ভ্রান্তিবিলাস – ৫

পঞ্চম পরিচ্ছেদ


রাজপুরুষ, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীবকে লইয়া, তদীয় আলয় অভিমুখে প্রয়াণ করিলে পর, উত্তমর্ণ বণিক অধমর্ণ স্বর্ণকারকে বলিলেন, তোমায় টাকা দিয়া পাইতে এত কষ্ট হইবেক, তাহা আমি এক বারও মনে করি নাই। হয় ত, এই টাকার গোলে আজ আমার যাওয়া হইল না; যাওয়া না হইলে, বিলক্ষণ ক্ষতিগ্রস্ত হইব। এখন বোধ হইতেছে, সে সময়ে তোমার উপকার করিয়া ভাল করি নাই। স্বর্ণকার সাতিশয় কুণ্ঠিত হইয়া, কহিলেন, মহাশয়! আর আমার লজ্জা দিবেন না, আমি আপনকার আবশ্যক সময়ে টাকা দিতে না পারিয়া মরিয়া রহিয়াছি। চিরঞ্জীববাবু যে আমার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করিবেন, ইহা স্বপ্নের অগোচর। উনি যে হার লইয়া পাই নাই বলিবেন, অথবা টাকা দিতে আপত্তি করিবেন, এক মুহূর্ত্তের জন্যেও মনে হয় নাই। আপনি এ সন্দেহ করিবেন না যে আমি উহাকে হার দি নাই, কেবল আপনকার সঙ্গে ছল করিতেছি। আমি ধর্ম্মপ্রমাণ বলিতেছি, চারি দণ্ড পূর্ব্বে আমি নিজে উহার হস্তে হার দিয়াছি। উনি সে সময়ে মূল্য দিতে চাহিয়াছিলেন; আমার কুবুদ্ধি, আমি বলিলাম, এখন কার্য্যান্তরে যাইতেছি, পরে সাক্ষাৎ করিব ও মূল্য লইব। উনি কিন্তু সে সময়ে বলিয়াছিলেন, এখন না লও, পরে আর পাইবার সম্ভবনা থাকিবে না। তৎকালে কি অভিপ্রায়ে উনি এ কথা বলিয়াছিলেন, জানি না; কিন্তু কার্য্যগতিকে উহার কথাই ঠিক হইতেছে।

স্বর্ণকারের এই সকল কথা শুনিয়া বণিক জিজ্ঞাসা করিলেন, বলি, চিরঞ্জীববাবু লোক কেমন। বসুপ্রিয় কহিলেন, উনি জয়স্থলে সর্ব্ব বিষয়ে অদ্বিতীয় ব্যক্তি। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই উঁহাকে জানে এবং সকলেই উঁহাকে ভাল বাসে। উনি সকল সমাজে সমান আদরণীয় ও সর্ব্বপ্রকারে প্রশংসনীয় ব্যক্তি। ঐশ্বর্য্য ও আধিপত্য বিষয়ে এ রাজ্যে উঁহার তুল্য লোক নাই। কখনও কোনও বিষয়ে উঁহার কথা অন্যথা হয় না। পরোপকারার্থে অকাতরে অর্থব্যয় করিয়া থাকেন। উনি যে আজ আমার সঙ্গে এরূপ ব্যবহার করিলেন, শুনিলে কেহ বিশ্বাস করিবেক না। এই সকল কথা শুনিয়া বণিক কহিলেন, আমরা আর এখানে অনর্থক বসিয়া থাকি কেন; চল, তাঁহার বাটীতে যাই; তাহা হইলে শীঘ্র টাকা পাইব এবং হয় ত আজই যাইতে পারিব। অনন্তর বসুপ্রিয় ও বণিক উভয়ে চিরঞ্জীবের ভবন অভিমুখে গমন করিলেন।

এই সময়ে, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব, কিঙ্কর সমভিব্যাহারে, পান্থনিবাসে প্রতিগমন করিতেছিলেন। বণিক দূর হইতে দেখিতে পাইয়া বসুপ্রিয়কে কহিলেন, আমার বোধ হয়, চিরঞ্জীববাবু আসিতেছেন। বসুপ্রিয় কহিলেন, হাঁ তিনিই বটে; আর, আমার নির্ম্মিত হারও উঁহার গলায় রহিয়াছে, দেখিতেছি; অথচ, দেখুন, আপনকার সমক্ষে উনি স্পষ্ট বাক্যে বারংবার হার পাই নাই বলিলেন, এবং আমার সঙ্গে কত বিবাদ ও বাদানুবাদ করিলেন। এই বলিয়া, তাহার নিকটে গিয়া, বসুপ্রিয় কহিলেন, চিরঞ্জীববাবু! আমি আজ আপনকার আচরণ দেখিয়া হতবুদ্ধি হইরাছি। আপনি কেবল আমায় কষ্ট দিতেছেন ও অপদস্থ করিতেছেন এরূপ নহে, আপনকারও বিলক্ষণ অপযশ হইতেছে। এখন, হার পরিয়া রাজপথে স্পষ্ট বেড়াইতেছেন; কিন্তু, তখন, অনায়াসে শপথ পূর্ব্বক হারপ্রাপ্তি অপলাপ করিলেন। আপনকার এরূপ ব্যবহারে এই এক ভদ্র লোকের কত কার্য্য়ক্ষতি হইল, বলিবার নয়। উনি স্থানান্তরে যাইবার সমুদয় স্থির করিয়াছিলেন; এত ক্ষণ কোন কালে চলিয়া যাইতেন; কেবল আমাদের বিবাদের জন্যে যাইতে পারিলেন না। তখন অনায়াসে অপলাপ করিয়াছেন, এখনও কি অপলাপ করিবেন।

বসুপ্রিয়ের এই কথা শুনিয়া চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি তোমার নিকট হইতে এই হার পাইয়াছি বটে, কিন্তু এক বারও তাহা অস্বীকার করি নাই, তুমি সহসা আমার উপর এরূপ দোষারোপ করিতেছ কেন। তখন বণিক কহিলেন, হাঁ, আপনি অস্বীকার করিয়াছেন, এবং, হার পাই নাই বলিয়া, বারংবার শপথ পর্য্য়ন্ত করিয়াছেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি শপথ ও অস্বীকার করিয়াছি, তাহা কে শুনিয়াছে। বণিক কহিলেন, আমি নিজে স্বকর্ণে শুনিয়াছি। ইহা অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয়, যে তোমার মত নরাধমেরা ভদ্রসমাজে প্রবেশ করিতে পায়। শুনিয়া, কোপে কম্পিতকলেবর হইয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, তুই বেটা বড় পাজি ও বড় ছোট লোক, অকারণে আমায় কটু বলিতেছিস। আমি ভদ্র কি অভদ্র, তাহা এখনই তোরে শিখাইতেছি। মর বেটা পাজি, যত বড় মুখ, তত বড় কথা। এই বলিয়া, তিনি তরবারি নিকাশিত করিলেন, এবং বণিকও তরবারি নিষ্কাশিত করিয়া, দ্বন্দ্বযুদ্ধে উদ্যত হইলেন।

এই সময়ে চন্দ্রপ্রভা, কতকগুলি লোক সঙ্গে করিয়া, সহসা সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন এবং বণিকের সহিত হেমকূটবাসী চিরজীবের দ্বন্দ্বযুদ্ধের উপক্রম দেখিয়া, স্বীয় পতি জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব তাদৃশ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতেছেন, এই বোধে, সাতিশয় কাতরতা প্রদর্শন পূর্ব্বক, বণিককে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, দোহাই ধর্ম্মের, উঁহারে প্রহার করিবেন না, উনি উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছেন। এ অবস্থায়, কোনও কারণে উঁহার উপর রাগ করা উচিত নয়। কৃতাঞ্জলিপুটে বলিতেছি, দয়া করিয়া ক্ষান্ত হউন। এই বলিয়া, তিনি সঙ্গের লোকদিগকে কহিলেন, তোমরা, কৌশল করিয়া, উঁহার হাত হইতে তরবারি ছাড়াইয়া লও, এবং প্রভু ও ভৃত্য উভয়কে বন্ধন করিয়া আমার আলয়ে লইয়া চল। চন্দ্রপ্রভাকে সহসা সমাগত দেখিয়া ও তদীয় আদেশবাক্য শ্রবণ করিয়া, কিঙ্কর চিরঞ্জীবকে কহিল, মহাশয়! আবার সেই মায়াবিনী ঠাকুরাণী আসিয়াছেন; আর এখানে দাঁড়াইবেন না, পলায়ন করুন; নতুবা নিস্তার নাই। এই বলিয়া, সে চারি দিকে দৃষ্টি সঞ্চারণ করিয়া কহিল, মহাশয়! আসুন, এই দেবালয়ে প্রবেশ করি; তাহা হইলে, আমাদের উপর কেহ আর অত্যাচার করিতে পারিবেক না। তৎক্ষণাৎ উভয়ে দৌডিয়া পার্শ্ববর্ত্তী দেবালয়ে প্রবিষ্ট হইলেন। চন্দ্রপ্রভা, বিলাসিনী ও তাঁহাদের সমভিব্যাহারের লোক সকল দেবালয়ের দ্বারদেশে উপনীত হইল। এই গোলযোগ উপস্থিত দেখিয়া, রাজপথবাহী লোক সকলও তথায় সমবেত হইতে লাগিল।

