১২
মহেন্দ্র একদিন বিরক্ত হইয়া তাহার মাকে ডাকিয়া কহিল, “এ কি ভালো হইতেছে? পরের ঘরের যুবতী বিধবাকে আনিয়া একটা দায় ঘাড়ে করিবার দরকার কী। আমার তো ইহাতে মত নাই–কী জানি কখন কী সংকট ঘটিতে পারে।”
রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ও যে আমাদের বিপিনের বউ, উহাকে আমি তো পর মনে করি না।”
মহেন্দ্র কহিল, “না মা, ভালো হইতেছে না। আমার মতে উঁহাকে রাখা উচিত হয় না।”
রাজলক্ষ্মী বেশ জানিতেন, মহেন্দ্রের মত অগ্রাহ্য করা সহজ নহে। তিনি বিহারীকে ডাকিয়া কহিলেন, “ও বেহারি, তুই একবার মহিনকে বুঝাইয়া বল্। বিপিনের বউ আছে বলিয়াই এই বৃদ্ধবয়সে আমি একটু বিশ্রাম করিতে পাই। পর হউক, যা হউক, আপন লোকের কাছ হইতে এমন সেবা তো কখনো পাই নাই।”
বিহারী রাজলক্ষ্মীকে কোনো উত্তর না করিয়া মহেন্দ্রের কাছে গেল–কহিল, “মহিনদা, বিনোদিনীর কথা কিছু ভাবিতেছে?”
মহেন্দ্র হাসিয়া কহিল, “ভাবিয়া রাত্রে ঘুম হয় না। তোমার বোঠানকে জিজ্ঞাসা করো না, আজকাল বিনোদিনীর ধ্যানে আমার আর-সকল ধ্যানই ভঙ্গ হইয়াছে।”
আশা ঘোমটার ভিতর হইতে মহেন্দ্রকে নীরবে তর্জন করিল।
বিহারী কহিল, “বল কী। দ্বিতীয় বিষবৃক্ষ!”
মহেন্দ্র। ঠিক তাই। এখন উহাকে বিদায় করিবার জন্য চুনি ছটফট করিতেছে।
ঘোমটার ভিতর হইতে আশার দুই চক্ষু আবার ভর্ৎসনা বর্ষণ করিল।
বিহারী কহিল, “বিদায় করিলেও ফিরিতে কতক্ষণ। বিধবার বিবাহ দিয়া দাও–বিষদাঁত একেবারে
ভাঙিবে।”
মহেন্দ্র। কুন্দরও তো বিবাহ দেওয়া হইয়াছিল।
বিহারী কহিল, “থাক্, ও উপমাটা এখন রাখো। বিনোদিনীর কথা আমি মাঝে মাঝে ভাবি। তোমার এখানে উনি তো চিরদিন থাকিতে পারেন না। তাহার পরে, যে বন দেখিয়া আসিয়াছি সেখানে উঁহাকে যাবজ্জীবন বনবাসে পাঠানো, সেও বড়ো কঠিন দণ্ড।”
মহেন্দ্রের সম্মুখে এ পর্যন্ত বিনোদিনী বাহির হয় নাই, কিন্তু বিহারী তাহাকে দেখিয়াছে। বিহারী এটুকু বুঝিয়াছে, এ নারী জঙ্গলে ফেলিয়া রাখিবার নহে। কিন্তু শিখা এক ভাবে ঘরের প্রদীপরূপে জ্বলে, আর-এক ভাবে ঘরে আগুন ধরাইয়া দেয়–সে আশঙ্কাও বিহারীর মনে ছিল।
মহেন্দ্র বিহারীকে এই কথা লইয়া অনেক পরিহাস করিল। বিহারীও তাহার জবাব দিল। কিন্তু তাহার মন বুঝিয়াছিল, এ নারী খেলা করিবার নহে, ইহাকে উপেক্ষা করাও যায় না।
রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীকে সাবধান করিয়া দিলেন। কহিলেন, “দেখো বাছা, বউকে লইয়া তুমি অত টানাটানি করিয়ো না। তুমি পাড়াগাঁয়ের গৃহস্থ-ঘরে ছিলে–আজকালকার চালচলন জান না। তুমি বুদ্ধিমতী, ভালো করিয়া বুঝিয়া চলিয়ো।”-
ইহার পর বিনোদিনী অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্বক আশাকে দূরে দূরে রাখিল। কহিল, “আমি ভাই কে। আমার মতো অবস্থার লোক আপন মান বাঁচাইয়া চলিতে না জানিলে, কোন্ দিন কী ঘটে বলা যায় কি।”
আশা সাধাসাধি কান্নাকাটি করিয়া মরে–বিনোদিনী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মনের কথায় আশা আকণ্ঠ পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, কিন্তু বিনোদিনী আমল দিল না।
এ দিকে মহেন্দ্রের বাহুপাশ শিথিল এবং তাহার মুগ্ধদৃষ্টি যেন ক্লান্তিতে আবৃত হইয়া আসিয়াছে। পূর্বে যেসেকল অনিয়ম-উচ্ছৃঙ্খলা তাহার কাছে কৌতুকজনক বোধ হইত, এখন তাহা অল্পে অল্পে তাহাকে পীড়ন করিতে আরম্ভ করিয়াছে। আশার সাংসারিক অপটুতায় সে ক্ষণে ক্ষণে বিরক্ত হয়, কিন্তু প্রকাশ করিয়া বলে না। প্রকাশ না করিলেও আশা অন্তরে অন্তরে অনুভব করিয়াছে, নিরবচ্ছিন্ন মিলনে প্রেমের মর্যাদা মলান হইয়া যাইতেছে। মহেন্দ্রের সোহাগের মধ্যে বেসুর লাগিতেছিল–কতকটা মিথ্যা বাড়াবাড়ি, কতকটা আত্মপ্রতারণা।
এ সময়ে পলায়ন ছাড়া পরিত্রাণ নাই, বিচ্ছেদ ছাড়া ঔষধ নাই। স্ত্রীলোকের স্বভাবসিদ্ধ সংস্কারবশে আশা আজকাল মহেন্দ্রকে ফেলিয়া যাইবার চেষ্টা করিত। কিন্তু বিনোদিনী ছাড়া তাহার যাইবার স্থান কোথায়।
