স্নেহদ্রব্য

স্নেহদ্রব্য (১৮৮১/১৯৫৯)

বাঙালীর রান্নায় সরষের তেল আর ঘি বহুকাল থেকে চলে আসছে। কুড়ি-পঁচিশ বৎসর আগে পঞ্জাবী আর উত্তরপ্রদেশীকে বলতে শুনেছি, সরষের তেল খেলে পেট জ্বলে যায়, কিন্তু এখন তারাও খেতে আরম্ভ করেছে। গান্ধীজী বলতেন, লংকা আর সরষের তেল বিষবৎ ত্যাজ্য। কিন্তু লংকাখোর দক্ষিণভারতবাসীর জঠর এপর্যন্ত দগ্ধ হয় নি, বাঙালীর জঠরও সরষের তেলে স্নিগ্ধ আছে, যদিও কেউ কেউ বিষাক্ত ভেজাল তেল খেয়ে রোগে পড়েছেন।

বনস্পতি নাম কোন মহাপণ্ডিত চালিয়েছেন জানি না। সরকার এই উৎকট নাম মেনে নিয়েছেন। এর আভিধানিক অর্থ–পুষ্পব্যতিরেকে ফলজনক বৃক্ষ, অশ্বত্থাদি; বৃক্ষ মাত্র (শব্দসার)। হিন্দীতে বনস্পতি মানে উভিদ। যদি সেই অর্থই ধরা হয় তা হলেও উদভিজ্জ তৈলজাত দ্রব্যবিশেষের নাম বনস্পতি হবে কেন? গরু থেকে দুধ হয়, দুধ থেকে ঘি। সে কারণে ঘিকে গরু বলা চলে কি? এই প্রবন্ধে হাইড্রোজেনেটেড অয়েলকে সংক্ষেপে হাইড্রোতেল বলব। বিভিন্ন কারখানায় প্রস্তুত এই দ্রব্য ডালডা, রসোই, কুসুম, পকাও ইত্যাদি নানা নামে বিক্রি হয়।

গত যুদ্ধের আগে ঘি আর সরষের তেলের যে দাম ছিল এখন তার পাঁচ ছ গুণ হয়েছে। হাইড্রোতেল প্রায় পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে বিদেশ থেকে আসতে আরম্ভ করে। প্রথম প্রথম হোটেলের রান্নায়, ময়রার ভিয়ানে, আর ঘিএর ভেজালে চলত, কিন্তু সাধারণ গৃহস্থ তা পছন্দ করত না, যদিও দাম ছিল দশ আনা সেরের কাছাকাছি, অর্থাৎ ঘিএর অর্ধেক। অনেকে মনে করত, বস্তুটি অপকারী, অন্তত তার ফুড-ভ্যালু কিছু নেই। হাইড্রোতেল সম্বন্ধে সাধারণের ভয় ক্রমশ দূর হল, গৃহস্বামীর আপত্তি থাকলেও গৃহিণীরা লুকিয়ে আনাতে লাগলেন। কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের কত্রী আমাকে বলেছিলেন, কি করা যায় বলুন, ছেলেগুলো রাক্ষসের মতন লুচি খাচ্ছে, কাহাতক ঘি যোগান? (ঘি তখন পাঁচ সিকে সের)।

এখন এদেশে প্রচুর হাইড্রোতেল তৈরি হচ্ছে, জনকতকের আপত্তি থাকলেও জনসাধারণ বিনা দ্বিধায় খাচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি এই বস্তুটির বিরুদ্ধে নূতন অভিযোগ উঠেছে, এবং সবিশেষ জানবার জন্য অনেকে আগ্রহী হয়েছেন। এই প্রবন্ধে তেল ঘি হাইড্রোতেল প্রভৃতি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করছি।

স্নেহ (fat)— ইংরেজী ফ্যাট শব্দের অর্থ প্রাণিদেহের চর্বি, কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় মাখন ঘি আর উভিজ্জ তেলও ফ্যাটএর অন্তর্গত। এই ব্যাপক অর্থে ফ্যাট সংজ্ঞার প্রতিশব্দ রূপে অনেকে লেখেন, চর্বি বা চর্বিজাতীয় দ্রব্য। ইংরেজী প্রয়োগের অন্ধ অনুকরণে সরষে তিল ইত্যাদির তেলকে চর্বি বললে আমাদের সংস্কারের উপর পীড়ন হয়। বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গে ফ্যাটএর প্রতিশব্দ স্নেহ বা স্নেহদ্রব্য লেখাই ভাল, তাতে ভুল বোঝবার সম্ভাবনা থাকবে না।

