শ্রাবণ মাসের ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের ধর্ম নিরূপণ করিয়াছেন এবং পরবর্তী সংখ্যায় ডাক্তার শ্রীযুক্ত নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত উক্ত ধর্মের সীমানা নির্দেশ করিয়া একান্ত শ্রদ্ধাভরে কবির উদাহরণগুলিকে রূপক এবং যুক্তিগুলিকে সবিনয়ে রস-রচনা বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন।
উভয়ের মতদ্বৈধ ঘটিয়াছে প্রধানতঃ আধুনিক সাহিত্যের আব্রুতা ও বে-আব্রুতা লইয়া।
ইতিমধ্যে বিনাদোষে আমার অবস্থা করুণ হইয়া উঠিয়াছে। নরেশচন্দ্রের বিরুদ্ধ দলের শ্রীযুক্ত সজনীকান্ত ‘শনিবারের চিঠি’তে আমার মতামত এমনি প্রাঞ্জল ও স্পষ্ট করিয়া ব্যক্ত করিয়া দিয়াছেন যে, ঢোক গিলিয়া, মাথা চুলকাইয়া হাঁ ও না একই সঙ্গে উচ্চারণ করিয়া পিছলাইয়া পলাইবার আর পথ রাখেন নাই।
একবারে বাঘের মুখে ঠেলিয়া দিয়াছেন।
এদিকে বিপদ হইয়াছে এই যে, কালক্রমে আমারও দুই-চারিজন ভক্ত জুটিয়াছেন; তাঁহারা এই বলিয়া আমাকে উত্তেজিত করিতেছেন যে, তুমিই কোন্ কম? দাও না তোমার অভিমত প্রচার করিয়া।
আমি বলি, সে যেন দিলাম, কিন্তু তার পরে? নিজে যে ঠিক কোন্ দলে আছি তাহা নিজেই জানি না, তা ছাড়া ওদিকে নরেশবাবু আছেন যে! তিনি শুধু মস্ত পণ্ডিত নহেন, মস্ত উকিল। তাঁর যে জেরার পরাক্রমে কবির যুক্তি-তর্ক রস-রচনা হইয়া গেল, সে-জেরার প্যাঁচে পড়িলে আমি ত এক দণ্ডও বাঁচিব না। কবি তবুও অব্যাপ্তি ও অতিব্যাপ্তির কোঠায় পৌঁছিয়াছেন, আমি হয়ত ব্যাপ্তি অব্যাপ্তি কোনটারই নাগাল পাইব না, ত্রিশঙ্কুর ন্যায় শূন্যে ঝুলিয়া থাকিব! তখন?
ভক্তরা বলে, আপনি ভীরু।
আমি বলি, না।
তাহারা বলে, তবে প্রমাণ করুন।
আমি বলি, প্রমাণ করা কি সহজ ব্যাপার! ‘রস-সৃষ্টি‘ রসোদ্বোধন প্রভৃতির রসবস্তুটির মত ধোঁয়াটে বস্তু সংসারে আর আছে নাকি? এ কেবল রস-রচনার দ্বারাই প্রমাণিত করা যায়,—কিন্তু সে সময় আপাততঃ আমার হাতে নাই।
এ তো গেল আমার দিকের কথা। ও-দিকের কথাটা ঠিক জানি না কিন্তু অনুমান করতে পারি।
প্রিয়পাত্ররা গিয়া কবিকে ধরিয়াছে, মশাই আমরা ত আর পারিয়া উঠি না, এবার আপনি অস্ত্র ধরুন। না না, ধনুর্বাণ নয়,—গদা। ঘুরাইয়া দিন ফেলিয়া ওই অতি-আধুনিক-সাহিত্যিক-পল্লীর দিকে। লক্ষ্য? কোন প্রয়োজন নাই। ওখানে একসঙ্গে অনেকগুলি থাকে।
কবির সেই গদাটাই অন্ধকারে আকাশ হইতে পড়িয়াছে। ইহাতে ঈপ্সিত লাভ না হউক শব্দ এবং ধূলা উঠিয়াছে প্রচুর। নরেশচন্দ্র চমকিয়া জাগিয়া উঠিয়াছেন, এবং বিনীত ক্রুদ্ধকণ্ঠে বারংবার প্রশ্ন করিতেছেন, কাহাকে লক্ষ্য করিয়াছেন বলুন? কেন করিয়াছেন বলুন? হাঁ কি না বলুন?
