অশনি সংকেত – ৬

বিশ্বাস মশায়ের বাড়ী একদিন গঙ্গাচরণ গিয়ে দেখলে গ্রামের অনেকগুলি লোক জুটেচে। ঘন ঘন তামাক চলচে।

হীরু কাপালী বলচে—আমাদের কিছু ধান দ্যান বিশ্বেস মশাই, নয়তো আমরা না খেয়ে মলাম।

সঙ্গে সঙ্গে আরও পাঁচ-ছ’জন লোক ওই এক কথাই বললে। ধান দিতে হবে, না দিলে তাদের পরিবারে অনাহার শুরু হবে।

বিশ্বাস মশাই বললেন—নিয়ে যাও গোলা থেকে। যা আছে, দু-পাঁচ আড়ি করে এক এক জনের হবে এখন। যতক্ষণ আমার আছে, ততক্ষণ তোমাদের দিয়ে তো যাই, তারপর যা হয়।

গঙ্গাচরণ ধানের জন্য দরবার করতে গিয়েছিল। তাকে বিশ্বাস মশায় বললেন—আপনি ব্রাহ্মণ মানুষ। আপনাকে কর্জ হিসেবে ধান আর কি দেবো! পাঁচ আড়ি ধান নিয়ে যান। কিন্তু এই শেষ, আর আমার গোলায় ধান নেই।

গঙ্গাচরণ বিস্মিত হল বিশ্বাস মশায়ের কথায়। যার গোলাভর্তি ধান, মাত্র এই কয় জন লোককে সামান্য কিছু ধান দিয়ে তার গোলা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে, এ কেমন কথা হল?

পথে তাকে হীরু কাপালী গোপনে বললে—বিশ্বেস মশায় ধান সব লুকিয়ে সরিয়ে ফেলে দিয়েচে পণ্ডিত মশাই। পাছে মোদের দিতি হয় সেই ভয়ে। দু’পৌটি ধান ধরে হাতীর মত গোলা—ধান নেই কি রকম?

—তোমরা তো ধান নিলে, কি রকম দেখলে গোলায়?

—গোলা সাবাড় পণ্ডিত মশাই, নিজের চোকে দেকি এলাম। এক দানা নেই ওর মধ্যি।

—তাই তো!

—এবার এই ধান কটা ফুরুলি না খেয়ে মরতি হবে—

—কেন, ভাদ্র মাসের দশ-বারো তারিখের মধ্যে আউশ ধান পেকে উঠচে। ভাবনা চলে যাবে তখন।

—তা কি হয় পণ্ডিত মশাই? নতুন ধানের চাল খেলি সদ্য কলেরা। দেখবেন তাই লোকে খাবে পেটের জ্বালায় আর পট পট মরবে। ও চাল কি এখন খাওয়া যাবে, না পেটে সহ্যি হবে? ও খেতি পারা যাবে কার্তিক অঘ্রাণ মাসের দিকি।

—তবে উপায় কি হবে লোকের?

—এবার যে রকমডা দেখছি, না খেয়ে লোক মরবে।

.

কথাটা গঙ্গাচরণের বিশ্বাস হলো না। না খেয়ে আবার লোক মরে? কখনো দেখা যায় নি কেউ না খেয়ে মরেচে। জুটে যায়ই কোনো-না-কোনো উপায়ে। যে দেশে এত খাবার জিনিস, সে দেশে লোকে না খেয়ে মরবে?

অনঙ্গ-বৌ বললে—ও কটা ধান আমি নিজেই ভেনে কুটে নেবো ঢেঁকিতে। ওর জন্যে আর কারো খোশামোদ করতে হবে না। কিন্তু ওতে কদিন চলবে?

—তাই তো আমিও ভাবচি।

—আমি একটা কথা ভাবচি। অন্য লোকের চাল কেন আমি ভেনে দেই না? বানি পাবো দু’কাঠা করে চাল মণে!

—ছিঃ ছিঃ, দু’কাঠা চাল বানি দেবে তার জন্যে তুমি দশ আড়ি ধান ভানতে যাবে? অত কষ্ট করে দরকার নেই।

—কষ্ট আর কি? দু’কাঠা চালের দাম কত আজকাল! আমি তা ছাড়বো না। দু’কাঠা চাল বুঝি ফেলনা?

—লোকে কি বলবে বল তো?

—বলুক গে। আমার সংসারে যদি দু’কাঠা চালের সাশ্রয় হয় তবে লোকের কথাতে কি আসে যাচ্চে?

—তুমি যা ভালো বোঝো কর, কিন্তু আমার মনে হচ্চে তোমার শরীর টিকবে না।

—সে তোমায় দেখতে হবে না।

তারপর অনঙ্গ-বৌ হঠাৎ খিল খিল করে হেসে উঠে ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে বললে—তোমায় ঠকিয়েচি গো তোমায় ঠকিয়েচি।

গঙ্গাচরণ বিস্ময়ের সুরে বললে—কি ঠকিয়েচ?

—ঠকিয়েচি মানে চোখে ধুলো দিইচি।

—কেন?

—কত দিন আগে থেকে আমি ধান ভানচি।

—সত্যি?

—সত্যি গো সত্যি। নাইলে চালের হিসেব নিয়ে দেখো। দু’ কাঠা চাল তো হাট থেকে কিনেছিলে, কত দিন খেলে মনে নেই?

