৷৷ আরণ্যকপর্বাধ্যায়৷৷
১। যুধিষ্ঠির ও অনুগামী বিপ্রগণ-সূর্যদত্ত তাম্ৰস্থালী
পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী হস্তিনাপুর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে উত্তরমুখে যাত্রা করলেন। ইন্দ্রসেন প্রভৃতি চোদ্দ জন ভৃত্য স্ত্রীদের নিয়ে রথে চড়ে তাদের পশ্চাতে গেল। পুরবাসীরা কৃতাঞ্জলি হয়ে পাণ্ডবগণকে বললে, আমাদের ত্যাগ করে আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? নিষ্ঠুর শত্রুরা অধর্ম করে আপনাদের জয় করেছে এই সংবাদ শুনে উবিগ্ন হয়ে আমরা এসেছি। আমরা আপনাদের ভক্ত অনুরক্ত ও হিতকামী, কুরাজার অধিষ্ঠিত রাজ্যে আমরা বাস করব না। ধর্ম-অর্থ-কাম এই ত্রিবর্গের সাধক এবং লোকাচারসম্মত ও বেদোক্ত সকল গুণ আপনাদের আছে, আমরা আপনাদের সঙ্গেই থাকব।
যুধিষ্ঠির বললেন, আমরা ধন্য, ব্রাহ্মণপ্রমুখ প্রজারা আমাদের স্নেহ করেন, তাই যে গুণ আমাদের নেই তাও আছে বলছেন। আমরা আপনাদের কাছে এই অনুরোধ করছি, স্নেহ ও অনুকম্পার বশবর্তী হয়ে অন্যথা করবেন না।-পিতামহ ভীষ্ম, রাজা ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, আমাদের জননী, এবং বহু সুহৃৎ হস্তিনাপুরে রয়েছেন, তারা শোকে বিহ্বল হয়ে আছেন, আপনারা তাদের সযত্নে পালন করুন, তাতেই আমাদের মঙ্গল হবে। আপনারা বহু দূরে এসে পড়েছেন, এখন ফিরে যান। আমাদের স্বজনবর্গের ভার আপনাদের উপর রইল, তাঁদের প্রতি স্নেহদৃষ্টি রাখবেন, তাতেই আমরা তুষ্ট হব।
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কথায় প্রজাবর্গ ‘হা রাজা’ বলে আর্তনাদ করে উঠল এবং অনিচ্ছায় বিদায় নিয়ে শোকাতুরচিত্তে ফিরে গেল। তারা চ’লে গেলে পাণ্ডবগণ রথারোহণে যাত্রা করলেন এবং দিনশেষে গঙ্গাতীরে প্রমাণ নামক মহাবট-বৃক্ষের নিকট উপস্থিত হলেন। সেই রাত্রিতে তারা কেবল জলপান করে রইলেন। শিষ্য ও পরিজন সহ কয়েকজন ব্রাহ্মণ পাণ্ডবদের অনুগমন করেছিলেন, তারা সেই রমণীয় ও ভয়সংকুল সন্ধ্যাকালে হোমাগ্নি জ্বেলে বেদধ্বনি ও বিবিধ আলাপ করতে লাগলেন এবং মধুর বাক্যে যুধিষ্ঠিরকে আশ্বাস দিয়ে সমস্ত রাত্রি যাপন করলেন।
পরদিন প্রভাতকালে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণদের বললেন, আমরা হৃতসর্বস্ব হয়ে দুঃখিতমনে বনে যাচ্ছি, সেখানে ফলমূল আর মাংস খেয়ে থাকব। হিংসুপ্রাণি-সমাকুল বনে বহু কষ্ট, আপনারা এখন ফিরে যান। ব্রাহ্মণরা বললেন, রাজা, আপনার যে গতি আমাদেরও সেই গতি হবে। আমাদের ভরণপোষণের জন্য ভাববেন না, নিজেরাই আহার সংগ্রহ করে নেব। আমরা ধ্যান ও জপ করে আপনার মঙ্গল-বিধান করব, মনোহর কথায় চিত্তবিনোদন করব। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনারা আহার সংগ্রহ করে ভোজন করবেন তা আমি কি করে দেখব? আপনারা ক্লেশভোগের যোগ্য নন। ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের ধিক, আমাদের প্রতি স্নেহবশেই আপনারা ক্লেশভোগ করতে চাচ্ছেন।
যোগ ও সাংখ্য শাস্ত্রে বিশারদ শৌনক নামক এক ব্রাহ্মণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, রাজা, সহস্র শোকস্থান (১) আছে, শত ভয়স্থান (১) আছে, মূর্খরাই প্রতিদিন তাতে অভিভূত হয়, পণ্ডিতজন হন না। শাস্ত্রসম্মত অমঙ্গলনাশিনী বুদ্ধি আপনার আছে, অর্থকষ্ট, দুর্গমস্থানে বাস বা স্বজনবিচ্ছেদের জন্য শারীরিক বা মানসিক দুঃখে অবসন্ন হওয়া আপনার উচিত নয়। মহাত্মা জনক বলেছেন, রোগ, শ্রম, অপ্রিয় বিষয়ের প্রাপ্তি ও প্রিয় বিষয়ের বিরহ, এই চার কারণে শারীরিক দুঃখ উৎপন্ন হয়। শারীরিক দুঃখের প্রতিবিধান করা এবং মানসিক দুঃখ সম্বন্ধে চিন্তা না করাই দুঃখনিবৃত্তির উপায়। অগ্নি যেমন জলে নির্বাপিত হয় সেইরূপ জ্ঞান দ্বারা মানসিক দুঃখ দূরীকৃত হয়, মন প্রশান্ত হলে শারীরিক কষ্টেরও উপশম হয়। স্নেহ (২) ই মানসিক দুঃখের মূল, দুঃখ ভয় শোক হর্ষ আয়াস সবই স্নেহ থেকে উৎপন্ন। জ্ঞানী যোগী ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি স্নেহে লিপ্ত হন না। আপনি কোনও বিষয় স্পৃহা করবেন না, যদি ধর্ম চান তবে স্পৃহা ত্যাগ করুন।
যুধিষ্ঠির বললেন, ব্রাহ্মণদের ভরণের জন্যই আমি অর্থ কামনা করি, আমার নিজের লোভ নেই। অনুগতজনকে পালন না করে আমার ন্যায় গৃহাশ্রমবাসী কি করে থাকতে পারে?
তৃণাসন ভূমি জল ও মধুর বাক্য, এই চারটির অভাব সজ্জনের গৃহে কখনও হয় না। আর্ত ব্যক্তিকে শয্যা, শ্রান্তকে আসন, তৃষিতকে জল এবং ক্ষুধিতকে আহার দিতে হবে। গৃহস্থের পক্ষে এইরূপ আচরণই পরম ধর্ম।
শৌনক বললেন, মহারাজ এই বেদবচন আছে-কর্ম কর, ত্যাগও কর; অতএব কোনও ধর্মকার্য কামনাপূর্বক করা উচিত নয়। ব্রাহ্মণদের ভরণের জন্য আপনি তপ ও যোগ দ্বারা সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করুন, সিদ্ধ ব্যক্তি যা ইচ্ছা করেন তপস্যার প্রভাবে তাই করতে পারেন।
যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের কাছে গিয়ে পুরোহিত ধৌম্যকে বললেন, বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ আমার সঙ্গে যাচ্ছেন, কিন্তু আমি দুঃখী, তাদের পালন করতে অক্ষম, পরিত্যাগ করতেও পারছি না। কি কর্তব্য বলুন। ক্ষণকাল চিন্তা করে ধৌম্য বললেন, সূর্যই সর্বভূতের পিতা, প্রাণীদের প্রাণধারণের নিমিত্ত তিনিই অন্নস্বরূপ, তুমি তার শরণাপন্ন হও। ধৌম্য সূর্যের অষ্টোত্তর-শত নাম শিখিয়ে দিলে যুধিষ্ঠির পুষ্প ও নৈবেদ্য দিয়ে সূর্যের পূজা করলেন এবং কঠোর তপস্যা ও স্তবপাঠে রত হলেন। সূর্যদেব প্রসন্ন হয়ে দীপ্যমান মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে বললেন, রাজা তোমার যা অভীষ্ট আছে সবই তুমি পাবে, বনবাসের দ্বাদশ বৎসর আমি তোমাকে অন্ন দেব। এই তাম্রময় স্থালী নাও, পাঞ্চালী পাকশালায় গিয়ে এই পাত্রে ফল মূল আমিষ শাকাদি রন্ধন করে যতক্ষণ অনাহারে থাকবেন ততক্ষণ চতুর্বিধ অন্ন অক্ষয় হয়ে থাকবে। চতুর্দশ বৎসর পরে তুমি আবার রাজ্যলাভ করবে। এই বলে সূর্য অন্তর্হিত হলেন।
বরলাভ করে যুধিষ্ঠির ধৌম্যকে প্রণাম এবং ভ্রাতাদের আলিঙ্গন করলেন, এবং তখনই দ্রৌপদীর সঙ্গে পাকশালায় গিয়ে রন্ধন করলেন। চর্ব্য চূষ্য লেহ্য পেয় এই চতুর্বিধ খাদ্য প্রস্তুত হল অল্প হলেও তা প্রয়োজনমত বাড়তে লাগল। ব্রাহ্মণভোজন শেষ হলে যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতারা খেলেন, তার পর বিঘস নামক অবশিষ্ট অন্ন যুধিষ্ঠির এবং সর্বশেষে দ্রৌপদী খেলেন। তখন অন্ন নিঃশেষ হয়ে গেল। সূর্যের বরপ্রভাবে এইরূপে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণগণকে অভিলষিত বস্তু দান করতে লাগলেন। কিছু কাল পরে পাণ্ডবগণ ধৌম্য ও অন্য ব্রাহ্মণদের সঙ্গে কাম্যকবনে যাত্রা করলেন।আমার আশেপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট
**
(১) শোক ও ভয়ের কারণ।
(২) অনুরাগ, আসক্তি।
২। ধৃতরাষ্ট্রের অস্থির মতি
পাণ্ডবদের বনযাত্রার পর প্রজ্ঞাচক্ষু (১) ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে বললেন, তোমার বুদ্ধি নির্মল, ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব তুমি জান, কুরুবংশীয়গণকে তুমি সমদৃষ্টিতে দেখ; যাতে কুরুপাণ্ডবের হিত হয় এমন উপায় বল। বিদুর বললেন, মহারাজ, অর্থ কাম ও মোক্ষ এই ত্রিবর্গের মুল ধর্ম; রাজ্যেরও মূল ধর্ম। সেই ধর্মকে বঞ্চিত করে শকুনি প্রভৃতি পাপাত্মারা যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করেছে। আপনি পূর্বে যেমন পাণ্ডবদের সমস্ত সম্পত্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, এখন আবার সেইরূপ দিন। পাণ্ডবদের তোষণ এবং শকুনির অবমাননা—এই আপনার সর্বপ্রধান কার্য, এই যদি করেন তবেই আপনার পুত্রদের কিছু রাজ্য রক্ষা পাবে। দুর্যোধন যদি সন্তুষ্ট হয়ে পাণ্ডবদের সঙ্গে একযোগে রাজ্য ভোগ করে তবে আপনার দুঃখ থাকবে না। যদি তা না হয় তবে দুর্যোধনকে নিগৃহীত করে যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যের আধিপত্য দিন, দুর্যোধন শকুনি আর কর্ণ পাণ্ডবগণের অনুগত হ’ক, দুঃশাসন সভামধ্যে ভীমসেন আর দ্রৌপদীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করুক। এ ছাড়া আর কি পরামর্শ আমি দিতে পারি ?
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, তুমি পূর্বে দূতসভায় যা বলেছিলে এখন আবার তাই বলছ। তোমার কথা পাণ্ডবদের হিতকর, আমাদের অহিতকর। পাণ্ডবদের জন্য নিজের পুত্রকে কি করে ত্যাগ করব? পাণ্ডবরাও আমার পুত্র বটে, কিন্তু দুর্যোধন আমার দেহ থেকে উৎপন্ন। বিদুর, আমি তোমার বহু সম্মান করে থাকি, কিন্তু তুমি যা বলছ সবই কুটিলতাময়। তুমি চ’লে যাও বা থাক, যা ইচ্ছা কর, অসতী স্ত্রীর সঙ্গে মিষ্ট ব্যবহার করলেও সে স্বামিত্যাগ করে। ধৃতরাষ্ট্র এই বলে সহসা অন্তঃপুরে চ’লে গেলেন। বিদুর হতাশ হয়ে পাণ্ডবদের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।
পাণ্ডবগণ পশ্চিম দিকে যাত্রা করে সরস্বতী নদীর তীরে সমতল মরুপ্রদেশের নিকটবর্তী কাম্যকবনে এলেন। সেই বনে তারা মুনিগণের সঙ্গে বাস করতে লাগলেন। বিদুর রথারোহণে আসছেন দেখে যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, ইনি কি আবার আমাদের দ্যূতক্রীড়ায় ডাকতে এসেছেন? শকুনি কি আমাদের অস্ত্রশস্ত্রও জয় করে নিতে চায়?
**
(১) যাঁর চক্ষুর ক্রিয়া দ্বারা সম্পন্ন হয়।
যুধিষ্ঠিরাদি আসন থেকে উঠে বিদুরের সংবর্ধনা করলেন। বিশ্রামের পর বিদুর বললেন, ধৃতরাষ্ট্র আমার কাছে হিতকর মন্ত্রণা চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার কথা তার রুচিকর হয় নি, তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে বললেন, যেখানে ইচ্ছা চ’লে যাও, রাজ্যশাসনের জন্য তোমার সাহায্য আর আমি চাই না। যুধিষ্ঠির, ধৃতরাষ্ট্র আমাকে ত্যাগ করেছেন, এখন আমি তোমাকে সদুপদেশ দিতে এসেছি। পূর্বে তোমাকে যা বলেছিলাম এখনও তাই বলছি।-শত্রু কর্তৃক নির্যাতিত হয়েও যে সহিষ্ণু হয়ে কালপ্রতীক্ষা করে সে একাকীই সমস্ত পৃথিবী ভোগ করে। সহায়দের সঙ্গে যে সমভাবে বিষয় ভোগ করে, সহায়কা তার দুঃখেরও অংশভাগী হয়। সহায়সংগ্রহের এই উপায়, তাতেই রাজ্যলাভ হয়। পাণ্ডুপুত্র, অন্নাদি সমস্তই সমভাবে সহায়দের সঙ্গে ভোগ করবে, অনর্থক কথা বলবে না, আত্মশ্লাঘা করবে না, এইরূপ আচরণেই রাজারা সমৃদ্ধি লাভ করেন।
বিদূর চ’লে গেলে ধৃতরাষ্ট্রের অনুতাপ হল। তিনি সঞ্জয়কে বললেন, বিদুর আমার ভ্রাতা সুহৃৎ এবং সাক্ষাৎ ধর্ম, তাঁর বিচ্ছেদে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে, তুমি শীঘ্র তাকে নিয়ে এস। যাও সঞ্জয়, তিনি বেঁচে আছেন কিনা দেখ। আমি পাপী তাই ক্রোধবশে তাকে দূর করে দিয়েছি, তিনি না এলে আমি প্রাণত্যাগ করব। সঞ্জয় অবিলম্বে কাম্যকরণে উপস্থিত হলেন। কুশলজিজ্ঞাসার পর সঞ্জয় বললেন, ক্ষত্তা, রাজা ধৃতরাষ্ট্র আপনাকে স্মরণ করেছেন, পাণ্ডবদের অনুমতি নিয়ে সত্বর হস্তিনাপুরে চলুন, রাজার প্রাণরক্ষা করুন।
বিদুর ফিরে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্র তাকে ক্রোড়ে নিয়ে মস্তক আঘ্রাণ করে বললেন, ধর্মজ্ঞ, আমার ভাগ্যক্রমে তুমি ফিরে এসেছ, তোমার জন্য আমি দিবারাত্র অনিদ্রায় আছি, অসুস্থ বোধ করছি। যা বলেছি তার জন্য ক্ষমা কর। বিদুর বললেন, মহারাজ, আপনি আমার পরম গুরু, আপনাকে দেখবার জন্য আমি ব্যর্থ হয়ে সত্বর চ’লে এসেছি। আপনার আর পাণ্ডুর পুত্রেরা আমার কাছে সমান পাণ্ডবরা এখন দুর্দশাগ্রস্ত তাই আমার মন তাদের দিকে গেছে।
৩। ধৃতরাষ্ট্র-সকাশে ব্যাস ও মৈত্রেয়
বিদুর আবার এসেছেন এবং ধৃতরাষ্ট্র তাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন শুনে দুর্যোধন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কর্ণ শকুনি ও দুঃশাসনকে বললেন, পাণ্ডবদের যদি ফিরে আসতে দেখি তবে আমি বিষ খেয়ে, উদ্বন্ধনে, অস্ত্রাঘাতে অগ্নিপ্রবেশে প্রাণ বিসর্জন দেব। শকুনি বললেন, তুমি মূখের ন্যায় ভাবছ কেন? পাণ্ডবরা প্রতিজ্ঞা করে গেছে, তারা সত্যনিষ্ঠ, তোমার পিতার অনুরোধে ফিরে আসবে না। কর্ণ বললেন, যদি ফিরে আসে তবে আবার দ্যূতক্রীড়ায় তাদের জয় করবেন। দুর্যোধন তুষ্ট হলেন না, মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন কর্ণ বললেন, আমরা দুর্যোধনের প্রিয়কামনায় কেবল কিংকরের ন্যায় কৃতাঞ্জলি হয়ে থাকব, অথচ স্বাধীনতার অভাবে প্রকৃত প্রিয়কার্য করতে পারব না, এ ঠিক নয়। আমরা সশস্ত্র হয়ে রথারোহণে গিয়ে পাণ্ডবদের বধ করব। সকলেই কর্ণের এই প্রস্তারের প্রশংসা করলেন এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে পৃথক পৃথক রথে চড়ে যাত্রার উপক্রম করলেন।
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন দিব্যদৃষ্টিতে সমস্ত জানতে পেরে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এসে বললেন, পাণ্ডবগণ কপটদ্যুতে পরাজিত হয়ে বনে গেছে—এই ঘটনা আমার প্রীতিকর নয়। তারা তের বৎসর পরে ফিরে এসে কৌরবদের উপর বিষ মোচন করবে। তোমার পাপাত্মা মূঢ় পুত্রকে বারণ কর, সে পাণ্ডবদের মারতে গিয়ে নিজেই প্রাণ হারাবে। রাজা, পাণ্ডবদের প্রতি দুর্যোধনের এই বিদ্বেষ যদি তুমি উপেক্ষা কর তবে ঘোর বিপদ উৎপন্ন হবে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ভগবান, দ্যূতক্রীড়ায় আমার এবং ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর গান্ধারীর মত ছিল না, দৈবের আকর্ষণেই আমি তা হ’তে দিয়েছিলাম। নির্বোধ দুর্যোধনের স্বভাব জেনেও পুত্রস্নেহবশে তাকে ত্যাগ করতে পারি না।
ব্যাসদেব বললেন, তোমার কথা সত্য, পুত্রের চেয়ে প্রিয় কিছু নেই। আমি একটি আখ্যান বলছি শোন।-পুরাকালে একদা গোমাতা সুরভীকে কাঁদতে দেখে ইন্দ্র তার শোকের কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। সুরভী বললেন, দেখুন আমার ওই দুর্বল ক্ষুদ্র পুত্র লাঙ্গলের ভারে পীড়িত হয়ে আছে, কৃষক তাকে কষাঘাত করছে। দুই বৃষের মধ্যে একটি বলবান, সে অধিক ভার বইছে; অন্যটি দুর্বল ও কৃশ, তার দেহের সর্বত্র শিরা দেখা যাচ্ছে, বার বার কশাহত হয়েও সে ভার বইতে পারছে। তার জন্যই আমি শোকার্ত হয়েছি। ইন্দ্র বললেন, তোমার তো সহস্র সহস্র পুত্র নিপীড়িত হয়, একটির জন্য এত কৃপা কেন? সুরভী বললেন, সহস্র পুত্রকে আমি সমদৃষ্টিতে দেখি, কিন্তু যে দীন ও সৎ তারই উপর আমার অধিক কৃপা। তখন ইন্দ্র প্রবল জলবর্ষণ করে কৃষককে বাধা দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র, সুরভীর ন্যায় তুমিও সকল পুত্রকে সমভাবে দেখো, কিন্তু দুর্বলকে অধিক কৃপা ক’রো। পুত্র, তুমি পাণ্ডু ও বিদুর সকলেই আমার কাছে সমান। তোমার একশত এক পুত্র; পাণ্ডুর কেবল পাঁচ পুত্র, তারা হীনদশাগ্রস্ত ও দুঃখার্ত। কি উপায়ে তারা জীবিত থাকবে এবং সমৃদ্ধি লাভ করবে এই চিন্তায় আমি সন্তপ্ত আছি। যদি কৌরবগণের জীবনরক্ষা করতে চাও তবে দুর্যোধন যাতে পাণ্ডবদের সঙ্গে শান্তভাবে থাকে সেই চেষ্টা কর।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মহাপ্রাজ্ঞ মুনি, আপনি যা বললেন তা সত্য। যদি আমরা আপনার অনুগ্রহের যোগ্য হই তবে আপনি নিজেই দুরাত্মা দুর্যোধনকে উপদেশ দিন। ব্যাস বললেন, ভগবান মৈত্রেয় ঋষি পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করে এখানে আসছেন, তিনিই দুর্যোধনকে উপদেশ দেবেন। এই বলে ব্যাস চ’লে গেলেন।
মুনিশ্রেষ্ঠ মৈত্রেয় এলে ধৃতরাষ্ট্র অর্থ্যাদি দিয়ে তাঁর পূজা করলেন। মৈত্রেয় বললেন, মহারাজ, আমি তীর্থপর্যটন করতে করতে কাম্যকবনে গিয়েছিলাম, সেখানে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমি শুনলাম আপনার পুত্রদের বিভ্রান্তির ফলে দূতরূপে মহাভয় উপস্থিত হয়েছে। আপনি আর ভীষ্ম জীবিত থাকতে আপনার পুত্রদের (১) মধ্যে বিরোধ হওয়া উচিত নয়। দূতসভায় দস্যুবৃত্তির ন্যায় যা ঘটেছে তাতে আপনি তপস্বীদের সমক্ষে আর মুখ দেখাতে পারেন না। তার পর মৈত্রেয় মিষ্টবাক্যে দুর্যোধনকে বললেন, মহাবাহু, আমি তোমার হিতের জন্য বলছি শোন, পাণ্ডবদের সঙ্গে বিরোধ ক’রো না। তারা সকলেই বিক্রমশালী সত্যব্রত ও তেজস্বী এবং হিড়িম্ব বক প্রভৃতি রাক্ষসগণের হন্তা। ব্যাঘ্র যেমন ক্ষুদ্র মৃগকে বধ করে সেইরূপ বলিশ্রেষ্ঠ ভীম কিমীর রাক্ষসকে বধ করেছেন। আরও দেখ, দিগবিজয়ের পূর্বে ভীম মহাধনুর্ধর জরাসন্ধকেও যুদ্ধে নিহত করেছেন। বাসুদেব যাঁদের আত্মীয়, ধৃষ্টদ্যুম্নাদি যাঁদের শ্যালক, তাদের সঙ্গে কে যুদ্ধ করতে পারে? রাজা দুর্যোধন, তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে শান্ত আচরণ কর, আমার কথা শোন, ক্রোধের বশবর্তী হয়ো না।
দুর্যোধন তার উরুতে চপেটাঘাত করলেন এবং ঈষৎ হাস্য করে অধোবদনে অঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ভূমিতে রেখা কাটতে লাগলেন। দুর্যোধনের এই অবজ্ঞা দেখে মৈত্রেয় ক্রোধে রক্তলোচন হলেন এবং জলস্পর্শ করে অভিশাপ দিলেন, তুমি আমার কথা অগ্রাহ্য করছ, এই অহংকারের ফল শীঘ্রই পাবে, মহাযুদ্ধে গদাঘাতে ভীম তোমার উরু ভগ্ন করবেন। ধৃতরাষ্ট্র প্রসন্ন করবার চেষ্টা করলে মৈত্রেয় বললেন, রাজা, দুর্যোধন যদি শান্তভাবে চ’লে তবে আমার শাপ ফলবে না, নতুবা ফলবে। ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করলেন, কিমীরকে ভীম কি করে বধ করেছেন? মৈত্রেয় উত্তর দিলেন, আমি আর কিছু বলব না, আপনার পুত্র আমার কথা শুনতে চায় না। আমি চ’লে গেলে বিদুরের কাছে শুনবেন।
** (১) পাণ্ডবরাও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররূপে গণ্য।
৷৷ কির্মীরবধপর্বাধ্যায়৷৷
৪। কির্মীরবধের বৃত্তান্ত
মৈত্রেয় চ’লে গেলে ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে বললেন, তুমি কির্মীরবধের বৃত্তান্ত বল। বিদুর বললেন, যুধিষ্ঠিরের নিকট যে ব্রাহ্মণরা এসেছিলেন, তাদের কাছে যা শুনেছি তাই বলছি।- পাণ্ডবরা এখান থেকে যাত্রা করে তিন অহোরাত্র পরে কাম্যকবনে পৌঁছেছিলেন। ঘোর নিশিথে নরখাদক রাক্ষসেরা সেখানে বিচরণ করে। তাদের ভয়ে তপস্বী গোপ সেই বনের নিকটে যান না। পাণ্ডবরা সেই বনে প্রবেশ করলে এক ভীষণ রাক্ষস বাহু প্রসারিত করে তাঁদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। তার চক্ষু দীপ্ত তাম্রবর্ণ, দশন প্রকটিত, কেশ ঊর্ধ্বগত হস্তে জ্বলন্ত কাঠ। তার গর্জনে বনের পক্ষী হরিণ ব্যাঘ্র মহিষ সিংহ প্রভৃতি সন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে লাগল। দ্রৌপদী ভয়ে চোখ বুজলেন, পঞ্চপান্ডব তাঁকে ধ’রে রইলেন। পুরোহিত ধৌম্য যথাবিধি রক্ষোঘ্ন মন্ত্র পাঠ করে রাক্ষসী-মায়াব বিনষ্ট করলেন। যুধিষ্ঠির রাক্ষসকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কে, কি চাও? রাক্ষস বললে, আমি কির্মীর, বক রাক্ষসের ভ্রাতা তোমাদের যুদ্ধে পরাজিত করে ভক্ষণ করব। যুধিষ্ঠির নিজেদের পরিচয় দিলে কির্মীর বললে ভাগ্যক্রমে আমার ভাতৃহন্তা ভীমের দেখা পেয়েছি, সে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে মন্ত্রবলে আমার ভ্রাতাকে মেরেছে, আমার প্রিয় সখা হিড়িম্বকে বধ করে তার ভগিনীকে হরণ করেছে। আজ ভীমের রক্তে আমার ভ্রাতার তর্পণ করব, হিড়িম্ববধের প্রতিশোধ নেব, ভীমকে ভক্ষণ করে জীর্ণ করে ফেলব।
ভীম একটি বৃক্ষ উৎপাটিত ও পত্রশূন্য করে হাতে নিলেন, অর্জুনও তার গান্ডীব ধনুতে জ্যারোপণ করলেন। ভীম বৃক্ষ দিয়ে রাক্ষসের মস্তকে প্রহার করলেন, রাক্ষসও দীপ্ত অশনির ন্যায় জ্বলিত কাষ্ঠ ভীমের দিকে ছুড়ে মারলে।ভীম বাম পদের আঘাতে সেই কাষ্ঠ রাক্ষসের দিকেই নিক্ষেপ করলেন। তারপর ভীম ও কির্মীর বলবান বৃষের ন্যায় পরস্পরকে আক্রমণ করলেন। ভীমের নিপীড়নে জর্জর হয়ে কির্মীর ভূতলে পড়ল, ভীম তাকে নিষ্পিষ্ট করে বধ করলেন।
এরপর যুধিষ্ঠির সেই স্থান নিষ্কণ্টক করে দ্রৌপদী ও ভ্রাতাদের সঙ্গে সেখানেই বাস করছেন। আমি তাঁদের কাছে যাবার সময় মহাবনের পথে সেই রাক্ষসের মৃতদেহ দেখেছি।
৷৷ অর্জুনাভিগমনপর্বাধ্যায়৷৷
৫। কৃষ্ণের আগমন-দ্রৌপদীর ক্ষোভ
পাণ্ডবগণের বনবাসের সংবাদ পেয়ে ভোজ বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয়গণ তাদের দেখতে এলেন। পাঞ্চালরাজের পুত্রগণ, চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু এবং কেকয়রাজপুত্রগণও এলেন। সেই ক্ষত্রিয়বীরগণ বাসুদেব কৃষ্ণকে পুরোবর্তী করে যুধিষ্ঠিরের চতুর্দিকে উপবেশন করলেন।
বিষন্নমনে যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করে কৃষ্ণ বললেন, যুদ্ধভূমি দুরাত্মা দুর্যোধন কর্ণ শকুনি আর দুঃশাসনের শোণিত পান করবে। তাদের নিহত এবং দলের সকলকে পরাজিত করে আমরা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে অভিষিক্ত করব। অনিষ্টকারী শঠকে বধ করাই সনাতন ধর্ম।
পাণ্ডবগণের পরাজয়ে জনার্দন কৃষ্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, তিনি যেন সর্বলোক দগ্ধ করতে উদ্যূত হলেন। অর্জুন তাঁকে শান্ত করে তাঁর পূর্বজন্মের কর্মকলাপ কীর্তন করলেন।-কৃষ্ণ, তুমি পুরাকালে গন্ধমাদন পর্বতে যত্রসায়ংগৃহ (১) মুনি হয়ে দশ সহস্র বৎসর বিচরণ করেছিলে। আমি ব্যাসদেবের কাছে শুনেছি, তুমি বহু বৎসর পুষ্কর তীর্থে, বিশাল বদরিকায়, সরস্বতীনদীতীরে ও প্রভাস তীর্থে কৃচ্ছ্রসাধন করেছিলে।তুমি ক্ষেত্র, সর্বভূতের আদি ও অন্ত, তপস্যার নিধান, সনাতন যজ্ঞস্বরূপ। তুমি সমস্ত দৈত্যদানব বধ করে শচীপতিকে সর্বেশ্বর করেছিলে। তুমিই নারায়ণ হরি ব্রহ্মা সূর্য চন্দ্র কাল আকাশ পৃথিবী। তুমি শিশু বামনরূপে তিন পদক্ষেপে স্বর্গ আকাশ ও মর্ত্য আক্রমণ করেছিলে তুমি নিসুন্দ নরকাসুর শিশুপাল জরাসন্ধ শৈব্য শতধন্বা প্রভৃতিকে জয় করেছ, রুক্মীকে পরাস্ত করে ভীষ্মকদুহিতা রুক্সিণীকে হরণ করেছ; ইন্দ্রদ্যুম্ন(২) রাজা, যবন কসেরুমান ও শাল্বকে বধ করেছ। জনার্দন, তুমি দ্বারকা নগরী আত্মসাৎ করে সমুদ্রে নিমগ্ন করবে। তোমাতে ক্রোধ বিদ্বেষ অসত্য নৃশংসতা কুটিলতা নেই। ব্রহ্মা তোমার নাভিপদ্ম থেকে উৎপন্ন, তুমি মধুকৈটভের হন্তা, শূলপাণি শম্ভু তোমার ললাট থেকে জন্মেছেন।
কৃষ্ণ বললেন, অর্জুন, তুমি আমারই, আমি তোমারই, যা আমার তাই তোমার, যে তোমাকে দ্বেষ করে সে আমাকেও করে, যে তোমার অনুগত সে আমারও অনুগত। তুমি নর আর আমি নারায়ণ ঋষি ছিলাম, আমরা এখন নরলোকে এসেছি।
শরণার্থিনী দ্রৌপদী পুণ্ডরীকাক্ষকে বললেন, হৃষীকেশ, ব্যাস বলেছেন তুমি দেবগণেরও দেব। তুমি সর্বভূতের ঈশ্বর, সেজন্য প্রণয়বশে আমি তোমাকে দুঃখ জানাচ্ছি। আমি পাণ্ডবগণের ভার্যা, তোমার সখী, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী; দুঃশাসন কেন আমাকে কুরুসভায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল? আমার একমাত্র বস্ত্র শোণিতসিক্ত, আমি লজ্জায় কাঁপছি, আমাকে দেখে পাপাত্মা ধৃতরাষ্ট্রগণ হেসে উঠল। পাণ্ডুর পঞ্চপুত্র, পাঞ্চালগণ ও বৃষ্ণিগণ জীবিত থাকতে তার আমাকে দাসীরূপে ভোগ করতে চেয়েছিল। ধিক পাণ্ডবগণ, ধিক ভীমসেনের বল, ধিক অর্জুনের গাণ্ডীব! তাদের ধর্মপত্নীকে যখন নীচজন পীড়ন করছিল তখন তারা নীরবে দেখছিলেন। স্বামী দুর্বল হলেও স্ত্রীকে রক্ষা করে, এই সনাতন ধর্ম। পাণ্ডবরা শরণাপন্নকে ত্যাগ করে না, কিন্তু আমাকে রক্ষা করেননি। কৃষ্ণ, আমি বহু ক্লেশ পেয়ে আর্যা কুন্তীকে ছেড়ে পুরোহিত ধৌম্যের আশ্রয়ে বাস করছি। আমি যে নির্যাতন ভোগ করেছি তা এই সিংহবিক্রান্ত বীরগণ কেন উপেক্ষা করছেন? দেবতার বিধানে মহৎ কুলে আমার জন্ম, আমি পাণ্ডবদের প্রিয়া ভার্যা, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ, তথাপি পঞ্চপাণ্ডবে সমক্ষেই দুঃশাসন আমার কেশাকর্ষণ করেছিল।
মৃদুভাষিণী কৃষ্ণা পদ্মকোষতুল্য হস্তে মুখ আবৃত করে সরোদনে বললেন,
নৈব মে পতবঃ সন্তি ন পুত্রা ন চ বান্ধবাঃ।
ন ভ্রাতবো ন চ নৈব ত্বং মধুসূদন।।
যে মাং বিপ্রকৃতাং ক্ষু্দ্রৈবুপেক্ষধ্বং বিশোকবৎ।
ন চে মে শামাতে দুঃখং কর্ণো যৎ প্রাহসৎ তদা।
চতুর্ভিঃ কারণৈঃ কৃষ্ণ ত্বযা রক্ষাস্মি নিত্যশঃ।
সম্বন্ধাদ্ গৌববাৎ সখ্যাৎ প্রভূত্বেন চ কেশব।।
-মধুসূদন, আমার পতি নেই, পুত্র নেই, বান্ধব ভ্রাতা পিতা নেই, তুমিও নেই। ক্ষু্দ্রেরা আমাকে নির্যাতিত করেছে, তোমরা শোকশূন্যের ন্যায় তা উপেক্ষা করেছ। তখন কর্ণ যে আমাকে উপহাস করেছিল সেই দুঃখ আমার দূর হচ্ছে না।কেশব, আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক (৩) আছে, তোমার যশোগৌরব আছে, তুমি সখা ও প্রভু (৪), এই চার কারণে আমাকে রক্ষা করা তোমার উচিত।
কৃষ্ণ বললেন, ভাবিনী, তুমি যাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছ তারা অর্জুনের শরে আচ্ছন্ন হয়ে রক্তাক্তদেহে ভূমিতে শোবে, তা দেখে তাদের ভার্যারা রোদন করবে। পাণ্ডবদের জন্য যা সম্ভবপর তা আমি করব, তুমি শোক ক’রো না। কৃষ্ণা, আমি সত্য প্রতিজ্ঞা করছি, তুমি রাজগণের রাজ্ঞী হবে। যদি আকাশ পতিত হয়, হিমালয় শীর্ণ হয়, পৃথিবী খণ্ড খণ্ড হয়, সমুদ্র শুষ্ক হয়, তথাপি আমার বাক্য ব্যর্থ হবে না।
দ্রৌপদী অর্জুনের দিকে বক্র দৃষ্টিপাত করলেন। অর্জুন তাঁকে বললেন, দেবী, রোদন ক’রো না, মধুসূদন যা বললেন তার অন্যথা হবে না। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, আমি দ্রোণকে বধ করব; শিখন্ডী ভীষ্মকে, ভীমসেন দুর্যোধনকে এবং ধনঞ্জয় কর্ণকে বধ করবেন। ভগিনী, বলরাম আর কৃষ্ণকে সহায় রূপে পেলে আমরা ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধেও অজেয় হব। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমি যদি দ্বারকায় থাকতাম তবে আপনাদের এই কষ্ট হত না। আমাকে না ডাকলেও আমি কুরুসভায় যেতাম এবং ভীষ্ম দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি কে বুঝিয়ে দ্যূতক্রীড়া নিবারণ করতাম। ধৃতরাষ্ট্র যদি না শুনতেন তবে তাকে সবলে নিগৃহীত করতাম, সুহৃদদ্বেশী শত্রু দ্যূতকারগণকে বধ করতাম। আমি দ্বারকায় ফিরে এসে সাত্যকির কাছে আপনার বিপদের কথা শুনে উদ্বিগ্ন দেখতে এসেছি। হা, আপনারা সকলেই বিষাদসাগরে নিমগ্ন হয়ে কষ্ট পাচ্ছেন!
**
(১) যেখানে সন্ধ্যা হয় সেই স্থানই যাঁর গৃহ।
(২) ইনি বনপর্ব ৮২-পরিচ্ছেদে উক্ত রাজা নন।
(৩) কৃষ্ণ দ্রৌপদীর মামাতো দেওর।
(৪) নিগ্রহ-অনুগ্রহ-সমর্থ।
৬। শাল্ববধের বৃত্তান্ত- দ্বৈতবন
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, কৃষ্ণ তুমি দ্বারকা ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলে? তোমার কি প্রয়োজন ছিল?
কৃষ্ণ বললেন, আমি শাল্ব রাজার সৌভনগর বিনষ্ট করতে গিয়েছিলাম। আপনার রাজসূয় যজ্ঞে আমি শিশুপালকে বধ করেছি শুনে শাল্ব ক্রুদ্ধ হয়ে দ্বারকাপুরী আক্রমণ করেন। তিনি তাঁর সৌভবিমানে ব্যূহ রচনা করে আকাশে অবস্থান করলেন। এই বৃহৎ বিমানই তাঁর নগর। যাদববীরগণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে দ্বারকাপুরী সর্বপ্রকারে সুরক্ষিত করলেন। উগ্রসেন (১) উদ্ধব (২) প্রভৃতি ঘোষণা করলেন, কেউ সুরাপান করতে পাবে না। আনর্ত (৩) দেশবাসী নট নর্তক ও গায়কগণকে অন্যত্র পাঠানো হল। সমস্ত সেতু ভেঙে দেওয়া হল এবং নৌকার যাতায়াত নিষিদ্ধ হল। সৈন্যদের বেতন খাদ্য ও পরিচ্ছদ দিয়ে সন্তুষ্ট করা হল। শাল্বের চতুরঙ্গিণী সেনা সর্বদিক বেষ্টন করে দ্বারকা অবরুদ্ধ করলে। তখন চারুদেষ্ণ, প্রদ্যুম্ন শাম্ব (৪) প্রভৃতি বীরগণ রথারোহণে শাল্বের সম্মুখীন হলেন। জাম্ববতীপুত্র শাম্ব শাল্বের সেনাপতি ক্ষেমবৃদ্ধির সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। ক্ষেমবৃদ্ধি আহত হয়ে পালিয়ে গেলে বেগবান নামে এক দৈত্য শাম্বকে আক্রমণ করলে, কিন্তু সে শাম্বের গদাঘাতে নিহত হল। বিবিন্ধ্য নামক এক মহাবল দানবকে চারুদেষ্ণ বধ করলেন।
প্রদ্যুম্ন শাল্বের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি শরাঘাতে মুর্ছিত হয়ে প’ড়ে গেলে সারথি দারুকপুত্র তাকে দ্রুতগামী রথে যুদ্ধভূমি থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। সংজ্ঞালাভ করে প্রদ্যুম্ন বললেন, তুমি রথ ফিরিয়ে নাও, যুদ্ধ থেকে পালানো বৃষ্ণিকুলের রীতি নয়। আমাকে পশ্চাৎপদ দেখলে কৃষ্ণ বলরাম সাত্যকি প্রভৃতি কি বলবেন? কৃষ্ণ আমাকে দ্বারকারক্ষার ভার দিয়ে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে গেছেন, তিনি আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন রুক্সিণীপুত্র প্রদ্যুম্ন আবার রণস্থলে গেলেন এবং শাল্বকে শরাঘাতে ভূপাতিত করে এক ভয়ংকর শর ধনুতে সন্ধান করলেন। তখন ইন্দ্রাদি দেবগণের আদেশে নারদ ও পবনদেব ভ্রতবেগে এসে প্রদ্যুম্নকে বললেন, বীর শাল্বরাজ তোমার বধ্য নন, বিধাতা সংকল্প করেছেন যে কৃষ্ণের হাতে এঁর মৃত্যু হবে। প্রদ্যুম্ন নিবৃত্ত হলেন, শাল্বও দ্বারকা ত্যাগ করে সৌভবিমানে আকাশে উঠলেন।
মহারাজা যুধিষ্ঠির, আপনার রাজসূয় যজ্ঞ শেষ হলে আমি দ্বারকায় ফিরে এসে দেখলাম যে শাল্বের আক্রমণে নগরী বিধ্বস্ত হয়েছে। উগ্রসেন বসুদেব প্রভৃতিকে আশ্বস্ত করে চতুরঙ্গ বল নিয়ে আমি মার্তিকাবত দেশে গেলাম এবং সেখান থেকে শাল্বের অনুসরণ করলাম। শাল্ব সমুদ্রের উপরে আকাশে অবস্থান করছিলেন। আমার শাঙ্গর্ধনু থেকে নিক্ষিপ্ত শর তার সৌভবিমান স্পর্শ করতে পারল না। তখন আমি মন্ত্রাহূত অসংখ্য শর নিক্ষেপ করলাম, তার আঘাতে সৌভমধ্যস্থ যোদ্ধারা কোলাহল করে মহার্ণবে নিপতিত হল। সৌভপতি শাল্ব মায়াযুদ্ধ আরম্ভ করলেন, আমি প্রজ্ঞাস্ত্র দ্বারা তাঁর মায়া অপসারিত করলাম।
এই সময়ে উগ্রসেনের এক ভৃত্য এসে আমাকে তার প্রভুর এই বার্তা জানালে।-কেশব, শাল্ব দ্বারকায় গিয়ে তোমার পিতা বসুদেবকে বধ করেছে, আর যুদ্ধের প্রয়োজন নেই, তুমি ফিরে এস। এই সংবাদ শুনে আমি বিহ্বল হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলাম। সহসা দেখলাম, আমার পিতা হস্তপদ প্রসারিত করে সৌভবিমান থেকে নিপতিত হচ্ছেন। কিছুক্ষণ সংজ্ঞাহীন হয়ে থাকার পর প্রকৃতিস্থ হয়ে দেখলাম সৌভবিমান নেই, শাল্ব নেই, আমার পিতাও নেই। তখন বুঝলাম সমস্তই মায়া। দানবগণ অদৃশ্য বিমান থেকে শিলাবর্ষণ করতে লাগল। অবশেষে আমি ক্ষুরধার নির্মল কালান্তক যমতুল্য সুদর্শন চক্র কে অভিমন্ত্রিত করে বললাম তুমি সৌভবিমান এবং তার অধিবাসী রিপুগণকে বিনষ্ট কর। তখন যুগান্তকালীন দ্বিতীয় সূর্যের ন্যায় সুদর্শন চক্র আকাশে উঠল এবং ক্রকচ (করাত) যেমন কাষ্ঠ
বিদারিত করে সেইরূপ সৌভবিমানকে বিদারিত করলে। সুদর্শন চক্র আমার হাতে ফিরে এলে তাকে আবার আদেশ দিলাম, শাল্বের অভিমুখে যাও। সুদর্শনের আঘাতে শাল্ব দ্বিখন্ডিত হলেন, তাঁর অনুচর দানবগণ হা হা রব করে পালিয়ে গেল।
শাল্ববধের বিবরণ শেষ করে কৃষ্ণ বললেন, মহারাজ, আমি দ্যূতসভায় কেন যেতে পারিনি তার কারণ বললাম। আমি গেলে দ্যূতক্রীড়া হত না। তারপর কৃষ্ণ পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদীর কাছে বিদায় নিয়ে সুভদ্রা ও অভিমন্যুর সঙ্গে যাত্রা করলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীর পুত্রদের নিয়ে পাঞ্চালরাজ্যে এবং ধৃষ্টকেতু নিজের ভগিনী(৫)র সঙ্গে চেদিরাজ্যে গেলেন, কৈকেয়গণ (৬)ও স্বরাজ্যে প্রস্থান করলেন।
ব্রাহ্মণগণকে বহু ধন দান করে এবং কুরুজাঙ্গলবাসী প্রজাবর্গের নিকট বিদায় নিয়ে
পঞ্চপাণ্ডব ভ্রৌপদী ও ধৌম্য রথারোহণে অন্য বনে এলেন। যুধিষ্ঠির তাঁর ভ্রাতাদের বললেন, আমাদের বার বৎসর বনবাস করতে হবে, তোমরা এই মহারণ্যে এমন একটি স্থান দেখ যেখানে বহু মৃগ পক্ষী পুষ্প ফল পাওয়া যায় এবং যেখানে সাধুলোক বাস করেন। অর্জুন বললেন, দ্বৈতবন রমণীয় স্থান, ওখানে সরোবর আছে, পুষ্পফল পাওয়া যায় আছে, দ্বিজগণও বাস করেন। আমরা ওখানেই বার বৎসর কাটাব।
পাণ্ডবগণ দ্বৈতবনে সরস্বতীনদীর নিকটে আশ্রম নির্মাণ করে বাস করতে লাগলেন। একদিন মহামুনি মার্কণ্ডেয় তাঁদের আশ্রমে এলেন।॥ তিনি পাণ্ডবগণের পূজা গ্রহণ করে তাদের দিকে চেয়ে একটু হাসলেন। যুধিষ্ঠির দুঃখিত হয়ে বললেন, আমাদের দুর্ভাগ্যের জন্য এই তপস্বীরা সকলেই অপ্রফুল্ল হয়ে আছেন, কিন্তু আপনি হৃষ্ট হয়ে হাসলেন কেন? মার্কণ্ডেয় বললেন, বৎস আমি আনন্দের জন্য হাসি নি, তোমার বিপদ দেখে আমার সত্যব্রত দাশরথি রামকে মনে পড়েছে, আমি তাঁকে ঋষ্যমূক পর্বতে দেখেছিলা।ম তিনি ইন্দ্রতুল্য মহাপ্রভাব এবং সমরে অজয় হয়েও ধর্মের জন্য রাজভোগ ত্যাগ করে বনে খিয়লেছিলেন। নিজেকে শক্তিমান ভেবে অধর্ম করা কারও উচিত নয়। যুধিষ্ঠির, তোমার প্রতিজ্ঞা অনুসারে বনবাসের কষ্ট সয়ে তুমি আবার রাজশ্রী লাভ করবে।
মার্কণ্ডেয় চ’লে গেলে দালভগোত্রীয় বক মুনি এলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন, কুন্তী পুত্র অগ্নি ও বায়ু মিলিত হয়ে যেমন বন দগ্ধ করে, সেইরূপ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় মিলিত হয়ে শত্রু দমন করবে।
**
(১) ইনি কংসের পিতা এবং দ্বারকার অভিজাতন্ত্রের অধিনায়ক বা প্রেসিডেন্ট।
(২) কৃষ্ণের এক বন্ধু।
(৩) দ্বারকার নিকটস্থ দেশ।
(৪) এঁরা তিনজনেই কৃষ্ণপুত্র।
(৫) টীকাকার নীলকন্ঠ বলেন, ইনি করেণুমতী, নকুলের পত্নী
(৬) সহদেবের শ্যালক।
৭। দ্রৌপদী-যুধিষ্ঠিরের বাদানুবাদ
একদিন সায়াহ্নকালে পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদী কথোপকথন করছিলেন। দ্রৌপদী যুধিষ্টিরকে বললেন, মহারাজ, তুমি যখন মৃগচর্ম পরে বনবাসের জন্য যাত্রা করেছিলে তখন দুরাত্মা দুর্যোধন দুঃশাসন কর্ণ আর শকুনি ছাড়া সকলেই অশ্রুপাত করেছিলেন।
পূর্বে তুমি শুভ্র কৌষেয় বস্ত্র পরতে, এখন তোমাকে চীরধারী দেখছি। কুণ্ডলধারী যুবক পাচকগণ সযত্নে মিষ্টান্ন প্রস্তুত করে তোমাদের খাওয়াত, এখন তোমরা বনজাত খাদ্যে জীবনধারণ করছ। বনবাসী ভীমসেনের দুঃখ দেখে কি তোমার ক্রোধবৃদ্ধি হয় না। বৃকোদর একাই সমস্ত কৌরবদের বধ করতে পারেন, কেবল তোমার জন্যই কষ্ট সইছেন। পুরুষব্যাঘ্র অর্জুন আর নকুল-সহদেবের দুর্দশা দেখেও কি তুমি শত্রুদের ক্ষমা করবে? দ্রুপদের কন্যা, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী, পতিব্রতা বীরপত্নী আমাকে বনবাসিনী দেখেও কি তুমি সয়ে থাকবে? লোকে বলে, ক্রোধশুন্য ক্ষত্রিয় নেই, কিন্তু তোমাতে তার ব্যতিত্রম দেখছি। যে ক্ষত্রিয় যথাকালে তেজ দেখায় না তাকে সকলেই অবজ্ঞা করে। প্রাচীন ইতিহাসে আছে, একদিন বলি তার পিতামহ মহাপ্রজ্ঞ অসুরপতি প্রহ্লাদকে প্রশ্ন করেছিলেন, ক্ষমা ভাল না তেজ ভাল? প্রহ্লাদ উত্তর দিলেন, বৎস, সর্বদা তেজ ভাল নয়, সর্বদা ক্ষমাও ভাল নয়। যে সর্বদা ক্ষমা করে তার বহু ক্ষতি হয়, ভৃত্য শক্র ও নিরপেক্ষ লোকেও তাকে অবজ্ঞা করে এবং কটুবাক্য বলে। আবার যারা যখনও ক্ষমা করে না তাদেরও বহু দোষ। যে লোক ক্রোধবশে স্থানে অস্থানে দণ্ডবিধান করে তার অর্থহানি অন্তাপ মোহ ও শক্রলাভ হয়। অতএব যথাকালে মৃদু হবে এবং যথাকালে কঠোর হবে। যে পুর্বে তোমার উপকার করেছে সে ণ্ডরু অপরাধ করলেও তাকে ক্ষমা করবে। যে না বুঝে অপরাধ করে সেও ক্ষমার যোগ্য, কারণ সকলেই পণ্ডিত নয়। কিন্তু যারা সজ্ঞানে অপরাধ করে বলে যে না বুঝে করেছি, সেই কুটিল লোকদের অল্প অপরাধেও দণ্ড দেবে। সকলেরই প্রথম অপরাধ ক্ষমার যোগ্য, কিন্ত দ্বিতীয় অপরাধ অল্প হলেও দণ্ডণীয়। মহারাজ, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা লোভী ও সর্বদা অপরাধী; তারা কোনও কালে ক্ষমার যোগ্য নয়, তাদের প্রতি তেজ প্রকাশ করাই তোমার কর্তব্য।
যুধিষ্ঠির বললেন, দ্রৌপদী, তুমি মহাপ্রজ্ঞাবতী, জেনে রাখ যে ক্রোধ থেকে শুভাশুভ দুইই হয়। ক্রোধ সয়ে থাকলে মঙ্গল হয়। ক্রুদ্ধ লোকে পাপ করে, ণ্ডরুহত্যাও করে। তাদের অকার্য কিছু নেই, তারা অবধ্যকে বধ করে, বধ্যকে পূজা করে। এই সমস্ত বিবেচনা করে আমার ক্রোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অপরের ক্রোধ দেখলেও যে ক্রুদ্ধ হয় না সে নিজেকে এবং অপরকেও মহাভয় থেকে ত্রাণ করে। ক্রোধ উৎপন্ন হলে যিনি প্রজ্ঞার দ্বারা রোধ করতে পারেন, পণ্ডিতরা তাকেই তেজস্বী মনে করেন। মূর্খরাই সর্বদা ক্রোধকে তেজ মনে করে, মানুষের বিনাশের জনাই রজোণ্ডণজাত ক্রোধের উৎপত্তি। ভীষ্ম কৃষ্ণ দ্রোণ বিদুর কৃপ সঞ্জয় ও পিতামহ ব্যাস সর্বদাই শমণ্ডণের কথা বলেন। এঁরা ধৃতরাষ্ট্রকে শান্তির উপদেশ দিলে তিনি অবশ্যই আমাকে রাজ্য ফিরিয়ে দেবেন, যদি লোভের বশে না দেন, তবে বিনষ্ট হবেন।
দ্রৌপদী বললেন, ধাতা আর বিধাতাকে নমস্কার, যাঁরা তোমার মোহ সৃষ্টি করেছেন, তার ফলে পিতৃপিতামহের বৃত্তি ত্যাগ করে তোমার মতি অন্য দিকে গেছে। জগতে কেউ ধর্ম অনিষ্ঠুরতা ক্ষমা সরলতা ও দয়ার দ্বারা লক্ষ্মীলাভ করতে পারে না। তুমি বহুপ্রকার মহাযজ্ঞ করেছ তথাপি বিপরীত বুদ্ধির বশে দ্যূতক্রীড়ায় রাজ্য ধন ভ্রাতৃগণ আর আমাকেও হারিয়েছ। তুমি সরল মৃদুস্বভাব বদান্য লজ্জাশীল সত্যবাদী, তথাপি দ্যূতব্যসনে তোমার মতি হল কেন? বিধাতাই পূর্বজন্মোর কর্ম অনুসারে প্রাণিগণের সুখদুঃখ বিধান করেন। কাষ্ঠময় পুত্তলিকা যেমন অঙ্গচালনা করে সেইরূপ সকল মনুষ্য বিধাতার নির্দেশেই ক্রিয়া করে। যেমন সূত্রে গ্রথিত মণি, নাসাবদ্ধ বৃষ, আৌতে পতিত বৃক্ষ, সেইরূপ মানুষও স্বাধীনতাহীন, তাকে বিধাতার বিধানেই চলতে হয়। সর্বভূতে ব্যাপ্ত হয়ে ঈশ্বরই পাপপুণ্য করাচ্ছেন তা কেউ লক্ষ্য করে না। মানুষ যেমন অচেতন নিশ্চেষ্ট কাষ্ঠ-পাষাণ-লৌহ দ্বারাই তদ্রুপ পদার্থ ছিন্ন করে, ঈশ্বর সেইরূপ জীব দ্বারাই জীবহিংসা করেন।
সংপ্রযোজ্য বিয়োজ্যাযং কামকাবকরঃ প্রভু।
ক্রীড়তে ভগবান্ ভূতৈর্বালঃ ক্রীড়নকৈরিব।।
ন মাতৃপিতৃবদ্ রাজন্ ধাতা ভূতেষূ বর্তাতে।
রোষাদিব প্রবৃত্তহবং যথাবমিতরো জনঃ।।…
তবেমামাপদং দৃষ্ট্বা সমৃদ্ধিঞ্চ সুযোধনে।
ধাতারং গর্হয়ে পার্থ বিষমং যোহনুপশ্যতি।।
কর্ম চেং কৃতমন্বেতি কর্তাবং নান্যমূচ্ছতি।
কর্মশা তেন পাপেন লিপ্যতে নূনমীশ্বরঃ।
অথ কর্মকৃতং পাপং ন চেৎ কর্তাবমৃচ্ছতি।
কারণং বলমেবেহ জনান্ শোচামি দুর্বলান্।।
-বালক যেমন খেলনা নিয়ে খেলে সেইরূপ প্রভু ভগবান ইচ্ছাসুসারে কখনও সংযুক্ত কখনও বিযুক্ত করে প্রাণিগণকে নিয়ে খেলা করেন। মহারাজ, বিধাতা প্রাণিগণকে মাতা-পিতার দৃষ্টিতে দেখেন না, তিনি রুষ্ট ইতর জনের ন্যায় ব্যবহার করেন। তোমার বিপদ আর দুর্যোধনের সমৃদ্ধি দেখে আমি বিধাতারই নিন্দা করছি যিনি এই বিষম ব্যবস্থা করেছেন। যদি কৃতকর্মের ফল কর্তারই ভোগ্য হয়, অন্যের ভোগ্য না হয় তবে প্রবৃত্তিদাতা ঈশ্বর নিশ্চয়ই কর্মজনিত পাপে লিপ্ত হন। আর কৃতকর্মের পাপ যদি কারয়িতা ঈশ্বরকে স্পর্শ না করে তবে তার-কারণ তিনি বলবান।দুর্বল লোকের জন্যই আমার শোক হচ্ছে।
