বিজ্ঞাপন
এ দেশে বহুবিবাহপ্রথা প্রচলিত থাকাতে, স্ত্রীজাতির যৎপরোনাস্তি ক্লেশ ও সমাজের বহুবিধ অনিষ্ট হইতেছে। রাজশাসন ব্যতিরেকে, সেই ক্লেশের ও সেই অনিষ্টের নিবারণ সম্ভাবনা নাই। এজন্য, দেশস্থ লোকে, সময়ে সময়ে, এই কুৎসিত প্রথার নিবারণপ্রার্থনায়, রাজদ্বারে আবেদন করিয়া থাকেন। প্রথমতঃ, ১৬ বৎসর পূর্ব্বে, শ্রীযুত বাবু কিশোরীচাঁদ মিত্র মহাশয়ের উদ্যোগে, বন্ধুবৰ্গসমবায়নামক সভা হইতে ভারতবর্ষীয় ব্যবস্থাপক সমাজে এক আবেদনপত্র প্রদত্ত হয়। বহুবিবাহ শাস্ত্রসম্মত কার্য্য, তাহা রহিত হইলে হিন্দুদিগের ধর্ম্মলোপ হইবেক, অতএব এ বিষয়ে গবর্ণমেণ্টের হস্তক্ষেপ করা বিধেয় নহে, এই মর্ম্মে প্রতিকুল পক্ষ হইতেও এক আবেদনপত্র প্রদত্ত হইয়াছিল। ঐ সময়ে, এই দুই আবেদনপত্রপ্রদান ভিন্ন, এ বিষয়ের অন্য কোনও অনুষ্ঠান দেখিতে পাওয়া যায় নাই।
২। দুই বৎসর অতীত হইলে, বৰ্দ্ধমান, নবদ্বীপ, দিনাজপুর, নাটোর, দিঘাপতি প্রভৃতি স্থানের রাজার ও দেশস্থ প্রায় যাবতীয় প্রধান লোকে, বহুবিবাহনিবারণপ্রার্থনীয়, ব্যবস্থাপক সমাজে আবেদনপত্র প্রদান করেন। এই সময়ে, দেশস্থ লোকে এ বিষয়ে একমত হইয়াছিলেন, বলা যাইতে পারে। কারণ, নিবারণপ্রার্থনায় প্রায় সকল স্থান হইতেই আবেদনপত্র আসিয়াছিল, তদ্বিষয়ে প্রতিকূলকথা কোনও পক্ষ হইতে উচ্চারিত হয় নাই। লোকান্তরবাসী সুপ্রসিদ্ধ বাবু রমাপ্রসাদ রায় মহাশয়, এই সময়ে, এই কুৎসিত প্রথার নিবারণবিষয়ে যেরূপ যত্নবান হইয়াছিলেন, এবং নিরতিশয় উৎসাহসহকারে অশেষপ্রকারে যেরূপ পরিশ্রম করিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহাকে সহস্ৰ সাধুবাদ প্রদান করিতে হয়। ব্যবস্থাপক সমাজ বহুবিবাহনিবারণী ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করবেন, সে বিষয়ে সম্পূর্ণ আশ্বাস জন্মিয়াছিল। কিন্তু, এই হতভাগ্য দেশের দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই সময়ে রাজবিদ্রোহ উপস্থিত হইল। রাজপুরুষের বিদ্রোহনিবারণবিষয়ে সম্পূর্ণ ব্যাপৃত হইলেন; বহুবিবাহনিবারণবিষয়ে আর তাঁহাদের মনোযোগ দিবার অবকাশ রহিল না।
৩। এইরূপে এই মহোদ্যোগ বিফল হইয়া যায়। তৎপরে, বারাণসীনিবাসী অধুনা লোকান্তরবাসী রাজা দেবনারায়ণ সিংহ মহোদয় বহুবিবাহ নিবায়ণবিষয়ে অত্যন্ত উৎসাহী ও উদ্যোগী হইয়াছিলেন। এই সময়ে, উদারচরিত রাজাবাহাদুর ভারতবর্ষীয় ব্যবস্থাপক সমাজের সভ্য ছিলেন। তিনি নিজে সমাজে এ বিষয়ের উত্থাপন করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন। তদনুসারে তদ্বিষয়ক উদ্যোগও হইতেছিল। কিন্তু, আক্ষেপের বিষয় এই, তাঁহার ব্যবস্থাপক সমাজে উপবেশন করিবার সময় অতীত হইয়া গেল; সুতরাং, তথায় তাঁহার অভিপ্রেত বিষয়ের উথাপন করিবার সুযোগ রহিল না।
