সুমিত্রা সিংহর বয়েস এখন আটচল্লিশ। কিন্তু মেয়েদের কাছে আটষট্টির মুখোস এঁটে থাকেন সর্বদা। শুধু মেয়েদের কাছে কেন, নানা বয়সের বিয়াল্লিশজন শিক্ষয়িত্রীও তার প্রায় মৌন অনুশাসনের ভয়ে সন্ত্রস্ত। বিচ্ছিন্ন ভাবে ঘরে ডাক পড়লে তারাও খুব স্বস্তি বোধ করেন না।
চারশো মেয়ে, বিয়াল্লিশজন শিক্ষয়িত্রী, স্কুল বাস-এর জনাকয়েক ড্রাইভার আর ক্লিনার, চারজন ঝাড়ুদার, তিনটে মালী আর হস্টেলের মেট্রন আর কিছু ঝি-চাকর নিয়ে সুমিত্রা সিংহর সাম্রাজ্য। ছোট ব্যাপার কিছু নয়। সকলের সকল স্বার্থ বজায় রেখে নিয়ম শৃঙ্খলার সঙ্গে একটা স্কুল চালানো বেশ ধকলের কাজ। আজ ছবছর ধরে শক্ত হাতে এই প্রতিষ্ঠানটির হাল ধরে আছেন তিনি। স্কুল কর্তৃপক্ষ নির্বিবাদে এখন তার সব সুপারিশ মেনে চলেন। সব থেকে উঁচু আসনটি তাঁর দখলে আসার পর থেকে বছরের পর বছর বোর্ডের পরীক্ষার রেজাল্ট দেখছেন তারা। শুধু এরই ফলে স্কুলে প্রতি বছর নতুন ভর্তির হিড়িক সামলানো দায়। কোন ক্লাসে সাতটা সীট খালি থাকলে তিনশো মেয়ে পরীক্ষা দিতে বসে যায়। এ ব্যাপারে হোমরা চোমরাদের সুপারিশ অচল। তাছাড়া সুমিত্রা সিংহ আসার পর গার্জেনদের অবুঝ দাপট কমেছে, শিক্ষয়িত্রীদের দলাদলি গেছে। হবিতম্বি করতে এসে অনেক গার্জেনকে মুখ বুজে মেয়ের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে যেতে হয়েছে। কয়েকজন অকেজো বা অবাধ্য টিচারকে অবসর নিয়ে যেতে হয়েছে। সর্বাধিনায়িকাটির সুনজরে পড়তে হলে ক্লাসের। মেয়েদের ভালর জন্যে প্রাণপাত করতে হবে–এ এখন সব শিক্ষয়িত্রীরাই বুঝে নিয়েছেন।
বেশি পরিশ্রম করতে হয় বলে সকলেই তুষ্ট নয়। এত দাপট দেখে ভিতরে ভিতরে কারো বা ঈর্ষা। তারা দেমাক দেখেন, দম্ভ দেখেন। রূপের দেমাক। রূপসী আদৌ নন, কিন্তু সুশ্রী বটেই। তাছাড়া স্বাস্থ্যের বাঁধুনি এমন যে আটচল্লিশ বছর বয়সটাকে অনায়াসে চল্লিশে টেনে নামানো যায়। আর এদের চোখে দম্ভ বলতে শিক্ষার দম্ভ। ইংরেজিতে কলকাতার এম, এ আর এম, এড। সুযোগ সুবিধে পেলে ওরকম বিলেতি ছাপ যে কেউ নিয়ে আসতে পারে। বেড়ালের ভাগ্যে ক্কচিৎ কখনও শিকে ঘেঁড়েও। স্কুলমাস্টারি করতে করতে হঠাৎ সরকারী দাক্ষিণ্যের সুযোগে সুমিত্রা সিংহও তেমনি কিছুদিন বিলেতে ঘুরে এসেছেন। আড়ালে আবডালে এই সরকারী দাক্ষিণ্য লাভের ব্যাপারেও কেউ কেউ জটিল সংশয়ের ছায়া ফেলতে ছাড়েন না। বয়েসকালের সুশ্রী মেয়ের সুপটু তোষামোদে কত কি হয়, কত কি হতে পারে। কিন্তু দেয়ালেরও কান আছে। একান্ত বিশ্বস্তজন ভিন্ন কারো মনের কথা মুখে ফোটে না।
