কীর্তিহাটের কড়চা – ১.১

একান্তভাবেই ঘটনাচক্রে ঘটল। নইলে যোগেশ্বর এ সব গ্রাহ্য করতেন না, জীবনধারণের পন্থায় তিনি সাহেব ছিলেন—মতামতে তিনি মডারেট ছিলেন। নিখুঁত সাহেবী পোশাক পরে চুরুট মুখে সভায় পার্টিতে ঘুরতেন, রাত্রিকালে ফিটনে চেপে বেড়াতেন। হোটেলে মধ্যে মধ্যে খানা খেতেন। মদ্যপান ছিল নিয়মিত। এবং নামও তখন তাঁর ছড়িয়েছে। বিলেতের কাগজেও লেখা বের হয়। হঠাৎ বাঁধা পড়ে গেলেন সুরেশ্বরের মা হেমলতার কাছে। হেমলতার মামা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট, মাঝারি পশার, কিন্তু থাকতেন ব্যারিস্টারি চালে অর্থাৎ বিলেত-ফেরতের চালে। সেদিক দিয়ে যোগেশ্বরের সঙ্গে মিল ছিল। হেমলতার মা-বাপ দুই-ই ছেলেবয়সে মারা যাওয়ায় সে মামারই পোষ্য হয়েছিল, কিন্তু অবজ্ঞার পোষ্য নয়। মামা-মামী দুজনের কাছেই ছিল তার পরম সমাদর। মামী শুধু মামীই ছিলেন না, তিনি তার পিসীমাও ছিলেন-আপন পিসীমা। সুতরাং মামাও একাধারে মামা ও পিসেমশাই ছিলেন। হেমলতাকেই নিজের মেয়ের মত যত্নে মানুষ করেছিলেন। এবং বেশ বেশী বয়সে যখন তাঁদের সন্তান হল—তখন স্নেহ তার উপর পড়লেও হেমলতার উপর তাঁরা নির্দয় হননি। হেমলতা তখন এন্ট্রান্স পাশ করে কলেজে পড়ছে। সেই সময় যেন ঠিক লগ্নটিতেই যোগেশ্বর রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেছিলেন। হেমলতার বয়স তখন ষোল। যোগেশ্বর হেমলতাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। এবং কিছুদিনের মধ্যেই হেমল তার মামাকে চিঠি লিখে জানালেন যে তিনি হেমলতাকে বিবাহ করতে চান, এবং পাত্র হিসাবে অযোগ্য নন। তাঁর আয় ব্যয় যা কিছু সমস্ত কিছুর বিশদ বিবরণ দিয়ে লিখলেন—”হেমলতার মত নেবার ভার আপনার উপর। বিবাহ হিন্দুমতে হবে যখন, তখন এ পদ্ধতিটাও সেই মতানুযায়ী হওয়াই বাঞ্ছনীয়।”

মামা খুঁত-খুঁত করেছিলেন বয়েসের জন্য এবং যোগেশ্বর সম্পর্কে গুজবের কথা শুনে। কিন্তু হেমলতা যোগেশ্বরকে দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিল। সেকালের এন্ট্রান্স পাশ করা হেমলতা একালের এম.এ. পাশ মেয়ের থেকেও প্রগতিশীলা। তার উপর বাড়ীর চালটাই ছিল বিলেতফেরত না হয়েও বিলেত-ফেরতদের মতো। লোকে বলত, —সূর্যের তাপে বালি তাতে-তার চেয়েও বেশী তাতে উনোনের উপর আগুনের তাপে খোলার বালি। কথাটা খুব রঙচড়ানো নয়। হেমলতা নিজেই মামীকে বা পিসীকে বলেছিল—বয়সের জন্য খুঁতখুঁত করতে বারণ করো পিসীমা। কি বয়েস? ওর যদি তিরিশ বয়স হয়ে থাকে তবে আমিও ষোল, আমারও তো তা হলে প্রায় বুড়ী হওয়ার কাল হয়ে এসেছে গো। এ দেশে তো কুড়ি পেরোলেই বুড়ী। আর মদ-টদ—অন্য কথা? ওসব আমার ওপর ছেড়ে দাও।

