ঘূর্ণি হাওয়ায় টানটান রোদটা টাল খায়, দূরে পানিতে গায়ে গায়ে ঠেকানো মিশকালো ঢিবির মতো উপুড় হাঁড়ির পর হাঁড়ি। শরবন, ঠাসবুনট আড়ালি ঘাসের জঙ্গল, ট্রলারের টানা গোঁ গোঁ। হাওয়া, রোদ আর পানির তোড়ে চোখ-কান অবশ। দূরে বেঁটে-বেঁটে ঝোপঝাড়ে আবছা ডাঙার ঝিলমিল, আরও দূরে খসে পড়া টুকরো আসমানের মতো হঠাৎ ঝলকে ওঠে সফেদ বালির মাচান। রোদের ঘষায় পানিতে বেশুমার রাংতার ঝিলিক, মাথার ওপর গাঙশালিকের চেরা চিক্কুর। চেনা জগতের স্মৃতি-গন্ধহীন অগাধ অন্য জগৎ।
নয়া বসতের টানে কে কোথায় হারায়! চোখে আসমানজ্বলা রোদ, মাথার ভিতর গুমরানো ভাপ আর দৃষ্টিতে দুনিয়া-সয়লাব পানি আর পানি…। দেখতে দেখতে ছাইকালো উপুড় হাঁড়িগুলো দুলে দুলে পালে পাল মোষের কাঁধ-পিঠ হয়ে যেতে বা দূরে শরবনের ফাঁক-ফোকরে চোখধাঁধানো সরিষার খেত, কাশফুলের ফকফকে ঢলাঢলি কিছুটা চেনা জগতের ইশারা দিতে খালি বুকে শ্বাস জমে, রোদ-টনটন চোখের কোণে এক তিল ছায়া নড়ে।
শেফালি বেগম এত পানি, এত রোদ, এত ডাঙর আসমান দেখেনি। আর হাওয়া—গা-খোলা নাঙ্গা হাওয়া বন্ধ-কানে কী কথা ঠুকে ঠুকে যায়! তার মনে পড়ে না সে কোথায় ছিল, এখন কোথায়? শুধু রোদ-বাতাস-পানি ঠেলে কোথাও যে যাচ্ছে এ তাড়াটুকু ছাড়া মন থেকে, মাথা থেকে, হাড়-পাঁজরার গাঁট-গাঁটরি থেকে তামাম অতীত খসে পড়তে দেখে ভাবে এই তবে এত দিনে! আগুনঝরা রোদ আর শনশন বাতাসের ফেনায় মিশে গিয়ে সে যেন এখন অন্য কিছু—রোদে চিমসানো সন্ধ্যা রাতের তারা, চিন-পরিচয়হীন ঘাসফড়িং, বরুণ ফুলের চিকন একরত্তি শুঁড়, গরুর হাঁটুতে গেড়ে বসা এঁটুলি, চামকাঁঠালের বিচি, রেখাবুর আঁচল খসা এক ফোঁটা টলমল মায়া।
নয়া বসত—হারিয়ে যাওয়ার নয়া ঠিকানা। নামটা মন্দ নয়। কলকারচর।
.
রোদনচাঁপার মঞ্জরি
চম্পা
চনমনে আলো-হাওয়ায় তাজা-টাটকা সকাল, তাও পা দুটোয় সাড় নাই, দেবে যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে গর্তে পড়ে এক পা, কখনো দুই পা-ই হারিয়ে গেলে জোর ঝাঁকুনিতে পা ফেরত পেয়ে সে জেগে উঠে হাঁফ ছাড়ে। প্রায় রাতেই এমন হয়। তবে এ সময় ঘুমটুম দূরের, পায়ের তলায় খটখটে পাথুরে মাটি, তাও যাচ্ছে—দুই ফিতার স্যান্ডেলসহ পায়ের পাতা, আঙুল, গোড়ালি-টোড়ালি তলিয়ে যাচ্ছে। গর্তে পড়ে না, ভূমিকম্পে।
সকাল সাড়ে সাতটায় ফ্যাক্টরি গেট থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরে লাইনে দাঁড়ানো মেয়েদের ঠেলাঠেলির ফাঁকে চম্পা যা দেখার দেখে ফেলেছে। দূর থেকে এক নজর দেখলেও ভুল নাই দেখায়। ঝট্ করে ঘুরে খানিকটা আড়ালে সরে দাঁড়াতেই টের পেল পা জোড়া থরথরিয়ে কাঁপছে, আর ভূমিকম্প যে ভাবছে তার প্রমাণ পায়ের তলায় দাপাদাপি, ঝুরঝুরিয়ে মাটি সরে যাচ্ছে।
কেউ জানে না, চম্পা একাই টের পাচ্ছে।
ডানে-বাঁয়ে না তাকিয়ে পা চালিয়ে লাইন ছেড়ে সরে পড়তে মনে হয়েছিল কেউ না আবার পেছন থেকে ডেকে ঝামেলা বাধায়। ডাকেনি। সবাই গেট বরাবর ছুটতে ব্যস্ত। মাসের আট তারিখ। বেতনের দিনটা আজ না হয়ে যদি গতকাল হতো! কিছু করার নাই। পুরো মাসের মাইনা, সঙ্গে বেশ কয়েক দিনের ওভারটাইম।
অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ খানিকটা আগেই ঘর থেকে বেরিয়েছিল। কোনো কারণ ছিল না, ফজরের আজানে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। রোজই ভাঙে, আবার জোড়াও লাগে। আজ কী মনে করে উঠে পড়েছিল। বাইরে তাকিয়ে আকাশটাকে মনে হয়েছিল বেশি-বেশি টাটকা। আজান কি দেরিতে হয়েছে, না কি ভাদ্র মাসে বৃষ্টি-বাদলা না হলে ভোর-ভোরই আসমানে রোশনাই ফোটে, এসব ভাবতে ভাবতে মনে পড়েছিল তারিখটা—ইংরেজি আট তারিখ। ঘরের বেড়ায় এক পাতায় খোপ-খোপ পুরো বারো মাসের একটা ক্যালেন্ডার আছে, নতুন মাস আসামাত্র আগের মাসের খোপটায় কোনাকুনি টান দিয়ে সে আট তারিখে একটা গোল্লা আঁকে। চম্পার এই গোল্লা পাকানোয় জবা মজা পায়, বলে, মাইনষ্যে দাগ দেয় য্যেন ভুইলা না যায়, তুমি দাগ দেও ক্যান? চম্পা জবাব দেয়, দাগ কই? এইটা পুন্নিমার চান্দ, আসমানে ওই দিন ডাঙর চান্দ ওঠে।
খালি চৌকি পেয়ে জবা হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। গত সন্ধ্যায় মার খাওয়ার পর কথাবার্তা বলেনি। ভাত বেড়ে দিতে চুপচাপ খেয়ে শুধু নিজের প্লেটটাই ধুয়ে রেখে চৌকির কিনার ঘেঁষে কুঁকড়ে-মুকড়ে শুয়ে পড়েছিল, মার খাওয়ার শোধ তুলতেই যেন। চম্পার ইচ্ছা হয়নি ডেকে ওঠায়, বাকি বাসন-কোসন ধুয়ে শুতে এসে খেয়াল করেছিল জবা ঘুমায়নি। বারবার চুলের জটে আঙুল দিয়ে খোঁচাচ্ছিল আর হয়তো আশা করছিল চম্পা তাকে কিছু বলবে বা টেনে কাছে নেবে বা বলবে আর মারুম না যা—বরাবর যেমন বলে। চম্পা হয়তো কিছু একটা করত, কিন্তু সারাদিন টানা খাটনির পর ঘুমে মাথা কাবু হয়ে থাকলে কী করা!
ফ্যাক্টরি কম্পাউন্ড ছেড়ে হাঁটার বেগ বাড়াতে মনে হলো চেনাজানা কেউ যদি দেখেও থাকে, ভাববে তাড়াহুড়ায় আসার সময় ঘরে জরুরি কিছু ফেলে এসেছে। তেমন অবশ্য চম্পার কদাচিৎ হয়। ঘর ছাড়ার আগে তাকে ঠান্ডা মাথায় অনেক কিছু ভাবতে হয়, সাবধান হতে হয়। মেয়েটা বড় হচ্ছে, ঘরে একা রেখে যাওয়ার কারণেই সাবধানতা। রোজই ওকে কিছু না কিছু কাজ দিয়ে বেরোয় যাতে ব্যস্ত থাকে। কাপড় কাচা, হাঁড়িকুড়ি মাজা এসব তো থাকেই। বাড়তি কিছু না থাকলে চাল থেকে ধান বা চিটা বাছা, আটা চালা। মেয়ে চালাকি বোঝে, ঘরে আটকানোর ফন্দি। খুচরা এসব কাজে জবাকে সারাদিন ঘরবন্দি রাখা যাবে না জেনেও চম্পা রোজই বেরোনোর আগে কাজের কথাগুলো মনে করায়। এমন না যে জবা করে না, তারপরও বলে। আর আসল কথাটা যা না বললেও চলে, তাও। বাইরে যেন না যায়। যদি শোনে গিয়েছে, ঠ্যাং ভেঙে ফেলবে।
বস্তিটা বড় না, চার বছরের ওপর জবাকে নিয়ে চম্পা এখানে। লোকজন প্রায় সবাই জানাশোনা। তারপরও বস্তি তো বস্তিই। কাজিয়া-ফ্যাসাদ ছাড়া একদিনও যায় না। এ ছাড়া কে কার মেয়েকে ফুসলানোর ধান্ধা করছে বা নিয়ে ভেগেই গেছে বা খালি ঘর পেয়ে কার উঠতি কি নাবালিকাকে নিয়ে দরজা আটকেছে কোন লুচ্চা—এসব তো আছেই। ঠেকানোর ক্ষমতা নাই, চম্পা জানে। তবু তার যা করার করে। মেয়েকে সাবধান করে, বাইরে যেতে মানা করে। পুরনো বই-খাতা নিয়ে বসতেও বলে। বই-খাতায় জবার মন নাই। আর বই বলতে টিকে আছে ক্লাস থ্রি-র ছেঁড়াফাড়া বাংলা আর সমাজ বই দুটো। বাংলা বইয়ের পদ্যগুলো এক সময় সুর করে তালে তালে মুখস্থ বলতে পারত। এতদিনে ভুলে গেছে, তবে মাঝে মাঝে অনেকটা যেন বেখেয়ালে বাঁশ বাগানের মাথার ওপর পদ্যটার কয়েক লাইন আউড়ে থেমে যায়। চম্পা মনে করাতে চায়, জবা যখন আগে দুলে দুলে কোলের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে পড়ত তখন শুনে শুনে তারও মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। জবা ভুলে গেলেও সে ভোলেনি। আর তাই সে যখন তাকে ধরিয়ে দিতে পরের লাইনগুলো বলে, জবা চোখমুখ কটমট করে অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে থাকে। যেন পড়া-ই যখন ছেড়ে দিয়েছে, মিছামিছি বাঁশ বাগানের চাঁদ দেখে কী ফায়দা! জবা স্কুল ছাড়তে চায়নি, এখানে আসার আগে বিএনপি বস্তিতে মহিলা সমিতির স্কুলে থ্রি পর্যন্ত পড়েছিল।
মেয়েকে যে ঘরে রেখে যায়, এতে অন্য ভয়ও আছে। প্রতিবছর দুই-চারটা বস্তিতে নিয়মমাফিক আগুন লাগে। কেউ না কেউ লাগায়। বস্তির ভিতরের মানুষ বাইরের মানুষ, যারাই হোক, লাগায়। চুলার আগুনে এত তেজ থাকার কথা না। তুফানের বেগে যে একেকটা বস্তি চোখের পলকে ছারখার হয়ে যায়, তাতে কে না বোঝে চুলা-টুলা না, পেট্রোল। আশপাশে গুলশান, নিকেতনে বড়লোকেরা থাকে। বস্তি উঠে গেলে সাফসুতরা, তবে ঠেকায়ও পড়বে তারা। বস্তি যদি না থাকে, ছুটা বা বাঁধা বুয়া পাবে কই?
