রবীন্দ্র পরিবেশ
(১৩৫৫/১৯৪৮)
আমাদের জীবনযাত্রায় নানারকম বস্তু দরকার হয়, কিন্তু শুধু দরকার বুঝেই আমরা তাদের মর্যাদা দিই না। যেসব বস্তু আমরা অত্যন্ত আবশ্যক মনে করি তাদের উদ্ভাবক বা নির্মাতা মহাপ্রতিভাশালী হলেও আমাদের কাছে নিতান্ত পরোক্ষ, তারা একেবারেই আড়ালে থাকেন, ভোগের সময় তাদের কথা ভাবি না। রেলগাড়ি না হলে আমাদের চলে না, কিন্তু গাড়িতে চড়ে তার প্রবর্তক স্টিভেনসনকে কজন স্মরণ করে? কালক্রমে বহু যন্ত্রী রেলগাড়ির বহু পরিবর্তন করেছেন, কিন্তু এমন আপত্তি শোনা যায় নি যে তাতে স্টিভেনসনের মর্যাদাহানি হয়েছে। পক্ষান্তরে যে বস্তু স্থূল সাংসারিক ব্যাপারে অনাবশ্যক, কিন্তু আনন্দ দেয় বা রসোৎপাদন করে, তার রচয়িতা রচনার সঙ্গে একীভূত হয়ে থাকেন, ভোগের সঙ্গে সঙ্গে আমরা রচয়িতাকেও স্মরণ করি, রচনা থেকে রচয়িতার তিলমাত্র বিচ্ছেদ সইতে পারি না। যন্ত্রের অদলবদল নির্বিবাদে হতে পারে, কারণ যন্ত্রের সঙ্গে আমাদের কেবল স্থূল স্বার্থের সম্বন্ধ। কিন্তু কবি বা চিত্রকরের রচনার সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের সম্বন্ধ, তাই এমন স্পর্ধা কারও নেই যে তাঁদের উপর কলম চালান।
রসসৃষ্টি ও রসস্রষ্টার এই যে অঙ্গাঙ্গিভাব, এরও ইতরবিশেষ আছে। রচয়িতার পরিচয় আমরা যত বেশী জানি ততই রচনার সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্বন্ধ উপলব্ধি করি। যাঁরা বেদ বাইবেল রচনা করেছেন তারা অতিদূরস্থ নক্ষত্রতুল্য অস্পষ্ট, তাঁদের পরিচয় শুধুই বিভিন্ন ঋষি আর প্রফেটের নাম। বেদ বাইবেল অপৌরুষেয় কারণ রচয়িতারা অজ্ঞাতপ্রায়। বাল্মীকি কালিদাস সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ কিংবদন্তী আছে বলেই পাঠকালে আমরা তাদের স্মরণ করি। শেকস্পীয়ার সম্বন্ধে যে তথ্য পাওয়া গেছে তাই সম্বল করে পাঠক তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে, যদিও তিনিই তন্নামে খ্যাত নাটকাদির লেখক কিনা সে বিতর্ক এখনও থামে নি। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি সম্বন্ধে লোকের যতটুকু জ্ঞান ছিল সম্প্রতি তার নোটবুক আবিষ্কৃত হওয়ায় তা অনেক বেড়ে গেছে, এখন তাঁর অঙ্কিত চিত্রের সঙ্গে তাঁর অজ্ঞাতপূর্ব বহুমুখী প্রতিভার ইতিহাস জড়িত হয়ে তার ব্যক্তিত্বকে স্পষ্টতর করেছে।
.
রবীন্দ্রনাথের পরিচয় আমরা যত এবং যেভাবে জানি, আর কোনও রচয়িতার পরিচয় কোনও দেশের লোক তেমন করে জানে কিনা সন্দেহ। আমাদের এই পরিচয় কেবল তার সাহিত্যে সংগীতে চিত্রে ও শিক্ষায়তনে আবদ্ধ নয়, তার আকৃতি প্রকৃতি ধর্ম কর্ম অনুরাগ বিরাগ সমস্তই আমরা, জানি এবং ভবিষ্যদ্রবংশীয়রাও জানবে। এই সর্বাঙ্গীণ সপ্রেম পরিচয়ের ফলে তাঁর রচনা আর ব্যক্তিত্বের যে সংশ্লেষ ঘটেছে তা জগতে দুর্লভ।
ইওরোপ আমেরিকায় এমন লেখক অনেক আছেন যাঁদের গ্রন্থবিক্রয়সংখ্যার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তাঁদের রচনা যে মাত্রায় জনপ্রিয় তারা স্বয়ং সে মাত্রায় জনহৃদয়ে প্রতিষ্ঠা পান নি। বাইরনের অগণিত ভক্ত ছিল, তার বেশভূষার অনুকরণও খুব হত, কিন্তু তার ভাগ্যে প্রীতিলাভ হয় নি। বার্নাড শ বই লিখে প্রচুর অর্থ ও অসাধারণ খ্যাতি পেয়েছেন। তিনি অশেষ কৌতূহলের পাত্র হয়েছেন, লোকে তার নামে সত্য মিথ্যা গল্প বানিয়ে তাকে সম্মানিত করেছে; কিন্তু তিনি জনবল্লভ হতে পারেন নি।