কিন্তু এ প্রশ্নই অবৈধ। কারণ, কবি ত থাকেন বারো মাসের মধ্যে তেরো মাস বিলাতে। কি জানেন তিনি কে আছে তোমাদের খড়্গহস্তা শুচি-ধর্মী অনুরূপা, আর কে আছে তোমাদের বংশী-ধারী অশুচি-ধর্মী শৈলজা-প্রেমেন্দ্র-নজরুল-কল্লোল-কালিকলমের দল? কি করিয়া জানিবেন তিনি কবে কোন্ মহীয়সী জননী অতি-আধুনিক-সাহিত্যিক দলন করিতে ভবিষ্যৎ মায়েদের সূতিকা-গৃহেই সন্তান-বধের সদুপদেশ দিয়া নৈতিক উচ্ছ্বাসের পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছেন, আর কবে শৈলজানন্দ কুলি-মজুরের নৈতিক হীনতার গল্প লিখিয়া আভিজাত্য খোয়াইয়া বসিয়াছে? এ-সকল অধ্যয়ন করিবার মত সময়, ধৈর্য এবং প্রবৃত্তি কোনটাই কবির নাই, তাঁহার অনেক কাজ। দৈবাৎ এক-আধটা টুক্রা-টাক্রা লেখা যাহা তাঁহার চোখে পড়িয়াছে তাহা হইতেও তাঁহার ধারণা জন্মিয়াছে, আধুনিক বাঙ্গালা সাহিত্যের আব্রুতা এবং আভিজাত্য দুই-ই গিয়াছে। শুরু হইয়াছে চিৎপুর রোডের খচো-খচো-খচ্কার যোগে একঘেয়ে পদের পুনঃ পুনঃ আবর্তিত গর্জন। আধুনিক সাহিত্যিকদের প্রতি কবির এত বড় অবিচারে শুধু নরেশচন্দ্রের নয়, আমারও বিস্ময় ও ব্যথার অবধি নাই।
ভক্ত-বাক্যের মত প্রামাণ্য সাক্ষ্য আর কি আছে? অতএব, তাঁহার নিশ্চয় বিশ্বাস জন্মিয়াছে আধুনিক সাহিত্যে কেবল সত্যের নাম দিয়া নর-নারীর যৌনমিলনের শারীর ব্যাপারটাকেই অলঙ্কৃত করা চলিয়াছে। তাহাতে লজ্জা নাই, শরম নাই, শ্রী নাই, সৌন্দর্য নাই, রস-বোধের বাষ্প নাই,—আছে শুধু ফ্রয়েডের সাইকো-এনালিসিস। অথচ, যে-কোন সাহিত্যিককেই যদি তিনি ডাকিয়া পাঠাইয়া জিজ্ঞাসা করিতেন ত শুনিতে পাইতেন তাহারা প্রত্যেকেই জানে যে, সত্যমাত্রই সাহিত্য হয় না, জগতে এমন অনেক নোংরা সত্য ঘটনা আছে যে তাহাকে কেন্দ্র করিয়া কোন মতেই সাহিত্য রচনা করে চলে না।
কবির হঠাৎ চোখে পড়িয়াছে যে, সজিনা, বক, কুমড়া প্রভৃতি কয়েকটা ফুল কাব্যে স্থান পায় নাই। গোলাপজাম ফুলও না, যদিচ সে, শিরীষ ফুলের সর্ববিষয়েই সমতুল্য। কারণ? না, সেগুলো মানুষে খায়! রান্নাঘর তাহাদের জাত মারিয়াছে। তাই উদাহরণের জন্য ছুটিয়া গিয়াছেন গঙ্গাদেবীর মকরের কাছে। অথচ, হাতের কাছে বাগ্দেবীর বাহন হাঁস খাইয়া যে মানুষে উজাড় করিয়া দিল, সে তাঁহার চোখে পড়িল না! কুমুদ ফুলের বীজ হইতে ভেটের খৈ হয়, এমন যে পদ্ম তাহারও বীজ লোকে ভাজিয়া খাইতে ছাড়ে না। তিল ফুলের সহিত নাসিকার, কদলী বৃক্ষের সহিত সুন্দরীর জানুর উপমা কাব্যে বিরল নহে। অথচ, সুপক্ক মর্তমান রম্ভার প্রতি বিতৃষ্ণার অপবাদ কোন কবির বিরুদ্ধেই শুনি নাই। আজ নরেশচন্দ্র বৃথাই তাঁহাকে স্মরণ করাইয়া দিতে গিয়াছেন যে, বিম্বফল অনেকে তরকারি রাঁধিয়া খায়। উত্তরে কবি কি বলিবেন জানি না, কিন্তু তাঁহার ভক্তরা হয়ত ক্রুদ্ধ হইয়া জবাব দিবেন, খাওয়া অন্যায়। যে খায় সে সৎ-সাহিত্যের প্রতি বিদ্বেষ-বুদ্ধিবশতঃই এরূপ করে।
কিন্তু এই লইয়া প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধি করা নিরর্থক! এগুলি যুক্তিও নয়, তর্কও নয়, কোন কাজেও লাগে না। অথচ, এই ধরনের গোটা-কয়েক এলোমেলো দৃষ্টান্ত আহরণ করিয়া কবি চিরদিনই জোর করিয়া বলেন, এর পরে আর সন্দেহ-ই থাকতে পারে না যে, আমি যা বোলচি তাই ঠিক এবং তুমি যা বোলচ সেটা ভুল।
কিন্তু এ কথাও আমি বলি না যে, আধুনিক বাঙ্গালা সাহিত্যে দুঃখ করিবার আদৌ কারণ ঘটে নাই, কিংবা রবীন্দ্রনাথের এবংবিধ মনোভাব একেবারেই আকস্মিক। তাঁহার হয়ত মনে নাই, কিন্তু বছর-কয়েক পূর্বে আমাকে একবার বলিয়াছিলেন যে, সে দিন তাঁহার বিদ্যালয়ের একটি বারো-তেরো বছরের ছাত্র ‘পতিতা’র সম্বন্ধে একটা গল্প লিখিয়াছে।
আমার ছেলেবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের ছোড়দা হঠাৎ কবি-যশোলুব্ধ হইয়া কাব্য-কলায় মনোনিবেশ করিলেন। এবং বাঙ্গালা ভাষায় গভীর ভাব প্রকাশের যথেষ্ট সুবিধা হয় না বলিয়া ইংরাজী ভাষাতেই কবিতা রচনা করিলেন। রচনা করিলেন কি চুরি করিলেন জানি না, কিন্তু কবিতাটি আমার মনে আছে :
A lion killed a mouse
And carried it into his house;
Then cried his mother,
And therefore cried his sister!