স্নেহাম্ল (fatty acid)— স্নেহ শব্দের এক অর্থ স্নিগ্ধতা, চিক্কণতা, বা তেলা ভাব। ভ্যাসেলিন, লুব্রিকেটিং অয়েল প্রভৃতিও চিক্কণ, কিন্তু তাদের রাসায়নিক গঠন স্নেহ বা ফ্যাটের তুল্য নয়। স্নেহ মাত্রেরই প্রধান উপাদান গ্লিসারিন এবং কয়েক প্রকার স্নেহাম্ল বা ফ্যাটি অ্যাসিড। রসায়ন শাস্ত্রে যাকে অম্ল বা অ্যাসিড বলা হয় তার স্বাদ টক নাও হতে পারে। অধিকাংশ স্নেহাম্ল টক নয়।

অপূরিত (unsaturated) ও প্রপূরিত (saturated)— প্রত্যেক স্নেহাম্লের অণুতে কতকগুলি কার্বন হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণু থাকে। এই সব পরমাণুর বিন্যাস ও সংখ্যা এক-এক স্নেহাম্নে এক-এক প্রকার। এক শ্রেণীর স্নেহাম্লে আরও হাইড্রোজেন পরমাণু জুড়ে দিতে পারা যায়, অপর শ্রেণীতে তা পারা যায় না। প্রথম শ্রেণীকে বলা হয় অপূরিত (অনসাটুরেটেড), অর্থাৎ যতটা হাইড্রোজেন থাকতে পারে ততটা নেই, হাইড্রোজেনের কিছু আসন খালি আছে। অপর শ্রেণীর স্নেহাম্লকে বলা হয় প্রপূরিত (সাটুরেটেড), অর্থাৎ এগুলিতে পূর্ণমাত্রায় হাইড্রোজেন আছে, আসন খালি নেই।

বিভিন্ন তেলে আর ঘিএ যে স্নেহাম্ল থাকে তার মধ্যে অপূরিত আর প্রপূরিতর শতকরা হার মোটামুটি এই রকম–

অপূরিত—প্রপূরিত

সরষের তেল—৫০—৫০
তিল তেল—৮৫—১৫
চীনাবাদাম তেল—৭৫-৮৭—২৫-১৩
নারকেল তেল—২—৯৮
ঘি (গাওয়া ভঁয়সার কিছু তারতম্য আছে)—২৯—৭১

সরষে তিল আর চীনাবাদাম তেলে অপূরিত স্নেহাম্ল প্রচুর আছে, এই সব তেল শীতকালেও তরল থাকে। নারকেল তেল আর ঘিএ প্রপূরিত বেশী, ঠাণ্ডায় জমে যায়।

রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন সংযোগ করলে অপূরিত স্নেহা প্রপূরিত হয়ে যায়, তার ফলে তরল তেল গাঢ় হয়। যোজিত হাইড্রোজেনের মাত্রা অনুসারে তেলের রূপ ঘিএর মতন নরম, ছাগল-ভেড়ার চর্বির মতন জমাট বা মোমের মতন শক্ত করা যায়। এদেশে ৯ ভাগ চীনাবাদাম তেলে ১ ভাগ তিল তেল মিশিয়ে তাই থেকে হাইড্রোতেল তৈরি হয়, কিন্তু সবগুলির গাঢ়তা সমান নয়। হাইড্রোতেলের কথা পরে হবে, এখন সাধারণ তেলের কথা বলছি।

কোন্ তেল ভাল?

ভারতের অনেক প্রদেশে তিল আর চীনাবাদাম তেলে রান্না হয়, দক্ষিণ ভারতে নারকেল তেলও চলে। বাঙালী সহজে অভ্যাস বদলাতে পারে না। বার-তের বৎসর আগে যখন সরষের তেল খুব দুষ্প্রাপ্য হয়েছিল তখন অনেকে জেনে শুনে ভেজাল তেল কিনত, কিন্তু তিল বা চীনাবাদাম তেল ছুঁত না। প্রচলিত তেলের মধ্যে কোটি বেশী হজম হয় বা বেশী পুষ্টিকর তার পরীক্ষা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ পর্যন্ত হয় নি, অতএব নিশ্চয় করে কিছু বলা যায় না। আয়ুর্বেদে তিল তৈলের বহু প্রশংসা আছে, তৈল শব্দের ব্যুৎপত্তি অর্থই তিলজাত (যেমন oilএর মৌলিক অর্থ olive-জাত)। সরষে তিল আর চীনাবাদাম তিন রকম তেলই অনেক কাল থেকে ভারতবাসীর রান্নায় চলছে, তাতে স্বাস্থ্যহানি হয়েছে এমন শোনা যায় নি। অতএব ধরা যেতে পারে যে তিনটি তেলই সুপাচ্য। অবশ্য এমন লোক আছে যার পেটে এক রকম তেল সয় কিন্তু অন্য রকম তেল সয় না, কিংবা ঘি সয় কিন্তু কোনও তেল সয় না। সব রকম তেলের চাইতে ঘি বেশী পাচ্য আর পুষ্টিকর, এ বিষয়ে মতভেদ নেই।