যুধিষ্ঠির বললেন, যাজ্ঞসেনী, তোমার কথা সুন্দর, আশ্চর্য ও মনোহর, কিন্তু নাস্তিকের যোগ্য। আমি ধর্মের ফল অন্বেষণ করি না, দাতব্য বলেই দান করি, যজ্ঞ করা উচিত বলেই যজ্ঞ করি। ফলের আকাঙকা না করেই আমি যথাশক্তি গৃহাশ্রমবাসীর কর্তব্য পালন করি। যে লোক ধর্মকে দোহন করে ফল পেতে চায় এবং নাস্তিক বুদ্ধিতে যে লোক ফললাভ হবে কি হবে না এই আশঙ্কা করে, সে ধর্মের ফল পায় না। দ্রৌপদী, তুমি মাত্রা ছাড়িয়ে তর্ক করছ। ধর্মের প্রতি সন্দেহ ক’রো না, তাতে তির্যগগতি লাভ হয়। কল্যাণী, তুমি মূঢ় বুদ্ধির বশে বিধাতার নিন্দা ক’রো না, সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী ঋষিগণ যার কথা বলেছেন, শিষ্টজন যার আচরণ করছেন, সেই ধর্মের সম্বন্ধে সংশয়াপন্ন হয়ো না।
দ্রৌপদী বললেন, আমি ধর্মের বা ঈশ্বরের নিন্দা করি না, দুঃখার্ত হয়েই অধিক কথা বলে ফেলেছি। আরও কিছু বলছি, তুমি প্রসন্ন হয়ে শোন। মহারাজ, তুমি অবসাদপ্রস্ত না হয়ে কর্ম কর। যে লোক কেবল দৈবের উপর নির্ভর করে, এবং যে হঠবাদী (১) তারা উভয়েই মন্দবুদ্ধি। দেবারাধনায় যা লাভ হয় তাই দৈব, নিজ কর্মের দ্বারা যে প্রত্যক্ষ ফল লাভ হয় তাই পৌরুষ। ফলসিদ্ধির তিনটি কারণ, দৈব, প্রাক্তনকর্ম ও পুরুষকার। আমাদের যে মহাবিপদ উপস্থিত হয়েছে, তুমি পুরুষকার অবলম্বন করে কর্মে প্রবৃত্ত হলে তা নিশ্চয় দূর হবে।
** (১) যে মনে করে সমস্তই অকস্মাৎ ঘটে।
৮। ভীম-যুধিষ্ঠিরের বাদানুবাদ-ব্যাসের উপদেশ
ভীম অসহিষ্ণু ও ক্রুদ্ধ হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ধর্ম অর্থ ও কাম ত্যাগ করে কেন আমরা তপোবনে বাস করব? উচ্ছিষ্টভোজী শৃগাল যেমন সিংহের কাছ থেকে মাংস হরণ করে সেইরূপ দুর্যোধন আমাদের রাজ্য হরণ করেছে। রাজা, আপনি প্রতিজ্ঞা পালন করছেন, অল্প একটু ধর্মের জন্য রাজ্য বিসর্জন দিয়ে দুঃখ ভোগ করছেন। আমরা আপনার শাসন মেনে নিয়ে বন্ধুদের দুঃখিত এবং শত্রুদের আনন্দিত করছি। ধার্তরাষ্ট্রগণকে বধ করিনি এই অন্যায় কার্যের জন্য আমরা দুঃখ পাচ্ছি। সর্বদা ধর্ম ধর্ম করে আপনি কি ক্লীবের দশা পান নি? যাতে নিজের ও মিত্রবর্গের দুঃখ উৎপন্ন হয় তা ধর্ম নয়, ব্যসন ও কুপথ। যেমন মেঘের কারণ সমুদ্র আবার সমুদ্রের কারণ মেঘ, সেইরূপ ধর্মের কারণ অর্থ, অর্থের কারণ ধর্ম।–
দ্রব্যাস্পর্শসংযোগে যা প্রীতিবুপজায়তে।
স কামশ্চিত্তসংকল্পঃ শরীরং নাসা দৃশ্যতে।।
ইন্দ্রিয়াণাঞ্চ পঞ্চানাং মনসো হৃদয়স্য চ।
বিষয়ে বর্তমানানাং যা বুদ্ধিঃ কর্মশাং ফলমুত্তমম্।
এবমেব পৃথগ্ দৃষ্ট্বা ধর্মার্থৌ কামমেব চ।।
ন ধর্মপর এব স্যান্ন চার্থপরমো নরঃ।
ন কামপরমো বা স্যাৎ সর্বান্ সেবেত সর্বদা।।
– দ্রব্য ও অর্থের উপভোগে যে প্রীতি জন্মায় তারই নাম কাম, তা কেবল চিত্তের সংকল্প, তার শরীর দেখা যায় না। পঞ্চ ইন্দ্রিয় মন ও হৃদয় বিষয়ভোগে রত হলে যে প্রীতি জন্মায় তারই নাম কাম, আমার মতে তাই হচ্ছে কর্মের শ্রেষ্ঠ ফল। অতএব মানুষ ধর্ম অর্থ কাম পৃথগভাবে দেখবে, কেবল ধর্মপরায়ণ বা কেবল অর্থপরায়ণ বা কেবল কামপরায়ণ হবে না, সর্বদা সমভাবে তিনটির অনুশীলন করবে।
তারপর ভীম বললেন, শাস্ত্রকাররা বলেছেন, পূর্বাহ্নে ধর্মের, মধ্যাহ্নে অর্থের এবং সায়াহ্নে কামের চর্চা করবে। আরও বলেছেন, প্রথম বয়সে কামের, মধ্য বয়সে অর্থের, এবং শেষ বয়সে ধর্মের আচরণ করবে। ষাঁরা মুক্তি চান তাদের পক্ষেই ধর্ম-অর্থ-কাম বর্জন করা বিধেয়, গৃহবাসীর পক্ষে এই ত্রিবর্গের সেবাই শ্রেয়। মহারাজ, আপনি হয় সন্ন্যাস নিন না হয় ধর্ম-অর্থ-কামের চর্চা করুন, এই দুইএর মধ্যবর্তী অবস্থা আতুরের জীবনের ন্যায় দুঃখময়। জগতের মূল ধর্ম ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নেই, কিন্তু বহু অর্থ থাকলেই ধর্মকার্য করা যায়। ক্ষত্রিয়ের পক্ষে বল আর উৎসাহই ধর্ম, ভিক্ষা বা বৈশ্য-শুদ্রের বৃত্তি বিহিত নয়। আপনি ক্ষত্রিয়োচিত দৃঢ়হৃদয়ে শৈথিল্য ত্যাগ করে বিক্রম প্রকাশ করুন, ধুরন্ধরের ন্যায় ভার বহন করুন। কেবল ধর্মাত্মা হলে কোনও রাজাই রাজ্য ধন ও লক্ষ্মী লাভ করতে পারেন না। বলবানরা কপটতার দ্বারা শক্র জয় করেন, আপনিও তাই করুন। কৃষক যেমন অল্প পরিমাণ বীজের পরিবর্তে বহু শস্য পায়, বুদ্ধিমান সেইরূপ অল্প ধর্ম বিসর্জন দিয়ে বৃহৎ ধর্ম লাভ করেন। আমরা যদি কৃষ্ণ প্রভৃতি মিত্রগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুদ্ধ করি তবে অবশ্যই রাজ্য উদ্ধার করতে পারব।
যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি আমাকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করছ তার জন্য তোমার দোষ দিতে পারি না, আমার অন্যায় কর্মের ফলেই তোমাদের বিপদ হয়েছে। আমি দুর্যোধনের রাজ্য জয় করবার ইচ্ছায় দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হয়েছিলাম, কিন্তু আমার সরলতার সুযোগে ধূর্ত শকুনি শঠতার দ্বারা আমাকে পরাস্ত করেছিল। দুর্যোধন আমাদের দাস করেছিল, দ্রৌপদীই তা থেকে আমাদের উদ্ধার করেছেন। দ্বিতীয়বার দ্যূতক্রীড়ায় যে পণ নির্ধারিত হয়েছিল তা আমি মেনে নিয়েছিলাম, সেই প্রতিজ্ঞা, এখন লঙ্ঘন করতে পারি না৷ তুমি দ্যূতসভায় আমার বাহু দগ্ধ করতে চেয়েছিলে,
অর্জুন তোমাকে নিরস্ত করেন। সেই সময়ে তুমি তোমার লৌহগদা পরিষ্কার করছিলে, তখনই কেন তা প্রয়োগ করলে না? আমার প্রতিজ্ঞার সময়ে কেন আমাকে বাধা দিলে না? উপযুক্ত কালে কিছু না করে এখন আমাকে ভর্ৎসনা করে লাভ কি? লোকে বীজারোপণ করে যেমন ফলের প্রতীক্ষা করে, তুমিও সেইরূপ ভবিষ্যৎ সুখোদয়ের প্রতীক্ষায় থাক।
ভীম বললেন, মহারাজ, যদি তের বৎসর প্রতীক্ষা করতে হয় তবে তার মধ্যেই আমাদের আয়ু শেষ হবে। শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতমূর্খের ন্যায় আপনআর বুদ্ধি শাস্ত্রের অনুসরণ করে নষ্ট হয়ে গেছে। আপনি ব্রাহ্মণের ন্যায় দয়ালু হয়ে পড়েছেন,ক্ষত্রিয়কুলে কেন আপনি জন্মেছেন? আমরা তের মাস বনে বাস করেছি, ভেবে দেখুন তের বৎসর কত বৃহৎ। মনীষীরা বলেন, সোমলতার প্রতিনিধি যেমন পূতিকা (পুই শাক), সেইরূপ বৎসরের প্রতিনিধি মাস। আপনি তের মাসকেই তের বৎসর গণ্য করুন। যদি এইরূপ গণনা অন্যায় মনে করেন তবে একটা সাধুস্বভাব ষণ্ডকে প্রচুর আহার দিয়ে তৃপ্ত করুন, তাতেহ পাপমুক্ত হবেন।
যুধিষ্ঠর বললেন, উত্তমরূপে মন্ত্রণা আর বিচার করে যদি বিক্রম প্রয়োগ করা হয় তবেই সিদ্ধিলাভ হয়, দৈবও তাতে অনুকূল হন। কেবল বলদর্পে চঞ্চল হয়ে কর্ম আরম্ভ করা উচিত নয় দুর্যোধন ও তার ভ্রাতারা দুর্ধর্ষ এবং অস্ত্রপ্রয়োগে সুশিক্ষিত। আমরা দিগবিজয়কালে যেসকল রাজাদের উৎগীড়িত করেছি তারা সকলেই কৌরবপক্ষে আছেন।ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ পক্ষপাতহীন, কিন্তু অন্নদাতা ধৃতরাষ্ট্রের ঋণ শোধ করবার জন্য তাঁরা প্রাণ বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত হবেন। কোপনস্বভাব সর্বাস্ত্রবিশারদ অজেয় অভেদ্যূকবচধারী কর্ণও আমাদের উপর বিদ্বেষ-যুক্ত। এই সকল পুরুষশ্রেষ্ঠকে বধ না করে তুমি দুর্যোধনকে বধ করতে পারবে না।
যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে ভীমসেন বিষপ্ন হয়ে চুপ করে রইলেন। এমন সময় মহাযোগী ব্যাস সেখানে উপস্থিত হলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে অন্তরালে নিয়ে গিয়ে বললেন, ভরতসত্তম, তোমাকে আমি প্রতিস্মৃতি নামে বিদ্যা দিচ্ছি, তার প্রভাবে অর্জুন কার্যসিদ্ধি করবে। অস্ত্রলাভ করবার জন্য সে ইন্দ্র রুদ্র বরুণ কুবের ও যমের নিকট যাক। তোমরাও এই বন ত্যাগ করে অন্য বনে যাও, এক স্থানে দীর্ঘকাল থাকা তপত্বীদের উদ্বেগজনক, তাতে উদ্ভিদ-মৃগাদিরও ক্ষয় হয়। এই বলে ব্যাস অন্তর্হিত হলেন। যুধিষ্ঠির প্রতিস্মৃতি মন্ত্র লাভ করে অমাত্য ও অনুচরদের সঙ্গে কাম্যকবনে গিয়ে বাস করতে লাগলেন।
৯। অর্জুনের দিব্যাস্ত্রসংগ্রহে গমন
কিছুকাল পরে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন, ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ ও অশ্বখামা-এঁরা সমগ্র ধনুর্বেদে বিশারদ, দুর্যোধন এঁদের সম্মানিত ও সন্তষ্ট করেছে। সমস্ত পৃথিবীই এখন তার বশে এসেছে। তুমি আমাদের প্রিয়, তোমার উপরেই আমরা নির্ভর করি। বৎস, আমি ব্যাসদেবের নিকট একটি মন্ত্রলাভ করেছি, তুমি তা শিখে নিয়ে উত্তর দিকে গিয়ে কঠোর তপস্যা কর। সমস্ত দিব্যাস্ত্র ইন্দ্রের কাছে আছে, তুমি তাঁর শরণাপন্ন হয়ে সেই সকল অস্ত্র লাভ কর।
স্বস্ত্যয়নের পর অর্জুন সশস্ত্র হয়ে যাত্রার উদযোগ করলেন। দ্রৌপদী তাঁকে বললেন, পার্থ, আমাদের সুখ দুঃখ জীবন মরণ রাজ্য ঐশ্চর্য সবই তোমার উপর নির্ভর করছে। তোমার মঙ্গল হ’ক, বলবানদের সঙ্গে তুমি বিরোধ ক’রো না।জয়লাভের জন্য যাত্রা কর, ধাতা ও বিধাতা তোমাকে কুশলে নীরোগে রাখুন।
অর্জুন হিমালয় ও গন্ধমাদন পার হয়ে ইন্দ্রকীল পর্বতে উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি আকাশবাণী শুনলেন-তিষ্ঠ। অর্জুন দেখলেন, পি্গলবর্ণ কৃশকায় জটাধারী এক তপস্থী বৃক্ষমূলে বসে আছেন। তিনি বললেন, বৎস, তুমি কে? অস্ত্রধারী হয়ে কেন এখানে এসেছ? এই শান্ত তপোবনে অস্ত্রের প্রয়োজন নেই, তুমি ধনু ত্যাগ কর, তপস্যার প্রভাবে তুমি পরমগতি পেয়েছ। অর্জুনকে অবিচলিত দেখে তপস্বী সহাস্যে বললেন, আমি ইন্দ্র, তোমার মঙ্গল হ’ক, তুমি অভীষ্ট স্বর্গ প্রার্থনা কর।অর্জুন কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, ভগবান, আমাকে সর্ববিধ অস্ত্র দান করুন, আর কিছুই আমি চাই না। যদি আমার ভ্রাতাদের বনে ফেলে রাখি এবং শক্রর উপর প্রতিশোধ নিতে না পারি তবে আমার অকীর্তি সর্বত্র চিরস্থায়ী হবে। তখন ইন্দ্র বললেন, বৎস, তুমি যখন ভূতনাথ ত্রিলোচন শূলধর শিবের দর্শন পাবে তখন সমস্ত দিব্য অস্ত্র তোমাকে দেব। এই বলে ইন্দ্র অদৃশ্য হলেন।
॥ কৈরাতপর্বাধ্যায় ॥
১০। কিরাতবেশী মহাদেব-অর্জুনের দিব্যাস্ত্র লাভ
অর্জুন এক ঘোর বনে উপস্থিত হয়ে আকাশে শঙ্খ ও পটহের ধ্বনি শুনতে পেলেন। তিনি সেখানে কঠোর তপস্যায় নিরত হলে মহর্ষিগণ মহাদেবকে জানালেন। মহাদেব কাঞ্চনতরুর ন্যায় উজ্জ্বল কিরাতের বেশ ধারণ করে পিনাকহস্তে দর্শন দিলেন। অনুরূপ বেশে দেবী উমা, তার সহচরীবৃন্দ এবং ভূতগণও অনুগমন করলেন। ক্ষণমধ্যে সমস্ত বন নিঃশব্দ হল , প্রস্রবণের নিনাদ ও পক্ষিরবও থেমে গেল। সেই সময়ে মূক নামে এক দানব বরাহের রূপে অর্জুনের দিকে ধাবিত হল। অর্জুন শরাঘাত করতে গেলে কিরাতবেশী মহাদেব বললেন, এই নীলমেঘবর্ণ বরাহকে মারবার ইচ্ছা আমিই আগে করেছি। অর্জুন বারণ শুনলেন না, তিনি ও কিরাত এককালেই শরমোচন করলেন, দুই শর একসঙ্গে বরাহের দেহে বিদ্ধ হল। মূক দানব ভীষণ রূপ ধারণ করে ম’রে গেল। অর্জুন কিরাতকে সহাস্যে বললেন, কে তুমি কনককান্তি? এই বনে স্ত্রীদের নিয়ে বিচরণ করছ কেন? আমার বরাহকে কেন তুমি শরবিদ্ধ করলে? পর্বতবাসী, তুমি মৃগয়ার নিয়ম লঙ্ঘন করেছ সেজন্য তোমাকে বধ করব। কিরাত হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, বীর, আমরা এই বনেই থাকি তুমি ভয় পেয়ো না। এই জনহীন দেশে কেন এসেছ? অর্জুন বললেন, মন্দবুদ্ধি তুমি বলদর্পে নিজের দোষ মানছ না, আমার হাতে তোমার নিস্তার নেই।
অর্জুন শরবর্ষণ করতে লাগলেন, পিনাকপাণি কিরাতরূপী শংকর অক্ষত শরীরে পর্বতের ন্যায় অচল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে অর্জুন বললেন, সাধু সাধু। তার অক্ষয় তূণীরের সমস্ত বাণ নিঃশেষ হল , তিনি ধনুর্গুণ দিয়ে কিরাতকে
আকর্ষণ করে মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগলেন, কিরাত ধনু কেড়ে নিলেন। অর্জুন তাঁর মস্তকে খড়্গাঘাত করলেন, খড়্গ লাফিয়ে উঠল। অর্জুন বৃক্ষ আর শিলা দিয়ে যুদ্ধ করতে গেলেন, তাও বৃথা হল। তখন দুজনে ঘোর মুষ্টিযুদ্ধ হ’তে লাগল। কিরাতের বাহুপাশে আবদ্ধ হয়ে অর্জুনের শ্বাসরোধ হল , তিনি নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে চৈতন্য পেয়ে তিনি মহাদেবের মৃন্ময় মূর্তি গড়ে পূজা করতে লাগলেন। তিনি দেখলেন, তার নিবেদিত মাল্য কিরাতের মস্তকে লগ্ন হচ্ছে। তখন তিনি কিরাতরূপী মহাদেবের চরণে পতিত হয়ে স্তব করতে লাগলেন।
মহাদেব প্রীত হয়ে অর্জুনকে আলিঙ্গন করে বললেন, পার্থ, তুমি পূর্বজন্মে বদরিকাশ্রমে নারায়ণের সহচর নর হয়ে অযুত বৎসর তপস্যা করেছিলে, তোমরা নিজ তেজে জগৎ রক্ষা করছ। তুমি অভীষ্ট বর চাও। অর্জুন বললেন, বৃষধ্বজ, ব্রহ্মশির নামে আপনার যে পাশুপত অস্ত্র আছে তাই আমাকে দিন, কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধকালে আমি তা প্রয়োগ করব। মহাদেব মূর্তিমান কৃতান্তের তুল্য সেই অস্ত্র অর্জুনকে দান করে তার প্রয়োগ ও প্রত্যাহারের বিধি শিখিয়ে দিলেন। তার পর অর্জুনের অঙ্গ স্পর্শ করে সকল ব্যথা দূর করে বললেন, এখন তুমি স্বর্গে যাও। এই বলে তিনি উমার সঙ্গে প্রস্থান করলেন।
তখন বরুণ কুবের যম এবং ইন্দ্রাণীর সঙ্গে ইন্দ্র অর্জুনের নিকট আবির্ভূত হলেন। যম তাঁর দণ্ড, বরুণ তাঁর পাশ, এবং কুবের অন্তর্ধান নামক অস্ত্র দান করলেন। ইন্দ্র বললেন, কৌন্তেয়, তোমাকে মহৎ কার্যের জন্য দেবলোকে যেতে হবে সেখানেই তোমাকে দিব্যাস্ত্রসমূহ দান করব। তার পর দেবতারা চ’লে গেলেন।
॥ ইন্দ্রলোকাভিগমনপর্বাধ্যায় ॥
১১। ইন্দ্রলোকে অর্জুন-উর্বশীর অভিসার
আকাশ আলোকিত ও মেঘ বিদীর্ণ করে গম্ভীরনাদে মাতলিচালিত ইন্দ্রের রথ অর্জুনের সম্মুখে উপস্থিত হল। সেই রথের মধ্যে অসি শক্তি গদা প্রাস বিদ্যুৎ বজ, চক্রযুক্ত মেঘধ্বনির ন্যায় শব্দকারী বায়ুবিস্ফোরক গোলক-ক্ষেপণাস্ত্র (১), মহাকায় জ্বলিতমুখ সর্প, এবং রাশীকৃত বৃহৎ শিলা ছিল। বায়ুগতি দশ সহস্র অশ্ব সেই মায়াময় দিব্য রথ বহন করে। মাতলি বললেন, ইন্দ্রপুত্র, রথে ওঠ, দেবরাজ ও অন্য দেবগণ তোমাকে দেখবার জন্য প্রতীক্ষা করছেন। অর্জুন বললেন, সাধু মাতলি, তুমি আগে রথে ওঠ, অশ্বসকল স্থির হ’ক, তার পর আমি উঠব। অর্জুন গঙ্গায় স্নান করে পবিত্র হয়ে মন্ত্রজপ ও পিতৃতর্পণ করলেন, তার পর শৈলরাজ হিমালয়ের স্তব করে রথে উঠলেন। সেই আশ্চর্য রথ আকাশে উঠে মানুষের অদৃশ্য লোকে এল, যেখানে চন্দ্র সূর্য বা অগ্নির আলোক নেই। পৃথিবী থেকে যে দ্যুতিমান তারকাসমূহ দেখা যায় সেসকল অতিবৃহৎ হলেও দূরত্বের জন্য দীপের ন্যায় ক্ষুদ্র বোধ হয়। অর্জুন সেইসকল তারকাকে স্বস্থানে স্বতেজে দীপ্তিমান দেখলেন। মাতলি বললেন, পার্থ, ভূতল থেকে যাঁদের তারকারূপে দেখেছ সেই পুণ্যবানরা এখানে স্বস্থানে অবস্থান করছেন।
অর্জুন অমরাবতীতে এলে দেব গন্ধর্ব সিদ্ধ ও মহর্ষিগণ হৃষ্ট হয়ে তার সংবর্ধনা করলেন। তিনি নতমস্তকে প্রণাম করলে ইন্দ্র তাঁকে কোলে নিয়ে নিজের সিংহাসনে বসালেন। তুম্বুরু প্রভৃতি গন্ধর্বগণ গাইতে লাগলেন, ঘৃতাচী মেনকা রম্ভা উর্বশী প্রভৃতি হাবভাবময়ী মনোহারিণী অপ্সরারা নাচতে লাগলেন। তার পর দেবগণ পাদ্য অর্ঘ্য ও আচমনীয় দিয়ে অর্জুনকে ইন্দ্রের ভবনে নিয়ে গেলেন।
ইন্দ্রের নিকট নানাবিধ অস্ত্র শিক্ষা করে অর্জুন অমরাবতীতে পাঁচ বৎসর সুখে বাস করলেন। তিনি ইন্দ্রের আদেশে গন্ধর্ব চিত্রসেনের কাছে নৃত্য-গীত-বাদ্যও শিখলেন। একদিন চিত্রসেন উর্বশীর কাছে গিয়ে বললেন, কল্যাণী, দেবরাজের আদেশে তোমাকে জানাচ্ছি যে অর্জুন তোমার প্রতি আসক্ত হয়েছেন, তিনি আজ তোমার চরণে আশ্রয় নেবেন। উর্বশী নিজেকে সম্মানিত জ্ঞান করে স্মিতমুখে বললেন, আমিও তাঁর প্রতি অনুরক্ত। সখা, তুমি যাও, আমি অর্জুনের সঙ্গে মিলিত হব।
উর্বশী স্নান করে মনোহর অলংকার ও গন্ধমাল্য ধারণ করলেন এবং সন্ধ্যাকালে চন্দ্রোদয় হলে অর্জুনের ভবনে যাত্রা করলেন।-
মৃদুকঞ্চিতদীর্ঘেণ কুসুমোৎকণধাবিণা।
কেশহস্তেন ললনা জগামাথ বিবাজতী।।
ভ্রূক্ষেপালাপমাধুর্যৈঃ কান্তা সৌম্যতপাপি চ।
শশিনং বক্ত্রচন্দ্রেণ সাহ্বযন্তীব গচ্ছতী।।
দিব্যাঙ্গরাগৌ সুমুখৌ দিবাচন্দনভূষিতৌ।
গচ্ছন্ত্যা হাররুচিবৌ স্তনৌ তস্যা ববলগতুঃ।।
সীধুপানেন চাল্পেন তুষ্ট্যাথ মদনেন চ।
বিলাসনৈশ্চ বিবিধৈঃ প্রেক্ষণীযতভাবৎ।।
-তাঁর কোমল কুঞ্চিত দীর্ঘ কেশপাশ, কুসুমস্তবকে ভূষিত, ভ্রূভঙ্গী স্বরূপ মধুর আলাপ, রমনীয় কান্তি, মুখচন্দ্র দ্বারা যেন গগনের চন্দ্রকে আহ্বান করে চ’লেছেন, দিব্য অঙ্গরাগ, চন্দন ও হারে বিভূষিত তাঁর সুমুখ স্তনযুগল পাদক্ষেপে লম্ফিত হ’তে লাগল। অল্প মদ্যপান, কামাবেশ ও বিলাসবিভ্রমের জন্য তিনি অতিশয় দর্শনীয়া হলেন।
দ্বারপালের মুখে উর্বশীর আগমনসংবাদ পেয়ে অর্জুন শঙ্কিতমনে এগিয়ে এলেন এবং লজ্জায়য় চক্ষু আবৃত করে সসম্মানে বললেন, দেবী নতমস্তকে অভিবাদন করছি, বলুন কি করতে হবে, আমি আপনার আজ্ঞাবহ ভৃত্য। অর্জুনের কথা শুনে উর্বশীর যেন চৈতন্যলোপ হল। তিনি বললেন, নরশ্রেষ্ঠ, চিত্রসেন আমাকে যা বলেছেন শোন। তোমার আগমনের জন্য ইন্দ্র যে আনন্দোৎসবের অনুষ্ঠান করেছিলেন তাতে দেবতা মহর্ষি রাজর্ষি প্রভৃতির সমক্ষে গন্ধর্বগণ বীণা বাজিয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ অপ্সরারা নৃত্য করেছিলেন। পার্থ, সেই সময়ে তুমি নাকি অনিমেষনয়নে শুধু আমাকেই দেখেছিলে। সভাভঙ্গের পর তোমার পিতা ইন্দ্র চিত্ররথকে দিয়ে আমাকে আদেশ জানালেন, আমি যেন তোমার সঙ্গে মিলিত হই। এই কারণেই আমি তোমার সেবা করতে এসেছি। তুমি আমার চিরাভিলষিত, তোমার ণ্ডণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে আমি অনঙ্গের বশবর্তিনী হয়েছি।
লজ্জায় কান ঢেকে অর্জুন বললেন, ভাগ্যবতী, আপনার কথা আমার শ্রবণযোগ্য নয়, কু্ন্তী ও সতীর ন্যায় আপনি আমার ণ্ডরুপত্নীতুল্য। আপনি পুরুবংশের জননী (২), ণ্ডরুর অপেক্ষাও ণ্ডরুতরা। সেজন্যই উৎফুল্পনয়নে আপনাকে দেখেছিলাম।উর্বশী বললেন, দেবরাজপুত্র, আমাকে ণ্ডরুস্থানীয়া মনে করা অনুচিত, অপ্সরারা নিয়মাধীন নয়। পুরুবংশের পুত্র বা পৌত্র যে কেউ স্বর্গে এলে আমাদের সঙ্গে সহবাস করেন। তুমি আমার বাঞ্ছা পূর্ণ কর। অর্জুন বললেন, বরবর্ণিনী, আমি আপনার চরণে মস্তক রাখছি, আপনি আমার মাতৃবৎ পূজনীয়া, আমি আপনার পুত্রবৎ রক্ষণীয়। উর্বশী ক্রোধে অভিভূত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভ্রূকুটি করে বললেন, পার্থ, আমি তোমার পিতার অনুজ্ঞায় স্বয়ং তোমার গৃহে কামার্তা হয়ে এসেছি তথাপি তুমি আদর করলে না; তুমি সম্মানহীন নপৃংসক নর্তক হয়ে স্ত্রীদের মধ্যে বিচরণ করবে।এই বলে উর্বশী স্বগৃহে চ’লে গেলেন।
উর্বশী শাপ দিয়েছেন শুনে ইন্দ্র স্মিতমুখে অর্জুনকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বৎস, তোমার জন্য কুন্তী আজ সুপুত্রবতী হলেন, তুমি ধৈর্ষে ঋষিগণকেও পরাজিত করেছ। উর্বশীর অভিশাপ তোমার কাজে লাগবে, অজ্ঞাতবাসকালে তুমি এক বৎসর নপুংসক নর্তক হয়ে থাকবে, তারপর আবার পুরুষত্ব পাবে।
অর্জুন নিশ্চিন্ত হয়ে চিত্রসেন গন্ধর্বের সংসর্গে সুখে স্বর্গবাস করাতে লাগলেন।
পাণ্ডুপুত্র অর্জুনের এই পবিত্র চরিতকথা যে নিত্য শোনে ভার পাপজনক, কামক্রিয়ার প্রবৃত্তি হয় না, সে মত্ততা দম্ভ ও রাগ পরিহার করে স্বর্গলোকে সুখভোগ করে।
**
(১) ‘চক্রযুক্তাস্তুণ্ডড়াঃ বায়ুস্ফোটাঃ সনির্ঘাতা মহামেঘস্বনাঃ।” নীলকণ্ঠ কামান অর্থ করেছেন। স্পষ্টত প্রক্ষিপ্ত।
(২) পুরূরবার ঔরসে উর্বশীর গর্ভে আয়ু জন্মগ্রহণ করেন, তাঁর প্রপৌত্র পুরু।
॥ নলোপাখ্যানপর্বাধ্যায়॥
১২। ভীমের অধৈর্য-মহর্ষি বৃহদশ্ব
একদিন পাণ্ডবরা দ্রৌপদীর সঙ্গে দুঃখিতমনে কাম্যকবনে উপবিষ্ট ছিলেন। ভীম যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, আমাদের পৌরুষ আছে, বলবানদের সাহায্য নিয়ে আমরা আরও বলশালী হ’তে পারি, কিন্তু আপনার, দ্যূতদোষের জন্য সকলে কষ্ট পাচ্ছি। রাজ্যশাসনই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, বনবাস নয়। আমরা অর্জুনকে ফিরিয়ে এনে এবং জনার্দন কৃষ্ণের সহায়তায় বার বৎসরের পূর্বেই ধার্তরাষ্ট্রদের বধ করব। শত্রুরা দুর হলে আপনি বন থেকে ফিরে যাবেন, তা হলে আপনার দোষ হবে না। তার পর আমরা অনেক যজ্ঞ করে পাপমুক্ত হয়ে উত্তম স্বর্গে যাব। রাজা, এইরূপই হ’তে পারে যদি আপনি নির্বুদ্ধিতা দীর্ঘসূত্রতা আর ধর্মপরায়ণতা ত্যাগ করেন। শঠতার দ্বারা শঠকে বধ করা পাপ নয়। ধর্মজ্ঞ লোকের বিচারে দুঃসহ দুঃখের কালে এক অহোরাত্রই এক বৎসরের সমান গণ্য হয়, এইরূপ বেদবচনও শোনা যায়। অতএব আমাদের তের দিনেই তের বৎসর পূর্ণ হয়েছে, দুর্যোধনাদিকে বধ করবার সময় এসেছে। দুর্যোধনের চর সর্বত্র আছে, অজ্ঞাত-বাসকালেও সে আমাদের সন্ধান পেয়ে আবার বনবাসে পাঠাবে। যদি অজ্ঞাতবাস থেকে উত্তীর্ণ হই তবে সে আবার আপনাকে দ্যূতক্রীড়ায় ডাকবে। আপনার নিপুণতা নেই, খেলতে খেলতে জনশুন্য হয়ে পড়েন, সেজন্য আবার আপনি হারবেন।
যুধিষ্ঠির ভীমকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, মহাবাহু, তের বৎসর উত্তীর্ণ হলে তুমি আর অর্জুন নিশ্চয় দুর্যোধনকে বধ করবে। তুমি বলছ, সময় এসেছে, কিন্তু আমি মিথ্যা বলতে পারব না। শঠতা না করেও তুমি শক্রবধ করবে।
এমন সময় মহর্ষি বৃহদশ্ব সেখানে এলেন। যুধিষ্ঠির যথাশাস্ত্র মধুপর্ক দিয়ে তাঁকে পূজা করলেন। বৃহদশ্ব বিশ্রামের পর উপবিষ্ট হলে যুধিষ্ঠির তাঁকে বললেন, ভগবান, ধূর্ত দ্যূতকারগণ আমার রাজ্য ও ধন শঠতার দ্বারা হরণ করেছে। আমি সরলস্বভাব, অক্ষনিপুণ নই। তারা আমার প্রিয়তমা ভার্যাকে দ্যূতসভায় নিয়ে গিয়েছিল, তার পর দ্বিতীয়বার দ্যূতে জয়লাভ করে আমাদের বনে পাঠিয়েছে। দ্যূতসভায় তারা যে দারুণ কটূবাক্য বলেছে এবং আমার দুঃখার্ত সুহৃদগণ যা বলেছিলেন তা আমার হৃদয়ে নিহিত আছে, সমস্ত রাত্রি আমি সেইসকল কথা চিন্তা করি। অর্জনের বিরহেও আমি যেন প্রাণহীন হয়ে আছি। আমার চেয়ে মন্দভাগ্য ও দুঃখার্ত কোনও রাজাকে আপনি জানেন কি?
মহর্ষি বৃহদশ্ব বললেন, যদি শুনতে চাও তবে এক রাজার কথা বলব যিনি তোমার চেয়েও দুঃখী ছিলেন। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে বৃহদশ্ব নল রাজার এই উপাখ্যান বললেন।-
১৩। নিষধরাজ নল-দময়ন্তীর স্বয়ংবর
নিষধ দেশে নল নামে এক বলশালী সদগুণান্বিত রূপবান অশ্বতত্ত্বজ্ঞ রাজা ছিলেন। তিনি বীরসেনের পুত্র,ব্রাহ্মণপালক, বেদজ্ঞ, দ্যূতপ্রিয়, সত্যবাদী, এবং বৃহৎ অক্ষৌহিণী সেনার অধিপতি। তাঁর সমকালে বিদর্ভ দেশে ভীম নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ও তীর মহিষী ব্রহ্মর্ষি দমনকে সেবায় তুষ্ট করে একটি কন্যা ও তিনটি পুত্র লাভ করেন। কন্যার নাম দময়ন্তী, তিন পুত্রের নাম দম, দান্ত ও দমন। দময়ন্তীর ন্যায় সুন্দরী মনুষ্যলোকে কেউ ছিল না, দেবতারাও তাকে দেখে আনন্দিত হ’তেন।
লোকে নল ও দময়ন্তীর নিকট পরস্পরের রূপণ্ডণের প্রশংসা করত, তার ফলে দেখা না হলেও তাঁরা পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত হলেন। একদিন নল নির্জন উদ্যানে বেড়াতে বেড়াতে কতকণ্ডলি কনকবর্ণ হংস দেখতে পেলেন। তিনি একটিকে ধরলে সে বললে, রাজা, আমাকে মারবেন না, আমি আপনার প্রিয়কার্য করব, দময়ন্তীর কাছে গিয়ে আপনার সম্বন্ধে এমন করে বলব যে তিনি অন্য পুরুষ কামনা করবেন না। নলের কাছে মুক্তি পেয়ে সেই হংস তার সহচরদের সঙ্গে বিদর্ভ দেশে দময়ন্তীর নিকট উপস্থিত হল। রাজকন্যা ও তার সখীরা সেই সকল আশ্চর্য হংস দেখে হৃষ্ট হয়ে তাদের ধরবার চেষ্টা করলেন। দময়ন্তী যাকে ধরতে গেলেন সেই হংস মানুষের ভাষায় বললে, নিষধরাজ নল মূর্তিমান কন্দর্পের ন্যায় রূপবান, তাঁর সমান আর কেউ নেই। আপনি যেমন নারীরত্ন, নলও সেইরূপ পুরুষশ্রেষ্ঠ, উত্তমার সঙ্গে উত্তমের মিলন অতিশয় শুভকর হবে। দময়ন্তী উত্তর দিলেন, তুমি নলের কাছে গিয়ে তাঁকেও এই কথা বলো। তখন হংস নিষধরাজ্যে গিয়ে নলকে সকল কথা জানালে।
দময়ন্তী চিন্তাগ্রস্ত বিবর্ণ ও কৃশ হ’তে লাগলেন। সখীদের মুখে কন্যার অসুস্থতার সংবাদ শুনে বিদর্ভরাজ ভীম ভাবলেন, কন্যা যৌবনলাভ করেছে, এখন তার স্বয়ংবর হওয়া উচিত। রাজা স্বয়ংবরের আয়োজন করলেন, তঁর নিমন্ত্রণে বহু রাজা বিদর্ভ দেশে সমবেত হলেন।
এই সময়ে নারদ ও পর্বত দেবর্ষিদ্বয় দেবরাজ ইন্দ্রের নিকটে গেলেন। কুশলজিজ্ঞাসার পর ইন্দ্র বললেন, যে ধর্মজ্ঞ রাজারা সমরে পরাঙমুখ না হয়ে জীবন ত্যাগ করেন তাঁরা অক্ষয় স্বর্গলোক লাভ করেন। সেই ক্ষত্রিয় বীরগণ কোথায়? সেই প্রিয় অতিথিগণকে আর এখানে আসতে দেখি না কেন? নারদ বললেন, দেবরাজ, তার কারণ শুনুন।
-বিদর্ভরাজকন্যা দময়ন্তী তাঁর সৌন্দর্যে পৃথিবীর সমস্ত নারীকে অতিক্রম করেছেন, শীঘ্রই তার স্বয়ংবর হবে। সেই নারীরত্নকে পাবার আশায় সকল রাজা আর রাজপুত্র স্বয়ংবর সভায় যাচ্ছেন। এমন সময় অগ্নি প্রভৃতি লোকপালগণ ইন্দ্রের কাছে এলেন এবং নারদের কথা শুনে হৃষ্ট হয়ে সকলে বললেন, আমরাও যাব।
ইন্দ্র অগ্নি বরুণ ও যম তাদের বাহন ও অনুচর সহ বিদর্ভ দেশে যাত্রা করলেন। পথে তারা সাক্ষাৎ মন্মথতুল্য নলকে দেখে বিস্মিত হলেন, তাদের দময়ন্তীলাভের আশা দূর হল। দেবগণ তাঁদের বিমান আকাশে রেখে ভূতলে নেমে নলকে বললেন, নিষধরাজ, তুমি সত্যব্রত, দূত হয়ে আমাদের সাহায্য কর। নল কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, করব। আপনারা কে? আমাকে কার দৌত্য করতে হবে? ইন্দ্র বললেন, আমরা অমর, দময়ন্তীর জন্য এসেছি। তুমি গিয়ে তাঁকে বল যে দেবতারা তাঁকে চান, তিনি ইন্দ্র অগ্নি বরুণ ও যম এই চারজনের একজনকে বরণ করুন। নল বললেন, আমিও তাকে চাই, নিজেই যখন প্রার্থী তখন পরের জন্য কি করে বলব? দেবগণ, আমাকে ক্ষমা করুন। দেবতারা বললেন, তুমি করব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ, এখন তার অন্যথা করতে পার না, অতএব শীঘ্র যাও। নল বললেন, সুরক্ষিত অন্তঃপুরে আমি কি করে প্রবেশ করব? ইন্দ্র বললেন, তুমি প্রবেশ করতে পারবে।
সখীগণে পরিবেষ্টিত দময়ন্তীর কাছে নল উপস্থিত হলেন। দময়ন্তী স্মিতমুখে বললেন, সর্বসুন্দর, তুমি কে? আমার হৃদয় হরণ করতে কেন এখানে এসেছ? নল বললেন, কল্যাণী, আমি নল, ইন্দ্র অগ্নি বরুণ ও যম এই চার দেবতারা দূত হয়ে তোমার কাছে এসেছি, তাঁদের একজনকে পতিরূপে বরণ কর। দময়ন্তী বললেন, রাজা, আমি এবং আমার যা কিছু আছে সবই তোমার, তুমিই আমার প্রতি প্রণয়শীল হও। হংসদের কাছে সংবাদ পেয়ে তোমাকে পাবার জন্যই আমি স্বয়ংবরে রাজাদের আনিয়েছি। তুমি যদি আমাকে প্রত্যাখ্যান কর তবে বিষ অগ্নি জল বা রজ্জুর দ্বারা আত্মহত্যা করব। নল বললেন, দেবতারা থাকতে মানুষকে চাও কেন? আমি তাঁদের চরণধুলির তুল্যও নই, তাদের প্রতিই তোমার মন দেওয়া উচিত। দময়ন্তী অশ্রুপ্লাবিতরনয়নে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, দেবগণকে প্রণাম করি; মহারাজ, আমি তোমাকেই পতিত্বে বরণ করব। নল বললেন, কল্যাণী, আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে দেবগণের দূত রূপে এসেছি, এখন স্বার্থসাধন কি করে করব? দময়ন্তী বললেন, আমি নির্দোষ উপায় বলছি শোন। ইন্দ্রাদি লোকপালগণের সঙ্গে তুমিও স্বয়ংবর সভায় এস, আমি তাদের সন্মুখেই তোমাকে বরণ করব।
নল ফিরে এসে দেবগণকে বললেন, আমি আপনাদের বার্তা দময়ন্তীকে জানিয়েছি, কিন্ত তিনি আমাকেই বরণ করতে চান। তিনি আপনাদের সকলকে এবং আমাকেও স্বযংবরসভায় আসতে বলেছেন।
বিদর্ভরাজ ভীম শুভদিনে শুভক্ষণে স্বয়ংবরসভা আহ্বান করলেন। নানা দেশের রাজারা সুগন্ধ মাল্য ও মণিকুণ্ডলে ভূষিত হয়ে আসনে উপবিষ্ট হলেন। দময়ন্তী সভায় এলে তাঁর দেহেই রাজাদের দৃষ্টি লগ্ন হয়ে রইল, অন্যত্র গেল না। অনন্তর রাজাদের নামকীর্তন আরম্ভ হল। দময়ন্তী তখন দেখলেন, তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের আকৃতি একই প্রকার, প্রত্যেককেই নল বলে মনে হয়। দময়ন্তী ভাবতে লাগলেন, এঁদের মধ্যে কে দেবতা আর কে নল তা কোন্ উপায়ে বুঝব? বৃদ্ধদের কাছে দেবতার যেসব লক্ষণ শুনেছি তা এই পাঁচজনের মধ্যে কারও দেখছি না। তখন দময়ন্তী কৃতাঞ্জলি হয়ে দেবগণের উদ্দেশে নমস্কার করে বললেন, আমি হংসগণের বাক্য শুনে নিষধরাজকে পতিত্বে বরণ করেছি, আমার সেই সত্য যেন রক্ষা পায়। দেবগণ নলকে দেখিয়ে দিন, তাঁরা নিজরূপ ধারণ করুন যাতে আমি নলকে চিনতে পারি।
দময়ন্তীর করুণ প্রার্থনা শুনে এবং নলের প্রতি তার পরম অনুরাগ জেনে ইন্দ্রাদি চারজন লোকপাল তাদের দেবচিহ্ণ ধারণ করলেন।
সাপশ্যদ্ বিবুধান সর্বানস্বেদান্ স্তব্ধলোচনান.
হৃষিতস্রগবজোহীনান্ স্থিতানস্পৃশতঃ ক্ষিতিম্।।
ছায়াদ্বিতীয়ো ম্লানস্রগবজঃ স্বেদসমন্বিতঃ।
ভূমিষ্ঠৌ নৈষধশ্চৈব নিমেষেণ চ সূচিতঃ।।
-দময়ন্তী দেখলেন, দেবগণের গাত্র স্বেদশুন্য, চক্ষু অপলক। তাঁদের মাল্য অম্লান, অঙ্গ ধূলিশুন্য, ভূমি স্পর্শ না করেই তাঁরা বসে আছেন। কেবল একজনের ছায়া আছে, তাঁর মাল্য ম্লান দেহ স্বেদযুক্ত, চক্ষুতে পলক পড়ছে, এই দেখে দময়ন্তী বুঝলেন তিনিই নিষধরাজ নল।
তখন লজ্জমানা দময়ন্তী বসনপ্রান্ত ধারণ করে নলের স্কন্ধদেশে পরম শোভন মাল্য অর্পণ করলেন। রাজারা হা হা করে উঠলেন, দেবতা ও মহর্ষিগণ সাধু সাধু বললেন। নল হৃষ্টমনে দময়ন্তীকে বললেন, কল্যাণী, তুমি দেবগণের সন্নিধিতে মানুষকেই বরণ করলে, আমাকে তোমার ভর্তা ও আজ্ঞানুবর্তী বলে জেনো। সুহাসিনী, যত দিন দেহে প্রাণ থাকবে তত দিন আমি তোমারই অনুরক্ত থাকব।
দেবতারা হৃষ্ট হয়ে নলকে বর দিলেন। ইন্দ্র বললেন, যজ্ঞকালে তুমি আমাকে প্রত্যক্ষ দেখবে এবং দেহান্তে উত্তম গতি লাভ করবে। অগ্নি বললেন, তুমি যেখানে ইচ্ছা করবে সেখানেই আমার আবির্ভাব হবে এবং অন্তিমে তুমি প্রভাময় দিব্যলোকে যাবে। যম বললেন, তুমি যে খাদ্য পাক করবে তাই সুস্বাদু হবে, তুমি চিরকাল ধর্মপথে থাকবে। বরুণ বললেন, তুমি যেখানে জল চাইবে সেখানেই পাবে। দেবতারা সকলে মিলে নলকে উত্তম গন্ধমাল্য এবং যুগল সন্তান লাভের বর দিলেন।
বিবাহের পর কিছুকাল বিদর্ভ দেশে থেকে নল তাঁর পত্নীর সঙ্গে স্বরাজ্যে ফিরে গেলেন। তিনি অশ্বমেধাদি বিবিধ যজ্ঞ করলেন। যথাকালে দময়ন্তী একটি পুত্র ও একটি কন্যা প্রসব করলেন, তাদের নাম ইন্দ্রসেন ও ইন্দ্রসেনা।
১৪। কলির আক্রমণ-নল-পুষ্করের দ্যূতক্রীড়া
স্বয়ংবর থেকে ফেরবার পথে দেবতাদের সঙ্গে দ্বাপর আর কলির দেখা হল। কলি বললেন, দময়ন্তীর উপর আমার মন পড়েছে, তাকে স্বয়ংরে পাবার জন্য যাচ্ছি। ইন্দ্র হেসে বললেন, স্বয়ংবর হয়ে গেছে, আমাদের সমক্ষেই দময়ন্তী নল রাজাকে বরণ করেছেন। কলি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, দেবগণকে ত্যাগ কারে সে মানুষকে বরণ করেছে, এজন্য তার কঠোর দণ্ড হওয়া উচিত। ইন্দ্র বললেন, কলি, নলের ন্যায় সর্বগুণসম্পন্ন রাজাকে যে অভিশাপ দেয় সে নিজেই অভিশপ্ত হয়ে ঘোর নরকে পড়ে। দেবতারা চ’লে গেলে কলি দ্বাপরকে বললেন, আমি ক্রোধ সংবরণ করতে পারছি না, নলের দেহে অধিষ্ঠান করে তাকে রাজ্যভ্রষ্ট করব। তুমি আমাকে সাহায্য করবার জন্য অক্ষের (পাশার) মধ্যে প্রবেশ কর।
কলি নিষধরাজ্যে এসে নলের ছিদ্র অনুসন্ধান করতে লাগলেন। বার বৎসর পরে একদিন কলি দেখলেন, নল মূত্রত্যাগের পর পা না ধুয়ে শুধু আচমন করে সন্ধ্যা করছেন। সেই অবসরে কলি নলের দেহে প্রবেশ করলেন। তার পর তিনি নলের ভ্রাতা পুষ্করের কাছে গিয়ে বললেন, তুমি নলের সঙ্গে অক্ষক্রীড়া কর, আমার সাহায্যে নিষধরাজ্য জয় করতে পারবে। পুষ্কর সম্মত হয়ে নলের কাছে চললেন, কলি বৃষের রূপ ধারণ কারে পিছনে পিছনে গেলেন।
নল পুষ্করের আহান প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না, দ্যূতক্রীড়ায় প্রবৃত্ত হলেন এবং ক্রমে ক্রমে সুবর্ণ যানবাহন বসন প্রভৃতি বহুপ্রকার ধন হারলেন। রাজাকে অক্ষক্রীড়ায় মত্ত দেখে মন্ত্রী, পুরবাসিগণ ও দময়ন্তী তাকে নিবৃত্ত করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কলির আবেশে নল কোনও কথাই বললেন না। দময়ন্তী পুনর্বার নিজে গিয়ে এবং তাঁর ধাত্রী বৃহৎসেনাকে পাঠিয়ে রাজাকে প্রবুদ্ধ করবার চেষ্টা করলেন, কিন্ত কোনও ফল হল না। তখন দময়ন্তী সারথি বার্ষ্ণেয়কে ডেকে আনিয়ে বললেন, রাজা বিপদে পড়েছেন, তুমি তাকে সাহায্য কর। তিনি পুষ্করের কাছে যত হেরে যাচ্ছেন ততই তার খেলার আগ্রহ বাড়ছে। রাজা মোহগ্রস্ত হয়েছেন তাই সুহৃজ্জনের আর আমার কথা শুনছেন না। আমার মন ব্যাকুল হয়েছে, হয়তো তার রাজ্যনাশ হবে। তুমি রথে দ্রুতগামী অশ্ব যোজনা কর, আমার পুত্রকন্যাকে কুণ্ডিন নগরে তাদের মাতামহের কাছে নিয়ে যাও। সেখানে আমার দুই সন্তান, রথ ও অশ্ব রেখে তুমি সেখানেই থেকো অথবা যেখানে ইচ্ছা হয় যেয়ো। সারথি বার্ষ্ণেয় মন্ত্রীদের অনুমতি নিয়ে বিদর্ভ রাজধানীতে গেল এবং বালক-বালিকা, রথ ও অশ্ব সেখানে রেখে ভীম রাজার কাছে বিদায় নিলে। তার পর শোকার্ত হয়ে নানা স্থানে ভ্রমণ করতে করতে অযোধ্যায় গেল এবং সেখানে রাজা ঋতুপর্ণের সারথির কর্মে নিযুক্ত হল।
১৫। নল-দময়ন্তীর বিচ্ছেদ – দময়ন্তীর পর্যটন
নলের রাজ্য ও সমস্ত ধন অক্ষক্রীড়ায় জিতে নিয়ে পুষ্কর হেসে বললেন, আপনার সর্বস্ব আমি জয় করেছ্ কেবল দময়ন্তী অবশিষ্ট আছেন, যদি ভালো মনে করেন তবে এখন তাঁকেই পণ রাখুন।পুণ্যশ্লোক নলের মন দুঃখে বিদীর্ণ হল , তিনি কিছু না বলে তাঁর সকল অলংকার খুলে ফেললেন এবং বিপুল ঐশ্বর্য ত্যাগ করে একবস্ত্রে অনাবৃত দেহে রাজ্য থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। দময়ন্তীও একবস্ত্রে তাঁর সঙ্গে গেলেন।
পু্ষ্করের শাসনে কোনও লোক নল-দময়ন্তীর সমাদর করলে না। তারা কেবল জলপান করে নগরের উপকণ্ঠে ত্রিরাত্র বাস করলেন। ক্ষুধার্ত নল ঘুরতে ঘুরতে কতকগুলি পাখি দেখতে পেলেন, তাদের পালক স্বর্ণবর্ণ। নল ভাবলেন, এই পাখিগুলিই আজ আমাদের ভক্ষ্য হবে আর তাদের পক্ষই ধন হবে। তিনি তার পরিধানের বস্ত্র খুলে ফেলে পাখিদের উপর চাপা দিলেন। পাখিরা বস্ত্র নিয়ে আকাশে উঠে বললে, দুর্বুদ্ধি নল, যা নিয়ে দ্যূতক্রীড়া করেছিলে আমরাই সেই পাশা। তুমি সবস্ত্রে গেলে আমাদের প্রীতি হবে না। বিবস্ত্র নল দময়ন্তীকে বললেন, অনিন্দিতা, যাদের প্রকোপে আমি ঐশ্বর্যহীন হয়েছি, যাদের জন্য আমরা প্রাণযাত্রার উপযুক্ত খাদ্য আর নিষধবাসীর সাহায্য পাচ্ছি না তারাই পক্ষী হয়ে আমার বস্ত্র হরণ করেছে। আমি দুঃখে জ্ঞানহীন হয়েছি। আমি তোমার স্বামী, তোমার ভালর জন্য যা বলছি শোন।
-এখান থেকে কতকগুলি পথ অবন্তী ও ঋক্ষবান পর্বত পার হয়ে দক্ষিণাপথে গেছে। ওই বিন্ধ্য পর্বত, ওই পয়োষ্ণী নদী, ওখানে প্রচুর ফলমুল সমন্বিত ঋষিদের আশ্রম আছে। এই বিদর্ভ দেশের পথ, এই কোশল দেশের, ওই দক্ষিণাপথের। নল কাতর হয়ে এই সব কথা বার বার দময়ন্তীকে বললেন।
দময়ন্তী বললেন, তোমার অভিপ্রায় অনুমান করে আমার হৃদয় কাঁপছে, সর্বাঙ্গ অবসন্ন হচ্ছে। তোমাকে ত্যাগ করে আমি কি করে অন্যত্র যাব? ভিষকরা বলেন, সকল দুঃখে ভার্যার সমান ঔষধ নেই। নল বললেন, তুমি কেন আশঙ্কা করছ, আমি নিজেকে ত্যাগ করতে পারি কিন্তু তোমাকে পারি না। দময়ন্তী বললেন, মহারাজ, তবে বিদর্ভের পথ দেখাচ্ছ কেন? যদি আমার আত্মীয়দের কাছেই আমাকে পাঠাতে চাও তবে তুমিও চল না কেন? আমার পিতা বিদর্ভরাজ তোমাকে সসম্মানে আশ্রয় দেবেন, তুমি আমাদের গৃহে সুখে থাকতে পারবে। নল বলালেন, পূর্বে সেখানে সমৃদ্ধ অবস্থায় গিয়েছিলাম, এখন নিঃস্ব হয়ে কি করে যাব?
নল দময়ন্তী
একই বস্ত্র পরিধান করে বিচরণ করতে করতে একটি পথিকদের বিশ্রাম স্থানে এলেন এবং ভূতলে শয়ন করলেন। দময়ন্তী তখনই নিদ্রিত হলেন। নল ভাবলেন, দময়ন্তী আমার জন্যই দুঃখ ভোগ করছেন, আমি না থাকলে ইনি হয়তো পিতৃগৃহে ঘাবেন। কলির দুষ্ট প্রভাবে নল দময়ন্তীকে ত্যাগ করাই স্থির করলেন এবং যে বস্ত্র তাঁরা দু’জনেই প’রে ছিলেন তা দ্বিখণ্ড করবার জন্য ব্যগ্র হলেন। নল দেখলেন, আশ্রয়স্থানের এক প্রান্তে একটি কোষমুক্ত খড়্গ রয়েছে। সেই খড়্গ দিয়ে বস্ত্রের অর্ধভাগ কেটে নিয়ে নিদ্রিতা দময়ন্তীকে পরিত্যাগ কারে নল দ্রুতবেগে নিষ্ক্রান্ত হলেন, কিন্ত আবার ফিরে এসে পত্বীকে দেখে বিলাপ করতে লাগলেন। এইরূপে নল আন্দোলিত হৃদয়ে বার বার ফিরে এসে অবশেষে প্রস্থান করলেন।
নিদ্রা থেকে উঠে নলকে না দেখে দময়ন্তী শোকার্ত ও ভয়ার্ত হয়ে কাঁদতে লাগলেন। তিনি পতির অন্বেষণে শ্বাপদসংকুল বনে প্রবেশ করলেন। সহসা কুম্ভীরের ন্যায় মহাকায় এক ক্ষুধার্ত অজগর তাকে ধরলে। দময়ন্তীর আর্তনাদ শুনে এক ব্যাধ তখনই সেখানে এল এবং তীক্ষ্ণ অস্ত্রে অজগরের মুখ চিরে দময়ন্তীকে উদ্ধার করলে। অজগরকে বধ করে ব্যাধ দময়ন্তীকে প্রক্ষালনের জন্য জল এনে দিলে এবং আহারও দিলে। দময়ন্তী আহার করলে ব্যাধ বললে, মৃগশাবকাক্ষী, তুমি কে, কেন এখানে এসেছ? দময়ন্তী সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন। অর্ধবসনধারিণী দময়ন্তীর রূপ দেখে ব্যাধ কামার্ত হয়ে তাকে ধরতে গেল। দময়ন্তী বললেন, যদি আমি নিষধরাজ ভিন্ন অন্য পুরুষকে মনে মনেও চিন্তা না করে থাকি তবে এই ক্ষুদ্র মৃগয়াজীবা গতাসু হয়ে পড়ে যাক। ব্যাধ তখনই প্রাণহীন হয়ে ভূপতিত হল।
দময়ন্তী ঝিল্লীনাদিত বহুবৃক্ষসমাকীর্ণ ঘোর অরণ্যে প্রবেশ করলেন, সিংহ-ব্যাপ্র-মহিষ-ভল্লুকাদি প্রাণী এবং ম্লেচ্ছ-তস্কর প্রভৃতি জাতি সেখানে বাস করে তিনি উন্মন্তার ন্যায় শ্বাপদ পশু ও অচেতন পর্বতকে নলের সংবাদ জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন। তিন অহোরাত্র উত্তর দিকে চ’লে তিনি এক রমণীয় তপোবনে উপস্থিত হলেন। তপস্বীরা বললেন, সর্বাঙ্গসুন্দরী, তুমি তুমি কে? শোক ক’রো না, আশ্বস্ত হও তুমি কি এই অরণ্যের বা পর্বতের বা নদীর দেবী? দময়ন্তী তাঁর ইতিহাস জানিয়ে বললেন, ভগবান, যদি কয়েক দিনের মধ্যে নল রাজার দেখা না পাই তবে আমি দেহত্যাগ করব। তপস্বীরা বললেন, কল্যাণী, তোমার মঙ্গল হবে, আমরা দেখছি তুমি শীঘ্রই নিষধরাজের দর্শন পাবে। তিনি সর্ব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে সর্বরত্নসমন্বিত হয়ে নিজ রাজ্য শাসন করবেন, শত্রুদের ভয় উৎপাদন ও সুহৃদগণের শোক নাশ করবেন। এই বলে তপস্বিগণ অন্তর্হিত হলেন। দময়ন্তী বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, আমি কি স্বপ্ন দেখলাম? তাপসগণ কোথায় গেলেন? তাঁদের আশ্রম, পুণ্যসলিলা নদী, ফলপুষ্পশোভিত বৃক্ষ প্রভৃতি কোথায় গেল?