ছন্দ ও ভাবের দিক দিয়া কবিতাটি অনবদ্য। কিন্তু তুমুল তর্ক উঠিল, ‘মাদার’ কার? সিঙ্গীর না ইঁদুরের? বড় বৌঠাকরুন ক্ষণকাল কান পাতিয়া শুনিয়া বলিলেন, না না ওদের নয়। ও কবির ‘মাদার’। ‘পতিতা’ গল্প রচনার বিবরণ শুনিলে বৌঠাকরুন হয়ত বলিবেন, এ ক্ষেত্রে কাঁদা উচিত ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষদের। আর কাহারও নয়। এ ত গেল অসাধু-সাহিত্যের দিক। আবার সাধু-সাহিত্যের দিকেও তরুণ কবির অভাব নাই। এদিকে যিনিই কবিতা বা গান লেখেন, তিনিই লেখেন, তোমার বীণা আমার তারে বাজিতেছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে তোমার ঝিলিক-মারা অরূপমূর্তিটি দেখিতে পাইতেছি, বুকের মাঝে তোমার নিঃশব্দ পদধ্বনি শুনিতে পাইতেছি, খেয়ার ঘাটে বসিয়া সন্ধ্যা হইয়া আসিল, কাণ্ডারি! এখন পার কর। ইত্যাদি।
একটা উদাহরণ দিই। ভাদ্র মাসের ‘কেতকী’ পত্রিকার গান ছাপা হইয়াছে :
তোমার ভাঙার গানে তোমায় নেব চিনি
পরাণ পাতি শুনবো পায়ের রিনিঝিনি!
(তোমার) কালবোশেখীর ঝড়ে তোমায় নেব দেখে
(তোমার) শ্রাবণ-ধারা অঙ্গে আমার নেব মেখে।
(আমার) বুকের মাঝে তোমার আঘাত চিহ্নখানি—
আমার রোদনের মাঝে তোমার দৈববাণী!
ভুল করে’ যে ভুলবো তোমায় হ’বে না তা’
(তোমার) আঘাত এলে কোথায় বা তার
লুকাবো ব্যথা?
আমার ছড়িয়ে প’ল সকল খানে—
সারা বুকে
আমার জড়িয়ে গেল সকল হিয়া
দুঃখে সুখে!
সেথায় আমি তোমায় খুঁজে নেব চিনি—
(আমার) পরাণ পাতি শুন্বো নূপুর রিনিঝিনি।
উপরের উদ্ধৃত ইংরাজী কবিতাটির ন্যায় এ গানখানিও অনবদ্য, কি ঝঙ্কারে, কি ভাবের গভীরতায়, কি বৈরাগ্যের বেদনায়! ‘কেতকী’র তরুণ সম্পাদককে জিজ্ঞাসা করিলাম, রচয়িতার বয়স কত? সে বন্ধু-গৌরবে মুখ উজ্জ্বল করিয়া কহিল, আজ্ঞে, পোনর-ষোলর বেশি নয়!
মনে মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া ভাবিলাম, দেশ-সুদ্ধ সাহিত্যিক বালক-বালিকার দল যখন প্রহ্লাদ হইয়াই উঠিল, এবং ‘ক’ লিখিতে কৃষ্ণ স্মরণ করিয়া কাঁদিয়া আকুল হইতে লাগিল, তখন ওরে অতিবৃদ্ধ! এক মাথা পাকাচুল লইয়া আর বাঁচিয়া আছিস কিসের জন্য?
সাহিত্য-সৃষ্টি অনুকরণের মধ্যে নাই। ভালোরও না, মন্দেরও না। হৃদয়ের সত্যকার অনুভূতি আনন্দ ও বেদনার আলোড়নে অলঙ্কৃত বাক্যে বিকশিত হইয়া না উঠিলে সে সাহিত্য পদবাচ্য হয় না। বৃদ্ধ কবির গীতাঞ্জলিও যত বড় কাব্যগ্রন্থ তাঁহার যৌবনের চিত্রাঙ্গদাও ঠিক তত বড়ই কাব্য-সৃষ্টি। লাঞ্ছনার আঘাত ও গৌরবের মালা যেমন করিয়াই তাঁহার শিরে বর্ষিত হউক না। অথচ, অনুভূতিহীন বাক্য যত অলঙ্কৃতই হউক ব্যর্থ। পতিতার অনুকরণও ব্যর্থ, গীতাঞ্জলির অনুকরণও ঠিক ততখানিই ব্যর্থ। দেশের সাহিত্যসম্পদ ইহাতে কণামাত্রও বর্ধিত হয় না।
আমি পূর্বেই বলিয়াছি রস-বস্তু লইয়া আমি আলোচনা করিতে পারিব না। কারণ, ও আমি জানি না। রসিক অরসিকের সংজ্ঞা নির্দেশ করিতেও আমি অপারক। কবির বোধের ক্ষুধা ও আত্মার ক্ষুধা ঠিক যে কি এবং কিসে মেটে সে আমার অনধিগম্য। কিন্তু একটা কথা জানি যে, কাব্য-সাহিত্য ও কথা-সাহিত্য এক বস্তু নয়। আধুনিক উপন্যাস-সাহিত্য ত নয়ই! ‘সোনার তরী’র যা লইয়া চলে ‘চোখের বালি’র তাহাতে কুলায় না। সজিনা ফুলে, বক ফুলে সোনার তরীর প্রয়োজন নাই, কিন্তু বিনোদিনীর রান্নাঘরে সেগুলা না হইলেই নয়। তেপান্তর মাঠ এবং পক্ষীরাজ ঘোড়া লইয়া কাব্যের চলে, কিন্তু উপন্যাস-সাহিত্যের চলে না। এখানে ঘোড়ার চার পায়ে ছুটিতে হয়, পক্ষবিস্তার করিয়া উড়ার সুবিধা হয় না।