সুমিত্রা সিংহ যেখান দিয়ে হাঁটেন চলেন, শিক্ষয়িত্রীরা ঠাণ্ডা, মেয়েরাও সন্ত্রস্ত। আর ঘরে ডাক পড়লে তো কথাই নেই, ভিতরে ভিতরে ঘাম হতে থাকে।
সুমিত্রা সিংহর বাড়ির চালচলনেও রকমফের নেই খুব। এখানেও একটা হালকা গাম্ভীর্য ছুঁয়ে আছে তাকে। এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে নতুন ডাক্তার, মেয়ে কলেজে পড়ে। ছেলে আর মেয়ে তাদের ডক্টরেট বাপের থেকে মাকে বেশি সমীহ করে। ডক্টরেট ভদ্রলোক ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বই পড়েন আর থেকে থেকে স্ত্রীর গম্ভীর মুখের ওপর দুচোখের কৌতুক ছড়ান। সেটা কখনও-সখনও ধরা পড়ে না এমন নয়।
স্ত্রীটি তখন থমকে তাকান।
–কি?
কি?
হাসছ মনে হচ্ছে?
এটা সেটা বলে ভদ্রলোক সামলে নেন। য়ুনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের প্রফেসার তিনি। আপন মনে হাসার অনেক কারণ তার ঠোঁটের ডগায় মজুত। মহিলার তখনো প্রধান শিক্ষয়িত্রীর সন্দিগ্ধ চোখ। এ নিয়ে এই সেদিন আরো একটু মজার ব্যাপার ঘটে গেছল। শনিবার বিকেল চারটের মধ্যে বাড়ি ফিরেছিলেন। ডক্টর সিংহ অন্য দিনের মতোই বই হাতে ইজিচেয়ারে শয়ান। ভদ্রলোকের দুতিন ঘণ্টার বেশি ক্লাস থাকে না বলে স্ত্রী তার চাকরিটাকে ফাঁকিবাজী ছাড়া আর কিছু ভাবেন না! এক এক সময় খোঁটাও দেন–মাস্টাররা যে রকম পরিশ্রমকাতর ছেলেরা কত আর মানুষ হবে!
সুমিত্রা সিংহর মেজাজ খুব প্রসন্ন ছিল না সেদিন। স্কুলের কোন একটা ভাবনা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। তারপর প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে সেই চিন্তা করেছেন, মাঝে মাঝে ভুরু কুঁচকে ঘরে আর সামনের বারান্দায় পায়চারি করেছেন।
হঠাৎই এক সময় খেয়াল হল বই কোলের ওপর ফেলে স্বামীটি সকৌতুকে চেয়ে আছেন তাঁর দিকে। ভুরুর ভাজ আরো একটু ঘন হল–হাসছ যে?
ভদ্রলোক সেদিন সত্যি কথাই বললেন। জবাব দিলেন, তোমাকে দেখে।
আমাকে দেখে হাসছ মানে?
বাজারে সাদা কলপ কিনতে পাওয়া যায় কিনা দেখো, তোমার এই চালচলন মানাচ্ছে না।
তার মানে?
