প্রাতরাশের পর মানিক উচ্চস্বরে খবরের কাগজ পাঠ করতে লাগল এবং জয়ন্ত একমনে শুনতে লাগল খবরগুলো৷
ভৃত্য মধুর প্রবেশ-সঙ্গে তার এক পাহারাওয়ালা৷
জয়ন্ত শুধোলে, ‘ব্যাপার কী?’
পাহারাওয়ালার মুখে শোনা গেল, ইনস্পেকটর সুন্দরবাবু এই পাড়ায় তদন্তে এসেছেন, জয়ন্তের সঙ্গে তিনি পরামর্শ করতে চান৷
জয়ন্ত বলল, ‘চলো মানিক, নিশ্চয় কোনো নতুন মামলা৷ একঘেয়ে কাগজ শোনার চেয়ে নতুন মামলা নিয়ে নাড়াচাড়া করা ভালো৷’
মানিক বলল, ‘হ্যাঁ, তাতে আমাদের সময়ও কাটে, আর সুন্দরবাবুরও হাতযশ বাড়ে৷’
গঙ্গার ধার৷ রেল লাইনের সামনেই একখানা মাঝারি আকারের তিনতলা বাড়ি৷ সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে দুই পাহারাওয়ালা৷
বৈঠকখানায় কয়েক জন লোকের সঙ্গে বসে আছেন সুন্দরবাবু৷ একগাল হেসে বললেন, ‘এসো জয়ন্ত, এসো মানিক৷’
জয়ন্ত বলল, ‘আবার কোনো নতুন মামলার হামলা সামলাতে এসেছেন বুঝি?’
-‘হুম, তা ছাড়া আর কী? সেই জন্যেই তো আজকে তোমাদের চায়ের আসরে যাওয়া হল না৷’
মানিক বলল, ‘না গিয়ে ভালো করেননি৷ মধু আজ একটি চমৎকার খাবার বানিয়েছিল৷’
-‘কী খাবার?’
-‘চকোলেট স্যান্ডউইচ৷’
সুন্দরবাবু ফোঁশ করে একটা নিশ্বাস ফেললেন বিরসবদনে৷
জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘মামলাটা কীসের?’
-‘কাল এই বাড়ি থেকে পঁচিশ হাজার টাকা চুরি গিয়েছে, আর সঙ্গে সঙ্গে হয়েছে হত্যার চেষ্টা৷’
-‘তাহলে সামান্য মামলা নয় দেখছি৷ গোড়া থেকে সব খুলে বলুন৷’
সুন্দরবাবু যা বললেন, মোটামুটি তা হচ্ছে এই-
অনন্তচন্দ্র পাইন হচ্ছেন বিখ্যাত লৌহ-ব্যবসায়ী৷ তাঁর দোকান কলকাতার লোহাপট্টিতে এবং তাঁর বসতবাড়ি গঙ্গার ধারে৷ তিনি বিপত্মীক ও নিঃসন্তান৷
তাঁর পিতার দুই বিবাহ৷ তিনি প্রথম পক্ষের পুত্র৷ দ্বিতীয় পক্ষের পুত্রের নাম নবীনমাধব, বয়স ছাব্বিশ বৎসর৷ তার পিতা পরলোকে৷ তার বিমাতা ইহলোকেই বিদ্যমান বটে, কিন্তু বাস করেন পিত্রালয়ে, কারণ অনন্তবাবুর সঙ্গে তার বনিবনা নেই৷ তবে সপত্নী-পুত্র তাকে মাসোহারা থেকে বঞ্চিত করেননি৷
অনন্তবাবুর সম্পত্তি স্বোপার্জিত এবং তার অবর্তমানে সেই সম্পত্তির অধিকারী হবে নবীনমাধবই৷ বিমাতার সঙ্গে না বনলেও অনন্তবাবু তার বৈমাত্রেয় ভাইটিকে ভালোবাসেন যার-পর-নাই এবং এনে রেখেছেন নিজের কাছেই৷
অনন্তবাবুর ম্যানেজারের নাম সুবোধ কুমার বসু, লোহার কারবারে তিনিই তার দক্ষিণ হস্তের মতো৷ দশ বছরের বিশ্বাসী লোক, প্রভুর অনেক টাকা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন৷
ঘটনার দিন কার্যসূত্রে অনন্তবাবুকে যেতে হয়েছিল আসানসোলে৷ সেইদিন সন্ধ্যার সময়ে দোকান বন্ধ করে সুবোধ পঁচিশ হাজার টাকা নিয়ে অনন্তবাবুর বাড়িতে আসে এবং দোতলার ঘরে লোহার সিন্দুকে টাকাগুলি রাখে৷ তারপর ঘরের দরজায় তালা দিয়ে সিন্দুকের ও দরজার চাবি নবীনমাধবের হাতে অর্পণ করে নিজের বাসায় চলে যায়৷ সে বাস করে গঙ্গার অপর পারে, ঘুষুড়ীতে৷
