কীর্তিহাটের কড়চা – ১.৩

পরের দিন এলেন—মিস চন্দ্রিকা মালহোত্রা। মিশ্রিত রক্তের যে লাবণ্য লাল কালোয় মেশানো পপি ফুলে থাকে সেই লাবণ্যে লাবণ্যময়ী। দীর্ঘাঙ্গী। বড় চোখ। পুরু ঠোঁট। বাপ ছিলেন আর্মিতে ডাক্তার-লেফটেনান্ট কর্নেল।

জীবন কেটেছে ভারতবর্ষের বাইরে প্রথম দিকটায়। চন্দ্রিকার মা ছিলেন আসামের খাসিয়া ক্রীশ্চান মেয়ে, ওঁর অধীনে নার্স ছিলেন হংকংয়ে। বিয়ে হয়েছিল সেখানে। তারপর ১৯১৪ সালের যুদ্ধের সময় ইন্ডিয়ান আর্মির সঙ্গে গিয়েছিলেন ফ্রান্সে। তখন চন্দ্রিকা এবং তার মা ছিল দেরাদুনে। চন্দ্রিকা পড়ত সেখানে। দেরাদুন থেকে পাস করে এসেছিল কলকাতায়। ওদিকে তখন যুদ্ধ শেষ হয়েছে। মালহোত্রার ইচ্ছে হয়েছিল হোমে বাস করবে। নিয়ে গিয়েছিল স্ত্রী-কন্যাকে। চন্দ্রিকা বিলেতে গিয়েছিল ১৯১৯-এ। বয়স তখন উনিশ কুড়ি। কলকাতায় থাকতেই সে নিজের গায়ের রং বিচার করে ফ্রক ছেড়ে শাড়ী ধরেছিল। এবং শাড়ী পরেই গিয়েছিল ইংল্যান্ড। সে শাড়ী পরা সেখানে গিয়েও ছাড়েনি। তার সঙ্গে চুল শ্যাম্পু করা—মুখ রঙ করার আর্টেও দক্ষ হয়ে মুর্তিমতী পূর্ব-পশ্চিমের মিশ্র সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। অন্তত ওর ভক্তগণ বলতো তাই। তার মধ্যে ঔপনিবেশ-স্বপ্নাতুর ইংরেজ সন্তানও ছিল।

