ভূমিকা

প্রকাশকের নিবেদন 

সাহিত্যসমাজ এবং সংশ্লিষ্ট জনসাধারণ বিভিন্ন সময়ে যথাযোগ্য ব্যক্তিকে অভিভাবক করে নেন। এক সময়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তারপর এলেন রাজশেখর। একই ব্যক্তির মধ্যে গল্প-লেখক পরশুরাম ও প্রাবন্ধিক রাজশেখরের অবস্থান সত্ত্বেও তাঁর সম্বন্ধে মান্যতা এমনই ছিল, রবীন্দ্র পরবর্তী যে কোনও শারদ সংখ্যায় বা কোনও সংকলনে তাঁর প্রবন্ধ বা গল্প থাকলেই তা সর্বাগ্রে স্থান পেত। সাহিত্য ও সমাজের এই অভিভাবকত্বের সংজ্ঞা নিরূপণ অসাধ্য, তবে সমাজ কতকগুলি লক্ষণ দেখেই তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেন। এই প্রসঙ্গে রাজশেখরের উক্তি উদ্ধৃত করি, গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মত—“সকল দেশেই অল্প কয়েকজন বিচক্ষণ বোদ্ধা সাহিত্যের বিচারকরূপে গণ্য হয়ে থাকেন। এঁদের কেউ নির্বাচন করে না, নিজের প্রতিভাবলেই এঁরা বিচারকের পদ অধিকার করেন। এঁরা কেবল রচনার রস বা উপভোগ্যতা দেখেন না, সমাজের উপর, তার সম্ভাব্য প্রভাবও বিচার করেন। পাঠকের আনন্দ ও সামাজিক স্বাস্থ্য দুইয়ের প্রতিই তিনি দৃষ্টি রাখেন। …সামাজিক আদর্শ চিরকাল একরকম থাকে না, সে কারণে রচনায় অল্পস্বল্প বিচ্যুতি থাকলে তিনি উপেক্ষা করেন, কিন্তু অধিক বিচ্যুতি তিনি মার্জনা করেন না। …শিক্ষিত জনসাধারণ তাঁর অভিমতই প্রামাণিক মনে করে।”

 

রাজশেখর বসুর প্রবন্ধাবলীর বিষয়ব্যাপ্তি এবং বিষয়বৈচিত্র্য পাঠকের কাছে এক বিরাট মহাদেশ উন্মোচন করে। সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ে তাঁর মতামত এক অনায়াসলব্ধ অখণ্ডনীয় কাণ্ডজ্ঞানের উদাহরণ, যা আমাদের কাছে এক দুর্লভ প্রাপ্তি। প্রবন্ধ-গ্রন্থের এবং অগ্রন্থিত প্রবন্ধাবলীর কালানুক্রমিকতা বজায় রেখেই এই প্রবন্ধাবলী প্রস্তুত হয়েছে। প্রবন্ধগুলির নামেই অবশ্য বিষয়ের প্রকাশ। এই প্রখর ও মহান্ ব্যক্তিত্বের রচনায় আপাতভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু সংশোধনের সাহস আমরা পাই নি। সম্পাদক শ্রী দীপংকর বসুর সর্ববিষয়ে সাহায্য ও শ্রী পৰিত্ৰ সরকারের ভূমিকার জন্য আমরা এঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। এই সমবেত প্রচেষ্টা পাঠকের সমাদর পাবে বলেই আমাদের একান্ত বিশ্বাস। গ্রন্থ সম্বন্ধে পাঠক ও সমালোচকদের মতামত পেলে আমরা পরবর্তী সংস্করণে সেগুলি যথাসাধ্য কার্যকর করব।

 

বিনত

সবিতেন্দ্রনাথ রায়

 

 

সম্পাদনা 

রাজশেখর বসুর সঙ্গে আমার সম্পর্ক (বংশলতা পশ্য) মেয়ের মেয়ের ছেলে, দৌহিত্রীপুত্র। দৌহিত্রী, আমার মা, বলতেন—দাদা (এবং ‘আপনি’), আমাকে শেখানো হয়েছিল—দাদু (সর্বদাই ‘তুমি’)। একদিন বললেন—আজ সুনির্মল বসু তোমাকে দূর থেকে দেখে জিগেস করলেন—আপনার নাতি? আমি বললাম—ঠিক নাতি নয়… ও তাহলে পুতি। হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন! আর একবার বলেছিলেন— আমার সঙ্গে তোমার কোনও সম্পর্কই নেই—মোক্ষম যুক্তি দিলেন—আমি মারা গেলে তোমার অশৌচও হবে না! (অশৌচ অবশ্য নিয়েছিলুম।)

আসলে ১৯৪২এ স্ত্রীবিয়োগের পর বকুলবাগানের বাড়িতে একা হয়ে যাওয়ায় আমার মা বাবা দেড় বছরের আমাকে নিয়ে তাঁর কাছে চলে আসেন। সেই থেকে আমার অহরহ রাজশেখর সান্নিধ্য—২৭ এপ্রিল ১৯৬০, পরশুরামএর শেষ প্রস্থানের দিন পর্যন্ত। তাঁর রামায়ণ মহাভারত ও পরবর্তী সব সৃষ্টির সাক্ষাৎদর্শী, প্রথম পাঠক, অনিয়োজিত একান্ত সচিব। সর্বোপরি, জ্ঞানোন্মেষ অবধি শেষদিন পর্যন্ত (প্রায় পনর বৎসর) তুচ্ছাতিতুচ্ছ থেকে গুরুগম্ভীর অসংখ্য বিষয়ে তাঁর গল্পচ্ছলে সরল শিক্ষাদান ও আলোচনা আমার শ্রেষ্ঠতম জ্ঞানলাভ। তাই দেশী-বিদেশী সাহিত্যে, এমনকি বাংলা ভাষায়ও আমার সামান্য দখল সত্ত্বেও আজন্ম দাদুর এই শিক্ষা-সান্নিধ্য-‘শ্রুতি’ এবং তাঁর কাছে আসা তখনকার প্রায় সব জ্ঞানী গুণীজনের আলোচনায় আমার অনিবার্য উপস্থিতি ও তার সঙ্গে আমার অতি খুঁটিনাটি বিষয়ের (অনেকের কাছে ‘বিরক্তিকর’) স্মৃতিশক্তি—এই সব মিলিয়ে আমার এই একদা বাংলা ভাষার অন্যতম কর্ণধার এক অনন্ত প্রতিভাধর ব্যক্তির রচনা সম্পাদনার স্পর্ধা ও অধিকার।

 

 

॥ ২ ॥

অবশ্য প্রথমে মনে হয়েছিল—সম্পাদনা! আজন্ম দেখেছি দাদু প্রুফ দেখছেন—ছাপার ভুল ছাড়া প্রতি শব্দ বাক্য, মায় কমা দাঁড়ি ড্যাশ পাণ্ডুলিপিতে যা আছে অপরিবর্তিত থাকছে। তাঁর লেখার আবার সম্পাদনা কী করব। পরে দেখলুম, দরকার আছে। প্রথমত দীর্ঘজীবনের ‘গোড়ার দিকে উত্তর বিহারের একটা মাঝারি শহরে’ (দরভঙ্গা) থাকা, বার বৎসর বয়স পর্যন্ত বাংলা-না-জানা এক বালকের পরবর্তী পঞ্চাশ বৎসরে ব্যবহারিক রসায়নের বিপুল মণ্ডলে স্বচ্ছন্দ আধিপত্যের পর সেই বাংলা ভাষারই অন্যতম কর্ণধার হওয়ার বিবর্তন, বহু বয়োজ্যেষ্ঠ মনীষীর সঙ্গে নিজমত প্রতিষ্ঠার লড়াই, বানান সংস্কারে যা সর্বোচ্চ ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত গড়িয়েছিল, শেষ পর্যন্ত জয়ী হওয়া—এসব অবশ্যই তাঁকে ক্লান্ত সংশয়াচ্ছন্ন করে রেখেছিল। নিজের কিছু মতবাদ, শব্দের বানানও বদলাচ্ছেন। কোটা রাখব? অন্যদিকে তাঁর মৃত্যুর পর চল্লিশ বৎসর (এমনকি জীবদ্দশারও শেষ দিকে অশক্তির জন্য) নজর না দেওয়ায় জমে ওঠা তুমুল মুদ্রণ প্রমাদাবলী! গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ও বাক্যের বিকৃতি ও অবলুপ্তি এই অসাধারণ সৃষ্টির বহু স্থানই কিম্ভূত করে তুলেছিল। সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।

 

এই সুবিশাল কর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে মনে হল সব বানানের সমতা আনব? তাহলে বিবর্তনের ইতিহাস লুপ্ত হবে। অতএব প্রথম দিকের সাধুভাষায় রচনার শুধু ভ্রম সংশোধিত হল, পরের চলিত ভাষায় সংশোধন ও যথাসাধ্য সমতা। কিন্তু প্রমাদ-শিখর বিরাট অন্তরায়। পাণ্ডুলিপি প্রায় কিছুই নেই। (ছাপতে পাঠিয়ে নিজের কপি রাখতেন না। প্রুফ সংশোধন ও পরবর্তী কিছু পরিবর্তন করতেন পাণ্ডুলিপি না দেখে, স্মৃতি থেকে)। অগত্যা ‘অনুমান’ এবং তিনি কী ভাবতেন, কী করতেন—সেই স্মৃতি অনুসরণ করতে হল। একটা সামান্য উদাহরণ দিচ্ছি। জীবনযাত্রা প্রবন্ধে — ‘শ্রমিকের আহার অশ্রমিকের সমান হলে চলবে না।’ ‘অশ্রমিক’ শব্দে সংশয়। এই বিশেষ প্রয়োগে রাজশেখরীয় ছোঁয়া নেই। অনেক জায়গায় রাজশেখর বসুর সঙ্গে পরশুরামের ‘মিসচিভস’ মিশ্রণ রাজশেখর-প্রবন্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য—এবং তা বলছে ওটা ‘আশ্রমিক’ হবে। এ অনুমানের সাহায্য আরও অনেক নিতে হয়েছে।

এই সূত্রে একটা সত্য কবুল করি। পরশুরাম রচনা সমগ্র বারবার পড়ে প্রায় নখদর্পণে আনলেও রাজশেখর-প্রবন্ধ এতকাল অতি অল্পই পড়েছি। এই প্রথম দাদুর সমগ্র প্রবন্ধ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পড়লুম। এক নতুন জগৎ দেখা হল। সেইসঙ্গে পঞ্চাশ বৎসরের স্মৃতি বলছে—সারাজীবন দাদুর মুখে অগণিত মজার কথা, ঘটনা, চুটকি মন্তব্য শুনেছি (তখন তাঁর মুখে বহুজন পরিচিত গাম্ভীর্যের লেশমাত্র থাকত না)। আজও, দাদুর অবর্তমানের দ্বিচ্চত্বারিংশৎ বর্ষেও আবিষ্কার করি সেসব কথা গম্ভীর অথচ সরসভাবে তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে ছড়িয়ে আছে। আর একই কথা— রাংতার মোড়কে, ঈষৎ ব্যঙ্গ মিশ্রিত হয়ে প্রচ্ছন্ন রয়েছে পরশুরামের সব গল্পে।

 

এইখানে আর এক প্রাসঙ্গিক স্মৃতি—আমার শৈশবে-কৈশোরে অনেকবার শোনা দাদুর সকৌতুক উক্তি—আমি যখন ঠাট্টা করে কিছু লিখি তখন নকল নামে লিখি, আর যখন গম্ভীর হয়ে লিখি তখন আসল নামে।

তবু স্বীকার করছি আরও গবেষণা দরকার ছিল। এগোতে এগোতে বারবার বুঝেছি বহু শব্দের সমতা থাকছে না। কিন্তু বারবার পিছনো সম্ভব নয়, সাধ্যও নয়। সান্ত্বনা এই, যে সবই তুচ্ছ, গভীর কিছু নয়। এবং অধিক তাপসের শরণ না নিয়ে পদে পদে স্মরণ করেছি শ্রীসবিতেন্দ্রনাথ রায়—ভানুবাবুকে। বহু শব্দ প্রয়োগের–সংস্কৃত হলে কথাই নেই যাথার্থ্য বিচারে (ঠিক আছে না ছাপার ভুল) তিনিই আমার অনন্য দিশারী। শংসা কিছু পেলে অবশ্যই, শঙ্কিত অভিশংসারও কিঞ্চিৎ ‘অংশ’ তাঁকে ‘গ্রহণ’ করতেই হবে। তবু বিদ্বজ্জনের কাছে যুক্তকর নিবেদন, প্রায় বিস্মৃতি, অবলুপ্তির কবল থেকে যে রত্নখনি-উদ্ধার করেছি তার ঔজ্জ্বল্য উপভোগই মুখ্য হক। আমার ছিদ্রান্বেষণ নিতান্তই গৌণ কর্ম।

 

|| ৩ ||

পরবর্তী কঠিন সমস্যা প্রবন্ধ নির্বাচন। কোটা থাকবে, কোন্টা বাদ (রিগিং-এর অপবাদ না জোটে)। একই বিষয়ের পুনরুক্তি একাধিক প্রবন্ধে আছে। স্বমত প্রতিষ্ঠায় এই ‘কর্ণেজপন’ অবশ্যম্ভাবী। আর এক বিরল প্রতিভাধর, যাঁর অশেষ স্নেহ লাভ করেছি, দাদুর এক ‘গুণমুগ্ধ, বশংবদ’ ভক্ত সৈয়দ মুজতবা আলী বলতেন—গদ্যসাহিত্যে বারবার এককথা না বললে কানে জল যাবে কী করে। গানে তার দরকার নেই, সেখানে একই লাইন ফিরে ফিরে আসে। তাই যতই পুনরুক্তি থাক, তার জন্য কোনও প্রবন্ধ ত্যাজ্য নয়। (রবীন্দ্র-প্রশস্তি যে কতবার ফিরে এসেছে ; থেমেছে মৃত্যুর কয়েকঘণ্টা আগে লেখা শেষ প্রবন্ধে।)

|| ৪ ||

সংকলন বিষয়ে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মত অনেকদিন মনে রেখেছিলুম। শরদিন্দু অমনিবাস দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত ডায়েরিতে ২৮ ভাদ্র ১৩৪০—আজ থেকে ৬৮ বৎসর আগে লেখা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক মন্তব্যের একটি—সাময়িক রচনা (topi- cal) পুস্তকাকারে বাহির করিবে না।—এর ব্যত্যয় আছে। বিষয়ের topicality যতই তামাদি হক, রাজশেখরের ভাষা, শৈলী, শব্দ প্রয়োগ, স্বল্পতম শব্দে বক্তব্যের স্বচ্ছতা সর্বকালীন। ‘টপিকলিটি’র অভাব যুক্তিতে তার পরিহার সংগত হবে না। অন্য একটি ব্যাপারও আছে। ‘উদয়ের পথে’র মুক্তির বহু বৎসর পরে ছবিটি দেখি। তখন রেশনের লাইন অবাস্তব হয়ে গেছে। তাই এতে দেখা চালের জন্য লাইন কৌতুককর লেগেছিল। তখন তা টপিকলিটি-রহিত। আরও পরে ঘটনাটি প্রবল উদ্যমে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উদিত হল; আজও তা বিদ্যমান। ক্ষণিক অবলুপ্তির পর উদয়ের পথের সে লাইন আজ আবার টপিকল। প্রায় সমস্ত ঘটনাই প্রকৃতির নিয়মে চক্রবৎ আবর্তিত হয়—দশ বিশ বা পঞ্চাশ বৎসর পরে। তার বর্জন অনুচিত।