কাছে এস, বলছি।
সত্যিই এখন শুধু সমস্যার জগৎ আর চিন্তার জগতে বাস মিসেস সুমিত্রা সিংহর। সঠিক না বুঝে কাছে এসে দাঁড়ালেন। হাত ধরে আচমকা আরো কাছে টেনে যে কাণ্ডটা করে বসলেন ভদ্রলোক দিশেহারার মত ছিটকে সরে দাঁড়ালেন মহিলা। আরক্ত মুখে আর অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলেন খানিক। ভদ্রলোক কৈফিয়ৎ দিলেন, সেজন্যেই তো সাদা কলপের কথা বলছিলাম, তোমাকে দেখলে আমার এখনো এই সাধ জাগে তো কি করব।
সুমিত্রা সিংহ এরপর পনেরো মিনিট ধরে শাসালেন তাঁকে। শোওয়ার ঘর আলাদা করে দেবার হুমকি দিলেন, বয়েস কালের ধর্ম আর শৃঙ্খলা মেনে চলার কথা বললেন, দরজা কপাট হাঁ করা খোলা, ছেলেমেয়েরা একজন কেউ দেখে ফেললে কি কাণ্ড হত সে কথা পাঁচবার করে শোনালেন।
ভদ্রলোক বেচারা দোষ স্বীকার করে বললেন, দরজ, কপাট বন্ধ না করে এ রকম গর্হিত কাজ আর কখনো করবেন না।
ভদ্রমহিলা দ্বিগুণ আগুন হয়ে ঘর ছেড়ে প্রস্থান করলেন। এরপর কটা দিন মায়ের মেজাজ দেখে ছেলে মেয়ে অবাক। বাবার সামনেই কথায় কথায় আত্মসংযম সম্পর্কে ধারালো উপদেশ শুনতে হয়েছে তাদের।
সুমিত্রা সিংহ স্কুলে নিজের ঘরে বসে আছেন। কঠিন থমথমে মুখ। অসংযম আর শৃঙ্খলাভঙ্গের এক দারুণ নালিশ এসেছে তার কাছে। অপরাধী একেবারে উঁচু ক্লাসের পাঁচটি মেয়ে। স্কুল হস্টেলে থাকে তারা। নিজের স্কুলে এত বড় অপরাধের কথা তিনি ভাবতে পারেন না। কিন্তু অবিশ্বাস করার কিছু নেই। অপরাধের নজির তার সামনে। স্কুল লাইব্রেরির কতগুলো ঘেঁড়া-খোঁড়া বই। অসংযত ঘূর্তির উল্লাসে ওই মেয়েগুলো ছিঁড়েছে। বইয়ের নানা জায়গায় অশ্লীল মন্তব্য লেখা। সেও ওই মেয়েগুলোর কাজ। এ ছাড়া তাদের কতগুলো নোঙরা চিঠিচাপাটি হাতে নাতে ধরা পড়েছে। রেসিডেন্সিয়াল টিচার আর মেট্রন সেগুলোও হেডমিসট্রেসের কাছে দাখিল করেছেন।
সব দেখে শুনে সুমিত্রা সিংহর নিজেরই আত্মস্থ হতে সময় লেগেছে। তারপর ঠাণ্ডা মুখে ওই পাঁচ মেয়ের সম্পর্কে রিপোর্ট নিয়েছেন তিনি। পাঁচটি মেয়ের মধ্যে চারজন স্কুলের পুরনো ছাত্রী এবং মোটামুটি ভাল ছাত্রী। কেবল একটি মেয়ে নতুন। নাম নন্দিতা বসু। গেল বছর অন্য স্কুল থেকে ট্রান্সফার নিয়ে এই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কোনরকম ধর-পাকড়ের জোরে নয়, পঞ্চাশ ষাটজন বাইরের মেয়ের মধ্যে এখানকার