ওদিকে ডাক্তার মালহোত্রা তখন শ্বেতপুষ্পে কালো ভ্রমরের মত মধুলোলুপ হয়ে উঠেছেন। এবং জুয়াতে মদে রেসের ঘোড়ার মতো দৌড়াতে আরম্ভ করেছেন। তার ফলে একদা পড়লেন জালে জড়িয়ে। জুয়ার সঙ্গে জালিয়াতির এবং সুরার সঙ্গে নারীর সম্পর্ক আঙ্কিক হিসেবে নিবিড়। ওদেশে ডিম যেমন নিরামিষ—তেমন বিচারে ওদেশে এ দুটোর মধ্যেই এক ধরনের আধানিরিমিষ সততা আছে, সেটা এদেশী মালহোত্রার পক্ষে বজায় রাখা সম্ভবপর হয়নি, সুতরাং জালিয়াতির দায়ে এবং অ্যাডালট্রির প্যাঁচে প্রায় একসঙ্গে পড়ে গেলেন। নিঃস্ব হয়েও যখন বাঁচবার সম্ভাবনা রইল না—তখন প্রায় পাগল হলেন। এই সময়েই এই ক্ষুদ্র করদরাজ্যের মহারাজটির সঙ্গে মালহোত্রা পরিবারের হল আলাপ। বয়স্ক ব্যক্তি। চন্দ্রিকার বাপ, কন্যাকে সামনে রেখে এই মহারাজাকে ধরেছিলেন পরিত্রাণের আশায়। তার ফল ভালো হয়নি; তার মা দাঁড়িয়েছিল পথরোধ ক’রে। পাগল আর্মি অফিসার, তাঁর পক্ষে এই পথের বাধা অপসারণে দিশেহারা হবার কথা নয়, পিস্তল বের করে স্ত্রীকে হত্যা করেছিলেন। এবং তারপরই মাথা ভাল হয়েছিল, তিনি নিজেও আত্মহত্যা করেছিলেন। চন্দ্রিকা একাকিনী। সে পথ খুঁজতে গিয়ে দেখেছিল, হয় হোটেলে বাসন ধুতে হয়, নয় ওয়েট্রেস হতে হয়, নয়—। কিন্তু সেখানেও প্রতিদ্বন্দ্বিনী অনেক—যুদ্ধের পর ফ্রান্স জার্মানি রাশিয়া থেকে অনেক মেয়ে ইংলন্ডে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বিয়ের বাজার থেকে পথে ঘাটে হোটেলে সর্বত্র দাম পড়ে গেছে মেয়েদের। সুতরাং মহারাজা যখন তাকে স্পেশ্যাল প্রাইভেট সেক্রেটারির পদ দিলেন তখন সে নিতে দ্বিধা করেনি। সেই পদ নিয়ে সে মহারাজার সঙ্গে দেশে ফেরে। মহারাজা তার প্রতি অনুগ্রহে অকৃপণ। সে বিলিতী নাচ কিছু শিখেছিল—এখানে এসে তিনি তাকে গান বাজনা শিখিয়েছেন। বন্দুক ছুঁড়তেও শিখিয়েছেন। মহারাজার সঙ্গে গল্ফ খেলায় সে সঙ্গিনী। টেনিসেও তাকে দক্ষ করে তুলেছেন। মহারাজা এখন টেনিস খেলেন না, আগে ক্রিকেট টেনিসেও দড় না হলেও তাঁর মহারাজত্বের গুরুত্বের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত। তবে পোলোতে কখনও কখনও এখনও শখ যায়। গোটা কয়েক দেশী ভাষাতেও চন্দ্রিকাকে তালিম নিতে হয়েছিল—তার মধ্যে হিন্দী বাংলা ওড়িয়া অন্যতম। বাংলা সে কিছু আগে থেকেই বুঝত।

এই হল চন্দ্রিকা।

হেমলতা তাকে অভ্যর্থনা ক’রে এনে ঘরে বসিয়ে স্বামীকে ডেকেছিল।

—এসো একবার। আমার বান্ধবী এসেছে!

—বান্ধবী? কালকের সেই মহারাজার নর্মসহচরী—বেগ ইওর পার্ডন প্রাইভেট সেক্রেটারি সুন্দরী!

বসেছিলেন তিনি ঢিলেঢালা একটা আলখাল্লার মত জামা আর কোঁচানো ধুতি পরে। তাই পরেই যাচ্ছিলেন। হেমলতা বলেছিলেন—ও কি?

—কেন?

—পোশাক বদল কর। ও কি? ওই জামাটা—

—পোশাক? কি বিপদ! বলে পোশাক বদলের ঘরে গিয়ে নিজের স্যুটে হাত দিয়ে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর আলনা থেকে হেমলতার একখানা বেনারসী চাদর টেনে নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন।

হেমলতা বলেছিলেন—ওকি?

কেন? শোনাতে হবে বাজনা-এটা কি তার পক্ষে বেমানান হল? খারাপ লাগছে?

তা বলতে পারেননি হেমলতা। বলতে কি চমৎকার দেখাচ্ছিল যোগেশ্বরকে। রায়বাড়ির পুরুষদের চেহারার জন্য খ্যাতি আছে। লম্বা চেহারা, মাজা রঙ, টিকালো নাক, বড় চোখ, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, সুচলো করে পাকানো গোঁফ, তার সঙ্গে লুটিয়ে পড়া কোঁচানো ধুতির সঙ্গে ওই ঢিলেঢালা ধবধবে সাদা মখমলের আলখেল্লার মত জামায় চমৎকার মানায় যোগেশ্বরকে। শৌখিন মানুষটি এসব করেন খেয়াল বলে নয়, অনেক হিসেব করে মানিয়ে দেখে। এখন তার উপর বেনারসী চাদরটার দুটো প্রান্ত গলায় বেড় দিয়ে দুপাশে পা পর্যন্ত ঝুলে পড়তেই মনে হল–বাঃ—এই যোগেশ্বরই আসল যোগেশ্বর, যার পিতামহ প্রপিতামহ জরি মখমলের পোশাক এবং পাগড়ি পরে আর্টিস্টের সামনে বসে অয়েলপেন্টিংয়ের সিটিং দিয়েছিলেন।