—আমায় না জানিয়ে কেন অমন করচো তুমি? ছিঃ ছিঃ—কাদের ধান ভানো?

—হরি কাপালীদের। শ্যাম বিশ্বেসদের।

—ক’কাঠা চালের জন্যে কেন কষ্ট করা! ওতে মান থাকে না। ব্রাহ্মণের মেয়ে হয়ে কাপালীদের ধান ভানা? লোকে জানলে কি বলবে বল তো? এত ছোট নজর তোমার হল কেমন করে তাই ভাবচি।

—বেশ, লোকে আমায় বলে বলবে, আমার ছেলেপুলে তো দু’ মুঠো পেট ভরে খেতে পাবে। তা ছাড়া কাপালীদের দুই বৌ ধান এলে দেয়। আমি শুধু ঢেঁকিতে পাড় দিই।

—তুমি ধান এলে দিতে পারো? এলে দেওয়া বড্ড শক্ত না?

—এলে দেওয়া শিখতে হয়। তাড়াতাড়ি গড় থেকে যে হাত উঠিয়ে নিতে পারে সে ভালো এলে দিতে পারে। এলে দেওয়ানো শিখচি একটু একটু।

গঙ্গাচরণ স্ত্রীর কথায় ভাবনায় পড়ে গেল। তার স্ত্রী যে তাকে লুকিয়ে এ কাজ করচে তা সে জানতো না। মাঝে মাঝে সে ভেবেচে অবিশ্যি, মাত্র দু’কাঠা এক কাঠা চালে তার এক হাট থেকে আর এক হাট পর্যন্ত চলচে কি করে? এতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে অনঙ্গ-বৌ চালাচ্চে তা তো সে জানতো না!

আহা, বেচারী! যদি ধান এলে দিতে গিয়ে কোনোদিন ওর আঙুলে ঢেঁকি পড়ে যায়?

গঙ্গাচরণ পাঠশালায় বেরিয়ে গেলে হরি কপালীর ছোট বৌ এসে ছেঁচতলায় দাঁড়িয়ে চুপি চুপি বললে—উনি চলে গিয়েচেন?

—হ্যাঁ, দিদি। যাই—

—চলো বামুন-বৌ, ওরা সব বসে আছে তোমার জন্যি।

—কত ধান আজকে?

—পাঁচ আড়ি তিন কাঠা। চিঁড়ে আছে তিন কাঠা।

—আমাকে ধান এলে দেওয়া শিখিয়ে দিবি দিদি?

—সে তোমার কাজ নয়। অমন চাঁপাফুলের কলির মত আঙুল, ঢেঁকি পড়ে ছেঁচে যাবে। তার দায়িক আমি হবো বুঝি বামুন-বৌ?

—দায়িক হতে হবে না সেজন্যি। আহা, ভঙ্গি দেখো না! মরণের ভগ্নদশা!

কাপালী-বৌ অনঙ্গ-বৌয়ের দিকে চোখ মিটকি মারছিল, তার প্রতি লক্ষ্য করেই অনঙ্গ-বৌয়ের শেষের উক্তিটুকু। হরি কাপালীর ছোট বৌয়ের বয়েস অনঙ্গ অপেক্ষা বছর দুই বেশি হবে, ছেলেপুলে হয় নি, রংও ফর্সা, মুখ-চোখের চটক ও দেহের গড়ন এবং বাঁধুনি ভালোই। রাস্তার লোকে চেয়ে দেখে।

অনঙ্গ হেসে বললে—আড়চোখ দেখাগে অন্য জায়গায়—বহুলোকের মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিতে পারবি!

কাপালী-বৌ হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি! বললে—মুণ্ডু ঘুরিয়ে বেড়ানো বুঝি আমার কাজ?

—কি জানি দিদি?

—আর তুমি বামুন-বৌ—তুমি যে অনেক মুনির মন টলিয়ে দিতে পারো মন করলি? আমরা তো তোমার পায়ের নখের যুগ্যি নই। সামনে খোশামোদ করে বলচি নে বামুন-বৌ, গ্রামের সবাই বলে—

অনঙ্গ-বৌ সলজ্জ হাসিমুখে বললে—যাঃ—

হরি কাপালীর দু’খানা মেটে ঘর, একদিকে পুঁইমাচা, একদিকে বেড়ার মধ্যে লাউডাঁটা ঝিঙে ও বেগুনের চাষ। পুঁইমাচার পাশে ছোট চালার নিচে ঢেঁকি পাতা। সেখানে জড়ো হয়েচে হরি কাপালীর বড়-বৌ, আরও পাড়ার দু-তিনটি ঝি-বৌ। ঢেঁকিঘরের চারপাশে বর্ষাপুষ্ট বনকচুর ঝাড়, ধুতরো গাছ, আদাড়, বাগ গাছে রাঙা রাঙা মটর ফল, ঢেঁকিঘরের চালে তেলাকুচো লতা উঠে দুলচে, বর্ষাসজল হাওয়ায় কচি লতাপাতার গন্ধ।

