১৫. পঞ্চদশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

ভারতবর্ষের উত্তর সীমায়, হিমালয় নামে, অতি প্ৰসিদ্ধ পৰ্বত আছে। তাহার প্রস্থদেশে, পুষ্পপুর নামে, পরম রমণীয় নগর ছিল। গন্ধৰ্বরাজ জীমূতকেতু ঐ নগরে রাজত্ব করিতেন। তিনি, পুত্ৰকামনা করিয়া, বহু কাল, কল্পবৃক্ষের আরাধনা করিয়াছিলেন। কল্পবৃক্ষ প্রসন্ন হইয়া বরপ্রদান করিলে, রাজা জীমূতকেতুর এক পুত্র জন্মিল। তিনি পুত্রের নাম জীমূতবাহন রাখিলেন। জীমূতবাহন, স্বভাবতঃ, সাতিশয় ধর্মশীল, দয়াবান, ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন; এবং, স্বল্প পরিশ্রমে, স্বল্পকাল মধ্যে, সর্ব শাস্ত্রে পারদর্শী ও শস্ত্রবিদ্যায় বিশারদ হইয়া উঠিলেন।

কিয়ৎ কাল পরে, রাজা জীমূতকেতু, পুনরায় কল্পবৃক্ষকে প্রসন্ন করিয়া, এই বরপ্রার্থনা করিলেন, আমার প্রজারা সর্বপ্রকার সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ হউক। কল্পবৃক্ষের বরদান দ্বারা, তদীয় প্রজাবৰ্গ সর্বপ্রকার সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ হইল, এবং ঐশ্বৰ্যমদে মত্ত হইয়া, রাজাকেও তৃণজ্ঞান করিতে লাগিল। ফলতঃ, অল্পকালমধ্যে, রাজা ও প্রজা বলিয়া, কোনও অংশে, কোনও বিশেষ রহিল না। তখন, জীমূতকেতুর জ্ঞাতিবর্গ গোপনে পরামর্শ করিল, ইহার পিতাপুত্রে, অনন্যমন ও অনন্যকর্ম হইয়া, দিবানিশি, কেবল ধর্মচিন্তায় কালযাপন করিতেছে; রাজ্যের দিকে ক্ষণমাত্রও দৃষ্টিপাত করে না। প্ৰজা সকল উচ্ছৃঙ্খল হইতে লাগিল। অতএব, ইহাদের উভয়কে রাজ্যচ্যুত করিয়া, যাহাতে উপযুক্তরূপ রাজ্যশাসন হয়, এরূপ ব্যবস্থা করা উচিত। অনন্তর, বহুতর সৈন্যসংগ্রহপূর্বক, তাহার রাজপুরীর চতুর্দিক নিরুদ্ধ করিল।

এই ব্যাপার দেখিয়া, যুবরাজ জীমূতবাহন পিতার নিকট নিবেদন করিলেন, মহারাজ! জ্ঞাতিবর্গ, একবাক্য হইয়া, আমাদিগকে রাজ্যচ্যুত করিবার অভিসন্ধিতে, এই উদ্যোগ করিয়াছে। আপনকার আজ্ঞা পাইলে, রণক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইয়া, বিপক্ষপক্ষের সৈন্যক্ষয় ও সমুচিত দণ্ডবিধান করি।

জীমূতকেতু কহিলেন, এই ক্ষণভঙ্গুর পাঞ্চভৌতিক দেহ অতি অকিঞ্চিৎকর; বিনশ্বর রাজপদের নিমিত্ত, বহুসংখ্যক জীবের প্রাণহিংসা করিয়া, মহাপাপে লিপ্ত হওয়া উচিত নহে। ধর্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির, আত্মীয়গণের কুমন্ত্রণায়, কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া, পশ্চাৎ অনেক অনুতাপ করিয়াছিলেন। অতএব, রাজপদপরিত্যাগ করিয়া, কোনও নিভৃত স্থানে গিয়া, প্রশান্ত মনে, দেবতার আরাধনা করা ভাল। এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া, পিতাপুত্রে নগর হইতে বহির্গত হইলেন; এবং, মলয় পর্বতে গিয়া, তদীয় অধিত্যকায় কুটীরনির্মাণপূর্বক, তপস্যা করিতে লাগিলেন।