নবীন সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে ভোর বেলায়৷ রাত্রি বেলায় বাড়িতে ছিল এক জন দারোয়ান, একজন ভৃত্য৷ আরও একজন দারোয়ান ও এক জন ভৃত্য অনন্তবাবুর সঙ্গেই আসানসোলে গিয়েছিল৷ পাচক ও দাসী ঠিকা, তারা রাত্রে বাড়িতে থাকে না৷
সকালে নবীন বাড়ি ফিরে আসবার আগেই ভৃত্য রঘুর নিদ্রাভঙ্গ হয়৷ সে বাইরে এসে দেখে, উঠোনের উপরে পড়ে আছে দারোয়ানের অচৈতন্য দেহ, তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাতের চিহ্ন, মাটির উপরে রক্তের ধারা৷ আর একগাছা রুপো-বাঁধানো, মোটা রক্তাক্ত লাঠি৷
তার চিৎকারে যখন লোকজন জড়ো হয়েছে, সেই সময়েই নবীন বাড়িতে ফিরে আসে৷ তারপর দেখা যায়, দোতলায় অনন্তবাবুর ঘরের দরজা খোলা, লোহার সিন্দুকেরও দরজা খোলা, পঁচিশ হাজার টাকা অদৃশ্য৷ নবীন তৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দেয়৷
পুলিশ-তদন্তে এই তথ্যগুলি প্রকাশ পেয়েছে:
দরজার ও লোহার সিন্দুকের চাবি কাল থেকে আজ পর্যন্ত নবীন একবারও কাছছাড়া করেনি৷ অথচ দরজার তালা ও সিন্দুকটা যে চাবি দিয়েই খোলা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনোই সন্দেহ নেই৷
রাত্রে সে কোথায় ছিল, এই প্রশ্নের উত্তরে নবীন বলে, এক বন্ধুর বাড়িতে৷ কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে বন্ধুর নাম ও ঠিকানা আদায় করা যায়নি৷
দারোয়ানের দেহের পাশে যে মোটা লাঠিগাছা পাওয়া গিয়েছে, তার অধিকারী যে স্বয়ং নবীন সেটাও প্রমাণিত হয়েছে৷
ভৃত্য রঘু বলে, রাত্রে সে কোনো শব্দ শোনেনি৷ দারোয়ান তাকে সিদ্ধি খাইয়ে দিয়েছিল৷ সিদ্ধি খেতে সে অভ্যস্ত নয়, ঘুমিয়ে একেবারে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল৷
অপরাধী যে কেমন করে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করেছিল, এ সমস্যার কোনোই সমাধান হয়নি৷ সদর দরজা রঘু নিজের হাতে বন্ধ করেছিল৷ বাইরে থেকে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করবার দ্বিতীয় কোনো উপায়ই নেই৷
দারোয়ানই কি কড়া নাড়া শুনে অপরাধীকে দরজা খুলে দিয়ে পরে তার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে? এ প্রশ্নেরও জবাব পাবার উপায় নেই৷ কারণ, দারোয়ান এখনও অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে৷
সমস্ত শুনে জয়ন্ত মুখে কিছু বলল না৷ বাড়ির বাইরে গিয়ে খানিকক্ষণ এদিকে-ওদিকে ঘোরাঘুরি করে, আবার ফিরে এসে সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সুন্দরবাবু, আপনি ঠিকই বলেছেন৷ বাইরে থেকে এ বাড়ির ভিতরে আসবার কোনো উপায় নেই৷’
-‘তাহলে অপরাধী বাড়ির ভেতরে এল কেমন করে?’