কবি সাহিত্য-ধর্ম প্রবন্ধে লিখিয়াছেন :
“মধ্যযুগে এক সময়ে য়ুরোপে শাস্ত্র-শাসনের খুব জোর ছিল। তখন বিজ্ঞানকে সেই শাসন অভিভূত করেছে। সূর্যের চারিদিকে পৃথিবী ঘোরে এ কথা বলতে গেলে মুখ চেপে ধরেছিল—ভুলেছিল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের একাধিপত্য—তার সিংহাসন ধর্মের রাজত্বসীমার বাইরে। আজকের দিনে তার বিপরীত হল। বিজ্ঞান প্রবল হ’য়ে উঠে কোথাও আপনার সীমা মানতে চায় না। তার প্রভাব মানব-মনের সকল বিভাগেই আপন পিয়াদা পাঠিয়েছে।
নূতন ক্ষমতার তকমা পরে কোথাও সে অনধিকার প্রবেশ করতে কুণ্ঠিত হয় না। বিজ্ঞান পদার্থটা ব্যক্তি-স্বভাব-বর্জিত—তার ধর্মই হচ্চে সত্য সম্বন্ধে অপক্ষপাত কৌতূহল। এই কৌতূহলের বেড়াজাল এখানকার সাহিত্যকেও ক্রমে ক্রমে ঘিরে ধরেচে।”
কবির এই উক্তির মধ্যে বহু অভিযোগ নিহিত আছে, সুতরাং কথাগুলিকে একটুখানি পরীক্ষা করিয়া দেখিতে চাই। বিজ্ঞানের প্রতি কবির হয়ত একটা স্বাভাবিক বিমুখতা আছে, কিন্তু বিজ্ঞানের ক্ষেত্র বলিতে যে কি বুঝায় আমি বুঝিলাম না। বিজ্ঞান বলিতে যদি শুধু Sex-Psychology/Anatomy অথবা Gynaecology বুঝাইত তাহা হইলে সাহিত্যের মধ্যে অবারিত প্রবেশে আমিও বাধা দিতাম। কেবল অবাঞ্ছিত বলিয়া নয়, অহেতুক ও অসঙ্গত বলিয়া আপত্তি করিতাম। পৃথিবী সূর্যের চারিপাশে ঘোরে, ইহা যত বড় কথাই হউক, সাহিত্যের মন্দিরে ইহার প্রয়োজন গৌণ, কিন্তু যে সুবিন্যস্ত, সংযত চিন্তাধারার ফল এই জিনিসটি, সে চিন্তা নহিলে কাব্যের চলে চলুক, উপন্যাসের চলে না। বিজ্ঞান ত কেবল অপক্ষপাত কৌতূহল মাত্রই নয়, কার্য-কারণের সত্যকার সম্বন্ধ-বিচার। চার এবং চারে আট হয়, এবং আট হইতে চার বাদ দিলে চার থাকে ইহাই বিজ্ঞান। এ মনোভাবকে ভয় কিসের? কিন্তু তাই বলিয়া নোংরামি যে সাহিত্যের অন্তর্গত নয় এ কথা আমি পূর্বেই বলিয়াছি। বিজ্ঞান হইলেও নয়, অবিজ্ঞান হইলেও নয়, সত্য হইলেও নয়, মিথ্যা হইলেও নয়। গল্পের ছলে ধাত্রীবিদ্যা শিখানোকেও আমি সাহিত্য বলি না, উপন্যাসের আকারে কামশাস্ত্র প্রচারকেও আমি সাহিত্য বলি না। বোধ হয় বাঙ্গালা দেশের একজনও অতি-আধুনিক সাহিত্যসেবী এ কথা বলে না।
বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করিয়া ধর্মপুস্তক রচনা করা যায়, আধ্যাত্মিক কবিতা রচনা করা যায়, রূপকথা-সাহিত্যও রচনা করা না যায় তাহা নহে, কিন্তু উপন্যাস-সাহিত্যের ইহা শ্রেষ্ঠ পন্থা নহে। রাজার পুত্র গেলেন চব্বিশ বছর বয়সে এবং তেপান্তর মাঠের দুর্গম পথ পার হইয়া রাজকন্যার সন্ধানে। কোটালপুত্রের ডিটেকটিভ বুদ্ধি তাঁহার নাই, সওদাগর পুত্রের বেনেবুদ্ধি তাঁহার নাই, আছে শুধু রস। গিয়া বলিলেন, তুমি যে তুমি এই আমার যথেষ্ট। এই রস উপভোগ করিবার মত রসজ্ঞ ব্যক্তির সংসারে অভাব নাই তাহা মানি, কিন্তু ভিন্ন রুচির লোকও ত সংসারে আছে? তাহারা গিয়া যদি বলে, রাজপুত্র, তোমার মনের মধ্যে রাজকন্যার রূপ-যৌবন স্থান পায় নাই, যৌতুকস্বরূপ অর্ধেক রাজত্বের প্রতিও তোমার কিছুমাত্র খেয়াল নাই, তুমি মহৎ,—কন্যাটি সে ঘুঁটে-কুড়োনির কন্যা নয়, রাজার কন্যা, ইহাই তোমার যথেষ্ট,—মনস্তত্ত্বের অবতারণায় প্রয়োজন নাই, কিন্তু রাজপুত্র! তোমার মনের কথাটা আরও একটু খোলসা করিয়া না বলিলে ত এই উচ্চাঙ্গের রস-সাহিত্যের সমস্ত রসটুকু উপলব্ধি করিতে পারতেছি না, তখন ইহাদের মুখেই বা হাত চাপা দিবে কে?
