বাংলা ছন্দের শ্রেণী
(১৩৫২/১৯৪৫)
‘পরিচয়’-এর শ্রীযুক্ত গোপাল হালদার মহাশয় জানতে চেয়েছেন ছন্দ সম্বন্ধে আমার ধারণা কি। বিষয়টি বৃহৎ, ছন্দের সমগ্র তথ্য নিয়ে কখনও মাথা ঘামাই নি, সেজন্য সবিস্তার আলোচনা আমার সাধ্য নয়। বৎসরাধিক পূর্বে শ্রীযুক্ত প্রবোধচন্দ্র সেন মহাশয়ের সঙ্গে ছন্দের শ্রেণী সম্বন্ধে পত্রযোগে কিছু আলাপ হয়েছিল। তাকে আমার মতামত যা জানিয়েছিলাম তাই এই প্রবন্ধের ভিত্তি।
.
ছন্দের মূল উপাদান মাত্রা, এবং তার বাহন syllable। সংস্কৃত ‘অক্ষর’ শব্দে syllable ও হরফ দুইই বোঝায়, তা ছাড়া ইংরেজী আর সংস্কৃতের syllable একই রীতিতে নিরূপিত হয় না। এই গোলযোগের জন্য syllable এর অন্য প্রতিশব্দ দরকার। প্রবোধবাবু ‘ধ্বনি’ চালিয়েছেন, কিন্তু এই সংজ্ঞাটিতে কিছু আপত্তি করবার আছে। Word যদি শব্দ হয়, syllable যদি ‘ধ্বনি’ হয়, তবে sound বোঝাতে কি লিখব? ব্যাকরণে vowel sound, gutteral sound ইত্যাদির প্রতিশব্দ দরকার হয়। নূতন পরিভাষা স্থির করবার সময় যথাসম্ভব দ্ব্যর্থ পরিহার বাঞ্ছনীয়। বহুকাল পূর্বে কোনও প্রবন্ধে syllable-এর প্রতিশব্দ ‘শব্দাঙ্গ’ দেখেছিলাম। এই সংজ্ঞায় দ্বার্থের আশঙ্কা নেই, কিন্তু শুতিকটু। সেজন্য এখন প্রবোধবাবুর ‘ধ্বনি’ই মেনে নিচ্ছি। আশা করি পরে আরও ভাল সংজ্ঞা উদ্ভাবিত হবে।
ধ্বনি দুই প্রকার, মুক্ত (open) ও বদ্ধ (closed)। মুক্তধ্বনির শেষে স্বরবর্ণ থাকে, তা টেনে দীর্ঘ করা যেতে পারে, যেমন তু। বদ্ধধ্বনির শেষে ব্যঞ্জনবর্ণ বা ংঃ বা দ্বিস্বর (diphthong) থাকে, তা টানা যায় না, যেমন উৎ, সং, তঃ, কই, সৌ। সংস্কৃতে দীর্ঘরান্ত মুক্ত ধ্বনি এবং বদ্ধধ্বনি গুরু বা দুই মাত্রা গণ্য হয় (ধী, উৎ), এবং হ্রস্বস্বরান্ত মুক্তধ্বনি লঘু বা এক মাত্রা গণ্য হয় (ধি, তু)। ইংরেজীতে সংস্কৃতের তুল্য সুনির্দিষ্ট দীর্ঘ স্বর নেই, কিন্তু বহু শব্দে স্বরের দীর্ঘ উচ্চারণের জন্য গুরুধ্বনি হয় (fee)। বদ্ধধ্বনিতে যদি accent পড়ে তবেই গুরু, নতুবা লঘু। বাংলা ছন্দের যে সুপ্রচলিত তিন শ্রেণী আছে তাদের মাত্রানির্ণয় এক নিয়মে হয় না। ধ্বনির লঘুগুরুতার মূলে কোনও স্বাভাবিক বৈজ্ঞানিক কারণ নেই, তা প্রচল বা convention মাত্র, এবং ভাষা ভেদে বিভিন্ন।
বাংলা ছন্দের শ্রেণীভাগ এই রকম করা যেতে পারে–
বাংলা ছন্দ
স্থিরমাত্র