নলের অন্বেষণে আবার যেতে দময়ন্তী এক নদীতীরে এসে দেখলেন, এক বৃহৎ বণিকের দল অনেক হস্তী অশ্ব রথ নিয়ে নদী পার হচ্ছে। দময়ন্তী সেই যাত্রিদলের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তার উন্মন্তের ন্যায় অর্ধবসনাবৃত কৃশ মলিন মূর্তি দেখে কতকগুলি লোক ভয়ে পালিয়ে গেল, কেউ অন্য লোককে ডাকতে গেল, কেউ হাসতে লাগল। একজন বললে, কল্যাণী, তুমি কি মানবী, দেবতা যক্ষী, না রাক্ষসী? আমরা তোমার শরণ নিলাম, আমাদের রক্ষা কর, যাতে এই বণিকের দল নিরাপাদে যেতে পারে তা কর। দময়ন্তী তাঁর পরিচর় দিলেন এবং নলের সংবাদ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন. শুচি নামক সার্থবাহ ( বণিকসংঘের নায়ক) বললেন, যশস্বিনী, নলকে আমরা দেখি নি, এই বনে আপনি ভিন্ন কোনও মানুষও দেখি নি। আমরা বাণিজ্যের জন্য চেদিরাজ সুবাহুর রাজ্যে যাচ্ছি।
নলের দেখা পাবেন এই আশায় দময়ন্তী সেই বণিকসংঘের সঙ্গে চলতে লাগলেন কিছু দূর গিয়ে সকলে এক বৃহৎ জলাশয়ের তীরে উপস্থিত হলেন। পরিশ্রান্ত বণিকের দল সেখানে রাত্রিযাপনের আয়োজন করলে। সকলে নিদ্রিত হলে অর্ধরাত্রে এক দল মদমত্ত বন্য হস্তী বণিক সংঘের পালিত হস্তীদের মারবার জন্য সবেগে এল সহসা আক্রান্ত হয়ে বণিকরা ভয়ে উদভ্রান্ত হয়ে পালাতে লাগল, বন্য হস্তীর দন্তাঘাতে ও পদের পেষণে অনেকে নিহত হল , বহু উষ্ট্র ও অশ্বও বিনষ্ট হল। হতাবশিষ্ট বণিকরা বলতে লাগল, আমরা বাণিজ্যদেবতা মণিভদ্রের এবং যজ্ঞাধিপ কুবেরের পূজা করি নি তারই এই ফল। কয়েকজন বললে, সেই উন্মত্তর্শনা বিকৃতরূপা নারীই মায়াবলে এই বিপদ ঘটিয়েছে। নিশ্চয় সে রাক্ষসী যক্ষী বা পিশাচী, তাকে দেখলে আমরা হত্যা করব।
এই কথা শুনতে পেয়ে দময়ন্তী বেগে বনমধ্যে পলায়ন করলেন। তিনি বিলাপ করে বললেন, এই নির্জন অরণ্যে যে জনসংঘে আশ্রয় পেয়েছিলাম তাও হস্তিযুথ এসে বিধ্বস্ত করলে, এও আমার মন্দভাগ্যের ফল। আমি স্বয়ংবরে ইন্দ্রাদি লোকপালগণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, তাদেরই কোপে আমার এই দুর্দশা হয়েছে। হতাবশিষ্ট লোকদের মধ্যে কয়েকজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন, দময়ন্তী তাদের সঙ্গে যেতে লাগলেন। বহুকাল পর্যটনের পর দময়ন্তী একদিন সায়াহ্ণকালে চেদিরাজ সুবাহুর নগরে উপস্থিত হলেন। তাকে উন্মত্তার ন্যায় দেখে গ্রাম্য বালকগণ কৌতুহলের বশে তাঁর অনুসরণ করতে লাগল। দময়ন্তী রাজপ্রাসাদের নিকটে এলে রাজামাতা তাঁকে দেখতে পেয়ে এক ধাত্রীকে বললেন, ওই দুঃখিনী শরণার্থিনী নারীকে লোকে কষ্ট দিচ্ছে, তুমি ওকে নিয়ে এস।
দময়ন্তী এলে রাজমাতা বললেন, এই দুর্দশাতেও তোমাকে রূপবতী দেখছি, মেঘের মধ্যে বিদ্যুতের ন্যায় তুমি কে? দময়ন্তী বললেন, আমি পতিব্রতা সদবংশীয়া সৈরিন্ধ্রী(১)। আমার ভর্তার গুণের সংখ্যা করা যায় না, কিন্ত দুরদৈববশে দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হয়ে তিনি বনে এসেছিলেন, সেখানে আমাকে নিদ্রিত অবস্থায় ত্যাগ করে চ’লে গেছেন। বিরহতাপে দিবারাত্র দগ্ধ হয়ে আমি তার অন্বেষণ করছি। রাজমাতা বললেন, কল্যাণী, তোমার উপর আমার স্নেহ হয়েছে, আমার কাছেই তুমি থাক। আমার লোকেরা তোমার পতির অন্বেষণ করবে, হয়তো তিনি ঘুরতে ঘুরতে নিজেই এখানে এসে পড়বেন।
দময়ন্তী বললেন, বীরজননী, আমি আপনার কাছে থাকব, কিন্তু কারও উচ্ছিষ্ট খাব না বা পা ধুইয়ে দেব না। পতির অন্বেষণের জন্য আমি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে দেখা করব, কিন্তু অন্য পুরুষের সঙ্গে কথা বলব না। যদি কোনও পুরুষ আমাকে প্রার্থনা করে তবে আপনি তাকে বধদণ্ড দেবেন। রাজমাতা সানন্দে সম্মত হলেন, এবং নিজ দুহিতা সুনন্দাকে ডেকে বললেন, এই দেবরূপিণী সৈরিন্ধ্রী তোমার সমবয়স্কা, ইনি তোমার সখী হবেন। সুনন্দা হৃষ্টচিত্তে দময়ন্তীকে নিজগৃহে নিয়ে গেলেন।
** (১) যে নারী পরগৃহে স্বাধীনভাবে থেকে শিল্পাদির দ্বারা জীবিকানির্বাহ করে।
১৬। কর্কোটক নাগ-নলের রূপান্তর
দময়ন্তীকে ত্যাগ করে নল গহন বনে গিয়ে দেখলেন, দাবাগ্নি জলছে এবং কেউ তাঁকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকছে, পুণ্যশ্লোক নল, শীঘ্র আসুন। নল অগ্নির নিকটে এলে এক কুন্ডলীকৃত নাগরাজ কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, রাজা, আমি কর্কোটক নাগ, মহর্ষি নারদকে প্রতারিত করেছিলাম সেজন্য তিনি শাপ দিয়েছেন-এই স্থানে স্থাবরের ন্যায় পড়ে থাক, নল যখন তোমাকে অন্যত্র নিয়ে যাবেন তখন শাপমুক্ত হবে। আপনি আমাকে রক্ষা করুন, আমি সখা হয়ে আপনাকে সৎপরামর্শ দেব। এই বলে নাগেন্দ্র কর্কোটক অঙ্গুষ্ঠ-প্রমাণ হলেন, নল তাকে নিয়ে দাবাগ্নিশূন্য স্থানে চললেন।
যেতে যেতে কর্কোটক বললেন, নিষধরাজ, আপনি পদক্ষেপ গণনা করে চলুন, আমি আপনার মহোপকার করব। নল দশম পদক্ষেপ করবামাত্র কর্কোটক তাঁকে দংশন করলেন, তৎক্ষণাৎ নলের রূপ বিকৃত হয়ে গেল। কর্কোটক নিজ মূর্তি ধারণ করে বললেন, মহারাজ, লোকে আপনাকে যাতে চিনতে না পারে সেজন্য আপনার প্রকৃত রূপ অন্তহিত করে দিলাম। যে কলি কর্তৃক আবিষ্ট হয়ে আপনি প্রতারিত ও মহাদুঃখে পতিত হয়েছেন সে এখন আমার বিষে আক্রান্ত হয়ে আপনার দেহে কষ্টে বাস করবে। আপনি অযোধ্যায় ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা খতুপর্ণের কাছে গিয়ে বলুন যে আপনি বাহুক নামক সারথি। তিনি আপনার নিকট অশ্বহৃদয় শিখে নিয়ে আপনাকে অক্ষহৃদয় (১) দান করবেন। ঋতুপর্ণ আপনার সখা হবেন, আপনিও দ্যূতক্রীড়ায় পারদর্শী হয়ে শ্ৰেয়োলাভ করবেন এবং পত্নী পুত্রকন্যা ও রাজ্য ফিরে পাবেন। যখন পূর্বরূপ ধারণের ইচ্ছা হবে তখন আমাকে স্মরণ করে এই বসন পরিধান করবেন। এই বলে কর্কোটক নলকে দিব্য বস্ত্রযুগল দান করে অন্তর্হিত হলেন।
দশ দিন পরে নল ঋতুপর্ণ রাজার কাছে এসে বললেন, আমার নাম বাহুক, অশ্বচালনায় আমার তুল্য নিপুণ লোক পৃথিবীতে নেই। সংকটকালে এবং কোনও কার্যে নৈপুণ্যের প্রয়োজন হলে আমি মন্ত্রণা দিতে পারব, রন্ধনবিদ্যাও আমি বিশেষরূপে জানি। সর্বপ্রকার শিল্প ও দুরূহ কার্য সম্পাদনেও আমি যত্নশীল হব। ঋতুপর্ণ বললেন, বাহুক, তুমি আমার কাছে থাক,
তোমার ভাল হবে। দশ সহস্র মুদ্রা বেতনে তুমি আমার অশ্বাধ্যক্ষ নিযুক্ত হলে বাষ্ণেয় (২) ও জীবল (৩) তোমার সেবা করবে।
ঋতুপর্ণের আশ্রয়ে নল সসম্মানে বাস করতে লাগলেন। দময়ন্তীকে স্মরণ করে তিনি প্রত্যহ সায়ংকালে এই শ্লোক বলতেন
ক্ক নু সা ক্ষুৎপিপাসার্তা শ্রান্তা শেতে তপস্বিনী।
স্মরন্তী তস্য মন্দস্য কং বা সাইদ্যোপতিষ্ঠতি ৷৷
-সেই ক্ষুৎপিপাসার্তা শ্রান্তা দুঃখিনী আজ কোথায় শুয়ে আছে? এই হতভাগ্যকে স্মরণ করে সে আজ কার আশ্রয়ে বাস করছে?
একদিন জীবল বললে, বাহুক, কোন নারীর জন্য তুমি নিত্য এরূপ বিলাপ কর? নল বললেন, কোনও এক মন্দবুদ্ধি পুরুষ ঘটনাক্রমে তার অত্যন্ত আদরণীয়া পত্নীর সহিত বিচ্ছেদের ফলে শোকে দগ্ধ হয়ে ভ্রমণ করছে। নিশাকালে তার প্রিয়াকে স্মরণ করে সে এই শ্লোক গান করে। সেই পতিপরিত্যক্তা বালা ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে একাকী শ্বাপদসংকুল দারুণ বনে বিচরণ করছে, হায়, তার জীবনধারণ দুষ্কর।
**
(১) ‘হৃদয়’-এর অর্থ গুপ্তবিদ্যা, অর্থাৎ অশ্বচালনা বা অক্ষক্রীড়ায় অসাধারণ নৈপুণ্য
(২) ১৪-পরিচ্ছেদে উক্ত নল-সারথি।।
(৩) ঋতুপর্ণের পূর্বসারথি।
১৭। পিত্রালয়ে দময়ন্তী-নল-ঋতুপর্ণের বিদর্ভযাত্রা
বিদর্ভরাজ ভীম তার কন্যা ও জামাতার অন্বেষণের জন্য বহু ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করলেন। তারা প্রচুর পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি পেয়ে নানা দেশে নল-দময়ন্তীকে খুঁজতে লাগলেন। সুদেব নামে এক ব্রাহ্মণ চেদি দেশে এসে রাজভবনে যজ্ঞকাননে দময়ন্তীকে দেখতে পেলেন। সুদেব নিজের পরিচয় দিয়ে দময়ন্তীকে তাঁর পিতা মাতা ও পুত্রকন্যার কুশল জানালেন। ভ্রাতার প্রিয় সখা সুদেবকে দেখে দময়ন্তী কাঁদতে লাগলেন। সুনন্দার কাছে সংবাদ পেয়ে রাজমাতা তখনই সেখানে এলেন এবং সুদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্রাহ্মণ, ইনি কার ভার্যা, কার কন্যা ? আত্মীয়দের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেন কেন? আপনিই বা এঁকে জানলেন কি করে ? সুদেব নল-দময়ন্তীর ইতিহাস বিকৃত করে বললেন, দেবী, এঁর অন্বেষণে আমরা সর্বত্র ভ্রমণ করেছি, এখন আপনার আলয়ে এঁকে পেলাম। এঁর অতুলনীয় রূপ এবং দুই ভ্রুর মধ্যে যে পদ্মাকৃতি জটুল রয়েছে তা দেখেই ধূমাবৃত অগ্নির ন্যায় এঁকে আমি চিনেছি।
সুনন্দা দময়ন্তীর ললাটের মল মুছিয়ে দিলেন, তখন সেই জটুল মেঘমুক্ত চন্দ্রের ন্যায় সুস্পষ্ট হল। তা দেখে রাজমাতা ও সুনন্দা দময়ন্তীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। রাজমাতা অপূর্ণ নয়নে বললেন, তুমি আমার ভগিনীর কন্যা, ওই জটুল দেখে চিনেছি। দশার্ণরাজ সুদামা তোমার মাতার ও আমার পিতা, তোমার জন্মকালে দশার্ণদেশে পিতৃগৃহে আমি তোমাকে দেখেছিলাম। দময়ন্তী, তোমার পক্ষে আমার গৃহ তোমার পিতৃগৃহেরই সমান। দময়ন্তী, আনন্দিত হয়ে মাতৃম্বসাকে প্রণাম করে বললেন, আমি অপরিচিত থেকেও আপনার কাছে সুখে বাস করেছি, এখন আরও সুখে থাকতে পারব। কিন্তু মাতা, পুত্রকন্যার বিচ্ছেদে আমি শোকার্ত হয়ে আছি, অতএব আজ্ঞা দিন আমি বিদর্ভ দেশে যাব। |
রাজমাতা তার পুত্রের অনুমতি নিয়ে বিশাল সৈন্যদল সহ দময়ন্তীকে মনুষ্যবাহিত যানে বিদভরাজ্যে পাঠিয়ে দিলেন। রাজা ভীম আনন্দিত হয়ে সহস্ৰ গো, গ্রাম ও ধন দান করে সুদেবকে তুষ্ট করলেন। দময়ন্তী তার জননীকে বললেন, যদি আমার জীবন রক্ষা করতে চান তবে আমার পতিকে আনবার চেষ্টা করুন। রাজার আজ্ঞায় ব্রাহ্মণগণ চতুর্দিকে যাত্রা করলেন। দময়ন্তী তাঁদের বলে দিলেন, আপনারা সকল রাষ্ট্রে জনসংসদে এই কথা বার বার বলবেন—‘দূতকার, বস্ত্রাধ ছিন্ন করে নিদ্রিতা প্রিয়াকে অরণ্যে ফেলে কোথায় গেছ? সে এখনও অর্ধবস্ত্রে আবৃত হয়ে তোমার জন্য রোদন করছে। রাজা, দয়া কর, প্রতিবাক্য বল। আপনারা এইরূপ বললে কোনও লোক যদি উত্তর দেন তবে ফিরে এসে আমাকে জানাবেন, কিন্তু কেউ যেন আপনাদের চিনতে না পারে।
দীর্ঘকাল পরে পর্ণাদ নামে এক ব্রাহ্মণ ফিরে এসে বললেন, আমি ঋতুপর্ণ রাজার সভায় গিয়ে আপনার বাক্য বলেছি, কিন্তু তিনি বা কোনও সভাসদ উত্তর দিলেন না। তার পর আমি বাহুক নামক এক রাজভৃত্যের কাছে গেলাম। সে রাজার সারথি, কুরূপ, খর্ববাহু, দ্রুত রথচালনায় নিপুণ, সুস্বাদু খাদ্য প্রস্তুত করতেও জানে। সে বহুবার নিঃশ্বাস ফেলে ও রোদন করে আমার কুশল জিজ্ঞাসা করলে, তার পর বললে, সতী কুলস্ত্রী বিপদে পড়লেও নিজের ক্ষমতায় নিজেকে রক্ষা করেন। পক্ষী যার বসন হরণ করেছিল, সেই মোহগ্রস্ত বিপদাপন্ন ক্ষুধার্ত পতি পরিত্যাগ করে চ’লে গেলেও সতী নারী ক্রুদ্ধ হন না। এই বার্তা শুনে দময়ন্তী তাঁর জননীকে বললেন, আপনি পিতাকে কিছু জানাবেন না। এখন সুদেব শীঘ্র ঋতুপর্ণের রাজধানী অযোধ্যায় যান এবং নলকে আনবার চেষ্টা করুন।
দময়ন্তী পর্ণাদকে পারিতোষিক দিয়ে বললেন, বিপ্র, নল এখানে এলে আমি আবার আপনাকে ধনদান করব। পর্ণাদ কৃতার্থ হয়ে চ’লে গেলে দময়ন্তী সুদেবকে বললেন, আপনি সত্বর অযোধ্যায় গিয়ে রাজা ঋতুপর্ণকে বলুন-ভীম রাজার কন্যা দময়ন্তীর পুনর্বার স্বয়ংবর হবে, কাল সূর্যোদয়কালে তিনি দ্বিতীয় পতি বরণ করবেন, কারণ নল জীবিত আছেন কিনা জানা যাচ্ছে না। বহু রাজা ও রাজপুত্র স্বয়ংবর সভায় যাচ্ছেন, আপনিও যান।
সুদেবের বার্তা শুনে ঋতুপর্ণ নলকে বললেন, বাহুক, আমি একদিনের মধ্যে বিদর্ভরাজ্যে দময়ন্তীর স্বয়ংবরে যেতে ইচ্ছা করি। নল দুঃখার্ত হয়ে ভাবলেন, আমার সঙ্গে মিলিত হবার জন্যই কি তিনি এই উপায় স্থির করেছেন? আমি হীনমতি অপরাধী, তাঁকে প্রতারিত করেছি, হয়তো সেজন্যই তিনি এই নৃশংস কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছেন। না, তিনি কখনও এমন করবেন না, বিশেষত তার যখন সন্তান রয়েছে। ঋতুপর্ণকে নল বললেন যে তিনি একদিনেই বিদর্ভনগরে পৌঁছবেন তার পর তিনি অশ্বশালায় গিয়ে কয়েকটি সিন্ধুদেশজাত কৃশকায় অশ্ব বেছে নিলেন। তা দেখে রাজা কিঞ্চিৎ রুষ্ট হয়ে বললেন, বাহুক, এইসকল ক্ষীণজীবী অশ্ব নিচ্ছ কেন, আমাকে কি প্রতারিত করতে চাও ? নল উত্তর দিলেন, মহারাজ, এই অশ্বগুলির ললাট মস্তক পার্শ্ব প্রভৃতি স্থানে দশটি রোমাবর্ত আছে, দ্রুতগমনে এরাই শ্রেষ্ঠ। তবে আপনি যদি অন্য অশ্ব উপযুক্ত মনে করেন, তাই নেব। ঋতুপর্ণ বললেন, বাহুক, তুমি অশ্বতত্ত্বজ্ঞ, যে অশ্ব ভাল মনে কর তাই নাও। তখন নল নিজের নির্বাচিত চারটি অশ্ব রথে যুক্ত করলেন।
ঋতুপর্ণ রথে উঠলে নল সারথি বাষ্ণেয়কে তুলে নিলেন এবং মহাবেগে রথ চাললেন। বাষ্ণেয় ভাবলে, এই বাহুক কি ইন্দ্রের সারথি মাতলি না স্বয়ং নল রাজা? বয়সে নলের তুল্য হলেও এ আকৃতিতে বিরূপ ও খর্ব। বাহুকের রথচালনা দেখে ঋতুপর্ণ বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন। সহসা তার উত্তরীয় উড়ে যাওয়ায় তিনি বললেন, রথ থামাও, বাষ্ণেয় আমার উত্তরীয় নিয়ে আসুক। নল বললেন, আমরা এক যোজন ছাড়িয়ে এসেছি, এখন উত্তরীয় পাওয়া অসম্ভব। ঋতুপর্ণ বিশেষ প্রীতি হলেন না। তিনি এক বিভীতক (বহেড়া) বৃক্ষ দেখিয়ে বললেন, বাহুক, সকলে সব বিষয় জানে না, তুমি আমার গণনার শক্তি দেখ—এই বৃক্ষ থেকে ভূমিতে পতিত পত্রের সংখ্যা একশ এক, ফলের সংখ্যাও তাই। এর শাখায় পাঁচ কোটি পত্র আর দু হাজার- পঁচানব্বই ফল আছে, তুমি গণনা করে দেখ।
বাহুক বলল আপনি গর্ব করছেন, আমি এই বৃক্ষ কেটে ফেলে পত্র ও ফল গণনা করব। রাজা বললেন, এখন বিলম্ব করবার সময় নয়। নল বললেন, আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আর যদি যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকেন তবে সম্মুখের পথ ভাল আছে, বাষ্ণেয় আপনাকে নিয়ে যাক। ঋতুপর্ণ অনুনয় করে বললেন, বাহুক, তোমার তুল্য সারথি পৃথিবীতে নেই, আমি তোমার শরণাপন্ন, গমনে বিঘ্ন ক’রো না। যদি আজ সূর্যাস্তের পূর্বে বিদর্ভদেশে যেতে পার তবে তুমি যা চাইবে তাই দেব। নল বললেন, আমি পত্র আর ফল গণনা করে বিদর্ভে যাব। রাজা অনিচ্ছায় বললেন, আমি শাখার এক অংশের পত্র ও ফলের সংখ্যা বলছি, তাই গণনা করে সন্তুষ্ট হও। নল শাখা কেটে গণনা করে বিস্মিত হয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার শক্তি অতি অদ্ভুত, আমাকে এই বিদ্যা শিখিয়ে দিন, তার পরিবর্তে আপনি আমার বিদ্যা অশ্বহৃদয় নিন।।
ঋতুপর্ণ অশ্বহৃদয় শিখে নলকে অক্ষহৃদয় দান করলেন। তৎক্ষণাৎ কলি কৰ্কোটক-বিষ বমন করতে করতে নলের দেহ থেকে বেরিয়ে এলেন এবং অন্যের অদৃশ্য হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে ক্রুদ্ধ নলকে বললেন, নৃপতি, আমাকে অভিশাপ দিও না, আমি তোমাকে পরমা কীর্তি দান করব। যে লোক তোমার নাম কীর্তন করবে তার কলিভয় থাকবে না। এই বলে তিনি বিভীতক বৃক্ষে প্রবেশ করলেন। কলির প্রভাব থেকে মুক্ত নলের সন্তাপ দূর হল কিন্তু তখনও তিনি বিরূপ হয়ে রইলেন।
১৮। নল-দময়ন্তীর পুনর্মিলন
ঋতুপর্ণ সায়ংকালে বিদর্ভরাজপর কন্ডিন নগরে প্রবেশ করলেন। নল-চালিত রথের মেঘগর্জনের ন্যায় ধ্বনি শুনে দময়ন্তী অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। তিনি ভাবলেন, নিশ্চয় মহীপতি নল এখানে আসছেন। আজ যদি তার চন্দ্রবদন না দেখতে পাই, যদি তার বাহুদ্বয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারি, তবে আমি নিশ্চয় মরব। দময়ন্তী জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রাসাদের উপরে উঠে ঋতুপর্ণ ও বাহুককে দেখতে পেলেন।
ঋতুপর্ণ স্বয়ংবরের কোনও আয়োজন দেখতে পেলেন না। বিদর্ভরাজ ভীম কিছুই জানতেন না, তিনি ঋতুপর্ণকে সংবর্ধনা করে তার আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ঋতুপর্ণ দেখলেন, কোনও রাজা বা রাজপুত্র স্বয়ংবরের জন্য আসেননি; অগত্যা তিনি বিদর্ভরাজকে বললেন, আপনাকে অভিবাদন করতে এসেছি। রাজা ভীমও বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, শত যোজনের অধিক পথ অতিক্রম করে কেবল অভিবাদনের জন্য এঁর আসবার কারণ কি?
রাজভৃত্যগণ ঋতুপর্ণকে তার জন্য নির্দিষ্ট গৃহে নিয়ে গেল, বাষ্ণেয়ও তাঁর সঙ্গে গেল। বাহুকরূপী নল রথশালায় রথ নিয়ে গিয়ে অশ্বদের যথাবিধি পরিচর্যা করে রথেতেই বসলেন। দময়ন্তী নলকে না দেখে শোকার্তা হলেন, তিনি কেশিনী নামে এক দূতীকে বললেন, তুমি জেনে এস ওই হ্রস্ববাহু বিরূপ রথচালকটি কে?
দময়ন্তীর উপদেশ অনুসারে কেশিনী নলের কাছে গিয়ে কুশল প্রশ্ন করে বললে, দময়ন্তী জানতে চান আপনারা অযোধ্যা থেকে কেন এখানে এসেছেন। আপনি কে, আপনাদের সঙ্গে যে তৃতীয় লোকটি এসেছে সেই বা কে? নল উত্তর দিলেন, দময়ন্তীর দ্বিতীয়বার স্বয়ংবর হবে শুনে রাজা ঋতুপর্ণ এখানে এসেছেন। আমি অশ্ববিদ্যায় বিশারদ সেজন্য রাজা আমাকে সারথি করেছেন, আমি তার আহারও প্রস্তুত করি। তৃতীয় লোকটির নাম বাষ্ণেয়, পূর্বে সে নলের সারথি ছিল, নল রাজ্যত্যাগ করার পর থেকে সে রাজা ঋতুপর্ণের আশ্রয়ে আছে। কেশিনী বললে, বাহুক, নল কোথায় আছেন বাষ্ণেয় কি তা জানে? নল বললেন, সে বা অন্য কেউ নলের সংবাদ জানে না, তার রূপ নষ্ট হয়েছে, তিনি আত্মগোপন করে বিচরণ করছেন। কেশিনী বললে, যে ব্রাহ্মণ অযোধ্যায় গিয়েছিলেন তার কথার উত্তরে আপনি যা বলেছিলেন দময়ন্তী পুনর্বার তা আপনার নিকট শুনতে চান। নল অশ্রুপূর্ণনয়নে বাষ্পগদ্গদস্বরে পূর্ববৎ বললেন, সতী কুলস্ত্রী বিপদে পড়লেও নিজের ক্ষমতায় নিজেকে রক্ষা করেন। পক্ষী যার বস্ত্র হরণ করেছিল সেই মোহগ্রস্ত বিপদাপন্ন ক্ষুধার্ত পতি পরিত্যাগ করে চ’লে গেলেও সতী নারী ক্রুদ্ধ হন না।
কেশিনীর কাছে সমস্ত শুনে দময়ন্তী অনুমান করলেন, বাহুকই নল। তিনি কেশিনীকে বললেন, তুমি আবার বাহুকের কাছে গিয়ে তার আচরণ ও কার্যের কৌশল লক্ষ্য কর। তিনি চাইলেও তাঁকে জল দিও না। কেশিনী পুনর্বার গেল এবং ফিরে এসে বললে, এমন শুদ্ধাচার মানুষ আমি কখনও দেখি নি। ইনি অনুচ্চ দ্বারে প্রবেশকালে নত হন না, দ্বারই তার জন্য উচ্চ হয়ে যায়। ঋতুপর্ণের ভোজনের জন্য আমাদের রাজা বিবিধ পশুমাংস পাঠিয়েছেন, মাংস ধোবার জন্য কলসও সেখানে আছে। বাহুকের দৃষ্টিপাতে কলস জলপূর্ণ হয়ে গেল। মাংস ধুয়ে উননে চড়িয়ে বাহুক এক মুষ্টি তৃণ সূর্যকিরণে ধরলেন, তখনই তৃণ প্রজ্বলিত হল। তিনি অগ্নি স্পর্শ করলে দগ্ধ হন না, পুষ্প মর্দন করলে তা বিকৃত হয় না, আরও সুগন্ধ ও বিকশিত হয়। দময়ন্তী বললেন, কেশিনী, তুমি আবার যাও, তাকে না জানিয়ে তার রাঁধা মাংস কিছু নিয়ে এস। কেশিনী মাংস আনলে দময়ন্তী তা চেখে বুঝলেন যে নলই তা বেঁধেছেন। তখন তিনি তাঁর পুত্রকন্যাকে কেশিনীর সঙ্গে বাহুকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। নল ইন্দ্রসেন ও ইন্দ্রসেনাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তার পর কেশিনীকে বললেন, এই বালক-বালিকা আমার পুত্র-কন্যার সদৃশ সেজন্য আমি কাঁদছি। ভদ্রে, আমরা অন্য দেশের অতিথি, তুমি বার বার এলে লোকে দোষ দেবে, অতএব তুমি যাও।
দময়ন্তী তার মাতাকে বললেন, আমি বহু পরীক্ষায় বুঝেছি যে বাহুকই নল, কেবল তার রূপের জন্য আমার সংশয় আছে। এখন আমি নিজেই তাকে দেখতে চাই, আপনি পিতাকে জানিয়ে বা না জানিয়ে আমাকে অনুমতি দিন। পিতা মাতার সম্মতিক্রমে দময়ন্তী নলকে তার গৃহে আনালেন। কায়বসনা জটাধারিণী মলিনাঙ্গী দময়ন্তী সরোদনে বললেন, বাহুক, নিদ্রিত পত্নীকে বনে পরিত্যাগ করে চ’লে গেছেন এমন কোনও ধর্মজ্ঞ পুরুষকে জান কি? পুণ্যশ্লোক নল ভিন্ন আর কে সন্তানবতী পতিব্রতা ভার্যাকে বিনা দোষে ত্যাগ করতে পারে? নল বললেন, কল্যাণী, যার জন্য আমার রাজ্য নষ্ট হয়েছে সেই কলির প্রভাবেই আমি তোমাকে ত্যাগ করেছিলাম। তোমার অভিশাপে দগ্ধ হয়ে কলি আমার দেহে বাস করছিল, এখন আমি তাকে জয় করেছি, সেই পাপ দূর হয়েছে। কিন্তু তুমি দ্বিতীয় পতি বরণে প্রবৃত্ত হয়েছ কেন? দময়ন্তী কৃতাঞ্জলি হয়ে কম্পিতদেহে বললেন, নিষধরাজ, আমার দোষ দিতে পার না, দেবগণকে বর্জন করে আমি তোমাকেই বরণ করেছিলাম। তোমার অন্বেষণে আমি সর্বত্র লোক পাঠিয়েছিলাম। ব্রাহ্মণ পর্ণাদের মুখে তোমার বাক্য শুনেই তোমাকে আনাবার জন্য আমি স্বয়ংবর রূপ উপায় অবলম্বন করেছি। যদি আমি পাপ করে থাকি তবে বায়ু সূর্য চন্দ্র আমার প্রাণ হরণ করুন।
অন্তরীক্ষ থেকে বায়ু বললেন, নল, এঁর কোনও পাপ নেই, আমরা তিন বৎসর এঁর সাক্ষী ও রক্ষী হয়ে আছি। তুমি ভিন্ন কেউ একদিনে শত যোজন পথ অতিক্রম করতে পারে না, তোমাকে আনাবার জন্যই ইনি অসাধারণ উপায় স্থির করেছিলেন। তখন পুষ্পবৃষ্টি হল , দেবদুন্দুভি বাজতে লাগল। নাগরাজ কর্কোটকের বস্ত্র পরিধান করে নল তার পূর্বরূপ ফিরে পেলেন, দময়ন্তী তাঁকে আলিঙ্গন করে রোদন করতে লাগলেন। অর্ধসঞ্জাতশস্য ভূমি জল পেয়ে যেমন হয়, সেইরূপ দময়ন্তী ভর্তাকে পেয়ে পরিতৃপ্ত হলেন।
১৯। নলের রাজ্যোদ্ধার
পরদিন প্রভাতকালে নল রাজা সুসজ্জিত হয়ে দময়ন্তীর সঙ্গে শ্বশুর ভীম রাজার কাছে গিয়ে অভিবাদন করলেন, ভীমও পরম আনন্দে নলকে পুত্রের ন্যায় গ্রহণ করলেন। রাজধানী ধ্বজ পতাকা ও পুষ্পে অলংকৃত করা হল , নগরবাসীরা হর্ষধ্বনি করতে লাগল। ঋতুপর্ণ বিস্মিত ও আনন্দিত হয়ে নলকে বললেন, বিষধরাজ, ভাগ্যক্রমে আপনি পত্নীর সঙ্গে পুনর্মিলিত হলেন। আমার গৃহে আপনার অজ্ঞাত-বাসকালে যদি আমি কোনও অপরাধ করে থাকি তো ক্ষমা করুন। নল বললেন, মহারাজ, আপনি কিছুমাত্র অপরাধ করেননি, আপনি পূর্বে আমার সখা ও আত্মীয় ছিলেন, এখন আরও প্রীতিভাজন হলেন। তার পর ঋতুপর্ণ নলের নিকট অশ্বহৃদয় শিক্ষা করে এবং তাকে অক্ষহৃদয় দান করে স্বরাজ্যে প্রস্থান করলেন।
এক মাস পরে নল সসৈন্যে নিজ রাজ্যে প্রবেশ করে পুষ্করকে বললেন, আমি বহু ধন উপার্জন করেছি, পুনর্বার দ্যূতক্রীড়া করব। আমার সমস্ত ধন ও দময়ন্তীকে পণ রাখছি, তুমি রাজ্য পণ রাখ। যদি দ্যূতক্রীড়ায় অসম্মত হও তবে আমার সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধ কর। পুষ্কর সহস্যে বললেন, ভাগ্যক্রমে আপনি আবার এসেছেন, আমি আপনার ধন জয় করে নেব, সুন্দরী ময়ন্তী আমার সেবা করবেন। নলের ইচ্ছা হল তিনি খড়গাঘাতে পুষ্করের শিরচ্ছেদ করেন, কিন্তু ক্রোধ সংবরণ করে বললেন, এখন বাক্যব্যয়ে লাভ কি, আগে জয়ী হও তার পর বলো।
এক পণেই নল পুষ্করের সর্বস্ব জয় করলেন। তিনি বললেন, মূর্খ, তুমি বৈদভীকে পেলে না, নিজেই সপরিবারে তার দাস হলে। আমার পূর্বের পরাজয় কলির প্রভাবে হয়েছিল, তোমার তাতে কর্তৃত্ব ছিল না। পরের দোষ তোমাতে আরোপ করব না, তুমি আমার ভ্রাতা, আমার রাজ্যের এক অংশ তোমাকে দিলাম। তোমার প্রতি আমার স্নেহ কখনও নষ্ট হবে না, তুমি শত বৎসর জীবিত থাক। এই বলে নল ভ্রাতাকে আলিঙ্গন করলেন। পুণ্যশ্লোক নলকে অভিবাদন করে কৃতাঞ্জলি হয়ে পুষ্কর বললেন, মহারাজ, আপনার কীর্তি অক্ষয় হ’ক, আপনি আমাকে প্রাণ ও রাজ্য দান করলেন, আপনি অযুত বৎসর জীবিত থাকুন। এক মাস পরে পুষ্কর হৃষ্টচিত্তে নিজ রাজধানীতে চ’লে গেলেন। অমাত্যগণ নগরবাসী ও জনপদবাসী সকলে আনন্দে রোমাঞ্চিত হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে নলকে বললেন, মহারাজ, আমরা পরম সুখ লাভ করেছি; দেবগণ যেমন দেবরাজের পূজা করেন সেইরূপ আপনার পূজা করবার জন্য আমরা আবার আপনাকে পেয়েছি।
নলোপাখ্যান শেষ করে বৃহদ বললেন, যুধিষ্ঠির, নল রাজা দ্যূতক্রীড়ার ফলে ভার্যার সঙ্গে এইরূপ দুঃখভোগ করেছিলেন, পরে আবার সমৃদ্ধিলাভও করেছিলেন। কর্কোটক নাগ, নল-দময়ন্তী আর রাজর্ষি ঋতুপর্ণের ইতিহাস শুনলে কলির ভয় দূর হয়। তুমি আশ্বস্ত হও, বিষাদগ্রস্ত হয়ো না। তোমার ভয় আছে, আবার কেউ দ্যূতক্রীড়ায় তোমাকে আহ্বান করবে; এই ভয় আমি দূর করছি। আমি সমগ্র অক্ষহৃদয় জানি, তুমি তা শিক্ষা কর। এই বলে বৃহদশ্ব যুধিষ্ঠিরকে অক্ষহৃদয় দান করে তীর্থভ্রমণে চ’লে গেলেন।
॥ তীর্থযাত্রাপর্বাধ্যায়৷৷
২০। যুধিষ্ঠিরাদির তীর্থযাত্রা
অর্জুনের বিরহে বিষগ্ন হয়ে পাণ্ডবগণ কাম্যকবন ত্যাগ করে অন্যত্র যাবার ইচ্ছা করলেন। একদিন দেবর্ষি নারদ এসে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ধার্মিক-শ্রেষ্ঠ, তোমার কি প্রয়োজন বল। যুধিষ্ঠির প্রণাম করে বললেন, আপনি প্রসন্ন থাকায় আমার সকল প্রয়োজন সিদ্ধ হয়েছে মনে করি। তীর্থপর্যটনে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করলে কি ফললাভ হয় তাই আপনি বলুন।
বহু শত তীর্থের (১) কথা সবিস্তারে বিবৃত করে নারদ বললেন, যে লোক যথারীতি তীর্থপরিভ্রমণ করে সে শত অশ্বমেধ যজ্ঞেরও অধিক ফল পায়। এখানকার ঋষিগণ তোমার প্রতীক্ষা করছেন, লোমশ মুনিও আসছেন, তুমি এঁদের সঙ্গে তীর্থপর্যটন কর। নারদ চ’লে গেলে পুরোহিত ধৌম্যও বহু তীর্থের বর্ণনা করলেন। তার পর লোমশ মুনি এসে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, বৎস, আমি একটি অতিশয় প্রিয় সংবাদ বলব, তোমরা শোন। আমি ইন্দ্রলোক থেকে আসছি, অর্জুন মহাদেবের নিকট ব্রহ্মশির নামক অস্ত্র লাভ করেছেন, যম কুবের বরুণ ইন্দ্রও তাকে বিবিধ দিব্যাস্ত্র দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাবসুর পুত্র চিত্রসেনের নিকট নৃত্য গীত বাদ্য ও সামগান যথাবিধি শিখেছেন। দেবরাজ ইন্দ্র তোমাকে এই কথা বলতে বলছেন।-অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষা শেষ হয়েছে, তিনি একটি মহৎ দেবকার্য সম্পাদন করে শীঘ্র তোমাদের কাছে ফিরে যাবেন। আমি জানি যে সূর্যপুত্র কর্ণ সত্য-প্রতিজ্ঞ, মহোৎসাহী, মহাবল, মহাধনুর্ধর; কিন্তু তিনি এখন অর্জুনের ষোড়শাংশের একাংশের তুল্যও নন। কর্ণের যে সহজাত কবচকে তোমরা ভয় কর তাও আমি হরণ করব। তোমার যে তীর্থযাত্রার অভিলাষ হয়েছে তার সম্বন্ধে এই ব্রহ্মর্ষি লোমশই তোমাকে উপদেশ দেবেন।
এই বার্তা জানিয়ে লোমশ বললেন, ইন্দ্র আর অর্জুনের অনুরোধে আমি তোমার সঙ্গে তীর্থভ্রমণ করব এবং সকল ভয় থেকে তোমাকে রক্ষা করব। যুধিষ্ঠির, তুমি লঘু (২) হও, লঘু হলে স্বচ্ছন্দে ভ্রমণ করতে পারবে।
উপস্থিত সকল লোককে যুধিষ্ঠির বললেন, যে ব্রাহ্মণ ও যতিগণ ভিক্ষাভোজী, যাঁরা ক্ষুধা তৃষ্ণা পথশ্রম আর শীতের কষ্ট সইতে পারেন না, তাঁরা নিবৃত্ত হ’ন। যাঁরা মিষ্টভোজী, বিবিধ পক্কান্ন লেহ্য পেয় মাংস প্রভৃতি খেতে চান, যাঁরা পাচকের পিছনে পিছনে থাকেন, তাঁরাও আমার সঙ্গে যাবেন না। যাঁদের জীবিকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি তারাও নিবৃত্ত হন। যেসকল পুরবাসী রাজ-ভক্তির বশে আমার সঙ্গে এসেছেন, তাঁরা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যান, তিনিই সকলকে উপযুক্ত বৃত্তি দেবেন। যদি তিনি না দেন তবে আমার প্রীতির নিমিত্ত পাঞ্চালরাজ দেবেন। তখন বহু পুরবাসী দুঃখিতমনে হস্তিনাপুরে চ’লে গেলেন ধৃতরাষ্ট্রও তাদের তুষ্ট করলেন।
কাম্যকবনবাসী ব্রাহ্মণগণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আমাদেরও তীর্থভ্রমণে নিয়ে চলুন, আপনাদের সঙ্গে না হলে আমরা যেতে পারব না। লোমশ ও ধৌম্যের মত নিয়ে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণদের প্রস্তাবে সম্মত হলেন। তার পর ব্যাস পর্বত ও নারদ ঋষি এসে স্বস্ত্যয়ন করলেন। তাদের প্রণাম করে পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদী অগ্রহায়ণ-পূর্ণিমার শেষে। পুষ্যা-নক্ষত্রযোগে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নিষ্ক্রান্ত হলেন। পাণ্ডবগণ চীর অজিন ও জটা ধারণ করে এবং অভেদ্য কবচ ও অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পূর্বদিকে যাত্রা করলেন। ইন্দ্রসেন প্রভৃতি ভৃত্যগণ, চতুর্দশাধিক রথ পাচকগণ ও পরিচারকগণ তাঁদের সঙ্গে গেল।
**
** (১) এই প্রসঙ্গে দ্বারবতীর পরে পিন্ডারক তীর্থের বর্ণনায় আছে—এখনও এই তীর্থে পদ্মচিহ্রিত ও ত্রিশূলাঙ্কিত বহু মুদ্রা (seal) পাওয়া যায়। বোধ হয় এইসকল মুদ্রা মহেঞ্জোদারোতে প্রাপ্ত মুদ্রার অনুরূপ।
(২) অর্থাৎ বেশী লোকজন জিনিসপত্র সঙ্গে নিও না।
২১। ইম্বল-বাতাপি-অগস্ত্য ও লোপামুদ্রা-ভৃগুতীর্থ
পাণ্ডবগণ নৈমিষারণ্য প্রয়াগ প্রভৃতি তীর্থ দর্শন করে অগস্ত্যের আশ্রম মণিমতী পুরীতে এলেন। লোমশ বললেন, পুরাকালে এখানে ইন্বল নামে এক দৈত্য বাস করত, তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম বাতাপি। একদিন ইন্বল এক তপস্বী ব্রাহ্মণকে বললে, আমাকে একটি ইন্দ্রতুল্য পুত্র দিন। ব্রাহ্মণ তার প্রার্থনা পূর্ণ করলেন না। ইন্দ্বল অতিশয় ক্রুদ্ধ হল এবং মায়াবলে বাতাপিকে ছাগ বা মেষে রূপান্তরিত করে তার মাংস বেঁধে ব্রাহ্মণভোজন করাতে লাগল। ভোজনের পর ইন্বল তার ভ্রাতাকে উচ্চস্বরে ডাকত, তখন ব্রাহ্মণের পার্শ্ব ভেদ করে বাতাপি হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসত। দুরাত্মা ইন্বল এইরূপে বহু ব্রাহ্মণ হত্যা করলে।
এই সময়ে অগস্ত্য মুনি একদিন দেখলেন, একটি গর্তের মধ্যে তার পিতৃপুরুষগণ অধোমুখে ঝুলছেন। অগস্ত্যের প্রশ্নের উত্তরে তারা বললেন, বংশলোপের সম্ভাবনায় আমরা এই অবস্থায় আছি; যদি তুমি সৎপুত্রের জন্ম দিতে পার তবে আমরা নরক থেকে মুক্ত হব, তুমিও সঙ্গতি লাভ করবে। অগস্ত্য বললেন, পিতৃগণ, নিশ্চিন্ত হ’ন, আমি আপনাদের অভিলাষ পূর্ণ করব।
অগস্ত্য নিজের যোগ্য স্ত্রী খুঁজে পেলেন না। তখন তিনি সর্ব প্রাণীর শ্রেষ্ঠ অঙ্গের মিবায়ে এক অত্যুত্তমা স্ত্রী কল্পনা করলেন। সেই সময়ে বিদর্ভ দেশের রাজা সন্তানের জন্য তপস্যা করছিলেন, তাঁর মহিষীর গর্ভ থেকে অগস্ত্যের সেই সংকল্পিত ভার্যা ভূমিষ্ঠ হলেন। সৌদামিনীর ন্যায় সুন্দরী সেই কন্যার নাম রাখা হল লোপামুদ্রা। লোপামুদ্রা বিবাহযোগ্যা হলে অগস্ত্য বিদর্ভরাজকে বললেন, আপনার কন্যা আমাকে দিন। অগস্ত্যকে কন্যাদান করতে রাজার ইচ্ছা হল না, শাপের ভয়ে প্রত্যাখ্যান। করতেও তিনি পারলেন না। মহিষীও নিজের মত বললেন না। তখন লোপামুদ্রা বললেন, আমার জন্য দুঃখ করবেন না, অগস্ত্যের হাতে আমাকে দিন। রাজা যথাবিধি কন্যা সম্প্রদান করলেন।
বিবাহের পর অগস্ত্য তাঁর পত্নীকে বললেন, তোমার মহার্য বসন ও আভরণ ত্যাগ কর। লোপামুদ্রা চীর বল্কল ও মৃগচর্ম ধারণ করে পতির ন্যায় ব্রতচারিণী হলেন। অনেক দিন গঙ্গাদ্বারে কঠোর তপস্যার পর একদিন অগস্ত্য পত্নীর নিকট সহবাস প্রার্থনা করলেন। লোপামুদ্রা কৃতাঞ্জলি হয়ে লজ্জিতভাবে বললেন, পিতার প্রাসাদে আমার যেমন শয্যা ছিল সেইরূপ শয্যায় আমাদের মিলন হ’ক। আপনি মাল্য ও ভূষণ ধারণ করুন, আমিও দিব্য আভরণে ভূষিত হই। আমি চীর আর কাষায় বস্ত্র পরে আপনার কাছে যাব না, এই পরিচ্ছদ অপবিত্র করা উচিত নয়। অগস্ত্য বললেন, কল্যাণী, তোমার পিতার যে ধন আছে তা আমার নেই। আমার তপস্যার যাতে ক্ষয় না হয় এমন উপায়ে আমি ধন আহরণ করতে যাচ্ছি।
শ্রুতর্বা রাজার কাছে এসে অগস্ত্য বললেন, আমি ধনার্থী, অন্যের ক্ষতি না করে আমাকে যথাশক্তি ধন দিন। রাজা বললেন, আমার যত আয় তত ব্যয়। এই রাজার কাছে ধন নিলে অপরের কষ্ট হবে এই বুঝে অগস্ত্য তাকে সঙ্গে নিয়ে একে একে ব্রধশ্ব ও সদস্যু রাজার কাছে গেলেন। তারা জানালেন যে তাদেরও আয়-ব্যয় সমান, উদ্বৃত্ত কিছু থাকে না। তার পর রাজারা পরামর্শ করে বললেন, ইল্বল দানব সর্বাপেক্ষা ধনী, চলুন আমরা তার কাছে যাই।
অগস্ত্য ও তার সঙ্গী তিন রাজাকে ইল্বল সসম্মানে গ্রহণ করলে। রাজারা ব্যাকুল হয়ে দেখলেন, বাতাপি মেঘ হয়ে গেল, ইল্বল তাকে কেটে অতিথি-সেবার জন্য রন্ধন করলে। অগস্ত্য বললেন, আপনারা বিষণ্ণহবেন না, আমিই এই অসুরকে খাব। তিনি প্রধান আসনে উপবিষ্ট হলে ইল্বল তাঁকে সহাস্যে মাংস পরিবেশন করলে। অগস্ত্য সমস্ত মাংস খেয়ে ফেললে ইন্বল তার ভ্রাতাকে ডাকতে লাগল। তখন মহামেঘের ন্যায় গর্জন করে মহাত্মা অগস্ত্যের অধোদেশ থেকে বায়ু নির্গত হল। ইন্বল বার বার বললে, বাতাপি, নিষ্ক্রান্ত হও। অগস্ত্য হেসে বললেন, কি করে নিষ্ক্রান্ত হবে, আমি তাকে জীর্ণ করে ফেলেছি।
ইল্বল বিষাদগ্রস্ত হয়ে কৃতাঞ্জলিপুটে বললে, আপনারা কি চান বলুন। অগস্ত্য বললেন, আমরা জানি যে তুমি মহাধনী। অন্যের ক্ষতি না করে আমাদের যথাশক্তি ধন দাও। ইল্বল বললে, আমি যা যা দান করতে চাই তা যদি বলতে পারেন তবেই দেব। অগস্ত্য বললেন, তুমি এই রাজাদের প্রত্যেককে দশ হাজার গরু আর দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং আমাকে তার দ্বিগুণ দিতে চাও, তা ছাড়া একটি হিরন্ময় রথ ও দুই অশ্বও আমাকে দিতে ইচ্ছা করেছ। ইল্বল দুঃখিতমনে এই সকল ধন এবং তারও অধিক দান করলে। তখন সমস্ত ধন নিয়ে অগস্ত্য তার আশ্রমে এলেন, রাজারাও বিদায় নিয়ে চ’লে গেলেন।
লোপামুদ্রাকে তার অভীষ্ট শয্যা ও বসনভূষণাদি দিয়ে অগস্ত্য বললেন, তুমি কি চাও-সহস্র পুত্র, শত পুত্র, দশ পুত্র, না সহস্র পুত্রের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এক পুত্র ? লোপামুদ্রা এক পুত্র চাইলেন। তিনি গর্ভবতী হয়ে সাত মাস পরে দৃঢ়স্যু নামে পুত্র প্রসব করলেন। এই পুত্র মহাকবি মহাতপা এবং বেদাদি শাস্ত্রে অভিজ্ঞ হয়েছিলেন। এর অন্য নাম ইধ্নবাহ।
উপাখ্যান শেষ করে লোমশ বললেন, যুধিষ্ঠির, অগস্ত্য এইরূপে প্রহাদ-বংশজাত বাতাপিকে বিনষ্ট করেছিলেন। এই তাঁর আশ্রম। এই পুণ্যসলিলা ভাগীরথী, পতাকার ন্যায় বায়ুতে আন্দোলিত এবং পবর্তশৃঙ্গে প্রতিহত হয়ে শিলাতলে নাগিনীর ন্যায় নিপতিত হচ্ছেন। তোমরা এই নদীতে ইচ্ছানুসারে অবগাহন কর।
তার পর পাণ্ডবগণ ভৃগুতীর্থে এলে লোমশ বললেন, পুরাকালে রামরূপে বিষ্ণু ভার্গব পরশুরামের তেজোহরণ করেছিলেন। পরশুরাম ভীত ও লজ্জিত হয়ে মহেন্দ্র পর্বতে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। এক বৎসর পরে পিতৃগণ তাকে নিস্তেজ গর্বহীন ও দুঃখিত দেখে বললেন, পুত্র, বিষ্ণুর নিকটে তোমার দর্পপ্রকাশ উচিত হয় নি। তুমি দীপ্তোদ তীর্থে যাও, সেকানে সত্যযুগে তোমার প্রপিতামহ ভৃগু তপস্যা করেছিলেন। সেই তীর্থে পবিত্র বধূসর নদীতে স্নান করলে তোমার পূর্বের তেজ ফিরে পাবে। পিতৃগণের উপদেশ অনুসারে পরশুরাম এই ভৃগুতীর্থে স্নান করে তার পূর্বতেজ লাভ করেছিলেন।
২২। দধীচ-বৃত্রবধ-সমুদ্ৰশোষণ
যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে লোমশ অগস্ত্যের কীর্তিকথা আরও বললেন-সত্যযুগে কালেয় নামে এক দল দুর্দান্ত দানব ছিল, তারা বৃত্রাসুরের সহায়তায় দেবগণকে আক্রমণ করে। ব্রহ্মার উপদেশে দেবগণ নারায়ণকে অগ্রবর্তী করে দধীচ মুনির কাছে গেলেন এবং চরণ বন্দনা করে তার অস্থি প্রার্থনা করলেন। দধীচ প্রীতমনে তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগ করলেন, দেবগণ তার অস্থি নিয়ে বিশ্বকর্মাকে দিলেন। সেই অস্থি দিয়ে। বিশ্বকর্মা ভীমরূপ বজ্র নির্মাণ করলেন। ইত্র সেই বজ্র ধারণ করে দেবগণ কর্তৃক রক্ষিত হয়ে বৃত্রকে আক্রমণ করলেন, কিন্তু দেবতারা কালেয় দানবদের বেগ সইতে পারলেন না, রণে ভঙ্গ দিয়ে পলায়ন করলেন। তখন মোহাবিষ্ট ইন্দ্রের বলবৃদ্ধির জন্য নারায়ণ ও মহর্ষিগণ নিজ নিজ তেজ দিলেন। দেবরাজ বলান্বিত হয়েছেন জেনে বৃত্র ভয়ংকর সিংহনাদ করে উঠল, সেই শব্দে সন্ত্রস্ত হয়ে ইন্দ্র অবশভাবে বজ্র নিক্ষেপ করলেন। মহাসুর বৃত্র নিহত হয়ে মন্দর পর্বতের ন্যায় ভূপতিত হল। তার পর দেবতারা ত্বরিত হয়ে দৈত্যদের বধ করতে লাগলেন, তারা পালিয়ে গিয়ে সমুদ্রগর্ভে আশ্রয় নিলে।
কালের দানবগণ রাত্রিকালে সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এসে তপস্বী ব্রাহ্মণদের বধ করতে লাগল। বিষ্ণুর উপদেশে ইন্দ্রাদি দেবগণ অগস্ত্যের কাছে গিয়ে বললেন, আপনি মহাসমুদ্র পান করে ফেলুন, তা হলে আমরা কালেয়গণকে বধ করতে পারব। অগস্ত্য সম্মত হয়ে দেবতাদের সঙ্গে ফেনময় তরঙ্গায়িত জলজন্তুসমাকুল সমুদ্রের তীরে এলেন এবং জলরাশি পান করলেন। দেবতারা দানবদের বধ করলেন, হতাবশিষ্ট কয়েকজন কালেয় বসুধা বিদীর্ণ করে পাতালে আশ্রয় নিলে। অনন্তর দেবগণ অগস্ত্যকে বললেন, আপনি যে জল পান করেছেন তা উদগার করে সমুদ্র আবার পূর্ণ করুন। অগস্ত্য বললেন, সে জল জীর্ণ হয়ে গেছে, তোমরা অন্য ব্যবস্থা কর। তখন ব্রহ্মা দেবগণকে আশ্বাস দিলেন যে বহুকাল পরে মহারাজ ভগীরথ। সমুদ্রকে আবার জলপূর্ণ করবেন।।
একদা বিন্ধ্যপর্বত সূর্যকে বললে, উদয় ও অস্তের সময় তুমি যেমন মেরুপর্বত প্রদক্ষিণ কর সেইরূপ আমাকেও প্রদক্ষিণ কর। সূর্য বললেন, আমি স্বেচ্ছায় মেরু প্রদক্ষিণ করি না, এই জগতের যিনি নির্মাতা, তাঁরই বিধানে করি। বিন্ধ্য ক্রুদ্ধ হয়ে সহসা বাড়তে লাগল, যাতে চন্দ্ৰসূর্যের পথরোধ হয়। দেবতারা অগস্ত্যের শরণ নিলেন। অগস্ত্য তার পত্নীর সঙ্গে বিন্ধ্যের কাছে গিয়ে বললেন, আমি কোনও কার্যের জন্য দক্ষিণ দিকে যাব, তুমি আমাকে পথ দাও। আমার ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি অপেক্ষা কর, তার পর ইচ্ছামত বর্ধিত হয়ো। অগস্ত্য দক্ষিণ দিকে চ’লে গেলেন, কিন্তু আর ফিরলেন না, সেজন্য বিন্ধ্যপর্বতেরও আর বৃদ্ধি হল না।
২৩। সগর রাজা-ভগীরথের গঙ্গানয়ন
যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে লোমশ এই আখ্যান বললেন।-ইক্ষাকুবংশে সগর নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি পত্নীদের সঙ্গে কৈলাস পর্বতে গিয়ে পুত্রকামনায় কঠোর তপস্যা করেন। মহাদেবের বরে তার এক পত্নীর গর্ভে ষাট হাজার পুত্র এবং আর এক পত্নীর গর্ভে একটি পুত্র হল। বহুকাল পরে সগর অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞের অশ্ব সগরের ষাট হাজার পুত্র কর্তৃক রক্ষিত হয়ে বিচরণ করতে করতে জলশূন্য সমুদ্রের তীরে এসে অন্তর্হিত হয়ে গেল। এই সংবাদ শুনে সগর তাঁর পুত্রদের আদেশ দিলেন, তোমরা সকলে সকল দিকে অপহৃত অশ্বের অন্বেষণ কর। সগরপুত্রগণ যজ্ঞশ্ব কোথাও না পেয়ে সমুদ্র খনন করতে লাগলেন, অসুর নাগ রাক্ষস এবং অন্যান্য অসংখ্য প্রাণী নিহত হল। অবশেষে তারা সমুদ্রের উত্তরপূর্ব দেশ বিদীর্ণ করে পাতালে গিয়ে সেই অশ্ব এবং তার নিকটে তেজোরাশির ন্যায় দীপ্যমান মহাত্মা কপিলকে দেখতে পেলেন। সগরপুত্রগণ চোর মনে করে কপিলের প্রতি সক্রোধৈ ধাবিত হলেন, কিন্তু তাঁর দৃষ্টির তেজে তখনই ভস্ম হয়ে গেলেন।
সগররাজার দ্বিতীয়া পত্নী শৈব্যার গর্ভে জাত পুত্রের নাম অসমঞ্জ। ইনি দুর্বল বালকদের ধরে ধরে নদীতে ফেলে দিতেন সেজন্য সগর তাকে নির্বাসিত করেন। অসমঞ্জর পুত্রের নাম অংশুমান। নারদের নিকট ষাট হাজার পুত্রের মৃত্যুসংবাদ শুনে সগর শোকে সন্তপ্ত হয়ে পৌত্র অংশুমানকে বললেন, তুমি যজ্ঞশ্ব খুঁজে নিয়ে এসে আমাদের নরক থেকে উদ্ধার কর। অংশুমান পাতালে গিয়ে কপিলকে প্রণাম করে যজ্ঞা ও পিতৃব্যগণের তর্পণের জন্য জল চাইলেন। কপিল প্রসন্ন হয়ে বললেন, তুমি অশ্ব নিয়ে গিয়ে সগরের যজ্ঞ সমাপ্ত কর। তোমার পিতৃব্যগণের উদ্ধারের জন্য তোমার পৌত্র মহাদেবকে তুষ্ট করে স্বর্গ থেকে গঙ্গা আনবেন।
অংশুমান ফিরে এলে সগরের যজ্ঞ সমাপ্ত হল, তিনি সমুদ্রকে নিজের পুত্ররূপে (১) কল্পনা করলেন। সগর স্বর্গারোহণ করলে অংশুমান রাজা হলেন। তাঁর পুত্র দিলীপ, দিলীপের পুত্র ভগীরথ। ভগীরথ রাজ্যলাভ করে মন্ত্রীদের উপর রাজকার্যের ভার দিয়ে হিমালয়ে গিয়ে গঙ্গার আরাধনা করতে লাগলেন। সহস্র দিব্য বৎসর অতীত হলে গঙ্গা মূর্তিমতী হয়ে দেখা দিলেন।
ভগীরথ তাকে বললেন, আমার পূর্বপুরুষ ষাট হাজার সগরপুত্র কপিলের শাপে ভস্মীভূত হয়েছেন, আপনি তাদের দেহাবশেষ জলসিক্ত করুন তবে তারা স্বর্গে যেতে পারবেন। গঙ্গা বললেন, মহারাজ, তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করব, এমন তুমি মহাদেবকে তপস্যায় তুষ্ট করে এই বর চাও, যেন পতনকালে আমাকে তিনি মস্তকে ধারণ করেন। ভগীরথ কৈলাস পর্বতে গিয়ে কঠোর তপস্যায় মহাদেবকে তুষ্ট করলেন, মহাদেব গঙ্গাকে ধারণ করতে সম্মত হলেন।
ভগীরথ প্রণত হয়ে সংযতচিত্তে গঙ্গাকে স্মরণ করলেন। হিমালয়কন্যা পুণ্যতোয়া গঙ্গা মৎস্যাদি জলজন্তু সহিত গগনমেখলার ন্যায় মহাদেবের ললাটে পতিত হলেন এবং ত্রিধা বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হ’তে লাগলেন। ভগীরথ তাঁকে পথ দেখিয়ে সগরসন্তানগণের ভস্মরাশির নিকট নিয়ে গেলেন। গঙ্গার পবিত্র জলে সিক্ত হয়ে সগরসন্তানগণ উদ্ধার লাভ করলেন, সমুদ্র পুনর্বার জলপূর্ণ হল , ভগীরথ গঙ্গাকে নিজ দুহিতারূপে কল্পনা করলেন।
** (১) ষাট হাজার সন্তানের ভস্মের আধার এজন্য সমুদ্র সগরের পুত্ররূপে কল্পিত এবং ‘সাগর’ নামে খ্যাত।
২৪। ঋষ্যশৃঙ্গের উপাখ্যান
পাণ্ডবগণ নন্দা ও অপরনন্দা নদী এবং ঋষভকূট পর্বত অতিক্রম করে কৌশিকী নদীর তীরে এলেন। লোমশ বললেন, ওই বিশ্বামিত্রের আশ্রম দেখা যাচ্ছে। কশ্যপগোত্রজ মহাত্মা বিভাণ্ডকের আশ্রমও এইখানে ছিল। তাঁর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের তপস্যার প্রভাবে ‘ইন্দ্র অনাবৃষ্টির কালেও জলবর্ষণ করেছিলেন। তাঁর আখ্যান বলছি শোন।-
একদিন বিভান্ডক মুনি দীর্ঘকাল তপস্যায় শ্রান্ত হয়ে কোনও মহাহ্রদে স্নান করছিলেন এমন সময় উর্বশী অপ্সরাকে দেখে তিনি কামাবিষ্ট হলেন।
তৃষিতা হরিণী জলের সঙ্গে বিভান্ডকের শুক্র পান করে গর্ভিণী হল এবং যথাকালে ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রসব করলে। এই মুনিকুমারের মস্তকে একটি শৃঙ্গ ছিল, তিনি সর্বদা ব্রহ্মচর্যে নিরত থাকতেন এবং পিতা বিভাণ্ডক ভিন্ন অন্য মানুষও দেখেন নি। এই সময়ে অঙ্গদেশে লোমপাদ নামে এক রাজা ছিলেন, তিনি দশরথের সখা। আমরা শুনেছি, লোমপাদ ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতের প্রতি অসদাচরণ করেছিলেন সেজন্য ব্রাহ্মণগণ তাকে ত্যাগ করেন এবং ইন্দ্রও জলবর্ষণে বিরত হন, তার ফলে প্রজারা কষ্টে পড়ে। একজন মুনি রাজাকে বললেন, আপনি প্রায়শ্চিত্ত করে ব্রাহ্মণদের কোপ শান্ত করুন এবং মুনিকুমার ঋষ্যশৃঙ্গকে আনান, তিনি আপনার রাজ্যে এলে তখনই বৃষ্টিপাত হবে।
লোমপাদ প্রায়শ্চিত্ত করে ব্রাহ্মণদের প্রসন্ন করলেন এবং ঋষ্যশৃঙ্গকে আবার জন্য শাস্ত্রজ্ঞ কর্মকুশল মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তিনি প্রধান প্রধান বেশ্যাদের ডেকে আনিয়ে বললেন, তোমরা ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রলোভিত করে আমার রাজ্যে নিয়ে এস। বেশ্যারা ভীত হয়ে জানালে যে তা তাসাধ্য। তখন এক বৃদ্ধ-বেশ্যা বললে, মহারাজ, আমি সেই তপোধনকে নিয়ে আসব, আমার যা যা আবশ্যক ত আমাকে দিন। রাজার নিকট সমস্ত প্রয়োজনীয় বস্তু ও ধনরত্নাদি পেয়ে সেই বৃদ্ধবেশ্যা একটি নৌকায় কৃত্রিম বৃক্ষ গুল্ম লতা ও পুষ্পফল দিয়ে সাজিয়ে রমণীয় আশ্রম নির্মাণ করলে এবং কয়েকজন রূপযৌবনবতী রমণীকে সঙ্গে নিয়ে বিভাণ্ডকের আশ্রমের অদূরে এসে নৌকা বাঁধলে।
বিভাণ্ডক তার আশ্রমে নেই জেনে নিয়ে সেই বৃদ্ধা তার বুদ্ধিমতী কন্যাকে উপদেশ দিয়ে পাঠিয়ে দিলে। বেশ্যাকন্যা ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে গিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করে বললে, আপনারা এই আশ্রমে সুখে আছেন তো? ফলমূলের অভাব নেই তো? আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, আপনাকে জ্যোতিঃপুঞ্জের ন্যায় দেখছি, আপনি আমার বন্দনীয়, পাদ্য ফল মূল দিয়ে আমি আপনার যথাবিধি সৎকার করব। এই কৃষ্ণাজিনাবৃত সুখাসনে সুখে উপবেশন করুন। আপনার আশ্রম কোথায়? আপনি দেবতার ন্যায় কোন্ ব্রত আচরণ করছেন?