তার প্রমাণও সে দেখিয়ে দিয়েছিল। একখানা চিঠি যোগেশ্বরকে লিখেছিল—আপনার প্রস্তাবে আমি মত দেব ভাবছি মামাকে। কিন্তু আপনি আমার মামার সামনে মদ খাবেন—এটা আমার কেমন লাগছে। মট-টদ কিন্তু চলবে না। এটার প্রমাণ পেলেই আমার মত মামাকে জানাব।

যোগেশ্বর এতে অরাজি হননি। হাজার হলেও বাঙালীর ছেলে-ডাল ভাতের সঙ্গে ছেলেবেলায় এইসব সুলভ সৌজন্য এবং শ্রদ্ধা প্রকাশের আচরণগুলিতে অভ্যস্তও ছিলেন এবং এ-সবের একটা মিষ্টি স্বাদ স্মৃতিতেও ছিল। তিনি প্রস্তাবটিকে রাবিশ বলেননি বা এতে তিনি নিজে খাটো হবেন একথাও তাঁর মনে হয়নি। সুতরাং সেদিন রাত্রেই সাড়ে আটটার পর কাগজের আপিস থেকে বেরিয়ে সটান হেমলতার মামার বাড়ীতে উঠে সিঁড়ির মুখের চুরোটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘরে ঢুকছিলেন। হেমলতার মামা সামনে হুইস্কির গ্লাস রেখে বসেছিলেন। যোগেশ্বরকে দেখেই বেয়ারাকে ডেকেছিলেন, “বয়, গ্লাস লে আও।” যোগেশ্বর বলেছিল–নো থ্যাঙ্কস। পেগ নয়—বরং চা এক কাপ। হেসে সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ছিলেন—আপনি গুরুজন—মামাশ্বশুর হবেন। ওটা আর আপনার সামনে চলতে পারে না। আমরা হরতন নই ইস্কাপন। ইস্কাপনী ধারাটাই ভাল। তার উপর বিয়ে হলে হবে খাঁটি হিন্দুমতে। রেজেস্ট্রীতে ডাইভোর্স আছে। বিধবা-বিবাহ আছে। জানেন—Spade is always a Spade—আপনাকে চিঠি লিখে অবধি রেজেস্ট্রী বিয়ের কথা ভাবতে গেলেই বুকটা রি রি করে উঠছে। তার ওপর আমাদের দেবোত্তর সম্পত্তি অনেক বড়, জ্ঞাতিগুষ্টিরা শুনেছি খুঁত খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছে। রেজেস্ট্রী বিয়ে করলে তাল ঠুকে নালিশ করে বসবে! তবে এটার চেয়ে ওটা বড়। ভারী ভাবতে ভালো লাগছে—আমি মরে গেলেও হেমলতা আমার ফটোয় মালা পরাচ্ছে চন্দন দিচ্ছে।

সুতরাং বিয়ে হতে আর বিন্দুমাত্র বাধা হয়নি। তবে ওই শেষ কথাটার জন্যে হেমলতা রাগ করেছিল, না-ও বলেছিল। যোগেশ্বর রাগ ভাঙিয়েছিলেন। বলেছিলেন-ও কথাগুলো আমি উইথড্র করছি। তার বদলে বলছি—তুমি মরলে আমি কাঁদছি, সিঁথিতে সিঁদুর ঢেলে দিচ্ছি—পায়ে আলতা—আমি না—অন্যকে দিয়ে পরিয়ে দিচ্ছি। বেনারসী কাপড় পরিয়ে খোল-করতাল বাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। সমারোহ করে চন্দনধেনু শ্রাদ্ধ করছি।—

হেমলতা হেসে ফেলেছিলেন-তুমি ইনকরিজিবল। থাম!