আগুন লাগার দুশ্চিন্তাটা চম্পাকে যখন-তখন ভোগায়। জবা গায়ে-গতরেই বাড়ছে, মাথায় আক্কেল-বুদ্ধির ছিটাফোঁটা যদি থাকত! আগুন যদি লাগে, ওর মগজেই আসবে না কী করা উচিত, অন্তত নিজের জান বাঁচানোর জন্য।
তো হনহনিয়ে যে ছুটছে, যাচ্ছে কোথায়? ঘর ছাড়া আর কোথায়! চোরের মতো ঘাপটি মেরে যতক্ষণ ঘরে পার করতে পারে। ঘরই-বা কতক্ষণ ঘর থাকবে? আজই কি সরে পড়বে? গত চার বছর এ জায়গায় ঠাঁই গেড়ে সরে পড়ার চিন্তাটা মাথা থেকে বলতে গেলে বিদায়ই নিয়েছিল।
মিনিট বিশেকের পথ। জোরে পা ফেলছে, তাতেও পথ ফুরাচ্ছে না। ঘরে ঢুকে মাথা ঠান্ডা করে ভাববে কী করা। এ সময় হাতে যদি বেতনের টাকা কয়টা থাকত! একটা টিনের কৌটায় কিছু টাকাপয়সা যখন যা পারে জমায়। কতই বা হবে, বড়জোর হাজার দুই হয় কি না। যা করতে হবে তাড়াতাড়ি। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। ঘটনা নতুন না। এই নিয়ে চারবার। তারপরও প্রতিবারই যখন ঘটে, মাথায় মনে হয় আসমান ভেঙে পড়ছে। পায়ের তলায় মাটি কাঁপে। ভূমিকম্প। এবার চার বছর পরে বলে পায়ের তলায় মাটিটা যেন বেশি বেশি হুড়োহুড়ি করছে।
জবা
দূর থেকে মাকে অসময়ে ফিরে আসতে দেখে জবা তোরাবের টঙের দোকান থেকে ঘরমুখো ছুটবে, না মায়ের দিকে এগোবে এ দোটানায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাকে কাছে ভিড়তে দিল। মা বেরিয়ে যেতেই সে যে পাড়া বেড়াতে বের হয়নি, তোরাবের দোকানে বাকিতে বাংলা সাবান কিনতে এসেছে এর প্রমাণ পলিথিন মোড়ানো সাবানের গোল্লাটা হাতে থাকার পরও বুক ধুকপুক করছে।
বাইরে যাওয়া তার একদম মানা। বড়জোর যেতে পারে পাশের ঘরে মর্জিনার মায়ের কাছে। বুড়ি নড়তে-চড়তে পারে না, তবে একবার টেনেটুনে কাঁথা-বালিশে ঠেস দিয়ে বসিয়ে দিলে দুনিয়ার গালগল্প জুড়বে। বেশিরভাগই নদী ভাঙার আগে যখন তার ভরা সংসার ছিল, ঘরগেরস্তি ছিল সেসব নিয়ে। শুনতে হয় বলে জবা শোনে, বিশ্বাস করে না। দুই বেলা নাকি আড়াই সের দুধ পেত দুইটা গাই দুইয়ে। ভাতের অভাব কী জিনিস জীবনে দেখে নাই—মানে যতদিন জমাজমি, ভিটি, ঘর-দুয়ার পদ্মা গিলে খায় নাই। কতক্ষণ বুড়ির ভ্যাজরভ্যাজর শোনা যায়! জবা মাঝে মাঝে ঘরে টিপতালা মেরে এদিকে-ওদিকে যায়।
দূরে কোথাও না। এই যেমন তোরাবের টঙের দোকানে বা বেড়িবাঁধের দিকে যেখান থেকে দূরে ইটভাটার চোঙগুলো নজরে পড়ে, গোল্লা-গোল্লা কালো ধোঁয়া মেঘের মতো ওড়ে। উড়তে উড়তে এক সময় মেঘ ছুঁয়ে ফেললে সাদা মেঘে কালচে গোল্লাগুলো কখনো হাতি, কখনো শিং-বাগানো মোষ হয়ে যায়। তাকিয়ে থেকে ঘাড় টনটন করে, তবে কিছুটা সময় সয়ে গেলে শুধু হাতি-মোষ না, মন যা চায় তা-ই দেখা যায়। গাছপালা, পাহাড়-পর্বত, পালতোলা জাহাজ। মায়ের এসব বরদাস্ত হয় না। যদি জানতে পারে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল, এমনকি তোরাবের দোকানেও গেছে, দুম দুম কিলাবে।
গত রাতেও এক দফা হয়ে গেছে। বস্তির শেষ মাথায় যেখানে এনজিও-ওয়ালারা নাইট ইশকুল করবে বলে শামিয়ানা খাটিয়ে বক্তৃতা আর গানের ফাঁকে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম বাজাচ্ছিল, শুনে তার খুব ইচ্ছা করছিল এক চক্কর ঘুরে আসে। গিয়েওছিল। বড় ঘরের সুন্দর-সুন্দর মহিলারা নাকে কালো চশমা, হাতে ভোম্বা মোবাইল নিয়ে কাজের তদারকি করেছিল। ওদের একজন নাদুসনুদুস দেখতে, তাকে নাম জিজ্ঞাসা করেছিল। পড়ে কি না জানতে চাইলে সে বলেছিল কেলাস ফাইভ। আসলে থ্রি শেষ না করতেই যে পড়া ছেড়ে দিয়েছে সে কথা চেপে গিয়ে ফাইভে পড়ে বলায় কেন যেন ভালো লাগছিল। তার মতো বারো-তেরো বছরের মেয়ে মাত্র থ্রি-তে, এ কথায় মহিলা হয়তো অবাক হতো। যাই হোক, মহিলাটা ভালো, তাকে কাছে ডেকে বলেছিল নাইট ইশকুলে ছোট-বড় সবার পড়ার বন্দোবস্ত হবে, সে যেন আসে, খরচাপাতি লাগবে না। তার পর তাকে অবাক করে এদিকে আসো তো বলে—মাগ্গো মা, কী মায়া গলায়—তার কাঁধে হাত বেড় দিয়ে মোবাইলে ছবি তুলেছিল। তাকে দেখিয়েওছিল ছবিটা।
মায়ের কাছে কি খবর চাপা থাকে! ক্যান গেছিলি হারামজাদি বলে কিল আর কিল।
মাকে আসতে দেখে কিল খাওয়া পিঠের যন্ত্রণাটা যেন টনটন করে উঠল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল মা কী করে। তাকে দেখে কি এখানেই গত রাতের মতো হাত দুটো আবার চালু করবে? অবাক হলো, মা যেন তাকে দেখেও না দেখার মতো তেরচা চোখে একবার তাকিয়ে বলল, চল।
পেছন পেছন চলতে গিয়ে জবা ভাবল মা যদি উল্টাপাল্টা কিছু শুরু করে, সে মুখে যা আসবে বলবে। তোরাবের দোকানে বা বেড়িবাঁধের দিকে যে যায়, কুমতলবে তো যায় না। ঘরের মধ্যে গরমে সেদ্ধ হয়ে সারা দিন তার কিভাবে কাটে মা খোঁজ রাখে? তাও যদি নড়াচড়ার জায়গা থাকত! মা যদি আজ তেড়িবেড়ি করে, সাফ সাফ মুখের ওপর বলবে, হয় তার জন্য ফ্যাক্টরিতে কাজ দেখতে, নয় কিলাকিলি বন্ধ করতে। এইটুকু ঘরে সে টিকতে পারে না।
ঘরে ঢুকে মা তেমন কিছুই করল না। ‘সাবান নাই আগে কস নাই ক্যান’ বলে তার দিকে একবার তাকাল, তার পর আস্তে আস্তে বলল, ‘এইখানে আর না, কাউয়া আইসা পড়ছে।’
থতমত খেয়ে মা-র মুখে তাকিয়ে জবা যা বোঝার বুঝল। এ নিয়ে কয়বার হলো? কাউয়া আসে আর মা তাকে নিয়ে তল্পিতল্পা গোটায়। এর আগে, তার জন্মের আগে, মায়ের বিয়েরও আগে, মা যখন ছোট তখনো এভাবে এক জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় ভেগেছে। সে সময় তার নানির সাথে থাকত মা। নানিই ভাগত মাকে নিয়ে, এখন মা ভাগে তাকে নিয়ে।
ছোটবেলার কথা মনে নাই, তবে চার বছর আগে যখন মা তাকে নিয়ে এক রাতে এই বস্তিতে এসে উঠল, সে সময়ের ঘটনা জবার পরিষ্কার মনে আছে। থাকত তারা তখন আগারগাঁও বিএনপি বস্তিতে। মা কাজে যেত মিরপুরে এক গার্মেন্টে। খুব ভোরে বের হতো, বাসে করে অনেক পথ। প্রায় দিনই তাকে ঘুমে ফেলে চলে যেত। রাতে খাওয়ার পর ভাতের ডেকচিতে পানি দিয়ে রাখত। ভোরে মা সেই পান্তা খেয়ে তার জন্য ঢেকে রেখে যেত। বেশি করেই রাখত, পেট ঠেসে খাওয়ার পর দুপুর পর্যন্ত তেমন খিদাটিদা টের পেত না। তবে বিকাল নাগাদ খিঁচ-ধরা খিদায় মাথা ভোঁ ভোঁ করত। মা বুদ্ধি করে ঘরে মুড়ি রাখত, মুড়ি আর পানি খেয়ে খিদা চাপা দেওয়া চলত। ঘরটা ওখানে এত ছোট ছিল না, আর বস্তির ভিতরে এদিকে-ওদিকে কিছু খোলা জায়গা ছিল যেখানে সারা দিনই কাচ্চাবাচ্চাদের খেলা, ক্যাচমেচ, মারামারি। জবাও যেত। খেলার টানে যেত। মা না ফেরা পর্যন্ত ইচ্ছা করত না খেলা ফেলে ঘরে যায়। কোনো দিন মা চুল ধরে টেনেহিঁচড়ে ঘরে ঢোকাত। ছোট মানুষ, চুলের ওপর দিয়েই যেত, কিলাকিলি তখনো শুরু হয়নি।
বছরখানেকের মতো ছিল ওখানে। এক রাতে মা বলল, আমরা আইজ এই জাগা ছাইড়া যামু। ঘুমাইবি না খবরদার। কেউ যেন ঠার না পায়। কপাল ভালো, মা তাকে বেশি হাঁটায়নি। কয়েকটা বোঁচকাবুচকি মা বস্তির একটা চাপা পথ দিয়ে বের করে রাস্তায় এনে রেখেছিল। এক সাথে আনেনি, তাকে পাহারায় রেখে কয়েকবারে এনেছিল। তারপর রিকশায় বসে ঘুমে ঢুলে ঢুলে বাতাস খেতে খেতে অনেক রাতে এখানে এসে পৌছেছিল। মা আগেই সব বন্দোবস্ত করে রেখেছিল।
গত চার বছরে কাউয়ার কথা একবারও না শুনে আজ যখন হঠাৎ শুনল, সে চমকে মা-র মুখে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। কিছু জানতে চাওয়ার দরকার নাই। কাউয়া এসে গেছে এটাই বড় কথা। কিন্তু এবার তো জিনিসপাতি কম না। আগারগাঁও ছাড়ার সময় মাত্র কয়েকটা বোঁচকাবুচকিতে হয়ে গিয়েছিল। এখন তো তারা দুজন শুতে পারার মতো একটা চৌকি আছে, পিঁড়ি আছে, এমনকি আলনা পর্যন্ত। এ ছাড়া কম্বল-তোশক-বালিশ, চালের মটকা, হাঁড়িকুড়ি, টিনের ট্রাংক। কাউয়ার কথা মা হয়তো ভুলে গিয়েছিল, না হলে এত কিছুতে ঘর ভরায়! কী করবে, সব ফেলে যাবে? ঘর ভাড়া মিটিয়ে দিলে অবশ্য চুরি করে যাওয়ার চিন্তা করতে হবে না। ভাড়ার টাকা কি আছে মায়ের কাছে? কিন্তু যাবে কোথায়?
মাকে ঘাঁটাতে সাহস হচ্ছে না, আবার দুশ্চিন্তাও মাথা ছাড়ছে না। মা সেই যে ঘরে ঢুকে কাউয়ার কথা বলে কেওড় বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে, একটা কথাও আর বলছে না। সে কি মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে, না কি হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করবে—যেভাবে ঘামছে! পাশের ঘর থেকে মর্জিনার মা চিল্লাচ্ছে। বুড়ি হয়তো উঠে বসবে, কেউ যেন তাকে ঠেলেঠুলে বসায়। একটু পর জবা শুনতে পেল তার নাম ধরে ডাকছে, ‘ও জবা, জবা, কই গেলি সুনা, এট্টু আইবি।’
জবা কান দিল না। হাতপাখা নিয়ে মায়ের মাথার কাছে বসল। মা এত সময়ে মুখ খুলল, ‘দ্যাখ কী চায়।’
জবা বসেই থাকল। পাখার বাতাসে মা-র চুল দোল খাচ্ছে, চোখের পাতা কাঁপছে। সে জোরে জোরে পাখা নাড়তে লাগল। মা এবার হাত দিয়ে তাকে ঠেলল, ‘ক্যান ডাকে দ্যাখ।’
চম্পা
জবা তবু নড়ল না।
চম্পা পষ্ট মনে করতে পারে সে যখন জবার চেয়েও অনেক ছোট, মা-র সাথে এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় পালাত, ভয়-ডরের কারণ বলতে ছিল মা-ই। নতুন জায়গাটা কেমন, সেখানে মা কী কাজ করবে, থাকবে কোথায়, খাবে কী এসবের চেয়ে মা যে কখন তার ওপর হামলে পড়বে, খিস্তি করবে, মারবে এ চিন্তাই তাকে কাবু করে রাখত। দোষটা তার, তার জন্যই মার ভোগান্তি এ কথা শুনে শুনেই সে বড় হয়েছে—কুন কামে যে বাচাইয়া রাখছিলাম, যুদি নুন দিয়া খালাসের বাদেই মাইরা থুইতাম! পারলাম কই, রেখাবু কাইড়া নিয়া নিজের শাড়ি প্যাঁচাইয়া তোর কান্দন থামাইল। হায় গো রেখাবু, লাভ কী অইল!
