চতুর্থ অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
বিজয়ার বাটী-সংলগ্ন উদ্যানের অপর প্রান্ত
[অদূরে সরস্বতী নদীর কিছু কিছু দেখা যাইতেছে, বিজয়া ও কানাই সিং। দয়াল প্রবেশ করিলেন]
দয়াল। তোমাকেই খুঁজে বেড়াচ্চি মা। শুনলাম এইদিকেই এসেছো, ভাবলাম বাড়ি যাবার আগে এদিকটা দেখে যাই যদি দেখা মেলে।
বিজয়া। কেন দয়ালবাবু।
দয়াল। আজ তৃতীয়া, পূর্ণিমা হলো সতেরোই। আর কটা দিন বাকী বলো ত মা?
বিবাহের সমস্ত উদ্যোগ-আয়োজন এই ক’দিনেই সম্পূর্ণ করে নিতে হবে। অথচ রাসবিহারীবাবু সমস্ত দায়িত্ব আমার উপর ফেলে নিশ্চিন্ত হয়েছেন।
বিজয়া। দায়িত্ব নিলেন কেন?
দয়াল। এ যে আনন্দের দায়িত্ব মা,—নেবো না?
বিজয়া। তবে অভিযোগ করচেন কেন?
দয়াল। অভিযোগ করিনি বিজয়া; কিন্তু মুখে বলচি বটে আনন্দের দায়িত্ব, তবু কেন জানিনে, কাজে উৎসাহ পাইনে, মন কেবলি এর থেকে দূরে সরে থাকতে চায়!
বিজয়া। কেন দয়ালবাবু?
দয়াল। তাও ঠিক বুঝিনে। জানি এ-বিবাহে তুমি সম্মতি দিয়েছ, নিজের হাতে নামসই করেছ,—আগামী পূর্ণিমায় বিবাহও হবে, তবু এর মধ্যে যেন রস পাইনে মা। সেদিন আমার অসম্মানে বিরক্ত হয়ে তুমি বিলাসবাবুকে যে তিরস্কার করলে সে সত্যই রূঢ়, সত্যই কঠোর; তবু, কেন জানিনে মনে হয়ে এর মধ্যে কেবল আমার অপমানই নেই, আরও কিছু গোপন আছে যা তোমাকে অহরহ বিঁধচে। (কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া) তোমার কাছে সর্বদা আসিনে বটে, কিন্তু চোখ আছে মা। তোমার মুখে আসন্ন-মিলনের স্বর্গীয় দীপ্তি কৈ,—কৈ সে সূর্যোদয়ের অরুণ আভা? তুমি জানো না মা, কিন্তু কতদিন নিরালায় তোমার ক্লান্ত বিষণ্ণ মুখখানি আমার চোখে পড়েছে। বুকের ভেতর কান্নার ঢেউ উথলে উঠেচে—
বিজয়া। না দয়ালবাবু, ও-সব কিছুই নয়।
দয়াল। আমার মনের ভুল, না মা?
বিজয়া। (ম্লান হাসিয়া) ভুল বৈ কি।
দয়াল। তাই হোক মা, আমার ভুলই যেন হয়। এ-সময়ে বাবার জন্যে বোধ করি মন কেমন করে—না বিজয়া? (বিজয়া নীরবে মাথা নাড়িয়া সায় দিল) (দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া) এমন দিনে তিনি যদি বেঁচে থাকতেন!
বিজয়া। আমাকে কি জন্যে খুঁজছিলেন বললেন না ত দয়ালবাবু?
দয়াল। ওঃ—একেবারেই ভুলেচি। বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র ছাপাতে হবে, তোমার বন্ধুদের সমাদরে আহ্বান করতে হবে, তাঁদের আনবার ব্যবস্থা করতে হবে,—তাই তাঁদের সকলের নামধাম জানতে পারলে—
বিজয়া। নিমন্ত্রণপত্র বোধ করি আমার নামেই ছাপানো হবে?
দয়াল। না মা, তোমার নামে হবে কেন? রাসবিহারীবাবু বর-কন্যা উভয়েরই যখন অভিভাবক তখন তাঁর নামেই নিমন্ত্রণ করা হবে স্থির হয়েছে।
বিজয়া। স্থির কি তিনিই করেছেন?
দয়াল। হাঁ, তিনিই বৈ কি।
বিজয়া। তবে এ-ও তিনিই স্থির করুন। আমার বন্ধু-বান্ধব কেউ নেই।
দয়াল। (সবিস্ময়ে) এ কেমনধারা জবাব হলো মা! এ বললে আমরা কাজের জোর পাব কোথা থেকে?
বিজয়া। হাঁ দয়ালবাবু, সেদিন নরেনবাবুকে কি আপনি একতাড়া চিঠি দিয়েছিলেন?
দয়াল। দিয়েছি মা। সেদিন হঠাৎ দেখি একটা ভাঙ্গা দেরাজের মধ্যে এক বাণ্ডিল পুরানো চিঠি। তাঁর বাবার নাম দেখে তাঁর হাতেই দিলাম। কোন দোষ হয়েছে কি মা?
বিজয়া। না দয়ালবাবু, দোষ হবে কেন? তাঁর বাবার চিঠি তাঁকে দিয়েছেন এ ত ভালোই করেছেন। চিঠিগুলো কি আপনি পড়েছিলেন?
দয়াল। (সবিস্ময়ে) আমি? না, না, পরের চিঠি কি কখনো পড়তে পারি?
বিজয়া। চিঠির সম্বন্ধে আপনাকে তিনি কি কিছু বলেন নি?
