কীর্তিহাটের কড়চা – ১.২

রাত্রি হয়েছিল সুরেশ্বরকে বের করে আনতে। সার্জেন্টের হাতে সে মার খেয়েছিল। থানার লকআপ থেকে বের করে আনতে হয়েছিল। তাতে সুরেশ্বর অপ্রতিভ হয়নি, লজ্জিত হয়নি, সগৌরবে ঘোষণা করে বলেছিল—আমি ওকে ইট মারতে পারতুম কিন্তু মারতে মানা। অহিংসার মানে কি হয় বাবা?

যোগেশ্বর আগে হ’লে বলতেন—কাউয়ার্ডিস। ভীরুতা হল এর মানে। কিন্তু সেদিন তা বলতে পারেননি। বেটনের ঘায়ে সুরেশ্বরের পিঠে কয়েকটা দাগ উঠেছিল। তিনি তার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—

—মার খেয়ে তুমি বলেছিলে- আর করব না?

না। সবেগে ঘাড় নেড়ে অস্বীকার করে সে বলেছিল-আমি বন্দে মাতরম বলেছিলাম!

—তুমি এখন শুয়ে পড়। এখুনি ডাক্তার আসবেন।

এরপর একলা ঘরে পায়চারি করেছিলেন। মধ্যে মধ্যে অস্ফুট কণ্ঠে বলেছিলেন—He is the man. Yes, He is the man.

চাকর হুইস্কির বোতল গ্লাস সোডা দিয়ে গিয়েছিল, প্লেটে মাংসের বড়া-হেমলতার নিজের তৈরী, দিয়েছিল, তার সঙ্গে স্যালাড এবং একটা কাটলেট। যা তাঁর নিত্যকারের খাদ্য। কিন্তু ও-সবের আকর্ষণেও তিনি চেয়ারে এসে বসেননি। সেই ঘুরেই বেড়াচ্ছিলেন। ছেলেকে ডাক্তার দেখিয়ে ঘুম পাড়িয়ে হেমলতা তাঁর ঘরে এসে ঢুকে সবিস্ময়ে বলেছিলেন—একি? এখনও ঘুরপাক খাচ্ছ? ভয় নেই, বস, সুরো ঘুমিয়েছে, ডাক্তার দেখে বললে—হ্যাঁ—মার খেলেই দাগ ওঠে। নাথিং সিরিয়াস। হাসপাতালে একে বলে মাইনর ইনজুরি।

—হুঁ। আর একটা পাক ঘুরে আসতে আসতেই হেমলতার কানে তাঁর ওই He is the man কথাটা গিয়েছিল। বলেছিলেন—কি বলছ?

—ঠিক হয়েছে। আচ্ছা, বলো তো এদেশের সব থেকে বড়লোক—আই মীন গ্রেটেস্ট মেনদের নাম। ফাইভ অর সিক্স।

—কেন, রামমোহন রায়?

—তাঁর নাম—কীর্তিহাটের লোকে জানে? তাছাড়া উনি তো টাটকা। পাঁচ হাজার বছর পর যাদের নাম থাকবে—ফাইভ—বলো!

—তা হলে—। শ্রীরামচন্দ্র—শ্রীকৃষ্ণ—

—ওঁরা অবতার।

তা হ’লে—বুদ্ধ, শঙ্কর, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ—

দ্যাটস ইট। করেক্ট। এদেশে রাজা রাজপুত্র বীর—এরা নয়—বুদ্ধ, শঙ্কর, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ দিজ সন্ন্যাসীজ—এরাই বড়। এরাই বেঁচে থাকে। এবং If I am not wrong, একটু ভেবে বলেছিলেন—no-I am not wrong, this man this Mr. Gandhi—he is one of them. লোকটা ঘরে থাকবে না। নিশ্চয় চলে যাবে ঘর ছেড়ে। দেখো।

—তোমার হ’ল কি? বস, খাও। খাবার জুড়িয়ে গেল—

—যাক। বোতল গ্লাস সোডা নিয়ে যেতে বল। এক গ্লাস ঠান্ডা জল দিয়ে যাও! -না না—পাগলামী কোরো না, এতদিনের অভ্যেস। বরং কমাতে পার।

—নো। মরদ কি কত-হাতী কি দাঁত। আমি বন্য শূকর নই। শুকরেরও দাঁত থাকে—সে দাঁতে কোন কাজ হয় না!