হেমলতাকে নিরুত্তর দেখে যোগেশ্বর বলেছিলেন—কি, চুপ করলে যে? হেমলতা হেসে বলেছিলেন—তোমাকে প্রণাম!

—কেন?

—এতও আসে মগজে।

—ভালো লাগছে তো?

—ওয়ান্ডারফুল! কালই বেনারসীর চাদর কিনে আনব!

—রঙিন এনো। সাদা না! চল!

শ্যাম্পুকরা চুল—রঙকরা মুখ—পালিশকরা নখ; জর্জেট-পরা দীর্ঘাঙ্গী চন্দ্রিকা মালহোত্রা- সিগারেট খেতে-খেতে দেওয়ালের ছবি দেখছিল। ১৯২৪ সালের চৈত্র মাস। তখন অবনীন্দ্রনাথের পরে নন্দলাল অসিত হালদার এঁরা এসেছেন; যামিনী রায় তখনও ঠিক আসেননি। অবনীন্দ্রনাথ নন্দলালের ছবির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল চন্দ্রিকা, হাতের আঙুলে সিগারেট পুড়ছিল!

—মিস মালহোত্রা—

ফিরে তাকিয়ে মিস মালহোত্রা সবিস্ময়ে চোখ বড় করে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলেন। একেবারে কোমর থেকে ভেঙে নুয়ে বাউ করেছিলেন যোগেশ্বর।—গুড আফটার-নুন!

হেমলতা বলেছিলেন—আমার স্বামী!

হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল চন্দ্রিকা এবং বলেছিল- ও! হাউ ওয়ান্ডারফুল ইউ লুক! আমি ভেবেছিলাম—

—এ বাজাওলা উস্তাদ ফ্রম ইউ পি অর পাঞ্জাব—

খিল-খিল করে হেসে উঠেছিল চন্দ্রিকা। বারবার বলেছিল-নো-নো-নো—আমি ভেবেছিলাম মুরশিদাবাদি নবাব শাহীর কোন তনখা-পানেওলা আমীর—

—এই দাড়ির জন্যে? তা বলতে পার। কিন্তু আমরা হলাম পুরনো জমিদার। এই যে আলখাল্লাটা দেখছ এটা আমাদের বৈরাগীদের পোশাক। কোঁচানো ধুতি আর এই চাদর দিয়ে ভোগ এবং বৈরাগ্যের সমন্বয় হয়েছে।

—কি সুন্দর ব্যাখ্যা করলে তুমি। ওয়ান্ডারফুল। ওয়ান্ডারফুল। জান তোমার লেখার ভক্ত আমি। মহারাজাকে কাগজ পড়ে শোনাতে হয় আমাকে। কিন্তু লেখাতে তো তোমার এ পরিচয় নেই? সেখানে তো তুমি তলোয়ার খেল খাঁটি ইংরিজী ঢঙে।

হেমলতা বলেছিলেন—বসে কথা বললে ভাল হয় না?

—নিশ্চয়ই। আমি দুঃখিত—তোমাকে আমি দাঁড় করিয়ে রেখেছি।

বসে কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। সুরেশ্বর এসে বসেছিল। হেমলতা শুনছিলেন কিন্তু সুরেশ্বর চুপ করে শোনেনি, সে মধ্যে মধ্যে কথার মধ্যে কথা বলেছিল। এবং বেমানান ভাবে বলেনি, বেশ মানানসই করে বলেছিল।

মিস মালহোত্রা বার বার তারিফ করেছিলেন সুরেশ্বরের কথায়। সে যা বলেছে তা আবোল তাবোল নয়, হয়তো বলার ভঙ্গিটা ছেলেমানুষের প্রকাশ চেষ্টায় আবোল-তাবোল মত শুনিয়েছিল। ঈশ্বর নিয়ে তর্ক হচ্ছিল। যে তর্ক জগতে সব থেকে বেশি হয় এবং যে তর্কে নেই বললেও হারে না, আছে বললেও হারে না-তারই মাঝখানে হেমলতা এক সময় বলেছিলেন—কেন এ সব তর্ক করছ বলো তো? সে থেকেও তোমাকে দিক করে না, না থাকলেও তোমার বৃদ্ধি হয় না, তাকে নিয়ে কেন চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলছ?