খাদ্যের রাসায়নিক গঠনের সঙ্গে তার পাচ্যতা আর পুষ্টিকরতার সম্বন্ধ আছে, কিন্তু সেই সম্বন্ধ সকল ক্ষেত্রে সুনিণীত হয় নি। মোটামুটি দেখা যায়, স্নেহদ্রব্যের মধ্যে যেগুলি তরল এবং যাতে অপূরিত স্নেহা বেশী, সেইগুলিই সহজে জীর্ণ হয়। ঘিএ প্রপূরিত স্নেহা বেশী থাকলেও তার লঘু গঠনের জন্য সুপাচ্য। তা ছাড়া ঘিএ ভাইটামিন এ আর ডি আছে, তেলে নেই। নারকেল তেলে প্রপূরিত স্নেহা খুব বেশী, কিন্তু তার কতকটা ঘিএর তুল্য।

পূর্বোক্ত তালিকায় বিভিন্ন তেলের যে স্নেহা দেখানো হয়েছে তাতে তিল তেলে অপূরিত স্নেহাম্ল সব চাইতে বেশী আর প্রপূরিত কম। এই কারণে অন্য তেলের তুলনায় সম্ভবত তিল তেল পাচ্যতায় শ্রেষ্ঠ, তার পরেই চীনাবাদাম তেল।

খাদ্যদ্রব্য ভাজবার সময় তেল ঘি তপ্ত করতে হয়। বেশী তাপে সব। স্নেহদ্রব্যই বিকৃত হয় বা পুড়ে যায়, কিন্তু তেল যত আঁচ সইতে পারে, ঘি তত পারে না। সেজন্য প্রবাদ–তেল পুড়লে ঘি, ঘি পুড়লে ছাই। ঘি বেশী পুষ্টিকর হলেও ভাজবার পক্ষে তেলই ভাল, যদিও ঘি ভাজা তপ্ত লুচির খ্যাতি বেশী। চর্বি আর হাইড্রোতেলও বেশী আঁচ সইতে পারে।

ভাজবার সময় তেল-ঘিএর কিছু অংশ বাম্পাকারে উবে যায়। ঘিএ সব চাইতে বেশী যায়, তিল তেলে আর নারকেল তেলে একটু কম, সরষে আর চীনাবাদাম তেলে আরও কম। এই কারণে ভাজবার পক্ষে সরষে আর চীনাবাদাম তেল শ্রেষ্ঠ। সরষের তেলের দুর্লভতার সময় আমি তিন-চার মাস তিল তেল চালিয়েছিলাম, তার ফলে রান্নাঘরের দেওয়াল তৈলাক্ত হয়ে যায়।

খাদ্য সম্বন্ধে অকারণ পক্ষপাত বা বিদ্বেষ ভাল নয়। পশ্চিম বাংলার খাদ্যসংকটের একটি কারণ–রুটিতে আপত্তি আর ভাতে অত্যাসক্তি। যে সব খাদ্য অন্য প্রদেশে খুব চলে তা বাঙালীরও অভ্যাস করা উচিত। প্রত্যেক তেলেরই বিশিষ্ট গন্ধ আছে। সরষের তেল না হলে চলবে না, অন্য তেলের গন্ধ খারাপ, এমন মনোভাব ক্ষতিকর। অভ্যাস করলে তিল আর চীনাবাদাম তেলেও রুচি হবে।