ঐ দেবালয়ের কার্য্য পর্য্য়বেক্ষণের সমস্ত ভার এক বর্ষীয়সী তপস্বিনীর হস্তে ন্যস্ত ছিল। ইনি যার পর নাই সুশীলা ও নিরতিশয় দয়াশীলা ছিলেন এবং সুচারুরূপে দেবালয়ের কার্য্য সম্পাদন করিতেন; এজন্য, জয়স্থলবাসী যাবতীয় লোকের বিলক্ষণ ভক্তিভাজন ও সাতিশয় শ্রদ্ধাস্পদ ছিলেন। অভ্যন্তর হইতে অকস্মাৎ বিষম গোলযোগ শ্রবণ করিয়া, কারণ জানিবার নিমিত্ত, তিনি দেবালয় হইতে বহির্গত হইলেন এবং সমবেত লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কি জন্য তোমরা এখানে গোলযোগ করিতেছ। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, আমার উন্মাদগ্রস্ত স্বামী পলাইয়া দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছেন, আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে ও আমার লোকদিগকে ভিতরে যাইতে দেন, আমরা তাঁহারে বন্ধন করিয়া বাটী লইয়া যাইব। তপস্বিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, কত দিন তিনি এই দুর্দ্দান্ত রোগে আক্রান্ত হইয়াছেন। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, পাঁচ সাত দিন হইতে তাঁহাকে সর্ব্বদাই বিরক্ত, অন্যমনস্ক ও দুর্ভাবনায় অভিভূত দেখিতাম, কিন্তু, আজ আড়াই প্রহরের সময় অবধি, এক বারে বাহ্য়জ্ঞানশূণ্যপ্রায় হইয়াছেন। এই বলিয়া, তিনি সঙ্গের লোকদিগকে কহিলেন, তোমরা ভিতরে গিয়া, তাঁহাকে ও কিঙ্করকে বন্ধন করিয়া, সাবধানে লইয়া আইস। তপস্বিনী কহিলেন, বৎসে! তোমার একটি লোকও দেবালয়ে প্রবেশ করিতে পারিবেক না। তখন চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, তবে আপনকার লোকদিগকে আদেশ করুন, তাহারাই বন্ধন করিয়া তাঁহাকে আমার নিকটে আনিয়া দিউক। তপস্বিনী কহিলেন, তাহাও হইবেক না; তিনি যখন এই দেবালয়ে আশ্রয় লইয়াছেন, তখন, যত ক্ষণ বা যত দিন ইচ্ছা হয়, তিনি সচ্ছন্দে এখানে থাকিবেন; সে সময়ে তোমার বা অন্য কোনও ব্যক্তির তাঁহার উপর কোনও অধিকার থাকিবেক না। আমি উঁহার চিকিৎসার ও শুশ্রুষার সমস্ত ভার লইতেছি। উনি সুস্থ ও প্রকৃতিস্থ হইলে আপন আলয়ে যাইবেন। এ অবস্থায়, আমি কোনও ক্রমে উঁহাকে তোমার হস্তে সমর্পণ করিতে পারিব না।

এই সকল কথা শুনিয়া, কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, আপনি অন্যায় আজ্ঞা করিতেছেন; আমি যেমন প্রাণপণে উঁহার চিকিৎসা করাইব ও পরিচর্য্য়া করিব, অন্যের সেরূপ করা সম্ভব নহে। আপনি উঁহাকে আমার হস্তে সমর্পণ করুন। তখন তপস্বিনী কহিলেন, বৎসে! এত উতলা হইতেছ কেন, ধৈর্য্য অবলম্বন কর। আমি অনেক প্রকার মন্ত্র, ঔষধ ও চিকিৎসা জানি, এবং এ পর্যন্ত শত শত লোকের শারীরিক ও মানসিক রোগের শান্তি করিয়াছি। যেরূপ শুনিতেছি, আমি, অল্প কালের মধ্যেই, তোমার স্বামীকে প্রকৃতিস্থ করিতে পারিব; তখন তিনি স্বেচ্ছাক্রমে আপন ভবনে প্রতিগমন করিবেন। আমাদের তপস্যা ও ধর্ম্মচর্য্য়ার যেরূপ নিয়ম এবং দেবালয়ের কার্য্য়নির্ব্বাহ সম্বন্ধে যেরূপ নিয়মাবলী প্রচলিত আছে, তদনুসারে, যখন তোমার স্বামী এখানে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহার অনিচ্ছায় বল পূর্ব্বক উঁহাকে দেবালয় হইতে বহিষ্কৃত করিতে পারি না। অতএব, বৎসে! প্রস্থান কর; যাবৎ উনি আরোগ্য লাভ না করিতেছেন, আমার নিকটেই থাকুন; উঁহার চিকিৎসা বা শুশ্রুষা বিষয়ে কোনও অংশে ত্রুটি হইবেক না, সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকিবে। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, উঁহাকে ছাড়িয়া, আমি কখনও এখান হইতে যাইব না। আমার অনিচ্ছায় ও অসম্মতিতে, আমার স্বামীকে এখানে রুদ্ধ করিয়া রাখা কোনও মতে আপনার উচিত হইতেছে না। আপনি, সকল বিষয়ের বিশেষ অনুধাবন না করিয়াই, আমায় এখান হইতে চলিয়া যাইতে বলিতেছেন। শুনিয়া, কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া, তপস্বিনী কহিলেন, বৎসে! তুমি এ বিষয়ে অনর্থক আগ্রহ প্রকাশ করিতেছ; তোমার সঙ্গে বৃথা বাদানুবাদ করিব না। আমি এক কথায় বলিতেছি, তোমার স্বামী সুস্থ না হইলে, তুমি কখনও তাঁহাকে এখান হইতে লইয়া যাইতে পারিবে না; এখন আপন আলয়ে প্রতিগমন কর।

এই বলিয়া, তপস্বিনী দেবালয়ে প্রবেশ করিলেন। তদীয় আদেশ অনুসারে, দেবালয়ের দ্বার রুদ্ধ হইল; সুতরাং, আর কাহারও তথায় প্রবেশ করিবার পথ রহিল না। চন্দ্রপ্রভার এইরূপ অবমাননা দর্শনে, বিলাসিনী অতিশয় রুষ্ট ও অসন্তুষ্ট হইলেন, এবং তাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিলেন, দিদি! আর এখানে দাঁড়াইয়া ভাবিলে ও বৃথা কালহরণ করিলে, কি ফল হইবে বল; চল, আমরা অধিরাজ বাহাদুরের নিকটে গিয়া, এই অহঙ্কারিণী তপস্বিনীর অন্যায় আচরণ বিষয়ে অভিযোেগ করি, তিনি অবশ্যই বিচার করিবেন। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, বিলাসিনি! তুমি বিলক্ষণ বুদ্ধির কথা বলিয়াছ; চল, তাঁহার নিকটেই যাই। তিনি যত ক্ষণ না, স্বয়ং এখানে আসিয়া, আমার স্বামীকে বল পূর্ব্বক দেবালয় হইতে বহিস্কৃত করিয়া, আমার হস্তে দিতে সম্মত হন, তাবৎ আমি কোনও ক্রমে তাহাকে ছাড়িব না; তাঁহার চরণে পড়িয়া থাকিব এবং অবিশ্রামে অশ্রু বিসর্জ্জন করিব। এই কথা শুনিয়া বণিক কহিলেন, আপনারা কিঞ্চিৎ অপেক্ষা করিলে, এই খানেই অধিরাজের সহিত সাক্ষাৎ হইবেক। আমি অবধারিত জানি, সন্ধ্যার অব্যবহিত পূর্ব্বে, তিনি এই পথ দিয়া বধ্যভূমিতে যাইবেন। বেলা অবসান হইয়াছে; সায়ংকাল আগতপ্রায়; তাঁহার আসিবার আর বড় বিলম্ব নাই। বসুপ্রিয় জিজ্ঞাসিলেন, তিনি কি জন্যে এ সময়ে বধ্যভূমিতে যাইবেন। বণিক কহিলেন, আপনি কি শুনেন নাই, হেমকূটের এক বৃদ্ধ বণিক জয়স্থলের অধিকারে প্রবেশ করিয়াছিলেন, এই অপরাধে তাহার প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে; ভাহার শিরচ্ছেদনকালে অধিরাজ বাহাদুব স্বয়ং বধ্যভূমিতে উপস্থিত থাকবেন। বিলাসিণী চন্দ্রপ্রভাকে কহিলেন, অধিরাজ বাহাদুর দেবালয়ের সম্মুখে উপস্থিত হইলেই, তুমি তাঁহার চরণে ধরিয়া বিচার প্রার্থনা করিবে, কোনও মতে ভীত বা সঙ্কুচিত হইবে না।