অস্থিরমাত্র
সংকোচক
প্রসারক
‘স্থিরমাত্র’–যে ছন্দে ধ্বনির মাত্রা বদলায় না, যেমন বাংলা মাত্রাবৃত্ত। এতে মুক্তধ্বনি সর্বত্র লঘু, বদ্ধধ্বনি সর্বত্র গুরু। সংস্কৃতে দুই শ্রেণীর ছন্দ বেশী চলে, অক্ষরছন্দ (বা বৃত্ত) এবং মাত্রাছন্দ (বা জাতি)। এই দুই শ্রেণীই স্থিরমাত্র। সংস্কৃত মাত্রাছন্দের সঙ্গে বাংলা মাত্রাবৃত্তের সাদৃশ্য আছে; প্রভেদ এই, যে বাংলায় হ্রস্ব দীর্ঘ স্বরের উচ্চারণভেদ নেই। ইংরেজী ছন্দকেও স্থিরমাত্র বলা যেতে পারে, কারণ তাতে accent-এর স্থান সাধারণত সুনির্দিষ্ট। সংস্কৃত অক্ষরছন্দের সঙ্গে ইংরেজী ছন্দের এইটুকু মিল আছে–ইন্দ্ৰবৰ্জা মন্দাক্রান্তা প্রভৃতিতে যেমন লঘু গুরু ধ্বনির অনুক্রম সুনিয়ন্ত্রিত, ইংরেজী iambus, trochee প্রভৃতিতেও সেইরূপ।
‘অস্থিরমাত্র’–যে ছন্দে ধ্বনির মাত্রা বদলাতে পারে। এর দুই শাখা :
(ক) ‘সংকোচক’–যে ছন্দে স্থানবিশেষে বদ্ধধ্বনির মাত্রা সংকোচ হয়, অর্থাৎ গুরু না হয়ে লঘু হয়, যেমন বাংলা অক্ষরবৃত্তে। মোটামুটি বলা যেতে পারে, এই শ্রেণীর ছন্দে মুক্তধ্বনি সর্বত্র লঘু, বদ্ধধ্বনি শব্দের অন্তে গুরু কিন্তু আদিতে ও মধ্যে সাধারণত লঘু। ‘হে নিস্তব্ধ গিরিরাজ, অভ্রভেদী তোমার সংগীত’–এখানে—রাজ–মার গীত গুরু কিন্তু নিস- তব- অভ সং- লঘু। উক্ত নিয়মটি সম্পূর্ণ নয়, ব্যতিক্রম অনেক দেখা যায়। ‘বীরবর, ভারতমাতা’ প্রভৃতি সমাসবদ্ধ শব্দে এবং ‘জামরুল, মুসলমান’ প্রভৃতি অসংস্কৃত শব্দে আদ্য ও মধ্য বদ্ধধ্বনির সংকোচ হয় না, গুরুই থাকে। এই ব্যতিক্রমের কারণ–যুক্তাক্ষরের অভাব। সে সম্বন্ধে পরে বলছি।
(খ) ‘প্রসারক’–যে ছন্দে বদ্ধধ্বনি সর্বত্র গুরু; আবার স্থানবিশেষে মাত্রা প্রসারিত করে মুক্তধ্বনিকেও গুরু করা হয়। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয়। এল বান’–এখানে মাত্রাবৃত্তের তুল্য সকল বদ্ধধ্বনিই গুরু, অধিকন্তু ‘পড়ে’ আর ‘এল’-র শেষ ধ্বনিকেও টেনে গুরু করা হয়েছে।
সংক্ষেপে-স্থিরমাত্র (মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মুক্তধ্বনি সর্বত্র লঘু, বদ্ধধ্বনি সর্বত্র গুরু। সংকোচক (অক্ষরবৃত্ত) ছন্দে মুক্তধ্বনি সর্বত্র লঘু, কিন্তু বদ্ধধ্বনি। কোথাও গুরু কোথাও লঘু। প্রসারক (ছড়া-জাতীয়) ছন্দে মুক্তধ্বনি কোথাও লঘু কোথাও গুরু, এবং বদ্ধধ্বনি সর্বত্র গুরু।
.
