বাংলা ছন্দের মাত্রা
আমি ছন্দোবিশারদ নই, কিন্তু আমার একটা চলনসই কর্ণেন্দ্রিয় আছে। যার দ্বারা বোধ হয় যে অমুক পদ্যের ছন্দটা ঠিক, অমুকটার বেঠিক। হয়তো কানের বা পাঠের বা অভিজ্ঞতার দোষে মাঝে মাঝে ঠিক ছন্দেও ত্রুটি ধরি, বেঠিক ছন্দেরও পতন বুঝতে পারি না। তথাপি নিজের কানের উপর নির্ভর করে যথাবুদ্ধি বাংলা ছন্দ বিশ্লেষের চেষ্টা করছি। অনেকে ছন্দের রহস্য না জেনেও ভাল পদ্য লিখতে পারেন, অনেক সাধারণ পাঠকও ছন্দ বজায় রেখে পড়তে পারেন। আমি সেই সহজ সংস্কারবশেই ছন্দোজিজ্ঞাসায় প্রবৃত্ত হয়েছি।
চিত্রশাস্ত্রকার বিধান দিতে পারেন যে মানুষের মাথার যে মাপ হবে তার সঙ্গে চোখ নাক ধড় হাত পা প্রভৃতির এই এই অনুপাত থাকবে। আরও অনেক নিয়ম তিনি বিজ্ঞানীর মতন সূত্রাকারে বেঁধে দিতে পারেন। ঐসমস্ত নিয়ম অনুসারে কেউ যদি ছবি আঁকে তবে তা শাস্ত্রসম্মত হবে, কিন্তু ভাল নাও হতে পারে। যে যে লক্ষণ থাকলে চিত্র উত্তম হয় তার সম্পূর্ণ নির্দেশ দেওয়া শাস্ত্রের সাধ্য নয়। শাস্ত্রকার কেবল স্থূল নিয়ম দিতে পারেন। ছন্দঃশাস্ত্রেও এই কথা খাটে। ছন্দের স্থূল নিয়মের আলোচনাই সুসাধ্য।
ছন্দ শব্দের ব্যাপক অর্থ করা যেতে পারে–পর্বে পর্বে বিভক্ত সুপাঠ্য সুশ্রাব্য শব্দধারা। ধারার বিভাগ অর্থাৎ মাঝে মাঝে বিরাম বা একান্বয়ভঙ্গ (break of monotony) চাই, আবার বিভাগগুলির সংগতি বা সামঞ্জস্য (harmony)ও চাই। কেন সুশ্রাব্য হয়, কিসে সংগতি হয়, তা বলা আমার সাধ্য নয়। যে সকল ছন্দ সুপ্রচলিত তাদের স্পষ্ট ও সাধারণ লক্ষণগুলিই বিচার করে দেখতে পারি। ছন্দের চরণসংখ্যা, পর্ববিভাগ, যতি এবং স্থানবিশেষে স্বরাঘাত বা জোর(stress)ও আমার আলোচ্য নয়। বিভিন্ন ছন্দঃশ্রেণীর যা কঙ্কালস্বরূপ, অর্থাৎ মাত্ৰাসংস্থান বা মাত্রাগণনার রীতি, কেবল তার সম্বন্ধেই লিখছি। মাঝে মাঝে সংস্কৃত রীতির উল্লেখ করতে হয়েছে, কারণ বাংলা ছন্দের প্রকৃতি আলাদা হলেও ক্ষেত্রবিশেষে সংস্কৃতের সঙ্গে তার সাদৃশ্য আছে।
প্রথমেই কয়েকটি শব্দের অর্থ নির্দিষ্ট করা দরকার, নয়তো বোঝবার ভুল হতে পারে।
হরফ ও অক্ষর
অক্ষর শব্দ সাধারণত দুই অর্থে চলে। প্রথম অর্থ হরফ, যেমন অ ক্ ক কু কে ঐ ৎ ং :। দ্বিতীয় অর্থsyllable। এই প্রবন্ধে প্রথম অর্থে অক্ষর লিখব না, হরফ লিখব। দ্বিতীয় অর্থেই অক্ষর লিখব। এক শ্রেণীর বাংলা ছন্দকে অক্ষরবৃত্ত বলা হয়, সেখানে অক্ষর মানে হরফ। অক্ষরবৃত্ত নামটি ভ্রান্তিজনক, কিন্তু বহুপ্রচলিত, সেজন্য বজায় রেখেছি।
