জলস্থল

আমরা ডাঙার মানুষ কিন্তু আমাদের চারি দিকে সমুদ্র। জল এবং স্থল এই দুই বিরোধী শক্তির মাঝখানে মানুষ। কিন্তু, মানুষের প্রাণের মধ্যে এ কী সাহস। যে জলের কূল দেখিতে পাই না মানুষ তাহাকেও বাধা বলিয়া মানিল না, তাহার মধ্যে ভাসিয়া পড়িল।

যে জল মানুষের বন্ধু সেই জল ডাঙার মাঝখান দিয়াই বহে। সেই নদীগুলি ডাঙার ভগিনীদের মতো। তাহারা কত দূরের পাথর-বাঁধা ঘাট হইতে কাঁখে করিয়া জল লইয়া আসে; তাহারাই আমাদের তৃষ্ণা দূর করে, আমাদের অন্নের আয়োজন করিয়া দেয়। কিন্তু, আমাদের সঙ্গে সমুদ্রের এ কী বিষম বিরোধ। তাহার অগাধ জলরাশি সাহারার মরুভূমি মতোই পিপাসায় পরিপূর্ণ। আশ্চর্য, তবু সে মানুষকে নিরস্ত করিতে পারিল না। সে যমরাজের নীল মহিষটার মতো কেবলই শিঙ তুলিয়া মাথা ঝাঁকাইতেছে, কিন্তু কছুতেই মানুষকে পিছু হঠাইতে পারিল না।

পৃথিবীর এই দুইটা ভাগ–একটা আশ্রয়, একটা অনাশ্রয়, একটা স্থির, একটা চঞ্চল; একটা শান্ত একটা ভীষণ। পৃথিবীর যে- সন্তান সাহস করিয়া এই উভয়কেই গ্রহণ করিতে পারিয়াছে সেই তো পৃথিবীর পূর্ণ- সম্পদ লাভ করিয়াছে। বিঘ্নের কাছে যে মাথা হেঁট করিয়াছে, ভয়ের কাছে যে পাশ কাটাইয়া চলিয়াছে, লক্ষ্মীকে সে পাইল না। এইজন্য আমাদের পুরাণকথায় আছে, চঞ্চলা লক্ষ্মী চঞ্চল সমুদ্র হইতে উঠিয়াছেন, তিনি আমাদের স্থির মাটিতে জন্মগ্রহণ করেন নাই।

বীরকে তিনি আশ্রয় করিবেন, লক্ষ্মীর এই পণ। এইজন্যই মানুষের সামনে তিনি প্রকাণ্ড এই ভয়ের তরঙ্গ বিস্তার করিয়াছেন । পার হইতে পারিলে তবে তিনি ধরা দিবেন। যাহারা কূলে বসিয়া কলশব্দে ঘুমাইয়া পড়িল, হাল ধরিল না, পাল মেলিল না, পাড়ি দিল না, তাহারা পৃথিবীর ঐশ্বর্য হইতে বঞ্চিত হইল।

আমাদের জাহাজ যখন নীলসমুদ্রের ক্রুদ্ধ হৃদয়কে ফেনিল করিয়া, সগর্বে পশ্চিমদিগন্তের কূলহীনতার অভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিল, তখন এই কথাটাই আমি ভাবিতে লাগিলাম। স্পষ্টই দেখিতে পাইলাম, য়ুরোপীয় জাতিরা সমুদ্রকে যেদিন বরণ করিল সেইদিনই লক্ষ্মীকে বরণ করিয়াছে। আর, যাহারা মাটি কামড়াইয়া পড়িল তাহারা আর অগ্রসর হইল না, এক জায়গায় আসিয়া থামিয়া গেল।

মাটি যে বাঁধিয়া রাখে। সে অতি স্নেহশীল মাতার মতো সন্তানকে কোনোমতে দূরে যাইতে দেয় না। শাক-ভাত তরি-তরকারি দিয়া পেট ভরিয়া খাওয়ায়, তাহার পরে ঘনছায়াতলে শ্যামল অঞ্চলের উপর ঘুম পাড়াইয়া দেয়। ছেলে যদি একটু ঘরের বাহির হইতে চায় তবে তাহাকে অবেলা অযাত্রা প্রভৃতি জুজুর ভয় দেখাইয়া শান্ত করিয়া রাখে।