এই ত্রিবিধ ছন্দশ্রেণীর মধ্যে মাত্রাবৃত্তের নিয়ম সর্বাপেক্ষা সরল, সেইজন্য তার আর আলোচনা করব না। অন্য দুই শ্রেণীর সম্বন্ধে কিছু বলছি।
‘অক্ষরবৃত্ত’ নামটি সুপ্রচলিত, শুনেছি প্রবোধবাবু এই নামের প্রবর্তক, কিন্তু সম্প্রতি তিনি অন্য নাম দিয়েছেন—’যৌগিক ছন্দ’। মাত্রাগত লক্ষণ অনুসারে একেই আমি ‘সংকোচক ছন্দ’ বলছি। ‘অক্ষরবৃত্ত’ নামের অর্থ বোধ হয় এই–এতে চরণের অক্ষর অর্থাৎ হরফের সংখ্যা প্রায় সুনিয়ত, যেমন পয়ারের প্রতি চরণে চোদ্দ অক্ষর, মাত্রাসমষ্টিও চোদ্দ। এই অক্ষরের হিসাবটি কৃত্রিম। ছন্দ কানের ব্যাপার, মাত্রাবৃত্ত ও ছড়ার ছন্দে পদ্যের লেখ্য রূপ অর্থাৎ বানান বা অক্ষরসংখ্যার উপর নজর রাখা হয় না, মাত্রাই একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু পদ্যকার যখন সংকোচক ছন্দ রচনা করেন তখন শ্রাব্য রূপ আর লেখ্য রূপকে পরস্পরের অনুবর্তী করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। শব্দ ও অর্থ। সমান হলেও ‘ঐ’ এক অক্ষর, ‘ওই’ দুই অক্ষর, পদ্যকার সংখ্যার উপর দৃষ্টি রেখে ‘ঐ’ বা ‘ওই’ লেখেন। উচ্চারণ একজাতীয় হলেও স্থলবিশেষে শব্দের বানান অনুসারে মাত্রা বদলায় অথবা মাত্রার প্রয়োজনে বানান বদলায়। মাত্রাবৃত্তে শর্করা’ আর ‘হরকরা’ দুইই চার মাত্রা, কিন্তু সংকোচক ছন্দে প্রথমটি তিন এবং দ্বিতীয়টি চার মাত্রা। ‘সর্দার, বাগ্দেবী’ তিন অক্ষর, কিন্তু মাত্রার প্রয়োজনে ‘সরদার, বাগদেবী’ লিখে চার অক্ষর করা হয়। যাঁরা গদ্যে, ‘আজও, আমারই’ লেখেন তাঁরাও পদ্যে, ‘আজো, আমারি’ বানান করেন, পাছে অক্ষর বাড়ে। পদ্যকার ও পদ্যপাঠক দুজনেই জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে যুক্তাক্ষরের উপর দৃষ্টি রেখে মাত্রা নির্ণয় করেন। এরকম করবার প্রয়োজন আছে এমন নয়। যদি বানান না বদলে ‘সরদার’কে স্থানভেদে চার মাত্রা বা তিন মাত্রা করবার রীতি থাকত তবে পাঠকের বিশেষ বাধা হত এমন মনে হয় না। কিন্তু যে কারণেই হোক রীতি অন্যবিধ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ‘ছন্দ’ পুস্তকে ১৪৩ পৃষ্ঠায় একটি উদাহরণ লিখেছেন—‘দিগ্দিগন্তে প্রচারিছে অন্তহীন আনন্দের গীতা।’ তিনি প্রচলিত রীতির বশেই অক্ষরসংখ্যা ঠিক রাখবার জন্য ‘দিগ্দিগন্তে’ লিখেছেন, মাত্রাবৃত্ত লিখলে সম্ভবত ‘দিগ্দিগন্তে’ বানান করতেন।
অতএব কানের উপর নির্ভর করে অক্ষরবৃত্তের সম্পূর্ণ নিয়ম রচনা করা চলে না, বানান অনুসারেও (অর্থাৎ যুক্তাক্ষর ং : ইত্যাদির অবস্থান অনুসারেও) করতে হবে। সেকালের কবিরা অক্ষর সংখ্যার উপর বিশেষ নজর রাখতেন না–সন্ন্যাসী পণ্ডিতগণের করিতে সর্বনাশ। নীচ শূদ্র দিয়া করে ধর্মের প্রকাশ। (চৈতন্যচরিতামৃত)। এরকম পদ্য এখন লিখলে doggerel গণ্য হবে। বোধ হয় ভারতচন্দ্রের আমল থেকে মাত্ৰাসংখ্যা আর অক্ষরসংখ্যার সাম্য সম্বন্ধে পদ্যকারগণ সতর্ক হয়েছেন। সম্ভবত তারা সংস্কৃত অক্ষরছন্দের আদর্শে এই সাম্যরক্ষার চেষ্টা করেছেন। হয়তো আর এক কারণ–পাঠককে কিছু সাহায্য করা। ইংরেজী পদ্যেও syllable-সংখ্যা ঠিক রাখার জন্যে miss’d lack’d প্রভৃতি বানান চলে, যদিও কানে missed আর missd দুইই সমান।
যদি বাংলায় যুক্তাক্ষর উঠে যায় বা রোমান লিপি চলে, তা হলেও সম্ভবত বর্তমান রীতি অন্য উপায়ে বজায় রাখবার চেষ্টা হবে, সরদার’ লেখা হবে sardar, কিন্তু মাত্ৰাসংকোচ বোঝাবার জন্য হয়তো সর্দার’ স্থানে লেখা হবে sa’dar।
.