অক্ষর বা syllable শব্দে বোঝায়–শব্দের নূন্যতম অংশ যার পৃথক্ উচ্চারণ হতে পারে। আগে বা পরে স্বরবর্ণ না থাকলে ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারণ করা যায় না, সেজন্য কেবল ব্যঞ্জনবর্ণে অক্ষর হতে পারে না। র ল শ ষ স স্বরযুক্ত না করেও উচ্চারণ করা যায় বটে, কিন্তু সাধারণ ভাষায় সেরকম প্রয়োগ নেই। প্রতি অক্ষরে থাকে–শুধুই একটি স্বর, অথবা একটিমাত্র স্বরের সঙ্গে এক বা একাধিক ব্যঞ্জন। অনুস্বার বিসর্গও ব্যঞ্জনস্থানীয়। অক্ষরের উদাহরণ–অ তু উৎ কন্ দ্বী প্রাং ন্তঃ। জল সংস্কৃতে ২ অক্ষরজ-ল, কিন্তু বাংলা উচ্চারণে জল হসন্ত সেজন্য ১ অক্ষর। জলছবি ৩ অক্ষরজল-ছ-বি, জলযোগ ৩ অক্ষরজ-ল-যোগ, জলকেলি ৪ অক্ষর–জ-ল-কে-লি। অন্তঃপাতী–অন্তঃ–পা-তী কিংবা অন্তঃ-পাতী। অধিষ্ঠাত্রী–অ-ধি-ঠাৎ-রী কিংবা অধিষ্ঠাত্রী।
একটিমাত্র স্বর থাকাই অক্ষরের সাধারণ লক্ষণ। শব্দে যতগুলি স্বর ততগুলি অক্ষর। কিন্তু বাংলায় কতকগুলি দ্বিস্বর অক্ষর চলে, যেমন এই, বউ, খাও। এইরকম জোড়াস্বর বা dipthong ঐ ঔ বর্ণের তুল্য এবং অক্ষরে এক স্বর রূপে গণনীয়। অথবা ধরা যেতে পারে যে দ্বিতীয় স্বরটি ব্যঞ্জনধর্মী, কারণ তার টান নেই।
মাত্রা, স্বরের হ্রস্বদীর্ঘ ভেদ, অক্ষরের লঘুগরু ভেদ
মাত্রার অর্থ–স্বরবর্ণের উচ্চারণকাল। ব্যঞ্জনবর্ণের মাত্রা নেই, ব্যঞ্জন যে স্বরকে আশ্রয় করে তারই মাত্রা আছে। ব্যঞ্জনের মাত্রা আছে মনে করলে অনর্থক বিভ্রাট হয়। সংস্কৃতে স্বরবর্ণের হ্রস্বদীর্ঘভেদ আছে, হ্রস্বস্বরের এক মাত্রা দীর্ঘস্বরের দুই মাত্রা। ছন্দে অক্ষরেরও ভেদ ধরা হয়। যে অক্ষরের অন্তর্গত স্বর হ্রস্ব তা লঘু, যার স্বর দীর্ঘ তা গুরু। সংস্কৃত ছন্দের নিয়মে হ্রস্ব স্বরও দীর্ঘতা পায়–যদি তার পরে অনুস্বর বা বিসর্গ থাকে অথবা হচিহ্নিত ব্যঞ্জন বা যুক্তব্যঞ্জন থাকে। তা ছাড়া দরকার হলে চরণের শেষের স্বরও দীর্ঘতা পায়–
সানুস্বারশ্চ দীর্ঘশ্চ বিসর্গী চ গুরুর্ভবেৎ।
বর্ণঃ সংযোগপূর্বশ্চ তথা পাদান্তগোপি বা৷
প্রথম ও তৃতীয় চরণের আদিতে যুক্তব্যঞ্জন থাকলে পূর্ববর্তী স্বরের উপর তার প্রভাব হয় না। বাংলায় হ্রস্বদীর্ঘ স্বরের স্বাভাবিক ভেদ নেই, কেবল স্থান বিশেষে ঐ ঔ দীর্ঘ হয়।
উক্ত সংস্কৃত নিয়ম অনুসারে এইসকল অক্ষরের অন্তর্গত স্বর হ্রস্ব, সেজন্য অক্ষরগুলি লঘু–অ চ কি তু নৃ প্র দ্বি ক্ষু। এইগুলি গুরু, কারণ অন্তর্গত স্বর দীর্ঘ–আ কা কী ভূ সে নৌ কিং নিঃ কিম্ পূর ন্যস্ ক্ষি। শিল্প শব্দের ই-কার দীর্ঘ, কারণ পরে যুক্তব্যঞ্জন আছে। . সংস্কৃত নিয়মে সূত আর সুপ্ত দুই এরই আদ্য স্বর দীর্ঘ–এবং অন্ত্য স্বর হ্রস্ব, সেজন্য আদ্য অক্ষর সূ, সু- গুরু এবং অন্ত্য অক্ষর–ত লঘু। কারু, দীন, শৌরি এবং সত্ত্ব, দুষ্ট, দীপ্তি, সৈন্য সবগুলিই ঐপ্রকার, একটির বদলে অন্য একটি বসালে দোষ হয় না। সূ- আর সু- অক্ষরের যে উ উ আছে তাদের উচ্চারণকাল বা মাত্রা সমান। কিন্তু সূ- আর সু- অক্ষরের ধ্বনির ওজনও কি সমান? সূ-এর উচ্চারণে টান আছে, সু-এ ঘাত বা ধাক্কা বা সহসা ধ্বনিরোধ আছে, দুটিই সমান হতে পারে না। উক্ত