অ্যাডমিশন টেস্টে সমস্ত পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে ভর্তি হয়েছিল। তারপর গেলবারের অ্যানুয়াল পরীক্ষায়ও ওই মেয়ে সমস্ত বিষয়ে ফার্স্ট হয়ে ক্লাস প্রমোশন পেয়েছে। কিন্তু পড়াশুনায় যত ভালই হোক ওই মেয়েই সমস্ত নষ্টের গোড়া। এসব অপকর্ম বেশীরভাগই তার। কাউকে পরোয়া করে না। ওই একটা মেয়েই বাকি চারটে মেয়েকে এভাবে নষ্ট করছে। ধরা পড়ার পর এই মেয়েরা ঘাবড়ে গিয়ে রেসিডেন্সিয়াল টিচারের কাছে সব কবুল করেছে। মেট্রন আরো জানালেন ধরা পড়ার পরেও ওই নন্দিতা বসুরই কেবল বেপরোয়া হাবভাব।
অভাবনীয় একটা শাস্তির নজির রাখার সংকল্প নিয়েছেন সুমিত্রা সিংহ। তার নামেই সমস্ত মেয়ের রক্ত জল, কোনদিন কোন মেয়ের গায়ে হাত তোলার দরকার হয়নি। কিন্তু এ ঘটনা সব কিছুর ব্যতিক্রম। তিনটে বেত আনিয়ে টেবিলের ওপর রাখলেন। তার নির্দেশমত রেসিডেন্সিয়াল টিচার আর মেট্রন ওই পাঁচ মেয়েকে ডেকে নিয়ে আসতে গেলেন।
শাস্তি কি দেবেন সুমিত্রা সিংহ সেটা স্থির করে ফেলেছেন। নতুন মেয়ে নন্দিতা বসু যত ভাল ছাত্রীই হোক এতখানি অধঃপতনের পর তাকে আর স্কুলে রাখবেন না। তাই তার গায়ে হাত তোলা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তাকে সেটা বুঝতে দেবেন না। তার সামনে চার মেয়েকে শাস্তি দেবার পর ব্যাড কন্ডাক্ট-এর ছাপ মেরে তাকে স্কুল থেকে তাড়াবেন।
পাঁচ মেয়েই এল। পিছনে রেসিডেন্সিয়াল টিচার আর মেট্রন। পুরনো চার মেয়ের বিবর্ণ পাংশু মুখ। এমনিতেই থর থর কাঁপছিল, প্রধান শিক্ষয়িত্রীর মূর্তি দেখে আর টেবিলের ওপর বেত দেখে তাদের আরো হয়ে গেছে। চারজনই হাত জোড় করে নিঃশব্দে ক্ষমা চাইছে।
ক্ষমাশূন্য চোখে একে একে সবকটি মেয়েকে দেখলেন সুমিত্রা সিংহ। সব শেষে নন্দিতা বসুকে। মেয়েটার তখনো উগ্র হিংস্র চাউনি। নতুন বয়সের খাঁচায় পোরা এক উদ্ধত জীব যেন। সংকল্প ভুলে সকলকে ছেড়ে ওকেই মাটিতে শুইয়ে ফেলার জন্যে হাত নিশপিশ করে উঠল সুমিত্রা সিংহর। কিন্তু নিজে তিনি সংযম খুইয়ে বসতে পারেন না।
ওই নন্দিতা বসু মেয়েটার দিকে কয়েক পলক চেয়ে থাকার পরই নিজের ভিতরে কেমন যেন একটা নাড়া-চাড়া পড়ল সুমিত্রা সিংহর। এই মেয়ের মুখে কার যেন চেনা আদল একটা। ঠিক মনে করে উঠতে পারছেন না, কিন্তু এই মুখে কার একখানা মুখ যেন হুবহু বসানো!
