‘আরে যাঃ—এই ত বটে! মনে মনে প্রায় হাল ছাড়িয়া দিয়াছিলাম, বুঝি বা ইহজন্মে হাতের লেখা আর ছাপার অক্ষরে দেখা ঘটিল না!
না, তা কেন? এই যে বেশ পথের সন্ধান মিলিয়াছে। আমি ভ্রমণ-বৃত্তান্ত লিখিব। এ বুদ্ধি এতদিন আমার ছিল কোথায়? দেখি, সবাই লেখে ভ্রমণ-বৃত্তান্ত—মেয়ে পুরুষ ইহার আর অন্ত নাই, সমাপ্তি নাই। যে-কোন একখানা মাসিকপত্র খুলিলেই চোখে পড়ে—আছে রে, আছে আছে। ঐ যে! কে গিয়াছে কাশী, কে গিয়াছে খুলনা, কে গিয়াছে সিমলা-পাহাড়—অমনি ভ্রমণ-কাহিনী। যে পাহাড়ে পর্বতে উঠিয়াছে, তাহার ত কথা নাই। আর যে জল-জাহাজে চড়িয়া সমুদ্র দেখিয়া আসিয়াছে, তাহাকে ঠেকাইয়া রাখা ত একেবারে অসাধ্য!
কিন্তু এ খেয়াল আমার হইল কেন? সে কৈফিয়ত ত আগেই দিয়াছি—তা ছাড়া আরও একটা কারণ ঘটিয়াছিল।
সেদিন সন্ধ্যার পর ভুল করিয়া বার-দুই আফিং খাইয়া ফেলার দরুন রাত্রে ঠিক সেই অমৃত-মধুর নিদ্রাটুকু আসিতেছিল না। যদিচ বহুদিন হইতেই এই বস্তুটা সেবন করিতেছি, কিন্তু এমনি হতভাগ্য আমি যে, কিছুতে আফিংখোর হইয়া আর উঠিতে পারিলাম না। বলিতেও লজ্জায় ঘাড় হেঁট হইয়া যায় যে, সুদীর্ঘ চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সামান্যমাত্র ভরিখানেকের একটু বেশি পেটে গেলেও কেমন যেন একটু অস্বস্তি বোধ করি। আজও বিছানায় পড়িয়া এ-পাশ ও-পাশ করিতেছিলাম। হঠাৎ মনে পড়িল একখানা বাঙলা মাসিকপত্র চোখের সামনে মেলিয়া ধরি না কেন? যে-কোন প্রবন্ধ—ঘুমের এমন মহৌষধ ত আর নাই! তাই করিলাম। কখন ঔষধ ধরিল মনে নাই—কারণ, মনে থাকিবার জো নাই! আফিংখোরের নিদ্রা। ইহা যে অব্যক্ত, অতুলনীয়, অনির্বচনীয় ব্যাপার! ইনি যে কখন কেমন করিয়া ভক্ত-চক্ষু-পল্লবে আবির্ভূতা হন এবং কখন কি করিয়া অন্তর্হিতা হন, সে তত্ত্ব কে কবে পাইয়াছে?