বিয়ে হয়েছিল ১৯০৯ সালে, মার্চে। সেদিক দিয়ে রোমান্টিক ছিলেন যোগেশ্বর। বসন্তকাল শুক্লপক্ষ দেখে দিন নির্বাচন করেছিলেন—যার কদিন পরেই হোলি। শোলার টোপর গরদের পাঞ্জাবি বেনারসী ধুতি-চাদরগোড়ের মালাচন্দনের তিলক-সজ্জা—বাকী কিছু রাখেননি। বিয়ের পর হোলির সময় দীর্ঘকাল পর কীর্তিহাটে গিয়ে এক সপ্তাহ থেকে মধুচন্দ্রিমা যাপন করে এসেছিলেন। এবং সেবার হোলিতে নিজের খরচে রাজরাজেশ্বরের নাটমন্দিরে কলকাতা থেকে বাঈজীর নাচ করিয়েছিলেন।

এর প্রায় এক বছরের মধ্যেই জন্ম হয়েছিল সুরেশ্বরের। ফাল্গুনের শেষে ওই হোলির দিনই সুরেশ্বরের জন্ম। হেমলতা ওকে ডাকতেন সেই জন্য ফাল্গুনী বলে। এমন সুন্দর নামটা —ভাল নাম হতে বাধা হবার কথা নয়—কিন্তু কীর্তিহাটের কুড়ারাম ভট্টাচার্যের ছেলে সোমেশ্বর রায় নাম গ্রহণ করার পর থেকে ঈশ্বর পরিশেষে যুক্ত না করে নাম রাখবার নিয়ম নেই। যোগেশ্বর যে যোগেশ্বর তিনি ছদ্মনামে লিখবার জন্য যে নাম নিয়েছিলেন তাও ঈশ্বরের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়নি—“ওমনি-পোটেন্ট” নামে লিখতেন। সেই কারণে ১৯১০ সালে বাংলাদেশের নেতা এবং সংবাদপত্র ক্ষেত্রে তখনকার সিংহ সুরেন্দ্রনাথের নামটাকেই অর্থাৎ সুর-ইন্দ্রকেই সুরেশ্বর করে নামকরণ করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগেশ্বরের প্রবল মতপার্থক্য ছিল- সেলী আর ইংলিশম্যানের মতপার্থক্য—তবু তিনি অর্থাৎ যোগেশ্বর তাঁকে বলতেন লায়ন অব বেঙ্গল।

চাকর দারোয়ান ডাকত ‘লাল’ বাবু বলে। আসলে ফাগুলাল কিন্তু হেমলতার ভয়ে লালবাবু হয়েছিল।

লাল সত্যই রূপের অধিকারী ছিল, এবং বাপের দুলাল ছিল। মা শাসন করতে চাইতেন কিন্তু বাপ দিতেন না।

মধ্যে মধ্যে এ নিয়ে বাগযুদ্ধ হত স্বামী-স্ত্রীতে। হেমলতা বলতেন-দেখো সব বিষয়ে তুমি আমাকে দাবিয়ে রেখেছ, ছেলের ক্ষেত্রে তা চলবে না, আমি মানব না।

যোগেশ্বর কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতেন—ভাগাং ফলতি সর্বত্র ন চ বিদ্যা ন চ পৌরুষং।

—তার অর্থ?

—অতি সরল। তোমাকে আমি দাবিয়ে রেখেছি এ অপবাদও শুনতে হল—এবং হ’ল হ’ল তোমার মুখ থেকেই হ’ল?

—রাখনি দাবিয়ে—তুমি আমার কোন কথাটা রাখো—

বাধা দিয়ে যোগেশ্বর বলতেন সে তুমি বললেও হবে না—আমি বললেও হবে না। সাক্ষী মান। বলুক তৃতীয় পক্ষ!

হেমলতা বলেছিলেন-তোমার চাকর-বাকর তো তোমাকে ভয় করে।

—বেশ তো ডাকো না, এই বাড়ীর প্রায় সামনে শিককাবাবওলা আবদুল কি বলে—ডেকে জিজ্ঞেস কর!

—আবদুল? কি বলে আবদুল?

