বেতাল পঞ্চবিংশতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত প্রথম গ্রন্থ৷ ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর লল্লুলাল রচিত হিন্দি “বেতাল পচীসী” গ্রন্থের আলোকে এই গ্রন্থ রচনা করেন৷ আপাতদৃষ্টিতে অনুবাদ মনে হলেও তিনি হুবহু অনুবাদ না করে মূল গ্রন্থের আলোকে এটি রচনা করেন৷ বেতাল পঞ্চবিংশতি তাঁর প্রথম গ্রন্থ হলেও এই গ্রন্থে শক্তিশালী গদ্যের লক্ষণ সুষ্পষ্ট ছিল৷ বিদ্যাসাগর মহাশয় গ্রন্থের বিজ্ঞাপনে রচনার হেতু উল্লেখ করে লেখেন— ‘কালেজ অব ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয়ে, তত্ৰত্য ছাত্ৰগণের পাঠার্থে, বাঙ্গালা ভাষায় হিতোপদেশ নামে যে পুস্তক নির্দিষ্ট ছিল, তাহার রচনা অতি কদৰ্য্য। বিশেষতঃ, কোনও কোনও অংশ এরূপ দুরূহ ও অসংলগ্ন যে কোনও ক্রমে অর্থবোধ ও তাৎপর্যগ্ৰহ হইয়া উঠে না। তৎপরিবর্তে পুস্তকান্তর প্রচলিত করা উচিত ও আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, উক্ত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহামতি শ্ৰীযুত মেজর জি. টি. মার্শল মহোদয় কোনও নূতন পুস্তক প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন। তদনুসারে আমি, বৈতালপচীসীনামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বন করিয়া, এই গ্রন্থ লিখিয়াছিলাম।’
————-
দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন
কালেজ অব্ ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয়ে, তত্ৰত্য ছাত্ৰগণের পাঠার্থে, বাঙ্গালা ভাষায় হিতোপদেশ নামে যে পুস্তক নির্দ্দিষ্ট ছিল, তাহার রচনা অতি কদৰ্য্য। বিশেষতঃ, কোনও কোনও অংশ এরূপ দুরূহ ও অসংলগ্ন যে কোনও ক্রমে অর্থবোধ ও তাৎপর্য্যগ্ৰহ হইয়া উঠে না। তৎপরিবর্ত্তে পুস্তকান্তর প্রচলিত করা উচিত ও আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, উক্ত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহামতি শ্ৰীযুত মেজর জি. টি. মার্শল মহোদয় কোনও নূতন পুস্তক প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন। তদনুসারে আমি, বৈতালপচীসীনামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বন করিয়া, এই গ্রন্থ লিখিয়াছিলাম।
যৎকালে প্ৰথম প্রচারিত হয়, আমার এমন আশা ছিল না, বেতালপঞ্চবিংশতি সৰ্ব্বত্র পরিগৃহীত হইবেক। কিন্তু, সৌভাগ্যক্রমে, বাঙ্গালা ভাষার অনুশীলনকারী ব্যক্তিমাত্রেই আদরপূর্বক গ্ৰহণ করিয়াছেন, এবং এতদ্দেশীয় প্রায় সমুদায় বিদ্যালয়েই প্রচলিত হইয়াছে। ফলতঃ, দুই বৎসরের অনধিক কাল মধ্যেই প্রথম মুদ্রিত সমস্ত পুস্তক নিঃশেষ রূপে পৰ্য্যবসিত হয়।
প্রায় সংবৎসর অতিক্রান্ত হইল, পুস্তকের অসদ্ভাব হইয়াছে। কিন্তু, কোনও কোনও কারণবশতঃ, আমি পুনর্ম্মুদ্রাকরণে এ পর্য্যন্ত পরাঙ্মুখ ছিলাম। পরিশেষে, গ্রাহকমণ্ডলীর আগ্রহাতিশয় দর্শনে, দ্বিতীয় বার মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলাম। যে যে স্থান কোনও অংশে অপরিশুদ্ধ ছিল, পরিশোধিত হইয়াছে, এবং অশ্লীল পদ, বাক্য, ও উপাখ্যানভাগ পরিত্যক্ত হইয়াছে। এক্ষণে বেতালপঞ্চবিংশতি পূর্ববৎ সর্বত্র পরিগৃহীত হইলে শ্রম সফল বোধ করিব।
শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰ শর্ম্মা
কলিকাতা।
১০ই ফাল্গুন। সংবৎ ১৯০৬।
————–
দশম সংস্করণের বিজ্ঞাপন
বেতালপঞ্চবিংশতি দশম বার প্রচারিত হইল। এই পুস্তক, এত দিন, বাঙ্গালা ভাষার প্রণালী অনুসারে, মুদ্রিত হইয়াছিল; সুতরাং, ইঙ্গরেজী পুস্তকে যে সকল বিরামচিহ্ন ব্যবহৃত হইয়া থাকে, পূর্ব পূর্ব সংস্করণে সে সমুদয় পরিগৃহীত হয় নাই। এই সংস্করণে সে সমস্ত সন্নিবেশিত হইল।
১৯০৩ সংবতে, বেতালপঞ্চবিংশতি প্ৰথম প্রচারিত হয়। ২৫ বৎসর অতীত হইলে, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জামাতা, শ্ৰীযুত বাবু যোগেন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ., তদীয় জীবনচরিত প্রচারিত করিয়াছেন। ঐ পুস্তকের ৪২ পৃষ্ঠায় লিখিত হইয়াছে—
বিদ্যাসাগরপ্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নুতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমার্জিত হইয়াছিল যে বোমাণ্ট ও ফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থগুলির ন্যায়। ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে।
যোগেন্দ্ৰ বাবু, কি প্রমাণ অবলম্বনপূর্বক, এরূপ অপ্রকৃত কথা লিখিয়া প্রচারিত করিলেন, বুঝিয়া উঠা কঠিন। আমি বেতালপঞ্চবিংশতি লিখিয়া, মুদ্রিত করিবার পূর্বে, শ্ৰীযুত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে শুনাইয়াছিলাম। তাঁহাদিগকে শুনাইবার অভিপ্ৰায় এই যে, কোনও স্থল অসঙ্গত বা অসংলগ্ন বোধ হইলে, তাঁহারা স্ব স্ব অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করিবেন; তদনুসারে, আমি সেই সেই স্থল পরিবর্ত্তিত করিব। আমার বিলক্ষণ স্মরণ আছে, কোনও কোনও উপাখ্যানে একটি স্থলও তাঁহাদের অসঙ্গত বা অসংলগ্ন বোধ হয় নাই, সুতরাং, সেই সেই উপাখ্যানের কোনও স্থলেই কোনও প্রকার পরিবর্ত্তন করিবার আবশ্যকতা ঘটে নাই। আর, যে সকল উপাখ্যানে তাঁহারা তদ্রূপ অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ করিয়াছিলেন, সেই সেই উপাখ্যানে, স্থানে স্থানে, দুই একটি শব্দ মাত্র পরিবর্ত্তিত হইয়াছিল। বিদ্যারত্ন ও তর্কালঙ্কার ইহার অতিরিক্ত আর কিছুই করেন নাই। সুতরাং, “বেতালপঞ্চবিংশতি তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমাজিত হইয়াছিল যে ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে”; যোগেন্দ্র বাবুর এই নির্দেশ, কোনও মতে, সঙ্গত বা ন্যায়ানুগত হয় নাই। শ্ৰীযুত গিরিশচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ন অদ্যাপি বিদ্যমান আছেন। তিনি এক্ষণে সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপক। এ বিষয়ে, তিনি, আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে, যে পত্র লিখিয়াছেন, ঐ উত্তরপত্র, আমার জিজ্ঞাসাপত্রের সহিত, নিম্নে নিবেশিত হইতেছে।