কিন্তু, মানুষের যে দূরে যাওয়া চাই। মানুষের মন এত বড়ো যে, কেবল কাছটুকুর মধ্যে তাহার চলাফেরা বাধা পায়। জোর করিয়া সেইটুকুর মধ্যে ধরিয়া রাখিতে গেলেই, তাহার অনেকখানি বাদ পড়ে। মানুষের মধ্যে যাহারা দূরে যাইতে পাইয়াছে তাহারাই আপনাকে পূর্ণ করিতে পারিয়াছে। সমুদ্রই মানুষের সম্মুখবর্তী সেই অতিদূরের পথ; দুর্লভের দিকে, দুঃসাধ্যের দিকে সেই তো কেবলই হাত তুলিয়া তুলিয়া ডাক দিতেছে। সেই ডাক শুনিয়া যাহাদের মন উতলা হইল, যাহারা বাহির হইয়া পড়িল, তাহারাই পৃথিবীতে জিতিল। ঐ নীলাম্বুরাশির মধ্যে কৃষ্ণের বাঁশি বাজিতেছে, কূল ছাড়িয়া বাহির হইবার জন্য ডাক।

পৃথিবীর একটা দিকে সমাপ্তির চেহারা, আর-একটা দিকে অসমাপ্তির। ডাঙা তৈরি হইয়া গিয়াছে; এখানো তাহার মধ্যে যেটুকু ডাঙাগড়া চলিতেছে তাহার গতি মৃদুমন্দ, চোখে পড়েই না। সেটুকু ভাঙাগড়ারও প্রধান কারিগর জল। আর, সমুদ্রের গর্ভে এখনো সৃষ্টির কাজ শেষ হয় নাই। সমুদ্রের মজুরি করে যে-সকল নদনদী তাহারা দূরদূরান্তর হইতে ঝুড়ি ঝুড়ি কাদা বালি মাথায় করিয়া আনিতেছে। আর কত লক্ষ লক্ষ শামুক ঝিনুক প্রবালকীট এই রাজমিস্ত্রির সৃষ্টির উপকরণ অহোরাত্র জোগাইয়া দিতেছে। ডাঙার দিকে দাঁড়ি পড়িয়াছে, অন্তত সেমিকোলন; কিন্তু সমুদ্রের দিকে সমাপ্তির চিহ্ন নাই। দিগন্তব্যাপী অনিশ্চয়তার চিরচঞ্চল রহস্যান্ধকারের মধ্যে কী যে ঘটিতেছে, তাহার ঠিকানা কে জানে। অশান্ত এবং অশ্রান্ত এই সমুদ্র; অনন্ত তাহার উদ্যম।

পৃথিবীর মধ্যে যে জাতি এই সমুদ্রকে বিশেষভাবে বরণ করিয়াছে তাহারা সমুদ্রের এই কূলহীন প্রয়াসকে আপন চরিত্রের মধ্যে পাইয়াছে। তাহারাই এমন কথা বলিয়া থাকে, কোনো-একটা চরম পরিণাম মানবজীবনের লক্ষ্য নহে; কেবল অবিশ্রাম-ধাবমান গতির মধ্যেই আপনাকে প্রসারিত করিয়া চলাই জীবনের উদ্দেশ্য। তাহারা অনিশ্চিতের মধ্যে নির্ভয়ে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া কেবলই নব নব সম্পদকে আহরণ করিয়া আনিতেছে। তাহারা কোনো-একটা কোণে বাসা বাঁধিয়া থাকিতে পারিল না। দূর তাহাদিগকে ডাকে; দুর্লভ তাহাদিগকে আকর্ষণ করিতে থাকে। অসন্তোষের ঢেউ দিবারাত্রি হাজার হাজার হাতুড়ি পিটাইয়া তাহাদের চিত্তের মধ্যে কেবলই ভাঙাগড়ায় প্রবৃত্ত আছে। রাত্রি আসিয়া যখন সমস্ত জগতের চোখে পলক টানিয়া দেয় তখনো তাহাদের কারখানাঘরের দীপচক্ষু নিমেষ ফেলিতে জানে না। ইহারা সমাপ্তিকে স্বীকার করিবে না, বিশ্রামের সঙ্গেই ইহাদের হাতাহাতি লড়াই।