—আবদুল বলে—সাদী করকে রায় সাহেব তো শের সে শিয়ার বন গয়া। সাদীকা পহেলে বারা-এক বাজেতক মায়দানমে ফিটনকে পর ঘুমতা, শেরকে মাফিক আওয়াজ দেতা। কনেস্টবল লোক সেলাম দেতা। ঘরকে দরওয়াজা পর পৌঁছছ কর শেরকে মাফিক ফুকারতা-কেয়া বানায়া রে আবদুল? আর সাদীকে বাদ দেখো—নও বাজতা আওর রায় সাহেব ঘর মে পৌঁছছ যাতা—, আবদুলকো ফুকারতা নেহি—কাবাব ভি খাতা নেহি—ঘর ঘুষ যাতা। বারা বাজতা বাতি বুজ যাতা। পহলে-দো-তিন তক বাতি জ্বলতা, রায় সাহাবকো আওয়াজ মিলতা- বোয়। খানা টেবিলসে বর্তন-উর্তন ফেক দেতা–ঝনঝন ঝনঝন! বাস। আব বলো—ঠিক বোলা কি ঝুট বোলা! নেকড়ানি ফিরিঙ্গী ছোকরী লোক তো রোতি হ্যায় উনকো লিয়ে!

হেমলতা এ সবের একটাও অস্বীকার করতে পারতেন না—মুখ টিপে হেসে বলতেন—লোকটাকে আমি বকশিশ করব, কিন্তু তার জন্যে আপসোস হয় না কি?

—একবারে হয় না বলতে পারিনে। তবে তার থেকে অনেক বেশী আনন্দ এবং আরাম তাতে সন্দেহ নেই। ছেলেবেলা কীর্তিহাটে চণ্ডী ভটচাজ ছিল তন্ত্রসাধক। দিন-রাত্রি মদ খেয়ে থাকত, টলত। তার ভাগ্নে অমর মুখুজ্জে গাঁজা খেত। চণ্ডী ভট্টাচাজ বলতেন-ওরে অমরা, আমি একদিন একছিলম গাঁজা খেয়েছিলাম তিনদিন হুঁস ছিল না—সেই গাঁজা তুই ব্যাটা দিনে তিনবার টানিস! তা দেখ, বিয়েও আমার কাছে তাই। ওই একবার খেয়ে যে বুদ হয়ে গেছি সে বুঁদ নেশা আর কাটল না। রাত্রি নটা হতে না হতে সেই বিয়ের রাতের চাঁদ ওঠে মনের মধ্যে। কলায় কলায় বাড়তে থাকে মিনিটে মিনিটে। পূর্ণ চন্দ্র দেখতে ছুটে এসে আমি হাঁ করে চেয়ে থাকি! তুমি ভেবো না, ব্যাটার ষোল বছর হ’তে-না-হ’তে বিয়ে দিয়ে দেব। আমি শেয়াল হয়েছি—ব্যাটা খরগোস হয়ে যাবে।

—কিন্তু তরিবৎ সহবৎ লেখাপড়া—এগুলো চাই না কি?

—ডোন্ট ওরি—ডার্লিং, তুমি মা, আমি বাপ, আমার বাপ দেবেশ্বর রায় এম.এ., তার বাপ রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় বি.এ., তার বাপ বীরেশ্বর রায়,—তিনি নীলকরদের ছেলেদের সঙ্গে মিশতেন, পাদরী হিল সাহেবের কাছে ইংরিজী শিখেছিলেন, কালীপ্রসন্ন সিংহী প্রভৃতির বিদ্যোৎসাহিনী সভায় তার নেমন্তন্ন হত। রত্নেশ্বর মানুষ হয়েছিলেন পিসেমশাইয়ের কাছে। পিসেমশাই বিমলাকান্ত ছিলেন সংস্কৃতে ইংরিজিতে পণ্ডিত। সোমেশ্বর তাদের পূর্বপুরুষ—তিনি সংস্কৃত, পার্সী, উর্দু ভাল জানতেন। এ বংশের সুরেশ্বর তরিবত সহবত লেখাপড়া সব শিখবে।