-‘এই সদর দরজা দিয়ে৷’
-‘দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ ছিল!’
জয়ন্ত জবাব দিল না৷ নীচের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সে উবু হয়ে বসে পড়ল৷ তারপর মাটির উপর থেকে কী একটা তুলে নিয়ে চোখের কাছে এনে পরীক্ষা করল৷ তারপর পকেটের ভিতর থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে জিনিসটা মুড়ে রাখল৷
সুন্দরবাবু শুধোলেন, ‘কী ওটা?’
জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘একরত্তি মাটি৷ সে নতমুখে এদিকে-ওদিকে চোখ বুলোতে বুলোতে অগ্রসর হল৷ উঠোনের উপরে আবার বসে পড়ল৷ আবার কী তুলে নিয়ে মোড়কের ভিতরে রেখে উঠে দাঁড়াল৷
সুন্দরবাবু বললেন, ‘আবার কী পেলে হে!’
-‘আবার একরত্তি মাটি৷’
-‘খালি খালি মাটি কুড়িয়ে ছেলেখেলা করছ কেন? কাজের কথা বলো৷’
-‘দোতলায় চলুন৷ যে ঘর থেকে টাকা চুরি গিয়েছে সেইখানে৷’
কিন্তু সেখানে নুতন কিছুই আবিষ্কৃত হল না৷
জয়ন্ত বলল, ‘এ মামলায় একটা মস্ত সূত্র হচ্ছে নবীনের রক্তাক্ত লাঠিগাছা৷’
-‘হুম, আরও দুটো বড়ো সূত্র আছে৷ প্রথম, নবীনের কাছে ছিল দরজার আর সিন্দুকের চাবি৷ দ্বিতীয়, কাল কোথায় রাত্রিবাস করেছিল, সেকথা সে বলতে নারাজ কেন?’
জয়ন্ত মাথা নেড়ে বলল, ‘উঁহু, ওর চেয়ে বড়ো সূত্র হচ্ছে ওই লাঠিগাছা৷’
-‘হ্যাঁ, ওই সূত্র ধরে আমি নবীনকে গ্রেফতার করতে পারি৷’
-‘আপাতত সে চেষ্টা করবেন না৷’
-‘যদি সে পালায়?’
-‘আমি নবীনের মুখ দেখেছি৷ বুদ্ধিমানের মুখ৷ বোকার মতন এখন পালিয়ে গিয়ে সে নিজের পায়ে কুড়ুল মারবে না৷’
-‘ওই নবীন আর সুবোধ এইদিকে আসছে৷ ওদের কিছু জিজ্ঞাসা করবে কি?’
নবীন ও তার পিছনে পিছনে সুবোধ এসে দাঁড়াল জয়ন্তর সামনে৷ নবীনের মুখশ্রী, দেহের গঠন ও গায়ের রং চমৎকার৷ চোখের চাহনি শিশুদের মতন সরল৷ কিন্তু কারুর মুখ দেখে পুলিশ ভোলে না৷ কারণ, এমন অপরাধীর সংখ্যাও অল্প নয়, যাদের মতো দেববাঞ্ছিত চেহারা পেলে মুনি-ঋষিরাও নিজেদের ভাগ্যবান মনে করতেন৷
সুবোধের চেহারাও নিরীহ গোছের, শ্যামবর্ণ, দোহারা দেহ, মাথায় মাঝারি, মুখ হাসি-হাসি৷ চেহারায় কোনো বৈশিষ্ট্য না থাকলেও মানুষটিকে মন্দ বলে মনে হয় না৷
জয়ন্ত বলল, ‘আসুন নবীনবাবু৷ বলতে পারেন, দারোয়ানের দেহের পাশে আপনার লাঠিগাছা পাওয়া গেছে কেন?’
শুষ্ককন্ঠে নবীন বলল, ‘কেমন করে বলব মশাই; আমার নিজের মনেও বার বার জাগছে ওই প্রশ্নই৷ আমি হতভম্ব হয়ে গেছি৷’
সুবোধের দিকে ফিরে জয়ন্ত বলল, ‘শুনলাম আপনার বাড়ি ঘুষুড়ীতে৷ আপনি কি রোজ সেখান থেকে আনাগোনা করেন, না কলকাতাতেও কোনো বাসা রেখেছেন?’