আমার যিনি গুরু, যাঁর পদরেণুর যোগ্যতাও আমার নাই—তিনি ত আর আমাদের মত ফাঁকি নন; তাঁর শ্রীমুখে শুনিয়াছি, বেদ ইঁহাকে অজ্ঞেয় পরম বস্তু বলিয়া নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। পাতঞ্জলের নিগূঢ়-মর্মের সন্ধান যাঁহারা পাইয়াছেন, তাঁহারা বিদিত আছেন যে, এই চতুষ্পাদ যোগশাস্ত্রের আগাগোড়ায় ইঁহার বাহক বলিয়া আমাদিগকে মহাযোগী আখ্যা দেওয়া হইয়াছে। বস্তুতঃ, আমরা জীবন্মুক্ত! কারণ, সেই পরমানন্দের আস্বাদ উপভোগ করিয়া আমরা চিরদিনের মত ধন্য হইয়া গিয়াছি। অহোরাত্র ইহাতে লীন থাকিয়া, আমরা বিধাতা-পুরুষের ন্যায় জাগিয়া ঘুমাই এবং ঘুমাইয়া জাগি। কাজকর্মের নশ্বরতা সম্যক উপলব্ধি করিয়া আমরা নড়াচড়াকে অত্যন্ত ঘৃণা করি। আমরা শর্করা-দুগ্ধ-ঘৃতাদি সাত্ত্বিক ভোজ্য ভালবাসি এবং চেঁচামেচি, গোলমাল, হাঙ্গামা সর্বপ্রযত্নে পরিহার করিয়া চলি; এবং সেই পরম পুরুষের পদে সমস্ত চিত্ত মগ্ন করিয়া দিয়া যোগনেত্র ও স্তব্ধ হইয়া যখন আমরা মাথা ঝুঁকাইয়া ঝুঁকাইয়া তাঁহাকেই বার বার প্রণাম করিতে থাকি, বিশ্বাসবিহীন মূঢ় লোকেরা আমাদের সেই ভক্তি-নম্র নমস্কারকে ‘ঝিমানো’ বলিয়া অশ্রদ্ধা ও উপহাস করিয়া শুধু নিজেদের নিদারুণ অজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং পরলোকে কৈলাসে যাইতে পারে না।
এই হতভাগ্যদিগকে আমরা অতিশয় কৃপার চক্ষে দেখি, এবং যে ব্যক্তি আফিং ভোজন করে না, তাহার বাঁচিয়া থাকাটাকে নিছক বিড়ম্বনা বলিয়া মনে করি। যাক ইহাদের কথা। অকস্মাৎ সজাগ হইয়া দেখিলাম, হাতের ‘ভারতবর্ষ’ বুকের উপর আড় হইয়া পড়িয়া আছে, এবং বুকের ভিতরে তাহারই উত্তর হইতে দক্ষিণ এবং পূর্ব হইতে পশ্চিম, সমগ্র ভূখণ্ডটাই চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। না হইবেই বা কেন? হেন স্থান ত এই সীমাটুকুর মধ্যে নাই, যেখানে বাল্য ও যৌবনে এই চরণ-জোড়াটি মাড়াইয়া বেড়ায় নাই।
সেটা ছেলেবেলার কথা; অর্থাৎ যখন এমন সুসিদ্ধ, সুপক্ক হইয়া উঠিতে পারি নাই—শুধু চেষ্টা করিতেছি মাত্র। সেই তরুণ-দিনে একজামিন ফেল করার দরুন একবার, এবং লুকাইয়া গাঁজা খাওয়ার তুচ্ছ অপরাধে কানমলা খাইয়া আর একবার, এই মায়ামোহময় অনিত্য সংসার ত্যাগ করিয়া বাবাজী হইয়া গিয়াছিলাম। তারপরে পাহাড় জঙ্গল—সে অনেক কথা—কিন্তু, সে-সব এখন থাক। আবার বাহিরেও অনেকদূর পর্যন্ত গতিবিধি ছিল। অভ্যাসের দোষে আজ সমুদ্রটাকেও ডোবার মত দেখি। কিন্তু, এ-সব কথাতেও এখন কাজ নাই। ছেলেবেলার এই যে ছোট্ট একটু ভ্রমণ-কাহিনী বলিতে বসিয়াছি, ইহা ছাপা হয় ত, সে-সকল ইতিহাস পরেও একদিন হইতে পারিবে।