অশেষগুণাশ্রয়
শ্ৰীযুত গিরিশচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ন ভ্রাতৃপ্ৰেমাস্পদেষু
————-
সান্দরসম্ভাষণমাবেদনম্
তুমি জান কি না বলিতে পারি না, কিছু দিন হইল, সংস্কৃত কলেজের ভূতপূর্ব ছাত্ৰ শ্ৰীযুত বাবু যোগেন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ., মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনচরিত প্রচারিত করিয়াছেন। ঐ পুস্তকের ৪২ পৃষ্ঠায় লিখিত হইয়াছে, “বিদ্যাসাগরপ্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নুতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমার্জিত হইয়াছিল যে, বোমাণ্ট ও ফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থগুলির ন্যায় ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে”। বেতালপঞ্চবিংশতি সম্প্রতি পুনরায় মুদ্রিত হইতেছে। যোগেন্দ্ৰ বাবুর উক্তি বিষয়ে কিছু বলা আবশ্যক বোধ হওয়াতে, এই সংস্করণের বিজ্ঞাপনে তাহা ব্যক্ত করিব, স্থির করিয়াছি। বেতালপঞ্চবিংশতির সংশোধনবিষয়ে তর্কালঙ্কারের কত দূর সংস্রব ও সাহায্য ছিল, তাহা তুমি সবিশেষ জান। যাহা জান, লিপি দ্বারা আমায় জানাইলে, অতিশয় উপকৃত হইব। তোমার পত্ৰখানি, আমার বক্তব্যের সহিত, প্রচারিত করিবার অভিপ্ৰায় আছে, জানিবে ইতি।
ত্বদেকশর্ম্মশর্ম্মণঃ
শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰশৰ্ম্মণঃ
কলিকাতা।
১০ই বৈশাখ, ১২৮৩ সাল।
পরমশ্রদ্ধাস্পদ
শ্ৰীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর মহাশয়
জ্যেষ্ঠভ্রাতৃপ্রতিমেয়ু
শ্ৰীযুত বাবু যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ. প্রণীত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনচরিত গ্রন্থে বেতালপঞ্চবিংশতি সম্বন্ধে যাহা লিখিত হইয়াছে, তাহা দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলাম। তিনি লিখিয়াছেন, “বিদ্যাসাগরপ্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নূতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমার্জিত হইয়াছিল যে, বোমাণ্ট ও ফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থগুলির ন্যায় ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে”। এই কথা নিতান্ত অলীক ও অসঙ্গত; আমার বিবেচনায়, এরূপ অলীক ও অসঙ্গত কথা লিখিয়া প্রচার করা যোগেন্দ্র বাবুর নিতান্ত অন্যায় কাৰ্য্য হইয়াছে।
এতদ্বিষয়ের প্রকৃত বৃত্তান্ত এই—আপনি, বেতালপঞ্চবিংশতি রচনা করিয়া, আমাকে ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে শুনাইয়াছিলেন। শ্রবণকালে আমরা মধ্যে মধ্যে স্ব স্ব অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতাম। তদনুসারে, স্থানে স্থানে দুই একটি শব্দ পরিবর্তিত হইত। বেতালপঞ্চবিংশতি বিষয়ে, আমার অথবা তর্কালঙ্কারের, এতদন্তিরিক্ত কোন সংস্রব বা সাহায্য ছিল না।
আমার এই পত্ৰখানি মুদ্রিত করা যদি আবশ্যক বোধ হয়, করিবেন, তদ্বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ সম্মতি ইতি।
সোদারাভিমানিনঃ
শ্রীগিরিশচন্দ্রশর্ম্মণঃ
কলিকাতা।
১২ই বৈশাখ, ১২৮৩ সাল।
যোগেন্দ্র বাবু স্বীয় শ্বশুরের জীবনচরিত পুস্তকে, আমার সংক্রান্ত যে সকল কথা লিখিয়াছেন, তাহার অধিকাংশই এইরূপ অমূলক। দৃষ্টান্তস্বরূপ আর একটি স্থল প্রদর্শিত হইতেছে। তিনি ১৮ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন—
সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষের পদ শূন্য হইল। এরূপ শুনিতে পাই, বেথুন তর্কালঙ্কারকে এই পদ গ্রহণে অনুরোধ করেন। তিনি বিদ্যাসাগরকে ঐ পদের যোগ্য বলিয়া বেথুনের নিকট আবেদন করায়, বেথুন সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়কেই ঐ পদে নিযুক্ত করিতে বাধ্য হইলেন। এই জনশ্রুতি যদি সত্য হয়, তাহা হইলে ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে তর্কালঙ্কারের ন্যায় সদাশয়, উদারচরিত ও বন্ধুহিতৈষী ব্যক্তি অতি কম ছিলেন। হৃদয়ের বন্ধুকে আপনি অপেক্ষা উচ্চতর পদে অভিষিক্ত করিয়া তর্কালঙ্কার বন্ধুত্বের ও ঔদার্য্যের পরা কাষ্ঠা দেখাইয়া গিয়াছেন।
