, “ব্রাহ্মদের মধ্যেও এরকম লোক অনেক আছে। তারা হিন্দুয়ানির সমস্ত সংস্রবই নির্বিচারে পরিহার করতে চায়, পাছে বাইরের কোনো লোক ভুল করে যে তারা হিন্দুধর্মের কুপ্রথাকেও স্বীকার করে। এ-সকল লোক পৃথিবীতে বেশ সহজভাবে চলতে পারে না–এরা হয় ভান করে, নয় বাড়াবাড়ি করে; মনে করে সত্য দুর্বল, এবং সত্যকে কেবল কৌশল করে কিম্বা জোর করে রক্ষা করা যেন কর্তব্যের অঙ্গ। “আমার উপরে সত্য নির্ভর করছে, সত্যের উপরে আমি নির্ভর করছি নে’ এইরকম যাদের ধারণা তাদেরই বলে গোঁড়া। সত্যের জোরকে যারা বিশ্বাস করে নিজেদের জবরদস্তিকে তারা সংযত রাখে। বাইরের লোকে দু-দিন দশ-দিন ভুল বুঝলে সামান্যই ক্ষতি, কিন্তু কোনো ক্ষুদ্র সংকোচে সত্যকে স্বীকার না করতে পারলে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি। আমি ঈশ্বরের কাছে সর্বদাই এই প্রার্থনা করি যে, ব্রাহ্মের সভাতেই হোক আর হিন্দুর চণ্ডীমণ্ডপেই হোক আমি যেন সত্যকে সর্বত্রই নতশিরে অতি সহজেই বিনা বিদ্রোহে প্রণাম করতে পারি– বাইরের কোনো বাধা আমাকে যেন আটক করে না রাখতে পারে।”

এই বলিয়া পরেশবাবু স্তব্ধ হইয়া আপনার মনকে যেন আপনার অন্তরে ক্ষণকালের জন্য সমাধান করিলেন। পরেশবাবু মৃদুস্বরে এই-যে কয়টি কথা বলিলেন তাহা এতক্ষণের সমস্ত আলোচনার উপরে যেন একটা বড়ো সুর আনিয়া দিল–সে সুর যে ঐ কয়টি কথার সুর তাহা নহে, তাহা পরেশবাবুর নিজের জীবনের একটি প্রশান্ত গভীরতার সুর। সুচরিতার এবং ললিতার মুখে একটি আনন্দিত ভক্তির দীপ্তি আলো ফেলিয়া গেল। বিনয় চুপ করিয়া রহিল। সেও মনে মনে জানিত গোরার মধ্যে একটা প্রচণ্ড জবরদস্তি আছে–সত্যের বাহকদের বাক্যে মনে ও কর্মে যে একটি সহজ ও সরল শান্তি থাকা উচিত তাহা গোরার নাই–পরেশবাবুর কথা শুনিয়া সে কথা তাহার মনে যেন আরো স্পষ্ট করিয়া আঘাত করিল। অবশ্য, বিনয় এতদিন গোরার পক্ষে এই বলিয়া মনে মনে তর্ক করিয়াছে যে, সমাজের অবস্থা যখন টলমল, বাহিরের দেশকালের সঙ্গে যখন বিরোধ বাধিয়াছে, তখন সত্যের সৈনিকরা স্বাভাবিকতা রক্ষা করিতে পারে না– তখন সাময়িক প্রয়োজনের আকর্ষণে সত্যের মধ্যেও ভাঙচুর আসিয়া পড়ে। আজ পরেশবাবুর কথায় বিনয় ক্ষণকালের জন্য মনে প্রশ্ন করিল যে, সাময়িক প্রয়োজন-সাধনের লুব্ধতায় সত্যকে ক্ষুব্ধ করিয়া তোলা সাধারণ লোকের পক্ষেই স্বাভাবিক, কিন্তু তাহার গোরা কি সেই সাধারণ লোকের দলে?