যোগেশ্বরের অতিবাৎসল্যের আর একটু কারণ ছিল; সুরেশ্বরের জন্মের দু বছর পর হেমলতা আবার সন্তানসম্ভবা হয়েছিলেন এবং প্রসবের সময় মরণাপন্ন হন। বহু কষ্টে বহু অর্থব্যয়ে কলকাতার শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকদের অস্ত্রোপ্রচারের ফলে মরা সন্তান কেটে বের করে দেওয়া হয়, এবং সেই সঙ্গে হেমলতারও আর সন্তান ধারণের শক্তি শেষ হয়।

যোগেশ্বর সেটা মনে পড়িয়ে দিতেন—আর তো হবে না। তাছাড়া আমরা যখন আমরা হয়েছি তখন ও-ও তাই হবে, মা ভৈঃ।

নিরস্ত হতে হত হেমলতাকে। হয়তো স্বামী-গরবিণী অন্তরে অন্তরে পুলকিতও হতেন।

* * *

মা ভৈঃ বলতেন বটে যোগেশ্বর কিন্তু এগার বছর বয়সে তিনি ছেলেকে নিজেই ভয় পেলেন। তিনি যে চেয়ারটায় অনড় হয়ে বসেছিলেন ইংলিশম্যান আপিসে ১৯০৫ সাল থেকে, সেই চেয়ারটায় ধাক্কা দিয়ে তাঁকে চমকে দিল এগার বছরের ছেলে সুরেশ্বর। অবশ্য তিনি নিজেই যেন চঞ্চল হয়ে অন্যমনস্ক ছিলেন, ঠিক শক্তভাবে নিজের পুরো চাপ দিয়ে বসে কর্মনিমগ্ন ছিলেন না। সেটা উনিশশো একুশ সাল —অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়েছে। যোগেশ্বর বরাবর ইংরিজীর ভক্ত, ইংরেজ শাসন ও শৃঙ্খলার পক্ষপাতী। এর জন্য ভক্তি ও শ্রদ্ধা সত্ত্বেও সুরেন্দ্রনাথকে তিনি মানেননি। বেঙ্গলীর এডিটোরিয়ালের জবাব লিখেছেন। ১৯০৫ সালে কোথায় এক টিন বিলিতী বিস্কুট ভেঙে ছড়িয়ে গুঁড়ো করার জন্য তিনি একটা প্যারা লিখেছিলেন—“একটি আবিষ্কার”। তাতে লিখেছিলেন—“আমরা বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হলাম যে, ইংরেজের ভারত সাম্রাজ্যের স্বত্বের দলিল নিরাপত্তার জন্য ইংরেজ বিস্কুটের টিনে প্যাক করে রেখে দিয়েছে। সেই সত্য আবিষ্কার করেছেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী এবং তাঁর সহকর্মীরা। সম্প্রতি স্থানে স্থানে বিস্কুটের টিন পেলেই ভেঙে দেখা হচ্ছে দলিলখানা পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কর্তারা বিস্কুটগুলো অপচয় করছেন কেন? সেগুলো খেলে তো পেট ভরে!”

প্রথম মহাযুদ্ধের সময় সরকার থেকে তিনি মেসোপোটেমিয়া ফ্রন্ট এবং ওদিকে ফ্রান্সে ভার্দুন পর্যন্ত ফ্রন্ট দেখে এসেছিলেন।