 

এই সব ভেবেই আপাতত বিশল্যকরণীর সন্ধানে বিরত থেকে যথালভ্য সমগ্র প্রবন্ধই রাখা হল। অন্তত একটা যথাসাধ্য প্রামাণিক দলিল লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা তো হল—আরও অনেক ছিল জেনেও। আমি নিরুপায়, সে সব লুপ্ত।

|| ৫ ||

এই সুযোগে দুটি সামান্য দোষের কথা উল্লেখ করছি—আমার নয়—দাদুর। তাঁর ভাষা যতই সরল হক বহু সুপরিচিত শব্দের এমন বিকল্প রূপ ব্যবহার করেছেন যা সাধারণের নাগালের বাইরে (‘খ্যাপন’ অর্থাৎ প্রচার, জ্ঞাপন)। ‘প্রতিযোগ’ দেখে হোঁচট- খেতে হয়—ছাপার ভুলে ‘প্রতিযোগিতা’? দুটোই এক—চলন্তিকা উবাচ। অবশ্য এই ‘দোষ’ থেকে মস্ত লাভ—নতুন কিছু শেখা গেল; জানাও গেল—একটা ই-কার, একটা ত ও একটা আ-কার বাদ দিয়ে যদি শুদ্ধি বজায় থাকে তবে অযথা আড়ম্বর কেন। তবে সমগ্র প্রবন্ধে একটিমাত্র শব্দ পেয়েছি যা বোধহয় কোনও বাংলা অভিধানে নেই। প্ৰথম প্রবন্ধ নামতত্ত্বে ব্যবহৃত ‘গরদখোর নাম’। কিছুতেই যখন ভেবে পাচ্ছি না ওটা কিসের ‘প্রমাদ’ তখন হঠাৎ আবিষ্কার করলুম ওটা হিন্দী শব্দ। একটা হিন্দী অভিধানে পেয়েছি—যা গর্দ বা ময়লা খায় বা সাফ করে। তবু এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে প্রয়োগ ঠিক বোধগম্য নয়।

 

 

দ্বিতীয় দোষ, অনেক ক্ষেত্রে শব্দের ভুল বা দোষ উল্লেখ করলেও তার সঠিক বিকল্পের নির্দেশ নেই, যেমন বাধ্যতামূলক, আইন-অমান্য-আন্দোলন ইত্যাদি। বহু প্রচলিত ‘অংশগ্রহণ’এ প্রবল আপত্তির কারণ অবশ্য সোজা; ওটা ইংরেজির কণামাত্র নকল তাঁর কাছে পুরীষবৎ পরিত্যাজ্য ছিল বলে। Take part, অতএব অংশ-গ্রহণ। সাঁতারে বা আলোচনায় অংশ নেওয়া মানে? সাঁতারের কোন্ বা কতটা বখরা? খাঁটি বাংলা ‘যোগদান’ সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হল কোন্ দোষে ?

॥ ৬ ॥

এই বৃহৎ কর্মের এক প্রেরণা কয়েক বৎসর আগে কলকাতা দূরদর্শনে এক আলোচনায় শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকারের উক্তি—আগেকার সেসব চমৎকার লেখা আর কোথায়, রাজশেখর বসুর কত বিস্তৃত ক্ষেত্রে কত সরস স্বচ্ছন্দ প্রবন্ধ। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এই সংকলনে তাঁর ভূমিকার জন্যও আমি ধন্য। সত্যই অমূল্য তাঁর কৃত দাদুর রচনার মূল্যায়ন।

কিছু প্রবন্ধ সামান্য টীকাভারাক্রান্ত করার লোভ সামলাতে পারিনি— গভীর বিশ্বাস নিয়ে, যে তা নিতান্ত বিরক্তিকর লাগবে না।

 

সব প্রবন্ধের রচনাকাল দাদু বঙ্গাব্দে (১৩…) লিখতেন। বিজ্ঞানসম্মত শকাব্দ প্রচলনের পর তাই (১৮…) লিখেছেন। কিন্তু আমি লজ্জিত; এখনও সময়ের সঠিক পরিপ্রেক্ষিত পাওয়ার জন্য খ্রিষ্টাব্দই সহজ, তাই প্রতি রচনায় বঙ্গ-শকের সঙ্গে আনুমানিক খ্রিষ্টাব্দ দেওয়া হল।

[তবু বিকটতম মাছিমারাটা দেখতে হয়নি—work culture। ওয়র্ক মানে কর্ম, কালচর অবশ্যই একমেবদ্বিতীয়ম্ সংস্কৃতি—অর্থাৎ কর্মে অবহেলা কর না, খুব সংস্কৃতি— গান বাজনা চালাও। রীতিমতন ওয়াক (বমি) কালচর। বিশুদ্ধ কর্মনিষ্ঠাকে গুমখুন করা হল কোন্ মহাপাতকে? নানান ইনফেকশন লেগে থাকলে কি যেন একটা কালচর করা হয়—কি একটা সংস্কৃতি !]

অপর এক অপরিচিতজনকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করছি। Statesman পত্রিকার উল্লেখ দাদুর অনেক প্রবন্ধে আছে। অগস্ট ২০০০এ তারই এক রবিবাসরীয় Impressionএ শ্রীজ্যোতি সান্যাল মহাশয় লিখেছিলেন—

 

Indians who wish to write good English need to first study writing in our regional languages. Bengalis have in short stories by Parashuram and Rabindranath Tagore perhaps the world’s best models for precision and economy of languages. In his first three collections… Parashuram’s prose defies editing. Not a word is excess; every sentence is stripped to its cleanest component.

দাদুর মৃত্যুর চল্লিশ বৎসর পরে তাঁর সম্বন্ধে এই এক অদৃষ্টপূর্ব মন্তব্য পেলুম, যা তাঁর প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারি একে তিনি তাঁর সাহিত্যজীবনের এক বিরাট সম্মান মনে করতেন।

অনেক হাটের মাঝে এবার দাঁড়ি দিচ্ছি ।

দীপংকর বসু
১৫.০৮.২০০১

.

ভূমিকা 

রাজশেখর বসু-পরশুরাম (১৮৮০-১৯৬০) যাকে বলেন ‘ললিত সাহিত্য’, (ইদানীং আমরা যাকে বলি সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম)—তা রচনা করা তাঁর পক্ষে যতটা আকস্মিক ও অভাবিত, প্রবন্ধরচনা ততটা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন-বিজ্ঞানের উজ্জ্বল ছাত্র, পরবর্তীকালে বেঙ্গল কেমিক্যালের জবরদস্ত প্রশাসক, অসাধারণ এক অভিধানকার এবং ভাষা-নিয়ামক রাজশেখর তাঁর ন-টি গল্পের বইয়ের প্রায় একশোটি গল্পের একটিও লিখলেন না, এমন হতেই পারত, হওয়াই খুব স্বাভাবিক ছিল। হয়তো কেবল সংকলন করলেন ‘চলন্তিকা’ (১৯৩০), লিখলেন ‘লঘুগুরু’ (১৯৩৯/১৩৪৬), ‘কুটিরশিল্প’ (১৯৪৩/১৩৫০), ‘ভারতের খনিজ’ (১৯৪৩/১৩৫০), ‘বিচিত্তা’ (১৯৫৫/১৩৬২), ‘চলচ্চিন্তা’ (১৯৫৮/ ১৩৬৫) ইত্যাদি গ্রন্থের অন্তর্ভূত এবং অগ্রন্থিত নানা প্রবন্ধ। তাহলে তা আমাদের মনে খুব একটা বিস্ময় উৎপাদন করত না। তাঁর যে শিক্ষাদীক্ষা, কর্মক্ষেত্র, উপরন্তু ভাষা সম্বন্ধে ব্যক্তিগত অভিনিবেশ ও বিশেষজ্ঞতা—তাতে এ ধরনের রচনা তাঁর কলম থেকে মোটেই অনপেক্ষিত নয়। তারও উপরে তিনি যে অনুবাদ করলেন ‘মেঘদূত’ (১৯৪৫/১৩৫২), বাল্মীকির রামায়ণ (১৯৪৬/১৩৫৩), ব্যাসদেবের মহাভারত (১৯৪৯/১৩৫৬), এবং ‘শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা’ (১৩৬৮)— তাও আমরা স্বাভাবিক বলে মেনে নিতেই পারি, কারণ তখনকার দিনে বিজ্ঞানের ছাত্ররাও সংস্কৃত ভাষায় অনেকেই বিশেষ পারদর্শী হতেন। আর রাজশেখরের পিতা চন্দ্রশেখরের সংস্কৃত ভাষা এবং বেদান্তদর্শনে গভীর অনুপ্রবেশ ছিল, বাড়িতে সংস্কৃতভাষা সমাদৃত ছিল, চন্দ্রশেখর বেদান্তের নানা বিষয়ে একাধিক ভাষ্যপুস্তক রচনা করেছিলেন। রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদ-নিয়ন্ত্রিত গুরুগম্ভীর ভাষার পাশে রাজশেখরের অত্যন্ত সহজ শিশুবোধ্য ভাষায় পুনঃকথিত ‘হিতোপদেশের গল্প’ (১৯৫০/১৩৫৭) হয়তো একটু সচকিত করে। তবু সহজ সরল অন্তরঙ্গ ভাষায় বাংলা লেখাও সম্ভবত তাঁর পারিবারিক ঘরানার অন্তর্গত ছিল। তাঁর বাবার কোনো রচনা আমাদের দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু যিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিষ্যস্থানীয় এবং ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র নিয়মিত লেখক ছিলেন, তাঁর ভাষাশৈলীর আদর্শ দেবেন্দ্রনাথের অতিশয় প্রসাদগুণসম্পন্ন গদ্য হওয়াই সম্ভব। তাঁর দাদা শশিশেখরের বাংলা গদ্যও ছিল স্বচ্ছ ও সরসতাপূর্ণ।

শুধু উপরে তালিকাবদ্ধ সব গ্রন্থের রচয়িতা—তাঁর প্রধান সব অনুবাদও এক ধরনের রচনাকর্ম—হয়ে থাকলে তিনি কেবল রাজশেখর বসুই থাকতেন, পরশুরাম হতেন না—এ তো সংগত সিদ্ধান্ত।

এই কথা বলা সত্ত্বেও আমরা রাজশেখর এবং পরশুরামের মধ্যে কোনো স্থায়ী বিভাজন রচনা করতে চাই না। আমরা অন্যত্র প্রমথনাথ বিশীর এই কথা সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারিনি যে, “এই দুই নামের স্বাতন্ত্র্য তিনি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বজায় রেখেছেন, এমন আর কোনো লেখক রাখতে পেরেছেন কি না সন্দেহ।” পরশুরাম রাজশেখরের কাছে নিশ্চয়ই হাত পেতেছেন তাঁর গল্পগুলির অন্তবর্তী বিপুল অভিজ্ঞতা বৈচিত্র্যের জন্য, কিন্তু রাজশেখরের প্রবন্ধেও মাঝে মাঝে পরশুরামের ছায়া পড়েছে। “আমিষ ও নিরামিষ” (‘চলচ্চিন্তা’) প্রবন্ধে সরস সংলাপ গ্রন্থনা ও বক্তাদের সংলাপবাহিত চরিত্রচিত্রণ, ‘লঘুগুরু’-র “প্রার্থনা”-য় গল্পের প্রাক্‌সূত্র, ‘বিচিন্তা’র “ভেজাল ও নকল” এবং “সমদৃষ্টি” প্রবন্ধে নিজের জীবনখণ্ডের দুটি ছিন্ন চিত্র দিয়ে গল্পের ধরনে প্রবন্ধের উপক্রম রচনা—ইত্যাদি রাজশেখরের পিছনে পরশুরামের অদৃশ্য উপস্থিতির প্রমাণ। একেবারে বিশুদ্ধ জ্ঞাপনাত্মক (শুধু জানানোর জন্য লেখা) প্রবন্ধ অবশ্যই আছে ‘ভারতের খনিজ’ বা ‘কুটিরশিল্প’ যেমন—কিন্তু তাঁর গল্প ও প্রবন্ধ উভয়ে যে উভয়ের কাছ থেকে মনোভঙ্গি, শৈলী ও অভিজ্ঞতার (জীবন ও গ্রন্থগত) নানা সূত্র গ্রহণ করেছে তা আমরা লক্ষ করব। বিশেষ করে সামাজিক এবং সামাজিক আচরণ ও বিশ্বাসগত নানা প্রবন্ধেই এমন প্রবন্ধ-প্রকরণের সীমা ভাঙার প্রবণতা যেন একটু বেশি।