সুরেশ্বর বলে উঠেছিল—God is nothing but botheration.

হো-হো করে হেসে উঠেছিলেন সকলে। মিস মালহোত্রা বলেছিলেন—Wonderful.

সুরেশ্বর অপ্রতিভ হয়নি। বলেছিল—তার থেকে তুমি বেহালা বাজাও না বাবা, মা বলছিল তুমি আজ বাজাবে!

—আন, তাই আন। কিন্তু কি বাজাব? আপ ফরমাইয়ে!

—আমি? না-না-না—যা খুশি তোমার।

—সন্ধে হয়ে আসছে, পুরবী বাজাও বাবা!

হেমলতা বলেছিলেন—না, তা হলে আর কিছু জমবে না এরপর।

ছড়ি টেনেছিলেন যোগেশ্বর। একটু বাজাতেই সুরেশ্বর বলেছিল—বসন্ত, না বাবা? ছড়ি টানতে টানতেই ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিলেন যোগেশ্বর।

* * *

মিস মালহোত্রা চলে গেলে যোগেশ্বর বলেছিলেন-এদের কেন ডাক?

—কেন?

নাঃ। এরা হল আলাদা জাত- এদের হল আলাদা ধাত!

একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন হেমলতা। কিন্তু পরের দিনই মহারাজার পুরুষ সেক্রেটারী এসে যোগেশ্বরকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন লাউডন স্ট্রীটের বাড়িতে। একলা নয়—স্ত্রী-পুত্র সমেত যোগেশ্বরকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন চায়ে। চায়ের নিমন্ত্রণ শেষ করতে প্রায় ডিনারটাইম হয়ে গিয়েছিল। আগের কথায় বংশপরিচয় থেকে শুরু করে খেলা-শিকার-সঙ্গীত থেকে পলিটিক্স পর্যন্ত। এরই মধ্যে মহারাজা হঠাৎ বলেছিলেন, মিস্টার রয়, তোমার সঙ্গে আমার কিছু প্রাইভেট কথা ছিল। যদি আপত্তি না থাকে তবে এস না, আমরা আধঘণ্টার জন্যে ওঘরে কথা বলে নিই। চন্দ্রিকা, তুমি মিসেস রয় এবং মাস্টার রয়কে দেখাও না সব।

ঘরে নিয়ে গিয়ে মহারাজা বলেছিলেন—দেখো রয়, তোমার লেখা আমি পড়ি। তা ছাড়া আমি চন্দ্রিকার কাছে তোমার কথা শুনে দু-চারজনের কাছে পরামর্শ নিয়েছি। তারা তোমার কলম সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে। আমার স্টেট সম্পর্কে প্রজারা এই সব কংগ্রেসী লিডারদের উস্কানিতে সহায়তায় নানান নিন্দার কথা অশাসন-কুশাসনের কথা ভেন্টীলেট করছে, দরখাস্ত পাঠাচ্ছে। পলিটিক্যাল এজেন্ট এতে আমার উপর সুবিধে নিতে চাচ্ছে। আমি চাই আমি কি করেছি—সেই কথা প্রকাশ করতে। তুমি আমাকে হেল্প কর। কাজটার ভার নাও।

গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন যোগেশ্বর। এ যোগেশ্বর জার্নালিস্ট যোগেশ্বর। যে যোগেশ্বর দেশের সুলভ মতামত উপেক্ষা করে দীর্ঘদিন ইংরেজ রাজত্বকে সমর্থন করে এসেছেন। যে যোগেশ্বর উনিশশো একুশে চাকরি ছেড়েছেন। যে যোগেশ্বর নন কো-অপারেশন মুভমেন্টের ব্যর্থতায় হিন্দু শাস্ত্র সংহিতা পড়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে উচ্চ কণ্ঠে বলেছেন—“অহিংসা একটি মনোরম রোমান্টিক স্বপ্ন—প্রায় ঈশ্বরের মত। বাস্তবের সম্পূর্ণ বিরোধী। অবাস্তব বললেও যথেষ্ট বলা হয় না। মানবসমাজ এবং সভ্যতাকে ক্ষীণবল করে এতকালে বহুকষ্টে অর্জিত মনুষ্যত্বের বিকৃতি ঘটায় ক্লীবত্বে অর্থাৎ সভ্যতার বংশধারা বা স্রোতোধারায় ছেদ টেনে দেয়। এমন কি যদি সব দেশের সব মানুষ অহিংস হয়েই বসে, যুদ্ধও আর না হয়, তবে সেদিন দলবদ্ধভাবে বনের বাঘ সিংহ হিংস্র জন্তুরা মানুষকে আক্রমণ করে পরমানন্দে পশু-রাজত্বের সৃষ্টি করবে।”

এ লিখেও নিন্দাকে সমালোচনাকে ভয় করেননি যে যোগেশ্বর সেই যোগেশ্বর। তিনি বলেছিলেন—মহারাজা, এ ভার নিচ্ছি এ কথা তো বলতে পারব না। যতক্ষণ সব না জেনেছি। বেশ, তোমাকে আমরা সব তথ্য দিচ্ছি। ফুল স্ট্যাটিস্টিক্‌স্ দিয়ে দেব আমি। হেসে যোগেশ্বর বলেছিলেন—স্ট্যাটিস্টিক্স আর সত্য এক নয় মহারাজ।

—বেশ, তুমি এস আমার স্টেটে। দেখ সব!

—পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যে দেখব সব?

—নিশ্চয়!

—ভেবে বলব কাল।

—আমি তোমাকে বিলেতের কাগজে যে পেমেন্ট করে, তাই করব। এবং সব খরচ আমি বহন করব। যদি মাইনে নিয়ে কাজ করতে চাও—

—না। ওদিকে আমি প্রথমটাতে রাজী! তবে ভেবে দেখব!

—তুমি একবার স্টেটে এসে সব দেখো রয়। প্লিজ। ফার্স্টক্লাস বাংলো-মোটর-এভরিথিং। তুমি মিসেস রয়কে নিয়ে চলো, দেখো।

—কাল বলব মহারাজা!

পথে ভাবতে ভাবতে এসেছিলেন, কথাটা হেমলতাকেও বলেছিলেন। হেমলতা বলেছিলেন—দেখ!

—কি?

—কাল বলছিলে চন্দ্রিকার জন্যে যে ওকে কেন আনলে?

—হুঁ। বলেছিলাম।

—এখন?

—এখন?

—হ্যাঁ এখন?

—বলতে পারছি না! ভেবে দেখি।

***

কাজ নিয়েছিলেন যোগেশ্বর। চন্দ্রিকা নিজে এসেছিল মত জানতে। মত তিনি দিয়েছিলেন। হেমলতা বলেছিলেন—এবার বল!

—কি?

—ডেকে ভাল করেছিলাম কি না?

—কর্মের একটা চক্র আছে হেম!

হেসে হেমলতা বলেছিলেন—তবু বলবে না যে ভাল করেছিলাম!

—নিশ্চয় বলব। তা বলব। যা ঘটবার তাই যখন ঘটে তখন সেই ভালো। যা ঘটবার নয় তা ঘটাতে গেলে বা ঘটালে পৃথিবীতে যতিভঙ্গ হয়—সুর কাটে। আমার মত জার্নালিস্টের পক্ষে এইটেই ঘটবার। আমি জমিদারের বংশধর। জার্নালিস্ট হয়েছি। ওই কংগ্রেসী সুরে সুর মেলাতে গেলে বেসুর বলতাম। সংসারে যারা বেসুর বলে এ যুগে তাদের বলে বিদ্রোহী। তারা জিতলে দেবতা হয় হারলে অসুর নাম পায় ইতিহাসে। সে রিস্ক আমি নিতে নারাজ!