মহেন্দ্র প্রণয়ের উত্তপ্ত বাসরশয্যার মধ্যে চক্ষু উন্মীলন করিয়া ধীরে ধীরে সংসারের কাজকর্ম, পড়াশুনার প্রতি একটু সজাগ হইয়া পাশ ফিরিল। ডাক্তারি বইগুলাকে নানা অসম্ভব স্থান হইতে উদ্ধার করিয়া ধুলা ঝাড়িতে লাগিল এবং চাপকান-প্যাণ্টলুন কয়টা রৌদ্রে দিবার উপক্রম করিল।
Related Chapters
- দুই বোন
- ১. শর্মিলা
- ২. নীরদ
- বউ-ঠাকুরানীর হাট
- বউ-ঠাকুরানীর হাট ০১-০৫
- বউ-ঠাকুরানীর হাট ০৬-১০
- বউ-ঠাকুরানীর হাট ১১-১৫
- বউ-ঠাকুরানীর হাট ১৬-২০
- বউ-ঠাকুরানীর হাট ২১-২৫
- বউ-ঠাকুরানীর হাট ২৬-৩০
- বউ-ঠাকুরানীর হাট ৩১-৩৫
- বউ-ঠাকুরানীর হাট ৩৬-৩৭ (শেষ)
- চোখের বালি
- চোখের বালি ০১
- চোখের বালি ০২
- চোখের বালি ০৩
- চোখের বালি ০৪
- চোখের বালি ০৫
- চোখের বালি ০৬
- চোখের বালি ০৭
- চোখের বালি ০৮
- চোখের বালি ০৯
- চোখের বালি ১০
- চোখের বালি ১১
- চোখের বালি ১২
- চোখের বালি ১৩
- চোখের বালি ১৪
- চোখের বালি ১৫
- চোখের বালি ১৬
- চোখের বালি ১৭
- চোখের বালি ১৮
- চোখের বালি ১৯
- চোখের বালি ২০
- চোখের বালি ২১
- চোখের বালি ২২
- চোখের বালি ২৩
- চোখের বালি ২৪
- চোখের বালি ২৫
- চোখের বালি ২৬
- চোখের বালি ২৭
- চোখের বালি ২৮
- চোখের বালি ২৯
- চোখের বালি ৩০
- চোখের বালি ৩১
- চোখের বালি ৩২
- চোখের বালি ৩৩
- চোখের বালি ৩৫
- চোখের বালি ৩৬
- চোখের বালি ৩৭
- চোখের বালি ৩৮
- চোখের বালি ৩৯
- চোখের বালি ৪০
- চোখের বালি ৪১
- চোখের বালি ৪২
- চোখের বালি ৪৩
- চোখের বালি ৪৪
- চোখের বালি ৪৫
- চোখের বালি ৪৬
- চোখের বালি ৪৭
- চোখের বালি ৪৮
- চোখের বালি ৪৯
- চোখের বালি ৫০
- চোখের বালি ৫১
- চোখের বালি ৫২
- চোখের বালি ৫৩
- চোখের বালি ৫৪
- চোখের বালি ৫৫
- ঘরে বাইরে
- ঘরে বাইরে ০১
- ঘরে বাইরে ০২
- ঘরে বাইরে ০৩
- ঘরে বাইরে ০৪
- ঘরে বাইরে ০৫
- ঘরে বাইরে ০৬
- ঘরে বাইরে ০৭
- ঘরে বাইরে ০৮
- ঘরে বাইরে ০৯
- ঘরে বাইরে ১০
- ঘরে বাইরে ১১
- ঘরে বাইরে ১২
- ঘরে বাইরে ১৩
- ঘরে বাইরে ১৪
- ঘরে বাইরে ১৫
- ঘরে বাইরে ১৬
- ঘরে বাইরে ১৭
- ঘরে বাইরে ১৮
- প্রজাপতির নির্বন্ধ
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ০১
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ০২
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ০৩
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ০৪
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ০৫
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ০৬
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ০৭
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ০৮
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ০৯
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ১০
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ১১
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ১২
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ১৩
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ১৪
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ১৫
- প্রজাপতির নির্বন্ধ ১৬
- চতুরঙ্গ
- চতুরঙ্গ ০১
- চতুরঙ্গ ০২
- চতুরঙ্গ ০৩
- চতুরঙ্গ ০৪
- চার অধ্যায়
- চার অধ্যায় ০১
- চার অধ্যায় ০২
- চার অধ্যায় ০৩
- চার অধ্যায় ০৪
- চার অধ্যায় ০৫
- যোগাযোগ
- যোগাযোগ ০১-০৫
- যোগাযোগ ০৬-১০
- যোগাযোগ ১১-১৫
- যোগাযোগ ১৬-২০
- যোগাযোগ ২১-২৫
- যোগাযোগ ২৬-৩০
- যোগাযোগ ৩১-৩৫
- যোগাযোগ ৩৬-৪০
- যোগাযোগ ৪১-৪৩
- যোগাযোগ ৪৪-৪৫
- যোগাযোগ ৪৬-৫০
- যোগাযোগ ৫১-৫৪
- যোগাযোগ ৫৫-৫৮ (শেষ)
- মালঞ্চ
- মালঞ্চ ০১
- মালঞ্চ ০২
- মালঞ্চ ০৩
- মালঞ্চ ০৪
- মালঞ্চ ০৫
- মালঞ্চ ০৬
- মালঞ্চ ০৭
- মালঞ্চ ০৮
- মালঞ্চ ০৯
- মালঞ্চ ১০
- রাজর্ষি