৪। পাঁচ বৎসর অতিক্রান্ত হইল, পুনরায় বহুবিবাহনিবারণের উদ্যোগ হয়। ঐ সময়ে, বর্ধমান, নবদ্বীপ প্রভৃতির রাজা, দেশের অন্যান্য ভুম্যধিকারিগণ, তদ্ব্যতিরিক্ত অনেকানেক প্রধান মনুষ্য, এবং বহুসংখ্যক সাধারণ লোক, একমতাবলম্বী হইয়া, এ দেশের তৎকালীন লেপ্টেনেণ্ট গবর্ণর শ্রীযুত সর সিসিল বীডন মহোদয়ের নিকট আবেদনপত্র প্রদান করেন। মহামতি সর সিসিল বীডন, আবেদনপত্র পাইয়া, এ বিষয়ে বিলক্ষণ অনুরাগ প্রকাশ ও অনুকূল বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন; এবং যাহাতে বহুবিবাহনিবারণী ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ হয়, তদুপযোগী উদ্যোগও দেখিতেছিলেন। কিন্তু, উপরিস্থ কর্তৃপক্ষের অনভিপ্রায় বশতঃ, অথবা কি হেতু বশতঃ বলিতে পারা যায় না, তিনি এতদ্বিষয়ক উদ্যোগ হইতে বিরত হইলেন।
৫। শেষবার আবেদনপত্র প্রদত্ত হইলে, কোনও কোনও পক্ষ হইতে আপত্তি উত্থাপিত হইয়াছিল। সেই সকল আপতির মীমাংসাকরা উচিত ও আবশ্যক বোধ হওয়াতে, এই পুস্তক মুদ্রিত হইতে আরম্ভ হয়। কিন্তু, এ বিষয় আপাততঃ স্থগিত রহিল, এবং আমিও, ঐ সময়ে অতিশয় পীড়িত হইয়া, কিছু কালের জন্য শয্যাগত হইলাম; সুতরাং তৎকালে পুস্তক মুদ্রিত করিবার তাদৃশ আবশ্যকতাও রহিল না, আর, তাহা সম্পন্ন করিয়া উঠি, আমার তাদৃশ ক্ষমতাও ছিল না। এই দুই কারণ বশতঃ, পুস্তক এত দিন অর্দ্ধমুদ্রিত অবস্থায় কালযাপন করিতেছিল।
৬। সম্প্রতি শুনিতেছি, কলিকাতাস্থ সনাতনধর্মরক্ষিণী সভা বহুবিবাহনিবারণবিষয়ে বিলক্ষণ উদযোগী হইয়াছেন; তাঁহাদের নিতান্ত ইচ্ছা, এই অতিজঘন্য, অতিনৃশংস প্রথা রহিত হইয়া যায়। এই প্রথা নিবারিত হইলে, শাস্ত্রের অবমাননা ও ধর্ম্মের ব্যতিক্রম ঘটিবেক কি না, এই আশঙ্কার অপনয়নার্থে, সভার অধ্যক্ষ মহাশয়েরা ধর্ম্মশাস্ত্রব্যবসায়ী প্রধান প্রধান পণ্ডিতের মত গ্রহণ করিতেছেন, এবং রাজদ্বারে আবেদন করিবার অপরাপর উদযোগ দেখিতেছেন। তাঁহারা, সদভিপ্রায়প্রণোদিত হইয়া, যে অতি মহৎ দেশহিতকর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, হয়ত সে বিষয়ে তাঁহাদের কিছু আনুকূল্য হইতে পারিবেক, এই ভাবিয়া, আমি পুস্তক মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলাম।
