নৌকাডুবি ৪৭

চন্দ্রমোহনের কাছে রমেশের খবর পাইয়া অক্ষয়ের মনে অনেকগুলা চিন্তার উদয় হইল। সে ভাবিতে লাগিল, ব্যাপারখানা কী? রমেশ গাজিপুরে প্র্যাকটিস করিতেছিল, এতদিন নিজেকে যথেষ্ট গোপনেই রাখিয়াছিল, ইতিমধ্যে এমন কী ঘটিল যাহাতে সে সেখানকার প্র্যাকটিস ছাড়িয়া দিয়া আবার সাহসপূর্বক কলুটোলার গলির মধ্যে আত্মপ্রকাশ করিবার জন্য উপস্থিত হইয়াছে। অন্নদাবাবুরা যে কাশীতে আছেন, কোন্‌দিন রমেশ কোথা হইতে সে খবর পাইবে এবং নিশ্চয়ই সেখানে গিয়া হাজির হইবে। অক্ষয় স্থির করিল, ইতিমধ্যে গাজিপুরে গিয়া সে সমস্ত সংবাদ জানিবে এবং তাহার পর একবার কাশীতে অন্নদাবাবুর সঙ্গে গিয়া দেখা করিয়া আসিবে।

একদিন অগ্রহায়ণের অপরাহ্নে অক্ষয় তাহার ব্যাগ হাতে করিয়া গাজিপুরে আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রথমে বাজারে জিজ্ঞাসা করিল, “রমেশবাবু বলিয়া একটি বাঙালি উকিলের বাসা কোন্‌ দিকে?” অনেককেই জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, বাজারে রমেশবাবু-নামক কোনো ব্যক্তির উকিল বলিয়া কোনো খ্যাতি নাই। তখন সে আদালতে গেল। আদালত তখন ভাঙিয়াছে। শামলা-পরা একটি বাঙালি উকিল গাড়িতে উঠিতে যাইতেছেন, তাঁহাকে অক্ষয় জিজ্ঞাসা করিল, “মশায়, রমেশচন্দ্র চৌধুরী বলিয়া একটি নূতন বাঙালি উকিল গাজিপুরে আসিয়াছেন, তাঁহার বাসা কোথায় জানেন?”

অক্ষয় ইঁহার কাছ হইতে খবর পাইল যে, রমেশ তো এতদিন খুড়ামশায়ের বাড়িতেই ছিল, এখন সে সেখানে আছে কি কোথাও গেছে তাহা বলা যায় না। তাহার স্ত্রীকে পাওয়া যাইতেছে না, সম্ভবত তিনি জলে ডুবিয়া মরিয়াছেন।

অক্ষয় খুড়ার বাড়িতে যাত্রা করিল। পথে যাইতে যাইতে ভাবিতে লাগিল, এইবার রমেশের চালটা বুঝা যাইতেছে। স্ত্রী মারা গিয়াছে; এখন সে অসংকোচে হেমনলিনীর কাছে প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিবে, তাহার স্ত্রী কোনোকালেই ছিল না। হেমনলিনীর অবস্থা যেরূপ, তাহাতে রমেশের কথা অবিশ্বাস করা তাহার পক্ষে অসম্ভব হইবে। যাহারা ধর্মনীতি লইয়া অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করিয়া বেড়ায়, গোপনে তাহারা যে কী ভয়ানক লোক অক্ষয় তাহা মনে মনে আলোচনা করিয়া নিজের প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করিতে লাগিল।

খুড়ার কাছে গিয়া তাঁহাকে রমেশের ও কমলার কথা জিজ্ঞাসা করিবামাত্র তিনি শোক সংবরণ করিতে পারিলেন না, তাঁহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। তিনি কহিলেন, “আপনি যখন রমেশবাবুর বিশেষ বন্ধু, তখন আমার মা কমলাকে নিশ্চয় আপনি আত্মীয়ের মতোই জানেন; কিন্তু আমি এ কথা বলিতেছি, কয়েক দিন মাত্র তাঁহাকে দেখিয়া আমি আমার নিজের কন্যার সহিত তাঁহার প্রভেদ ভুলিয়া গেছি। দুদিনের জন্য মায়া বাড়াইয়া মা-লক্ষ্মী যে আমাকে এমন বজ্রাঘাত করিয়া ত্যাগ করিয়া যাইবেন, এ কি আমি জানিতাম।”