- রাজর্ষি – ০১ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ০২ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ০৩ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ০৪ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ০৫ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ০৬ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ০৭ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ০৮ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ০৯ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ১০ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ১১ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ১২ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ১৩ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ১৪ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ১৫ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ১৬ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ১৭ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ১৮ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ১৯ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ২০ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ২১ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ২২ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ২৩ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ২৪ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ২৫ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ২৬ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ২৭ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ২৮ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ২৯ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৩০ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৩১ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৩২ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৩৩ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৩৪ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৩৫ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৩৬ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৩৭ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৩৮ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৩৯ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৪০ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৪১ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৪২ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৪৩ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৪৪ পরিচ্ছেদ
- রাজর্ষি – ৪৫ উপসংহার
- গোরা
- গোরা ০১
- গোরা ০২
- গোরা ০৩
- গোরা ০৪
- গোরা ০৫
- গোরা ০৬
- গোরা ০৭
- গোরা ০৮
- গোরা ০৯
- গোরা ১০
- গোরা ১১
- গোরা ১২
- গোরা ১৩
- গোরা ১৪
- গোরা ১৫
- গোরা ১৬
- গোরা ১৭
- গোরা ১৮
- গোরা ১৯
- গোরা ২০
- গোরা ২১
- গোরা ২২
- গোরা ২৩
- গোরা ২৪
- গোরা ২৫
- গোরা ২৬
- গোরা ২৭
- গোরা ২৮
- গোরা ২৯
- গোরা ৩০
- গোরা ৩১
- গোরা ৩২
- গোরা ৩৩
- গোরা ৩৪
- গোরা ৩৫
- গোরা ৩৬
- গোরা ৩৭
- গোরা ৩৮
- গোরা ৩৯
- গোরা ৪০
- গোরা ৪১
- গোরা ৪২
- গোরা ৪৩
- গোরা ৪৪
- গোরা ৪৫
- গোরা ৪৬
- গোরা ৪৭
- গোরা ৪৮
- গোরা ৪৯
- গোরা ৫০
- গোরা ৫১
- গোরা ৫২
- গোরা ৫৩
- গোরা ৫৪
- গোরা ৫৫
- গোরা ৫৬
- গোরা ৫৭
- গোরা ৫৮
- গোরা ৫৯
- গোরা ৬০
- গোরা ৬১
- গোরা ৬২
- গোরা ৬৩
- গোরা ৬৪
- গোরা ৬৫
- গোরা ৬৬
- গোরা ৬৭
- গোরা ৬৮
- গোরা ৬৯
- গোরা ৭০
- গোরা ৭১
- গোরা ৭২
- গোরা ৭৩
- গোরা ৭৪
- গোরা ৭৫
- গোরা ৭৬
- গোরা ৭৬