কমলা বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দেখিল— অন্নদাবাবু ও হেমনলিনী ক্ষেমংকরীর কাছে বসিয়া আছে। কমলাকে দেখিয়া ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এই-যে হরিদাসী, তোমার বন্ধুকে তোমার ঘরে লইয়া যাও বাছা ! আমি অন্নদাবাবুকে চা খাওয়াইতেছি।”
কমলার ঘরে প্রবেশ করিয়াই হেমনলিনী কমলার গলা ধরিয়া কহিল, “কমলা !”
কমলা খুব বেশি বিস্মিত না হইয়া কহিল, “তুমি কেমন করিয়া জানিলে আমার নাম কমলা।”
হেমনলিনী কহিল, “একজনের কাছে আমি তোমার জীবনের ঘটনা সব শুনিয়াছি। যেমনি শুনিলাম অমনি তখনই আমার মনে সন্দেহ রহিল না তুমিই কমলা। কেন যে, তা বলিতে পারি না।”
কমলা কহিল, “ভাই, আমার নাম যে কেহ জানে সে আমার ইচ্ছা নয়। আমার নিজের নামে একেবারে ধিক্কার জন্মিয়া গেছে।”
হেমনলিনী কহিল, “কিন্তু ঐ নামের জোরেই তো তোমাকে তোমার অধিকার পাইতে হইবে।”
কমলা মাথা নাড়িয়া কহিল, “ও আমি বুঝি না। আমার জোর কিছুই নাই, আমার অধিকার কিছুই নাই, আমি জোর খাটাইতেই চাই না।”
হেমনলিনী কহিল, “কিন্তু তোমার স্বামীকে তোমার পরিচয় হইতে বঞ্চিত করিবে কী বলিয়া। তোমার ভালোমন্দ সবই কি তাঁহার কাছে নিবেদন করিবে না ? তাঁর কাছে কি কিছু লুকানো চলিবে ?”
হঠাৎ কমলার মুখ যেন বিবর্ণ হইয়া গেল— সে কোনো উত্তর খুঁজিয়া না পাইয়া নিরূপায়ভাবে হেমনলিনীর মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। আস্তে আস্তে কমলা মেজের মাদুরের ’পরে বসিয়া পড়িল; কহিল, “ভগবান তো জানেন, আমি কোনো অপরাধ করি নাই, তবে তিনি কেন আমাকে এমন করিয়া লজ্জায় ফেলিবেন ? যে পাপ আমার নয় তার শাস্তি আমাকে কেন দিবেন ? আমি কেমন করিয়া তাঁর কাছে আমার সব কথা প্রকাশ করিব ?”
হেমনলিনী কমলার হাত ধরিয়া কহিল, “শাস্তি নয় ভাই, তোমার মুক্তি হইবে। যতদিন তুমি তোমার স্বামীর কাছে আপনাকে গোপন করিয়া রাখিতেছ ততদিন তুমি আপনাকে একটা মিথ্যার বন্ধনে জড়িত করিতেছ-তাহা তেজের সহিত ছিঁড়িয়া ফেলো, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করিবেনই।”
কমলা কহিল, “আবার পাছে সব হারাই এই ভয় যখন মনে আসে তখন সব বল চলিয়া যায়। কিন্তু তুমি যা বলিতেছ আমি তা বুঝিয়াছি— অদৃষ্টে যা থাকে তা হোক, কিন্তু তাঁর কাছে আপনাকে লুকানো আর চলিবে না, তিনি আমার সবই জানিবেন।”
এই বলিতে বলিতে সে আপনার দুই হাত দৃঢ়বলে বদ্ধ করিল।
হেমনলিনী সকরুণচিত্তে কহিল, “তুমি কি চাও আর-কেহ তোমার কথা তাঁহাকে জানায় ?”
কমলা সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, “না না, আর-কাহারো মুখ হইতে তিনি শুনিবেন না— আমার কথা আমিই তাঁহাকে বলিব— আমি বলিতে পারিব।”
হেমনলিনী কহিল, “সেই কথাই ভালো। তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে কি না, জানি না। আমরা এখান হইতে চলিয়া যাইতেছি, তাহা তোমাদের বলিতে আসিয়াছি।”
কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবে ?”