সুবোধ বলল, ‘গঙ্গার এপারে কলকাতা, ওপারে ঘুষুড়ী৷ দূর তো বেশি নয়, তাই ঘুষুড়ী থেকেই আনাগোনা করি৷’
-‘অনন্তবাবু আপনাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করতেন?’
সুবোধ ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, ‘কিন্তু কালকের ঘটনার পরও তিনি কি আর আমাকে বিশ্বাস করবেন?’
নবীন বলল, ‘আমিও কেমন করে দাদার কাছে মুখ দেখাব জানি না৷’
জয়ন্ত বলল, ‘আপনাদের বেয়ারা রঘুকে একবার আসতে বলুন৷’
রঘু এলে জয়ন্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাদের সদর দরজা থেকে উঠোন পর্যন্ত রোজ ধোয়া-মোছা, ঝাঁট দেওয়া হয়?’
রঘু হাত জোড় করে বলল, ‘হ্যাঁ হুজুর, দু-বেলাই৷ কর্তাবাবু কোথাও এক তিল ধুলো দেখলে রেগে আগুন হয়ে ওঠেন৷’
সদরের জানলা দিয়ে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে জয়ন্ত বলল, ‘এত কাছে গঙ্গা, তোমরা নিশ্চয়ই রোজ গঙ্গাস্নান কর!’
-‘না হুজুর, গঙ্গায় স্নান করতে যাই কালেভদ্রে৷’
-‘কাল সকালে কি বৈকালে তোমাদের কেউ গঙ্গাস্নান করতে যায়নি?’
-‘না, হুজুর৷’
-‘সুন্দরবাবু, আমার আর কিছু জিজ্ঞাস্য নেই৷ এসো মানিক৷’
জয়ন্ত ও মানিকের সঙ্গে সুন্দরবাবুও নীচে নেমে শুধোলেন, ‘কী হে ভায়া, উঠোন ঝাঁট দেওয়া, গঙ্গাস্নান করার সঙ্গে টাকা চুরির সম্পর্কটা কোনখানে?’
-‘এখন বুঝবেন না৷’
-‘নতুন কোনো সূত্র পেয়েছ বুঝি?’
-‘পেয়েছি৷ সবচেয়ে বড়ো সূত্র৷’
-‘সূত্রটা কী?’
-‘একরত্তি মাটি৷’
জয়ন্তর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে সুন্দরবাবু বললেন, ‘হুম, তুমি একটি আস্ত বাতুল৷’
পথ দিয়ে যেতে যেতে মানিক বলল, ‘আমিও একরত্তি মাটির মানে বুঝলাম না৷ তুমি এখন কী করবে?’
-‘তথ্যানুসন্ধান৷ আমার বিশ্বাস এটা জটিল মামলা নয়৷ চোর ধরা পড়তে বেশি বিলম্ব হবে না৷’
-‘কারুকে তুমি সন্দেহ করছ?’
-‘কারুকে না, কারুকে না৷ অর্থাৎ সকলকেই৷ নবীন, সুবোধ থেকে শুরু করে, এ বাড়ির পাচক, দারোয়ান, বেয়ারা, দাসী, সকলকেই৷ অথবা চোর হচ্ছে কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তি, কিন্তু তা হলেও বাড়ির কেউ-না-কেউ যে তাকে কোনো সাহায্য করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নাস্তি৷ আর কোন দিক থেকে সে এসেছে, তাও আমি বুঝতে পেরেছি৷’
-‘কী দেখে বুঝলে?’
-‘একরত্তি মাটি৷’
-‘জয়ন্ত, তোমার নাগাল পাওয়া ভার৷’
এক, দুই, তিন দিন কেটে গেল৷ জয়ন্ত মাঝে মাঝে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে, কিন্তু মুখে কিছু বলে না৷
চতুর্থ দিনের প্রভাতি চায়ের আসরে সুন্দরবাবু যথারীতি উপস্থিত৷
টেলিফোনের ঘণ্টি বেজে উঠল৷ রিসিভার ধরে জয়ন্ত বলল, ‘হ্যালো! হ্যাঁ, আমি জয়ন্ত৷ নমস্কার৷ কী বললেন? যাকে খোঁজা হচ্ছে, তাকে পেয়েছেন? অতিশয় সুসংবাদ৷ তার নাম কী?-রামলাল? বেশ, বেশ তাকে আজ দুপুরেই আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারবেন? আচ্ছা, ধন্যবাদ৷’
সুন্দরবাবু শুধোলেন, ‘কীসের সুসংবাদ জয়ন্ত?’