সুচরিতা রাত্রে বিছানায় আসিয়া শুইলে পর ললিতা তাহার খাটের এক ধারে আসিয়া বসিল। সুচরিতা বুঝিল, ললিতার মনের ভিতর একটা কোনো কথা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। কথাটা যে বিনয়ের সম্বন্ধে তাহাও সুচরিতা বঝিয়াছিল।

সেইজন্য সুচরিতা আপনি কথা পাড়িল, “বিনয়বাবুকে কিন্তু আমার বেশ ভালো লাগে।”

ললিতা কহিল, “তিনি কিনা কেবলই গৌরবাবুর কথাই বলেন, সেইজন্য তোমার ভালো লাগে।”

সুচরিতা এ কথাটার ভিতরকার ইঙ্গিতটা বুঝিয়াও বুঝিল না। সে একটা সরল ভাব ধারণ করিয়া কহিল, “তা সত্য, ওঁর মুখ থেকে গৌরবাবুর কথা শুনতে আমার ভারি আনন্দ হয়। আমি যেন তাঁকে স্পষ্ট দেখতে পাই।”

ললিতা কহিল, “আমার তো কিছু ভালো লাগে না–আমার রাগ ধরে।”

সুচরিতা আশ্চর্য হইয়া কহিল, “কেন?”

ললিতা কহিল, “গোরা, গোরা, গোরা, দিনরাত্রি কেবল গোরা! ওঁর বন্ধু গোরা হয়তো খুব মস্ত লোক, বেশ তো, ভালোই তো–কিন্তু উনিও তো মানুষ।”

সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “তা তো বটেই, কিন্তু তার ব্যাঘাত কি হয়েছে?”

ললিতা। ওঁর বন্ধু ওঁকে এমনি ঢেকে ফেলেছেন যে উনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারছেন না। যেন কাঁচপোকায় তেলাপোকাকে ধরেছে–ওরকম অবস্থায় কাঁচপোকার উপরেও আমার রাগ ধরে, তেলাপোকার উপরেও আমার শ্রদ্ধা হয় না।

ললিতার কথার ঝাঁজ দেখিয়া সুচরিতা কিছু না বলিয়া হাসিতে লাগিল।

ললিতা কহিল, “দিদি, তুমি হাসছ, কিন্ত আমি তোমাকে বলছি, আমাকে যদি কেউ ওরকম করে চাপা দিতে চেষ্টা করত আমি তাকে একদিনের জন্যেও সহ্য করতে পারতুম না। এই মনে করো, তুমি–লোকে যাই মনে করুক তুমি আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখ নি–তোমার সেরকম প্রকৃতিই নয়–সেইজন্যেই আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি। আসল, বাবার কাছে থেকে তোমার ঐ শিক্ষা হয়েছে–তিনি সব লোককেই তার জায়গাটুকু ছেড়ে দেন।”

এই পরিবারের মধ্যে সুচরিতা এবং ললিতা পরেশবাবুর পরম ভক্ত–বাবা বলিতেই তাহাদের হৃদয় যেন স্ফীত হইয়া উঠে।

সুচরিতা কহিল, “বাবার সঙ্গে কি আর কারো তুলনা হয়? কিন্তু যাই বল ভাই, বিনয়বাবু ভারি চমৎকার করে বলতে পারেন।”

ললিতা। ওগুলো ঠিক ওঁর মনের কথা নয় বলেই অত চমৎকার করে বলেন। যদি নিজের কথা বলতেন তা হলে বেশ দিব্যি সহজ কথা হত; মনে হত না যে ভেবে ভেবে বানিয়ে বানিয়ে বলছেন। চমৎকার কথার চেয়ে সে আমার ঢের ভালো লাগে।

সুচরিতা। তা, রাগ করিস কেন ভাই? গৌরমোহনবাবুর কথাগুলো ওঁর নিজেরই কথা হয়ে গেছে।

ললিতা। তা যদি হয় তো সে ভারি বিশ্রী–ঈশ্বর কি বুদ্ধি দিয়েছেন পরের কথা ব্যাখ্যা করবার আর মুখ দিয়েছেন পরের কথা চমৎকার করে বলবার জন্যে? অমন চমৎকার কথায় কাজ নেই।