বেশ্যাকন্যা বললে, এই ত্রিযোজনব্যাপী পর্বতের অপর দিকে আমার রমণীয় আশ্রম আছে। আমার স্বধর্ম এই, যে আমি অভিবাদন বা পাদ্য জল গ্রহণ করতে পারি না। আপনি আমাকে অভিবাদন করবেন না, আমিই করব, আমার ব্রত অনুসারে আপনাকে আলিঙ্গন করব। ঋষ্যশৃঙ্গ বললেন, আমি আপনাকে পক ভল্লাতক আমলক করূষক ইদ ধন্বন ও প্রিয়লক ফল দিচ্ছি, আপনি ইচ্ছানুসারে ভোজন করুন। বেশ্যাকন্যা উপহৃত ফলগুলি বর্জন করে ঋষ্যশৃঙ্গকে মহামূল্য সুন্দর সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য, সুগন্ধ মাল্য, বিচিত্র উজ্জ্বল বসন এবং উত্তম পানীয় দিলে, তার পর নানা প্রকার। খেলা ও হাস্যপরিহাসে রত হল। সে লতার ন্যায় বক্র হয়ে কদুক নিয়ে খেলতে লাগল এবং ঋষ্যশৃঙ্গের গায়ে গা দিয়ে বার বার আলিঙ্গন করলে। মুনি-কুমারকে এইরূপে প্রলোভিত করে এবং তাকে বিকারগ্রস্ত দেখে সে অগ্নিহোত্র-হোম করবার ছলে ধীরে ধীরে চ’লে গেল।
ঋষ্যশৃঙ্গ মদনাবিষ্ট হয়ে অচেতনের ন্যায় শূন্যমনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। ক্ষণকাল পরে বিভান্ডক মুনি আশ্রমে ফিরে এলেন। তার চক্ষু পিঙ্গলবর্ণ, নখের অগ্রভাগ থেকে সমস্ত গাত্র রোমাবৃত। পুত্রকে বিহ্বল দেখে তিনি বললেন, বৎস, তোমাকে পূর্বের ন্যায় দেখছি না, তুমি চিন্তামগ্ন অচেতন ও কাতর হয়ে আছ কেন? কে এখানে এসেছিল? ঋষ্যশৃঙ্গ উত্তর দিলেন, একজন জটাধারী ব্রহ্মচারী এসেছিলেন, তিনি আকারে অধিক দীর্ঘ নন, খবও নন, তার বর্ণ সুবর্ণের ন্যায়, চক্ষু পদ্মপলাশতুল্য আয়ত, তিনি দেবপুত্রের ন্যায় সুন্দর। তার জটা সুদীর্ঘ, নির্মল কৃষ্ণবর্ণ, সুগন্ধ এবং স্বর্ণসূত্রে গ্রথিত। আকাশে বিদ্যুতের ন্যায় তাঁর কণ্ঠে কি এক বস্তু দুলছে, তার নীচে দুটি রোমহীন অতি মনোহর মাংসপিণ্ড আছে। তাঁর কটি পিপীলিকার মধ্যভাগের ন্যায় ক্ষীণ, পরিধেয় চীরবসনের ভিতরে সুবর্ণমেখলা দেখা যাচ্ছিল। আমার এই জপমালার ন্যায় তার চরণে ও হস্তে শব্দকারী আশ্চর্য মালা আছে। তার পরিধেয় অতি অদ্ভুত, আমার চীরবসনের মতন নয়। তার মুখ সুন্দর, কণ্ঠস্বর কোকিলের তুল্য, তাঁর বাক্য শুনলে আনন্দ হয়। তিনি তার ডান হাত দিয়ে একটি গোলাকার ফলকে বার বার আঘাত করছিলেন, সেই ফলটি ভূমি থেকে লাফিয়ে উঠছিল। সেই দেবপুত্রের উপর আমার অত্যন্ত অনুরাগ হয়েছে, তিনি আমাকে আলিঙ্গন করে আমার জটা ধরে মুখে ঠেকিয়ে একপ্রকার শব্দ করলেন, তাতে আমার হর্ষ হল। তিনি যেসব ফল আমাকে খেতে দিয়েছিলেন তার ত্বক আর বীজ নেই, আমাদের আশ্রমের ফল তেমন নয়। তার প্রদত্ত সুস্বাদু জল পান করে আমার অত্যন্ত আনন্দ হল , বোধ হল যেন পৃথিবী ঘুরছে। এইসকল বিচিত্র সুগন্ধ মালা তিনি ফেলে গেছেন, তার বিরহে আমি অসুখী হয়েছি, আমার গাত্র যেন দগ্ধ হচ্ছে। পিতা, আমি তার কাছে যেতে চাই, তার ব্রহ্মচর্য কি প্রকার ? আমি তার সঙ্গেই তপস্যা করব।
বিভান্ডক বললেন, ওরা রাক্ষস, অদ্ভুত রূপ ধারণ করে তপস্যার বিঘ্ন জন্মায়, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করাও তপস্বীদের উচিত নয়। পুত্র, অসৎ লোকেই সুরাপান করে, মুনিদের তা পান করা অনুচিত, আর এই সকল মাল্যও আমাদের অব্যবহার্য।
ওরা রাক্ষস, এই বলে পুত্রকে নিবারণ করে বিভাণ্ডক বেশ্যাকে খুঁজতে গেলেন, কিন্তু তিন দিনেও না পেয়ে আশ্রমে ফিরে এলেন। তারপর যখন তিনি ফল আহরণ করতে গেলেন তখন বেশ্যাকন্যা আবার আশ্রমে এল। ঋষ্যশৃঙ্গ হৃষ্ট ও ব্যস্ত হয়ে তাকে বললেন, আমার পিতা ফিরে আসবার আগেই আমরা আপনার আশ্রমে যাই চলুন। বেশ্যা তাকে নৌকায় নিয়ে গেল এবং বিবিধ উপায়ে তাকে প্রলোভিত করে অঙ্গদেশের অভিমুখে যাত্রা করলে। নৌকা যেখানে উপস্থিত হল তার তীরদেশে লোমপাদ এক বিচিত্র আশ্রম নির্মাণ করলেন। রাজা ঋষ্যশৃঙ্গকে অন্তঃপুরে নিয়ে যাওয়ামাত্র দেবরাজ প্রচুর বৃষ্টিপাত করলেন। অঙ্গরাজের কামনা পূর্ণ হল তিনি তাঁর কন্যা শান্তাকে ঋষ্যশৃঙ্গের হস্তে সম্প্রদান করলেন।
বিভান্ডক আশ্রমে ফিরে এসে পুত্রকে দেখতে না পেয়ে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। লোমপাদের আজ্ঞায় এই কার্য হয়েছে এইরূপ অনুমান করে তিনি অঙ্গরাজধানী চম্পার অভিমুখে যাত্রা করলেন। শ্রান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে তিনি এক গোপপল্লীতে এলে গোপগণ তাকে যথোচিত সৎকার করলে, বিভাণ্ডক রাজার ন্যায় সুখে রাত্রিবাস করলেন। তিনি তুষ্ট হয়ে প্রশ্ন করলেন, গোপগণ, তোমরা কার প্রজা? লোমপাদের শিক্ষা অনুসারে তারা কৃতাঞ্জলি হয়ে উত্তর দিলে, মহর্ষি, এইসব পশু ও কৃষিক্ষেত্র আপনার পুত্রের অধিকারভুক্ত। এইরূপে সম্মান পেয়ে এবং মিষ্ট বাক্য শুনে বিভাণ্ডকের ক্রোধ দূর হল তিনি রাজধানীতে এসে লোমপাদ কর্তৃক পূজিত হয়ে এবং পুত্র-পুত্রবধূকে দেখে তুষ্ট হলেন। বিভাণ্ডকের আজ্ঞায় ঋষ্যশৃঙ্গ কিছুকাল অঙ্গরাজ্যে রইলেন এবং পুত্রজন্মের পর আবার পিতার আশ্রমে ফিরে গেলেন।
২৫। পরশুরামের ইতিহাস-কার্তবীৰ্মাৰ্জুন
পাণ্ডবগণ কৌশিকী নদীর তটদেশ থেকে যাত্রা করে গঙ্গাসাগরসংগম কলিঙ্গদেশস্থ বৈতরণী নদী প্রভৃতি তীর্থ দেখে মহেন্দ্র পর্বতে এলেন। যুধিষ্ঠির পরশুরামের অনুচর অকৃতব্রণকে বলেন, ভগবান পরশুরাম কখন তপস্বীদের দর্শন দেন? আমি তাকে দেখতে ইচ্ছা করি। অকৃতব্রণ বললেন, আপনার আগমন তিনি জানেন, শীঘ্রই তার দেখা পাবেন। চতুর্দশী ও অষ্টমী তিথিতে তিনি দেখা দেন, এই রাত্রি অতীত হলেই চতুর্দশী পড়বে। তার পর যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে অকৃতব্রণ পরশুরামের এই ইতিহাস বললেন।
হৈহয়রাজ কার্তবীর্যের সহস্র বাহু ছিল, মহর্ষি দত্রাত্রেয়র বরে তিনি স্বর্ণময় বিমান এবং পৃথিবীর সকল প্রাণীর উপর আধিপত্য লাভ করেছিলেন। তাঁর উপদ্রবে পীড়িত হয়ে দেবগণ ও ঋষিগণ বিযুকে বললেন, আপনি কার্তবীর্যকে বধ করে প্রাণীদের রক্ষা করুন। বিষ্ণু সম্মত হয়ে তাঁর স্বকীয় আশ্রম বদরিকায় গেলেন। এই সময়ে খ্যাতনামা মহাবল গাধি কান্যকুজে রাজত্ব করতেন, তার অপ্সরার ন্যায় রূপবতী একটি কন্যা ছিল। ভূগুপুত্র ঋচীক সেই কন্যাকে চাইলে গাধি বললেন, কৌলিক রীতি রক্ষা করা আমার কর্তব্য, আপনি যদি শুল্ক স্বরূপ আমাকে এক সহস্র দ্রুতগামী অশ্ব দেন যাদের কর্ণের এক দিক শ্যামবর্ণ এবং দেহ পাণ্ডুবর্ণ, তবে কন্যা দান করতে পারি। ঋচীক বরুণের নিকট ওইরূপ সহস্র অশ্ব চেয়ে নিয়ে গাধিকে দিলেন এবং তার কন্যা সত্যবতীকে বিবাহ করলেন।।
একদিন সপত্নীক মহর্ষি ভৃগু তার পুত্র ও পুত্রবধূকে দেখতে এলেন। ভৃগু হৃষ্ট হয়ে বধূকে বললেন, সৌভাগ্যবতী, তুমি বর চাও। সত্যবতী নিজের এবং তার মাতার জন্য পুত্র চাইলেন। ভৃগু বললেন, ঋতুস্নানের পর তোমার মাতা অশ্বত্থা বৃক্ষকে আলিঙ্গন করবেন, তুমি উড়ম্বর বৃক্ষকে করবে, এবং দুজনে এই দুই চরু ভক্ষণ করবে। সত্যবতী ও তার মাতা (গাধির মহিষী) বৃক্ষ আলিঙ্গন ও চরু ভক্ষণে বিপর্যয় করলেন। ভৃগু তা দিব্যজ্ঞানে জানতে পেরে সত্যবতীকে বললেন, তোমরা বিপরীত কার্য করেছ, তোমার মাতাই তোমাকে বঞ্চনা করেছেন। তোমার পুত্র ব্রাহ্মণ হলেও বৃত্তিতে ক্ষত্রিয় হবে, তোমার মাতার পুত্র ক্ষত্রিয় হলেও আচারে ব্রাহ্মণ হবে। সত্যবতী বার বার অনুনয় করলেন, আমার পুত্র যেন ক্ষত্রিয়াচারী না হয়, বরং আমার পৌত্র সেইরূপ হ’ক। ভৃগু বললেন, তাই হবে। জমদগ্নি নামে খ্যাত এই পুত্র কালক্রমে সমগ্র ধনুর্বেদ ও অস্ত্রপ্রয়োগবিধি আয়ত্ত করলেন। তার সঙ্গে রাজা প্রসেনজিতের কন্যা রেণুকার বিবাহ হল। রেণুকার পাঁচ পুত্র, তাদের মধ্যে কনিষ্ঠ রাম (বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম) গুণে শ্রেষ্ঠ।
একদিন রেণুকা স্নান করতে গিয়ে দেখলেন, মার্তিকাবত দেশের রাজা চিত্ররথ তাঁর পত্নীদের সঙ্গে জলক্রীড়া করছেন। চিত্তবিকারের জন্য ব্যস্ত ও ত্রস্ত হয়ে রেণুকা আশ্রমে ফিরে এলেন। পত্নীকে অধীর ও ব্রাহ্মীশ্রীবর্জিত দেখে জমদগ্নি ধিককার দিয়ে ভৎর্সনা করলেন এবং তাকে হত্যা করবার জন্য পুত্রদের একে একে আজ্ঞা দিলেন। মাতৃস্নেহে অভিভূত হয়ে চার পুত্র নীরবে রইলেন। জমদগ্নি ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের অভিশাপ দিলেন, তারা পশুপক্ষীর ন্যায় জড়বুদ্ধি হয়ে গেলেন। তার পর পরশুরাম আশ্রমে এলে জমদগ্নি তাকে বললেন, পুত্র, দুশ্চরিত্রা মাতাকে বধ কর, ব্যথিত হয়ো না। পরশুরাম কুঠার দিয়ে তার মাতার শিরচ্ছেদ করলেন। জমদগ্নি প্রসন্ন হয়ে বললেন, বৎস, আমার আজ্ঞায় তুমি দুষ্কর কর্ম করেছ, তোমার বাঞ্ছিত বর চাও। পরশুরাম এই বর চাইলেন—মাতা জীবিত হয়ে উঠুন, তার হত্যার স্মৃতি যেন না থাকে, আমার যেন পাপ-স্পর্শ না হয়, আমার ভ্রাতারা যেন তাদের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পান, আমি যেন যুদ্ধে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হই, এবং দীর্ঘায়ু লাভ করি। জমদগ্নি এই সকল বর দিলেন।
একদিন জমদগ্নির পুত্রগণ অন্যত্র গেলে রাজা কার্তবীর্য আশ্রমে এসে সবলে হোমধেনুর বৎস হরণ করলেন এবং আশ্রমের বৃক্ষসকল ভগ্ন করলেন। পরশুরাম আশ্রমে ফিরে এসে পিতার নিকট সমস্ত শুনে কার্তবীর্যের প্রতি ধাবিত হলেন এবং তীক্ষ্ণ ভল্লের আঘাতে তার সহস্র বাহু ছেদন করে তাকে বধ করলেন। তখন কার্তবীর্যের পুত্রগণ আশ্রমে এসে জমদগ্নিকে আক্রমণ করলেন। তিনি তপোনিষ্ঠ ছিলেন সেজন্য মহাবলশালী হয়েও যুদ্ধ করলেন না, অনাথের ন্যায় ‘রাম রাম’ বলে পুত্রকে ডাকতে লাগলেন। কার্তবীর্যের পুত্রগণ তাকে বধ করে চ’লে গেলেন।
পরশুরাম আশ্রমে ফিরে এসে পিতাকে নিহত দেখে বহু বিলাপ করলেন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করে একাকীই কার্তবীর্যের পুত্র ও অনুচরগণকে যুদ্ধে বিনষ্ট করলেন। তিনি একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করে সমস্তপঞ্চক প্রদেশে পাঁচটি রুধিরময় হ্রদ সৃষ্টি করে পিতৃগণের তর্পণ করলেন। অবশেষে পিতামহ ঋচীকের অনুরোধে তিনি ক্ষত্রিয়হত্যা থেকে নিবৃত্ত হলেন এবং এক মহাযজ্ঞ সম্পন্ন করে মহাত্মা কশ্যপকে একটি প্রকাণ্ড স্বর্ণময় বেদী দান করলেন। কশ্যপের অনুমতিক্রমে ব্রাহ্মণগণ সেই বেদী খণ্ড খণ্ড করে ভাগ করে নিলেন, সেজন্য তাঁদের নাম খাণ্ডবায়ন হল। তার পর ক্ষত্রিয়ান্তক পরশুরাম সমগ্র পৃথিবী কশ্যপকে দান করলেন। তদবধি তিনি এই মহেন্দ্র পর্বতে বাস করছেন।
চতুর্দশী তিথিতে মহাত্মা পরশুরাম পাণ্ডব ও ব্রাহ্মণদের দর্শন দিলেন। তার অনুরোধে যুধিষ্ঠির এক রাত্রি মহেন্দ্র পর্বতে বাস করে পরদিন দক্ষিণ দিকে যাত্রা করলেন।
২৬। প্রভাস-চ্যবন ও সুকন্যা-অশ্বিনীকুমারদ্বয়
পাণ্ডবগণ গোদাবরী নদী, দ্রবিড় দেশ, অগস্ত্য তীর্থ, সূপারক তীর্থ প্রভৃতি দর্শন। করে সুবিখ্যাত প্রভাসতীর্থে উপস্থিত হলেন। তাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে বলরাম ও কৃষ্ণ সসৈন্যে যুধিষ্ঠিরের কাছে এলেন। পাণ্ডবগণ ভূমিতে শয়ন করেন, তাদের গাত্র মলিন, এবং সুকুমারী দ্রৌপদীও কষ্টভোগ করছেন দেখে সকলে অতিশয় দুঃখিত হলেন। বলরাম কৃষ্ণ প্রত্যুম্ন শাম্ব সাত্যকি প্রভৃতি বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ যুধিষ্ঠির কর্তৃক যথাবিধি সম্মানিত হয়ে তাকে বেষ্টন করে উপবেশন করলেন।
গোদুগ্ধ কুন্দপুষ্প ইন্দু মৃণাল ও রজতের ন্যায় শুভ্রবর্ণ বলরাম বললেন, ধর্মাচরণ করলেই মঙ্গল হয় না, অধর্ম করলেই অমঙ্গল হয় না। মহাত্মা যুধিষ্ঠির জটা ও চীর ধারণ করে বনবাসী হয়ে ক্লেশ পাচ্ছেন, আর দুর্যোধন পৃথিবী শাসন করছেন, এই দেখে অল্পবুদ্ধি লোকে মনে করবে ধর্মের চেয়ে অধর্মের আচরণই ভাল। ভীষ্ম কৃপ দ্রোণ ও ধৃতরাষ্ট্রকে ধিক, পাণ্ডবদের বনে পাঠিয়ে তারা কি সুখ পাচ্ছেন? ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের নির্বাসন আর দুর্যোধনের বৃদ্ধি দেখে পৃথিবী বিদীর্ণ হচ্ছেন না কেন?
সাত্যকি বললেন, এখন বিলাপের সময় নয়, যুধিষ্ঠির কিছু না বললেও আমাদের যা কর্তব্য তা করব। আমরা ত্রিলোক জয় করতে পারি, বৃষ্ণি ভোজ অন্ধক প্রভৃতি যদুবংশের বীরগণ আজই সসৈন্য যাত্রা করে দুর্যোধনকে যমালয়ে পাঠান। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির তার প্রতিজ্ঞা পালন করুন, তার বনবাসের কাল সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত অভিমন্যু রাজ্য শাসন করবে।
কৃষ্ণ বললেন, সাত্যকি, আমরা তোমার মতে চলতাম, কিন্তু যা নিজ ভুবলে বিজিত হয়নি এমন রাজ্য যুধিষ্ঠির চান না। ইনি, এঁর ভ্রাতারা, এবং দ্রুপদকন্যা, কেউ স্বধর্ম ত্যাগ করবেন না।
যুধিষ্ঠির বললেন, সত্যই রক্ষণীয়, রাজ্য নয়। একমাত্র কৃষ্ণই আমাকে যথার্থভাবে জানেন, আমিও তাঁকে জানি। সাত্যকি, পুরুষশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ যখন মনে করবেন যে বলপ্রকাশের সময় এসেছে তখন তোমরা দুর্যোধনকে জয় ক’রো।
যাদবগণ বিদায় নিয়ে চ’লে গেলেন। যুধিষ্ঠিরাদি পুনর্বার যাত্রা করে পুণ্যতোয়া পয়োফী নদী অতিক্রম করে নর্মদার নিকটস্থ বৈদূর্য পর্বতে উপস্থিত হলেন। লোমশ এই আখ্যান বললেন।-মহর্ষি ভৃগুর পুত্র চ্যবন এই স্থানে দীর্ঘকাল তপস্যা করেছিলেন, তাঁর দেহ বল্মীক পিপীলিকা ও লতায় আবৃত হয়ে যায়। একদিন রাজা শর্ষাতি এখানে বিহার করতে এলেন, তার চার হাজার স্ত্রী এবং সুকন্যা নামে এক রূপবতী কন্যা ছিল। সুকন্যাকে সেই মনোরম স্থানে বিচরণ করতে দেখে চ্যবন আনন্দিত হয়ে ক্ষীণকণ্ঠে তাকে ডাকলেন। সুকন্যা শুনতে পেলেন না, তিনি বল্মীক্যুপের ভিতরে চ্যবনের দুই চক্ষু দেখতে পেয়ে বললেন, একি! তার পর কৌতূহল ও মোহের বশে কাটা দিয়ে বিদ্ধ করলেন। চ্যাবন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শর্ষাতির সৈন্যদের মলমূত্র রুদ্ধ করলেন। সৈন্যদের কষ্ট দেখে রাজা সকলকে জিজ্ঞাসা করলেন, বৃদ্ধ ক্রোধী চ্যবন ঋষি এখানে তপস্যা করেন, কেউ তার অপকার করে নি তো? সুকন্যা বললেন, বল্মীকস্তুপের ভিতরে খদ্যোতের ন্যায় দীপ্যমান কি রয়েছে দেখে আমি কণ্টক দিয়ে বিদ্ধ করেছি। শর্ষাতি তখনই চ্যবনের কাছে গিয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, আমার বালিকা কন্যা অজ্ঞানবশে আপনাকে পীড়া দিয়েছে, ক্ষমা করুন। চ্যবন বললেন, রাজা, তোমার কন্যা দর্প ও অবজ্ঞার বশে আমাকে বিদ্ধ করেছে, তাকে যদি দান কর তবে ক্ষমা করব। শর্যাতি বিচার না করেই তার কন্যাকে সমর্পণ করলেন।
সুকন্যা সযত্নে চ্যবনের সেবা করতে লাগলেন। একদিন অশ্বিনীকুমারদ্বয় সুকন্যাকে স্নানের পর নগ্নাবস্থায় দেখতে পেয়ে তাঁকে বললেন, ভাবিনী, তোমার ন্যায় সুন্দরী দেবতাদের মধ্যেও নেই। তোমার পিতা তোমাকে বৃদ্ধের হস্তে দিয়েছেন কেন? তুমি শ্রেষ্ঠ বেশভূষা ধারণের যোগ্য, জরাজর্জরিত অক্ষম চ্যবনকে ত্যাগ করে আমাদের একজনকে বরণ কর। সুকন্যা বললেন, আমি আমার স্বামীর প্রতি অনুরক্ত। অশ্বিনীকুমারদ্বয় বললেন, আমরা দেবচিকিৎসক, তোমার পতিকে যুবা ও রূপবান করে দেব, তার পর তিনি এবং আমরা এই তিন জনের মধ্যে একজনকে তুমি পতিত্বে বরণ ক’রো। সুকন্যা চ্যবনকে জানালে তিনি এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। তখন অশ্বিনীকুমারদ্বয় চ্যবনকে নিয়ে জলে প্রবেশ করলেন এবং মুহূর্তকাল পরে তিন জনেই দিব্য রূপ ও সমান বেশ ধারণ করে জল থেকে উঠলেন। সকলে তুল্যরূপধারী হলেও সুকন্যা চ্যবনকে চিনতে পেরে তংকেই বরণ করলেন। চ্যবন হৃষ্ট হয়ে অশ্বিনীদ্বয়কে বললেন, আপনারা আমাকে রূপবান যুবা করেছেন, আমি এই ভাষাকেও পেয়েছি। আমি দেবরাজের সমক্ষেই আপনাদের সোমপায়ী করব।
চ্যবনের অনুরোধে রাজা শর্ষাতি এক যজ্ঞ করলেন। চ্যবন যখন অশ্বিদ্বয়কে দেবার জন্য সোমরসের পাত্র নিলেন তখন ইন্দ্র তাকে বারণ করে বললেন, এঁরা দেবতাদের চিকিৎসক ও কর্মচারী মাত্র, মর্ত্যলোকেও বিচরণ করেন, এঁরা সোমপানের অধিকারী নন। চ্যবন নিরস্ত হলেন না, ঈষৎ হাস্য করে অশ্বিদ্বয়ের জন্য সোমপাত্র তুলে নিলেন। ইন্দ্র তখন বজ্রপ্রহারে উদ্যত হলেন। চ্যবন ইন্দ্রের বাহু স্তম্ভিত করে মন্ত্রপাঠ করে অগ্নিতে আহুতি দিলেন, অগ্নি থেকে মদ নামক এক মহাবীর্য মহাকায় ঘোরদর্শন কৃত্যা (১) উদ্ভূত হয়ে মুখব্যাদান করে ইন্দ্রকে গ্রাস করতে গেল। ভয়ে ওষ্ঠ লেহন করতে করতে ইন্দ্র চ্যবনকে বললেন, ব্রহ্মর্ষি, প্রসন্ন হন, আজ থেকে দুই অশ্বিনীকুমারও সোমপানের অধিকারী হবেন। চ্যবন প্রসন্ন হয়ে ইন্দ্রের স্তম্ভিত বাহুদ্বয় মুক্ত করলেন এবং মদকে বিভক্ত করে সুরাপান, স্ত্রী, দূত ও মৃগয়ায় স্থাপিত করলেন। শর্ষাতির যজ্ঞ সমাপ্ত হল , চ্যবন তার ভাষার সঙ্গে বনে চ’লে গেলেন।
** (১) অভিচার ক্রিয়ার জন্য আবির্ভূত দেবতা।
২৭। মান্ধাতা, সোমক ও জন্তুর ইতিহাস
পাণ্ডবগণ নানা তীর্থ দর্শন করে যমুনা নদীর তীরে উপস্থিত হলেন, যেখানে মান্ধাতা ও সোমক রাজা যজ্ঞ করেছিলেন। লোমশ এই ইতিহাস বললেন।
ইক্ষাক্রবংশে যুবনাশ্ব নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি মন্ত্রীদের উপর রাজ্যভার দিয়ে বনে গিয়ে সন্তানকামনায় যোগসাধনা করতে লাগলেন। একদিন তিনি ক্লান্ত ও পিপাসার্ত হয়ে চ্যবন মুনির আশ্রমে প্রবেশ করে দেখলেন যজ্ঞবেদীর উপর এক কলস জল রয়েছে। যুবনাশ্ব জল চাইলেন, কিন্তু তার ক্ষীণ কণ্ঠস্বর কেউ শুনতে পেলেন না। তখন তিনি জলপান করে অবশিষ্ট জল কলস থেকে ফেলে দিলেন। চ্যবন ও অন্যান্য মুনিরা নিদ্রা থেকে উঠে দেখলেন, কলস জলশূন্য। যুবনাশ্বের স্বীকারোক্তি শুনে চ্যবন বললেন, রাজা, আপনি অনুচিত কার্য করেছেন, আপনার পুত্রোৎপত্তির জন্যই এই তপঃসিদ্ধ জল রেখেছিলাম। জলপান করার ফলে আপনিই পুত্র প্রসব করবেন কিন্তু গর্ভধারণের ক্লেশ পাবেন না। শতবর্ষ পূর্ণ হলে যুবনাশ্বের বাম পার্শ্ব ভেদ করে এক সূর্যতুল্য তেজস্বী পুত্র নির্গত হল। দেবতারা শিশুকে দেখতে এলেন। তারা বললেন, এই শিশু কি পান করবে? ‘মাং স্যতি’-আমাকে পান করবে—এই বলে ইন্দ্র তার মুখে নিজের তর্জনী পুরে দিলেন, সে চুষতে লাগল। এজন্য তার নাম হল মান্ধাতা। মান্ধাতা বড় হয়ে ধনুর্বেদে পারদর্শী এবং বিবিধ দিব্যাস্ত্র ও অভেদ্য কবচের অধিকারী হলেন। স্বয়ং ইন্দ্র তাঁকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। মান্ধাতা ত্রিভুবন জয় এবং বহু যজ্ঞ করে ইন্দ্রের অর্ধার্সন লাভ করেছিলেন।
সোমক রাজার একশ ভার্যা ছিল। বৃদ্ধ বয়সে জন্তু নামে তাঁর একটি মাত্র পুত্র। হল , সোমকে শতপত্নী সর্বদা তাকে বেষ্টন করে থাকতেন। একদিন সেই বালক পিপীলিকার দংশনে কেঁদে উঠল, তার মাতারাও কাতর হয়ে কাঁদতে লাগলেন। রাজা সোমক সেই আর্তনাদ শুনে অন্তঃপুরে এসে পুত্রকে শান্ত করলেন। তারপর তিনি তাঁর পুরোহিত ও মন্ত্রিবর্গকে বললেন, এক পুত্রের চেয়ে পুত্র না থাকাই। ভাল, এক পুত্রে কেবলই উদবেগ হয়। অমি পুত্রার্থী হয়ে শত ভার্যার পাণিগ্রহণ করেছি, কিন্তু শুধু একটি পুত্র হয়েছে, এর চেয়ে দুঃখ আর কি আছে। আমার ও পত্নীদের যৌবন অতীত হয়েছে, আমাদের প্রাণ এখন একটিমাত্র বালককে আশ্রয় করে আছে। এমন উপায় কি কিছু নেই যাতে আমার শত পুত্র হ’তে পারে?
পুরোহিত বললেন, আমি এক যজ্ঞ করব, তাতে যদি আপনি আপনার পুত্র জন্তুকে আহুতি দেন তবে শীঘ্ৰ শত পুত্র লাভ করবেন। জন্তুও আবার তার মাতৃগর্ভে জন্মগ্রহণ করবে, তার বাম পার্শ্বে একটি কনকবর্ণ চিহু থাকবে। রাজা সম্মত হলে পুরোহিত যজ্ঞ আরম্ভ করলেন, রাজপত্নীরা জন্তুর হাত ধরে ব্যাকুল হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। যাজক (পুরোহিত) তখন বালককে সবলে টেনে নিয়ে কেটে ফেললেন এবং তার বসা দিয়ে যথাবিধি হোম করলেন। তার গন্ধ আঘ্রাণ করে রাজপত্নীরা শোকার্ত হয়ে সহসা ভূমিতে পড়ে গেলেন এবং সকলেই গর্ভবতী হলেন। যথাকালে সোমক শত পুত্র লাভ করলেন। জন্তু কনকবর্ণ চিক্ষু ধারণ করে তার ভূতপূর্ব মাতার গর্ভ থেকেই ভূমিষ্ট হল।
তারপর সেই যাজক ও সোমক দুজনেই পরলোকে গেলেন। যাজককে নরকভোগ করতে দেখে সোমক তাঁকে কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। যাজক বললেন, আমি আপনার জন্য যে যজ্ঞ করেছিলাম তারই এই ফল। তখন সোমক ধর্মরাজ যমকে বললেন, যাজককে মুক্তি দিন, এঁর পরিবর্তে আমিই নরকভোগ করব। যম বললেন, রাজা, একজনের পাপের ফল অন্যে ভোগ করতে পারে না। সোমক বললেন, এই ব্রহ্মাবাদী যাজককে ছেড়ে আমি পুণ্যফল ভোগ করতে চাই না, এঁর সঙ্গেই আমি স্বর্গে বা নরকে বাস করব। আমরা একই কর্ম করেছি, আমাদের পাপপুণ্যের ফল সমান হ’ক। তখন যমের সম্মতিক্রমে যাজকের সঙ্গে সোমকও নরকভোগ করলেন এবং পাপক্ষয় হলে দুজনেই মুক্ত হয়ে শুভলোক লাভ করলেন।
২৮। উশীনর, কপোত ও শ্যেন
যুধিষ্ঠিরাদি প্ৰসৰ্পণ ও প্লক্ষাবতরণ তীর্থ, সরস্বতী নদী, কুরুক্ষেত্র, সিন্ধু নদ, কাশ্মীরমণ্ডল, পরশুরামকৃত মানস সরোবরের দ্বার ক্রৌঞ্চরন্ধ্র, ভৃগুতুঙ্গ, বিতস্তা নদী প্রভৃতি দেখে যমুনার পার্শ্ববর্তী জলা ও উপজলা নদীর তীরে উপস্থিত হলেন।
লোমশ বললেন, রাজা উশীনর এখানে যজ্ঞ করেছিলেন। তাঁকে পরীক্ষা করবার জন্য ইন্দ্র শ্যেনরূপে এবং অগ্নি কপোতরূপে রাজার কাছে আসেন। শ্যেনের ভয়ে কপোত রাজার শরণাপন্ন হয়ে তার উরুদেশে লুকিয়ে রইল। শ্যেন বললে, আমি ক্ষুধার্ত, এই কপোত আমার বিহিত খাদ্য, ধর্মের লোভে ওকে রক্ষা করবেন না, তাতে আপনি ধর্মচ্যুত হবেন। উশীনর বললনে, এই কপোত ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমার কাছে এসেছে, শরণাগতকে আমি ত্যাগ করতে পারি না। শ্যেন বললে, যদি আমাকে আহার থেকে বঞ্চিত করেন তবে আমার প্রাণবিয়োগ হবে, আমি মরলে আমার স্ত্রীপুত্রাদিও মরবে। আপনি একটা কপোতকে রক্ষা করতে গিয়ে বহু প্রাণ নষ্ট করবেন। যে ধর্ম অপর ধর্মের বিরোধী তা কুধর্ম। রাজা, গুরুত্ব ও লঘুত্ব বিচার করে ধর্মাধর্ম নিরূপণ করা উচিত। উশীনর বললেন, বিহগশ্রেষ্ঠ, তোমার বাক্য কল্যাণকর, কিন্তু শরণাগতকে পরিত্যাগ করতে বলছ কেন? ভোজন করাই তোমার উদ্দেশ্য, তোমাকে আমি গো বৃষ বরাহ মৃগ মহিষ বা অন্য যে মাংস চাও তাই দেব। শ্যেন বললে, মহারাজ, বিধাতা এই কপোতকে আমার ভক্ষ্যরূপে নির্দিষ্ট করেছেন, আর কিছুই আমি খাব না। উশীনর বললেন, শিবিবংশের (১) এই সমৃদ্ধ রাজ্য অথবা যা চাও তাই তোমাকে দেব। শ্যেন বললে, কপোতের উপরে যদি আপনার এতই স্নেহ তবে তার সমপরিমাণ মাংস নিজের দেহ থেকে কেটে আমাকে দিন। উশীনর বললেন, শ্যেন, তোমার এই প্রার্থনাকে আমি অনুগ্রহ মনে করি। এই বলে তিনি তুলাযন্ত্রের এক দিকে কপোতকে রেখে অপর দিকে নিজের মাংস কেটে রাখলেন, কিন্তু বার বার মাংস কেটে দিলেও কপোতের সমান হল না। অবশেষে উশীনর নিজেই তুলায় উঠলেন।
তখন শ্যেন বললে, ধর্মজ্ঞ, আমি ইন্দ্র, এই কপোত অগ্নি; তোমার ধর্মজ্ঞান পরীক্ষার জন্য এখানে এসেছিলাম। জগতে তোমার এই কীর্তি চিরস্থায়ী হবে। এই বলে তাঁরা চ’লে গেলেন। ধর্মাত্মা উশীনর নিজের যশে পৃথিবী ও আকাশ আবৃত করে যথাকালে স্বর্গারোহণ করলেন।
** (১) উশীনর শিবিবংশীয়। ৪১-পরিচ্ছেদে উশীনরের পুত্রের নামও শিবি।
২৯। উদ্দালক, শ্বেতকেতু, কহোড়, অষ্টাবক্র ও বন্দী
লোমশ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এই দেখ উদ্দালকপুত্র শ্বেতকেতুর আশ্রম। ত্রেতাযুগে অষ্টাবক্র ও তাঁর মাতুল শ্বেতকেতু শ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ ছিলেন, তাঁরা জনক রাজার যজ্ঞে গিয়ে বরুণপুত্র বন্দীকে বিতর্কে পরাস্ত করেছিলেন। উদ্দালক ঋষি তাঁর শিষ্য কহোড়ের সঙ্গে নিজের কন্যা সুজাতার বিবাহ দেন। সুজাতা গর্ভবতী হলে গর্ভস্থ শিশু বেদপাঠরত কহোড়কে বললে, পিতা, আপনার প্রসাদে আমি গর্ভে থেকেই সর্ব শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি, আপনার পাঠ ঠিক হচ্ছে না। মহর্ষি কহোড় ক্রুদ্ধ হয়ে গর্ভস্থ শিশুকে শাপ দিলেন-তোর দেহ অষ্ট স্থানে বক্র হবে। কহহাড়ের এই পুত্র অষ্টাবক্র নামে খ্যাত হন, তিনি তার মাতুল শ্বেতকেতুর সমবয়স্ক ছিলেন।
গর্ভের দশম মাসে সুজাতা তার পতিকে বললেন, আমি নিঃস্ব, আমাকে অর্থসাহায্য করে এমন কেউ নেই, কি করে সন্তানপালন করব? কহোড় ধনের জন্য জনক রাজার কাছে গেলেন, সেখানে তর্ককুশল বন্দী তাকে বিচারে পরাস্ত করে জলে ডুবিয়ে দিলেন। এই সংবাদ পেয়ে উদ্দালক তার কন্যা সুজাতাকে বললেন, গর্ভস্থ শিশু যেন জানতে না পারে। জন্মগ্রহণ করে অষ্টাবক্র তাঁর পিতার বিষয় কিছুই জানলেন না, তিনি উদ্দালককে পিতা এবং শ্বেতকেতুকে ভ্রাতা মনে করতে লাগলেন। বার বৎসর বয়সে একদিন অষ্টাবক্র তার মাতামহের কোলে বসে আছেন এমন সময় শ্বেতকেতু তার হাত ধরে টেনে বললেন, এ তোমার পিতার কোল নয়। অষ্টাবক্র দুঃখিত হয়ে তাঁর মাতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার পিতা কোথায় ? তখন সুজাতা পূর্বঘটনা বললেন।
অষ্টাবক্র তাঁর মাতুল শ্বেতকেতুকে বললেন, চল, আমরা জনক রাজার যজ্ঞে যাই, সেখানে ব্রাহ্মণদের বিতর্ক শুনব, উত্তম অন্নও ভোজন করব। মাতুল ও ভাগিনেয় যজ্ঞসভার নিকটে এলে দ্বারপাল বাধা দিয়ে বললে, আমরা বন্দীর আজ্ঞাধীন, এই সভায় বালকরা আসতে পারে না, কেবল বিদ্বান বৃদ্ধ ব্রাহ্মণরাই পারেন। অষ্টাবক্র বললেন, আমরা ব্রতচারী, বেদজ্ঞ, জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানশাস্ত্রে পারদর্শী, অতএব আমরা বৃদ্ধই। দ্বারপাল পরীক্ষা করবার জন্য কতকগুলি প্রশ্ন বললে। অষ্টাবক্র তার যথাযথ উত্তর দিয়ে জনক রাজাকে সম্বোধন করে বললেন, মহারাজ, শুনেছি বন্দীর সঙ্গে বিতর্কে যাঁরা হেরে যান আপনার আজ্ঞায় তাদের জলে ডোবানো হয়। কোথায় সেই বন্দী? আমি তাকে পরাস্ত করব। জনক বললেন, বৎস, তুমি না জেনেই বন্দীকে জয় করতে চাচ্ছ, জ্ঞানগর্বিত অনেক পণ্ডিত তার সঙ্গে বিচার করতে এসে পরাস্ত হয়েছেন। অষ্টাবক্র বললেন, বন্দী আমার তুল্য প্রতিপক্ষ পাননি তাই বিচারসভায় সিংহের ন্যায় আস্ফালন করেন। আমার সঙ্গে বিতর্কে তিনি পরাস্ত হয়ে ভগ্নচক্র শকটের ন্যায় পথে পড়ে থাকবেন।
তখন রাজা জনক অষ্টাবক্রকে বিবিধ দুরূহ প্রশ্ন করলেন এবং তার সদুত্তর পেয়ে বললেন, দেবতুল্য বালক, বাকপটুতায় তোমার সমান কেউ নেই, তুমি বালক নও, স্থবির। তোমাকে আমি দ্বার ছেড়ে দিচ্ছি। অষ্টাবক্র সভায় প্রবেশ করে বন্দীর সঙ্গে বিচারে প্রবৃত্ত হলেন। অনেক প্রশ্ন উত্তর ও প্রত্যুত্তরের পর বন্দী অধোমুখে নীরব হলেন। সভায় মহা কোলাহল উঠল, ব্রাহ্মণগণ কৃতাঞ্জলি হয়ে সসম্মানে অষ্টাবত্রের কাছে এলেন। অষ্টাবক্র বললেন, এই বন্দী ব্রাহ্মণদের জয় করে জলে ডুবিয়েছিলেন, এখন এঁকেই আপনারা ডুবিয়ে দিন। বন্দী বললেন, আমি বরুণের পুত্র, জনক রাজার এই যজ্ঞের সমকালে বরুণও এক যজ্ঞ আরম্ভ করেছেন, আমি ব্রাহ্মণদের জলমজ্জিত করে সেই যজ্ঞ দেখতে পাঠিয়েছি, তারা এখন ফিরে আসছেন। আমি অষ্টাবক্রকে সম্মান করছি, তার জন্যই আমি (জলমজ্জিত হয়ে) পিতার সঙ্গে মিলিত হব। অষ্টাবক্রও তাঁর পিতা কহোড়কে এখনই দেখতে পাবেন।
অনন্তর কহোড় ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ বরুণের নিকট পূজা লাভ করে জনকের সভায় ফিরে এলেন। কহোড় বললেন, মহারাজ, এই জন্যই লোকে পুত্রকামনা করে, আমি যা করতে পারি নি আমার পুত্র তা করেছে। তার পর বন্দী সমুদ্রে প্রবেশ করলেন, পিতা ও মাতুলের সঙ্গে অষ্টাবক্রও উদ্দালকের আশ্রমে ফিরে এলেন। কহোড় তার পুত্রকে বললেন, তুমি শীঘ্র এই নদীতে প্রবেশ কর। পিতার আজ্ঞা পালন করে অষ্টাবক্র নদী থেকে অবক্ৰ সমান-অঙ্গ হয়ে উত্থিত হলেন। সেই কারণে এই নদী সমঙ্গা নামে খ্যাত।
৩০। ভরদ্বাজ, যবক্রীত, রৈভ্য, অর্বাবসু ও পরাবসু
লোমশ বললেন, যুধিষ্ঠির, এই সেই সমঙ্গা বা মধুবিলা নদী, বৃত্ৰবধের পর ইন্দ্র যাতে স্নান করে সর্ব পাপ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। এই ঋষিগণের প্রিয় কনখল পর্বত, এই মহানদী গঙ্গা, ওই রৈভ্যাশ্রম যেখানে ভরদ্বাজপুত্র যবক্রীত বিনষ্ট হয়েছিলেন। সেই ইতিহাস শোন।-
ভরদ্বাজ তার সখা রৈভ্যের নিকটেই বাস করতেন। রৈভ্য এবং তাঁর দুই পুত্র অর্বাবসু ও পরাবসু বিদ্বান্ ছিলেন, ভরদ্বাজ শুধু তপস্বী ছিলেন। ব্রাহ্মণগণ ভরদ্বাজকে সম্মান করেন না কিন্তু রৈভ্য ও তার দুই পুত্রকে করেন দেখে ভরদ্বাজপুত্র যবক্রীত কঠোর তপস্যায় নিরত হলেন। ইন্দ্র উদবিগ্ন হয়ে তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন তপস্যা করছ? যবক্রীত বললেন, দেবরাজ, গুরুমুখ থেকে বহুকালে বেদবিদ্যা লাভ করতে হয়; অধ্যয়ন না করেই যাতে বেদবিৎ হওয়া যায় সেই কামনায় আমি তপস্যা করছি। ইন্দ্র বলেলন, তুমি কুপথে যাচ্ছ, আত্মহত্যা ক’রো না, ফিরে গিয়ে গুরুর নিকট বেদবিদ্যা শেখ। যবক্রীত তথাপি তপস্যা করতে লাগলেন। ইন্দ্র আবার এসে তাকে নিরস্ত হ’তে বললেন কিন্তু যবক্রীত শুনলেন না। তখন ইন্দ্র অতিজরাগ্রস্ত দুর্বল যক্ষ্মাকান্ত ব্রাহ্মণের রূপে গঙ্গাতীরে এসে নিরন্তর বালুকামুষ্টি ফেলতে লাগলেন। যবক্রীত তাকে সহাস্যে প্রশ্ন করলেন ব্রাহ্মণ, নিরর্থক একি করছেন? ইন্দ্র বললেন, বৎস, আমি গঙ্গায় সেতু বাঁধছি, লোকে যাতে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। যবক্রীত বললেন, তপোধন, এই অসাধ্য কার্যের চেষ্টা করবেন না। ইন্দ্র বললেন, তুমি যেমন বেদজ্ঞ হবার আশায় তপস্যা করছ আমিও সেইরূপ বৃথা চেষ্টা করছি। যবক্রীত বললেন, দেবরাজ, যদি আমার তপস্যা নিরর্থক মনে করেন তবে বর দিন যেন আমি বিদ্বান হই। ইন্দ্র বর দিলেন—তোমরা পিতা-পুত্রে বেদজ্ঞান লাভ করবে।
যবক্রীত পিতার কাছে এসে বরলাভের বিষয় জানালেন। ভরদ্বাজ বললেন, বৎস, অভীষ্ট বর পেয়ে তোমার দর্প হবে, মন ক্ষুদ্র হবে, তার ফলে তুমি বিনষ্ট হবে। মহর্ষি রৈভ্য কোপনস্বভাব, তিনি যেন তোমার অনিষ্ট না করেন। যবক্রীত বললেন, আপনি ভয় পাবেন না, রৈভ্য আপনার তুল্যই আমার মান্য। পিতাকে এইরূপে সান্ত্বনা দিয়ে যবক্রীত মহানন্দে অন্যান্য ঋষিদের অনিষ্ট করতে লাগলেন।
একদিন বৈশাখ মাসে যবক্রীত রৈভ্যের আশ্রমে গিয়ে কিন্নরীর ন্যায় রূপবতী পরাবসুর পত্নীকে দেখতে পেলেন। যবক্রীত নির্লজ্জ হয়ে তাকে বললেন, আমাকে ভজনা কর। পরাবসুপত্নী ভয় পেয়ে তাই হবে’ বলে পালিয়ে গেলেন। রৈভ্য আশ্রমে এসে দেখলেন তার কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কাঁদছেন। যবক্ৰীতের আচরণ শুনে রৈভ্য অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তার দু গাছি জটা ছিড়ে অগ্নিতে নিক্ষেপ করলেন, তা থেকে পরাবসুপত্নীর তুল্য রূপবতী এক নারী এবং এক ভয়ংকর রাক্ষস উৎপন্ন হল। রৈভ্য তাদের আজ্ঞা দিলেন, যবক্রীতকে বধ কর। তখন সেই নারী যবক্ৰীতের কাছে গিয়ে তাঁকে মুগ্ধ করে কমণ্ডলু হরণ করলে। যবক্ৰীতের মুখ তখন উচ্ছিষ্ট ছিল। রাক্ষস শূল উদ্যত করে তার দিকে ধাবিত হল। যবক্রীত তার পিতার অগ্নিহোত্রগৃহে আশ্রয় নিতে গেলেন, কিন্তু সেই গৃহের রক্ষী এক অন্ধ শূদ্র তাকে সবলে দ্বারদেশে ধরে রাখলে। তখন রাক্ষস শূলের আঘাতে যবক্রীতকে বধ করলে।
পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ভরদ্বাজ বিলাপ করতে লাগলেন-পুত্র, তুমি ব্রাহ্মণদের জন্য তপস্যা করেছিলে যাতে তারা অধ্যয়ন না করেই বেদজ্ঞ হ’তে পারেন। ব্রাহ্মণের হিতার্থী ও নিরপরাধ হয়েও কেন তুমি বিনষ্ট হলে? আমার নিষেধ সত্ত্বেও কেন রৈভ্যের আশ্রমে গিয়েছিলে? আমি বৃদ্ধ, তুমি আমার একমাত্র পুত্র, তথাপি দুর্মতি রৈভ্য আমাকে পুত্রহীন করলেন। রৈভ্যও শীঘ্র তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র কর্তৃক নিহত হবেন। এইরূপ অভিশাপ দিয়ে ভরদ্বাজ পুত্রের অগ্নিসকার করে নিজেও অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দিলেন।
এই সময়ে রাজা বৃহদ্যুম্ন এক যজ্ঞ করছিলেন। সাহায্যের জন্য রৈভ্যের দুই পুত্র সেখানে গিয়েছিলেন, আশ্রমে কেবল রৈভ্য ও তার পুত্রবধূ ছিলেন। একদিন পরাবসু আশ্রমে আসছিলেন, তিনি শেষরাত্রে বনমধ্যে কৃষ্ণাজিনধারী পিতাকে দেখে মৃগ মনে করে আত্মরক্ষার্থ তাকে বধ করলেন। পিতার অন্ত্যেষ্টি করে পরাবসু যজ্ঞস্থানে ফিরে গিয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অর্বাবসুকে বললেন, আমি মৃগ মনে করে পিতাকে বধ করেছি। আপনি আশ্রমে ফিরে গিয়ে আমার হয়ে ব্রহ্মহত্যার প্রায়শ্চিত্ত করুন, আমি একাকীই এই যজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারব। অর্বাবসু সম্মত হয়ে আশ্রমে গেলেন এবং প্রায়শ্চিত্তের পর যজ্ঞস্থানে ফিরে এলেন। তখন পরাবসু হৃষ্ট হয়ে রাজা বৃহদদ্যুম্নকে বললেন, এই ব্রহ্মহত্যাকারী যেন আপনার যজ্ঞ না দেখে ফেলে, তা হলে আপনার অনিষ্ট হবে। রাজা অর্বাবসুকে তাড়িয়ে দেবার জন্য ভৃত্যদের আজ্ঞা দিলেন। অর্বাবসু বার বার বললেন, আমার এই ভ্রাতাই ব্রহ্মহত্যা করেছে, আমি তাকে সেই পাপ থেকে মুক্ত করেছি। তার কথায় কেউ বিশ্বাস করলে না দেখে অর্বাবসু বনে গিয়ে সূর্যের আরাধনায় নিরত হলেন। মূর্তিমান সূর্য ও অন্যান্য দেবগণ প্রীত হয়ে অর্বাবসুকে সংবর্ধনা এবং পরাবসুকে প্রত্যাখ্যান করলেন। অর্বাবসুর প্রার্থনায় দেবগণ বর দিলেন, তার ফলে রৈভ্য ভরদ্বাজ ও যবক্রীত পুনর্জীবিত হলেন, পরাবসুর পাপ দূর হল , রৈভ্য বিস্মৃত হলেন যে পরাবসু তাঁকে হত্যা করেছিলেন, এবং সূর্যমন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হল।
জীবিত হয়ে যবক্রীত দেবগণকে বললেন, আমি বেদাধ্যায়ী তপস্বী ছিলাম তথাপি রৈভ্য আমাকে কি করে বধ করতে পারলেন ? দেবতারা বললেন, তুমি গুরুর সাহায্য নিয়ে (কেবল তপস্যার প্রভাবে) বেদপাঠ করেছিলে, আর রৈভ অতি কষ্টে গুরুদের তুষ্ট করে দীর্ঘকালে বেদজ্ঞান লাভ করেছিলেন, সেজন্য তাঁর জ্ঞানই শ্রেষ্ঠ।
৩১। নরকাসুর-বরাহরূপী বিষ্ণু-বদরিকাশ্রম
উশীরবীজ ও মৈনাক পর্বত, শ্বেতগিরি এবং কালশৈল অতিক্রম করে যুধিষ্ঠিরাদি সপ্তধারা গঙ্গার নিকট উপস্থিত হলেন। লোমশ বললেন, এখন আমরা মণিভদ্র ও যজ্ঞরাজ কুবেরের স্থান কৈলাসে যাব। সেই দুর্গম প্রদেশ গন্ধর্ব কিন্নর যক্ষ ও রাক্ষসগণ কর্তৃক রক্ষিত, তোমরা সতর্ক হয়ে চল। যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম, তুমি দ্রৌপদী ও অন্য সকলের সঙ্গে এই গঙ্গাদ্বারে অপেক্ষা কর, কেবল আমি নকুল ও মহাতপা লোমশ এই তিনজন লঘু আহার করে ও সংযত হয়ে এই দুর্গম পথে যাত্রা করব। ভীম বললেন, অর্জুনকে দেখবার জন্য দ্রৌপদী এবং আমরা সকলেই উৎসুক হয়ে আছি। এই রাক্ষসসংকুল দুর্গম স্থানে আপনাকে আমি ছেড়ে দিতে পারি না। পাঞ্চালী বা নকুল-সহদেব যেখানে চলতে পারবেন না সেখানে আমি তাদের বহন করে নিয়ে যাব দ্রৌপদী সহাস্যে বললেন, আমি চলতে পারব, আমার জন্য ভেবো না।
যুধিষ্ঠিরাদি সকলে পুলিন্দরাজ সুবাহুর বিশাল রাজ্যে উপস্থিত হলেন এবং সসম্মানে গৃহীত হয়ে সেখানে সুখে রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন সূর্যোদয় হলে পাচক ও ভৃত্যদের পুলিন্দরাজের নিকটে রেখে তারা পদব্রজে হিমালয় পর্বতের দিকে যাত্রা করলেন। যেতে যেতে এক স্থানে এসে লোমশ বললেন, দূরে ওই যে কৈলাসশিখরতুল্য সুবিশাল সুদৃশ্য স্তুপ দেখছ তা নরকাসুরের অস্থি। নরকাসুর তপস্যার প্রভাবে ও বাহুবলে দুর্ধর্ষ হয়ে দেবগণের উপর উৎপীড়ন করত। ইন্দ্রের প্রার্থনায় বিষ্ণু হস্ত দ্বারা স্পর্শ করে সেই অসুরের প্রাণহরণ করেন।
তারপর লোমশ বরাহরূপী বিষ্ণুর এই আখ্যান বললেন।
-সত্যযুগে এক ভয়ংকর কালে আদিদেব বিষ্ণু যমের কার্য করতেন। তখন কেউ মরত না, কেবল জন্মগ্রহণ করত। পশুপক্ষী মানুষ প্রভৃতির সংখ্যা এত হল যে তাদের গুরুভারে বসুমতী শত যোজন নিম্নে চ’লে গেলেন। তিনি সর্বাঙ্গে ব্যথিত হয়ে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। তখন বিষ্ণু রক্তনয়ন একদন্ত ভীষণাকার বরাহের রূপে পৃথিবীকে দন্তে ধারণ করে শত যোজন ঊর্ধ্বে তুললেন। চরাচর সংক্ষোভিত হল , দেবতা ঋষি প্রভৃতি সকলেই কম্পিত হয়ে ব্রহ্মার নিকটে গেলেন, ব্রহ্মা আশ্বাস দিয়ে তাঁদের ভয় দূর করলেন।
পাণ্ডবগণ গন্ধমাদন পর্বতে উপস্থিত হলে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হ’তে লাগল, সকলে ভীত হয়ে বৃক্ষ বল্মীকস্তুপ প্রভৃতির নিকট আশ্রয় নিলেন। দুর্যোগ থেমে গেলে তারা আবার চলতে লাগলেন। এক ক্রোশ গিয়ে দ্রৌপদী শ্রান্ত ও অবশ হয়ে ভূমিতে পড়ে গেলেন। যুধিষ্ঠির তাকে কোলে নিয়ে বিলাপ করতে লাগলেন-আমি পাপী, আমার কর্মের ফলেই ইনি শোকে ও পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে ভূপতিত হয়েছেন। ধৌম্য প্রভৃতি ঋষিগণ শান্তির জন্য মন্ত্র জপ করলেন, পাণ্ডবগণ দ্রৌপদীকে মৃগচর্মের উপর শুইয়ে নানাপ্রকারে তার সেবা করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির ভীমকে বললেন, তুষারাবৃত দুর্গম গিরিপথে দ্রৌপদী কি করে যাবেন? ভীম স্মরণ করা মাত্র মহাবাহু ঘটোৎকচ সেখানে এসে করজোড়ে বললেন, আজ্ঞা করুন কি করতে হবে। ভীম বললেন, বৎস, তামার মাতা পরিশ্রান্ত হয়েছেন, এঁকে বহন করে নিয়ে চল। তুমি এঁকে স্কন্ধে নিয়ে আমাদের নিকটবর্তী হয়ে আকাশমার্গে চল, যেন এঁর কষ্ট না হয়।
ঘটোৎকচ দ্রৌপদীকে বহন করে নিয়ে চললেন, তাঁর অনুচর রাক্ষসরা পাণ্ডব ও ব্রাহ্মণদের নিয়ে চলল, কেবল মহর্ষি লোমশ নিজের প্রভাবে সিদ্ধমার্গে দ্বিতীয় ভাস্করের ন্যায় অগ্রসর হলেন। বদরিকাশ্রমে উপস্থিত হয়ে সকলে রাক্ষসদের স্কন্ধ থেকে নেমে নরনারায়ণের রমণীয় আশ্রম দর্শন করলেন। সেখানকার মহর্ষিগণ যুধিষ্ঠিরাদিকে সাদরে গ্রহণ করে যথাবিধি অতিথিসকার করলেন। সেই আনন্দজনক অতি দুর্গম স্থানে বিশাল বদরী তরুর নিকটে ভাগীরথী নদী প্রবাহিত হচ্ছে। যুধিষ্ঠিরাদি সেখানে পিতৃগণের তর্পণ করলেন।
৩২। সহস্রদল পদ্মভীম-হনুমান-সংবাদ
অর্জুনের প্রতীক্ষায় পাণ্ডবগণ ছ-রাত্রি শুদ্ধভাবে বদরিকাশ্রমে বাস করলেন। একদিন উত্তরপূর্ব দিক থেকে বায়ু দ্বারা বাহিত একটি সহস্রদল পদ্ম দেখে দ্রৌপদী ভীমকে বললেন, দেখ, এই দিব্য পদ্মটি কি সুন্দর ও সুগন্ধ! আমি ধর্মরাজকে এটি দেব। ভীম, আমি যদি তোমার প্রিয়া হই তবে এইপ্রকার বহু পদ্ম সংগ্রহ করে নিয়ে এস, আমি কাম্যক বনে নিয়ে যাব। এই বলে দ্রৌপদী পদ্মটি নিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন, ভীমও ধনুর্বাণহস্তে পদ্মবনের সন্ধানে যাত্রা করলেন।
ভীম মনোহর গন্ধমাদন পর্বতে উপস্থিত হলেন এবং আনন্দিতমনে লতাসমূহ সঞ্চালিত করে যেন খেলা করতে করতে চললেন। ভয়শূন্য হরিণের দল ঘাস মুখে করে তার দিকে সকৌতুকে চেয়ে রইল। যক্ষ ও গন্ধর্ব রমণীরা পতির পার্শ্বে বসে পরম রূপবান দীর্ঘকায় কাঞ্চনবর্ণ ভীমকে অদৃশ্যভাবে নানা ভঙ্গী সহকারে দেখতে লাগল। বনচর বরাহ মহিষ সিংহ ব্যাঘ্র শৃগাল প্রভৃতিকে সন্ত্রস্ত করে চলতে চলতে ভীম গন্ধমাদনের সানুদেশে এক রমণীয় সুবিশাল কদলীবন দেখতে পেলেন। তিনি গর্জন করে কদলীতরু উৎপাটিত করতে লাগলেন সহস্র সহস্র জলচর পক্ষী ভয় পেয়ে আর্দ্রপক্ষে আকাশে উড়তে লাগল। তাদের অনুসরণ করে তিনি পদ্ম ও উৎপল সমন্বিত একটি রমণীয় বিশাল সরোবরে উপস্থিত হলেন এবং উদ্দাম মহাগজের ন্যায় বহুক্ষণ জলক্রীড়া করে তীরে উঠে তাল ঠুকে শঙ্খধ্বনি করলেন। সেই শব্দ শুনে পর্বতগুহায় সুপ্ত সিংহসকল গর্জন করে উঠল এবং সিংহনাদে ত্রস্ত হয়ে হস্তীর দলও উচ্চ রব করতে লাগল।
হনুমান সেখানে ছিলেন। ভ্রাতা ভীমসেন স্বর্গের পথে এসে পড়েছেন দেখে। তার প্রাণরক্ষার জন্য হনুমান কদলীতরুর মধ্যবর্তী পথ রুদ্ধ করলেন। সেই সংকীর্ণ। পথ দিয়ে কেবল একজন চলতে পারে। হনুমান সেখানে শুয়ে পড়ে ছাই তুলে। তাঁর বিশাল লাঙ্গুল আস্ফোটন করতে লাগলেন, তার শব্দ পর্বতের গুহায় গুহায় প্রতিধ্বনিত হল। সেই শব্দ শুনে ভীমের রোমাঞ্চ হল , তিনি নিকটে এসে দেখলেন, কদলীবনের মধ্যে এক বিশাল শিলার উপরে হনুমান শুয়ে আছেন, তিনি বিদ্যুৎসম্পাতের ন্যায় দুর্নিরীক্ষ্য পিঙ্গলবর্ণ ও চঞ্চল। তার গ্রীবা স্থূল ও খর্ব, কটিদেশ ক্ষীণ, ওষ্ঠদ্বয় হ্রস্ব, জিহ্বা ও মুখ তাম্রবর্ণ, জ চঞ্চল, দন্ত শুক্ল ও তীক্ষ্ম, তিনি স্বর্গের পথ রোধ করে হিমাচ’লের ন্যায় বিরাজ করছেন। ভীম নির্ভয়ে হনুমানের কাছে গিয়ে ঘোর সিংহনাদ করলেন। মধুর ন্যায় পিঙ্গলবর্ণ চক্ষু ঈষৎ উন্মীলিত করে হনুমান ভীমের দিকে অবজ্ঞাভরে চাইলেন এবং একটু হেসে বললেন, আমি রুগ্ন, সুখে নিদ্রামগ্ন ছিলাম, কেন আমাকে জাগালে? আমি তির্যযোনি, ধর্ম জানি না, কিন্তু তুমি তো জান যে সকল প্রাণীকেই দয়া করা উচিত। তুমি কে, কোথায় যাবে? এই পথ দেবলোকে যাবার, মানুষের অগম্য।
ভীম নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তুমি কে? হনুমান বললেন, আমি বনের, তোমাকে পথ ছেড়ে দেব না। ভাল চাও তো নিবৃত্ত হও, নতুবা তোমার মৃত্যু হবে। ভীম বললেন, মৃত্যুই হ’ক বা যাই হ’ক, তুমি ওঠ, পথ ছেড়ে দাও, তাহলে আমিও তোমার হানি করব না। হনুমান বললেন, আমি রুগ্ন, ওঠবার শক্তি নেই, যদি নিতান্তই যেতে চাও তো আমাকে ডিঙিয়ে যাও। ভীম বললেন, নির্গুণ পরমাত্মা দেহ ব্যাপ্ত করে আছেন, তাকে অবজ্ঞা করে আমি তোমাকে ডিঙিয়ে যেতে পারি না; নতুবা হনুমান যেমন সাগর লঙ্ঘন করেছিলেন সেইরূপ আমিও তোমাকে লঙ্ঘন করতাম। হনুমান বললেন, কে সেই হনুমান? ভীম বললেন, তিনি আমার ভ্রাতা, মহাগুণবান বুদ্ধিমান ও বলবান, রামায়ণােক্ত অতি বিখ্যাত বানরশ্রেষ্ঠ। আমি তারই তুল্য বলশালী, তোমাকে নিগৃহীত করবার শক্তি আমার আছে। তুমি পথ দাও, নয়তো যমালয়ে যাবে। হনুমান বললেন, বার্ধক্যের জন্য আমার ওঠবার শক্তি নেই। তুমি দয়া কর, আমার লাঙ্গুলটি সরিয়ে গমন কর।
বানরটাকে যমালয়ে পাঠবেন স্থির করে ভীম তার পুচ্ছ ধরলেন, কিন্তু নড়াতে পারলেন না। তিনি দু হাত দিয়ে ধরে তোলবার চেষ্টা করলেন, তার চক্ষু বিস্ফারিত হল , ঘর্মস্রাব হ’তে লাগল, কিন্তু কোনও ফল হল না। তখন তিনি অধোবদনে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, কপিশ্রেষ্ঠ, প্রসন্ন হন, আমার কটুবাক্য ক্ষমা করুন। আমি শরণাপন্ন হয়ে শিষ্যের ন্যায় প্রশ্ন করছি—আপনি কে?