তবু গল্প গল্পই, প্রবন্ধ প্রবন্ধ। উভয়েই পাঠকের কাছে কিছু বলতে চায়, কিন্তু দুয়ের লক্ষ্য ও বলার ভঙ্গি মূলত পৃথক, ফলে দুয়ের প্রতি পাঠকের সাড়াও ভিন্ন, এবং দুয়ের পাঠকচরিত্রও এক নয়। গল্পসাহিত্য সাধারণ ও ব্যাপক পাঠকসমাজকে লক্ষ করে, প্রবন্ধ সাহিত্য বেশির ভাগ সময়ে এই ব্যাপক পাঠকসমাজের দ্বারা গৃহীত হয় না। কখনও তা একেবারেই বিশেষ জ্ঞান বা সংবাদমুখী পাঠকের প্রত্যাশী, যেমন অভিধান ভাষাতত্ত্ব পরিভাষা, বানান সমতা ইত্যাদি সংক্রান্ত বা ‘ভারতের খনিজ’ জাতীয় প্রবন্ধে, আবার কখনও তা তুলনায় একটু ব্যাপক পাঠকদের জন্য প্রস্তুত হয়, যেমন পোশাক, খাদ্যাখাদ্য, বিশ্বাস কুসংস্কার, সমদৃষ্টি ইত্যাদি মূলত সামাজিক প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা নানা প্রবন্ধে। পরশুরাম দীর্ঘদিন ধরে, গল্পরচনার প্রায় অব্যাহত ধারাবাহিকতার ফাঁকে ফাঁকে প্রবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তাঁর এসব প্রবন্ধ সব সময় স্বতঃস্ফূর্ত উপলক্ষ্যে লেখা হয়নি। ‘ভারতের খনিজ’ বা ‘কুটিরশিল্প’ বিশ্বভারতীর অনুরোধে লেখা, সে অনুরোধ না এলে তিনি লিখতেন কি না সন্দেহ। আবার বেশ কিছু নৈমিত্তিক প্রবন্ধ আছে যা হয়তো সেই মুহূর্তের কোনো উপলক্ষ্যের তাগিদে কোনো সম্পাদকের অনুরোধে লেখা, নাতিদীর্ঘ, অবিশদ, কিছুটা দায়পালনের প্রয়াস দ্বারা চিহ্নিত, যেমন ‘চলচ্চিন্তা’-র “অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর”, “বিচিন্তা’-র “কবির জন্মদিনে” ইত্যাদি। কিন্তু বেশির ভাগ প্ৰবন্ধ, যেগুলিতে একটি প্রসঙ্গ নানা উদাহরণ ও আলোচনার সাহায্যে অল্পাধিক বিস্তারিত রূপ পেয়েছে, তাঁর নিজস্ব কর্ম ও অভিজ্ঞতার উৎস থেকে আরব্ধ এবং রূপায়িত। এগুলি যেন তাঁর জীবন ও কর্মের সম্প্রসারণ, শুধু ভাবনার নয়। ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধগুলিকে এই পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু এ সম্বন্ধে আরও আলোচনার আগে, গ্রন্থ, অভিধানের সঙ্গে যুক্ত বাংলা ব্যাকরণতত্ত্ব, অনুবাদের ভূমিকা ও ভাষ্য ইত্যাদি বাদ দিয়ে এ গ্রন্থে যে সব প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে সেগুলির একটা মোটামুটি শ্রেণীবিভাগ করার চেষ্টা করি।

ভাষা ও বানান সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি বিশেষার্থী ও বিশেষজ্ঞ পাঠকের জন্য। সেগুলির মধ্যে একটি প্রায় অক্ষুণ্ণ ধারাবাহিকতা আছে, ‘লঘুগুরু’ থেকে আরম্ভ করে ‘চলচ্চিন্তা’ পর্যন্ত তিনটি নিছক প্রবন্ধের সংকলনেই একাধিক এ ধরনের প্রবন্ধ আছে, এ ছাড়াও একই বিষয়ে যেমন আছে অগ্রন্থিত কিন্তু পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্ৰবন্ধ, তেমনই আছে নানা জিজ্ঞাসু ব্যক্তিকে লেখা চিঠি। আগেই বলেছি, এগুলি ভাষা বানান পরিভাষা ইত্যাদির ক্ষেত্রে রাজশেখরের নানা কর্ম ও দায়িত্বের সূত্রে রচিত। রাজশেখর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিভাষা ও বানান সংস্কারের জন্য প্রতিষ্ঠিত উভয় সমিতির (১৯৩৪, ১৯৩৫) সর্বমান্য সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। সমিতিতে সুনীতিকুমারের উপস্থিতি এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ সত্ত্বেও তিনি যে এদুটি দায়িত্বের সম্পূর্ণ যোগ্য ছিলেন, তা তাঁর এ লেখাগুলি পড়লেই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়। এই প্রবন্ধগুলি হল—’লঘুগুরু’-র “নামতত্ত্ব”, “ভাষা ও সংকেত”, “সাধু ও চলিত ভাষা”, “বাংলা পরিভাষা”, “ভাষার বিশুদ্ধি”, “বাংলা বানান”, “বাংলা ছন্দের শ্রেণী”; ‘বিচিত্তা’তে আছে “ভাষার মুদ্রাদোষ ও বিকার”, “বাঙালীর হিন্দীচর্চা”, “বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান”, “বাংলা ভাষার গতি”; আর ‘চলচ্চিন্তা’য় এ সংক্রান্ত লেখাগুলি হল “বানানের সমতা ও সরলতা”, “আচার্য উপাচার্য”। অগ্রন্থিত লেখার মধ্যে পাচ্ছি “ভুল নাম ও নকল জিনিস”, “বাংলা বানানের নিয়ম” (এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার সমিতির সুপারিশগুলির (তৃতীয় সংস্করণ, মে ১৯৩৬) পুনর্মুদ্রণ ঘটেছে, তবে রাজশেখরের একটি ছোটো ভূমিকা, এবং রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের চিঠির—(আসলে রবীন্দ্রনাথের চিঠি, শরৎচন্দ্র তাঁর স্বাক্ষরের নীচে স্বাক্ষর করেছেন মাত্র)–প্রতিলিপি আছে। দুটিই ‘দেশ’ সাপ্তাহিকে প্রকাশিত। এ ছাড়া আছে কিছু চিঠি ও অমুদ্রিত পাণ্ডুলিপি— একটি জামসেদপুরের প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক সুস্থিরকুমার বসুকে লেখা (২৪/১২/৪০), ‘বাঙ্গালা ভাষার আধুনিক রূপ ও তাহা সর্বজনমান্য করিবার উপায়’ সম্বন্ধে, আর একটি অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের “সরকারী কার্যে ব্যবহার্য পরিভাষা” প্রবন্ধের প্রতিক্রিয়ায় লেখা, ৫-৯- ৪৮ তারিখের পাণ্ডুলিপি। আরও একটি পাণ্ডুলিপি আছে সরকারি পরিভাষা সম্বন্ধে এবং এ সংক্রান্ত শেষ লেখাটি হল ‘বাংলা অক্ষরের’ সংস্কার। পাণ্ডুলিপি ও পত্রগুলি কোথাও মুদ্রিত হয়েছিল কি না সে বিষয়ে উপযুক্ত তথ্য আপাতত আমাদের কাছে নেই

সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধগুলির মধ্যে আছে ‘লঘুগুরু’-র “রস ও রুচি”, “সাহিত্যবিচার”, “সংকেতময় সাহিত্য”, “রবীন্দ্র-পরিবেশ, “রবীন্দ্র-পরিবেশ”, — চলচ্চিন্তা’-র “অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর”, “গল্পের বাজার”, “সাহিত্যের পরিধি”, “কবির জন্মদিনে” “সাহিত্যিকদের ব্রত”; বিচিন্তার’ “নিসর্গচর্চা”, “সংস্কৃতি ও সাহিত্য” এবং অগ্রন্থিত “ছোটগল্প বলতে কি বোঝায়”।

সমাজ-মানসিকতা ও সামাজিক প্রথা, স্বভাব ও আচরণ বিষয়ে তাঁর একাধিক প্রবন্ধ আছে। ‘লঘুগুরু’-র “ডাক্তারি ও কবিরাজি”, “ভদ্র জীবিকা”, “ঘনীকৃত তৈল”, “খ্রিষ্টীয় আদর্শ”, “তিমি’”; ‘চলচ্চিন্তা’-র “আমাদের পরিচ্ছদ”, “আমিষ-নিরামিষ”, ’বিচিন্তা’- র “বিলাতী খ্রিষ্টান ও ভারতীয় হিন্দু”, “ভেজাল ও নকল”, “জীবনযাত্রা”, “জন্মশাসন ও প্রজাপালন”, “সমদৃষ্টি”, “অশ্রেণিক সমাজ” তার মধ্যে পড়বে। ব্যাপকতর ভাবে জাতীয় রাজনৈতিক প্রসঙ্গগুলিও হয়তো আসবে, যেমন ‘চলচ্চিত্তা’-র “স্বাধীনতার স্বরূপ”, “বিচিন্তা’-র “ভারতীয় সাজাত্য”, এবং অগ্রন্থিত “বঙ্গ-বিহার”।

আমাদের বিশ্বাস, সংস্কার ও বিজ্ঞানভাবনা নিয়ে রাজশেখরের কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ আছে। তার মধ্যে কিছু সামাজিক প্রবন্ধও অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যেমন ‘লঘুগুরু’-র “ডাক্তারি ও কবিরাজি”। কিন্তু ওই বইয়েরই “অপবিজ্ঞান”, “প্রার্থনা” এবং “বিচিন্তা’- র “ইহকাল পরকাল” ও “বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি”-কে আলাদা করে তালিকাবদ্ধ করতে হয়। শিক্ষা সম্বন্ধে পাই একটিমাত্র পৃথক প্রবন্ধ, ‘চলচ্চিত্তা’-র “শিক্ষার আদর্শ”। আর আছে তিন জন অসাধারণ বাঙালির জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত আলোচনা, আগে অগ্রন্থিত—“লোকহিতৈষী প্রফুল্লচন্দ্র”, “কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়” ও “ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়”।

আমরা আগেই বলেছি, বিষয় অনুসারে প্রবন্ধাবলির এ ধরনের বিভাজন খানিকটা কৃত্রিম ও সুবিধা-নির্দেশিত। এক বিষয় নানা প্রসঙ্গে অনুপ্রবিষ্ট হতে পারে, কিন্তু মূলত বিষয়ের প্রাধান্য ও প্রাথমিকতাকে ভিত্তি করে এ ধরনের বিভাগ করে নিলে আলোচনার পক্ষে সুবিধা হয়। দ্বিতীয়ত, বিষয়-অনুযায়ী তালিকা থেকে আমরা বুঝতে পারি রাজশেখরের প্রধান ও স্থায়ী মনোযোগের প্রসঙ্গ কোন্‌গুলি ছিল, এবং তাঁর মনোযোগ আর অগ্রাধিকারের একটি ক্রমও এভাবে হয়তো নির্দেশ করা চলে। হয়তো, কিন্তু সম্পূর্ণত নয়। কারণ লেখাগুলির প্রত্যেকটির বিস্তার ও ভাবনার নানামুখিতা তাঁর মনোযোগের আর একটি প্রমাণ, “আমিষ ও নিরামিষ” প্রবন্ধটি যার নিদর্শন। তবু ভাষা-সংক্রান্ত প্ৰবন্ধ যেখানে তিনি লিখছেন ১৯২৩ থেকে, এবং শেষ লেখাটি লিখেছেন ১৮৮০ শকে, সম্ভবত ১৯৫৮-তে। আর নানা সময়ে লিখেছেন তিনি মোট কুড়িটি প্রবন্ধ বা পত্রপ্রবন্ধ। সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ আছে বারোটি, কিন্তু সবগুলি সমান বিশদ নয়, বোঝাই যায় সেগুলি ‘অনুরোধে বা উপলক্ষ্যে’র তাগিদে লেখা। সমাজ ও রাজনীতি বিষয়ক লেখা ষোলোটি, ফলে বিষয়ের এবং অভিনিবেশের গুরুত্বে, আমাদের মনে হয়, এগুলির স্থান ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধগুলির পরেই, যদিও “বঙ্গ-বিহার”-এর মতো দু-একটি লেখা স্পষ্টতই উপলক্ষ্যতাড়িত। আবার “লোকহিতৈষী প্রফুল্লচন্দ্র” নিবন্ধটিকে এর মধ্যেও পার্শ্বিকভাবে স্থান দেওয়া যায়। বিজ্ঞান, বিশ্বাস ও সংস্কার নিয়ে লেখা চার-পাঁচটি প্রবন্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ, যেমন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা-বিষয়ক প্রায় নিঃসঙ্গ প্রবন্ধটি, “শিক্ষার আদর্শ”। ফলে গুরুত্বের নানা প্রমিতি ও মাত্রা অনুযায়ী তাঁর অগ্রাধিকারকে বিচার করেই এ সম্বন্ধে আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করতে হবে।

আসলে রাজশেখরের প্রবন্ধাবলি যদি প্রসঙ্গ অনুসারে সংকলিত ও গ্রন্থিত হত, তাহলে আমাদের দায়িত্ব কমত, তাঁর মনন ও সংবেদনের ক্ষেত্র খুব সহজেই নির্দেশ করা যেত। কিন্তু এক-একটি বইয়ে নানা প্রসঙ্গের রচনার বিমিশ্র সংকলন প্রস্তুত হওয়ায় তাঁর লেখাগুলিকে আমাদের মতো করে সাজিয়ে নিতে হয়েছে।

ভাষাবিষয়ক প্রবন্ধাবলিতে তাঁর চিন্তা বহুধা ও বিচিত্র। কখনও শব্দ ও অর্থের সম্বন্ধ এবং অর্থানুযায়ী উপযুক্ত শব্দের প্রয়োগ বা নির্মাণ (শব্দার্থ-তত্ত্ব বা সিম্যানটিক্স), কখনও বাংলা ভাষার শৈলীগত আদর্শের চিন্তা, কখনও বর্তমান সাহিত্যের উপযুক্ত বাহন কোন্ উপভাষা হবে সে বিষয়ে ভাবনা, কখনও বা ভাষার লিখিত রূপের শারীরিক পরিচর্যা—যা ভাষার আদর্শায়নের পক্ষে জরুরি। বাংলা ছন্দের শ্রেণিবিভাগের উপরেও দুটি প্রবন্ধ আছে।