কিয়ৎ ক্ষণ পরেই, অধিরাজ বিজয়বল্লভ, রাজপুরুষগণ ও বধ্যবেশধারী সোমদত্ত প্রভৃতি সমভিব্যাহারে, দেবালয়ের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। দেখিবামাত্র, চন্দ্রপ্রভা, তার সম্মুখবর্ত্তিনী হইয়া, অঞ্জলি বন্ধ পূর্ব্বক, বিনীত বচনে কহিলেন, মহারাজ! এই দেবালয়ের কর্ত্রী তপস্বিনী আমার উপর যার পর নাই অত্যাচাব করিয়াছেন, আপনারে অনুগ্রহ করিয়া বিচার করিতে হইবেক। শুনিয়া বিজয়বল্লভ কহিলেন, তিনি অতি সুশীলা ধর্ম্মশীলা প্রবীণা নারী, কোনও ক্রমে অন্যায় আচরণ করিবার লোক নহেন; তুমি কি কারণে তাঁহাব নামে অত্যাচারের অভিযোগ করিতেছ, বুঝিতে পারিলাম না। চন্দ্র প্রভ কহিলেন, মহাবাজ! আমি মিথ্যা অভিযোগ করিতেছি না; কিঞ্চিৎ মনোেযোগ দিয়া আমার নিবেদন শুনিতে হইবেক। আপনি যে ব্যক্তির সহিত আমার বিবাহ দিয়াছেন, তিনি ও তাঁহার পরিচারক কিঙ্কর উভয়ে উন্মাদরোগে আক্রান্ত হইয়াছেন, এবং রাজপথে ও লোকের বাটীতে অনেক প্রকার অত্যাচার করিতেছেন, এই সংবাদ পাইয়া, এক বার অনেক যত্নে বন্ধন পূর্ব্বক তাঁহাকে ও কিঙ্করকে বাটীতে পাঠাইয়া দিয়া, কোনও কার্য্য়বশতঃ বসুপ্রিয় স্বর্ণকারের আময়ে যাইতেছিলাম; ইতিমধ্যে দেখিতে পাইলাম, তিনি ও কিঙ্কর বাটী হইতে পলাইয়া আসিয়াছেন! আমি, পুনরায় তাঁহাদিগকে বাটীতে লইয়া যাইবার চেষ্টা পাইলাম। উভয়েই এক বারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য; আমাদিগকে দেখবামাত্র, উভয়েই তরবারি হস্তে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইলেন। তৎকালে আমার সঙ্গে অধিক লোক ছিল না; এজন্য, আমি তৎক্ষণাৎ বাটী গিয়া, লোক সংগ্রহ পূর্ব্বক, তাঁহাকে ও কিঙ্করকে লইয়া যাইতে আসিয়াছিলাম। এ বার আমাদিগকে দেখিয়া, ভয় পাইয়া, উভয়ে এই দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছেন। আমরাও তাঁহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রবিষ্ট হইতেছিলাম; এমন সময়ে, এখানকার কর্ত্রী তপস্বিনী, দ্বার রুদ্ধ করিয়া, আমাদিগকে প্রবেশ করিতে দিলেন না। অনেক বিনয় করিয়া বলিলাম; কিন্তু তিনি কোনও ক্রমে আমায় উঁহাকে লইয়া যাইতে দিবেন না। আমি, উঁহাকে এ অবস্থায় এখানে রাখিয়া, কেমন করিয়া বাটীতে নিশ্চিন্ত থাকিব। মহারাজ! যাহাতে আমি অবিলম্বে উঁহাকে বাটীতে লইয়া যাইতে পারি, অনুগ্রহ পূর্ব্বক তাহার উপায় করিয়া দেন, নতুবা আমি আপকে যাইতে দিব না।

এই বলিয়া চন্দ্রপ্রভা অধিরাজের চরণে নিপতিত হইয়া রহিলেন, এবং অবিশ্রান্ত অশ্রু বিমোচন করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে অধিরাজের অন্তঃকরণে দয়ার উদ্রেক হইল। তিনি পার্শ্ববর্ত্তী রাজপুরুষকে কহিলেন, তুমি দেবালয়ের কর্ত্রীকে আমার নমস্কার জানাইয়া, একবার ক্ষণকালের জন্য, আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বল; অনন্তর, চন্দ্রপ্রভার হস্তে ধরিয়া, ভূতল হইতে উঠাইলেন কহিলেন, বৎসে! শোক সংবরণ কর, এ বিষয়ের মীমাংসা না করিয়া আমি এখান হইতে যাইতেছি না।

এই সময়ে, এক ভৃত্য আসিয়া, অতি আকুল বচনে চন্দ্রপ্রভাকে কহিতে লাগিল, মা ঠাকুরাণি! যদি প্রাণ বাঁচাইতে চান, অবিলম্বে কোনও স্থানে লুকাইয়া থাকুন। কর্তা মহাশয় ও কিঙ্কর উভয়ে বন্ধন ছেদন করিয়াছেন এবং দাস দাসীদিগকে প্রহার করিয়া, বিদ্যাধর মাহাশয়কে দৃঢ় রূপে বন্ধন পূর্ব্বক তাহার দাড়ীতে আগুন লাগাইয়া দিয়াছেন; পরে, আগুন নিবাইবার জন্য, ময়লা জল আনিয়া তাঁহার মুখে ঢালিয়া দিতেছেন। বিদ্যাধর মহাশয়ের উপর প্রভুর যেরূপ রাগ দেখিলাম, তাহতে, হয় ত, তাঁহার প্রাণবধ করিবেন। এক্ষণে, যাহা কর্ত্তব্য হয় করুন, এবং আপনি সাবধান হউন। শুনিয়া চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, অরে নির্বোধ! তুই মিথ্যা বলিতেছিস; তোর প্রভু ও কিঙ্কর উভয়ে কিছু পূর্ব্বে এই দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছেন। ভৃত্য কহিল, মা ঠাকুরাণি! আমি মিথ্যা বলিতেছি না। তিনি বন্ধন ছেদন পূর্ব্বক দৌরাত্ম্য আরম্ভ করিলে, আমি, ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌড়িয়া, আপনার নিকটে আসিয়াছি। এই কথা বলিতে বলিতে, চিরঞ্জীবের তর্জন গর্জন শুনিতে পাইয়া, সে কহিল, মা ঠাকুরাণি! আমি তাঁহার চীৎকার শুনিতে পাইতেছি; বোধ হয় এখানেই আসিতেছেন; আপনি সাবধান হউন। তিনি বারংবার বলিয়াছেন, আপনাকে পাইলে, নাক কান কাটিয়া হতশ্রী করিয়া দিবেন। সত্বর পলায়ন করুন, কদাচ এখানে থাকিবেন না। চন্দ্রপ্রভা, ভয়ে অভিভূত হইয়া, ইতস্ততঃ দৃষ্টি সঞ্চারণ করিতে লাগিলেন। তদ্দর্শনে অধিরাজ বাহাদুর কহিলেন, বৎসে! ভয় নাই, আমার নিকটে আসিয়া দাঁড়াও। এই বলিয়া তিনি রক্ষকদিগকে বলিলেন, কাহাকেও নিকটে আসিতে দিও না।

