শিবপুরের এই ক্ষুদ্র সমিতির সাহিত্য-শাখার পক্ষ হইতে আপনাদিগের সম্বর্ধনার ভার একজন সাহিত্য-ব্যবসায়ীর হাতে পড়িয়াছে। আমি আপনাদিগকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করিতেছি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কয়েকটি সাহিত্যিক জমায়েত হইয়া গিয়াছে; তাহাদের আয়োজন ও আয়তনের বিপুলতার কাছে এই ক্ষুদ্র অধিবেশনটি আরও ক্ষুদ্র কিন্তু আপনাদের পদার্পণে এই ক্ষুদ্র বস্তুটি আজ যে গৌরব লাভ করিবে, তাহাকে কিছুতেই যে আর ছোট বলা চলিবে না, এই লোভই আমরা কোনমতে সম্বরণ করিতে পারি নাই।
সমস্ত বিশ্বের বরণীয় কবি আজ আমাদের সভাপতি। অনেক কষ্টে তাঁহাকে সংগ্রহ করিয়াছি; শুধু কেবল তাঁহাকে মাঝখানে পাইবার লোভেই নয়,—এই সভাপতি লইয়া অনেক ক্ষেত্রে অনেকেরই মর্মপীড়ার কারণ ঘটে। আমরা তাই স্থির করিয়াছিলাম যে, এমন এক ব্যক্তিকে আনিয়া হাজির করিব, যাঁহার সর্বোচ্চ স্থানটি লইয়া তর্ক না থাকে,—এই আনন্দ-উৎসবের মাঝখানে মর্মদাহের যেন আর লেশমাত্র অবকাশ না ঘটে।
সর্বপ্রকার সভা-সমিতিতেই গতিবিধি আমার অল্প। কখনো বা খবর পাই না বলিয়া, এবং কখনো বা পারিয়া উঠি না বলিয়াই যাওয়া হয় না। অতএব সাহিত্যের নাম দিয়া দেশের মধ্যে সচরাচর যে-সকল দরবার বসে, সেখানে ঠিক যে কি-সব হয় আমি জানি না। তবে, ঘরে বসিয়া সংবাদপত্রাদির মারফতে যে-সকল তথ্য পাই তাহা হইতে মোটামুটি একটা ধারণা জন্মিয়াছে। আজিকার এই সমবেত সাহিত্যিকগণের সম্মুখে আমি সবিনয়ে তাহারই কিঞ্চিৎ আভাস দিবার চেষ্টা করিব।
বহু ধনীর সমাগমে আড়ম্বর-বহুল দেশের এই-সকল সাহিত্যিক-জনতায় দরিদ্র সাহিত্যিকগণ উপস্থিত হন কি না আমি নিশ্চয় জানি না। এবং হইলেও, কিছু তাঁহারা তথায় বলিবার প্রয়াস করেন কি না, তাহাও অবগত নই। হয়ত কিছু বলেন, কিন্তু সভার একান্ত হইতে নিরন্ন, নিছক-সাহিত্যসেবীর ক্ষীণকণ্ঠ প্রবল পক্ষের উদ্দাম কোলাহলে খুব সম্ভব ঢাকা পড়িয়া যায়—তাঁহাদের কথা আমাদের কানে পৌঁছে না।
কিন্তু কণ্ঠ যাঁহাদের চাপা পড়ে না,—কথা যাঁহাদের সাধারণের কানে ঢাকের মত পিটিতে থাকে,—গলায় তাঁহাদের জোর আছে বলিয়া আমি দ্বেষ করি না, কিংবা সাহিত্য-সাধনায় বৎসরের তিন শ’ চৌষট্টি দিনই সাহিত্যিকগণকে অকাতরে ছাড়িয়া দিয়া কেবল মাত্র একটি দিন যাঁহারা নিজেদের হাতে রাখিয়াছেন, এইরূপ বিনীত ও উদার ব্যক্তিদের প্রতি ঈর্ষা হওয়াও সম্ভবপর নয়। কিন্তু এই একটা মাত্র দিনের উদ্যম যখন তাঁহাদের সকল সীমা অতিক্রম করিয়া যায়, তখন দুই-একটা কথা বলিবার প্রয়োজন হইয়া পড়ে।
