সারানুবাদ—রাজশেখর বসু
ভূমিকা, বিষয়সূচী, অষ্টাদশ পর্ব এবং গ্রন্থে
বহু উক্ত ব্যক্তি স্থান ও অস্ত্রাদির বিবরণ
সংবলিত পরিশিষ্ট
প্রথম প্রকাশ: ১৩৬৭
.
আর্যসমাজে যত কিছু জনশ্রুতি ছড়াইয়া পড়িয়াছিল তাহাদিগকে তিনি (ব্যাস) এক করিলেন। জনশ্রুতি নহে, আর্যসমাজে প্রচলিত সমস্ত বিশ্বাস, তর্কবিতর্ক ও চারিত্রনীতিকেও তিনি এই সঙ্গে এক করিয়া একটি জাতির সমগ্রতার এক বিরাট মূর্তি এক জায়গায় খাড়া করিলেন। ইহার নাম দিলেন মহাভারত। … ইহা কোনও ব্যক্তি বিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।
রবীন্দ্রনাথ, ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা।’
মহাভারতের বর্ণিত ইতিহাস মানবসমাজের বিপ্লবের ইতিহাস। … হয়তো কোনও ক্ষুদ্র প্রাদেশিক ঘটনার স্মৃতিমাত্র অবলম্বন করিয়া মহাকবি আপনার চিত্তবৃত্তির সমাধিকালে মানবসমাজের মহাবিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন; এবং সেই স্বপ্নদৃষ্ট ধ্যানলন্ধ মহাবিপ্লবের, – ধর্মের সহিত অধর্মের মহাসমরের চিত্র ভবিষ্যৎ যুগের লোকশিক্ষার জন্য অঙ্কিত করিয়া গিয়াছেন।
রামেন্দ্রসুন্দর, ‘মহাকাব্যের লক্ষণ।’
.
ভূমিকা
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের মহাভারত প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের বৃহত্তম গ্রন্থ এবং জগদবিখ্যাত গ্রন্থসমূহের অন্যতম। প্রচুর আগ্রহ থাকলেও এই বিশাল গ্রন্থ বা তার অনুবাদ আগাগোড়া পড়া সাধারণ লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য। যাঁরা অনুসন্ধিৎসু তাঁদের দৃষ্টিতে সমগ্র মহাভারতই পুরাবৃত্ত ঐতিহ্য ও প্রাচীন সংস্কৃতির অমূল্য তাণ্ডার, এর কোনও অংশই উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু সাধারণ পাঠক মহাভারতের আখ্যানভাগই প্রধানত পড়তে চান, আনুষঙ্গিক বহু সন্দর্ভ তাদের পক্ষে নীরস ও বাধাস্বরূপ।
এই পুস্তক ব্যাসকৃত মহাভারতের সারাংশের অনুবাদ। এতে মূল গ্রন্থের সমগ্র আখ্যান এবং প্রায় সমস্ত উপাখ্যান আছে, কেবল সাধারণ পাঠকের যা মনোরঞ্জক নয়, সেই সকল অংশ সংক্ষেপে দেওয়া হয়েছে, যেমন বিস্তারিত বংশতালিকা, যুদ্ধবিবরণের বাহুল্য, রাজনীতি ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ক প্রসঙ্গ, দেবতাদের স্তুতি এবং পুনরুক্ত বিষয়। স্থল বিশেষে নিতান্ত নীরস অংশ পরিত্যক্ত হয়েছে। এই সারানুবাদের উদ্দেশ্য-মূল রচনার ধারা ও বৈশিষ্ট্য যথাসম্ভব বজায় রেখে সমগ্র মহাভারতকে উপন্যাসের ন্যায় সুখপাঠ্য করা।
মহাভারতকে সংহিতা অর্থাৎ সংগ্রহ এবং পঞ্চম বেদ স্বরূপ ধর্মগ্রন্থ বলা হয়। যেসকল খণ্ড খণ্ড আখ্যান ও ঐতিহ্য পুরাকালে প্রচলিত ছিল তাই সংগ্রহ করে মহাভারত সংকলিত হয়েছে। এতে ভগবদগীতা প্রভৃতি যেসকল দার্শনিক সন্দর্ভ আছে তা অধ্যাত্মবিদ্যার্থীর অধ্যয়নের বিষয়। প্রত্নান্বেষীর কাছে মহাভারত অতি প্রাচীন সমাজ ও নীতি বিষয়ক তথ্যের অনন্ত ভাণ্ডার। ভূগোল জীবতত্ত্ব পরলোক প্রভৃতি সম্বন্ধে প্রাচীন ধারণা কি ছিল তাও এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়। প্রচুর কাব্যরস থাকলেও মহাভারতকে মহাকাব্য বলা হয় না, ইতিহাস নামেই এই গ্রন্থ প্রসিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – ‘ইহা কোনও ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নহে, ইহা একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।’
মহাভারতে সত্য ঘটনার বিবরণ কতটা আছে, কুরুপাণ্ডবযুদ্ধ মূলত কুরুপাঞ্চালযুদ্ধ কিনা, পাণ্ডু albino ছিলেন কিনা, কুন্তীর বহুদেবভজনা এবং একই কন্যার সহিত পঞ্চ পাণ্ডব ভ্রাতার বিবাহ কোনও বহুভর্তৃক (polyandrous) জাতির সুচনা করে কিনা, যুধিষ্ঠিরাদির পিতামহ কৃষ্ণদ্বৈপায়নই আদিম মহাভারতের রচয়িতা কিনা, ইত্যাদি আলোচনা এই ভূমিকার অধিকারবহির্ভূত। মহাভারতে আছে, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এই গ্রন্থের রচয়িতা; তিনি তাঁর পৌত্রের প্রপৌত্র জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞে উপস্থিত ছিলেন এবং নিজের শিষ্য বৈশম্পায়নকে মহাভারত পাঠের আদেশ দেন। শাস্ত্রবিশ্বাসী প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতগণের মতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কাল খ্রী-পূ ৩০০০ অব্দের কাছাকাছি, এবং তার কিছুকাল পরে মহাভারত রচিত হয়। ইওরোপীয় পণ্ডিতগণের মতে আদিগ্রন্থের রচনাকাল খ্রী-পূ চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দের মধ্যে, খ্রীষ্টজন্মের পরেও তাতে অনেক অংশ যোজিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে কুরুক্ষেত্রযুদ্ধের কাল খ্রী-পূ ১৫৩০ বা ১৪৩০, তিলক ও অধিকাংশ আধুনিক পণ্ডিতগণের মতে প্রায় ১৪00। কৃষ্ণ চরিত্র গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘যুদ্ধের অল্পকাল পরেই আদিম মহাভারত প্রণীত হইয়াছিল বলিয়া যে প্রসিদ্ধি আছে তাহার উচ্ছেদ করিবার কোনও কারণ দেখা যায় না।’ বর্তমান মহাভারতের সমস্তটা এক কালে রচিত না হলেও এবং তাতে বহ লোকের হাত থাকলেও সমগ্র রচনাই এখন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের নামে চলে।