গ্রন্থকৰ্ত্তার কল্পনাশক্তি ব্যতীত এ গল্পটির কিছুমাত্র মূল নাই। মদনমোহন তর্কালঙ্কার, ইঙ্গরেজী ১৮৪৬ সালে, সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকপদে নিযুক্ত হয়েন; ইঙ্গরেজী ১৮৫০ সালের নবেম্বর মাসে, মুরশিদাবাদের জজপণ্ডিত নিযুক্ত হইয়া, সংস্কৃত কালেজ হইতে প্ৰস্থান করেন। তর্কালঙ্কারের নিয়োগসময়েও, যিনি ( বাবু রসময় দত্ত ) সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, তর্কালঙ্কারের প্রস্থানসময়েও, তিনিই ( বাবু রসময় দত্ত) সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ফলতঃ, তর্কালঙ্কার যত দিন সংস্কৃত কালেজে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় মধ্যে, এক দিনের জন্যেও, ঐ বিদ্যালয়ে অধ্যক্ষের পদ শূন্য হয় নাই। সুতরাং, সংস্কৃত কালেজে অধ্যক্ষের পদ শূন্য হওয়াতে, বেথুন সাহেব মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে ঐ পদে নিযুক্ত করিতে উদ্যত হইলে, তর্কালঙ্কার, ঔদাৰ্য্যগুণের আতিশয্যাবশতঃ, আমাকে ঐ পদের যোগ্য বিবেচনা করিয়া, ও বন্ধুস্নেহের বশীভুত হইয়া, বেথুন সাহেবকে আমার জন্য অনুরোধ করাতে, আমি ঐ পদে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, ইহা কি রূপে সম্ভাবিতে পারে, তাহা যোগেন্দ্ৰ বাবুই বলিতে পারেন।
আমি যে সূত্রে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষতাপদে নিযুক্ত হই, তাহার প্রকৃত বৃত্তাত্ত এই—মদনমোহন তর্কালঙ্কার, জজপণ্ডিত নিযুক্ত হইয়া, মুরশিদাবাদ প্ৰস্থান করিলে, সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। শিক্ষাসমাজের তৎকালীন সেক্রেটারি, শ্ৰীযুক্ত ডাক্তর মোয়েট সাহেব, আমায় ঐ পদে নিযুক্ত করিবার অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ করেন।[1] আমি, নানা কারণ দর্শাইয়া, প্রথমতঃ অস্বীকার করি। পরে, তিনি সবিশেষ যত্ন ও আগ্ৰহ প্ৰকাশ করাতে, আমি কহিয়াছিলাম, যদি শিক্ষাসমাজ আমাকে প্রিন্সিপালের ক্ষমতা দেন, তাহা হইলে আমি এই পদ স্বীকার করিতে পারি। তিনি আমার নিকট হইতে ঐ মর্মে একখানি পত্র লেখাইয়া লয়েন। তৎপরে ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে, আমি সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশ্যাস্ত্রের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হই। আমার এই নিয়োগের কিছু দিন পরে, বাবু রসময় দত্ত মহাশয় সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতাপদ পরিত্যাগ করেন। সংস্কৃত কালেজের বর্ত্তমান অবস্থা, ও উত্তরকালে কিরূপ ব্যবস্থা করিলে, সংস্কৃত কালেজের উন্নতি হইতে পারে, এই দুই বিষয়ে রিপোর্ট করিবার নিমিত্ত, আমার প্রতি আদেশ প্রদত্ত হয়। তদনুসারে আমি রিপোর্ট সমৰ্পণ করিলে, ঐ রিপোর্ট দৃষ্টে সন্তুষ্ট হইয়া, শিক্ষাসমাজ আমাকে সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত করেন। সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতাকাৰ্য্য, সেক্রেটারি ও আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারি, এই দুই ব্যক্তি দ্বারা নির্ব্বাহিত হইয়া আসিতেছিল; এই দুই পদ রহিত হইয়া, প্রিন্সিপালের পদ নূতন সৃষ্ট হইল। ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষে, আমি সংস্কৃত কালেজের প্রিন্সিপাল অর্থাৎ অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হইলাম।
যোগেন্দ্র বাবুর গল্পটির মধ্যে, “এই জনশ্রুতি যদি সত্য হয়,” এই কথাটি লিখিত আছে। যাঁহারা, বহুকাল অবধি, সংস্কৃত কালেজে নিযুক্ত আছেন, অথবা যাঁহারা কোনও রূপে সংস্কৃত কালেজের সহিত কোনও সংস্রব রাখেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কখনও এরূপ জনশ্রুতি কৰ্ণগোচর করিয়াছেন, এরূপ বোধ হয় না। যাহা হউক, যদিই দৈবাৎ ঐ রূপ অসম্ভব জনশ্রুতি কোনও সূত্রে যোগেন্দ্র বাবুর কর্ণগোচর হইয়াছিল, ঐ জনশ্রুতি অমূলক অথবা সমূলক, ইহার পরীক্ষা করা তাঁহার আবশ্যক বোধ হয় নাই। আবশ্যক বোধ হইলে, অনায়াসে তাঁহার সংশয়চ্ছেদন হইতে পারিত। কারণ, আমার নিয়োগবৃত্তান্ত সংস্কৃত কালেজ সংক্রান্ত তৎকালীন ব্যক্তিমাত্রেই বিলক্ষণ অবগত আছেন। যোগেন্দ্ৰ বাবু সংস্কৃত কালেজের ছাত্র; যে সময়ে তিনি আমার নিয়োগের উপাখ্যান রচনা করিয়াছেন, বোধ হয়, তখনও তিনি সংস্কৃত কালেজে অধ্যয়ন করিতেন। যদি সবিশেষ জানিয়া যথার্থ ঘটনার নির্দ্দেশ করা তাঁহার অভিপ্রেত হইত, তাহা হইলে, আমার নিয়োগ সংক্রান্ত প্রকৃত বৃত্তান্ত তাঁহার অপরিজ্ঞাত থাকিত না।
ইঙ্গরেজী ১৮৪৬ সালে, পূজ্যপাদ জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয়ের লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। সংস্কৃত কালেজের সেক্রেটারি বাবু রসময় দত্ত মহাশয় আমায় ঐ পদে নিযুক্ত করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন।[2] আমি, বিশিষ্ট হেতুবশতঃ, অধ্যাপকের পদগ্রহণে অসম্মত হইয়া, মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত, সবিশেষ অনুরোধ করি।[3] তদনুসারে, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ঐ পদে নিযুক্ত হয়েন। এই প্রকৃত বৃত্তান্তটির সহিত, যোগেন্দ্র বাবুর কল্পিত গল্পটির, বিলক্ষণ সৌসাদৃশ্য দৃশ্যমান হইতেছে।
শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰ শর্ম্মা
কলিকাতা।
১লা পৌষ, সংবৎ ১৯৩৩।
————–
[1] এই সময়ে আমি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে হেড রাইটর নিযুক্ত ছিলাম।
[2] এই সময়ে, আমি সংস্কৃত কালেজে আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত ছিলাম।
[3] এই সময়ে মদনমোহন তর্কালঙ্কার কৃষ্ণনগর কালেজে প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত ছিলেন।