দুরকম অক্ষরের অনুষঙ্গী দুরকম দীর্ঘস্বরের পার্থক্যসূচক পরিভাষা আছে কিনা জানি না। কাজ চালাবার জন্য নাম দিচ্ছি–স্বতেদীর্ঘ, অর্থাৎ যে স্বর সংস্কৃতে স্বভাবত দীর্ঘ, যেমন সূতএর ঊ; পরতোদীর্ঘ, অর্থাৎ যে স্বর হ্রস্ব হলেও পরবর্তী যুক্তব্যঞ্জনাদির প্রভাবে দীর্ঘ হয়, যেমন সুপ্তএর উ। অক্ষরের ঐরকম ভেদসূচক নাম-স্বলতাগুরু, পরতোগুরু। সংস্কৃত ছন্দে এই ভেদ গ্রাহ্য হয় না–
রাগেণ বালারুণকোমলেন।
চুতপ্রবালোষ্ঠমলঞ্চকার।
প্রথম পঙক্তিতে যুক্তব্যঞ্জন নেই, দ্বিতীয়তে আছে, অথচ ছন্দ একই। বাংলা ছন্দের শ্রেণীভেদে পরতোগুরু অক্ষর মানা হয় কিন্তু ঐ ঔ ছাড়া স্বতোগুরু মানা হয় না, আবার কৃত্রিমগুরুও মানা হয়–সে কথা পরে বলব।
সংস্কৃত ছন্দে উক্ত ভেদের নিয়ম না থাকলেও নিপুণ কবি ধ্বনিবৈচিত্র্যের জুন্য স্বলতাগুরু বা পরতোগুরু অক্ষর নির্বাচন করে প্রয়োগ করেন। এই নির্বাচনের সূত্র কবির মাথাতেই থাকে, ছন্দঃশাস্ত্রে তা নেই।
অক্ষর ও মাত্রা সম্বন্ধে আর একটু বলবার আছে। কোনও শব্দের অক্ষরগুলি দুই রীতিতে পৃথক করে দেখানো যেতে পারে। প্রথম রীতি–শব্দের যুক্তব্যঞ্জন না ভাঙা, যেমন সু-প্ত, শ্রদ্ধা-বান্। কিন্তু এতে পরতোদীর্ঘতা প্রকাশ পায় না। সু- আর শ্র- এর স্বর পরতোদীর্ঘ, কিন্তু অক্ষরে তার লক্ষণ নেই। দ্বিতীয় রীতি–যথাসম্ভব যুক্তব্যঞ্জন বিশ্লেষ করা, যাতে স্বরের পরতোদীর্ঘতা (বা অক্ষরের পরতোগুরুতা) অক্ষর দেখলেই বোঝা যায়, যেমন সু-ত, শ্রদ্ধা-বান্। এই প্রবন্ধের উদাহরণে দ্বিতীয় রীতিই অনুসৃত হয়েছে। কিন্তু যে বাংলা ছন্দে যুক্তব্যঞ্জনের জন্য পূর্বস্বর দীর্ঘ হয় না সেখানে প্রথম রীতিতে অক্ষর ভাগ হয়েছে, যেমন জন্মেছিস।
সংস্কৃত ছন্দ
বাংলা ছন্দের আলোচনার আগে সংস্কৃত ছন্দের কিঞ্চিৎ পরিচয় আবশ্যক মনে করি, তাতে বাংলা ছন্দের সূত্রগঠন সহজ হবে। সংস্কৃত নিয়ম খুব বাঁধাধরা, পদ্যকারের স্বাধীনতা অল্প, সেজন্য নিয়মের সূত্র সরল। সংস্কৃতে দুই শ্রেণীর ছন্দ বেশী চলে–অক্ষরছন্দ বা বৃত্ত, এবং মাত্রাছন্দ বা জাতি।
অক্ষরছন্দের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা নিয়ত; মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাসও নিয়ত, অর্থাৎ ভেদে অক্ষর সাজাবার বাঁধা নিয়ম আছে। মিশ্র ছন্দও চলে, যেমন ইন্দ্ৰবজ্রা ও উপেন্দ্ৰবজ্রার মিশ্রণে উপজাতি ছন্দ। মন্দাক্রান্তা অমিশ্র ছন্দ, সব চরণ সমান। অক্ষর ভাগ করে তার উদাহরণ দিচ্ছি–
– ক-চিৎ কান্তা–বি-র-হ-গুরু-না স্বা-ধি-কা-র-র-মৎ-তঃ
শা-পে-না-তং-গ-মি-ত-ম-হি-মা বর্ষ-ভোগৃ-য়ে-ণ ভর-তুঃ।
প্রত্যেক চরণে অক্ষরসংখ্যা ১৭, মাত্ৰাসংখ্যা ২৭। উদাহরণের শব্দগুলির যথাক্ৰম অক্ষরবিন্যাস নীচে দেওয়া হল, লঘু অক্ষরের চিহ্ন ১, গুরু অক্ষরের ২–
২২ ২২১১১১১২ ২১২২১২২
২২২২১১১১১২ ২১২২১ ২২
