॥ জলদানিকপর্বাধ্যায়॥
১। বিদুরের সান্ত্বনাদান
শত পুত্রের মৃত্যুতে ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত শোকাকুল হলেন। সঞ্জয় তাঁকে বললেন, মহারাজ, শোক করছেন কেন, শোকের কোনও প্রতিকার নেই। এখন আপনি মৃত আত্মীয়সুহৃদ্গণের প্রেতকার্য করান। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমার সমস্ত পুত্র অমাত্য ও সুহৃৎ নিহত হয়েছেন, এখন আমি ছিন্নপক্ষ জরাজীর্ণ পক্ষীর ন্যায় হয়েছি, আমার চক্ষু নেই, রাজ্য নেই, বন্ধু নেই; আমার জীবনের আর প্রয়োজন কি?
ধৃতরাষ্ট্রকে আশ্বাস দেবার জন্য বিদুর বললেন, মহারাজ, শুয়ে আছেন কেন, উঠুন, সর্ব প্রাণীর গতিই এই। মানুষ শোক করে মৃতজনকে ফিরে পায় না, শোক করে নিজেও মরতে পারে না। –
সর্বে ক্ষয়ান্তা নিচয়াঃ পতনাস্তাঃ সমুণ্ডুয়াঃ।
সংযোগ বিয়োগান্তা মরণান্তঞ্চ জীবিত৷৷
আদর্শনাদাপতিতাঃ পুনশ্চাদর্শনং গতাঃ।
ন তে তব ন ত্বেষাং ত্বং তত্র কা পরিবেদনা।
শোকস্থানসহস্রাণি ভয়স্থানশতানি চ।
দিবসে দিবসে মূঢ়মাবিশন্তি ন পণ্ডিত৷৷
ন কালস্য প্রিয়ঃ কশ্চিন্ন দেশ্যঃ কুরুসত্তম।
ন মধ্যস্থঃ কচিৎ কালঃ সর্বং কালঃ প্রকৰ্ষতি৷
-সকল সঞ্চয়ই পরিশেষে ক্ষয় পায়, উন্নতির অন্তে পতন হয়, মিলনের অন্তে বিচ্ছেদ হয়, জীবনের অন্তে মরণ হয়। মানুষ অদৃশ্য স্থান থেকে আসে, আবার অদৃশ্য স্থানেই চ’লে যায়; তারা আপনার নয়, আপনিও তাদের নন; তবে কিসের। খেদ? সহস্র সহস্র শোকের কারণ এবং শত শত ভয়ের কারণ প্রতিদিন মূঢ় লোককে অভিভূত করে, কিন্তু পণ্ডিতকে করে না। কুরুশ্রেষ্ঠ, কালের কেউ প্রিয় বা অপ্রিয় নেই, কাল কারও প্রতি উদাসীনও নয়; কাল সকলকেই আকর্ষণ করে নিয়ে যায়।
তারপর বিদুর বললেন, গর্ভাধানের কিছু পরে জীব জরায়ুতে প্রবেশ করে, পঞ্চম মাস অতীত হলে তার দেহ গঠিত হয়। অনন্তর সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ হয়ে জ্বণরূপে সে মাংসশোণিতযুক্ত অপবিত্র স্থানে বাস করে। তার পর বায়ুর বেগে সেই ভ্রূণ ঊর্ধ্বপাদ অধঃশিরা হয়ে বহু কষ্ট ভোগ করে যোনিদ্বার দিয়ে নির্গত হয়। সেই সময়ে গ্রহগণ তার কাছে আসে। ক্রমশ সে স্বকর্মে বদ্ধ হয় এবং বিবিধ ব্যাধি ও বিপদ তাকে আশ্রয় করে, তখন হিতৈষী সুহৃঙ্গণই তাকে রক্ষা করেন। কালক্রমে যমদূতেরা তাকে আকর্ষণ করে, তখন সে মরে। হা, লোকে লোভের বশে এবং ক্রোধ ও ভয়ে উন্মত্ত হয়ে নিজেকে বুঝতে পারে না। সকুলে জন্মালে নীচকুলজাতের এবং ধনী হলে দরিদ্রের নিন্দা করে, অন্যকে মূর্খ বলে, নিজেকে সংযত করতে চায় না। প্রাজ্ঞ ও মূর্খ, ধনবান ও নির্ধন, কুলীন ও অকুলীন, মানী ও অমানী সকলেই যখন পরিশেষে শ্মশানে গিয়ে শয়ন করে তখন দুষ্টবুদ্ধি লোকে কেন পরস্পরকে প্রতারিত করে?