এক ঋষিকুমারের সহিত, রাজকুমারের অতিশয় বন্ধুত্ব জন্মিল। এক দিন, দুই বন্ধুতে একত্র হইয়া ভ্ৰমণার্থে নিৰ্গত হইলেন। অনতিদূরে কাত্যায়নীর মন্দির ছিল; শ্রবণমনোহর বীণা শব্দ শ্রবণগোচর করিয়া, তাঁহারা, কৌতুকাবিষ্ট চিত্তে, সত্বর গমনে, তথায় উপস্থিত হইয়া, দেখিলেন, এক পরম সুন্দরী কন্যা, বীণানুগত স্তুতিগর্ভ গীত দ্বারা, ভগবতী কাত্যায়নীর উপাসনা করিতেছে। উভয়ে, একতানমন হইয়া, শ্রবণ ও দর্শন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, সেই কন্যা, জীমূতবাহনকে নয়নগোচর করিয়া, মনে মনে তাঁহাকে পতিত্বে বরণ, এবং স্বীয় সহচরী দ্বারা তাঁহার নাম, ধাম, ব্যবসায় প্রভৃতির পরিচয়গ্রহণপূর্বক, প্ৰস্থান করিল।

অনন্তর, তাহার সহচরী, তদীয় নির্দেশক্রমে, তাহার মাতার নিকট পূর্বাপর সমস্ত নিবেদন করিলে, তিনি স্বীয় পতি রাজা মলয়কেতুর নিকটে কন্যার অভিপ্রায় ব্যক্তি করিলেন। মলয়কেতু আপন পুত্র মিত্ৰা বসুকে কহিলেন, তোমার ভগিনী বিবাহযোগ্য হইয়াছে; আর নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নহে; উপযুক্ত পাত্রের অন্বেষণ করা আবশ্যক। শুনিলাম, গন্ধৰ্বাধিপতি রাজা জীমূতকেতু, রাজ্যাধিকারপরিহারপূর্বক, নিজ পুত্ৰ জীমূতবাহন মাত্র সমভিব্যাহারে, মলয়াচলে অবস্থিতি করিতেছেন। আমার অভিপ্রায়, জীমূতবাহনকে কন্যাদান করি। তুমি, রাজা জীমূতকেতুর নিকটে গিয়া, আমার এই অভিপ্ৰায় তাহার গোচয় কর।

মিত্রাবসু, পিতার আদেশ অনুসারে, জীমূতকেতুর সমীপে উপস্থিত হইয়া, সবিশেষ সমস্ত বিজ্ঞাপন করিলে, তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন; এবং, জীমূতবাহনকে, মিত্রাবসুর সমভিব্যাহারে, মলয়কেতুর নিকটে পাঠাইয়া দিলেন। মলয়কেতু, শুভ লগ্নে, স্বীয় কন্যা মলয়াবতীর বিবাহকাৰ্য সম্পন্ন করিলেন। বর ও কন্যা, পরম সুখে, কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।

এক দিন, জীমূতবাহন ও মিত্রাবসু, উভয়ে, মলয় মহীধরের পরিসরে, পরিভ্রমণবাসনায়, বাসস্থান হইতে বহির্গত হইলেন। ভূধরের উত্তর ভাগে উপস্থিত হইয়া, দূর হইতে এক শ্বেতবর্ণ বস্তুরাশি নয়নগোচর করিয়া, জীমূতবাহন মিত্রাবসুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য। গণ্ডশৈলের ন্যায়, ধবলবৰ্ণ, রাশীকৃত কি বস্তু দৃষ্ট হইতেছে। মিত্ৰাবসু কহিলেন, মিত্র। পূর্ব কালে, গরুড়ের সহিত, নাগগণের নিরন্তর ঘোরতর যুদ্ধ হইয়াছিল। কিয়ৎ কাল পরে, নাগেরা, সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইয়া, সন্ধিপ্রার্থনা করিলে, গরুড় কহিলেন, যদি তোমরা, আমার দৈনন্দিন আহারের নিমিত্ত, এক এক নাগ উপহার দিতে পার, তাহা হইলে আমি তোমাদের প্রার্থনায় সম্মত হই; নতুবা, অবিলম্বে নাগকুল নিঃশেষ করিব। নিরুপায় নাগেরা, তাহাতেই সন্মত হইল। তদবধি, প্রতিদিন, এক এক নাগ, পাতাল হইতে আসিয়া, ঐ স্থানে উপস্থিত থাকে; গরুড়, মধ্যাহ্নকালে আসিয়া, ভক্ষণ করেন। এইরূপে, ভক্ষিত নাগগণের অস্থি দ্বারা, ঐ পর্বতাকার ধবলরাশি প্রস্তুত হইয়াছে।