————-
উপক্রমণিকা
উজয়িনী নগরে গন্ধৰ্বসেন নামে রাজা ছিলেন। তাঁহার চারি মহিষী। তাঁহাদের গর্ভে রাজার ছয় পুত্র জন্মে। রাজকুমারেরা সকলেই সুপণ্ডিত ও সর্ব বিষয়ে বিচক্ষণ ছিলেন। কালক্রমে, নৃপতির লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, সর্বজ্যেষ্ঠ শঙ্কু সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন। তৎকনিষ্ঠ বিক্রমাদিত্য বিদ্যানুরাগ, নীতিপরতা ও শাস্ত্রানুশীলন দ্বারা
সবিশেষ বিখ্যাত ছিলেন; তথাপি, রাজ্যভোগের লোভসংবরণে অসমর্থ হইয়া, জ্যেষ্ঠের প্রাণসংহারপূর্বক, স্বয়ং রাজ্যেশ্বর হইলেন; এবং, ক্রমে ক্রমে, নিজ বাহুবলে, লক্ষযোজনাবিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপের অধীশ্বর হইয়া, আপন নামে অব্দ প্রচলিত করিলেন।
একদা, রাজা বিক্রমাদিত্য মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, জগদীশ্বর আমায়, নানা জনপদের অধীশ্বর করিয়া, অসংখ্য প্ৰজাগণের হিতাহিতচিন্তার ভার দিয়াছেন। আমি, আত্মসুখে নির্বৃত হইয়া, তাহাদের অবস্থার প্রতি ক্ষণমাত্রও দৃষ্টিপাত করি না; কেবল অধিকৃতবর্গের বিবেচনার উপর নির্ভর করিয়া, নিশ্চিন্ত রহিয়াছি। তাহারা প্ৰজাগণের সহিত কিরূপ ব্যবহার করিতেছে, অন্ততঃ একবারও পরীক্ষা করিয়া দেখা উচিত। অতএব আমি, প্রচ্ছন্ন বেশে পৰ্যটন করিয়া, প্ৰজাগণের অবস্থা প্রত্যক্ষ করিব। অনন্তর তিনি, নিজ অনুজ ভর্তৃহরির হস্তে সমস্ত সাম্রাজ্যের ভারার্পণ করিয়া, সন্ন্যাসীর বেশে, দেশে দেশে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন।
উজ্জয়িনীবাসী এক দরিদ্র ব্ৰাহ্মণ, বহু কাল, অতি কঠোর তপস্যা করিতেছিলেন। তিনি, আপন উপাস্য দেবতার নিকট বরস্বরূপ এক অমরফল পাইয়া, আনন্দিত মনে গৃহে আসিয়া, স্বীয় ব্ৰাহ্মণীকে বলিলেন, দেখ, দেবতা, তপস্যায় তুষ্ট হইয়া, আজ আমায় এই ফল দিয়াছেন; বলিয়াছেন, ইহা ভক্ষণ করিলে, নর অমর হয়। ব্ৰাহ্মণী শুনিয়া, অতিশয় খেদ করিয়া, কহিলেন, হায়! অমর হইয়া, আর কতকাল যন্ত্রণাভোগ করিবে। তুমি, কি সুখে, অমর হইবার অভিলাষ কর, বুঝিতে পারিতেছি না। বরং, এই দণ্ডে মৃত্যু হইলে, সাংসারিক ক্লেশ হইতে পরিত্রাণ হয়।
গৃহিণীর এই আক্ষেপবাক্য শুনিয়া, হতবুদ্ধি হইয়া, ব্ৰাহ্মণ কহিলেন, আমি তৎকালে, না বুঝিয়া, এই দেবদত্ত ফল লইয়াছিলাম; এক্ষণে, তোমার কথা শুনিয়া, আমার চৈতন্য হইল। এখন তুমি যেরূপ বলিবে, তাহাই করিব। ব্ৰাহ্মণী কহিলেন, এই ফল রাজা ভর্তৃহরিকে দিয়া, ইহার পরিবর্তে, পারিতোষিকস্বরূপ, কিঞ্চিৎ অর্থ লইয়া আইস; তাহা হইলে, অনায়াসে সংসারযাত্ৰা সম্পন্ন করিতে পরিবে।
ইহা শুনিয়া, ব্ৰাহ্মণ রাজার নিকটে উপস্থিত হইলেন এবং, যথাবিধি আশীৰ্বাদপ্রয়োগের পর, দেবদত্ত ফলের গুণব্যাখ্যা ও পূর্বাপর সমন্ত বৃত্তান্তের প্রকৃতরূপ বর্ণন করিয়া, বিনীত বচনে নিবেদন করিলেন, মহারাজ! আপনি, এই ফল লইয়া, আমায় কিছু অর্থ দেন। আপনি চিরজীবী হইলে, সমন্ত রাজ্যের মঙ্গল। রাজা, ফল গ্ৰহণ করিয়া, লক্ষমূদ্রাপ্ৰদানপূর্বক, ব্ৰাহ্মণকে বিদায় করিলেন এবং, নিতান্ত স্ত্ৰৈণতাবশতঃ, মনে মনে বিবেচনা করিলেন, যে ব্যক্তির চির জীবন ও স্থির যৌবন হইলে, আমি যাবজ্জীবন সুখী হইব, তাহাকেই এই ফল দেওয়া আবশ্যক। অনন্তর, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া, রাজা প্ৰাণাধিক মহিষীর হস্তে ফল প্ৰদান করিলেন এবং কহিলেন, প্রিয়ে! তুমি আমার জীবন-সর্বস্ব; এই ফল খাও, চিরজীবিনী ও স্থিরযৌবনা হইবে। রাজ্ঞী, নিরতিশয় আহ্নলাদপ্রদর্শনপূর্বক, ফলগ্রহণ করিলেন। রাজা প্ৰীত মনে, সভায় প্রত্যাগমন করিয়া, অমাত্যবর্গের সহিত রাজকাৰ্য পৰ্যালোচনা করিতে লাগিলেন।
উজ্জয়িনীর নগরপাল রাজমহিষীর সাতিশয় প্রিয় পাত্র ছিল; তিনি, ঐ ফলের গুণব্যাখ্যা করিয়া, তাহার হস্তে সমর্পণ করিলেন। নগরপাল এক বারাঙ্গনাকে অত্যন্ত ভালবাসিত; সে, তাহার হস্তে প্ৰদানপূর্বক, ঐ ফলের সবিশেষ গুণবর্ণনা করিল। বারাঙ্গনা, ফল পাইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিল, আমি অতি অধম জাতি, কুক্রিয়া দ্বারা উদরপূর্তি করি; আমার চিরজীবিনী হওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। অতএব, এই ফল রাজাকে দেওয়া উচিত; রাজা চিরজীবী হইলে, অসংখ্য লোকের মঙ্গল হইবেক। অনন্তর, রাজার নিকটে গিয়া, বারবনিতা, বিনয়পূর্বক, নিবেদন করিল, মহারাজ! আমি এই এক অপূর্ব ফল পাইয়াছি; ইহা ভক্ষণ করিলে, নর অমর হয়; এই ফল আপনকার যোগ্য; আপনি গ্ৰহণ করুন।
রাজা, অমরফল বারাঙ্গনার হস্তগত দেখিয়া, বিস্ময়াপন্ন হইলেন; এবং, ফল লইয়া, পুরস্কারপ্রদানপূর্বক, তাহাকে বিদায় দিয়া, ভাবিতে লাগিলেন, এই ফল রাজ্ঞীকে দিয়াছি; ইহা কিরূপে বারাঙ্গনার হস্তগত হইল। পরে, সবিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা, তিনি পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইলেন এবং, সাংসারিক বিষয়ে নিরতিশয় বীতরাগ হইয়া, বিবেচনা করিতে লাগিলেন, সংসার অতি অকিঞ্চিৎকর, ইহাতে সুখের লেশমাত্র নাই; অতএব, বৃথা মায়ায় মুগ্ধ হইয়া, আর ইহাতে লিপ্ত থাকা, কোনও ক্রমে, শ্রেয়স্কর নহে। অতএব, সংসারযাত্রায় বিসর্জন দিয়া, অরণ্যে গিয়া, জগদীশ্বরের আরাধনায় প্রবৃত্ত হই; চরমে পরম পুরুষাৰ্থ মুক্তিপদার্থ প্রাপ্ত হইতে পারিব।