“নামতত্ত্ব” প্রবন্ধটি দাঁড়িয়ে আছে একটি নৈয়ায়িক প্রশ্নের উপর, নাম ও নামীর কোনো গুণগত অভেদ থাকে কি না, বিশেষত proper name-এর connotation আছে কি না। ভাষাবিজ্ঞান ও যুক্তিবিজ্ঞান বলে, নেই। তবু সরস কৌতুকছলে রাজশেখর নামের লৌকিক ও আক্ষরিক অর্থ যদি কোনোভাবে ব্যক্তি বা সমাজ গ্রহণ করে তাহলে কী বিভ্ৰাট দাঁড়ায় তা নিয়ে নানা জল্পনা করেছেন। তারই মধ্যে পদবির বানান, শ্রী ও মিস্টার, শ্রীমতী ও মিস্ বা মিসেস্ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর সংগত সুপারিশ আছে। “ভাষা ও সংকেত” নামে সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধটিতে অর্থের আর একটি মাত্রা—ব্যঞ্জনা, যার বাহন “সর্বথা নমনীয় নির্বাধ ভাষা”— তা-ই যে সাহিত্যের যথার্থ ভিত্তি তা প্রতিষ্ঠা করেছেন পরিভাষা দরকার, কিন্তু ‘ললিত সাহিত্যে’ নয়। ব্যঞ্জক দরকার, কিন্তু বিজ্ঞানের প্রবন্ধে নয়। পরিভাষার ব্যঞ্জনারিক্ততা তাকে সাহিত্যে ব্যবহারের অযোগ্য করে রাখে। এ প্রবন্ধটি, মনে হয়, আরও বিশদ হতে পারত। ‘চলচ্চিত্তা’-র একটি প্রবন্ধ “সাহিত্যের পরিধি”-তে এই নাম সত্ত্বেও শব্দার্থতত্ত্বই মূল আলোচ্য,—কীভাবে বিভিন্ন লোক একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ ধরে নিয়ে অর্থহীন তর্কে কাল ও শক্তিক্ষয় করে। নিপুণ অভিধানকার রাজশেখর জানতেন, ভাষার সাধারণ শব্দমাত্রেরই একাধিক অর্থ থাকে, এখানেই একার্থমাত্রিক পরিভাষার সঙ্গে সেগুলির তফাত। তবে এই বহু-অর্থকতার মাত্রা ও স্তর সব শব্দের ক্ষেত্রে সমান নয়। কোনো কোনো অর্থ মূলের বিভাজন, বিস্তার বা বিবর্তন, কোনো কোনো অর্থ সম্পূর্ণত ভিন্ন উৎস থেকে এসে এক শব্দের শরীরে ঢুকে গেছে, যেমন রাজশেখরের দৃষ্টান্তে ‘ঘোড়া’ (‘চতুষ্পদ দ্রুতগামী তৃণভোজী জন্তু’, আর ‘যা টিপলে বন্দুকের আওয়াজ হয়’)। এগুলি আসলে এক শরীরে দুটি (বা তার বেশি) শব্দ। “আচার্য উপাচার্য” প্রবন্ধে (‘বিচিন্তা’) রাজশেখরের পরিভাষা-জনিত উদ্‌বেগের কারণ তার প্রয়োগযোগ্যতা ও যথার্থতা শুধু নয়, একটি সার্বিক ব্যবস্থার মধ্যে তার স্থান, তাতে একটির সঙ্গে আর একটি পরিভাষার সম্পর্ক। দুর্গামোহন ভট্টাচার্যের সুপারিশ মেনে তিনি আচার্য-এর (চ্যান্সেলর) জায়গায় চেয়েছেন ‘মহাধিপাল’, ‘উপাচার্য’-এর জায়গায় ‘অধিপাল’। আমার মনে হয় এ সুপারিশ আমাদের গ্রহণ করা উচিত ছিল। আসলে “কালক্রমে অনেক শব্দের মানে বদলায়” এবং এক শব্দের একাধিক অর্থ দাঁড়িয়ে যায়—এই দুই বিপত্তি এড়ানোর জন্যই যে পরিভাষা নির্মাণ করতে হয় তা রাজশেখর খেয়াল করেন। এগুলি হল পরিভাষা- নির্মাণের তাত্ত্বিক বা নৈয়ায়িক ভিত্তি বা যুক্তি। “গ্রহণীয় শব্দ”-তে পরিভাষা গ্রহণে তাঁর যে একটি উদারনীতি তা লক্ষ করে আমাদের ভালো লাগে। যথার্থ ব্যাকরণসম্মত পরিভাষা যেমন চাই (‘নিষ্প্রদীপ’ নয় ‘অপ্রদীপ’), তেমনই ‘পিগ্‌-লোহা’-তেও তাঁর আপত্তি নেই। নানা প্রচলিত পরিভাষার ব্যাকরণগত বিচারে তাঁর ব্যাকরণ-সতর্ক মনটি অবশ্য বেরিয়ে পড়ে। অগ্রন্থিত “ভুল নাম ও নকল জিনিস”-এ বিজ্ঞাপনে বিক্রেতার স্বার্থে কীভাবে ভুল পরিভাষা তৈরি করে লোক-ঠকানোর ব্যবস্থা চলে তা চমৎকার দেখিয়েছেন। ‘লঘুগুরু’র “বাংলা পরিভাষা” পরিভাষা সম্বন্ধে একটি পূর্ণাঙ্গ তাত্ত্বিক বিচার, এবং ভারতীয় ও বাংলা ভাষায় যাঁরা পরিভাষা রচনা করেন তাঁদের অবশ্যপাঠ্য।

ওই প্রবন্ধে এবং সরকারি পরিভাষা সংক্রান্ত দুটি অগ্রন্থিত প্রবন্ধে রাজশেখর পরিভাষা-নির্মাণের তাত্ত্বিক যুক্তির বাইরে এসে কিছু ‘শারীরিক’ যুক্তি তৈরি করেছেন, বলেছেন ইংরেজি পরিভাষাকে যদি স্থানচ্যুত করতে হয় তবে ১. সর্বভারতে প্রচলনযোগ্য ‘ভারতীয়’ পরিভাষা চাই, কিন্তু ২. জনপ্রিয় প্রচলিত ফারসি ও ইংরেজি শব্দ চলতেই পারে, তবে ৩. সংস্কৃত শব্দের কাছেই বেশি করে হাত পেতে পরিভাষা সৃষ্টি করতে হবে। অগ্রন্থিত ওই দুটি পাণ্ডুলিপি আসলে মূলত একই লেখার প্রতিলিপির মতো—তা নিশ্চয়ই পাঠকেরা লক্ষ করবেন। তবে পরিভাষা থেকে অ-পরিভাষায় রাজশেখরের পরিক্রমা ভাষার একদিককার একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করে। সুনির্দিষ্ট অর্থ থেকে অনির্দিষ্ট, ব্যঞ্জিত, বিভক্ত, বিবর্তমান, অস্থায়ী ইত্যাদি নানা অর্থের মধ্যে যে ভাষার বাসস্থান তা তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না।

আর-একটা জিনিস চমৎকৃত হয়ে দেখি। বিশেষ করে শব্দার্থের বিবেচনা শুধু তাঁর কাছে আর ব্যাকরণবিদের শুষ্ক বিবেচনা থাকে না, তা সামাজিক মঙ্গল-অমঙ্গল সম্বন্ধে তাঁর চিন্তার সঙ্গেও প্রায়ই মিশে যায়। “ভুল নাম ও নকল জিনিস” নিবন্ধটি তার নিদর্শন।

আসলে পরিভাষা যেমন অর্থের দিক থেকে শব্দকে সুনির্দিষ্ট করে, এবং ভাষার মনন, যুক্তি ও বৈজ্ঞানিকতার ভিত্তি সবল করে, তেমনই অন্যদিকে অতিকথন, উচ্ছ্বাসপ্রবণতা, শব্দাড়ম্বর ও ভাষার অস্পষ্টতাকে ধ্বংস করে। ফলে ভাষার ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে ও কঠোরভাবে বিজ্ঞানমনস্ক এবং ঋজুকথন-প্রিয় রাজশেখর ছিলেন সমস্ত অস্পষ্টতা ও অতিকথনের প্রবল শত্রু! ‘লঘুগুরু’-র “ভাষার বিশুদ্ধি”-তে সেই ১৯৪৩ থেকেই তিনি আমাদের সতর্ক করছেন, ‘পূর্বাহ্ণেই’ না লিখে ‘পূর্বেই’ লেখা যায়, ‘কার্যকরী’-র বদলে ‘কার্যকর’ দিব্যি চলে, ‘পরিস্থিতি’-র বদলে ‘অবস্থা’ যেমন। প্রমথনাথ বিশীর একটি গল্পে, মনে পড়ছে, কাগুজে ভাষার এই ‘পরিস্থিতি’ নিয়ে ব্যঙ্গ ছিল। এইসব কাগুজে ‘জার্নালিজ’ (journalesc) অপ্রপ্রয়োগ সাধারণ লেখাতেও বিস্তারিত হয়েছে, তার আলোচনা তিনি করেছেন ‘বিচিন্তা’-র “ভাষার মুদ্রাদোষ ও বিকার” প্রবন্ধে, যেখানে আরও বহু এরকম দৃষ্টান্ত তুলেছেন তিনি : ‘ব্যর্থ হইবে’ না লিখে ‘ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইবে’, ‘হিন্দীভাষী’ না লিখে ‘হিন্দীভাষাভাষী’ লেখা যেমন। সংস্কৃত শব্দের ভুল অর্থে প্রয়োগ এরকম আর একটি দোষ। নামকরণে (সন্তান থেকে দোকানের) যে ধরনের স্বপ্নবিলাস দেখা যায়, তা রাজশেখরের মতে, কেবল বাঙালির পক্ষেই সম্ভব। এ বইয়ের “বাংলা ভাষার গতি” প্রবন্ধেও এই প্রসঙ্গ অংশত আলোচিত হয়েছে। রাজশেখর লক্ষ করেছেন, “বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান” রচনার প্রধান কণ্টক এইগুলি, শুধু পরিভাষার অভাব নয়। সেই সঙ্গে আছে ইংরেজি থেকে আক্ষরিক অনুবাদের কৃত্রিম ও আড়ষ্ট শৈলী, কখনও-বা অকারণ উচ্ছ্বাস ও কাব্যিকতা, কখনও নিখাদ অল্পজ্ঞান।

ভাষার, বিশেষত লিখিত ভাষার শারীরিক প্রসঙ্গগুলির মধ্যে দুটি প্রধান। একটি বর্ণমালা ও লিখনরীতির সংস্কার, অন্যটি বানানের সরলতা ও সমতাবিধান। একটি আর- একটির উপর অংশত নির্ভরশীল—রেফের নীচে একটি ব্যঞ্জন লিখলেই বানান সরল হবে। “বাংলা অক্ষরের সংস্কার” প্রবন্ধে তিনি যে-সব সুপারিশ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে উদার হল বাংলা লিখতে রোমক লিপির ব্যবহার। এ কাজে কী অসুবিধা তা আমরা অন্যত্র, (“ভাষা দেশ কাল’ বইয়ের “রোমক লিপি ও ভারতীয় ভাষা” প্রবন্ধে ) দেখিয়েছি। কিন্তু অন্যান্য সুপারিশ, যথা কিছু যুক্তব্যঞ্জন হস্ চিহ্ন দিয়ে ভাঙা, যুক্তব্যঞ্জনের ‘স্বচ্ছতা’, তুচ্ছ কারণে বর্ণবাহুল্য (আগে ও মধ্যে দু-রকমের এ-কার) ইত্যাদি বিষয় বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য, কিছু এর মধ্যে গৃহীতও হয়েছে। বর্ণের ঘাড়ে ফুটকি চিহ্ন দিয়ে সমবর্গীয় নাসিক্যব্যঞ্জন বোঝানোর প্রস্তাব সংগত, কিন্তু সে সম্বন্ধে প্রবল বাধা আমরা লক্ষ করেছি।

বানানের সরলতা ও সমতা সম্বন্ধে তাঁর ভাবনার অধিকাংশ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৩৬-এর প্রস্তাবগুলিতে স্বীকৃত হয়েছে, ফলে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই। ‘লঘুগুরু’-র “বাংলা বানান” প্রবন্ধটি তবু উল্লেখযোগ্য, কারণ তিনি লক্ষ করেন প্রাদেশিক উপভাষার প্রভাব কীভাবে বানান ভুলের দিকে আমাদের চালিত করে। ভাষা সম্বন্ধে আর যে প্রসঙ্গটিকে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন তা হল, সাধারণ সাহিত্যের বাহন কোন্ লেখ্য উপভাষা হবে—সাধু না চলিত? এইখানে রাজশেখর সুদক্ষ ভাষাবিজ্ঞানীর মতো, কিছুটা যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির সূত্র গ্রহণ করে, ‘মৌখিক’ ও ‘লৈখিক’ এই দুটি ভাষার মধ্যে তফাত আমাদের খেয়াল করতে বলেন। লৈখিক ভাষার আবার দুটি রূপ আছে বাংলায়—সাধু ও চলিত। রাজশেখর বিশেষ যত্ন নেন মৌখিক ও চলিত-এর পার্থক্য বোঝাতে। মৌখিক যেখানে অ-মান্য (non-standard) উপভাষা মাত্র, সেখানে চলিত একটা সর্বমান্য স্ট্যান্ডার্ড বা আদর্শ ভাষা। মৌখিক ভাষা ‘অযত্নলব্ধ’, কিন্তু ‘লৈখিক’ চলিত যত্ন করে শিখতে হয়। আমাদের ‘মাতৃভাষা’ সম্বন্ধে যে বিভ্রান্তি—তার জন্ম এই মৌখিক ও চলিতের পার্থক্য ভুলে যাবার ফলে। রাজশেখর ‘চলন্তিকা’র প্রস্তাবনাতেও ওই পার্থক্যের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। যাই হোক, এ প্রবন্ধেও তাঁর উদারতা লক্ষ করি আমরা, চলিত ভাষার বিবর্তনে সর্ববঙ্গের দানের উল্লেখ করতে ভোলেন না তিনি, আর পশ্চিমবঙ্গের মৌখিক ভাষার সঙ্গে তার দূরত্বও দেখিয়ে দেন। উল্লেখযোগ্য যে, তিনি নিজে ১৯৩০ সাল থেকেই চলিত ভাষায় প্রবন্ধ লিখছেন, ১৯৩২- এ “প্রেমচক্র” গল্পে এলেন চলিত ভাষায়

এ পর্যন্ত বাংলা ভাষারই নানা রূপের (উপভাষার) মধ্য থেকে নির্বাচনের প্রসঙ্গ তাঁর বিবেচ্য। “বাঙালীর হিন্দীচর্চা”-তে বাংলাকে অতিক্রম করে অন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা দখল করার কথা বলেছেন তিনি, প্রস্তাব করেছেন বাঙালি লেখকেরাও ক্রমে হিন্দিতে মৌলিক সাহিত্য রচনার দিকে অগ্রসর হোন। তাঁর এই প্রস্তাব যে খুব উৎসাহের সঙ্গে গৃহীত হয়নি, এতেই বোঝা যায় যে সে-প্রস্তাব পালন করা কোথাও খুব সহজ নয়। দ্বিভাষী লেখক নেই তা নয়, কিন্তু সংখ্যায় তাঁরা খুবই বিরল। আর প্রতিষ্ঠালোভী বিশ্বায়নপ্রত্যাশী বাঙালি ইংরেজি ছেড়ে হিন্দির দিকে এগোবেন কেন? লোকে যে বেশি বড়োলোক বা বেশি শক্তিশালী তারই সঙ্গে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করবার চেষ্টা করে। “সংস্কৃতি ও সাহিত্য” (“বিচিন্তা’) নাম হলেও, এ প্রবন্ধে হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার সংস্পর্শে বাংলা ভাষার শারীরিক পরিবর্তন ও সমস্যার কথাই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