দয়াল। একটি কথাও না। কিন্তু কিছু জানবার থাকলে তাঁকে জিজ্ঞেসা করে আমি কালই তোমাকে বলতে পারি।
বিজয়া।কালই বলবেন কি করে? তিনি ত আর এদিকে আসেন না।
দয়াল। আসেন বৈ কি। আমাদের বাড়িতে রোজ আসেন।
বিজয়া। রোজ? আপনার স্ত্রীর অসুখ কি আবার বাড়লো? কৈ, সে কথা ত আপনি একদিনও বলেন নি?
দয়াল। (হাসিয়া) না মা, এখন তিনি বেশ ভালোই আছেন। তাই বলিনি। নরেনের চিকিৎসা এবং ভগবানের দয়া।
[হাতজোড় করিয়া উদ্দেশে নমস্কার করিলেন]
বিজয়া। ভালো আছেন, তবু কেন তাঁকে প্রত্যহ আসতে হয়?
দয়াল। আবশ্যক না থাকলেও জন্মভূমির মায়া কি সহজে কাটে? তা ছাড়া, আজকাল ওঁর কাজকর্ম নেই, সেখানে বন্ধু-বান্ধব বিশেষ কেউ নেই—তাই সন্ধ্যেবেলাটা এখানেই কাটিয়ে যান। আমার স্ত্রী ত তাঁকে ছেলের মত ভালবাসেন। ভালবাসার ছেলেও বটে। এমন নির্মল, এমন স্বভাবতঃ ভদ্রমানুষ আমি কম দেখেচি মা। নলিনীর ইচ্ছে সে বি. এ. পাস করে ডাক্তারি পড়ে। এ বিষয়ে তাকে কত উৎসাহ কত সাহায্য করেন তার সীমা নেই। ওঁর সাহায্যে এরই মধ্যে নলিনী অনেকগুলো বই পড়ে শেষ করেছে। লেখাপড়ায় দু’জনের বড় অনুরাগ। আপনার প্রিয়জনের জন্য সেরা উপহার
বিজয়া। তা হোক, কিন্তু আপনি কি আর কিছু সন্দেহ করেন না?
দয়াল। কিসের সন্দেহ মা?
বিজয়া। আমার মনে হয় কি জানেন দয়ালবাবু?
দয়াল। কি মনে হয় মা?
বিজয়া। আমার মনে হয় নলিনীর সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে প্রকাশ করা উচিত।
দয়াল। ও—এই বলচ? সে আমারও মনে হয়েছে মা, কিন্তু তার ত এখনো সময় যায়নি। বরঞ্চ দু’জনের পরিচয় আরো একটু ঘনিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত সহসা কিছু না বলাই উচিত।
বিজয়া। কিন্তু নলিনীর পক্ষে ত ক্ষতিকর হতে পারে। তাঁর মনস্থির করতে হয়ত সময় লাগবে, কিন্তু ইতিমধ্যে নলিনীর—
দয়াল। সত্যি কথা। কিন্তু আমার স্ত্রীর কাছে যতদূর শুনেচি তাতে,—না না নরেনকে আমরা খুব বিশ্বাস করি। তাঁর দ্বারা যে কারো কোন ক্ষতি হতে পারে, তিনি ভুলেও যে কারো প্রতি অন্যায় করতে পারেন, এ আমি ভাবতেই পারিনে। কিন্তু একি, কথায় কথায় যে তুমি অনেক দূর এগিয়ে এসেছ। এতখানিই যদি এলে, চল না মা, তোমার এ বাড়িটাও একবার দেখে আসবে। নলিনীর মামী কত যে খুশী হবে তার সীমা নেই।
বিজয়া। চলুন, কিন্তু ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে যে।
দয়াল। হলোই বা। আমি তার ব্যবস্থা করব। তা ছাড়া সঙ্গে কানাই সিং ত আছেই।
[উভয়ের প্রস্থান
দ্বিতীয় দৃশ্য
দয়ালবাবুর বাটীর নীচের বারান্দা
[নলিনী ও নরেন। টেবিলের দুইদিকে দুইজন বসিয়া, সম্মুখে খোলা বই দোয়াত কলম ইত্যাদি রক্ষিত]
নলিনী। সত্যিই মিস রায়ের বিবাহে আপনি উপস্থিত থাকবেন না? এই ত মাত্র কটা দিন পরে, আর রাসবিহারীবাবু কি অনুরোধই না আপনাকে করেছেন।
নরেন। তিনি করেছেন বটে, কিন্তু যাঁর বিবাহ তিনি নিজে ত একটি মুখের কথাও বলেন নি।
নলিনী। বললে থাকতেন?
নরেন। না। থাকবার জো নেই আমার। যত শীঘ্র সম্ভব নতুন চাকরিতে গিয়ে যোগ দিতে হবে।
নলিনী। কিন্তু আমার বেলায়? সে-ও থাকবেন না?
নরেন। থাকব। নিমন্ত্রণপত্র পাঠাবেন, যদি অসম্ভব না হয় আপনার বিবাহে আমি উপস্থিত হবোই।
নলিনী। কথা দিলেন?
নরেন। হাঁ, দিলুম কথা। হয়ত এমনি কথা বিজয়াকেও দিতুম যদি তিনি নিজে অনুরোধ করতেন। কাজের ক্ষতি হলেও।
নলিনী। দেখুন ডক্টর মুখার্জী, এ বিবাহে বিজয়ার সুখ নেই, আনন্দ নেই এই আমার ঘোরতর সন্দেহ। সেইজন্যেই আপনাকে অনুরোধ করেন নি।
নরেন। কিন্তু তিনি নিজেই ত সম্মতি দিয়েছেন।
নলিনী। দিয়েছেন মুখের সম্মতি—হয়ত বাধ্য হয়ে। কিন্তু অন্তরের সম্মতি কখনো দেননি। আমার মামার মত নিরীহ সরল মানুষ, যিনি সামনে ছাড়া এতটুকু আশেপাশে দেখতে পান না, তাঁরও কেমন যেন সংশয় জেগেছে, বিজয়া যাকে চায় সে লোক ঐ বিলাসবাবু নয়। কালকেই বলছিলেন আমাকে, নলিনী, বিবাহ-আয়োজনের সব ভারটাই এসে পড়েছে আমার ‘পরে, কিন্তু মনে উৎসাহ পাইনে মা, কেবলই ভয় হতে থাকে যেন কি একটা গর্হিত কাজে প্রবৃত্ত হয়েছি। যতই দেখি ওকে ততই মনে হয় দিন দিন শুকিয়ে যেন বিজয়া কালি হয়ে যাচ্চে। কেনই বা এখানে এসেছিলুম, শেষ বয়সে যদি পাপ অর্জন করেই যাই মরণের পরে তাঁর কাছে গিয়ে কি জবাব দেব মা!