ছেলেবেলা হইতে ‘ভবঘুরে’ হইয়াই ত বুড়া হইলাম। আত্মীয়-অনাত্মীয় সকলের মুখেই শুধু একটা একটানা ‘ছি-ছি’ শুনিয়া শুনিয়া নিজেও নিজের জীবনটাকে একটা মস্ত ‘ছি-ছি-ছি’ ছাড়া আর কিছুই ভাবিতে পারি নাই। কিন্তু কি করিয়া যে জীবনের প্রভাতেই এই সুদীর্ঘ ‘ছি-ছি’ র ভূমিকা চিহ্নিত হইয়া গিয়াছিল, বহু কালান্তরে বসিয়া প্রয়োজনবোধে আজ সেই – সব স্মৃত ও বিস্মৃত কাহিনীর মালা গাঁথিতে বসিয়া যেন হঠাৎ সন্দেহ হইতেছে, এই ‘ছি-ছি’টা যত বড় করিয়া সবাই দেখিয়াছে, হয়ত ঠিক তত বড়ই ছিল না। মনে হইতেছে, হয়ত ভগবান যাহাকে তাঁহার বিচিত্র সৃষ্টির ঠিক মাঝখানটিতে টান দেন, তাহাকে ভাল ছেলে হইয়া একজামিন পাস করিবার সুবিধাও দেন না; গাড়ি-পালকি চড়িয়া বহু লোক-লশকর সমভিব্যাহারে ভ্রমণ করিয়া তাহাকে ‘কাহিনী’ নাম দিয়া ছাপাইবার অভিরুচিও দেন না। বুদ্ধি হয়ত ভগবান তাহাদের কিছু দেন, কিন্তু বিষয়ী লোকেরা তাহাকে সুবুদ্ধি বলে না। তাই প্রবৃত্তি তাহাদের এমনি অসঙ্গত খাপছাড়া এবং দেখিবার বস্তু ও তৃষ্ণাটা স্বভাবতঃই এতই বেয়াড়া হইয়া উঠে যে, তাহার বর্ণনা করিতে গেলে সুধী ব্যক্তিরা বোধ করি হাসিয়াই খুন হইবেন। তারপরে সেই মন্দ ছেলেটি যে কেমন করিয়া অনাদরে অবহেলায় মন্দের আকর্ষণে মন্দ হইয়া, ধাক্কা খাইয়া, অজ্ঞাতসারে অবশেষে একদিন অপযশের ঝুলি কাঁধে ফেলিয়া কোথায় সরিয়া পড়ে—সুদীর্ঘদিন আর তাহার কোন উদ্দেশই পাওয়া যায় না।
কিন্তু এ কি করিতেছি! কাঁদুনি গাহিতে বসিয়া গেলাম কিরূপে? ‘ভ্রমণ-কাহিনী’ যদি বা কেহ শোনে—এ-সকল শুনিবেই বা কে, আর ইহার সমাপ্তি হইবেই বা কোথায়?
অতএব এ-সকলও থাক। যাহা বলিতে বসিয়াছি, তাহাই বলি। কিন্তু বলিলেই ত বলা হয় না, ভ্রমণ করা এক, তাহা প্রকাশ করা আর। যাহার পা-দুটো আছে, সে-ই ভ্রমণ করিতে পারে; কিন্তু হাত-দুটো থাকিলেই ত আর লেখা যায় না। সে যে ভারী শক্ত। তাছাড়া মস্ত মুশকিল হইয়াছে আমার এই যে, ভগবান আমার মধ্যে কল্পনা-কবিত্বের বাষ্পটুকুও দেন নাই। এই দুটো পোড়া চোখ দিয়া আমি যা কিছু দেখি, ঠিক তাহাই দেখি। গাছকে ঠিক গাছই দেখি—পাহাড়-পর্বতকে পাহাড়-পর্বতই দেখি। জলের দিকে চাহিয়া, জলকে জল ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। আকাশে মেঘের পানে চোখ তুলিয়া রাখিয়া ঘাড়ে ব্যথা করিয়া ফেলিয়াছি, কিন্তু যে মেঘ সেই মেঘ। কাহারো নিবিড় এলোকেশের রাশি চুলোয় যাক—একগাছি চুলের সন্ধানও কোনদিন তাহার মধ্যে খুঁজিয়া পাই নাই। চাঁদের পানে চাহিয়া চোখ ঠিকরাইয়া গিয়াছে, কিন্তু কাহারো মুখটুকু ত কখনো নজরে পড়ে নাই!