২। ভীমের লৌহমূর্তি
সদেব ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এসে বহু সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, তুমি শোকে অভিভূত হয়ে বার বার মূৰ্ছিত হচ্ছ জানলে যুধিষ্ঠিরও দুঃখে প্রাণত্যাগ করতে পারেন। তিনি সকল প্রাণীকে কৃপা করেন, তোমাকে করবেন না কেন? বিধির বিধানের প্রতিকার নেই এই বুঝে আমার আদেশে এবং পাণ্ডবদের দুঃখ বিবেচনা করে তুমি প্রাণধারণ কর, তাতেই তোমার কীর্তি ধর্ম ও তপস্যা হবে। প্রজ্বলিত অগ্নির ন্যায় যে পুত্রশোক উৎপন্ন হয়েছে, প্রজ্ঞারূপ জল দিয়ে তাকে নির্বাপিত কর। এই বলে ব্যাসদেব প্রস্থান করলেন।
ধৃতরাষ্ট্র শোক সংবরণ করে গান্ধারী, কুন্তী এবং বিধবা বন্ধুদের নিয়ে বিদুরের সঙ্গে হস্তিনাপুর থেকে যাত্রা করলেন। সহস্র সহস্র নারী কাঁদতে কাঁদতে তাদের সঙ্গে চলল। এক ক্রোশ গিয়ে তারা কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মাকে দেখতে পেলেন। কৃপাচার্য জানালেন যে ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র প্রভৃতি সকলেই নিহত হয়েছেন। তারপর কৃপাচার্য হস্তিনাপুরে, কৃতবর্মা নিজের দেশে, এবং অশ্বত্থামা ব্যাসের আশ্রমে চ’লে গেলেন।
ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুর থেকে নির্গত হয়েছেন শুনে যুধিষ্ঠিরাদি, কৃষ্ণ, সাত্যকি ও যুযুৎসু তার অনুগমন করলেন। দ্রৌপদী ও পাঞ্চালবধূগণও সঙ্গে চললেন। পাণ্ডবগণ প্রণাম করলে ধৃতরাষ্ট্র অপ্রীতমনে যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন করলেন এবং ভীমকে খুঁজতে লাগলেন। অন্ধরাজের দুষ্ট অভিসন্ধি বুঝে কৃষ্ণ তার হাত দিয়ে ভীমকে সরিয়ে দিলেন এবং ভীমের লৌহময় মূর্তি ধৃতরাষ্ট্রের সম্মুখে রাখলেন। অযুত হস্তীর ন্যায় বলবান ধৃতরাষ্ট্র সেই লৌহমূর্তি আলিঙ্গন করে ভেঙে ফেললেন। বক্ষে চাপ লাগার ফলে তাঁর মুখ থেকে রক্তপাত হল , তিনি ভূমিতে পড়ে গেলেন; তখন সঞ্জয় তাকে ধরে তুললেন। ধৃতরাষ্ট্র সরোদনে উচ্চস্বরে বললেন, হা হা ভীম!
কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, শোক করবেন না, আপনি ভীমকে বধ করনেনি, তার প্রতিমূর্তিই চূর্ণ করেছেন। দুর্যোধন ভীমের যে লৌহমূর্তি নির্মাণ করিয়েছিলেন তাই আমি আপনার সম্মুখে রেখেছিলাম। আপনার মন ধর্ম থেকে চ্যুত হয়েছে তাই আপনি ভীমসেনকে বধ করতে চান; কিন্তু তাঁকে মারলেও আপনার পুত্রেরা বেঁচে উঠবেন না। আপনি বেদ ও বিবিধ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন, পুরাণ ও রাজধর্মও শুনেছেন, তবে স্বয়ং অপরাধী হয়ে এরূপ ক্রোধ করেন কেন? আপনি আমাদের উপদেশ শোনেন নি, দুর্যোধনের বশে চ’লে বিপদে পড়েছেন।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মাধব, তোমার কথা সত্য, পুত্রস্নেহই আমাকে ধৈর্যচ্যুত করেছিল। আমার ক্রোধ এখন দূর হয়েছে, আমি মধ্যম পাণ্ডবকে স্পর্শ করতে ইচ্ছা করি। আমার পুত্রেরা নিহত হয়েছে, এখন পাণ্ডুর পুত্রেরাই আমার স্নেহের পাত্র। এই বলে ধৃতরাষ্ট্র ভীম প্রভৃতিকে আলিঙ্গন ও কুশল প্রশ্ন করলেন।