ছন্দের শ্রেণি-বিষয়ক একটি প্রবন্ধে প্রবোধচন্দ্র সেনের পরিভাষার বিকল্প পরিভাষা প্রস্তাব করেছেন তিনি। কিন্তু মুক্তদল রুদ্ধদলের পরিবর্তে ‘মুক্তধ্বনি’ ‘বদ্ধধ্বনি’ কথাগুলি কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি করতেই পারে। মাত্রাবৃত্ত (এখানকার সরল কলাবৃত্ত বা কলামাত্রিক)-কে ‘স্থিরমাত্র’ বলতে অসুবিধে নেই, কিন্তু দলবৃত্ত এবং মিশ্রবৃত্ত দুধরনের ছন্দেই দলের সংকোচন এবং প্রসারণ ঘটে বলে মাত্রা মানের হেরফের হয়। ফলে ‘সংকোচক’ ‘প্রসারক’ বা ‘অস্থিরমাত্র’ এই নামে বাকি দুটি ছন্দপদ্ধতিকে সুনির্দিষ্ট করা যায় না। কিন্তু আগেকার “বাংলা ছন্দের মাত্রা” প্রবন্ধটিতে এই সংজ্ঞার পুনর্বিন্যাস নেই, তা অভ্যস্ত পরিভাষাগুলিকে আরও স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট করার এক প্রশংসার্হ প্রয়াস। তবে “হরফ”-এর বিবেচনা যে ছন্দোবিচারে প্রায় সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, সে উপলব্ধি এ প্রবন্ধে নেই।

সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধগুলি তুলনায় সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সেগুলিতেও মৌলিক চিন্তার ঝলক আছে। এর মধ্যে কিছুটা বিস্তারিত “রস ও রুচি”-তে সাহিত্যে ফ্রয়েডীয় সূত্র অনুসারে যৌনতা ও কামনার অনাবরণ ছবি থাকবে কি না সে বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি মূলত রাবীন্দ্রিক। তাঁর মতে জীবনের সব তথ্য সাহিত্যের উপজীব্য নয়। “সাহিত্য রস” নামে ছোটো নিবন্ধটি মূলত এরই অনুবৃত্তি, তাতে তিনি সর্বসাধারণের জন্য রচিত সাহিত্যে “মজা ও স্বাস্থ্য” দুইই রক্ষা করতে বলেন, শুধু “মজা” বা শুধু “স্বাস্থ্য” নয়। “ভাষা ও সংকেত”- এ সাহিত্যে ব্যঞ্জনার স্থায়ী ভূমিকা, কিন্তু “সংকেতময় সাহিত্য”-এ প্রধানত এসেছে ভাষা এবং সাহিত্য দুইই যে প্রতীকের বয়ন ও বিন্যাস—তারই চমৎকার স্বীকৃতি। আজকের ভাষাবিজ্ঞানী হয়তো ভাষাকে বলবেন প্রতীক বা symbol-এর সমষ্টি, আর সাহিত্যকে, বিশেষত কবিতাকে, –রোমান ইয়াকবসনরা যেমন—বলবেন রূপক বা metaphor-এর সমষ্টি। এখান থেকে রাজশেখর চলে যান নানা কারুকলা ও শিল্পকলার প্রতীকধর্মে, কবিতার সুবোধ্যতা-দুর্বোধ্যতার প্রসঙ্গে, কিন্তু বিতর্কের জটিল পথে অগ্রসর হতে চান না। “কবির জন্মদিনে”-তে দেশীয় সাজাত্যবোধ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে রবীন্দ্রনাথের ব্যাপ্ত মানবপ্রেম, “সাহিত্যিকের ব্রত”-তে একই ভাবে সংকীর্ণ মতাদর্শ পরিহার করে সমাজ ও মানবজীবনের আশু ও স্থায়ী স্বার্থের বিষয়গুলি নিয়ে লেখকের অভিনিবেশ, “নিসর্গচর্চা”-তে নিসর্গ-পরিবেশের সঙ্গে মানুষের গভীর আত্মিক যোগ রক্ষা করা—এ সমস্তই তাঁর মূল চিন্তাসূত্র। “অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর” এক মহৎ শিল্পী, শিল্পভাষ্যকার ও লেখকের এক সংক্ষিপ্ত, কিন্তু সর্বাঙ্গীণ পরিচয়। “গল্পের বাজার” মূলত পাঠকরুচি-নিয়ন্ত্রিত বাজারের কথাই আলোচনা করে। তিনি লক্ষ করেন, পাঠক দু ধরনের—একদল চায় ‘নিষ্কণ্টক’ গল্প, সুখান্ত আখ্যান। কিন্তু “বিদগ্ধ এবং মানবচিত্তের রহস্য সম্বন্ধে কুতূহলী”, বাস্তবরসিক পাঠকেরা চান “সকণ্টক” গল্প। “সাহিত্যের পরিধি”-তে সাহিত্যের উৎকর্ষ বিচারে একমাত্র ও নির্ভুল মানদণ্ড-নির্ধারণের সমস্যা, সাহিত্যের সীমানা নির্ধারণে বাস্তব ও কল্পনার ভূমিকা, প্রকাশে ভঙ্গি ও রসের টেনশন বা আততি—এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ আলোচনা করার পর, আমরা জানি, তাঁর এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাশিত যে, বিচক্ষণ সমালোচক “পাঠকের আনন্দ আর সামাজিক স্বাস্থ্য” দুয়ের প্রতিই দৃষ্টি রাখেন। সাহিত্য সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলিতে যেমন, অন্যান্য প্রবন্ধেও আমরা লক্ষ করব, মতামতের এক ধরনের জটিল দ্বান্দ্বিকতার মধ্যে তিনি একটা সমন্বয়ের সূত্র সন্ধান করেন। কিন্তু তা দুর্বল আপোষরফা নয়, সুচিন্তিত বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত।

সমাজবিষয়ক প্রবন্ধগুলিতেই এই ডায়ালেটিক্স বা দ্বান্দ্বিকতার দৃষ্টিভঙ্গিটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হতে দেখি। তিনি জানেন বহু মানুষের বহু মত, অধিকাংশ‍ই পরস্পরবিরোধী, কারণ সেগুলি ব্যক্তিগত প্রত্যাশা ও স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত। তবু এসব অতিক্রম করে সার্বিক কোনো ‘সামাজিক’ সত্য (নির্বিশেষ সত্য না হোক), নৈতিকতা ও কল্যাণের কোনো ভিত্তি আছে কি না—মূলত এই তার সন্ধান। এ সন্ধানে তিনি ‘নেতি নেতি’ করে এগোবার চেষ্টা করেন, এবং যে সমাধান দেন তা কোনো এক পক্ষকে রেয়াত করে না, কোনো একদেশদর্শিতার দ্বারা গ্রস্ত হয় না। “ভদ্র জীবিকা”-র “ভদ্র” কথাটিকে তাঁর প্রশ্ন বিদ্ধ করে, এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ধরনেই বাঙালির ওই “ভদ্র” ধারণার মোহ তার হাত থেকে কীভাবে অর্থনৈতিক শক্তি ও উদ্‌যোগ অন্যদের হাতে সরিয়ে নিয়ে গেছে তা লক্ষ করেন রাজশেখর। তাঁর একটু আশান্বিত সিদ্ধান্ত, “বণিবৃত্তির প্রসারে বাঙালীর মানসিক অবনতি হইবে না।” “ঘনীকৃত তৈল”-এ আমাদের খাদ্যাভ্যাসের কুসংস্কার নিরসনের জন্য আশ্বাস দেন যে, স্বদেশীয় ‘ডালডা’ জাতীয় তেলে “ধর্মহানির আপত্তি থাকিবে না।” কিন্তু এই বিশ্বায়নের যুগে, রুচি হলে “স্বদেশীয় চর্বি” খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে “বিদেশীয় ঘনীকৃত তৈল পূতনার স্তন্যবৎ পরিহার করিব”—তাঁর এ কথা এখন অরণ্যে রোদনের মতো শোনাবে বলে মনে হয়। “খ্রিষ্টীয় আদর্শ” বা যে-কোনো ধর্মের আদর্শ, সেই ধর্মের যারা অনুগামী, যারা যুদ্ধ, সাম্রাজ্যদখল, জোচ্চুরি, জালিয়াতি সবই করে—তাদের হাতে কতটা রক্ষিত হয় তাই নিয়ে তাঁর প্রশ্ন। এখানেও প্রচারণ ও আচরণের সেই দ্বান্দ্বিকতা তাঁর অবলম্বন। “প্রার্থনা”-র মূল কথাও তাই—ব্যক্তি ও গোষ্ঠী কীভাবে ধর্মকে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারযোগ্য করে তোলে, তারই বিবরণ। এর উপসংহার বাক্যটি যেন ঋষিবাক্যের মতো শোনায়—“হে আমার আত্মা, ক্ষুদ্রতা পরিহার কর, সুখদুঃখে লাভালাভে, জয়াজয়ে অবিচলিত থাক, বিশ্বাত্মার যে সর্বব্যাপী সমদৃষ্টি তা তোমাতে সঞ্চারিত হোক।” এ প্রার্থনা সম্বুদ্ধ মানুষের, রাজশেখর সেই বিরল প্রজাতির সদস্য। “তিমি” প্রবন্ধটিতেও ওই একই উদ্‌বেগ—তিমি বৃহৎ শক্তির প্রতীক, তিমিংগিল আরও বৃহৎ শক্তির প্রতীক। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রতিবেশে লেখা এ প্রবন্ধে রাজশেখর বৃহৎ ও অতিবৃহৎ শক্তিগুলির সমস্ত আশ্বাস ও আদর্শের ঘোষণায় একটি সংগত অবিশ্বাস পোষণ করছেন, বলেছেন “সমস্ত মানবজাতির মঙ্গলামঙ্গল একসঙ্গে জড়িত –এই উজ্জ্বল স্বার্থবুদ্ধির প্রসার না ঘটলে সমস্ত ব্যবস্থাই পণ্ড হবে।”

এই “উজ্জ্বল স্বার্থবুদ্ধি”র পিছনে আছে যেমন প্রখর যুক্তি, তেমনই বিশ্বাস, ঘটনা ও আবেগের স্রোত কিংবা গোষ্ঠীগত স্বার্থ ও মতাদর্শের সংকীর্ণতায় বিভ্রান্ত না হয়ে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে একটি কল্যাণকর বিশ্বানুভব নির্মাণের চেষ্টা। রাজশেখর জানেন সমস্যা কত জটিল, গড্ডলিকার বিরুদ্ধে যাওয়া কত কঠিন। ফলে তাঁর আশা তাঁর অভিজ্ঞতা ও বিচারবোধের দ্বারা শাসিত ও দমিত। তবু অনাসক্তির মধ্যেও, প্রায় সোক্রাতেসীয় গোত্রের প্রশ্নসংকুলতার (সোক্রাতেসের ছদ্মযুক্তির ফাঁদে ফেলার চেষ্টা রাজশেখরে নেই) মধ্যেও মানবজীবন ও সমাজের ভবিষ্যতের জন্য তাঁর প্রচ্ছন্ন উদ্‌বেগটি আভাসিত হয়। “ভেজাল ও নকল”-এও সামাজিক মানুষের নীতিবোধের সেই ক্ষীয়মাণ তাৎপর্যের বিষয়ে তাঁর উদ্‌বেগ, যার নাম চারিত্রশক্তি। সমাজে প্রতারণা, এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রিক প্রতারণাতে আমরা কত সহজে অভ্যস্ত হয়ে যাই, “সত্যমেব জয়তে” কথাটা কত বিচিত্রভাবে আমাদের হাতে লাঞ্ছিত তা তিনি লক্ষ করেন, আমাদের প্রতিনিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ চেষ্টায় ক্রোধ নেই, হতাশা নেই, অভিশাপ নেই, প্রভুত্বধর্মী হুকুম নেই। এমনকি “সত্যমেব জয়তে—এই রাষ্ট্রীয় মন্ত্রের মর্যাদাহানি যেন কদাপি না হয়”—এই ভাববাচ্যীয় নিষেধে যে প্রত্যক্ষতাও অনুপস্থিত—তা থেকে রাজশেখরের মনোভঙ্গিটি বুঝতে পারি আমরা। “বিলাতী খ্রিষ্টান ও ভারতীয় হিন্দু”-র মধ্যেও তুলনার সূত্রে দু সমাজের বিশ্বাস ও আচরণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করেন, এবং সমাজের শক্তির মূলে যে চারিত্রশক্তি তার কথা বার বার বলেন। “অশ্রেণিক সমাজ” তাঁরও কাম্য, কিন্তু তার নির্মাণ যে কত কঠিন সে সম্বন্ধে তাঁর সম্যক ধারণা আছে, তাই আলোচনা ও প্রশ্নের গণ্ডি তিনি পেরোন না, সমাধান দেন না। “সমদৃষ্টি”-র মধ্যেও সেই স্বার্থহীন নৈতিকতার কথা আসে, যে-নৈতিকতা সামাজিক স্বাস্থ্যের ভিত্তি। তিনি গুরুর আসন নিতে আদৌ আগ্রহী নন, বন্ধুর মতো সৎপরামর্শ নিয়ে হাজির থাকেন মাত্র। সমাজের কাছ থেকে খুব একটা প্রত্যাশা তাঁর নেই, কিন্তু তাঁর নিজের দায়, ওই সুপরামর্শ নিয়ে প্রস্তুত থাকার দায় তাঁকে বহন করতেই হবে। যে-নৈতিকতা তিনি নিজের উপর এমন শান্তভাবে আরোপ করেন তা তিনি সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রতিফলিত দেখতে চাইবেন, এ স্বাভাবিক। কিন্তু কখনোই তিনি ক্রুদ্ধ ও সর্বজ্ঞ গুরুর আসন নেন না ।