মাত্রাচ্ছন্দের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা প্রায় অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত। যথা পজঝটিকা ছন্দে–
মূঢ় জহীহি ধনাগমতৃষ্ণাং ।
কুরু তনুবুদ্ধে মনসি বিতৃষ্ণা।
যল্লভসে নিজকর্মোপাত্তং
বিত্তং তেন বিনোদয় চিত্ত
যথাক্রমে চার চরণের অক্ষরসংখ্যা ১১, ১২, ১০, ১০। মাত্ৰাসংখ্যা প্রতি চরণে ১৬। অক্ষরবিন্যাস এইরকম–
২১ ১২১ ১২১১২২।
১১ ১১২২ ১১১ ১২২
২১১২ ১১২২২২
২২ ২১ ১২১১ ২২
সংস্কৃত পদ্যে চরণের শেষে মিল কম দেখা যায়। যা আছে তা প্রায় মাত্রাচ্ছন্দে, যেমন পজঝটিকায়, গীতগোবিন্দে, কজ্জলপূরিতলোচনভারে প্রভৃতি স্তোত্রে। কারণ বোধ হয় এই–অক্ষরচ্ছন্দে অক্ষরবিন্যাস ভেদে নিয়মিত, পর্যায়ক্রমে তার আবর্তন হয়। এমন ছন্দের মাধুর্য মিলের উপর নির্ভর করে না। মাত্রাচ্ছন্দে এই আবর্তনের অভাবে কিঞ্চিৎ আকাঙ্ক্ষা রয়ে যায়, তার পূরণের জন্যই মিলের চেষ্টা। অথবা এও হতে পারে যে চরণের মিল করতে গেলে অক্ষরচ্ছন্দের কড়া নিয়ম মানা শক্ত হয়, তাই পদ্যকার অপেক্ষাকৃত স্বাধীন মাত্রাচ্ছন্দের শরণ নেন।
বাংলা ছন্দ
বাংলা ছন্দের প্রচলিত শ্রেণী তিনটি। সাধারণত তাদের নাম দেওয়া হয়–অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। তা ছাড়া সংস্কৃত ছন্দের অনুকরণও কিছু চলে। বাংলায় স্বতেদীর্ঘ স্বর নেই, কিন্তু ছন্দের শ্রেণীবিশেষে ঐ ঔ দীর্ঘ হয় এবং পরতোদীর্ঘ ও কৃত্রিমদীর্ঘ স্বরও চলে।
বাংলা ছন্দের সাধারণ লক্ষণ–চরণের নিয়ত মাত্ৰাসংখ্যা, যেমন অধিকাংশ সংস্কৃত ছন্দে। অনেক আধুনিক ছন্দের চরণ অত্যন্ত অসমান, তথাপি তার জন্য সুশ্রাব্যতার হানি হয় না, বরং বৈচিত্র্য হয়। কিন্তু এইসব ছন্দের সূত্র-নিরূপণ অসম্ভব। শুধু বলা যেতে পারে যে অমুক পদ্যের শব্দগুলির মাত্রা অমুক শ্রেণীর রীতিতে ধরা হয়েছে। কিন্তু তাও আবার সর্বত্র স্থির করা যায় না।
অক্ষরবৃত্ত
অক্ষরবৃত্তের উদাহরণ সাধারণ পয়ার ত্রিপদী ইত্যাদি। এই শ্রেণীর ছন্দের প্রধান লক্ষণ–চরণের নিয়ত হরফ-সংখ্যা, যেমন পয়ারের প্রতি চরণে ১৪ হরফ। স্বরান্ত ব্যঞ্জন, হচিহ্নিত বা হসন্তবৎ উচ্চারিত ব্যঞ্জন, যুক্তব্যঞ্জন, অনেক স্থলে অনুস্বার পর্যন্ত নির্দিষ্ট সংখ্যার মধ্যে ধরা হয়, কেবল বিসর্গ ধরা হয় না। ঐ এক হরফ, কিন্তু ওই দু হরফ। সর্দার ৩ হরফ, কিন্তু দরকার হলে সরদার লিখে ৪ হরফ করা যায়। বান্দেবী আর বাগদেবী একই শব্দ, অথচ প্রথমটির ৩ হরফ দ্বিতীয়টির ৪ হরফ ধরা হয়। আসল কথা–হরফের হিসাব একটা কৃত্রিম চাক্ষুষ উপায়। ছন্দের ব্যঞ্জন মুখে, ধারণা কানে। মুখ আর কানের সাক্ষ্য নিয়েই সূত্রনির্ণয় করতে হবে।
পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল,
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল!