শ্রবণমাত্র, জীমূতবাহনের অন্তঃকরণ কারুণ্যরসে পরিপূর্ণ হইল। তখন তিনি মনে মনে বিবেচনা করিলেন, মধ্যাহ্নকাল আগতপ্ৰায়; অবশ্যই এক নাগ, গরুড়ের আহারার্থে, পৰ্যায়ক্রমে, উপস্থিত হইবেক; আমি, আপন প্ৰাণ দিয়া, তাহার প্রাণরক্ষা করিব। অনন্তর, কৌশলক্রমে শ্যালককে বিদায় করিয়া, ক্ৰমে ক্রমে অস্থিরাশির নিকটবর্তী হইয়া, জীমূতবাহন রোদনশব্দশ্রবণ করিলেন; এবং, সত্বর গমনে, রোদনস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, এক বৃদ্ধা নাগী, শিরে করাঘাতপূর্বক, হাহাকার ও উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতেছে। দেখিয়া, একান্ত শোকাক্রান্ত হইয়া, তিনি কাতর বচনে নাগীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মা! তুমি কি নিমিত্তে রোদন করিতেছ। সে গরুড়বৃত্তান্তের বর্ণন করিয়া কহিল, অন্য আমার পুত্র শঙ্খচূড়ের বার; ক্ষণকাল পরেই, গরুড় আসিয়া, আহারার্থে তাহার প্রাণসংহার করিবেক। আমার দ্বিতীয় পুত্র নাই। আমি, সেই দুঃখে দুঃখিত হইয়া, রোদন করিতেছি। জীমূতবাহন কহিলেন, মা আর রোদন করিও না; আমি, আপন প্রাণ দিয়া, তোমার পুত্রের প্রাণরক্ষা করিব। নাগী কহিল, বৎস! তুমি, কি কারণে, পরের জন্যে প্রাণত্যাগ করিবে। আর, পরের পুত্রের প্রাণ দিয়া, আপন পুত্রের প্রাণরক্ষা করিলে, আমারও ঘোরতর অধৰ্ম ও যার পর নাই অপযশ হইবেক।

এইরূপে উভয়ের কথোপকথন হইতেছে, ইত্যবসরে শঙ্খচূড়ও তথায় উপস্থিত হইল; এবং, জীমূতবাহনের অভিসন্ধি শুনিয়া, তাহার পরিচয়গ্ৰহণপূর্বক, বিশেষজ্ঞ হইয়া কহিল, মহারাজ। আপনি অন্যায় আজ্ঞা করিতেছেন। বিবেচনা করিয়া দেখুন, আমার মত কত শত ব্যক্তি সংসারে জন্মিতেছে ও মরিতেছে; কিন্তু, আপনকার ন্যায় ধর্মাত্মা দয়ালু সংসারে সর্বদা জন্মগ্রহণ করেন না। অতএব, আমার পরিবর্তে, আপনকার প্রাণত্যাগ করা, কোনও ক্রমে, উচিত নহে। আপনি জীবিত থাকিলে, লক্ষ লক্ষ লোকের মহোপকার হইবেক। আমি জীবিত থাকিয়া, কোনও কালে, কাহারও কোনও উপকার করিতে পারিব না। মাদৃশ্য ব্যক্তির জীবন মরণ দুই তুল্য।