৩। গান্ধারীর ক্রোধ
তারপর পঞ্চপাণ্ডব গান্ধারীর কাছে গেলেন। পুত্রশোকার্তা গান্ধারী যুধিষ্ঠিরকে শাপ দিতে ইচ্ছা করেছেন জেনে দিব্যচক্ষুষ্মান মনোভাবজ্ঞ মহর্ষি ব্যাস তখনই উপস্থিত হলেন। তিনি তার পুত্রবধূকে বললেন, গান্ধারী, তুমি পাণ্ডবদের উপর ক্রুদ্ধ হয়ো
অষ্টাদশ দিন যুদ্ধের প্রতিদিনই দুর্যোধন তোমাকে বলত, মাতা, আমি শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি, আমাকে আশীর্বাদ করুন। তুমি প্রতিদিনই পুত্রকে বলতে, যে পক্ষে ধর্ম সেই পক্ষেই জয় হবে। কল্যাণী, তুমি চিরদিন সত্য কথাই বলেছ। পাণ্ডবরা অত্যন্ত সংশয়াপন্ন হয়ে পরিশেষে তুমুল যুদ্ধে জয়ী হয়েছে, অতএব তাদের পক্ষেই অধিক ধর্ম আছে। মনস্বিনী, তুমি পূর্বে ক্ষমাশীলা ছিলে, এখন ক্ষমা করছ না কেন? যে পক্ষে ধর্ম সেই পক্ষেরই জয় হয়েছে। তোমার পূর্ববাক্য স্মরণ করে পাণ্ডুপুত্রদের উপর ক্রোধ সংবরণ কর।
গান্ধারী বললেন, ভগবান, আমি পাণ্ডবদের দোষ দিচ্ছি না, তাদের বিনাশও কামনা করি না; পুত্রশোকে আমার মন বিহ্বল হয়েছে। দুর্যোধন শকুনি কর্ণ আর দুঃশাসনের অপরাধেই কৌরবগণের ক্ষয় হয়েছে। কিন্তু বাসুদেবের সমক্ষেই ভীম দুর্যোধনের নাভির নিম্নদেশে গদাপ্রহার করেছে, সেজন্যই আমার ক্রোধ বর্ধিত হয়েছে। যিনি বীর তিনি নিজের প্রাণরক্ষার জন্যও যুদ্ধকালে কি করে ধর্মত্যাগ করতে পারেন?
ভীম ভীত হয়ে সানুনয়ে বললেন, দেবী, ধর্ম বা অধর্ম যাই হ’ক, আমি ভয়ের বশে আত্মরক্ষার জন্য এমন করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন। আপনার পুত্রও পূর্বে অধর্ম অনুসারে যুধিষ্ঠিরকে পরাভূত করেছিলেন এবং সর্বদাই আমাদের সঙ্গে কপটাচরণ করেছেন, সেজন্যই আমি অধর্ম করেছি। তিনি দ্যূতসভায় পাঞ্চালীকে কি বলেছিলেন তা আপনি জানেন; তার চেয়েও তিনি অন্যায় কার্য করেছিলেন-সভামধ্যে দ্রৌপদীকে বাম ঊরু দেখিয়েছিলেন। রাজ্ঞী, দুর্যোধন নিহত হওয়ায় শত্রুতার অবসান হয়েছে, যুধিষ্ঠির রাজ্য পেয়েছেন, আমাদের ক্রোধও দূর হয়েছে।
গান্ধারী বললেন, বৃকোদর, তুমি দুঃশাসনের রুধির পান করে অতি গর্হিত অনার্যোচিত নিষ্ঠুর কর্ম করেছ। ভীম বললেন, রক্ত পান করা অনুচিত, নিজের রক্ত তো নয়ই। ভ্রাতার রক্ত নিজের রক্তেরই সমান। দুঃশাসনের রক্ত আমার দন্ত ও ওষ্ঠের নীচে নামেনি, শুধু আমার দুই হস্তই রক্তাক্ত হয়েছিল। যখন দুঃশাসন দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করেছিল তখন আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তাই আমি ক্ষত্র-ধর্মানুসারে পালন করেছি। আপনার পুত্রেরা যখন আমাদের অপকার করত তখন আপনি নিবারণ করেন নি, এখন আমাদের দোষ ধরা আপনার উচিত নয়।