নরেন। দেখুন মিস দাস, ও-সব কিছু না। বিজয়া এই সেদিন অসুখ থেকে উঠলেন, এখনো ভালো সেরে উঠতে পারেন নি।
নলিনী। তাই প্রতিদিন শুকিয়ে যাচ্চেন? ডক্টর মুখার্জী, আমার মামা তবু সামনাসামনি দেখতে পান, কিন্তু আপনি তাও পান না। আপনি তাঁর চেয়েও অন্ধ। সেদিনের কথা মনে করে দেখুন, ভালোবাসলে কোন মেয়ে প্রভু-ভৃত্য সম্বন্ধের কথা বিলাসবাবুকে কিছুতে বলতে পারতেন না,—তা যত রাগই হোক।
নরেন। বড়লোক টাকার অহঙ্কারে সব পারে মিস দাস। ওদের মুখে কিছু আটকায় না।
নলিনী। এ বলা আপনার ভারী অন্যায় ডক্টর মুখার্জী। আপনার আগে আমি ওঁকে দেখেচি—আমরা এক কলেজে পড়তুম। ঐশ্বর্য আছে, কিন্তু ঐশ্বর্যের গর্ব কোনদিন কেউ অনুভব করিনি। ওঁর কত দয়া, কত দান, কত পুণ্য অনুষ্ঠান।—মনে নেই আপনার? অপরিচিত আপনি, তবু আপনার কথাতেই পূর্ণবাবুর বাড়ির পূজোর অনুমতি তখনি দিয়ে দিলেন। বিলাসবাবু, রাসবিহারীবাবু শত চেষ্টাতেও তা বন্ধ করতে পারলে না। ভদ্রতা, সহানুভূতি, ন্যায়-অন্যায়বোধ কতটা জাগ্রত থাকলে এ-রকম হতে পারে একবার ভেবে দেখুন দিকি। আমার মামা ত গরীব, কিন্তু কি শ্রদ্ধাই না তাঁকে করেন। এ কি ধনীর দর্পের প্রকাশ ডক্টর মুখার্জী?
নরেন। (কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া) সে সত্যি। কেউ অভুক্ত জানলে না খাইয়ে কিছুতে ছেড়ে দেবে না, যেমন করে হোক খাওয়াবেই। আর সে কি যত্ন!
নলিনী। তবে? এ-সব কি আসে সম্পদের দম্ভ থেকে?
নরেন। আর কি অদ্ভুত অপরিসীম পিতৃভক্তি এই মেয়েটির। এই বাড়িটা নিয়ে পর্যন্ত তাঁর মনে শান্তি ছিল না, নিতে হয়েছিল শুধু বিলাসবাবুর জবরদস্তিতে—
নলিনী। এ কথা আমরা সবাই জানি ডক্টর মুখার্জী।
নরেন। হাঁ অনেকেই জানে। সেদিন ওঁকে একটু বিপদগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যেই বনমালীবাবুর সেই চিঠির উল্লেখ করে বলেছিলুম, আমার বাবা যত ঋণই করে থাকুন, আপনার বাবা কিন্তু এ-বাড়ি আমাকেই যৌতুক দিয়েছিলেন। তবু আপনি কেড়ে নিলেন। শুনে বিজয়ার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল, বললেন, সত্যি হলে এ বাড়ি আপনাকে আমি ফিরিয়ে দেব। বললুম, সত্যিই বটে, কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে আমি করব কি? পেটের দায়ে চাকরি করতে নিজে থাকব বাইরে,—বাড়ি হবে বন-জঙ্গল, শিয়াল-কুকুরের বাসা—তার চেয়ে যা হয়েছে সেই ভালো। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, না, সে হবে না,—নিতেই হবে আপনাকে। বাবার আদেশ আমি প্রাণ গেলেও উপেক্ষা করতে পারব না। অন্ততঃ বাড়ির ন্যায্য যা দাম—তাই নিন। বললুম, ভিক্ষে নিতে আমি পারব না। তিনি বললেন, তা হলে বিলিয়ে দেব আপনার দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়দের। বাবা যা দিয়ে গেছেন আমি তা অপহরণ করব না— কোনমতেই না—এই আমার পণ। শুনে, দুষ্টবুদ্ধি মাথায় চেপে গেল, বললুম, ও পণ রাখতে গেলে কি কি দিতে হয় জানেন? শুধু এই বাড়িটাই নয়, এই বাড়ি, এই জমিদারি, দাস-দাসী, আমলা-কর্মচারী, খাট-পালঙ্ক-টেবিল-চেয়ার, মায় তাদের মনিবটিকে পর্যন্ত আমার হাতে তুলে দিতে হবে। দেবেন এই-সব? পারবেন দিতে?
নলিনী। (সবিস্ময়ে) বনমালীবাবুর আছে নাকি এই-সব চিঠি? কৈ আমাদের ত কাউকে বলেন নি!