এইখানে আমি একটা কথা ভাল করিয়া বলিয়া রাখিতে চাই যে, কোন ব্যক্তি বা সমিতিবিশেষকে লক্ষ্য করিয়া আমি একটা কথাও বলিতেছি না। কারণ, ইহা বিশেষ কোন লোক বা বিশেষ কোন সমিতির খেয়ালের ব্যাপার হইলে বলার কোন প্রয়োজনই হইত না। আমি সাধারণভাবেই আমার মন্তব্য প্রকাশ করিতেছি।
আমি লক্ষ্য করিয়াছি যে, সাহিত্য রচনার কাজটাকে বাহুল্য মনে করিয়া যাঁহারা ইহার সমালোচনার কাজে মনোনিবেশ করিয়াছেন, বক্তব্য তাঁহাদের প্রধানতঃ দুইটি। অন্য শাখা-প্রশাখা অনেক আছে,—সে কথা পরে হইবে।
প্রথমে তাঁহারা বলেন যে, বাঙ্গালা ভাষার মত ভাষা আর কাহার আছে? আমাদের সাহিত্য বিশ্ব-সাহিত্যে স্থান পাইয়াছে; আমাদের সাহিত্য ‘নোবেল প্রাইজ’ পাইয়াছে; এমন কি আমাদের সাহিত্য যে খুব ভালো, এ কথা বিলাতের সাহেবরা পর্যন্ত বলিতেছে। পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে এতবড় উন্নতি কোন্ দেশে আর কবে করিয়াছে?
তাঁহাদের দ্বিতীয় বক্তব্য এই যে, বাঙ্গালা সাহিত্য রসাতলে গেল,—আর বাঁচে না। আবর্জনায় বাঙ্গালা সাহিত্য বোঝাই হইয়া উঠিল, আমাদের কথা কেহ শুনে না; হায়! হায়! বঙ্কিমচন্দ্র বাঁচিয়া নাই, মুগুর মারিবে কে? ঝুড়ি ঝুড়ি নাটক নভেল ও কবিতা বাহির হইতেছে, তাহাতে সুশিক্ষা নাই—তাহা নিছক দুর্নীতিপূর্ণ। ইহার কুফলও স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। কারণ প্রত্নতত্ত্বের যে-সকল বই এখনও লেখা হয় নাই, তাহার প্রতি পাঠকদিগের আগ্রহ দেখা যাইতেছে না, এবং ইতিহাস, বিজ্ঞান প্রভৃতি ভাল ভাল বই পাঠকদিগের উৎসাহের অভাবে লেখাই হইতেছে না।
অবশ্য আমি স্বীকার করি, যে-সকল বই লেখা হয় নাই, তাহা না পড়িবার প্রায়শ্চিত্ত কি আমি জানি না, এবং পাঠকের আগ্রহের অভাবে যে-সকল পণ্ডিত ব্যক্তিদের বই লেখা বন্ধ হইয়া আছে, ইহারই যে কি উপায় আছে, তাহাও আমার গোচর নয়, কিন্তু ঝুড়ি ঝুড়ি বই লেখা সম্বন্ধে আমার কিছু বলিবারও আছে এবং বোধ হয় বলিবার সামান্য দাবীও আছে।