অন্তঃকরণে এইরূপ আলোচনা করিয়া, অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া, রাজা রাজ্ঞীকে জিজ্ঞাসিলেন, তুমি সে ফল কি করিয়াছ। তিনি কহিলেন, ভক্ষণ করিয়াছি। রাজা, সাতিশয় বিরাগপ্রদর্শনপূর্বক, রাণীকে সেই ফল দেখাইলেন। রাণী, এক কালে, হতবুদ্ধি ও অধোবদন হইয়া রহিলেন, বাক্য নিঃসরণ করিতে পারিলেন না। রাজা ভর্তৃহরি, অবিলম্বে অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া, প্রক্ষালনপূর্বক ফলভক্ষণ করিলেন। এবং, রাজ্যাধিকারে জলাঞ্জলি দিয়া, একাকী অরণ্যে গিয়া, যোগসাধনে প্ৰবৃত্ত হইলেন।
বিক্ৰমাদিত্যের সিংহাসন শূন্য রহিল। দেবরাজ, উজ্জয়িনীর অরাজকসংবাদ প্রাপ্ত হইবামাত্র, এক যক্ষকে রক্ষক নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। যক্ষ, সাতিশয় সতর্কতাপূর্বক, অহোরাত্ৰ, নগরীর রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল। অল্পদিনের মধ্যেই, দেশে বিদেশে প্রচার হইল, রাজা ভর্তৃহরি, রাজত্বপরিত্যাগপূর্বক, বনপ্রস্থান করিয়াছেন। বিক্ৰমাদিত্য শ্রবণমাত্র, অতিমাত্র ব্যগ্র হইয়া, স্বদেশে প্রত্যাগমন করিলেন। তিনি, অর্ধারাত্র সময়ে, নগরে প্রবেশ করিতেছেন; এমন সময়ে, নগররক্ষক যক্ষ আসিয়া নিষেধ করিয়া কহিল, তুই কে, কোথায় যাইতেছিস, দাঁড়া, তোর নাম কি বল। রাজা কহিলেন, আমি বিক্ৰমাদিত্য, আপন নগরে যাইতেছি; তুই কে, কি নিমিত্তে আমার গতিরোধ করিতেছিস, বল।
যক্ষ কহিল, দেবরাজ ইন্দ্ৰ আমায় এই নগরের রক্ষক নিযুক্ত করিয়াছেন। তাঁহার অনুমতি ব্যতিরেকে, আমি তোমায় অসময়ে নগরে প্রবেশ করিতে দিব না। অথবা, যদি তুমি যথার্থই রাজা বিক্ৰমাদিত্য হও, অগ্রে আমার সহিত যুদ্ধ কর, পরে নগরে যাইতে দিব। রাজা শ্রবণমাত্র, বদ্ধপরিকর হইয়া, যুদ্ধার্থে প্ৰস্তুত হইলেন। যক্ষও, তৎক্ষণাং প্রস্তুত হইয়া, তাঁহার সম্মুখীন হইল। ঘোরতর সংগ্ৰাম হইতে লাগিল। পরিশেষে, রাজা, যক্ষকে ভূতলে ফেলিয়া, তাহার বক্ষঃস্থলে বসিলেন। তখন যক্ষ কহিল, মহারাজ! তুমি আমায় পরাভূত করিয়াছ। তোমার প্রভাব ও পরাক্রম দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম, তুমি যথার্থই রাজা বিক্ৰমাদিত্য। এক্ষণে আমায় ছাড়িয়া দাও; আমি তোমায় প্ৰাণদান দিতেছি।
রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, তুই বাতুল, নতুবা এরূপ অসঙ্গত কথা বলিবি কেন। তুই আমায় প্রাণদান কি দিবি; আমি মনে করিলে, এখনই তোর প্ৰাণদণ্ড করিতে পারি। যক্ষ শুনিয়া কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিল, মহারাজ! যাহা কহিতেছ, তাহা সম্পূর্ণ যথার্থ, কিন্তু, আমি তোমায় আসন্ন মৃত্যু হইতে বাঁচাইতেছি, এজন্য এরূপ বলিতেছি। যাহা কহি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, তদনুযায়ী কাৰ্য করিলে, দীর্ঘজীবী হইবে, এবং নিরুদ্বেগে, অখণ্ড ভূমণ্ডলে, একাধিপত্য করিতে পরিবে। তখন ভূপতি, অতিশয় বিস্মিত ও উৎকণ্ঠিত হইয়া, যক্ষের বক্ষঃস্থল হইতে উত্থিত হইলেন। যক্ষও, ক্ষণ মধ্যে সমরশ্রান্তিপরিহারপূর্বক, বিক্ৰমাদিত্যকে সম্বোধিয়া, তদীয় জীবনসংক্রান্ত গৃঢ় বৃত্তান্ত তাঁহার গোচর করিতে আরম্ভ করিল।
মহারাজ! শ্রবণ কর,—
ভোগবতী নগরে, চন্দ্ৰভানু নামে অতি প্ৰতাপশালী নরপতি ছিলেন। তিনি, এক দিবস, মৃগয়ার অভিলাষে, কোনও অটবীতে প্ৰবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, এক তপস্বী, অধঃশিরাঃ ও বৃক্ষে লম্ববান হইয়া, ধূমপান করিতেছেন। অনেক অনুসন্ধানের পর, তত্ৰত্য লোকের মুখে অবগত হইলেন, তপস্বী কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন না; বহুকাল অবধি, একাকী এইভাবে তপস্যা করিতেছেন। রাজা, সন্ন্যাসীর কঠোর ব্ৰত দর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া, নগর প্রত্যাবর্তন করিলেন; এবং পর দিন, যথাকালে, রাজসভায় অধিষ্ঠান করিয়া কহিলেন, হে অমাত্যবর্গ! হে সভাসদগণ! আমি গতকল্য, মৃগয়ায় গিয়া, বিপিনমধ্যে এক অদ্ভূত তপস্বী দেখিয়াছি; যদি কেহ তাঁহারে রাজধানীতে আনিতে পারে, তাহাকে লক্ষ মুদ্রা পারিতোষিক দিব।
এই রাজবাক্য নগর মধ্যে প্রচারিত হইলে, এক প্রসিদ্ধ বারবনিতা, নৃপতিসমীপে আসিয়া, নিবেদন করিল, মহারাজ! আজ্ঞা পাইলে, আমি, ঐ তাপসীর ঔরসে পুত্র জন্মাইয়া, ঐ পুত্র তাহার স্কন্ধে দিয়া, আপনকার সভায় আনিতে পারি। রাজা শুনিয়া সাতিশয় চমৎকৃত হইলেন এবং পরম সমাদরপূর্বক, বারনারীর উপর তাপসের আনয়নের ভারার্পণ করিলেন। সে ভূপালের নিয়োগ অনুসারে, যোগীর আশ্রমে উপস্থিত হইয়া দেখিল, যোগী যথার্থই মুদ্রিতনয়ন, অধঃশিরাঃ ও বৃক্ষে লম্বমান হইয়া, ধূমপান করিতেছেন; নিরতিশয় শীর্ণদেহ, কেহ কোনও প্রশ্ন করিলে উত্তর দেন না। তদ্দর্শনে বারযোষিৎ, সহসা সন্ন্যাসীর সমাধিভঙ্গ করা অসাধ্য জানিয়া তদীয় আশ্রমের অনতিদূরে এক সুশোভন উপবন ও তন্মধ্যে পরম রমণীয় বাসভবন নির্মিত করাইল এবং নানা উপায় চিন্তিয়া, পরিশেষে, যুক্তিপূর্বক, মোহনভোগ প্রস্তুত করিয়া, ধূমপায়ী তপস্বীর আস্যে অৰ্পিত করিল। তপস্বী, রসনাসংযোগ দ্বারা মিষ্ট বোধ হওয়াতে, ক্ৰমে ক্ৰমে সমুদয় ভক্ষণ করিলেন। বারাঙ্গনা পুনরায় দিল; তিনিও পুনরায় ভক্ষণ করিলেন।