নরেন। (হাসিয়া) এ তামাশা বলব কাকে? আমি কি পাগল? কিন্তু চিঠির কথা যদি বলেন ত সত্যিই আছে বনমালীবাবুর চিঠি। সত্যি আছে এই-সব লেখা। (আঙুল দিয়া দেখাইয়া) ঐ ঘরটায় ছিল একতাড়া চিঠি একটা ভাঙ্গা দেরাজের মধ্যে—বাবার চিঠি বলে দয়ালবাবু দিলেন আমার হাতে, পড়ে দেখি তাতে এই মজার ব্যাপার। জানেন ত, আমার বাবার বনমালীবাবু ছিলেন অকৃত্রিম বন্ধু। লেখাপড়ার জন্যে আমাকে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন তিনিই।
নলিনী। তারপরে?
নরেন। বিজয়া বললেন, কৈ দেখি বাবার চিঠি। পকেটেই ছিল, ফেলে দিলুম সুমুখে। বাণ্ডিল খুলে ফেলে খুঁজতে লাগল বুভুক্ষু কাঙালের মত—হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল—এই যে আমার বাবার হাতের লেখা। তারপরে চিঠি দুটো নিজের মাথায় চেপে ধরে চক্ষের নিমেষে যেন একেবারে পাথর হয়ে গেল।
নলিনী। তারপরে?
নরেন। মূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেলুম। একেবারে নিঃশব্দ নিশ্চল! হঠাৎ দেখি চাপা কান্নায় তার বুকের পাঁজরগুলো ফুলে ফুলে উঠছে—আর বসে থাকতে সাহস হলো না, নিঃশব্দে বেরিয়ে এলুম।
নলিনী। নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন? আর যাননি তাঁর কাছে?
নরেন। না, সেদিকেই না।
নলিনী। তাঁকে দেখতে ইচ্ছে করে না আপনার?
নরেন। (হাসিয়া) এ কথা জেনে লাভ কি?
নলিনী। না, সে হবে না, আপনাকে বলতেই হবে।
নরেন। বলতে আপনাকেই শুধু পারি। কিন্তু কথা দিন কখনো কাউকে বলবেন না?
নলিনী। কথা আমি দেব না। তবু বলতেই হবে তাঁকে দেখতে ইচ্ছে করে কি না।
নরেন। করে। রাত্রিদিনই করে।
নলিনী। (বাহিরের দিকে চাহিয়া মহা-উল্লাসে) এই যে! আসুন, আসুন। নমস্কার! ভালো আছেন?
[বিজয়া ও দয়ালের প্রবেশ]
বিজয়া। (নরেনের দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরিয়া নলিনীকে) নমস্কার! ভালো আছি কিনা খোঁজ নিতে একদিনও ত আর গেলেন না?
নলিনী। রোজই ভাবি যাই, কিন্তু সংসারের কাজে—
বিজয়া। সংসারের কাজ বুঝি আমাদের নেই?
নলিনী। আছে সত্যি, কিন্তু মামীমার অসুখে—
বিজয়া। একেবারে সময় পান না। না?
নরেন। (সম্মুখে আসিয়া হাসিমুখে বলিল) আর আমি যে রয়েছি, আমাকে বুঝি চিনতেই পারলেন না?
বিজয়া। চিনতে পারলেই চেনা দরকার নাকি? (নলিনীর প্রতি) চলুন মিস দাস, ওপরে গিয়ে মামীমার সঙ্গে একটু আলাপ করে আসি। চলুন!
[নরেনের প্রতি দৃষ্টিপাতমাত্র না করিয়া নলিনীকে
একপ্রকার ঠেলিয়া লইয়া চলিল]
নলিনী। (চলিতে চলিতে) ডক্টর মুখার্জী, চা না খেয়ে আপনি যেন পালাবেন না। আমাদের ফিরতে দেরি হবে না বলে যাচ্চি।
[নলিনী ও বিজয়া চলিয়া গেল
দয়াল।তুমিও চল না বাবা ওপরে। সেখানেই চা খাবে।
নরেন। ওপরে গেলেই দেরি হবে দয়ালবাবু, ছ’টার গাড়ি ধরতে পারব না।
দয়াল। তুমি ত সেই আটটার ট্রেনে যাও, আজ এত তাড়াতাড়ি কেন? চা না হয় এখানেই আনতে বলে দি। কি বল?
নরেন। না দয়ালবাবু, আজ চা খাওয়া থাক। (ঘড়ি দেখিয়া) এই দেখুন পাঁচটা বেজে গেছে—আর আমার সময় নেই। আমি চললুম। মামীমা যেন দুঃখ না করেন।
দয়াল। দুঃখ সে করবেই নরেন।
নরেন। না করবেন না। আর একদিন আমি তাঁকে বুঝিয়ে বলব।
[প্রস্থান
[ভিতরে নলিনী ও বিজয়ার হাসির শব্দ শোনা গেল, এবং
পরক্ষণে তাহারা দয়ালের স্ত্রীকে লইয়া প্রবেশ করিল]
দয়ালের স্ত্রী। (স্বামীর প্রতি) নরেন কোথায় গেল, তাকে দেখচি নে ত?
দয়াল। সে এইমাত্র চলে গেল। কাজ আছে, ছ’টার ট্রেনে আজ তার না ফিরে গেলেই নয়।
দয়ালের স্ত্রী। সে কি কথা! চা খেলে না, খাবার খেলে না,—এমনধারা সে ত কখনো করে না!
[সকলেই নীরব। বিজয়া আর একদিকে চোখ ফিরাইয়া রহিল]
দয়ালের স্ত্রী। (স্বামীর প্রতি) তুমি যেতে দিলে কেন? বললে না কেন আমি ভারী দুঃখ পাব?