অক্ষয় মুখ ম্লান করিয়া কহিল, “এমন ঘটনাটা যে কী করিয়া ঘটিল, আমি তো কিছুই বুঝিতে পারি না। নিশ্চয়ই রমেশ কমলার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে নাই।”

খুড়া। আপনি রাগ করিবেন না, আপনাদের রমেশটিকে আমি আজ পর্যন্ত চিনিতে পারিলাম না। এ দিকে বাহিরে তো দিব্য লোকটি; কিন্তু মনের মধ্যে কী ভাবেন, কী করেন, বুঝিবার জো নাই। নহিলে কমলার মতো অমন স্ত্রীকে কী মনে করিয়া যে অনাদর করিতেন তাহা ভাবিয়া পাওয়া যায় না। কমলা এমন সতীলক্ষ্মী, আমার মেয়ের সঙ্গে তার আপন বোনের মতো ভাব হইয়াছিল– তবু কখনো একদিনের জন্যও নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে একটি কথাও কহে নাই। আমার মেয়ে মাঝে মাঝে বুঝিতে পারিত যে, সে মনের মধ্যে খুবই কষ্ট পাইতেছে, কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত একটি কথা বলাইতে পারে নাই। এমন স্ত্রী যে কী অসহ্য কষ্ট পাইলে এমন কাজ করিতে পারে তাহা তো আপনি বুঝিতেই পারেন–সে কথা মনে করিলেও বুক ফাটিয়া যায়। আবার আমার এমনি কপাল, আমি তখন এলাহাবাদে চলিয়া গিয়াছিলাম, নহিলে কি মা কখনো আমাকে ছাড়িয়া যাইতে পারিতেন?

পরদিন প্রাতে খুড়াকে লইয়া অক্ষয় রমেশের বাংলা ও গঙ্গার তীর ঘুরিয়া আসিল। ঘরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “দেখুন মশায়, কমলা যে গঙ্গায় ডুবিয়া আত্মহত্যা করিয়াছে, এ সম্বন্ধে আপনি যতটা নিঃসংশয় হইয়াছেন আমি ততটা হইতে পারি নাই।”

খুড়া। আপনি কিরূপ মনে করেন?

অক্ষয়। আমার মনে হয় তিনি গৃহ ছাড়িয়া চলিয়া গেছেন, তাঁহাকে ভালোরূপ খোঁজ করা উচিত।

খুড়া হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “আপনি ঠিক বলিয়াছেন, কথাটা নিতান্তই অসম্ভব নহে।”

অক্ষয়। নিকটেই কাশীতীর্থ। সেখানে আমাদের একটি পরম বন্ধু আছেন; এমনও হইতে পারে, কমলা তাঁহাদের কাছে গিয়া আশ্রয় লইয়াছে।

খুড়া আশান্বিত হইয়া কহিলেন, “কই, তাঁহাদের কথা তো রমেশবাবু আমাদের কখনো বলেন নাই। যদি জানিতাম, তবে কি খোঁজ করিতে বাকি রাখিতাম?”

অক্ষয়। তবে একবার চলুন-না, আমরা দুইজনেই কাশী যাই। পশ্চিম-অঞ্চল আপনার সমস্তই জানাশোনা আছে, আপনি ভালো করিয়া খোঁজ করিতে পারিবেন।

খুড়া এ প্রস্তাবে উৎসাহের সহিত সম্মত হইলেন। অক্ষয় জানিত তাহার কথা হেমনলিনী সহজে বিশ্বাস করিবে না, এইজন্য প্রামাণিক-সাক্ষীর স্বরূপে খুড়াকে সঙ্গে করিয়া কাশীতে গেল।


© 2024 পুরনো বই