চিরঞ্জীবকে দূর হইতে দেখিতে পাইয়া, চন্দ্রপ্রভা অধিরাজ বাহাদুরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহারাজ! কি আশ্চর্য্য দেখুন। প্রথমতঃ, আমি উঁহারে, দৃঢ় বন্ধন করাইয়া, বাটীতে পাঠাই; কিঞ্চিৎ পরেই, উঁহারে রাজপথে দেখিতে পাই, তত অল্প সময়ের মধ্যে, বন্ধন ছেদন পূর্ব্বক রাজপথে উপস্থিত হওয়া কোনও মতে সম্ভব নহে। তৎপরে, পলাইয়া এইমাত্র দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছেন। দেবালয়ে প্রবেশনির্গমের এক বই পথ নাই; বিশেষতঃ, আমরা সকলে দ্বারদেশে সমবেত আছি; ইতিমধ্যে, কেমন করিয়া, দেবালয় হইতে বহির্গত হইলেন, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। বলিতে কি, মহারাজ! উহার আজকার কাজ সকল মনুষ্যের বুদ্ধি ও বিবেচনার অতীত। এই সময়ে, জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব, উন্মত্তের ন্যায়, বিশৃঙ্খল বেশে অধিরাজের সম্মুখদেশে উপস্থিত হইলেন, এবং কহিতে লাগিলেন, দোহাই মহারাজের! দোহাই মহারাজের। আজ আমার উপর ঘোরতর অত্যাচার হইয়াছে; আমি জন্মাবচ্ছেদে কখনও এরূপ অপদস্থ ও অপমানিত হই নাই, এবং কখনও এরূপ লাঞ্ছনা ও এরূপ যাতনা ভোগ করি নাই। আমার স্ত্রী চন্দ্রপ্রভা, নিতান্ত সাধুশীলার ন্যায়, আপনার নিকটে দাড়াইয়া আছেন; কিন্তু আমি ইঁহার তুল্য দুশ্চারিণী নারী আর দেখি নাই। কতকগুলি ইতরের সংসর্গে কালযাপন আরম্ভ করিয়াছেন; এবং তাহাদের কুমন্ত্রণায় আজ যে যন্ত্রণা দিয়াছেন এবং যে দুরবস্থা করিয়াছেন, তাহা বর্ণন করিবার নয়। আপনারে নিরপেক্ষ হইয়া বিচার করিতে হইবেক; নতুরা আমি আত্মঘাতী হইব।

চিরঞ্জীবের অভিযোগ শুনিয়া, অধিরাজ কহিলেন, তোমার উপর কি অত্যাচার হইয়াছে বল; যদি বাস্তবিক হয়, অবশ্য প্রতিকার করিব। চিরঞ্জীব কহিলেন, মহারাজ! আজ মধ্যাহ্নকালে, আহারের সময়, দ্বার রুদ্ধ করিয়া, আমায় বাটীতে প্রবেশ করিতে দেন নাই, এবং সেই সময়ে কতকগুলি ইতর লোক লইয়া আমোদ আলাদ করিয়াছেন। শুনিয়া অধিরাজ কহিলেন, এ কথা যদি যথার্থ হয়, তাহা হইলে স্ত্রীলোকের পক্ষে ইহা অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ আর কিছুই হইতে পারে না। চন্দ্রপ্রভা! এ বিষয়ে তোমার কিছু বলিবার আছে। চন্দ্র প্রভা কহিলেন, মহারাজ! উনি অমূলক কথা বলিতেছেন; আজ মধ্যাহ্নকালে উনি, আমি ও বিলাসিনী তিন জনে একত্র আহার করিয়াছি; এ কথা যদি অন্যথা হয়, আমার যেন নরকেও স্থান না হয়। বিলাসিনী কহিলেন, হাঁ মহারাজ! দিদি আপনকার নিকট একটিও অলীক কথা বলেন নাই। উভয়ের কথা শুনিয়া, বসুপ্রিয় স্বর্ণকার বলিলেন, মহারাজ! আমি ইহাদের তুল্য মিথ্যাবাদিনী কামিনী ভূমণ্ডলে দেখি নাই; উভয়েই সম্পূর্ণ মিথ্যা বলিতেছেন। চিরঞ্জীববাবু আজ উন্মাদগ্রস্তই হউন, আর যাই হউন, উনি যে অভিযোগ করিতেছেন, তাহা সম্পূর্ণ সত্য। আপনি এই দুই দুরাচারিণীর বাক্যে বিশ্বাস করিবেন না।

অনন্তর, চিরঞ্জীব নিজ দুরবস্থার বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বর্ণন করিতে আরম্ভ করিলেন। মহারাজ! আমি মত্ত বা উন্মত্ত কিছুই হই নাই। কিন্তু আজ আমার উপর যেরূপ অত্যাচার হইয়াছে, যাহার উপর সেরূপ হইবেক, সেই উন্মত্ত হইবেক। প্রথমতঃ, আহারের সময়, দ্বার রুদ্ধ করিয়া, আমায় বাটীতে প্রবেশ করিতে দেন নাই; তৎকালে বসুপ্রিয় স্বর্ণকার ও রত্নদত্ত বণিক আমার সঙ্গে ছিলেন। আমি ক্রোধভরে দ্বারভঙ্গে উদ্যত হইয়াছিলাম; রত্নদত্ত অনেক বুঝাইয়া আমায় নিবারণ করিলেন। পরে আমি, বসুপ্রিয়কে সত্বর আমার নিকট হার লইয়া যাইতে বলিয়া, রত্নদত্ত সমভিব্যাহারে অপরাজিতার বাটীতে আহার করিলাম। বসুপ্রিয়ের আসিতে অনেক বিলম্ব হওয়াতে, আমি উঁহার অন্বেষণে নির্গত হইলাম। পথিমধ্যে উঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল। তৎকালে ঐ বণিকটি উঁহার সঙ্গে ছিলেন। বসুপ্রিয় কহিলেন, কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে আমি তোমায় হার দিয়াছি, টাকা দাও! কিন্তু, জগদীশ্বর সাক্ষী, আমি এ পর্য্য়ন্ত হার দেখি নাই। উনি তৎক্ষণাৎ রাজপুরুষ দ্বারা আমায় অবরুদ্ধ করাইলেন। পরে নিরুপায় হইয়া, আমার পরিচারক কিঙ্করকে দেখিতে পাইয়া, টাকা আনিবার জন্য বাটীতে পাঠাইলাম। সে যে গেল, সেই গেল, আর ফিরিয়া আসিল না। আমি অনেক বিনয়ে সম্মত করিয়া, রাজপুরুষকে সঙ্গে লইয়া বাটী যাইতেছিলাম; এমন সময়ে, আমার স্ত্রী ও তাহার ভগিনীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। দেখিলাম, উঁহাদের সঙ্গে কতকগুলি ইতর লোক রহিয়াছে; আর, আমাদের পল্লীতে বিদ্যাধর নামে একটা হতভাগা গুরুমহাশয় আছে, তাহাকেও সঙ্গে আনিয়াছেন। সে লোকের নিকট চিকিৎসক বলিয়াও পরিচয় দিয়া থাকে। তাহার মত দুশ্চরিত্র নরাধম ভূমণ্ডলে নাই। সেই দুরাত্মা আজ কাল আমার স্ত্রীর প্রিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়াছে। সে আমায় দেখিয়া বলিল, আমি উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছি। অনন্তর, তাহার উপদেশ অনুসারে, আমাকে ও কিঙ্করকে বন্ধন করিয়া বাটীতে লইয়া গেল, এবং এক দুর্গন্ধপূর্ণ অন্ধকারময় গৃহে বন্ধন অবস্থায় রাখিয়া দিল। আমরা, অনেক কষ্টে দন্ত দ্বারা রজ্জু ছেদন পূর্ব্বক, পলাইয়া আপনকার সমীপে সমুদয় নিবেদন করিতে যাইতেছিলাম; ভাগ্যক্রমে এই স্থানে আপনার সাক্ষাৎ পাইলাম। আপনি সাক্ষাৎ ধর্ম্মের অবতার, এ রাজ্যে ন্যায় অন্যায় বিচারের একমাত্র কর্তা। আমার প্রার্থনা এই, যথার্থ বিচার করিয়া, অপরাধীর সমুচিত দণ্ড বিধান করেন। আমি আপনকার সমক্ষে যে সকল কথা বলিলাম, যদি ইহার একটিও মিথ্যা হয়, আপনি আমার প্রাণদণ্ড করিবেন।