গান্ধী যখন কলকাতায় এসে ভূপেন বোসের বাড়ী অতিথি হয়েছিলেন, তখন তিনি তাঁকে দেখেছেন—আলাপ করেছেন। তাঁর ভাল লাগেনি। বাড়ীতে হেমলতার সঙ্গে আলোচনায় বিদ্রূপ করেছেন। বিদ্রূপ করেছেন তাঁর বেশভূষার জন্য, বিদ্রূপ করেছেন তাঁর ফল খেয়ে থাকার জন্য, তাঁর অদ্ভুত মতবাদের জন্য। এবং যেদিন রাউলাট বিলের প্রতিবাদে হরতাল ডেকে শেষ পর্যন্ত জালিয়ানওয়ালাবাগের মত মর্মান্তিক কাণ্ড ঘটল সেদিন তাঁর যত ক্রোধ হয়েছিল ইংরেজের ওপর এমন কি সার মাইকেল ওডায়ার ও জেনারেল ডায়ারের উপর তার চেয়েও তাঁর ক্রোধ হয়েছিল গান্ধীর উপর। সেই—সেই ব্যক্তিই এর জন্য দায়ী। কিন্তু বিস্মিত হয়েছিলেন ব্যক্তিটির ভারত চিত্ত অনুভবের শক্তি দেখে। এত তাপ এদেশের মাটির মতো মানুষের মধ্যে সঞ্চিত ছিল? তারপর ধীরে ধীরে যে বিচিত্র পরিচয়ে এই খর্ব কৃশকায় ব্যক্তিটি নিজেকে উদ্ভাসিত করেছিলেন এবং যার প্রতিচ্ছটায় ইংরেজের নতুন চেহারা দেখিয়েছিলেন, তাতে তাঁর বিস্ময় জেগে উঠেছিল। কলকাতার কংগ্রেসে তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লোকটিকে দেখছিলেন। স্তিমিত কৃশকায় ছোট একটি মানুষ! তেমনি বেশভুষা! অথচ—!

এ নিয়ে ইংলিশম্যানের সম্পাদকীয় বৈঠকে আলোচনা হত। প্রথমদিকে তিনি ছিলেন প্রখর বক্তা। তারপর যত দিন গেল তত তিনি হয়ে উঠলেন নীরব থেকে নীরবতর। ইংলিশম্যানের খোদ সম্পাদক মশায় ছিলেন যোগেশ্বরের বন্ধু এবং গুণমুগ্ধ। সব থেকে ভাল লাগত তাঁর যোগেশ্বরের শেষভরা উক্তি!

তিনি একদিন প্রশ্ন করেছিলেন—মিস্টার রে—

যোগেশ্বর হেসে মুখ তুলে তাকিয়েছিলেন, কথা বলেন নি!

সম্পাদক বলেছিলেন—তুমি এমন নীরব চুপচাপ হয়ে যাচ্ছ কেন?

চুরুটে টান দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে চেয়ারের পিছন দিকে হেলান দিয়ে বসে যোগেশ্বর বলছিলেন—হয়ে যাচ্ছি, না?

—কি হয়েছে?

—ঠিক জানি না। তবে দেখ, আমার বাড়ীতে একটা কুকুর ছিল, কিছু দুর্ঘটনা ঘটবার হলে সেটা কেমন গুড়িসুড়ি পাকিয়ে কোণ খুঁজে বেড়াত আর মধ্যে মধ্যে মৃদু শব্দ করত। আমারও মনে হচ্ছে ওই কুকুরটার ছোঁয়াচ লেগেছে। I am smelling something like that—একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন—Something will happen. —আমি যেন কারুর footsteps শুনতে পাচ্ছি!