দয়াল। বলেছিলুম, কিন্তু থাকতে পারলে না।
দয়ালের স্ত্রী। তবে নিশ্চয় কোন জরুরী কাজ আছে। মিছে কথা সে কখনো বলে না। কি ভদ্র ছেলে মা! যেমন বিদ্বান তেমনি বুদ্ধিমান। আমাকে ত মরা বাঁচালে। রোজ বিকালে নলিনী আর ও বসে বসে পড়াশুনো করে, আমি আড়াল থেকে দেখি। দেখে কি যে ভালো লাগে তা আর বলতে পারিনে। ভগবান ওর মঙ্গল করুন।
বিজয়া। সন্ধ্যা হয়ে গেল, আমি এবার যাই মামীমা।
দয়ালের স্ত্রী। তোমার বিয়েতে আমি উপস্থিত থাকবই। তা যত অসুখই করুক। নরেন বলে, বেশী নড়াচড়া করা উচিত নয়। তা সে বলুক গে,—ওদের সব কথা শুনতে গেলে আর বেঁচে থাকা চলে না। আশীর্বাদ করি সুখী হও, দীর্ঘজীবী হও,—বিলাসবাবুকে চোখে দেখিনি, কিন্তু কর্তার মুখে শুনি খাসা ছেলে। (সহাস্যে) বর পছন্দ হয়েছে ত মা, নিজে বেছে নিয়েছ—
বিজয়া। বেছে নেবার কি আছে মামীমা। মেয়েদের সম্বন্ধে সব পুরুষই সমান। মুখের ভদ্রতায় কেউ বা একটু হুঁশিয়ার, কেউ বা তা নয়। প্রয়োজন হলে দুটো মিষ্টি কথা বলে, প্রয়োজন ফুরোলে উগ্রমূর্তি ধরে। ওর ভালো-মন্দ নেই মামীমা, আমাদের দুঃখের জীবন শেষ পর্যন্ত দুঃখেই কাটে।
নলিনী। এ কথা বলা আপনার উচিত নয় মিস রায়।
বিজয়া। এখন তর্ক করব না, কিন্তু নিজের বিবাহ হলে একদিন স্মরণ করবেন, বিজয়া সত্যি কথাই বলেছিল। কিন্তু আর দেরি নয়, আমি আসি। কানাই সিং—
[নেপথ্যে] —মাইজী—
দয়াল। (ব্যস্তভাবে) অন্ধকার রাত, একটা আলো এনে দিই মা।
বিজয়া। (হাসিয়া) অন্ধকার কোথায় দয়ালবাবু, বাইরে জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে। আমরা বেশ যেতে পারব, আপনি উদ্বিগ্ন হবেন না। নমস্কার!
[বিজয়া বাহির হইয়া গেল
দয়ালের স্ত্রী। (স্বামীর প্রতি) মেয়েটা কি বললে—শুনলে?
দয়াল। কি?
দয়ালের স্ত্রী। তোমাদের কি কান নেই? এসে পর্যন্ত ওর কথায় যেন একটা কান্নার সুর। যখন হাসছিল তখনও। বিজয়াকে আগে কখনও দেখিনি, কিন্তু ওর মুখ দেখে আজ মনে হলো যেন ধরেবেঁধে ওকে কেউ বলি দিতে নিয়ে যাচ্চে। জিজ্ঞেসা করলুম, বর পছন্দ হয়েছে ত মা? বললে, পছন্দের কি আছে মামীমা, মেয়েদের দুঃখের জীবন শেষ পর্যন্ত দুঃখেই কাটে। এ কি আহ্লাদের বিয়ে? দেখো, কোথায় কি একটা গোলমাল বেধেছে। ওর মা নেই, বাপ নেই,—মুখ দেখলে বড্ড মায়া হয়। না বুঝেসুঝে একটা কাজ করে বসো না।
দয়াল। আমি কি করতে পারি বল? রাসবিহারীবাবুই কর্তা।
দয়ালের স্ত্রী। তাঁর ওপরেও আর একজন কর্তা আছে মনে রেখো। তুমি ওর মন্দিরের আচার্য, ওর টাকায়, ওর বাড়িতে তোমরা খেয়েপরে সুখে আছ,—ওর ভালো-মন্দ সুখ-দুঃখ দেখা কি তোমার কর্তব্য নয়? সমস্ত না ভেবেই কি একটা করে বসবে?
দয়াল। তবে কি করব বল?
দয়ালের স্ত্রী। এ বিয়েতে আচার্যগিরি তুমি করো না। আমি বলচি, তোমাকে একদিন মনস্তাপ পেতে হবে।
দয়াল। (চিন্তান্বিত-মুখে) কিন্তু বিজয়া যে নিজে সম্মতি দিয়েছে। রাসবিহারীবাবুর সুমুখে নিজের হাতে কাগজে সই করে দিয়েছে!
নলিনী। দিক। ওর হাত সই করেছে কিন্তু হৃদয় সই করেনি, ওর জিভ সম্মতি দিয়েছে কিন্তু অন্তর সম্মতি দেয়নি। সেই মুখ আর হাতই বড় হবে মামাবাবু, তার অন্তরের সত্যিকার অসম্মতি যাবে ভেসে?
দয়াল। তুমি এ কথা জানলে কি করে নলিনী?
নলিনী। আমি জানি। আজ যাবার সময় নরেনবাবুর মুখ দেখেও কি তুমি বুঝতে পারনি?
দয়াল ও দয়ালের স্ত্রী। (সমস্বরে) নরেন? আমাদের নরেন?
নলিনী। হাঁ তিনিই।
দয়াল। অসম্ভব! একেবারে অসম্ভব!
নলিনী। (হাসিয়া) অসম্ভব নয় মামাবাবু, সত্যি।
দয়াল। (সজোরে) কিন্তু বিজয়া যে আমাকে নিজে বললেন—
নলিনী। কি বললেন?
