পারিস নগরে লঞ্জিনে নামক এক ব্যক্তি ছিলেন। রাজদণ্ডে প্রাণবধের আদেশ হওয়াতে, তিনি তথা হইতে পলায়ন করিলেন, এবং বেণে নামক স্থানে তাঁহাদের যে বসতিবাটী ছিল, তথায় উপস্থিত হইলেন। তৎকালে, সেই বাটীতে এক পরিচারিকা ব্যতীত আর কেহ ছিল না। তিনি কি অবস্থায় সেখানে উপস্থিত হইয়াছেন, প্রথমতঃ পরিচারিকার নিকট তাহার কিছুমাত্র ব্যক্ত করিলেন না।
কতিপয় দিবস পরে, লঞ্জিনে সংবাদপত্রে দেখিলেন, রাজপুরুষেরা এই ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন, যাহারা রাজদণ্ডগ্রস্ত ব্যক্তিদিগকে আশ্রয় দিবে, কিংবা যে সকল পরিচারক অথবা পরিচারিকারা তাদৃশ ব্যক্তিদিগকে গোপন করিয়া রাখিবে, তাহাদেরও প্রাণদণ্ড হইবে। তিনি, তৎক্ষণাৎ পরিচারিকাকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, দেখ, রাজদণ্ডে আমার প্রাণবধের আদেশ হইয়াছে, সে জন্য আমি, পারিস পরিত্যাগ করিয়া, এখানে লুকাইয়া আছি, আজ সংবাদপত্রে দেখিলাম, যদি কোনও পরিচারক বা পরিচারিকা ঈদৃশ দণ্ডগ্রস্ত প্রভুকে গোপন করিয়া রাখে, তাহারও প্রাণদণ্ড হইবে। অতএব তুমি অবিলম্বে এই স্থান হইতে প্রস্থান কর, এখানে থাকিলে, তোমার প্রাণদণ্ড হইবে।
এই কথা শুনিয়া পরিচারিকা কহিল, মহাশয়। আমি বহুকাল আপনার আশ্রয়ে আছি, এবং আপনার অন্নে প্রতিপালিত হইয়াছি, এক্ষণে, বিপদের সময়, যদি আমি আপনাকে পরিত্যাগ করিয়া যাই, তাহা হইলে আমা অপেক্ষা কৃতঘ্ন আর কেহই হইতে পারে না, এ অবস্থায়, আমি কখনই, আপনাকে পরিত্যাগ করিয়া, স্থানান্তরে যাইব না। যদি আপনার নিকটে থাকিয়া ও পরিচর্য্যা করিয়া আমার প্রাণদণ্ড হয়, তাহাতে আমি কাতর নহি, বরং শ্লাঘা জ্ঞান করিব, আমি মৃত্যুকে কিছু মাত্র ভয়ানক জ্ঞান করি না। যদি আপনার প্রাণ রক্ষা বিষয়ে, কিঞ্চিত অংশেও, সাহায্য করিতে পারি, জন্ম সার্থক জ্ঞান করিব।
পরিচারিকার উক্তি শুনিয়া ও ভক্তি দেখিয়া, লঞ্জিনে চমৎকৃত হইলেন, এবং কহিলেন, দেখ, আমার উপর তোমার যে এত দূর পর্য্যন্ত স্নেহ ও ভক্তি আছে, ইহাতে আমি কত প্রীত হইলাম, বলিতে পারি না, কিন্তু অকারণে আমি তোমার প্রাণদণ্ড হইতে দিব না, কারণ, তুমি এখানে থাকিয়া, আমার প্রাণ রক্ষা বিষয়ে, কোনও সাহায্য করিতে পারিবে না, লাভের মধ্যে আপনার প্রাণ নাশের পথ করিতেছ। অতএব তুমি অবিলম্বে এখান হইতে চলিয়া যাও, আমি এখানে লুকাইয়া আছি, যদি তুমি ইহা কাহারও নিকট ব্যক্ত না কর, তাহা হইলেই আমি যথেষ্ট উপকৃত হইব।
এইরূপে, লঞ্জিনে পরিচারিকাকে অনেক প্রকারে বুঝাইলেন, সে কোনও ক্রমেই তাঁহাকে পরিত্যাগ করিয়া যাইতে সম্মত হইল না। তিনি বিনয় করিয়া বলিলেন, তথাপি সে সম্মত হইল না, তিনি বিরক্ত হইয়া ভর্ৎসনা করিলেন, তথাপি সে সম্মত হইল না, অবশেষে তিনি কুপিত হইয়া কহিলেন, আমি তোমার প্রভু, তোমায় এই আদেশ করিতেছি, অবিলম্বে আমার আলয় হইতে চলিয়া যাও। তখন সে অশ্রুপূর্ণ লোচনে কাতর বচনে কহিল, আপনি ক্ষমা করুন, প্রাণ থাকিতে আমি, এমন সময়ে, আপনাকে পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারিব না, আমি অনেক কাল আপনার পরিচর্য্যা করিয়াছি। এক্ষণে, পুরস্কারস্বরূপ এই ভিক্ষা চাহিতেছি, কৃপা করিয়া আমায় আপনার নিকটে থাকিতে দেন।
পরিচারিকার ভাব দর্শনে ও প্রার্থনা শ্রবণে, তিনি নিরতিশয় প্রীতি প্রাপ্ত হইলেন, এবং অগত্যা তাহার প্রার্থিত বিষয়ে সম্মতি প্রদান করিলেন। এ দিকে তাঁহার পলায়নসংবাদ প্রচার হইবা মাত্র, রাজপুরুষেরা বিশিষ্ট রূপে তাঁহার অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়াছিলেন, কিন্তু সেই প্রভুভক্তিপরায়ণা পরিচারিকা সকল বিষয়ে এরূপ বুদ্ধিকৌশল প্রদর্শন করিতে লাগিল যে, তিনি কোথায় লুকাইয়া আছেন, তাঁহারা কিছু মাত্র অনুধাবন করিতে পারিলেন না। অবশেষে, বিপক্ষপক্ষ অপদস্থ হওয়াতে, লঞ্জিনে প্রাণদণ্ড হইতে পরিত্রাণ পাইলেন।