হাইড্রোতেল

ঘিএর উপর ভারতবাসীর যে আসক্তি আছে তা অন্যায় নয়, কারণ অন্য স্নেহদ্রব্যের চাইতে ঘিএর পুষ্টিকরতা বেশী। জল আর বাতাসের সংস্পর্শে, পুরনো হলে, এবং বার বার তপ্ত করলে ঘি আর তেল বিকৃত হয়। ঘিএর উপর সাধারণের পক্ষপাত আছে, তাই খারাপ ঘি দিয়ে তৈরি খাবারে একটু দুর্গন্ধ থাকলে লোকে গ্রাহ্য করে না, বরং সেই গন্ধকেই ঘৃতপক্কতার প্রমাণ মনে করে। ঘি আভিজাত্যের লক্ষণ, মান্য কুটুম্ব বা অতিথিকে তেলে ভাজা খাবার দেওয়া যায় না। খাঁটী ঘি দুর্মূল্য হলে লোকে সজ্ঞানে বা অজ্ঞাতসারে সস্তা ভেজাল দেওয়া ঘি কেনে। ঘিএর কৃত্রিম এসেন্স বাজারে পাওয়া যায়, হাইড্রোতেলে অল্প একটু দিলে পচা ঘিএর মতন গন্ধ হয়। অনেক দোকানের বিশুদ্ধ ঘৃতের খাবার এই নকল ঘি তৈরি হয়। গৃহস্থের যে চক্ষুলজ্জা আগে ছিল এখন তা দূর হয়েছে, নকল ঘি কিনে আত্মবঞ্চনা বা অতিথিবঞ্চনার দরকার হয় না, খোলাখুলি হাইড্রোতেলে রান্না হয়। তেলে ভাজা খাবারে যে গন্ধ হয় তা হাইড্রোতেলের খাবারে থাকে না, সেজন্য ঘৃতপকের বিকল্পরূপে হাইড্রোতেলপক্ক খাবার অবাধে চলে।

হাইড্রোতেলে ঘি-ব্যবসায়ীর ক্ষতি

অনেকে বলেন, হাইড্রোতেলে ঘিএর সর্বনাশ হচ্ছে, এর উৎপাদন একেবারে বন্ধ না করলে ঘি লোপ পাবে। এই অভিযোগ যুক্তিসঙ্গত নয়। চল্লিশ বৎসর আগে হাইড্রোতেল ছিল না, তখন ঘিএ চর্বি চীনাবাদাম তেলের ভেজাল দেওয়া হত। ভাল চর্বির গন্ধ অনেকটা ভঁয়সা ঘিএর মতন, তাই ভেজাল ধরা সাধারণের অসাধ্য ছিল। হাইড্রোতেল তুলে দিলে আবার চর্বি চলবে। ঘি-ব্যবসায়ীর যে অসুবিধা হয়েছে তার প্রকৃত কারণ হিন্দু জনসাধারণ চোখ বুজে চর্বি-মিশ্রিত ভেজাল ঘি খেলেও শুধু চর্বি খেতে রাজী নয়, কিন্তু শুধু হাইড্রোতেল খেতে তার আপত্তি নেই। সেকালে খাঁটী আর ভেজাল ঘিএর একাধিপত্য ছিল, তাই ঘিএর ব্যবসা ভাল চলত। কিন্তু এখন হাইড্রোতেল প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছে। হাইড্রোতেল তুলে দিলে চর্বি-মিশ্রিত ভেজাল ঘিএর বিক্রি খুব বেড়ে যাবে, খাঁটী ঘিএর দাম চড়বে।

ভারতবর্ষ ভেজালের জন্য কুখ্যাত। আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসংখ্য অসাধু আছে, জনসাধারণও নিশ্চেষ্ট। বাজারের ঘি আর তেলে প্রচুর ভেজাল চলে, বিদেশ থেকে ঘি আর সরষের তেলের কৃত্রিম এসেন্স অবাধে আমদানি হয়। আমাদের সরকার ছোটখাট ভেজালদারদের সাজা দেন কিন্তু বড়দের পরিহার করেন। যেমন, বেরাল নেংটি ইঁদুর ধরে কিন্তু ড্রেনবাসী বড় ইঁদুর দেখলে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দেয়।

সরকারী নিয়ম অনুসারে হাইড্রোতেলে কিছু তিল তেল দেওয়া হয়। রাসায়নিক পরীক্ষায় তিল তেল সহজেই ধরা যায়, সেজন্য ঘিএ হাইড্রোতেল থাকলে তিল তেলের জন্যই ভেজাল ধরা পড়ে। কিন্তু রাসায়নিক পরীক্ষা সাধারণের সাধ্য নয়, সেজন্য প্রস্তাব হয়েছে, হাইড্রোতেলে এমন রঙ দেওয়া হক যাতে ঘি মেশালে রঙ দেখেই লোকে ভেজাল বুঝতে পারে। এই প্রস্তাব একেবারে নিরর্থক। হাইড্রোতেলে যদি প্রচুর রঙ থাকে তবেই ঘিএ তার ভেজাল ধরা পড়বে। কিন্তু লাল নীল সবুজ ব্রাউন ইত্যাদি রঙের হাইড্রোতেল তৈরি করা বৃথা, কেউ তা কিনবে না।