খাননি মদ।

পরদিন সকালে উঠে চলে গিয়েছিলেন বাজারে, চীৎপুর বেন্টিঙ্ক স্ট্রীট অঞ্চলে। হেমলতা বলেছিলেন—কোথায় যাচ্ছ?

—আসছি। ব্যস্ত হোয়ো না।

ঘণ্টা দেড়েক পরেই ফিরে এসেছিলেন এক সেতার এবং এক বেহালা নিয়ে।

হেমলতা সবিস্ময়ে বলেছিলেন—ও মা! এ কি হবে?

—বাজাবো।

—এই বুড়ো বয়সে সারেগামাপাধানিসা? কি খেয়াল তোমার?—হেমলতা তাঁর বিবাহিত জীবনে স্বামীর সঙ্গীতানুরাগের কোন পরিচয় পাননি। যোগেশ্বর হেসে বলেছিলেন—ক্ষণেক অপেক্ষা কর।

ব’লে বেহালাখানা নিয়ে সুর বেঁধে বাজিয়েছিলেন কিছু। এবং অতি নিপুণ সুন্দরভাবে বাজিয়েছিলেন।

অবাক হয়ে গিয়েছিলেন হেমলতা। কথা বলতে পারেননি। সুরেশ্বরও এসে দাঁড়িয়েছিল। যোগেশ্বর হেসে প্রশ্ন করেছিলেন—কি বাজালাম জান?—

সুরেশ্বর বলেছিল—আমি বলব বাবা?

—পার বলতে? হ্যাঁ তা পারবার কথা। বল

—একি রূপ হেরি হরি ধরেছ যোগীর বেশ—। বাগেশ্রী।

—রাইট। তারপর হেমলতার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—গ্রামোফোনের সামনে বসে ওর গান শোনা এবং গলা মেলানো দেখ নি! কিন্তু গলা নেই। তবে সঙ্গীত রোগটা আমাদের রক্তে আছে বংশগত! শুনেছি আমাদের পূর্বপুরুষে একজন ছিলেন মস্ত বড় সাধক আর গানে ছিলেন সিদ্ধহস্ত অর্থাৎ যন্ত্রী!

—কই, আমাকে তো কখনও বলনি—

—কি বলব? ছেলেবেলা কীর্তিহাটে ছিলাম ক’বছর। ঠাকুরদা তখন বেঁচে। তখন শিখেছিলাম। কিন্তু বাবা আমাকে বারণ করেছিলেন। বলেছিলেন, ওটা তুমি শিখো না। তা হলে আর কিছু হবে না। বৃদ্ধ বয়সে ওটা নিয়ে বসো। তখন কল্যাণ হবে।

—সে বয়স এই চল্লিশ বছর বয়সেই হল?

—হল বই কি! আজ থেকে বানপ্রস্থ

এর অর্থটা ঠিক বুঝতে পারেন নি হেমলতা। মানে চেষ্টাই করেন নি। দুপুরবেলা খেয়ে শোবার সময় বলেছিলেন-দেখ আমাকে আজ আর ডেকে ঘুম ভাঙিয়ো না। মানে নট বিফোর ফোর। কোচম্যানকে বলে দিয়ো গাড়ী চাই না।

—আপিসে যাবে না?

—না, ওবেলাতেই চুকিয়ে দিয়েছি পাট!

—কি যে হেঁয়ালী কর—

—বলি নি তোমাকে, চাকরি ছেড়ে দিয়েছি!

ছেড়ে দিয়েছ? বিস্ময়ের অবধি ছিল না হেমলতার। কারণ জালিয়ানওয়ালাবাগের সময় থেকেই সে বহুবার অনুরোধ করেছে সায়েবদের ইংরিজী কাগজ ছাড়তে। কিন্তু যোগেশ্বর ছাড়েন নি। বলেছিলেন—হেম, সেন্টিমেন্ট ইমোশন বড় সর্বনাশা। ওর একসেস যখন হয় তখন আত্মহত্যার ঝোঁক চাপে মানুষের। পাথরে মাথা ঠোকে মানুষ—মাথা রক্তাক্ত হয়। পাথর ভাঙে না—মানুষের মাথা ভাঙে। এই পাথরে কাঁচা মাথা ঠুকে মাথা ভেঙে আত্মহত্যার সেন্টিমেন্টাল ইমোশনালিজম থেকে জাতটাকে বাঁচানো আমার মিশন। অন্যে না বুঝুক, তুমি অবুঝ হয়ো না। বিশ্বাস রাখ আমি বুঝি। অনেক বুঝি। এই ইংরেজ জাত যত বড় তত নিষ্ঠুর! আজ সেই লোক চাকরি ছেড়ে দিয়েছে শুনে হেমলতা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন!