অনঙ্গ-বৌ আর ছোট-বৌ সেখানে পৌঁছুতে সবাই খুব খুশি।

বড়-বৌ বললে—এসো বামুন-বৌ, তুমি না এলি ঢেঁকশেলের মজলিশ আমাদের জমে না—

ক্ষিত্তুরী কাপালী বললে—যা বললে দিদি, ঠাকরুণ দিদি আমাদের ঢেঁকশেল আলো করে থাকেন। আমাদের বুকির মধ্যি হু-হু করতি থাকে উনি না এলি—

অনঙ্গ-বৌ হেসে বললে—তোমাদের বড্ড দরদ দেখছি—

ছোট-বৌ বললে—আমিও তা বলছিলাম, বামুন-বৌয়ের রাঙা পায়ের তলায় আমি মরতি পারি—

বড়-বৌ বললে—সে তো ভাগ্যি—বামুনের এয়িস্ত্রী বৌয়ের পায়ে মরবার ভাগ্যি চাই রে ছুটকি! সে এমনি হয় না।

এদের দুপুরের মজলিশ জমে উঠলো।

কাপালীপাড়ার বৌ-ঝিয়েদের এই একমাত্র আমোদ-আহ্লাদের স্থান। এখানে না এলে ওদের দুপুরটা মিথ্যে হয় যেন। পাড়াগাঁয়ের গৃহস্থঘরের মেয়ে, দুপুরে এদের দিবা-নিদ্রার অভ্যেস নেই, সময়ও পায় না। ধান ভানা চিঁড়ে কোটাতেই অবসর সময় কেটে যায়, ওর মধ্যেই এদের আড্ডা, গল্পগুজব যা কিছু।

অনঙ্গ-বৌ বললে—বড়-বৌ, ও ধান কাদের?

—কাল উনি কোত্থেকে কত কষ্টে পাঁচ কাঠা ধান এনেলেন—কিন্তু শুনচি ধান নাকি সব গবরমেণ্ট নিয়ে যাচ্চে?

—কে বললে?

—উনি কাল হাট থেকে নাকি শুনে এয়েচেন।

ছোট-বৌ বললে—ওসব কথা এখন রাখো দিদি। বামুন-বৌয়ের জন্যে একটা পান সেজে নিয়ে এসো দিকি।

—পান আছে, সুপুরি নেই যে? কাল হাটে একটা সুপুরির দাম দু’পয়সা।

সিদ্ধেশ্বর কামারের বৌ বললে—হ্যাঁ দিদি, নাকি আজকাল খেজুরের বীচি দিয়ে পান সাজা হচ্চে সুপুরির বদলে?

অনঙ্গ-বৌ বললে—সত্যি?

কামার-বৌ বললে—সত্যি মিথ্যে জানি নে ঠাকরুণ-দিদি। মিথ্যে কথা বলে শেষকালে বামুনের কাছে নরকে পচে মরবো? কানে যা শুনিচি—বললাম।

কথা-শেষে সে হাতের এক রকম ভঙ্গি করে মৃদু হাসলো।

এই ঢেঁকিশালের মজলিশে অনঙ্গ-বৌয়ের পরে দেখতে ভালো হরি কাপালীর ছোট-বৌ, তার পরেই এই কামার-বৌ। এর বয়েস আরও কম ছোট-বৌয়ের চেয়ে, রংও আরও একটু ফর্সা—তবে ছোট-বৌয়ের মুখশ্রী এর চেয়ে ভালো। কামার-বৌ সম্বন্ধে গ্রামে একটু বদনাম আছে, সে অনেক ছেলেছোকরার মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেবার জন্যে দায়ী, অনেককে প্রশ্রয়ও দেয়। কিন্তু ছোট-বৌ সম্বন্ধে সে কথা কেউ বলতে পারে না। অনঙ্গ-বৌ বললে—পোড়া কপাল পান খাওয়ার! খেজুরের বীচি দিয়ে পান খেতে যাচ্চি নে।

ক্ষিত্তুরী কাপালী শুনে হেসে খুন হয় আর কি। সে বিনোদ মোড়লের বিধবা বোন, ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়েস, আধফর্সা থান পরে এসেচে, দেখতে শুনতে নিতান্ত ভালোও নয়, খুব মন্দও নয়। কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়া ওর একটা রোগের মধ্যে গণ্য।

অনঙ্গ-বৌয়ের হাসি পেলে ক্ষিত্তুরীর হাসি দেখে। হাসতে হাসতে বললে—নে বাপু থাম—তুই আবার জ্বালালি দেখচি—এত হাসিও তোর!

ছোট-বৌ ঠোঁট উল্টে বললে—ওই বোঝো।

ইতিমধ্যে বড়-বৌ কি ভাবে দুটো পান সেজে নিচু ঘরের দাওয়ার ধাপ থেকে নামলো।

ছোট-বৌ ঝঙ্কার দিয়ে বলল—ওরে না না, খুঁজেপেতে ঘর থেকে উটকে বার করলাম।

—কোথায় ছিল?

—তোকে বলবো কেন?

—কেন?

—তুই সব্বস্ব উটকে বের করবি। তোর জ্বালায় ঘরে কিছু থাকবার জো আছে? আমি যাই গিন্নী, তাই সব জিনিস যোগাড় করে তুলে লুকিয়ে রেখে দি, আর তুই সব উটকে উটকে বার করিস।

ছোট-বৌ চোখ পাকিয়ে ভুরু তুলে বললে—আমি?