এদেশে একাধিক ধর্মনেতা ও গণনেতা যশ ও প্রীতি এক সঙ্গেই অর্জন করেছেন, যেমন চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু নেতা না হয়েও যে লোকচিত্তে দেবতার আসন পাওয়া যায় তা রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক সম্ভব হয়েছে। কেবল রচনার প্রতিভা বা কর্মসাধনার দ্বারা এই ব্যাপার সংঘটিত হয় নি, লোকোত্তর প্রতিভার সঙ্গে মহানুভবতা ও কান্তগুণ মিশে তাঁকে দেশবাসীর হৃদয়াসনে বসিয়েছে। এদেশে যা তিনি পেয়েছেন তা শুধু সম্মান নয়, যথার্থই পূজা।
গুরু বললে আমরা সাধারণত যা বুঝি–অর্থাৎ মন্ত্রদীক্ষাদাতা–তার জন্য যে বাহ্য ও আন্তর লক্ষণ আবশ্যক তা সমস্তই তার প্রভূত মাত্রায় ছিল। কিন্তু যিনি লিখেছেন–ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার’–তার পক্ষে সামান্য গুরু হওয়া অসম্ভব। যে অগুহ্য মন্ত্র তিনি দেশবাসীকে দিয়ে গেছেন তার সাধনা যোগাসনে জপ করলে হয় না, ভক্তিতে বিহ্বল হলেও হয় না। তার জন্য যে জ্ঞান নিষ্ঠা ও কর্ম আবশ্যক তা তিনি নিজের আচরণে দেখিয়ে গেছেন। তাই তিনি অগণিত ভক্তের প্রশস্ত অর্থে গুরুদেব। তার লোকচিত্তজয়ের ইতিহাস অলিখিত, কিন্তু অজ্ঞাত নয়। কৃতী গুণীকে তিনি উৎসাহদানে কৃতীতর করেছেন, ভীরু নির্বাক অনুরাগীকে সাদরে ডেকে এনে অভয়দানে মুখর করেছেন, ভক্ত প্রাকৃত জনকে বোধগম্য সরস আলাপে কৃতার্থ করেছেন। মূঢ় অসূয়ক তার সৌজন্যে পদানত হয়েছে, ক্র নিন্দক তার নীরব উপেক্ষায় অবলুপ্ত হয়েছে।
বুদ্ধ চৈতন্যাদিতে কালক্রমে দেবত্বারোপ হয়েছে। কালিদাস শুধুই কবি, তথাপি নিস্তার পান নি, কিংবদন্তী তাঁকে বাগদেবীর সাক্ষাৎ বরপুত্র বানিয়েছে। রবীন্দ্রচরিতের এরকম পরিণাম হবে এমন আশঙ্কা করি না। সর্ববিধ অতিকথার বিরুদ্ধে তিনি যা লিখে গেছেন তাই তাঁকে অমানবতা থেকে রক্ষা করবে।
.
রবীন্দ্ররচনা অতি বিশাল, রবীন্দ্রবিষয়ে যে সাহিত্য লিখিত হয়েছে তাও অল্প নয়, কালক্রমে তা আরও বাড়বে। কবির সঙ্গে যাঁদের সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটেছে তাদের অনেকে আরও চল্লিশ-পঞ্চাশ বৎসর বাঁচবেন এবং তাদের দ্বারা রবীন্দ্রতত্ত্ব বিবর্ধিত হবে। তা ছাড়া কবির বহু সহস্র পত্ৰ, অসংখ্য প্রতিকৃতি, স্বরচিত অনেক চিত্র বিকীর্ণ হয়ে আছে, তাঁর গানে দেশ প্লাবিত হয়েছে, তার কণ্ঠস্বরও যন্ত্ৰধৃত হয়ে স্থায়িত্ব পেয়েছে। এই সমস্তের সমবায়ে এবং তার স্বরচিত ভারতীক্ষেত্রে যে বিপুল রবীন্দ্র-পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা রবীন্দ্ররচনার সঙ্গে রবীন্দ্ৰাত্মার নিবিড় সংযোগ অক্ষয় করে রাখবে। তিনি মহা অজানায় প্রস্থান করলেও আমাদের কাছে চিরকাল জীবিতবৎ প্রত্যক্ষ থাকবেন। এমন অমরত্বলাভ অল্প লোকের ভাগ্যেই ঘটেছে।
———-
শেক্স্পীয়ারের নাটক পড়িয়া
পাঠক বলিল– ধন্য ধন্য।
পণ্ডিত কহে- সবুর করহ,
শোধন করিব ত্রুটি অগণ্য।
যষ্টি তুলিয়া বলে সুধীজন–
কি আস্পর্ধা ওরে জঘন্য।।
স্টিভেনসনের রেলগাড়ি চড়ে
যাত্রী বলিল– কি আশ্চর্য!
মিস্ত্রী বলিল– আছে ঢের দোষ,
সারিব সে সব, ধরহ ধৈর্য।
ধনী জন কহে লেগে যাও দাদা,
যত টাকা লাগে দিতেছি কর্জ।।
পরশুরাম (১৯৪৫)