এই ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় স্বর্গীয় সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের সাহিত্য রচনায়। পরলোকগত সাহিত্যিকের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য ইহার উল্লেখ করিতেছি না, করিতেছি হাতের কাছে একটা অবৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির অসম্ভব কল্পনার উদাহরণ পাইতেছি বলিয়া, বাঙ্গালা দেশে তাঁহার পাঠকসংখ্যা বিরল নয়। আমি নিজে দেখিয়াছি মুদির দোকানে একজন গ্রন্থ পাঠ করিতেছে এবং বহুলোকে গলদশ্রুলোচনে সেই সাহিত্যসুধা পান করিতেছে।
নিষ্ঠাবান্ সচ্চরিত্র দরিদ্র নায়ক মা কালীর কাছে স্বপ্নে আদেশ পাইয়া সাত ঘড়া সোনার মোহর গাছতলা হইতে খুঁড়িয়া বাহির করিয়া বড়লোক হইল। ছেলে মরিল কিন্তু ভয় নাই। শ্মশানে জটাজূটধারী তেজঃপুঞ্জ-কলেবর এক সন্ন্যাসীর আকস্মিক আবির্ভাবে ছেলে চিতার উপরে ‘বাবা’ বলিয়া উঠিয়া বসিল। রসজ্ঞ শ্রোতার দল কাঁদিয়া আকুল। তাহাদের আনন্দ রাখিবার স্থান নাই। সেখানে কেহই ঠেলা দিয়া প্রশ্ন করে না, কেন? কিসের জন্য? তাহারা বলে, দরিদ্র নায়ক বড়লোক হইয়াছে ঢের। মরা-ছেলে প্রাণ পাইয়াছে ইহাই আমাদের যথেষ্ট,—ইহাতেই আমাদের বোধের ক্ষুধা, আত্মার ক্ষুধা মেটে। ইহা অনির্বচনীয়,—এইপ্রকার সাহিত্য-রসেই আমাদের হৃদয়ের বসন্তলোকে কল্পলতায় ফুল ফুটে।
কলহ করিবার কি আছে? কিন্তু, আমি যদি এ কাজ না পারি, নিজের গ্রন্থের দরিদ্র নায়ককে মা কালীর অনুগ্রহ জোগাড় করিয়া দিতে সক্ষম না হই, জটাজূটধারী সন্ন্যাসীকে খুঁজিয়া না পাইয়া মরা-ছেলেকে দাহ করিতে বাধ্য হই, ত নিশ্চয় জানি আমার বই তাহারা পুড়াইয়া ছাই করিয়া ছাড়িবে। কিন্তু উপায় কি? বরঞ্চ, হাতজোড় করিয়া চতুরাননের কাছে গিয়া বলিব, তাহারা আরও খান-কয়েক বই আমার পুড়াক, সে আমার সহিবে, কিন্তু এই রসজ্ঞ ব্যক্তিদের আত্মার ক্ষুধা, বোধের ক্ষুধা মিটাইবার সৌভাগ্য “শিরসি মা লিখ, মা লিখ, মা লিখ”।
কিন্তু কেন? কেন, এই জন্য যে কাব্য-সাহিত্য ও কথা-সাহিত্য এক বস্তু নয়। ইহাদের ধর্মও এক নয়, ধর্মের সীমানাও এক নয়। এবং মানুষের বোধের ক্ষুধা ও আত্মার ক্ষুধার জাতিভেদ এতই গভীর ও বিস্তৃত যে, বৈজ্ঞানিক মনোভাব-নিয়ন্ত্রিত কল্পনাকে বিসর্জন দিলে ইহাদের অর্থ-ই প্রায় থাকে না।
কবির কাঁকর-পদ্মের উদাহরণে নরেশচন্দ্র বলিতেছেন, ইহা যুক্তিও নয়, নৈয়ায়িকের দৃষ্টান্তও নয়। অতএব, ইহা রস-রচনা। আমার বোধ হয় উপাখ্যান হইলেও হইতে পারে। কিন্তু অতিশয় দুরূহ। আমি ইহার তাৎপর্য বুঝিতে পারি নাই। বস্তুতঃ, কাঁকর বরণীয় কি পদ্ম বরণীয়, চড়াই পাখি ভালো কি মোটর গাড়ি ভালো বলা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু কবি তাঁহার ‘সাহিত্য-ধর্মে’ নর-নারীর যৌন-মিলন সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন, আমার মনে হয় উপন্যাস-সাহিত্যেও তাহা খাঁটি কথা। তাঁহার বক্তব্য বোধ হয় ইহাই যে, ও ব্যাপারটা ত আছেই। কিন্তু মানুষের মাঝে যে ইহার দু’টি ভাগ আছে, একটি দৈহিক এবং অপরটি মানসিক, একটি পাশব ও অন্যটি আধ্যাত্মিক, ইহার কোন্ মহলটি যে সাহিত্যে অলঙ্কৃত করা হইবে এইটিই আসল প্রশ্ন। বাস্তবিক, ইহাই হওয়া উচিত আসল প্রশ্ন। নরেশচন্দ্র বলিতেছেন, ইহার সীমা নির্দেশ করিয়া