—হ্যাঁ, তুই। আমি কাউকে ভয় করে কথা বলবো নাকি? তুই ছাড়া আর কে?

—তুমি দেখেচ দিদি?

—দেখি নি! একশো দিন দেখিচি। বলি, ঘর বলতি দু’খানা বাতাসা রেখে দিইছিলাম, ওমা সেদিন দেখি নেই সেটুকু। তুই চুরি করে খেয়েচিস। কে ঘরে ঢুকতে গিয়েচে তুই ছাড়া? ছেলেপিলের বালাই নেই যখন বাড়ীতে?

কথাটা বোধ হয় নিতান্ত মিথ্যা নয়, কারণ এই কথার পর ছোট-বৌয়ের কথার সুর ও তেজ কমে গেল। সে বললে—খেইচি যাও, বেশ করিচি। আমার জিনিস না?

—বড্ড যে স্বত্ব দেখাচ্ছিস লা!

অনঙ্গ-বৌ বললে—আহা, কি তুচ্ছ জিনিস নিয়ে দু’বেলা তোমাদের ঝগড়া! থামো না বাপু।

বড়-বৌ বললে—আমি অন্যায় কথাটি কি বলিচি বামুন-বৌ তুমিই বিচের কর। ঘর বলে জিনিস লুকিয়ে রাখি এই যুজ্যের বাজারে। তুই সেগুলো উটকে উটকে চুরি করে খাস কেন?

অনঙ্গ-বৌ বললে—ও ছেলেমানুষ যে বড়-বৌ। তোমার মেয়ে হলে আজ কত বড় মেয়েই হত। হত না?

—আমার মেয়ের পোড়াকপাল!

—ওমা সে কি, পোড়াকপাল কি? ছোট-বৌ দেখতে সুশ্রী কেমন? চেয়ে দেখতে পাও না? দু’চোখের কি মাথা খেয়েচ?

ছোট-বৌ হঠাৎ বড় নরম হয়ে গিয়েছিল। সে বললে—নাও নাও বামুন-বৌ, তোমার আদিখ্যেতা দেখে আর বাঁচিনে!

বড়-বৌ ছোট-বৌয়ের দিকে আড়চোখে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে, মুখ চোখ ঘুরিয়ে হাত নেড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বললে—আহা-হা! বলি কত ঢং দেখালি লা!

ক্ষিত্তুরী কাপালী বড়-বৌয়ের চোখ মুখ ঘোরানোর ভঙ্গি দেখে পুনরায় হেসে গড়িয়ে প্রায় ঢেঁকির গড়ের উপর উপুড় হয়ে পড়লো। মুখে অসংলগ্ন ভাবে যা বলতে লাগলো তা অনেকটা এই রকম—ওমা পোড়ানি—বড়-বৌ—হি হি—কি কাণ্ড—হি হি—বলে কিনা—ও বামুনদিদি—হি হি—আমি আর বাঁচবো না—ওমা—হি হি—ইত্যাদি।

কামার-বৌ বললে—তা নাও, তুমি আবার যে কাণ্ড বাধালে! গড়ে কপাল ছেঁচে না যায় দেখো!

.

শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি অবস্থা দেখে অনঙ্গ-বৌ যে এত আশাবাদী, সে পর্যন্ত ভয় খেয়ে গেল। ধান চাল হঠাৎ যেন কর্পূরের মত দেশ থেকে উবে গেল কোথায়! এক দানা চাল কোথাও পাওয়া গেল না। অত বড় গোবিন্দপুরের হাটে চাল আসে না আজকাল। খালি ধামা কাঠা হাতে দলে দলে লোক ফিরে যাচ্চে চাল অভাবে। হাহাকার পড়ে গিয়েচে হাটে হাটে। কুণ্ডুদের দোকানে যে এত চাল ছিল, বস্তা সাজানো থাকতো বালির বস্তার দেওয়ালের মত, সে গুদাম আজকাল শূন্যগর্ভ। পথেঘাটে ক্রমশ ভিখিরীর ভিড় বেড়ে যাচ্চে দিন দিন, এরা এত দিন ছিল কোথায় সকলেই ভাবে, অথচ কেউ জানে না। এ দেশের লোকও নয়, এরা বিদেশী ভিখিরী। একদিন অনঙ্গ-বৌ রান্নাঘরে রান্না করচে, হঠাৎ পাঁচ-ছটি অর্ধউলঙ্গ জীর্ণশীর্ণ স্ত্রীলোক, সঙ্গে তাদের সম্পূর্ণ উল। বালক-বালিকা—ঘরের দাওয়ার ধারে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো—ফ্যান খাইতাম—ফ্যান খাইতাম—

অনঙ্গ প্রথমটা ওদের উচ্চারণের বিকৃতির দরুন কথাটা কি বলা হচ্চে বুঝতে পারলে না। তা ছাড়া ‘খাইতাম’ এটা ক্রিয়াপদের অতীত কালের রূপ এসব দেশে, তা বর্তমানে প্রয়োগ করার সার্থকতা কি, এটা বুঝতেও একটু দেরি হল।