মহাভারতকথা স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক ব্যাপারের বিচিত্র সংমিশ্রণ, পড়তে পড়তে মনে হয় আমরা এক অদ্ভুত স্বপ্নদৃষ্ট লোকে উপস্থিত হয়েছি। সেখানে দেবতা আর মানুষের মধ্যে অবাধে মেলামেশা চলে, ঋষিরা হাজার হাজার বৎসর তপস্যা করেন এবং মাঝে মাঝে অপ্সরার পাল্লায় পড়ে নাকাল হন; তাঁদের তুলনায় বাইবেলের মেথুসেলা অল্পায়ু শিশুমাত্র। যজ্ঞ করাই রাজাদের সব চেয়ে বড় কাজ। বিখ্যাত বীরগণ যেসকল অস্ত্র নিয়ে লড়েন তার কাছে আধুনিক অস্ত্র তুচ্ছ। লোকে কথায় কথায় শাপ দেয়, সে শাপ ইচ্ছা করলেও প্রত্যাহার করা যায় না। শ্রীপুরষ অসংকোচে তাদের কামনা ব্যক্ত করে। পুত্রের এতই প্রয়োজন যে ক্ষেত্রজ পুত্র পেলেও লোকে কৃতার্থ হয়। কিছুই অসম্ভব গণ্য হয় না; গরুড় গজকচ্ছপ খান, এখন সরোবর আছে যাতে অবগাহন করলে পুরুষ স্ত্রী হয়ে যায়; মনুষ্যজন্মের জন্য নারীগর্ভ অনাবশ্যক, মাছের পেট, শরের ঝোপ বা কলসীতেও জরায়ুর কাজ হয়।
সৌভাগ্যের বিষয়, অতিপ্রাচীন ইতিহাস ও রূপকথার সংযোগে উৎপন্ন এই পরিবেশে আমরা যে নরনারীর সাক্ষাৎ পাই তাদের দোষগুণ সুখদুঃখ আমাদেরই সমান। মহাভারতের যা মুখ্য অংশ, কুরুপাণ্ডবীয় আখ্যান, তার মনোহারিতা অপ্রাকৃত ব্যাপারের চাপে নষ্ট হয়নি। স্বাভাবিক মানবচরিত্রের ঘাতপ্রতিঘাত, নাটকীয় ঘটনাসংস্থান, সরলতা ও চক্রান্ত, করুণা ও নিষ্ঠুরতা, ক্ষমা ও প্রতিহিংসা, মহত্ত্ব ও নীচতা, নিষ্কাম কর্ম ও ভোগের আকাঙ্ক্ষা, সবই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। আজকাল যাকে মনস্তত্ত্ব বলা হয়, অর্থাৎ গল্পবর্ণিত নরনারীর আচরণের আকস্মিকতা এবং জটিল প্রণয়ব্যাপার, তারও অভাব নেই। অতিপ্রাচীন ব্যাস ঋষি যেকোনও অর্বাচীন গল্পকারকে এই বিদ্যায় পরাস্ত করতে পারেন।
জীবন্ত মানুষের চরিত্রে যত জটিলতা আর অসংগতি দেখা যায় গল্পবর্ণিত চরিত্রে ততটা দেখালে চলে না। নিপুণ রচয়িতা যখন বিরুদ্ধ গুণাবলীর সমাবেশ করেন তখন তাকে সাবধান হতে হয় যেন পাঠকের কাছে তা নিতান্ত অসম্ভব না ঠেকে। বাস্তব মানবচরিত্র যত বিপরীতধর্মী, কল্পিত মানবচরিত্র ততটা হতে পারে না, বেশী টানাটানি করলে রসভঙ্গ হয়, কারণ, পাঠকসাধারণের প্রত্যয়ের একটা সীমা আছে। প্রাচীন কথাকারগণ এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। মহাকাব্যের লেখকরা বরং অতিরিক্ত সরলতার দিকে গেছেন, তাঁদের অধিকাংশ নায়ক নায়িকা ছাঁচে ঢালা পালিশ করা প্রাণী, তাদের চরিত্রে কোথাও খোঁচ বা আঁচড় নেই। রঘুবংশের দিলীপ রঘু অজ প্রভৃতি একই আদর্শে কল্পিত। মহাভারত অতি প্রাচীন গ্রন্থ, কিন্তু এতে বহু চরিত্রের যে বৈচিত্র্য দেখা যায় পরবর্তী ভারতীয় সাহিত্যে দুর্লভ। অবশ্য এ কথা বলা যায় না যে মহাভারতে গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেক চরিত্রের বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন আছে। মহাভারত সংহিতা গ্রন্থ, এতে বহ রচয়িতার হাত আছে এবং একই ঘটনার বিভিন্ন কিংবদন্তী গ্রথিত হয়েছে। মূল আখ্যান সম্ভবত একজনেরই রচনা, কিন্তু পরে বহু
লেখক তাতে যোগ করেছেন। এমন আশা করা যায় না যে তাঁরা প্রত্যেকে সতর্ক হয়ে একটি পূর্বনির্ধারিত বিরাট পরিকল্পনার বিভিন্ন অংশ গড়বেন, মূল প্ল্যান থেকে কোথাও বিচ্যুত হবেন না। মহাভারত তাজমহল নয়, বারোয়ারী উপন্যাসও নয়।
সকল দেশেই কুম্ভীলক বা plagiarist আছেন যাঁরা পরের রচনা চুরি করে নিজের নামে চালান। কিন্তু ভারতবর্ষে কুম্ভীলকের বিপরীতই বেশী দেখা যায়। এঁরা কবিযশঃপ্রার্থী নন, বিখ্যাত প্রাচীন গ্রন্থের মধ্যে নিজের রচনা গুঁজে দিয়েই কৃতার্থ হন। এইপ্রকার বহু রচয়িতা ব্যাসের সহিত একাত্ম হবার ইচ্ছায় মহাভারতসমুদ্রে তাদের ভাল মন্দ অর্ঘ্য প্রক্ষেপ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র যাকে মহাভারতের বিভিন্ন স্তর বলেছেন তা এইরূপে উৎপন্ন হয়েছে। কেউ কেউ কৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব পাকা করবার জন্য স্থানে অস্থানে তাঁকে দিয়ে অনর্থক অলৌকিক লীলা দেখিয়েছেন, কিংবা কুটিল বা বালকোচিত অপকর্ম করিয়েছেন। কেউ সুবিধা পেলেই মহাদেবের মহিমা কীর্তন করে তাঁকে কৃষ্ণের উপরে স্থান দিয়েছেন; কেউ বা গো-ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য, ব্রত-উপবাসাদির ফল বা স্ত্রীজাতির কুৎসা প্রচার করেছেন, কেউ বা আষাঢ়ে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র উত্ত্যক্ত হয়ে ‘কৃষ্ণচরিত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘এ ছাই ভস্ম মাথামুণ্ডের সমালোচনা বিড়ম্বনা মাত্র। তবে এ হতভাগ্য দেশের লোকের বিশ্বাস যে যাহা কিছু, পুঁথির ভিতর পাওয়া যায় তাহাই ঋষিবাক্য, অভ্রান্ত, শিরোধার্য। কাজেই এ বিড়ম্বনা আমাকে স্বীকার করিতে হইয়াছে।’
বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত্রের জন্য তথ্য খুঁজছিলেন তাই তাঁকে বিড়ম্বনা স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু যিনি কথাগ্রন্থ হিসাবেই মহাভারত পড়বেন তাঁর ধৈর্যচ্যুতি হবার কারণ নেই। তিনি প্রথমেই মেনে নেবেন যে এই গ্রন্থে বহু লোকের হাত আছে, তার ফলে উত্তম মধ্যম ও অধম রচনা মিশে গেছে, এবং সবই একসঙ্গে পড়তে হবে। কিন্তু জঞ্জাল যতই থাকুক, মহাভারতের মহত্ব উপলদ্ধি করতে কোনও বাধা হয় না। সহৃদয় পাঠক এই জগদবিখ্যাত প্রাচীন গ্রন্থেরর আখ্যানভাগ সমস্তই সাগ্রহে পড়তে পারবেন। তিনি এর শ্রেষ্ঠ প্রসঙ্গসমূহ মুগ্ধচিত্তে উপভোগ করবেন এবং কুরুচিত বা উৎকট যা পাবেন তা সকৌতুকে উপেক্ষা করবেন।