কয়েক নিমেষের অন্যমনস্কতা ঝেড়ে ফেলে সুমিত্রা সিংহ কর্তব্যে মন দিলেন। বেতের আঘাতে আঘাতে এক একটা মেয়ে আর্তনাদ করে মাটিতে লুটোপুটি খেতে লাগল আর তার পা জড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে লাগল। তখনো নির্মম কঠিন তিনি। শাস্তির পর একটি করে মেয়েকে বিদায় দিয়ে পরেরটিকে ধরেন। ঘরের মধ্যে শুধুই একটা ত্রাসের হাওয়া বইছে।
কিন্তু একটা করে মেয়ের ওই আর্তনাদের মুখেই এক একবার নন্দিতা বসুর দিকে চোখ গেছে তার। উদ্ধত আক্রোশে মেয়েটা যেন ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু বন্ধ দরজার সামনে মেট্রন দাঁড়িয়ে, বাইরে দরোয়ান। এক একটা মেয়ের শাস্তি শেষ হলে তবে দরজা খুলে তাকে বার করে দেওয়া হচ্ছে। তখনো সুমিত্রা সিংহর মনে হয়েছে রাগ হলে কার একখানা মুখের চিবুক আর ঠোঁট ওই মেয়েটার মতই বেঁকে যেতে দেখেছেন কবে। আবারও মনে হয়েছে মেয়েটার অমন সুশ্রী মুখের সঙ্গে কার যেন আশ্চর্যরকম মিল।
চার নম্বর পুরনো মেয়েও বেত্রাঘাতে জর্জরিত হয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে ঘর ছেড়ে চলে গেল। সুমিত্রা সিংহ হাঁপাচ্ছেন বেশ। দুচোখ জ্বলছে। নিজের চেয়ারে বসে সোজা একবার তাকালেন নন্দিতা বসুর দিকে। সব থেকে বেশি দাগী মেয়েটা এখন বেপরোয়া উদ্ধত চোখেই চেয়ে আছে তার দিকে।
সুমিত্রা সিংহ ইশারায় রেসিডেন্সিয়াল টিচার আর মেট্রনকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বললেন।
তারা অনিচ্ছাসত্ত্বেই প্রস্থান করল। এই মেয়ের শাস্তিটাই বিশেষ করে চোখে দেখার ইচ্ছে ছিল বোধহয়।
ঘরের মধ্যে দুজনে মুখোমুখি এবার। চোখাচোখি।
অনুচ্চ কঠিন গলায় সুমিত্রা সিংহ জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নাম নন্দিতা বসু?
হ্যাঁ। আপনি আমার গায়ে হাত তুলবেন না, ইচ্ছে হলে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেন।
মুহূর্তের জন্যে সংযম হারালেন সুমিত্রা সিংহ। উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল থেকে বেতটা তুলে নিয়ে মেয়েটার কাধ বেড়িয়ে একটা প্রচণ্ড আঘাত করে বসলেন। কিন্তু ওই একটাই। সুশ্রী মেয়েটার রক্তবর্ণ মুখ এখন। চেয়ে আছে। প্রহারের জবাবটা যেন চোখ দিয়ে দিচ্ছে। সুমিত্রা সিংহ বুঝে নিলেন আঘাতে আঘাতে মাটিতে শুইয়ে ফেললেও এ মেয়ের মুখ দিয়ে কান্নার শব্দ বেরুবে না।
তার দরকারও নেই। সংকল্প মতই কাজ করবেন। কিন্তু মেয়েটার এই মুখের আদল কেন যেন বড় বেশি বিমনা করে তুলছে তাকে।
বসলেন আবার। তেমনি কঠিন গলায় ফের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার মায়ের নাম কি?
সুজাতা বোস।
না, সুমিত্রা সিংহ এই নামের কাউকে চিনলেন না।
বাবার নাম কি?
নীতিশ বোস।
নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বুকের তলায় কি রকম একটা তোলপাড় কাণ্ড হয়ে। গেল সুমিত্রা সিংহর। একটা অস্পষ্টতার পর্দা সরে গেল চোখের সামনে থেকে। হ্যাঁ, অবিকল সেই নাক মুখ চোখই বটে। ঠোঁট বাঁকানোটা পর্যন্ত সেই রকম। জিজ্ঞাসা করার দরকার ছিল না, তবু প্রশ্নটা যেন আপনা থেকেই গলা দিয়ে বেরিয়ে এল।–কি করেন?
বার অ্যাট ল। হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন।
না, কোথাও ভুল নেই, বিয়ের পর নীতিশ বোসের ব্যারিস্টারি পড়ার জন্যেই বিদেশ যাওয়া স্থির ছিল।
দীর্ঘকালের শিক্ষয়িত্রী জীবনে এ রকম আর কখনো হয়নি। মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে চেষ্টা করেও নিজেকে আর অত কঠিন করে তুলতে পারছেন না। সুমিত্রা সিংহ। জিজ্ঞাসা করলেন, কলকাতাতেই বাড়ি, তবু তুমি বাবা মায়ের সঙ্গে থাক না কেন?