প্রবোধবাবু ছড়া-জাতীয় ছন্দের নাম দিয়েছিলেন ‘স্বরবৃত্ত’, এখন তিনি তাকে ‘লৌকিক ছন্দ’ বলেন। শেষের নামটি ভাল তথাপি মাত্রাগত লক্ষণ অনুসারে আমি এই শ্রেণীকে ‘প্রসারক’ বলতে চাই। প্ৰবোধবাবুর মতে, এই ছন্দে সাধারণত প্রতি পঙক্তিতে চার পর্ব (চতুর্থটি অপূর্ণ), প্রতি পর্বে চার ধ্বনি, এবং প্রথম ধ্বনিতে প্রস্বর (accent) থাকে। শ্ৰীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ও তার ব্যাকরণে অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন। উদাহরণ—’সাম্নেকে তুই ভয় করেছিস পেছন তোরে ঘিরবে’। আমি মনে করি বাংলায় accent থাকলেও ছন্দের বন্ধনে তা অবান্তর, সাধারণত গুরুধ্বনি আর accent মিশে যায়। আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে’ ইত্যাদি চরণে প্রথম ধ্বনি ‘আ’, পাঠকালে তাতে accent পড়ে না। ‘কাশ’-এ accent আছে বলা যেতে পারে, কিন্তু বস্তুত তা গুরুধ্বনি। প্রিয়নামটি শিখিয়ে দিত সাধের সারিকারে…কালিদাস তো নামেই আছেন আমি আছি বেঁচে’–এই দুই চরণের প্রথম ধ্বনি (প্রি-, কা)তে accent দেওয়া যায় না। প্রতি পর্বে সাধারণত চার ধ্বনি তা স্বীকার করি, কিন্তু ব্যতিক্রমও হয় (শিখিয়ে দিত, তিন কন্যে)। এই রকম ছড়াজাতীয় বা লৌকিক ছন্দের একটি লক্ষণ শেষ পর্ব ছাড়া প্রতি পর্বে ছ মাত্রা, কিন্তু অন্য শ্রেণীর ছন্দেও ছ মাত্রা হতে পারে। অতএব এই ছন্দের বিশেষ লক্ষণ আর কিছু। এই লক্ষণমাত্রাপূরণের জন্য স্থানে স্থানে মুক্তধ্বনিকে টেনে গুরু করা। রবীন্দ্রনাথ ‘ছন্দ’ পুস্তকে লিখেছেন—’তিন গণনায় যেখানে ফাঁক, পার্শ্ববর্তী স্বরবর্ণগুলি সহজেই ধ্বনি প্রসারিত করে সেই পোডড়া জায়গা দখল করে নিয়েছে। ‘বৃষ্টি পড়ে’ ইত্যাদি ছড়ায় ‘বৃষ্টি’ তিন মাত্রা, শেষের এ-কার প্রসারিত করার ফলে ‘পড়ে’ও তিন মাত্রা হয়েছে। এইরকম মাত্রাপ্রসার হয় বলেই এই শ্রেণীকে ‘প্রসারক’ বলতে চাই।
পদ্যকার বানানের উপর দৃষ্টি রেখে সংকোচক ছন্দ রচনা করেন, হয়তো তার এক কারণ পাঠককে সাহায্য করা–এ কথা পূর্বে বলেছি। প্রসারক শ্রেণীর লৌকিক ছন্দেও স্থানে স্থানে ধ্বনির মাত্রা বদলায়, কিন্তু চিহ্নাদির দ্বারা পাঠককে সাহায্য করবার চেষ্টা হয় নি। এর কারণ–সেকালে এই ছন্দ পণ্ডিত জনের অস্পৃশ্য ছিল, লিখে রাখাও হত না, লোকে অতি সহজে মুখে মুখেই শিখত।