এক বছর পর হেমলতাকে বসে থেকে যোগেশ্বর যে চিঠি লিখেছিলেন তার গোড়াতেই এই কথাটার উল্লেখ করেছিলেন—তিনি চন্দ্রিকাকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন ইউরোপ।

গোড়াতেই লিখেছিলেন—তোমাকে এই চন্দ্রিকা পর্বের গোড়াতেই বলেছিলাম তুমি ওকে কেন আনলে? তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে–কেন? দোষ কি হল? বলতে সেদিন পারিনি, আজ লিখে জানাচ্ছি—দোষ তোমার নয়, দোষ আমার, আমি ওকে দেখে এক মুহূর্তে ক্লোরোফর্ম করা মানুষের মত চেতনা হারিয়ে ফেলেছিলাম। ওর রূপসজ্জা, ওর ভঙ্গি, ওরা শ্যাম্পুকরা চুলের গন্ধ সত্যিই যেন ক্লোরোফর্মের মিষ্টি গন্ধের সঙ্গে একমাত্র তুলনীয়। তবু আমি প্রাণপণে লড়াই করে চেতনাকে জাগিয়ে রেখেছিলাম অনেকদিন। তুমি জানো পরদিন চন্দ্রিকা এসেই আমার মত আদায় করে ছেড়েছিল। কি বলেছিল জান—বলেছিল—রয় প্লিজ, প্লিজ তুমি অমত কোরো না। প্লিজ! আমার চোখে নেশার ঘোর ছিল। সেই ঘোরের মধ্যেই বলেছিলাম, কেন? আমাকে নেবার জন্য এত ব্যস্ত কেন? মহারাজাকে তুমি এত ভালবাস। সে বলেছিল—উল্টো! ঠিক উল্টো রয়। তুমি যদি স্টেটের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হও তবে আমি পরিত্রাণ পাই। আমার নিশ্চিত ধারণা আমি পরিত্রাণ পাব। জিজ্ঞাসা করেছিলাম—মানে কি বল তো। সে বলেছিল—রয়, আমাকে মহারাজা আসলে কিনেছে। আমার বাবা আমাকে বিক্রি করেছিল। আমি একটা সাংঘাতিক দলিলে সই করেছি। এক লক্ষ টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছি—আমার চাকরির উপর। আমার এ থেকে পরিত্রাণ নেই। তুমি যদি এস রয়—আমি তোমাকে অনেক ফ্যাক্টস্ দেব প্রমাণ দেব, তার দাবিতে তখন হয়তো মুক্তি পেতে পারব। আমি বলেছিলাম—কিন্তু মহারাজা তো তোমাকে খুব সুখে রেখেছেন চন্দ্রিকা! চন্দ্রিকা বলেছিল- তার থেকে মৃত্যু ভাল। কিন্তু মরতে আমার ভয় করে। আমি নিজে উপরে দরখাস্ত করতে পারি না—আমাকে গুলী করে মেরে দেবে! তুমি এদের জান! তবু আমি বলেছিলাম, কিন্তু আর কি এখান থেকে মুক্তি নিয়ে সাধারণ জীবনে ফিরে যেতে পারবে? সে বলেছিল—রয়, আমি তখন সাধারণ মেয়ের মত সাধারণ মানুষের কাছে নিজেকে বিক্রী করেও বাঁচতে পারব। আমি আর আত্মসম্বরণ করতে পারিনি, বলেছিলাম-আমার ফার্স্ট অফার রইল। চন্দ্রিকা বলেছিল-আমি নিজেকে ইন অ্যাডভান্স তোমাকে দিয়ে রাখলাম। এনগেজমেন্টও করে গিয়েছিল : সেটা একটা বড় হোটেলে। মহারাজার সেদিন ডিনারে নেমন্তন্ন ছিল গভর্নমেন্ট হাউসে।

