চোখের বালি ৩৬

৩৬
যাহা অসম্ভব তাহাও সম্ভব হয়, যাহা অসহ্য তাহাও সহ্য হয়, নহিলে মহেন্দ্রের সংসারে সে রাত্রি সে দিন কাটিত না। বিনোদিনীকে প্রস্তুত হইয়া থাকিতে পরামর্শ দিয়া মহেন্দ্র রাত্রেই একটা পত্র লিখিয়াছিল, সেই পত্র ডাকযোগে সকালে মহেন্দ্রের বাড়িতে পৌঁছিল।
আশা তখন শয্যাগত। বেহারা চিঠি হাতে করিয়া আসিয়া কহিল, “মাজি, চিট্‌ঠি।”
আশার হৃৎপিণ্ডে রক্ত ধক্‌ করিয়া ঘা দিল। এক পলকের মধ্যে সহস্র আশ্বাস ও আশঙ্কা একসঙ্গে তাহার বক্ষে বাজিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি মাথা তুলিয়া চিঠিখানা লইয়া দেখিল, মহেন্দ্রের হাতের অক্ষরে বিনোদিনীর নাম। তৎক্ষণাৎ তাহার মাথা বালিশের উপরে পড়িয়া গেল–কোনো কথা না বলিয়া আশা সে চিঠি বেহারার হাতে ফিরাইয়া দিল। বেহারা জিজ্ঞাসা করিল, “চিঠি কাহাকে দিতে হইবে।”
আশা কহিল, “জানি না।”
রাত্রি তখন আটটা হইবে, মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি ঝড়ের মতো বিনোদিনীর ঘরের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল, দেখিল–ঘরে আলো নাই, সমস্ত অন্ধকার। পকেট হইতে একটা দেশালাইয়ের বাক্স বাহির করিয়া দেশালাই ধরাইল–দেখিল, ঘর শূন্য। বিনোদিনী নাই, তাহার জিনিসপত্রও নাই। দক্ষিণের বারান্দায় গিয়া দেখিল, বারান্দা নির্জন। ডাকিল, “বিনোদ।” কোনো উত্তর আসিল না।
“নির্বোধ। আমি নির্বোধ। তখনই সঙ্গে করিয়া লইয়া যাওয়া উচিত ছিল। নিশ্চয়ই মা বিনোদিনীকে এমন গঞ্জনা দিয়াছেন যে, সে ঘরে টিকিতে পারে নাই।”
সেই কল্পনামাত্র মনে উদয় হইতেই, তাহা নিশ্চয় সত্য বলিয়া তাহার মনে বিশ্বাস হইল। মহেন্দ্র অধীর হইয়া তৎক্ষণাৎ মার ঘরে গেল। সে-ঘরেও আলো নাই–কিন্তু রাজলক্ষ্মী বিছানায় শুইয়া আছেন, তাহা অন্ধকারেও লক্ষ্য হইল। মহেন্দ্র একেবারেই রুষ্টস্বরে বলিয়া উঠিল, “মা, তোমরা বিনোদিনীকে কী বলিয়াছ।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কিছুই বলি নাই।”
মহেন্দ্র। তবে সে কোথায় গেছে। রাজলক্ষ্মী। আমি কী জানি।
মহেন্দ্র অবিশ্বাসের স্বরে কহিল, “তুমি জান না? আচ্ছা, আমি তাহার সন্ধানে চলিলাম–সে যেখানেই থাক্‌, আমি তাহাকে বাহির করিবই।”
বলিয়া মহেন্দ্র চলিয়া গেল। রাজলক্ষ্মী তাড়াতাড়ি বিছানা হইতে উঠিয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিতে চলিতে বলিতে লাগিলেন, “মহিন, যাস নে মহিন, ফিরিয়া আয়, আমার একটা কথা শুনিয়া যা।”
মহেন্দ্র এক নিশ্বাসে ছুটিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল। মুহূর্ত পরেই ফিরিয়া আসিয়া দরোয়ানকে জিজ্ঞাসা করিল, “বহুঠাকুরানী কোথায় গিয়াছেন।”
দরোয়ান কহিল, “আমাদের বলিয়া যান নাই, আমরা কিছুই জানি না।”
মহেন্দ্র গর্জিত ভর্ৎসনার স্বরে কহিল, “জান না!”
দরোয়ান করজোড়ে কহিল, “না মহারাজ, জানি না।”
মহেন্দ্র মনে মনে স্থির করিল, “মা ইহাদের শিখাইয়া দিয়াছেন।” কহিল, “আচ্ছা, তা হউক।”
মহানগরীর রাজপথে গ্যাসালোকবিদ্ধ সন্ধ্যান্ধকারে বরফওয়ালা তখন বরফ ও তপ্‌সিমাছওয়ালা তপ্‌সিমাছ হাঁকিতেছিল। কলরবক্ষুদ্ধ জনতার মধ্যে মহেন্দ্র প্রবেশ করিল এবং অদৃশ্য হইয়া গেল।


© 2024 পুরনো বই