হেমনলিনী কহিল, “কলিকাতায়। তোমাদের সকালে কাজকর্ম আছে, আমরা আর দেরি করিব না। আমি তবে আসি ভাই ! বোনকে মনে রাখিয়ো।”
কমলা তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “আমাকে চিঠি লিখিবে না ?”
হেমনলিনী কহিল, “আচ্ছা, লিখব।”
কমলা কহিল, “কখন কী করিতে হইবে, আমাকে তুমি উপদেশ দিয়া লিখিয়ো— আমি জানি তোমার চিঠি পাইলে আমি বল পাইব।”
হেমনলিনী একটু হাসিয়া কহিল, “আমার চেয়ে ভালো উপদেশ দিবার লোক তুমি পাইবে, সেজন্য কিছুই ভাবিয়ো না।”
আজ হেমনলিনীর জন্য কমলা মনের মধ্যে বড়োই একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিল। হেমনলিনীর প্রশান্ত মুখে কী-একটা ভাব ছিল যাহা দেখিয়া কমলার চোখে যেন জল ভরিয়া আসিতে চাহিতেছিল। কিন্তু হেমনলিনীর কেমন-একটা দূরত্ব আছে— তাহাকে কোনো কথা বলা যেন চলে না, তাহাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে যেন বাধে। আজ কমলার সকল কথাই হেমনলিনীর কাছে প্রকাশ পাইয়াছে, কিন্তু সে আপনার সুগভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন হইয়া চলিয়া গেল, কেবল একটা-কী রাখিয়া গেল যাহা বিলীয়মান গোধূলির মতো অপরিমেয় বিষাদের বৈরাগ্যে পরিপূর্ণ।
গৃহকর্মের অবকাশকালে আজ সমস্ত দিন কেবল হেমনলিনীর কথাগুলি এবং তাহার শান্ত-সকরুণ চোখের দৃষ্টি কমলার মনকে আঘাত দিতে লাগিল। কমলা হেমনলিনীর জীবনের আর-কোনো ঘটনা জানিত না— কেবল জানিত, নলিনাক্ষের সঙ্গে তাহার বিবাহের সম্বন্ধ হইয়া ভাঙিয়া গেছে। হেমনলিনী তাহাদের বাগান হইতে আজ এক সাজি ফুল আনিয়া দিয়াছিল। বৈকালে গা ধুইয়া আসিয়া কমলা সেই ফুলগুলি লইয়া মালা গাঁথিতে বসিল। মাঝে একবার ক্ষেমংকরী আসিয়া তাহার পাশে বসিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “আহা মা, আজ হেম যখন আমাকে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল, আমার মনের মধ্যে যে কী করিতে লাগিল বলিতে পারি না। যে যাই বলুক, হেম মেয়েটি বড়ো ভালো। আমার এখন কেবলই মনে হইতেছে, উহাকে যদি আমাদের বউ করিতাম তো বড়ো সুখের হইত। আর-একটু হইলেই তো হইয়া যাইত, কিন্তু আমার ছেলেটিকে তো পারিবার জো নাই-ও যে কী ভাবিয়া বাঁকিয়া বসিল তা সে ওই জানে।”
শেষকালে তিনিও যে এই বিবাহের প্রস্তাবে বিমুখ হইয়াছিলেন সে কথা ক্ষেমংকরী আর মনের মধ্যে আমল দিতে চান না।
বাহিরে পায়ের শব্দ শুনিয়া ক্ষেমংকরী ডাকিলেন, ‘ও নলিন, শুনে যা।”
কমলা তাড়াতাড়ি আঁচলের মধ্যে ফুল ও মালা ঢাকিয়া ফেলিয়া মাথায় কাপড় তুলিয়া দিল। নলিনাক্ষ ঘরে প্রবেশ করিলে ক্ষেমংকরী কহিলেন, “হেমরা যে আজ চলিয়া গেল। তোর সঙ্গে কি দেখা হয় নাই ?”