দাও। কিন্তু সুস্পষ্ট সীমারেখা কি ইহার আছে না কি যে, ইচ্ছা করিলেই কেহ আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিবে? সমস্তই নির্ভর করে লেখকের শিক্ষা, সংস্কার, রুচি ও শক্তির উপরে। একজনের হাতে যাহা রসের নির্ঝর অপরের হাতে তাহাই কদর্যতায় কালো হইয়া উঠে। শ্লীল, অশ্লীল, আব্রু, বে-আব্রু এ-সকল তর্কের কথা ছাড়িয়া দিয়া তাঁহার আসল উপদেশটি সকল সাহিত্যসেবীরই সবিনয়ে শ্রদ্ধার সহিত গ্রহণ করা উচিত। নর-নারীর যৌন-মিলন যে সকল রস-সাহিত্যের ভিত্তি, এ সত্য কবি অস্বীকার করেন নাই। তথাপি মোট কথাটি বোধ হয় তাঁহার এই যে, ভিত্তির মত ও-বস্তুটি সাহিত্যের গভীর ও গোপন অংশেই থাক। বনিয়াদ যত নীচে এবং যতই প্রচ্ছন্ন থাকে অট্টালিকা ততই সুদৃঢ় হয়।
ততই শিল্পীর ইচ্ছামত তাহাতে কারুকার্য রচনা করা চলে। গাছের শিকড়, গাছের জীবন ও ফুল-ফলের পক্ষে যত প্রয়োজনীয়ই হউক তাহাকে খুঁড়িয়া উপরে তুলিলে তাহার সৌন্দর্যও যায়, প্রাণও শুকায়। এ সত্য যে অভ্রান্ত তাহা ত না বলা চলে না। অবশ্য ঠিক এ জিনিসটিই আধুনিক সাহিত্যে ঘটিতেছে কি না সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র।
নরেশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের লেখা হইতে অনেকগুলি নজির তুলিয়া দিয়া বলিতেছেন—
“শারীর ব্যাপার মাত্রেই তো অপাংক্তেয় নয়, কেন না, চুম্বনের স্থান সাহিত্যে পাকা করিয়া দিয়াছেন বঙ্কিমচন্দ্র হইতে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকল সাহিত্য-সম্রাট। আলিঙ্গনও চলিয়া গিয়াছে।”
কিন্তু আলিঙ্গন ত দূরের কথা চুম্বন কথাটাও আমার বইয়ের মধ্যে নিতান্ত বাধ্য না হইলে দিতে পারি না। ওটা পাশ কাটাইতে পারিলেই বাঁচি। নর-নারীর মধ্যে ইহা আছেও জানি, চলেও জানি, দোষেরও বলিতেছি না, তবুও কেমন যেন পারিয়া উঠি না। আমাদের সমাজে এ বস্তুটিকে লোকে গোপন করিতে চাহে বলিয়াই বোধ হয় সুদীর্ঘ সংস্কারে য়ুরোপীয় সাহিত্যের ন্যায় ইহার প্রকাশ্য demonstration-এ লজ্জা করে। খুব সম্ভব আমার দুর্বলতা। কিন্তু ভাবি, এই দুর্বলতা লইয়াই ত অনেক প্রণয়-চিত্র লিপিবদ্ধ করিয়াছি, মুশকিলে ত পড়ি নাই। কাব্য-সাহিত্য এক, কথা-সাহিত্য আর। ‘হৃদয়-যমুনা’ ‘স্তন’ ‘বিজয়িনী’ ‘চিত্রাঙ্গদা’ প্রভৃতি কাব্যের মধ্যে যাহাই ঘটুক কথা-সাহিত্যে মনে হয় আমারই মত কবি এ দৌর্বল্য কাটাইয়া উঠিতে পারেন নাই। বোধ করি এই সকল এবং এমনি আরও দুই-একটা ছোটখাটো ত্রুটির কথা লোকের মুখে শুনিয়া কবি অতিশয়-ক্ষুণ্ণ হইয়াছেন। ‘বিদেশের আমদানি’ কথাটা তাঁহার ক্ষোভেরই কথা। দেশভেদে সাহিত্যের ভাষা আলাদা হয়, কিন্তু সত্যকার সাহিত্যের যে দেশ-বিদেশ নাই এ সত্য কবি জানেন। এবং সকলের চেয়ে বেশি করিয়াই জানেন। তা না হইলে আজ বিশ্বসুদ্ধ লোকে তাঁহাকে বিশ্বের কবি বলিয়া মর্যাদা দিত না। কবির সৃষ্টি সমুদ্রের ন্যায় অপরিসীম। নজির আছে জানি, তথাপি সেই সমুদ্র হইতেই স্ব-মতের অনুকূলে নজির তুলিয়া তাঁহাকে খোঁটা দেওয়া শুধু অবিনয় নয়, অন্যায়।
কবি বলিয়াছেন :
“ভারতসাগরের ওপারে (অর্থাৎ য়ুরোপে) যদি প্রশ্ন করা যায় তোমাদের সাহিত্যে এত হট্টগোল কেন? উত্তর পাই, হট্টগোল সাহিত্যের কল্যাণে নয়, হাটেরই কল্যাণে। হাটে যে ঘিরেছে। ভারতসাগরের এ পারে যখন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি তখন জবাব পাই, হাট ত্রি-সীমানায় নেই বটে, কিন্তু হট্টগোল যথেষ্ট আছে। আধুনিক সাহিত্যের ঐটেই বাহাদুরী।”