মায়ের রেখাবুকে চম্পা যখন মালিবাগের আম্মা, পরে শুধুই আম্মা বলে চিনতে শিখল, সে ভাবত এই বড় বড় চোখ, চাপা গাল ও উঁচু চোয়ালের রোগাপাতলা মহিলার কারণে সে ও তার মা বেঁচে আছে। ব্যাপারটা ঘোরপ্যাচের। মা তো আম্মাকে দোষও দিত, কেন তাদের বাঁচাল? আবার এমনও বলত, আসমানো ফিরিস্তা আছে না, ব্যাকটি পুরুষ, মাইয়া না, এই এ্যাকজন মাইয়া, আসমানো থাকে না, মাটিত চলে ফিরে।
খুব ছোটবেলা থেকে এসব কথা শুনে শুনে মনে হতো সব মা-রা হয়তো এ রকম আবোল-তাবোল অনেক কিছু বলে। তবে একটা ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল, সব মা-রা কাউয়ার কথা বলে না। মনে আছে প্রথম যেবার মায়ের মুখে কাউয়ার কথা শুনেছিল, সে জানতে চেয়েছিল, কাউয়া ক্যান? মা ঝামটে উঠেছিল, কাউয়া চিনস না! কা-কা কইরা ঢোল পিটায়, চিনবি।
তারপরও বোঝেনি। মা ভেঙে বলেনি। নিজে নিজে বুঝতে তার অনেক সময় লেগেছিল।
সে তো চম্পার মায়ের আমলের ঘটনা। তার নিজের আমলে সে জবাকে বোঝার জন্য বেশি দিন বসিয়ে রাখেনি। সেই যেবার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের কাছে চেরাগি বস্তি ছেড়ে আগারগাঁও আসার আগে চম্পা তার মায়ের গলা নকল করে জবাকে বলেছিল, কাউয়া আইসা পড়ছে, জবা কী বুঝে মাকে সাহস দিয়েছিল- কাউয়ারে ডরাও? চম্পা সে সময় ছয়-সাত বছরের এইটুকু জবাকে কাউয়া-কাহিনি শুনিয়েছিল।
কী বুঝতে কী বুঝবে এ নিয়ে মনে খটকা ছিল। তবে মেয়ে তো, বয়স যত কমই হোক, বুঝবে এ ধারণা থেকেই ভেবেছিল বলে ফেলা দরকার। শোনার পর আচানক গল্পটা হয়তো জবার মন্দ লাগেনি। আর মনের কিছু খটকা যে এতে দূর হয়েছিল তা সে সময় তার কথায়ই ধরা পড়েছিল। জবা বলেছিল, কাউয়া তাইলে কাউয়া না।
অথচ চম্পাকে তার মা নিজের কাহিনি লুকিয়েছিল। বাপের কথা জানতে চাইলে বলত, মইরা গ্যাছে তুই অওনের আগে। তবে রেগে গেলে জাউরা বলে গাল দিতে ছাড়ত না। চম্পা বোকাই ছিল, মরা বাপ নিয়ে মাকে ঘাঁটাঘাঁটিতে যেত না। মরে গেছে তো মরে গেছে, এ নিয়ে কথা তুলে কী লাভ! মা যখন বলত, কাউয়া এসে গেছে, ভাগতে হবে, তার মাথায় তখন এক নাম না জানা বিপদ ছাড়া অন্য কিছু খেলত না।
মায়ের এমনই কপাল, বাসাবাড়িতে কাজ নিয়েও টিকতে পারেনি। ঘর ভাড়া লাগবে না ভেবে ছুটা কাজের চেয়ে বাঁধা কাজ পছন্দ করত। খাওয়া-থাকার চিন্তা করতে হবে না, বাইরে বেরোতে হবে না, আর তার দেখাদেখি চম্পাও কাজকর্ম শিখতে পারবে এ ভরসায় মা হয়তো ভেবেছিল নিজেকে আড়ালে-আবডালে রাখতে পারবে। আর নিজেকে যদি আড়াল করতে পারে, চম্পাকে নিয়ে কীসের চিন্তা! চম্পার জীবন তো তার মতো হতে পারে না। তার বিয়ে-শাদি হবে, স্বামী-সংসার হবে। কে আর তখন খোঁজ পাবে কে তার মা! হিসাবটা মায়ের মন্দ ছিল না। পারল কই? এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় ভেগে ভেগেই জিন্দেগি গেল।
কলকারচরে এখন শেফালি বেগমের কেমন কাটছে চম্পার জানার উপায় নাই। ফরিদপুর জেলা সদর থেকে বাস বা টেম্পোতে করে সিঅ্যান্ডবি ঘাট, তারপর ট্রলারে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পদ্মার সেই চরে মা যে গেল তা তার নিজের ইচ্ছায়। সেও হয়ে গেছে অনেক বছর। মা যে সেই গেল, আর দেখা হয়নি, তবে বেঁচে যে আছে এটুকু চম্পা জানে। মা-ই মাঝে মাঝে খবর পাঠায়, তবে তাকে না, পাঠায় আম্মাকে। আম্মার বাসায় মাসে-দুই মাসে চম্পা যায়, এমনিই যায়। গেলে কখনো শোনে তার মা কাকে দিয়ে যেন ফোন করিয়েছিল। চম্পার পক্ষে টাকা-পয়সা পাঠানোর উপায় নাই। ওখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নাই, বিকাশ-এ যে টাকা পাঠাবে সে পথ বন্ধ।
মা ভেবেচিন্তে কাজটা করেছিল। ভেবেছিল সে সরে গেলে তার দুর্গতি চম্পাকে পাবে না। বলত, এট্টুন দ্যাশ, ভাইগা কই যাই! কিন্তুক তরে আমার ছাড়ন লাগব, আমি থাকলে তর রেহাই নাই। এমুন এক চরে যামু, কেউ বিচরাইয়া পাইব না। তুইও পাইবি না। মনো করবি দুইন্যায় একলা আইছস, মা বইল্যা তোর কেউ আছিল না, তুইও কেউর মাইয়া না। পারবি না?
কী পারবে? তার মায়ের ভাবনাচিন্তায় যে দুনিয়া চলে না, এ যেমন শেফালি বেগম চোখের পানি মুছে ফেলার সময় বোঝেনি, চম্পাও কি আন্দাজ করতে পেরেছিল মা না থাকলেও মায়ের জীবনটা তার ঘাড়ে সওয়ার হবে। মা ভাগত তাকে নিয়ে, এখন সে ভাগে জবাকে নিয়ে।
মান্তু
আজ সকালে ফ্যাক্টরি গেটে লাইন ধরা এত মেয়েদের ভিড়ে মান্তুকে দেখবে চম্পা কল্পনাও করেনি। আজগরের চাচাতো বোন মান্তুর ভালোই বিয়ে হয়েছিল, জামাই ট্রাক না বাস চালাত। দেখতে-শুনতে, চালচলনে ভালো, স্বামীর ঘরে মান্তুর সুখেই থাকার কথা। সে যে কোন মুসিবতে পড়ে গার্মেন্টে ভিড়ল! হয়তো সবে ভিড়েছে, হতে পারে আজই প্রথম হাজিরার লাইনে দাঁড়িয়েছে। আট-দশ বছর পরে দেখলেও চম্পা এক নজরেই চিনতে পেরেছিল। রোগা হয়েছে আগের চেয়ে, গায়ের রঙ তো ফরসার দিকে ছিল, রঙটা কালচে মেরে গেছে, তবে জোড়া ভুরুর মাঝখানে কাটা দাগটা প্রথম দেখায়ই চোখে দগদগ করে উঠতে চম্পা চমকে উঠেছে, এ কাকে দেখছে, এখানে কী করছে? পরপরই মাথা ঘুরিয়ে লাইন ছেড়ে এক পা দুই পা করে পিছু হটেছে।
আজগরের আপন দুই বোনের কেউই বেঁচে ছিল না, চম্পার ননদ বলতে তখন এই মান্তু। যদিও আসগরের চাচা একই গাঁয়ে আলাদা বাড়ি করে চলে গিয়েছিল, মান্তু প্রায়ই আসত, চম্পাকে ডাকত চম্পাবু। বলত, ‘তুমার শরীলে যে চম্পা ফুলের গেরান এইটা কে ঠার পাইছিল তুমি হওনের সুময়? কে রাখছিল গো নামটা—তুমার মায় না বাপে?’ চম্পার সাথে তার ঘনিষ্ঠতার অন্য কারণও ছিল। মান্তুর তখন বিয়ের কথাবার্তা চলছে, আর এ নিয়ে চম্পাকে একা পেলে তার কত কানাকানি! বিয়ের পর যদি স্বামী বোরকা পরতে বলে, সে কিছুতেই রাজি হবে না, পয়লা রাতেই কি গায়ে হাত দেবে, জবরদস্তি করবে, যদি মুখে দাড়ি-মোচ থাকে সে আস্তাগফিরুল্লা বলে আল্লার কাছে কী বলে মাফি মাঙবে, দাড়ি রাখা তো রাসুলের সুন্নত—কত যে ফুসুরফুসুর! চম্পা মনে মনে হাসত, মেয়েটা তাকে পছন্দ করে বলেই এসব বলে, তার মতামত জানতে চায় ভাবতে ভালোই লাগত। এই মান্ত্রর কী হলো জানার উপায় নাই। চম্পা এমনও ভাবে, যদি তার নিজের জীবনটা এমন না হতো তা হলে দেখামাত্র ছুটে গিয়ে সে তার হাত ধরত। গার্মেন্টে যখন মান্তু কাজ নিয়েছে, বিপদে পড়েই নিয়েছে। চম্পার হাত ধরাটা মান্তুর জন্য মুসকিল আসানের মতো হতো। আর চম্পা কি হাত ধরেই দাঁড়িয়ে থাকত? ওর জন্য যা যা দরকার করত, এমনও তো হতে পারত, সে তাকে তার ঘরেই এনে রাখত, বা দুজনে মিলে বড় দেখে ঘর নিত। কিন্তু কথা হলো, সে যদি এই চম্পাই না হবে তা হলে গ্রাম ছেড়ে এই ঢাকা শহরে জবাকে নিয়ে বস্তিতে থাকে, গার্মেন্টে কাজ নেয়! আর যে মান্তুকে নিয়ে এত কিছু ভাবছে তাকে দেখামাত্র ঘাড় ঘোরায়! পায়ের তলায় ভূমিকম্পের নাচনকুদনে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখে! হায় রে মান্তু, কত না খোয়াব দেখতি নায়ক রিয়াজের মতো জামাই পাইবি!
চম্পা
মালিবাগের এই গলির মুখে একটা নুয়ে পড়া ঝাঁকড়া আমগাছ ছিল। গাছটা কাটা পড়েছে অনেক দিন, তবে চওড়া গোড়া রয়ে গেছে, তাতে বেশ জুত হয়ে বসে কোলের ওপর মাথা ঝুঁকিয়ে চুলের জট ছাড়াচ্ছে রুশি পাগলি। মুখ দেখা না গেলেও চম্পা নিশ্চিত রুশিই। ছোটবেলা চম্পা দেখেছে পাড়ার ছেলেপেলেরা তাকে খেপাত, রুশি তোর কুশি দেখা। রুশি যে খুব খেপে উঠত তা না, বুকে আঙুল ঠুকে বলত, খাইবি?