নলিন কহিল, “হাঁ, আমি যে তাঁহাদের গাড়িতে তুলিয়া দিয়া আসিলাম।”
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “যাই বলিস বাপু, হেমের মতো মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না।”
যেন নলিনাক্ষ এ সম্বন্ধে বরাবর তাঁহার প্রতিবাদ করিয়াই আসিয়াছে। নলিনাক্ষ চুপ করিয়া একটুখানি হাসিল।
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “হাসলি যে বড়ো ! আমি তোর সঙ্গে হেমের সম্বন্ধ করিলাম, আশীর্বাদ পর্যন্ত করিয়া আসিলাম, আর তুই যে জেদ করিয়া সব ভণ্ডুল করিয়া দিলি, এখন তোর মনে কি একটু অনুতাপ হইতেছে না ?
নলিনাক্ষ একবার চকিতের মতো কমলার মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল; দেখিল কমলা উৎসুকনেত্রে তাহার দিক তাকাইয়া আছে। চারি চক্ষু মিলিত হইবামাত্র কমলা লজ্জায় মাটি হইয়া চোখ নিচু করিল।
নলিনাক্ষ কহিল, “মা, তোমার ছেলে কি এমনি সৎপাত্র যে, তুমি সম্বন্ধ করিলেই হইল ? আমার মতো নীরস গম্ভীর লোককে সহজে কি কারো পছন্দ হইতে পারে।”
এই কথায় কমলার চোখ আপনি আবার উপরে উঠিল, উঠিবামাত্র দেখিল নলিনাক্ষের হাস্যোজ্জ্বল দৃষ্টি তাহার উপরেই পড়িয়াছে— এবার কমলার মনে হইতে লাগিল ‘ঘর হইতে ছুটিয়া পালাইতে পারিলে বাঁচি।’
ক্ষেমংকরী কহিলেন, “যা যা, আর বকিস নে, তোর কথা শুনিলে আমার রাগ ধরে।”
এই সভা ভঙ্গ হইয়া গেলে পর কমলা হেমনলিনীর সব ক’টি ফুল লইয়া একটি বড়ো মালা গাঁথিল। ফুলের সাজির উপরে সেই মালাটি লইয়া জলের ছিটা দিয়া সেটি নলিনাক্ষের উপাসনা-ঘরের এক পার্শ্বে রাখিয়া দিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, আজ বিদায় হইয়া যাইবার দিনে এইজন্যই হেমনলিনী সাজি ভরিয়া ফুল আনিয়াছিল— মনে করিয়া তাহার চোখ ছল্ ছল্ করিয়া উঠিল।
তাহার পরে আপনার ঘরে ফিরিয়া আসিয়া তাহার মুখের দিকে নলিনাক্ষের সেই দৃষ্টিপাত কমলা অনেকক্ষণ ধরিয়া আলোচনা করিতে লাগিল। নলিনাক্ষ কমলাকে কী মনে করিতেছে ? কমলার মনের কথা যেন নলিনাক্ষের কাছে সমস্তই প্রকাশ হইয়া পড়িয়াছে। কমলা পূর্বে যখন নলিনাক্ষের সম্মুখে বাহির হইত না, তখন সে একরকম ছিল ভালো। এখন প্রতিদিন কমলা তাহার কাছে ধরা পড়িয়া যাইতেছে। আপনাকে গোপন করিয়া রাখিবার এই তো শাস্তি ! কমলা ভাবিতে লাগিল, নিশ্চয়ই নলিনাক্ষ মনে মনে বলিতেছেন, ‘এই হরিদাসী মেয়েটিকে মা কোথা হইতে আনিলেন, এমন নির্লজ্জ তো দেখি নাই !’ নলিনাক্ষ যদি এক মুহূর্তও এমন কথা মনে করে তবে তো সে অসহ্য।
কমলা রাত্রে বিছানায় শুইয়া মনে মনে খুব জোর করিয়া প্রতিজ্ঞা করিল, ‘যেমন করিয়া হউক, কালই আপনার পরিচয় দিতে হইবে, তাহার পরে যাহা হয় তাহা হউক।”