‘সর্বজ্ঞতা’প্রসূত আপ্তবাক্য প্রবণতার অভাব এবং নিরপেক্ষ বিচারবোধ, মতামতের নানাদিক দেখার ইচ্ছা তাঁর সামাজিক এবং বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলির এক বিশেষ লক্ষণ। এবং এ প্রবন্ধগুলিতেই দেখি তিনি পাঠকের সবচেয়ে বেশি কাছাকাছি, কখনও গল্প বা কল্পিত উদাহরণ দিয়ে শুরু করেন, কখনও-বা সংলাপের রীতি গ্রহণ করেন, যে-প্রসঙ্গে আমাদের রাজশেখরের পাশে পরশুরামের উপস্থিতির কথা মনে হয়। বিশেষ করে পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাখাদ্য, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিধি ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রবন্ধগুলিতে মৃদু কৌতুকেরও আলো জেগে ওঠে। এখানে আবার রাজশেখরের নির্মোহ বৈজ্ঞানিক ঔদার্যও স্পষ্ট। পোশাক-যে দেশের জলবায়ু ও উপলক্ষ্য অনুযায়ী স্বাচ্ছন্দ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে তা তিনি জানেন, তবু অন্য সংস্কৃতির কাছ থেকে গ্রহণ করা পোশাক মেনে নিতে তাঁর আপত্তি নেই। ফলে পাজামার প্রতি অনেকের (হয়তো কিছুটা সাম্প্রদায়িক) বিদ্বেষ থাকলেও, রাজশেখর বলে দেন “তা নানা বিষয়ে ধুতির চাইতে শ্রেষ্ঠ।” এমনকি কর্মক্ষেত্রে বাঙালি মেয়েরা যদি স্কার্টস বা স্ন্যাক্স পরে যায় তাতেও তাঁর আপত্তি নেই। “আমিষ-নিরামিষ”- এও এই ঔদার্য সম্পূর্ণ হাজির। অঘোর এখানে তাঁর সত্তার প্রতিনিধি। সে প্রথমত বলছে বিজ্ঞানের কথা—“হাতি ঘোড়া থেকে পোকামাকড় পর্যন্ত সব প্রাণীই মানুষের ভক্ষ্য। প্রবৃত্তি বলছে, বাছা বাছা গুটিকতক প্রাণীই খেতে ইচ্ছা করে। অন্তরাত্মা বলছে, নিরামিষেই যখন কাজ চলে তখন জীবহিংসার দরকার কি।” এখানেও সমস্ত দিক দেখে, গ্রহণীয়তার অন্তত তিনটি মাত্রা–বিজ্ঞান, রুচি বা প্রবৃত্তি এবং অন্তরাত্মা— দিয়ে তিনি তাঁর নিজের পছন্দের ইঙ্গিত দেন। কোথাও বলেন না, ‘এরকমই করো’, বা ‘এরকম‍ই হওয়া উচিত।’

রাজশেখরের বিজ্ঞান ও সংস্কার-কুসংস্কার বিষয়ক প্রবন্ধগুলি এদেশের যুক্তিবাদী আন্দোলনের শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে গণ্য হবার মতো। তবে তাঁর হোমিয়োপ্যাথি সম্বন্ধে সংশয় ও বিদ্রূপ আমরা মেনে নিতে পারি না, কারণ আমাদের নিজেদের এবং অন্যান্য বিশ্বাসযোগ্য অভিজ্ঞতা থেকে এ পদ্ধতির কার্যকরতা ও দরিদ্র দেশের পক্ষে উপযোগিতার বিষয়টি আমাদের কাছে গ্রাহ্য। কিন্তু “ডাক্তারি ও কবিরাজি”-তে তাঁর যুক্তিবিস্তার আমাদের আদর্শ হয়ে ওঠে। ভারতের ঐতিহ্যাগত চিকিৎসাপদ্ধতি, কবিরাজি বা হেকিমির ব্যবহারযোগ্যতা ও আস্থা তখনই বাড়বে যখন তা খলনুড়ির নিয়ন্ত্রণ, অসংবদ্ধ ও অলৌকিক তত্ত্বের অধীনতা ছেড়ে এসে আধুনিক রসায়নাগারে প্রস্তুত হবে, যখন তার উপাদান, মিশ্রণ, উৎপাদন ইত্যাদি কঠোরভাবে তালিকাভুক্ত ও বিধিবদ্ধ হবে। রাজশেখরের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত যুগোপযোগী, কারণ আমরা চিনে সেদেশের প্রাচীন চিকিৎসা ও ভেষজের সাফল্য দেখেছি, এদেশেও ক্রমশ তা শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

“অপবিজ্ঞান” “ইহকাল পরকাল” এবং “বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি”-তে তাঁর বিজ্ঞান ও যুক্তির প্রতি অবিচল আনুগত্যের পরিচয় পাই, কিন্তু তাঁর মন সংকীর্ণ এবং একদেশবদ্ধ নয়। এ বিষয়ে “ইহকাল পরকাল” প্রবন্ধটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যিনি নিজে গীতার অনুবাদ করেছেন তিনি “বাসাংসি জীর্ণানি” ইত্যাদি শ্লোকের প্রসঙ্গে বলছেন, মানুষ যে জীর্ণ বস্ত্রের মতো এক দেহ ছেড়ে আর এক দেহ নেয়— “গীতাকার প্রমাণ দিলেন না।” ফলে ইদানীং প্যারাসাইকোলজি-র নানা প্রচারে জাতিস্মর ইত্যাদির ঘটনা সম্বন্ধে, অর্থাৎ পরলোক, আত্মা ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁর চূড়ান্ত মন্তব্য—“অতীন্দ্রিয় ব্যাপার নিয়ে সতর্ক গবেষণা সবে আরম্ভ হয়েছে, তা সফল হবে কি বিফল হবে এখনই বলা অসম্ভব। ভবিষ্যতে হয়ত অনেক আশ্চর্য বিষয় আবিষ্কৃত হবে; কিন্তু এখনই উৎফুল্ল হবার কারণ নেই।” আমরা এ লেখার তিপ্পান্ন বছর পরেও অলৌকিকের ব্যাপারে ‘উৎফুল্ল’ হবার মতো কিছু পাইনি। “শিক্ষার আদর্শ” প্রবন্ধটিতে শিক্ষার নৈতিক, চারিত্রিক ও ব্যবহারিক লক্ষ্য সম্বন্ধে একটি সচেতন, সর্বাঙ্গীণ আলোচনা যেমন নেই, তেমনই ব্যক্তিত্বভিত্তিক প্রবন্ধগুলিতে মহৎ মানুষটির ব্যক্তিত্বের মূল সূত্রগুলিকে ধরে—তাও আমাদের দৃষ্টি এড়ায় না।

 

সব প্রবন্ধের আলোচনা আমরা করছি না। উপরে শুধু প্রবন্ধলেখক রাজশেখরের প্রধান মনোযোগের ক্ষেত্র, এবং তাঁর আলোচনার ধরন ও প্রকরণ আমরা লক্ষ করলাম। প্রায় অনাসক্ত বিচার ও যুক্তিবিচার, দু পক্ষের বা নানা মতের উদ্ধার ও আলোচনা তাঁর নানা ধরনের প্রবন্ধের মূল লক্ষ্য, এবং কোথাও তিনি নিজের ব্যক্তিত্বের ভার পাঠকদের উপরে নিক্ষেপ করেন না। বানান পরিভাষা ভাষার প্রয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবশ্য তিনি তাঁর বিশেষজ্ঞের অভিমত দেন, পাঠকের চিন্তা বা অভিপ্রায়কে ততটা স্বীকৃতি দেন না। তার কারণ সম্ভবত এই যে, তিনি জানেন এ বিষয়টা সম্বন্ধে অধিকাংশ পাঠক খুব অধিকারসম্পন্ন বা আগ্রহী নন, আর তাঁরা খুব গুছিয়ে বা সুশৃঙ্খলভাবে এসব নিয়ে ভাবেন না। তাঁরা রাজশেখরের মতো সর্বমান্য অপক্ষপাতী পণ্ডিতের কাছে ex cathe – dra (উপদেশকের মঞ্চ থেকে) আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত। কিন্তু সামাজিক ও বিজ্ঞান প্রসঙ্গের প্রবন্ধগুলিতে তথ্য ও যুক্তির নানামুখী আহরণের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও লৌকিক সংস্কার, ধারণা, ইত্যাদিকেও তিনি বিচারের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন। আগেই যেমন বলেছি, এখানে তিনি পাঠকের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে স্বীকার করেন। তাই এগুলিতে গল্প, ঘটনা, চরিত্র, সংলাপ ইত্যাদির ভূমিকা বেশি, এবং কৌতুকরসেরও একটা অবকাশ তিনি তৈরি করে নেন।

আমার কাছে রাজশেখরের প্রবন্ধরচনার ভাষা বাংলায় প্রবন্ধের জন্য আদর্শ গদ্যভাষা বলে মনে হয়। ভাষার আতিশয্য ও প্রগল্ভতা তাঁর নিজের অপছন্দ ছিল, এ দুটিই তিনি সযত্নে পরিহার করেন। তাঁর চিন্তা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, বিষয়গুলির অবতারণায় পুনরাবৃত্তি বা অপ্রাসঙ্গিকতা বা প্রসঙ্গমিশ্রণ তাঁর লেখায় আদৌ নেই। আবেগ উচ্ছ্বাস, ব্যক্তিত্বের একমাত্রিক ভাষালক্ষণ বা মুদ্রাদোষ তাঁর গদ্যকে বিড়ম্বিত করে না। নেই তৎসম শব্দের অতিরিক্ত আসক্তি, অন্যদিকে নেই পাঠকতোষক ‘ছ্যাবলামি’——যা পাঠককে কখনও নির্বোধ অনুকম্পাযোগ্য শিশু, কখনও-বা আড্ডার ইয়ার্কিযোগ্য বন্ধু মনে করে নেয়। পাঠকদের বুদ্ধিমান এবং মতামতসম্পন্ন (সে মতামত ভ্রান্ত হলেও ক্ষতি নেই) জীব মনে করে, তাদের সম্মান করে, রাজশেখর একটি অত্যন্ত সৌজন্যসম্মত স্বচ্ছ ভাষা নির্মাণ করে বঙ্কিমচন্দ্রের “সরলতা ও স্পষ্টতা”-র নির্দেশ তো শিরোধার্য করেইছেন, সেই সঙ্গে যে সস্মিত হৃদ্যতা ও সরসতা যোগ করেছেন তা-ই তাঁর গদ্যকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।

এ কথা আমাদের বেশি করে মনে রাখা, এবং এই গদ্যকে আমাদের সাধারণ প্রবন্ধরচনায় আরও ব্যাপকভাবে অনুশীলন করা এই কারণে উচিত যে, আমাদের ছাত্রদের স্কুলে, নোট বইয়ে রচনা বইয়ে বা পরীক্ষার খাতায় যে গদ্যরীতির শিক্ষা দেওয়া হয় তা কুৎসিতের শ্রেণিতে পড়ে। তাতে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস, বিশেষণপীড়িত পল্লবিত অতিশয়োক্তি ইত্যাদির প্রাবল্যে বলার কথাবস্তু, সুশৃঙ্খল তথ্য ও যুক্তির বিন্যাস সবই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ইস্কুলের মাস্টারমশাইয়েরা যখন ছাত্রছাত্রীদের ‘ভাব বা ভাষা দিয়ে’ লিখতে বলেন এবং না লিখলে নম্বর দেন না, তখন ওই ভ্রান্ত জবড়জং বাংলার আদল সহজে মরতে চায় না। এই গদ্য আমাদের ছেলেমেয়েদের সজ্জিত সুবিন্যস্ত চিন্তা করতে শেখায় না, কেবল অর্থহীন শব্দের ধূম্রজাল তৈরি করতে উৎসাহ দেয়। তাতে তারা ভুল করে বেশি, কারণ ওই সব শব্দের শরীরটাকেই তারা দেখে, তাদের অর্থ কিছু সুসংহত বক্তব্যে গিয়ে দাঁড়ায় কি না তা তারা বোঝে না।

রাজশেখরের গদ্যভাষা কবে আমাদের হাতে এই শব্দদূষণের যোগ্য প্রতিবিধান হয়ে উঠবে জানি না। কিন্তু তা সর্বদা আমাদের সামনে অনুকরণযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকা দরকার। সেখানেই প্রবন্ধগুলির একত্র প্রকাশের অন্যতর একটি সার্থকতা তৈরি হবে।

পবিত্র সরকার

.

রাজশেখর জীবনচরিত 

একই ব্যক্তির দুই নাম। রাজশেখর বসু ও পরশুরাম। ‘বাঙালী সাহিত্যিকগণের অগ্রজস্বরূপ, বাংলা সাহিত্যের নিয়ামক নায়ক ও লোকশিক্ষক’ রূপে রাজশেখর বসু বিংশ শতকের বাংলার প্রণম্য পুরুষ। পাণিনিকে বলা হতো অশেষবিৎ, রাজশেখর বসুও ছিলেন অশেষবিৎ।

পরশুরামের প্রথম রচনা পড়ে রবীন্দ্রনাথ রসায়নাগারে অনপেক্ষিত রসস্রষ্টা বনস্পতিকে দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন, কিন্তু রাজশেখর বসুর সব কিছুই বিস্ময়কর। রাসায়নিক, যন্ত্রবিজ্ঞানী, কুটিরশিল্পজ্ঞ, সুদক্ষ ব্যবসায় পরিচালক, ভাষাবিজ্ঞানী, শাস্ত্রবিদ্, আভিধানিক ও রসস্রষ্টা,—একসঙ্গে এতগুলি গুণের সমাবেশ অসম্ভব মনে হয়, কিন্তু রাজশেখরের মধ্যে বাংলার সুধীসমাজ ও সাধারণ মানুষ এইসব গুণ প্রত্যক্ষ করেছেন। উনিশ শতকের প্রাণরসে সঞ্জীবিত ও প্রজ্বলিত দ্বৈত নামের বহু বিচিত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই মানুষটি ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাণপুরুষ।

রাজশেখর বসু ১৮৮০ খ্রীস্টাব্দের ১৬ই মার্চ (১২৮৬ বঙ্গাব্দের ৪ঠা চৈত্র) মঙ্গলবার বর্ধমান জেলায় শক্তিগড়ের কাছে মাতুলালয় বামুনপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক বাড়ি নদীয়া জেলায় কৃষ্ণনগরের কাছে উলা বীরনগরে।

পিতা চন্দ্রশেখর বসু (১৮৩৩-১৯১৩) তিনবার বিবাহ করেন। প্রথমা স্ত্রী নিঃসন্তান অবস্থায় অল্প বয়সে মারা যান। কয়েকবছর পরে হাওড়ায় সুপুরিয়ার কাশীশ্বর মিত্রের কন্যাকে চন্দ্রশেখর বিবাহ করেন। তাঁর একটি কন্যা ছিল। দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পর চন্দ্রশেখর তিরিশ বছর বয়সে বর্ধমানে বামুনপাড়ায় নৃত্যগোপাল দত্ত ও জগমোহিনী দত্তের কন্যা লক্ষ্মীমণি দেবীকে বিবাহ করেন। লক্ষ্মীমণির চারপুত্র ও পাঁচ কন্যা –ইন্দুমতী (পরে দত্ত), কুমুদবতী (পরে মুস্তৌফী), শশিশেখর, ঊষাবতী (পরে সোম), লীলাবতী (পরে ঘোষ), রাজশেখর, হিরণ্যবতী (পরে দত্ত), কৃষ্ণশেখর, গিরীন্দ্রশেখর।