—Oh Ray—তুমি যে মিস্টিক হয়ে পড়ছ—

—Perhaps. বলে হেসেছিলেন যোগেশ্বর।

তারপরও নাগপুর কংগ্রেসে গান্ধীর নন কো-অপারেশন নিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। হাওড়া প্ল্যাটফর্মে সি আর দাশের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলে আপিসে ফিরে খুব কড়া ভাষায় লিখেছিলেন সম্পাদকীয়। প্রবন্ধটা কড়া হয়েছিল, কিন্তু তাঁর যেটা বৈশিষ্ট্য—শ্লেষ এবং ব্যঙ্গ সেটা ঠিক ছিল না তাতে! এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন কংগ্রেসের অধিবেশনে এই খর্বকায় কৃশতনু ব্যক্তিটি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত হবেন। কলকাতা কংগ্রেসে যে প্রস্তাব উপস্থিত হয়েছে তা নাগপুরে নিশ্চয়ই প্রত্যাখ্যাত হবে। সি আর দাশ তো সেজেই গেছেন ডেলিগেট নিয়ে। কিন্তু আশ্চর্য! সি আর দাশ, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু, লালা লজপত রায়, পণ্ডিত মালব্য, মি. মহম্মদ আলি জিন্না, সভাপতি বিজয়রাঘব চারিয়া—সকলে এই ব্যক্তিটির প্রভাবে এক বাক্যে কলকাতায় গৃহীত প্রস্তাব কনফার্ম করে গ্রহণ করলে। যোগেশ্বরের বিস্ময়ের অবধি রইল না। যেদিন খবরটা আসে সেদিন তাঁকেই বলা হয়েছিল সম্পাদকীয় লিখবার জন্য। কিন্তু কিছুক্ষণ বিমুঢ়ের মত বসে থেকে তিনি প্রধান সম্পাদককে স্লিপ পাঠিয়েছিলেন-আমার মাথার মধ্যে যন্ত্রণা হচ্ছে। আজকের লীডার তুমি নিজে লিখো। আমি বাড়ি যাচ্ছি। দীর্ঘক্ষণ তিনি গঙ্গার ধারে বসে থেকে বাড়ী ফিরেছিলেন। এবং সে রাত্রে যে মদ্যটুকু নিয়মিত খান তা খেয়ে উঠতে পারেননি—চিন্তার মধ্যে। এত ভুল হল তাঁর?

তারপর একুশ সালে আরম্ভ হল আন্দোলন। তিনি আপিসের রিভলভিং চেয়ারে বসে ঘুরতেন—এটা যেন নেশা হয়ে গেল তাঁর। তিনি মনে মনে ঘুরতেন চারিদিক। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারটাকেও ঘোরাতেন।

.

একটা নতুন চেহারা। গোটা দেশটার একটা নতুন চেহারা। মদ্যপ মদ ছাড়ছে। চাকুরে চাকরি ছাড়ছে। ছাত্ররা পরীক্ষার হলের সিঁড়িতে শুয়েছে, নিজেরা পরীক্ষা দেবে না—অন্যদের দিতে দেবে না। শোভাযাত্রীর উপর লাঠিচার্জ হচ্ছে। তাদের অ্যারেস্ট করে জেলে পাঠানো হচ্ছে; কিন্তু একদল যাচ্ছে আর একদল তার স্থান পূরণ করছে। মেয়েরা জেলে যাচ্ছে। বাসন্তী দেবী জেলে গেলেন দাশ মশায়ের পিছন পিছন। এ হ’ল কি?

ইংরেজরা গাল দিচ্ছে।

সুরেন্দ্রনাথ পিছিয়েছেন। তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করবেন। তিনি নিজে তাঁরও পিছনে, অনেক পিছনে। তিনি ইংলিশম্যানে এডিটোরিয়াল লিখছেন। তাঁর পিতা দেবেশ্বর রায় বিপ্লবীদের সমর্থন করেছেন গোপনে—অর্থ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি? এমনিই অবস্থায় ওই ঘোরানো চেয়ারখানা কিসের ধাক্কায় যেন উল্টে যাই-যাই হল। টেলিফোন বেজে উঠল। তিনি রিসিভার তুলে ধরে বলেন—রয়!

ওদিক থেকে কথা ভেসে এল—আমি হেম বলছি!

—কি? কি খবর?

—তুমি বাড়ী এস। গাড়ী গেল।

—এই তো ঘণ্টাখানেক বাড়ী থেকে এসেছি

—সুরেশ্বর ইস্কুল থেকে ফেরেনি। গাড়ী ফিরে এল—তাকে পায়নি।

—মানে?

—সে টিফিনে বেরিয়ে চলে গেছে। ক্লাসের বন্ধুরা বলেছে সে বড়বাজার গেছে পিকেটিং করতে।

—পিকেটিং করতে?

—হ্যাঁ।

যোগেশ্বর তৎক্ষণাৎ উঠে বেরিয়ে এসেছিলেন আপিস থেকে। সেই এসেছিলেন আর ঢোকেন নি


© 2024 পুরনো বই