আম্মাকে বাসায় পাবে কি না দুশ্চিন্তায় ছিল চম্পা। বাসায় নতুন দারোয়ান। বলল, ‘খালাম্মা বাইরে। আসুক, তুমারে ঢুকাইতে কইলে ভিতরে যাইবা।’ এটুকু শুনেই মাথা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। তবে লোকটা তাকে চেনে না বলেই তাকে ও জবাকে গেট থেকে খেদাতে বকবক জুড়ে দিল, ‘অনে যাও, এইখানে খাড়াইয়া থাকবা না। আজাইরা মানুষ দেখলে আমার চাকরি যাইব। ওই দ্যাখো, ক্যামেরা ফিট করা, কে আইলো কে গেল ফটো তোলা থাকে। তুমার লগে এইডা কে, মাইয়া? আর বিয়ানকালে পোঁটলাপাটলা লইয়া আইছো, কাম করবা? খালাম্মা আমারে কইছিলেন কামের বুয়ার খোঁজ করতে, কই পামু। গেরামে খবর করছিলাম …’ লোকটার কথার মাঝ পথেই চম্পা গেট ছেড়ে সরে বলল, ‘অত প্যাঁচাল পাড়েন ক্যান? আমরা বাইরে বইসা থাকুম, আম্মা আসলে আমরারে তো দেখবই, আপনের কিছু করা লাগব না।’
গেটের বাইরে রোদ। দাঁড়াতে গেলে খানিকটা দূরে একটা কাঠবাদাম গাছের ছায়ায় যেতে হয়। ওখানে এক জোড়া অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে গল্প করছে, মনে হয় উল্টো দিকের কোচিংয়ে পড়ে। জবাকে নিয়ে ওখানেই গিয়ে দাঁড়াবে বলে পা বাড়াতে যাবে, দেখে জবা গেটের মুখেই দাঁড়িয়ে। হারামজাদা দারোয়ান কী নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে। হতে পারে বলছে, সে ইচ্ছা করলে থাকতে পারে। ‘কী অইলো তোর’ বলে জোরে চিল্লানি দিতে জবা নড়ল। তবে চম্পা যে কাঠবাদাম গাছটাকে নিশানা করে হাঁটছে আর ওখানে যে ছেলেমেয়ে দুটো প্রেম করছে বুঝেই যেন জবা কয়েক পা এগিয়ে, না, ওইখানে না, বলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বেশি সময় দাঁড়াতে হলো না। মিনিট পনেরো হয় কি না, গেট বরাবর রঙচটা সুরমা রঙের গাড়িটা এসে থামতে ভিতরে আম্মার মুখটা আবছা এক নজর দেখামাত্র চম্পা কীসের দারোয়ান কীসের ক্যামেরা, জবাকে নিয়ে গেটের মুখে গাড়ি আগলে দাঁড়াল।
সিঁড়ি ভেঙে তিন তলায় উঠতে উঠতে চম্পা খেয়াল না করে পারল না আম্মার বয়স যেন হু হু বেড়ে গেছে। একেকটা সিঁড়ি ভাঙছেন আর জোরে জোরে শ্বাস ফেলছেন। চেহারা ভাঙাচোরা, বড় বড় চোখ গর্তে বসে গেছে, তবে এখনো কী একটা আছে যা আগেও ছিল। ‘তোর মেয়ে তো বড় হয়ে গেছে রে’ বলতে বলতে সিঁড়ির শেষ ধাপটা পাড়ি দিয়ে জবার দিকে ফিরে দরজার মুখে দাঁড়ালেন। চম্পা শুনল শরীর ভেঙে গেলেও গলাটা পরিষ্কার, তাকিয়ে দেখল চোখজোড়া এইমাত্র যা ভেবেছিল বসে গেছে, তা তো না, ছোট কোটেরের ঘের ঠেলে বড় বড় ঘোর কালো মণি দুটো সারা মুখে আলো ছিটিয়ে তাদের মা-মেয়েকে দেখছে।
আমি যখন অশ্রুদানি
আমার দুই অক্ষরের ডাকনামটা এ বয়সে বেমানান। ছোট বয়স পেরোনোর পর বাড়ির বাইরে নামটা তেমন শুনিনি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা যাকে বলি ভালো নাম সেটাই চালু হয়ে গিয়েছিল। আমিও তা-ই চেয়েছিলাম। চম্পার মা শেফালি যে আমাকে রেখাবু ডাকত, সেটা কার মুখে শুনে বলতে পারব না। অন্য মেয়েরা যারা ছিল তারাও তার দেখাদেখি কেউ রেখা আপা, কেউ রেখাদি। শুধু আপা ডাকার মেয়েরাও ছিল। তখন আমার বয়স নেহাত কম না, তিরিশের ঘরে পড়েছি। এ ছাড়া কাজ যা করতাম সেটা সর্দারনি গোছের, গার্লস গাইডের তখন আমি সেক্রেটারি। কত আগের কথা! অথচ মনে হয় সেদিনের। নিজের কথা থাক। চম্পার কথা বলি। না, চম্পার কথা পরে, চম্পার আগে ওর মা শেফালির কথা। আমার চেয়ে শেফালির বিষয়ে কে ভালো জানে! শুধু কি শেফালি? কত কত মেয়ে, কত নাম! তবে শেফালি মনে হয় অন্যদের থেকে আলাদা বলেই আজও আমার মাথায় গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। আজ এত দিন পর ওর কথা আমি না বললে কে বলবে!
প্রথম যেদিন শেফালিকে দেখি, আমার ভয় ছিল ওকে বাঁচানো যাবে না। রক্তহীন, ফ্যাকাসে মুখ, কপালের ডান পাশে একটা বড়সড় জড়ুল ছাড়া চেহারায় চোখে পড়ার মতো কিছু নাই। হাড্ডিসার হাত-পায়ে কাঁড়িকাঁড়ি ময়লা, কদমছাঁট চুলে মাথাটা এতই ছোট যেন হাতের তালুতে পুরোটা ঘিরে ফেলা যাবে। বমি করবে বলে বারবার ঘাড়-মাথা ঝাঁকিয়ে ওয়াক তুলছিল, বমি হচ্ছিল না, তবে প্রতিবার ঝাঁকানোর তোড়ে মনে হচ্ছিল এই বুঝি চামড়া-টামড়া ছিঁড়ে পাঁজরের হাড়গোড় ছিটকে পড়বে। মনে আছে কুমিল্লা থেকে ওকে নিয়ে এসেছিল সঞ্জু ও মতিন। সঙ্গে আরও চার-পাঁচজন মেয়ে। ওদের অবস্থা অতটা খারাপ ছিল না। সঞ্জুরা এলাকার মুক্তিবাহিনীর। ওদের বলা ছিল যেভাবে পারে মেয়েগুলোকে যেন ঢাকায় নিয়ে আসে। কিভাবে আনবে সেটা ছিল সমস্যা। ওদের কাছে টাকা-পয়সা ছিল না যে গাড়ি ভাড়া করে এতগুলো অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে এতটা পথ আসবে। কেমন করে যেন রেডক্রসের একটা পিকআপের ব্যবস্থা হয়ে যেতে গাদাগাদি করে নিয়ে আসতে পেরেছিল। মগবাজার ইস্পাহানি কলোনির উল্টো দিকের বাড়িটার কথা ওদের বলা ছিল। আগাখানিদের পরিত্যক্ত ওই বাড়ি তখন অস্থায়ী পুনর্বাসনকেন্দ্র। ওরা সরাসরি ওখানেই চলে এসেছিল। রওনা হওয়ার আগে সঞ্জুরা কিছু কাপড়চোপড় জোগাড় করেছিল; নিশ্চয়ই মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে চেয়েচিন্তে এনেছিল। শাড়ি, চাদর, গামছা, কম্বল যা জুটেছিল তাই দিয়ে মেয়েগুলোকে ঢেকেঢুকে আনার ব্যবস্থা করেছিল।
আনা তো হলো, কিন্তু আমি তখন কী করি! আমার সঙ্গে ভলান্টিয়ার বলতে মাত্র চারজন মেয়ে। সবাই গার্লস গাইডের। সেবা-শুশ্রূষার কিছু কিছু অভিজ্ঞতা থাকলেও শেফালির মতো মরণাপন্ন একটা মেয়েকে নিয়ে কী করি ভেবে পাচ্ছিলাম না। ডাক্তার, ওষুধপত্র, টাকা-পয়সার জোগান বলতে তখন পর্যন্ত কিছুই ছিল না। আমরা নিজেদের ঘর থেকে কিছু কাপড়চোপড়, কম্বল, গুঁড়োদুধ, পাউরুটি, অল্পস্বল্প ওষুধপত্র যার যখন যা মনে পড়েছে এনে রেখেছিলাম। আমাদের মাথার ওপরে যারা ছিলেন তাদের কড়া নির্দেশ ছিল যা করা দরকার আমাদেরই করতে হবে। উটকো মানুষকে জানানো চলবে না, যার-তার কাছে সাহায্যও চাওয়া চলবে না, হইচই একদম না। যা করতে হবে চুপেচাপে, সাবধানে। এত দিন মেয়েগুলো বেঘোরে আবদ্ধ থেকে প্রায় চেতনহীন অবস্থায় ছিল, ছাড়া পেয়ে তাদের মাথায় প্রথমেই যা কাজ করার কথা তা লজ্জা, পরিত্রাণহীন লজ্জা। সুযোগ পেলে কারো পক্ষে যে কোনো কায়দায় আত্মহত্যা করে ফেলাও বিচিত্র কিছু ছিল না।
শেফালি ঠান্ডা মেঝেতে পড়েছিল, আর একটু পর পর খিঁচুনি তুলে ঘাড়-মাথা ঝাঁকাচ্ছিল। ওর কাছে গিয়ে মেঝেতে বসে কপালে হাত রাখতেই চমকে উঠেছিলাম। গায়ে ধুম জ্বর। হাতের ছোঁয়া পেয়েই কি না ওর শরীরের ঝাঁকুনি আরও বেড়ে গিয়েছিল। আমি দেরি করিনি, ওর কদমছাঁট মাথাটা কোলে টেনে চেপে ধরেছিলাম। মুখে নিশ্চয় কিছু বলেওছিলাম। শেফালির মুখ থেকে অস্ফুট আওয়াজ পাচ্ছিলাম, আমি ওকে আরও জোরে চেপে ধরেছিলাম। কেন জানি মনে হচ্ছিল এভাবে চেপে ধরে ওকে ওর যন্ত্রণা থেকে কিছুটা হলেও রেহাই দিতে পারব। শেফালি হাত-পা ছুড়ছিল, মুখে অনর্গল গোঙানি। আমি তখন বাকি কাজটা করি, টেনে টেনে ওর প্রায় অর্ধেকটা শরীর আমার বুকে, কোলে নিয়ে জাপটে ধরে বসে থাকি। কিন্তু যতই তাকে চেপে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, সে ততই মৃগী রোগীর মতো গা মোচড়াচ্ছিল। তখন আমার খেয়াল হয়েছিল ওর হয়তো জ্ঞান নেই, প্রবল জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে এমন করছে। ওই অবস্থায় গরম পানিতে ডেটোল ছেড়ে ওর শরীর ডলে ডলে পরিষ্কার করতে গিয়ে পেটের নিচের দিকে হাত ঠেকতে জোর ধাক্কা খেয়েছিলাম। রোগা শরীরের তুলনায় অসমান, উঁচু তলপেট আমার আঙুলগুলোকে অসাড় করে দিচ্ছিল। তাড়াতাড়ি ওর গায়ে কাপড় জড়িয়ে আমি যেন এক চ্যালেঞ্জের মুখে ওকে পাঁজাকোলা করে পাশের ছোট কামরায় নিয়ে কম্বল বিছানো চৌকিতে শুইয়ে দিয়েছিলাম। এখন আমাকে দেখে আন্দাজ করা যাবে না, তবে সে সময় রোগা-পটকা হলেও গায়ে শক্তিটক্তি ছিল। শেফালিকে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে বয়ে নিয়ে যেতে এতটুকু কষ্ট হয়নি। তখন সন্ধ্যা হয় হয়, ডিসেম্বরের শেষাশেষি, রাতের দিকে বেশ শীত পড়ত। মনে পড়ে না সে রাতে আমার মধ্যে শীতের কোনো বোধ ছিল। আমার সঙ্গী ভলান্টিয়ারদের মধ্যে কে যেন, সম্ভবত নাজমা বা বকুল, নোভালজিন ট্যাবলেট গুঁড়ো করে পানিতে মিশিয়ে শেফালির গলায় ঢেলে মুখ চেপে ধরেছিল। শেফালি কিছুটা শান্ত হলে ওর কপালে, মাথায় জলপট্টি দিতে শুরু করেছিলাম। নাজমা, বকুলরা তখন অন্য মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত। ওদের কেউ চিৎকার করছিল, কেউ কাঁদছিল। একটা কুড়ি-একুশ বছরের মেয়ে, নাম পরে জেনেছিলাম মালতী, আসার পর থেকে চুপচাপ দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সেই যে বসেছিল, সারা রাত হাজার অনুনয়-বিনয়েও নড়ানো যায়নি।