পরদিন কমলা প্রত্যুষে উঠিয়া স্নান করিতে গেল। স্নানের পর প্রতিদিন সে একটি ছোটো ঘটিতে গঙ্গাজল আনিয়া নলিনাক্ষের উপাসনা-ঘরটি ধুইয়া মার্জনা করিয়া তবে অন্য কাজে মন দিত। আজও সে তার দিবসের প্রথম কাজটি সারিতে গিয়া দেখিল, নলিনাক্ষ আজ সকাল-সকাল তাহার উপাসনা-ঘরে প্রবেশ করিয়াছে— এমন তো কোনোদিন হয় নাই। কমলা তাহার মনের মধ্যে অসমাপ্ত কাজের একটা ভার বহন করিয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল। খানিকটা দূরে গিয়া সে হঠাৎ থামিল, স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া কী-একটা ভাবিল। তার পরে আবার ধীরে ধীরে ফিরিয়া আসিয়া উপাসনা-ঘরের দ্বারের কাছে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহাকে যে কিসে আবিষ্ট করিয়া ধরিল তাহা সে জানে না; সমস্ত জগৎ তাহার কাছে ছায়ার মতো হইয়া আসিল, সময় যে কতক্ষণ চলিয়া গেল তাহা তাহার বোধ রহিল না। হঠাৎ এক সময় দেখিল, নলিনাক্ষ ঘর হইতে বাহির হইয়া তাহার সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কমলা মুহূর্তের মধ্যে উঠিয়া দাঁড়াইয়া তখনই ভূতলে হাঁটু গাড়িয়া একেবারে নলিনাক্ষের পায়ের উপর মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিল— তাহার সদ্যস্নানে আর্দ্র চুলগুলি নলিনের পা ঢাকিয়া মাটিতে ছড়াইয়া পড়িল। কমলা প্রণাম করিয়া উঠিয়া পাথরের মূর্তির মতো স্থির হইয়া দাঁড়াইল; তাহার মনে রহিল না যে, তাহার মাথার উপর হইতে কাপড় পড়িয়া গেছে— সে যেন দেখিতেই পাইল না, নলিনাক্ষ অনিমেষ স্থিরদৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া আছে— তাহার বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত, সে একটি অন্তরের চৈতন্য-আভায় অপূর্বরূপে দীপ্ত হইয়া অবিচলিতকণ্ঠে কহিল, “আমি কমলা।”
এই কথাটি বলিবার পরেই তাহার আপনার কণ্ঠস্বরে তাহার যেন ধ্যানভঙ্গ হইয়া গেল, তাহার একাগ্র চেতনা বাহিরে ব্যাপ্ত হইল। তখন তাহার সর্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল; মাথা নত হইয়া গেল; সেখান হইতে নড়িবারও শক্তি রহিল না, দাঁড়াইয়া থাকাও যেন অসাধ্য হইয়া উঠিল; সে তাহার সমস্ত বল, সমস্ত পণ ‘আমি কমলা’ এই একটি কথায় নলিনাক্ষের পায়ের কাছে উজাড় করিয়া ঢালিয়া দিয়াছে— নিজের কাছে নিজের লজ্জা রক্ষা করিবার কোনো উপায় সে আর হাতে রাখে নাই, এখন সমস্তই নলিনাক্ষের দয়ার উপরে নির্ভর। নলিনাক্ষ আস্তে আস্তে তাহার হাতটি আপনার হাতের উপর তুলিয়া লইয়া কহিল, “আমি জানি, তুমি আমার কমলা। এসো, আমার ঘরে এসো।”