জীমূতবাহন কহিলেন, শুন শঙ্খচূড়। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, আপন প্রাণ দিয়া, তোমার প্রাণরক্ষা করিব। আমি ক্ষত্ৰিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছি; ক্ষত্ৰিয়েরা, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ অপেক্ষা, প্রাণত্যাগ অতি লঘু ও সহজ জ্ঞান করেন। বিশেষতঃ, প্ৰাণস্নেহে প্ৰতিজ্ঞাপ্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইলে, নরকগামী হইতে হয়। অতএব, যখন স্বমুখে ব্যক্ত করিয়াছি, তখন অবশ্যই প্ৰাণ দিয়া, তোমার প্রাণরক্ষা করিব; তুমি স্বস্থানে প্রস্থান কর। এইরূপ বলিয়া, তিনি শঙ্খচূড়কে বিদায় করিলেন; এবং তদীয় প্রতিশীর্ষ হইয়া, গরুড়ের আগমনপ্রতীক্ষায়, নির্দ্দিষ্ট স্থানে উপবিষ্ট রহিলেন। শঙ্খচূড়, জীমূতবাহনের নির্বন্ধলঙ্ঘনে অসমর্থ হইয়া, বিষন্ন মনে, বিরস বদনে, মলয়াচলবাসিনী কাত্যায়নীর সম্মুখে উপস্থিত হইল; এবং, একাগ্ৰচিত্ত হইয়া, জীবনদাতা জীমূতবাহনের জীবনরক্ষণের উপায়প্রার্থনা করিতে লাগিল।

নিরূপিত সময় উপস্থিত হইলে, গরুড় আসিয়া, চঞ্চুপুট দ্বারা জীমূতবাহনগ্রহণপূর্বক, নভোমণ্ডলে উড্ডীন হইয়া, মণ্ডলাকারে ভ্রমণ করিতে লাগিল। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, জীমূতবাহনের দক্ষিণবাহুস্থিত নামাঙ্কিত মণিময় কেয়ুর, শোণিতলিপ্ত হইয়া, মলয়াবতীর সম্মুখে পতিত হইল। মলয়াবতী, নামাক্ষরপরিচয় দ্বারা, প্রিয়তমের প্রাণাত্যয় স্থির করিয়া, শিরে করাঘাতপূর্বক, ভূতলে পতিত হইয়া, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। তাহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, কেয়ুর দর্শনে সাতিশয় বিষন্ন হইয়া, হাহাকার করিতে লাগিলেন। রাজা মলয়কেতু, চতুর্দিকে বহুসংখ্যক লোক প্রেরিত করিয়া, পরিশেষে স্বয়ং, পুত্ৰ সহিত, জীমূতবাহনের অন্বেষণে নির্গত হইলেন।

শঙ্খচূড়, কাত্যায়নীর আলয় হইতে, রাজপরিবারের কোলাহলশ্রবণ করিয়া, সবিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা, জীমূতবাহনের অমঙ্গলবৃত্তান্ত অবগত হইয়া, অশ্রুপূর্ণ নয়নে পূর্বস্থানে উপস্থিত হইল; এবং, গরুড়কে সম্বোধন করিয়া, উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিল, অহে বিহঙ্গরাজ! তুমি, শঙ্খচূড়ক্রমে, রাজা জীমূতবাহনকে লইয়া গিয়াছ; উনি তোমার ভক্ষ্য নহেন। আমার নাম শঙ্খচূড়; অদ্য আমার বার। তুমি, তাহারে পরিত্যাগ করিয়া, আমায় ভক্ষণ কর; নতুবা, তোমায় সাতিশয় অধৰ্মগ্ৰস্ত হইতে হইবেক।