রাজশেখরের ডাকনাম ছিল ফটিক। ‘রাজশেখর’ নামকরণের ইতিহাস প্রসঙ্গে শশিশেখর বসু লিখেছেন, ‘দারভাঙ্গা ঘুরে এসে একবার বললেন, ফটিকের নাম ঠিক হয়ে গেছে। মহারাজ (লক্ষ্মীশ্বর সিং, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ) জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার দ্বিতীয় ছেলের নামও একটা শেখর হবে না কি? কি শেখর হবে? আমি বললাম, ইয়র হাইনেস যখন তাকে আশীর্বাদ করচেন, তখন আপনিই তার শিরোমাল্য, আমি আপনার সামনে তার নামকরণ করলাম রাজশেখর।’ (‘রাজশেখরের ছেলেবেলা’, যুগান্তর, শারদীয় সংখ্যা রাজশেখরের শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে দরভঙ্গায় পিতার কর্মস্থলে। পূর্বোক্ত প্রবন্ধটিতে বড়দাদা শশিশেখর রাজশেখরের ছেলেবেলার অনেক কৌতুককর ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। শৈশবে রাজশেখর ছিলেন অত্যন্ত কৌতূহলী ও জিজ্ঞাসু। খেলনা ভেঙ্গে-ভেঙ্গে তাঁর বিচিত্র ‘এক্সপেরিমেন্ট’ চলতো। শশিশেখর লিখেছেন, “সায়েন্স পাশ করবার আগেই ল্যাবরেটরী হল, দুই আলমারি অ্যাসিড, ক্লোরেট অব পটাস, কোবাল্ট, ক্লোরাইড ইত্যাদি। বোমা তৈরি করে ফাটাতো, কাগজের ব্যারোমিটার দেওয়ালে এঁটে বলতো বিষ্টি হবে কি না। আমাদের কাশি হলে কফ-মিকশ্চার প্রেসক্রিপশন লিখতো, কবিরাজি কেতাব আমি এনে দিতাম তাই পড়তো। টেম্পল মেডিক্যাল স্কুলে শখ করে মড়াও চিরতো। আমাকে গীতার বুকনি ইংরেজীতে ট্রানস্লেট করে দিত, আমি সেগুলো টাইম্স অফ ইন্ডিয়া, মাদ্রাজ মেল ও পাইওনীয়ারে নিজের বলে চালিয়ে দিতাম। তার অরিজিন্যাল কমপোজিশনে ঝোঁক হতে লাগল, কিন্তু সে কভারওয়ালা ম্যাগাজিন ভিন্ন লিখতো না; ডেলি পেপারকে গ্রাহ্য করতো না, এখনও নয়। যতদূর মনে পড়ে ইন্ডিয়ান টিট্‌বিট্’ ম্যাগাজিনে কি একটা লিখেছিল ছেলেবেলায়।” (তদেব)।

১৮৮৮ থেকে ১৮৯৫ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত রাজশেখর দরভঙ্গা রাজ স্কুলে পড়াশুনো করেন, এবং সেখান থেকে চৌদ্দ বছর নয় মাস বয়সে এন্‌ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সে বছর দরভঙ্গা রাজ স্কুলে রাজশেখরই ছিলেন একমাত্র বাঙালী ছাত্র। হিন্দী ছিল তাঁর কাছে মাতৃভাষার মতো সহজ ও স্বচ্ছন্দ, একেবারে শৈশবে তিনি বাংলা বলতে পর্যন্ত পারতেন না।

এন্‌ট্রান্স পাশ করে পটনা কলেজে এফ-এ পড়তে এলেন। কলেজে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মহেন্দ্রপ্রসাদ তাঁর সহপাঠী ছিলেন। পাটনা কলেজে বাঙালী সহপাঠী ছিলেন জন দশেক, তাঁদের সঙ্গে সাহিত্যালোচনা চলতো। বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আগ্রহ এই সময়ে মনের মধ্যে জাগতে শুরু করে। ১৮৯৭ খ্রীস্টাব্দে রাজশেখর পটনা কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে এফ-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

বি-এ পড়ার জন্য কলকাতা এলেন, ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। অনর্স ছিল ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে। ১৮৯৯ খ্রীস্টাব্দে অনর্স-সহ বি-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। সে বছর অনর্স পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজেরই ছাত্র শরৎকুমার দত্ত, রাজশেখর দ্বিতীয় শ্রেণীতে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন।

এক বছর পরে ১৯০০ খ্রীস্টাব্দে রাজশেখর প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়ন শাস্ত্রে এম-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন, এবং সে বছর প্রথম শ্রেণী কেউ না পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে তিনিই প্রথম স্থানাধিকারী বলে পরিগণিত হন।

বিজ্ঞানের দিকে তাঁর আবাল্য ঝোঁক। তবু বৈষয়িক দিকের কথা ভেবেই সম্ভবত ১৯০২ খ্রীষ্টাব্দে তিনি রিপন কলেজ থেকে বি-এল পরীক্ষা দেন এবং তাতে উত্তীর্ণ হয়ে ঠিক তিনদিন কোর্টে যান। কিন্তু আদালত-জীবন তাঁর পছন্দ হলো না। ফিরে এলেন বিজ্ঞান-চর্চার স্বক্ষেত্রে।

পরিচয় হলো আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে, তিনি তাঁর বেঙ্গল কেমিক্যালে রাজশেখরকে ডেকে নিলেন। ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দের এপ্রিল মাসে রাজশেখর কেমিস্ট হিসাবে বেঙ্গল কেমিক্যালে যোগ দিলেন। তারপর এক বছরের মধ্যেই হলেন প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ও সেক্রেটারী। বেঙ্গল কেমিক্যাল ধরতে গেলে রাজশেখরেরই হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র অবশ্যই এর জন্মদাতা—‘জনক’, রাজশেখর প্রকৃত ‘পিতা’—প্রতিপালক। একদিকে গবেষণার কাজ অন্যদিকে ব্যবসায় পরিচালনা—উভয় ক্ষেত্রেই রাজশেখরের দক্ষতা ও সাফল্য লক্ষণীয় ছিল।

ব্যবসায় পরিচালনার ক্ষেত্রেও রাজশেখরের বাস্তববুদ্ধি, নিয়মনিষ্ঠা ও কর্তব্যবোধ বেঙ্গল কেমিক্যালকে প্রতিষ্ঠাদানে সাহায্য করে। বেঙ্গল কেমিক্যালের অনেক খাতাপত্র রাজশেখর বাংলায় লেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। বিভিন্ন বিভাগের নামকরণে বাংলা পরিভাষার ব্যবহার তিনিই প্রথম শুরু করেন। সেই সঙ্গে বেঙ্গল কেমিক্যালের বিভিন্ন ঔষধ, সেন্ট, সাবান ও প্রসাধন দ্রব্যের নামকরণে বাংলা ও সংস্কৃত শব্দের সুন্দর ব্যবহার তাঁর সৃষ্টি। ‘তাছাড়া বেঙ্গল কেমিক্যালের বিজ্ঞাপনের লেখনী, ছবি ও বিভিন্ন জিনিসের সচিত্র লেবেল তাঁরই কল্পনাপ্রসূত ছিল।’ [ সুধীরচন্দ্র সরকার, ‘রাজশেখর বসু’, যষ্টিমধু, বৈশাখ ১৩৬৭ ]। মাণিকতলায় কারখানা, কাজের সুবিধার জন্য সেখানেই একটি বাড়িতে তিনি থাকতেন। কারখানা এবং অফিস—দুদিকই তাঁকে দেখতে হতো।

দীর্ঘ তিরিশ বছর কাজ করে স্বাস্থ্যহানির জন্য ১৯৩৩ খ্রীস্টাব্দের ১লা জানুআরী তিনি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ও সেক্রেটারী পদ থেকে অবসর গ্রহণ করলেন। কিন্তু সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হলো না, টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসার ও একজন ডিরেক্টর হিসাবে মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

.

যে-বছর রাজশেখর বি-এ পাশ করলেন, (১৮৯৭) সেবারই তাঁর সঙ্গে মৃণালিনী দেবীর (১৮৮৬-১৯৪২) বিবাহ হয়। তাঁদের একমাত্র সন্তান প্রতিমা (১৯০১-১৯৩৪)। ‘গড্ডলিকা’র গল্পগুলি পড়ে রবীন্দ্রনাথ পরশুরামকে অভিনন্দিত করেন, কিন্তু রাজশেখরকে তিনি তখনও দেখেননি, কোনও ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। অমল হোম লিখেছেন, ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ একদিন তাঁর বাড়ি এলে রাজশেখরকেও তিনি আসবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাজশেখরের এই ‘প্ৰথম পরিচয়’-এর কথা (দ্র: পৃ ৩৩৫) রাজশেখর পরবর্তীকালে লিখেছেন, ‘প্রায় কুড়ি বৎসর আগেকার কথা। অমল হোম মহাশয় বলে পাঠালেন, রবীন্দ্রনাথ সন্ধ্যায় তাঁর বাড়িতে আসবেন, আমাকে দেখতে চান। ভয় ছিল আমার সঙ্গে কথা কয়ে কবি নিরাশ হবেন। কবি কি মনে করেছিলেন জানি না, কিন্তু আমি নিরাশ হই নি। ‘কবি কি মনে করেছিলেন’ তা জানতে পাই অমল হোমকে লেখা তাঁর চিঠিতে, ‘কাল তোমার ওখানে রাজশেখরবাবুর সঙ্গে কথা বলে ভারি খুশি হয়ে এসেছি। ওঁর হাতে কুঠার আছে কি না জানি না কিন্তু ওঁর অন্তরে আছে পাবক যা নিঃশেষ করে চিত্তবুদ্ধির আবর্জনা। উনি সহজ করে সব জানেন—সহজ করে সব বলতে পারেন। ওঁকে একবার শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসবার ভার রইল তোমার উপর।’ (দ্র. অমল হোম, ‘প্রথম দেখা : রবীন্দ্রনাথ-রাজশেখর’, কথাসাহিত্য, শ্রাবণ ১৩৬০)। রাজশেখর সে সময়ে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন কি না জানি না, কিন্তু পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিজ্ঞান গবেষণাগারের নামকরণ- কালে ‘রাজশেখর বিজ্ঞান-সদন’ নামের মধ্য দিয়ে রাজশেখরকে স্মরণীয়তা দান করেছেন।

রাজশেখর বসু সংকলিত ‘চলন্তিকা’ অভিধানটি প্রকাশিত হলে ‘গুণগ্রাহী’ রবীন্দ্রনাথ ১১ই ফেব্রুআরি ১৯৩১ তারিখের চিঠিতে রাজশেখরকে অভিনন্দন জানিয়ে লেখেন, ‘এতদিন পরে বাঙলা ভাষার অভিধান পাওয়া গেল। পরিশিষ্টে চলন্তিকায় বাঙলার যে সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণ দিয়েছেন তাও অপূর্ব হয়েছে।’ (বিশ্বভারতী পত্রিকা, শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৬৮)।

‘চলন্তিকা’ রাজশেখরের এক অসামান্য কীর্তি। ‘ভূমিকা’য় তিনি লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষার একটি ছোট অভিধানের দরকার আছে—যাহা সহজে নাড়াচাড়া করিতে পারা যায় অথচ যাহাতে মোটামুটি কাজ চলে। যাঁহারা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের চর্চা করেন তাঁহারা প্রধানতঃ যে প্রয়োজনে অভিধানের সাহায্য লইয়া থাকেন, বিনা বাহুল্যে তাহা সাধিত করাই এই অভিধানের উদ্দেশ্য।’ রাজশেখর বাংলা শব্দের বানান ও পারিভাষিক শব্দ নিয়ে সারাজীবন চিন্তা করেছেন। ‘চলন্তিকা’ সংকলনকালে বাংলা বানানের বৈচিত্র্য দূর করার জন্য রাজশেখর সাহিত্যিকদের মতামত গ্রহণ করেছিলেন; রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী, যোগেশচন্দ্র রায় প্রভৃতি লেখকদের কাছে তিনি বানানের তালিকা পাঠিয়েছিলেন।

‘চলন্তিকা’ প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার কয়েক বছর পরে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ স্থির করার জন্য একটি কমিটি নিযুক্ত হয় (নভেম্বর ১৯৩৫)। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন রাজশেখর বসু এবং সম্পাদক চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। ‘বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকাটি (১৩৪৩) যখন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃক প্রকাশিত হলো রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যিকেরা ‘বাংলা বানান সম্বন্ধে যে নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন আমি তাহা পালন করিতে সম্মত আছি’,–এই মর্মে তাঁদের সমর্থন জানান। প্রকৃতপক্ষে ‘চলন্তিকা’ সংকলয়িতা রাজশেখরের প্রয়াস-প্রযত্নের ফলেই বাংলা বানানের ক্ষেত্রে আজ অনেকটা সমতা এসেছে। সজনীকান্ত দাসের ভাষায়, “ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া তিনি বাংলা ভাষার বৈজ্ঞানিক গোড়াপত্তন করিয়াছেন এবং বাঙালীর ঢিলাঢালা এলোমেলো প্রকৃতিতে একটা বাঁধন আনিয়া দিয়াছেন। অথচ এই বাঁধনে কষ্ট নাই, অপমান নাই। ‘চলন্তিকা’ মারফৎ আমরা আমাদের অজ্ঞাতসারেই ভাষার শৃঙ্খলা শিখিতেছি। সাহিত্যকর্মী রাজশেখরের ইহা একটি বিপুল কীর্তি।” (‘সাহিত্যকর্মী শ্রীরাজশেখর বসু’, কথাসাহিত্য, শ্রাবণ ১৩৬০)।

পারিভাষিক শব্দের জন্যেও ‘চলন্তিকা’র আশ্রয় আমাদের নিতে হয়। যদিও এর ভূমিকায় রাজশেখর বসু জানিয়েছেন, “পরিশিষ্টে যে পারিভাষিক শব্দাবলী দেওয়া হইয়াছে তাহার ‘পাটীগণিত’ হইতে ‘মনোবিদ্যা’ প্রভৃতি বিষয়ক অংশ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকলন হইতে উদ্ধৃত। ‘সরকারী কার্য’ বিষয়ক অংশ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংকলন হইতে উদ্ধৃত।” কিন্তু আসলে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকলন এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংকলন দুটিও প্রধানত রাজশেখরের উদ্যোগের ও অনেক পরিমাণে তাঁর ব্যক্তিগত প্রয়াসের ফল। ১৯৩৪ খ্রীস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিভাষা সমিতি গঠন করে, তার সভাপতি ছিলেন রাজশেখর বসু।