আর, ডাঙায় যাহারা বাসা বাঁধিয়াছে তাহারা কেবলই বলে, “আর নহে, আর দরকার নাই।’ তাহারা যে কেবল ক্ষুধার খাদ্যটাকে সংকীর্ণ করিতে চাহে তাহা নহে, তাহারা ক্ষুধাটাকে সুদ্ধ মারিয়া নিকাশ করিয়া দিতে চায়। তাহারা যেটুকু পাইয়াছে তাহাকেই কোনোমতে স্থায়ী করিবার উদ্দেশে কেবলই চারিদিকে সুনিশ্চিতের সনাতন বেড়া বাঁধিয়া তুলিতেছে। তাহারা মাথার দিব্য দিয়া বলিতেছে, “আর যাই কর, কোনোমতে সমুদ্র পার হইতে চেষ্টা করিয়ো না। কেননা সমুদ্রের হাওয়া যদি লাগে, অনিশ্চিতের স্বাদ যদি পাও, তবে মানুষের মনের মধ্যে অসন্তোষের যে একটা নেশা আছে তাহাকে আর কে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে।’ সেই অপরিচিত নূতনের রাগিণী লইয়া কালো সমুদ্রের বাঁশির ডাক কোনো-একটা উতলা হাওয়ায় যাহাতে ঘরের মধ্যে আসিয়া পৌঁছিতে না পারে, সেইজন্য কৃত্রিম প্রাচীরগুলাকে যত সমুচ্চ করা সম্ভব সেই চেষ্টাই কেবল চলিতেছে।

কিন্তু, এই সমুদ্র ও ডাঙার সাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ স্বীকার করিয়া, তাহার বিরোধ ঘুচাইবার দিন আসিয়াছে বলিয়া মনে করি। এই দুয়ে মিলিয়াই মানুষের পৃথিবী। এই দুয়ের মধ্যে বিচ্ছেদকে জাগাইয়া রাখিলেই, মানুষের যত-কিছু বিপদ। তবে এতদিন এই বিচ্ছেদ চলিয়া আসিতেছে কেন। সে কেবল ইহারা হরগৌরীর মতো তপস্যার দ্বারা পরস্পরকে পাইবে বলিয়াই। ঐ-যে এক দিকে স্থানু দিগম্বরবেশে সমাধিস্থ হইয়া বসিয়া আছেন, আর-এক দিকে গৌরী নব নব বসন্তপুষ্পে আপনাকে সাজাইয়া তুলিতেছেন–স্বর্গের দেবতার ইঁহাদেরই শুভযোগের অপেক্ষা করিয়া আছেন, নহিলে কোনো মঙ্গল-পরিণাম জন্মলাভ করিবে না।

আমরা ডাঙার লোকেরা ভগবানের সমাপ্তির দিককেই সত্য বলিয়া আশ্রয় করিয়াছি তাহাতে ক্ষতি হইত না; কিন্তু আমরা তাঁহার ব্যাপ্তির দিকটাকে একেবারেই মিথ্যা বলিয়া, মায়া বলিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিয়াছি। সত্যকে এক অংশে মিথ্যা বলিলেই তাহাকে অপরাংশেও মিথ্যা করিয়া তোলা হয়। আমরা স্থিতিকে আনন্দকে মানিলাম, কিন্তু শক্তিকে দুঃখকে মানিলাম না। তাই আমরা রানীকে আপমান করাতে রাজার স্তব করিয়াও রক্ষা পাইলাম না; সত্য আমাদিগকে শত শত বৎসর ধরিয়া নানা আঘাতেই মারিতেছেন।

সমুদ্রের লোকেরা ভগবানের ব্যাপ্তির দিকটাকেই একেবারে একান্ত সত্য করিয়া ধরিয়া বসিয়া আছে। তাহারা সমাপ্তিকে কোনোমতেই মানিবে না, এই তাহাদের পণ। এইজন্য বাহিরের দিকে তাহারা যেমন কেবলই আহরণ করিতেছে অথচ সন্তোষ নাই বলিয়া কিছুকেই লাভ করিতেছে না, তেমনি তত্ত্বজ্ঞানের দিকেও তাহারা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে যে, সত্যের মধ্যে গম্যস্থান বলিয়া কোনো পদার্থই নাই, আছে কেবল গমন। কেবলই হইয়া উঠা, কিন্তু কী যে হইয়া উঠা তাহার কোনো ঠিকানা কোনোখানেই নাই। ইহা এমন একটি সমুদ্রের মতো যাহার কূলও নাই, তলও নাই, আছে কেবল ঢেউ–যাহা পিপাসাও মেটায় না, ফসলও ফলায় না, কেবলই দোলা দেয়।