যদি প্রত্যেক হরফ স্বরান্ত করে পড়া হয় তবে বলা যেতে পারে–প্রতি চরণে ১৪ হরফ, ১৪ অক্ষর, ১৪ মাত্রা। কিন্তু যদি সহজ রীতিতে পড়া হয় তবে হসন্ত উচ্চারণের উপর নজর রেখে এইরকমে অক্ষর ভাগ করা যেতে পারে
পা-খি সব ক-রে রব রা-তি পো-হা-ই-ল,
কা-ন-নে কু-সুম-ক-লি স-ক-লি ফু-টি-ল।
প্রথম চরণে ১২ অক্ষর, দ্বিতীয়তে ১৩। হসন্ত উচ্চারণের জন্য সব, রব,–সুম এই ৩ অক্ষর পরতোগুরু হয়েছে, অন্য অক্ষরগুলি লঘু। দুই চরণেই ১৪ মাত্রা। কিন্তু অক্ষরবৃত্তের সূত্র এত সহজে পাওয়া যাবে না। সকল পদ্যই যুক্তাক্ষরবর্জিত শিশুপাঠ্য নয়।
বহু পরিচর্যা করি পে-য়ে-ছি-নু তো-রে,
জন্মেছিস ভর্তৃহী-না জ-রালার ক্রোড়ে।
এখানে জন্মেছিস আর জবালার এই দুই শব্দের উচ্চারণ হসন্ত, সেজন্য–ছিস ও লার এই দুই অক্ষর পরতোগুরু। কিন্তু যুক্তব্যঞ্জনের প্রভাবে পরিচর্যা, জন্মেছিস, ভর্তৃহীনা শব্দে পরতোগুরু অক্ষর উৎপন্ন হয় নি। প রি-চর্যা ৪টিই লঘু অক্ষর। চ-এর অ-কারকে চেপে হ্রস্ব করে রাখা হয়েছে, তার ফলে পরিচর্যার উচ্চারণকাল পেয়েছিনুর সমান। জন্মেছিস, ভর্তৃহীনাও এইরকম। উপরের উদাহরণে যথাক্রমে দুই চরণের হরফ-সংখ্যা ১৪, ১৪, অক্ষরসংখ্যা ১৪, ১২, মাত্ৰাসংখ্যা ১৪, ১৪।
অক্ষরবৃত্তের রীতি–হসৃচিহ্নিত বা হসন্তবৎ উচ্চারিত ব্যঞ্জন বা পূর্বোক্ত দ্বিস্বর থাকলে অক্ষর পরতোগুরু হয়, কিন্তু যুক্তব্যঞ্জন বা ঐ ঔ থাকলে হয় না। বিসর্গের জন্যও হয় না, দুঃখএর দুই অক্ষরই লঘু। শব্দের মধ্যে অনুস্বার থাকলে প্রায় হয় না, কিন্তু শেষে থাকলে হয়। সংখ্যার দুই অক্ষরই লঘু, কিন্তু সুতরাংএর প্রথম দুই অক্ষর লঘু, শেষ অক্ষর গুরু।
উক্ত রীতির বশে অক্ষরবৃত্তের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা নিয়ত, অক্ষরসংখ্যা অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত এবং সাধারণত হরফসংখ্যার সমান। অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত।
যুক্তব্যঞ্জনের জন্য অক্ষরের গুরুতা হয় না বটে, কিন্তু তার ঘাত বা ধাক্কা নিপুণ কবিরা উপেক্ষা করেন না, উপযুক্ত স্থলে প্রয়োগ করে বৈচিত্র্যসাধন করেন। পাঠকও বিশেষ বিশেষ স্বরে জোর দিয়ে ঘাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেন।
মাত্রাবৃত্ত
এই শ্রেণীর ছন্দে যুক্তব্যঞ্জন অবজ্ঞাত নয়, সেজন্য পরতোগুরু অক্ষর প্রচুর দেখা যায়। অনুস্বার, বিসর্গ, হচিহ্নিত বা হসন্তবৎ উচ্চারিত ব্যঞ্জন এবং যুক্তব্যঞ্জনের প্রভাবে অক্ষর পরতোগুরু হয়। যে অক্ষরে ঐ ঔ বা দ্বিস্বর আছে তাও গুরু। কিন্তু শব্দের আদিতে যুক্তব্যঞ্জন থাকলে তার প্রভাব পূর্ববর্তী শব্দের অন্ত্য স্বরে প্রায় হয় না।
মাত্রাবৃত্তের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত। যথা
পল্ল বঘন আম্র–কা-ন-ন রা-খা-লের খে-লা-গে-হ,
স্তব্ধ অতল দিঘি-কা-লো-জল নিশীথ-শীতল স্নেহ।