এই বলিয়া, চিরঞ্জীব বিরত হইবামাত্র, বসুপ্রিয় কহিলেন, মহারাজ! উনি আহারের সময় বাটীতে প্রবেশ করিতে পান নাই, এবং বাটীতে আহার করেন নাই, আমি এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিতে প্রস্তুত আছি; তৎকালে আমি উঁহার সঙ্গে ছিলাম। অধিরাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি উঁহারে হার দিয়াছ কি না, বল। বসুপ্রিয় কহিলেন, হাঁ মহারাজ! আমি স্বয়ং উঁহার হস্তে হার দিয়াছি। উনি কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে যখন পলাইয়া দেবালয়ে প্রবেশ করেন, উঁহার গলায় ঐ হার ছিল, ইঁহারা সকলে স্বচক্ষে দেখিয়াছেন। বণিক কহিলেন, মহারাজ! যখন উঁহার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়, তখন একবারে হারপ্রাপ্তি অস্বীকার করিয়াছিলেন; কিন্তু দ্বিতীয় বার সাক্ষাৎকারকালে, হার পাইয়াছি বলিয়া স্পষ্ট বাক্যে স্বীকার করিয়াছেন। আমি উঁহার স্বীকার ও অস্বীকার উভয়ই স্বকর্ণে শুনিয়াছি। তৎপরে কথায় কথায় বিবাদ উপস্থিত হওয়াতে, উভয়েই তরবারি লইয়া দ্বন্দ্বযুদ্ধে উদ্যত হইয়াছিলাম; এমন সময়ে, উনি পলাইয়া দেবালয়ে প্রবেশ করেন, এক্ষণে দেবালয় হইতে বহির্গত হইয়া, আপনকার সমক্ষে উপস্থিত হইয়াছেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, মহারাজ! এ জন্মে আমি এ দেবালয়ে প্রবেশ করি নাই; বণিকের সহিত দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হই নাই; বসুপ্রিয় কখনই আমার হস্তে হার দেন নাই। উহারা আমার নামে এ তিনটি মিথ্যা অভিযোগ উপস্থিত করিতেছেন।

এই সমস্ত অভিযোগ ও প্রত্যভিযোগ শ্রবণ করিয়া, অধিরাজ কহিলেন, এরূপ দুরূহ বিষয় কখনও আমার সম্মুখে উপস্থিত হয় নাই। আমার বোধ হয়, তোমাদের সকলেরই দৃষ্টিক্ষয় ও বুদ্ধি বিপর্য্য়য় ঘটিয়াছে। তোমরা সকলেই বলিতেছ, চিরঞ্জীব এইমাত্র দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছে; যদি দেবালয়ে প্রবেশ করিত, এখনও দেবালয়েই থাকিত। তোমরা কহিতেছ, চিরঞ্জীব উন্মত্ত হইয়াছে; যদি উন্মত্ত হইত, তাহা হইলে এরূপ বুদ্ধি ও বিবেচনা সহকারে এত ক্ষণ আমার সমক্ষে অভিযোগ ও প্রত্যভিযোগ করিতে পারিত না। তোমরা দুই ভগিনীতে বলিতেছ, চিরঞ্জীব বাটীতে আহার করিয়াছে; কিন্তু বসুপ্রিয় তৎকালে তাহার সঙ্গে ছিল, সে বলিতেছে, চিরঞ্জীব বাটীতে আহার করে নাই। এই বলিয়া, তিনি কিঙ্করকে জিজ্ঞাসিলেন, কি রে, তুই কি জানিস, বল্‌। সে কহিল, মহারাজ! কর্ত্তা আজ মধ্যাহ্নকালে অপরাজিতার বাটীতে আহার করিয়াছেন। অপরাজিতা কহিলেন, হা মহারাজ! আজ চিরঞ্জীববাবু আমার বাটীতে আহার করিয়াছিলেন; ঐ সময়ে আমার অঙ্গুলি হইতে একটি অঙ্গুরীয় খুলিয়া লইয়াছেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, হাঁ মহারাজ! আমি এই অঙ্গুরীয়টি উঁহার অঙ্গুলি হইতে খুলিয়া লইয়াছি, যথার্থ বটে। অধিরাজ অপরাজিতাকে জিজ্ঞাসিলেন, কেমন, তুমি কি চিরঞ্জীবকে দেবালয়ে প্রবেশ করিতে দেখিয়াছ। অপরাজিতা কহিলেন, আজ্ঞা হাঁ, মহারাজ! আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি, সে বিষয়ে আমার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।

এইরূপ পরস্পর বিরুদ্ধ উক্তি প্রত্যুক্তি শ্রবণ করিয়া, হতবুদ্ধি হইয়া, অধিরাজ কহিলেন, আমি এমন অদ্ভুত কাণ্ড কখনও দেখি নাই ও শুনি নাই। আমার স্পষ্ট বোধ হইতেছে, তোমরা সকলেই উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছ। অনন্তর, তিনি এক রাজপুরুষকে কহিলেন, আমার নাম করিয়া, তুমি দেবালয়ের কর্ত্রীকে অবিলম্বে এখানে আনিতে বল; দেখা যাউক, তিনিই বা কিরূপ বলেন। রাজপুরুষ, যে আজ্ঞা মহারাজ! বলিয়া, দেবালয়ে প্রবেশ করিলেন।

চিরঞ্জীব অধিরাজের সম্মুখবর্ত্তী হইবামাত্র, সোমদত্ত তাঁহাকে নয়নগোচর করিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, যদি শোকে ও দুরবস্থায় পড়িয়া, আমার নিতান্তই বুদ্ধির ভ্রংশ ও দর্শনশক্তির ব্যতিক্রম না ঘটিয়া থাকে, তাহা হইলে, এ ব্যক্তি আমার পুত্র চিরঞ্জীব ও অপর ব্যক্তি তাহার পরিচারক কিঙ্কর, তাহার কোনও সন্দেহ নাই। তিনি, চিরঞ্জীবকে পুত্র বলিয়া সম্ভাষণ করিবার নিমিত্ত, নিতান্ত অস্থিরচিত্ত হইয়াছিলেন, কেবল অভিযোগ ও প্রত্যভিযোগের গোলযোগে অবকাশ পান নাই, এক্ষণে অধিরাজকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, মহারাজ! যদি অনুমতি হয়, কিছু নিবেদন করিতে ইচ্ছা করি। অধিরাজ কহিলেন, যাহা ইচ্ছা হয়, সচ্ছন্দে বল, কোনও বিষয়ে কিছুমাত্র সঙ্কোচ করিও না। সোমদত্ত কহিলেন, মহারাজ! এত ক্ষণের পর, এই জনতার মধ্যে, আমি একটি আত্মীয় দেখিতে পাইয়াছি; বোধ করি, তিনি টাকা দিয়া আমার প্রাণরক্ষা করিতে পারেন। অধিরাজ কহিলেন, সোমদত্ত! যদি কোনও রূপে তোমার প্রাণরক্ষা হয়, আমি কি পর্য্যন্ত আহ্লাদিত হই, বলিতে পারি না। তুমি তোমার আত্মীয়কে জিজ্ঞাসা কর, তিনি তোমায় প্রাণরক্ষার্থে, এই মুহূর্ভে পাঁচ সহস্র টাকা দিতে প্রস্তুত আছেন কি না। তখন সোমদত্ত চিরঞ্জীবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন গো, বাবা! তোমার নাম চিরঞ্জীব ও তোমার পরিচারকের নাম কিঙ্কর বটে। বধ্যবেশধারী অপরিচিত বৈদেশিক ব্যক্তি অকস্মাৎ এরূপ প্রশ্ন করিলেন, কেন, ইহার মর্ম্ম বুঝিতে না পারিয়া, চিরঞ্জীব একদৃষ্টিতে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। তখন সোমদত্ত কহিলেন, তুমি নিতান্ত অপরিচিতের ন্যায় আমায় নিরীক্ষণ করিতেছ কেন; তুমি ত আমায় বিলক্ষণ জান। চিরঞ্জীব কহিলেন, না মহাশয়! আমি আপনারে চিনিতে পারিতেছি না, এবং ইহার পূর্ব্বে কখনও আপনাকে দেখিয়াছি, এরূপ মনে হইতেছে না। সোমদত্ত কহিলেন, তোমার সঙ্গে শেষ দেখার পর, শোকে ও দুর্ভাবনায় আমার আকৃতির এত পরিবর্ত্ত হইয়াছে যে আমায় চিনিতে পারা সম্ভব নহে; কিন্তু তুমি কি আমার স্বর চিনিতে পারিতেছ না। চিরঞ্জীব কহিলেন, না মহাশয়! আমি আর কখনও আপনকার স্বর শুনি নাই। তখন সোমদত্ত কিঙ্করকে জিজ্ঞাসিলেন, কেমন কিঙ্কর! তুমিও কি আমায় চিনিতে পারিতেছ না। কিঙ্কর কহিল, যদি আমার কথায় বিশ্বাস করেন, তবে বলি, আমি আপনারে চিনিতে পারিতেছি না। অনন্তর, সোমদত্ত চিরঞ্জীবকে কহিলেন, আমার নিশ্চিত বোধ হইতেছে, তুমি আমায় চিনিতে পারিয়াছ। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমারও নিশ্চিত বোধ হইতেছে, আমি আপনারে চিনিতে পারিতেছি না; চিনিলে অস্বীকার করিবার কোনও প্রয়োজন ছিল না। আর, যখন আমি বারংবার বলিতেছি, আমি আপনারে চিনিতে পারিতেছি না, তখন আমার কথায় অবিশ্বাস করিবারও কোনও কারণ দেখিতেছি না।