দয়াল। বললেন, তোমার আর নরেনের পানে একটু চোখ রাখতে। বললেন, নরেনের উচিত তোমার সম্বন্ধে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট করে জানাতে—
নলিনী। (সলজ্জে) ছি ছি, নরেনবাবু যে আমার বড়ভাইয়ের মত মামাবাবু।
দয়ালের স্ত্রী। কি আশ্চর্য কথা! তুমি আমাদের সেই জ্যোতিষকে ভুলে গেলে? তার বিলেত থেকে ফিরতে ত আর দেরি নেই।
দয়াল। জ্যোতিষ? আমাদের সেই জ্যোতিষ?
দয়ালের স্ত্রী। হাঁ হাঁ, আমাদের সেই জ্যোতিষ। (হাসিয়া) এই অন্ধ মানুষটিকে নিয়ে আমার সারাজীবন কাটল!
দয়াল। আমি এখ্খুনি যাব নরেনের বাসায়।
দয়ালের স্ত্রী। এত রাত্রে? কেন?
দয়াল। কেন? জিজ্ঞাসা করছ—কেন? আমার কর্তব্য আমি স্থির করে ফেলেচি—সে থেকে কেউ আর আমাকে টলাতে পারবে না।
নলিনী। তুমি শান্ত মানুষ মামাবাবু, কিন্তু কর্তব্য থেকে তোমাকে কে কবে টলাতে পেরেছে! কিন্তু আজ রাত্রে নয়,—তুমি কাল সকালে যেও।
দয়াল। তাই হবে মা, আমি ভোরের গাড়িতেই বেরিয়ে পড়ব।
নলিনী। আমি তোমার চা তৈরি করে রাখব মামাবাবু। কিন্তু ওপরে চল তোমার খাবার সময় হয়েছে।
দয়াল। চল।
[সকলের প্রস্থান
তৃতীয় দৃশ্য
লাইব্রেরি
[বিজয়া চিঠি লিখিতেছিল, পরেশের মা প্রবেশ করিল]
পরেশের মা। রাত্তিরে কিচ্ছু খাওনি, আজ একটু সকাল সকাল খেয়ে নাও না দিদিমণি।
[বিজয়া মুখ তুলিয়া চাহিয়া পুনরায় লেখায় মনঃসংযোগ করিল]
পরেশের মা। খেয়ে নিয়ে তারপরে লিখো। ওঠো—ও-মা, ডাক্তারবাবু আসচেন যে!
[বলিয়াই সরিয়া গেল। পরেশ নরেনকে পৌঁছাইয়া দিয়া চলিয়া গেল। নরেন ঘরে ঢুকিয়া অদূরে একখানা চৌকি টানিয়া বসিল। তাহার মুখ শুষ্ক, চুল এলোমেলো। উদ্বেগ ও অশান্তির চিহ্ন তাহার চোখে-মুখে বিদ্যমান]
নরেন। কাল আমাকে চিনতে চাননি কেন বলুন ত! এখন থেকে চিরদিনের মত অপরিচিত হয়ে গেলুম এই বুঝি ইঙ্গিত?
বিজয়া। আপনার চোখ-মুখ এমন ধারা দেখাচ্চে কেন, অসুখ-বিসুখ করেনি ত? এত সকালে এলেন কি করে? কিছু খাওয়াও হয়নি বোধ করি?
নরেন। স্টেশনে চা খেয়েছি। ভোরে উঠেই বেরিয়ে পড়েছিলুম। কাল খেতে পারিনি, ঘুমোতে পারিনি, সারা রাত কেবল এক কথাই মনে হয়েছে দোর বোধ হয় বন্ধ হলো,— দেখা আর হবে না।
বিজয়া। ও-বাড়ি থেকে কাল না খেয়ে পালিয়ে গেলেন, বাসায় ফিরে গিয়ে খেলেন না শুলেন না, আবার সকালে উঠে স্নান নেই খাওয়া নেই, এতটা পথ হাঁটা,—শরীরটা যাতে ভেঙ্গে পড়ে সেই চেষ্টাই হচ্চে বুঝি? আমাকে কি আপনি এতটুকু শান্তি দেবেন না?
নরেন। আপনি অদ্ভুত মানুষ। পরের বাড়িতে চিনতে চান না, আবার নিজের বাড়িতে এত বেশী চেনেন যে সেও আশ্চর্য ব্যাপার। কালকের কাণ্ড দেখে ভাবলুম খবর দিলে দেখা করবেন না, তাই বিনা সংবাদে পরেশের সঙ্গে এসে আপনাকে ধরেচি। একটু ক্লান্ত হয়েছি মানি, কিন্তু এসে ঠকিনি। (বিজয়া নীরবে চাহিয়া রহিল) কাল ফিরে গিয়ে দেখি সাউথ অ্যাফ্রিকা থেকে কেব্ল এসেছে, আমি চাকরি পেয়েছি। চারদিন পরে করাচী থেকে জাহাজ ছাড়বে—আজ আসতে না পারলে হয়ত আর কখনো দেখাই হতো না। আপনার বিবাহের নিমন্ত্রণপত্রও পেলুম। দেখে যাবার সৌভাগ্য হবে না, কিন্তু আমার আশীর্বাদ, আমার অকৃত্রিম শুভকামনা আপনাদের পূর্বাহ্নেই জানিয়ে যাই। আমার কথা অবিশ্বাস করবেন না এই প্রার্থনা।
বিজয়া। এখানকার কাজ ছেড়ে দিয়ে সাউথ অ্যাফ্রিকায় চলে যাবেন? কিন্তু কেন?
নরেন। (হাসিয়া) বেশী মাইনে বলে। আমার কলকাতাও যা, সাউথ অ্যাফ্রিকাও ত তাই।
বিজয়া। তাই বৈ কি! কিন্তু নলিনী কি রাজী হয়েছেন? হলেও বা এত শীঘ্র কি করে যাবেন আমি ত ভেবে পাইনে। তাঁকে সমস্ত খুলে বলেছেন কি? আর এত দূরে যেতেই বা তিনি মত দিলেন কি করে?