যোগেশ্বর বলেছিলেন—অবাক হয়ে গেছ?

—তা হয়েছি!

—দুঃখিত হয়েছ?

—না। খুশী হয়েছি।

—সত্য কথা?

—তার থেকেও বেশী কিছু! বোঝাতে পারব না তোমাকে!

—তাহলে—

—কি—

—তাহলে—গিভ মি এ—

—পাগল! উন্মাদ! এত বড় ছেলে পাশের ঘরে!

—তা বটে। জানো ওই ওরই জন্যে-না ওর জন্যে নয়, ও আমার একটা দুরন্ত ভয় ঘুচিয়ে দিয়েছে। আই ওয়াজ এ কাওয়ার্ড! ভয়ে বলতাম ইংরেজ পাথর। ও মাথা ঠুকে অক্ষত মাথা নিয়ে ফিরে এসে আমাকে দেখিয়ে দিল যে, না, তা নয়।

—যাক। তুমি ঘুমোও। আমি সুরোকে ঘরে বদ্ধ করেছি। তার কাছে যাই। বিকেলে কিন্তু খদ্দর কিনতে যাব। সুরোকে কথা দিয়েছি।

—শোন-আর একটা কথা।

—কি?

—আমাকে ঘুম পাড়িয়ে মা-বেটা দুজনেই যেন বেরিয়ে পড়ো না পিকেটিংয়ে।

—ঠাট্টা হচ্ছে?

—মোটেই না। বুড়ো বয়সে বিয়ে করেছি। সুন্দরী প্রগতিশীলা লেখাপড়া জানা মেয়ে তুমি। তবুও কোনদিন বুড়ো বয়সের ব্যাধি যেটা সেটাকে প্রশ্রয় দিইনি। মানে সন্দেহবাতিক। আজ ভয় হচ্ছে—ছেলের কাছে ঘায়েল হয়ে কাত হয়েছি। তুমি তাতে পুলকিত। আনন্দে আটখানা হয়ে খদ্দর কিনতে যাচ্ছ। দেখো, উৎসাহবশে দোকান থেকে বেরিয়েই পিকেটিংয়ে নেমো না মা বেটায়!—জেলে যাও, কষ্টেসৃষ্টে বিরহ সইতে পারব। কিন্তু উদ্বেগের সীমা থাকবে না, মনে মনে কোন পিকেটিং রণনিপুণ প্রদীপ্ত পুরুষকে জয়মাল্য দিলে।

হেমলতা সেকালের আধুনিকা। কালটা একদিকে যেমন ক্ষোভ আর রোষের যুগ তেমনি রসের যুগ। রবীন্দ্রনাথের কাব্যরসে গৌড়ভূমি ভেসে গেছে। হেমলতা রাগ করেন নি। তিনি হেসে বলেছিলেন—দেখ, তোমার এই রসবোধের জন্যই বয়সের বার তের বছর তফাত সত্ত্বেও আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। তোমরা জমিদার, তুমি জার্নালিজমে নামী লোক, শৌখিন সাহেব মানুষ, তোমার ফ্রেঞ্চছাঁট দাড়ি আছে, সে জন্যে নয়। আজ এই চাকরি ছাড়লে মদ ছাড়লে এর জন্যে admiration—প্রায় ভক্তিবাদে এসে পৌঁচেছে! ভেবো না। ইন্দ্র হাতছানি দিয়ে শচীত্ব অফার করলেও আমি মরতে চাইব না তোমাকে ফেলে! বলে স্বামীর ঠোঁটের উপর ঠোঁট রেখেছিলেন।

যোগেশ্বর পরবর্তীকালে বলতেন—ওই দিনটি তাঁর জীবনে সর্বোত্তম সুখের দিন!

