তামাক ও বড় তামাক (১৩৫৬/১৯৪৯)
মানুষ ও জন্তুর মধ্যে প্রধান প্রভেদ এই যে, মানুষ নেশা করিতে শিখিয়াছে, জন্তু শেখে নাই। বিড়াল দুধ মাছ খায়, অভাবে পড়িলে হাঁড়ি খায়, ঔষধার্থে ঘাস খায়, কিন্তু তাকে তামাকের পাতা বা গাঁজার জটা চিবাইতে কেউ দেখে নাই। মানুষ অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করে, ঘর-সংসার পাতে, জীবন ধারণের জন্য যা-কিছু আবশ্যক সমস্তই সাধ্যমত সংগ্রহ করে, কিন্তু এতেই তার তৃপ্তি হয় না–সে একটু নেশাও চায়। অবশ্য গম্ভীর-প্রকৃতি হিসাবী লোকের কথা আলাদা। তাঁদের কাছে নেশা মাত্রই অনাবশ্যক; কারণ তাতে দেহের পুষ্টি হয় না, জ্ঞানেরও বৃদ্ধি হয় না, বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রে অপকারই হয়। তথাপি বহু লোক কোনও অজ্ঞাত অভাব মিটাইবার জন্য নেশার শরণাপন্ন হয়।
নেশা বহু প্রকার, যথা তামাক গাঁজা মদ সঙ্গীত কাব্য উপন্যাস প্রভৃতি। সকলগুলির চর্চার স্থান এই ক্ষুদ্র পত্রিকায় নাই, সুতরাং তামাক ও গাঁজা সম্বন্ধেই কিঞ্চিৎ আলোচনা করা যাক।
তামাক আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই তার নিন্দক জুটিয়াছে। তামাক খাইলে ক্ষুধা নষ্ট হয়, বুদ্ধি জড় হয়, হৃৎপিণ্ড দূষিত হয়, ইত্যাদি। কিন্তু কে গ্রাহ্য করে? জগতের আবাল-বৃদ্ধ তামাকের সেবক, বনিতারাও হইয়া উঠিতেছেন। তামাকের বিরুদ্ধে যেসব ভীষণ অভিযোগ শোনা যায়, তামাক-খোর তার খণ্ডনের কোন প্রয়াসই করে না, শুধু একটু হাসে ও নির্বিকারচিত্তে টানে। • কিন্তু তাদের অন্তরে যে জবাব অস্ফুট হইয়া আছে, আমরা তার কতকটা আন্দাজ করিতে পারি। মশায়, তামাক জিনিসটা স্বাস্থ্যের অনুকূল না হইতে পারে, কিন্তু স্বাস্থ্যই কি সব চেয়ে বড়? একটু না হয় ক্ষুধা কমিল, চেহারায় পাক ধরিল, হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করিল, কিন্তু আনন্দটা কি কিছুই নয়? মোটের উপর লাভটাই আমাদের বেশী। লোকসানের মাত্রা যদি বেশী হইত, তবে আপনিই আমরা ছাড়িয়া দিতাম, উপদেশের অপেক্ষা রাখিতাম না। আমাদের শরীর মন বেশ ভালই আছে, ভদ্র-সমাজে কেউ আমাদের অবজ্ঞা করে না। হাঁ, কোন কোন অর্বাচীনের তামাক খাইলে মাথা ঘোরে তা মানি; কিন্তু দু-এক জনের দুর্বলতার জন্য আমরা এত লোক কেন এই আনন্দ হইতে বঞ্চিত হইব?
এই সময় গঞ্জিকাসেবীর বাজখাই গলার আওয়াজ শোনা গেল–ভায়া, আমরাও আছি। আমাদের তরফেও কিছু বল।
তামাক-খোর ধমক দিয়ে বলেন–দূর হ লক্ষ্মীছাড়া গেঁজেল! তোদের সঙ্গে আমাদের তুলনা?