সুরচিতা। কিন্তু এটা তুই বুঝছিস নে কেন যে বিনয়বাবু গৌরমোহনবাবুকে ভালোবাসেন–তাঁর সঙ্গে ওঁর মনের সত্যিকার মিল আছে।

ললিতা অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিল, “না, না, না, সম্পূর্ণ মিল নেই। গৌরমোহনবাবুকে মেনে চলা ওঁর অভ্যাস হয়ে গেছে–সেটা দাসত্ব, সে ভালোবাসা নয়। অথচ উনি জোর করে মনে করতে চান যে তাঁর সঙ্গে ওঁর ঠিক এক মত, সেইজন্যেই তাঁর মতগুলিকে উনি অত চেষ্টা করে চমৎকার করে বলে নিজেকে ও অন্যকে ভোলাতে ইচ্ছা করেন। উনি কেবলই নিজের মনের সন্দেহকে বিরোধকে চাপা দিয়ে চলতে চান, পাছে গৌরমোহনবাবুকে না মানতে হয়। তাঁকে না মানবার সাহস ওঁর নেই। ভালোবাসা থাকলে মতের সঙ্গে না মিললেও মানা যেতে পারে–অন্ধ না হয়েও নিজেকে ছেড়ে দেওয়া যায়–ওঁর তো তা নয়–উনি গৌরমোহনবাবুকে মানছেন হয়তো ভালোবাসা থেকে, অথচ কিছুতে সেটা স্বীকার করতে পারছেন না। ওঁর কথা শুনলেই সেটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। আচ্ছা দিদি, তুমি বোঝ নি? সত্যি বলো।”

সুচরিতা ললিতার মতো এ কথা এমন করিয়া ভাবেই নাই। কারণ, গোরাকে সম্পূর্ণরূপে জানিবার জন্যই তাহার কৌতূহল ব্যগ্র হইয়াছিল–বিনয়কে স্বতন্ত্র করিয়া দেখিবার জন্য তাহার আগ্রহই ছিল না। সুচরিতা ললিতার প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর না দিয়া কহিল, “আচ্ছা, বেশ, তোর কথাই মেনে নেওয়া গেল–তা কী করতে হবে বল্‌।”

ললিতা। আমার ইচ্ছা করে ওঁর বন্ধুর বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওঁকে স্বাধীন করে দিতে।

সুচরিতা। চেষ্টা করে দেখ্‌-না ভাই।

ললিতা। আমার চেষ্টায় হবে না–তুমি একটু মনে করলেই হয়।

সুচরিতা যদিও ভিতরে ভিতরে বুঝিয়াছিল যে, বিনয় তাহার প্রতি অনুরক্ত তবু সে ললিতার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিল।

ললিতা কহিল, “গৌরমোহনবাবুর শাসন কাটিয়েও উনি যে তোমার কাছে এমন করে ধরা দিতে আসছেন তাতেই আমার ওঁকে ভালো লাগে; ওঁর অবস্থার কেউ হলে ব্রাহ্ম-মেয়েদের গাল দিয়ে নাটক লিখত–ওঁর মন এখনো খোলসা আছে, তোমাকে ভালোবাসেন আর বাবাকে ভক্তি করেন এই তার প্রমাণ। বিনয়বাবুকে ওঁর নিজের ভাবে খাড়া করিয়ে দিতে হবেই দিদি। উনি যে কেবলই গৌরমোহনবাবুকে প্রচার করতে থাকেন সে আমার অসহ্য বোধ হয়।”

এমন সময় “দিদি দিদি” করিয়া সতীশ ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। বিনয় তাহাকে আজ গড়ের মাঠে সার্কাস দেখাইতে লইয়া গিয়াছিল। যদিও অনেক রাত্রি হইয়াছিল তবু তাহার এই প্রথম সার্কাস দেখার উৎসাহ সে সম্বরণ করিতে পারিতেছিল না। সার্কাসের বর্ণনা করিয়া সে কহিল, “বিনয়বাবুকে আজ আমার বিছানায় ধরে আনছিলুম। তিনি বাড়িতে ঢুকেছিলেন, তার পরে আবার চলে গেলেন। বললেন কাল আসবেন। দিদি, আমি তাঁকে বলেছি তোমাদের একদিন সার্কাস দেখাতে নিয়ে যেতে।”

ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “তিনি তাতে কী বললেন?”