এইরূপে, ক্ৰমাগত কতিপয় দিবস, মোহনভোগ উপযোগ করিয়া, শরীরে কিঞ্চিৎ বলসঞ্চার হইলে, সন্ন্যাসী, নেত্ৰদ্ধয় উল্মীলিত করিয়া, তরু হইতে অবতীর্ণ হইলেন, এবং বারনারীকে জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কে, কি অভিপ্ৰায়ে, একাকিনী এই নির্জন বনস্থানে আগমন করিয়াছ। সে কহিল, আমি দেবকন্যা, দেবলোকে তপস্যা করি; সম্প্রতি, তীৰ্থপৰ্যটনপ্রসঙ্গে, পরম পবিত্র কর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে আসিয়া, যোগাভ্যাসবাসনায়, অনতিদূরে আশ্রমনির্মাণ করিয়াছি; নিয়ত তথায় অবস্থিতি করি। অদ্য সৌভাগ্যক্ৰমে, এই আশ্রমে প্রবেশ করিয়া, আপনকার সন্দর্শন ও সম্ভাষণানুগ্রহ দ্বারা, চরিতার্থতা প্রাপ্ত হইলাম। তপস্বী কহিলেন, আমি, তোমার সৌজন্য ও সুশীলতা দর্শনে, পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং তোমার মধুর মূর্তি সন্দর্শনে আত্মাকে চরিতার্থ বোধ করিতেছি; যেহেতু জন্মান্তরীণ পুণ্যসঞ্চয় ব্যতিরেকে, সাধুসমাগম লব্ধ হয় না। যাহা হউক, তোমার আশ্রম দেখিবার নিমিত্ত, আমার অতিশয় বাসনা হইতেছে। যদি প্রতিবন্ধক না থাকে, ও অধিক দূরবর্তী না হয়, আমায় তথায় লইয়া চল।
বারবিলাসিনী, তপস্বীর অভ্যর্থনা শ্রবণে কৃতাৰ্থম্মন্য ও অতিমাত্র ব্যগ্ৰ হইয়া, তাঁহাকে আপন আলয়ে লইয়া গেল, এবং, সাতিশয় যত্ন ও সবিশেষ সমাদর পুরঃসর, নানাবিধ সুম্বাদ মিষ্টান্ন ও সুরস পানীয় প্রদান করিল। তিনি, বারনারীর কপটজালে বন্ধ হইয়া, তাহার দত্ত সমস্ত বস্তু ভক্ষণ ও পান করিলেন। এইরূপে, তপস্বী, ধূমপান পরিত্যাগপূর্বক, যোগাভ্যাসে জলাঞ্জলি দিয়া, বারবনিতার সহিত বিষয়বাসনায় কালব্যাপন করিতে লাগিলেন। বারাঙ্গনা গর্ভবতী ও যথাকালে পুত্রবতী হইল। কিছুদিন অতীত হইলে পর, সে সন্ন্যাসীর নিকট নিবেদন করিল, মহাশয়। বহু দিবস অতিক্রান্ত হইল, আমরা নিরন্তর কেবল বিষয়বাসনায় কালাহরণ করিলাম; এক্ষণে তীর্থযাত্রা দ্বারা দেহ পবিত্র করা উচিত।
বারবনিতা, এইরূপ প্রবঞ্চনা দ্বারা, তপস্বীকে সংজ্ঞাশূন্য করিয়া, তাঁহার স্কন্ধে পুত্রপ্রদানপূর্বক, চন্দ্ৰভানুর রাজধানীতে লইয়া চলিল। সে রাজসভার সমীপবৰ্তিনী হইলে, রাজা তাহাকে চিনিতে পারিয়া, এবং সন্ন্যাসীর স্কন্ধে পুত্ৰ দেখিয়া, সামাজিকদিগকে বলিলেন, দেখ দেখ, যে বারনারী যোগীর আনয়নবিষয়ে প্ৰতিজ্ঞা করিয়া গিয়াছিল, সে আপন প্রতিজ্ঞা পূৰ্ণ করিয়া আসিতেছে। আমি উহার অসম্ভব বুদ্ধিকৌশলে চমৎকৃত হইয়াছি। অধিক আর কি বলিব, এই বুদ্ধিমতী বারবনিতা চিরশুষ্ক নীরস তরুকে পল্লবিত এবং পুষ্পে ও ফলে সুশোভিত করিয়াছে। সামাজিকেরা কহিলেন, মহারাজ! যথার্থ আজ্ঞা করিতেছেন; এ সেই বারাঙ্গনাই বটে।
রাজা ও সভাসদগণের এইরূপ কথোপকথন শ্রবণে, সহসা বোধসুধাকরের উদয় হওয়াতে, সন্ন্যাসীর মোহান্ধকার অপসারিত হইল। তখন তিনি, পূর্বাপরপর্যালোচনা করিয়া, যৎপরোনাস্তি ক্ষোভ প্রাপ্ত হইলেন এবং আপনাকে বারংবার ধিক্কার দিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, দুরাত্মা চন্দ্ৰভানু, ঐশ্বৰ্যমদে মত্ত ও ধর্মাধৰ্মজ্ঞানশূন্য হইয়া আমার তপস্যাভ্রংশের নিমিত্ত এই দুর্বিগাহ মায়াজাল বিস্তারিত করিয়াছিল। আমিও অতি অধম ও অবশেন্দ্ৰিয়; অনায়াসে স্বৈরিণীর মায়ায় মুগ্ধ হইয়া, চিরসঞ্চিত কর্মফলে বঞ্চিত হইলাম। অনন্তর, ক্ৰোধে কম্পান্বিতকলেবর হইয়া স্কন্ধস্থিত পুত্রকে ভূতলে নিক্ষিপ্ত করিয়া, তিনি তৎক্ষণাৎ তথা হইতে প্ৰস্থান করিলেন; অন্য এক অরণ্যে প্রবেশপূর্বক, পূর্ব অপেক্ষায় অধিকতর মনোযোগ ও অধ্যবসায় সহকারে, যোগসাধন করিতে লাগিলেন, এবং, কিয়াৎ কাল পরে, ঐ নরেশ্বরের মৃত্যুসাধন করিয়া, কৃতকাৰ্য হইলেন।
এইরূপে, আখ্যায়িকার সমাপন করিয়া, যক্ষ কহিল, মহারাজ! তুমি, ও রাজা চন্দ্ৰভানু, আর ঐ যোগী, এই তিন জন এক নগরে, এক নক্ষত্রে, এক লগ্নে, জন্মিয়াছিলো। তুমি, রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়া পৃথিবীর রাজত্ব করিতেছ। চন্দ্ৰভানু, তৈলিকাগৃহে জন্মিয়া ভাগ্যক্রমে ভোগবতী নগরীর অধিপতি হইয়াছিল। আর, যোগী, কুম্ভকারকুলে উৎপন্ন হইয়া যত্নপূর্বক যোগসাধন করিয়া চন্দ্ৰভানুর প্রাণবধ করিয়াছে, এবং তাঁহাকে বেতাল করিয়া শ্মশানবর্তী শিরীষবৃক্ষে লন্বিত করিয়া রাখিয়াছে; এক্ষণে, অনন্যকর্মা হইয়া, তোমার প্রাণসংহার করিবার চেষ্টায় আছে; ইহাতে কৃতকাৰ্য হইলেই, উহার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। যদি তুমি তাহার হস্ত হইতে নিস্তার পাও, বহুকাল অকণ্টকে রাজ্যভোগ করিতে পরিবে। আমি, সবিশেষ সমস্ত কহিয়া, তোমায় সতর্ক করিয়া দিলাম; তুমি এ বিষয়ে ক্ষণমাত্রও অনবহিত থাকিবে না।
এইরূপ উপদেশ দিয়া, যক্ষ স্বস্থানে প্ৰস্থান করিল। রাজাও শুনিয়া, ত্ৰস্ত ও বিস্ময়গ্ৰস্ত হইয়া, নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে, রাজবাটীতে প্রবিষ্ট হইলেন। পর দিন প্রভাতে, তিনি সিংহাসনে উপবিষ্ট হইলে, ভৃত্যগণ ও প্ৰজাবৰ্গ, বহুদিনের পর, রাজসন্দর্শন প্ৰাপ্ত হইয়া, আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইল। রাজা বিক্ৰমাদিত্য, রাজনীতির অনুবর্তী হইয়া, রাজ্যশাসন ও প্ৰজাপালন করিতে লাগিলেন।
কিছুদিন পরে, শান্তশীল নামে এক সন্ন্যাসী, শ্ৰীফল হস্তে রাজসভায় উপস্থিত হইলেন এবং শ্ৰীফলপ্ৰদানপূর্বক রাজাকে আশীৰ্বাদ করিয়া, কক্ষস্থিত আসন পাতিয়া, তদুপরি উপবেশন করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ কথোপকথন করিয়া, রাজার নিকট বিদায় লইয়া, সন্ন্যাসী সভা হইতে প্ৰস্থান করিলে পর, তিনি অন্তঃকরণে এই বিতর্ক করিতে লাগিলেন, যক্ষ যে সন্ন্যাসীর কথা কহিয়াছিল, এ সেই ব্যক্তি কিনা। যাহা হউক, সহসা শ্ৰীফলভক্ষণ করা উচিত নহে। রাজা, মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, কোষাধ্যক্ষের হন্তে সমর্পণপূর্বক কহিলেন, তুমি এই শ্ৰীফল সাবধানে রাখিবে। সন্ন্যাসী প্ৰত্যহ রাজদর্শন ও শ্ৰীফলপ্ৰদান করিতে লাগিলেন।