মেয়েটা সাদাসাপটা জবাব দিল, মা বাবার সঙ্গে থাকেন না, ডিভোর্স হয়ে গেছে। বাবা তাই আমাকে হস্টেলে রেখেছেন।
সব ভুলে সুমিত্রা সিংহ বিমূঢ় মুখে মেয়েটার দিকে চেয়ে রইলেন খানিক। মেয়েটা পড়াশুনায় এত ভাল, তা সত্ত্বেও এ রকম উজ্জ্বল হয়ে ওঠার কারণ যেন বুঝতে পারছেন তিনি। মেয়েটার কথা-বার্তায় আচরণে একটা চাপা ক্ষোভ স্পষ্ট।
তোমার বাবার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হতে পারে?
মেয়েটা টেলিফোন নম্বর বলে দিল।
কখন ফ্রী থাকেন তিনি?
সন্ধ্যার পর। সমস্ত দিন ব্যস্ত থাকেন।
আচ্ছা, তুমি যেতে পারো।
উদ্ধত মখেই মেয়েটা চলে গেল। সে কেমন করে যেন ধরে নিয়েছে অন্য কটা মেয়ের থেকে তার শাস্তি কঠিন হবে। অর্থাৎ বাবাকে বলে স্কুল থেকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে তাকে।
প্রায় আধঘণ্টা স্থাণুর মত চুপচাপ বসে রইলেন সুমিত্রা সিংহ। সাড়ে নটায় স্কুল, এখন সকাল সাড়ে দশটা। কি ভেবে ফোনের রিসিভার তুলে নিয়ে নম্বর ডায়াল করলেন।
পেলেন।
বোস হিয়ার।
আমি আপনার মেয়ের স্কুলের হেড-মিস্ট্রেস মিসেস সিংহ।… আপনার মেয়ে নন্দিতার গ্রোস মিস কর্ডাক্টের সম্পর্কে আপনার সঙ্গে কথা হওয়া দরকার। তাকে আর এ স্কুলে রাখতে পারা শক্ত।
ওদিকের ভারী গলার স্বর থমকালো একটু।–কি মিস কনডাক্ট?
সেটা টেলিফোনে বলা সম্ভব নয়।
আই সি…বাট আই অ্যাম অফুলি বিজই…একমাত্র সন্ধ্যার পর বাড়িতে দেখা হতে পারে, বাট দ্যাট উইল বি পারহ্যাপস্ টু মাচ টু আস্ক
এদিক থেকে আরক্ত মুখে সুমিত্রা সিংহ বললেন, ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুতর এবং জরুরী–আপনার আসা দরকার।
বাট ইউ সি, আই কান্ট পসিবলি মেক এই টাইম। ঈষৎ অসহিষ্ণু কণ্ঠস্বর। ইউ ডু ওয়ান থিং ম্যাডাম, কাইন্ডলি সেণ্ড এভরিথিং ইন রাইটিং, আই উইল সি টু ইট। থ্যাঙ্ক ইউ।
রিসিভার নামিয়ে রাখার শব্দ।
অসহিষ্ণু মুখে সুমিত্রা সিংহ ঘরের মধ্যে পায়চারি করে নিলেন খানিক। এরপর সোজাসুজি ওই মেয়ের বিরুদ্ধে চরম ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন নেবার কথা তার। তিনি সদয় হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লোকটার এত সাহস আর এত দম্ভ যে ঘুরিয়ে বাড়িতে দেখা করার কথা বলল। কিন্তু আশ্চর্য, এর পরেও তিনি যা করণীয় করে উঠতে পারলেন না। মেয়েটার প্রতি তার মায়া বাড়তেই থাকল। তার ধারণা, পুঞ্জীভূত ক্ষোভ নিয়ে বিকৃত পথে চলেছে এমন ভাল মেয়েটা ৮ হ্যাঁ, এখনো তার উদার হবার ইচ্ছে। উদার হতে পারলে কোথায় যেন একটু শান্তিও। …প্রায় পঁচিশ বছর আগের একখানা মুখ চোখে ভাসছে তাঁর। ওই সুশ্রী মেয়েটার সঙ্গে মুখের আদল হুবহু মেলে যাঁর সঙ্গে তার। নীতিশ বোসের।