আমরা দেখিলাম আনন্দকে, আর দুঃখকে বলিলাম মিথ্য মায়া; উহারা দেখিল দুঃখকে, আর আনন্দকে বলিল মিথ্যা মায়া। কিন্তু,পরিপূর্ণ সত্যের মধ্যে তো কোনোটাই বাদ পড়িতে পারে না; পূর্ব পশ্চিম সেখানে না মিলিলে পূর্বও মিথ্যা হয়, পশ্চিমও মিথ্যা হয়। আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে–অর্থাৎ আনন্দ হইতেই এই সমস্ত-কিছু জন্মিতেছে–এ কথা যেমন সত্য, “স তপোহতপ্যত’ অর্থাৎ তপস্যা হইতে, দুঃখ হইতেই সমস্ত-কিছু সৃষ্ট হইতেছে, এ কথা তেমনি সত্য। গায়কের চিত্তে দেশকালের অতীত গানের পূর্ণ আনন্দও যেমন সত্য আবার দেশকালের ভিতর দিয়া গানা গাহিয়া প্রকাশ করিবার বেদনাও তেমনি সত্য। এই আনন্দ এবং দুঃখ, এই সমাপ্তি ও ব্যাপ্তি, এই চিরপুরাতন এবং চিরনূতন, এই ধনধান্যপূর্ণ ভূমি ও দুঃখাশ্রুচঞ্চল সমুদ্র, উভয়কে মিলিত করিয়া স্বীকার করাই সত্যকে স্বীকার করা।

এইজন্য দেখিতেছি, যাহারা চরমকে না মানিয়া কেবল বিকাশকেই মানিতেছে তাহারা উন্মত্ত হইয়া উঠিয়া অপঘাতমৃত্যুর অভিমুখে ছুটিতেছে, পদে পদেই তাহাদের জাহাজ কেবল আকস্মিক বিপ্লবের চোরা পাহাড়ের উপর গিয়া ঠেকিতেছে। আর যাহারা বিকাশকে মিথ্যা বলিয়া কেবলমাত্র চরমকেই মানিতে চায়, তাহারা নির্বীর্ষ ও জীর্ণ হইয়া এক শয্যায় পড়িয়া অভিভূত হইয়া মরিতেছে।

কিন্তু, চলিতে চলিতে একদিন ঐ ডাঙার গাড়ি এবং সমুদ্রের জাহাজ যখন একই বন্দরে আসিয়া পৌঁছিবে এবং দুই পক্ষের মধ্যে পণ্যবিনিময় হইবে তখনি উভয়ে বাঁচিয়া যাইবে। নহিলে কেবলমাত্র আপনার পণ্য দিয়া কেহ আপনার দারিদ্র্য ঘুচাইতে পারে না; বিনিময় না করিতে পারিলে বাণিজ্য চলে না এবং বাণিজ্য না চলিলে লক্ষ্মীর দেখা পাওয়া যায় না।

এই বাণিজ্যের যোগেই মানুষ পরস্পর মিলিবে বলিয়াই, পৃথিবীতে ঐশ্বর্য দিকে দিকে বিভক্ত হইয়া গিয়াছে। একদা জীবরাজ্যে স্ত্রীপুরুষের বিভাগ ঘটাতেই যেমন দেখিতে দেখিতে বিচিত্র সুখদুঃখের আকর্ষণের ভিতর দিয়া প্রাণীদের প্রাণসম্পদ আজ আশ্চর্যরূপে উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে, তেমনি মানুষের প্রকৃতিও কেহ বা স্থিতিকে কেহ বা গতিকে বিশেষভাবে আশ্রয় করাতেই, আজ আমরা এমন একটি মিলনকে আশা করিতেছি মানুষের সভ্যতাকে যাহা বিচিত্র ভাবে সার্থক করিয়া তুলিবে।

আরব-সমুদ্র ১৬ জ্যৈষ্ঠ, বুধবার, ১৩১৯


© 2024 পুরনো বই