৭। শেষবারের উদযোগের সময়, কেহ কেহ কহিয়াছিলেন, রাজপুরুষেরা পরামর্শ দিয়া, কোনও ব্যক্তিকে এ বিষয়ে প্রবৃত্ত করিয়াছেন, তাহাতেই বহুবিবাহনিবারণপ্রার্থনায় আবেদনপত্র প্রদত্ত হইয়াছে। কেহ কেহ কহিয়াছিলেন, যাহাদের উদযোগে আবেদনপত্র প্রদত্ত হইয়াছে; তাহারা হিন্দুধর্ম্মদ্বেষী, হিন্দুধর্ম্ম লোপ করিবার অভিপ্রায়ে এই উদযোগ করিয়াছে। কিন্তু, সনাতনধর্ম্মরক্ষিণী সভার এই উদযোগে তাদৃশ অপবাদপ্রবর্ত্তনের অণুমাত্র সম্ভাবনা নাই। যাহাতে এ দেশে হিন্দুধর্ম্মের রক্ষা হয়, সেই উদ্দেশে সনাতনধর্ম্মরক্ষিণী সভা সংস্থাপিত হইয়াছে। ঈদৃশ সভার অধ্যক্ষেরা, রাজপুরুষদিগের উপদেশের বশবর্ত্তী হইয়া, হিন্দুধর্ম্ম লোপের জন্য, এই উদযোগ করিয়াছেন, নিতান্ত নির্ব্বোধ ও নিতান্ত অনভিজ্ঞ না হইলে, কেহ এরূপ কহিতে পারিবেন না। তবে, প্রস্তাবিত দেশহিতকর বিষয়মাত্রে প্রতিপক্ষতা করা যাঁহাদের অভ্যাস ও ব্যবসায়, তাঁহারা কোনও মতে ক্ষান্ত থাকিতে পারিবেন না। তাঁহারা, এরূপ সময়ে, উন্মত্তের ন্যায় বিক্ষিপ্তচিত্ত হইয়া উঠেন; এবং, যাহাতে প্রস্তাবিত বিষয়ের ব্যাঘাত ঘটে, স্বতঃ পরতঃ সে চেষ্টার ত্রুটি করেন না। ঈদৃশ ব্যক্তিরা সামাজিক দোষসংশোধনের বিষম বিপক্ষ। তাঁহাদের অদ্ভুত প্রকৃতি ও অদ্ভুত চরিত্র; নিজেও কিছু করিবেন না, অন্যকেও কিছু করিতে দিবেন না। তাঁহারা চিরজীবী হউন।
৮॥ এ বিষয়ে যেরূপ ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ হওয়া আবশ্যক, রাজা দেবনারায়ণ সিংহ মহোদয়ের উদযোগের সময়, তাহার পাণ্ডুলেখ্য প্রস্তুত হইয়াছিল। ঐ পাণ্ডুলেখ্য, বিধিবদ্ধ হইয়া, এতৎপ্রদেশীয় হিন্দুসমাজের বহুবিবাহবিষয়ক ব্যবস্থারূপে প্রবর্ত্তিত হইলে, দেশের ও সমাজের মঙ্গল ভিন্ন, কোনও প্রকার অমঙ্গল বা অসুবিধা ঘটতে পারে, এরূপ বোধ হয় না। পাণ্ডুলেখ্য পুস্তকের পরিশিষ্টে মুদ্রিত হইল।
৯। পরিশেষে, সনাতনধর্মরক্ষিণী সভার নিকট প্রার্থনা এই, যখন তাঁহারা এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিয়াছেন, সবিশেষ যত্ন ও যথোচিত চেষ্টা না করিয়া যেন ক্ষান্ত না হয়েন। তাঁহারা কৃতকার্য্য হইতে পারিলে, দেশের ও সমাজের যে, যার পর নাই, হিতসাধন হইবেক, তাহা বলা বাহুল্যমাত্র; সেরূপ সংস্কার না জন্মিলে, তাঁহারা কদাচ এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতেন না। বহুবিবাহপ্রথা প্রচলিত থাকাতে, সমাজে যে মহীয়সী অনিষ্টপরম্পরা ঘটিতেছে, তদ্দর্শনে তদীয় অন্তঃকরণে বহুবিবাহবিষয়ে ঘৃণা ও দ্বেষ জন্মিয়াছে; সেই ঘৃণা প্রযুক্ত, সেই দ্বেষ বশতঃ, তাঁহারা তন্নিবারণবিষয়ে উদযোগী হইয়াছেন, তাহার সংশয় নাই।
শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা।
কাশীপুর।
১লা শ্রাবণ। সংবৎ ১৯২৮।
.