এর পর সেতার বেহালা নিয়ে পড়েছিলেন যোগেশ্বর। ওস্তাদ রেখেছিলেন। এবং শেখার সময় সুরেশ্বরকে কাছে রাখতেন। সুরেশ্বর জন্মাবধি যে সঙ্গীতবোধ নিয়ে জন্মেছিল—তাতে সে না শিখেই বাঁয়া তবলা বাজাতে পারত। আর ছবি আঁকত যেখানে সেখানে।

সে বছর খানেক। এর মধ্যেই ক্রমে ভাঁটা পড়ে এল আন্দোলনে। জেলখানায় দেশবন্ধু দাশের সঙ্গে ইংরেজ সরকারের কথা হতে হতে বন্ধ হল। গান্ধী রাজী হলেন না। অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন যোগেশ্বর।

হঠাৎ গানবাজনা বন্ধ ক’রে পড়াশোনায় মাতলেন। সুরেশ্বরকে ইস্কুল তিনি তখনই ছাড়িয়েছিলেন। বাড়ীতে মাস্টার রেখে পড়াচ্ছিলেন। সুরেশ্বর যদৃচ্ছ পড়ত। তার কোন বাধানিষেধ ছিল না। তিনি নিজে পড়তে লাগলেন—গীতা চণ্ডী থেকে শুরু করে রামায়ণ মহাভারত—উপনিষদ পর্যন্ত।

হেমলতা শঙ্কিত হয়েছিলেন। বলেছিলেন—এ কি করছ তুমি?

—একটা মীমাংসা খুঁজছি। An answer—

—কিসের?

—বাঘ সাপের সামনে ননভায়োলেন্স —অহিংসার কিছু দাম আছে কিনা? এবং মানুষের প্রকৃতির মধ্যে বাঘ সাপের প্রকৃতির অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় কিনা? কথাটা বুঝেছিলেন হেমলতা। উত্তর দিতে পারার তাঁর কথা নয় কিন্তু তিনি বলতে পারতেন, কেন এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ তুমি? স্বাভাবিক নিয়মে যা ঘটবার তা ঘটবেই! বা এই ধরনের কোন কথা তিনি নিশ্চয় বলতে পারতেন কিন্তু তাও তিনি বলতে পারেন নি!

যোগেশ্বর বলেছিলেন—নর্থ পোল সাউথ পোলেও ছ মাস–দিন ছ মাস রাত্রি। ডার্কনেস অ্যান্ড লাইট। সমান অধিকার। সূর্যালোকে গেলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দ্যাট ইজ ডেথ। এ লোকটি ভুল করলে। গান্ধী! ইংরেজ নিজেকে ব্রিটিশ লায়ন বলে, কিন্তু আসলে সে বাঘ! এত বড় এম্পায়ার যে সে গড়েছে তাতে তার ক্যারেক্টারে সিংহের ক্যারেক্টারের স্ট্যাম্প নেই; আছে বাঘের। ব্রিটিশ জাস্টিস ততক্ষণ যতক্ষণ তার এম্পায়ার অনড় আছে। নতুন গড়া নতুন পাওয়া কোম্পানীর দেওয়ানীর মধ্যে প্রজার উপর অত্যাচার হয়েছিল, কটা রাজা রাণী বেগমের ওপর অত্যাচার হয়েছিল ব’লে হেস্টিংসের ইস্পীচমেন্ট হয়েছিল, বার্ক সেরিডনের কণ্ঠস্বর হেস্টিংসকে তিরস্কার করে পৃথিবীকে চমকে দিয়েছিল; কিন্তু আর তা হবে না, নিশ্চিত থাক। অক্টারলোনী মনুমেন্টটাকে আমি আওয়াজের ধাক্কায় কাঁপতে দেখি! দিস ম্যান-আশ্চর্য ক্ষমতা কিন্তু এক ভুলে সব মাটি করে দিলে। আমি চোখে দেখছি!

হেমলতা এবার বলেছিলেন—তুমি কাগজ বের কর। লেখ।

—কাগজ?

—হ্যাঁ।

—উহু—ও আমার দ্বারা হবে না। লিখতে পারলেই কাগজ বের করা যায় না!

—কেন—তোমার তো টাকার অভাব নেই!