এক দিবস রাজা, বয়স্যবর্গ সমভিব্যাহারে, মন্দুরাসিন্দর্শনার্থ গমন করিয়াছেন, এমন সময়ে সন্ন্যাসী তথায় উপস্থিত হইয়া, পূর্ববং শ্ৰীফলপ্রদানপূর্বক, আশীৰ্বাদ করিলেন। দৈবযোগে, শ্ৰীফল ভূপতির করতল হইতে ভূতলে পতিত ও ভগ্ন হওয়াতে, তন্মধ্য হইতে এক অপূর্ব রত্ন নিৰ্গত হইল। রাজা ও রাজবয়স্যগণ তদীয় প্ৰভা দর্শনে চমৎকৃত হইলেন। রাজা যোগীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়। আপনি কি জন্যে আমায় এই রত্নগর্ভ শ্ৰীফল দিলেন।
যোগী কহিলেন, মহারাজ! শাস্ত্রে রাজা, গুরু, জ্যোতির্বিদ, ও চিকিৎসকের নিকট রিক্ত হস্তে যাইতে নিষেধ আছে; এইজন্যে, আমি এই রত্নগৰ্ভ শ্ৰীফল লইয়া আসিয়াছিলাম। আর, এক রত্নগৰ্ভ শ্ৰীফলের কথা কি কহিতেছেন, প্রতিদিন আপনাকে যে শ্ৰীফল দিয়াছি, সকলের মধ্যেই এতাদৃশ এক এক রত্ন আছে। তখন রাজা কোষাধ্যক্ষকে ডাকাইয়া কহিলেন, তোমাকে যত শ্ৰীফল রাখিতে দিয়াছি, সমুদয় এই স্থানে আন। কোষাধ্যক্ষ, রাজকীয় আদেশ অনুসারে, সমস্ত শ্ৰীফল তথায় উপস্থিত করিলে, রাজা প্রত্যেক শ্রীফল ভাঙ্গিয়া, সকলের মধ্যেই এক এক রত্ন দেখিয়া যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত ও চমৎকৃত হইলেন এবং, তৎক্ষণাৎ রাজসভায় গমনপূর্বক, এক মণিকারকে ডাকাইয়া, ঐ সমস্ত রত্বের পরীক্ষা করিতে আজ্ঞা দিয়া কহিলেন, এই অসার সংসারে ধর্মই সার পদার্থ; অতএব, তুমি ধর্মপ্রমাণ প্রত্যেক রত্বের মূল্য নির্ধারিত করিয়া দাও।
এইরূপ রাজবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, মণিকার কহিল, মহারাজ! আপনি যথার্থ আজ্ঞা করিয়াছেন। ধর্মরক্ষা করিলে, সকল বিষয়ের রক্ষা হয়; ধর্মলোপ করিলে সকল বিষয়ের লোপ হয়। অতএব, আমি ধৰ্মীসাক্ষী করিয়া প্ৰতিজ্ঞা করিতেছি, আপন জ্ঞান অনুসারে, যথার্থ মূল্য নির্ধারিত করিয়া দিব। ইহা কহিয়া, সে প্রত্যেক রত্নের লক্ষণপরীক্ষা করিয়া কহিল, মহারাজ! বিলক্ষণ বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, সকল রত্নই সর্বাঙ্গসুন্দর; কোটি মুদ্রাও একৈকের প্রকৃত মূল্য নহে। এ সকল অমূল্য রত্ন।
রাজা শুনিয়া, সাতিশয় হৃষ্ট হইয়া, সমুচিত পারিতোষিক প্রদানপূর্বক, মণিকারকে বিদায় করিলেন এবং, হস্তদ্বারা সন্ন্যাসীর হস্তগ্রহণ করিয়া, সিংহাসনার্থে উপবেশন করাইয়া কহিলেন, মহাশয়! আমার, সমস্ত সাম্রাজ্যও আপনকার প্রদত্ত রত্নসমূহের তুল্যমূল্য হইবেক না। আপনি, সন্ন্যাসী হইয়া এ সকল অমূল্য রত্ন কোথায় পাইলেন, এবং কি অভিপ্ৰায়েই বা আমায় দিলেন, জানিতে ইচ্ছা করি। যোগী কহিলেন, মহারাজ! ঔষধ, মন্ত্রণা, গৃহচ্ছিদ্র, এসকল সর্বসমক্ষে ব্যক্ত করা বিধেয় নহে; যদি অনুমতি হয়, নির্জনে গিয়া নিবেদন করি। মহারাজ! নীতিজ্ঞেরা বলেন, মন্ত্রণা, ষট্ কৰ্ণে প্রবিষ্ট হইলে, অপ্রকাশিত থাকে না, তাহাতে কাৰ্যহানির সম্পূর্ণ সম্ভাবনা; চারিকর্ণে হইলে, প্রকাশিত হয় না, অথচ কাৰ্যসিদ্ধি করে; আর, দুই কর্ণের মন্ত্রণা, মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, ব্ৰহ্মাও জানিতে পারেন না।
ইহা শুনিয়া, রাজা সন্ন্যাসীকে নির্জনে লইয়া কহিতে লাগিলেন, যোগীশ্বর। আপনি আমায় এত রত্ন দিলেন, কিন্তু একদিনও আমার আলয়ে ভোজন বা জলগ্রহণ করিলেন না; এজন্য, আমি আপনকার নিকট অতিশয় লজ্জিত হইতেছি। আপনকার কোনও অভিপ্রায় থাকে, ব্যক্ত করুন: আমি প্রাণান্তেও তৎসম্পাদনে পরাঙ্মুখ হইব না। সন্ন্যাসী কহিলেন, মহারাজ! গোদাবরীতীরবর্তী শ্মশানে মন্ত্র সিদ্ধ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছি; তাহাতে অষ্টসিদ্ধি লাভ হইবেক। অতএব, তোমার নিকট আমার প্রার্থনা এই, তুমি একদিন, সন্ধ্যা অবধি প্রভাত পর্যন্ত, আমার সন্নিহিত থাকিবে। তুমি সন্নিহিত থাকিলেই, আমার মন্ত্র সিদ্ধ হইবেক। রাজা কহিলেন, অবধারিত যাইব; আপনি দিন নির্ধারিত করিয়া বলুন। সন্ন্যাসী কহিলেন, তুমি, আগামী ভাদ্রীকৃষ্ণচতুর্দশীতে, সন্ধ্যাকালে, একাকী আমার নিকটে যাইবে। রাজা কহিলেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন; আমি, নিঃসন্দেহ, যথাসময়ে, আপনকার আশ্রমে উপস্থিত হইব। এইরূপে রাজাকে বচনবদ্ধ করিয়া, বিদায় লইয়া, সন্ন্যাসী স্বীয় আশ্রমে প্ৰতিগমন করিলেন।
কৃষ্ণচতুর্দশী উপস্থিত হইল। সন্ন্যাসী, সায়ং সময়ে, আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর সংগ্ৰহপূর্বক, শ্মশানে যোগাসনে বসিলেন। রাজা বিক্ৰমাদিত্যও, প্রতিশ্রুত সময় সমুপস্থিত দেখিয়া, সাহসে নির্ভর করিয়া, করে তরবারি ধারণপূর্বক, একাকী সন্ন্যাসীর আশ্রমে উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, বহুসংখ্যক বিকটাকৃতি ভূত, প্ৰেত, পিশাচ, শঙ্খিনী, ডাকিনী প্রভৃতি আনন্দে উন্মত্তপ্রায় হইয়া, সন্ন্যাসীর চতুর্দ্দিকে নৃত্য করিতেছে; সন্ন্যাসী, যোগাসনে আসীন হইয়া, দুই হস্তে দুই নরকপাল লইয়া, বাদ্য করিতেছেন। রাজা, এতাদৃশ্য ভয়াবহ ব্যাপার দর্শনে, কিঞ্চিম্মাত্র ভীত হইলেন না; যথোপযুক্ত ভক্তিযোগ সহকারে প্রণাম করিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, মহাশয়! ভৃত্য উপস্থিত; আদেশ দ্বারা চরিতার্থ করিতে আজ্ঞা হয়। যোগী, আশীৰ্বাদপ্রয়োগপূর্বক, সমীপপাতিত আসনের দিকে অঙ্গুলি প্রয়োগ করিয়া কহিলেন, এই আসনে উপবেশন কর।