বহুবিবাহ
স্ত্রীজাতি অপেক্ষাকৃত দুর্ব্বল ও সামাজিকনিয়মদোষে পুৰুষজাতির নিতান্ত অধীন। এই দুর্বলতা ও অধীনতা নিবন্ধন, তাঁহারা পুরুষ-জাতির নিকট অবনত ও অপদস্থ হইয়া কালহরণ করিতেছেন প্রভুতা-পন্ন প্রবল পুরুষজাতি, যদৃচ্ছাপ্রবৃত্ত হইয়া, অত্যাচার ও অন্যায়াচরণ করিয়া থাকেন, তাঁরা নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, সেই সমস্ত সহ্য করিয়া জীবনযাত্রা সমাধান করেন। পৃথিবীর প্রায় সর্ব প্রদেশেই স্ত্রীজাতির ঈদৃশী অবস্থা। কিন্তু, এই হতভাগ্য দেশে, পুৰুষজাতির নৃশংসতা, স্বার্থপরতা, অবিমৃশ্যকারিতা প্রভৃতি দোষের আতিশয্য বশতঃ, স্ত্রীজাতির যে অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহা অন্যত্র কুত্রাপি লক্ষিত হয় না। অত্রত্য পুৰুষজাতি, কতিপয় অতিগহিত প্রথার নিতান্ত বশবর্তী হইয়া, হতভাগা স্ত্রীজাতিকে অশেষবিধ যাতনাপ্রদান করিয়া আসিতেছেন। তন্মধ্যে, বহুবিবাহপ্রথা এক্ষণে সর্বাপেক্ষা অধিকতর অনিষ্টকর হইয়া উঠিয়াছে। এই অতিজঘন্য অতিনৃশংস প্রথা প্রচলিত থাকাতে, স্ত্রীজাতির দুরবস্থার ইয়ত্তা নাই। এই প্রথার প্রবল যুক্ত, তাঁহাদিগকে যে সমস্ত ক্লেশ ও যাতনা ভোগ করিতে হইতেছে, তৎসমুদায় আলোচনা করিয়া দেখিলে, হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়। ফলতঃ, এতম্মুলক অত্যাচার এত অধিক ও এত অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে যে . যাঁহাদের কিঞ্চিত্র হিতাহিতবোধ ও সদসদ্বিবেকশক্তি আছে, তাদৃশ ব্যক্তিমাত্রেই এই প্রথার বিষম বিদ্বেষী হইয়া উঠিয়াছেন। তাঁহাদের আন্তরিক ইচ্ছা, এই প্রথা এই দণ্ডে রহিত হইয়া যায়। অধুনা এ দেশের যেরূপ অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাতে রাজশাসন ব্যতিরেকে, ঈদৃশ দেশব্যাপক দোষ নিবারণের উপায়ান্তর নাই। এজন্য, অনেকে উদ্যুক্ত হইয়া, অশেষদোষাস্পদ বহুবিবাহ প্রথা নিবারণের নিমিত্ত, রাজদ্বারে আবেদন করিয়াছেন। এ বিষয়ে কোনও কোনও পক্ষ হইতে আপত্তি উত্থাপিত হইতেছে। যথাশক্তি সেই সকল আপত্তির উত্তর প্রদানে প্রবৃত্ত হইতেছি।