সতীশ কহিল, “তিনি বললেন, মেয়েরা বাঘ দেখলে ভয় করবে। আমার কিন্তু কিছু ভয় হয় নি।” বলিয়া সতীশ পৌরুষ-অভিমানে বুক ফুলাইয়া বসিল।

ললিতা কহিল, “তা বৈকি! তোমার বন্ধু বিনয়বাবুর সাহস যে কত বড়ো তা বেশ বুঝতে পারছি। না ভাই দিদি, আমাদের সঙ্গে করে ওঁকে সার্কাস দেখাতে নিয়ে যেতেই হবে।”

সতীশ কহিল, “কাল যে দিনের বেলায় সার্কাস হবে।”

ললিতা কহিল, “সেই তো ভালো। দিনের বেলাতেই যাব।”

পরদিন বিনয় আসিতেই ললিতা বলিয়া উঠিল, “এই-যে ঠিক সময়েই বিনয়বাবু এসেছেন। চলুন।”

বিনয়। কোথায় যেতে হবে?

ললিতা। সার্কাসে।

সার্কাসে! দিনের বেলায় এক-তাঁবু লোকের সামনে মেয়েদের লইয়া সার্কাসে যাওয়া! বিনয় তো হতবুদ্ধি হইয়া গেল।

ললিতা কহিল, “গৌরমোহনবাবু বুঝি রাগ করবেন?”

ললিতার এই প্রশ্নে বিনয় একটু চকিত হইয়া উঠিল।

ললিতা আবার কহিল, “সার্কাসে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া সম্বন্ধে গৌরমোহনবাবুর একটা মত আছে?”

বিনয় কহিল, “নিশ্চয় আছে।”

ললিতা। সেটা কী রকম আপনি ব্যাখ্যা করে বলুন। আমি দিদিকে ডেকে নিয়ে আসি, তিনিও শুনবেন!

বিনয় খোঁচা খাইয়া হাসিল। ললিতা কহিল, “হাসছেন কেন বিনয়বাবু। আপনি কাল সতীশকে বলেছিলেন মেয়েরা বাঘকে ভয় করে–আপনি কাউকে ভয় করেন না নাকি?”

ইহার পরে সেদিন মেয়েদের লইয়া বিনয় সার্কাসে গিয়াছিল। শুধু তাই নয়, গোরার সঙ্গে তাহার সম্বন্ধটা ললিতার এবং সম্ভবত এ বাড়ির অন্য মেয়েদের কাছে কিরূপ ভাবে প্রতিভাত হইয়াছে সে কথাটাও বার বার তাহার মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে লাগিল।

তাহার পরে যেদিন বিনয়ের সঙ্গে দেখা হইল ললিতা যেন নিরীহ কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করিল, “গৌরমোহনবাবুকে সেদিনকার সার্কাসের গল্প বলেছেন?

এ প্রশ্নের খোঁচা বিনয়কে গভীর করিয়া বাজিল–কেননা তাহাকে কর্ণমূল রক্তবর্ণ করিয়া বলিতে হইল, “না, এখনো বলা হয় নি।”

লাবণ্য আসিয়া ঘরে ঢুকিয়া কহিল, “বিনয়বাবু আসুন-না।”

ললিতা কহিল, “কোথায়? সার্কাসে নাকি?”

লাবণ্য কহিল, “বাঃ, আজ আবার সার্কাস কোথায়? আমি ডাকছি আমার রুমালের চার ধারে পেন্‌সিল দিয়ে একটা পাড় এঁকে দিতে–আমি সেলাই করব। বিনয়বাবু কী সুন্দর আঁকতে পারেন!”

লাবণ্য বিনয়কে ধরিয়া লইয়া গেল।


© 2024 পুরনো বই