এমন করিয়া ভগবান যখন বিড়ম্বিত করিয়াছেন, তখন আমি আর কি উপায় করিব? তাই পূর্বেই বলিয়াছি—নিরুপায় হইয়া হালটা ত প্রায় ছাড়িয়াই দিয়াছিলাম! হঠাৎ সেদিন বড় একটা ফন্দি মাথায় ঢুকিয়াছে! আচ্ছা, এক কাজ করি না কেন? বড় বড় লোকের ভ্রমণ-কাহিনীগুলো পড়িয়া লই না কেন? অতএব আর দ্বিধা নয়—ইহাই স্থির। তখন হইতে ইহাই উলটিয়া-পালটিয়া অধ্যয়ন করিয়া করিয়া, আজ আমার এমনি সাহস বাড়িয়া গিয়াছে যে সত্য সত্যই লিখিতে বসিয়া গিয়াছি। শুধু তাই নয়, আমার নিশ্চয় মনে হইতেছে, কাহিনী লিখিবার গুপ্ত ‘এলেম’টায় লায়েক হইয়া পড়িয়াছি!
কিন্তু এ কি নিদারুণ ব্যবধান! বড়লোক এবং দুঃখীকে ভগবান কি আলাদা করিয়াই গড়িয়াছেন! উভয়ের বেড়াইয়া-বেড়ানোর মধ্যেও কি আকাশ-পাতাল পার্থক্য!
বড়লোক ক্রমাগত বলিতেছেন—‘আমি! আমি! আমি! ওগো তোমরা দেশের হতভাগা পাঁচজন চোখ চাহিয়া ইহার প্রতি অক্ষরটি পড়, হাঁ করিয়া আমার প্রতি শব্দটি শোন—আমি বিদেশে গিয়াছিলাম।’
কিন্তু সে যেন হইল। তাঁহাদের কাজ না হয় তাঁহারা ভবিষ্যতে ভাল করিয়াই করিলেন।
কিন্তু আমার দুঃখ তাহাতে ত ঘুচিবে না। বড়লোক ত নই। আমার অহংটা কোনদিনই ত তেমন করিয়া হাত-পা ঝাড়া দিয়া বিকশিত হইয়া উঠিতে পারে নাই। আমি হাজার চেষ্টা করিয়াও অতটা সাহস করিয়া ‘আমি’ ‘আমি’ করিতে পারিব কিনা, সে ভরসা ত কোনমতেই পাঠকবর্গকে দিতে পারিতেছি না।
আবার ইহাই কি সব? ইহার চেয়েও বড় বাধা এই দেখি যে, বিনা রঙে, অর্থাৎ শুধু ‘লাইট’ এবং ‘শেড’ দিয়া আঁকিতে ত শিখি নাই। নিছক কালি দিয়া ছবি আঁকিতে জানা, এই সব ‘ভ্রমণ-কাহিনী’ বিবৃত করার পক্ষে যে একেবারে অত্যাবশ্যক।
অতএব পাঠকবর্গের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, শ্রীকান্তের কাছে আপনারা সে প্রত্যাশা রাখিবেন না। এ ত ভ্রমণ নয়, এ এক দুর্ভাগার ঘুরে বেড়ানো মাত্র! সঙ্গে থাকার ক্লেশ আছে। সঙ্গে গেলে, গতি ও স্থিতির জন্য ‘ফার্স্ট ক্লাস সেলুন’ ও ‘শ্লিপিং কার’ দিতে পারিব না, আহারের জন্য ডিনার যোগাড় করিতেও পারিব না। তবে চাহিলে এক-আধবিন্দু সর্বশ্রান্তিহরা কালাচাঁদ দিতে পারিব বটে। এ ভরসা দিতেছি। তাও কিন্তু একটু-আধটু এক-আধবার।
ভাল কথা। কি করিয়া ‘ভবঘুরে’ হইয়া পড়িলাম, সে কথা বলিতে গেলে, প্রভাত-জীবনে এ নেশায় কে মাতাইয়া দিয়াছিল, তাহার একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। তাহার নাম ইন্দ্রনাথ।