মহাভারতে যে ঘটনাগত অসংগতি দেখা যায় , তার কারণ – বিভিন্ন কিংবদন্তীর যোজনা। চরিত্রগত অসংগতির একটি কারণ – বহু রচয়িতার হস্তক্ষেপ, অন্য কারণ – প্রাচীন ও আধুনিক আদর্শের পার্থক্য। সেকালের আদর্শ এবং ন্যায়-অন্যায়ের বিচারপদ্ধতি সকল ক্ষেত্রে একালের সমান বা আমাদের বোধগম্য হ’তে পারে না। মহামতি দ্রোণাচার্য একলব্যকে তার আঙুল কেটে দক্ষিণা দিতে বললেন, অর্জুনও তাতে খুশী। জতুগৃহ থেকে পালাবার সময় পাণ্ডবরা বিনা দ্বিধায় এক নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রকে পুড়ে মরতে দিলেন। দুঃশাসন যখন চুল ধরে দ্রৌপদীকে দ্যূতসভায় টেনে নিয়ে এল তখন দ্রৌপদী আকুল হয়ে বললেন, ‘ভীষ্ম দ্রোণ বিদুর আর রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কি প্রাণ নেই? কুরুবৃদ্ধগণ এই দারুণ অধর্মাচার কি দেখতে পাচ্ছেন না?’ দ্রৌপদী বহুবার প্রশ্ন করলেন, “আমি ধর্মানুসারে বিজিত হয়েছি কিনা আপনারা বলুন।’ ভীষ্ম বললেন, ‘ধর্মের তত্ত্ব অতি সূক্ষ্ম, আমি তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারছি না।’ বীরশ্রেষ্ঠ শিভালরাস কর্ণ অম্ললানবদনে দুঃশাসনকে বললেন, ‘পাণ্ডবদের আর দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কর।’ মহাপ্রাজ্ঞ ভীষ্ম আর মহাতেজস্বী দ্রোণ চুপ করে বসে ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব ভাবতে লাগলেন। ভীষ্ম-দ্রোণ দুর্যোধনাদির অন্নদাস এবং কৌরবদের হিতসাধনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কিন্তু দুর্যোধনের উৎকট দুষ্কর্ম সইতেও কি তারা বাধ্য ছিলেন? তাঁদের কি স্বতন্ত্র হয়ে কিংবা যুদ্ধে কোনও পক্ষে যোগ না দিয়ে থাকবার উপায় ছিল না? এ প্রশ্নের আমরা বিশদ উত্তর পাই না। যুদ্ধারম্ভের পূর্বক্ষণে যখন যুধিষ্ঠির ভীষ্মের পদস্পর্শ করে আশীর্বাদ ভিক্ষা করলেন তখন ভীষ্ম এই বলে আত্মগ্লানি জানালেন – ‘কৌরবগণ অর্থ দিয়ে আমাকে বেঁধে রেখেছে, তাই ক্লীবের ন্যায় তোমাকে বলছি, আমি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে পারি না।’ দ্রোণ ও কৃপও অনুরূপ বাক্য বলেছেন। এঁদের মর্যাদাবুদ্ধি বা code of honour আমাদের পক্ষে বোঝা কঠিন। এরা পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাত গোপন করেন না, অথচ যুদ্ধকালে পাণ্ডবদের বহু নিকট আত্মীয় ও বন্ধুকে অসংকোচে বধ করেছেন।
ভাগ্যক্রমে মহাভারতে চরিত্রগত অসংগতি খুব বেশী নেই। অধিকাংশ স্থলে মহাভারতীয় নরনারী স্বাভাবিক রূপেই চিত্রিত হয়েছে, তাদের আচরণ আমাদের অবোধ্য নয়। যেটুকু জটিলতা পাওয়া যায় তাতে আমাদের আগ্রহ ও কৌতুহল বেড়ে ওঠে, আমরা যেন জীবন্ত মানুষকে চোখের সামনে দেখতে পাই। মূল আখ্যানের ব্যাস শান্তনু, ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী কুন্তী বিদুর দ্রোণ অশ্বথামা পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদী দুর্যোধন কর্ণ শকুনি কৃষ্ণ সত্যভামা বলরাম শিশুপাল শল্য অম্বা-শিখণ্ডী প্রভৃতি, এবং উপাখ্যানবর্ণিত কচ দেবযানী শর্মিষ্ঠা বিদুলা নল দময়ন্তী ঋষ্যশৃঙ্গ সাবিত্রী প্রভৃতি, প্রত্যেকেরই বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে কেবল কয়েকজনের সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করছি।-
কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস বিচিত্রবীর্যের বৈপিত্র ভ্রাতা, তাকে আমরা শান্তনু, থেকে আরম্ভ করে জনমেজয় পর্যন্ত সাতপুরুষের সমকালবর্তী রূপে দেখতে পাই। ইনি মহাজ্ঞানী সিদ্ধপুরুষ, কিন্তু সুপুরুষ মোটেই নন। শাশুড়ী সত্যবতীর অনুরোধে অম্বিকা ও অম্বালিকা অত্যন্ত বিতৃষ্ণায় ব্যাসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন; অম্বিকা চোখ বুজে ভীষ্মাদিকে ভেবেছিলেন, অম্বালিকা ভয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। ব্যাস ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু-বিদুরের জন্মদাতা, কিন্তু প্রাচীন রীতি অনুসারে অপরের ক্ষেত্রে উৎপাদিত এই সন্তানদের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। উদাসীন হলেও তিনি কুরুপাণ্ডবের হিতকামী, deus ex machina র ন্যায় মাঝে মাঝে আবির্ভূত হয়ে সংকটমোচন এবং সমস্যার সমাধান করেন।
ভীষ্মচরিত্রের মহত্ত্ব আমাদের অভিভূত করে। তিনি দ্যূতসভায় দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন নি – এ আমরা ভুলতে পারি না; কিন্তু অনুমান করতে পারি যে তৎকালে তাঁর নিশ্চেষ্টতা, যুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষে যোগদান, এবং পরিশেষে পাণ্ডবদের হিতার্থে মত্যুবরণ – এই সমস্তের কারণ তার প্রাচীন আদর্শ অনুযায়ী কর্তব্যবুদ্ধি। তিনি তাঁর কামুক পিতার জন্য কুরুরাজ্যের উত্তরাধিকার ত্যাগ করলেন, চিরকুমারব্রত নিয়ে দুই অপদার্থ বৈমাত্র ভ্রাতা চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্যের অভিভাবক হলেন, এবং আজীবন নিষ্কামভাবে ভ্রাতার বংশধরদের সেবা করলেন। তার পিতৃভক্তিতে আমরা চমৎকৃত হই, কিন্তু আমাদের খেদ থাকে যে অনুপযুক্ত কারণে তিনি এই অসাধারণ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। ভীষ্ম তাঁর ভ্রাতার জন্য ক্ষত্রিয় রীতি অনুসারে কাশীরাজের তিন কন্যাকে স্বয়ংবরসভা থেকে হরণ করেছিলেন, কিন্তু জ্যেষ্ঠা অম্বা শাল্বরাজের অনুরাগিণী জেনে তাঁকে সসম্মানে শাল্বের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। অভাগিনী অম্বা সেখানে প্রত্যাখ্যাত হয়ে সংকল্প করলেন যে ভীষ্মের বধসাধন করবেন। অবার এই ভীষণ আক্রোশের উপযুক্ত কারণ আমরা খুঁজে পাই না। উদযোগপর্বে আছে, পরশুরাম ভীষ্মকে বলেছিলেন, ‘তুমি একে গ্রহণ করে বংশরক্ষা কর।’ ভীষ্ম সম্মত হন নি। অম্বার মনে কি ভীষ্মের প্রতি প্রচ্ছন্ন অনুরাগ জন্মেছিল? ভীষ্ম-অম্বার প্রণয় কল্পনা করে বাংলায় একাধিক নাটক রচিত হয়েছে।