যথাক্রমে দুই চরণের হরফ-সংখ্যা ১৮, ১৯, অক্ষরসংখ্যা ১৭, ১৬, মাত্ৰাসংখ্যা ২০, ২০।
অনেকে বলেন–মাত্রাবৃত্তে যুক্তব্যঞ্জন ২ মাত্রা। তাতে হিসাব মিলতে পারে, কিন্তু উক্তিটি ভ্রমাত্মক। পল্লব শব্দের ল্ল ২ মাত্রা বললে বোঝায় ম্ল এর অ-কার ২ মাত্রা। কিন্তু তা সত্য নয়, প-এর অ-কারই ২ মাত্রা, কারণ পরে যুক্তব্যঞ্জন আছে। পল্লব এইরকমে অক্ষরভাগ করলে মাত্রাবিপর্যয় ঘটে না। অনুরূপ–উৎ-সা-হ, সংহ-ত, দুঃসহ।
বাংলা মাত্রাবৃত্তের সঙ্গে সংস্কৃত মাত্রাচ্ছন্দের সাদৃশ্য আছে। প্রভেদ এই–বাংলায় ঐ ঔ ছাড়া স্বতদীর্ঘ স্বর নেই। মাত্রাবৃত্তে যদি অক্ষরবিন্যাস ভেদে নিয়মিত করা হয় তবে তার সঙ্গে সংস্কৃত অক্ষরচ্ছন্দের সাদৃশ্য হয়। উদাহরণ শেষে আছে।
স্বরবৃত্ত
রবীন্দ্রনাথ এই শ্রেণীর বাংলা ছন্দের নাম দিয়েছেন–প্রাকৃত ছন্দ। গ্রাম্য ছড়ায় ও গানে প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়। স্বরবৃত্ত নামের উদ্দিষ্ট অর্থ কি ঠিক জানি না। কেউ কেউ বলেন–এতে প্রতি চরণে স্বরবর্ণের (অতএব অক্ষরের) সংখ্যা সমান রাখা হয়। অনেক স্থলে তা হয় বটে, কিন্তু শ্রেষ্ঠ কবির লেখাতেও ব্যতিক্রম দেখা যায় এবং তার জন্য ছন্দঃপাত হয় না। অতএব বলা চলে না যে নিয়ত স্বরসংখ্যাই এই শ্রেণীর লক্ষণ। স্বরবৃত্তের বিশিষ্টতা-মাত্ৰাসংখ্যা ঠিক রাখবার জন্য স্থানবিশেষে কৃত্রিম দীর্ঘ স্বরের প্রয়োগ।
বৃটি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান,
শিব-ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কনে দান।
যথাক্রমে দুই চরণের হরফ-সংখ্যা ১৭, ১৬, অক্ষরসংখ্যা ১৩, ১২, মাত্রাবৃত্তের রীতিতে গণিত মাত্ৰাসংখ্যা ১৮, ১৭। এই হিসাবে দ্বিতীয় চরণে এক মাত্রা কম পড়ে, কিন্তু চিহ্নস্থানে প্রথম চরণে ২টি স্বর এবং দ্বিতীয় চরণে ৩টি স্বর প্রসারিত করায় কৃত্রিমগুরু অক্ষর উৎপন্ন হয়েছে, তার ফলে প্রতি চরণে ২০ মাত্রা হয়েছে। এই ছড়া সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছন্দ পুস্তকে লিখেছেন–তিন গণনায় যেখানে ফাঁক, পার্শ্ববর্তী স্বরবর্ণগুলি সহজেই ধ্বনি প্রসারিত করে সেই পোড়ো জায়গা দখল করে নিয়েছে। অর্থাৎবৃষ্টি ৩ মাত্রা; শেষের এ-কার প্রসারিত করার ফলে পড়েও ৩ মাত্রা।
দিনের আলো নিবে এ-র্ল সু-যি ডো-র্বে ডো-বে,
আকাশ ঘি-রে মেঘ জুটেছে চা-দের লো-র্ভে লো-ভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে, রঙের উপর রঙ।
মন্-দি-রে-তে কাঁসর ঘন্টা বাজল ঠং ঠং।
উপরের ৪ পঙক্তিতে যথাক্রমে হরফ-সংখ্যা ১৫, ১৭, ১৯, ১৬, অক্ষরসংখ্যা ১৪, ১৪, ১৩, ১২, মাত্রাবৃত্তানুসারে মাত্ৰাসংখ্যা ১৬, ১৭, ১৯, ১৮। চিহ্নস্থানে চার পঙক্তিতে যথাক্রমে ৪, ৩, ১, ২, স্বর প্রসারিত করায় প্রতি পঙক্তিতে ২০ মাত্রা হয়েছে। প্রথম ঠং লক্ষণীয়–এখানে প্রসারণ ও অনুস্বার এই দুই কারণে অ-কার ৩ মাত্রা পেয়েছে।