থাক ওসব কথার বিশদ বিবরণে প্রয়োজনও নেই, আমার নিজেরও অপরাধবোধ মরে যায়নি। হেম, এ বোধহয় একটা ব্যাধি। এ বোধহয় নিয়ে জন্মেছিলাম। কারণ তার সংক্রমণের সূত্র আমি দেখতে পাচ্ছি আমার জন্মদাতার জীবন থেকে। তোমাকে বিবাহের পূর্বে এ ব্যাধি আমাকে প্রায় বাঁধা বন্য-জন্তুর মত বা জোতা-ঘোড়ার মত এই মুখে চালাচ্ছিল। চলতে তো আমার বাধা ছিল না। অর্থ ছিল। তার উপর সমাজের যেটা তাড়না বা ভয় তাতেও ছিলাম বেপরোয়া। কিন্তু বাবার একটা মেসেজ ছিল-আমার কাছে। দাদার কাছেও ছিল। সেটা সীল-করা কভারে তিনি দিয়েছিলেন—আমাদের অ্যাটর্নীকে। সেটা তাঁর উইলের সঙ্গে পেয়েছিলাম। লেখা ছিল-’পিতার যদি কোন অধিকার থাকে পুত্রকে উপদেশ দেবার তবে উপদেশ রইল নারী-বিলাস থেকে দূরে থেকো। যদি তা সম্বরণ করতে নাই পার, তবে বিবাহ করে সংসারী হয়ো না।’ কারণটা অজানা ছিল না। আমার বাল্যকালে আমার এক মেম গভর্নেস ছিল। তিনি তাঁর প্রেয়সী ছিলেন। আমাকে চড় মারার জন্য আমার দাদা তাকে ঘোড়ার চাবুক দিয়ে মেরেছিলেন! তারপর মেমসাহেব গেল চলে, বাবা তাকে অনুসরণ করে এসেছিলেন কলকাতায়। এটা প্ৰত্যক্ষভাবে জানতাম। তখন আমার পিতামহ বেঁচে। তখন থেকেই আমরা তাঁর থেকে স্বতন্ত্র বাস করেছিলাম। পিতামহের মৃত্যুর পরও বাবা স্বতন্ত্র থেকেছিলেন কিছুদিন। তারপর তিনি অন্য মানুষ হতে চেয়েছিলেন। সে আত্মনির্যাতন আমি দেখেছি। এবং তখন আভাসও পেয়েছি—তাঁর প্রথম জীবনের উদ্দাম গতির বিচিত্র কথার। সেই কারণেই আমি দীর্ঘদিন বিবাহ করিনি—এবং উদ্দাম গতিতে ছুটতে গিয়েও ভয়ে নিজেকে সংযত রেখেছি। তারপর তুমি এলে জীবনে। তুমি দেখেছ প্রমাণ পেয়েছ আমি কি হয়েছিলাম বা হতে চেষ্টা করেছিলাম। ইদানিং ভাবতাম আমি সব সংকট পার হয়ে এসেছি। কিন্তু না।

পিতামহ ছিলেন পুণ্যবান পবিত্র চরিত্র মানুষ। অন্তত চরিত্রের দিক থেকে। বিষয়ী হিসেবে তাঁর দোর্দণ্ডপ্রতাপের পরিচয় চোখে দেখেছি। জীবনযাপনের ধারা দেখেছি। এ যুগে আমার শিক্ষানুযায়ী তাঁর জীবনকে বলব আত্মনির্যাতন। অর্থহীন আত্মনির্যাতন। তিনি আমাদের শিখিয়ে ছিলেন—একটা কথা। শিখিয়েছিলেন সংসারে মানুষের জীবনে নারীর সঙ্গে সম্পর্ক দুটি। দুটি সম্পর্কের একটি ভেঙে আবার দুটি হয়েছে। এক পুরুষ আর প্রকৃতি। মানুষের জীবনে এই সম্পর্ক একটি পুরুষের সঙ্গে একটি নারীর। অন্যটি মাতা আর পুত্র। সেটা বয়সভেদে হয় কন্যা আর পিতা। এইটেই জগৎজোড়া। এর অন্যথায় তুমি স্বর্গ নরক মানলে নরকে পড়বে, না মানলে তোমাকে ফিরতে হবে জন্তু জীবনে। অথবা তাকে হতে হবে সেই পুরুষ যাকে পাপপুণ্য দেশ সমাজ কিছু স্পর্শ করতে পারবে না—তার নাগাল পাবে না।