শেফালির মাথায় কতক্ষণ জলপট্টি দিয়েছিলাম বলতে পারব না, ঘণ্টা কয়েক তো হবেই। জ্বর তবু কমছিল না। এক সময় নিঃসাড় পড়েছিল। রাতের দিকে, নাজমাই হবে, গুঁড়ো দুধ গুলে কয়েক ঢোক তার গলায় ঢেলেছিল। রাতটা কেটেছিল।
পরদিন সকালেও শেফালির অবস্থায় পরিবর্তন নেই। জ্বর কিছুটা কমলেও একটু পর পর খিঁচুনিতে গা মোচড়াচ্ছিল। মাঝে মাঝে চোখ খুলছিল, তবে নিথর চোখের মণিতে কিছু ধরা পড়ছিল বলে মনে হয়নি। এ সময় মুশকিলআসান হয়ে যিনি হাজির হয়েছিলেন তিনি ডাক্তার হালিমা। মাঝবয়সি মহিলা। শেফালির গা মোচড়ানো দেখে বললেন এর তো মনে হচ্ছে মেনিনজাইটিস। পরপরই বুকে স্টেথো চেপে কাপড় সরাতেই পেটের দিকে চোখ পড়তে মুখ কালো করে ফেলেছিলেন।
শেফালিকে তখনি কাছাকাছি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়া ছাড়া গতি ছিল না। ডাক্তার হালিমার সঙ্গে আমিও গেলাম। গাড়িটাড়ির প্রশ্ন ওঠে না, শেফালিকে কম্বলে পেঁচিয়ে এক রিকশায় তিনজন চাপলাম। হলি ফ্যামিলি তখন রেডক্রসের হাসপাতাল। প্রচুর রোগী চারদিকে। এদের মধ্যে গুলিখাওয়া মুক্তিবাহিনীর ছেলেরাও রয়েছে। কী করি, বারান্দায় পা ছড়িয়ে শেফালির মাথা কোলে নিয়ে বসে আছি। হালিমা আপা দৌড়াদৌড়ি করে কোথা থেকে একটা ট্রলি এনে শেফালিকে তুলে নিজেই ইমারজেন্সির দিকে ঠেলে নিয়ে গেলেন। অল্প সময়ে ইনজেকশন, সেলাইন চালু হলো। আমার কাঁচুমাচু মুখ দেখে হালিমা আপা যেন অভয় দিতে কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু তার হয়তো মন সায় দিল না অযথা ভরসা দিতে। বললেন, কম করে হলেও চার মাসের প্রেগনেন্সি, তার ওপর এ অবস্থা।
আমার তখন বারবার মনে পড়ছিল আগের দিন শেফালিকে জড়িয়ে ধরে ভেবেছিলাম ওর কষ্ট কিছুটা হলেও কমাতে পারব। এও মনে হচ্ছিল জীবনে কাউকে এতটা আকুল হয়ে বুকে চেপে ধরিনি। ও যদি এখন মরে যায়, তা হলে হয়তো তা আমারই ব্যর্থতা। তখনো ওর নাম জানতাম না।
সন্ধ্যা নাগাদ ডাক্তার হালিমা সত্যি সত্যি অভয় দিলেন, ওষুধ কাজ করছে। জ্বর আছে, তবে খিঁচুনি অনেকটা কমে এসেছে। ছুটে গিয়ে যা দেখলাম তাতে ভরসা পেলাম। শেফালি চোখ মেলে তাকাচ্ছে, যেন বুঝতে পারছে না কোথায় আছে। আমি ঝুঁকে পড়ে আমার মুখ ওর মুখের কাছে নিয়ে কী বলব বুঝতে না পেরে ওর কপালে আলতো গাল ঠেকিয়ে রাখলাম। তখন আমি নিশ্চিত গতকাল যা পারিনি, সে সময় তা পারছিলাম। শেফালি আমার গালের উষ্ণতা পাচ্ছে, আর সারা দিন নাওয়া-খাওয়াহীন আমিও তার কষ্ট-যন্ত্রণায় একটু হলেও ভাগ বসাতে পারছি।
তিন দিন পরে শেফালিকে নিয়ে ফিরে আসতে দেখি আরও অনেক মেয়ে এসেছে। বেশিরভাগই ঢাকার আশপাশ— সাভার, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে।
নানা জায়গায় মিলিটারি ক্যাম্পে এত এত মেয়ে আটকা পড়েছিল এ খবর জানতে পেরেছিলাম দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু আগে-পরে। আমার কাজের শুরুটা ছিল ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে দুজনকে উদ্ধার করা দিয়ে। আজ যেখানে জাহাঙ্গীর গেট তার পাঁচ-সাতশ গজ ভিতরে উত্তর দিকে একটা একতলা হলুদ বাড়ি-ঘেঁষা বাংকারে ছিল মেয়ে দুজন। ওটাই সম্ভবত ছিল সবচেয়ে কাছের বন্দিশালা, অথচ আমরা এ খবর পাই ষোলোই ডিসেম্বর বিকালে, যখন রেসকোর্সে নিয়াজি-অরোরার সই-সাবুদ চলছে। তবে এর মাস দুয়েক আগে খবর পেয়েছিলাম নাখালপাড়া এমপি হোস্টেলে—ওটা তখন আর্মি ক্যাম্প–অনেক মেয়েকে আটকে রাখা হয়েছে। সম্ভবত সেখান থেকে মেয়েদের অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল বা মেরে ফেলা হয়েছিল। কারণ পরে ওখানে খোঁজ করে কালচে জমাটবাঁধা রক্ত ছাড়া জীবিত বা মৃত কাউকে পাওয়া যায়নি।
সেই হলুদ বাড়ি থেকে মেয়ে দুজনকে আনতে আমাকে পাঠিয়েছিলেন বদরুন আপা, যার নামে আজকের বদরুন্নেসা কলেজ। তারিখটা ছিল ডিসেম্বরের সতেরো। তখনো জানা ছিল না সংখ্যাটা দুই না বেশি। খবরটা এনেছিল মুক্তিবাহিনীর এক ঝাঁকড়া চুল-দাড়িওয়ালা ছেলে, জায়গা চেনাতে আমার সঙ্গে সেও গিয়েছিল। পরে ওর নাম জেনেছিলাম সজীব, ঢাকার ছেলে, আজিমপুরে গণকটুলিতে থাকে। আমরা গিয়েছিলাম একটা খোলা জিপে। মনে আছে জিপ চালাচ্ছিল কালো পাগড়ি মাথায় শিখ ড্রাইভার। কিভাবে ওটার ব্যবস্থা হয়েছিল বলতে পারব না। অনেক দিন পর রাস্তায় বেরিয়ে সব কিছু অন্যরকম লাগছিল। ফাঁকা রাস্তা, শীত শীত হাওয়া আর খোলা টানটান আকাশ। রাস্তার দুই পাশের দালানকোঠাকেও ঠিক চেনা ঠেকছিল না, মনে হচ্ছিল শেষবিকালের রোদ লালচে শ্যাওলার মতো তাদের গা পিছলে রাস্তায় গড়িয়ে নামছে।
কখন যে গাড়ি ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে পড়েছিল খেয়াল করিনি আর তখনি হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। সজীব ড্রাইভারকে কিছু দূর পথ দেখিয়ে জিপ থামাতে বলেছিল। তার পর কী যে ভয়ে, দমবন্ধ অস্থিরতায় গাড়ি থেকে নেমে বাংকার পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম বলতে পারব না। সজীবকে গাড়ি থেকে নামতে মানা করেছিলাম, সেও নামতে চায়নি। কিন্তু আমি তখন কী করব মাথায় আসছিল না।
বাংকারের কাছাকাছি গিয়ে সম্ভবত কয়েক সেকেন্ড নিশ্চল দাঁড়িয়েছিলাম। মেয়েদের নাম জানি না, সংখ্যায় কজন তাও না। আর যে ভয়টা ছিল—যে কজনই হোক, বেঁচে কি আছে? তখন বিকালের আলো কমে আসছে, দূরে দূরে ছাড়া-ছাড়া গাছপালা, আশপাশে কোথাও সাড়াশব্দ নেই, একটা পাখির পাখা ঝাপটানো পর্যন্ত না। পায়ে পায়ে বাংকারের পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে মনে হলো কেউ নেই। প্রায়ান্ধকার গভীর করে কাটা অন্তত পনেরো-কুড়ি হাত টানা-লম্বা খাদে আবর্জনার স্তূপ আর দুর্গন্ধ। দুর্গন্ধটা আমার ঝুঁকে পড়ার কারণেই বুঝি তেড়েফুঁড়ে ধোঁয়ার মতো পাকিয়ে উঠল। এমন অবস্থায় মুখ থেকে তখন কী বেরিয়েছিল মনে নেই। হয়তো বলেছিলাম, অ্যাই তোমরা কই? আমি তোমাদের নিতে আসছি, ভয় নাই।
আর কী বলতে পারি সে সময়! কিন্তু কোথায় কী! আধো আলোয় নিঝুম গহ্বর, আমার কথাগুলো আবর্জনায়, দুর্গন্ধে টোকা দিয়ে আমারই কানে ফিরে এলো। কিন্তু সজীবের খবর পাকা, এ বাংকারেই মেয়েদের থাকার কথা। তবে কি আমাদের আসার আগে অন্য কেউ তাদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে? বসে পড়ে চোখ ঘুরিয়ে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছি, তখনি নজরে পড়েছিল এক কোণে আবর্জনার আড়ালে গা ঘেঁষাঘেঁষি দুটো মেয়ে হাত-পা গুটিয়ে মাথা নিচু করে বসে। বসার ধরনে দুজনকে আলাদা করার উপায় ছিল না। প্রায় উদোম গায়ে হাঁটু বেড় দেওয়া হাতে মাথা গুঁজে থাকা ওদের দেখামাত্র ভেবে পাচ্ছিলাম না কী করি। আমার কাঁধের কাপড়ের ঝোলায় মাত্র একটা শাড়ি। কোন বুদ্ধিতে একটামাত্র শাড়ি নিয়ে এলাম এ নিয়ে মেজাজ খারাপ করে কয়েক সেকেন্ড পার করে কাজে নেমেছিলাম। ঝোলা থেকে শাড়িটা বের করে ভাঁজ খুলে দাঁত বসিয়ে হ্যাঁচকা টান দিতে কাজ হয়েছিল। সুতির শাড়ি, ফড়ফড় করে আলগা হয়ে গিয়েছিল। দুই টুকরায় হবে না, আবার দাঁত বসিয়েছিলাম। বড় বড় অসমান চার টুকরা হাতে পেয়ে সেগুলো দলা পাকিয়ে মেয়েদের তাক করে ছুড়তে শুরু করেছিলাম। অভয় দিয়ে নিশ্চয় কিছু বলেওছিলাম। নিজের ভয় কাটাতে হয়তো একই কথা বারবার বলেছিলাম। তাতে কাজ হয়েছিল। দেখতে পাচ্ছিলাম ওরা শাড়ির টুকরোগুলো বসা অবস্থায়ই একে অন্যের গায়ে জড়াচ্ছে।
দুই পাট করে শাড়ির টুকরো গায়ে পেঁচিয়ে ইতস্তত পায়ে ওরা আবর্জনা ডিঙিয়ে খাদের কিনারে আমার কাছাকাছি আসতে টেনে তুলব বলে হাত বাড়াতে নিজের নিঃসাড় হাত দুটো আমাকে হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল। এই কাঠ-কাঠ অবশ হাত ওদের কী কাজে লাগবে! আবছা আলোয় দপদপ করছিল দুই জোড়া চোখের অসহনীয় চাউনি। একবার তাকিয়ে দ্বিতীয়বার তাকানোর শক্তি-সাহস আমার ছিল না। নিজে মেয়ে হয়ে এমন একটা অকল্পনীয় ঘটনায় অংশ নিচ্ছি ভাবতে বারবার গা শিউরে উঠছিল
আমার অসাড়, কাঠ-কাঠ হাত ধরেই মেয়ে দুটো কষ্টেসৃষ্টে পাড়ে উঠেছিল। মনে আছে ওরা উঠে পড়তেই আমার পরনের চাদর দিয়ে দুজনের গা ঢেকে কোনো দিকে না তাকিয়ে পা চালিয়ে জিপে এসে উঠেছিলাম।
ফেরার পথে তেজগাঁও এয়ারপোর্টের পাশ দিয়ে আসার সময় দেখতে পাচ্ছিলাম রাস্তাজুড়ে জনতার উল্লাস। লাখখানেক সৈন্য নিয়ে জেনারেল নিয়াজি আগের দিন আত্মসমর্পণ করেছে। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আকাশমুখো বেদম গুলি ছুড়ছে। মাইকে জয়বাংলা বাংলার জয় বাজছে। জিপের পেছনে আমার পাশে জবুথবু মেয়ে দুটো পাথরের মতো স্থির। তারা কি বুঝতে পারছিল কী ঘটে গেছে? চারদিকে কীসের এত হইচই, আনন্দ-হুল্লোড়? না কি তারা ভাবছিল আলো-বাতাসহীন গহ্বর থেকে বের করে গায়ে কাপড় জড়িয়েও আমি তাদের এই জনসমাগমে উলঙ্গ করে ফেলেছি?