চিরঞ্জীবের কথা শুনিয়া, সোমদত্ত বিষণ্ণ ও বিস্ময়াপন্ন হইয়া, কহিতে লাগিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে, এই সাত বৎসরে আমার স্বরের ও আকৃতির এত বৈলক্ষণ্য ঘটিয়াছে যে একমাত্র পুত্র চিরঞ্জীবও আজ আমায় চিনিতে পারিল না। যদিও আমি জরায় জীর্ণ ও শোকে শীর্ণ হইয়াছি, এবং আমার বুদ্ধিশক্তি, দর্শনশক্তি ও শ্রবণশক্তির প্রায় লোপাপত্তি হইয়াছে; তথাপি, তোমার স্বর শুনিয়া ও আকৃতি দেখিয়া, আমার স্পষ্ট প্রতীতি জন্মিতেছে, তুমি আমার পুত্র; এ বিষয়ে আমার অণুমাত্র সংশয় হইতেছে না। শুনিয়া, কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করিয়া, চিরঞ্জীব কহিলেন, মহাশয়! আপনি সাত বৎসরের কথা কি বলিতেছেন, জ্ঞান হওয়া অবধি, আমি আমার পিতাকে দেখি নাই। সোমদত্ত কহিলেন, বৎস! যা বল না কেন, সাত বৎসর মাত্র তুমি হেমকূট হইতে প্রস্থান করিয়াছ। এই অল্প সময়ে এককালে সমস্ত বিস্মৃত হইয়াছ, ইহাতে আমি আশ্চর্য্য জ্ঞান করিতেছি। অথবা, আমার অবস্থার বৈগুণ্য দর্শনে, এত লোকের সাক্ষাতে, আমায় পিতা বলিয়া অঙ্গীকার করিতে তোমার লজ্জাবোধ হইতেছে। চিরঞ্জীব কহিলেন, মহাশয়! আমি জন্মবচ্ছেদে কখনও হেমকুট নগরে যাই নাই; অধিরাজ বাহাদুর নিজে এবং নগরের যে সকল লোক আমায় জানেন, সকলেই এ বিষয়ে সাক্ষ্য দিবেন; আমি আপনকার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করিতেছি না। তখন অধিরাজ কহিলেন, সোমদত্ত! চিরঞ্জীব বিংশতি বৎসর আমার নিকটে রহিয়াছে; এই বিংশতি বৎসরের মধ্যে, ও যে কখনও হেমকূট নগরে যায় নাই, আমি তাহার সাক্ষী। আমি স্পষ্ট বুঝিতেছি, শোকে, ও দুর্ভাবনায়, ও প্রাণদণ্ডভয়ে তোমার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে, তাহাতেই তুমি এই সমস্ত অসম্বদ্ধ কথা বলিতেছ। সোমদত্ত নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া নিরস্ত হইলেন, এবং দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক অধোবদনে মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন।

এই সময়ে, দেবালয়ের কর্ত্রী, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে সমভিব্যাহারে করিয়া, অধিরাজের সম্মুখবর্ত্তীনী হইলেন, এবং বহুমান পুরঃসর সম্ভাষণ করিয়া কহিলেন, মহারাজ! এই দুই বৈদেশিক ব্যক্তির উপর যথেষ্ট অত্যাচার হইয়াছে, আপনাকে তাহার বিচার করিতে হইবেক। ভাগ্যক্রমে, ইঁহারা দেবালয়ে প্রবেশ করিয়াছিলেন; নতুবা, ইঁহাদের প্রাণহানি পর্য্য়ন্ত ঘটিতে পারিত।

এক কালে দুই চিরঞ্জীব ও দুই কিঙ্কর অবলোকনমাত্র, সমবেত ব্যক্তিবর্গ বিস্ময়সাগরে মগ্ন হইয়া অবিচলিত নয়নে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। চন্দ্রপ্রভা, দুই স্বামী উপস্থিত দেখিয়া, হতবুদ্ধি হইয়া রহিলেন। হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব সোমদত্তকে দেখিবামাত্র চিনিতে পারিলেন, এবং তদীয় দুরবস্থা দর্শনে সজল নয়নে জিজ্ঞাসিলেন, পিতঃ! আমি সাত বৎসর মাত্র আপনকার সহিত বিয়োজিত হইয়াছি; এই স্বল্প সময়ের মধ্যে, আপনকার আকৃতির এত বৈলক্ষণ্য ঘটিয়াছে যে সহসা চিনিতে পারা যায় না। সে যাহা হউক, আপনকার শরীরে বধ্যবেশ লক্ষিত হইতেছে কেন। হেমকূটবাসী কিঙ্করও তাঁহাকে চিনিতে পারিয়া, ভূতলে দণ্ডবৎ পতিত হইয়া প্রণাম করিল এবং অশ্রুপূর্ণ নয়নে জিজ্ঞাসিল, মহাশয়! কে আপনারে বন্ধন করিয়া রাখিয়াছে, বলুন। দেবালয়ের কর্ত্রীও, কিয়ৎ ক্ষণ অনিমিষ নয়নে নিরীক্ষণ করিয়া, সোমদত্তকে চিনিতে পারিয়াছিলেন; এক্ষণে কিঙ্করেব কথা শুনিয়া, বাষ্পাকুল লোচনে শোকাকুল বচনে কহিলেন যে বন্ধন করুক, আমি উঁহার বন্ধন মোচন করিতেছি। অনন্তর, তিনি সোমদত্তকে জিজ্ঞাসিলেন, কেমন মহাশয়! আপনকার স্মরণ হয়, আপনি লাবণ্যময়ী নাম্নী এক মহিলার পাণি গ্রহণ করিয়াছিলেন; ঐ দুর্ভগার গর্ভে সর্বাংশে একাকৃতি দুই যমজ কুমার জন্মগ্রহণ করে। আমি সেই হতভাগা লাবণ্যময়ী, অদ্যাপি জীবিত রহিয়াছি। এ জন্মে আর যে আপনকার দর্শন পাইব, এক মুহূর্ত্তের জন্যেও, আমার সে আশা ছিল না। যদি পূর্ব্ব বৃত্তান্ত স্মরণ থাকে—

এই বলিতে বলিতে, লাবণ্যময়ীর কণ্ঠরোধ হইল। চক্ষের জলে বক্ষঃস্থল ভালিয়া যাইতে লাগিল।