সুমিত্রার বয়েস তখন তেইশ। তখন সিংহ হননি। ঘোষ, সবে এম-এ পাশ করেছেন। এবারে নীতিশ বোসের সঙ্গে বিয়েটা হয়ে যাবার কথা। বাপে-বাপে বন্ধুত্ব। অনেক দিন আগে থেকেই কথা পাকা। বোসেরা বনেদী বড়লোক। সুমিত্রার বাবা-মা নিশ্চিন্ত। বিয়ের পরেই ছেলে বিলেত চলে যাবেন ব্যারিস্টারি পড়তে অতএব তার পক্ষে ঘন ঘন এ বাড়িতে আসার লোভটা স্বাভাবিক। নীতিশ বোস সপ্তাহে কম করে চার পাঁচদিন আসতেন আর সে রকম ফাঁক পেলে ভাবী স্ত্রীর ওপর একটু আধটু মিষ্টি হামলাও করে বসতেন। সুমিত্রাকে নিয়ে বেরুনোর তাগিদ দিতেন। কিন্তু সুমিত্রার দিক থেকে তেমন সাড়া পেতেন না বলে কখনো রাগ হত কখনো বা অভিমান।
সুমিত্রার জীবনে যথার্থই সংকটের কাল সেটা। রাশভারী বাবাকে কিছু বলা যাচ্ছে না। বলা যাচ্ছে না, কারণ ওখানে বিয়ে অনেক দিন ধরেই ঠিক। অথচ তিন বছর হল পিছনের বাড়ির এক ছেলের কাছে মন সঁপে বসে আছেন তিনি। গরীব ঘরের ছেলে। স্কলারশিপ পেয়ে নিজের পড়াশুনা চালাচ্ছেন। কোন এক দুর্বল মুহূর্তে সেই ছেলেও সুমিত্রার আশ্বাস পেয়ে ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন। বড়লোকের হবু ব্যারিস্টার ছেলের মনের মত অনেক মেয়ে জুটবে, কিন্তু কথার খেলাপ করলে এই ছেলের বুক ভেঙেই যাবে একেবারে।
সেই সংকটের ফলে জীবনে একটাই মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছিল তাকে। মাকে স্পষ্ট করে বলেছেন, বাবাকে জানিয়ে দাও এ বিয়েতে আমার আপত্তি আছে।
মা আকাশ থেকে পড়েছিলেন একেবারে।সে কি রে! কেন?
কেন আবার কি! সুমিত্রা মরিয়া একেবারে।–বড়লোকের ছেলে, এখনই মদের নেশা, পরে আরো কত গুণ দেখা যাবে কে জানে। আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি, আমার আপত্তি আছে।
ওই একটা জিনিস বাবা আন্তরিক ঘৃণা করেন সুমিত্রার সেটা খুব ভাল জানা ছিল। এই এক কারণে বাবার সঙ্গে কাকার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। অতএব আর কোন উপায় না দেখে সুমিত্রা এই পথ ধরেই সংকট কাটিয়ে উঠতে চেয়েছেন। হবু ব্যারিস্টারের বাড়িতে এ কথা তো কোনদিন প্রকাশ হবে না, তাদের আর এমন কি ক্ষতি। বিয়েটা নাকচ হবে শুধু।
নাকচ হয়েছে। সুমিত্রার ধারণা বাবা শুধু তাদের জানিয়ে দিয়েছেন মেয়ের আপত্তির কারণে এ বিয়ে হল না। এ ছাড়া আর বলার কি আছে?
তারপর কথা যাঁকে দেওয়া হয়েছে সময়ে তাকেই বিয়ে করেছেন তিনি। সুমিত্রা সিংহ হয়েছেন।
নিজের ভিতরে কোন সুপ্ত অপরাধবোধ ছিল কিনা সুমিত্রা সিংহ জানেন না। নইলে পঁচিশ বছর বাদে এক মেয়ের মুখের আদল দেখে অবচেতন মনে হঠাৎ ওই রকম নাড়া পড়েছিল কেন!