পরে বুঝলে যখন তখন বললে—একটু দাঁড়াও—ফ্যান দেবো।

ওরা হাঁড়ি-তোবড়ানো টিনের কৌটো পেতে ফ্যান নিয়ে যখন চলে গেল, তখন অনঙ্গ-বৌ কতক্ষণ ওদের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েচে নাকি যে দেশ ছেড়ে এদের বিদেশে আসতে হয়েচে ছেলেমেয়ের হাত ধরে এক মগ ফ্যান ভিক্ষে করতে? অনঙ্গ-বৌয়ের চোখে জল এল। নিজের ছেলেরা পাঠশালায় গিয়েচে, ওদের কথা মনে পড়লো। এতগুলো লোককে ভাত দেওয়ার উপযুক্ত চাল নেই ঘরে, নইলে দিত না হয় ওদের দুটো দুটো ভাত।

ক্রমে নানাস্থান থেকে ভীতিজনক সংবাদ আসতে লাগলো সব। অমুক গ্রামে চাল একদম পাওয়া যাচ্চে না, লোক না খেয়ে আছে। অমুক গ্রামের অমুক লোক আজ পাঁচদিন ভাত খায় নি ইত্যাদি। তবুও সবাই ভাবতে লাগলো, মানুষে কি সত্যি না খেয়ে মরে? কখনই নয়। তাদের নিজেদের কোনো বিপদ নেই!

একদিন অনঙ্গ-বৌ খুব ভোরে ঘাটে গিয়ে দেখলে জেলেপাড়ার রয়ে জেলের বৌ ঘাটের ধারের কচুর ডাঁটা তুলে এক বোঝা করেচে।

অনঙ্গ হেসে বললে—কি গা রয়ের বৌ, আজ বুঝি কচুর শাক খাবে?

জেলে-বৌ যেন ধরা পড়ে একটু চমকে গেল। যেন সে আশা করে নি এত ভোরে কেউ নদীর ঘাটে আসবে। লুকিয়ে লুকিয়ে এ কাজ করছিল সে, এমন একটা ভাব প্রকাশ পেলে ওর ধরনধারণে।

সে মৃদু হেসে বললে—হ্যাঁ, মা।

—তা এত? এ যেন দু’তিন বেলার শাক হবে!

—সবাই খাবে মা, তাই।

বলেই কেমন এক অদ্ভুত ধরনে ওর মুখের দিকে চেয়ে জেলে-বৌ ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললে।

অনঙ্গ-বৌ অবাক হয়ে বললে—ওকি রয়ের-বৌ, কাঁদচিস কেন? কি হল?

রয়ের-বৌ আঁচলে চোখের জল মুছে আস্তে আস্তে বলে—কচ্চি কি সাধে মা? এই ভরসা।

—কি ভরসা?

—এই কচুর শাক মা। তিন দিন আজ কারো পেটে লক্ষ্মীর দানা সেধোঁয় নি।

—বলিস কি রয়ের-বৌ? না খেয়ে—

—নিনক্যি, মা নিনক্যি—তোমার কাছে মিছে কথা বলবো না সকালবেলা। কার দোরে যাবো, কে দেবে মোরে এই যুজ্যের বাজারে? যুজ্যের আক্রা ভাত কার কাছে গিয়ে চাইবো মা? তাই বলি এখনো কেউ ওঠে নি, গাঙের ধারে বড় বড় কচুর ডাঁটা হয়েচে, তুলে আনি গে। তাই কি তেল নুন আছে মা? শুধু সেদ্ধ।

অন্নকষ্টের এ মূর্তিই কখনো দেখে নি অনঙ্গ। সে ভাবলে—আহা, আমার ঘরে যদি চাল থাকতো! আজ রয়ের-বৌ ছেলেমেয়েকে কি না খাইয়ে থাকি?

জেলে-বৌ আপনমনে বলতে লাগলো—এক সের দেড় সের মাছ ধরে। পয়সা বড় জোর দশ আনা বারো আনা হয়। এক কাঠা চাল কিনতি একটা টাকা যায়—তাও মিলচে না হাটে বাজারে। মোরা গরীব নোক, কি করে চালাই বলো মা—

অনঙ্গ-বৌ আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে বাড়ী গেল। গঙ্গাচরণ ঘুম থেকে উঠে তামাক খেতে বসেচে, স্বামীকে বললে—হ্যাঁগা, এ কি রকম বাজার চালের? ভাত বিনে কি সব উপোস দিতে হবে? আমাদের ঘরেও তো চাল বাড়ন্ত। আজকাল চালের ধান আর কেউ দেয় না। গাঁ থেকে ধান গেল কোথায়?

গঙ্গাচরণ বললে—তামার পয়সা যেখানে গিয়েচে।

অনঙ্গ-বৌ রেগে বললে—দ্যাখো ওসব রঙ্গরস ভালো লাগে না। একটা হিল্লে করো—ছেলেপুলে উপোস করে থাকবে শেষে?

গঙ্গাচরণ চিন্তিত মুখে বললে—তাই ভাবচি। আমি কি চুপ করে বসে আছি গা? কি হবে এ ভাবনা আমারও হয়েচে।

—চারিধারে ব্যাপার দেখে হাত-পা পেটের ভেতর ঢুকে যাচ্চে যে! আর বসে থেকো না, উপায় দ্যাখো। তিন দিনের মত চাল ঘরে আছে মজুত—

—আর ধান কতটা আছে?