গাঁজা-খোর ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিলেন–সে কি দাদা? তোমাতে আমাতে তো কেবল মাত্রার তফাত। তুমি খাও তামাক, আমি খাই বড়-তামাক। তোমরা শৌখিন বড়লোক, তাই বিস্তর আড়ম্বর,-রুপোর ফরসি, জমিদারি সটকা, সোনার সিগারেট-কেস, কলের চকমকি। আমরা গরীব, তাই তুচ্ছ সরঞ্জামের বড়বড় নাম রাখিয়াই শখ মিটাই। গাঁজা কাটিবার ছুরিকে বলি রতন-কাটারি, কাঠের পিঁড়িকে বলি প্রেম-তক্তি, ধোঁয়া ছাঁকিবার ভিজা ন্যাতাকে বলি জামিয়ার, গাঁজা ডলিবার সময় মন্ত্র বলিবোম্ শঙ্কর কঙ্কড় কি ভোলা! আমাদের নেশার আয়োজনেই কত কাব্য-রস–তোমরা তো পরের প্রস্তুত জিনিস টানিয়াই খালাস। আর, আনন্দের কথা যদি ধর, তবে তোমরা বহু পশ্চাতে। ত্বরিতানন্দ জান? আমরা তাই উপভোগ করি। স্বাস্থ্য? তার জবাব তো তোমরা নিজেরাই দিয়াছ। আমরা স্বাস্থ্যের উপর একটু বেশী অত্যাচার করি বটে, কিন্তু আনন্দটি কেমন? না হয় গলাটা একটু কর্কশ হইল, চোখ একটু লাল হইল, চেহারাটা একটু চোয়াড়ে হইল, কিন্তু মোটের উপর শরীর মন ঠিকই আছে।
হিসাবী সমাজহিতৈষী দুই তরফের কথা শুনিয়া বলিলেন–তোমাদের বচসা মিটানো বড়ই শক্ত কাজ। আমি বলি কি–তোমরা দু দলই বদ অভ্যাস ত্যাগ কর। শরবত খাও, ভাল ভাল জিনিস খাও, যাতে গায়ে গত্তি লাগে, যথা লুচি-মণ্ডা। প্রকৃত আনন্দ তাতেই আছে।
তামাক-খোর বলিলেন–শরবত খুব স্নিগ্ধ, লুচি-মণ্ডাও খুব পুষ্টিকর, সুবিধা পাইলেই আমরা তা খাই। কিন্তু এ সব জিনিসে আত্মা তৃপ্ত হয় না, আড্ডা জমে না। কিঞ্চিৎ নেশার চর্চা না করিলে মানুষে মানুষে ভাবের বিনিময় অসম্ভব। তামাক অবশ্য চাই, এইটিই নিরীহ প্রকাশ্য নেশা, আর সব নেশা অপ্রকাশ্য।
গাঁজা-খোর বলিলেন–ঠিক কথা। নেশা চাই বইকি, কিন্তু গাঁজাই পরাকাষ্ঠা। তোমাদের পাঁচ জনের উৎসাহ পাইলেই আমরা ভদ্র-সমাজে চালাইয়া দিতে পারি।
সমাজহিতৈষী চিন্তিত হইয়া বলিলেন–তাই তো, বড় মুশকিলের কথা। দেখিতেছি তোমরা কেউ-ই ধোঁয়া না টানিলে বাঁচিবে না। আচ্ছা, অক্সিজেন খুঁকিলে চলে না?
তামাক-খোর গাঁজা-খোর অবজ্ঞার হাসি হাসিয়া সমস্বরে কহিলেন– আজ্ঞে, ওটা অন্তিম কালে, হরিনামের সঙ্গে সঙ্গে। আপাতত কিছু সাকার সুগন্ধি সুস্বাদ মনোহারী ধোঁয়ার ফরমাশ করুন।
হিতৈষী নাচার হইয়া বলিলেন–তবে ঐ তামাক অবধি বরাদ্দ রহিল। তার উপর আর উঠিও না, ঐখানেই গণ্ডি টানিলাম।
গাঁজা-খোর অট্টহাস্যে বলিলেন–খুব বুদ্ধি আপনার! নেশার তত্ত্ব আপনি কিছুই বোঝেন না। ঐ তামাকই তো একটু একটু করিয়া বেমালুম ভাবে গাঁজায় পরিণত হইয়াছে–তামাক-তামা-তাজা-গাঁজা। মৌচাকএর শিশু পাঠকরাও এই তত্ত্ব জানে। কোথায় গণ্ডি টানিবেন?
সমাজহিতৈষী মহাশয় হতাশ হইয়া বলিলেন–তবে মর তোমরা পীত্বা পীত্বা পুনঃ পীত্ব। দিন কতক যাক, তারপর বুঝিব কার পরমায়ু কত কাল।