সহসা চিরঞ্জীবের মুখদর্শন ও তদীয় অমৃতময় সম্ভাষণবাক্য শ্রবণ করিয়া, সোমদত্তের হৃদয়কন্দর অনির্ব্বচনীয় আনন্দসলিলে উচ্ছলিত হইয়াছিল; এক্ষণে আবার লাবণ্যময়ীর উদ্দেশ পাইয়া, যেন তিনি অমৃতসাগরে অবগাহন করিলেন এবং বাষ্পাকুল লোচনে গদগদ বচনে কহিলেন, প্রিয়ে! আমি যেরূপ হতভাগ্য, তাহাতে পুনরায় তোমার ও চিরঞ্জীবের মুখ নিরীক্ষণ করিব, কোনও রূপে সম্ভব নহে। তোমাদিগকে প্রত্যক্ষ করিতেছি বটে, কিন্তু তুমি যে বাস্তবিক লাবণ্যময়ী, আর ও যে বাস্তবিক চিরঞ্জীব, এখনও আমার সে বিশ্বাস হইতেছে না। বলিতে কি, আমি এই সমস্ত স্বপ্নদর্শনবৎ বোধ করিতেছি। যাহা হউক, যদি তুমি যথার্থই লাবণ্যময়ী হও, আমায় বল; যে পুত্রটির সহিত এক গুণবৃক্ষে বদ্ধ হইয়া সমুদ্রে ভাসিয়াছিলে, সে কোথায় গেল, সে কি অদ্যাপি জীবিত আছে। এই কথা শ্রবণমাত্র লাবণ্যময়ীর নয়নযুগল হইতে প্রবল বেগে বাষ্পবারি বিগলিত হইতে লাগিল। কিয়ৎ ক্ষণ পর্য্য়ন্ত তাহার বাক্যনিঃসরণ হইল না। পরে, কিঞ্চিৎ অংশে শোকাবেগ সংবরণ করিয়া, তিনি নিরতিশয় করুণ স্বরে কহিলেন, নাথ! তোমার কথা শুনিয়া, আমার চিরপ্রসুপ্ত শোকসাগর উথলিয়া উঠিল। তোমার জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। আমরা তীরে উত্তীর্ণ হইলে পর, কর্ণপুরের লোকেরা চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে লইয়া পলায়ন করিল। আমি তোমার ও তনয়দিগের শোকে, একান্ত বিকলচিত্ত হইয়া, অহোরাত্র হাহাকার করিয়া, পথে পথে কঁদিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। কিয়ৎ কাল অতীত হইলে, কিঞ্চিৎ অংশে শোক সংবরণ করিয়া, তোমাদের অন্বেষণে নির্গত হইলাম। কত কষ্টে কত দেশ পর্য্য়টন করিলাম, কিন্তু কোনও স্থানে কোনও সন্ধান পাইলাম না। পরিশেষে, তোমাদের পুনর্দর্শন বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরাশ্বাস হইয়া, স্থির করিলাম, আমার প্রাণ ধারণের প্রয়োজন নাই। এত ক্লেশে অসার দেহভার বহন করা বিড়ম্বনামাত্র; অতএব, আত্মঘাতিনী হই, তাহা হইলে, এক কালে সকল ক্লেশের অবসান হয়। পরে, আত্মঘাতিনী হওয়া সর্ব্বথা অনুচিত বিবেচনা করিয়া, জীবনের অবশিষ্ট ভাগ তপস্যা ও দেবকার্য্যে নিয়োজিত করাই সৎপরামর্শ বলিয়া অবধারিত করিলাম। অবশেষে, জয়স্থলে আসিয়া, এই দেবালয়ে প্রবিষ্ট হইয়া, তপস্বিনীভাবে কালহরণ করিতেছি। জ্যেষ্ঠ চিরঞ্জীব ও তাহার সহচর কিঙ্কর অদ্যাপি জীবিত আছে কি না, আর যদিই জীবিত থাকে, কোথায় আছে, কিছুই বলিতে পারি না। অনন্তর, লাবণ্যময়ী ও সোমদত্ত উভয়ে নিষ্পন্দ নয়নে পরস্পর মুখ নিরীক্ষণ ও প্রভূত বাষ্পবারি বিসর্জন করিতে লাগিলেন।

দুই চিরঞ্জীব ও দুই কিঙ্কর সমবেত দেখিয়া, অধিরাজ বাহাদুরও, কিছুই নির্ণয় করিতে না পারিয়া, সন্দিহান চিত্তে কত কল্পনা করিতেছিলেন, এক্ষণে লাবণ্যময়ী ও সোমদত্তের আলাপ শ্রবণে, সর্ব্বাংশে ছিন্নসংশয় হইয়া, সহাস্য বদনে কহিলেন, সোমদত্ত! তুমি প্রাতঃকালে যে আত্মবৃত্তান্ত বর্ণন করিয়াছিলে, তাহার অনেক অংশে আমার বিলক্ষণ সংশয় ছিল; কিন্তু এক্ষণে, তোমাদের স্ত্রীপুরুষের কথোপকথন শুনিয়া, সকল অংশে সম্পূর্ণরূপে সংশয় নিরাকরণ হইল। লাবণ্যময়ীর উপাখ্যান দ্বারা তোমার বর্ণিত বৃত্তান্তের সম্পূর্ণ সমর্থন হইতেছে। এখন আমি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম, দুই চিরঞ্জীব তোমাদের যমজ সন্তান; দুই কিঙ্কর তোমাদের ক্রীত দাস। আমাদের চিরঞ্জীব, অতি শৈশব অবস্থায়, তোমাদের সহিত বিয়োজিত হইয়াছিলেন, এজন্য তোমায় চিনিতে পারেন নাই। যাহা হউক, মনুষ্যের ভাগ্যের কথা কিছুই বলতে পারা যায় না। তুমি যাহাদের অদর্শনে এত কাল জীবন্মৃত হইয়া ছিলে, এক কালে সেই সকলগুলির সহিত অসম্ভাবিত সমাগম হইল। তুমি এত দিন আপনাকে অতি হতভাগ্য জ্ঞান করিতে; কিন্তু এক্ষণে দৃষ্ট হইতেছে, তোমার তুল্য সৌভাগ্যশালী পুরুষ অতি বিরল। শেষ দশায়, তোমার অদৃষ্টে যে এরূপ সুখ ও এরূপ সৌভাগ্য ঘটিবেক, ইহা স্বপ্নের অগোচর।

সোমদত্তকে এইরূপ কহিয়া, হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে জয়স্থলবাসী জ্ঞান করিয়া, অধিরাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন চিরঞ্জীব! তুমি প্রথম কর্ণপুর হইতে আসিয়াছিলে। তিনি কহিলেন, না মহারাজ! আমি নই; আমি হেমকূট হইতে আসিয়াছি। এই কথা শুনিয়া, অধিরাজ সস্মিত বদনে কহিলেন, হাঁ, বুবিলাম, তুমি আমাদের চিরঞ্জীব নও; তুমি এই দিকে স্বতন্ত্র দাঁড়াও; তোমাদের কে কোন ব্যক্তি, চিনা ভার। তখন জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, মহারাজ! আমি কর্ণপুর হইতে আসিয়াছিলাম; আপনকার পিতৃব্য বিখ্যাত বীর বিজয়বর্ম্মা আমায় সঙ্গে আনিয়াছিলেন। জয়স্থলবালী কিঙ্কর কহিল, আমি উঁহার সঙ্গে আসি। বিজয়বল্লভ কহিলেন, তোমরা দুজনে এক সঙ্গে এক দিকে দাঁড়াও।

এই সময়ে, চন্দ্রপ্রভা চিরঞ্জীবদিগকে জিজ্ঞাসিলেন, তোমাদের দুজনের মধ্যে কে আজ মধ্যাহ্নকালে আমার সঙ্গে আহার করিয়াছিলে। হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, তুমি কি আমার স্বামী নও। তিনি কহিলেন, না, আমি তোমার স্বামী নই; কিন্তু তুমি, স্বামী জ্ঞান করিয়া, আমায় বল পূর্ব্বক বাটীতে লইয়া গিয়াছিলে, এবং সেই সংস্কারে আমায় অনেক অনুযোগ করিয়াছিলে। তোমার ভগিনীও আমায় ভগিনীপতি জ্ঞানে পূর্ব্বাপর সম্ভাষণ করিয়াছিলেন। আমি কিন্তু আদ্যোপান্ত বলিয়াছিলাম, জয়স্থলে আমার বাস নয়, আমি তোমার পতি নই, আমি এ পর্য্য়ন্ত বিবাহ করি নাই। তোমরা তৎকালে আমার সে সকল কথায় বিশ্বাস কর নাই। আমিই তোমার পতি, তোমার উপর বিরক্ত হইয়া ঐরূপ কহিতেছি, তোমরা দুই ভগিনীতেই পূর্ব্বাপর সেই জ্ঞান করিয়াছিলে। এই বলিয়া, তিনি বিলাসিনীকে সম্ভাষণ করিয়া সম্মিত বদনে কহিলেন, আমি তৎকালে পরিণয় প্রস্তাব করাতে, তুমি বিস্ময়াপন্ন হইয়াছিলে, এবং আমায় যথোচিত ভর্ৎসনা ও বহুবিধ আপত্তি উত্থাপন করিয়াছিলে; এখন, বোধ হয়, তোমার আর সে সকল আপত্তি হইতে পারে না। বিলাসিনী শুনিয়া, লজ্জায় নম্নমুখী হইয়া রহিলেন। কিন্তু, তদীয় আকার প্রকার দর্শনে সন্নিহিত ব্যক্তি মাত্রেই বুঝিতে পারিলেন, চিরঞ্জীবের প্রস্তাবে তাঁহার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। এই পরিণয়প্রসঙ্গ শ্রবণে নিরতিশয় পরিতোষ প্রদর্শন করিয়া, অধিরাজ বিজয়বল্লভ প্রীতিপ্রফুল্ল লোচনে কহিলেন, শুভ কার্য্য়ে বিলম্বে প্রয়োজন নাই; চিরঞ্জীব! বিলাসিনী কল্য তোমার সহধর্মিণী হইবেন।