বাংলা ছাপাখানার ইতিহাসেও রাজশেখরের বিশিষ্ট দান স্মরণীয়। বাংলা লাইনো টাইপের উদ্ভাবক সুরেশচন্দ্র মজুমদার, কিন্তু এই কাজে তাঁর অন্যতম সহায় ছিলেন রাজশেখর। ১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর লাইনোটাইপ কোম্পানীর শো-রুমে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলা লাইনো টাইপ যন্ত্রের কর্মারম্ভের উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে রাজশেখর বসুও উপস্থিত ছিলেন। লাইনো টাইপ কোম্পানীর পক্ষ থেকে মিঃ গেভিল বলেন, “শ্রীসুরেশচন্দ্র মজুমদারের অক্লান্ত চেষ্টায় ইহা সম্ভব হইয়াছে; শ্রীরাজশেখর বসু তাঁহাকে এ কার্যে সহায়তা করিয়াছেন। মূল অক্ষরগুলির আকৃতি অঙ্কন করিয়াছেন যতীন্দ্রকুমার সেনের সহায়তায় এস. কে. ভট্টাচার্য।” সুরেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমার চেষ্টার ফলে লাইনো যন্ত্রে বাংলা অক্ষর মুদ্রণের একটা উপায় উদ্ভাবন করিতে সমর্থ হইয়াছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পারিভাষিক সমিতির সভাপতি শ্রীযুক্ত রাজশেখর বসু ও শ্রীযুক্ত যতীন্দ্র কুমার সেন প্রভৃতি আমাকে এ বিষয়ে প্রভূত সহায়তা করিয়াছেন। সে সাহায্য না পাইলে আমার পক্ষে এ কার্য করা সম্ভব হইত না।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৫)।*

সুরেশচন্দ্র মজুমদার লাইনো টাইপকে বাজারে চালু করেছিলেন, কিন্তু যুক্তাক্ষরের জট ছাড়িয়ে সহজ হরফ তৈরী করেছিলেন রাজশেখর বসু। বাংলা লাইনো টাইপে প্ৰথম সম্পূর্ণ মুদ্রিত বই পরশুরামের ‘হনুমানের স্বপ্ন ইত্যাদির গল্প’ দ্বিতীয় সংস্করণ।

সভা-সমিতি উৎসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে রাজশেখরের খুব একটা যোগ ছিল না। বক্তৃতায় তাঁর বিশ্বাস ছিল না, কর্মে ছিল তাঁর একান্ত নিষ্ঠা। ১৯০৫ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে যোগ দেননি, কিন্তু ১৯০৬ খ্রীস্টাব্দে যখন জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (The National Council of Education) প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন তিনি সক্রিয়ভাবে পরিষদের বিভিন্ন কর্মানুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। রাজশেখর শুধু ‘কাউন্সিল’- এর সভ্য ছিলেন না, তিনি ‘ফ্যাকালটি অফ সায়েন্স’ এবং ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যানুফাকচার ও কমার্সের ‘বোর্ড অফ স্টাডিস’-এরও সদস্য ছিলেন। (দ্র. The National Council of Education, Bengal, Calender, 1906-1908, Calcutta, 1908, pp. 27, 30, 34, 36, etc.)

মানিকতলার বাগানে বিপ্লবীদের বোমা তৈরীর ব্যাপারে রাজশেখর মালমশলা দিয়ে সাহায্য করতেন। বোমা তৈরীর ফর্মুলাও রাজশেখরের। বিপ্লবীদের পরিবারকে তিনি গোপনে অর্থসাহায্যও করতেন। একথা তিনি নিজেই প্রকাশ করেছিলেন তাঁর দৌহিত্রীর কাছে। ভারত স্বাধীনতার পরে।

সাহিত্য-সংগঠন যেগুলির সঙ্গে রাজশেখর কোনও সময় যুক্ত ছিলেন, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রবিবাসর ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ। ১৩৩৬ সালে রবিবাসর প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম যুগে কিছুদিন রবিবাসর-এর সম্পাদক ছিলেন, সেই সময়ে রাজশেখর রবিবাসর-এর সদস্য হয়েছিলেন।

এর কিছুকাল পরে (১৩৪০) ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উৎসাহেই রাজশেখর বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর সদস্য হন।। যোগেশচন্দ্র বাগল লিখেছেন, ‘রাজশেখরবাবু পরিষদের সভ্য হইয়াছেন। বেঙ্গল কেমিক্যালের মতো এতবড় প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তিনি তাঁহাকে যদি সাহিত্যপরিষদের সম্পাদকরূপে পাওয়া যায় তাহা হইলে ইহার কার্য কিরূপ সুপরিচালিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হইতে পারে সে সম্বন্ধে তাঁহার (ব্রজেন্দ্রনাথের) বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না।’

ব্যক্তিজীবনে রাজশেখর ছিলেন অল্পভাষী, পরিচ্ছন্ন-প্রকৃতি, নিয়মনিষ্ঠ আদর্শবাদী মানুষ।। বিচিত্র বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল। একদা ছবি আঁকতেন, যোগেশচন্দ্র বাগল লিখেছেন, ‘একবার তিনি কিছুদিনের জন্য সুকিয়া স্ট্রীটের এক বাটী ভাড়া করিয়া ছিলেন। সেখানে গিয়া দেখি তিনি ছবি আঁকিতেছেন। তিনি যে চিত্রশিল্পেও সিদ্ধহস্ত, এ পরিচয় তখনই প্রথম পাইলাম। ব্রজেন্দ্রনাথের মুখে শুনিয়াছি—রাজশেখর অবসরকালে চিত্র অঙ্কনে নিয়োজিত থাকেন।’

ফোটোগ্রাফিতেও একদা তাঁর আগ্রহ ছিল। শেষজীবনে পরিমল গোস্বামীকে বলেছেন, .‘আজকাল চমৎকার সব ক্যামেরা বেরিয়েছে দেখলে আবার ক্যামেরা ব্যবহার করতে ইচ্ছা হয়।’ পরিমল গোস্বামী মন্তব্য করেছেন, ‘আবার ইচ্ছা হয়’ মানে এ বিদ্যা তাঁর অজানা নয়। আগে তিনি ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন।” (“দ্বিতীয় স্মৃতি”)।

অবসর সময়ে তিনি নানারকম শিল্পদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় জিনিস নিজেই তৈরী করতেন। লেখার ফাইল, খাম ইত্যাদি থেকে শুরু করে ঘড়ির ‘পার্টস’ জোড়া লাগানো, ঘড়ি ‘অয়েল’ করা—সবকিছুই নিজে করতেন। কুমারেশ ঘোষ তাঁর স্মৃতিকথায় রাজশেখরের তৈরি গণনার জন্য কাঠের ফ্রেমে আঁটা নানা রঙের সছিদ্র রুদ্রাক্ষ এবং নতুন ধরনের কাঠের নিক্তির কথা বলেছেন। (দ্র. ‘শ্রদ্ধেয় শ্রীরাজশেখর বসুর সঙ্গে কিছুক্ষণ’, যষ্টিমধু, বৈশাখ ১৩৬৭)।

[* লাইনোটাইপ চিত্রাঙ্কনে রাজশেখরের প্রত্যক্ষ ভূমিকা কিরকম ছিল, তা পত্রাবলী অংশে প্রথম চিঠি দেখলেই বোঝা যাবে (পৃ: ৪০৮-৪০৯)। এ কাজে সহায়ক হিসাবে এক তরুণ শিল্পীকে তিনি বেছে নেন—অর্ধেন্দু দত্ত। পরবর্তীকালে ইনি আনন্দবাজার পত্রিকার প্রসিদ্ধ শিল্পী ও মানচিত্র-অঙ্কনকারী ছিলেন।]

সাহিত্যকর্মের জন্য রাজশেখর স্বীকৃতি নিশ্চয়ই পেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা থেকে শুরু করে অকাদেমি পুরস্কার পর্যন্ত—কিন্তু তবু যেন মনে হয়, সম্ভবত হাসির গল্প লেখার জন্যই তাঁকে সাহিত্যিক হিসাবে যথোপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হয়নি। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দে জগত্তারিণী পদক এবং ১৯৪৫এ সরোজিনী পদক দানের দ্বারা সম্মানিত করেন। কিন্তু কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি. লিট উপাধি তাঁকে দেওয়া হলো ১৯৫৭এ অল্প কয়েকদিন পরে কুমারেশ ঘোষকে পত্রে তিনি লিখেছেন, “৭৭ বৎসর পেরিয়ে উপাধিলাভে কিছুমাত্র আনন্দের কারণ নেই, আর ডাক্তার উপাধি তো গড়াগড়ি যাচ্ছে।” (তদেব)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পরের বছর ১৯৫৮এ রাজশেখরকে ডি. লিট উপাধি দান করেন।

“কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প” গ্রন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার ১৯৫৫ খ্রীষ্টাব্দে রাজশেখরকে দেওয়া হয়। ভারত সরকার ১৯৫৬এ রাজশেখরকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে সম্মানিত করেন। ১৯৫৮এ রাজশেখর পেলেন অকাদেমি পুরস্কার তাঁর “আনন্দবাঈ ইত্যাদি গল্প” গ্রন্থটির জন্য।

কিন্তু জীবনের প্রান্তভাগে এসে যে-সম্মান তিনি লাভ করেন তা তো অনেক আগেই তাঁর পাওয়ার কথা ছিল। হয়তো কিছু অভিমান এবং স্বাভাবিক বিনয়ের সঙ্গেই রাজশেখর মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে (১০ জানুআরি ১৯৬০) সাহিত্যিকদের সংবর্ধনার উত্তরে প্রকাশ করেছিলেন (দ্র. পৃ ৪১৫)।

সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘একমাত্র সন্তান, কন্যা; বিদ্বান্ গুণবান সর্বজনপ্রিয় জামাতা অন্তিম রোগশয্যায়; স্বামীর আসন্ন মৃত্যুর কথা জেনে কন্যা যেন ইচ্ছামৃত্যুকে ডেকে এনে অবলীলাক্রমে দেহত্যাগ করলেন, মুমূর্ষু জামাতা তার কিছু পরেই প্রাণত্যাগ করলেন। একই চিতায় কন্যা-জামাতার অগ্নিক্রিয়া সম্পন্ন হল। পিতামাতার কাছে এরূপ মর্মন্তুদ দুঃখ, সংসারে মানুষের জীবনে এ ধরনের বেদনা যে কত গভীর কত চিরস্থায়ী তা আমরা অনুমান করতে পারি। কিন্তু তাঁর সাহিত্য-সর্জনা যা জগতের জন্য, তাতে এই দুঃখের ছোঁয়াচ পর্যন্ত লাগতে দেখি না।’ (‘সুবুদ্ধিবিলাস রাজশেখর’ কথাসাহিত্য, শ্রাবণ ১৩৬০) ১৩৪১ সালে ২রা বৈশাখ কন্যা-জামাতার মৃত্যুর দিন রাজশেখর ‘সতী’ কবিতাটি লেখেন।

১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে রাজশেখরের পত্নীবিয়োগ ঘটে।। সে সময়ে (২-১২-৪২) চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যকে লেখা তাঁর চিঠিখানিতে ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ চিত্তের পরিচয় পাওয়া যায়, ‘মন বলছে, নিদারুণ দুঃখ, চারিদিকে অসংখ্য চিহ্ন ছড়ানো, তার মধ্যে বাস করে স্থির থাকা যায় না। বুদ্ধি বলছে, শুধু কয়েক বছর আগে পিছে যদি এর উল্টোটা ঘটত তবে তাঁর মানসিক শারীরিক সাংসারিক সামাজিক দুঃখ ঢের বেশী হত। পুরুষের বাহ্য পরিবর্তন হয় না, খাওয়া-পরা পূর্ববৎ চলে, কিন্তু মেয়েদের উপর খাঁড়ার ঘা পড়ে

‘নিরন্তর শোকাতুর আর একজনকে দেখলে নিজের শোক দ্বিগুণ হয়। গতবারে আমার সেই অবস্থা হয়েছিল। এবারে শোক উসকে দেবার লোক নেই, আমার স্বভাবও কতকটা অসাড়, সেজন্য মনে হয় এই অন্তিম বয়সেও সামলাতে পারব।’ (চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’, কথাসাহিত্য, শ্রাবণ ১৩৬০)।

এরপর প্রায় আঠারো বছর রাজশেখর জীবিত ছিলেন। এর মধ্যে অনেক লিখেছেন। বেঙ্গল কেমিক্যালের একজন ডিরেক্টর হিসেবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৯ খ্রীস্টাব্দ থেকে তাঁর শরীর খারাপ যাচ্ছিল। ডিসেম্বরে প্রথম স্ট্রোকের পর প্রায় অথর্ব হয়ে পড়েন। কিন্তু লেখা বন্ধ থাকেনি।

‘১৯৬০এর ২৭শে এপ্রিল (১৪ই বৈশাখ ১৩৬৭) সকাল পর্যন্ত বেশ সুস্থ ছিলেন। দুপুরে বেঙ্গল কেমিক্যালের মিটিং-এ যাবার আগে বিশ্রাম করছিলেন। তারপর সকলের অজ্ঞাতে দ্বিতীয় স্ট্রোক, বিশ্রামরত অবস্থাতেই চিরনিদ্রায় মগ্ন হন। বেলা ১টা হইতে সোয়া একটার মধ্যে তাঁহার মৃত্যু ঘটে বলিয়া অনুমান করা যায়।’ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮ এপ্রিল ১৯৬০)।

যষ্টিমধু ১৩ই বৈশাখ ১৩৬৭ সংখ্যায় অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘রাজশেখরবাবু যেতেই চেয়েছিলেন, যে ভাবে গেলেন তার চেয়ে ভালোভাবে কে কবে গেছেন। এ মৃত্যু সাধুসজ্জনের মৃত্যু। কর্মনিষ্ঠ পুরুষের মৃত্যু। এর জন্যে সাধনা করতে হয়। প্রস্তুত হতে হয়। রাজশেখরবাবু একে বহু তপস্যায় অর্জন করেছেন। জীবনের শেষে এটি একটি পূর্ণচ্ছেদ। তাঁর সেই সুন্দর হস্তাক্ষরে ‘ইতি’ লিখে দাঁড়ি টেনে সম্পূর্ণ অনাসক্তভাবে তিনি তাঁর জীবনলিপি সমাপ্ত করলেন।’

.

এই সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত শ্রীযুক্ত অলোক রায় ও শ্রীযুক্ত দীপেন সাহার সৌজন্যে বাগর্থ প্রকাশিত রাজশেখর বসু জীবনীগ্রন্থ থেকে সংকলিত—প্রকাশক।


© 2024 পুরনো বই