আচার্য উপাচার্য (১৮৭৯/১৯৫৭)
কালক্রমে অনেক শব্দের মানে বদলায়। সংস্কৃত অভিধানে যেসব অর্থ পাওয়া যায় আধুনিক বাঙলা প্রয়োগে বহু ক্ষেত্রে তার অল্পাধিক পরিবর্তন হয়েছে। পাঠশালা আর বিদ্যালয় এই দুইএর মূল অর্থ একই, কিন্তু আজকাল মানে বদলে গেছে। সেই রকম–বৈদ্য ও চিকিৎসক, ঘটনা ও যোজনা, অভ্যর্থনা ও প্রার্থনা, প্রণাম ও নমস্কার। অনেক শব্দের অর্থব্যাপ্তি (connotation) পূর্ববৎ নেই, যেমন, সাহিত্যএর অর্থ প্রসারিত হয়েছে, কাব্যএর অর্থ সংকুচিত হয়েছে। ধাতু বললে সাধারণ শিক্ষিত লোকে বোঝে metal, কিন্তু কবিরাজরা প্রাচীন অর্থ অনুসারে অধিকন্তু বোঝেন হরিতাল হিঙগুল প্রভৃতি যৌগিক পদার্থ এবং রক্ত মাংস প্রভৃতি দৈহিক উপাদান।
একালের রাষ্ট্রিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা সেকালের মতন নয়, সেজন্য অনেক শব্দের প্রাচীন অর্থ কিছু না বদলালে আমাদের আধুনিক প্রয়োজন মেটে না। কিন্তু মূল অর্থের সঙ্গে নূতন অর্থের ভাবগত বিরোধ যাতে না হয় তা দেখা দরকার। স্নাতকএর একটি প্রাচীন অর্থ– বিদ্যাশিক্ষান্তে যে ব্রহ্মচর্যসমাপ্তিসূচক স্নান করেছে। সমাবর্তন-এর অর্থ ব্রহ্মচর্যের অন্তে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ। আজকাল এই দুই শব্দ গ্র্যাজুএট ও কনভোকেশন অর্থে চলছে। এতে আপত্তির কারণ কিছু নেই। কিন্তু নাচ গানের স্কুলকে বিদ্যালয় বলা গেলেও পাঠশালা বলা চলবে না, সেখানকার শিক্ষককেও গুরুমহাশয় বা অধ্যাপক বলা চলবে না।
কুলপতি শব্দের আভিধানিক অর্থ–যে বিপ্রর্ষি দশসহস্র মুনিকে প্রতিপালন ও শিক্ষাদান করেন। যেমন অক্ষৌহিণী শব্দের বিবৃতিতে ৬৫,৬১০ অশ্ব, ২১,৮৭০ গজ ইত্যাদির উল্লেখ আছে তেমনি কুলপতির বিবৃতিতে ১০,০০০ শিক্ষার্থী মুনির উল্লেখও পৌরাণিক সংখ্যান ধরা যেতে পারে। দশ সহস্র শিষ্যের মানে অনেক শিষ্য, দু-এক হাজার বা দু-পাঁচ শও হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর কুলপতি ছিলেন– একথা বললে প্রাচীন অর্থের অপলাপ হবে মনে করি না।
মনুর বচন অনুসারে আচার্য শব্দের অর্থ–যে দ্বিজ শিষ্যকে উপনীত করে বেদাঙ্গ ও উপনিষৎ সমেত বেদ শিক্ষা দেন। আপ্তের অভিধানে আচার্যএর একটি অর্থ দেওয়া আছে–(when affixed to proper names) learned, venerable (somewhat like the Eng. Dr.) 143 সব অর্থের কালোচিত পরিবর্তন করলে রবীন্দ্রনাথের আচার্য উপাধিও সার্থক। গুরু আর আচার্য প্রায় সমার্থক, সেজন্য তাঁর গুরুদেব উপাধিও সার্থক।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আর বিশ্বভারতীর শুধু প্রতিষ্ঠাতা নন, বহুকাল স্বয়ং অধ্যাপনা করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সমগ্র শিক্ষার বিধায়ক ছিলেন। এ কারণে আচার্য উপাধি সর্বতোভাবেই তার উপযুক্ত। বিশ্বভারতী এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে, তার চানসেলর নেহরুজী দিল্লিতে থাকেন, কালেভদ্রে বিশেষ উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে আসেন, প্রশাসন বা adminis tration সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয়ে তার সম্মতি নিতে হয়। কোনও স্কুল বা কলেজের গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্টকে আচার্য বা অধ্যাপক বললে যে দোষ হয়, বিশ্বভারতীর চানসেলরকে আচার্য বললেও সেই দোষ হয়। বিশ্বভারতী বা কলিকাতা বা অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের চানসেলরের পদে যিনি অধিষ্ঠান করেন তিনি রাষ্ট্রপতি প্রধান মন্ত্রী বা রাজ্যপাল যাই হন, তাকে আচার্য বলা নিতান্ত অসংগত। চানসেলর আর আচার্য এই দুই শব্দের অর্থগত বা ভাবগত সাদৃশ্য কিছুমাত্র নেই।
কলেজের প্রিনসিপাল অধ্যাপনাও করতে পারেন কিন্তু অধ্যাপনার উপর গুরুত্ব না দিয়ে তাকে শুধু প্রাধান্যসূচক পদবী দেওয়া হয়েছে, কারণ, তিনি অধ্যাপকবর্গের প্রধান এবং পরিচালক। প্রিনসিপালএর প্রতিশব্দ অধ্যক্ষও প্রাধান্য ও কর্তৃত্বসূচক। Concise Oxford Dictionaryতে University Chancellorএর অর্থ–titular head with Vice-c. acting, অর্থাৎ চানসেলর পদবীতে প্রধান হলেও ভাইস-চানসেলরই প্রকৃত কর্তা। চানসেলরের যা অধিকার তা প্রশাসন বা ব্যয়-অনুমোদন সংক্রান্ত, তাঁকে আচার্য বলার পক্ষে কিছুমাত্র যুক্তি নেই।
ভাইস-চানসেলরকে উপাচার্য বলা আরও আপত্তিজনক। ইংরেজী ভাইস-এর অন্ধ অনুকরণে বাঙলায় উপ-উপসর্গের প্রয়োগ একেবারে নিরর্থক। ভাইস-চানসেলর ইচ্ছা করলে অধ্যাপনা করতে পারেন, কিন্তু তার প্রকৃত কর্ম প্রশাসন বা পরিচালন। ইংরেজী নামে ভাইস উপসর্গ সত্ত্বেও তিনি কারও স্থলাভিষিক্ত বা সহকারী নন। উপাচার্য শুনলে মনে আসে assistant professor। এই উপাধি তার শুধু অযোগ্য নয়, মর্যাদাহানিকরও। বটে।
সরকারী কার্যের পরিভাষা সংকলনের জন্য কয়েক বৎসর পূর্বে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি সমিতি নিযুক্ত করেছিলেন।* এই সমিতির সংকলিত তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কয়েকটি পরিভাষা আছে, যেমন–Senate অধিষদ, Syndicate নিষদ, Registrar নিবন্ধক, Vice Chancellor অধিপাল, Chancellor মহাধিপাল। (এই সংজ্ঞাগুলির রচয়িতা অধ্যাপক শ্রীযুক্ত দুর্গামোহন ভট্টাচার্য এম এ, কাব্যসাংখ্যপুরাণ তীর্থ)। কলেজের প্রধান যেমন অধ্যক্ষ, সরকারী বিভাগের ডিরেক্টর যেমন অধিকর্তা, কোনও সংঘের প্রধান নেতা বা নিয়ন্তা যেমন অধিনায়ক, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি প্রধান নিয়ন্তা তিনি অধিপাল।
একালের ভাইস-চানসেলর (বিশেষত বিশ্বভারতীর তুল্য আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের) সেকালের কুলপতিরই সমপর্যায়ের। অধিপাল উপাধিতে তার অধিনায়কত্ব ও পদোচিত গৌরব সূচিত হয়। চানসেলরকে আচার্য আখ্যা না দিয়ে মহাধিপাল বললে তারও যথোচিত মর্যাদা বজায় থাকে।
[* কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিযুক্ত সমিতির মতন এটিরও সভাপতি ছিলেন–রাজশেখর বসু।–স:।]