—সে ভানলে বড় জোর পাঁচ কাঠা চাল হবে। তাতে ধরো আরো দশ দিন। তার পরে?

—আমিও তাই ভাবচি।

—যা হয় উপায় করো।

.

দিন দুই পরে গঙ্গাচরণ পাঠশালা বন্ধ রেখে নরহরিপুরের হাটে গেল চালের সন্ধানে। বিষ্টুপুর, ভাতছালা, সুবর্ণপুর, খড়িদীঘি প্রভৃতি গ্রাম থেকে ধানচাল জড়ো হয়ে আগে আগে নরহরিপুরের প্রসিদ্ধ চালের ও ধানের হাট বোঝাই হয়ে যেতো—সেই হাটের অত বড় চালাঘর খালি পড়ে আছে—এক কোণে বসে শুধু এক বুড়ী সামান্য কিছু চাল বিক্রি করচে।

গঙ্গাচরণ কাছে গিয়ে বললে—কি ধানের চাল?

—কেলে ধান ঠাকুর মশায়। নেবেন? খুব ভালো চাল কেলে ধানের। কথায় বলে—ধানের মধ্যি কেলে, মানুষের মধ্যি ছেলে—

বুড়ীর কবিত্বের দিকে তত মনোযোগ না দিয়ে গঙ্গাচরণ ওর ধামা থেকে চাল তুলে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। যেমন মোটা, তেমনি গুমো। মানুষের অখাদ্য। তবুও চাল বটে, খেয়ে মানুষে প্রাণ বাঁচাতে পারে।

—কতটা আছে?

—সবটা নেবা তুমি? তিন কাঠা আছে।

—দাম?

—দেড় টাকা করে কাঠা।

গঙ্গাচরণ চমকে উঠলো, ভাবলে কথাটা সে শুনতে পায় নি। আবার জিজ্ঞেস করার পরেও যখন বুড়ী বললে এক কাঠার দাম দেড় টাকা, তখন গঙ্গাচরণের কপালে ঘাম দেখা দিয়েচে। দেড় টাকায় আড়াই সের, তা হলে পড়লো চব্বিশ টাকা মণ! কি সর্বনাশ! অনঙ্গ-বৌ এত দিন পরের বাড়ীর ধান ভেনে চালিয়ে আসছিল বলে সে অনেকদিন হাটে-বাজারের চালের দর জানে না। চাল এত চড়ে গিয়েচে তা তো জানা ছিল না। চারিদিক অন্ধকার দেখলো গঙ্গাচরণ। এত বড় নরহরিপুরের হাট ধানচাল-শূন্য? মানুষ এবার কি সত্যিই তবে না খেয়ে মরবে? কিসের কুলক্ষণ এসব? পরশুও তো চালের দাম এত ছিল না। দুদিনে ষোল টাকা থেকে উঠলো চব্বিশ টাকা এক মণ চালের দর—তাও এই মোটা, গুমো, মানুষের অখাদ্য আউশ চালের?

গঙ্গাচরণের সারা শরীরটা যেন ঝিম ঝিম করে উঠলো। কি করে সে চালাবে? নিজেদের ধানের ক্ষেত নেই। চব্বিশ টাকা মণের চাল সে কিনে খাওয়াতে পারবে ক’দিন, বারো টাকা যার মাসিক আয়? অনঙ্গ-বৌ না খেয়ে মরবে? হাবু পটল না খেয়ে—না, আর সে ভাবতে পারে না।

গঙ্গাচরণ চাল নিয়ে বাড়ী ফিরবার পথে দেখলে ধামা কাঠা হাতে আরও অনেকে হাটের দিকে ছুটেচে চালের চেষ্টায়। অনেকে ওকে জিজ্ঞেস করে, চাল কনে পালেন ও পণ্ডিত মশাই? কি দর?

—চব্বিশ টাকা।

—মোটা আশ চাল চব্বিশ? বলেন কি পণ্ডিতমশাই?

—দেখ গে যাও হাটে গিয়ে।

বৃদ্ধ দীনু নন্দী একটা ধামা হাতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটচে। দীনু নন্দী বাড়ীতে বসে সোনা-রূপোর কাজ করে অর্থাৎ গহনা গড়ে। সোনার কাজ তত বেশি নয়, চাষা-মহলে গহনার কাজে সোনার চেয়ে রুপোর ব্যবহারই বেশি। কিন্তু এই দুর্দিনে গহনা কে গড়ায়, কাজেই দীনুর ব্যবসা অচল। দুটি বিধবা ভাই-বৌ, বৃদ্ধ মাতা ও কয়েকটি শিশুসন্তান, তৃতীয় পক্ষের তরুণী ভার্যা তার ঘাড়ে। দীনু বললে—পণ্ডিত মশায় চাল পাবো?

—ছুটে যাও। বড্ড ভিড়।

—ছুটি বা কোত্থেকে, পায়ে বাত হয়ে কষ্ট পাচ্চি বড্ড। দুবেলা খাওয়া হয় নি—

—বল কি?

—সত্যি বলচি পণ্ডিত মশায়। বামুন দেবতা, এই অবেলায় কি মিছে কথা বলে নরকগামী হবো?