কথাটা সত্য। চন্দ্রিকার সঙ্গে জীবনের গ্রন্থি লাগল। সেটা যদি মা বা কন্যার মন্ত্রে গ্রন্থি পড়ত! কিন্তু না, তা পড়ল না। আজ একটা বছর আমি নানান অজুহাতে মহারাজার স্টেটে কাটিয়েছি ঘুরেছি সে কেবল চন্দ্রিকার জন্য। যখন চন্দ্রিকাকে জীবনে জড়িয়েছি তখন চেষ্টা করেছি এই রকম পুরুষ হতে; পাপপুণ্যের দেশসমাজের ঊর্ধ্বের পুরুষ। কিন্তু তা পারিনি। সে সহজ নয়। সহজ সাধারণের মত অবস্থায় পড়লাম। ওদিকে মহারাজা, এদিকে তুমি এবং সুরেশ্বর। একদিকে ভয়, অন্যদিকে নিদারুণ অপরাধবোধ। মহারাজা জানতে পারলে গুলি ক’রে মারত! এদিকে তুমি জানলে কি হত তা কল্পনাও করতে পারিনি। ফলে জন্তুর অধম চোরের মত তার সঙ্গে মিশেছি। আমার সম্পদ আমার সহায়তা করেছে। বাঘের নখ আর দাঁতের মতো মানুষের এই সম্পদ আর প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আর গোপন রইল না। মহারাজা জেনেছেন। সুতরাং শিকারীর বনভাঙার শব্দে ভীত জন্তুর মত চন্দ্রিকাকে নিয়ে বিদেশ পালানো ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই। আজই জাহাজ ছাড়বে। বম্বে থেকে চলে যাচ্ছি চন্দ্রিকাকে নিয়ে। ব্যাঙ্কের পাস বইয়ে তিন লক্ষ টাকা মজুত আছে। তার দু-লক্ষ আমি নিলাম। এক লক্ষ টাকার চেক কেটে বাড়ীঘর সম্পত্তির দলিল তোমাদের নামে করে দিয়ে বম্বের অ্যাটর্নীকে দিলাম—তারা যথাসময়ে তোমাদের কাছে পৌঁছে দেবে। সম্পত্তি যা পৈতৃক তা সুরেশ্বরের রইল-এ অধিকার ওর জন্মগত। তবে শর্ত রাখলাম যতদিন তুমি বাঁচবে ততদিন সব কাজে তোমার মত নিতে হবে। তোমাকে আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আর এক লাখ টাকার অর্ধেক পঞ্চাশ হাজার নির্বঢ় স্বত্বে।

মার্জনা করতে বলব না। বলব অভিসম্পাতই দিয়ো। অন্য দেশের মত ডাইভোর্স নেই। থাকলেও আমি বলতে পারতাম না। তোমাকে আমি আজও ভালোবাসি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমার কোন শক্তি আজ নেই, আমি ভেসে যাচ্ছি একটা দুর্দান্ত আকর্ষণে। কি মোহ এই মেয়েটার! ওঃ!

সুরেশ্বরকে বাঁচাতে চেষ্টা করো। কিন্তু তাকে বন্ধনেও বেঁধো না। মানুষ কেউ কাউকে বাঁচাতে পারে না হেম। মানুষ বাঁচে নিজে। তার বীজ থাকে তার চরিত্রে। সে চরিত্র আপনি গড়ে। অন্যে যেটা গড়ে দেয় সেটা খড়ের কাঠামোর উপর চাপানো মাটি আর রঙ। কালে ফাটে—জলে গলে। ইতি—

যোগেশ্বর রায়।


© 2024 পুরনো বই