কথাটা মিথ্যে ছিল না। তাঁর বাপ তাঁকে এক লাখ টাকা নগদ দিয়েছিলেন—কাগজ বের করবার জন্যেই। বড়ছেলেকে কলিয়ারি দিয়েছিলেন, তাঁকে দেন নি-তার জন্যে। এ ছাড়া এত বড় বাড়ীটা দিয়েছিলেন—সেও এরই জন্যে। নিচের তলায় প্রেস হবে। উপরতলায় আপিস। একদিকে কিছুটা নিয়ে তিনি থাকবেন; প্রয়োজন হলে তেতলায় ঘর তুলে নেবেন। কিন্তু যোগেশ্বর তা না করে কাগজের আপিসে চাকরিই করেছেন। বাড়ীর নিচের তলাটা ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়া দিয়েছেন বড় বড় কোম্পানিকে। তারা গুদোম করেছে। চাল ডাল খাদ্যদ্রব্য যাতে ইঁদুর লাগে—তাদের দেননি; পাটওয়ালাদের দেননি আগুনের ভয়ে। দিয়েছেন হগ মার্কেটের, ধর্মতলায় যারা স্টেশনারী জিনিস আমদানী করে তাদের। ভাড়ায় নিজের উপার্জনে শেয়ার ডিভিডেন্ডে কীর্তিহাটের জমিদারির অংশ বাবদ দেব খরচ বাদে উদ্বৃত্ত আয়ে তাঁর খরচ সংকুলান হয়েও বছর বছর অনেক সঞ্চয় হয়ে ওই এক লাখ টাকাকে স্ফীত করে প্রায় তিন লাখের কোঠায় নিয়ে গেছে। সুতরাং তিনি কাগজ বের করতে চাইলে অবশ্যই বের করতে পারেন।

যোগেশ্বর বললেন—টাকা-লেখা—বাড়ী এ তিনটে কাগজের পক্ষে বাইরে থেকে দেখতে খুব জরুরী। তার চেয়েও জরুরী হল ব্যবসার দিক। ওতে আমার মাথা খারাপ হয়।

—আমি দেখব!

—তুমি? হা-হা করে হেসেছিলেন যোগেশ্বর।

—তুমি হাসছ? আমি পারব না?

—পারবে না বলছিনে। কিন্তু আমার ভুল পলিসিতে কাগজ ডুবতে বসলে আমাকে নোটিশ দিতে পারবে ইওর সার্ভিস ইজ নো লংগার রিকোয়ার্ড বলে?

শুধু হেমলতাই নয়। বন্ধুবান্ধব সকলেই বলেছিল। তারা সব বিশিষ্ট লোক। এবং সংবাদপত্র জগতের লোক অনেকে। দু-একটা কাগজ থেকে তাঁকে চাকরিও দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি নেন নি।

দেশবন্ধু স্বরাজ্য পার্টি করে তাঁকে ডেকেছিলেন। দেশবন্ধু তাঁর থেকে বয়সে কিছু বড় ছিলেন। অসীম শ্রদ্ধাও তিনি করতেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন-আমাকে নিয়ে আপনাদের চলবে না। আমি পারব না মানিয়ে চলতে!

—বেশ—তুমি লেখ।

—তা চেষ্টা ক’রে দেখতে পারি।

চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেন নি। বলেছিলেন—হচ্ছে না!

—হচ্ছে না মানে কি? এত বড় নামী লেখক তুমি—পারছ না?

—বল পাচ্ছি না।

—পাবে। আমি ব্যবস্থা করছি।

এই কথা বলে হেমলতা মদ আনিয়ে বলেছিলেন—এতকালের অভ্যেস ছেড়ে দিয়ে তুমি দুর্বল হয়ে গেছ। খেয়ে দেখ তো পার কি না?

—খাব?