স্বরবৃত্তের সূত্র-চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত। মাত্রাগণনায় মাত্রাবৃত্তের রীতি অনুসৃত হয়, কিন্তু অতিরিক্ত কৃত্রিমদীর্ঘ স্বরও ধরা হয়। কৃত্রিমদীর্ঘ স্বর (বা কৃত্রিমগুরু অক্ষর) থাকাতেই মাত্রাবৃত্তের সঙ্গে স্বরবৃত্তের প্রভেদ হয়েছে।
উল্লিখিত সংস্কৃত ও বাংলা বিভিন্ন ছন্দঃশ্রেণীর লক্ষণ এই সারণীতে সংক্ষেপে দেওয়া হল–
লক্ষণ
সংস্কৃত
বাংলা অক্ষরচ্ছন্দ মাত্রাচ্ছন্দ। অক্ষরবৃত্ত মাত্রাবৃত্ত স্বরবৃত্ত
নেই।
আছে আছে। নেই : অনিয়ত নিয়ত
নেই
স্বভোগুরু অক্ষর। পরতোগুরু অক্ষর কৃত্রিমগুরু অক্ষর হরফ-সংখ্যা অক্ষরসংখ্যা মাত্ৰাসংখ্যা অক্ষরবিন্যাস
নেই
আছে।
অল্প * অল্প* আছে। অল্প + আছে আছে।
আছে। অনিয়ত। নিয়ত অনিয়ত অনিয়ত প্রায় অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত নিয়ত নিয়ত নিয়ত নিয়ত
অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত
নিয়ত
নিয়ত
অসম ছন্দ ও গদ্য ছন্দ
পূর্বোক্ত তিন শ্রেণীর বাংলা ছন্দে দেখা যায় যে একচরণের মাত্ৰাসংখ্যা পরবর্তী কোনও এক চরণের সমান। এইরকম দু-একজোড়া চরণ মিলিয়ে দেখলেই ছন্দের শ্রেণী ধরা পড়ে। কিন্তু যেখানে চরণগুলি অসমান সেখানে উপায় কি? শব্দাবলীর মাত্রাভঙ্গী থেকে অনেক স্থলে বলা যেতে পারে যে ছন্দটি অমুক শ্রেণীর। কিন্তু কতকগুলি ছন্দ, বিশেষত গদ্য ছন্দ, তিন শ্রেণীর কোনওটির সঙ্গে খাপ খায় না।
১। আমার দুর্বোধ বাণী
বিরুদ্ধ বুদ্ধির পরে মুষ্টি হানি
করিবে তাহারে উচ্চকিত
আতঙ্কিত
২। অধরা মাধুরী পড়িয়াছে ধরা
এ মোর ছন্দ বন্ধনে।
বলাকা পাঁতির পিছিয়ে পড়া ও পাখি,
বাসা সুদূরের বনের প্রাঙ্গণে।
৩। আমার পক্ষে বিয়ে করা বিষম কঠিন কর্ম,
কিন্তু গৃহধর্ম।
স্ত্রী না হলে অপূর্ণ যে রয়,
মনু হতে মহাভারত সকল শাস্ত্রে কয়।
উদ্ধৃত উদাহরণগুলির ভঙ্গী থেকে বলা যেতে পারে প্রথমটি অক্ষরবৃত্ত, দ্বিতীয়টি মাত্রাবৃত্ত, তৃতীয়টি স্বরবৃত্ত। প্রত্যেকটিতে যেন সমান মাত্রার এক একরকম ছন্দ থেকে এক একটি পঙক্তি তুলে এনে অসমান মাত্রার গোছা বাঁধা হয়েছে। এরকম ছন্দকে মিশ্রছন্দ বলা যেতে পারে। কিন্তু–
সন্ধ্যা এল চুল এলিয়ে
অস্তসমুদ্রে সদ্য স্নান করে।
মনে হল স্বপ্নের ধূপ উঠছে।
নক্ষত্রলোকের দিকে।
এই উদাহরণ একবারে স্বচ্ছন্দ, সাধারণ ছন্দের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। রবীন্দ্রনাথ এরকম গদ্য ছন্দের পরিচয় দিয়েছেন–এতে পদ্যের ছন্দ নেই, এতে জমানো ভাবের ছন্দ। শব্দবিন্যাসে সুপ্রত্যক্ষ অলংকরণ নেই, তবুও আছে শিল্প।
সংস্কৃত ছন্দের অনুকরণ
সংস্কৃত ছন্দের সমস্ত নিয়ম বজায় রেখে কেউ কেউ বাংলা পদ্য লেখবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সুবিধা হয় নি, কারণ স্বতেদীর্ঘ স্বর বাংলা ভাষার প্রকৃতি-বিরুদ্ধ, তাতে রচনা কৃত্রিম হয়ে পড়ে। বলদেব পালিতের লেখা। থেকে উপজাতি ছন্দের নমুনা–