যাঁহারা এই অভিযোগ আনেন তাঁহারা কখনো কি হিসাব করিয়া দেখিয়াছেন বাস্তবিক কয়টা বই মাসে মাসে বাহির হয়? ভাল ও মন্দে মিলাইয়া আজ পর্যন্ত কয়খানা নাটক, নভেল ও কবিতার বই বঙ্গভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে এবং তাহাদের সংখ্যা কত? বঙ্গসাহিত্য আমাদের বিশ্ব-সাহিত্যে জায়গা লইয়াছে জানি, কিন্তু শুধু কেবল আমরাই ত নয়, আরও ত কেহ কেহ আছেন বিশ্ব-সাহিত্যে যাঁহারা আমাদেরই মত স্থান পাইয়াছেন, তাঁহাদের নাটক নভেলের তুলনায় কয়খানা নাটক নভেল বাঙ্গালায় আছে? কবিতার বই বা কয়টা বাহির হইয়াছে? নাটক নভেলে বাঙ্গালা দেশ প্লাবিত হইয়া গেল, এ বুলি কে আবিষ্কার করিয়াছিলেন আমি জানি না, কিন্তু এখন যে-কেহ দেখি আপনাকে বঙ্গ-সাহিত্যের বিচারক বলিয়া স্থির করেন, তিনিই এই বুলি নির্বিচারে আবৃত্তি করিয়া যান, মনে করেন, সমঝদার বলিয়া খ্যাতি অর্জন করিবার ইহার চেয়ে বড় পথ আর নাই।
কথায় কথায় তাঁহারা বিশ্ব-সাহিত্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু বিশ্ব-সাহিত্যের সহিত সত্যকার পরিচয় যদি তাঁহাদের থাকিত, ত জানিতেন যাহাকে তাঁহারা আবর্জনা বলিয়া ঘৃণা প্রকাশ করেন, সেই আবর্জনাই সকল সাহিত্যের বনিয়াদ, তাহারাই সাহিত্যের অস্থি-মজ্জা। মেঘদূত, চণ্ডীদাস, গীতাঞ্জলি কোন সাহিত্যেই ঝুড়ি ঝুড়ি সৃষ্টি হয় না। এবং আবর্জনা থাকে বলিয়াই ইহাদের জন্মলাভ সম্ভবপর হইয়াছে; না হইলে হইত না। আবর্জনার বালাই যেদিন দূর হইবে, সেদিন যাহাকে তাঁহারা সারবস্তু বলিতেছেন, সেও সেই পথেই অন্তর্হিত হইবে। আবর্জনা চিরজীবী হইয়া থাকে না, নিজের কাজ করিয়া সে মরে, সেই তাহার প্রয়োজন, সেই তাহার সার্থকতা। কিন্তু সেই আবর্জনার ভার বহিতে যেদিন দেশ অস্বীকার করিবে, সেদিন আনন্দ করিবার দিন নহে, সেদিন দেশের দুর্দিন।
আর এই যে একটা কথা,—ভাল ভাল বই অর্থাৎ ইতিহাস, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই বাহির হইতেছে না, কেবল কবিতা, কেবল উপন্যাস,—এ কথার উত্তর কি কথাসাহিত্য-লেখকদের দিবার? তাহারা বড় জোর এই কথাটাই স্মরণ করাইয়া দিতে পারে যে, বাঙ্গালা দেশের ‘গীতাঞ্জলি’ বাঙ্গালা দেশের ‘ঘরে-বাইরে’ —অর্থাৎ কথা-সাহিত্যই বিশ্ব-সাহিত্যে আসন লাভ করিয়াছে।
সম্প্রতি একটা কলরব উঠিয়াছে যে, আধুনিক উপন্যাস লেখকেরা বঙ্কিম-সাহিত্যকে ডুবাইয়া দিল। বঙ্কিম-সাহিত্য ডুবিবার নয়। সুতরাং আশঙ্কা তাহাদের বৃথা। কিন্তু আধুনিক ঔপন্যাসিকদের বিরুদ্ধে এই যে নালিশ যে, ইহারা বঙ্কিমের ভাষা, ভাব, ধরন-ধারণ, চরিত্র-সৃষ্টি কিছুই আর অনুসরণ করিতেছে না, অতএব অপরাধ ইহাদের অমার্জনীয়, ইহার জবাব দেওয়া একটা প্রয়োজন। আমি বয়েসে যদিচ প্রাচীন হইয়াছি, কিন্তু সাহিত্য-ব্যবসায় আজও আমার বছর— দশেক উত্তীর্ণ হয় নাই। অতএব আধুনিকদের পক্ষ হইতে উত্তর দিই ত বোধ করি অন্যায় হইবে না। অভিযোগ ইহাদের সত্য, আমি তাহা অকপটে স্বীকার করিতেছি, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা আমাদের কাহারও অপেক্ষা কম নয়, এবং সেই শ্রদ্ধার জোরেই আমরা তাঁহার ভাষা, ভাব পরিত্যাগ করিয়া আগে চলিতে দ্বিধা বোধ করি নাই। মিথ্যা ভক্তির মোহে আমরা যদি তাঁহার সেই ত্রিশ বৎসর পূর্বেকার বস্তুই শুধু ধরিয়া পড়িয়া থাকিতাম, ত কেবলমাত্র গতির অভাবেই বাঙ্গালা সাহিত্য আজ মরিত। দেশের কল্যাণে এক দিন তিনি নিজে প্রচলিত ভাষা ও পদ্ধতি পরিত্যাগ করিয়া পা বাড়াইতে ইতস্ততঃ করেন নাই, তাঁহার সেই নির্ভীক কর্তব্য-বোধের দৃষ্টান্তকেই আজ যদি আমরা তাঁহার প্রবর্তিত সাহিত্য-সৃষ্টির চেয়েও বড় করিয়া গ্রহণ করিয়া থাকি, ত সে তাঁহার মর্যাদাহানি করা নয়। এবং সত্যই যদি তাঁহার ভাষা, ধরন-ধারণ, চরিত্র-সৃষ্টি প্রভৃতি সমস্তই আমরা আজ ত্যাগ করিয়া গিয়া থাকি ত দুঃখ করিবারও কিছু নাই। কথাটা পরিস্ফুট করিবার জন্য একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি। তাঁহার মর্যাদা লঙ্ঘন করিতেছি, আশা করি এ কথা কাহারও মনে কল্পনায়ও উদয় হইবে না। ধরা যাক তাঁহার ‘চন্দ্রশেখর’ বই। শৈবলিনীর সম্বন্ধে লেখা আছে—“এমনি করিয়া প্রেম জন্মিল।” এই ‘এমনি’টা হইতেছে—নক্ষত্র দেখা, নৌকার পাল গণনা করা, মালা গাঁথিয়া গাভীর শৃঙ্গে পরাইয়া দেওয়া, আরও দুই-একটা কি আছে, আমার ঠিক মনে নাই। কিন্তু তাহার পরবর্তী ঘটনা অতিশয় জটিল। গঙ্গায় ডুবিতে যাওয়া হইতে আরম্ভ করিয়া সাহেবের নৌকায় চড়িয়া পরপুরুষ কামনা করিয়া স্বামিগৃহ ত্যাগ করিয়া যাওয়া অবধি, সে-সমস্তই নির্ভর করিয়াছে শৈবলিনীর বাল্যকালে ‘এমনি করিয়া’ যে প্রেম জন্মিয়াছিল তাহারই উপর।
তখনকার দিনে পাঠকেরা লোক ভাল ছিল। এবং বোধ করি তখনকার দিনের সাহিত্যের শৈশবে ইহার অধিক গ্রন্থকারের কাছে তাহারা চাহে নাই, এবং এই দুষ্কৃতির জন্য শেষকালে শৈবলিনীর যে-সকল শাস্তিভোগ হইয়াছিল তাহাতেই তাহারা খুশী হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু এখনকার দিনের পাঠকেরা অত্যন্ত তার্কিক, তাহারা গ্রন্থকারের মুখের কথায় বিশ্বাস করিতে চাহে না, নিজে তাহারা বিচার করিয়া দেখিতে চায় শৈবলিনী লোক কিরূপ ছিল, তাহার কতখানি প্রেম জন্মিয়াছিল, জন্মানো সম্ভবপর কি না এবং এতবড় একটা অন্যায় করিবার পক্ষে সেই