দ্রোণ দ্রুপদের বাল্যসখা, কিন্তু পরে অপমানিত হওয়ায় দ্রুপদের উপর তাঁর ক্রোধ হয়েছিল। কুরুপাণ্ডব রাজকুমারদের সাহায্যে দ্রুপদকে পরাস্ত করে দ্রোণ পাঞ্চালরাজ্যের কতক অংশ কেড়ে নিয়েছিলেন। তার পরে দ্রুপদের উপর তাঁর আর ক্রোধ ছিল না, কিন্তু দ্রুপদ প্রতিশোধের জন্য উদযোগী হলেন। উদারস্বভাব দ্রোণ তা জেনেও দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দ্রোণের হতেই দ্রুপদের মৃত্যু হল , ধৃষ্টদ্যুম্নও পিতৃহন্তার শিরচ্ছেদ করলেন। কৌরবপক্ষে থাকলেও দ্রোণ অর্জুনের প্রতি তাঁর পক্ষপাত গোপন করেন নি, এজন্য তাঁকে দুর্যোধনের বহু কটুবাক্য শুনতে হয়েছে।
ধৃতরাষ্ট্র অব্যবস্থিতচিত্ত, তাঁর নীচতা আছে উদারতাও আছে, দুর্যোধন তাকে সম্মোহিত করে রেখেছিলেন। দ্যূতসভায় বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন, ‘মহারাজ, দুর্যোধনের জয়ে আপনার খুব আনন্দ হচ্ছে, কিন্তু এ থেকেই যুদ্ধ আর লোকক্ষয় হবে। ধনের প্রতি আপনার আকর্ষণ আছে এবং তার জন্য আপনি মন্ত্রণা করেছেন তা আমি জানি।’ এই অস্থিরমতি হতভাগ্য অন্ধ বৃদ্ধের ধর্মবুদ্ধি মাঝে মাঝে জেগে ওঠে, তখন তিনি দুর্যোধনকে ধমক দেন। সংকটে পড়লে তিনি বিদুরের কাছে মন্ত্রণা চান, কিন্তু স্বার্থত্যাগ করতে হবে শুনলেই চ’টে ওঠেন। ধৃতরাষ্ট্রের আন্তরিক ইচ্ছা যুদ্ধ না হয় এবং দুর্যোধন যা অন্যায় উপায়ে দখল করেছেন তা বজায় থাকে। কৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদূত হয়ে হস্তিনাপুরে আসেন তখন ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে ঘুষ দিয়ে বশে আনবার ইচ্ছা করেছিলেন। দারুণ শোক পেয়ে শেষ দশায় তাঁর স্বভাব পরিবর্তিত হল , যুধিষ্ঠিরকে তিনি পুত্ৰতুল্য জ্ঞান করলেন। আশ্রমবাসিক পর্বে বনগমনের পূর্বে প্রজাদের নিকট বিদায় নেবার সময় ধৃতরাষ্ট্র যা বলেছেন তা সদাশয়তার পরিচায়ক।
গান্ধারী মনস্বিনী, তিনি পুত্রের দুর্বত্ততা ও স্বামীর দুর্বলতা দেখে শঙ্কিত হন, ভর্ৎসনাও করেন, কিন্তু প্রতিকার করতে পারেন না। শতপুত্রের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠিরের উপর তাঁর অতি স্বাভাবিক বিদ্বেষ হয়েছিল, কিন্তু তা দীর্ঘকাল রইল না। পরিশেষে তিনিও পাণ্ডবগণকে পুত্ৰতুল্য জ্ঞান করলেন।
কুন্তী দৃঢ়চরিত্ৰা তেজস্বিনী বীরনারী, দ্রৌপদীর যোগ্য শাশুড়ী। তিনি যখনই মনে করেছেন যে পুত্রেরা নিরুদ্যম হয়ে আছে তখনই অনতিতীক্ষ্ম বাক্যে তাঁদের উৎসাহিত করেছেন। উদযোগপর্বে কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, ‘পুত্র, তুমি মন্দমতি, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের ন্যায় কেবল শাস্ত্র আলোচনা করে তোমার বুদ্ধি বিকৃত হয়েছে, তুমি কেবল ধর্মেরই চিন্তা করেছ।’
যুধিষ্ঠির অর্জুনের তুল্য কীর্তিমান নন, কিন্তু তিনিই মহাভারতের নায়ক ও কেন্দ্রস্থ পুরুষ। তাঁকে নির্বোধ বললে অবিচার হবে, কিন্তু দ্যূতপ্রিয়তা উদারতা ও ধর্মভীরুতার জন্য সময়ে সময়ে তিনি কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সাধারণত তাঁর ক্রোধ অল্প সেজন্য প্রতিশোধের প্রবৃত্তি তীক্ষ্ম নয়; কিন্তু কদাচিৎ তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন, যেমন কর্ণপর্বে অর্জুনের উপর। তিনি বিশেষ যুদ্ধপটু নন, সেজন্য তাঁর ভ্রাতারা তাঁকে একটু আড়ালে রাখেন, তথাপি মাঝে মাঝে তিনি বীরত্ব দেখিয়েছেন। দ্রোণবধের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের প্ররোচনায় নিতান্ত অনিচ্ছায় তিনি মিথ্যা বলেছেন, কিন্তু সাধারণত পাপপুণ্যেরর সুক্ষ্ম বিচার না করে তিনি কোনও কাজ করেন না, এজন্য দ্রৌপদী আর ভীমের কাছে তাঁকে বহু ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে। যুধিষ্ঠিরের অহংবুদ্ধি বড় বেশী, তার ফলে কেবলই নিজেকে পাপী মনে করে মনস্তাপ ভোগ করেন। বার বার তাঁর মুখে বৈরাগ্যের কথা শুনে ব্যাসদেবও বিরক্ত হয়ে তাঁকে ভর্ৎসনা করেছেন। যুধিষ্ঠির ভালমানুষ হলেও দৃঢ়চিত্ত, যা সংকল্প করেন তা থেকে টলেন না। অবস্থাবিশেষে তিনি realistও হতে পারেন। কপট উপায়ে দ্রোণবধের জন্য অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করেছিলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির বিশেষ অনুতপ্ত হন নি। অশ্বত্থামা যখন নারায়ণাস্ত্রে পাণ্ডবসৈন্য বধ করছিলেন তখন অর্জুনকে নিশ্চেষ্ট দেখে যুধিষ্ঠির দ্রোণের অন্যায় কার্যাবলীর উল্লেখ করে ব্যঙ্গ করে বললেন, “আমাদের সেই পরম সুহৎ নিহত হয়েছেন, অতএব আমরাও সবান্ধবে প্রাণত্যাগ করব।‘ ভীম নাভির নিম্নে গদাপ্রহার করে দুর্যোধনের উরুভঙ্গ করলেন দেখে বলরাম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ভর্ৎসনা করে চ’লে গেলেন। তখন যুধিষ্ঠির বিষণ্ণহয়ে কৃষ্ণকে বললেন, ‘ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আমাদের উপর বহু অত্যাচার করেছে, সেই দারুণ দুঃখ ভীমের হৃদয়ে রয়েছে, এই চিন্তা করে আমি ভীমের আচরণ উপেক্ষা করলাম।’ যুধিষ্ঠিরের মহত্ত্ব সব চেয়ে প্রকাশ পেয়েছে শেষ পর্বে। তিনি স্বর্গে এলে ইন্দ্র তাঁকে ছলক্রমে নরকদর্শন করতে পাঠালেন। যুধিষ্ঠির মনে করলেন তাঁর ভ্রাতারা ও দ্রৌপদী সেখানেই যন্ত্রণাভোগ করছেন। তখন তিনি স্বর্গের প্রলোভন ও দেবতাদের অনুরোধ পরম অবজ্ঞায় উপেক্ষা করে বললেন, ‘আমি ফিরে যাব না, এখানেই থাকব।’