গান্ধারী বললেন, বৎস, আমাদের শত পুত্রের একটিকেও অবশিষ্ট রাখলে না কেন? সে বৃদ্ধ পিতামাতার যষ্টিস্বরূপ হত। তারপর গান্ধারী সক্রোধে জিজ্ঞাসা করলেন, সেই রাজা যুধিষ্ঠির কোথায়? যুধিষ্ঠির কাঁপতে কাঁপতে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, দেবী, আমিই আপনার পুত্রহন্তা নৃশংস যুধিষ্ঠির, আমাকে অভিশাপ দিন। গান্ধারী নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন। তার চরণ ধারণের জন্য যুধিষ্ঠির অবনত হলেন, সেই সময়ে গান্ধারী তার চক্ষুর আবরণবস্ত্রের অন্তরাল দিয়ে যুধিষ্ঠিরের অঙ্গুলির অগ্রভাগ দেখলেন; তার ফলে যুধিষ্ঠিরের সুন্দর নখ কুৎসিত হয়ে গেল। অনন্তর কৃষ্ণের পশ্চাতে অর্জুনও গান্ধারীর কাছে এলেন। অবশেষে গান্ধারী ক্রোধমুক্ত হয়ে মাতার ন্যায় পাণ্ডবগণকে এবং কুন্তী ও দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিলেন।
॥ স্ত্রীবিলাপপর্বাধ্যায়॥
৪। গান্ধারীর কুরুক্ষেত্র দর্শন-কৃষ্ণকে অভিশাপ
ব্যাসের আজ্ঞানুসারে ধৃতরাষ্ট্র ও যুধিষ্ঠিরাদি কৃষ্ণকে অগ্রবর্তী করে কৌরবনারীদের নিয়ে কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। রুদ্রের ক্রীড়াস্থানের ন্যায় সেই যুদ্ধভূমি দেখে নারীরা উচ্চকণ্ঠে কাঁদতে কাঁদতে যান থেকে নামলেন। এ গান্ধারী দূর থেকেই দিব্যচক্ষু দ্বারা সেই ভীষণ রণভূমি দর্শন করলেন। তিনি কৃষ্ণকে বললেন, দেখ, একাদশ অক্ষৌহিণীর অধিপতি দুর্যোধন গদা আলিঙ্গন করে রক্তাক্তদেহে শুয়ে আছেন। আমার পুত্রের মৃত্যু অপেক্ষাও কষ্টকর এই, যে নারীরা নিহত পতিগণের পরিচর্যা করছেন। লক্ষ্মণজননী দুর্যোধনপত্নী মস্তকে করাঘাত করে পতির বক্ষে পতিত হয়েছেন। আমার পতিপুত্রহীনা পুত্রবধূরা আলুলায়িতকেশে রণভূমিতে ধাবিত হচ্ছেন। মস্তকহীন দেহ এবং দেহহীন মস্তক দেখে অনেকে মূৰ্ছিত হয়ে প’ড়ে গেছেন। ওই দেখ, আমার পুত্র বিকর্ণের তরুণী পত্নী মাংসলোভী গৃধ্রুদের তাড়াবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পারছেন না। কৃষ্ণ, তুমি নারীদের দারুণ ক্রন্দনের নিনাদ শোন। শ্বাপদগণ আমার পুত্র দুর্মুখের মুখমণ্ডলের অধভাগ ভক্ষণ করেছে। কেশব, লোকে যাঁকে অর্জুন বা তোমার চেয়ে দেড়গুণ অধিক শৌর্যশালী বলত সেই অভিমন্যুও নিহত হয়েছেন, বিরাটদুহিতা বালিকা উত্তরা শোকে আকুল হয়ে পতির গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। উত্তরা বিলাপ করে বলছেন, বীর, তুমি আমাদের মিলনের ছ মাস পরেই নিহত হলে! ওই দেখ, মৎস্যরাজের কুলস্ত্রীগণ অভাগিনী উত্তরাকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। হায়, কর্ণের পত্নী জ্ঞানশূন্য হয়ে ভূতলে পড়ে গেছেন, শ্বাপদগণ কর্ণের দেহের অল্পই অবশিষ্ট রেখেছে। গৃধ্র ও শৃগালগণ সিন্ধুসৌবীররাজ জয়দ্রথের দেহ ভক্ষণ করছে, আমার কন্যা দুঃশলা আত্মহত্যার চেষ্টা করছে এবং পাণ্ডবদের গালি দিচ্ছে। হা হা, ওই দেখ, দুঃশলা তার পতির মস্তক না পেয়ে চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে। ওখানে ঊর্ধরেতা সত্যপ্রতিজ্ঞ ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে আছেন। দ্রোণপত্নী কৃপী শোকে বিহ্বল হয়ে পতির সেবা করছেন, জটাধারী ব্রাহ্মণগণ দ্রোণের চিতা নির্মাণ করছেন। কৃষ্ণ, ওই দেখ, শকুনিকে শকুনগণ বেষ্টন করে আছে, এই দুর্বুদ্ধিও অস্ত্রাঘাতে নিধনের ফলে স্বর্গে যাবেন!