নরেন। দাঁড়ান, দাঁড়ান। এখনো কাউকে সমস্ত কথা খুলে বলা হয়নি বটে, কিন্তু—
বিজয়া। কিন্তু কি? না সে কোনমতেই হতে পারবে না। আপনারা কি আমাদের বাক্স-বিছানার সমান মনে করেন যে, ইচ্ছে থাক না থাক দড়ি দিয়ে বেঁধে গাড়িতে তুলে দিলেই সঙ্গে যেতে হবে? সে কিছুতেই হবে না। তাঁর অমতে কোনমতেই অত দূরে যেতে পারবেন না।
নরেন। (কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের ন্যায় স্তব্ধভাবে থাকিয়া) ব্যাপারটা কি আমাকে বুঝিয়ে বলুন ত? পরশু না কবে এই নূতন চাকরির কথাটা দয়ালবাবুকে বলতে তিনিও চমকে উঠে এই ধরনের কি একটা আপত্তি তুললেন আমি বুঝতেই পারলুম না। এত লোকের মধ্যে নলিনীর মতামতের ওপরেই বা আমার যাওয়া-না-যাওয়া কেন নির্ভর করে, আর তিনিই বা কিসের জন্যে বাধা দেবেন,—এ-সব যে ক্রমেই হেঁয়ালি হয়ে উঠচে।কথাটা কি আমাকে খুলে বলুন ত!
বিজয়া। (ক্ষণেক পরে ধীরে ধীরে) তাঁর সঙ্গে একটা বিবাহের প্রস্তাব কি আপনি করেন নি?
নরেন। আমি? না কোনদিন নয়।
বিজয়া। না করে থাকলেও কি করা উচিত ছিল না? আপনার মনোভাব ত কারও কাছে গোপন নেই।
নরেন। (কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া) এ অনিষ্ট কার দ্বারা ঘটেছে আমি তাই শুধু ভাবচি। তাঁর নিজের দ্বারা কদাচ ঘটেনি। দু’জনেই জানি এ অসম্ভব।
বিজয়া। অসম্ভব কেন?
নরেন। সে থাক। একটা কারণ এই যে আমি হিন্দু এবং আমাদের জাতও এক নয়।
বিজয়া। জাত আপনি মানেন?
নরেন। মানি।
বিজয়া। আপনি শিক্ষিত হয়ে একে ভালো বলে মানেন কি করে?
নরেন। ভালো-মন্দর কথা বলিনি, জাত মানি তাই বলেচি।
বিজয়া। আচ্ছা অন্য জাতের কথা থাক, কিন্তু জাত যেখানে এক, সেখানেও কি শুধু আলাদা ধর্মমতের জন্যই বিবাহ অসম্ভব বলতে চান? আপনি কিসের হিন্দু? আপনি ত একঘরে। আপনার কাছেও কি কোন অন্য সমাজের কুমারী বিবাহযোগ্যা নয় মনে করেন? এত অহঙ্কার আপনার কিসের জন্য? আর এই যদি সত্যিকার মত, তবে সে কথা গোড়াতেই বলে দেননি কেন?
[বলিতে বলিতে তাহার চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া উঠিল
এবং ইহাই গোপন করিতে সে মুখ ফিরাইয়া লইল]
নরেন। (ক্ষণকাল একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করিয়া) আপনি রাগ করে যা বলচেন এ ত আমার মত নয়।
বিজয়া। নিশ্চয় এই আপনার সত্যিকার মত।
নরেন। আমাকে পরীক্ষা করলে টের পেতেন এ আমার সত্যিকার মিথ্যেকার কোন মতই নয়। এ ছাড়া নলিনীর কথা নিয়ে কেন আপনি বৃথা কষ্ট পাচ্ছেন? আমি জানি তাঁর মন কোথায় বাঁধা এবং তিনিও নিশ্চয় বুঝবেন কেন আমি পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পালাচ্চি। আমার যাওয়া নিয়ে আপনি নিরর্থক উদ্বিগ্ন হবেন না।
বিজয়া। নিরর্থক? তাঁর অমত না হলেই আপনি যেখানে খুশি যেতে পারেন মনে করেন?
নরেন। না তা পারিনে। আপনার অমতেও আমার কোথাও যাওয়া চলে না। কিন্তু আপনি ত আমার সব কথাই জানেন। আমার জীবনের সাধও আপনার অজানা নয়, বিদেশে কোনদিন হয়ত সে সাধ পূর্ণ হতেও পারে, কিন্তু এ-দেশে এত বড় নিষ্কর্মা দীন-দরিদ্রের থাকা-না-থাকা সমান। আমাকে যেতে বাধা দেবেন না।
বিজয়া। আপনি দীন-দরিদ্র ত নন। আপনার সবই আছে, ইচ্ছে করলেই ফিরে নিতে পারেন।
নরেন। ইচ্ছে করলেই পারিনে বটে, কিন্তু আপনি যে দিতে চেয়েছেন সে আমার মনে আছে এবং চিরদিন থাকবে। কিন্তু দেখুন, নেবারও একটা অধিকার থাকা চাই—সে অধিকার আমার নেই।
বিজয়া। (উচ্ছ্বসিত রোদন সংবরণ করিতে করিতে উত্তেজিত-স্বরে) আছে বৈ কি। বিষয় আমার নয়, বাবার। সে আপনি জানেন। নইলে পরিহাসচ্ছলেও তাঁর যথাসর্বস্ব দাবী করার কথা মুখে আনতে পারতেন না। আমি হলে কিন্তু ঐখানেই থামতুম না। তিনি যা দিয়ে গেছেন সমস্ত জোর করে দখল করতুম, তার একতিলও ছেড়ে দিতুম না। (টেবিলে মুখ রাখিয়া কাঁদিতে লাগিল)
নরেন। নলিনী ঠিকই বুঝেছিল বিজয়া, আমি কিন্তু বিশ্বাস করিনি। ভাবতেই পারিনি আমার মত একটা অকেজো অক্ষম লোককে কারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু সত্যিই যদি এই অসঙ্গত খেয়াল তোমার মাথায় ঢুকেছিল শুধু একবার হুকুম করোনি কেন? আমার পক্ষে এর স্বপ্ন দেখাও যে পাগলামি বিজয়া!