হাইড্রোতেলের দোষ

হাইড্রোতেলে প্রপূরিত গাঢ় স্নেহাম্ল বেশী, সেজন্য তার কতকটা হজম হয় না, মলের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। এই কারণে খাদ্য হিসাবে তেলের চাইতে হাইড্রোতেল নিকৃষ্ট।

শারীরবিজ্ঞানী আর স্বাস্থ্যবিশারদগণ মাঝে মাঝে এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন যাতে লোকে উদবিগ্ন হয়। কয়েক বৎসর থেকে তারা প্রচার করছেন সিগারেটখোরদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসার বেশী দেখা যায়। সিগারেট ব্যবসায়ীরা এই মত খণ্ডনের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন, নামজাদা ডাক্তারদের দিয়ে প্রতিবাদও প্রচার করাচ্ছেন, তথাপি সিগারেটের অনিষ্ট করতা এখন প্রায় সর্বস্বীকৃত হয়েছে। এই বিষয় নিয়ে সাধারণ লোকেও খুব জল্পনা করছে, কিন্তু সিগারেটের কাটতি এখন পর্যন্ত কিছুমাত্র কমে নি। লোকের মনোভাব বোধ হয় এই হুজুকে পড়ে নেশা ছাড়তে পারব না, ক্যানসার যখন হবে তখন দেখা যাবে। সম্প্রতি শারীরবিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত করেছেন, স্নেহদ্রব্যে যদি প্রপূরিত স্নেহা থাকে তবে তা বেশী খেলে রক্তে কোলেস্টেরল নামক পদার্থ উৎপন্ন হয়, তার ফলে থ্রম্বোসিস হতে পারে। হাইড্রোতেলে প্রপূরিত স্নেহাম্ন বেশী, সেজন্য এসব জিনিস খেলে থ্রম্বোসিসের সম্ভাবনা বাড়ে। মাখন আর ঘিও নিরাপদ নয়, কারণ তাতেও প্রপূরিত স্নেহা আছে। অতএব তরল তেল খাওয়াই সব চেয়ে ভাল।

ঘিএর অনুকল্প

এদেশে যেমন ঘিএর, পাশ্চাত্ত্য দেশে তেমনি মাখনের আদর। মাখন দুর্মূল্য, সেজন্য দরিদ্রের জন্য মাখনের অনুকল্প মার্গারিনএর প্রচলন হয়েছে। ঘিএরও একটা অনুকল্প দরকার। মার্গারিন দেখতে মাখনের মতন হলেও উপাদান মাখনের সমান নয়, কিন্তু সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। আমাদের দেশে ঘিএর যে অনুকল্প হবে তারও উপাদান আর লক্ষণ নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার। হাইড্রোতেলে প্রপূরিত স্নেহা যদি খুব কমানো হয়, অর্থাৎ চীনাবাদাম তেলে যদি বেশী হাইড্রোজেন সংযোগ নিষিদ্ধ হয় তবে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা কমবে। এ রকম হাইড্রোতেল হয়তো খুব নরম হবে, গ্রীষ্মকালে তেলের মতন তরল থাকবে, কিন্তু নিরাপত্তার জন্য তাই চালাতে হবে। সরকার স্বয়ং উদযোগী হয়ে কিছু করবেন মনে হয় না, কিন্তু জনমত যদি প্রবল হয়, তবে আইন করতে বাধ্য হবেন।

এক বিষয়ে চর্বি আর গাঢ় হাইড্রোতেল ঘি আর তরল তেলের চাইতে শ্রেষ্ঠ। বিস্কুটে ঘি বা তেলের ময়ান দিলে চলে না। পূর্বে দেশী বিলাতী সব বিস্কুটেই চর্বির ময়ান চলত, এখন হাইড্রোতেল দেওয়া হয়। রান্নার হাইড্রোতেল যদি পাতলা করা হয় বিস্কুটওয়ালাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে।

বাজারে প্রায় গন্ধহীন ও বর্ণহীন চীনাবাদাম তেল পাওয়া যায়, তার দাম সাধারণ তেলের চাইতে বেশী, কিন্তু হাইড্রোতেলের চাইতে কম। অনেক গুজরাটী আর মারোয়াড়ী খাবারওয়ালা তা ঘিএর বদলে ব্যবহার করে। এই deodorized decolorized তেলে হাইড্রোজেন যোগ করা হয় না, তেলের স্বাভাবিক স্নেহাই বজায় থাকে। বাঙালী গৃহস্থ এই তেল ঘিএর অনুকল্পরূপে ব্যবহার করে দেখতে পারেন।


© 2024 পুরনো বই