—খাবে, আমি বলছি।

খেয়েছিলেন এবং মিনিট কয়েক পরে বলেছিলেন-ঠিক বলেছ।

সঙ্গে সঙ্গে আর এক গ্লাস খেয়ে কিছুক্ষণ পর কাগজ কলম টেনে বসেছিলেন লিখতে। গান্ধীজীর অহিংসা মতবাদকে বিদ্রূপাত্মক যুক্তির ধারালো ছুরিতে টুকরো টুকরো করে কেটে নিজের নাম দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ইংরেজের ইংরিজী কাগজে। খুব মোটা হেডলাইন দিয়ে সমাদর করে তারা ছেপেছিল। এতদিন পরে এই প্রথম লেখাটাই চারিদিকে বেশ সোরগোল তুলেছিল—শুধু বাংলাদেশেই নয়-গোটা ভারতবর্ষে। মাদ্রাজের হিন্দু, বম্বের টাইমস অব ইন্ডিয়া, দিল্লির কাগজ সর্বত্রই এ নিয়ে আলোচনা চলেছিল। লন্ডনের টাইমস পত্রিকাতেও কিছু মন্তব্য করেছিল তারা।

প্রশ্নটা ওই অহিংসা নিয়ে। বলেছিলেন—হয় গান্ধী বলুন এটা তাঁর নেহাতই বাঘের স্বরূপের উপর নামাবলী, ভবিষ্যতে একদা নামাবলীখানা ফেলে দিয়ে ব্যাঘ্র মূর্তিতে দাঁড়াবেন অথবা তিনি নিতান্তই সেই হিতোপদেশের গল্পের মূষিক? যে মুষিককে এক ঋষির বরে কয়েক দিনের জন্য লোকচক্ষে বাঘ বলে মনে হত এবং পরে যে আবার মুষিকই হয়ে গিয়েছিল।

প্রায় বছর দেড়েক যে টেলিফোনটা কদাচিৎ বাজত সেটা সেদিন থেকে আবার মুখর হয়ে ওঠে প্রবলভাবে।

হেমলতা খুব খুশী হয়েছিলেন।

সুরেশ্বর তখন বারো বছরের। ইংরেজী সে বাপের কাছে পড়ত। সে বলেছিল—এ তুমি কেন লিখলে বাবা?

যোগেশ্বর তাকে স্তোকবাক্যে সান্ত্বনা দেননি, তিনি তাকে সাধ্যমত বুঝিয়েছিলেন। গল্প বলেছিলেন অ্যামেরিকান ইন্ডিপেন্ডেন্সের, ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশনের, রাশিয়ান রেভল্যুশনের। সুরেশ্বর বয়সের তুলনায় পড়েছিল অনেক। গোগ্রাসে যাকে পড়া বলে। এবং তার খোরাক যুগিয়েছিলেন—যোগেশ্বর।

সেদিন গল্প বলতে বলতে তিনি সুরেশ্বরকেই বলেছিলেন—গেলাসে মদ ঢেলে দিতে। সুরেশ্বরই দিচ্ছিল। একসময় হেমলতা এসে বলেছিলেন—এ কি! ও কি হচ্ছে? তুমি কেন ঢালছ? সুরো?

—বাবা বললে যে।

—হ্যাঁ আমি বলেছি।

—খুব ভাল! এর থেকে ভাল আর কিছু হতে পারে না।

হেসে যোগেশ্বর বলেছিলেনদেখো, ওর বয়স আঠারো পার হলে আজ আমি ওকে খেতে শেখাতুম। খেতে তো শিখবেই। যার তার কাছে শিখবে কেন? বলে হা-হা করে হেসেছিলেন। হেমলতা রাত্রে বলেছিলেন—না—না—এত বাড়াবাড়ি করো না। দেখছি আমিই অন্যায় করেছি। তোমাকে আবার ধরিয়ে।

—খুব যে অহঙ্কার!

—মানে?

—তুমি না দিলে বোধহয় আমিই আনিয়ে শুরু করতাম। তুমি এলে মনের কথা নিয়ে মানসীর মত অথবা ডেস্টিনির মত।