[বিজয়া মুখের উপর আঁচল চাপিয়া উচ্ছ্বসিত রোদন সংবরণ করিতে লাগিল। নরেন পিছনে পদশব্দ শুনিয়া ফিরিয়া দেখিল দয়াল দাঁড়াইয়া দ্বারের কাছে। তিনি ধীরে ধীরে ঘরে আসিয়া বিজয়ার আসনের একান্তে বসিয়া তাহার মাথায় হাত দিলেন, বলিলেন—]
দয়াল। মা!
[বিজয়া একবার মুখ তুলিয়া দেখিল পুনরায় উপুড় হইয়া পড়িয়া মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল। দয়ালের চোখ দিয়া জল গড়াইয়া পড়িল, সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন—]
দয়াল। শুধু আমার দোষেই এই ভয়ানক অন্যায় হয়ে গেল মা, শুধু আমি এই দুর্ঘটনা ঘটালুম। কাল তোমরা চলে গেলে নলিনীর সঙ্গে আমার এই কথাই হচ্ছিল,—সে সমস্তই জানত। কিন্তু কে ভেবেছে নরেন মনে মনে কেবল তোমাকেই,—কিন্তু নির্বোধ আমি সমস্ত ভুল বুঝে তোমাকে উলটো খবর দিয়ে এই দুঃখ ঘরে ডেকে আনলুম। এখন বুঝি আর কোন প্রতিকার নেই?(তেমনি মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে দিতে) এর কি আর কোন উপায় হতে পারে না বিজয়া?
বিজয়া।(তেমনি মুখ লুকাইয়া ভগ্নকণ্ঠে) না দয়ালবাবু, মরণ ছাড়া আর আমার নিষ্কৃতির পথ নেই।
দয়াল। ছি মা, এমন কথা বলতে নেই।
বিজয়া। আমি কথা দিয়েছি দয়ালবাবু। তাঁরা সেই কথার নির্ভর করে সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ করে এনেছেন। এ যদি ভাঙ্গি, সংসারে আমি মুখ দেখাব কেমন করে? শুধু বাকী আছে মরণ—
[বলিতে বলিতে পুনরায় তাহার কণ্ঠরোধ হইল। দয়ালের চোখ দিয়াও
আবার জল গড়াইয়া পড়িল। হাত দিয়া মুছিয়া বলিলেন—]
দয়াল। নলিনী বললে, বিজয়া কথা দিয়েছে, সই করে দিয়েছে—এ ঠিক। কিন্তু কোনটায় তার অন্তর সায় দেয়নি। তার সেই মুখের কথাটাই বড় হবে মামাবাবু, আর হৃদয় যাবে মিথ্যে হয়ে? তার মামী বললে, ওর মা নেই, বাপ নেই,—একলা মেয়ে,—আচার্য হয়ে তুমি এতবড় পাপ করো না। যে দেবতা হৃদয়ে বাদ করেন এ অধর্ম তিনি সইবেন না। সারা রাত চোখে ঘুম এল না, কেবলই মনে হয় নলিনীর কথা—মুখের বাক্যটাই বড় হবে, হৃদয় যাবে ভেসে? ভোর হতেই ছুটলুম কলকাতায়—নরেনের কাছে—
নরেন। আপনি আমার কাছে গিয়েছিলেন?
দয়াল। গিয়ে দেখি তুমি বাসায় নেই, খোঁজ নিয়ে গেলুম তোমার আফিসে, তারাও বললে, তুমি আসনি। ফিরে এলুম বিফল হয়ে, কিন্তু আশা ছাড়লুম না। মনে মনে বললুম, যাব বিজয়ার কাছে, বলব তাকে গিয়ে সব কথা—
[পরেশ গলা বাড়াইয়া দেখা দিল]
পরেশ। মা ঠান, একটা-দুটো বেজে গেল—তুমি না খেলে যে আমরা কেউ খেতে পাচ্চিনে।
[শুনিয়া বিজয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিল]
বিজয়া।(ব্যস্তভাবে) দয়ালবাবু, এখানেই আপনাকে স্নানাহার করতে হবে।
দয়াল। না মা, আজ তোমার আদেশ পালন করতে পারব না। তারা সব পথ চেয়ে আছে। নরেন, তোমাকেও যেতে হবে। কাল না খেয়ে চলে এসেছ, সে দুঃখ ওদের যায়নি, এস আমার সঙ্গে।
[নরেন উঠিয়া দাঁড়াইল। বিজয়া ইঙ্গিতে তাহাকে একপাশে
ডাকিয়া লইয়া দয়ালের অগোচরে মৃদুকণ্ঠে বলিল]
বিজয়া। আমাকে না জানিয়ে কোথাও চলে যাবেন না ত?
নরেন। না। যাবার আগে তোমাকে বলে যাব।
বিজয়া। ভুলে যাবে না?
নরেন। (হাসিয়া) ভুলে যাব? চলুন দয়ালবাবু, আমরা যাই।
দয়াল। চল। আসি মা এখন।
(একদিক দিয়া দয়াল ও নরেন, অন্যদিক দিয়া বিজয়া প্রস্থান করিল