প্রেমের শক্তি যথেষ্ট কি না। প্রতাপ অতবড় একটা কাজ করিল, কিন্তু এখনকার দিনের পাঠক হয়ত অবলীলাক্রমে বলিয়া বসিবে—কি এমন আর সে করিয়াছে! শৈবলিনী পরস্ত্রী, গুরুপত্নী,—নিজের ঘরে পাইয়া তাহার প্রতি অত্যাচার করে নাই, এমন অনেকেই করে না, এবং করিলে গভীর অন্যায় করা হয়। আর তার যুদ্ধের অজুহাতে আত্মহত্যা? তাহাতে পৌরুষ থাকিতে পারে, কিন্তু কাজ ভাল নয়। সংসারের উপরে, নিজের স্ত্রীর উপরে এই যে একটা অবিচার করা হইয়াছে, আমরা তাহা পছন্দ করি না। আর তাহার মানসিক পাপের প্রায়শ্চিত্ত? তা আত্মহত্যায় আবার প্রায়শ্চিত্ত কিসের? অথচ, সেকালে আমি লোককে এই বলিয়া আশীর্বাদ করিতে শুনিয়াছি, “তুমি প্রতাপের ন্যায় আদর্শ পুরুষ হও।” মানুষের মতিগতি কি বদলাইয়া গেছে!
আর একটা চরিত্রের উল্লেখ করিয়া আমি এ প্রসঙ্গ শেষ করিব। সে ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র রোহিণীর চরিত্র। এ কথা কেন তুলিলাম হয়ত তাহা অনেকেই বুঝিবেন। সেদিনের সঙ্গে এ দিনের এইখানেই একটা প্রকাণ্ড বিচ্ছেদ ঘটিয়াছে। তাহার জীবনের অবসান হইয়াছে পিস্তলের গুলিতে। এইরূপে তাহার পাপের শাস্তি না হইলে কানা ও খোঁড়া হইয়া তাহাকে নিশ্চয়ই কাশীর পথে পথে ‘একটি পয়সা দাও’ বলিয়া ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতে হইত। তার চেয়ে এ ভালই হইয়াছে, সে মরিয়াছে। তাহার মরার সম্বন্ধে আধুনিক লেখক ও পাঠকগণের যে আপত্তি আছে তাহা নয়। কিন্তু আগ্রহও নাই। বস্তুতঃ এ সম্বন্ধে আমরা অনেকটা উদাসীন। পাপের শাস্তি না হইলে গ্রন্থ শিক্ষাপ্রদ হইবে না, অতএব শাস্তি চাই-ই। এই ‘চাই-ই’-এর জন্য গ্রন্থকারকে যে অদ্ভুত উপায় অবলম্বন করিতে হইয়াছে, সেইখানেই আমাদের বড় বাধা। তাহার গোবিন্দলালকে ভালোবাসিবার যে শক্তি, সাধারণ নারীতে তাহা অসম্ভব,—উইল বদলাইতে সে কৃষ্ণকান্তের মত বাঘের ঘরে ঢুকিয়াছিল—গোবিন্দলালের ভাল করিতে, ‘বারুণী’র জলতলে প্রাণ দিতে গিয়াছিল সে এমনিই প্রিয়তমের জন্য, আবার সেই রোহিণীই যখন কেবলমাত্র নীতিমূলক উপন্যাসের উপরোধেই অকারণে এবং এক মুহূর্তের দৃষ্টিপাতে সমস্ত ভুলিয়া, আর একজন অপরিচিত পুরুষকে গোবিন্দলালের অপেক্ষাও বহুগুণে সুন্দর দেখিয়া প্রাণ দিল, তখন পুণ্যের জয় ও পাপের পরাজয় সপ্রমাণ করিয়া সাংসারিক লোকের সুশিক্ষার পথে হয়ত প্রভূত সাহায্য করা হইল, কিন্তু আধুনিক লেখক তাহাকে গ্রহণ করিতে পারিল না। রোহিণী