এ জবাব কবিকে কে দিয়াছে জানি না, কিন্তু যেই দিয়া থাক আমি তাহার প্রশংসা করিতে পারি না।
নরেশচন্দ্র বলিতেছেন :
“…হাট জমিবার একটু চেষ্টা না হইতেছে এমন নয়। তা ছাড়া হাট জমিবার আগে হট্টগোল সাহিত্যের ইতিহাসে অনেকবার শোনা গিয়াছে। রুশো ও ভল্টেয়ার লিখিয়াছিলেন বলিয়াই ফরাসী- বিপ্লবের হাট জমিয়াছিল। এবং আজ বিশ্বব্যাপী ভাব বিনিময়ের দিনে বিলাতে যেটা ঘটিয়াছে, সে সম্বন্ধে আমরা নিরপেক্ষ থাকিতে পারি কি? যে হাট আজ পশ্চিমে বসিয়াছে তাতে আমার সওদা করিবার অধিকার কোনও প্রতীচ্যবাসীর চেয়ে কম নয়।”
আধুনিক সাহিত্য সম্বন্ধে এমন স্পষ্ট কথা এমনি নির্ভয়ে আর কেহ বলিয়াছেন কিনা জানি না।
সাহিত্যের নানা কাজের মধ্যে একটা কাজ হইতেছে জাতিকে গঠন করা, সকল দিক দিয়া তাহাকে উন্নত করা। Idea পশ্চিমের কি উত্তরের, ইহা বড় কথা নয়, স্বদেশের কি বিদেশের তাহাও বড় কথা নয়, বড় কথা ইহা ভাষার ও জাতির কল্যাণকর কি না। ‘বিদেশের আমদানি’ কথাটা মুর্গী খাওয়ার অপবাদ নয় যে, শুনিবামাত্রই লজ্জায় মাথা হেঁট করিতে হইবে। অতএব, সাহিত্যিকের শুভবুদ্ধি যদি কল্যাণের নিমিত্তই ইহার আমদানি প্রয়োজনীয় জ্ঞান করে এমন কেহই নাই যে তাহার কণ্ঠরোধ করিতে পারে। যত মতভেদই থাক গায়ের জোরে রুদ্ধ করিবার চেষ্টায় মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই অধিক হয়। কিন্তু এই সকল অত্যন্ত মামুলি কথা কবিকে স্মরণ করাইয়া দিতে আমার নিজেরই লজ্জা করিতেছে। ইহা যে প্রায় অনধিকারচর্চার কোঠায় গিয়া পড়িতেছে তাহাও সম্পূর্ণ বুঝিতেছি, কিন্তু না বলিয়াও কোন উপায় পাইতেছি না।
এ প্রবন্ধের কলেবর আর অযথা বাড়াইব না। কিন্তু উপসংহারে আরও দুই-একটা সত্য কথা সোজা করিয়াই কবিকে জানাইব। তাঁহার সাহিত্য-ধর্ম প্রবন্ধের শেষ দিকটার ভাষাও যেমন তীক্ষ্ণ শ্লেষও তেমনি নিষ্ঠুর! তিরস্কার করিবার অধিকার একমাত্র তাঁহারই আছে, এ কথা কেহই অস্বীকার করে না, কিন্তু সত্যই কি আধুনিক বাঙ্গালা সাহিত্য রাস্তার ধূলা পাঁক করিয়া তুলিয়া পরস্পরের গায়ে নিক্ষেপ করাটাকেই সাহিত্য-সাধনা জ্ঞান করিতেছে? হয়ত, কখনো কোথাও ভুল হইয়াছে, কিন্তু তাই বলিয়া সমস্ত আধুনিক সাহিত্যের প্রতি এত বড় দণ্ডই কি সুবিচার হইয়াছে?
কবি বলিয়াছেন :
“সে দেশের সাহিত্য অন্ততঃ বিজ্ঞানের দোহাই পেড়ে এই দৌরাত্ম্যের কৈফিয়ৎ দিতে পারে। কিন্তু যে দেশে অন্তরে-বাহিরে, বুদ্ধিতে-ব্যবহারে বিজ্ঞান কোনখানেই প্রবেশাধিকার পায়নি…।”
এই যদি সত্য হইয়া থাকে ত ভারতের দুঃখের কথা, দুর্ভাগ্যের কথা। হয়ত প্রবেশাধিকার পায় নাই, হয়ত এ বস্তু সত্যই ভারতে ছিল না, কিন্তু কোন একটা জিনিস শুধু কেবল ছিল না বলিয়াই কি চিরদিন বর্জিত হইয়া থাকিবে? ইহাই কি তাঁহার আদেশ?
পরের লাইনে কবি বলিয়াছেন :
“সে দেশের (অর্থাৎ বাঙ্গালা দেশের) সাহিত্যে ধার করা নকল নির্লজ্জতাকে কার দোহাই দিয়ে চাপা দিবে?”
দোহাই দেওয়া প্রয়োজন নাই, চাপা দেওয়াও অন্যায়, কিন্তু ভক্তের মুখের ধার-করা অভিমতটাকেই অসংশয়ে সত্য বলিয়া বিশ্বাস করাতেই কি ন্যায়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয় না?
রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্য-ধর্মে’র জবাব দিয়াছেন নরেশচন্দ্র। হয়ত তাঁহার ধারণা অনেকের মত তিনিও একজন কবির লক্ষ্য। এ ধারণার হেতু কি আছে আমি জানি না। তাঁহার সকল বই আমি পড়ি নাই, মাসিকের পৃষ্ঠায় যাহা প্রকাশিত হয় তাহাই শুধু দেখিয়াছি। মতের একতা অনেক জায়গায় অনুভব করি নাই। কখনো মনে হইয়াছে নর-নারীর প্রেমের ব্যাপারে তিনি প্রচলিত সুনির্দিষ্ট রাস্তা অতিক্রম করিয়া গিয়াছেন, কিন্তু এখানেও নিজের মতকেই অভ্রান্ত বলিয়া বিবেচনা করি নাই। নরেশচন্দ্রের প্রতি অনেকেই প্রসন্ন নহেন জানি। কিন্তু, মত্ততার আত্মবিস্মৃতিতে মাধুর্যহীন রুঢ়তাকেই শক্তির লক্ষণ মনে করিয়া পালোয়ানির মাতামাতি করিতেই তিনি বই লেখেন এমন অপবাদ আমি দিতে পারি না। তাঁহার সহিত পরিচয় আমার নাই, কখনও তাঁহাকে দেখিয়াছি বলিয়াও স্মরণ হয় না, কিন্তু পাণ্ডিত্যে, জ্ঞানে,ভাষার অধিকারে, চিন্তার বিস্তারে এবং সর্বোপরি স্বাধীন অভিমতের অকুণ্ঠিত প্রকাশে বাঙ্গালা সাহিত্যে তাঁহার সমতুল্য লেখক অল্পই আছেন।
বাঙ্গালা সাহিত্যের অবিসংবাদী বিচারক হিসাবে কবির কর্তব্য ইঁহার সমগ্র পুস্তক পাঠ করা, কোথায় বা শীলতার অভাব, কোথায় বা কাব্যলক্ষ্মীর বস্ত্রহরণে ইনি নিযুক্ত, স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়া দেওয়া। তবে এমনও হইতে পারে কবির লক্ষ্য নরেশচন্দ্র নহেন, আর কেহ। কিন্তু সেই ‘আর কেহ’রও সব বই তাঁহার পড়িয়া দেখা উচিত বলিয়া মনে করি। নিজের সাহিত্যিক জীবনের কথা মনে পড়ে। এই ত সেদিনের কথা—গালিগালাজের আর অন্ত ছিল না। অনেক লিখিয়াছি, সকলকে খুশী করিতে পারি নাই, ভুল করিয়াছিও বিস্তর। কিন্তু একটা ভুল করি নাই। স্বভাবতঃ নিরীহ শান্তিপ্রিয় লোক বলিয়াই হউক, বা অক্ষমতাবশতঃই হউক, আক্রমণের উত্তরও দিই নাই। কাহাকে আক্রমণও করি নাই। বহুকাল হইয়া গেলেও, কবির নিজের কথাও হয়ত মনে পড়িবে। সংসারে চিরদিনই কিছু কিছু লোক থাকে যাহারা সাহিত্যের এই দিকটাই পছন্দ করে। এখন বুড়া হইয়াছি, মরিবার দিন আসন্ন হইয়া উঠিল, গালমন্দ আর বড় খাই না। শুধু ‘পথের দাবী’ লিখিয়া সেদিন ‘মানসী’ পত্রিকার মারফতে এক রায়সাহেব সাবডেপুটির ধমক খাইয়াছি। বইয়ের মধ্যে কোথায় নাকি সোনাগাছির ইয়ারকি ছিল, অভিজ্ঞ ব্যক্তির চক্ষে তাহা ধরা পড়িয়া গিয়াছিল। সে যাই হউক, আমাদের দিন গত হইতে বসিয়াছে। এখন একদল নবীন সাহিত্য-ব্রতী সাহিত্যসেবার ভার গ্রহণ করিতেছেন। সর্বান্তঃকরণে আমি তাঁহাদের আশীর্বাদ করি। এবং যে-কয়টি দিন বাঁচিব শুধু এই কাজটুকুই নিজের হাতে রাখিব।
কিন্তু কিছুদিন হইতে দেখিতেছি ইঁহাদের বিরুদ্ধে একটা প্রচণ্ড অভিযান শুরু হইয়াছে।
ক্ষমা নাই, ধৈর্য নাই, বন্ধুভাবে ভ্রম সংশোধনের বাসনা নাই, আছে শুধু কটূক্তি আছে শুধু সুতীব্র বাক্যশেলে ইঁহাদের বিদ্ধ করিবার সঙ্কল্প। আছে শুধু দেশের ও দশের কাছে ইঁহাদের হেয় প্রতিপন্ন করিবার নির্দয় বাসনা। মনের অনৈক্য মাত্রেই বাণীর মন্দিরে সেবকদিগের এই আত্মঘাতী কলহে না আছে গৌরব, না আছে কল্যাণ।
বিশ্বকবির এই ‘সাহিত্য-ধর্মে’র শেষের দিকটা আমি সবিনয়ে প্রতিবাদ করি। ভাগ্যদোষে আমার প্রতি তিনি বিরূপ, আমার কথা হয়ত তিনি বিশ্বাস করিতে পারিবেন না, কিন্তু তাঁহাকে সত্যই নিবেদন করিতেছি যে, বাঙ্গালা সাহিত্যসেবীদের মাঝে এমন কেহই নাই যে তাঁহাকে মনে মনে গুরুর আসনে প্রতিষ্ঠিত করে নাই, আধুনিক সাহিত্যের অমঙ্গল আশঙ্কায় যাহারা তাঁহার কানের কাছে ‘গুরুদেব’ বলিয়া অহরহ বিলাপ করিতেছে, তাহাদের কাহারও চেয়েই ইহারা রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধায় খাটো নহে।
————
(‘বঙ্গবাণী’ ১৩৩৪ আশ্বিন সংখ্যা হইতে গৃহীত।)