দীনু খোঁড়াতে খোঁড়াতে সজোরে প্রস্থান করলে।

গঙ্গাচরণ বাড়ী ফিরতে ফিরতেই কত লোক শুধু হাতেই হাট থেকে ফিরচে দেখা গেল। সাগরতলার কর্মকারদের বাড়ীতে একটু বসে তামাক খাচ্ছিল, এমন সময় দু’চারজন লোক সেখানে এসে জুটলো গল্প করতে।

একজন বললে—নরহরিপুরের হাটে চাল পাওয়া গেল না, আর কোথায় পাওয়া যাবে বলুন!

আর একজন বললে—লোকও জড়ো হয়েছে দেখুন গে। এক কাঠা চাল নেই। কেউ তিন দিন, কেউ পাঁচ দিন না খেয়ে আছে। আমারই বাড়ীতে দুদিন ভাত খায় নি কেউ।

গঙ্গাচরণ বললে—আটা ময়দা নিয়ে যে খাবে, তাও নেই।

—বস্তাপচা আটা আছে দু-এক দোকানে, বারো আনা সের! কে খাবে?

আরও মাইলখানেক এগিয়ে গেল গঙ্গাচরণ। খলসেখালির সনাতন ঘোষ নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে তামাক খাচ্চে, ওকে দেখে বললে—পণ্ডিত মশাই, ওতে কি? চাল নাকি?

—হ্যাঁ।

—কোথায় পেলেন?

—সে যা কষ্ট তা আর বোলো না। এক বুড়ীর কাছ থেকে সামান্য কিছু আদায় করেচি, তাও আগুন দর।

—কই দেখি দেখি?

সনাতন ঘোষ নেমে এসে ওর হাতের পুঁটুলিটা নিজের হাতে নিয়ে পুঁটুলি নিজেই খুলে চাল দেখতে লাগলো। ওর মুখটা যেন কেমন হয়ে গেল। চালের দানা পরীক্ষা করতে করতে বললে—বড্ড মোটা। কত দর নিলে? একটা কথা বলবো পণ্ডিত মশাই?

—কি?

—দাম আমি যা হয় দিচ্চি। আমায় অর্ধেকটা চাল দিয়ে যান। দিতেই হবে। দু’দিন না খেয়ে আছে সবাই। মেয়েকে শ্বশুরবাড়ীর থেকে এনে এখন মহা মুশকিল, সে বেচারীর পেটে আজ দু’দিন লক্ষ্মীর দানা যায় নি—কত চেষ্টা করেও চাল পাই নি—

সনাতন ঘোষের অবস্থা খারাপ নয়, বাড়ীতে অনেকগুলো গরু, দুধ থেকে ছানা কাটিয়ে নরহরিপুরের ময়রাদের দোকানে যোগান দেয়—এই তার ব্যবসা। গঙ্গাচরণ ইতিপূর্বে সনাতনের বাড়ী থেকে দু’এক খুলি টাটকা ছানা নিয়েও গিয়েচে। তার আজ এই দশা! কিন্তু চাল মাত্র সে নিয়েচে তিন কাঠা। আর কোথাও চাল পাওয়া যাচ্চে না। এ চাল দিলে তার স্ত্রী-পুত্র অনাহারে থাকবে দুদিন পরে। চাল দেওয়ার ইচ্ছে তার মোটেই নেই—এদিকে সনাতন মোক্ষম ধরেচে চালের পুঁটুলি, তার হাত থেকে চাল নিতান্তই ছিনিয়ে নিতে হয় তাহলে। কিংবা ঝগড়া করতে হয়।

সনাতন ততক্ষণে কাকে ডেকে বললে—ওরে একটা ধামা নিয়ে আয় তো বাড়ীর মধ্যে থেকে? একটা কাঠাও নিয়ে আয়—

সনাতন নিজের হাতে এক কাঠা চাল যখন মেপে ঢেলে নিয়েচে, তখন গঙ্গাচরণ মিনতিসূচক ভদ্রতার সুরে বললে—আর না সনাতন, আর নিও না—

—আর আধ কাঠা—

—না বাপু, আমি আর দিতে পারবো না। বাড়ীতে চাল বাড়ন্ত—বুঝলে না?

সনাতনের নাতিটি বললে—দাদামশাই, ওঁর চাল আর নিও না, দিয়ে দাও।

সনাতন মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলো—তোদের জন্যি বাপু খেটে মরি, নিজের জন্যি কিসের ভাবনা! একটা পেট যে করে হোক চলে যাবেই। রইল পড়ে চাল, যা বুঝিস করগে যা।

রাগ না লক্ষ্মী। গঙ্গাচরণ বিনা চক্ষুলজ্জায় সমস্ত চাল উঠিয়ে নিয়ে চলে এল। বাড়ী এসে দেখলে অনঙ্গ-বৌ ভাত চড়িয়ে ওল কুটতে বসেচে রান্নাঘরের দাওয়ায়। স্বামীকে দেখে বললে—ওগো শোনো, আমি এক কাজ করিচি। সেদিন সেই বোষ্টম প্রভাতী সুরে গান করছিল, মনে আছে? আজ এসেছিল, কি সুন্দর গান যে গায়!

—কে বল তো?