জয়ন্ত বলল, ‘সুন্দরবাবু, আজ বৈকালে অনন্তবাবুর বাড়ির সকলেই যেন এক জায়গায় হাজির থাকে, এমনকী, পাচক পর্যন্ত৷’
কৌতূহল প্রদীপ্ত মুখে সুন্দরবাবু বললেন, ‘কেন জয়ন্ত, কেন?’
-‘সকলের সঙ্গে আমি রামলাল নামে এক ব্যক্তির পরিচয় করিয়ে দিতে চাই৷’
-‘কে রামলাল?’
-‘ব্যস, এখন আর কোনো প্রশ্ন নয়৷’ এই বলে জয়ন্ত একেবারে বোবা হয়ে গেল৷
বৈকাল৷ অনন্তবাবুর বাড়ির সবাই বৈঠকখানায় হাজির৷ টেবিলের সামনের চেয়ারখানা দখল করেছেন সুন্দরবাবু৷
জয়ন্ত ও মানিকের আবির্ভাব৷ তাদের পিছনে আর একজন লোক৷ তার খালি পা, কোমর-বাঁধা কাপড়, গায়ে গেঞ্জি, জাতে সে বোধ হয় বেহারি৷
জয়ন্ত বলল, ‘সুন্দরবাবু, এই লোকটির নাম রামলাল?’
-‘হুম!’
-‘নবীনবাবু, ঘটনার দিন আপনি কোথায় রাত্রিবাস করেছেন, বলবেন না?’
নবীন কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘আমাকে মাপ করুন৷’
-‘বেশ, আপনাকে তা আর বলতে হবে না, কারণ আমি আপনার গুপ্তকথা জানতে পেরেছি৷’
নবীনের মুখ হয়ে উঠল উদবিগ্ন!
জয়ন্ত বলল, ‘রামলাল, সে রাত্রে এই নবীনবাবু কি তোমার নৌকা ভাড়া করেছিলেন?’
রামলাল বলল, ‘না হুজুর৷’
-‘তবে?’
রামলাল অঙ্গুলিনির্দেশে দেখিয়ে দিল সুবোধকে৷
জয়ন্ত বলল, ‘সুবোধবাবু, ঘটনার দিন রাত্রে আপনি রামলালের নৌকো ভাড়া করে কলকাতায় এসেছিলেন কেন?’
সুবোধের চেহারা তখন আর নিরীহের মতো দেখাচ্ছিল না৷ সে গর্জন করে বলে উঠল, ‘মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা!’