হনুমান তখন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, রাজলাভের পর রাম আমাকে এই বর দিয়েছিলেন যে, তাঁর কথা যত দিন জগতে প্রচলিত থাকবে তত দিন আমি জীবিত থাকব। সীতার বরে সর্বপ্রকার দিব্য ভোগ্যবস্তু আমি ইচ্ছা করলেই উপস্থিত হয়। কুরুনন্দন, এই দেবপথ মানুষের অগম্য সেজন্যই আমি রোধ করেছিলাম।
তুমি যে পদ্মের সন্ধানে এসেছ তার সরোবর নিকটেই আছে। ভীম হৃষ্ট হয়ে বললে আমার চেয়ে ধন্যতর কেউ নেই, কারণ আপনার দর্শন পেয়েছি। বীর, সমুদ্রলঙ্নে সময় আপনার যে রূপ ছিল তাই দেখিয়ে আমাকে কৃতার্থ করুন। হনুমান ভীমে প্রার্থনা পূরণ করলেন, তাঁর সেই আশ্চর্য ভীষণ বিন্ধ্যপর্বততুল্য দেহ দেখে ভী রোমাঞ্চিত হয়ে বললেন, প্রভু, আপনার বিপুল শরীর দেখলাম, এখন সংকুচি করুন। আপনি পার্শ্বে থাকতে রাম স্বয়ং কেন রাবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন? আপনি তো নিজের বাহুবলেই রাবণকে সদলবলে ধ্বংস করতে পারতেন। হনুমান বললেন তোমার কথা যথার্থ, রাবণ আমার সমকক্ষ ছিলেন না, কিন্তু আমি তাঁকে বধ করলে রামের কীর্তি নষ্ট হত। ভীম, এই পদ্মবনে যাবার পথ, এখান দিয়ে গেলে তুমি কুবেরের উদ্যান দেখতে পাবে, কিন্তু তুমি বলপ্রয়োগ করে পুষ্পচয়ন ক’রো না।
হনুমান তার দেহ সংকুচিত করে ভীমকে আলিঙ্গন করলেন। ভীমের সকল শ্রম দূর হল তার বোধ হল তিনি অত্যন্ত বলশালী হয়েছেন। হনুমান বললেন, কুন্তীপুত্র, যদি চাও তবে আমি ক্ষুদ্র ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদের সংহার করব, শিলার আঘাতে হস্তিনাপুর বিমর্দিত করব। ভীম বললেন, মহাবাহু, আপনার প্রসাদেই আমরা শত্ৰুজয় করব। হনুমান বললেন, তুমি যখন যুদ্ধে সিংহনাদ করবে তখন আমিও তার সঙ্গে আমার কণ্ঠস্বর যোগ করব; আমি অর্জুনের ধ্বজের উপরে বসে প্রাণান্তকর দারুণ নিনাদ করব; তাতে তোমরা অনায়াসে শত্রুবধ করতে পারবে। এই বলে হনুমান অন্তর্হিত হলেন।
৩৩। ভীমের পদ্মসংগ্রহ
ভীম গন্ধমাদনের উপর দিয়ে হনুমানের প্রদর্শিত পথে যাত্রা করলেন। দিনশেষে তিনি বনমধ্যে হংস কারণ্ডব ও চক্ৰবাকে সমাকীর্ণ একটি বৃহৎ নদী দেখতে পেলেন, তার জল অতি নির্মল এবং পরম সুন্দর স্বর্ণময় দিব্য পদ্মে আচ্ছন্ন। এই নদী কৈলাসশিখর ও কুবের ভবনের নিকটবর্তী, ক্রোধবশ নামক রাক্ষসগণ তা রক্ষা করে। মৃগচর্মধারী স্বর্ণাঙ্গদভূষিত ভীম নিঃশঙ্কচিত্তে খড়্গ-হস্তে পদ্ম নিতে আসছেন দেখে রাক্ষসগণ তাকে প্রশ্ন করলে, মুনিবেশধারী অথচ সশস্ত্র কে তুমি? ভীম তার পরিচয় দিয়ে জানালেন যে তিনি দ্রৌপদীর জন্য পদ্ম নিতে এসেছেন। রাক্ষসরা বললে, এখানে কুবের ক্রীড়া করেন, মানুষ এখানে আসতে পারে না। যক্ষরাজের অনুমতি নিয়ে যে আসে সে বিনষ্ট হয়। তুমি ধর্মরাজের ভ্রাতা হয়ে সবলে পদ্ম হরণ করতে এসেছ কেন? ভীম বললেন, যক্ষপতি কুবেরকে তো এখানে দেখছি না, আর তার দেখা পেলেও আমি অনুমতি চাইতে পারি না, কারণ ক্ষত্রিয়রা প্রার্থনা করেন না, এই সনাতন ধর্ম। তা ছাড়া এই নদীর উৎপত্তি পর্বতনিঝর থেকে, কুবেরভবনে নয়, সকলেরই এতে সমান অধিকার।
নিষেধ অগ্রাহ্য করে ভীম জলে নামছেন দেখে রাক্ষসরা তাকে মারবার জন্য ধাবিত হল। শতাধিক রাক্ষস ভীমের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হল , আর সকলে কৈলাস পর্বতে পালিয়ে গেল। ভীম তখন নদীতে নেমে অমৃততুল্য জল পান করলেন এবং পদ্মতরু উৎপাটিত করে অনেক পদ্ম সংগ্রহ করলেন। পরাজিত রাক্ষসদের কাছে সমস্ত শুনে কুবের হেসে বললেন, আমি সব জানি, কৃষ্ণার জন্য ভীম ইচ্ছামত পদ্ম নিন।
সেই সময়ে বদরিকাশ্রমে বালুকাময় খরস্পর্শ বায়ু বইতে লাগল, উল্কাপাত হল , এবং অন্যান্য দুর্লক্ষণ দেখা গেল। বিপদের আশঙ্কায় যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, ভীম কোথায় ? দ্রৌপদী জানালেন যে ভীম তার অনুরোধে পদ্ম আনতে গেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, আমরাও শীঘ্র সেখানে যাব। তখন ঘটোৎকচ তার অনুচরদের সাহায্যে যুধিষ্ঠিরাদি, দ্রৌপদী, লোমশ ও অন্যান্য ব্রাহ্মণদের বহন করে ভীমের নিকট উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির দেখলেন, অনেক যক্ষ নিহত হয়ে পড়ে আছে, ক্রুদ্ধ ভীম স্তব্ধনয়নে ওষ্ঠ দংশন করে গদা তুলে নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ভীম, একি করেছ? এতে দেবতারা অসন্তুষ্ট হবেন আর এমন ক’রো না। সেই সময়ে উদ্যানরক্ষিগণ এসে সকলকে প্রণাম করলে। যুধিষ্ঠির সেই রাক্ষসদের সান্ত্বনা দিলে তারা কুবেরের কাছে ফিরে গেল।
পাণ্ডবগণ অর্জুনের প্রতীক্ষায় গন্ধমাদনের সেই সানুদেশে কিছুকাল সুখে যাপন করলেন। তার পর একদিন যুধিষ্ঠির তার ভ্রাতাদের বললেন, মহাত্মা লোমশ আমাদের বহু তীর্থ দেখিয়েছেন, বিশালা বদরী এবং এই দিব্য নদীও আমরা দেখেছি, এখন কোন উপায়ে আমরা কুবেরভবনে যাব তা ভেবে দেখ। এই সময়ে আকাশবাণী হল —এখান থেকে কেউ সেখানে যেতে পারে না। আপনি বদরিকাশ্রমে ফিরে গিয়ে সেখান থেকে বৃষপর্বার আশ্রম হয়ে আচিঁষেণের আশ্রমে যান, তা হলে কুবেরভবন দেখতে পাবেন। আকাশবাণী শুনে সকলে বদরিকায় ফিরে গেলেন।
॥ জটাসুরবধপাধ্যায়॥
৩৪। জটাসুরবধ
জটাসুর নামে এক রাক্ষস ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পাণ্ডবদের সঙ্গে বাস করত। সর্বশাস্ত্রজ্ঞ উত্তম ব্রাহ্মণ বলে সে নিজের পরিচয় দিত, যুধিষ্ঠির অসন্ধিগ্ধমনে সেই পাপীকে পালন করতেন। একদিন ভীম মৃগয়ায় গেছেন, ঘটোৎকচ ও তার অনুচর রাক্ষসরাও আশ্রমে নেই, এবং লোমশ প্রভৃতি মহর্ষিরা ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন, এই সুযোগে জটাসুর বিকট রূপ ধারণ করে যুধিষ্ঠির নকুল সহদেব দ্রৌপদী এবং পাণ্ডবদের সমস্ত অস্ত্র হরণ করে নিয়ে চলল। সহদেব বিশেষ চেষ্টা করে তার বাহুপাশ থেকে নিজেকে মুক্ত করলেন এবং খড়্গ কোষমুক্ত করে উচ্চকণ্ঠে ভীমকে ডাকতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির জটাসুরকে বললেন, দুর্বুদ্ধি, তুমি আমাদের আশ্রমে সসম্মানে বাস করে এবং আমাদের অন্ন খেয়ে কেন আমাদের হরণ করছ? দ্রৌপদীকে স্পর্শ করার ফলে তুমি কলসস্থিত বিষ আলোড়ন করে পান করেছ।
যুধিষ্ঠির নিজেকে গুরুভার করলেন, তাতে রাক্ষসের গতি মন্দীভূত হল। সহদেব বললেন, মহারাজ, আমি এর সঙ্গে যুদ্ধ করব, সূর্যাস্তের পূর্বেই যদি একে বধ করতে পারি তবে আমি নিজেকে ক্ষত্রিয় বলব না। সহদেব যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলেন। এমন সময়ে গদাহস্তে ভীম সেখানে এলেন। ভীম রাক্ষসকে বললেন, পাপী, তুমি যখন আমাদের অস্ত্রশস্ত্র নিরীক্ষণ করতে তখনই তোমাকে আমি চিনেছিলাম, কিন্তু তুমি ব্রাহ্মণবেশী অতিথি হয়ে আমাদের প্রিয়কার্য করতে এজন্য বিনা অপরাধে তোমাকে বধ করিনি। তুমি এখন কালসূত্রে বদ্ধ মৎস্যের ন্যায় দ্রৌপদীরূপ বড়িশ গ্রাস করেছ। বক আর হিড়িম্ব রাক্ষস যেখানে গেছে তুমিও সেখানে যাবে। জটাসুর যুধিষ্ঠিরাদিকে ছেড়ে দিয়ে ভীমকে বললে, তুমি যেসব রাক্ষস বধ করেছ আজ তোমার রক্তে তাদের তর্পণ করব।
ভীম ও জটাসুরের দারুণ বাহুযুদ্ধ হ’তে লাগল। নকুল-সহদেব সাহায্য করতে এলে ভীম তাদের নিরস্ত করে সহাস্যে বললেন, আমি একে মারতে পারব, তোমরা দাঁড়িয়ে দেখ। ভীমের মুষ্টির আঘাতে রাক্ষস ক্রমশ শ্রান্ত হয়ে পড়ল, তখন ভীম। তার সর্বাঙ্গ নিষ্পিষ্ট করে চূর্ণ করে দিলেন, বৃন্তচ্যুত ফলের ন্যায় তার মস্তক ছিন্ন হয়ে ভূপতিত হল।
॥ যক্ষযুদ্ধপর্বাধ্যায়॥
৩৫। ভীমের সহিত যক্ষরাক্ষসাদির যুদ্ধ।
বদরিকাশ্রমে বাস কালে একদিন যুধিষ্ঠির বললেন, আমাদের বনবাসকালের চার বৎসর নিরাপদে অতীত হয়েছে। অস্ত্রশিক্ষার জন্য সুরলোকে যাবার সময় অর্জুন। বলেছিলেন যে পঞ্চম বৎসর প্রায় পূর্ণ হলে তিনি কৈলাস পর্বতে আমাদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হবেন। অতএব আমরা কৈলাসে গিয়েই তার প্রতীক্ষা করব। | যুধিষ্ঠিরাদি, লোমশ ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ এবং ঘটোৎকচ ও তাঁর অনুচরগণ সতর দিনে হিমলায়ের পৃষ্ঠদেশে উপস্থিত হলেন। তারপর তারা গন্ধমাদন পর্বতের নিকটে রাজর্ষি বৃষপর্বার পবিত্র আশ্রমে এলেন। সেখানে সাত রাত্রি সুখে বাস করার পর অতিরিক্ত পরিচ্ছদ আভরণ ও যজ্ঞপাত্র বৃষপর্বার কাছে রেখে তারা উত্তর দিকে যাত্রা করলেন। পাণ্ডবদের সহচর ব্রাহ্মণগণ বৃষপর্বার আশ্রমেই রইলেন। যুধিষ্ঠিরাদি, দ্রৌপদী, লোমশ ও ধৌম্য চতুর্থ দিনে কৈলাস পর্বতের নিকটস্থ হলেন। তার পর তারা মাল্যবান পর্বত অতিক্রম করে রমণীয় গন্ধমাদন পর্বতে রাজর্ষি আচিঁযেণের আশ্রমে এলেন। উগ্রতপা কৃশকায় সর্বধর্মজ্ঞ আমিঁষেণ তাদের সাদরে গ্রহণ করে বললেন, বৎস যুধিষ্ঠির, তোমরা এখানেই অর্জুনের জন্য অপেক্ষা কর। পাণ্ডবগণ সুম্বাদু ফল, বাণহত মৃগের পবিত্র মাংস, পবিত্র মধু, এবং মুনিগণের অন্যান্য খাদ্য খেয়ে এবং লোমশের মুখে বিবিধ কথা শুনে বনবাসের পঞ্চম বর্ষ যাপন করলেন।
ঘটোৎকচ তার অনুচরদের সঙ্গে চ’লে গেলেন। একদিন দ্রৌপদী ভীমকে বললেন, তোমার ভ্রাতা অর্জুন খাণ্ডবদাহকালে গন্ধর্ব নাগ রাক্ষস এবং ইন্দ্রকেও নিবারিত করেছিলেন। তিনি দারুণ মায়াবীদের বধ করেছেন, গাণ্ডীব ধনুও লাভ করেছেন। তোমারও ইন্দ্রের ন্যায় তেজ ও অজেয় বাহুবল আছে। তুমি এখানকার রাক্ষসদের বিতাড়িত করে দাও, আমরা সকলে এই রমণীয় পর্বতের উপরিভাগ দেখব।
মহাবৃষ যেমন প্রহার সইতে পারে না, ভীম সেইরূপ দ্রৌপদীর তিরস্কারতুল্য বাক্য সইতে পারলেন না, সশস্ত্র হয়ে পর্বতশৃঙ্গে উঠলেন। সেখান থেকে তিনি কুবেরভবন দেখতে পেলেন। তার প্রাসাদসমূহ কাঞ্চন ও স্ফটিকে নির্মিত, সর্বদিক সুবর্ণপ্রাচীরে বেষ্টিত এবং নানাপ্রকার কাঞ্চন ও স্ফটিকে নির্মিত, সর্বদিক সুবর্ণপ্রাচীরে বেষ্টিত এবং নানাপ্রকার উদ্যানে শোভিত। কিছুক্ষণ বিষগ্নমনে নিশ্চল হয়ে কুবেরপুরী দেখে ভীম শঙ্খধ্বনি ও জ্যানির্ঘোষ করে করতালি দিলেন। শব্দ শুনে যক্ষ রাক্ষস ও গন্ধর্বগণ বেগে আক্রমণ করতে এল। ভীমের অস্ত্রাঘাতে অনেকে বিনষ্ট হল অবশিষ্ট সকলে পালিয়ে গেল। তখন কুবেরসখা মণিমান নামক মহাবল রাক্ষস শক্তি শল ও গদা নিয়ে যুদ্ধ করতে এলেন, কিন্তু ভীম তাঁকেও গদাঘাতে বধ করলেন।
যুদ্ধের শব্দ শুনে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে আর্টিষেণের কাছে রেখে নকুল-সহদেবের সঙ্গে সশস্ত্র হয়ে পর্বতের উপরে উঠলেন। মহাবাহু ভীম বহু রাক্ষস সংহার করে ধনু আর গদা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দেখে যুধিষ্ঠির তাঁকে আলিঙ্গন করে বললেন, ভীম, তুমি হঠকারিতার বশে অকারণে রাক্ষস বধ করেছ, তাতে দেবতারা ক্রুদ্ধ হবেন। এমন কার্য আর ক’রো না।
ভীম দ্বিতীয়বার রাক্ষসদের বধ করেছেন শুনে কুবের ক্রুদ্ধ হয়ে পুষ্পক বিমানে গন্ধমাদন পর্বতে এলেন। পাণ্ডবগণ রোমাঞ্চিত হয়ে যক্ষ-রাক্ষ্য-পরিবেষ্টিত প্রিয়দর্শন কুবেরকে দেখতে লাগলেন। কুবেরও খড়্গধনুর্ধারী মহাবল পাণ্ডবগণকে দেখে এবং তারা দেবতাদের প্রিয়কার্য করবেন জেনে প্রীত হলেন। যুধিষ্ঠির নকুল ও সহদেব কুবেরকে প্রণাম করলেন এবং নিজেতে অপরাধী মনে করে কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভীম খড়্গ ও ধনুর্বাণ হাতে নিয়ে কুবেরকে দেখতে লাগলেন।
কুবের যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তুমি প্রাণিগণের হিতে রত তা সকলেই জানে; তোমার ভ্রাতাদের সঙ্গে তুমি নির্ভয়ে এই পর্বতের উপরে বাস কর। ভীমের হঠকারিতার জন্য ক্রুদ্ধ বা লজ্জিত হয়ো না, এই যক্ষ-রাক্ষসদের বিনাশ হবে তা দেবতারা পূর্বেই জানতেন। তার পর কুবের ভীমকে বললেন, বৎস, তুমি দ্রৌপদীর জন্য আমাকে ও দেবগণকে অগ্রাহ্য করে এই যে সাহসের কাজ করেছ তাতে আমি প্রীত হয়েছি, তুমি আমাকে শাপমুক্ত করেছ। কুশবতী নগরীতে যখন দেবগণের মন্ত্রণাসভা হয় তখন আকাশপথে সেখানে যাবার সময় আমি মহর্ষি অগস্ত্যকে দেখেছিলাম, তিনি যমুনাতীরে উগ্র তপস্যা করছিলেন। আমার সখা রাক্ষসপতি মণিমান মূর্খতা মোহ ও দৰ্পের বশে অগস্ত্যের মস্তকে নিষ্ঠীবন ত্যাগ করেন। ক্রোধে চতুর্দিক যেন দগ্ধ করে অগস্ত্য আমাকে বললেন, তোমার এই দুরাত্মা সখা সসৈন্যে মানুষের হাতে মরবে; তুমিও সৈন্যবিনাশের দুঃখ ভোগ করবে, সেই সৈন্যহন্তা মনুষ্যকে দেখে পাপমুক্ত হবে।
তার পর কুবের যুধিষ্ঠিরকে বললেন, এই ভীমসেন ধর্মজ্ঞানহীন, গর্বিত, বালবুদ্ধি, অসহিষ্ণু ও ভয়শূন্য; একে তুমি শাসনে রেখো। রাজর্ষি আর্ষ্টিষেণের আশ্রমে ফিরে গিয়ে তুমি সেখানে কৃষ্ণপক্ষ যাপন ক’রো, আমার নিযুক্ত গন্ধর্ব যক্ষ কিন্নর ও পর্বতবাসিগণ তোমাদের রক্ষা করবে এবং খাদ্যপানীয় এনে দেবে। কুবেরকে প্রণাম করে ভীম তার শক্তি গদা খড়্গ ধনু প্রভৃতি অস্ত্র সমর্পণ করলেন। শরণাগত ভীমকে কুবের বললেন, বৎস, তুমি শত্রুগণের গৌরব নাশ কর, সুহৃদ্গণের আনন্দ বর্ধন কর। এই গন্ধমাদন পর্বতে সকলে নির্ভয়ে বাস কর। অর্জুন শীঘ্রই তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবেন। এ বলে কুবের অন্তর্হিত হলেন।
॥ নিবাতকবচযুদ্ধপর্বাধ্যায়॥
৩৬। অর্জুনের প্রত্যাবর্তন-নিবাতকবচ ও হিরণ্যপুরের বৃত্তান্ত
একমাস পরে একদিন পাণ্ডবগণ দেখলেন, ভিতরে কিরীটমাল্যধারী অর্জুন নব-আভরণে ভূষিত হয়ে বসে আছেন। বিমান থেকে নেমে অর্জুন পুরোহিত ধৌম্য, যুধিষ্ঠির ও ভীমের চরণবন্দনা করলেন। পাণ্ডবগণ কর্তৃক সৎকৃত হয়ে মাতলি বিমান নিয়ে ইন্দ্রলোকে ফিরে গেলেন।
প্রিয়া দ্রৌপদীকে ইন্দ্রদত্ত বিবিধ মহামূল্য অলংকার উপহার দিয়ে অর্জুন তার ভ্রাতা ও ব্রাহ্মণদের মধ্যে এসে বসলেন এবং সুরলোকে বাস ও অস্ত্রশিক্ষার বৃত্তান্ত সংক্ষেপে বললেন। পরদিন প্রভাতকালে উজ্জ্বল বিমানে আরোহণ করে ইন্দ্র পাণ্ডবদের নিকট উপস্থিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, তুমি পৃথিবী শাসন করবে, এখন তোমরা কাম্যকবনে ফিরে যাও। অর্জুন সর্ববিধ অস্ত্র লাভ করেছেন, আমার প্রিয়কার্যও করেছেন। এখন ত্রিভুবনের লোকেও এঁকে জয় করতে পারবে না। ইন্দ্র চ’লে গেলে যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন তার যাত্রা ও সুরলোকবাসের ঘটনাবলী সবিস্তারে জানিয়ে নিবাতকবচবধের এই বৃত্তান্ত বললেন।
আমার অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হলে দেবরাজ বললেন, তোমার এখন গুরুদক্ষিণা দেবার সময় এসেছে। আমার শত্রু নিবাতকবচ নামক তিন কোটি দানব সমুদ্রমধ্যস্থ দুর্গে বাস করে, তারা রূপে ও বিক্রমে সমান। তুমি তাদের বধ কর, তা হলেই তোমার গুরুদক্ষিণা দেওয়া হবে।
কিরীট-কবচে ভূষিত হয়ে গাণ্ডীবধনু নিয়ে আমি ইন্দ্রের রথে যাত্রা করলাম। অবিলম্বে মাতলি আমাকে সমুদ্রস্থ দানবনগরে নিয়ে এলেন। সহস্র সহস্র নিবাতকবচ নামক দানব লৌহময় মহাশূল গদা মুষল খড়্গ প্রভৃতি অস্ত্র নিয়ে বিকৃত বাদ্যধ্বনি করে আমাকে আক্রমণ করলে। তুমুল যুদ্ধে অনেক দানব আমার অস্ত্রাঘাতে নিহত হল। তারপর তারা মায়াবলে শিলা জল অগ্নি ও বায়ু বর্ষণ করতে লাগল, চতুর্দিক ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হল। তখন আমি নিজের অস্ত্রমায়ায় দানবগণের মায়া নষ্ট করলাম। তারা অদৃশ্য হয়ে আকাশ থেকে শিলা বর্ষণ করতে লাগল, আমরা যেখানে ছিলাম সেই স্থান গুহার ন্যায় হয়ে গেল। তখন মাতলিব উপদেশে আমি দেবরাজের প্রিয় ভীষণ বজ অস্ত্র নিক্ষেপ করলাম। পর্বতের ন্যায় বিশালকায় নিবাতকবচগণের মৃতদেহে যুদ্ধস্থান ব্যাপ্ত হল , দানবরমণীগণ উচ্চস্বরে কঁদতে কাঁদতে তাদের গৃহমধ্যে আশ্রয় নিলে। আমি মাতলিকে জিজ্ঞাসা করলাম, দানবদের এই নগর ইন্দ্রালয়ের চেয়েও উৎকৃষ্ট, দেবতারা এখানে বাস করেন না কেন? মাতলি বললেন, এই নগর পূর্বে দেবরাজেরই ছিল, নিবাতকবচগণ ব্রহ্মার বরপ্রভাবে এই স্থান অধিকার করে দেবতাদের তাড়িয়ে দেয়। ইন্দ্রের অনুযোগে ব্রহ্মা বলেছিলেন, বাসব, এই নিয়তি আছে যে তুমি অন্য দেহে এদের সংহার করবে। এই কারণেই ইন্দ্র তোমাকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন।
নিবাতকবচগণকে বিনষ্ট করে যখন আমি দেবলোকে ফিরছিলাম তখন আর একটি দীপ্তিময় আশ্চর্য নগর আমার দৃষ্টিগোচর হল। মাতলি বললেন, পুলোমা নামে এক দৈত্যনারী এবং কালকা নামে এক মহাসুরী বহু সহস্র বৎসর তপস্যা করে ব্রহ্মার নিকট এই বর পায় যে, তাদের পৌলোম ও কালকেয় নামক পুত্রগণ দেব রাক্ষস ও নাগের অবধ্য হবে এবং তারা এই প্রভাময় রমণীয় আকাশচারী নগরে বাস করবে। এই সেই ব্রহ্মার নির্মিত হিরণ্যপুর নামক দিব্য নগর। পার্থ, তুমি এই ইন্দ্ৰশত্রু অসুরগণকে বিনষ্ট কর।
মাতলি আমাকে হিরণ্যপুরে নিয়ে গেলেন। দানবগণ আক্রমণ করলে আমি তাদের মোহগ্রস্ত করে শরাঘাতে বধ করতে লাগলাম। তাদের নগর কখনও ভূতলে নামল, কখনও আকাশে উঠল, কখনও জলমধ্যে নিমগ্ন হল। তার পর দানবগণ ষাট হাজার রথে চড়ে আমার দিব্যাস্ত্রসমূহ প্রতিহত করে যুদ্ধ করতে লাগল। আমি ভীত হয়ে দেবদেব রুদ্রকে প্রণাম করে রৌদ্র নামে খ্যাত সর্বশত্রু-নাশক দিব্য পাশুপত অস্ত্র প্রয়োগে উদ্যত হ’লাম। তখন এক আশ্চর্য পুরুষ আবির্ভূত হল , তার তিন মস্তক, নয় চক্ষু, ছয় হস্ত। তার কেশ সূর্য ও অগ্নির ন্যায় প্রদীপ্ত, লেলিহান মহানাগগণ তা বেষ্টন করে আছে। মহাদেবকে নমস্কার করে আমি সেই ঘোর রৌদ্র অস্ত্র গাণ্ডীবে যোজনা করে নিক্ষেপ করলাম। তৎক্ষণাৎ সহস্র সহস্র মৃগ সিংহ ব্যাঘ্র ভল্লুক মহি সর্প হস্তী প্রভৃতি এবং দেব ঋযি গন্ধর্ব পিশাচ যক্ষ ও নানারূপ অস্ত্রধারী রাক্ষস ও অন্যান্য প্রাণীতে সর্বস্থান ব্যাপ্ত হল। ত্রিমস্তক, চতুর্দন্ত, চতুর্ভুজ ও নানারূপধারী প্রাণিগণ নিরন্তর দানবগণকে বধ করতে লাগল, আমিও শরবর্ষণ করে মুহূর্তমধ্যে সমস্ত দানব সংহার করলাম।
আমি দেবলোকে ফিরে গেলে মাতলির মুখে সমস্ত শুনে দেবরাজ আমার বহু প্রশংসা করে বললেন, পুত্র, তুমি যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কর্ণ শকুনি ও তাদের সহায়ক রাজারা সকলে মিলে তোমার ষোল ভাগের এক ভাগেরও সমান হবেন না। তার পর তিনি আমাকে এই দেহরক্ষক অভেদ্য দিব্যকবচ, হিরন্ময়ী মালা, দেবদত্ত নামক মহারব শঙ্খ, দিব্য কিরীট এবং এই সকল দিব্য বস্ত্র ও আভরণ দান করলেন। আমি পাঁচ বৎসর সুরলোকে বাস করে ইন্দ্রের অনুমতিক্রমে এখন এই গন্ধমাদন পর্বতে আপনাদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়েছি।
অর্জুনের নিকট সকল বৃত্তান্ত শুনে যুধিষ্ঠির অতিশয় আনন্দিত হলেন। পরদিন তাঁর অনুরোধে অর্জুন দিব্যাস্ত্রসমূহের প্রয়োগ দেখাবার উপক্রম করলে নদী ও সমুদ্র বিক্ষুব্ধ, পর্বত বিদীর্ণ এবং বায়ুপ্রবাহ রুদ্ধ হল ; সূর্য উঠলেন না, অগ্নি জ্বললেন না, ব্রাহ্মণগণ বেদ স্মরণ করতে পারলেন না। তখন নারদ এসে বললেন, অজুন, দিব্যাস্ত্র বৃথা প্রয়োগ ক’রো না, তাতে মহাদোষ হয়। যুধিষ্ঠির, অর্জুন যখন শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন তখন তুমি এইসব অস্ত্রের প্রয়োগ দেখবে।
॥ আজগরপাধ্যায়॥
৩৭। অজগর, ভীম ও যুধিষ্ঠির
গন্ধমাদন পর্বতে কুবেরের উদ্যানে পঞ্চপাণ্ডব চার বৎসর সুখে বাস করলেন। তার পূর্বেই তারা ছ-বৎসর বনবাসে কাটিয়েছিলেন। একদিন ভীম অর্জুন নকুল সহদেব যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আপনার প্রতিজ্ঞা রক্ষা ও প্রীতির জন্যই আমরা দুর্যোধনকে মারতে যাইনি, মান পরিহার করে সুখভোগে বঞ্চিত হয়ে বনে বিচরণ করছি। আমাদের বনবাসের একাদশ বৎসর চলছে, পরে এক বৎসর দূরদেশে অজ্ঞাতবাস করলে দুর্যোধন জানতে পারবে না। এখন এখানে নিশ্চেষ্ট হয়ে না থেকে ভবিষ্যতে শত্রুজয়ের জন্য আমাদের প্রস্তুত হওয়া উচিত।
যুধিষ্ঠির গন্ধমাদন পর্বত ছেড়ে যেতে সম্মত হলেন। ঘটোৎকচ আনুচরবর্গের সঙ্গে এসে তাদের সকলকে বহন করে নিয়ে চললেন। লোমশ দেবলোকে ফিরে গেলেন। পাণ্ডবগণ বৃষপর্বার আশ্রমে এক রাত্রি এবং বদরিকায় এক মাস বাস করে কিরাতরাজ সুবাহুর দেশে উপস্থিত হলেন। সেখান থেকে ইন্দ্রসেন ও অন্যান্য ভৃত্য, পাচক, সারথি ও রথ প্রভৃতি সঙ্গে নিয়ে এবং ঘটোৎকচকে বিদায় দিয়ে তারা যমুনার উৎপত্তিস্থানের নিকট বিশাখযূপ নামক বনে এলেন। এই মনোহর বনে তারা এক বৎসর মৃগয়া করে কাটালেন।
একদিন ভীমসেন মৃগ বরাহ মহিষ বধ করে বনে বিচরণ করছিলেন এমন সময় এক পর্বতকরবাসী হরিদ্বর্ণ চিত্রিতদেহ মহাকায় সর্প তাকে বেষ্টন করে ধরলে। অজগরের স্পর্শে ভীমের সংজ্ঞালোপ হল মহাবলশালী হয়েও তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারলেন না। ভীম বললেন, ভুজগশ্রেষ্ঠ, তুমি কে? আমি ধর্মরাজের ভ্রাতা ভীমসেন, অযুত হস্তীর সমান বলবান, আমাকে কি করে বশে জানলে ? ভীমের দুই বাহু মুক্ত এবং তার দেহ বেষ্টিত করে অজগর বললে, তোমার পূর্বপুরুষ রাজর্ষি নহুষের নাম শুনে থাকবে, আমি সেই নহুষ (১) অগস্ত্যের শাপে সর্প হয়েছি। আমি বহুকাল ক্ষুধার্ত হয়ে আছি, আজ ভাগ্যক্রমে তোমাকে ভক্ষ্যরূপে
পেয়েছি। ভীম বললেন, নিজের প্রাণের জন্য আমি ভাবছি না, আমার মৃত্যু হলে আমার ভ্রাতারা শোকে বিহ্বল ও নিরুদ্যম হবেন। রাজ্যের লোভে আমি ধর্মপরায়ণ অগ্রজকে কটুকথা বলে পীড়া দিয়েছি। আমার মৃত্যুতে হয়তো সর্বাস্ত্রবিৎ ধীমান অর্জুন বিষাদগ্রস্ত হবেন না, কিন্তু মাতা কুন্তী ও নকুল-সহদেব অত্যন্ত শোক পাবেন।
সহসা নানাপ্রকার দুর্লক্ষণ দেখে যুধিষ্ঠির ভীত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ভীম কোথায়। দ্রৌপদী বললেন, তিনি বহুক্ষণ পূর্বে মৃগয়া করতে গেছেন। যুধিষ্ঠির ধৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে ভীমের অন্বেষণে চললেন। মৃগয়ার চিহু অনুসরণ করে তিনি এক পর্বতকন্দরে এসে দেখলেন, এক মহাকায় সর্প ভীমকে বেষ্টন করে রয়েছে, তার নড়বার শক্তি নেই। ভীমের কাছে সব কথা শুনে যুধিষ্ঠির সর্প বললে, এই রাজপুত্রকে আমি মুখের কাছে পেয়েছি, এই আমার ভক্ষ্য। তুমি চ’লে যাও। নয়তো কাল তোমাকেও খাব। কিন্তু তুমি যদি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পার তবে তোমার ভ্রাতাকে ছেড়ে দেব। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি ইচ্ছামত প্রশ্ন করুন, আমি তার উত্তর দেব।
সৰ্প বললে, তোমার বাক্য শুনে মনে হচ্ছে তুমি অতি বুদ্ধিমান। বল- ব্রাহ্মণ কে? জ্ঞাতব্য কি? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, সত্য দান ক্ষমা সচ্চরিত্র অহিংসা তপস্যা ও দয়া যাঁর আছে তিনিই ব্রাহ্মণ। সুখদুঃখহীন পরব্রহ্ম, যাঁকে লাভ করলে শোক থাকে না, তিনিই জ্ঞাতব্য। সর্প বললে, শূদ্রদের মধ্যেও তো ওইসব গুণ থাকতে পারে; আর, এমন কাকেও দেখা যায় না যিনি সুখদুঃখের অতীত। যুধিষ্ঠির বললেন, যে শূদ্রে ওইসব লক্ষণ থাকে তিনি শূদ্র নন, ব্রাহ্মণ; যে ব্রাহ্মণে থাকে না তিনি ব্রাহ্মণ নন, তাকে শূদ্র বলাই উচিত। আর, আপনি যাই মনে করুন, সুখদুঃখাতীত ব্রহ্ম আছেন এই আমার মত। সর্প বললে, যদি গুণানুসারেই ব্রাহ্মণ হয় তবে যে পর্যন্ত কেউ গুণযুক্ত না হয় সে পর্যন্ত সে জাতিতে ব্রাহ্মণ নয়। যুধিষ্ঠির বললেন, মহাসর্প, আমি মনে করি সকল বর্ণেই সংকরত্ব আছে, সেজন্য মানুষের জাতিনির্ণয় দুঃসাধ্য।
যুধিষ্ঠিরের উত্তর শুনে সর্প প্রীত হয়ে ভীমকে মুক্তি দিলে। তার পর তার সঙ্গে নানাবিধ দার্শনিক আলাপ করে যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান, সর্বজ্ঞ, স্বর্গবাসীও ছিলেন, তবে আপনার এ দশা হল কেন? সর্পরূপী নহুষ বললেন, আমি দেবলোকে অভিমানে মত্ত হয়ে বিমানে বিচরণ করতাম, ব্রহ্মর্ষি দেবতা গন্ধর্ব প্রভৃতি সকলেই আমাকে কর দিতেন। এক সহস্র ব্রহ্মর্ষি আমার শিবিকা বহন করতেন। একদিন অগস্ত্য যখন আমার বাহন ছিলেন তখন আমি পা দিয়ে তার মস্তক স্পর্শ করি। তার অভিশাপে আমি সর্প হয়ে অধোমুখে পতিত হলাম। আমার প্রার্থনায় তিনি বললেন, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তোমাকে শাপমুক্ত করবেন। এই কথা বলে নহুষ। অজগরের রূপ ত্যাগ করে দিব্যদেহে স্বর্গারোহণ করলেন। যুধিষ্ঠির ভীম ও ধৌম্য তাদের আশ্রমে ফিরে গেলেন।
**(১) নহুষের পূর্বকথা উদযোগপর্ব ৪-পরিচ্ছেদে আছে।
॥ মার্কণ্ডেয়সমাস্যা(১)পর্বাধ্যায়॥
৩৮। কৃষ্ণ ও মার্কণ্ডেয়র আগমন-অরিষ্টনেমা ও অত্রির কথা
বিশাখকূপ বনে বর্ষা ও শরৎ ঋতু কাটিয়ে পাণ্ডবগণ আবার কাম্যকবনে এসে বাস করতে লাগলেন। একদিন সত্যভামাকে সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণ তাদের দেখতে এলেন। অর্জুনকে সুভদ্রা ও অভিমন্যুর কুশলসংবাদ দিয়ে কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বললেন, যাজ্ঞসেনী, ভাগ্যক্রমে অর্জুন ফিরে এসেছেন, তোমার স্বজনবর্গ এখন পূর্ণ হল। তোমার বালক পুত্রগণ ধনুর্বেদে অনুরক্ত ও সুশীল হয়েছে। তোমার পিতা ও ভ্রাতা নিমন্ত্রণ করলেও তারা মাতুলালয়ের ঐশ্বর্য ভোগ করতে চায় না, তারা দ্বারকাতেই সুখে আছে। আর্যা কুন্তী আর তুমি যেমন পার সেইরূপ সুভদ্রাও সবর্দা তাদের সদাচার শিক্ষা দিচ্ছেন। রুক্মিণীতনয় প্রদ্যুম্ন ও কুমার অভিমন্যু তাদের রথ ও অশ্বচালনা এবং বিবিধ অস্ত্রের প্রয়োগ শেখাচ্ছেন। তার পর কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, যাদবসেনা আপনার আদেশের অপেক্ষা করছে, আপনি পাপী দুর্যোধনকে সবান্ধবে বিনষ্ট করুন। অথবা আপনি দূতসভায় যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাই পালন করুন, যাদবসেনাই আপনার শত্ৰু সংহার করবে, আপনি যথাকালে হস্তিনাপুর অধিকার করবেন।
যুধিষ্ঠির কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, কেশব, তুমিই আমাদের গতি, উপযুক্ত কালে তুমি আমাদের সর্বপ্রকারে সাহায্য করবে তাতে সংশয় নেই। আমরা প্রায় দ্বাদশ বৎসর বনবাসে কাটিয়েছি, অজ্ঞাতবাস শেষ করেই তোমার শরণ নেব।
এমন সময়ে মহাতপা মার্কণ্ডেয় মুনি সেখানে এলেন। তার বয়স বহু সহস্র বৎসর কিন্তু তিনি দেখতে পঁচিশ বৎসরের যুবার ন্যায়। তিনি পূজা গ্রহণ করে উপবিষ্ট হলে কৃষ্ণ তাঁকে বললেন, আমরা সকলে আপনার কাছে পুণ্যকথা শুনতে ইচ্ছা করি। এই সময়ে দেবর্ষি নারদও পাণ্ডবদের দেখতে এলেন, তিনিও মার্কণ্ডেয়কে অনুরোধ করলেন।
মার্কণ্ডেয় ধর্ম অধর্ম কর্মফল ইহলোক পরলোক প্রভৃতি সম্বন্ধে অনেক ব্যাখ্যান করলেন। পাণ্ডবগণ বললেন, আমরা ব্রাহ্মণমাহাত্ম্য শুনতে ইচ্ছা করি, আপনি বলুন। মার্কণ্ডেয় এই আখ্যান বললেন।
– হৈহয় বংশের এক রাজকুমার মৃগয়া করতে গিয়ে কৃষ্ণমৃগচর্মধারী এক ব্রাহ্মণকে দেখে তাকে পাপকর্মের কথা জানালেন। তখন হৈহয়রাজগণ ঘটনাস্থলে গিয়ে নিহত মুনিকে দেখলেন এবং তার সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে করতে মহর্ষি অরিষ্টনেমির আশ্রমে এলেন। মহর্ষি তাদের পাদ্য-অর্ঘাদি দিতে গেলে তারা বললেন, আমরা ব্রহ্মহত্যা করেছি, সৎকৃত হবার যোগ্য নই। তার পর সকলে পুনর্বার ঘটনাস্থলে গেলেন কিন্তু মৃতদেহ দেখতে পেলেন না। তখন অরিষ্টনেমি বললেন, দেখুন তো, আমার এই পুত্ৰই সেই নিহত ব্রাহ্মণ কিনা। রাজারা অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, সেই মৃত মুনিকমার কি করে জীবিত হলেন? অরিষ্টনেমি বললেন, আমরা স্বধর্মের অনুষ্ঠান করি, ব্রাহ্মণদের যাতে মঙ্গল হয় তাই বলি, যাতে দোষ হয় এমন কথা বলি না। অতিথি ও পরিচারকদের ভোজনের পর যা অবশিষ্ট থাকে তাই আমরা খাই। আমরা শান্ত, সংযতেন্দ্রিয়, ক্ষমাশীল, তীর্থপর্যাটক ও দানপরায়ণ, পণ্যদেশে তেজস্বী ঋষিগণের সংসর্গে বাস করি। যে সকল কারণে আমাদের মৃত্যুভয় নেই তার অল্পমাত্র আপনাদের বললাম। আপনারা এখন ফিরে যান, পাপের ভয় করবেন না। রাজারা হৃষ্ট হয়ে অরিষ্টনেমিকে প্রণাম। করে চ’লে গেলেন।
তারপর মার্কণ্ডেয় এই উপাখ্যান বললেন।
-মহর্ষি অত্রি বনগমনের ইচ্ছা করলে তাঁর ভার্যা বললেন, রাজর্ষি বৈণ্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করছেন, তুমি তার কাছে প্রার্থনা করে প্রচুর ধন নিয়ে এস, এবং সেই ধন পুত্র ও ভৃত্যদের ভাগ করে দিয়ে যেখানে ইচ্ছা হয় যেয়ো। অত্রি সম্মত হয়ে বৈণ্য রাজার কাছে গিয়ে তাঁর এই স্তুতি করলেন—রাজা, আপনি ধন্য, প্রজাগণের নিয়ন্তা ও পৃথিবীর প্রথম নরপতি; মুনিরা বলেন, আপনি ভিন্ন আর কেউ ধর্মজ্ঞ নেই। এই স্তুতি শুনে গৌতম ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, অত্রি, এমন কথা আর বলো না, ইন্দ্রই রাজাদের মধ্যে প্রথম। তুমি। মূঢ় অপরিণতবুদ্ধি, রাজাকে তুষ্ট করবার জন্য স্তুতি করছ। অত্রি ও গৌতম কলহ করছেন দেখে সভাস্থ ব্রাহ্মণগণ দুজনকে ধর্মজ্ঞ সনকুমারের কাছে নিয়ে গেলেন। সনকুমার বললেন, রাজাকে ধর্ম ও প্রজাপতি বলা হয়, তিনিই ইন্দ্র ধাতা প্রজাপতি বিরাট প্রভৃতি নামে স্তুত হন, সকলেই তার অর্চনা করে। অত্রি রাজাকে যে প্রথম বা প্রধান বলেছেন তা শাস্ত্রসম্মত। বিচারে অত্রিকে জয়ী দেখে বৈণ্য রাজা প্রীত হয়ে তাকে বহু ধন দান করলেন।
**(১) সমাস্যা-ধর্মতত্ত্ব, আখ্যান ইত্যাদি কথন ও শ্রবণের জন্য একত্র উপবেশন।
৩৯। বৈবস্বত মনু ও মৎস্য-বালকরূপী নারায়ণ
যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে মার্কণ্ডেয় বৈবস্বত মনুর এই বৃত্তান্ত বললেন।
-বিবস্বানের (সূর্যের) পুত্র মনু রাজ্যলাভের পর বদরিকাশ্রমে গিয়ে দশ হাজার বৎসর কঠোর তপস্যা করেছিলেন। একদিন একটি ক্ষুদ্র মৎস্যচীরিণী নদীর তীরে এসে মনুকে বললে, বলবান মৎস্যদের আক্রমণ থেকে আমাকে রক্ষা করুন। মনু সেই মৎস্যটিকে একটি জালার মধ্যে রাখলেন। ক্রমশ সে বড় হল , তখন মনু তাকে একটি বিশাল পুষ্করিণীতে রাখলেন। কালক্রমে মৎস্য এত বড় হল যে সেখানেও তার স্থান হল না, তখন মনু তাকে গঙ্গায় ছেড়ে দিলেন। কিছুকাল পরে মৎস্য বললে, প্রভু, আমি অতি বৃহৎ হয়েছি, গঙ্গায় নড়তে পারছি না, আমাকে সমুদ্রে ছেড়ে দিন। মনু যখন তাকে সমুদ্রে ফেললেন তখন সে সহাস্যে বললে, ভগবান, আপনি আমাকে সর্বত্র রক্ষা করেছেন, এখন আপনার যা কর্তব্য তা শুনুন।
-প্রলয়কাল আসন্ন, স্থাবর জঙ্গম সমস্তই জলমগ্ন হবে। আপনি রজ্জুযুক্ত একটি দৃঢ় নৌকা প্রস্তুত করিয়ে সপ্তর্ষিদের সঙ্গে তাতে উঠবেন, এবং পূর্বে ব্রাহ্মণগণ যেসকল বীজের কথা বলেছেন তাও তাতে রাখবেন। আপনি সেই নৌকায় থেকে আমার প্রতীক্ষা করবেন, আমি শৃঙ্গ ধারণ করে আপনার কাছে আসব। মৎস্যের উপদেশ অনুসারে মনু মহাসমুদ্রে নৌকায় উঠলেন। তিনি স্মরণ করলে মৎস্য উপস্থিত হল। মনু তার শৃঙ্গে রজ্জু বাঁধলেন, মৎস্য গর্জমান ঊর্মিময় লবণাম্বুক উপর দিয়ে মহাবেগে নৌকা টেনে নিয়ে চলল। তখন পৃথিবী আকাশ ও সর্বদিক সমস্তই জলময়, কেবল সাতজন ঋষি, মনু আর মৎস্যকে দেখা যাচ্ছিস। বহু বর্ষ পরে হিমালয়ের নিকটে এসে মনু মৎস্যের উপদেশ অনুসারে পর্বতের মহাশৃঙ্গে নৌকা বাঁধলেন। সেই শৃঙ্গ এখনও ‘নৌবন্ধন’ নামে খ্যাত। তার পর মৎস্য ঋষিগণকে বললে, আমি প্রজাপতি ব্রহ্মা, আমার উপরে কেউ নেই, আমি মৎস্যরূপে তোমাদের ভয়মুক্ত করেছি। এই মনু দেবাসুর মানুষ প্রভৃতি সকল প্রজা ও স্থাবর জঙ্গম সৃষ্টি করবেন। এই বলে মৎস্য অন্তর্হিত হল। তার পর মনু কঠোর তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে সকল প্রজা সৃষ্টি করতে লাগলেন।
যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি পুরাকালের সমস্ত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন, তার সম্বন্ধে কিছু শুনতে ইচ্ছা করি।
মার্কণ্ডেয় বললেন, সত্যযুগের পরিমাণ চার হাজার বৎসর (১), তার সন্ধ্যা (২) চার শ, এবং সন্ধ্যাংশ (৩) ও চার শ বৎসর। ত্রেতাযুগ তিন হাজার বৎসর, তার সন্ধ্যা তিন শ বৎসর, সন্ধ্যাংশও তাই। দ্বাপরযুগ দু-হাজার বৎসর, সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ দুইই দু শ বৎসর। কলিযুগ এক হাজার বৎসর, সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ এক-এক শ বৎসর। চার যুগে বার হাজার বৎসর; এক হাজার যুগে (এক হাজার চতুর্যগে) ব্রহ্মার এক দিন। তার পর ব্রহ্মার রাত্রি প্রলয়কাল। একদা প্রলয়কালে আমি নিরাশ্রয় হয়ে সমুদ্রজলে ভাসছিলাম এমন সময়ে দেখলাম, এক বিশাল বটবৃক্ষের শাখার তলে দিব্য-আস্তরণযুক্ত পর্যঙ্কে একটি চন্দ্রবদন পদ্মলোচন বালক শুয়ে আছে, তার বর্ণ অতসী (৪) পুষ্পের ন্যায়, বক্ষে শ্রীবৎসচিহু (৫)। সেই বালক বললেন, বৎস মার্কণ্ডেয়, তুমি পরিশ্রান্ত হয়েছ, আমার শরীরের ভিতরে বাস কর। এই বলে তিনি মুখব্যাদান করলেন। আমি তার উদরে প্রবেশ করে দেখলাম, নগর রাষ্ট্র পর্বত নদী সাগর আকাশ চন্দ্রসূর্য দেবগণ অসুরগণ প্রভৃতি সমেত সমগ্র জগৎ সেখানে রয়েছে। এক শত বৎসরের অধিক কাল তাহার দেহের মধ্যে বিচরণ করে কোথাও অন্ত পেলাম না, তখন আমি সেই বরেণ্য দেবের শরণ নিলাম এবং সহসা তাঁর বিবৃত মুখ থেকে বায়ুবেগে নির্গত হলাম। বাইরে এসে দেখলাম, সেই পীতবাস দ্যুতিমান বালক বটবৃক্ষের শাখায় বসে আছেন। তিনি সহাস্যে বললেন, মার্কণ্ডেয়, তুমি আমার শরীরে সুখে বাস করেছ তো? আমি নবদৃষ্টি লাভ করে মোহমুক্ত হয়ে তার সুন্দর কোমল আরক্ত চরণদ্বয় মস্তকে ধারণ করলাম। তার পর কৃতাঞ্জলি হয়ে বললাম, দেব, তোমাকে আর তোমার মায়াকে জানতে ইচ্ছা করি। সেই দেব বললেন, পুরাকালে আমি জলের নাম ‘নারা’ দিয়েছিলাম, প্রলয়কালে সেই জলই আমার অয়ন বা আশ্রয় সেজন্য আমি নারায়ণ। আমি তোমার উফর পরিতুষ্ট হয়ে ব্রহ্মার রূপ ধারণ করে অনেক বার তোমাকে বর দিয়েছি। লোকপিতামহ ব্রহ্মা আমার শরীরের অর্ধাংশ। যত কাল তিনি জাগরিত হন তত কাল আমি শিশুরূপে এইখানে থাকি। প্রলয়ান্তে ব্রহ্মা জাগরিত হলে আমি তার সঙ্গে একীভূত হয়ে আকাশ পৃথিবী স্থাবর জঙ্গম প্রভৃতি সৃষ্টি করব। তত কাল তুমি সুখে এখানে বাস কর। এই বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন।
এই ইতিহাস শেষ করে মার্কণ্ডেয় যুধিষ্ঠিরকে বললেন, মহারাজ, সেই প্রলয়কালে আমি যে পদ্মলোচন আশ্চর্য দেবকে দেখেছিলাম তিনিই তোমার এই আত্মীয় জনার্দন। এঁর বরে আমার স্মৃতি নষ্ট হয় না, আমি দীর্ঘায়ু ইচ্ছামৃত্যু হয়েছি। এই অচিন্ত্যস্বভাব মহাবাহু কৃষ্ণ যেন ক্রীড়ায় নিরত আছেন। তোমরা এঁর শরণ নাও। মার্কণ্ডেয় এইরূপ বললে পাণ্ডবগণ ও দ্রৌপদী জনার্দন কৃষ্ণকে নমস্কার করলেন।
**
(১) অনেকে বৎসরের অর্থ করেন দৈব বৎসর, অর্থাৎ মানুষের ৩৬০ বৎসর।
(২) যে কালে যুগলক্ষণ ক্ষীণ হয়।
(৩) যে কালে পরবর্তী যুগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।
(৪) অতসী বা তিসির ফুল নীলবর্ণ।
(৫) বিষ্ণুর বক্ষের রোমবর্ত।
৪০। পরীক্ষিৎ ও মণ্ডুকরাজকন্যা-শল, দল ও বামদেব
যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে মার্কণ্ডেয় ব্রাহ্মণমাহাত্ম্য-বিষয়ক আরও উপাখ্যান বললেন।-অযোধ্যায় পরীক্ষিৎ নামে ইন্ড্রাকুবংশীয় এক রাজা ছিলেন। একদিন তিনি অশ্বারোহণে মৃগয়ায় গিয়ে ক্ষুধাতৃষ্ণায় কাতর হয়ে নিবিড় বনে এক সরোবর দেখতে পেলেন। রাজা স্নান করে অশ্বকে মৃণাল খেতে দিয়ে সরোবরের তীরে বসলেন। তিনি দেখলেন, এক পরমসুন্দরী কন্যা ফুল তুলতে তুলতে গান করছে। রাজা বললেন, ভদ্রে, তুমি কে? আমি তোমার পাণিপ্রার্থী। কন্যা বললে, আমি কন্যা; যদি প্রতিজ্ঞা কর যে আমাকে কখনও জল দেখাবে না তবেই বিবাহ হ’তে পারে। রাজা সম্মত হলেন এবং কন্যাকে বিবাহ করে রাজধানীতে নিয়ে গেলেন। তিনি পত্নীর সঙ্গে নির্জন স্থানে বাস করতে লাগলেন।
পরিচারিকাদের কাছে কন্যার বৃত্তান্ত শুনে রাজমন্ত্রী বহুবৃক্ষশোভিত এক উদ্যান রচনা করলেন। সেই উদ্যানের এক পার্শ্বে একটি পুষ্করিণী ছিল, তার জল মুক্তাজাল দিয়ে এবং পাড় চুনের লেপে ঢাকা। মন্ত্রী রাজাকে বললেন, এই মনোরম উদ্যানে জল নেই, আপনি এখানে বিহার করুন। রাজা তার মহিষীর সঙ্গে সেখানে বাস করতে লাগলেন। একদিন তারা বেড়াতে বেড়াতে শ্রান্ত হয়ে সেই পুষ্করিণীর তীরে এলেন। রাজা রানীকে বললেন, তুমি জলে নাম। রানী জলে নিমগ্ন হলেন, আর উঠলেন না। রাজা তখন সেই পুষ্করিণী জলশূন্য করালেন এবং তার মধ্যে একটা ব্যাং দেখে আজ্ঞা দিলেন, সমস্ত মণ্ডুক বধ কর। মণ্ডুরাজ তপস্বীর বেশে রাজার কাছে এসে বললেন, মহারাজ, বিনা দোষে ভেক বধ করবেন না। রাজা বললেন, এই দুরাত্মারা আমার প্রিয়াকে খেয়ে ফেলেছে। মণ্ডুকরাজ নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার নাম আয়, আপনার ভাষা আমার কন্যা সুশোভনা। তার এই দুষ্ট স্বভাব-সে অনেক রাজাকে প্রতারণা করেছে। রাজার প্রার্থনায় আয়ু তার কন্যাকে। এনে দিলেন এবং তাকে অভিশাপ দিলেন, তোমার অপরাধের ফলে তোমার সন্তান ব্রাহ্মণের অনিষ্টকারী হবে।