তারপর কিছুদিন তিনি বিপুল উৎসাহে লিখলেন। প্রতিপন্ন করলেন—অন্তত তিনি তাই ভাবলেন, যে অহিংসার কল্পনা একটি রঙিন ফানুস ছাড়া আর কিছুই নয়। এবং এই ফানুস যখন ফাটে তখন তার যে গ্যাস বাতাসে ছড়ায় তাতে নিশ্বাস নেয় যে মানুষ তাদের একটা নেশা লাগে। বুদ্ধের পরে এই নেশায় গোটা দেশের মানুষ একটা ক্লীবের জাতিতে পরিণত হয়েছিল। দেশের বর্তমান এই যে ইংরিজি শিক্ষার প্রভাবে নতুন চেতনা —সে চেতনা সৎ কিন্তু বোকা। তুমি আর তোমার ধর্মের ধোঁয়া মেশানো অহিংসা নেশায় আবার নতুন করে ক্লীব ক’রে দিও না। ইংরেজের মত এত বড় একটা জাতের শিক্ষাদীক্ষা সব ব্যর্থ হবে। দুনিয়ার ঢাকা যখন স্টীম পাওয়ারে এবং ইলেকট্রিসিটিতে চলছে প্রচণ্ড ঘর্ঘর শব্দে তখন তুমি সেই পুরানো চরকাকে বের করে ঘ্যানর ঘ্যানর করে বিশ্বজগতে একটি অট্টহাস্যের সম্মুখীন কোরো না এই হতভাগ্য জাতিকে।

মদের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছিল, বলাই বাহুল্য। হেমলতা আপত্তি করলেন। তিনি বললেন—নো। আর শুনব না।

মান-অভিমান কাঁদাকাটির পর একটা আপোস হল। এরই মধ্যে ঘটল আর এক ঘটনা। এখানেও ঘটালেন হেমলতা। তাঁর মামাতো ভাই তখন ব্যারিস্টার এবং বেশ পসারওয়ালা ব্যারিস্টার। তার ছেলের জন্মদিনে বাড়ীতে ছিল পার্টি; সেখানে গিয়েছিলেন সুরেশ্বরকে নিয়ে, গান-বাজনার আসর ছিল, সেই আসরে বাজিয়ের অভাব হচ্ছিল, বসিয়ে দিলেন ছেলেকে বাঁয়া তবলা বাজাতে। সে চমৎকার বাজাল। চৌদ্দ বছরে সবে পা দিয়েছে-সুন্দর চেহারা; তারিফ সে পাওনার থেকে বলতে গেলে বেশীই পেলে। প্রশ্ন উঠল—ওমা, শিখলে কখন?

পার্টিতে ছিলেন মামাতো ভাইয়ের বিশিষ্ট মক্কেলরা। তার মধ্যে ছিলেন ছোট নেটিভ স্টেটের (যে নেটিভ স্টেটের আয় বাংলার বড় জমিদারী থেকেও কম) রাজার এক বান্ধবী। সে আমলেও খাঁটি ইঙ্গ-বঙ্গের চেয়েও কড়া চাল তাঁর। বিলেতও ঘুরে এসেছেন একসময়। পরিচয় তাঁর তিনি রাজার প্রাইভেট সেক্রেটারি। তাঁর সঙ্গে আলাপ হেমলতার পার্টির প্রারম্ভেই হয়েছিল। মিস্টার জে রয় এবং ওমনিপোটেন্টের নাম তিনি জানতেন। তিনি শুনে সবিস্ময়ে বলেছিলেন—সত্যি মিসেস রয়? না এটা তোমার স্বামী-প্রেমের সুন্দর স্বপ্ন?

হেমলতা বলেছিলেন—অর্থাৎ তুমি বলছ বাজনা আমি জেগে শুনিনি, স্বপ্নে শুনেছি। যেমন তোমার মহারাজার শিকারের ঘটনাগুলো ঘরে শুয়ে শুয়ে দেখেছ?

হেসে উঠেছিলেন মহারাজার বান্ধবী। বলেছিলেন—মহারাজার গুলির চেয়েও তোমার কথার টার্গেট অব্যর্থ এবং মারাত্মক। বেশ তো, আমি মহারাজার গুলির তাগ দেখাতে রাজি আছি, তবে শিকারে যেতে হবে। তুমি মিস্টার রয়ের অপরূপ বাজনা আমাকে শুনিয়ে দাও। আমি গান-বাজনা বুঝি। ভাল লাগে।

হেমলতা বলেছিলেন—কাল আমার ওখানে চায়ের নেমন্তন্ন তোমার।

তিনি আনন্দের সঙ্গে নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন।

হেমলতা বিশেষ কিছু জানান নি যোগেশ্বরকে, বলেছিলেন—একজন বান্ধবীকে চায়ের নেমন্তন্ন করেছি!

যোগেশ্বর লিখছিলেন। বলেছিলেন বেশ!


© 2024 পুরনো বই