ভীমকে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘রক্তপ রাক্ষস।’ যুধিষ্ঠিরের মুখে অশ্বত্থামার মিথ্যা মত্যুসংবাদ শুনে দ্রোণ যখন অবসন্ন হয়েছেন তখন ভীম নির্মম ভাষায় দ্রোণকে তিরস্কার করলেন। ভীম কর্তৃক দুঃশাসনের রক্তপানের বিবরণ ভীষণ ও বীভৎস। তথাপি সাধারণ লোকে এই স্থুলবুদ্ধি হঠকারী প্রতিহিংসাপরায়ণ নির্দয় লোকটিকে স্নেহ করে। ভীম তাঁর বৈমাত্র ভ্রাতা হনুমানের মত আরাধ্য হতে না পারলেও জনপ্রিয় হয়েছেন, কারণ তিনি উৎকট অপরাধের উৎকট শাস্তি দিতে পারেন। সেকালের যাত্রার ভীম, যিনি ‘দাদা আর গদা’ ভিন্ন কিছুই জানতেন না, যখন অয়েলক্লথের গদা নিয়ে আসরে নামতেন তখন আবালবৃদ্ধবনিতা উৎফুল্ল হত। ভীম চমৎকার কুযুক্তি দিতে পারেন। বনবাসে তের মাস যেতে না যেতে তিনি অধীর হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘কৃষক যেমন অল্পপরিমাণ বীজের পরিবর্তে বহু শস্য পায়, বুদ্ধিমান সেইরপ অল্প ধর্ম বিসর্জন দিয়ে বৃহৎ ধর্ম লাভ করেন। … সোমলতার প্রতিনিধি যেমন পূতিকা, সেইরূপ বৎসরের প্রতিনিধি মাস। আপনি তের মাসকেই তের বৎসর গণ্য করুন। যদি এই গণনা অন্যায় মনে করেন তবে একটা সাধুস্বভাব ষণ্ডকে প্রচুর আহার দিয়ে তৃপ্ত করুন, তাতেই পাপমুক্ত হবেন। ভীম মাংসলোভী পেটুক ছিলেন এবং তাঁর গোঁফদাড়ির অভাব ছিল; কর্ণ তাঁকে ঔদরিক আর তূবরক (মাকুন্দ) বলে খেপাতেন। শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠির বলেছেন, ভীম, অজ্ঞ লোকে উদরের জন্যই প্রাণিহিংসা করে, অতএব সেই উদরকে জয় কর, অল্পাহারে জঠরাগ্নি প্রশমিত কর।’ ধৃতরাষ্ট্ৰাদির অপরাধ ভীম কখনই ভুলতে পারেন নি, যুধিষ্ঠিরের আশ্রিত পুত্রহীন জ্যেষ্ঠতাতকে কিঞ্চিৎ অর্থ দিতেও তিনি আপত্তি করেছেন। তাঁর গঞ্জনা সইতে না পেরেই ধৃতরাষ্ট্র বনে যেতে বাধ্য হলেন।
অর্জুন সর্বগুণান্বিত এবং মহাভারতের বীরগণের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি কৃষ্ণের সখা ও মন্ত্রশিষ্য, প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকির অস্ত্রশিক্ষক, নানা বিদ্যায় বিশারদ এবং অতিশয় রূপবান। মহাকাব্যের নায়কোচিত সমস্ত লক্ষণ তাঁর আছে, এই কারণে এবং অত্যধিক প্রশস্তির ফলে তিনি কিঞ্চিৎ অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছেন। অর্জুন ধীরপ্রকৃতি, কিন্তু মাঝে মাঝে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। কর্ণপর্বে যুধিষ্ঠির তাকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, ‘তোমার গাণ্ডীব ধন, অন্যকে দাও।’ তাতে অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে কাটতে গেলেন, অবশেষে কৃষ্ণ তাকে শান্ত করলেন। কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধের পূর্বক্ষণে কৃষ্ণ অর্জুনকে যে গীতার উপদেশ শুনিয়েছিলেন তা পেয়ে জগতের লোক ধন্য হয়েছে। অর্জুনের ‘ক্ষুদ্র হদয়দৌর্বল্য’ দূর হয়েছিল, কিন্তু কোনও স্থায়ী উপকার হয়েছিল কিনা সন্দেহ। আশ্বমেধিকপর্বে অর্জুন কৃষ্ণের কাছে স্বীকার করেছেন যে বুদ্ধির দোষে তিনি পূর্বের উপদেশ ভুলে গেছেন।
নকুল-সহদেবের চরিত্রে অসামান্যতা বেশী কিছু পাওয়া যায় না। উদযোগপর্বে কৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদূত হয়ে হস্তিনাপুরে যাচ্ছিলেন তখন নকুল তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা কালোচিত মনে কর তাই করবে।’ কিন্তু সহদেব বললেন, ‘যাতে যুদ্ধ হয় তুমি তাই করবে, কৌরবরা শান্তি চাইলেও তুমি যুদ্ধ ঘটাবে।’ মহাপ্রস্থানিকপর্বে যুধিষ্ঠির বলেছেন, ‘সহদেব মনে করতেন তাঁর চেয়ে বিজ্ঞ কেউ নেই। … নকুল মনে করতেন তাঁর চেয়ে রূপবান কেউ নেই।’
মহাভারতে সকল পাণ্ডবেরই দ্রৌপদী ভিন্ন অন্য পত্নীর উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু ভীমের পত্নী হিড়িম্বা এবং অর্জনের পত্নী উলূপী চিত্রাঙ্গদা ও সুভদ্রা ছাড়া আর সকলের স্থান আখ্যানমধ্যে নগণ্য।
দ্রৌপদী সীতা-সাবিত্রীর শ্রেণীতে স্থান পান নি, তিনি নিত্যস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার একজন। দ্রৌপদী সব বিষয়ে অসামান্যা, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে অন্য কোনও নারী তাঁর তুল্য জীবন্ত রূপে চিত্রিত হননি। তিনি অতি রূপবতী, কিন্তু শ্যামাঙ্গী সেজন্য তাঁর নাম কৃষ্ণা। বার বৎসর বনবাস প্রায় শেষ হয়ে এলে সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ তাকে হরণ করতে আসেন। তখন বয়সের হিসাবে দ্রৌপদী যৌবনের শেষ প্রান্তে এসেছেন, তিনি পঞ্চ বীর পুত্রের জননী, তারা দ্বারকায় অস্ত্রশিক্ষা করছে। তথাপি জয়দ্রথ তাঁকে দেখে বলছেন, ‘একে পেলে আমার আর বিবাহের প্রয়োজন নেই, এই নারীকে দেখে মনে হচ্ছে অন্য নারীরা বানরী।’ দ্রৌপদী যখন বিরাটভবনে সৈরিন্ধ্রী রূপে এলেন তখন রাজমহিষী সুদেষ্ণা তাঁকে দেখে বললেন, ‘তোমার করতল পদতল ও ওষ্ঠ রক্তবর্ণ, তুমি হংসগদগদভাষিণী, সুকেশী, সুস্তনী, … কাশ্মীরী তুরঙ্গমীর ন্যায় সুদর্শনা। … রাজা যদি তোমার উপর লুব্ধ না হন তবে তোমাকে মাথায় করে রাখব। এই রাজভবনে যেসকল নারী আছে তারা একদৃষ্টিতে তোমাকে দেখছে, পুরো মোহিত হবে না কেন? … সুন্দরী, তোমার অলৌকিক রূপ দেখে বিরাট রাজা আমাকে ত্যাগ করে সর্বান্তঃকরণে তোমাতেই আসক্ত হবেন।’ এই আশাতেই সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে কীচকের কবলে ফেলতে সম্মত হয়েছিলেন। দ্রৌপদী অবলা নন, জয়দ্রথ ও কীচককে ধাককা দিয়ে ভূমিশায়ী করেছিলেন। তিনি অসহিষ্ণু, তেজস্বিনী স্পষ্টবাদিনী, তীক্ষ্ম বাক্যে নিষ্ক্রিয় পুরুষদের উত্তেজিত করতে পারেন। তাঁর বাগ্মিতার পরিচয় অনেক স্থানে পাওয়া যায়। বনপর্ব ৫-পরিচ্ছেদে, উদযোগপর্ব ১০-পরিচ্ছেদে, এবং শান্তিপর্ব ২-পরিচ্ছেদে দ্রৌপদীর খেদ ও ভর্ৎসনার যে নাটকীয় বিবরণ আছে তা সর্ব সাহিত্যে দুর্লভ। বহু কষ্ট ভোগ করে তার মন তিক্ত হয়ে গেছে, মঙ্গলময় বিধাতায় তাঁর আস্থা নেই। বনপর্ব ৭-পরিচ্ছেদে তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, ‘মহারাজ, বিধাতা প্রাণিগণকে মাতাপিতার দৃষ্টিতে দেখেন না, তিনি রুষ্ট ইতরজনের ন্যায় ব্যবহার করেন।’ দ্রৌপদী মাঝে মাঝে তার পঞ্চ স্বামীকে বাক্যবাণে পীড়িত করেন, স্বামীরা তা নির্বিবাদে সয়ে যান। তাঁরা দ্রৌপদীকে সম্মান ও সমাদর করেন। বিরাটপর্বে যুধিষ্ঠির বলেছেন, ‘আমাদের এই ভার্যা প্রাণাপেক্ষা প্রিয়া, মাতার ন্যায় পালনীয়া, জ্যেষ্ঠা ভগিনীর ন্যায় রক্ষণীয়া। দ্রৌপদী পাঁচ স্বামীকেই ভালবাসেন, কিন্তু তাঁর ভালবাসার কিছু প্রকারভেদ দেখা যায়। যুধিষ্ঠির তাঁকে অনেক জ্বালিয়েছেন, তথাপি দ্রৌপদী তাঁর জ্যেষ্ঠ স্বামীকে ভক্তি করেন, অনুকম্পা ও কিঞ্চিৎ অবজ্ঞাও করেন, ভালমানুষ অবুঝ একগুঁয়ে গুরুজনকে লোকে যেমন করে থাকে। বিপদের সময় দ্রৌপদী ভীমের উপরেই বেশী ভরসা রাখেন এবং শত কাজের জন্য তাঁকেই ফরমাশ করেন, তাতে ভীম কৃতার্থ হয়ে যান। নকুল-সহদেবকে তিনি দেবরের ন্যায় স্নেহ করেন। অর্জুন তাঁর প্রথম অনুরাগের পাত্র, পরেও বোধ হয় অর্জুনের উপরেই তাঁর প্রকৃত প্রেম ছিল। মহাপ্রস্থানিকপর্বে যুধিষ্ঠির বলেছেন, ‘ধনঞ্জয়ের উপর এঁর বিশেষ পক্ষপাত ছিল।’ বিদেশে অর্জুন কিছুকাল উলূপী ও চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন, দ্রৌপদী তা গ্রাহ্য করেন নি। কিন্তু অর্জুন যখন রূপবতী সুভদ্রাকে ঘরে আনলেন দ্রৌপদী অতি দুঃখে বললেন, ‘কৌন্তেয়, তুমি সুভদ্রার কাছেই যাও, পুনর্বার বন্ধন করলে পূর্বের বন্ধন শিথিল হয়ে যায়।’ দ্রৌপদীর একটি বৈশিষ্ট্য – কৃষ্ণের সহিত তার স্নিগ্ধ সম্বন্ধ। তিনি কৃষ্ণের সখী এবং সুভদ্রার ন্যায় স্নেহভাগিনী, সকল সংকটে কৃষ্ণই তাঁর শরণ্য ও স্মরণীয়।
দুর্যোধন মহাভারতের প্রতিনায়ক এবং পূর্ণ পাপী। তাঁর তুল্য রাজ্যলোভী বা প্রভুত্বলোভী ধর্মজ্ঞানহীন দুর্মুখ ক্রুর দুরাত্মা এখনও দেখা যায়, এই কারণে তাঁর চরিত্র আমাদের পরিচিত মনে হয়। তিনি আজীবন পাণ্ডবদের অনিষ্ট করেছেন, নিজেও ঈর্ষা ও বিদ্বেষে দগ্ধ হয়েছেন, তাঁর দুই মন্ত্রণাদাতা কর্ণ ও শকুনি তাতে ইন্ধন যুগিয়েছেন। দুর্যোধন নিয়তিবাদী। সভাপর্বে তিনি বিদুরকে বলেছেন, ‘যিনি গর্ভস্থ শিশুকে শাসন করেন তিনিই আমার শাসক; তাঁর প্রেরণায় আমি জলস্রোতের ন্যায় চালিত হচ্ছি।’ উদযোগপর্বে কণ্ব মুনি তাঁকে সদুপদেশ দিলে দুর্যোধন উরুতে চাপড় মেরে বললেন, ‘মহর্ষি, ঈশ্বর আমাকে যেমন সৃষ্টি করেছেন এবং ভবিষ্যতে আমার যা হবে আমি সেই ভাবেই চলছি, কেন প্রলাপ বকছেন?’ কিন্তু শয়তানকেও তার ন্যায্য পাওনা দিতে হয়। দুর্যোধনের অন্ধকারময় চরিত্রে আমরা একবার একটু স্নিগ্ধ আলোক দেখতে পাই। – দ্রোণবধের দিন প্রাতঃকালে সাত্যকিকে দেখে তিনি বলেছেন, ‘সখা, ক্রোধ লোভ ক্ষত্রিয়াচার ও পৌরুষকে ধিক – আমরা পরস্পরের প্রতি শরসন্ধান করছি! বাল্যকালে আমরা পরস্পরের প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় ছিলাম, এখন এই রণস্থলে সে সমস্তই জীর্ণ হয়ে গেছে। সাত্যকি, আমাদের সেই বাল্যকালের খেলা কোথায় গেল, এই যুদ্ধই বা কেন হল? যে ধনের লোভে আমরা যুদ্ধ করছি তা নিয়ে আমরা কি করব?’ আশ্রমবাসিকপর্বে প্রজাদের নিকট বিদায় নেবার সময় ধৃতরাষ্ট্র তাঁর মৃত পুত্রের সপক্ষে বলেছেন, ‘মন্দবুদ্ধি দুর্যোধন আপনাদের কাছে কোনও অপরাধ করেনি।’ প্রজাদের যিনি মুখপাত্র তিনিও স্বীকার করলেন, ‘রাজা দুর্যোধন আমাদের প্রতি কোনও দুর্ব্যবহার করেননি। যুধিষ্ঠির স্বর্গে গিয়ে দুর্যোধনকে দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। নারদ তাঁকে প্রবোধ দিয়ে বললেন, ‘ইনি ক্ষত্ৰধর্মানুসারে যুদ্ধে নিজ দেহ উৎসর্গ করে বীরলোক লাভ করেছেন, মহাভয় উপস্থিত হলেও ইনি কখনও ভীত হন নি। আসল কথা, দুর্যোধন লৌকিক ফরমুলা অনুসারে স্বর্গে গেছেন। যুদ্ধে মরলে স্বর্গ, অশ্বমেধে স্বর্গ, গঙ্গাস্নানে স্বর্গ; আজীবন কে কি করেছে তা ধর্তব্য নয়।
বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, ‘কর্ণচরিত্র অতি মহৎ ও মনোহর।’ তিনি কর্ণের গুণাগুণের জমাখরচ কষে সদগুণাবলীর মোটা রকম উদবৃত্ত পেয়েছিলেন কিনা জানি না। আমরা কর্ণচরিত্রে নীচতা ও মহত্ত্ব দুইই দেখতে পাই (নীচতাই বেশী), কিন্তু তার সমন্বয় করতে পারি না। বোধ হয় বহু রচয়িতার হাতে পড়ে কর্ণচরিত্রের এই বিপর্যয় হয়েছে। কর্ণপর্ব ১৮-পরিচ্ছেদে অর্জুনকে কৃষ্ণ বলেছেন, ‘জতুগৃহদাহ, দ্যুতক্ৰীড়া, এবং দুর্যোধন তোমাদের উপর যত উৎপীড়ন করেছেন সে সমস্তেরই মূল দুরাত্মা কর্ণ। ‘ কৃষ্ণ অত্যুক্তি করেন নি।
মহাভারতে সব চেয়ে রহস্যময় পুরুষ কৃষ্ণ। বহু হস্তক্ষেপের ফলে তাঁর চরিত্রেই বেশী অসংগতি ঘটেছে। মূল মহাভারতের রচয়িতা কৃষ্ণকে ঈশ্বর বললেও সম্ভবত তার আচরণে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার বেশী দেখান নি। সাধারণত তাঁর আচরণ গীতা ধর্ম ব্যাখ্যাতারই যোগ্য, তিনি বীতরাগভয়ক্রোধ স্থিতপ্রজ্ঞ লোকহিতে রত। কিন্তু মাঝে মাঝে তাঁর যে বিকার দেখা যায় তা ধর্মসংস্থাপক পুরুষোত্তমের পক্ষে নিতান্ত অশোভন, যেমন ঘটোৎকচবধের পর তাঁর উদ্দাম নৃত্য এবং দ্ৰোণবধের উদ্দেশ্যে যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যাভাষণের উপদেশ। বঙ্কিমচন্দ্র যা কিছু অপ্রিয় পেয়েছেন সবই প্রক্ষেপ বলে উড়িয়ে দিয়ে কৃষ্ণকে আদর্শনধর্মী ঈশ্বর বলে মেনেছেন। শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে ভীষ্ম বলেছেন, ‘এই মহাত্মা কেশব সেই পরম পুরুষের অষ্টমাংশ।’ মৃত্যুর পূর্বে তিনি কৃষ্ণকে বলেছেন, ‘তুমি সনাতন পরমাত্মা।’ অর্জুন কৃষ্ণকে ঈশ্বর জ্ঞান করলেও সব সময়ে তা মনে রাখতেন না। কষের বিশ্বরূপদর্শনে অভিভূত হয়ে অর্জুন বলেছেন, ‘তোমার মহিমা না জেনে প্রমাদবশে বা প্রণয়বশে তোমাকে কৃষ্ণ যাদব ও সখা বলে সম্বাোধন করেছি, বিহার ভোজন ও শয়ন কালে উপহাস করেছি, সে সমস্ত ক্ষমা কর।’ স্বামী প্রভবানন্দ ও ক্রিস্টফার ইশারউড তাঁদের গীতার মুখবন্ধে লিখেছেন, ‘Arjuna knows this yet, by a merciful ignorance, he sometimes forgets. Indeed, it is Krishna who makes him forget, since no ordinary man could bear the strain of constant companionship with God.’ মহাভারতপাঠে বোঝা যায় করে ঈশ্বরত্ব বহুবিদিত ছিল না। কৃষ্ণপুত্র শাম্ব দুর্যোধনের জামাতা; দুর্যোধন তাঁর বৈবাহিককে ঈশ্বর মনে করতেন না। উদযোগ পর্বে তিনি যখন পাণ্ডবদূত কৃষ্ণকে বন্দী করবার মতলব করছিলেন তখন কৃষ্ণ সভাস্থ সকলকে তাঁর বিশ্বরূপ দেখালেন, কিন্তু তাতেও দুর্যোধনের বিশ্বাস হল না। যুদ্ধের পূর্বে শকুনিপুত্র উলূককে তাঁর প্রতিনিধিরূপে পাণ্ডবশিবিরে পাঠাবার সময় দুর্যোধন তাঁকে শিখিয়ে দিলেন – ‘তুমি কৃষ্ণকে বলবে, … ইন্দ্রজাল মায়া কুহক বা বিভীষিকা দেখলে অস্ত্রধারী বীর ভয় পায় না, সিংহনাদ করে। আমরাও বহুপ্রকার মায়া দেখাতে পারি, কিন্তু তেমন উপায়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাই না। কৃষ্ণ, তুমি অকস্মাৎ যশস্বী হয়ে উঠেছ, কিন্তু আমরা জানি পুংশ্চিহ্ণধারী নপুংসক অনেক আছে। তুমি কংসের ভৃত্য ছিলে সেজন্য আমার তুল্য কোনও রাজা তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করেন নি।’ সর্বত্র ঈশ্বররূপে স্বীকৃত না হলেও কৃষ্ণ বহু সমাজে অশেষ শ্রদ্ধা ও প্রীতির আধার ছিলেন এবং রপ শৌর্য বিদ্যা ও প্রজ্ঞার জন্য পুরুষশ্রেষ্ঠ গণ্য হ’তেন। তিনি রাজা নন, যাদৰ অভিজাততন্ত্রের একজন প্রধান মাত্র, কিন্তু প্রতিপত্তিতে সর্বত্র শীর্ষস্থানীয়। তথাপি কৃষ্ণদ্বেষীর অভাব ছিল না। সভাপর্ব ৩-পরিচ্ছেদে উক্ত বঙ্গ-পুণ্ড্র-কিরাতের রাজা পৌণ্ড্রক কৃষ্ণের অনুকরণে শঙ্খ চক্র গদা ধারণ করতেন এবং প্রচার করতেন যে তিনিই আসল বাসুদেব ও পুরুষোত্তম।
অল্প বা অধিক যাই হক, মহাভারতের ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে তা সর্বস্বীকৃত। আখ্যানমধ্যে বহু বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় যার সত্যতায় সন্দেহের কারণ নেই। দ্রৌপদীর বহুপতিত্বের দোষ ঢাকবার জন্য গ্রন্থকারকে বিশেষ চেষ্টা করতে হয়েছে। তিনি যদি শুধু গল্পই লিখতেন তবে এই লোকাচারবিরুদ্ধ বিষয়ের অবতারণা করতেন না। তাঁকে সুপ্রতিষ্ঠিত জনশ্রুতি বা ইতিহাস মানতে হয়েছে তাই তিনি এই ঘটনাটি বাদ দিতে পারেন নি। আখ্যানের মধ্যে দ্রোণপত্নী কৃপীর উল্লেখ অতি অল্প, তথাপি প্রসঙ্গক্রমে তাকে অল্পকেশী বলা হয়েছে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন কৃষ্ণবর্ণ ছিলেন, তাঁর রূপ বেশ ও গন্ধ কুৎসিত ছিল, ভীম মাকুন্দ ছিলেন, মাহিষ্মতী পুরীর নারীরা স্বৈরিণী ছিল, মদ ও বাহীক দেশের স্ত্রীপুরুষ অত্যন্ত কদাচারী ছিল, যাদবগণ মাতাল ছিলেন, হিমালয়ের উত্তরে বালুকার্ণব ছিল, লোহিত্য (ব্রহ্মপুত্র নদ) এত বিশাল ছিল যে তাকে সাগর বলা হত, দ্বারকাপুরী সাগরকবলিত হয়েছিল – ইত্যাদি তুচ্ছ ও অতুচ্ছ অনেক বিষয় গ্রন্থমধ্যে বিকীর্ণ হয়ে আছে যা সত্য বলে মানতে বাধা হয় না।