উপাসনা-ঘরে তাহাকে লইয়া গিয়া তাহার গলায় কমলার গাঁথা সেই মালাটি পরাইয়া দিল এবং কহিল, “এসো, আমরা তাঁহাকে প্রণাম করি।”
দুই জনে পাশাপাশি যখন সেই শ্বেতপাথরের মেজের উপরে নত হইল, জানালা হইতে প্রভাতের রৌদ্র দুই জনের মাথার উপরে আসিয়া পড়িল।
প্রণাম করিয়া উঠিয়া আর-একবার নলিনাক্ষের পায়ের ধুলা লইয়া যখন কমলা দাঁড়াইল তখন তাহার দুঃসহ লজ্জা আর তাহাকে পীড়ন করিল না। হর্ষের উল্লাস নহে কিন্তু একটি বৃহৎ মুক্তির অচঞ্চল শান্তি তাহার অস্তিত্বকে প্রভাতের অকুণ্ঠিত উদারনির্মল আলোকের সহিত ব্যাপ্ত করিয়া দিল। একটি গভীর ভক্তি তাহার হৃদয়ের কানায় কানায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, তাহার অন্তরের পূজা সমস্ত বিশ্বকে ধূপের পুণ্য গন্ধে বেষ্টন করিল। দেখিতে দেখিতে কখন অজ্ঞাতসারে তাহার দুই চক্ষু জলে ভরিয়া আসিল; বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা তাহার দুই কপোল দিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল, আর থামিতে চাহিল না, তাহার অনাথ জীবনের সমস্ত দুঃখের মেঘ আজ আনন্দের জলে ঝরিয়া পড়িল। নলিনাক্ষ তাহাকে আর-কোনো কথা না বলিয়া একবার কেবল দক্ষিণ হস্তে তাহার ললাট হইতে সিক্ত কেশ সরাইয়া দিয়া ঘর হইতে চালিয়া গেল।
কমলা তাহার পূজা এখনো শেষ করিতে পারিল না— তাহার পরিপূর্ণ হৃদয়ের ধারা এখনো সে ঢালিতে চায়, তাই সে নলিনাক্ষের শোবার ঘরে গিয়া আপনার গলার মালা দিয়া সেই খড়ম-জোড়াকে জড়াইল এবং তাহা আপনার মাথায় ঠেকাইয়া যত্নপূর্বক যথাস্থানে তুলিয়া রাখিল।
তার পরে সমস্ত দিন তাহার গৃহকর্ম যেন দেবসেবার মতো মনে হইতে লাগিল। প্রত্যেক কর্মই যেন আকাশে এক-একটি আনন্দের তরঙ্গের মতো উঠিল পড়িল। ক্ষেমংকরী তাহাকে কহিলেন, “মা, তুমি করিতেছ কী ? এক দিনে সমস্ত বাড়িটাকে ধুইয়া মাজিয়া মুছিয়া একেবারে নূতন করিয়া তুলিবে না কি ?”
বৈকালের অবকাশের সময় আজ আর সেলাই না করিয়া কমলা তাহার ঘরের মেজের উপরে স্থির হইয়া বসিয়া আছে, এমন সময় নলিনাক্ষ একটি টুকরিতে গুটিকয়েক স্থলপদ্ম লইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল; কহিল, “কমলা, এই ফুল-ক’টি তুমি জল দিয়া তাজা করিয়া রাখো, আজ সন্ধ্যার পর আমরা দুজনে মাকে প্রণাম করিতে যাইব।”
কমলা মুখ নত করিয়া কহিল, “কিন্তু আমার সব কথা তো শোন নাই।”
নলিনাক্ষ কহিল, “তোমাকে কিছু বলিতে হইবে না, আমি সব জানি।”
কমলা দক্ষিণ করতল দিয়া মুখ ঢাকিয়া কহিল, “মা কি— ”
বলিয়া কথা শেষ করিতে পারিল না।
নলিনাক্ষ তাহার মুখ হইতে হাত নামাইয়া ধরিয়া কহিল, “মা তাহার জীবনে অনেক অপরাধকে ক্ষমা করিয়া আসিয়াছেন, যাহা অপরাধ নহে তাহাকে তিনি ক্ষমা করিতে পারিবেন। ”