গরুড় শুনিয়া অতিশয় শঙ্কিত হইলেন; এবং মৃতকল্প জীমূতবাহনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, অহে মহাপুরুষ! তুমি কে, কি নিমিত্তে প্ৰাণদানে উদ্যত হইয়াছ। জীমূতবাহন আত্মপরিচয়প্রদানপূর্বক, কহিলেন, অদ্য বা অশব্দতান্তে, অবশ্যই মৃত্যু ঘটিবেক। যে ব্যক্তি, ক্ষণবিধ্বংসী তুচ্ছ শরীরের বিনিয়োগ দ্বারা, পরোপকার করিয়া, দিগন্তব্যাপিনী ও অনন্তকালস্থায়িনী কীর্তি উপার্জন করে, তাহারই এই সংসারে জন্মগ্রহণ সার্থক; নতুবা, স্বোদরপরায়ণ কাক, কুকুর, শৃগাল প্রভৃতি হইতে বিশেষ কি। এই বিবেচনায়, আমি, আত্মপ্রাণব্যয় দ্বারা, শঙ্খচূড়ের প্রাণরক্ষা করিতে আসিয়াছি। গরুড় শুনিয়া, যার পর নাই, সন্তুষ্ট হইলেন, এবং জীমূতবাহনকে শত শত সাধুবাদপ্রদান করিয়া কহিলেন, জগতে জীবমাত্রেই স্ব স্ব প্রাণরক্ষায় যত্নবান। কিন্তু, আপন প্ৰাণ দিয়া, পরের প্রাণরক্ষা করে, এরূপ ব্যক্তি অতি বিরল। যাহা হউক, আমি তোমার দয়া ও সাহস দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি; বরপ্রার্থনা কর।

জীমূতবাহন কহিলেন, খগেশ্বর। যদি প্রসন্ন হইয়া থাক, এই বর দাও, তুমি অতঃপর আর নাগহিংসা করিবে না; এবং, দীর্ঘ কাল ভক্ষণ করিয়া, যে অসংখ্য নাগের প্রাণসংহার করিয়াছ, তাহদেরও জীবনদান কর। গরুড়, তথাস্তু বলিয়া, তৎক্ষণাৎ পাতাল হইতে অমৃত আহরণপূর্বক, অস্থিস্তূপের উপর সেচন করিয়া, মৃত নাগগণের জীবনদান করিলেন, এবং জীমূতবাহনকে কহিলেন, রাজকুমার! আমার প্রসাদে, তোমাদের অপহৃত রাজ্যের পুনরুদ্ধার হইবেক। এইরূপ বরপ্রদান করিয়া, গরুড় অন্তহিত হইলে, শঙ্খচূড়ও জীমূতবাহনের বহুবিধ স্তুতি করিয়া, বিদায় লইয়া, স্বস্থানে প্রস্থান করিল।

জীমূতবাহন, এইরূপ বরলাভে চরিতার্থ হইয়া, পিতৃসমীপে উপস্থিত হইলেন; এবং, লোক দ্বারা, শ্বশুরালয়ে স্বীয় মঙ্গলসংবাদ পাঠাইয়া দিলেন। তাঁহাদের রাজ্যাপহারক জ্ঞাতিবর্গ, বরপ্রদানবৃত্তান্ত অবগত হইয়া, রাজা জীমূতকেতুর শরণাগত হইল; এবং, স্তুতি ও বিনতি দ্বারা প্রসন্ন করিয়া, তাহাকে রাজপদে পুনঃস্থাপিত করিল।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! জীমূতবাহন ও শঙ্খচূড়, এ উভয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তির অধিক ভদ্রতাপ্রকাশ হইল। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, শঙ্খচূড়ের। বেতাল কহিল, কি প্রকারে। রাজা কহিলেন, শঙ্খচূড়, জীমূতবাহনের প্রাণদান বিষয়ে, প্রথমতঃ কোনও মতে সম্মত হয় নাই; পরিশেষে, সম্মত হইয়াও, কাত্যায়নীর নিকটে গিয়া, উপকারকের মঙ্গলপ্রার্থনা করিতে লাগিল; এবং পুনরায় আসিয়া, প্রাণদানে উদ্যত হইয়া, জীমূতবাহনের প্রাণরক্ষা করিল। বেতাল কহিল, যে ব্যক্তি পরার্থে প্ৰাণদান করিল, তাহার। ভদ্রতা অধিক বলিয়া গণ্য হইল না কেন। রাজা কহিলেন, জীমূতবাহন ক্ষত্রিয়জাতি; ক্ষত্রিয়ের প্রাণত্যাগ অতি অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করে। অতএব, এই জীবনদান, জীমূতবাহনের পক্ষে, তাদৃশ দুষ্কর নহে।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।


© 2024 পুরনো বই