সামতাবেড়. পানিত্রাস
জেলা হাবড়া
কল্যাণীয়েষু,—
ভাই কালিদাস, তোমার চিঠি পেলাম। আমার একটা দুর্নাম আছে যে, আমি জবাব দিইনে। নেহাৎ মিথ্যে বলতে পারিনে, কিন্তু যে বিষয়টি নিয়ে তুমি নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছো তারও যদি সাড়া না দিই ত শুধু যে অসৌজন্যের অপরাধ হবে তাই নয়,কোন দিক থেকেই যে যতীনকে সমাদর করবার অংশ নিতে পারলাম না যে দুঃখের অবধি থাকবে না। অনেকেই জানে না যে, যতীনকে আমি সত্যই ভালোবাসি। শুধু কেবল কবি বলে নয়, তাঁর ভেতরে এমনি একটি স্নেহ-সরস, বন্ধু-বৎসল, ভদ্র মন আছে যে, তার স্পর্শে নিজের মনটাও তৃপ্তিতে ভরে আসে।
যতীন জানেন, আমি তাঁর কবিতার একান্ত অনুরাগী। যখন যেখানেই তাদের দেখা পাই, বার বার করে পড়ি। স্নিগ্ধ সকরুণ নির্ভুল ছন্দগুলি কানে কানে যেন কত-কি বলতে থাকে।
কারও সম্বন্ধেই নিজের অভিমত আমি সহজে প্রকাশ করিনে, আমার সঙ্কাচ বোধ হয়। ভাবি, আমার মতামতের মূল্যই বা কি, কিন্তু যদি কখনো বলতেই হয় ত সত্যি কথাই বলি! যতীনকে স্নেহ করি, কিন্তু স্নেহের অতিশয়োক্তি দিয়ে তাঁকেও খুশী করতে পারতাম না সত্যি না হলে। যাক এ কথা।
তোমাদের অনুষ্ঠানটি ছোট;—হবেই ত ছোট। কিন্তু তাই বলে তার দামটি ছোট নয়।
এ ত ঢেঁটরা দিয়ে বহুলোক ডেকে এনে উচ্চ কোলাহলে “জয়, যতীন বাগচী কী জয়!” বলার ব্যাপার নয়, এ তোমাদের ছোট্ট রসচক্রের প্রীতি-সম্মিলন। অর্থাৎ, কোন একটি বিশেষ দিনে ও বিশেষ স্থানে জন-কয়েক সত্যিকার সাহিত্য-রসিক ও সাহিত্য-সেবী এক সঙ্গে মিলে আর একজন সত্যিকার সাহিত্য-সেবককে সাদরে আহ্বান করে এনে বলা—“কবি, আমরা তোমার সাহিত্য-সাধনায় আনন্দলাভ করেচি, তোমার বাণীপূজা সার্থক হয়েছে,—তুমি সুখী হও, তুমি দীর্ঘায়ুঃ হও, আমরা তোমাকে সর্বান্তঃকরণে ধন্যবাদ দিই—তুমি আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ কর।” এই ত? আয়োজন সামান্য বলে তোমরা ক্ষুণ্ণ হোয়ো না।
কিন্তু তবুও সম্মিলনে একটুখানি ত্রুটি ঘটলো,—আমি যেতে পারলাম না। কারণ আমি বোধ করি তোমাদের সকলের চেয়ে বয়সে বড়।
এ অঞ্চলটায় ব্যারাম-স্যারাম নেই, কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে হতভাগ্য ডেঙু এসে জুটেচে। সকাল থেকে ছোট ছেলেমেয়ে-দুটির চোক ছলছল করচে, চাকর জন-দুই ছাড়া সবাই বিছানা নিয়েছে, আমার এক নাক বন্ধ, অন্যটায় টিউব-ওয়েলের লীলা শুরু হয়েছে, রাত্রি নাগাদ বোধ হয় দেহ-মন-প্রাণ উৎসবে যোগ দিবেন, আভাস-ইশারায় তার খবর পৌঁছোচ্চে। নইলে এ অনুষ্ঠানে আমার নামে তোমাকে গর-হাজিরির ঢ্যারা টানতে দিতাম না।
অনেকে উপস্থিত আছো, এই সুযোগে একটা দুঃখের অনুযোগ জানাই। কালিদাস, তুমিও তো প্রায় সাবালক হতে চললে। আগেকার দিনের সকল কথা তোমার স্মরণ না থাকলেও কিছু কিছু হয়ত মনে পড়বে, এ দিনের মত সেদিনে আমরা এমন করে পরস্পরের ছিদ্র খুঁজে বেড়াতাম না, এক-আধটা ব্যতিক্রম হয়ত ঘটেচে, কিন্তু এখনকার সঙ্গে তার তুলনাই হয় না।
সাহিত্য-সেবকদের মাঝখানে ভাবের আদান-প্রদান, একের কাছে অপরের দেওয়া এবং পাওয়া চিরদিনই চলে আসচে এবং চিরদিনই চলবে। কিন্তু তরুণ দলের মধ্যে আজকাল এ কি হতে চললো? নিন্দে করার এ কি উদ্দাম উৎসাহ, গ্লানি প্রচারের এ কি নির্দয় অধ্যবসায়! কেবলি একজন আর একজনকে চোর প্রতিপন্ন করতে চায়। খবরের কাগজে কাগজে যত দেখি ততই যেন মন লজ্জায় দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে আসে। ক্ষমা নেই, ধৈর্য নেই, বেদনা বোধ নেই, হানাহানির নিষ্ঠুরতার যেন শেষ হতেই চায় না। কোথায় কার সঙ্গে কতটুকু মিলচে, কার লেখা থেকে কে কতটুকু নকল করেচে, রুক্ষ কটুকণ্ঠে এই খবরটা বিশ্বের দরবারে ঘোষণা করে যে এরা কি সান্ত্বনা অনুভব করে আমি ভেবেই পাইনে। ঘরে বাইরে কেবলি জানাতে চায় যে বাঙ্গালা দেশের সাহিত্যিকদের বিদেশের চুরি-করা ছাড়া আর কোন সম্বলই নেই।
যতীনকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবে অতি পরিশ্রমে খুঁজে খুঁজে এই গোয়েন্দাগিরির কাজটা তখনও আমাদের সাহিত্যিক মহলে প্রচলিত হয় উঠেনি! যাই হোক কামনা করি তোমাদের রসচক্রের রসিকদের মধ্যে যেন এ ব্যাধি কখনও প্রবেশ করবার দরজা খুঁজে না পায়।
কবি নই, মনের মধ্যে কথা জমে উঠলেও তোমাদের মত প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাইনে, গুছিয়ে বলা হয় না। তাই চিঠি লেখা হয়ে যায় আমার চিরদিনই এলোমেলো।
তা হোক গে এলোমেলো, তবু এমনি করেই বলি, তোমাদের রসচক্রের জয় হোক, তোমাদের আজকের আয়োজন সফল হোক, এবং যতীনকে বোলো শরৎদা তাঁকে এই চিঠির মারফৎ স্নেহাশীর্বাদ পাঠিয়েছেন। ইতি—৫ই ভাদ্র, ১৩৩৮।
শরৎদা।
(কলকাতার সাহিত্যিক ও শিল্পীদের সংস্থা ‘রসচক্রের’ পক্ষ থেকে কবি যতীন্দ্রনাথ বাগচীকে সম্বর্ধনা জানাবার ব্যবস্থা হলে, শরৎচন্দ্র তখন রসচক্রের সম্পাদক কবি কালিদাস রায়কে এই চিঠিটি লিখেছিলেন।)