তারপর গান্ধারী বললেন, মধুসূদন, তুমি কেন এই যুদ্ধ হতে দিলে? তোমার সামর্থ্য ও বিপুল সৈন্য আছে, উভয় পক্ষই তোমার কথা শুনত, তথাপি তুমি কুরুকুলের এই বিনাশ উপেক্ষা করেছ, তোমাকে এর ফল ভোগ করতে হবে। পতির শুশ্রুষা করে আমি যে তপোবল অর্জুন করেছি তার দ্বারা তোমাকে অভিশাপ দিচ্ছি-তুমি যখন কুরুপাণ্ডব জ্ঞাতিদের বিনাশ উপেক্ষা করেছ, তখন তোমার জ্ঞাতিগণকেও তুমি বিনষ্ট করবে। ছত্রিশ বৎসর পরে তুমি জ্ঞাতিহীন অমাত্যহীন পুত্রহীন ও বনচারী হয়ে অপকৃষ্ট উপায়ে নিহত হবে। আজ যেমন ভরতবংশের নারীরা ভূমিতে লুণ্ঠিত হচ্ছে, তোমাদের নারীরাও সেইরূপ হবে।
মহামনা বাসুদেব ঈষৎ হাস্য করে বললেন, দেবী, আপনি যা বললেন তা আমি জানি; যা অবশ্যম্ভাবী তার জন্যই আপনি অভিশাপ দিলেন। বৃষ্ণিবংশের সংহারকর্তা আমি ভিন্ন আর কেউ নেই। যাদবগণ মানুষ ও দেবদানবের অবধ্য, তারা পরস্পরের হস্তে নিহত হবেন। কৃষ্ণের এই উক্তি শুনে পাণ্ডবগণ উদবিগ্ন ও জীবন সম্বন্ধে নিরাশ হলেন।
॥ শ্রাদ্ধপর্বাধ্যায়॥
৫। মৃতসৎকার-কর্ণের জন্মরহস্যপ্রকাশ
যুধিষ্ঠিরের আদেশে ধৌম্য বিদুর সঞ্জয় ইন্দ্রসেন প্রভৃতি চন্দন অগুরুকাষ্ঠ ঘৃত তৈল গন্ধদ্রব্য ক্ষৌমবসন কাষ্ঠ ভগ্নরথ ও বিবিধ অস্ত্র সংগ্রহ করে সযত্নে বহু চিতা নির্মাণ করলেন এবং প্রজ্বলিত অগ্নিতে নিহত আত্মীয়বৃন্দ ও অন্যান্য শত-সহস্র বীগণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদন করলেন। তার পর ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্রবর্তী করে যুধিষ্ঠিরাদি গঙ্গার তীরে গেলেন এবং ভূষণ উত্তরীয় ও উষ্ণীষ খুলে ফেলে বীরপত্নী গণের সহিত তর্পণ করলেন।
সহসা শোকাকুল হয়ে কুন্তী তার পুত্রগণকে বললেন, অর্জুন যাঁকে বধ করেছেন, তোমরা যাকে সূতপুত্র এবং রাধার গর্ভজাত মনে করতে, সেই মহাধনুর্ধর বীরলক্ষণান্বিত কর্ণের উদ্দেশেও তোমরা তর্পণ কর। তিনি তোমাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, সূর্যের ঔরসে আমার গর্ভে কবচকুণ্ডলধারী হয়ে জন্মেছিলেন।
কর্ণের এই জন্মরহস্য শুনে পাণ্ডবগণ শোকাতুর হলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, মাতা, যাঁর বাহুর প্রতাপে আমরা তাপিত হতাম, বস্ত্রাবৃত অগ্নির ন্যায় কেন আপনি তাকে গোপন করেছিলেন? কর্ণের মৃত্যুতে আমরা সকলেই শোকার্ত হয়েছি। অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র, এবং পাঞ্চাল ও কৌরবগণের বিনাশে যত দুঃখ পেয়েছি তার শতগুণ দুঃখ কর্ণের জন্য আমরা এখন ভোগ করছি। আমরা যদি তার সঙ্গে মিলিত হতাম তবে স্বর্গের কোনও বস্তু আমাদের অপ্রাপ্য হত না, এই কুরুকুলনাশক ঘোর যুদ্ধও হত না।
এইরূপ বিলাপ করে যুধিষ্ঠির কর্ণপত্নীগণের সহিত মিলিত হয়ে কর্ণের উদ্দেশে তর্পণ করলেন।