সুশোভনার গর্ভে পরীক্ষিতের তিন পুত্র হল —শল, দল, বল। যথাকালে শলকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে পরীক্ষিৎ বনে চ’লে গেলেন। একদিন শল রথে চড়ে মৃগয়ায়। গিয়ে একটি দ্রুতগামী হরিণকে ধরতে পারলেন না। সারথি বললে, এই রথে যদি বামী নামক দুই অশ্ব জোতা হয় তবেই মৃগকে ধরতে পারবেন। মহর্ষি বামদেবের সেই অশ্ব আছে জেনে রাজা তার আশ্রমে গিয়ে অশ্ব প্রার্থনা করলেন। বামদেব বললেন, নিয়ে যাও, কিন্তু কৃতকার্য হলেই শীঘ্র ফিরিয়ে দিও। রাজা সেই দুই অশ্ব রথে যোজনা করে হরিণ ধরলেন, কিন্তু রাজধানীতে গিয়ে অশ্ব ফেরত পাঠালেন না। বামদেব তাঁর শিষ্য আত্রেয়কে রাজার কাছে পাঠালে রাজা বললেন, এই দুই অশ্ব রাজারই যোগ্য, ব্রাহ্মণের অশ্বে কি প্রয়োজন? তার পর বামদেব স্বয়ং এসে অশ্ব চাইলেন। রাজা বললেন মহর্ষি, সুশিক্ষিত বৃষই ব্রাহ্মণের উপযুক্ত বাহন; আর, বেদও তো আপনাদের বহন করে। শল রাজা যখন কিছুতেই দুই অশ্ব ফেরত দিলেন না, তখন বামদেবের আদেশে চারজন ঘোররূপ রাক্ষস আবির্ভূত হয়ে শূলহস্তে রাজাকে মারতে গেল। রাজা উচ্চস্বরে বললেন, ইক্ষাকুবংশীয়গণ, আমার ভ্রাতা দল এবং সভাস্থ বৈশ্যগণ যদি আমার অনুবর্তী হন তবে এই রাক্ষসদের নিবারণ করুন; বামদেব ধর্মশীল নন। এইরূপ বলতে বলতে শল রাক্ষসদের হাতে নিহত হলেন।
ইক্ষাকুবংশীয়গণ দলকে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। বামদেব তাঁর কাছে অশ্ব চাইলে দল ক্রুদ্ধ হয়ে তার সারথিকে বললেন, আমার যে বিষলিপ্ত বিচিত্র বাণ আছে তারই একটা নিয়ে এস, বামদেবকে মারব, তার মাংস কুকুরুরা খাবে। বামদেব বললেন, রাজা, সেনজিৎ নামে তোমার যে দশবৎসর বয়স্ক পুত্র আছে তাকেই তোমার বাণ বধ করুক। দলের বাণ অন্তঃপুরে গিয়ে রাজপুত্রকে বধ করলে। রাজা আর একটা বাণ আনতে বললেন, কিন্তু তার হাত বামদেবের শাপে অবশ হয়ে গেল। রাজা বললেন, সকলে দেখুন, বামদেব আমাকে স্তম্ভিত করেছেন, আমি তাকে শরাঘাতে মারতে পারছি না, অতএব তিনি দীর্ঘায়ু হয়ে জীবিত থাকুন। বামদেব বললেন, রাজা, তোমার মহিষীকে বাণ দিয়ে স্পর্শ কর, তা হলে পাপমুক্ত হবে। রাজা দল তা করলে মহিষী বললেন, এই নৃশংস রাজাকে আমি প্রতিদিন সদপদেশ দিই, ব্রাহ্মণগণকেও সত্য ও প্রিয় বাক্য বলি, তার ফলে আমি পুণ্যলোক লাভ করব। মহিষীর উপর তুষ্ট হয়ে বামদেব বর দিলেন, তার ফলে দল পাপমুক্ত হয়ে শুভাশীর্বাদ লাভ করলেন এবং অশ্ব ফিরিয়ে দিলেন।
৪১। দীর্ঘায়ু বক ঋষি-শিবি ও সুহোত্র-যযাতির দান
তার পর মার্কণ্ডেয় ইন্দ্রসখা দীর্ঘায়ু বক ঋষির এই উপাখ্যান বললেন।-দেবাসুরযুদ্ধের পর ইন্দ্র ত্রিলোকের অধিপতি হয়ে নানাস্থানে বিচরণ করতে করতে পূর্বসমুদ্রের নিকটে বক ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। বক পাদ্য অর্ঘ্য আসনাদি নিবেদন করলে ইন্দ্র বললেন, আপনার লক্ষ বৎসর বয়স হয়েছে; চিরজীবীদের কি দুঃখ তা আমাকে বলুন। বক বললেন, অপ্রিয় লোকের সঙ্গে বাস, প্রিয় লোকের বিরহ, অসাধু লোকের সঙ্গে মিলন, পুত্র-দারাদির বিনাশ, পরাধীনতার কষ্ট ধনহীনতার জন্য অবমাননা, অকুলীনের কুলমর্যাদা, কুলীনের কুলক্ষয়—চিরজীবীদের এইসব দেখতে হয়, এর চেয়ে অধিক দুঃখ আর কি আছে? ইন্দ্র আবার প্রশ্ন করলেন, চিরজীবীদের সুখ কি তা বলুন। বক উত্তর দিলেন, কুমিত্রকে আশ্রয় না করে দিবসের অষ্টম বা দ্বাদশ ভাগে শাক ভক্ষণ-এর চেয়ে সুখতর কি আছে? অতিভোজী না হয়ে নিজ গৃহে নিজ শক্তিতে আহৃত ফল বা শাক ভোজনই শ্রেয়, পরগৃহে অপমানিত হয়ে সুস্বাদু খাদ্য ভোজনও শ্রেয় নয়। অতিথি ভৃত্য ও পিতৃগণকে অন্নদান করে যে অবশিষ্ট অন্ন খায় তার চেয়ে সুখী কে আছে? মহর্ষি বকের সঙ্গে নানাপ্রকার সদালাপ করে দেবরাজ সুরলোকে চ’লে গেলেন।
পাণ্ডবগণ ক্ষত্রিয়মাহাত্ম শুনতে চাইলে মার্কণ্ডেয় বললেন।-একদা কুরুবংশীয় সুহোত্র রাজ্য পথিমধ্যে উশীনরপুত্র রথারূঢ় শিবি রাজাকে দেখতে পেলেন। তারা বয়স অনুসারে পরস্পরকে সম্মান দেখালেন, কিন্তু গুণে দুজনেই সমান এই ভেবে কেউ কাকেও পথ ছেড়ে দিলেন না। সেই সময়ে নারদ সেখানে এসে বললেন, তোমরা পরস্পরের পথ রোধ করে রয়েছ কেন? রাজারা উত্তর দিলেন, ভগবান, যিনি যিনি শ্রেষ্ঠ তাকেই পথ ছেড়ে দেবার বিধি আছে। আমরা তুল্যগুণশালী সখা, সেজন্য কে শ্রেষ্ঠ তা স্থির করতে পারছি না। নারদ বললেন, ক্রুর লোক মৃদুস্বভাব লোকের প্রতিও ক্রুরতা করে, সাধুজন অসাধুর প্রতিও সাধুতা করেন, তবে সাধুর সহিত সাধু সদাচরণ করবেন না কেন? শিবি রাজা সুহোত্রের চেয়ে সাধুস্বভাব।-
জয়েৎ কদর্যং দানেন সত্যেনাতবাদিন।
ক্ষময়া ক্রকর্মাণমসাধুং সাধুনা জয়েৎ।।
–দান করে কৃপণকে, সত্য বলে মিথ্যাবাদীকে, ক্ষমা করে অকর্মাকে, এবং সাধুতার দ্বারা অসাধুকে জয় করবে।
নারদ তার পর বললেন, তোমরা দুজনেই উদার; যিনি অধিকতর উদার তিনিই সরে গিয়ে পথ দিন, উদারতার তাই শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হবে। তখন সুহোত্র শিবিকে প্রদক্ষিণ করে পথ ছেড়ে দিলেন এবং তার বহু সৎকর্মের প্রশংসা করে চ’লে গেলেন। এইরূপে রাজা সুহোত্র তার মাহাত্ম্য দেখিয়েছিলেন।
তারপর মার্কণ্ডেয় এই উপাখ্যান বললেন।
-একদিন রাজা যযাতির কাছে এক ব্রাহ্মণ এসে বললেন, মহারাজ, গুরুর জন্য আমি আপনার কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছি। দেখা যায় লোকে যাচকের উপর অসন্তুষ্ট হয়; আপনার জিজ্ঞাসা করছি, আমার প্রার্থিত বস্তু আপনি তুষ্ট হয়ে দেবেন কিনা? রাজা বললেন, আমি দান করে তা প্রচার করি না, যা দান করা অসম্ভব তার জন্য প্রতিশ্রুতি দিই না। যা দানের যোগ্য তা দিয়ে আমি অতিশয় সুখী হই, দান করে কখনও অনুতাপ করি না। এই বলে রাজা যযাতি ব্রাহ্মণকে তার প্রার্থিত সহস্ৰ ধেনু দান করলেন।
৪২। অষ্টক, প্রতর্দন, বসুমনা ও শিবি-ইন্দ্রদ্যুম্ন
মার্কণ্ডেয় ক্ষত্রিয়মাহাত্ম-বিষয়ক আরও উপাখ্যান বললেন। বিশ্বামিত্রের পুত্র অষ্টক রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞ সমাপ্ত করে তার ভ্রাতা (১) প্রতর্দন, বসুমনা ও শিবিরের সঙ্গে থারোহণে যাচ্ছিলেন এমন সময়ে দেবর্ষি নারদের সঙ্গে দেখা হল। অষ্টক অভিবাদন করে নারদকে রথে তুলে নিলেন। যেতে যেতে এক ভ্রাতা নারদকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা চারজনেই স্বর্গে যাব, কিন্তু নরলোকে কে আগে ফিরে আসবেন? নারদ বললেন, অষ্টক। যখন আমি তার গৃহে বাস করছিলাম তখন একদিন তার সঙ্গে রথে যেতে যেতে নানা বর্ণের বহু সহস্র গরু দেখতে পাই। আমি জিজ্ঞাসা করলে অষ্টক বললেন, আমিই এই সব গরু দান করেছি। এই আত্মশ্লাঘার জন্যই অষ্টকের আগে পতন হবে।
আর এক ভ্রাতা প্রশ্ন করলেন, অষ্টকের পর কে অবতরণ করবেন ? নারদ বললেন, প্রতদন। একদিন তার সঙ্গে আমি রথে যাচ্ছিলাম এমন সময়ে এক ব্রাহ্মণ এসে একটি অশ্ব চাইলেন। প্রতর্দন বললেন, আমি ফিরে এসে দেব। ব্রাহ্মণ বললেন, এখনই দিন। প্রতন রথের দক্ষিণ পার্শ্বের একটি অশ্ব খুলে দান করলেন। তার পর আর এক ব্রাহ্মণের প্রার্থনায় তাকে বাম পার্শ্বের একটি অশ্ব দিলেন। তার পর আরও দুইজন ব্রাহ্মণের প্রার্থনায় অবশিষ্ট দুই অশ্ব দিয়ে স্বয়ং রথ টানতে টানতে বললেন, এখন আর ব্রাহ্মণদের চাইবার কিছু নেই। প্রতর্দন দান করে অসুয়াগ্রস্ত হয়েছিলেন সেজন্যই তাঁর পতন হবে।
তারপর একজন প্রশ্ন করলেন, দুজনের পর কে স্বর্গচ্যুত হবেন? নারদ বললেন, বসুমনা। একদিন আমি তার গৃহে গিয়ে আশীর্বাদ করি—তোমার পুষ্পক রথ লাভ হ’ক। বসুমনা পুষ্পক রথ পেলে আমি তার প্রশংসা করলাম। তিনি বললেন, ভগবান, এ রথ আপনারই। তার পর দ্বিতীয়বার আমি তার কাছে গিয়ে রথের প্রশংসা করলাম, তিনি আবার বললেন, রথ আপনারই। আমার রথের প্রয়োজন ছিল, তৃতীয় বার তার কাছে গেলাম কিন্তু রথ না দিয়ে তিনি বললেন, আপনার আশীর্বাদ সত্য হয়েছে। এই কপট বাক্যের জন্যই বসুমনার পতন হবে।
তারপর একজন প্রশ্ন করলেন, বসুমনার পর কে অবতরণ করবেন? নারদ বললেন, শিবি স্বর্গে থাকবেন, আমারই পতন হবে। আমি শিবির সমান নই। একদিন এক ব্রাহ্মণ শিবির কাছে এসে বলেছিলেন, আমি অন্নপ্রার্থী, তোমার পুত্র বৃহগর্ভকে বধ কর, তার মাংস আর অন্ন পাক করে আমার প্রতীক্ষায় থাক। শিবি তার পুত্রের পক্ক মাংস একটি পাত্রে রেখে তা মাথায় নিয়ে ব্রাহ্মণের খোঁজ করতে লাগলেন। একজন তাকে বললে, ব্রাহ্মণ ক্রুদ্ধ হয়ে আপনার গৃহ কোষাগার আয়ুধাগার অন্তঃপুর অশ্বশাল হস্তিশালা দগ্ধ করছেন। শিবি অবিকৃতমুখে ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে বললেন, ভগবান, আপনার অন্ন প্রস্তুত হয়েছে, ভোজন করুন। ব্রাহ্মণ বিস্ময়ে অধোমুখ হয়ে রইলেন। শিবি আবার অনুরোধ করলে ব্রাহ্মণ বললেন, তুমিই খাও। শিবি অব্যাকুলচিত্তে ব্রাহ্মণের আজ্ঞা পালন করতে উদ্যাত হলেন। ব্রাহ্মণ তখন তাঁর হাত ধরে বললেন, তুমি জিতক্রোধ, ব্রাহ্মণের জন্য তুমি সবই ত্যাগ করতে পার। শিবি দেখলেন, দেবকুমারতুল্য পুণাগন্ধান্বিত অলংকারধারী তার পুত্র সম্মুখে রয়েছে। ব্রাহ্মণ অন্তর্হিত হলেন। তিনি স্বয়ং বিধাতা, রাজর্ষি শিবিকে পরীক্ষা করবার জন্য এসেছিলেন। অমাত্যগণ শিবিকে প্রশ্ন করলেন, কোন্ ফল লাভের জন্য আপনি এই কর্ম করলেন? শিবি উত্তর দিলেন, যশোলাভ বা ধনভোগের উদ্দেশ্যে করিনি, সজ্জনের যা প্রশস্ত। আচরণ তাই আমি করেছি।
পাণ্ডবগণ মার্কণ্ডেয়কে প্রশ্ন করলেন, আপনার চেয়ে প্রাচীন কেউ আছেন কি? মার্কণ্ডেয় বললেন, পুণ্যক্ষয় হলে রাজর্ষি ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বর্গ থেকে চ্যুত হয়ে আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে চেনেন কি? আমি বললাম, আমি নিজ কার্যে ব্যস্ত থাকি সেজন্য সকলকে মনে রাখতে পারি না। হিমালয়ে প্রাবারকর্ণ নামে এক পেচক বাস করে, সে আমার চেয়ে প্রাচীন, হয়তো আপনাকে চেনে। ইন্দ্রদ্যুম্ন অশ্ব হয়ে আমাকে পেচকের কাছে বহন করে নিয়ে গেলেন। পেয়ক তাকে বললে, তোমাকে চিনি না; ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবরে নাড়ীজঙ্ নামে এক বক আছে, সে আমার চেয়ে প্রাচীন, তাকে প্রশ্ন কর। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আমাকে আর পেচককে নাড়ীজঙ্ঘের কাছে নিয়ে গেলেন। সে বললে, আমি এই রাজাকে চিনি না; এই সরোবরে আমার চেয়ে প্রাচীন অকূপার নামে এক কচ্ছপ আছে, তাকে প্রশ্ন কর। বকের আহ্বানে কচ্ছপ সরোবর থেকে উঠে এল। আমাদের প্রশ্ন শুনে সে মুহূর্তকাল চিন্তা করে অপূর্ণনয়নে কম্পিতদেহে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললে, এঁকে জানব না কেন? ইনি এখানে সহস্র যজ্ঞ করে যূপকাষ্ঠ প্রোথিত করেছিলেন; ইনি দক্ষিণাস্বরূপ যে সকল ধেনু দান করেছিলেন তাদেরই বিচরণের ফলে এই সরোবর উৎপন্ন হয়েছে।
তখন স্বর্গ থেকে দেবরথ এল এবং ইন্দ্রদ্যুম্ন এই দৈববাণী শুনলেন-তোমার জন্য স্বর্গ প্রস্তুত, তুমি কীর্তিমান, তোমার যোগ্য স্থানে এস।
দিবং স্মৃতি ভূমিঞ্চ শব্দঃ পুণ্যস্য কর্মণঃ।।
যাবৎ স শব্দো ভবতি তাবৎ পুরুষ উচাতে ৷৷
অকীর্তিঃ কীর্ততে লোকে যস্য ভূতস্য কস্যচিৎ।
স পতত্যধমাল্লোকান্ যাবচ্ছব্দঃ প্রকীর্ততে৷৷
-পুণ্যকর্মের শব্দ (প্রশংসাবাদ) স্বর্গ ও পৃথিবী স্পর্শ করে; যত কাল সেই শব্দ থাকে তত কালই লোকে পুরুষরূপে গণ্য হয় (২)। যত কাল কোনও লোকের অকীর্তি প্রচারিত হয় তত কাল সে নরকে পতিত থাকে।
তার পর ইন্দ্রদ্যুম্ন (৩) আমাদের সকলকে নিজ নিজ স্থানে রেখে দেবরথে স্বর্গে প্রস্থান করলেন।
**
(১) বৈপিত্র ভ্রাতা। উদযোগপর্ব ১৫-পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।
(২) এই শ্লোক ৫৭-পরিচ্ছেদও আছে।
(৩) ইনিই পুরীধামের জগন্নাথ-বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা এই খ্যাতি আছে।
৪৩। ধুন্ধুমার
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করলেন, ইক্ষাকুবংশীয় রাজা কুবলাশ্ব কি কারণে ধুন্ধুমার নাম পান? মার্কণ্ডেয় বললেন, উতঙ্ক (১) নামে খ্যাত এক মহর্ষি ছিলেন, তিনি মরুভূমির নিকটবর্তী রমণীয় প্রদেশে বাস করতেন। তাঁর কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু তাকে বর দিতে চাইলে তিনি বললেন, জগতের প্রভু হরিকে দেখলাম, এই আমার পর্যাপ্ত বর। বিষ্ণু তথাপি অনুরোধ করলে উতঙ্ক বললেন, আমার যেন ধর্মে সত্যে ও ইন্দ্রিয়সংযমে মতি এবং আপনার সান্নিধ্য লাভ হয়। বিষ্ণু বললেন, এ সমস্তই তোমার হবে, তা ভিন্ন তুমি যোগসিদ্ধ হয়ে মহৎ কার্য করবে। তোমার যোগবল অবলম্বন করে রাজা কুবলাশ্ব ধুন্ধু নামক মহাসুরকে বধ করবেন।
ইক্ষাকুরু পর যথাক্রমে শশাদ কুকুৎস্য অনেশ পৃথু বিগশ্ব অদ্রি যুবনাশ্ব শ্রাব শ্রাবস্তক (যিনি শ্রাবন্তী নগরী নির্মাণ করেছিলেন) ও বৃহদশ্ব অযোধ্যার রাজা হন। তার পুত্র কুবলাশ্ব। বৃহদশ্ব বনে যেতে চাইলে মহর্যি উতঙ্ক তাকে বারণ করে বললেন, আপনি রাজ্যরক্ষা ও প্রজাপালন করুন, তার তুল্য ধর্মকার্য অরণ্যে হ’তে পারে না। আমার আশ্রমের নিকটে মরুপ্রদেশে উজ্জ্বালক নামে এক বালুকাপূর্ণ সমুদ্র আছে, সেখানে মধু-কৈটভের পুত্র ধুন্ধু নামে এক মহাবল দানব ভূমির ভিতরে বাস করে। আপনি তাকে বধ করে অক্ষয় কীর্তি লাভ করুন, তার পর বনে যাবেন। বালুকার মধ্যে নিদ্রিত এই দানব যখন বৎসরান্তে নিঃশ্বাস ফেলে তখন সপ্তাহকাল ভূকম্প হয়, সূর্য পর্যন্ত ধূলি ওড়ে, স্ফুলিঙ্গ অগ্নিশিখা ও ধূম নির্গত হয়। রাজর্ষি বৃহদশ্ব কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, ভগবান, আমার পুত্র কুবলাশ্ব তার বীর পুত্রদের সঙ্গে আপনার প্রিয়কার্য করবে, আমাকে বনে যেতে দিন। উতঙ্ক তথাস্তু বলে তপোবনে চ’লে গেলেন।
প্রলয়সমুদ্রে বিষ্ণু যখন অনন্ত নাগের দেহের উপর যোগনিদ্রায় মগ্ন ছিলেন তখন তার নাভি হ’তে নির্গত পদ্মে ব্রহ্মা উৎপন্ন হয়েছিলেন। মধু ও কৈটভ নামে দুই দানব ব্রহ্মাকে সন্ত্রস্ত করলে। তখন ব্রহ্মা পদ্মনাল কম্পিত করে বিষ্ণুকে জাগরিত করলেন। বিষ্ণু দুই দানবকে স্বাগত জানালেন। তারা হাস্য করে বললে, তুমি আমাদের নিকট বর চাও। বিষ্ণু বললেন, লোকহিতের জন্য আমি এই বর চাচ্ছি—তোমরা আমার বধ্য হও। মধু-কৈটভ বললে, আমরা কখনও মিথ্যা বলি না, রূপ শৌর্য ধর্ম তপস্যা দান সদাচার প্রভৃতিতে আমাদের তুল্য কেউ নেই। তুমি অনাবৃত স্থানে আমাদের বধ কর এবং এই বর দাও যেন আমরা তোমার পুত্র হই। বিষ্ণু বললেন, তাই হবে। পৃথিবী ও স্বর্গে কোথাও অনাবৃত স্থান না দেখে বিষ্ণু তার অনাবৃত উরুর উপরে মধু ও কৈটভের মস্তক সুদর্শন চক্রে কেটে ফেললেন।
মধু-কৈটভের পুত্র ধুন্ধু তপস্যা করে ব্রহ্মার বরে দেব দানব যক্ষ গন্ধর্ব নাগ ও রাক্ষসের অবধ্য হয়েছিল। সে বালুকার মধ্যে লুকিয়ে থেকে উতঙ্কের আশ্রমে উপদ্রব করত। উতঙ্কের অনুরোধে বিষ্ণু কুবলাশ্ব রাজার দেহে প্রবেশ করলেন। কুবলাশ্ব তার একুশ হাজার পুত্র ও সৈন্য নিয়ে ধুন্ধুবধের জন্য যাত্রা করলেন। সপ্তাহকাল বালুকাসমুদ্রের সর্বদিক খনন করার পর নিদ্রিত ধুন্ধুকে দেখা গেল। সে গাত্রোত্থান করে তার মুখনিৰ্গত অগ্নিতে কুবলাশ্বের পুত্রদের দগ্ধ করে ফেললে। কুবলাশ্ব যোগশক্তির প্রভাবে ধুন্ধুর মুখাগ্নি নির্বাপিত করলেন এবং ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে তাকে দগ্ধ করে বধ করলেন। সেই অবধি তিনি ধুন্ধুমার নামে খ্যাত হলেন।
** (১) এঁর কথা আশ্রমবাসিকপর্ব ৫-৬-পরিচ্ছেদে আছে।
৪৪। কৌশিক, পতিব্রতা ও ধর্মব্যাধ
যুধিষ্ঠির বললেন, ভগবান, আপনি নারীর শ্রেষ্ঠ মাহাত্ম্য এবং সূক্ষ্ম ধর্ম সম্বন্ধে বলুন। মার্কণ্ডেয় বললেন, আমি পতিব্রতার ধর্ম বলছি শোন।
-কৌশিক নামে এক তপস্বী ব্রাহ্মণ ছিলেন। একদিন তিনি বৃক্ষমূলে বসে বেদপাঠ করছিলেন এমন সময়ে এক বলাকা (স্ত্রী-বক) তার মাথার উপরে মলত্যাগ করলে। কৌশিক ক্রুদ্ধ হয়ে তার দিকে চাইলেন, বলাকা তখনই মরে পড়ে গেল। তাকে ভূপতিত দেখে ব্রাহ্মণ অনুতপ্ত হয়ে ভাবলেন, আমি ক্রোধের বশে অকার্য করে ফেলেছি।
তারপর কৌশিক ভিক্ষার জন্য গ্রামে গিয়ে একটি পূর্বপরিচিত গৃহে প্রবেশ করে বললেন, ভিক্ষা দাও। তাকে অপেক্ষা করতে বলে গৃহিণী ভিক্ষাপাত্র পরিষ্কার করতে গেলেন। এমন সময়ে গৃহস্বামী ক্ষুধার্ত হয়ে গৃহে এলেন, সাধ্বী গৃহিণী তখন ব্রাহ্মণকে ছেড়ে পা আর মুখ ধোবার জল, আসন ও খাদ্যপানীয় দিয়ে স্বামীর সেবা করতে লাগলেন। তার পর তিনি ভিক্ষার্থী ব্রাহ্মণকে স্মরণ করে লজ্জিত হয়ে তাকে ভিক্ষা দিতে গেলেন। কৌশিক ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, এর অর্থ কি? তুমি আমাকে অপেক্ষা করতে বলে আটকে রাখলে কেন? সাধ্বী গৃহিণী বললেন, আমাকে ক্ষমা করুন, আমার স্বামী পরমদেবতা, তিনি শ্রান্ত ও ক্ষুধিত হয়ে এসেছেন সেজন্য তার সেবা আগে করেছি। কৌশিক বললেন, তুমি স্বামীকেই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে ব্রাহ্মণকে অপমান করলে ! ইন্দ্রও ব্রাহ্মণের নিকট প্রণত থাকেন। তুমি কি জান না যে, ব্রাহ্মণ পৃথিবী দগ্ধ করতে পারেন?
গৃহিণী বললেন, ক্রোধ ত্যাগ করুন, আমি বলাকা নই, ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে আপনি আমার কি করবেন ? আমি আপনাকে অবজ্ঞা করিনি, ব্রাহ্মণদের তেজ ও মাহাত্ম্য আমার জানা আছে, তাদের ক্রোধ যেমন বিপুল, অনুগ্রহও সেইরূপ। আপনি আমার ত্রুটি ক্ষমা করুন। পতিসেবাই আমি শ্রেষ্ঠ ধর্ম মনে করি, তার ফল আমি কি পেয়েছি দেখুন—আপনি ক্রুদ্ধ হয়ে বলাকাকে দগ্ধ করেছেন তা আমি জানতে পেরেছি। দ্বিজোত্তম, ক্রোধ মানুষের শরীরস্থ শত্রু, যিনি ক্রোধ ও মোহ ত্যাগ করেছেন দেবতারা তাকেই ব্রাহ্মণ মনে করেন। আপনি ধর্মজ্ঞ, কিন্তু ধর্মের যথার্থ তত্ত্ব জানেন না। মিথিলায় এক ব্যাধ আছেন, তিনি পিতা-মাতার সেবক, সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয়। আপনি সেই ধর্মব্যাধের কাছে যান, তিনি আপনাকে ধর্মশিক্ষা দেবেন। আমার বাচালতা ক্ষমা করুন, স্ত্রী সকলেরই অবধ্য।
কৌশিক বললেন, শোভনা, আমি প্রীত হয়েছি, আমার ক্রোধ দূর হয়েছে, তোমার ভর্ৎসনায় আমার মঙ্গল হবে। তার পর কৌশিক জনকরাজার পুরী মিথিলায় গেলেন এবং ব্রাহ্মণদের জিজ্ঞাসা করে ধর্মব্যাধের নিকট উপস্থিত হলেন। ধর্মব্যাধ তখন তার বিপণিতে বসে মৃগ ও মহিষের মাংস বিক্রয় করছেন, বহু ক্রেতা সেখানে এসেছে। কৌশিককে দেখে ধর্মব্যাধ সসম্ভ্রমে অভিবাদন করে বললেন, এক পতিব্রতা নারী আপনাকে এখানে আসতে বলেছেন তা আমি জানি। এই স্থান আপনার যোগ্য নয়, আমার গৃহে চলুন। ধর্মব্যাধের গৃহে গিয়ে কৌশিক বললেন, বৎস, তুমি যে ঘোর কর্ম কর তা তোমার যোগ্য নয়। ধর্মব্যাধ বললেন, আমি আমার কুলোচিত কর্মই করি। আমি বিধাতার বিহিত ধর্ম পালন করি, বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা করি, সত্য বলি, অসূয়া করি না, যথাশক্তি দান করি, দেবতা অতিথি ও ভৃত্যদের ভোজনের পর অবশিষ্ট অন্ন খাই। আমি নিজে প্রাণিবধ করি না, অন্যে যে বরাহ-মহিষ মারে আমি তাই বেচি। আমি মাংস খাই না, কেবল ঋতুকালে ভার্ষার সহবাস করি, দিনে উপবাসী থেকে রাত্রে ভোজন করি। আমার বৃত্তি অতি দারুণ, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দৈবকে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য, আমি পূর্বকৃত কর্মের ফল ভোগ করছি। মাংসে দেবতা পিতৃগণ অতিথি ও পরিজনের সেবা হয়, সেজন্য নিহত পশুরও দর্ম হয়। শ্রুতিতে আছে, অন্নের ন্যায় ওষধি লতা পশু পক্ষীও মানুষের খাদ্য। রাজা রন্তিদেবের পাকশালায় প্রত্যহ দু হাজার গরু পাক হত। যথাবিধানে মাংস খেলে পাপ হয় না। ধান্যাদি শস্যবীজও জীব, প্রাণী পরস্পরকে ভক্ষণ করেই জীবিত থাকে, মানুয চলবার সময় ভূমিস্থিত বহু প্রাণী বধ করে। জগতে অহিংসক কেউ নেই।
তার পর ধর্ম, দর্শন ও মোক্ষ সম্বন্ধে বহু উপদেশ দিয়ে ধর্মব্যাধ বললেন, যে ধর্ম দ্বারা আমি সিদ্ধিলাভ করেছি তা আপনি প্রত্যক্ষ করুন। এই বলে তিনি কৌশিককে এক মনোরম সৌধে নিয়ে গেলেন, সেখানে ধর্মব্যাধের মাতা-পিতা আহারের পর শুক্ল বসন ধারণ করে সন্তুষ্ট চিত্তে উত্তম আসনে বসে আছেন। ধর্মব্যাধ মাতা-পিতার চরণে মস্তক রাখলে তারা বললেন, পুত্র, ওঠ ওঠ, ধর্ম। তোমাকে রক্ষা করুন। ধর্মব্যাধ কৌশিককে বললেন, এঁরাই আমার পরমদেবতা, ইন্দ্রাদি তেত্রিশ দেবতার সমান। আপনি নিজের মাতা-পিতাকে অবজ্ঞা করে তাদের অনুমতি না নিয়ে বেদাধ্যায়নের জন্য গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলেন। আপনার শোকে তারা অন্ধ হয়ে গেছেন, আপনি শীঘ্র গিয়ে তাদের প্রসন্ন করুন।
কৌশিক বললেন, আমি নরকে পতিত হচ্ছিলাম, তুমি আমাকে উদ্ধার করলে। তোমার উপদেশ অনুসারে আমি মাতা-পিতার সেবা করব। তোমাকে আমি শূদ্র মনে করি না, কোন্ কর্মের ফলে তোমার এই দশা হয়েছে? ধর্মব্যাধ বললেন, পূর্বজন্মে আমি বেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণ ও এক রাজার সখ্য ছিলাম। তার সঙ্গে মৃগয়ায় গিয়ে আমি মৃগ মনে করে এক ঋষিকে বাণবিদ্ধ করি। তার অভিশাপে আমি ব্যাধ হয়ে জন্মেছি। আমার প্রার্থনায় তিনি বললেন, তুমি শূদ্রযোনিতে জন্মগ্রহণ করেও ধর্মজ্ঞ জাতিস্মর ও মাতা-পিতার সেবাপরায়ণ হবে, শাপক্ষয় হলে আবার ব্রাহ্মণ হবে। তার পর আমি সেই ঋষির দেহ থেকে শর তুলে ফেলে তাকে তার আশ্রমে নিয়ে গেলাম। তিনি মরেননি।
ধর্মব্যাধকে প্রদক্ষিণ করে কৌশিক তার আশ্রমে ফিরে গেলেন এবং মাতা-পিতার সেবায় নিরত হলেন।
৪৫। দেবসেনা ও কার্তিকেয়
মার্কণ্ডেয় বললেন, আমি এখন অগ্নিপুত্র কার্তিকেয়র কথা বলছি তোমার শোন।
-দেবগণের সহিত যুদ্ধে দানবগণ সর্বদাই জয়ী হয় দেখে দেবরাজ ইন্দ্র একজন সেনাপতির অনুসন্ধান করতে লাগলেন। একদিন তিনি মানস পর্বতে স্ত্রীকণ্ঠের আর্তনাদ শুনে কাছে গিয়ে দেখলেন, কেশী দানব একটি কন্যার হাত ধরে আছে। ইন্দ্রকে দানব বললে, এই কন্যাকে আমি বিবাহ করব, তুমি বাধা দিও না, চ’লে যাও। তখন কেশীর সঙ্গে ইন্দ্রের যুদ্ধ হল কেশী পরাস্ত হয়ে পালিয়ে গেল। কন্যা ইন্দ্রকে বললেন, আমি প্রজাপতির কন্যা দেবসেনা, আমার ভগিনী দৈত্যসেনাকে কেশী হরণ করেছে। আপনার নির্দেশে আমি অজেয় পতি লাভ করতে ইচ্ছা করি।ইন্দ্র বললেন, তুমি আমার মাতৃধসার কন্যা। এই বলে ইন্দ্র দেবসেনাকে ব্রহ্মার কাছে নিয়ে গেলেন। ব্রহ্মা বললেন, এক মহাবিক্রমশালী পুরুষ জন্মগ্রহণ করে এই কন্যার পতি হবেন, তিনি তোমার সেনাপতিও হবেন।
ইন্দ্র দেবসেনাকে বশিষ্ঠাদি সপ্তর্ষির যজ্ঞস্থানে নিয়ে গেলন। সেখানে অগ্নিদেব হোমকুণ্ড থেকে উঠে দেখলেন, অপূর্বসুন্দরী ঋষিপত্নীগণ কেউ আসনে বসে আছেন, কেউ শুয়ে আছেন। তাঁদের দেখে অগ্নি কামাবিষ্ট হলেন, কিন্তু তাদের পাওয়া অসম্ভব জেনে দেহত্যাগের সংকল্প করে বনে চ’লে গেলেন।
দক্ষকন্যা স্বাহা অগ্নিকে কামনা করতেন। তিনি মহর্ষি অঙ্গিরার ভার্যা শিবার রূপ ধরে অগ্নির কাছে এসে সংগম লাভ করলেন এবং অগ্নির শুক্র নিয়ে গরুড়-পক্ষিণী হয়ে কৈলাস পর্বতের এক কাঞ্চনকুণ্ডে তা নিক্ষেপ করলেন। তারপর তিনি সপ্তর্ষিগণের অন্যান্য ঋষির পত্নীরূপে পূর্ববৎ অগ্নির সঙ্গে মিলিত হলেন, কেবল বশিষ্ঠপত্নী অরুন্ধতীর তপস্যার প্রভাবে তার রূপ ধারণ করতে পারলেন না। এই প্রকারে স্বাহা ছ-বার কাঞ্চনকুণ্ডে অগ্নির শুক্র নিক্ষেপ করলেন। সেই স্কন্ন অর্থাৎ স্খলিত শুক্র থেকে স্কন্দ (১) উৎপন্ন হলেন; তার ঝয় মস্তক, এক গ্রীবা, এক উদর। ত্রিপুরাসুরকে বধ করে মহাদেব তার ধন রেখে দিয়েছিলেন, বালক স্কন্দ
সেই ধনু নিয়ে গর্জন করতে লাগলেন। বহু লোক ভীত হয়ে তার শরণাপন্ন হল, ব্রাহ্মণরা তাদের পারিষদ’ বলে থাকেন।
সপ্তর্ষিদের ছ-জন নিজ পত্নীদের ত্যাগ করলেন, তারা ভাবলেন তাদের পত্নীরাই স্কন্দের জননী। স্বাহা তাঁদের বারবার বললেন, আপনাদের ধারণা ঠিক নয়, এটি আমারই পুত্র। মহামুনি বিশ্বামিত্র কামার্ত অগ্নির পিছনে পিছনে গিয়েছিলেন সেজন্য তিনি প্রকৃত ঘটনা জানতেন। তিনি স্কন্দের জাতকর্মাদি ত্রয়োদশ মঙ্গলকার্য সম্পন্ন করে সপ্তর্ষিদের বললেন, আপনাদের পত্নীদের অপরাধ নেই; কিন্তু ঋষিরা তা বিশ্বাস করলেন না।
স্কন্দের বৃত্তান্ত শুনে দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন, এর বল অসহ্য হবে, শীঘ্র একে বধ করুন; কিন্তু ইন্দ্র সাহস করলেন না। তখন দেবতারা স্কন্দকে মারবার জন্য লোকমাতা (২) দের পাঠালেন। কিন্তু তারা গিয়ে বালককে বললেন, তুমি আমাদের পুত্র হও। স্কন্দ তাদের স্তন্যপান করলেন। সেই সময়ে অগ্নিও এলেন এবং মাতৃগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে স্কন্দকে রক্ষা করতে লাগলেন।
স্কন্দকে জয় করা দুঃসাধ্য জেনেও বজ্রধর ইন্দ্র সদলবলে তার কাছে গিয়ে সিংহনাদ করলেন। অগ্নিপুত্র কার্তিক সাগরের ন্যায় গর্জন করে মুখনির্গত অগ্নিশিখায় দেবসৈন্য দগ্ধ করতে লাগলেন। ইন্দ্র বজ্র নিক্ষেপ করলেন, কার্তিকের দক্ষিণ পার্শ্ব বিদীর্ণ হল , তা থেকে বিশাখ (৩) নামে এক যুবা উৎপন্ন হলেন, তার দেহ কাঞ্চনবর্ণ, কর্ণে দিব্য কুণ্ডল, হস্তে শক্তি অস্ত্র। তখন দেবরাজ ভয় পেয়ে কার্তিকের শরণাপন্ন হলেন এবং তাকে দেবসেনাপতি করলেন। পার্বতীর সঙ্গে মহাদেব এসে কার্তিকের গলায় দিব্য সুবর্ণমালা পরিয়ে দিলেন। দ্বিজগণ রুদ্রকে অগ্নি বলে থাকেন, সেজন্য কার্তিক মহাদেবেরও পুত্র, মহাদেব অগ্নির শরীরে প্রবেশ করে এই পুত্র উৎপাদন করেছিলেন।
দেবগণ কর্তৃক অভিষিক্ত হয়ে কার্তিক রক্ত বস্ত্র পরে রথারোহণ করলেন, তাঁর ধ্বজে অগ্নিদত্ত কুক্কুটচিন্বিত লোহিত পতাকা কালাগ্নির ন্যায় সমুখিত হল। ইন্দ্র দেবসেনাকে কার্তিকের হস্তে
সম্প্রদান করলেন। সেই সময়ে ছয় ঋষিপত্নী এসে কার্তিককে বললেন, পুত্র, আমরা তোমার জননী এই মনে করে আমাদের স্বামীরা অকারণে আমাদের ত্যাগ করেছেন এবং পুণ্যস্থান থেকে পরিচ্যুত করেছেন, তুমি আমাদের রক্ষা কর। কার্তিক বললেন, আপনারা আমার মাতা, আমি আপনাদের পুত্র, আপনারা যা চান তাই হবে।
স্কন্দের পালিকা মাতৃগণকে এবং স্কন্দ থেকে উৎপন্ন কতকগুলি কুমার-কুমারীকে স্কন্দগ্রহ (৪) বলা হয়, তারা যোড়শ বৎসর বয়স পর্যন্ত শিশুদের নানাপ্রকার অমঙ্গল ঘটান। এইসকল গ্রহের শান্তি এবং কার্তিকের পূজা করলে মঙ্গল আয়ু ও বীর্য লাভ হয়।
স্বাহা কার্তিকের কাছে এসে বললেন, আমি দক্ষকন্যা স্বাহা, তুমি আমার আপন পুত্র। অগ্নি জানেন না যে আমি বাল্যকাল থেকে তাঁর অনুরাগিণী। আমি তার সঙ্গেই বাস করতে ইচ্ছা করি। কার্তিক বললেন, দেবী, দ্বিজগণ হোমাগ্নিতে হব্য-কব্য অর্পণ করবার সময় স্বাহা’ বলবেন, তার ফলেই অগ্নির সঙ্গে আপনার সর্বদা বাস হবে।
তারপর হরপার্বতী সূর্যের ন্যায় দীপ্তিমান রথে চড়ে দেবাসুরের বিবাদস্থল ভদ্রবটে যাত্রা করলেন। দেবসেনায় পরিবৃত হয়ে কার্তিকও তাঁদের সঙ্গে গেলেন। সহসা নানাপ্রহরণধারী ঘোরাকৃতি অসুরসৈন্য মহাদেব ও দেবগণকে আক্রমণ করলে। মহিষ নামক এক মহাবল দানব এক বিপুল পর্বত নিক্ষেপ করলে, তার আঘাতে দশ সহস্র দেবসৈন্য নিহত হল। ইন্দ্রাদি দেবগণ ভয়ে পলায়ন করলেন। মহিষ দ্রুতবেগে অগ্রসর হয়ে রুদ্রের রথ ধরলে। তখন কার্তিক রথারোহণে এসে প্রজ্বলিত শক্তি অস্ত্র নিক্ষেপ করে মহিষের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। প্রায় সমস্ত দানব তার শরাঘাতে বিনষ্ট হল ; যারা অবশিষ্ট রইল, কার্তিকের পারিষদগণ তাদের খেয়ে ফেললে।
যুদ্ধস্থান দানবশূন্য হলে ইন্দ্র কার্তিককে আলিঙ্গন করে বললেন, মহাবাহু, এই মহিষদানব ব্রহ্মার নিকট বর পেয়ে দেবগণকে তৃণতুল্য জ্ঞান করত, তুমি এই দেবশত্রু ও তার তুল্য শত সথ দানবকে সংহার করেছ। তুমি উমাপতি শিবের ন্যায় প্রভাবশালী, ত্রিভুবনে তোমার কীর্তি অক্ষয় হয়ে থাকবে।
**
(১) স্কন্দ, কার্তিকেয় বা কার্তিকের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিভিন্ন উপাখ্যান প্রচলিত আছে।
(২) মাতৃকা, এঁরা শিবের অনুচরী।
(৩) কার্তিকের এক নাম।
(৪) গ্রহ-অপদেবতা।
॥ দ্রৌপদীসত্যভামাসংবাদপর্বাধ্যায়॥
৪৬। দ্রৌপদী-সত্যভামা-সংবাদ
পাণ্ডবগণ যখন মার্কণ্ডেয়র কথা শুনছিলেন তখন রাজা সত্রাজিতের কন্যা এবং কৃষ্ণের প্রিয়া মহিষী সত্যভামা নির্জনে দ্রৌপদীকে বললেন, কল্যাণী, তোমার স্বামীরা লোকপালতুল্য মহাবীর জনপ্রিয় যুবক, এঁদের সঙ্গে তুমি কিরূপ আচরণ কর ? এঁরা তোমার বশে চ’লেন, কখনও রাগ করেন না, সকল কাজই তোমার মুখ চেয়ে করেন, এর কারণ কি? ব্রতচর্যা জপতপ মন্ত্রৌষধি শিকড় বা অন্য যে উপায় তুমি জান তা বল, যাতে কৃষ্ণকেও আমি সর্বদা বশে রাখতে পারি।
পতিব্রতা মহাভাগা দ্রৌপদী উত্তর দিলেন। সত্যভামা, অসৎ স্ত্রীরা যা করে তাই তুমি জানতে চাচ্ছ, তা আমি কি করে বলব? কৃষ্ণের প্রিয়া হয়ে এমন প্রশ্ন করাই তোমার অনুচিত। স্ত্রী কোনও মন্ত্র বা ঔষধ প্রয়োগ করতে চায় জানলেই স্বামী উদবিগ্ন হন, গৃহে সর্প এলে লোকে যেমন হয়। মন্ত্রাদিতে স্বামীকে কখনও বশ করা যায় না। শত্রুর প্ররোচনায় স্ত্রীলোকে ঔষধ ভেবে স্বামীকে বিষ দেয়, তার ফলে উদরি জরা পুরুষত্বহানি জড়তা অন্ধতা বধিরতা প্রভৃতি ঘটে। আমি যা করি তা শোন। সর্বদা অহংকার ও কামক্রোধ ত্যাগ করে আমি সপত্নীদের সঙ্গে পাণ্ডবগণের পরিচর্যা করি। ধনবান, রূপবান, অলংকারধারী, যুবা, দেবতা, মানুষ বা গন্ধর্ব-অন্য কোনও পুরুষ আমি কামনা করি না। স্বামীরা স্নান ভোজন শয়ন করলে আমিও করি না, তারা অন্য স্থান থেকে গৃহে এলে আমি আসন ও জল দিয়ে তাদের সংবর্ধনা করি। আমি রন্ধন-ভোজনের পাত্র, খাদ্য ও গৃহ পরিষ্কৃত রাখি, তিরস্কার করি না, মন্দ স্ত্রীদের সঙ্গে মিশি না, গহের বাইরে বেশী যাই না, অতিহাস্য বা অতিক্ৰোধ করি না। ভর্তা যা আহার বা পান করেন না আমিও তা করি না, তাদের উপদেশে চলি। আত্মীয়দের সঙ্গে ব্যবহার, ভিক্ষাদান, শ্রাদ্ধ, পর্বকালে রন্ধন, মানী জনের সম্মান প্রভৃতি সম্বন্ধে আমার শ্বশ্রুঠাকুরানী যা বলে দিয়েছেন এবং আমার যা জানা আছে তাই আমি করি। রাজা যুধিষ্ঠির যখন পৃথিবী পালন করতেন তখন অন্তঃপুরের সকলে এবং গোপালক মেষপালক পর্যন্ত সকল ভৃত্য কি করে না করে তার সংবাদ আমি রাখতাম। রাজ্যের সমস্ত আয়ব্যয়ের বিষয় কেবল আমিই জানতাম। পাণ্ডবরা আমার উপর পোষ্যবর্গের ভার দিয়ে ধর্মকার্যে নিরত থাকতেন। আমি সকল সুখভোগ ত্যাগ করে দিবারাত্র আমার কর্তব্যের ভার বহন করতাম, কোনও দুষ্ট লোকে তাতে বাধা দিতে পারত না। আমি চিরকাল সকলের আগে জাগি, সকলের শেষে শুই। সত্যভামা, পতিকে বশ করবার এইসব উপায়ই আমি জানি, অসৎ স্ত্রীদের পথে আমি চলি না।
সত্যভামা বললেন, পাঞ্চালী, আমাকে ক্ষমা কর, তুমি আমার সখী, সেজন্য পরিহাস করছিলাম। দ্রৌপদী বললেন, সখী, যে উপায়ে তুমি অন্য নারীদের প্রভাব থেকে ভর্তার মন আকর্ষণ করতে পারবে তা আমি বলছি শোন। তুমি সর্বদা সৌহার্দ্য প্রেম ও প্রসাধন দ্বারা কৃষ্ণের আরাধনা কর। তাকে উত্তম খাদ্য মাল্য গন্ধদ্রব্য প্রভৃতি দাও, অনুকূল ব্যবহার কর, যাতে তিনি বোঝেন যে তিনি তোমার প্রিয়। তিনি যেন জানতে পারেন যে তুমি সর্বপ্রযত্নে তার সেবা করছ। বাসুদেব তোমাকে যা বলবেন তা গোপনীয় না হলেও প্রকাশ করবে না। যারা তোমার স্বামীর প্রিয় ও অনুরক্ত তাদের বিবিধ উপায়ে ভোজন করাবে, যারা বিদ্বেষের পাত্র ও অহিতকারী- তাদের বর্জন করবে। পুরুষের কাছে মত্ততা ও অসাবধানতা দেখাবে না মৌন অবলম্বন করবে, নির্জন স্থানে কুমার প্রদ্যুম্ন বা শাম্বেরও সেবা করবে না। সদ্বংশজাত নিস্পাপ সতী স্ত্রীদের সঙ্গেই সখিত্ব করবে, যারা ক্রোধপ্রবণ মত্ত অতিভোজী চোর দুষ্ট আর চপল তাদের সঙ্গে মিশবে না। তুমি মহার্ঘ মাল্য আভরণ ও অঙ্গরাগ ধারণ করে পবিত্র গন্ধে বাসিত হয়ে ভর্তার সেবা করবে।
এই সময়ে মার্কণ্ডেয় প্রভৃতি ব্রাহ্মণগণ ও কৃষ্ণ চ’লে যাবার জন্য সত্যভামাকে ডাকলেন। সত্যভামা দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন করে বললেন, কৃষ্ণা, তুমি উৎকণ্ঠা দূর কর, তোমার দেবতুল্য পতিগণ জয়ী হয়ে আবার রাজ্য পাবেন। তোমার দুঃখের দশায় যারা অপ্রিয় আচারণ করেছিল তারা সকলেই যমালয়ে গেছে এই তুমি ধরে নাও। প্রতিবিন্ধ্য প্রভৃতি তোমার পঞ্চ পুত্র দ্বারকায় অভিমন্যুর তুল্যই সুখে বাস করছে, সুভদ্রা তোমার ন্যায় তাদের যত্ন করছেন। প্রদ্যুম্নের মাতা রুক্মিণীও তাদের স্নেহ করেন। আমার শ্বশুর (বসুদেব) তাদের খাওয়া পরার উপর দৃষ্টি রাখেন, বলরাম প্রভৃতি সকলেই তাদের ভালবাসেন। এই কথা বলে দ্রৌপদীকে প্রদক্ষিণ করে সত্যভামা রথে উঠলেন। যদুশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণও মৃদু হাস্যে দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিয়ে এবং পাণ্ডবগণের নিকট বিদায় নিয়ে পত্নীসহ প্রস্থান করলেন।
॥ ঘোষযাত্রাপর্বাধ্যায়॥
৪৭। দুর্যোধনের ঘোষমাত্রা ও গন্ধবহস্তে নিগ্রহ
মার্কণ্ডেয় প্রভৃতি চ’লে গেলে পাণ্ডবগণ দ্বৈতবনে সরোবরের নিকট গৃহ নির্মাণ করে বাস করতে লাগলেন। সেই সময়ে হস্তিনাপুরে একদিন শকুনি ও কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন, রাজা, তুমি এখন শ্ৰীসম্পন্ন হয়ে রাজ্যভোগ করছ, আর পাণ্ডবরা শ্রীহীন রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে বাস করছে। এখন একবার তাদের দেখে এস। পর্বতবাসী যেমন ভূতলবাসীকে দেখে, সমৃদ্ধিশালী লোকে সেইরূপ দুর্দশাপন্ন শত্রুকে দেখে, এর চেয়ে সুখজনক আর কিছুই নেই। তোমার পত্নীরাও বেশভূষায় সুসজ্জিত হয়ে মৃগচর্মধারিণী দীনা দ্রৌপদীকে দেখে আসুন।
দুর্যোধন বললেন, তোমরা আমার মনের মতন কথা বলেছ, কিন্তু বৃদ্ধ রাজা আমাদের যেতে দেবেন না। শকুনির সঙ্গে পরামর্শ করে কর্ণ বললেন, দ্বৈতবনের কাছে আমাদের গোপরা থাকে, তারা তোমার প্রতীক্ষা করছে। ঘোষযাত্রা (১) সর্বদাই কর্তব্য, ধৃতরাষ্ট্র তোমাকে অনুমতি দেবেন। এই কথার পর তিনজনে সহাস্যে হাতে হাত মেলালেন।
কর্ণ ও শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে বললেন, কুরুরাজ, আপনার গোপপল্লীর গরুদের গণনা আর বাছুরদের চিহ্নিত করবার সময় এসেছে, মৃগয়ারও এই সময়, অতএব আপনি দুর্যোধনকে যাবার অনুমতি দিন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, মৃগয়া আর গরু দেখে আসা দুইই ভাল, কিন্তু শুনেছি গোপপল্লীর নিকটেই নরব্যাঘ্র পাণ্ডবরা বাস করেন, সেজন্য তোমাদের সেখানে যাওয়া উচিত নয়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তোমাদের দেখলে ক্রুদ্ধ হবেন না, কিন্তু ভীম অসহিষ্ণু আর যাজ্ঞসেনী তো মূর্তিমতী তেজ। তোমরা দর্প ও মোহের বশে অপরাধ করবে, তার ফলে তপস্বী পাণ্ডবরা তোমাদের দগ্ধ করে ফেলবেন। অর্জুনও ইন্দ্রলোকে অস্ত্রশিক্ষা করে ফিরে এসেছেন। অতএব দুর্যোধন, তুমি নিজে যেয়ো না, পরিদর্শনের জন্য বিশ্বস্ত লোক পাঠাও।
শকুনি বললেন, যুধিষ্ঠির ধর্মজ্ঞ, তিনি আমাদের উপর ক্রুদ্ধ হবেন না, অন্য পাণ্ডবরাও তার অনুগত। আমরা মৃগয়া আর গরু গোনবার জন্যই যেতে চাচ্ছি, পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য নয়। তারা যেখানে আছেন সেখানে আমরা যাব না। ধৃতরাষ্ট্র অনিচ্ছায় অনুমতি দিলেন। তখন দুর্যোধন কর্ণ শকুনি ও দুঃশাসন প্রভৃতি দ্বৈতবনে যাত্রা করলেন, তাদের সঙ্গে অশ্ব-গজ-রথ সমেত বিশাল সৈন্য, বহু স্ত্রীলোক, বিপণি ও শকট সহ বণিকের দল, বেশ্যা, স্তুতিপাঠক, মৃগয়াজীবী প্রভৃতিও গেল। গোপালনস্থানে উপস্থিত হয়ে দুর্যোধন বহু সহস্র গাভী ও বৎস পরিদর্শন গণনা ও চিহিত করলেন এবং গোপালকদের মধ্যে আনন্দে বাস করতে লাগলেন। নৃত্যগীতবাদ্যে নিপুণ গোপ ও গোপকন্যারা দুর্যোধনের মনোরঞ্জন করতে লাগল। তিনি সেই রমণীয় দেশে মৃগয়া দুগ্ধপান ও বিবিধ ভোগবিলাসে রত হয়ে বিচরণ করতে লাগলেন।
দ্বৈতবনের নিকটে এসে দুর্যোধন তার ভৃত্যদের আদেশ দিলেন, তোমরা শীঘ্র বহু ক্রীড়াগৃহ নির্মাণ কর। সেই সময়ে কুবেরভবন থেকে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন ক্রীড়া করবার জন্য দ্বৈতবনের সরোবরের নিকট সদলবলে অবস্থান করছিলেন। দুর্যোধনের লোকরা দ্বৈতবনের কাছে এলেই গন্ধর্বরা তাদের বাধা দিলে। এই সংবাদ পেয়ে দুর্যোধন তার একদল দুর্ধর্ষ সৈন্যদের বললেন, গন্ধর্বদের তাড়িয়ে দাও। তারা অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এলে দুর্যোধন বহু সহস্র যোদ্ধা পাঠালেন। গন্ধর্বগণ মৃদুবাক্যে বারণ করলেও কুরুসৈন্য সবলে দ্বৈতবনে প্রবেশ করলে।