মহাভারত পড়লে প্রাচীন সমাজ ও জীবনযাত্রার একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। ব্ৰাহ্মণক্ষত্রিয়াদি সকলেই প্রচুর মাংসাহার করতেন, ভদ্রসমাজেও সুরাপান চলত। গোমাংসভোজন ও গোমেধ যজ্ঞের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়, কিন্তু গ্ৰন্থরচনাকালে তা গর্হিত গণ্য হত। অস্পৃশ্যতা কম ছিল, দাসদাসীরাও অন্ন পরিবেশন করত। অনুশাসনপর্বে ভীষ্ম বলেছেন, ৩০ বা ২১ বৎসরের বর ১০ বা ৭ বৎসরের কন্যাকে বিবাহ করবে; কিন্তু পরে আবার বলেছেন, বয়স্য কন্যাকে বিবাহ করাই বিজ্ঞলোকের উচিত। মহাভারতে সর্বত্র যুবতীবিবাহই দেখা যায়। রাজাদের অনেক পত্নী এবং দাসী বা উপপত্নী থাকত, যাঁর এক ভার্যা তিনি মহাসুকৃতিশালী গণ্য হতেন। বর্ণসংকরদের ভয় ছিল, কিন্তু অনুশাসনপর্বে ভীষ্ম বহুপ্রকার বর্ণসংকরের উল্লেখ করে বলেছেন, তাদের সংখ্যার ইয়ত্তা নেই। অনেক বিধবা সহমৃত হতেন, আবার অনেকে পুত্রপৌত্রাদির সঙ্গে থাকতেন, যেমন সত্যবতী কুন্তী উত্তরা সুভদ্রা। নারীর মর্যাদার অভাব ছিল না, কিন্তু সময়ে সময়ে তাঁদেরও দানবিক্রয় এবং জুয়াখেলায় পণ রাখা হত। ভূমি ধনরত্ন বস্ত্র যানবাহন প্রভৃতির সঙ্গে রূপবতী দাসীও দান করার প্রথা ছিল। উৎসবে শোভাবৃদ্ধির জন্য বেশ্যার দল নিযুক্ত হত। ব্রাহ্মণেরা প্রচুর সম্মান পেতেন; তাঁরা সভায় তুমুল তর্ক করতেন বলে লোকে উপহাসও করত। দেবপ্রতিমার পূজা প্রচলিত ছিল। রাজাকে দেবতুল্য জ্ঞান করা হত, কিন্তু অনুশাসনপর্বে ১৩-পরিচ্ছেদে ভীষ্ম বলেছেন, যিনি প্রজারার আশ্বাস দিয়ে রক্ষা করেন না সেই রাজাকে ক্ষিপ্ত কুক্কুরের ন্যায় বিনষ্ট করা উচিত।’ অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান অতি বীভৎস ছিল। পুরাকালে নরবলি চলত, মহাভারতের কালে তা নিন্দিত হলেও লোপ পায় নি, জরাসন্ধ তার আয়োজন করেছিলেন।
যুদ্ধের বর্ণনা অতিরঞ্জিত হলেও আমরা তৎকালীন যুদ্ধরীতির কিছু কিছু আন্দাজ করতে পারি। ভীষ্মপর্ব ১-পরিচ্ছেদে কুরুক্ষেত্রের যে নিয়মবন্ধন বিবৃত হয়েছে তা আধুনিক সার্বজাতিক নিয়ম অপেক্ষা নিকৃষ্ট নয়। নিরস্ত্র বা বাহনচ্যুত শত্রুকে মারা অন্যায় গণ্য হত। নিয়মলঙ্ঘন করলে যোদ্ধা নিন্দাভাজন হতেন। স্বপক্ষ ও বিপক্ষের আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। সূর্যাস্তের পর অবহার বা যুদ্ধবিরাম ঘোষিত হত, কিন্তু সময়ে সময়ে রাত্রিকালেও যুদ্ধ চলত। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে যুদ্ধ হত, কিন্তু সৌপ্তিকপর্বে অশ্বথামা তার ব্যতিক্রম করেছেন। যুদ্ধভূমির নিকট বেশ্যাশিবির থাকত। বিখ্যাত যোদ্ধাদের রথে চার ঘোড়া জোতা হত। ধব্জদণ্ড রথের ভিতর থেকে উঠত, রথী আহত হলে ধব্জদণ্ড ধরে নিজেকে সামলাতেন। অর্জুন ও কর্ণের রথ শব্দহীন বলে বর্ণিত হয়েছে। দ্বৈরথ যুদ্ধের পূর্বে বাগযুদ্ধ হত, বিপক্ষের তেজ কমাবার জন্য দুই বীর পরস্পরকে গালি দিলে এবং নিজের গর্ব করতেন। বিখ্যাত রথীদের চতুর্দিকে রক্ষী যোদ্ধারা থাকতেন, পিছনে একাধিক শকটে রাশি রাশি শর ও অন্যান্য ক্ষেপণীয় অস্ত্র থাকত। বোধ হয় পদাতি সৈন্য ধনুর্বাণ নিয়ে যুদ্ধ করত না, তাদের বর্মও থাকত না; এই কারণেই রথারোহী বর্মধারী যোদ্ধা একাই বহু সৈন্য শরাঘাতে বধ করতে পারতেন।
আদিপর্ব ১-পরিছেদে মহাভারতকথক সৌতি বলেছেন, ‘কয়েকজন কবি এই ইতিহাস পূর্বে বলে গেছেন, এখন অপর কবিরা বলছেন, আবার ভবিষ্যতে অন্য কবিরা বলবেন।’ এই শেষোক্ত কবিরা মহাভারতের ত্রুটি শোধনের চেষ্টা করেছেন। মহাভারতের দুষ্মন্ত ইচ্ছা করে শকুন্তলার অপমান করেছেন, কিন্তু কালিদাসের দুষ্মন্ত শাপের বসে না জেনে করেছেন। মহাভারতের কচ দেবযানীকে প্রত্যভিশাপ দিয়েছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কচ পরম ক্ষমাশীল। কাশীরাম দাসের গ্রন্থে এবং বাংলা নাটকে চরিত্র সংশোধিত হয়েছে।
মহাভারতের আখ্যান ও উপাখ্যানগুলি দু-তিন হাজার বৎসর ধরে এদেশের জনসাধারণকে মনোরঞ্জনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মতত্ত্ব শিখিয়েছে এবং কাব্যনাটকের উপাদান যুগিয়েছে। মহাভারতের বহু শ্লোক প্রবাদরূপে সুপ্রচলিত হয়েছে। মহাভারতীয় নরনারীর চরিত্রে কোথায় কি অসংগতি বা ত্রুটি আছে লোকে তা গ্রাহ্য করে নি, কিন্তু মহৎ তাই আদর্শরূপে পেয়ে ধন্য হয়েছে। সেকাল আর একালের লোকাচারে অনেক প্রভেদ, তথাপি মহাভারতে কৃষ্ণ ভীষ্ম ও ঋষিগণ কর্তৃক ধর্মের যে মূল আদর্শ কথিত হয়েছে তা সর্বকালেই গ্রহণীয়।
দুঃখময় সংসারে মিলনান্ত আখ্যানই লোকপ্রিয় হবার কথা, কিন্তু এদেশের প্রাচীনতম এবং সর্বাধিকপ্রচলিত চিরায়ত-সাহিত্য বা ক্লাসিক রামায়ণ মহাভারত বিয়োগান্ত হল কেন? এই দুই গ্রন্থের স্পষ্ট উদ্দেশ্য – বিচিত্র ঘটনার বর্ণনা দ্বারা লোকের মনোরঞ্জন এবং কথাচ্ছলে ধর্মশিক্ষা; কিন্তু অন্য উদ্দেশ্যও আছে।
মানুষ চিরজীবী নয়, বাস্তব বা কাল্পনিক সকল জীবনবৃত্তান্তই বিয়োগান্ত। রামায়ণ রাম-রাবণ প্রভৃতির এবং মহাভারত ভরতবংশীয়গণের জীবনবৃত্তান্ত। এই গ্রন্থের রচয়িতারা নির্লিপ্ত সাক্ষীর ন্যায় অনাসক্তভাবে সুখদুঃখ মিলনবিরহ প্রভৃতি জীবনদ্বন্ধের বর্ণনা করেছেন। তাঁদের পরোক্ষ উদ্দেশ্য পাঠকের মনেও অনাসক্তি সঞ্চার করা। তাঁরা শ্মশানবৈরাগ্য প্রচার করেন নি, বিষয়ভোগও ছাড়তে বলেন নি, শুধু এই অলঙ্ঘনীয় জাগতিক নিয়ম শান্তচিত্তে মেনে নিতে বলেছেন –
সর্বে ক্ষয়ান্তা নিচয়াঃ পতনাপ্তঃ সমুচ্ছয়াঃ।
সংযোগা বিপ্রয়োগান্তা মরণান্তং চ জীবিতম্।। (স্ত্রীপর্ব)
– সকল সঞ্চয়ই পরিশেষে ক্ষয় পায়, উন্নতির অন্তে পতন হয়, মিলনের অন্তে বিচ্ছেদ হয়, জীবনের অন্তে মরণ হয়।
রাজশেখর বসু
১ আষাঢ় ১৩৫৬