শেফালির কথায় আসি। হাসপাতাল থেকে তো নিয়ে আসা হলো। সময়মতো চিকিৎসায় তার অবস্থার দ্রুত উন্নতি হলেও কথাবার্তা একদমই বলছিল না। ডাক্তার হালিমার সঙ্গে তখন হাজেরা খাতুন নামে একজন মেট্রোন মেয়েদের দেখাশোনা করছেন। আরও কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবিকাও যোগ দিয়েছে। আমি বলতে গেলে প্রায় সারাদিনই থাকি। নানা জায়গা থেকে নিয়ে আসা এতগুলো মেয়ে—বিবাহিত, সন্তানের মা, অবিবাহিত—কার কী ধরনের সাহায্য দরকার ধরতে পারাও ছিল এক সমস্যা। এত কিছুর মধ্যেও শেফালির প্রতি আমার টান ছিল অন্যরকমের। সে কি সেই প্রথম দিন তার খিঁচুনিরত ঘাড়-মাথা কোলে নিয়ে চেপে ধরেছিলাম বলে, না তার বোবা হিম চাউনি আমাকে এক অবোধ্য আকর্ষণে টানত বলতে পারব না। আমি শেফালির দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছিলাম।
কয়েক দিনের মধ্যে আমরা স্থায়ী একটা পুনর্বাসনকেন্দ্র পেয়ে গেলাম। সেটা ২০ নম্বর ইস্কাটন। বাড়িটা বড়, নিচতলায় পাঁচ-ছয়টা কামরা। এ ছাড়া দোতলায় অফিসের জন্য দুটো কামরা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা নামে সরকারি সংগঠনও চালু হয়েছে। সমাজসেবা দপ্তর থেকে সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। দেশের নানা জায়গা থেকে মেয়েদের ঢাকায় আনতে অসুবিধা, তাই সারাদেশে অনেকগুলো পুনর্বাসনকেন্দ্র চালু করা হয়েছে।
ইস্কাটনের বাড়িটা বড়-ই ছিল না, আলো-বাতাস পাওয়া যেত প্রচুর। মগবাজার থেকে মেয়েদের ওখানে নিয়ে আসার সময় মনে হয়েছিল ভালো পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধার কারণে ওদের শারীরিক-মানসিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি হবে। হয়েও ছিল অনেকের। অন্তত বাইরে থেকে দেখে সে রকম মনে হতো। তবে ইস্কটানের সে বাড়িতে ওঠার আগেই কয়েকজন মেয়েকে ওদের আত্মীয়-স্বজনেরা খবর পাওয়ামাত্র নিয়ে গিয়েছিল। ওরা শহরের বাসিন্দা বা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। থেকে গিয়েছিল গ্রামের নিম্নবিত্ত, গরিব ঘরের শেফালিরা।
সেই শেফালির মেয়ে চম্পা, চম্পার মেয়ে জবা। ফুলের নামে নাম। চম্পা আমার দেওয়া নাম। চম্পা মায়ের রূপ পায়নি, চেহারার গঠন মন্দ না, তবে চোখ দুটোর রসকষহীন রুক্ষতা জন্মের কিছু দিন পরেই আমার নজর এড়ায়নি। শেফালির প্রতি আমার টান চম্পা হয়ে এখন জবার ওপর ভর করেছে। পুনর্বাসনকেন্দ্রে কয়েক বছরে এত মেয়েদের কাছাকাছি পেলেও অনেকে হারিয়ে গিয়েছে, অনেকে হয়তো ইচ্ছা করে যোগাযোগ রাখেনি—বাধ্য হয়েই রাখেনি। কিন্তু শেফালি দীর্ঘদিন আমাকে ছাড়েনি, আমিও না। বলত আমাকে ছেড়ে কার কাছে যাবে কাঁদতে! তাই তো ভাবতাম আমি ওর অশ্রুদানি।
আজ যখন জবাকে নিয়ে চম্পা আমার পিছু পিছু ঘরে ঢুকল, শেফালির মুখটা তখন থেকে আমাকে জ্বালাচ্ছে, খুব মনে পড়ছে ওর কথা। চম্পার জন্ম বলতে গেলে আমারই হাতে। আমি কাছে না থাকলে শেফালির তখন যে অবস্থা, অঘটন কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারত। এখন সে কেমন আছে জানার উপায় নাই। পদ্মার এক চরে গিয়ে ঠাঁই গেড়ে কি শান্তিতে আছে? হঠাৎ হঠাৎ ওর খবর পাই। আমার ফোন নম্বর নিশ্চয় যত্ন করে রেখে দিয়েছে। নিজে সেই চর থেকে ফোন করতে পারে না, নেটওয়ার্ক নাই, কেউ যখন চর থেকে শহর-গঞ্জে আসে, শেফালির হয়ে ফোনে জানতে চায় আমি কেমন আছি। তার মানে সে শুধু আমার খবরই নেয়, সে বেঁচে আছে এর বেশি আমার জানার উপায় নাই। ওর হয়ে যে বা যারা ফোন করে তাদের কাছে ওর খবর জানতে চাইলে শুনি ভালো আছে। কী করে থাকে!
পালাবার গলিঘুঁজি
আম্মার বাসায় চম্পা হঠাৎ করে আসেনি। মান্তুকে ফ্যাক্টরি গেটে দেখে ঘরে ফিরে ভেবে উঠতে পারছিল না কী করবে। গত চার বছর ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট ছাড়া কেটেছে, জায়গা বদলের চিন্তা মাথায় আসেনি। বস্তির ঘরটা ছোট হলেও জবাকে নিয়ে এক রকম পাকাপোক্ত আস্তানাই গেড়েছিল। ঘরে প্রয়োজনের নানা জিনিসপত্র জড়ো করছিল। শহরের নানা জায়গায় বস্তি খালি করা হচ্ছে এমন খবরে মন খারাপ হলেও ভেবেছে গোটা বস্তিটাই যদি উঠে যায়, কী আর করা—অন্যদের যা হবে তারও তাই। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে চোরের মতো ভেগে পড়ার ঘটনা আবার ঘটতে পারে এ ভয়টা একদমই ছিল না। ঘরে এসে জবাকে যখন কাউয়ার কথা বলেছিল, বুক ধড়ফড় করছিল। বস্তি ছাড়া মানে চাকরিও ছাড়া।
কী করবে ভেবে ভেবে সারা দিন ঘরে দরজা আটকে পার করে দিয়েছিল। সন্ধ্যার দিকে, মাগরিবের আজান তখনো হয়নি, জবা বলে উঠেছিল, নানুর ধারে যাই চলো, নানু তুমারে বুদ্ধি দিব। কথাটা যে চম্পা ভাবেনি তা না, তবে বুদ্ধি নেওয়ার আগে সে ভাবছিল আম্মার কাছে যদি জবাকে গছাতে পারে। জবা তার সঙ্গে না থাকলে, নিজের একার একটা ব্যবস্থা সে হয়তো করে ফেলতে পারবে- যদিও সেটা কী ভেবে ভেবে কূলকিনারা পায়নি।
সন্ধ্যা নামতে আশপাশে মানুষের নড়াচড়ার আওয়াজ যত বাড়ছিল, দুশ্চিন্তাটা তাকে বেশি বেশি জ্বালাতন করছিল। জবা চুপচাপ ভাত চড়িয়ে বেগুন পোড়াবে বলে চুলায় খড়ি ঠেলে আগুন খোঁচাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে চম্পা মন ঠিক করে ফেলেছিল, সকাল হোক, আম্মার কাছে যাবে, জবাকে ওখানে রেখে নিজের কথা ভাববে। এদিকে পুরো মাসের বেতন ও ওভারটাইম মিলিয়ে সাড়ে আট হাজারের মতো টাকা বরবাদ; যন্ত্রণায় বুক মোচড়াচ্ছিল।
চার বছর একই গার্মেন্টে কাজ করছে চম্পা। ফ্যাক্টরিটা বড় না, তবে বছরজুড়ে কাজ চলে, মালিকও ভালো। অনেক ফ্যাক্টরিতে বেতন ঠিকঠাক দিলেও বোনাস বা ওভারটাইমের পুরো টাকা মাসে মাসে দেয় না। কিছু না কিছু রেখে দেয় পরে দেবে বলে। সেই টাকা একটু একটু করে বাড়তে থাকলে এর মায়ায় অনেকে অন্য কোথাও ভালো বেতনে কাজ পেলেও যেতে পারে না। মালিকরা ফন্দি করেই বদমায়েশিটা করে। মাত্র মাসখানেক হলো চম্পা প্লেন মেশিন ছেড়ে ওভারলক ধরেছে। সামনে বেতন বাড়বে এমন আশা ছিল। সুপারভাইজার মন্টু সিকদার নিজেই তাকে বলেছিল। মন্টু সিকদার লোক খারাপ না, চম্পার কাজকর্ম নিয়ে খামোখা হামকিদামকি করে না। চম্পা লোকটাকে মান্যগণ্য করে, সেই প্রথম থেকেই সে তাকে ছার ডাকে। অন্য মেয়েরা মন্টু ভাই, আড়ালে-আবডালে মন্টু মিয়া, থুতনিতে ছাগলদাড়ির জন্য আবার ছাগলা মিয়াও। ছার ডাকে যে সে খুশি হয় চম্পা জানে। আশা ছিল কিছু দিন গেলে বয়স বাড়িয়ে জবাকে হেলপারের কাজে নিতে লোকটার কাছে তদবির করবে। লাইন সুপারভাইজার হলেও ম্যানেজারের কাছে মন্টু সিকদারের সুপারিশের দাম আছে।
ঘরে ঢোকার আগে আম্মার রোগা চেহারা, সিঁড়ি ভাঙার কষ্ট দেখে চম্পা ভেবেছিল বড় কোনো অসুখ-বিসুখ করেছে কিনা, তবে ভিতরে এসে ফ্যানের নিচে বসে পুরো গ্লাস পানি খেয়ে কথাবার্তা শুরু করতে চম্পা ভরসা পেয়েছিল।
‘এতদিনে তোর মন চাইল আসতে? কত দিন বাদে আসলি!’
কথা শুনে চম্পা চমকাল। আম্মা কি বুঝতে পারেননি তার এ আসাটা অন্য সময়ের চেয়ে আলাদা? সঙ্গে তো একটা পোঁটলা রয়েছে, তাতে জবার কাপড়চোপড়, এটা তো পয়লাই নজরে পড়ার কথা।
চম্পা চুপ করে আছে দেখে বললেন, ‘ঘটনা কী? আমারে যে দেখতে আসস নাই তা তো বুঝছি। দাঁড়ায়া আছস কেন? আর জবারানি, মুখ শুকনা কেন, সকালে খাস নাই?’
কথা শেষ করেই তার নতুন কাজের বুয়াকে ডেকে বললেন ফ্রিজে কেক আছে, বের করতে। চম্পার দিকে ফিরে বললেন, ‘কী সমস্যা?’
চম্পা মেঝেতে তার পায়ের কাছে বসে ভাবল কী বলে? জবাকে রেখে যেতে এসেছে এ দিয়ে শুরু করে আসল ঘটনা বলবে? না কি আগাগোড়া সবই এক সাথে বলে, জবা যেমন আগের রাতে বলেছিল নানু তুমারে বুদ্ধি দিব, সেভাবে জানতে চাইবে সে কী করবে, না কি বলবে না কিছুই, কাঁদবে। অনেক দিন কাঁদেনি খেয়াল নেই যে এরই মধ্যে তার চোখ ভিজতে শুরু করেছে, ফোঁটায় ফোঁটায় ফেটে পড়তে বাকি। অবস্থা বেগতিক বুঝে চম্পা মাথা নিচু করে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরতে দিল। চোখ মুছে মুখ তুলতে যাবে, আম্মা ধমকে উঠলেন, ‘আমার আর কাজ নাই তোদের কান্না দেখা ছাড়া! তোর মা কানতে আসত, ও যা করত তুই তা-ই করবি! তুই আর তোর মা কী এক! এখন সর, খাওয়াদাওয়া কর। আমার কাজ আছে। কানতে আসছে!’
আম্মা উঠে যাওয়ার পরও চম্পা বসে থাকল। ঠিকই, তার মা যা করত, সে তা-ই করে যাচ্ছে। এ নতুন কিছু না। কিন্তু কিছু না শুনেই আম্মা এমন রেগে গেলেন! যেন রাগবেন বলে তৈরি হয়ে ছিলেন। মুখ ফুটে সে তো কিছু বলেনি। তবে কি তাকে ও জবাকে গেটের মুখে দেখেই আঁচ করতে পেরেছিলেন সে একটা অঘটন ঘটানোর অপেক্ষায়? কাঁদতে তো তার কাছে কতজনই আসে—সেই কোন কাল থেকে আসছে। আর কান্না শুনতে চান না, তাই রাগ?
সকালে না খেয়ে জবাকে নিয়ে বেরিয়েছিল। খিদা ছিল খুব, দুপুরে ভরপেট খেয়ে রান্নাঘর লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে বসতে মাথা ঝিমঝিম করছিল, ঘুমে চোখও ভার ভার। রাতে ঘুম হয়নি, সে চেষ্টাও করেনি। বারান্দায় বসে বসে বারবার হাই তুলে জবার কাপড়ের পোঁটলা মাথায় দিয়ে কখন ঘুমে ঢলে পড়েছিল খেয়াল নেই। জেগে উঠল যখন, বাইরে বিকালের রোদ মিইয়ে আসছে। এতটা সময় বেঘোরে ঘুমিয়েছে ভেবে চম্পা অবাক হলো। আম্মার নতুন কাজের বুয়া যাকে কুলসুমের মা বলে আম্মাকে ডাকতে শুনেছে, তাদের মা-মেয়েকে দেখে প্রথমে কী ভেবেছিল কে জানে, তবে বিকালে চম্পার ঘুম ভাঙতে চা সাধল। চম্পা চা খায় না শুনে বলল, সেও আগে খেত না, এখন দিনে দুই-তিন কাপ না হলে চলে না। মহিলা চম্পার বেশ খানিকটা বড় হবে, জানাল মেয়ের বিয়ে দিয়েছে, মেয়ে পোয়াতি–আল্লায় যেন নাতি দেয়। চম্পা বেফাঁস গার্মেন্টে কাজ করে বলে ফেলায় সে যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী নয় এ নিয়ে অনিশ্চয়তা দূর হতে বলল, তার এক সময় খুব ইচ্ছা ছিল গার্মেন্টে কাজ করবে, খাটনি যেমন বেশি, কামাইও বেশি, স্বাধীন জীবন; এখন তার জন্য বাসাবাড়ির কাজই সুবিধার। কুলসুমের মায়ের সাধাসাধি সত্ত্বেও চা না খেয়ে চম্পা উঠল, জবাকে খুঁজতে এঘরে ওঘরে উঁকি দিয়ে পেল না। পায়ে পায়ে এগিয়ে আম্মার শোবার ঘরের ভেজানো দরজায় হাত রাখতে যাবে, অল্প ফাঁক দরজার ওপারে নজরে পড়ল আম্মা খাটে শুয়ে, পাশেই জবা হাঁটু গেড়ে বসে তার কনুই টিপে দিচ্ছে। চম্পা ভিতরে ঢুকল। সাড়া পেয়ে আম্মা বললেন, ‘তুই নাকি কোন মান্তু না ফান্তুর ভয়ে ভাগার তাল করতেছিস?’