-‘কিন্তু রামলাল আপনাকে শনাক্ত করছে৷’
-‘ও ভুল দেখেছে৷’
-‘বেশ, আদালতে গিয়ে এই কথাই বলবেন৷ সকলে এখন আমার কথা শুনুন৷’
জয়ন্ত বলতে লাগল:
‘সুন্দরবাবু, আগেই আপনাকে বলেছিলুম, এ মামলায় একটা মস্ত সূত্র হচ্ছে, নবীনবাবুর রক্তাক্ত লাঠিগাছা৷
‘সুন্দরবাবু, আপনি যদি লাঠি দিয়ে দারোয়ানকে আঘাত করতেন, তাহলে নিশ্চয়ই নিজের বিরুদ্ধে অতবড়ো প্রমাণটা একটা নির্বোধের মতো ঘটনাস্থলে ফেলে রেখে যেতেন না৷
‘এখানেই বোঝা যায় তাঁর বিরুদ্ধে হয়েছিল একটা নিষ্ঠুর চক্রান্ত৷ নবীনবাবুর দিকে পুলিশের সন্দেহ আকৃষ্ট করে অপরাধী নিরাপদে বাস করতে চেয়েছে যবনিকার অন্তরালে৷ নবীনবাবুর রক্তাক্ত লাঠি পাওয়া গেছে ঘটনাস্থলে৷ ঘরের দরজার চাবিও তাঁর কাছে৷ পুলিশ সহজেই ভ্রমে পড়তে পারত৷
‘তার উপরে নবীনবাবু নিজের ব্যাপারটাকে আরও ঘোরালো করে তুলেছিলেন৷ তিনি কিছুতেই বলতে রাজি নন, ঘটনার দিন রাত্রে তিনি ছিলেন কোথায়? সে গুপ্তকথা আমি জানতে পেরেছি তাঁর মায়ের কাছে সন্ধান নিয়ে৷ তিনি ছিলেন তাঁর মায়ের কাছে৷ অনন্তবাবু তাঁর বিমাতাকে একেবারেই পছন্দ করতেন না৷ তাঁর সঙ্গে মেলামেশা করলে নবীনবাবু সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবেন, এই ছিল অনন্তবাবুর কঠিন নির্দেশ৷ নবীনবাবু রক্তের টানে দাদার অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু ভয়ে সেকথা স্বীকার করতে পারছিলেন না৷
‘নবীনবাবুর সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে আমি আর একটা সূত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলুম৷ ঘটনাস্থলে বাড়ির সদর দরজার আর উঠোনের উপরে পেয়েছিলুম দু-টুকরো মাটি৷ পরীক্ষা করেই বুঝতে পারলুম, তা গঙ্গামাটি ছাড়া আর কিছুই নয়৷ রঘু বেয়ারা বলল, ঘটনার দিন বাড়ির কেউ গঙ্গাস্নানে যায়নি৷ সে দু-বেলা বাড়ির উঠোন প্রভৃতি ঝাঁট দিয়ে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে রাখে, তবু ওখানে দু-টুকরো গঙ্গামাটি এল কেমন করে? তুচ্ছ মাটির টুকরো, কিন্তু সূত্র হিসাবে অসামান্য হয়ে উঠল৷
-‘করলুম কল্পনাশক্তি প্রয়োগ৷ মন বলল, অপরাধী এসেছে রাত্রে নৌকোয় চড়ে জলপথে৷ নদীতে তখন ভাঁটা ছিল, তাকে নামতে হল ভিজে মাটির উপরে৷ তার জুতোর তলায় লেগে গেল এঁটেল মাটি৷ সেই মাটির কিছু কিছু শুকিয়ে ঝরে পড়েছে ঘটনাস্থলে৷
‘গঙ্গার অপর পারে ঘুষুড়ীতে বাস করে সুবোধ৷ সে কেমন লোক? ঘুষুড়ীর পুলিশ সন্ধান নিয়ে সে-খবর আমাকে জানিয়েছে৷ সুবোধ হচ্ছে বিষম জুয়াড়ি৷ ঋণে সে ডুবে আছে৷ তার নৈতিক চরিত্রও ভালো নয়৷ হাতে পঁচিশ হাজার টাকা, অনন্তবাবু অনুপস্থিত, এ সুযোগ হয়তো সে ছাড়তে পারেনি৷ তার পক্ষে সিন্দুকের তালার দ্বিতীয় চাবি তৈরি করে নেওয়াও কিছুমাত্র কঠিন নয়৷ সে যদি নৌকো ভাড়া করে ঘুষুড়ী থেকে এসে থাকে; তবে নৌকোর মাঝিরও সন্ধান পাওয়া যেতে পারে সেইখানেই৷ তাই পাওয়া গেল৷ ঘুষুড়ীর পুলিশই খুঁজে বার করেছে মাঝি রামলালকে৷
‘কিন্তু সুবোধ বাড়ির ভিতরে ঢুকল কেমন করে? আমার অনুমান, রঘু বেয়ারাও ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছে৷ সেই সুবোধকে সদর দরজা খুলে দিয়েছে৷ সে কাজ সেরে যখন সরে পড়ছে, সেই সময়েই দারোয়ানের ঘুম ভেঙে যায়৷ তার পরের কথা আপনারাই অনুমান করুন৷
-‘সুন্দরবাবু, একরত্তি মাটি কি বড়ো ফ্যালনা!’
সুন্দরবাবু বললেন, ‘উহুম, উহুম!’