রাজা, তদীয় আদেশ অনুসারে, আসন পরিগ্রহ করিয়া, কিয়ৎক্ষণ পরে, পুনরায় নিবেদন করিলেন, মহাশয়! ভৃত্যের প্রতি কি আজ্ঞা হয়। যোগী কহিলেন, মহারাজ! তোমার বাক্যনিষ্ঠায় নিরতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। বুঝিলাম, সৎপুরুষেরা, প্ৰাণান্তেও, প্ৰতিজ্ঞাপ্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হয়েন না। যাহা হউক, যদি অনুগ্ৰহ করিয়া আসিয়াছ, এক বিষয়ে আমার সাহায্য কর। দুই ক্রোশ দক্ষিণে এক শ্মশান আছে; তথায় দেখিতে পাইবে, এক শিরীষবৃক্ষে শব ঝুলিতেছে; ঐ শব আমার নিকটে লাইয়া আইস। রাজা, যে আজ্ঞা বলিয়া, তৎক্ষণাৎ প্ৰস্থান করিলেন। এইরূপে, রাজাকে শবানয়নে প্রেরণপূর্বক, যথাবিধি বিবিধ আয়োজন করিয়া, সন্ন্যাসী পূজায় বসিলেন।
একে কৃষ্ণচতুর্দশীর রাত্ৰি সহজেই ঘোরতর অন্ধকারে আবৃত; তাহাতে আবার, ঘনঘটা দ্বারা গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন হইয়া মুষলধারায় বৃষ্টি হইতেছিল; আর, ভূতপ্ৰেতগণ চতুর্দ্দিকে ভয়ানক কোলাহল করিতেছিল। এইরূপ সঙ্কটে কাহার হৃদয়ে না ভয়সঞ্চার হয়। কিন্তু রাজার তাহাতে ভয় বা ব্যাকুলতার লেশমাত্ৰ উপস্থিত হইল না। পরিশেষে, নানা সঙ্কট হইতে উত্তীর্ণ হইয়া, রাজা নির্দ্দিষ্ট প্ৰেতভূমিতে উপনীত হইলেন; দেখিলেন, কোনও স্থলে অতি বিকটমূর্তি ভূতপ্ৰেতগণ, জীবিত মনুষ্য ধরিয়া, তাহাদের মাংস ভক্ষণ করিতেছে; কোনও স্থলে ডাকিনীগণ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালক ধরিয়া, তদীয় অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গ চর্বণ করিতেছে। রাজা, ইতস্ততঃ অনেক অন্বেষণ করিয়া, পরিশেষে শিরীষবৃক্ষের নিকটে গিয়া দেখিলেন, উহার মূল অবধি অগ্রভাগ পর্যন্ত, প্ৰত্যেক বিটপ ও পল্লব ধক্ ধক্ করিয়া জ্বলিতেছে; আর, চারিদিকে অনবরত কেবল মার্ মার্, কাট্ কাট্ ইত্যাদি ভয়ানক শব্দ হইতেছে।
এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়াও রাজা ভয় পাইলেন না; কিন্তু মনে মনে বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন, যক্ষ যে যোগীর কথা কহিয়াছিল, এ সেই ব্যক্তি, তাহার সন্দেহ নাই। অনন্তর, তিনি সেই বৃক্ষের সন্নিহিত হইয়া দেখিলেন, শব রজ্জুবদ্ধ, অধঃশিরাঃ, লম্বমান রহিয়াছে। শবদর্শনে শ্রম সফল বোধ করিয়া, রাজা সাতিশয় আহ্লাদিত হইলেন। এবং, নিৰ্ভয়ে বৃক্ষে আরোহণপূর্বক, খড়গাঘাত দ্বারা, শবের বন্ধনরজ্জ্ব ছিন্ন করিলেন। শব, ভূতলে পতিত হইবামাত্ৰ, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। রাজা, তদীয় কণ্ঠরব শ্ৰবণে, সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন, এবং ত্বরায় তরু হইতে অবতীর্ণ হইয়া, নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কে, কি নিমিত্তে তোমার এরূপ দুরবস্থা ঘাঁটিয়াছে, বল। শব খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। রাজা, দেখিয়া শুনিয়া, সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন ও চিন্তান্বিত হইলেন, এবং এই অদ্ভুত ব্যাপারের মর্মাববোধে অসমৰ্থ হইয়া, অন্তঃকরণে অশেষপ্রকার কল্পনা করিতে লাগিলেন।
এই অবকাশে শব, বৃক্ষে উঠিয়া পূর্ববৎ রজ্জুবদ্ধ ও লম্বমান হইয়া রহিল। রাজাও তৎক্ষণাৎ বৃক্ষে আরোহণ ও রজ্জুচ্ছেদন পুরঃসর, শবকে কক্ষে নিক্ষিপ্ত করিয়া অবতীর্ণ হইলেন, এবং নিরতিশয় নির্বন্ধ সহকারে, তাহার এরূপ বিপৎপ্রাপ্তির কারণ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। সে কিছুই উত্তর দিল না। রাজা, ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, যক্ষের নিকট যে তৈলিকের উপাখ্যান শুনিয়াছিলাম, এ সেই ব্যক্তি; আর, যোগীও সেই কুম্ভকার, আপনি যোগসিদ্ধির উদ্দেশে, ইহার প্রাণসংহার করিয়া, শ্মশানে রাখিয়াছে। অনন্তর তিনি, শবকে উত্তরীয়বস্ত্ৰে বদ্ধ করিয়া, যোগীর নিকটে লইয়া চলিলেন।
অর্ধপথে উপস্থিত হইলে, শবাবিষ্ট বেতাল বিক্ৰমাদিত্যকে জিজ্ঞাসিল, অহে বীর পুরুষ! তুমি কে, আমায়, কি নিমিত্তে, কোথায়, লইয়া যাইতেছ, বল। ভূপতি কহিলেন, আমি রাজা বিক্ৰমাদিত্য; শান্তশীল নামক যোগীর আদেশ অনুসারে, তোমায় তাঁহার আশ্রমে লইয়া যাইতেছি। বেতাল কহিল, মহারাজ! মূঢ়, নিৰ্বোধ, ও অলসেরা কেবল নিদ্রায়, আলস্যে ও কলহে কালাহরণ করে; কিন্তু বুদ্ধিমান, চতুর, পণ্ডিত ব্যক্তিরা, সদা সদালাপ, শাস্ত্রচিন্তা, ও সৎকর্মের অনুষ্ঠান দ্বারা, আনন্দে কালযাপন করিয়া থাকেন। অতএব, সমস্ত পথ মৌনভাবে গমন করা অপেক্ষা, সৎকথার আলোচনা শ্ৰেয়সী বোধ করিয়া, এক এক প্রসঙ্গ করিতেছি, শ্রবণ কর। প্রত্যেক প্রসঙ্গের পরিশেষে প্রশ্ন করিব; যদি তুমি তত্তৎ প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর দাও, তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া যাইব; আর, যদি জানিয়াও যথার্থ উত্তর না দাও, অবিলম্বে তোমার বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ হইবেক। রাজা, অগত্যা তদীয় প্রস্তাবে সন্মত হইয়া, তাহাকে সন্ন্যাসীর আশ্রমে লইয়া চলিলেন এবং বেতালও উপাখ্যানের আরম্ভ করিল।