অনন্তর, বসুপ্রিয় স্বর্ণকার হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবকে জিজ্ঞাসিলেন, আমি আপনাকে যে হার দিয়াছিলাম, আপনার গলায় এ সেই হার কি না। তিনি কহিলেন, এ সেই হার বটে; আমি এক বারও তাহা অস্বীকার করি নাই। তখন জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব স্বর্ণকারকে কহিলেন, তুমি কিন্তু এই হারের জন্যে আমায় অবরুদ্ধ করাইয়াছিলে। বসুপ্রিয় লজ্জিত হইয়া কহিলেন, হাঁ মহাশয়! আমি আপনারে রাজপুরুষের হস্তে সমর্পণ করিয়াছিলাম। কিন্তু, পূর্ব্বাপর বিবেচনা করিয়া দেখিলে, আপনি আমায় অপরাধী করিতে পারেন না। চন্দ্রপ্রভা স্বীয় পতিকে জিজ্ঞাসিলেন, তোমার অবরোধের সংবাদ পাইয়া, কিঙ্কর দ্বারা যে স্বর্ণমুদ্রা পাঠাইয়াছিলাম, তুমি কি তাহা পাও নাই। জয়স্থলবাসী কিঙ্কর কহিল, কই আপনি আমা দ্বারা স্বর্ণমুদ্রা পাঠান নাই। তখন হেমকূটবাসী চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি কিঙ্করকে জাহাজের অনুসন্ধানে পাঠাইয়া, পান্থনিবাসে বসিয়া, উৎসুক চিত্তে তাহার প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা করিতেছি, এমন সময়ে সে আসিয়া, তোমার প্রেরিত বলিয়া, আমার হস্তে এই স্বর্ণমুদ্রার থলী দেয়; আমি, কিছুই বুঝিতে না পারিয়া, আপন নিকটে রাখিয়াছিলাম।

এইরূপে সংশয়াপনোদন কাণ্ড সমাপিত হইলে, জয়স্থলবালী চিরঞ্জীব কহিলেন, মহারাজ! আমি যেরূপ শুনিয়াছি, তাহাতে সায়ংকালের মধ্যে দণ্ডের টাকা দিলেও, আমার পিতা প্রাণদণ্ড হইতে নিষ্কৃতি পাইবেন, আপনি দয়া করিয়া এই আদেশ প্রদান করিয়াছেন, অনুমতি হইলে, ঐ টাকা আনাইয়া দি। বিজয়বল্লভ কহিলেন, চিরঞ্জীব! তোমাদের এই অসম্ভাবিত সমাগম দর্শনে আমি যে অনির্ব্বচনীয় প্রীতি লাভ করিয়াছি, তাহাতে আমার সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য প্রাপ্তি অপেক্ষাও অধিকতর লাভ বোধ হইয়াছে; অতএব, তোমার পিতা দণ্ড প্রদান ব্যতিরেকেই প্রাণদান পাইলেন। এই বলিয়া তিনি, সন্নিহিত রাজপুরুষদিগকে সোমদত্তের বন্ধনমোচন ও বধ্যবেশের অপসারণ করিতে আদেশ দিলেন।

এই রূপে সকল বিষয়ের সমাধান হইলে, লাবণ্যময়ী, গলবস্ত্র ও কৃতাঞ্জলি হইয়া, বিজয়বল্লভকে সম্ভাষণ করিয়া, কহিলেন, মহারাজ! আমার কিছু প্রার্থনীয় আছে; কৃপা করিয়া শ্রবণ করিতে হইবেক। বিজয়বল্লভ কহিলেন, লাবণ্যময়ি! যাহা ইচ্ছা হয়, সচ্ছন্দে বল, সঙ্কুচিত হইবার অণুমাত্র আবশ্যকতা নাই; আজ তোমার কোনও কথাই অরক্ষিত হইবার বা কোনও প্রার্থনাই অপরিপূরিত থাকিবার আশঙ্কা নাই। শুনিয়া, সাতিশয় হর্ষিত ও উৎসাহিত হইয়া লাবণ্যময়ী কহিতে লাগিলেন, মহারাজ! আমি এত কাল মনে করিতাম, আমার মত হতভাগা নারী আর নাই; কিন্তু আজ দেখিতেছি, আমার মত ভাগ্যবতী অতি অল্প আছে। চিরবিয়োগের পর, এই অতর্কিত পতি পুত্র সমাগম দ্বারা আমি যে আজ কি হইয়াছি, বলিতে পারি না; আমার কলেববে আনন্দপ্রবাহের সমাবেশ হইতেছে না। মহারাজ! আজ আমার কি উৎসবের দিন, তাহা আপনি অনায়াসে অনুভব করিতে পারিতেছেন। বলিতে কি, মহারাজ! এখনও আমার এই সমস্ত ঘটনা স্বপ্নদর্শনবৎ বোধ হইতেছে। যাহা হউক, এক্ষণে, আমার প্রথম প্রার্থনা এই, অনুগ্রহ প্রদর্শন পূর্ব্বক আমায় পতি, পুত্র ও পুত্রবধূ লইয়া দেবালয়ে এই উৎসবরজনী অতিবাহনের অনুমতি প্রদান করেন; দ্বিতীয় প্রার্থনা এই, যে সকল ব্যক্তি আজ এই অদ্ভুত ঘটনার সংস্রবে ছিলেন, তাঁহারা সকলে, দেবালয়ে উপস্থিত থাকিয়া, কিয়ৎ কাল আমোদ আহ্লাদ করেন; তৃতীয় প্রার্থনা এই, মহারাজ নিজে উৎসবসময়ে দেবালয়ে অধিষ্ঠান করেন; চতুর্থ প্রার্থনা এই, আমার তৃতীয় প্রার্থনা যেন ব্যর্থ না হয়।

লাবণ্যময়ীর প্রার্থনা শ্রবণে, বিজয়বল্লভ সহাস্য বদনে কহিলেন, আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে আজ আমি যেরূপ আনন্দ লাভ করিয়াছি, জন্মাবচ্ছেদে কখনও তাদৃশ আনন্দ অনুভব করি নাই, এবং উত্তর কালেও যে কখনও আর তদ্রূপ আনন্দ লাভ ঘটিবেক, তাহা সম্ভাবিত বোধ হইতেছে না। অধিক আর কি বলিব, তোমরা আজ বেরূপ আনন্দ অনুভব করিতেছ, আমিও নিঃসন্দেহ সেই রূপ, বরং তদপেক্ষা অধিক, আনন্দ অনুভব করিতেছি। চিরঞ্জীব! আমি যে তোমায় পুত্র নির্বিশেষে লালন পালন করিয়াছিলাম, আজ তা সর্ব্বতোভাবে সার্থক হইল। বোধ হয়, আমি পিতৃব্যের নিকট হইতে আগ্রহ পূর্ব্বক তোমায় গ্রহণ না করিলে, আজকার এই অভূতপূর্ব্ব সংঘটন দেখিতে, ও তন্নিবন্ধন এই অননুভূতপূর্ব্ব আনন্দ অনুভব করিতে পাইতাম না। যাহা হউক, লাবণ্যময়ি! আমি স্থির করিয়াছিলাম, তোমাদের সকলকে আমার আলয়ে লইয়া গিয়া, এবং রাজধানীর সমস্ত সম্ভ্রান্ত লোককে সমবেত করিয়া, আমোদ আহ্লাদে এই উৎসব-রজনী অতিবাহিত করিব। কিন্তু তোমার ইচ্ছা শ্রবণ করিয়া আমার সে ইচ্ছা পরিত্যাগ করিলাম। আজ তোমার যে সুখের দিন, তাহাতে কোনও অংশে তোমার মনে অসুখের সঞ্চার হইতে দেওয়া উচিত নহে। ইচ্ছা বিঘাত হইলে, পাছে তোমার অন্তঃকরণে অণুমাত্রও অসুখ জন্মে, এই আশঙ্কায় আমি তোমার প্রার্থনায় সম্মত হইলাম। আজ সকল বিষয়ে তোমার ইচ্ছাই বলবতী থাকিবে।

এই বলিয়া, রাজপুরুষদিগের প্রতি রাজধানীস্থ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের নিমন্ত্রণ ও উপস্থিত মহোৎসবের উপযোগী আয়োজনের আদেশ দিয়া, অধিরাজ বিজয়বল্লভ সোমদত্তপরিবার সহিত দেবালয়ে প্রবেশ করিলেন।


সম্পূর্ণ।


© 2024 পুরনো বই