না, স্কুল থেকে তাড়িয়ে ওই সুশ্রী মেয়েটাকে জাহান্নমের পথে ঠেলে দেবেন না সুমিত্রা সিংহ। বরং এই মানসিক আবর্ত থেকে ওকে টেনে তুলতে পারাটাই যেন ভাল কাজ হবে, উদারতার কাজ হবে।
স্কুলের একজন ড্রাইভারকে বলে রেখেছিলেন। সন্ধ্যার পর সে তাকে নির্দিষ্ট ঠিকানায় নিয়ে এল।
সুমিত্রা সিংহ কার্ড পাঠালেন।
কিন্তু তারপরেও কম করে পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হল। ভাবলেন, কোন। কেস নিয়ে ব্যস্ত বোধহয়।
কিন্তু নীতিশ বোস ঘরে এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভুল ভাঙল। আঁ করে একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল। লোকটার থঙ্কলে লালচে মুখ। টানা দু চোখ ঈষৎ আরক্ত। নেশার মধ্যপথে উঠে আসতে হয়েছে বলেই হয়তো ভুরুর মাঝে ভাজ।–সীট ডাউন প্লীজ।
সুমিত্রা উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, বসলেন আবার। ভিতরটা মুহূর্তের মধ্যে বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেছে। আশ্চর্য, সেই সঙ্গে স্বস্তিবোধও। কোন এক দিনের মিথ্যাচারের সুপ্ত অপরাধটুকু আজ অন্তত ধুয়ে মুছে গেছে।
নীতিশ বোসের এবারে হঠাৎ খেয়াল হল সামনে কাকে দেখছেন। পঁচিশ বছরের ফারাকেও সুমিত্রার চেহারা খুব বদলায় নি। বিশ্বাস করবেন কি করবেন না ভেবে পাচ্ছেন না। চোখ টান করে দেখছেন। হাতের কার্ডটা একবার চোখের সামনে ধরলেন। তারপর ভারী গলায় টেনে টেনে বললেন, তুমি সুমিত্রা সিংহ…ওই স্কুলের হেডমিসট্রেস।
ঈষৎ রূঢ় গলায় সুমিত্রা বাধা দিলেন, আপনি করে বলুন। আপনার মেয়ের কনডাক্ট সম্পর্কে একটু সীরিয়াস আলোচনার দরকার ছিল, কিন্তু আপনার পক্ষে এখন সেটা সম্ভব নয় মনে হচ্ছে।
মেয়েকে ওই স্কুলে রাখতে হলে স্কুল টাইমে গিয়ে দেখা করার কথা বলতে যাচ্ছিলেন। বলা হল না। নীতিশ বোসের নেশা-ছোঁয়া দুচোখ তার মুখের ওপর আটকে আছে। সঙ্গে সঙ্গে টানা ভারী গলাও শোনা গেল।-ওয়েট! আই ডোন্ট থিংক দ্যাট উইল বি নেসেসারি। আলোচনার দরকার নেই। দু আঙুলে সুমিত্রা সিংহর নাম লেখা কার্ডটা তুলে সামনে ধরলেন।–এই মহিলা যে স্কুলের প্রধান সেখানে আমার মেয়েকে রাখা আমি উচিত মনে করি না। আই উইল সেণ্ড হার ডিউস টুমরো মর্নিং অ্যাণ্ড গেট হার টি. সি. গুড নাইট!
চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন তারপর সৌখিন পার্টিশনের ওধারে চলে গেলেন।
স্কুল বাসে বাড়ি ফিরছেন সুমিত্রা সিংহ। দুর্বার রাগে নিশ্চল স্তব্ধ তিনি। এত বড় স্পর্ধার কথা জীবনে কেউ শোনায়নি তাকে।…কিন্তু বুকের ভিতরে কোথায় চিনচিন করে জ্বলছে।