গন্ধরাজ চিত্রসেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর যোদ্ধাদের বললেন, তোমরা ওই অনার্যদের শাসন কর। সশস্ত্র গন্ধর্বসেনার আক্রমণে কুরুসেনা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণও যুদ্ধে বিমুখ হলেন। কিন্তু মহাবীর কর্ণ নিরস্ত হলেন না, তিনি শত শত গন্ধর্ব বধ করে চিত্রসেনের বাহিনী বিধ্বস্ত করে দিলেন। তখন দুর্যোধনাদি কর্ণের সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। নিজের সৈন্যদল নিপীড়িত হচ্ছে। দেখে চিত্রসেন মায়া অবলম্বন করলেন। গন্ধর্বসৈন্যরা কর্ণের রথ ধ্বংস করে ফেললে, কর্ণ লম্ফ দিয়ে নেমে দুর্যোধনের ভ্রাতা বিকর্ণের রথে উঠে চ’লে গেলেন। কর্ণের পরাজয় এবং কুরুসেনার পলায়ন দেখেও দুর্যোধন যুদ্ধে বিরত হলেন না। তাঁর রথও নষ্ট হল , তিনি ভূপতিত হয়ে চিত্রসেনের হাতে বন্দী হলেন। তখন গন্ধর্বরা দুঃশাসন প্রভৃতি এবং তাদের সকলের পত্নীদের ধরে নিয়ে দ্রুতবেগে চ’লে গেল।
গন্ধর্বগণ দুর্যোধনকে হরণ করে নিয়ে গেলে পরাজিত কুরুসৈন্য বেশ্যা ও বণিক প্রভৃতি পাণ্ডবগণের শরণাপন্ন হল। দুর্যোধনের বৃদ্ধ মন্ত্রীরা দীনভাবে যুধিষ্ঠিরের সাহায্য ভিক্ষা করলেন। ভীম বললেন, আমরা গজবাজি নিয়ে যুদ্ধ করে অনেক চেষ্টায় যা করতাম গন্ধর্বরা তা সম্পন্ন করেছে। দুর্যোধন যে উদ্দেশ্যে এসেছিল তা সিন্ধ না হয়ে অন্য প্রকার ঘটেছে। আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছি, কিন্তু ভাগ্যক্রমে এমন লোকও আছেন যিনি আমাদের প্রিয়সাধনের ভার স্বয়ং নিয়েছেন। ভীমের এই কর্কশ কথা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, এখন নিষ্ঠুরতার সময় নয়, কৌরবগণ ভয়ার্ত ও বিপদ্গ্রস্ত হয়ে আমাদের শরণ নিয়েছে। জ্ঞাতিদের মধ্যে ভেদ হয়, কলহ হয়, কিন্তু তার জন্য কুলধর্ম নষ্ট হ’তে পারে না। দুর্যোধন আর কুরুনারীদের হরণের ফলে আমাদের কুল নষ্ট হ’তে বসেছে, দুর্বুদ্ধি চিত্রসেন আমাদের অবজ্ঞা করে এই দুষ্কার্য করেছেন। বীরগণ, তোমরা বিলম্ব ক’রো না, ওঠ, চার ভ্রাতার মিলে দুর্যোধনকে উদ্ধার কর। ভীম, বিপন্ন দুর্যোধন জীবনরক্ষার জন্য তোমাদেরই বাহুবল প্রার্থনা করেছে এর চেয়ে গৌরবের বিষয় আর কি হ’তে পারে? আমি এখন সাদ্যস্ক যজ্ঞে নিযুক্ত আছি, নয়তো বিনা বিচারে নিজেই তার কাছে দৌড়ে যেতাম। তোমরা মিষ্ট কথায় দুর্যোধনাদির মুক্তি চাইবে, যদি তাতে ফল না হয় তবে বলপ্রয়োগে গন্ধর্বরাজকে পরাস্ত করবে।
ভীম অর্জুন নকুল সহদেব বর্ম ধারণ করে সশস্ত্র হয়ে রথারোহণে যাত্রা করলেন, তাঁদের দেখে কৌরবসৈন্যগণ আনন্দধ্বনি করতে লাগল। গন্ধর্বসেনার নিকটে গিয়ে অর্জুন বললেন, আমাদের ভ্রাতা দুর্যোধনকে ছেড়ে দাও। গন্ধর্বরা ঈষৎ হাস্য করে বললে, বৎস, আমরা দেবরাজ ভিন্ন আর কারও আদেশ শুনি না। অর্জুন আবার বললেন, যদি ভাল কথায় না ছাড় তবে বলপ্রয়োগ করব। তার পর গন্ধর্ব ও পাণ্ডবগণের যুদ্ধ আরম্ভ হল। অর্জুনের শরবর্ষণে গন্ধর্বসেনা বিনষ্ট হচ্ছে দেখে চিত্রসেন গদাহস্তে যুদ্ধ করতে এলেন, অর্জুন তার গদা শরাঘাতে কেটে ফেললেন। চিত্রসেন মায়াবলে অন্তর্হিত হয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। অর্জুন ক্রুদ্ধ হয়ে শব্দবেধী বাণ দিয়ে তাঁকে বধ করতে উদ্যত হলেন। তখন চিত্রসেন দর্শন দিয়ে বললেন, আমি তোমার সখা।
চিত্রসেনকে দুর্বল দেখে অর্জুন তাঁর বাণ সংহরণ করে সহাস্যে বললেন, বীর, তুমি দুর্যোধনাদি আর তার ভার্যাদের হরণ করেছ কেন? চিত্রসেন বললেন, ধনঞ্জয়, দুরাত্মা দুর্যোধন আর কর্ণ তোমাদের উপহাস করবার জন্য এখানে এসেছে জানতে পেরে দেবরাজ ইন্দ্র আমাকে বললেন, যাও, দুর্যোধন আর তার মন্ত্রণাদাতাদের বেঁধে নিয়ে এস। তার আদেশ অনুসারে আমি এদের সুরলোকে নিয়ে যাব। তার পর চিত্রসেন যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন এবং তার অনুরোধে দুর্যোধন প্রভৃতিকে মুক্তি দিলেন। যুধিষ্ঠির গন্ধর্বদের প্রশংসা করে বললেন, তোমরা বলবান, তথাপি ভাগ্যক্রমে এঁদের বধ করনি। বৎস চিত্রসেন, তোমরা আমার মহা উপকার করেছ, আমার কুলের মর্যাদাহানি করনি।
চিত্রসেন বিদায় নিয়ে চ’লে গেলেন। ইন্দ্র দিব্য অমৃত বর্ষণ করে নিহত গন্ধর্বগণকে পুনর্জীবিত করলেন। কৌরবগণ তাদের স্ত্রীপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে পাণ্ডবদের গুণকীর্তন করতে লাগলেন। যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে বললেন, বৎস, আর কখনও এমন দুঃসাহসের কাজ ক’রো না। এখন তোমরা নিরাপদে স্বচ্ছন্দে গৃহে যাও, মনে কোনও দুঃখ রেখো না। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করে দুর্যোধন লজ্জায় ও দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে বিকলেন্দ্রিয় আতুরের ন্যায় হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন।
**
(১) ঘোষ-গোপপল্লী বা বাথান যেখানে অনেক গরু রাখা হয়।
৪৮। দুর্যোধনের প্রয়োপবেশন
শোকে অভিভূত হয়ে নিজের পরাভবের বিষয় ভাবতে ভাবতে দুর্যোধন তাঁর চতুরঙ্গ বলের পশ্চাতে যেতে লাগলেন। পথে এক স্থানে যখন তিনি বিশ্রাম করছিলেন তখন কর্ণ তার কাছে এসে বললেন, রাজা, ভাগ্যক্রমে তুমি কামরূপী গন্ধর্বদের জয় করেছ, ভাগ্যক্রমে আবার তোমার সঙ্গে আমার মিলন হল। আমি শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলাম, গন্ধর্বরা আমার পশ্চাদ্ধাবন করেছিল, সেজন্যই আমি যুদ্ধ-স্থল থেকে চ’লে গিয়েছিলাম। এই অমানুষিক যুদ্ধে তুমি ও তোমার ভ্রাতারা জয়ী হয়ে অক্ষতদেহে ফিরে এসেছ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি।
অধোমুখে গদ্গদস্বরে দুর্যোধন বললেন, কর্ণ, তুমি প্রকৃত ঘটনা জান না। বহুক্ষণ যুদ্ধের পর গন্ধর্বরা আমাদের পরাস্ত করে এবং স্ত্রী পুত্র অমাত্য প্রভৃতি সহ বন্ধন করে আকাশপথে হরণ করে নিয়ে যায়। পাণ্ডবগণ সংবাদ পেয়ে আমাদের উদ্ধার করতে আসেন। তারপর চিত্রসেন আর অর্জুন আমাকে যুধিষ্ঠিরের কাছে নিয়ে যান, যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে আমরা মুক্তি পেয়েছি। চিত্রসেন যখন বললেন যে আমরা সপত্নীক পাণ্ডবদের দুর্দশা দেখতে এসেছিলাম তখন লজ্জায় আমার ভূগর্ভে প্রবেশ করতে ইচ্ছা হল। এর চেয়ে যুদ্ধে মরাই আমার পক্ষে ভাল হত। আমি হস্তিনাপুরে যাব না, এইখানেই প্রয়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করব, তোমরা ফিরে যাও। দুঃশাসন, কর্ণ আর শকুনির সহায়তায় তুমিই রাজ্যশাসন ক’রো।
দুঃশাসন কাতর হয়ে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পদতলে পড়ে বললেন, এ কখনই হ’তে পারে না। কর্ণ বললেন, রাজা, তোমার চিত্তদৌর্বল্য আজ দেখলাম। সেনানায়কগণ অনেক ক্ষেত্রে যুদ্ধে শত্রুহস্তে বন্দী হন, আবার নিজ সৈন্য কর্তৃক মুক্তও হন। তোমারই রাজ্যবাসী পাণ্ডবরা তোমাকে মুক্ত করেছে, তাতে দুঃখ কিসের? পাণ্ডবরা তোমার দাস, সেকারণেই তোমার সহায় হয়েছে।
শকুনি বললেন, আমি তোমাকে বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী করেছি, কিন্তু তুমি নির্বুদ্ধিতার জন্য সে সমস্ত ত্যাগ করে মরতে চাচ্ছ। পাণ্ডবরা তোমার উপকার করেছে তাতে তোমার আনন্দিত হওয়াই উচিত। তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে সৌভ্রাত্র কর, তাদের পৈতৃক রাজ্য ফিরিয়ে দাও (১), তাতে তোমার যশ ধর্ম ও সুখ লাভ হবে।
দুর্যোধন কিছুতেই প্রবোধ মানলেন না, প্রায়োপবেশনের সংকল্পও ছাড়লেন না। তখন তার সুহৃদ্গণ বললেন, রাজা, তোমার যে গতি আমাদেরও তাই, আমরা তোমাকে ছেড়ে যাব না। তার পর দুর্যোধন আচমন করে শুচি হলেন এবং কুশচীর ধারণ করে মৌনী হয়ে স্বর্গলাভের কামনায় কুশশয্যায় শয়ন করলেন।
দেবগণ কর্তৃক পরাজিত হয়ে দানবগণ পাতালে বাস করছিল। দুর্যোধনের প্রায়োপবেশনের ফলে তাদের স্বপক্ষের ক্ষতি হবে জেনে তারা এক যজ্ঞ করলে। যজ্ঞ সমাপ্ত হলে এক অদ্ভুত কৃত্যা মুখব্যাদান করে উত্থিত হয়ে বললে, কি করতে হবে? দানবরা বললে, দুর্যোধন প্রায়োপবেশন করেছেন, তাকে এখানে নিয়ে এস। নিমেষমধ্যে কৃত্যা দুর্যোধনকে পাতালে নিয়ে এল। দানবরা তাকে এখানে নিয়ে এস। নিমেষমধ্যে কৃত্যা দুর্যোধনকে পাতালে নিয়ে এল। দানবরা তাকে বললে, ভরত-কুলপালক রাজা দুর্যোধন, আত্মহত্যায় অধোগতি ও যশোহানি হয়, প্রায়োপবেশনের সংকল্প ত্যাগ কর। আমরা মহাদেবের তপস্যা করে তোমাকে পেয়েছি, তিনি তোমার পূর্বকায় (নাভির ঊর্ধ্ব দেহ) বজের ন্যায় দৃঢ় ও অস্ত্রের অভেদ্য করেছেন, আর পার্বতী তোমার অধঃকার পুষ্পের ন্যায় কোমল ও নারীদের মনোহর করেছেন। মহেশ্বর-মহেশ্বরী তোমার দেহ নির্মাণ করেছেন সেজন্য তুমি দিব্যপুরুষ, মানুষ নও। তোমাকে সাহায্য করবার জন্য দানব ও অসুরগণ ভূতলে জন্মগ্রহণ করেছেন। তারা ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ প্রভৃতির দেহে প্রবেশ করবেন, তার ফলে ভীম্মাদি দয়া ত্যাগ করে তোমার শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, পুত্র ভ্রাতা বন্ধু শিষ্য কাকেও নিষ্কৃতি দেবেন না। নিহত নারকাসুরের আত্মা কর্ণের দেহে অধিষ্ঠান করে কৃষ্ণ ও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। আমরা সংশপ্তক নামে বহু সহস্র দৈত্য ও রাক্ষস নিযুক্ত করেছি, তারা অর্জুনকে বধ করবে। তুমি শত্রুহীন হয়ে পৃথিবী ভোগ করবে, অতএব শোক ত্যাগ করে স্বগৃহে যাও। তুমি আমাদের আর পাণ্ডবগণ দেবতাদের অবলম্বন।
দানবগণ দুর্যোধনকে প্রিয়বাক্যে আশ্বাস দিয়ে আলিঙ্গন করলে। কৃত্যা তাঁকে পূর্বস্থানে রেখে এল। এইরূপ স্বপ্নদর্শনের পর দুর্যোধনের দৃঢ়বিশ্বাস হল যে পাণ্ডবগণ যুদ্ধে পরাজিত হবেন। তিনি স্বপ্নের বৃত্তান্ত প্রকাশ করলেন না। রাত্রিশেষে কর্ণ কৃতাঞ্জলি হয়ে সহাস্যে তাকে বললেন, রাজা, ওঠ, মরলে শত্রু-জয় করা যায় না, জীবিত থাকলেই শুভ হয়। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যুদ্ধে অর্জুনকে বধ করব। তার পর দুর্যোধন সদলে হস্তিনাপুরে ফিরে গেলেন।
**
(১) বোধ হয় দুর্যোধনকে উত্তেজিত করার জন্য শকুনি বিদ্রুপ করছেন।
৪৯। দুর্যোধনের বৈষ্ণব যজ্ঞ
দুর্যোধন ফিরে এলে ভীষ্ম তাকে বললেন, বৎস, আমার অমত সত্ত্বেও তুমি দ্বৈতবনে গিয়েছিলে। গন্ধর্বরা তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, অবশেষে পাণ্ডবরা তোমাকে মুক্ত করলেন। সূতপুত্র কর্ণ ভয় পেয়ে রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেলেন। মহাত্মা পাণ্ডবদের আর দুর্মতি কর্ণের বিক্রম তুমি দেখেছ, এখন বংশের মঙ্গলার্থে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি কর। দুর্যোধন হেসে শকুনির সঙ্গে উঠে গেলেন। ভীষ্ম লজ্জিত হয়ে নিজের ভবনে প্রস্থান করলেন।
দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, পাণ্ডবদের ন্যায় আমিও রাজসূয় যজ্ঞ করতে ইচ্ছা করি। কর্ণ প্রভৃতি সোৎসাহে এই প্রস্তাবের সমর্থন করলেন, কিন্তু পুরোহিত দুর্যোধনকে বললেন, তোমার পিতা আর যুধিষ্ঠির জীবিত থাকতে তোমাদের বংশে আর কেউ এই যজ্ঞ করতে পারেন না। তবে আর একটি মহাযজ্ঞ আছে যা রাজসূয়ের সমান, তুমি তাই কর। তোমার অধীন করদ রাজারা সুবর্ণ দেবেন, সেই সুবর্ণে লাঙ্গল নির্মাণ করে যজ্ঞভূমি কর্ষণ করতে হবে, তার পর যথাবিধি যজ্ঞ আরম্ভ হবে। এই যজ্ঞের নাম বৈষ্ণব যজ্ঞ, এর অনুষ্ঠান করলে তোমার অভিলাষ সফল হবে।
মহাসমারোহে প্রভূত অর্থব্যয়ে যজ্ঞের আয়োজন হল। দূতরা দ্রুতগামী রথে রাজা ও ব্রাহ্মণদের নিমন্ত্রণ করতে গেল। দুঃশাসন একজন দূতকে বললেন, শীঘ্র দ্বৈতবনে গিয়ে পাপী পাণ্ডবগণ আর সেখানকার ব্রাহ্মণগণকে নিমন্ত্রণ করে এস। দূতের বার্তা শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, রাজা দুর্যোধন ভাগ্যবান তাই এই মহাযজ্ঞ করছেন, এতে তার পূর্বপুরুষদের কীর্তি বৃদ্ধি পাবে। আমরাও তার কাছে যাব বটে, কিন্তু এখন নয়, ত্রয়োদশ বর্ষ পূর্ণ হলে। ভীম বললেন, তের বৎসর পরে যখন যুদ্ধযজ্ঞে অস্ত্রশস্ত্রে অগ্নি প্রজ্বলিত হবে আর সেই অগ্নিতে দুর্যোধনকে ফেলা হবে তখন যুধিষ্ঠির যাবেন; যখন ধার্তরাষ্ট্ররা সেই যজ্ঞাগ্নিতে দগ্ধ হবে আর পাণ্ডবগণ তাতে ক্রোধরূপ হবি অর্পণ করবেন তখন আমি যাব; দূত, এই কথা দুর্যোধনকে জানিও।
যজ্ঞ সমাপ্ত হলে কয়েকজন বায়ুরোগগ্রস্ত লোক দুর্যোধনকে বললে, আপনার এই যজ্ঞ যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞের তুল্য হয়নি। কেউ বললে, ষোল কলার এক কলাও হয়নি। সুহৃদগণ বললেন, এই যজ্ঞ সকল যজ্ঞকে অতিক্রম করেছে। কর্ণ বললেন, রাজা, পাণ্ডবরা যুদ্ধে বিনষ্ট হলে তুমি রাজসূয় যজ্ঞ করবে। আমি যা বলছি। শোন—যত দিন অর্জুন নিহত না হবে তত দিন আমি পা ধোব না, মাংস খাব না , সুরাপান করব না, কেউ কিছু চাইলে ‘না’ বলব না।
॥ মৃগস্বপ্নেদ্ভব ও ব্রীহিদ্রৌণিক-পর্বাধ্যায়॥
৫০। যুধিষ্ঠিরের স্বপ্ন-মুগলের সিদ্ধিলাভ
একদা রাত্রিকালে যুধিষ্ঠির স্বপ্ন দেখলেন, মৃগগণ কম্পিতদেহে বাষ্পকুলকণ্ঠে কৃতাঞ্জলি হয়ে তাকে বলছে, মহারাজ, আমরা দ্বৈতবনের হতাবশিষ্ট মৃগ। আপনার অস্ত্রপটু বীর ভ্রাতারা আমাদের অল্পই অবশিষ্ট রেখেছেন। আপনি দয়া করুন, যাতে আমার বৃদ্ধি পেতে পারি। যুধিষ্ঠির দুঃখার্ত হয়ে বললেন, যা বললে তাই হবে। প্রভাতকালে তিনি স্বপ্নবৃত্তান্ত জানিয়ে ভ্রাতাদের বললেন, এখনও এক বৎসর আট মাস আমাদের মৃগমাংসভোজী হয়ে বনবাস করতে হবে। আমরা দ্বৈতবন ত্যাগ করে আবার কাম্যকবনে যাব, সেখানে অনেক মৃগ আছে।
পাণ্ডবগণ কাম্যকবনে এলেন, সেখানে তাঁদের কষ্টকর বনবাসের একাদশ বর্ষ অতীত হল। একদিন মহাযোগী ব্যাসদেব তাদের কাছে এলেন এবং উপদেশপ্রসঙ্গে। এই উপাখ্যান বললেন।-কুরুক্ষেত্রে মুগল নামে এক ধর্মাত্মা মুনি ছিলেন, তিনি কপোতের ন্যায় শিলোঞ্ছ (১)-বৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকানির্বাহ ও ব্ৰতাদি পালন করতেন। তিনি স্ত্রীপুত্রের সহিত পনর দিনে একদিন মাত্র খেতেন, প্রতি অমাবস্যা-পূর্ণিমায় যাগ করতেন এবং অতিথিদের এক দ্রোণ (২) ব্রীহির (তণ্ডুলের) অন্ন দিতেন। যে অন্ন অবশিষ্ট থাকত তা অতিথি দেখলেই বৃদ্ধি পেত। একদিন দুর্বাসা ঋষি মুণ্ডিতমস্তকে দিগম্বর হয়ে কটুবাক্য বলতে বলতে উন্মত্তের ন্যায় উপস্থিত হয়ে বললেন, আমাকে অন্ন দাও। মুগল অন্ন দিলে দুর্বাসা সমস্ত ভোজন করলেন এবং গায়ে উচ্ছিষ্ট মেখে চ’লে গেলেন। এইরূপ পর পর ছবার পর্বদিনে এসে দুর্বাসা সমস্ত অন্ন খেয়ে গেলেন, মুদগল নির্বিকারমনে অনাহারে রইলেন। দুর্বাসা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, তোমার মহৎ দানে সংবাদ স্বর্গে ঘোষিত হয়েছে, তুমি সশরীরে সেখানে যাবে।
এই সময়ে এক দেবদূত বিচিত্র বিমান নিয়ে এসে মুগলকে বললে, মুনি, আপনি পরমা সিদ্ধি লাভ করেছেন, এখন এই বিমানে উঠে স্বর্গে চলুন। মুগল বললেন, স্বর্ণবাসের গুণ আর দোষ কি আগে বল। দেবদূত বললে, যাঁরা ধর্মাত্মা জিতেন্দ্রিয় দানশীল, যারা সম্মুখ সমরে নিহত, তারাই স্বর্গবাসের অধিকারী। সেখানে ঈর্ষা শোক ক্লান্তি মোহ মাৎসর্য নেই। দেবগণ সাধ্যগণ মহর্ষিগণ প্রভৃতি সেখানে নিজ নিজ ধামে বাস করেন। তা ভিন্ন তেত্রিশ জন ঋভু আছেন, তাদের স্থান আরও উচ্চে, দেবতারাও তাদের পূজা করেন। আপনি দান ও তপস্যার প্রভাবে ঋভুগণের সম্পদ লাভ করেছেন। স্বর্গের গুণ আপনাকে বললাম, এখন দোষ শুনুন। স্বর্গে কৃতকর্মের ফলভোগ হয় কিন্তু নূতন কর্ম করা যায় না। সেখানে অপরের অধিকতর সম্পদ জেখে অসন্তোষ হয়, কর্মক্ষয় হলে আবার ধরাতলে পতন হয়।
মুদগল বললেন, বৎস দেবদূত, নমস্কার, তুমি ফিরে যাও, স্বর্গসুখ আমি চাই। যে অবস্থায় মানুষ শোকদুঃখ পায় না, পতিতও হয় না, আমি সেই কৈবল্যের অন্বেষণ করব। দেবদূত চ’লে গেলে মুগল শুদ্ধ জ্ঞানযোগ অবলম্বন করে ধ্যানপরায়ণ হলেন এবং নির্বাণমুক্তিরূপ সিদ্ধি লাভ করলেন।
এই উপাখ্যান বলে এবং যুধিষ্ঠিরকে প্রবোধ দিয়ে ব্যাসদেব নিজের আশ্রমে প্রস্থান করলেন।
**
(১) শস্য কাটার পর ক্ষেত্রে যে শস্য পড়ে থাকে তাই সংগ্রহ করা।
(২) শস্যাদির মাপ বিশেষ।
॥ দ্রৌপদীহরণ ও জয়দ্রথবিমোণ-পর্বাধ্যায়
৫১। দুর্বাসার পারণ
পাণ্ডবগণ যখন কাম্যকবনে বাস করছিলেন তখন একদিন তপস্বী দুর্বাসা দশ হাজার শিষ্য নিয়ে দুর্যোধনের কাছে এলেন এবং তার বিনীত অনুরোধে কয়েক দিনের জন্য আতিথ্য গ্রহণ করলেন। দুর্বাসা কোনওদিন বলতেন, আমি ক্ষুধিত হয়েছি, শীঘ্র অন্ন দাও; এই বলেই স্নান করতে গিয়ে অতি বিলম্বে ফিরতেন। কোনও দিন বলতেন, আজ ক্ষুধা নেই, খাব না; তার পর সহসা এসে বলতেন, এখনই খাওয়াও। কোনও দিন মধ্যরাত্রে উঠে অন্নপাক করতে বলতেন কিন্তু খেতেন না, ভর্ৎসনা করতেন। পরিশেষে দুর্যোধনের অবিশ্রাম পরিচর্যায় তুষ্ট হয়ে দুর্বাসা বললেন, তোমার অভীষ্ট বর চাও। দুর্যোধন পূর্বেই কর্ণ দুঃশাসন প্রভৃতির সঙ্গে মন্ত্রণা করে রেখেছিলেন। তিনি দুর্বাসাকে বললেন, ভগবান, আপনি সশিষ্যে আমাদের জ্যেষ্ঠ ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের আতিথ্য গ্রহণ করুন। যদি আমার উপর আপনার অনুগ্রহ থাকে, তবে যখন সকলের আহারের পর নিজে আহার করে দ্রৌপদী বিশ্রাম করবেন সেই সময়ে আপনি যাবেন। দুর্বাসা সম্মত হলেন।
অনন্তর একদিন পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর ভোজনের পর অযুত শিষ্য নিয়ে দুর্বাসা কাম্যকবনে উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির যথাবিধি পূজা করে তাকে বললেন, ভগবান, আপনি আহ্নিক করে শীঘ্র আসুন। সশিষ্য দুর্বাসা স্নান করতে গেলেন। অন্নের আয়োজন কি হবে এই ভেবে দ্রৌপদী আকুল হলেন এবং নিরুপায় হয়ে মনে মনে কৃষ্ণের স্তব করে বললেন, হে দুঃখনাশন, তুমি এই অগতিদের গতি হও, দ্যুতসভায় দুঃশাসনের হাত থেকে যেমন আমাকে উদ্ধার করেছিলে সেইরূপ আজ এই সংকট থেকে আমাকে ত্রাণ কর।
দেবদেব জগৎপতি কৃষ্ণ তখনই পার্শ্বস্থিতা রুক্মিণীকে ছেড়ে দ্রৌপদীর কাছে উপস্থিত হলেন। দুর্বাসার আগমনের কথা শুনে তিনি বললেন, কৃষ্ণা, আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত, শীঘ্র আমাকে খাওয়াও তার পর অন্য কাজ ক’রো। দ্রৌপদী লজ্জিত হবে বললেন, যে পর্যন্ত আমি না খাই সে পর্যন্তই সূর্যদত্ত স্থালীতে অন্ন থাকে। আমি খেয়েছি, সেজন্য এখন আর অন্ন নেই। ভগবান কমললোচন বললেন, কৃষ্ণা, এখন পরিহাসের সময় নয়, আমি ক্ষুধাতুর, তোমার স্থালী এনে আমাকে দেখাও। দ্রৌপদী স্থালী আনলে কৃষ্ণ দেখলেন তার কানায় একটু শাকান্ন লেগে আছে, তিনি তাই খেয়ে বললেন, বিশ্বাঝা যজ্ঞভোজী দেব তৃপ্তিলাভ করুন, তুষ্ট হন। তার পর তিনি সহদেবকে (১) বললেন, ভোজনের জন্য মুনিদের শীঘ্ৰ ডেকে আন।
দুর্বাসা ও তার শিষ্য মুনিগণ তখন স্নানের জন্য নদীতে নেমে অঘমর্ষণ (২) মন্ত্র জপ করছিলেন। সহসা তাদের কণ্ঠ থেকে অন্নরসের সহিত উদ্গার উঠতে লাগল, তাঁরা তৃপ্ত হয়ে জল থেকে উঠে পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগলেন। মুনিরা দুর্বাসাকে বললেন, ব্রহ্মর্যি, আমরা যেন আকণ্ঠ ভোজন করে তৃপ্ত হয়েছি, এখন আবার কি করে ভোজন করব? দুর্বাসা বললেন, আমরা বৃথা অন্ন পাক করতে বলে রাজর্ষি যুধিষ্ঠিরের নিকটে মহা অপরাধ করেছি, পাণ্ডবগণ ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাতে আমাদের দগ্ধ না করেন। তারা হরিচরণে আশ্রিত সেজন্য তাদের ভয় করি। শিষ্যগণ, তোমরা শীঘ্র পালাও।
সহদেব নদীতীরে এসে দেখলেন কেউ নেই। তিনি এই সংবাদ দিলে পাণ্ডবগণ ভাবলেন, হয়তো মধ্যরাত্রে দুর্বাসা সহসা ফিরে এসে আমাদের ছলনা করবেন। তাদের চিন্তিত দেখে কৃষ্ণ বললেন, কোপনস্বভাব দুর্বাসার আগমনে বিপদ হবে এই আশঙ্কার দ্রৌপদী আমাকে স্মরণ করেছিলেন তাই আমি এসেছি। কোনও ভয় নেই, আপনাদের তেজে ভীত হয়ে দুর্বাসা পালিয়েছেন। পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী বললেন, প্রভু গোবিন্দ, মহার্ণবে মজ্জমান লোকে যেমন ভেলা পেলে রক্ষা পায়, আমরা সেইরূপ তোমার কৃপায় দুস্তর বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি। তার পর কৃষ্ণ পাণ্ডবগণের নিকট বিদায় নিয়ে চ’লে গেলেন।
**
(১) পাঠান্তরে ভীমসেনকে।
(২) পাপনাশন। ঋগবেদীয় সূক্তবিশেষ।।
৫২। দ্রৌপদীহরণ
একদিন পঞ্চপাণ্ডব মহর্ষি ধৌম্যের অনুমতি নিয়ে দ্রৌপদীকে আশ্রমে রেখে বিভিন্ন দিকে মৃগয়া করতে গেলেন। সেই সময়ে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ কাম্যকবনে উপস্থিত হলেন। তিনি বিবাহকামনায় শাম্বরাজ্যে যাচ্ছিলেন, অনেক রাজা তাঁর সহযাত্রী ছিলেন। দ্রৌপদীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি তার সঙ্গী রাজা কোটিকাস্যকে বললেন, এই অনবদ্যাঙ্গী কে? এঁকে পেলে আমার আর বিবাহের প্রয়োজন নেই। সৌম্য, তুমি জেনে এস ইনি কে, এঁর রক্ষক কে। এই বরারোহা সুন্দরী কি আমাকে ভজনা করবেন? শৃগাল যেমন ব্যাঘ্রবধূর কাছে যায় সেইরূপ কোটিকাস্য দ্রৌপদীর কাছে গিয়ে বললেন, সুন্দরী, কদম্বতরুর একটি শাখা নুইয়ে দীপ্তিমতী অগ্নিশিখার ন্যায় কে তুমি একাকিনী দাঁড়িয়ে আছ? তুমি কার কন্যা, কার পত্নী? এখানে কি করছ? আমি সুরথ রাজার পুত্র কোটিকাস্য। বার জন রথারোহী রাজপুত্র এবং বহু রথ হস্তী অশ্ব ও পদাতি যাঁর অনুগমন করছেন তিনি সৌবীররাজ জয়দ্রথ। আরও অনেক রাজা ও রাজপুত্র ওঁর সঙ্গে আছেন। দ্রৌপদী বললেন, এখানে আর কেউ নেই, অগতা আমিই আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। আমি দ্রুপদরাজকন্যা কৃষ্ণা, ইন্দ্রপ্রস্থবাসী পঞ্চপাণ্ডব আমার স্বামী, তারা এখন মৃগয়া করতে গেছেন। আপনারা যানবাহন থেকে নেমে আসুন, অতিথিপ্রিয় ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আপনাদের দেখে প্রীত হবেন।
কোটিকাস্যের কথা শুনে জয়দ্রথ বললেন, আমি সত্য বলছি, এই নারীকে দেখে। মনে হচ্ছে অন্য নারীরা বানরী। এই বলে তিনি ছ-জন সহচরের সঙ্গে আশ্রমে। প্রবেশ করে দ্রৌপদীকে কুশল প্রশ্ন করলেন। দ্রৌপদী পাদ্য ও আসন দিয়ে বললেন, নৃপকুমার, আপনাদের প্রাতরাশের জন্য আমি পঞ্চাশটি মৃগ দিচ্ছি, যুধিষ্ঠির এলে আরও বহুপ্রকার মৃগ শরভ শশ ঋক্ষ শম্বর গবয় বরাহ মহিষ প্রভৃতি দেবেন। জয়দ্রথ বললেন, তুমি আমাকে প্রাতরাশ দিতে ইচ্ছা করছ তা ভাল। এখন আমার রথে ওঠ, রাজ্যচ্যুত শ্রীহীন দীন পাণ্ডবদের জন্য তোমার অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তুমি আমার ভার্যা হও, সিন্ধুসৌবীররাজ্য ভোগ কর।
ক্রোধে আরক্তমুখে কুটি করে দ্রৌপদী বললেন, মূঢ়, যশস্বী মহারথ পাণ্ডবদের নিন্দা করতে তোমার লজ্জা হয় না? কুকুরুতুল্য লোকেই এমন কথা বলে। তুমি। নিদ্রিত সিংহ আর তীক্ষ্মবিষ সর্পকে পদাঘাত করতে ইচ্ছা করেছ। জয়দ্রথ বললেন, কৃষ্ণা, পাণ্ডবরা, কেমন তা আমি জানি, তুমি আমাদের ভয় দেখাতে পারবে না, এখন সত্বর এই হস্তীতে বা এই রথে ওঠ; অথবা দীনবাক্যে আমার অনুগ্রহ ভিক্ষা কর। দ্রৌপদী বললেন, আমি অবলা নই, সৌবীররাজের কাছে দীনবাক্য বলব না। গ্রীষ্মকালে শুষ্ক তৃণরাশির মধ্যে অগ্নির ন্যায় অর্জুন তোমার সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করবেন, অন্ধক ও বৃষ্ণি বংশীয় বীরগণের সঙ্গে জনার্দন আমার অনুসরণ করবেন। তুমি যখন অর্জুনের বাণবর্ষণ, ভীমের গদাঘাত এবং নকুল-সহদেবের ক্রোধ দেখবে তখন নিজ বুদ্ধির নিন্দা করবে।
জয়দ্রথ ধরতে এলে দ্রৌপদী তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন এবং পুরোহিত ধৌম্যকে ডাকতে লাগলেন। জয়দ্রথ ভূমি থেকে উঠে দ্রৌপদীকে সকলে রথে তুললেন। ধৌম্য এসে বললেন, জয়দ্ৰথ, তুমি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন কর, মহাবল পাণ্ডবদের পরাজিত না করে তুমি এঁকে নিয়ে যেতে পার না। এই নীচ কর্মের ফল তোমাকে নিশ্চয়ই ভোগ করতে হবে। এই বলে ধৌম্য পদাতি সৈন্যের সঙ্গে মিশে দ্রৌপদীর পশ্চাতে চললেন।
৫৩। জয়দ্রথের নিগ্রহ ও মুক্তি
পাণ্ডবগণ মৃগয়া শেষ করে বিভিন্ন দিক থেকে এসে একত্র মিলিত হলেন। বনমধ্যে পশুপক্ষীর রব শুনে যুধিষ্ঠির বললেন, আমার মন ব্যাকুল হচ্ছে, আর মৃগবধের প্রয়োজন নেই। এই বলে তিনি ভ্রাতাদের সঙ্গে রথারোহণে দ্রুতবেগে আশ্রমের দিকে চললেন। দ্রৌপদীর প্রিয়া ধাত্রীকন্যা ভূমিতে পড়ে কাঁদছে দেখে যুধিষ্ঠিরের সারথি ইন্দ্রসেন রথ থেকে লাফিয়ে নেমে জিজ্ঞাসা করলে, তুমি মলিন-মুখে কাঁদছ কেন? দেবী দ্রৌপদীর কোনও বিপদ হয় নি তো? বালিকা তার সুন্দর মুখ মুছে বললে, জয়দ্রথ তাকে সবলে হরণ করে নিয়ে গেছেন, তোমরা শীঘ্র তার অনুসরণ কর। পুষ্পমালা যেমন শ্মশানে পড়ে, বিপ্রগণ অসতর্ক থাকলে কুকুরু যেমন যজ্ঞের সোমরস চাটে, সেইরূপ ভয়বিহ্বলা দ্রৌপদীকে হয়তো কোনও অযোগ্য পুরুষ ভোগ করবে।
যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি সরে যাও, এমন কুৎসিত কথা বলো না। এই বলে তিনি ভ্রাতাদের সঙ্গে দ্রুতবেগে দ্রৌপদীর অনুসরণে যাত্রা করলেন। কিছুদূর গিয়ে তারা দেখলেন, সৈন্যদের অশ্বখুরের ধূলি উড়ছে, ধৌম্য উচ্চস্বরে ভীমবে ডাকছেন। পাণ্ডবগণ তাকে আশ্বস্ত করলেন এবং জয়দ্রথের রথে দ্রৌপদীকে দেখে ক্রোধে প্রজ্বলিত হলেন। পাণ্ডবদের ধ্বজাগ্র দেখেই দুরাত্মা জয়দ্রথের ভয় হল তিনি তার সহায় রাজাদের বললেন, আপনারা আক্রমণ করুন। তখন দুই পক্ষে ঘোর যুদ্ধ হ’তে লাগল, পাণ্ডবগণের প্রত্যেকেই শত্রুপক্ষের বহু যোদ্ধাকে বধ করলেন। কোটিকাস্য ভীমের গদাঘাতে নিহত হলেন। স্বপক্ষের বীরগণকে বিনাশিত দেখে জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে রথ থেকে নামিয়ে দিয়ে প্রাণরক্ষার জন্য বনমধ্যে পলায়ন করলেন। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে নিজের রথে উঠিয়ে নিলেন। ভমী বললেন, দ্রৌপদী নকুল-সহদেব আর ধৌম্যকে নিয়ে আপনি আশ্রমে ফিরে যান মূঢ় সিন্ধুরাজ যদি ইন্দ্রের সঙ্গে পাতালেও গিয়ে থাকে তথাপি সে জীবিত অবস্থায় আমার হাত থেকে মুক্তি পাবে না।
যুধিষ্ঠির বললেন, মহাবাহু, জয়দ্রথ (১) দুরাত্মা হলেও দুঃশলা ও গান্ধারীকে স্মরণ করে তাকে বধ করা উচিত নয়। দ্রৌপদী কুপিত হ’য়ে বললেন, যদি আমার প্রিয়কার্য কর্তব্য মনে কর তবে শেই পুরুষাধম পাপী কুলাঙ্গারকে বধ করতেই হবে। যে শত্রু ভার্যা বা রাজ্য হরণ করে তাকে কখনও মুক্তি দেওয়া উচিত নয়। তখন ভীম আর অর্জুন জয়দ্রথের সন্ধানে গেলেন। যুধিষ্ঠির আশ্রমে প্রবেশ করে দেখলেন, সমস্ত বিশৃঙ্খল হয়ে আছে এবং মার্কণ্ডেয় প্রভৃতি বিগণ সেখানে সমবেত হয়েছেন।
জয়দ্রথ এক ক্রোশ মাত্র দূরে আছেন শুনে ভীমার্জুন বেগে রথ চালালেন। অর্জুনের শরাঘাতে জয়দ্রথের অশ্বসকল বিনষ্ট হল , তিনি পালাবার চেষ্টা করলেন অর্জুন তাকে বললেন, রাজপুত্র, তুমি এই বিক্রম নিয়ে নারীহরণ করতে গিয়েছিলে! নিবৃত্ত হও, অনুচরদের শত্রুর হাতে ফেলে পালাচ্ছ কেন? জয়দ্রথ থামলেন না, ভীম দাঁড়াও দাঁড়াও’ বলে তার পিছনে ছুটলেন। দয়ালু অর্জুন বললেন, ওকে বধ করবেন না।
বেগে গিয়ে ভীম জয়দ্রথের কেশ ধরলেন এবং তাকে ভূমিতে ফেলে নিষ্পিষ্ট করলেন। তারপর মস্তকে পদাঘাত করে তার দুই জানু নিজের জানু দিয়ে চেপে প্রহার করতে লাগলেন। জয়দ্রথ মূৰ্ছিত হলেন। তাকে বধ করতে যুধিষ্ঠির বারণ করেছেন এই কথা অর্জুন মনে করিয়ে দিলে ভীম বললেন, এই পাপী কৃষ্ণাকে কষ্ট দিয়েছে, এ বাঁচবার যোগ্য নয়। কিন্তু আমি কি করব, যুধিষ্ঠির হচ্ছেন দয়ালু, আর তুমি মূর্খতার জন্য সর্বদাই আমাকে বাধা দাও। এই বলে ভীম তাঁর অর্ধচন্দ্র বাণে জয়দ্রথের মাথা মাঝে মাঝে মুড়িয়ে পাঁচচুলো করে দিলেন। তারপর তিনি জয়দ্রথকে বললেন, মূঢ়, যদি বাঁচতে চাও তবে সর্বত্র এই কথা বলবে যে তুমি আমাদের দাস। এই প্রতিজ্ঞা করলে তোমাকে প্রাণদান করব। জয়দ্রথ বললেন, তাই হবে। তখন ভীম ধূলিধূসরিত অচেতনয় জয়দ্রথকে বেঁধে রথে উঠিয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে নিয়ে এলেন। যুধিষ্ঠির একটু হেসে বললেন, এঁকে ছেড়ে দাও। ভীম বললেন, আপনি দ্রৌপদীকে বলুন, এই পাপাত্মা এখন পাণ্ডবদের দাস। যুধিষ্ঠিরের দিকে চেয়ে দ্রৌপদী ভীমকে বললেন, তুমি এর মাথায় পাঁচ জটা করেছ, এ রাজার দাস হয়েছে, এখন একে মুক্তি দাও। বিহ্বল জয়দ্রথ মুক্তি পেয়ে যুধিষ্ঠির ও উপস্থিত মুনিগণকে বন্দনা করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, পুরুষাধম, তুমি দাসত্ব থেকে মুক্ত হলে, আর এমন দুষ্কার্য ক’রো না।
লজ্জিত দুঃখার্ত জয়দ্রথ গঙ্গাদ্বারে গিয়ে উমাপতি বিরূপাক্ষের শরণাপন্ন হয়ে কঠোর তপস্যা করলেন। মহাদেব বর দিতে এলে জয়দ্রথ বললেন, আমি যেন পঞ্চপাণ্ডবকে যুদ্ধে জয় করতে পারি। মহাদেব বললেন, তা হবে না; অর্জুন ভিন্ন অপর পাণ্ডবগণকে সৈন্যসমেত কেবল এক দিনের জন্য তুমি জয় করতে পারবে। এই বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন।
** (১) ইনি ধৃতরাষ্ট্রের কন্যা দুঃশলার স্বামী।
॥ রামোপাখ্যানপর্বাধ্যায়॥
৫৪। রামের উপাখ্যান
যুধিষ্ঠির মার্কণ্ডেয়কে প্রশ্ন করলেন, ভগবান, আমার চেয়ে মন্দভাগ্য কোনও রাজার কথা আপনি জানেন কি? মার্কণ্ডেয় বললেন, রাম যে দুঃখ ভোগ করেছিলেন, তার তুলনা নেই। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে মার্কণ্ডেয় এই ইতিহাস বললেন।-(১)
ইক্ষাকুবংশীয় রাজা দশরথের চার মহাবল পুত্র ছিলেন—রাম লক্ষ্মণ ভরত শত্রুঘ্ন। রামের মাতা কৌশল্যা, ভরতের মাতা কৈকেয়ী এবং লক্ষ্মণ-শত্রুঘ্নের মাতা সুমিত্রা। বিদেহরাজ জনকের কন্যা সীতার সঙ্গে রামের বিবাহ হয়। এখন রাবণের জন্মকথা শোন। পুলস্ত্য নামে ব্রহ্মার এক মানসপুত্র ছিলেন, তাঁর পুত্র বৈশ্রবণ। এই বৈশ্রবণই শিবের সখা ধনপতি কুবের। ব্রহ্মার প্রসাদে তিনি রাক্ষসপুরী লঙ্কার অধিপতি হন এবং পুষ্পক বিমান লাভ করেন। বৈশ্রমণ তার পিতাকে ত্যাগ করে ব্রহ্মার সেবা করেছিলেন এজন্য পুলস্ত্য ক্রুদ্ধ হয়ে দেহান্তর গ্রহণ করেন, তখন তার নাম হয় বিশ্রবা। বিভিন্ন রাক্ষসীর গর্ভে বিশবার কতকগুলি সন্তান হয়—পুষ্পেকটার গর্ভে রাবণ ও কুম্ভকর্ণ, রাকার গর্ভে খর ও শূর্পণখা এবং মালিনীর গর্ভে বিভীষণ। কুবেরের উপর ঈর্ষান্বিত হয়ে রাবণ কঠোর তপস্যা করেন, তাতে ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে তাকে বর দেন যে, মানুষ ভিন্ন কোনও প্রাণীর হস্তে তার পরাভব হবে না। রাবণ কুবেরকে পরাস্ত করে লঙ্কা থেকে তাড়িয়ে দিলেন এবং স্বয়ং লঙ্কার অধীশ্বর হলেন। কুবের গন্ধমাদন পর্বতে গেলেন, ধর্মাত্মা বিভীষণও তার অনুসরণ করলেন।
রাবণের উৎপীড়নে কাতর হয়ে ব্রহ্মর্ষি ও দেবর্ষিগণ অগ্নিকে অগ্রবর্তী করে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা আশ্বাস দিলেন যে রাবণের নিগ্রহের জন্য বিষ্ণু ধরায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ব্রহ্মার উপদেশে ইন্দ্রাদি দেবগণ বানরী আর ভল্লুকীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করলেন। দুন্দুভী নামে এক গন্ধবী মন্থরা নামে কুবজারূপে জন্মগ্রহণ করলে।
বৃদ্ধ দশরথ যখন রামকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করবার সংকল্প করলেন তখন দাসী মন্থরার প্ররোচনায় কৈকেয়ী রাজার কাছে এই বর আদায় করলেন যে রাম চতুর্দশ বৎসরের জন্য বনে যাবেন এবং ভরত যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত হবেন। পিতৃসত্য রক্ষার জন্য রাম বনে গেলেন, সীতা ও লক্ষ্মণও তাঁর অনুগমন করলেন। পুত্রশোকে দশরথের প্রাণবিয়োগ হল। ভরত তাঁর মাতাকে ভৎর্সনা করে রাজ্য প্রত্যাখ্যান করলেন এবং রামকে ফিরিয়ে আনবার ইচ্ছায় বশিষ্ঠাদি ব্রাহ্মণগণ ও আত্মীয়স্বজন সহ চিত্রকুটে গেলেন, কিন্তু রাম সম্মত হলেন না। ভরত নন্দিগ্রামে গিয়ে রামের পাদুকা সম্মুখে রেখে রাজ্যচালনা করতে লাগলেন।
রাম চিত্রকূট থেকে দণ্ডকারণ্যে গেলেন। সেখানে শূর্পণখার জন্য জনস্থানবাসী খরের সঙ্গে তার শত্রুতা হল। খর ও তার সহায় দূষণকে রাম বধ করলেন। শূর্পণখা তার ছিন্ন নাসিকা আর ওষ্ঠ নিয়ে রাবণের পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগল। রাবণ ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিশোধের সংকল্প করলেন। তিনি তার পূর্ব অমাত্য মারীচকে বললেন, তুমি রত্নশৃঙ্গ বিচিত্ররোমা মৃগ হয়ে সীতাকে প্রলুব্ধ কর। রাম তোমাকে ধরতে গেলে আমি সীতাকে হরণ করব। মারীচ অনিচ্ছায় রাবণের আদেশ পালন করলে। রাম মৃগরূপী মারীচের অনুসরণ করলেন, মারীচ শরাহত হয়ে রামের তুল্য কণ্ঠস্বরে ‘হা সীতা হা লক্ষ্মণ’ বলে চীৎকার করে উঠল। সীতা ভয় পেয়ে লক্ষ্মণকে যেতে বললেন। লক্ষ্মণ তাকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সীতার কটু বাক্য শুনে অগত্যা রামের সন্ধানে গেলেন। এই সুযোগে রাবণ সীতাকে হরণ করে আকাশপথে নিয়ে চললেন।
গৃধ্ররাজ জটায়ু দশরথের সখা ছিলেন। তিনি সীতাকে রাবণের ক্রোড়ে দেখে তাঁকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু রাবণের হস্তে নিহত হলেন। সীতা তার অলংকার খুলে ফেলতে লাগলেন। একটি পর্বতের উপরে পাঁচটি বানর বসে আছে দেখে তিনি তার পীতবর্ণ উত্তরীয় খুলে ফেলে দিলেন। রাবণ লঙ্কায় উপস্থিত হয়ে সীতাকে অশোকবনে বন্দিনী করে রাখলেন।
রাম আশ্রমে ফেরবার পথে লক্ষ্মণকে দেখতে পেলেন। তিনি উবিগ্ন হয়ে আশ্রমে এসে দেখলেন সীতা নেই। রাম-লক্ষ্মণ ব্যাকুল হয়ে সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে মরণাপন্ন জটায়ুকে দেখতে পেলেন। সীতাকে নিয়ে রাবণ দক্ষিণ দিকে গেছেন এই সংবাদ ইঙ্গিতে জানিয়ে জটায়ু প্রাণত্যাগ করলেন।
যেতে যেতে রাম-লক্ষ্মণ এক কবন্ধরূপী রাক্ষস কর্তৃক আক্রান্ত হলেন এবং তার দুই বাহু কেটে ফেললেন। মৃত কবন্ধের দেহ থেকে এক গন্ধর্ব নির্গত হয়ে বললে, আমার নাম বিশ্বাবসু, ব্রাহ্মণশাপে রাক্ষস হয়েছিলাম। তোমরা ঋষ্যমূক পর্বতে সুগ্রীবের কাছে যাও, সীতার উদ্ধারে তিনি তোমাদের সাহায্য করবেন। রাম-লক্ষ্মণ ঋষ্যমুকে চললেন, পথে সুগ্রীবের সচিব হনুমানের সঙ্গে তাদের আলাপ হল। তারা সুগ্রীবের কাছে এসে সীতার উত্তরীয় দেখলেন। রামের সঙ্গে সুগ্রীবের সখ্য হল। রাম জানলেন যে সুগ্রীবকে তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বালী কিষ্কিন্ধ্যা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন এবং ভ্রাতৃবধূকেও আত্মসাৎ করেছেন। রামের উপদেশে সুগ্রীব বালীকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন। দুই ভ্ৰাতায় ঘোর যুদ্ধ হ’তে লাগল, সেই সময়ে রাম বালীকে শরাঘাত করলেন। রামকে ভর্ৎসনা করে বালী প্রাণত্যাগ করলেন, সুগ্রীব কিষ্কিন্ধ্যারাজ্য এবং চন্দ্রমুখী বিধবা তারাকে পেলেন।
অশোকবনে সীতাকে রাক্ষসীরা দিবারাত্র পাহারা দিত এবং সর্বদা তর্জন করত। একদিন ত্রিজটা নামে এক রাক্ষসী তাকে বললে, সীতা, ভয় ত্যাগ কর। অবিন্ধ্য নামে এক বৃদ্ধ রাক্ষসশ্রেষ্ঠ তোমাকে জানাতে বলেছেন যে রাম-লক্ষ্মণ কুশলে আছেন এবং শীঘ্রই সুগ্রীবের সঙ্গে এসে তোমাকে মুক্ত করবেন। আমিও এক ভীষণ স্বপ্ন দেখেছি যে রাক্ষসসেনা ধ্বংস হবে।
সীতার উদ্ধারের জন্য সুগ্রীব কোনও চেষ্টা করছেন না দেখে রাম লক্ষ্মণকে তাঁর কাছে পাঠালেন। সুগ্রীব বললেন, আমি অকৃতজ্ঞ নই, সীতার অন্বেষণে সর্বদিকে বানরদের পাঠিয়েছি, আর পাঁচ দিনের মধ্যে তারা ফিরে আসবে। তারপর একদিন। হনুমান এসে জানালেন যে তিনি সমুদ্র লঙ্ঘন করে সীতার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। অনন্তর রাম বিশাল বানর-ভল্লুক সৈন্য নিয়ে যাত্রা করলেন। সমুদ্র রামকে স্বপ্নযোগে দর্শন দিয়ে বললেন, তোমার সৈন্যদলে বিশ্বকর্মার পুত্র নল আছেন, তাকে সেতু নির্মাণ করতে বল। রামের আজ্ঞায় সমুদ্রের উপর সেতু নির্মিত হল , তা এখনও নলসেতু নামে খ্যাত। এই সময়ে বিভীষণ ও তার চারজন সচিব এসে রামের সঙ্গে মিলিত হলেন। রাম সসৈন্যে এক মাস সেতুপথে সমুদ্র পার হলেন এবং লঙ্কায় সৈন্যসমাবেশ করলেন।
