আমেরিকার অন্তঃপাতী নিউ ইয়র্ক প্রদেশে, এক অতি নিঃস্ব পরিবার ছিল। স্ত্রী পুরুষ উভয়েই বহুদিন অবধি, অকর্ম্মণ্য ও পরিশ্রমে অসমর্থ হইয়াছিল, এজন্য তাহাদের স্বয়ং কিছু উপার্জ্জন করিবার ক্ষমতা ছিল না। তাহাদের এক মাত্র কন্যা, সেই, পরিশ্রম করিয়া, কথঞ্চিৎ তাহাদের ভরণ পোষণ নির্ব্বাহ করিত। দুর্ভাগ্যক্রমে, ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে শীতকালে, ঐ প্রদেশে দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হওয়াতে, তাহাদের দিনান্তেও আহার পাওয়া দুর্ঘট হইয়া উঠিল। ফলতঃ, এই সময়ে শীতে ও অনাহারে, তাহারা যৎপরোনাস্তি কষ্ট পাইতে লাগিল।
পিতা মাতার দুরবস্থা দেখিয়া, এবং প্রাণপণে চেষ্টা ও পরি- পরিশ্রম করিয়াও তাঁহাদের আহারাদি সংগ্রহে অসমর্থ হইয়া, কন্যা অতিশয় দুঃখিত ও শোকাভিভূত হইল, এবং কি উপায়ে তাঁহাদের কষ্ট নিবারণ হয়, অহোরাত্র এইমাত্র চিন্তা করিতে লাগিল।
এক দিন কথাপ্রসঙ্গে কোন ব্যক্তি কহিল, অমুক ডাক্তার ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন, যদি কেহ আপন সম্মূখের দন্ত বিক্রয় করে, তাহা হইলে তিনি, তিন গিনি[১] করিয়া, প্রত্যেক দন্তের মূল্য দিবেন, কিন্তু ডাক্তার স্বয়ং, সেই ব্যক্তির মুখ হইতে, দন্ত তুলিয়া লইবেন।
এই ঘোষণার কথা শুনিয়া, কন্যা মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, আমি নানা চেষ্টা দেখিতেছি, এবং অনেকপ্রকার কষ্টও ভোগ করিতেছি, তথাপি পর্য্যাপ্ত পরিমাণে, পিতা মাতার আহার সংগ্রহ করিতে পারিতেছি না। এক্ষণে, এই উপায় অবলম্বন করিলে, কিছুকালের নিমিত্ত তাঁহাদের দুঃখ দূর হইবে। অতএব আমি, অবিলম্বে ডাক্তারের নিকট গিয়া, সম্মুখের কয়টি দন্ত দিয়া, গিনি আনয়ন করি।
মনে মনে এই আলোচনা করিয়া, কন্যা ডাক্তারের নিকট উপস্থিত হইল এবং কহিল, মহাশয়। আপনি যে ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন, তদনুসারে আমি আপনার নিকট দন্ত বিক্রয় করিতে আসিয়াছি, যে কয়টির প্রয়োজন হয়, তুলিয়া লইয়া, আমাকে অঙ্গীকৃত মূল্য প্রদান করুন।
ডাক্তার স্থির করিয়া রাখিয়াছিলেন, কেহই তাহার ঘোষণা অনুসারে, দন্ত বিক্রয় করিতে আসিবে না। এক্ষণে, এই কন্যাকে দন্তবিক্রয়ে উদ্যত দেখিয়া, চমৎকৃত হইয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, অয়ি বালিকে। তুমি কি কারণে ঈদৃশ ক্লেশকর বিষয়ে সম্মত হইতেছ? কাঁচা দন্ত তুলিয়া লইলে, কত কষ্ট হয়, তাহা তোমার বোধ নাই, বিশেষতঃ চির দিনের জন্য অত্যন্ত কদাকার হইয়া যাইবে। তুমি বালিকা, এরূপে দন্ত বিক্রয় করিয়া, টাকা লইবার প্রয়োজন কি, বুঝিতে পারিতেছি না।
কি অবস্থায়, ও কি কারণে, দন্ত বিক্রয় করিয়া, টাকা লইতে আসিয়াছ, কন্যা সজলনয়নে সবিশেষ সমস্ত বর্ণন করিল। ডাক্তার অতিশয় দয়ালু ও সদ্বিবেচক ছিলেন। তিনি, তদীয় পিতৃভক্তি ও মাতৃভক্তির ঐকান্তিকতা দর্শনে, মুগ্ধ ও কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। অনন্তর, তাহার মুখ নিরীক্ষণ করিয়া, অশ্রুপূর্ণ লোচনে, সস্নেহ বচনে কহিলেন, বৎসে। তোমার মত গুণবতী বালিকা ভূমণ্ডলে আছে, আমার এরূপ বোধ হয় না, আমি তোমার দন্ত চাই না, যদি আমি তোমার মত গুণবতী বালিকাকে কষ্ট দি ও কদাকার করি, তাহা হইলে, আমার মত নরাধম আর কেহ নাই। তোমার অসাধারণ গুণের যৎকিঞ্চিৎ পুরস্কারস্বরূপ, আমি তোমায় দশটি গিনি দিতেছি, লইয়া গৃহে যাও, এবং নিশ্চিন্ত হইয়া, পিতা মাতার শুশ্রূষা কর।
এই বলিয়া, দয়ালু ডাক্তার, সেই কন্যার হস্তে দশটি গিনি সমৰ্পণ করিলেন। কন্যা আহ্লাদে পুলকিত হইল। তাহার নয়নদ্বয় হইতে আনন্দাশ্রু নির্গত হইতে লাগিল। অনন্তর, সে, ভক্তিভাবে তাঁহাকে প্রণাম করিয়া, তদীয় অনুমতি গ্রহণ পূর্ব্বক, গৃহে প্রতিগমন করিল।