ইয়ুরোপের অন্তঃপাতী সুইট্জর্লণ্ড দেশ পর্ব্বতে পরিপূর্ণ। ঐ সকল পর্ব্বতের শিখরভূমি নিরন্তর নীহারে থাকে। এজন্য ঐ দেশে শীতের অত্যন্ত প্রাদুর্ভাব। জ্যেষ্ঠের বয়স নয় বৎসর, কনিষ্ঠের বয়স ছয় বৎসর, এরূপ দুই সহোদর, নীহারের উপর দৌড়াদৌড়ি করিয়া, খেলা করিতে করিতে, এক সন্নিহিত জঙ্গলে প্রবেশ করিল, এবং ক্রমে ক্রমে, অনেক দূর যাইয়া পথ হারাইল।
সায়ংকাল উপস্থিত হইল। তদ্দর্শনে তাহারা অতিশয় শঙ্কিত ও গৃহপ্রতিগমনের নিমিত্ত নিতান্ত ব্যগ্র হইয়া পথ অনুসন্ধান করিতে লাগিল, কিন্তু কিছুই নির্ণয় করিতে না পারিয়া, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে আরম্ভ করিল।
জ্যেষ্ঠটির বয়স যেমন অল্প, তাহার বুদ্ধি ও বিবেচনা তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক হইয়াছিল। সে বিবেচনা করিল, যত চেষ্টা করি না কেন, এই জঙ্গল হইতে বাহির হইতে পারিব না, সুতরাং সে চেষ্টা করা বৃথা, এই স্থানেই রাত্রি কাটাইতে হইবে, কিন্তু নীহারের উপর শয়ন করিলে উভয়েই মরিয়া যাইব। অতএব যেখানে নীহার নাই, এমন স্থান অন্বেষণ করি। এই স্থির করিয়া, সেই বালক নীহারশূন্য স্থানের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইল। ঐ সময়ে চন্দ্রের উদয় হওয়াতে, তদীয় আলোকে, পর্ব্বতের পাদদেশে একটি ক্ষুদ্র গহবর লক্ষিত হইল। বালক তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিল, সেখানে কিছুমাত্র নীহার নাই। তখন সে, কতকগুলি শুষ্ক পর্ণ সংগ্রহ করিয়া, তদ্দ্বারা একপ্রকার শয্যা প্রস্তুত করিল, পরে কনিষ্ঠ ভ্রাতার হস্ত ধরিয়া কহিল, ভাই, আর কাঁদিও না, তোমার কোনও ভয় নাই, এস, এইখানে শয়ন কর।
ইহা কহিয়া, কনিষ্ঠকে শয়ন করাইয়া, আপনিও তাহার পার্শ্বে শয়ন করিল। কনিষ্ঠ বারংবার কহিতে লাগিল, দাদা, বড় শীত। জ্যেষ্ঠ, কনিষ্ঠ ভাইটিকে অত্যন্ত ভাল বাসিত, এবং তাহার কোনও কষ্ট দেখিলে, সে অত্যন্ত কষ্ট বোধ করিত, এক্ষণে, কি উপায়ে তাহার শীতনিবারণ হয়, অনন্যমনে তাহাই চিন্তা করিতে লাগিল, অবশেষে, অন্য কোনও উপায় না দেখিয়া, আপন গাত্র হইতে সমুদয় বস্ত্র খুলিয়া, তাহার গাত্রে দিল, এবং পাছে তাহাতেও তাহার শীত নিবাবণ না হয়, এই ভাবিয়া, স্বয়ং তাহার গাত্রের উপর শয়ন করিল।
এইরূপে, নিজের ও জ্যেষ্ঠের বস্ত্রে আবৃত হওয়াতে ও জ্যেষ্ঠের গাত্রের উত্তাপ পাওয়াতে কনিষ্ঠের অনেক শীত নিবারণ হইল, তখন সে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছন্দ বোধ করিল। তদ্দর্শনে জ্যেষ্ঠের হৃদয় আহ্লাদে পরিপূর্ণ হইল, নিজে অনাবৃত গায়ে থাকাতে, তাহার যে ভয়ঙ্কর কষ্ট হইতেছিল, তাহাকে কষ্ট বলিয়া গণ্য করিল না। যদি তাহারা এই ভাবে অধিকক্ষণ থাকিত, তাহা হইলে অগ্রে জ্যেষ্ঠের, ও কিয়ৎক্ষণ পরে কনিষ্ঠের, নিঃসন্দেহ প্রাণবিয়োগ হইত, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তাহা ঘটিতে পারিল না।
সন্ধ্যার পর কিয়ৎকাল পর্য্যন্ত, তাহারা গৃহে প্রতিগত না হওয়াতে, তাহাদের পিতা ও মাতা অতিশয় চিন্তিত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে, তাহাদের পিতা অন্বেষণে নির্গত হইলেন, এবং ইতস্ততঃ অনেক অনুসন্ধান করিয়া অবশেষে সেই গহ্বরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, তাহারা শয়ন করিয়া আছে। তিনি তাহাদের বিষয়ে একপ্রকার হতাশ হইয়াছিলেন, এক্ষণে তাহাদিগকে দেখিতে পাইয়া, আহ্লাদে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিলেন। তাহার নয়নে আনন্দাশ্রুধারা বহিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে, তিনি তাহাদিগকে পর্ণশয্যা হইতে উঠাইলেন, এবং প্রথমতঃ যথোচিত তিরস্কার করিলেন, পরে, কিরূপে জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠের কষ্ট নিবারণের চেষ্টা করিয়াছিল, ইহা অবগত হইয়া, যার পর নাই আনন্দিত হইলেন, এবং জ্যেষ্ঠের ভ্রাতৃস্নেহের আতিশয্য দর্শনে পুলকিত হইয়া, তাহার প্রতি যৎপরোনাস্তি স্নেহ ও অনুরাগ প্রদর্শন পূর্ব্বক তাহাদিগকে সমভিব্যাহারে লইয়া, সত্বর গৃহে প্রতিগমন করিলেন।