অঙ্গদ রাবণের কাছে গিয়ে রামের এই বার্তা জানালেন।-সীতাকে হরণ করে তুমি আমার কাছে অপরাধী হয়েছ, কিন্তু তোমার অপরাধে নিরপরাধ লোকেও বিনষ্ট হবে। তুমি যেসকল ঋষি ও রাজর্ষি হত্যা করেছ, দেবগণকে অপমান করেছ, নারীহরণ করেছ, তার প্রতিফল এখন পাবে। তুমি জানকীকে মুক্ত কর, নতুবা পৃথিবী রাক্ষসশূন্য করব। রাবণের আদেশে চার জন রাক্ষস অঙ্গদকে ধরতে গেল, তিনি তাদের বধ করে রামের কাছে ফিরে এলেন।
রামের আজ্ঞায় বানররা লঙ্কার প্রাচীর ও গৃহাদি ভেঙে ফেললে। দুই পক্ষে ঘোর যুদ্ধ হ’তে লাগল, প্রহস্ত ধূমাক্ষ প্রভৃতি সেনাপতি এবং বহু রাক্ষস নিহত হল। লক্ষ্মণ কুম্ভকর্ণকে বধ করলেন। ইন্দ্রজিৎ মায়াবলে অদৃশ্য হয়ে রাম-লক্ষ্মণকে শরাঘাতে নির্জিত করলেন। সুগ্রীব মহৌষধি বিশল্যা দ্বারা তাদের সুস্থ করলেন। বিভীষণ জানালেন যে কুবেরের কাছ থেকে এক যক্ষ মন্ত্রসিদ্ধ জল নিয়ে এসেছে, এই জলে চোখ ধুলে অদৃশ্য প্রাণীদের দেখা যায়। রাম লক্ষ্মণ সুগ্রীব হনুমান প্রভৃতি সেই জল চোখে দিলেন, তখন সমস্তই তাদের দৃষ্টিগোচর হল। ইন্দ্রজিৎ আবার যুদ্ধ করতে এলেন। বিভীষণ ইঙ্গিত করলেন যে ইন্দ্রজিৎ এখনও আঙ্গিক করেন নি, এই অবস্থাতেই তাকে বধ করা উচিত। কিছুক্ষণ ঘোর যুদ্ধের পর লক্ষ্মণ শরাঘাতে ইন্দ্রজিতের দুই বাহু ও মস্তক ছেদন করলেন।
পুত্রশোকে বিভ্রান্ত হয়ে রাবণ সীতাকে বধ করতে গেলেন। অবিন্ধ্য তাকে বললেন, স্ত্রীহত্যা অকর্তব্য, আপনি এঁর স্বামীকেই বধ করুন। রাবণ যুদ্ধভূমিতে এসে মায়া সৃষ্টি করলেন, তার দেহ থেকে শতসহস্র অস্ত্রধারী রাক্ষস নির্গত হ’তে লাগল। তিনি রাম-লক্ষ্মণের রূপ গ্রহণ করে ধাবিত হলেন। এই সময়ে ইন্দ্র-সারথি মাতলি এক দিব্যরথ এনে রামকে বললেন, আপনি এই রথে চড়ে যুদ্ধ করুন। রাম রথারোহণ করে রাবণকে আক্রমণ করলেন। রাবণ এক ভীষণ শূল নিক্ষেপ করলেন, রাম তা শরাঘাতে ছেদন করলেন। তার পর তিনি তাঁর তৃণ থেকে এক উত্তম শর তুলে নিয়ে ব্রহ্মাস্ত্রমন্ত্রে প্রভাবান্বিত করলেন এবং জ্যাকর্ষণ করে মোচন করলেন। সেই শরের আঘাতে রাবণের দেহ অশ্ব রথ ও সারথি প্রজ্বলিত হয়ে উঠল, রাবণের ভস্ম পর্যন্ত রইল না।।
এই দারুণ বাক্য শুনে সীতা ছিন্ন কদলীতরুর ন্যায় ভূপতিত হলেন। এই সময়ে ব্রহ্মা ইন্দ্র অগ্নি বায়ু প্রভৃতি দেবগণ, সপ্তর্ষিগণ, এবং দিব্যমূর্তি রাজা দশরথ সংহযুক্ত বিমানে এসে দর্শন দিলেন। সীতা রামকে বললেন, রাজপুত্র, তোমার উপর আমার ক্রোধ নেই, স্ত্রীপুরুষের গতি আমার জানা আছে। যদি আমি পাপ করে থাকি তবে আমার অন্তশ্চর প্রাণবায়ু আমাকে ত্যাগ করুন। যদি আমি স্বপ্নেও অন্য পুরুষকে চিন্তা না করে থাকি তবে বিধাতার নির্দেশে তুমিই আমার পতি থাক। তখন দেবতারা রামকে বললেন, অতি সূক্ষ্ম পাপও মৈথিলীর নেই, তুমি এঁকে গ্রহণ কর। দশরথ বললেন, বৎস, তোমার মঙ্গল হ’ক, চতুদর্শবর্ষ পূর্ণ হয়েছে, তুমি অযোধ্যায় গিয়ে রাজ্যশাসন কর।
মৃত বানরগণ দেবগণের বরে পুনর্জীবিত হল। সীতা হনুমানকে বর দিলেন, পুত্র, রামের কীর্তি যত দিন থাকবে তুমিও তত দিন বাঁচবে, দিব্য ভোগ্যবস্তু সর্বদাই তোমার নিকট উপস্থিত হবে। তারপর রাম সীতার সঙ্গে পুষ্পক বিমানে কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে এলেন এবং অঙ্গদকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করে সুগ্রীবাদির সঙ্গে অযোধ্যায় যাত্রা করলেন। নন্দিগ্রামে এলে ভরত তাকে রাজ্যের ভার প্রত্যর্পণ করলেন। শুভনক্ষত্রযোগে বশিষ্ঠ ও বামদেব রামকে রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। সুগ্রীব বিভীষণ প্রভৃতি স্বরাজ্যে ফিরে গেলেন। রাম গোমতীতীরে মহাসমারোহে দশ অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন। | উপাখ্যান শেষ করে মার্কণ্ডেয় বললেন, বনবাসকালে রাম এইপ্রকার দারুণ বিপদ ভোগ করেছিলেন। যুধিষ্ঠির, তুমি শোক ক’রো না, তোমার বীর ভ্রাতাদের সাহায্যে তুমিও শত্ৰুজয় করবে।
** (১) এই রামোপাখ্যান বাল্মীকি-রামায়ণের সঙ্গে সর্বত্র মেলে না, সীতার বনবাস প্রভৃতি উত্তরকাণ্ডবর্ণিত ঘটনাবলী এতে নেই।
॥ পতিব্রতামাহাত্ম্যপর্বাধ্যায়॥
৫৫। সাবিত্রী-সত্যবান
যুধিষ্ঠির বললেন, আমার নিজের জন্য বা ভ্রাতাদের জন্য বা রাজ্যনাশের জন্য আমার তত দুঃখ হয় না যত দ্রৌপদীর জন্য হয়। দুরাত্মারা দূতসভায় আমাদের যে ক্লেশ দিয়েছিল দ্রৌপদীই তা থেকে আমাদের উদ্ধার করেছিলেন। আবার তাকে জয়দ্রথ হরণ করলে। এই দ্রুপদকন্যার তুল্য পতিব্রতা মহাভাগা কোনও নারীর কথা আপনি জানেন কি? মার্কণ্ডেয় বললেন, মহারাজ, তুমি রাজকন্যা সাবিত্রীর ইতিহাস শোন, তিনি কুলস্ত্রীর সমস্ত সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।-
মদ্র দেশে অশ্বপতি নামে এক ধর্মাত্মা রাজা ছিলেন। তিনি সন্তান কামনায় সাবিত্রী (১) দেবীর উদ্দেশ্যে লক্ষ হোম করেন। আঠার বৎসর পূর্ণ হলে সাবিত্রী তুষ্ট হয়ে হোমকুণ্ড থেকে উঠে রাজাকে বর দিতে চাইলেন। অশ্বপতি বললেন, আমার বহু পুত্ৰ হ’ক। সাবিত্রী বললেন, তোমার অভিলাষ আমি পূর্বেই ব্রহ্মাকে জানিয়েছিলাম, তাঁর প্রসাদে তোমার একটি তেজস্বিনী কন্যা হবে। আমি তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মার আদেশে এই কথা বলছি, তুমি আর প্রস্তুক্তি ক’রো না।
যথাকালে রাজার জ্যেষ্ঠা মহিষী এক রাজীবলোচনা কন্যা প্রসব করলেন। দেবী সাবিত্রী দান করেছেন এজন্য কন্যার নাম সাবিত্রী রাখা হল। মূর্তিমতী লক্ষ্মীর ন্যায় এই কন্যা ক্রমে যৌবনবতী হলেন, কিন্তু তার তেজের জন্য কেউ তার পাণি প্রার্থনা করলেন না। একদিন অশ্বপতি তাঁকে বললেন, পুত্রী, তোমাকে সম্প্রদান করবার সময় এসেছে, কিন্তু কেউ তোমাকে চাচ্ছে না। তুমি নিজেই তোমার উপযুক্ত গুণবান পতির অন্বেষণ কর। এই বলে রাজা কন্যার ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিলেন। সাবিত্রী লজ্জিতভাবে পিতাকে প্রণাম করে বৃদ্ধ সচিবদের সঙ্গে রথারোহণে যাত্রা করলেন। তিনি রাজর্ষিগণের তপোবন দর্শন এবং তীর্থস্থানে ব্রাহ্মণকে ধনদান করতে লাগলেন।
একদিন মদ্ররাজ অশ্বপতি সভায় বসে নারদের সঙ্গে কথা বলছেন এমন সময় সাবিত্রী ফিরে এসে প্রণাম করলেন। নারদ বললেন, রাজা, তোমার কন্যা কোথায় গিয়েছিল ? এ যুবতী হয়েছে, পতির হস্তে সম্প্রদান করছ না কেন? রাজা বললেন, দেবর্ষি, সেই উদ্দেশ্যেই একে পাঠিয়েছিলাম, এ কাকে বরণ করেছে তা শুনুন। পিতার আদেশে সাবিত্রী বললেন, শাম্ব দেশে দ্যুমৎসেন নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি অন্ধ যান এবং তার পুত্রও তখন বালক, এই সুযোগ পেয়ে শত্রু তাঁর রাজ্য হরণ করে। তিনি ভার্ষা ও পুত্রের সঙ্গে মহারণ্যে আসেন এবং এখন সেখানেই তপশ্চর্যা করছেন। তার পুত্র সত্যবান বড় হয়েছেন, আমি তাকেই মনে মনে বরণ করেছি।
নারদ বললেন, হা, কি দুর্ভাগ্য, সাবিত্রী না জেনে সত্যবানকে বরণ করেছে। তার পিতা-মাতা সত্য বলেন, সেজন্য ব্রাহ্মণরা তার সত্যবান নাম রেখেছেন। বাল্যকালে সে অশ্বপ্রিয় ছিল, মৃত্তিকার অশ্ব গড়ত, অশ্বের চিত্র আঁকত, সেজন তার আর এক নাম চিত্রা। সে রন্তিদেবের ন্যায় দাতা, শিবির ন্যায় ব্রাহ্মণসেব ও সত্যবাদী, চন্দ্রের ন্যায় প্রিয়দর্শন। তার একটিমাত্র দোষ আছে—এক বৎসর পরে তার মৃত্যু হবে।
রাজা বললেন, সাবিত্রী, তুমি আবার যাও, অন্য কাকেও বরণ কর। সাবিত্রী বললেন,
সুকৃদংশো নিপততি সকৃৎ কন্যা প্রদীয়তে।
সকৃদাহ দদানীতি ত্ৰীণ্যেতানি সকৃৎ সকৃৎ।
দীর্ঘায়ুরথবাল্পায়ুঃ সগুণো নিগুণোহপি বা।
সকৃতো ময়া ভর্তা ন দ্বিতীয়ং বৃণোম্যহম ৷৷
মনসা নিশ্চয়ং কৃত্বা ততো বাচাভিধীয়তে।
ক্রিয়তে কর্মর্ণ পশ্চাৎ প্রমাণং মে মনস্ততঃ।
-পৈতৃক ধনের অংশ একবারই প্রাপ্য হয়, কন্যাদান একবারই হয়, একবারই ‘দিলাম’ বলা হয়; এই তিন কার্যই এক-একবার মাত্র হয়। দীর্ঘায় বা অল্পায় গুণবান বা গুণহীন, আমি একবারই পতিবরণ করেছি, দ্বিতীয় কাকেও বরণ করব না। লোকে আগে মনে মনে কর্তব্য স্থির করে, তার পর বাক্যে প্রকাশ করে, তার পর কার্য করে; অতএব আমার মনই প্রমাণ (২)।
নারদ বললেন, মহারাজ, তোমার কন্যা তার কর্তব্য স্থির করে ফেলেছে, তাকে বারণ করা যাবে না। অতএব সত্যবানকেই কন্যাদান কর। নারদ আশীর্বাদ করে চ’লে গেলেন। রাজা অশ্বপতি বিবাহের উপকরণ সংগ্রহ করলেন এবং শুভদিনে সাবিত্রী ও পুরোহিতাদিকে নিয়ে দ্যুমৎসেনের আশ্রমে উপস্থিত হলেন।
অশ্বপতি বললেন, রাজর্ষি, আমার এই সুন্দরী কন্যাকে আপনি পুত্রবধূরূপে নিন। দ্যুমৎসেন বললেন, আমরা রাজ্যচ্যুত হয়ে বনবাসে আছি, আপনার কন্যা কি করে কষ্ট সইবেন? অশ্বপতি বললেন, সুখ বা দুঃখ চিরস্থায়ী নয়, আমার কন্যা আর আমি তা জানি। আমি আশা করে আপনার কাছে এসেছি, আমাকে প্রত্যাখ্যান করবেন না। দ্যুমৎসেন সম্মত হলেন, আশ্রমবাসী ব্রাহ্মণগণের সমক্ষে সাবিত্রী-সত্যবানের বিবাহ যথাবিধি সম্পন্ন হল। উপযুক্ত বসনভূষণ সহ কন্যাকে দান করে অশ্বপতি আনন্দিত মনে প্রস্থান করলেন। তারপর সাবিত্রী তার সমস্ত আভরণ খুলে ফেলে বল্কল ও গৈরিক বস্ত্র ধারণ করলেন এবং সেবার দ্বারা শ্বশুর শাশুড়ী ও স্বামীকে পরিতুষ্ট করলেন। কিন্তু নারদের বাক্য সর্বদাই তার মনে ছিল।
এইরূপে অনেক দিন গত হল। সাবিত্রী দিন গণনা করে দেখলেন, আর চার দিন পরে তার স্বামীর মৃত্যু হবে। তিনি ত্রিরাত্র উপবাসের সংকল্প করলেন। দ্যুমৎসেন দুঃখিত হয়ে তাঁকে বললেন, রাজকন্যা, তুমি অতি কঠোর ব্রত আরম্ভ করেছ, তিন রাত্রি উপবাস অতি দুঃসাধ্য। সাবিত্রী উত্তর দিলেন, পিতা, আপনি ভাববেন না, আমি ব্রত উদ্যাপন করতে পারব। সত্যবানের মৃত্যুর দিনে সাবিত্রী পূর্বাহ্মের সমস্ত কার্য সম্পন্ন করলেন এবং গুরুজনদের প্রণাম করে কৃতাঞ্জলি হয়ে রইলেন। তপোবনবাসী সকলেই তাকে আশীর্বাদ করলেন, অবিধবা হও। সাবিত্রী ধ্যানস্থ হয়ে মনে মনে বললেন, তাই যেন হয়। শ্বশুর-শাশুড়ী তাকে বললেন, তোমার ব্রত সমাপ্ত হয়েছে, এখন আহার কর। সাবিত্রী বললেন, সূর্যাস্তের পর আহার করব এই সংকল্প করেছি।
সত্যবান কাঁধে কুঠার নিয়ে বনে যাচ্ছেন দেখে সাবিত্রী বললেন, আমিও যাব, তোমার সঙ্গ ছাড়ব না। সত্যবান বললেন, তুমি পূর্বে কখনও বনে যাওনি, পথও কষ্টকর, তার উপর উপবাস করে দুর্বল হয়ে আছ, কি করে পদব্রজে যাবে? সাবিত্রী বললেন, উপবাসে আমার কষ্ট হয়নি, যাবার জন্য আমার উৎসাহ হয়েছে, তুমি বারণ ক’রো না। সত্যবান বললেন, তবে আমার পিতামাতার অনুমতি নাও, তা হলে আমার দোষ হবে না। সাবিত্রীর অনুরোধ শুনে দ্যুমৎসেন বললেন, সাবিত্রী আমাদের পুত্রবধু হবার পর কিছু চেয়েছেন বলে মনে পড়ে না, অতএব এঁর অভিলাষ পূর্ণ হ’ক। পুত্রী, তুমি সত্যবানের সঙ্গে সাবধানে যেয়ো। অনুমতি পেয়ে সাবিত্রী যেন সহাস্যবদনে কিন্তু সন্তপ্তহৃদয়ে স্বামীর সঙ্গে গেলেন। যেতে যেতে সত্যবান পুণ্যসলিলা নদী, পুষ্পিত পর্বত প্রভৃতি দেখাতে লাগলেন। সাবিত্রী নিরন্তর স্বামীর দিকে চেয়ে রইলেন এবং নারদের বাক্য স্মরণ করে তাঁকে মৃত জ্ঞান করলেন।
সত্যবান ফল পেড়ে তার থলি ভরতি করলেন, তার পর কাঠ কাটতে লাগলেন। পরিশ্রমে তার ঘাম হ’তে লাগল, মাথায় বেদনা হল। তিনি বললেন, সাবিত্রী, আমি অত্যন্ত অসুস্থ বোধ করছি, আমার মাথা যেন শূল দিয়ে বিঁধছে, দাঁড়াতে পারছি না। সাবিত্রী স্বামীর মাথা কোলে রেখে ভূতলে বসে পড়লেন। মুহূর্তকাল পরে তিনি দেখলেন, এক দীর্ঘকায় শ্যামবর্ণ রক্তলোচন ভয়ংকর পুরুষ পার্শ্বে এসে সত্যবানকে নিরীক্ষণ করছেন, তার পরিধানে রক্তবাস, কেশ চূড়াবন্ধ, হস্তে পাশ। তাকে দেখে সাবিত্রী ধীরে ধীরে তার স্বামীর মাতা কোল থেকে নামালেন এবং দাঁড়িয়ে উঠে কম্পিতহৃদয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, আপনার মূর্তি দেখে বুঝেছি আপনি দেবতা। আপনি কে, কি ইচ্ছা করেন?
যম বললেন, সাবিত্রী, তুমি পতিব্রতা তপশ্চারিণী, এজন্য তোমার সঙ্গে কথা বলছি। আমি যম। তোমার স্বামীর আয়ু শেষ হয়েছে, আমি এঁকে পাশবদ্ধ করে নিয়ে যাব। সত্যবান ধার্মিক, গুণসাগর, সেজন্য আমি অনুচর না পাঠিয়ে নিজেই এসেছি। এই বলে যম সত্যবানের দেহ থেকে অঙ্গুষ্ঠপরিমাণ পুরুষ (৩) পাশবদ্ধ করে টেনে নিলেন, প্রাণশূন্য দেহ শ্বাসহীন নিষ্প্রভ নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে রইল; যম দক্ষিণ দিকে চললেন। সাবিত্রীকে পশ্চাতে আসতে দেখে যম বললেন, সাবিত্রী, তুমি ভর্তার ঋণ শোধ করেছ, এখন ফিরে গিয়ে এঁর পারলৌকিক ক্রিয়া কর। এ সাবিত্রী বললেন, আমার স্বামী যেখানে যান অথবা তাকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয় আমারও সেখানে যাওয়া কর্তব্য, এই সনাতন ধর্ম। আমার তপস্যা ও পতিপ্রেমের বলে এবং আপনার প্রসাদে আমার গতি প্রতিহত হবে না। পণ্ডিতরা বলেন, একসঙ্গে সাত পা গেলেই মিত্রতা হয়; সেই মিত্রতায় নির্ভর করে আপনাকে কিছু বলছি শুনুন। পতিহীনা নারীর পক্ষে বনে বাস করে ধর্মাচরণ করা অসম্ভব। যে ধর্মপথ সাধুজনের সম্মত সকলে তারই অনুসরণ করে, অন্য পথে যায় না। সাধুজন গার্হস্থ্য ধর্মকেই প্রধান বলেন।
যম বললেন, সাবিত্রী, তুমি আর এসো না, নিবৃত্ত হও। তোমার শুদ্ধ ভাষা আর যুক্তিসম্মত বাক্য শুনে আমি তুষ্ট হয়েছি, তুমি বর চাও। সত্যবানের জীবন ভিন্ন যা চাও তাই দেব। সাবিত্রী বললেন, আমার শ্বশুর অন্ধ ও রাজ্যচ্যুত হয়ে বনে বাস করছেন, আপনার প্রসাদে তিনি চক্ষু লাভ করে অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় তেজস্বী হন। যম বললেন, তাই হবে। তোমাকে পথশ্রমে ক্লান্ত দেখছি, তুমি ফিরে যাও।
সাবিত্রী বললেন, স্বামীর নিকটে থাকলে আমার ক্লান্তি হবে কেন? তার যে গতি আমারও সেই গতি। তা ছাড়া আপনার ন্যায় সজ্জনের সঙ্গে একবার মিলনও বাঞ্ছনীয়, তা নিষ্ফল হয় না, সেজন্য সাধুসঙ্গেই থাকা উচিত। যম বললেন, তুমি যে হিতবাক্য বললে তা মনোহর বুদ্ধিপ্রদ। সত্যবানের জীবন ভিন্ন দ্বিতীয় একটি বর চাও। সাবিত্রী বললেন, আমার শ্বশুর তার রাজ্য পুনর্বার লাভ করুন, তিনি যেন স্বধর্ম পালন করতে পারেন।
যম বললেন, রাজকন্যা, তোমার কামনা পূর্ণ হবে। এখন নিবৃত্ত হও, আর পরিশ্রম ক’রো না। সাবিত্রী বললেন, দেব, আপনি জগতের লোককে নিয়মানুসারে সংযত রাখেন এবং আয়ুঃশেষে তাদেরই কর্মানুসারে নিয়ে যান, আপার নিজের ইচ্ছায় নয়; এজনওই আপনার নাম যম। আমার আর একটি কথা শুনুন। কর্ম মন ও বাক্য দ্বারা কোনও প্রাণীর অনিষ্ঠ না করা, অনুগ্রহ ও দান করা—এই সনাতন ধর্ম। জগতের লোক সাধারণত অল্পায়ু ও দুর্বল, সেজন্য সাধুজন শরণাগত অমিত্রকেও দয়া করেন। যম বললেন, পিপাসিতের পক্ষে যেমন জল, সেইরূপ তোমার বাক্য। কল্যাণী, সত্যবানের জীবন ভিন্ন আর একটি বর চাও।
সাবিত্রী বললেন, আমার পিতা পুত্রহীন, বংশরক্ষাৰ্থ তাঁর যেন শতপুত্র হয়, এই তৃতীয় বর আমি চাচ্ছি। যম বললেন, তাই হবে। তুমি বহুদূরে এসে পড়েছ, এখন ফিরে যাও। সাবিত্রী বললেন, আমার পক্ষে এ দূর নয়, কারণ স্বামীর নিকটে আছি।
আমার মন আর দূরে ধাবিত হচ্ছে। আপনি বিবস্বানের (সূর্যের) পুত্র, সেজন্য আপনি বৈবস্বত; আপনি সমবুদ্ধিতে ধর্মানুসারে প্রজাশাসন করেন সেজন্য আপনি ধর্মরাজ। আপনি সজ্জন, সজ্জনের উপরে যেমন বিশ্বাস হয় তেমন নিজের উপরেও হয়।
যম বললেন, তুমি যা বলছ তেমন বাক্য আমি কোথাও শুনিনি। তুমি সত্যবানের জীবন ভিন্ন আর একটি বর চাও। সাবিত্রী বললেন, আমার গর্ভে সত্যবানের ঔরসে যেন বলবীর্যশালী শতপত্র হয়, এই চতুর্থ বর চাচ্ছি। যম বললেন, বলবীর্যশালী শতপুত্র তোমাকে আনন্দিত করবে। রাজকন্যা, দূর পথে এসেছ, ফিরে যাও।
সাবিত্রী বললেন, সাধুজন সর্বদাই ধর্মপথে থাকেন, তারা দান করে অনুতপ্ত হন না। তাদের অনুগ্রহ ব্যর্থ হয় না, তাদের কাছে কারও প্রার্থনা বা সম্মান নষ্ট হয় না, তারা সকলেরই রক্ষক। যম বললেন, তোমার ধর্মসম্মত হৃদয়গ্রাহী বাক্য শুনে তোমার প্রতি আমার ভক্তি হয়েছে। পতিব্রতা, তুমি আর একটি বর চাও।
সাবিত্রী বললেন, হে মানদ, যে বর আমাকে দিয়েছেন তা আমার পুণ্য না থাকলে আপনি দিতেন না। সেই পুণ্যরলে এই বর চাচ্ছি—সত্যবান জীবনলাভ করুন, পতি বিনা আমি মৃততুল্য হয়ে আছি। পতিহীন হয়ে আমি সুখ চাই না, স্বর্গ চাই না, প্রিয়বস্তু চাই না, বাঁচতেও চাই না। আপনি শতপুত্রের বর দিয়েছেন, অথচ আমার পতিকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন। সত্যবান বেঁচে উঠুন এই বর চাচ্ছি, তাতে আপনার বাক্য সত্য হবে। ধর্মরাজ যম বললেন, তাই হবে। সত্যবানকে পাশমুক্ত করে যম হৃষ্টচিত্তে বললেন, তোমার পতিকে মুক্তি দিলাম, ইনি নীরোগ বলবান ও সফলকাম হবেন, চার শত বৎসর তোমার সঙ্গে জীবিত থাকনেব, যজ্ঞ ও ধর্মকার্য করে খ্যাতিলাভ করবেন।
যম চ’লে গেলে সাবিত্রী তার স্বামীর মৃতদেহের নিকট ফিরে এলেন। তিনি সত্যবানের মাথা কোলে তুলে নিয়ে বললেন, রাজপুত্র, তুমি বিশ্রাম করেছ, তোমার নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে, যদি পার তো ওঠ। দেখ, রাত্রি গাঢ় হয়েছে। সত্যবান সংজ্ঞালাভ করে চারিদিকে চেয়ে দেখলেন, তারপর বললেন, আমি শিরঃপীড়ায় কাতর হয়ে তোমার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তুমি আমাকে আলিঙ্গন করে ধরে ছিলে। আমি নিদ্রাবস্থায় ঘোর অন্ধকার এবং এক মহাতেজা পুরুষকে দেখেছি। একি স্বপ্ন না সত্য? সাবিত্রী বললেন, কাল তোমাকে বলব। এখন রাত্রি গভীর হয়েছে, ওঠ, পিতা-মাতার কাছে চল। সত্যবান বললেন, এই ভয়ানক বনে নিবিড় অন্ধকারে পথ দেখতে পাবে না। সাবিত্রী বললেন, এই বনে একটি গাছ জ্বলছে, তা থেকে আগুন এনে আমাদের চারিদিকে জ্বালব, কাঠ আমাদের কাছেই আছে। তোমাকে রুগ্নের ন্যায় দেখাচ্ছে, যদি যেতে না পার তবে আমরা এখানেই রাত্রিযাপন করব। সত্যবান বললেন, আমি সুস্থ হয়েছি, ফিরে যেতে ইচ্ছা করি। দিনমানেও যদি আমি আশ্রমের বাইরে যাই তবে পিতা-মাতা উদ্বিগ্ন হয়ে আমার অন্বেষণ করেন, বিলম্বের জন্য ভর্ৎসনা করেন। আজ তাদের কি অবস্থা হয়েছে তাই আমি ভাবছি।
সত্যবান শোকার্ত হয়ে কাঁদতে লাগলেন। সাবিত্রী তার চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন, যদি আমি তপস্যা দান ও হোম করে থাকি তবে এই রাত্রি আমার শ্বশুর-শাশুড়ী আর স্বামীর পক্ষে শুভ হ’ক। সাবিত্রী তার কেশপাশ সংযত করে দুই বাহু দিয়ে স্বামীকে তুললেন। সত্যবান তার ফলের থলির দিকে তাকাচ্ছেন দেখে সাবিত্রী বললেন, কাল নিয়ে যেয়ো, তোমার কুঠার আমি নিচ্ছি। ফলের থলি গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে কুঠার নিয়ে সাবিত্রী সত্যবানের কাছে এলেন এবং তার বাঁ হাত নিজের কাঁধে রেখে নিজের ডান হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে চললেন। সত্যবান বললেন, এই পলাশবনের উত্তর দিকের পথ দিয়ে দ্রুত চল, আমি এখন সুস্থ হয়েছি, পিতামাতাকে শীঘ্র দেখতে চাই।
এই সময়ে দ্যুমৎসেন চক্ষু লাভ করলেন। সত্যবান না আসায় তিনি উদবিগ্ন হয়ে তাঁর ভার্যা শৈব্যার সঙ্গে চারিদিকে উন্মত্তের ন্যায় খুঁজতে লাগলেন। আশ্রমবাসী ঋষিরা তাদের ফিরিয়ে এনে নানাপ্রকারে আশ্বাস দিলেন। এমন সময় সাবিত্রী সত্যবানকে নিয়ে আশ্রমে উপস্থিত হলেন। তখন ব্রাহ্মণরা আগুন জ্বাললেন এবং শৈব্যা সত্যবান ও সাবিত্রীর সঙ্গে সকলে রাজা দ্যুমৎসেনের নিকটে বসলেন। সত্যবান জানালেন যে তিনি শিরঃপীড়ায় কাতর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সেজন্য ফিরতে বিলম্ব হয়েছে। গৌতম নামে এক ঋষি বললেন, তোমার পিতা অকস্মাৎ চক্ষু লাভ করেছেন, তুমি এর কারণ জান না। সাবিত্রী, তুমি বলতে পারবে, তুমি সবই জান, তোমাকে ভগবতী সাবিত্রী দেবীর ন্যায় শক্তিমতী মনে করি। যদি গোপনীয় না হয়। তো বল।
সাবিত্রী বললেন, নারদের কাছে শুনেছিলাম যে, আমার পতির মৃত্যু হবে। আজ সেইদিন, সেজন্য আমি পতির সঙ্গ ছাড়িনি। তারপর সাবিত্রী যমের আগমন, সত্যবানকে গ্রহণ, এবং স্তবে প্রসন্ন হয়ে পাঁচটি বরদান প্রভৃতি সমস্ত ঘটনা বিবৃত করলেন। ঋষিরা বললেন, সাধ্বী, তুমি সুশীলা পুণ্যবতী সদ্বংশীয়া; তমোময় হ্রদে নিমজ্জমান বিপদ্গ্রস্ত রাজবংশকে তুমি উদ্ধার করেছ। তারপর তারা সাবিত্রীর বহু প্রশংসা ও সম্মাননা করে হৃষ্টচিত্তে নিজ নিজ গৃহে চ’লে গেলেন। | পরদিন প্রভাতকালে শাম্বদেশের প্রজারা এসে দুমৎসেনকে জানালে যে তার মন্ত্রী তার শত্রুকে বিনষ্ট করেছেন এবং রাজাকে নিয়ে যাবার জন্য চতুরঙ্গ সৈন্য : উপস্থিত হয়েছে। দ্যুমৎসেন তার মহিষী, পুত্র ও পুত্রবধূর সঙ্গে নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন এবং সত্যবানকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। যথাকালে সাবিত্রীর শত পুত্ৰ হল এবং অশ্বপতির ঔরসে মালবীর গর্ভে সাবিত্রীর এক শত ভ্রাতাও হল।
এই সাবিত্রীর উপন্যাস যে ভক্তিসহকারে শোনে সে সুখী ও সর্ববিষয়ে সিদ্ধকাম হয়, কখনও দুঃখ পায় না।
**
(১) সূর্যাধিষ্ঠাত্রী দেবী।
(২) আমি মনে মনে পতি বরণ করেছি, বিবাহের তাই প্রমাণস্বরূপ।
(৩) সূক্ষ্ম বা লিঙ্গ শরীর।
॥ কুণ্ডলাহরণপর্বাধ্যায়॥
৫৬। কর্ণের কবচ-কুণ্ডল দান
লোমশ মুনি যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছিলেন (১) যে ইন্দ্র কর্ণের সহজাত কুণ্ডল ও কবচ হরণ করে তাঁর শক্তিক্ষয় করবেন। পাণ্ডবদের বনবাসের দ্বাদশ বৎসর প্রায় অতিক্রান্ত হলে ইন্দ্র তার প্রতিজ্ঞাপালনে উদযোগী হলেন। ইন্দ্রের অভিপ্রায় বুঝে সূর্য নিদ্রিত কর্ণের নিকট গেলেন এবং স্বপ্নযোগে ব্রাহ্মণের মূর্তিতে দর্শন দিয়ে বললেন, বৎস, পাণ্ডবদের হিতের জন্য ইন্দ্র তোমার কুণ্ডল ও কবচ হরণ করতে চান। তিনি জানেন যে সাধুলোকে তোমার কাছে কিছু চাইলে তুমি দান কর। তিনি ব্রাহ্মণের বেশে কবচ-কুণ্ডল ভিক্ষা করতে তোমার কাছে যাবেন। তুমি দিও না, তাতে তোমার আয়ুক্ষয় হবে।
কর্ণ প্রশ্ন করলেন, ভগবান, আপনি কে? সূর্য বললেন, আমি সহস্রাংশু সূর্য, তোমার প্রতি স্নেহের জন্য দেখা দিয়েছি। কর্ণ বললেন, বিভাবসু, সকলেই আমার এই ব্রত জানে যে প্রার্থী ব্রাহ্মণকে আমি প্রাণও দিতে পারি। ইন্দ্র যদি পাণ্ডবদের হিতের জন্য ব্রাহ্মণবেশে কবচ-কুণ্ডল ভিক্ষা করেন তবে আমি অবশ্যই দান করব, তাতে আমার কীর্তি এবং ইন্দ্রের অকীর্তি হবে।
কর্ণকে নিবৃত্ত করবার জন্য সূর্য বহু চেষ্টা করলেন, কিন্তু কর্ণ সম্মত হলেন না। তিনি বললেন, আপনি উদবিগ্ন হবেন না, অর্জুন যদি কার্তবীর্যাজুনের তুল্যও হয় তথাপি তাকে আমি যুদ্ধে জয় করব। আপনি তো জানেন যে আমি পরশুরাম ও দ্রোণের নিকট অস্ত্রবল লাভ করেছি। সূর্য বললেন, তবে তুমি ইন্দ্রকে এই কথা বলো, সহস্রাক্ষ, আপনি আমাকে শত্রুনাশক অব্যর্থ শক্তি অস্ত্র দিন তবে কবচ-কুণ্ডল দেব। কর্ণ সম্মত হলেন।
প্রত্যহ মধ্যাহুকালে কর্ণ স্নানের পর জল থেকে উঠে সূর্যের স্তব করতেন, সেই সময়ে ধনপ্রার্থী ব্রাহ্মণরা তার কাছে আসতেন, তখন তার কিছুই অদেয়
থাকত না। একদিন ইন্দ্র ব্রাহ্মণের বেশে তার কাছে এসে বললেন, কর্ণ, তুমি যদি সত্যব্রত হও তবে তোমার সহজাত কবচ ও কুণ্ডল ছেদন করে আমাকে দাও। কর্ণ বললেন, ভূমি স্ত্রী গো বাসস্থান বিশাল রাজ্য প্রভৃতি যা চান দেব, কিন্তু আমার সহজাত কবচ-কুণ্ডল দিতে পারি না, তাতেই আমি জগতে অবধ্য হয়েছি। ইন্দ্র আর কিছুই নেবেন না শুনে কর্ণ সহাস্যে বললেন, দেবরাজ, আপনাকে আমি পূর্বেই চিনেছি। আমার কাছ থেকে বৃথা বর নেওয়া আপনার অযোগ্য। আপনি দেবগণের ও অন্য প্রাণিগণের ঈশ্বর, আপনারও উচিত আমাকে বর দেওয়া। ইন্দ্র বললেন, সূর্যই পূর্বে জানতে পেরে তোমাকে সতর্ক করে দিয়েছেন। বৎস কর্ণ, আমার বজ্র ভিন্ন যা ইচ্ছা কর তা নাও। কর্ণ বললেন, আমার কবচ-কুণ্ডলের পরিবর্তে আমাকে অব্যর্থ শক্তি-অস্ত্র দিন যাতে শত্রসংঘ ধ্বংস করা যায়।
ইন্দ্র একটু চিন্তা করে বললেন, আমার শক্তি তোমাকে দেব, তুমি তা নিক্ষেপ করলে একজন মাত্র শত্রুকে বধ করে সেই অস্ত্র আমার কাছে ফিরে আসবে। কর্ণ বললেন, আমি মহাযুদ্ধে একজন শত্রুকেই বধ করতে চাই, যাকে আমি ভয় করি। ইন্দ্র বললেন, তুমি এক শত্রুকে মারতে চাও, কিন্তু লোকে যাকে হরি নারায়ণ অচিন্ত্য প্রভৃতি বলে সেই কৃষ্ণই তাকে রক্ষা করেন। কর্ণ বললেন, যাই হ’ক আপনি আমাকে অমোঘ শক্তি দিন যাতে একজন প্রতাপশালী শত্রুকে বধ করা যায়। আমি কবচ-কুণ্ডল ছেদন করে দেব, কিন্তু আমার গাত্র যেন বিরূপ না হয়। ইন্দ্র বললেন, তোমার দেহের কোনও বিকৃতি হবে না। কিন্তু অন্য অস্ত্র থাকতে অথবা তোমার প্রাণসংশয় না হলে যদি অসাবধানে, এই অস্ত্র নিক্ষেপ কর তবে তোমার উপরেই পড়বে। কর্ণ বললেন, আমি সত্য বলছি, পরম প্রাণসংশয় হলেই আমি এই অস্ত্র মোচন করব।
ইন্দ্রের কাছ থেকে শক্তি-অস্ত্র নিয়ে কর্ণ নিজের কবচ-কুণ্ডল কেটে দিলেন, তা দেখে দেব দানব মানব সিংহনাদ করে উঠল। কর্ণের মুখের কোনও বিকার দেখা গেল না। কর্ণ থেকে কুণ্ডল কেটে দিয়েছিলেন সেজন্যই তার নাম কর্ণ। আর্দ্র কবচ-কুণ্ডল নিয়ে ইন্দ্ৰ সহাস্যে চ’লে গেলেন। তিনি মনে করলেন, তাঁর বঞ্চনার ফলে কর্ণ যশস্বী হয়েছেন, পাণ্ডবরাও উপকৃত হয়েছেন।
**
(১) বনপর্ব, ২০-পরিচ্ছেদে।
॥ আরণেয়পর্বাধ্যায়॥
৫৭। যক্ষ-যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নোত্তর
একদিন এক ব্রাহ্মণ যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে বললেন, আমার অরণি আর মন্থ (১) গাছে টাঙানো ছিল, এক হরিণ এসে তার শিঙে আটকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। আপনারা তা উদ্ধার করে দিন যাতে আমাদের অগ্নিহোত্রের হানি না হয়। যুধিষ্ঠির তখনই তাঁর ভ্রাতাদের সঙ্গে হরিণের অন্বেষণে যাত্রা করলেন। তারা হরিণকে দেখতে পেয়ে নানাপ্রকার বাণ নিক্ষেপ করলেন কিন্তু বিদ্ধ করতে পারলেন না। তার পর সেই হরিণকে আর দেখা গেল না। পাণ্ডবগণ শ্রান্ত হয়ে দুঃখিত-মনে বনমধ্যে এক বটগাছের শীতল ছায়ায় বসলেন।
নকুল বললেন, আমাদের বংশে কখনও ধর্মলোপ হয়নি, আলস্যের ফলে কোনও কার্য অসিদ্ধ হয়নি, আমার কোনও প্রার্থীকে ফিরিয়ে দিই নি; কিন্তু আজ আমাদের শক্তির সম্বন্ধে সংশয় উপস্থিত হল কেন? যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন, বিপদ কতপ্রকার হয় তার সীমা নেই, কারণও জানা যায় না; ধর্মই পাপপুণ্যের ফল ভাগ করে দেন। ভীম বললেন, দুঃশাসন দ্রৌপদীর অপমান করেছিল তথাপি তাকে আমি বধ করি নি, সেই পাপে আমাদের এই দশা হয়েছে। অর্জুন বললেন, সূতপুত্র কর্ণের তীক্ষ্ণ কটুবাক্য সহ্য করেছিলাম, তারই এই ফল। সহদেব বললেন, শকুনি যখন দূতে জয়ী হয় তখন আমি তাকে হত্যা করিনি সেজন্য এমন হয়েছে।
পাণ্ডবগণ তৃষার্ত হয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরের আদেশে নকুল বটগাছে উঠে চারিদিক দেখে জানালেন, জলের ধারে জন্মায় এমন অনেক গাছ দেখা যাচ্ছে, সারসের রবও শোনা যাচ্ছে, অতএব নিকটেই জল পাওয়া যাবে। যুধিষ্ঠির বললেন, তুমি শীঘ্র গিয়ে তুণে করে জল নিয়ে এস।
নকুল জলের কাছে উপস্থিত হয়ে পান করতে গেলেন, এমন সময়ে শুনলেন অন্তরীক্ষ থেকে কে বলছে-বৎস, এই জল আমার অধিকারে আছে, আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তার পর পান ক’রো। পিপাসার্ত নকুল সেই কথা অগ্রাহ্য করে জলপান করলেন এবং তখনই ভূপতিত হলেন।
নকুলের বিলম্ব দেখে যুধিষ্ঠির সহদেবকে পাঠালেন। সহদেবও আকাশ-বাণী শুনলেন এবং জলপান করে ভূপতিত হলেন। তারপর যুধিষ্ঠির একে একে অর্জুন ও ভীমকে পাঠালেন, তাঁরাও পূর্ববৎ জলপান করে ভূপতিত হলেন। ভ্রাতারা কেউ ফিরে এলেন না দেখে যুধিষ্ঠির উদবিগ্ন হয়ে সেই জনহীন মহাবনে প্রবেশ করলেন এবং এক স্বর্ণময়-পদ্মশোভিত সরোবর দেখতে পেলেন। সেই সরোবরের তীরে ধনুর্বাণ বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে এবং তার ভ্রাতারা প্রাণহীন নিশ্চেষ্ট হয়ে পড়ে আছেন। দেখে যুধিষ্ঠির শোকাকুল হয়ে বিলাপ করতে লাগলেন। ভ্রাতাদের গায়ে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন নেই, ভূমিতে অন্য কারও পদচিহ্ন নেই দেখে যুধিষ্ঠির ভাবলেন কোনও মহাপ্রাণী এঁদের বধ করেছে, অথবা দুর্যোধন বা শকুনি এই গুপ্তহত্যা করিয়েছে।
যুধিষ্ঠির সরোবরে নেমে জলপান করতে গেলেন এমন সময় উপর থেকে শুনলেন—আমি মৎস্যশৈবালভোজী বক, আমিই তোমার ভ্রাতাদের পরলোকে পাঠিয়েছি। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে যদি জলপান কর তবে তুমিও সেখানে যাবে। যুধিষ্ঠির বললেন, আপনি কোন দেবতা? মহাপর্বততুল্য আমার চার ভ্রাতাকে আপনি নিপাতিত করেছেন, আপনার অভিপ্রায় কি তা বুঝতে পারছি না, আমার অত্যন্ত ভয় হচ্ছে, কৌতুহলও হচ্ছে। ভগবান, আপনি কে? যুধিষ্ঠির এই উত্তর শুনলেন—আমি যক্ষ।
তখন তালবৃক্ষের ন্যায় মহাকায় বিকটাকার সূর্য ও অগ্নির ন্যায় তেজস্বী এক যক্ষ বৃক্ষে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মেঘগম্ভীরস্বরে বললেন, রাজা, আমি বহুবার বারণ করেছিলাম তথাপি তোমার ভ্রাতারা জলপান করতে গিয়েছিল, তাই তাদের মেরেছি। যুধিষ্ঠির, তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও তার পর জলপান ক’রো। যুধিষ্ঠির বললেন যক্ষ, তোমার অধিকৃত বস্তু আমি নিতে চাই না। তুমি প্রশ্ন কর, আমি নিজের বুদ্ধি অনুসারে উত্তর দেব।
তারপর যক্ষ একে একে অনেকগুলি প্রশ্ন করলেন, যুধিষ্ঠিরও তার উত্তর দিলেন। যথা—
যক্ষ। কে সূর্যকে ঊর্ধ্বে রেখেছে? কে সূর্যের চতুর্দিকে ভ্রমণ করে? কে তাঁকে অস্তে পাঠায় ? কোথায় তিনি প্রতিষ্ঠিত আছেন?
যুধিষ্ঠির। ব্রহ্ম সূর্যকে ঊর্ধ্বে রেখেছেন, দেবগণ তাঁর চতুর্দিকে বিচরণ করেন, ধর্ম তাকে অস্তে পাঠায়, সত্যে তিনি প্রতিষ্ঠিত আছেন।
য। ব্রাহ্মণের দেবত্ব কি কারণে হয় ? কোন্ ধর্মের জন্য তারা সাধু? তাদের মানুষভাব কেন হয় ? অসাধুভাব কেন হয়?
যু। বেদাধ্যায়নের ফলে তাদের দেবত্ব, তপস্যার ফলে সাধুতা; তারা মরেন এজন্য তারা মানুষ, পরনিন্দার ফলে তারা অসাধু হন।
য। ক্ষত্রিয়ের দেবত্ব কি? সাধুধর্ম কি? মানুষভাব কি? অসাধুভাব কি?
যু। অস্ত্রনিপুণতাই ক্ষত্রিয়ের দেবত্ব, যজ্ঞই সাধুধর্ম, ভয় মানুষভাব, শরণাগতকে পরিত্যাগই অসাধুভাব।
য। পৃথিবী অপেক্ষা গুরুতর কে? আকাশ অপেক্ষা উচ্চতর কে? বায়ু অপেক্ষা শীঘ্ৰতর কে? তৃণ অপেক্ষা বহুতর কে?
যু। মাতা পৃথিবী অপেক্ষা গুরুতর, পিতা আকাশ অপেক্ষা উচ্চতর, মন বায়ু। অপেক্ষা শীঘ্রতর, চিন্তা তৃণ অপেক্ষা বহুতর।
য। সুপ্ত হয়েও কে চক্ষু মুদ্রিত করে না? জন্মগ্রহণ করেও কে স্পন্দিত হয়? কার হৃদয় নেই? বেগ দ্বারা কে বৃদ্ধি পায় ?
যু। মৎস্য নিদ্রাকালেও চক্ষু মুদ্রিত করে না, অণ্ড প্রসূত হয়েও স্পন্দিত হয় , পাষাণের হৃদয় নেই, নদী বেগ দ্বারা বৃদ্ধি পায়।
য। প্রবাসী, গৃহবাসী, আতুর ও মুমূর্য—এদের মিত্র কারা ?
যু। প্রবাসীর মিত্র সঙ্গী, গৃহবাসীর মিত্র ভাষা, আতুরের মিত্র চিকিৎসক, মুমূর্যুর মিত্র দান।
য। কি ত্যাগ করলে লোকপ্রিয় হওয়া যায়? কি ত্যাগ করলে শোক হয় না? কি ত্যাগ করলে মানুষ ধনী হয়? কি ত্যাগ করলে সুখী হয়?
যু। অভিমান ত্যাগ করলে লোকপ্রিয় হওয়া যায়, ক্রোধ ত্যাগ করলে শোক হয় না, কামনা ত্যাগ করলে লোকে ধনী হয়, লোভ ত্যাগ করলে সুখী হয়।
তার পর যক্ষ বললেন, বার্তা কি? আশ্চর্য কি? পন্থা কি? সুখী কে? আমার এই চার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জলপান কর। যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন,
অস্মিন্ মহামোহময়ে কটাহে
সূর্যাগ্নিনা রাত্রিদিনেন্ধনেন।
মাসর্তুদবী পরিঘট্টনেন।
ভূতানি কালঃ পচতীতি বার্তা।
-এই মহামোহরূপ কটাহে কাল প্রাণিসমূহকে পাক করছে, সূর্য তার অগ্নি, রাত্রিদিন তার ইন্ধন, মাস-ঋতু তার আলোড়নের দর্বী (হাতা); এই বার্তা।
অহনহনি ভূতানি গচ্ছন্তি যমমন্দির।
শেষাঃ স্থিরভৃমিচ্ছন্তি কিমাশ্চর্মতঃ পরম্৷৷
—প্রাণিগণ প্রত্যহ যমালয়ে যাচ্ছে, তথাপি অবশিষ্ট সকলে চিরজীবী হ’তে চায়, এর চেয়ে আশ্চর্য কি আছে?
বেদাঃ বিভিন্নাঃ স্মৃতয়ো বিভিন্ন
নাসৌ মুনির্যস্য মতং ন ভিন্ন।
ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং।
মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ ৷৷
-বেদ বিভিন্ন, স্মৃতি বিভিন্ন, এমন মুনি নেই যাঁর মত ভিন্ন নয়। ধর্মের তত্ত্ব গুহায় নিহিত, অতএবং মহাজন (২) যাতে গেছেন তাই পন্থা।
দিবসস্যাষ্টমে ভাগে শাকং পচতি যো নরঃ।।
অনৃণী চাপ্রবাসী চ স বারিচর মোদতে৷৷
-হে জলচর বক, যে লোক ঋণী ও প্রবাসী না হয়ে দিবসের অষ্টম ভাগে (সন্ধ্যাকালে) শাক রন্ধন করে সেই সুখী।
যক্ষ বললেন, তুমি আমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিয়েছ; এখন বল, পুরুষ কে? সর্বধনেশ্বর কে?
যুধিষ্ঠির উত্তর দিলেন,
দিবং স্মৃতি ভূমিঞ্চ শব্দঃ পুণ্যেন কর্মর্ণা।
যাবৎ স শব্দো ভবতি তাবৎ পুরুষ উচ্যতে ৷৷
তুল্যে প্রিয়াপ্রিয়ে যস্য সুখদুঃখে তথৈব চ।
অতীতানাগতে চোভে স বৈ সর্বধনেশ্বরঃ।
-পুণ্যকর্মের শব্দ (প্রশংসাবাদ) স্বর্গ ও পৃথিবী স্পর্শ করে; যত কাল সেই শব্দ থাকে তত কালই লোকে পুরুষরূপে গণ্য হয়। প্রিয়-অপ্রিয়, সুখ-দুঃখ, অতীত ও ভবিষ্যৎ যিনি তুল্য জ্ঞান করেন তিনিই সর্বধনেশ্বর।
যক্ষ বললেন, রাজা, তুমি এক ভ্রাতার নাম বল যাঁকে বাঁচাতে চাও। যুধিষ্ঠির বললেন, মহাবাহু নকুল জীবনলাভ করুন।
যক্ষ বললেন, ভীমসেন তোমার প্রিয় এবং অর্জুন তোমার অবলম্বন; এঁদের ছেড়ে দিয়ে, বৈমাত্র ভ্রাতা নকুলের জীবন চাচ্ছ কেন?
যুধিষ্ঠির বললেন, যদি আমি ধর্ম নষ্ট করি তবে ধর্মই আমাকে বিনষ্ট করবেন। যক্ষ, কুন্তী ও মাদ্রী দুজনেই আমার পিতার ভার্যা, এঁদের দুজনেরই পুত্র থাকুক এই আমার ইচ্ছা, আমি দুই মাতাকেই তুল্য জ্ঞান করি।
যক্ষ বললেন, ভরতশ্রেষ্ঠ, তুমি অর্থ ও কাম অপেক্ষা অনৃশংসতাই শ্রেষ্ঠ মনে কর, অতএব তোমার সকল ভ্রাতাই জীবনলাভ করুন।
ভীমাদি সকলেই গাত্রোত্থান করলেন, তাদের ক্ষুৎপিপাসা দূর হল। যুধিষ্ঠির যক্ষকে বললেন, আপনি অপরাজিত হয়ে এই সরোবরের তীরে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন, আপনি কোন্ দেবতা? আমার এই মহাবীর ভ্রাতাদের নিপাতিত করতে পারেন এমন যোদ্ধা আমি দেখি না। এঁরা সুখে অক্ষতদেহে জাগরিত হয়েছেন। বোধ হয় আপনি আমাদের সুহৃৎ বা পিতা।
যক্ষ বললেন, বৎস, আমি তোমার জনক ধর্ম। তুমি বর চাও। যুধিষ্ঠির বললেন, যার অরণি ও মন্থ হরিণ নিয়ে গেছে সেই ব্রাহ্মণের অগ্নিহোত্র যেন লুপ্ত না হয়। ধর্ম বললেন, তোমাকে পরীক্ষা করবার জন্য আমিই মৃগরূপে অরণি ও মন্থ হরণ করেছিলাম, এখন তা ফিরিয়ে দিচ্ছি। তুমি অন্য বর চাও। যুধিষ্ঠির বললেন, আমাদের দ্বাদশ বৎসর বনে অতিবাহিত হয়েছে, এখৰ্ম ত্রয়োদশ বৎসর উপস্থিত। আমরা যেখানেই থাকি, কোনও লোক যেন আমাদের চিনতে না পারে। ধর্ম বললেন, তাই হবে, তোমার নিজ রূপে বিচরণ করলেও কেউ চিনতে পারবে না। তোমরা ত্রয়োদশ বৎসর বিরাট রাজার নগরে অজ্ঞাত হয়ে থেকো, তোমরা যেমন ইচ্ছা সেইপ্রকার রূপ ধারণ করতে পারবে।
তার পর পাণ্ডবগণ আশ্রমে ফিরে গিয়ে ব্রাহ্মণকে অরণি ও মন্থ দিলেন।
**
(১) এক খণ্ড কাঠের উপর আর একটি দণ্ডাকার কাঠ মন্থন করে আগুন জ্বালা হত। নীচের কাঠ অরণি, উপরের কাঠ মন্থ।
(২) বিখ্যাত সাধুজন, অথবা বহুজন।
৫৮। ত্রয়োদশ বৎসরের আরম্ভ
পাণ্ডবগণ তাদের সহবাসী তপস্বিগণকে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, আপনারা জানেন যে ধৃতরাষ্ট্রের পুরো কপট উপায়ে আমাদের রাজ্য হরণ করেছে, বহু দুঃখও দিয়েছে। আমার দ্বাদশ বৎসর বনবাসে কষ্টে যাপন কুরেছি, এখন শেষ ত্রয়োদশ বৎসর উপস্থিত হয়েছে। আপনারা অনুমতি দিন, আমার এখন অজ্ঞাতবাস করব। দুরাত্মা দুর্যোধন কর্ণ আর শকুনি যদি আমাদের সন্ধান পায় তবে বিষম অনিষ্ট করবে।
যুধিষ্ঠির বললেন, এমন দিন কি হবে যখন আমরা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে আবার নিজ দেশে নিজ রাজ্যে বাস করতে পারব? অঞরুদ্ধকণ্ঠে এই কথা বলে তিনি মূৰ্ছিত হলেন। ধৌম্য প্রভৃতি ব্রাহ্মণগণ সান্ত্বনাবাক্যে যুধিষ্ঠিরকে প্রবোধিত করলেন। ভীম বললেন, মহারাজ, আপনার আদেশের প্রতীক্ষায় আমার এযাবৎ কোনও দুঃসাহসের কর্ম করি নি। আপনি যে কর্মে আমাদের নিযুক্ত করবেন আমরা তা কখনও পরিত্যাগ করব না। আপনি আদেশ দিলেই আমরা অবিলম্বে শত্ৰুজয় করব।
আশ্রমস্থ ব্রাহ্মণগণ এবং বেদবিৎ যতি ও মুনিগণ যথাবিধি আশীর্বাদ করে পুনর্বার দর্শনের অভিলাষ জানিয়ে চ’লে গেলেন। তার পর পঞ্চপাণ্ডব ধনুর্বাণহস্তে দ্রৌপদী ও পুরোহিত ধৌম্যের সঙ্গে যাত্রা করলেন এবং এক ক্রোশ দূরবর্তী এক স্থানে এসে অজ্ঞাতবাসের মন্ত্রণার জন্য উপবিষ্ট হলেন।