পাপিষ্ঠা, এবং যে পাপিষ্ঠার প্রতি আমাদের কোন সহানুভূতি নাই, তাহারও প্রতি কিন্তু এতবড় অবিচার করিতে আমাদের হাত উঠে না। সেকাল ও একালে এখানেই মস্তবড় ব্যবধান। বিধবা রোহিণীর দুর্ভাগ্য যে, সে গোবিন্দলালকে ভালোবাসিয়াছিল। তাহার দুর্বুদ্ধি, তাহার দুর্বলতা,—কিন্তু পাপের সঙ্গে এক করিয়া, ইহাদের একত্রে ছাপ মারিয়া দিবার যখন অনুরোধ আসে তখন সে অনুরোধ রক্ষা করাকেই আমরা অকল্যাণ বলিয়া মনে করি।
প্রবৃত্তিকে বুদ্ধির বাটখারায় ওজন করিয়া সাহিত্যের মূল্য নির্দেশ করিতে গেলে কি হয় তাহার একটা উদাহরণ দিতেছি। একটুখানি ব্যক্তিগত হইলেও আমাকে আপনারা ক্ষমা করিবেন। ‘পল্লী-সমাজ’ বলিয়া একটা গ্রন্থ আছে। তাহাতে বিধবা রমা রমেশকে ভালোবাসিয়াছে দেখিয়া সেদিন একজন প্রবীণ সাহিত্যিক ও সমালোচক, ‘সাহিত্যের স্বাস্থ্য-রক্ষা’ গ্রন্থে এইরূপে রমাকে তিরস্কার করিয়াছেন— “তুমি না অত্যন্ত বুদ্ধিমতী? তুমি বুদ্ধিবলে পিতার জমিদারি শাসন করিয়া থাক, কিন্তু নিজের চিত্ত দমন করিতে পারিলে না? তুমি এতদূর সতর্ক যে রমেশের চাকরের নামে পুলিশে ডায়েরী করাইয়া রাখিলে, অথচ তুমি শিবপূজা কর, তাহার সার্থকতা কোথায়? তোমার এই পতন নিতান্তই ইচ্ছাকৃত।” এই অভিযোগের কি কোন উত্তর আছে, বিশেষ করিয়া সাহিত্যিক হইয়া সাহিত্যিককে মানুষে যখন এমনি করিয়া জবাবদিহি করিতে চায়?
সেই ভাল-মন্দ, সেই উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন; শুধু এই উচিত-অনুচিতই রোহিণীকে গোবিন্দলালের লক্ষ্য করিয়া দাঁড় করাইয়াছিল। যেখানে ভালবাসা উচিত নয়, সেখানে ভালবাসার অপরাধ যতই হউক,— বিশ্বাসহন্ত্রীর ঢের বড় অপরাধ মৃত্যুকালে হতভাগিনীর কপালে বঙ্কিমচন্দ্রকে দাগিয়া দিতেই হইল। এই অসঙ্গত জবরদস্তিই আধুনিক সাহিত্যিক স্বীকার করিয়া লইতে পারিতেছে না। ভাল-মন্দ সংসারে চিরদিনই আছে। হয়ত চিরদিনই থাকিবে। ভালকে ভাল, মন্দকে মন্দ সে-ও বলে; মন্দের ওকালতি করিতে কোন সাহিত্যিকই কোন দিন সাহিত্যের আসরে অবতীর্ণ হয় না, কিন্তু ভুলাইয়া নীতিশিক্ষা দেওয়াও সে আপনার কর্তব্য বলিয়া জ্ঞান করে না। দুর্নীতিও সে প্রচার করে না। একটুখানি তলাইয়া দেখিলে তাহার সমস্ত সাহিত্যিক-দুর্নীতির মূলে হয়ত এই একটা চেষ্টাই ধরা পড়িবে যে, সে মানুষকে মানুষ বলিয়াই প্রতিপন্ন করিতে চায়।
————
(১৩৩০ সালের ১৬ আষাঢ় হাওড়া টাউন হলে অনুষ্ঠিত শিবপুর ইন্স্টিটিউটের সাহিত্যসভায় পঠিত অভিভাষণ।)