দৈবানুকূলে বলহীন শক্ত,
বলী অশক্ত প্রতিকূল দৈবে।
দৈবে হবে নির্জিত সূতপুত্র।
তোমার ভাগ্যে ঘটিবে জয়শ্রী।
প্রতি চরণে ১১ অক্ষর। প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ চরণ ইন্দ্ৰবজ্রা, ১৮ মাত্রা; দ্বিতীয় চরণ উপেন্দ্ৰবজ্রা, ১৭ মাত্রা। অনুরূপ সংস্কৃত–
এষা প্রসন্নস্তিমিতপ্রবাহা
সরিদ বিদূরান্তরভাবতন্বী।
মন্দাকিনী ভাতি নগোপকণ্ঠে
মুক্তাবলী কণ্ঠগতেব ভূমেঃ ॥
রবীন্দ্রনাথের ছন্দ পুস্তকে দ্বিজেন্দ্রনাথ-রচিত একটি মন্দাক্রান্তার নমুনা আছে–
ইচ্ছা সম্যক ভ্রমণগমনে কিন্তু পাথেয় নাস্তি,
পায়ে শিকলী মন উড়ু উড় এ কি দৈবেরি শাস্তি।
সংস্কৃত মাত্রাচ্ছন্দের রীতিতে বাংলায় অনেক গান রচিত হয়েছে, যেমন দেশ দেশ নন্দিত করি, জনগণমন অধিনায়ক। এইসব গানে স্বতেদীর্ঘ স্বর থাকলেও তার ফল ভালই হয়েছে, কারণ গানের তালের সঙ্গে দীর্ঘস্বরের । টান সহজেই খাপ খায়।
বাংলা মাত্রাবৃত্তের নিয়মে, অর্থাৎ শুধু পরতোদীর্ঘ স্বর অবলম্বন করে কেউ কেউ সংস্কৃত অক্ষরচ্ছন্দের অনুকরণ করেছেন। কিন্তু স্বতেদীর্ঘ স্বরের জন্য সংস্কৃতে যে লালিত্য হয় অনুকরণে তা পাওয়া যায় না। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত বাংলা মাত্রাবৃত্তে মালিনী ছন্দের নমুনা–
উড়ে চলে গেছে বুলবুল, শূন্যময় স্বর্ণপিঞ্জর,
ফুরায়ে এসেছে ফাগুন, যৌবনের জীর্ণ নির্ভর।
প্রতি চরণে ১৫ অক্ষর, ২২ মাত্রা, অক্ষরবিন্যাস সংস্কৃত অক্ষরচ্ছন্দের রীতিতে, শুধু স্বলতাগুরু অক্ষর নেই। অনুরূপ সংস্কৃত–
শশিনমুপগতেয়ং কৌমুদী মেঘমুক্তং
জলনিধিমনুরূপং জন্ধু কন্যাবতীর্ণা।
সংস্কৃত মাত্রাচ্ছন্দে অক্ষরবিন্যাসের বাঁধাবাঁধি নেই, সেজন্য বাংলায় অনুরূপ রচনা আড়ষ্ট না করেও সংস্কৃত ছন্দের সঙ্গে অল্পাধিক সাদৃশ্য রাখা যেতে পারে। যথা রবীন্দ্রনাথের–
পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ এ কী সন্ন্যাসী,
বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে।
দুই চরণে যথাক্রমে ২০, ১৪ মাত্রা (চরণের অন্ত্যস্বর দীর্ঘ)। অনুরূপ গীতগোবিন্দে–
বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদী
হরতি দরতিমিরমতিঘোর।
ছন্দ পুস্তকে সংস্কৃত শিখরিণী অক্ষরচ্ছন্দের রবীন্দ্রনাথ-কৃত বাংলা রূপান্তরের একটি নমুনা আছে। এতে শুধু মাত্ৰাসংখ্যা ঠিক রাখা হয়েছে–
কেবলি অহরহ মনে মনে।
নীরবে তোমা সনে যা খুশি কহি কত;
সংস্কৃত নমুনা–
চলাপাঙ্গাং দৃষ্টিং/স্পৃশসি বহুশো বেপথুমতী
প্রতি ভাগে যথাক্রমে ১১, ১৪ মাত্রা। পরিশেষে বাংলা মাত্রাবৃত্ত-মন্দাক্রান্তার একটি উদ্ভট নমুনা দিচ্ছি–
মন্দ্রাক্রান্তায় রচিল কালিদাস কাব্য মেঘদূত চমৎকার,
বাংলায় তদ্রূপ বিভেদ নেই বলেই শক্ত একটু
যুক্তাক্ষর তাই যত পার চালাও আর দেদার দাও হসন্ত,
ঠিক ঠিক জায়গায় বসালে পাবে এই তকে কিঞ্চিৎ দুধের স্বাদ।