—সেই যে বলে—‘উঠ গো নন্দরাণী কত নিদ্রা যাও গো’—বেশ গলা—লম্বা মত, ফর্সা মত বোষ্টমটি—

ওর বাড়ী বেনাপোল। বেনাপোলে হরিদাস ঠাকুরের পীঠ আছে, সেখানকার কাজকর্ম করতে। বেশ গায়।

আমি তাকে বললাম রোজ সকালে এসে আমাদের বাড়ীতে ভগবানের নাম করবো। ভোরবেলায় বড় ভালো লাগে ভগবানের নাম। মাসে একটা টাকা আর এক কাঠা চালের একটা সিধে দিতে হবে বলেচে, এই ধরো ডাল, নুন, বড়ি, দুটো আলু, বেগুন, একটু তেল—এই। আমি বলিচি দেবো। কাল থেকে গাইতে আসবে। হ্যাঁগা, রাগ করলে না তো শুনে?

—তোমার যে পাগলামি! বলে, নিজে খেতে জায়গা পায় না, শঙ্করাকে ডাকে। দেবে কোথা থেকে?

—তুমি ঝগড়া কোরো না। সকালে উঠে ভগবানের নাম শুনবে যে রোজ রোজ তখন? হুঁ হুঁ—আমি যেখান থেকে পারি জুটিয়ে দেবো, তুমি ভেবো না কিছু। গরীব বলে কি ভালো গান শুনতে নেই?

পরদিন খুব ভোরে সেই বোষ্টমটি সুস্বরে প্রভাতী গান গাইতে গাইতে ওদের উঠানে এসে দাঁড়ালো। অনঙ্গ-বৌ খুশিতে ভরপুর হয়ে পাশের ঘরে এসে স্বামীকে ডেকে বললে—ওগো শুনচো? কেমন গায়? আর ভগবানের নাম—বেশ লাগে—না?

গঙ্গাচরণ কিছু জবাব না দিয়ে মৃদু হেসে পাশ ফিরে শুয়ে রইল। অনঙ্গ-বৌ রাগ করে বললে—আহা, ঢং দ্যাখো না! ওগো গান শোনো—তাতে জাত যাবে না।

—আমি কি রাজা যে বন্দীরা প্রভাতী গান গেয়ে আমার ঘুম ভাঙাবে? তোমার পয়সা থাকে তুমি বন্দীদের মাইনে দিয়ো গো রানী, আমি ওর মধ্যে নেই।

—আমার বন্দীর গান যে শুনবে, তাকে পয়সা দিতে হবেই। তবে কানে আঙুল দাও।

গঙ্গাচরণ হেসে কান চেপে ধরে বললে—এই দিলাম।

একটু বেলা হলে অনঙ্গ-বৌ রান্না চড়ালে, তার পরে মনে মনে হিসেব করে দেখলে দিন দশ-বারো পরে চাল একেবারে ফুরিয়ে যাবে, তখন উপায় কি হবে? চাল নাকি হাটে পাওয়া যাচ্চে না। সবাই বলচে। তার স্বামী নির্বিরোধী মানুষ, কোথা থেকে কি যোগাড় করবে এই দুর্দিনে? ভাবলে মায়া হয়।

কাপালীদের ছোট-বৌ চুপি চুপি এসে বললে—বামুন-দিদি, একটা কথা বলবো? এক খুঁচি চাল ধার দিতি পারো?

—মুশকিল করলি ছোট-বৌ। তোদের চাল কি বাড়ন্ত?

—মোটে নেই। কাল ছোলা সেদ্ধ খেয়ে সব আছে। না হয় ছোট ছেলেটিকে দুটি ভাত দিও এখন দিদি। আমরা যা হয় করবো এখন।

অনঙ্গ-বৌ কি ভেবে বললে—একটু দাঁড়া। এসেচিস যখন তখন নিয়ে যা এক খুঁচি চাল। ওতে আমাদের কতদিনের সাশ্রয় বা হত?

কাপালী-বৌ চাল আঁচল পেতে নিয়ে বললে—এক জায়গায় কচুর শাক আছে, তুলতে যাবে বামুন-দিদি? গেরামে তো কচুর শাক নেই—যে যেখান থেকে পারচে তুলে নিয়ে যাচ্চে। গাঙের ধারে এক জায়গায় সন্ধান করিচি, ঢের কচুর শাক হয়ে আছে। দু’জনে চলো চুপি চুপি তুলে আনি।

—চল, আজ দুপুরে যাবো। চাল তো নেই। যা দেখচি ওই খেয়েই থাকতে হবে দুদিন পরে।

কাপালী-বৌ হেসে বুড়ো আঙুল তুলে নাচিয়ে বললে—লবডঙ্কা! তাই বা কোথায় পাচ্ছ বামুন দিদি? কাওরাপাড়ার মাগী-মিন্সে এসে গাঙের ধারের যত শুষনি শাক, কলমি শাক, হেলেঞ্চা শাক তুলে উজোড় করে নিয়ে যাচ্চে দিনরাত। গিয়ে দ্যাখো গে কোথাও নেই। আমি কি খোঁজ করি নি বামুনদিদি? ওই খেয়ে আজ দু’দিন বেঁচে আছি—ওই সব শাক আর ছোলা সেদ্ধ। তোমার কাছে মিথ্যে কথা বলে বড়াই করে কি করবো?


© 2024 পুরনো বই