জবা তা হলে বলে ফেলেছে, ভালোই করেছে। চম্পা আর কী বলবে! সে জবাকে দেখিয়ে বলল, ‘আপনে এরে রাখেন। এরে আপনের ধারে রাখতে আসছি।’
আম্মা উঠে বসলেন। কথাটা শুনতে পাননি এমনভাবে ঘাড় ছাড়ানো মাত্র কয়েক গাছি চুল ধীরেসুস্থে রবারব্যান্ডে আটকালেন। ডান হাতের কনুইয়ে অন্য হাতের আঙুল চেপে কী যেন বোঝার চেষ্টা করলেন। এ সময় বালিশের পাশে মোবাইল বেজে উঠতে তুলে নিয়ে বিরক্ত গলায় কাকে যেন বললেন আজ যেতে পারবেন না, কাল সম্ভব হলে যাবেন। মোবাইল বালিশের পাশে রেখে জবাকে যেতে বলে এতক্ষণে যেন চম্পার কথা কানে নিলেন। বললেন, ‘ভাগবি যার ডরে সে কে? তোরে চিনে কী করে?’
সরাসরি প্রশ্নে চম্পার সুবিধা হলো। মান্তুর পরিচয় দিতে গিয়ে সে জানাল তার এক সময়ের ননদ, আপন ননদ না, আজগরের চাচাতো বোন। আজগরের বাড়ি ছেড়ে যখন সে বেরিয়ে এসেছিল, সে সময় শ্বশুরবাড়ির আশপাশের সব গ্রামে তার সম্বন্ধে কারো জানতে বাকি থাকেনি। মান্তু তো সেই পরিবারেরই। গতকাল মান্তুকে ফ্যাক্টরির গেটে দেখে সে আর কাজে যায়নি। মান্তু তাকে দেখেনি, দুই দিন গেলে ঠিকই দেখবে। তখন ফ্যাক্টরির সবাই তার ব্যাপারে জানবে, আর বস্তিতেও খবর আসতে সময় লাগবে না, বস্তির অনেকে একই ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সে জবার কথা ভেবে ঠিক করেছে বস্তি ছাড়বে, আর বস্তি ছাড়া মানে কাজও ছাড়া। জবা আম্মার কাছে থাকলে নিজের জন্য সে ভাববে না।
এক টানে কথাগুলো বলার সময় চম্পা একবারও মুখ তুলে তাকায়নি, যেন চোখাচোখি হলে আবার ধমক খাবে। ধমক খেল না, আম্মা ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘ওর সঙ্গে তোর ঝগড়াঝাঁটি ছিল?’
‘মান্তুর লগে? না না, আমারে খুব পছন্দ করত।’
‘তাইলে তোর সাথে দুশমনি করতে যাবে কেন?’
‘মান্তু সেই সময় আমারে পছন্দ করত, কিন্তু ঘটনা জানাজানির পর এত বছর বাদে আমারে নিয়া কী ভাবে কেমনে কই! আমারে দেখলেই তো হের মনে পড়ব আমি আসলে কে।’
‘তোর এত কিছু চিন্তা করার কী দরকার?’
‘আমার জইন্য করি না, চিন্তা জবারে নিয়া। ও তো আমার মতো না, ওর বাপ আছিল, বাপের পরিচয় নিয়া ওর সমুস্যা নাই। আমার কারণে ওর জীবন নষ্ট হউক চাই না।’
‘জীবন নষ্ট হওয়া মুখের কথা না। গার্মেন্টে কাম করতে করতে তোর দেখি জবান খুলছে। কিন্তু এসব কোনো কাজের কথা না, ভেগে ভেগে আর কত! তুই এক পা-ও নড়বি না, যেমন ছিলি তেমন থাকবি। কাল থেকে কাজে যাবি, আর নিজে গিয়ে তোর ওই মান্ত্রর খোঁজ করবি। তুই পালাবি কেন, তোর কী দোষ! আর জবা, ঠিক আছে, থাকুক আমার কাছে।’
জবা এখানে থাকবে এ কথায় মাথা ঠান্ডা হয়ে গেল চম্পার, তবে তার পক্ষে কাজে যাওয়া অসম্ভব। আম্মা তো যুক্তির মানুষ, কিন্তু ওনার যুক্তির কী দাম মানুষের কাছে! তার মাকেও তো বলেছিলেন কোথাও না যেতে, এও বলেছিলেন সাহস নিয়ে মানুষের মুখোমুখি হতে, দরকার পড়লে বদলোকের সঙ্গে টক্কর দিতে টক্করের আম্মা কী বোঝেন!
‘কথা বল, কাল থেকে কাজে যাবি, আর কে কী বলল একদম কানে তুলবি না।’
চম্পা কী বলবে! সে তো মন ঠিক করেই ফেলেছে, চিন্তা যা ছিল জবাকে নিয়ে, সেটা আম্মার এক কথায় মিটে যেতে সে এখন অনেক হালকা, কিন্তু আম্মাকে তো কিছু বলতে হবে।
‘আমার কথা কানে ঢুকছে না তোর? খুব তো জীবন নষ্টের কথা বললি, জীবন যে খেলার জিনিস না এটাও বোঝা দরকার। যুদ্ধ করেই জীবনে টিকে থাকা লাগে—কারো বেশি কারো কম।’
‘আম্মা, আমারে মাফ করেন।’
‘মানে?’
‘আমি কামে যামু না। আমারে যারা চিনে সক্কলেই ভালা জানে। কামের জায়গায়, বস্তিতে আমার নামে কেউ কুনুদিন আকথা-কুকথা কয় নাই। এখন তো কওয়ার মানুষের অভাব অইব না। আমারে পথে-ঘাটে মাইনষ্যে টিটকারি দিব, বেজন্মা-জাউরা কইব।’
যেভাবে কথাগুলো বলতে চেয়েছিল সেভাবে বলতে পারায়ই সম্ভবত আম্মা কথার চোট সইতে কিছু সময় চুপ করে থাকলেন। চম্পা মুখ তুলে না দেখলেও বুঝতে পারল আম্মার চোখ জোড়া তার মুখে।
‘তুই আগেভাগে নিজে নিজে সব ফয়সালা করে ফেললে তো হবে না। এমনও তো হতে পারে ওই মেয়েটা কাউকে কিছু বলবে না, আর যদি বলেও, তুই কেন ভাববি সবাই ওর কথায় তাল দেবে! তুই-ই তো বললি সবাই তোকে ভালো জানে, ভালো বলেই তোর সম্বন্ধে মানুষের ভালো ধারণা। এখন যদি সত্যিই তোকে নিয়ে কথা ওঠে, তুই পাত্তা দিবি না। কেন দিবি? তুই কারো ক্ষতি করছিস, না তোর কারণে মানুষ ভাববে তাদের ক্ষতি হবে?’
চম্পা মুখ তুলল না, যেমন বসেছিল তেমনি বসে বসে ভাবল যত মায়াই থাকুক কথায়, শুনলে চলবে না। জবার যখন ঠাঁই মিলে গেছে, তার আর চিন্তা কী! জবাকে আম্মা আগলে রাখবেন, সে মাঝে মাঝে এসে দেখে যাবে, বা না এসেই খোঁজ নেবে, মালিবাগ তো কলকারচর না যে যোগাযোগ রাখতে পারবে না। কিন্তু আম্মার কথার মায়া যে কান ছেড়ে নড়ছে না। আম্মার জন্য তার কষ্ট হতে লাগল, চম্পাকে সাহস দিয়ে কথা বলা ছাড়া আম্মা আর কী করতে পারেন! আম্মার পক্ষে কি চিন্তা করা সম্ভব জাউরা কথাটা কানে বাজলে কেমন লাগবে। শুধু তো কানে বাজবে না, হজমও করতে হবে। সত্যি যখন, হজম না করে কী উপায়!
তখনকার মতো কথাবার্তা আর এগোয়নি। আম্মার কথায় চুপ করে থাকলেও চম্পা যে তার কথা মেনে নেয়নি আর তিনি যে তা ঠিকই বুঝেছেন তার প্রমাণ মিলল রাতে। খাওয়ার পর, জবা মেঝেতে পা ছড়িয়ে টিভি দেখায় মশগুল, আম্মা চম্পাকে সরিয়ে নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কী ঠিক করলি? আমার কথা তো তোর পছন্দ হয় নাই।’
চম্পা বুঝল এবার কথা আদায় করে ছাড়বেন। সে কি মিথ্যা বলবে? কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, ‘আপনে তো সবই বুজেন। আমি নাচার।
‘নাচার-ফাচার বুঝি না। এত বড় দুনিয়ায় মানুষ নাচার হবে কেন? আর তোকে কে বলল আমি সব বুঝি? সব বোঝারই-বা কী দরকার! আপদ-বিপদ নিয়েই মানুষ বাঁচে, পালানো মানুষের কাজ না, পালায়া যাবি কই? কাল সকালে কাজে যাবি।’
কথা শেষ করেই আম্মা ঘাড় ঘুরিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলেন। ভঙ্গিটা বলে দিল এটাই শেষ কথা। চম্পা কাঠ-কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ভাবল আম্মা তার বিপদ বুঝতে পারছেন না বলেই নিজের সিদ্ধান্ত তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছেন। তাই বলে সে কি তা মেনে নেবে, না মেনে নেওয়ার তার উপায় আছে? পরপরই সে অন্য কথা ভাবল, জবাকে তার কাছে ঠাঁই দেবেন বলেই কি আম্মা তার ওপর জবরদস্তি করছেন?
রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক ভেবে ভেবেও যখন ঠিক করতে পারল না কী করবে, সে ভাবল আম্মার কথা রাখতে যদি সকালে ফ্যাক্টরিতে যায়, পাওনা টাকার টানেই যাবে। টাকাগুলো যদি উদ্ধার করা যায়।
যাত্রা
একদিন মানুষ ছিল বুনো, ঘোড়াও ছিল বনের জন্তু। মানুষ ছটিতে পারিত না, ঘোড়া বাতাসের মতো ছুটিত। কী সুন্দর তাহার ভঙ্গী, কী অবাধ তাহার স্বাধীনতা। মানুষ চাহিয়া দেখিত, আর তাহার ঈর্ষা হইত। সে ভাবিত, “ঐরকম বিদ্যুৎগামী চারটে পা যদি আমার থাকিত তাহা হইলে দূরকে দূর মানিতাম না, দেখিতে দেখিতে দিগ্দিগন্তর জয় করিয়া আসিতাম।’ ঘোড়ার সর্বাঙ্গে যে-একটি ছুটিবার আনন্দ দ্রুত তালে নৃত্য করিত সেইটের প্রতি মানুষের মনে মনে ভারি একটা লোভ হইল।
কিন্তু, মানুষ শুধু-শুধু লোভ করিয়া বসিয়া থাকিবার পাত্র নহে। “কী করিলে ঘোড়ার চারটে পা আমি পাইতে পারি’ গাছের তালায় বসিয়া এই কথাই সে ভাবিতে লাগিল। এমন অদ্ভুত ভাবনাও মানুষ ছাড়া আর-কেহ ভাবে না। “আমি দুই-পা-ওয়ালা খাড়া জীব, আমার চার পায়ের সংস্থান কি কোনোমতেই হইতে পারে। অতএব, চিরদিন আমি এক-এক পা ফেলিয়া ধীরে ধীরে চলিব আর ঘোড়া তড়বড় করিয়া ছুটিয়া চলিবে, এ বিধানের অন্যথা হইতেই পারে না।’ কিন্তু মানুষের আশান্ত মন এ কথা কোনোমতেই মানিল না।
একদিন সে ফাঁস লাগাইয়া বনের ঘোড়াকে ধরিল। কেশর ধরিয়া তাহার পিঠের উপর চড়িয়া বসিয়া নিজের দেহের সঙ্গে ঘোড়ার চার পা জুড়িয়া লইল। এই চারটে পাকে সম্পূর্ণ নিজের বশ করিতে তাহার বহুদিন লাগিয়াছে, সে অনেক পড়িয়াছে, অনেক মরিয়াছে, কিন্তু কিছুতেই দমে নাই। ঘোড়ার গতিবেগকে সে ডাকাতি করিয়া লইবেই, এই তাহার পণ। তাহারই জিত হইল। মন্দাগামী মানুষ দ্রুতগমনকে বাঁধিয়া ফেলিয়া আপনার কাজে খাটাইতে লাগিল।
ডাঙায় চলিতে চলিতে মানুষ এক জায়গায় আসিয়া দেখিল, সম্মুখে তাহার সমুদ্র, আর তো এগোইবার জো নাই। নীল জল, তাহার তল কোথায়, তাহার কূল দেখা যায় না। আর, লক্ষ লক্ষ ঢেউ তর্জনী তুলিয়া ডাঙার মানুষদের শাসাইতেছে; বলিতেছে,”এক পা যদি এগোও তবে দেখাইয়া দিব, এখানে তোমার জারিজুরি খটিবে না।’ মানুষ তীরে বসিয়া এই অকূল নিষেধের দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু, নিষেধের ভিতর দিয়া একটা মস্ত আহ্বানও আসিতেছে। তরঙ্গগুলা অট্টহাস্যে নৃত্য করিতেছে–ডাঙার মাটির মতো কিছুতেই তাহাদিগকে বাঁধিয়া রাখিতে পারে নাই। দেখিলে মনে হয়, লক্ষ লক্ষ ইস্কুলের ছেলে যেন ছুটি পাইয়াছে–চীৎকার করিয়া, মাতামাতি করিয়া কিছুতেই তাহাদের আশ মিটিতেছে না; পৃথিবীটাকে তাহারা যেন ফুট্বলের গোলার মতো লাথি ছুঁড়িয়া ছুঁড়িয়া আকাশে উড়াইয়া দিতে চায়। ইহা দেখিয়া মানুষের মন তীরে বসিয়া শান্ত হইয়া পড়িয়া থাকিতে পারে না। সমুদ্রের এই মাতুনি মানুষের রক্তের মধ্যে করতাল বাজাইতে থাকে। বাধাহীন জলরাশির এই দিগন্তবিস্তৃত মুক্তিকে মানুষ আপন করিতে চায়। সমুদ্রের এই দুরত্বজয়ী আনন্দের প্রতি মানুষ লোভ দিতে লাগিল। ঢেউগুলার মতো করিয়াই দিগন্তকে লুঠ করিয়া লইবার জন্য মানুষের কামনা।
কিন্তু, এমন অদ্ভুত সাধ মিটিবে কী করিয়া; এই তীরের রেখাটা পর্যন্ত মানুষের অধিকারের সীমা–তাহার সমস্ত ইচ্ছাটাকে এই দাঁড়ির কাছে আসিয়া শেষ করিতে হইবে। কিন্তু, মানুষের ইচ্ছাকে যেখানে শেষ করিতে চাওয়া যায় সেইখানেই সে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে। কোনোমতেই সে বাধাকে চরম বলিয়া মানিতে চাহিল না।
অবশেষে একদিন বুনো ঘোড়াটার মতোই সমুদ্রের ফেনকেশর ধরিয়া মানুষ তাহার পিঠের উপর চড়িয়া বসিল। ক্রুদ্ধ সাগর পিঠ নাড়া দিল; মানুষ কত ডুবিল, কত মরিল তাহার সীমা নাই। অবশেষে একদিন মানুষ এই অবাধ্য সাগরকেও আপনার সঙ্গে জুড়িয়া লইল। তাহার এক কূল হইতে আর-এক কূল পর্যন্ত মানুষের পায়ের কাছে বসিয়া মাথা হেঁট করিয়া দিল।
বিশাল সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত মানুষটা যে কীরকম, আজ আমরা জাহাজে চড়িয়া তাহাই অনুভব করিতেছি। আমরা তো এই একটুখানি জীব, তরণীর একপ্রান্তে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া আছি, কিন্তু দূর দূর বহুদূর পর্যন্ত সমস্ত আমার সঙ্গে মিলিয়াছে। যে দূরকে আজ রেখামাত্রাও দেখিতে পাইতেছি না তাহাকেও আমি এইখানে স্থির দাঁড়াইয়া অধিকার করিয়া লইয়াছি। যাহা বাধা তাহাই আমাকে পিঠে করিয়া লইয়া অগ্রসর করিয়া দিতেছে। সমস্ত সমুদ্র আমার , যেন আমারই বিরাট শরীর, যেন তাহা আমার প্রসারিত ডানা। যাহা-কিছু আমাদের বাধা তাহাকেই আমাদের চলিবার পথ, আমাদের মুক্তির উপায় করিয়া লইতে হইবে, আমাদের প্রতি ঈশ্বরের এই আদেশ আছে। যাহারা এই অদেশ মানিয়াছে তাহারাই পৃথিবীতে ছাড়া পাইয়াছে। যাহারা মানে নাই এই পৃথিবীটা তাহাদের পক্ষে কারাগার। নিজের গ্রামটুকু তাহাদিগকে বেরিয়াছে, ঘরের কোণটুকু তাহাদিগকে বাঁধিয়াছে, প্রত্যেক পা ফেলিতেই তাহাদের শিকল ঝম্ঝম্ করে।
মনের আনন্দে চলিতেছি। ভয় ছিল, সমুদ্রের দোলা আমার শরীরে সহিবে না। সে ভয় কাটিয়া গিয়াছে। যেটুকু নাড়া খাইতেছি তাহাতে আঘাত করিতেছে না, যেন আদর করিতেছে। সমুদ্র আমাকে কোলে করিয়া বহিয়া চলিয়াছে–রুগ্ন বালককে তাহার পিতা যেমন করিয়া লইয়া যায় তেমনি সাবধানে। এইজন্য এ যাত্রায় এখন পর্যন্ত আমার চলিবার কোনো পীড়া নাই, চলিবার আনন্দই ভোগ করিতেছি।
কেবলমাত্র এই চলিবার আনন্দটুকুই পাইব বলিয়া অমি বাহির হইয়াছি। অনেকদিন হইতে এই চলিবার, এই বাহির হইয়া পড়িবার,একটা বেগ আমাকে উতলা করিয়া তুলিতেছিল। অনেকদিন আমাদের আশ্রমের বাড়িতে দোতলার বারান্দায় একলা বসিয়া যখন আমাদের সামনের শালগাছগুলার উপরের আকাশের দিকে তাকাইয়াছি, তখন সেই আকাশ দূরের দিকে তাহার তর্জনী বাড়াইয়া দিয়া আমাকে সংকেত করিয়াছে। যদিও সেই আকাশটি নীরব তবু দেশদেশান্তরের যত অপরিচিত গিরিনদী-অরণ্যের আহ্বান কত দিগ্দিগন্তর হইতে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়া এই আাকাশের নীলিমাকে পরিপূর্ণ করিয়াছে। নিঃশব্দ আকাশ বহুদূরের সেই-সমস্ত মর্মরধ্বনি, সেই-সমস্ত কলগুঞ্জন, আমার কাছে বহন করিয়া আনিত। আমাকে কেবলই বলিত, “চলো, চলো, বাহির হইয়া এসো।’ সে কোনো প্রয়োজনের চলা নহে, চলার আনন্দেই চলা।
প্রাণ আপনি চায় চলিতে; সেই তাহার ধর্ম। না চলিলে সে যে মৃত্যুতে গিয়া ঠেকে। এইজন্য নানা প্রয়োজনে ও খেলার ছুতায় সে কেবল চলে। পদ্মার চরে শরতের সময়ে তো হাঁসের দল দেখিয়াছ। তাহারা কোন্ দুর্গম হিমালয়ের শিখরবেষ্টিত নির্জন সরোবরতীরের নীড় ছাড়িয়া কত দিনরাত্রি ধরিয়া উড়িতে উড়িতে এই পদ্মার বালুতটের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। শীতের দিনে বাষ্পে বরফে ভীষণ হইয়া উঠিয়া হিমালয় তাহাদিগকে তাড়া লাগাইয়া দেয়–তাহারা বাসা বদল করিতে চলে। সুতরাং সেই সময়ে হাঁসেদের পক্ষে দক্ষিণপথে যাত্রার একটা প্রয়োজন আছে বটে। কিন্তু, তবু সেই প্রয়োজনের অধিক আর-একটা জিনিস আছে। সেই-যে বহু দূরের গিরিনদী পার হইয়া উড়িয়া যাওয়া, ইহাতে এই পাখিদের ভিতরকার প্রাণের বেগ আনন্দলাভ করে। ক্ষণে ক্ষণে বাসা- বদল করিবার ডাক পড়ে, তখনি সমস্ত জীবনাট নাড়া খাইয়া আপনাকে আপনি অনুভব করিবার সুযোগ পায়।
আমার ভিতরেও বাসা- বদল করিবার ডাক পড়িয়াছিল। যে বেষ্টনের মধ্যে বসিয়া আছি সেখান হইতে আর-একটা কোথাও যাইতে হইবে। চলো,চলো, চলো। ঝরনার মতো চলো, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো চলো, প্রভাতের পাখির মতো চলো, অরুণোদয়ের আলোর মতো চলো। সেইজন্যই তো পৃথিবী এমন বৃহৎ, জগৎ এমন বিচিত্র, আকাশ এমন অসীম। সেইজন্যই তো বিশ্ব জুড়িয়া অণু পরমাণু নৃত্য করিতেছে এবং অগণ্য নক্ষত্রলোক আপন-আপন আলোকের শিবির লইয়া প্রান্তরচারী বেদুয়িনদের মতো আকাশর ভিতর দিয়া যে কোথায় চলিয়াছে তাহার ঠিকানা নাই। চিরকালের মতো কোনো একই জায়গায় বাসা বাঁধিয়া বসিব, বিশ্বের এমন ধর্মই নহে। সেইজন্যই মৃত্যুর ডাক আর-কিছুই নহে, সেই বাসাবদলের ডাক। জীবনকে কোনোমতেই সে কোনো সনাতন প্রাচীরের মধ্যে বদ্ধ হইয়া থাকিতে দিবে না–জীবনকে সেই জীবনের পথে অগ্রসর করিবে বলিয়াই মৃত্যু।
তাই আমি আজ চলিয়াছি; রূপকথার রাজপুত্র যেমন হঠাৎ একদিন অকারণে সাতসমুদ্র পার হইবার জন্য বাহির হইয়া পড়িত, তেমনি করিয়া আমি আজ বাহিরে চলিয়াছি। রাজকন্যা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, সে ঘুম ভাঙে না; সোনার কাঠি চাই। একই জায়গায় একই প্রথার মধ্যে বসিয়া বসিয়া জীবনের মধ্যে জড়তা আসে; সে অচেতন হইয়া পড়ে; সে কেবল আপনার শয্যাটুকুকেই আঁকড়িয়া থাকে; এই বৃহৎ পৃথিবীকে বোধ করিতেই পারে না; তখন সোনার কাঠি খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে; তখনি দূরে পাড়ি দেওয়া চাই; তখন এমন একটা চেতনার দরকার যাহা আমাদের চোখের কানের মনের রুদ্ধ দ্বারে কেবলই নূতন নূতন নূতনের আঘাত দিতে থাকিবে–যাহা আমাদের জীর্ণ পর্দাটাকে টুক্রা টুক্রা করিয়া চিরনূতনকে উদ্ঘাটিত করিয়া দিবে। কী বৃহৎ, কী সুন্দর, কী উন্মুক্ত এই জগৎ! কী প্রাণ, কী আলোক, কী আনন্দ! মানুষ এই পৃথিবীকে ঘিরিয়া ফেলিয়া কতরকম করিয়া দেখিতেছে, ভাবিতেছে, গড়িতেছে! তাহার প্রাণের, তাহার মনের, তাহার কল্পনার লীলাক্ষেত্রে কোনোখানে ফুরাইয়া গেল না। পৃথিবীকে বেষ্টন করিয়া মানুষের এই-যে মনোলোক ইহার কী অফুরান ও অদ্ভুত বৈচিত্র্য। সেই-সমস্তকে লইয়াই যে আমার এই পৃথিবী। এইজন্যই এই-সমস্তটিকে একবার প্রদক্ষিণ করিয়া প্রত্যক্ষ দেখিবার জন্য মনের মধ্যে আহ্বান আসে।
এই বিপুল বৈচিত্র্যকে তন্ন তন্ন করিয়া নিঃশেষে দেখিবার সাধ্য ও অবকাশ কাহারও নাই। বিশ্বকে দর্শন করিব বলিয়া তাহার সম্মুখে বাহির হইতে পারিলেই দর্শনের ফল পাওয়া যায়। যদিও এক হিসাবে বিশ্ব সর্বত্রই আছে তবু আলস্য ছাড়িয়া, অভ্যাস কাটাইয়া, চোখ মেলিয়া, যাত্রা করিলে তবেই আমাদের দৃষ্টিশক্তির জড়িমা কাটিয়া যায় এবং আমাদের প্রাণ উদ্বোধিত হইয়া বিশ্বপ্রাণের স্পর্শ উপলব্ধি করে। যে নিশ্চল, যে নিরুদ্যম, সে লোক সেই জিনিসকেই হারাইয়া বসে যাহা একেবারেই হাতের কাছে আছে। তাই নিকটের ধনকে দুঃখ করিয়া দূরে খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিলেই, তাহাকেই অত্যন্ত নিবিড় করিয়া পাওয়া যায়। আমাদের সমস্ত ভ্রমণেরই ভিতরকার আসল উদ্দেশ্যটি এই–যাহা আছেই, যাহা হারাইতে পারেই না, তাহাকেই কেবলই প্রতি পদে “আছে আছে আছে’ বলিতে বলিতে চলা–পুরাতনকে কেবলই নূতন নূতন নূতন করিয়া সমস্ত মন দিয়া ছুঁইয়া ছুঁইয়া যাওয়া।
লোহিত সমুদ্র ২১ জৈষ্ঠ্য, ১৩১৯